শ্রীকান্ত – ৩য় পর্ব – ১৩

তের

সন্ধ্যা শেষ হইল বলিয়া, কিন্তু রাত্রির অন্ধকার গাঢ়তর হইয়া উঠিতে তখনও বিলম্ব ছিল। এই সময়টুকুর মধ্যে যেমন করিয়া হউক আশ্রয় খুঁজিয়া বাহির করিতে হইবে। এ কাজ আমার পক্ষে নূতনও নহে, কঠিন বলিয়াও কোনদিন ভয় হয় নাই। কিন্তু আজ সেই আমবাগানের পাশ দিয়া পায়ে-চলা পথের রেখা ধরিয়া যখন ধীরে ধীরে অগ্রসর হইতে লাগিলাম, তখন কেমন যেন উদ্বিগ্ন লজ্জায় মনের ভিতরটা ভরিয়া আসিতে লাগিল। ভারতের অন্যান্য প্রদেশের সঙ্গে একদিন ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল, কিন্তু এখন যে পথে চলিয়াছি সে যে বাঙ্গলার রাঢ় দেশ। ইহার সম্বন্ধে ত কোন অভিজ্ঞতা নাই! কিন্তু একথা স্মরণ হইল না যে, সে-সকল দেশের সম্বন্ধেও একদিন এমনি অনভিজ্ঞই ছিলাম, জ্ঞান যাহা কিছু পাইয়াছি তাহা এমনি করিয়াই আপনাকে সঞ্চয় করিতে হইয়াছিল, অপরে করিয়া দেয় নাই।

আসল কথা, কিসের জন্য যে সেদিন দ্বার আমার সর্বত্রই মুক্ত ছিল এবং আজ সঙ্কোচ ও দ্বিধায় তাহা অবরুদ্ধপ্রায়, সেই কথাটাই ভাবিয়া দেখিলাম না। সেদিনের সে-যাওয়ার মধ্যে কৃত্রিমতা ছিল না, কিন্তু আজ যাহা করিতেছি সে শুধু সেদিনের নকল মাত্র। সেদিন বাহিরের অপরিচিতই ছিল আমার পরমাত্মীয়, তাদের পরে নিজের ভারার্পণ করিতে তখন বাধে নাই, কিন্তু সেই ভার আজ ব্যক্তিবিশেষের প্রতি একান্তভাবে ন্যস্ত হইয়া সমস্ত ভারকেন্দ্রটাই অন্যত্র অপসারিত হইয়া গেছে। তাই আজ অজানা-অচেনার মধ্যে চলিবার পা-দুটো আমার প্রতিপদেই ভারি হইয়া আসিতেছে। সেদিনের সেই-সব সুখ-দুঃখের ধারণায় আজ কতই না প্রভেদ! তথাপি চলিতে লাগিলাম। এই বনের মধ্যে রাত্রযাপনের সাহসও নাই, শক্তিও গেছে—আজিকার মত কিছু একটা পাইতেই যে হইবে।

ভাগ্য ভাল, খুব বেশি দূর হাঁটিতে হইল না। পত্রঘন কি একটা গাছের ফাঁক দিয়া অট্টালিকার মত দেখা গেল। সেই পথটুকু ঘুরিয়া তাহার সম্মুখে গিয়া উপস্থিত হইলাম।

অট্টালিকাই বটে, কিন্তু মনে হইল জনহীন। সুমুখে লোহার গেট, কিন্তু ভাঙ্গা। শিকগুলার অধিকাংশই লোকে খুলিয়া লইয়া গিয়াছে। ভিতরে ঢুকিয়া পড়িলাম। খোলা বারান্দা, বড় বড় দুটো ঘর, একটা বন্ধ এবং যেটা খোলা তাহার দ্বারে আসিবামাত্র একজন কঙ্কালসার মানুষ বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইল। দেখিলাম, ঘরের চার কোণে চারিটা লোহার খাট—একদিন গদি পাতা ছিল, কিন্তু কালক্রমে চটগুলা লুপ্ত হইয়াছে, আছে শুধু ছোবড়ার কিছু কিছু তখনও অবশিষ্ট, একটা তেপাই, গোটা-কয়েক টিন ও এনামেলের পাত্র, তাহাদের শ্রী ও বর্তমান অবস্থা বর্ণনাতীত।অনুমান যাহা করিয়াছিলাম, তাহাই বটে। বাড়িটি হাসপাতাল। এই লোকটি বিদেশী, চাকরি করিতে আসিয়া পীড়িত হইয়া দিনপনর হইল ইন্‌ডোর পেশেন্ট হইয়া আছে। লোকটির সহিত প্রথম আলাপ এইরূপ ঘটিল—

বাবুমশায়, গোটা-চারেক পয়সা দেবেন?

