বিপ্রদাস – ২০

কুড়ি

দ্বিজদাস জিজ্ঞাসা করিল, বন্দনা হঠাৎ চলে গেলেন কেন? আমার এসে পড়াটাই কি কারণ নাকি?

বিপ্রদাস বলিল, না। ওঁর বাবা টেলিগ্রাম করেছেন মাসীর বাড়িতে গিয়ে থাকতে যতদিন না বোম্বায়ে ফিরে যাওয়া ঘটে।

কিন্তু হঠাৎ মাসী বেরুলো কোথা থেকে? বন্দনা আমার সঙ্গে ত প্রায় কথাই কইলেন না, সর্বক্ষণ আড়ালে আড়ালে রইলেন, তার পর সকাল না হতে হতেই দেখচি সরে পড়লেন। একটা নমস্কার করে গেলেন সত্যি কিন্তু সেও মুখ ফিরিয়ে। আমার বিরুদ্ধে হলো কি তাঁর?

প্রশ্নের জবাবটা বিপ্রদাস এড়াইয়া গেল এবং মাসীর ব্যাপারটা সংক্ষেপে জানাইয়া কহিল, আমার অসুখে ভয় পেয়ে এই মাসীর বাড়ি থেকেই অনুদি ওকে ডেকে এনেছিলেন আমার শুশ্রূষা করতে। যথেষ্ট করেচে। ওর কাছে তোদের কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত।

দ্বিজদাস কহিল, উচিত নয় বলিনে, কিন্তু আপনাকে সেবা করতে পাওয়াটাও ত একটা ভাগ্য। সে মূল্যটা যদি উনিও অনুভব করতে পেরে থাকেন ত কৃতজ্ঞতা ওঁর কাছেও আমাদের পাওনা আছে।

বিপ্রদাস সহাস্যে কহিল, তুই ভারী নরাধম।

দ্বিজদাস বলিল, নরাধম কিন্তু নির্বোধ নই। আমার কথা যাক। কিন্তু এই সেবা করার কথাটা মায়ের কানে গেলে উনি চিরকাল আমদের মাকেই কিনে রাখবেন। সেই কি সোজা সম্পদ?

শুনিয়া বিপ্রদাস হাসিল, কহিল, মাকে এতকাল পরে তুই চিনতে পেরেছিস বল?

দ্বিজদাস বলিল, যদি পেরেও থাকি সে শুধু আপনিই জানুন। আমি মায়ের কুপুত্র, আমি কুলাঙ্গার, তাঁর কাছে এই পরিচয়ই থাক। একে আর নড়িয়ে কাজ নেই দাদা।

কিন্তু কেন? মা তোকে বিশ্বাস করতে পারেন, তোকে ভাল বলে ভাবতে পারেন, এ কি তুই সত্যিই চাসনে? এ অভিমানে লাভ কি’বল তো?

লাভ কি জানিনে, কিন্তু লোভ বিশেষ নেই। আমি আপনার পেয়েছি স্নেহ, পেয়েছি বৌদিদির ভালবাসা, এই আমার সাত রাজার ধন, সাতজন্ম দু’হাতে বিলিয়েও শেষ করতে পারবো না, কিন্তু বলিয়া ফেলিয়াই তাহার চোখ-মুখ লজ্জায় রাঙ্গা হইয়া উঠিল। হৃদয়ের এই-সকল আবেগ-উচ্ছ্বাস ব্যক্ত করিতে সে চিরদিন পরাঙ্মুখ,—চিরদিন নিস্পৃহতার আবরণে ঢাকা দিয়া বেড়ানোই তাহার প্রকৃতি,—মুহূর্তে নিজেকে সামলাইয়া ফেলিয়া বলিল, কিন্তু এ-সব আলোচনা নিষ্প্রয়োজন। যেটা প্রয়োজন সে হচ্চে এই যে, আমার চোখে বন্দনার চলে যাওয়ার ভাবটা দেখালো যেন রাগের মতো। এর মানেটা বলে দিন।

আপনার প্রিয়জনের জন্য সেরা উপহার

মানেটা বোধ হয় এই যে, তুই যখন এসে পড়েছিস তখন ওর আর দরকার নেই। এখন থেকে সেবা-শুশ্রূষার ভার তোর উপর। এই বলিয়া বিপ্রদাস হাসিতে লাগিল।

দ্বিজদাস বলিল, আপনি ঠাট্টা করচেন বটে, কিন্তু আমি বলচি, এই-সব ইংরেজিনবিশ মেয়েগুলো এই দম্ভতেই একদিন মরবে। আপনাকে রোগে সেবা করবার দিন যেন-না কখনও আসে, কিন্তু এলে প্রমাণ হতে দেরি হবে না যে দাদার সেবায় দ্বিজুকে হারানো দশটা বন্দনার সাধ্যে কুলোবে না, এ কথা তাকে জানিয়ে দেবেন।

স্নেহহাস্যে বিপ্রদাসের মুখ প্রদীপ্ত হইয়া উঠিল, কহিল, আচ্ছা জানাবো, কিন্তু বিশ্বাস করবে কিনা জানিনে। তবে, সে পরীক্ষার প্রয়োজন দাদার কাছে নেই,—আছে শুধু একজনের কাছে,—সে মা। বোঝাপড়া তোদের একটা হওয়া দরকার—বুঝলি রে দ্বিজু?

দ্বিজদাস বলিল, না দাদা, বুঝলাম না। কিন্তু মা যখন, তখন বেঁচে থাকলে বোঝাপড়া একদিন হবেই, কিন্তু এখুনি প্রয়োজনটা কিসের এলো এইটেই ভেবে পাচ্ছিনে। এই বলিয়া ক্ষণকাল নীরব থাকিয়া কহিল, আমার কপালে সবই হল উলটো। বাবা জন্ম দিলেন, কিন্তু দিয়ে গেলেন না কানাকড়ি সম্পত্তি—সে দিলেন আপনি। মা গর্ভে ধারণ করলেন কিন্তু পালন করলেন অন্নদাদিদি, আর সমস্ত ভার বয়ে মানুষ করে তুললেন বৌদিদি,—দুজনেই পরের ঘর থেকে এসে। পিতা স্বর্গঃ, পিতা ধর্মঃ, এবং মাতা স্বর্গাদপি গরীয়সী—এই শ্লোক আউড়ে মনকে আর কত চাঙ্গা রাখবো দাদা, আপনিই বলুন?

বিপ্রদাস কহিল, মায়ের মামলা নিয়ে আর ওকালতি করবো না, সে তুই আপনিই একদিন বুঝবি, কিন্তু বাবার সম্বন্ধে যে ধারণা তোর আছে সে ভুল। অর্ধেক বিষয়ের সত্যিই তুই মালিক।

দ্বিজদাস বলিল, হতে পারে সত্যি, কিন্তু বাবার মৃত্যুর পরে ঘরে দোর দিয়ে তাঁর উইলখানা কি আপনি পুড়িয়ে ফেলেন নি?

কে বললে তোকে?

এতকাল যিনি আমাকে সকল দিক দিয়ে রক্ষে করে এসেছেন এ তাঁর মুখেই শোনা।

তা হতে পারে, কিন্তু তোর বৌদিদি ত সে উইল পড়ে দেখেন নি। এমন ত হতে পারে, বাবা তোকেই সমস্ত দিয়ে গিয়েছিলেন বলে রাগ করে আমি তা পুড়িয়েছি। অসম্ভব ত নয়।

শুনিয়া কৌতুকের হাসিতে দ্বিজদাস প্রথমটা খুব হাসিয়া লইয়া কহিল, দাদা, আপনি যে কখনো মিথ্যে বলেন না? দ্বাপরে যুধিষ্ঠিরের মিথ্যেটা নোট করে গিয়েছিলেন বেদব্যাস, আর কলিতে আপনারটা নোট করে রাখবে দ্বিজদাস। দুই-ই হবে সমান। যা হোক, এটা বোঝা গেল, বিপাকে পড়লে সবই সম্ভব হয়। আর পাপ বাড়াবেন না, বলুন এখন থেকে কি আমাকে করতে হবে।