কেন বল ত?

ক্ষিদেয় মরি বাবু, মুড়িটুড়ি দুটো কিনে খাব।

জিজ্ঞাসা করিলাম, তুমি রোগী-মানুষ, যা তা খাওয়া তোমার বারণ নয়?

আজ্ঞে, না।

এখানে তোমাকে খেতে দেয় না?

লোকটি জানাইল যে, সকালে একবাটি সাগু দিয়াছিল তাহা সে কোন্‌কালে খাইয়া ফেলিয়াছে। তখন হইতে সে গেটের কাছে বসিয়া থাকে, ভিক্ষা পায় ত আর একবেলা খাওয়া চলে, না হয় ত উপবাসে কাটে। ডাক্তার একজন আছেন, বোধ হয় যৎসামান্য হাতখরচা মাত্র বন্দোবস্ত আছে, সকালবেলায় একবার করিয়া তাঁহার দেখা পাওয়া যায়। আর একটি লোক নিযুক্ত আছে, তাহাকে কম্পাউণ্ডারি হইতে শুরু করিয়া লন্ঠনে তেল দেওয়া পর্যন্ত সমস্তই করিতে হয়। পূর্বে একজন চাকর ছিল বটে, কিন্তু মাস-ছয়েক হইল মাহিনা না পাওয়ায় রাগ করিয়া চলিয়া গেছে, এখনও নূতন কেহ ভর্তি হয় নাই।

জিজ্ঞাসা করিলাম, ঝাঁটপাট কে দেয়?

লোকটি বলিল, আজকাল আমিই দি। আমি চলে গেলে আবার যে নতুন রোগী আসবে সেই দেবে।

কহিলাম, বেশ ব্যবস্থা। হাসপাতালটি কার জান?

লোকটি আমাকে ওদিকের বারান্দায় লইয়া গেল। কড়ি হইতে একটি টিনের লন্ঠন ঝুলিতেছে। কম্পাউণ্ডারবাবু বেলাবেলি সেটি জ্বালিয়া দিয়া কাজ সারিয়া ঘরে চলিয়া গেছেন। দেয়ালের গায়ে আঁটা মস্ত একটি মর্মর প্রস্তর-ফলক—সোনার জল দিয়া ইংরাজী অক্ষরে আগাগোড়া খোদাই-করা সন-তারিখ সংবলিত শিলালিপি। জেলার যে সাহেব ম্যাজিস্ট্রেট দয়া করিয়া ইহার উদ্বোধনকার্য সম্পন্ন করিয়াছিলেন তাঁহার নাম-ধাম সর্বাগ্রে, নীচে প্রশস্তি-পাঠ। কে একজন রায়বাহাদুর তাঁহার রত্নগর্ভা মাতার স্মৃতিরক্ষার্থে জননী-জন্মভূমিতে এই হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন। আর শুধু মাতা-পুত্রই নয়, ঊর্ধ্বতন তিন-চারি পুরুষের বিবরণ। বোধ করি ছোটখাটো কুলকারিকা বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। লোকটি যে রাজসরকারে রায়বাহাদুরির যোগ্য তাহাতে লেশমাত্র সন্দেহ নাই। কারণ টাকা নষ্ট করার দিক দিয়া ত্রুটি ছিল না। ইট ও কাঠ এবং বিলাতের আমদানি লোহার কড়ি-বরগার বিল মিটাইয়া অবশিষ্ট যদি বা কিছু থাকিয়া থাকে সাহেব শিল্পীর হাতে বংশগৌরব লিখাইতেই তাহা নিঃশেষিত হইয়াছে। ডাক্তার ও রোগীর ঔষধ-পথ্যাদির ব্যাপারের ব্যবস্থা করিবার হয়ত টাকাও ছিল না, ফুরসতও ছিল না।

প্রশ্ন করিলাম, রায়বাহাদুরের বাড়ি কোথায়?

সে কহিল, বেশি দূরে নয়, কাছেই।

এখন গেলে দেখা হবে?

আজ্ঞে না, বাড়িতে তালাবন্ধ, তাঁরা সব কলকাতায় থাকেন।

জিজ্ঞাসা করিলাম, কবে আসেন জান?