আমাদের কারবার বিষয়-আশয় সমস্ত দেখতে হবে।

কিন্তু কেন? কিসের জন্যে এত ভার আমি বইতে যাবো আমাকে বুঝিয়ে দিন। আপনি একা পারচেন না নাকি? অসম্ভব। আমি নিষ্কর্মা অপদার্থ হয়ে যাচ্চি? না যাচ্চিনে। তবু মা জিজ্ঞাসা করলে তাঁকে জানিয়ে দেবেন পদার্থের আমার দরকার নেই, অপদার্থ হয়েই আমি দিন কাটিয়ে দেবো, তাঁকে ভাবতে হবে না। আপনি থাকতে টাকাকড়ি বিষয়-সম্পত্তির বোঝা আমি বইব না। শেষে কি আপনার মতো ঘোরতর বিষয়ী হয়ে উঠবো নাকি? লোকে বলবে, ওর শিরের মধ্যে দিয়ে রক্ত বয় না, বয় শুধু টাকার স্রোত। কিন্তু বলিতে বলিতেই লক্ষ্য করিল বিপ্রদাস অন্যমনস্ক হইয়া কি যেন ভাবিতেছে, তাহার কথায় কান নাই। এমন সচরাচর হয় না,—এ স্বভাব বিপ্রদাসের নয়, একটু বিস্মিত হইয়া বলিল, দাদা, সত্যিই কি চান আমি বিষয়কর্ম দেখি, যা আমার চিরদিনের স্বপ্ন সেই স্বদেশসেবায় জলাঞ্জলি দিই?

বিপ্রদাস তাহার মুখের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া কহিল, জলাঞ্জলি দিবি এমন কথা ত তোকে কোনদিনই বলিনে দ্বিজু। যা তোর স্বপ্ন সে তোর থাক,—চিরদিন থাক—তবু বলি সংসারের ভার তুই নে।

কিন্তু কেন বলুন? কারণ না জানলে আমি কিছুতেই এ কথা মানবো না।

বিপ্রদাস একমুহূর্ত মৌন থাকিয়া বলিল, এর কারণ ত খুবই স্পষ্ট দ্বিজু। আজ আমি আছি, কিন্তু এমন ত ঘটতে পারে আর আমি নেই।

দ্বিজদাস জোর দিয়া বলিয়া উঠিল, না, ঘটতে পারে না। আপনি নেই,—কোথাও নেই এ আমি ভাবতে পারিনে।

তাহার বিশ্বাসের প্রবলতা বিপ্রদাসকে আঘাত করিল, কিন্তু হাসিয়া বলিল, সংসারে সবই ঘটে রে, এমন কি অসম্ভবও। এই কথাটা ভাবতে যারা ভয় পায় তারা নিজেদের ঠকায়। আবার এমনও হতে পারে আমি ক্লান্ত, আমার ছুটির দরকার,—তবু দিবিনে তুই?

না দাদা, পারবো না দিতে। তার চেয়ে ঢের সহজ আপনার আদেশ পালন করা। বলুন, কবে থেকে আমাকে কি করতে হবে।

আজ থেকে এ সংসারের সব ভার নিতে হবে।

আজ থেকেই? এতই তাড়াতাড়ি? বেশ তাই হবে। আপনার অবাধ্য হবো না। এই বলিয়া সে চলিয়া গেল, কিন্তু শুনিতে পাইল দাদার কথা—তোকে বলতে হবে না রে, আমি জানি আমার অবাধ্য তুই নয়।

দ্বিজদাসের কাজ শুরু হইয়া গেল। সে অলস, অকর্মণ্য, উদাসীন এই ছিল সকলের চিরদিনের অভিযোগ। কিন্তু দাদার আদেশে মায়ের ব্রত-প্রতিষ্ঠার সুবৃহৎ অনুষ্ঠান সম্পূর্ণ করিয়া তুলিবার সর্বপ্রকার দায়িত্ব আসিয়া পড়িল যখন একাকী তাহার পরে, তখন এ দুর্নাম অপ্রমাণ করিতে তাহার অধিক সময় লাগিল না। এই অনভ্যস্ত গুরুভার সে যে এত স্বচ্ছন্দে বহন করিবে এতখানি আশা বিপ্রদাস করে নাই, কিন্তু তাহার নিরলস, সুশৃঙ্খল কর্মপটুতায় সে যেন একেবারে বিস্মিত হইয়া গেল। যাহা কিনিয়া পাঠাইবার তাহা গাড়ি বোঝাই করিয়া দ্বিজদাস বাড়ি পাঠাইল, যাহা লইবার তাহা সঙ্গে রাখিল, আত্মীয়-কুটুম্বগণকে একত্র করিয়া যথাযোগ্য সমাদরে রওনা করিয়া দিল, এখানকার সকল কার্য সমাধা করিয়া আজ গৃহে ফিরিবার দিন সে দাদার শেষ উপদেশ গ্রহণ করিতে তাঁহার ঘরে ঢুকিয়া দেখিল সেখানে বসিয়া বন্দনা। সেই যাবার দিন হইতে আর সে আসে নাই, তাহার কথা কাজের ভিড়ে দ্বিজদাস ভুলিয়াছিল—আজ হঠাৎ তাহাকে দেখিতে পাইয়া মনে মনে সে আশ্চর্য হইল, কিন্তু সে-ভাব প্রকাশ না করিয়া শুধু একটা মামুলি নমস্কারে শিষ্টাচার সারিয়া লইয়া বলিল, দাদা, আজ রাত্রির গাড়িতে আমি বাড়ি যাচ্চি, সঙ্গে যাচ্চেন অক্ষয়বাবু, তাঁর স্ত্রী ও কন্যা মৈত্রেয়ী। আপনার কলেজের ছাত্ররা বোধ করি কাল-পরশু যাবে,—তাদের ভাড়া দিয়ে গেলুম। অনুদিকে কি আপনিই সঙ্গে নিয়ে যাবেন? কিন্তু দিন তিন-চারের বেশী বিলম্ব করবেন না যেন।

আমাকে কি যেতেই হবে?

হাঁ। না যান ত একজোড়া খড়ম কিনে দিন, নিয়ে গিয়ে ভরতের মতো সিংহাসনে বসাবো।
বিপ্রদাস হাসিয়া কহিল, ফাজিলের অগ্রগণ্য হয়েচিস তুই। কিন্তু আশ্চর্য করলি অক্ষয়বাবুর কথায়। তিনি যাবেন কি করে? তাঁর ত ছুটি নেই—কাজ কামাই হবে যে?

দ্বিজদাস বলিল, তা হবে; কিন্তু লোকসান নেই—ওদিকে তার চেয়েও ঢের বড় কাজ হবে বড়ঘরে মেয়ে দিতে পারাটা। টাকাওয়ালা জামাই ভবিষ্যতের অনেক ভরসা,—কলেজের বাঁধা মাইনের অনেক বেশি।

বিপ্রদাস রাগিয়া বলিল, তোর কথাগুলো যেমন রূঢ় তেমনি কর্কশ। মানুষের সম্মান রেখে কথা কইতে জানিস নে?

দ্বিজদাস বলিল, জানি কিনা বৌদিদিকে জিজ্ঞেসা করে দেখবেন। সৌজন্যের বাজে অপব্যয় করিনে শুধু এই আমার দোষ।

শুনিয়া বিপ্রদাস না হাসিয়া পারিল না, বলিল, তোর একটি সাক্ষী শুধু বৌদিদি। যেমন মাতালের সাক্ষী শুঁড়ি।

দ্বিজদাস কহিল, তা হোক, কিন্তু আপনার কথাটাও ঠিক মধুমাখা হচ্চে না দাদা। কারণ আমিও মাতাল নেই, তিনিও মদের যোগান দেন না। দেন অমৃত, দেন গোপনে বহুলোকের অন্ন যা অনেক বড়লোকে পারে না।

বিপ্রদাস কহিল, তাদের পেরেও কাজ নেই। আদর দিয়ে দেওরকে জন্তু করে তোলা ছাড়া বড়লোকদের অন্য কাজ আছে।

বন্দনা মুখ নীচু করিয়া হাসিতে লাগিল, দ্বিজদাস সেটা লক্ষ্য করিয়া বলিল, এ নিয়ে আর তর্ক করবো না দাদা। বৌদিদি আপনার নেই,—বাঙালীর সংসারে তাঁর স্নেহ যে কি সে আপনি কোনদিন জানেন না। অন্ধকে আলো বোঝানোর চেষ্টায় ফল নেই। একটু হাসিয়া বলিল, বন্দনা আড়ালে হাসচেন, কিন্তু মাসীর বাড়ির বদলে দিন-কতক আমাদের বাড়িতে কাটিয়ে এলে হয়ত আমার কথাটা বুঝতেন। কিন্তু থাক গে এ-সব আলোচনা।
আপনি কবে বাড়ি যাচ্ছেন বলুন?

আমি বড় ক্লান্ত দ্বিজু, মাকে বুঝিয়ে বলতে পারবি নে?

বিপ্রদাসের এমন নির্জীব নিস্পৃহ কণ্ঠস্বর সে কখনো শোনে নাই, চমকিয়া চাহিয়া দেখিল, ক্ষীণ হাসিটুকু তখনো ওষ্ঠপ্রান্তে লাগিয়া আছে—কিন্তু এ যেন তাহার দাদা নয়, আর কেহ—বিস্ময় ও ব্যথায় অভিভূত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, অসুখ কি এখনো সারেনি দাদা?

না, সেরে গেছে।

তবু মায়ের কাজে বাড়ি যেতে পারলেন না এ কথা মাকে বোঝাবো কি করে? ভয় পেয়ে তিনি চলে আসবেন, তাঁর সমস্ত আয়োজন লণ্ডভণ্ড হয়ে যাবে।

বিপ্রদাস ক্ষণকাল চিন্তা করিয়া বলিল, তুই আমাকে কবে যেতে বলিস?

দ্বিজদাস বলিল, আজ, কাল, পরশু—যবে হোক। আমাকে অনুমতি দিন আমি নিজে এসে আপনাকে নিয়ে যাবো।

বিপ্রদাস হাসিমুখে কিছুক্ষণ নীরবে থাকিয়া কহিল, বেশ তাই হবে। আমি নিজেই যেতে পারবো, তোকে ফিরে আসতে হবে না।

দ্বিজদাস চলিয়া গেলে বন্দনা জিজ্ঞাসা করিল, এটা কি হলো মুখুয্যেমশাই, বাড়ি যেতে আপত্তি করলেন কিসের জন্যে?

বিপ্রদাস কহিল, কারণটা ত নিজের কানেই শুনলে?

শুনলুম, কিন্তু ও জবাব পরের জন্যে, আমার জন্যে নয়। বলুন কিসের জন্যে বাড়ি যেতে চান না। আপনাকে বলতেই হবে।
আমি ক্লান্ত।

না।

না কেন? ক্লান্তিতে সকলেরই দাবী আছে, নেই কি শুধু আমার?

আপনারও আছে, কিন্তু সে দাবী সত্যিকার হলে সকলের আগে বুঝতে পারতুম আমি। আর সকলের চোখকেই ঠকাতে পারবেন, পারবেন না ঠকাতে শুধু আমার চোখকে। যাবার সময় মেজদিকে চিঠি লিখে যাবো, আপনার রোগ ধরবার কখনো দরকার হলে যেন তিনি আমাকে ডেকে পাঠান।

মেজদি নিজে পারবেন না রোগ ধরতে, তুমি দেবে ধরে!—এ কথা শুনলে কিন্তু তিনি খুশী হবেন না।

বন্দনা বলিল, খুশী হবেন না সত্যি, কিন্তু কৃতজ্ঞ হবেন। আমার মেজদি হলেন সে-যুগের মানুষ, স্বামী তাঁকে খুঁজে বেছে নিতে হয়নি, ভগবান দিয়েছিলেন আশীর্বাদের মতো অঞ্জলি পূর্ণ করে। তখন থেকে সুস্থ সবল মানুষটিকে নিয়েই তাঁর কারবার। কিন্তু সে মানুষেরও যে হঠাৎ একদিন মন ভাঙ্গতে পারে এ খবর তিনি জানবেন কি করে?

বিপ্রদাস কথা না কহিয়া শুধু একটুখানি হাসিল।

বন্দনা বলিল, আপনি হাসলেন যে বড়ো?

বিপ্রদাস বলিল, হাসি আপনি আসে বন্দনা। স্বামী খুঁজে-বেছে নেবার অভিযানে আজ পর্যন্ত যাদের তুমি দেখতে পেয়েছো, তাদের বাইরে যে কেউ আছে এ তোমরা ভাবতে পারো না। সংসারে সাধারণ নিয়মটাই শুধু মানো, স্বীকার করতে চাও না তার ব্যতিক্রমটাকে। অথচ এ ব্যতিক্রমটার জোরেই টিকে আছে ধর্ম, টিকে আছে পুণ্য, আছে কাব্য-সাহিত্য, আছে অবিচলিত শ্রদ্ধা-বিশ্বাস। এ না থাকলে পৃথিবীটা যেতো একেবারে মরুভূমি হয়ে। এই সত্যটাই আজও জানো না।

বন্দনা বিদ্রূপের সুরে বলিল, এই ব্যতিক্রমটা বুঝি আপনি নিজে মুখুয্যেমশাই? কিন্তু সেদিন যে বললেন আমাকেও আপনি ভালবাসেন?

সে আজও বলি। কিন্তু ভালবাসার একটিমাত্র পথই তোমাদের চোখে পড়ে আর সব থাকে বন্ধ, তাই সেদিনের কথাগুলো আমার তুমি বুঝতে পারনি। একবার দেখে এসো গে দ্বিজু আর তার বৌদিদিকে। দৃষ্টি অন্ধ না হোলে দেখতে পাবে কি করে শ্রদ্ধা গিয়ে মিশেচে ভালবাসার সঙ্গে। রহস্য-কৌতুকে, আদরে-আহ্লাদে, নিবিড় ঘনিষ্ঠতায় সে শুধু তার বৌদিদি নয়, সে তার বন্ধু, সে তার মা। সেই সম্বন্ধ ত তোমার-আমারও,—ঠিক তেমনি করেই কেন আমাকে তুমি নিতে পারলে না বন্দনা!

তাহার কণ্ঠস্বরের মধ্যে ছিল গভীর স্নেহের সঙ্গে মিশিয়া তিরস্কারের সুর, বন্দনাকে তাহা কঠিন আঘাত করিল। কিছুক্ষণ নীরবে অধোমুখে থাকিয়া সহসা চোখ তুলিয়া বলিল, আপনাকে আমি ভুল বুঝেছিলুম মুখুয্যেমশাই। আমার মেজদিদিকে যদি আপনি সত্যই ভালবাসতেন, দুঃখ আমার ছিল না; কিন্তু তা আপনি বাসেন না। আপনি পালন করেন শুধু ধর্ম, মেনে চলেন শুধু কর্তব্য। কঠিন আপনার প্রকৃতি, কাউকে ভালোবাসতে জানেন না। যত ঢেকেই রাখুন এ সত্য একদিন প্রকাশ পাবেই।

ক্ষণকাল স্থির থাকিয়া বলিয়া উঠল, আজ আমারও ভুল ভাঙলো। শূন্যের মধ্যে হাত বাড়িয়ে মানুষ খুঁজতে আর না যাই, আজ আমাকে এই আশীর্বাদ আপনি করুন।
বিপ্রদাস সহাস্যে হাত বাড়াইয়া বলিল, করলুম তোমাকে সেই আশীর্বাদ। আজ থেকে মানুষ খোঁজা যেন তোমার শেষ হয়, যে তোমার চিরদিনের তাকে যেন তিনিই তোমাকে দান করেন।

কথাটাকে অপমানকর পরিহাস মনে করিয়া বন্দনা রাগিয়া বলিল, আপনি ভুল করচেন মুখুয্যেমশাই, মানুষ খুঁজে বেড়ানোই আমার পেশা নয়। তারা আলাদা। কিন্তু হঠাৎ আজ কেন এসেচি এখনো সেই কথাটা আপনাকে বলা হয়নি। এদিক দিয়ে সত্যিই আমার একটা মস্ত ভুল ভেঙ্গে গেছে। এখানে আপনাদের সংস্রবে এসে ভেবেছিলুম এই-সব আচার-বিচার বুঝি সত্যিই ভালো, খাওয়া-ছোঁয়ার নিয়ম মেনে চলা, ফুল তোলা, চন্দন ঘষা, পূজোর সাজ-গোছ করা—আরও কত কি খুঁটিনাটি,—মনে করতুম এ-সব বুঝি সত্যিই মানুষকে পবিত্র করে তোলে, কিন্তু এবার মাসীমার বাড়িতে গিয়ে এ মূঢ়তা ঘুচেছে। দিন-কয়েক কি পাগলামিই না করেছিলুম মুখুয্যেমশাই, যেন সত্যিই এ-সব বিশ্বাস করি, যেন আমাদের শিক্ষায় সংস্কারে সত্যিই কোথাও এর থেকে প্রভেদ নেই। এই বলিয়া সে জোর করিয়া হাসিতে লাগিল।

ভাবিয়াছিল কথাটা হয়ত বিপ্রদাসকে ভারী আঘাত করবে, কিন্তু দেখিতে পাইল একেবারেই না। তাহার ছদ্মহাসিতে সে প্রসন্নহাসি যোগ করিয়া বলিল, আমি জানতুম বন্দনা। তোমার কি মনে নেই আমি সতর্ক করে একদিন তোমাকে বলেছিলুম এ-সব তোমার জন্যে নয়, এ-সব করতে তুমি যেয়ো না। সেই মূঢ়তা ঘুচেছে জেনে আমি খুশীই হলুম। মনে করেছিলে শুনে বুঝি বড় কষ্ট পাবো, কিন্তু তা নয়। যার যা স্বাভাবিক নয় তা না করলে আমি দুঃখ বোধ করিনে। তোমার ত মনে আছে আমি কিসের ধ্যান করি তুমি জানতে চাইলে আমি চুপ করে ছিলুম। বলতে বাধা ছিল বলে নয়, অকারণ বলে। কিন্তু এ-সব কথাবার্তা এখন থাক। তোমার বোম্বায়ে ফিরে যাবার কি কোন দিন স্থির হলো?

অভিমানে বন্দনার মুখ আরক্ত হইয়া উঠিল, বিপ্রদাসের প্রশ্নের উত্তরে শুধু বলিল, না।

সেদিন তোমার মাসীর ভাইপো অশোকের কথা বলেছিলে। বলেছিলে ছেলেটিকে তোমার ভালই লেগেছে। এ কয়দিনে তার সম্বন্ধে আর কিছু কি জানতে পারলে?

না।

তোমাদের বিয়েই যদি হয় আমি আশীর্বাদ করবো, কিন্তু মাসীর তাড়ায় যেন কিছু করে বসো না। তাঁর তাগাদাকে একটু সামলে চলো।

বন্দনার চোখে জল আসিয়া পড়িল, কিন্তু মুখ নিচু করিয়া সামলাইয়া বলিল, আচ্ছা।

বিপ্রদাস বলিল, আমি পরশু বাড়ি যাব। দু-তিন দিনের বেশি থাকতে পারবো না। ফিরে আসার পরেও যদি কলিকাতায় থাকো একবার এসো।

বন্দনা মুখ নীচু করিয়াই ছিল, মাথা নাড়িয়া কি একটা জবাব দিল তাহার স্পষ্ট অর্থ বুঝা গেল না।

বিপ্রদাস কহিল, শুনলে ত আমার ছুটি মঞ্জুর হলো, এখন থেকে সব ভার দ্বিজুর। সংসারের ঘানিতে বাবা আমাকে ছেলেবেলাতেই জুড়ে দিয়েছিলেন, কখনো অবকাশ পাইনি কোথাও যাবার। আজ মনে হচ্চে যেন নিশ্বাস ফেলে বাঁচবো।
এবার বন্দনা মুখ তুলিয়া জিজ্ঞাসা করিল, সত্যিই কি নিশ্বাস ফেলার এতই দরকার হয়েছে মুখুয্যেমশাই? সত্যিই কি আজ আপনি এত শ্রান্ত?

বিপ্রদাস এ প্রশ্নের উত্তরটা এড়াইয়া গেল, বলিল, ভালো কথা বন্দনা, আমার অসুখে তোমার সেবার উল্লেখ করে বলছিলুম, তোমার কাছে তাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। এর অর্ধেক তারা কেউ পারতো না। দ্বিজু কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেও তোমাকে বলতে বলেচে, যদি সে সময় কখনো আসে, দাদার সেবায় তার সমকক্ষ হওয়া দশটা বন্দনারও সাধ্যে কুলোবে না।

বন্দনা বলিল, তাঁকেও বলবেন শর্ত আমি স্বীকার করে নিলুম। কিন্তু পরীক্ষার দিন যদি কখনো আসে তখন যেন তাঁর দেখা মেলে।

শুনিয়া বিপ্রদাস হাসিমুখে বলিল, দেখা মিলবে বন্দনা, সে পিছোবার লোক নয়। তাকে তুমি জানো না।

জানি মুখুয্যেমশাই। ভালো করেই জানি, আপনার কাজে তাঁর প্রতিযোগিতা করা সত্যিই বন্দনার শক্তিতে কুলোবে না।

ভ্রাতৃগর্বে বিপ্রদাসের মুখ প্রদীপ্ত হইয়া উঠিল, কহিল, জানো বন্দনা, দ্বিজু আমার সাধু লোক।

আপনার চেয়েও নাকি?

হাঁ, আমার চেয়েও। এই বলিয়া বিপ্রদাস একমুহূর্ত ইতস্ততঃ করিয়া কহিল, কিন্তু সে বলছিল তুমি নাকি তার উপর রাগ করে আছো। কথা কওনি কেন?

কথা কইবার দরকার হয়নি মুখু্য্যেমশাই।

বিপ্রদাস হাসিয়া বলিল, তবেই ত দেখচি তুমি সত্যই রাগ করে আছো। কিন্তু একটা কথা আজ তোমাকে বলি বন্দনা, দ্বিজুর ব্যবহারটা রুক্ষ, কথাগুলোও সর্বদা বড় মোলায়েম হয় না, কিন্তু তার এই কর্কশ আবরণটা ঘুচিয়ে যদি কখনো তার দেখা পাও, দেখবে এমন মধুর লোক আর নেই। কথাটা আমার বিশ্বাস করো, এমন নির্ভর করবার মানুষও তুমি সহজে খুঁজে পাবে না।

বন্দনা আর একদিকে চাহিয়া রহিল, উত্তর দিল না। হঠাৎ এক সময়ে উঠিয়া পড়িয়া বলিল, গাড়ি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে মুখুয্যেমশাই, আমি যাই। যদি থাকতে পারি আপনি ফিরে এলে দেখা করবো। যদি না পারি এই আমার শেষ নমস্কার রইলো। এই বলিয়া হেঁট হইয়া পায়ের ধূলা মাথায় লইয়া সে দ্রুত প্রস্থান করিল। একটা কথা বলারও সে বিপ্রদাসকে অবকাশ দিল না।

বারান্দা পার হইয়া সিঁড়ির মুখে আসিয়া সবিস্ময়ে দেখিতে পাইল, দ্বিজদাস দাঁড়াইয়া হাত জোড় করিয়া।

বন্দনা হাসিয়া ফেলিয়া বলিল, এ আবার কি?

একটা মিনতি আছে। দাদাকে সঙ্গে নিয়ে আপনাকে আমাদের দেশের বাড়িতে একবার যেতে হবে।

আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে? এর হেতু?

দ্বিজদাস কহিল, বলবো বলেই দাঁড়িয়ে আছি। একদিন বিনা আহ্বানেই আমাদের বাড়িতে পায়ের ধূলো দিয়েছিলেন, আজ আবার সেই দয়া আপনাকে করতে হবে।

বন্দনা একমুহূর্ত ইতস্ততঃ করিল, তারপরে বলিল, কিন্তু আমাকে যাবার নিমন্ত্রণ করচে কে? মা, দাদা, না আপনি নিজে?

আমি নিজেই করচি।

কিন্তু আপনি ত ও-বাড়িতে তৃতীয় পক্ষ, ডাকবার আপনার অধিকার কি?

দ্বিজদাস বলিল, আর কোন অধিকার না থাক আমার বাঁচবার অধিকার আছে। সেই অধিকারে এই আবেদন উপস্থিত করলুম। বলুন মঞ্জুর করলেন? একান্ত প্রয়োজন না হলে কোন প্রার্থনাই আমি কারো কাছে করিনে।

বন্দনা বহুক্ষণ পর্যন্ত অন্যদিকে চাহিয়া রহিল, তার পরে বলিল, আচ্ছা, তাই যাবো, কিন্তু আমার মান-অপমানের ভার রইলো আপনার উপর।

দ্বিজদাস সকৃতজ্ঞ-কণ্ঠে কহিল, আমার সাধ্য সামান্য, তবু নিলুম সেই ভার।

বন্দনা বলিল, বিপদের সময়ে এ কথা ভুলবেন না যেন।

না, ভুলবো না।


© 2024 পুরনো বই