লোকটি বিদেশী, সঠিক সংবাদ দিতে পারিল না, তবে কহিল যে, বছর-তিনেক পূর্বে একবার আসিয়াছিলেন একথা সে ডাক্তারবাবুর মুখে শুনিয়াছে। সর্বত্র একই দশা, অতএব দুঃখ করিবার বিশেষ কিছু ছিল না।
৭৫০

এদিকে অপরিচিত স্থানে সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইতেছিল, সুতরাং রায়বাহাদুরের কার্যকলাপ পর্যালোচনা করার চেয়ে জরুরি কাজ বাকি ছিল। লোকটিকে কিছু পয়সা দিয়া জানিয়া লইলাম যে, নিকটই একঘর চক্রবর্তী ব্রাহ্মণের বাটী। তাঁহারা অতিশয় দয়ালু, এবং রাত্রিটার মত আশ্রয় মিলিবেই। সে নিজেই রাজি হইয়া আমাকে সঙ্গে লইয়া চলিল, কহিল, তাহাকে ত মুদির দোকানে যাইতেই হইবে, একটুখানি ঘুরপথ, কিন্তু তাহাতে কিছু আসে যায় না।

চলিতে চলিতে তাহার কথাবার্তায় বুঝিলাম, এই দয়ালু ব্রাহ্মণ পরিবার হইতে সে পথ্যাপথ্য অনেক রাত্রিই গোপনে সংগ্রহ করিয়া খাইয়াছে।

মিনিট-দশেক হাঁটিয়া চক্রবর্তীর বহির্বাটীতে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। আমার পথপ্রদর্শক ডাক দিয়া কহিল, ঠাকুরমশাই ঘরে আছেন?

কোন সাড়া আসিল না। ভাবিয়াছিলাম কোন সম্পন্ন ব্রাহ্মণ-বাটীতে আতিথ্য লইতে চলিয়াছি, কিন্তু ঘরদ্বারের শ্রী দেখিয়া মনটা দমিয়া গেল। ওদিকে সাড়া নাই, এদিকে আমার সঙ্গীর অধ্যবসায়ও অপরাজেয়।তাহা না হইলে এই গ্রাম ও হাসপাতালে বহুদিন পূর্বেই তাহার রুগ্ন-আত্মা স্বর্গীয় হইয়া তবে ছাড়িত। সে ডাকের উপর ডাক দিতেই লাগিল।

হঠাৎ জবাব আসিল, যা যা, আজ যা। যা বলচি।

লোকটি কিছুমাত্র বিচলিত হইল না, প্রত্যুত্তরে কহিল, কে এসেচে বার হয়ে দেখুন না।

কিন্তু বিচলিত হইয়া উঠিলাম আমি। যেন, চক্রবর্তীর পরমপূজ্য গুরুদেব গৃহ পবিত্র করিতে অকস্মাৎ আবির্ভূত হইয়াছি।

নেপথ্যে কণ্ঠস্বর মুহূর্তে মোলায়েম হইয়া উঠিল—কে রে ভীম? বলিতে বলিতে গৃহস্বামী দ্বারপথে দেখা দিলেন। পরনের বস্ত্রখানি মলিন এবং অতিশয় ক্ষুদ্র, অন্ধকারে তাঁহার বয়স অনুমান করিতে পারিলাম না, কিন্তু খুব বেশি বলিয়াও মনে হইল না। পুনশ্চ জিজ্ঞাসা করিলেন, কে রে ভীম?

বুঝিলাম, আমার সঙ্গীর নাম ভীম। ভীম বলিল, ভদ্দরলোক, বামুন। পথ ভুলে হাসপাতালে গিয়ে হাজির। আমি বললাম, ভয় কি, চলুন না ঠাকুরমশায়ের বাড়িতে রেখে আসি, গুরু আদরে থাকবেন।

বস্তুতঃ ভীম অতিশয়োক্তি করে নাই, চক্রবর্তী আমাকে পরম সমাদরে গ্রহণ করিলেন। স্বহস্তে মাদুর পাতিয়া বসিতে দিলেন এবং তামাক ইচ্ছা করি কি না জানিয়া লইয়া ভিতরে গিয়া নিজেই তামাক সাজিয়া আনিলেন।

বলিলেন, চাকরগুলো সব জ্বরে পড়ে রয়েছে—করি কি!

শুনিয়া অত্যন্ত কুণ্ঠিত হইয়া পড়িলাম। ভাবিলাম, এক চক্রবর্তীর গৃহ ছাড়িয়া আর এক চক্রবর্তীর গৃহে আসিয়া পড়িলাম। কে জানে আতিথ্যটা এখানে কিরূপ দাঁড়াইবে। তথাপি হুঁকাটা হাতে পাইয়া টানিবার উপক্রম করিয়াছি, সহসা অন্তরাল হইতে তীক্ষ্ণকণ্ঠের প্রশ্ন আসিল, হ্যাঁ গা, কে মানুষটি এলো?

অনুমান করিলাম, ইনিই গৃহিণী। জবাব দিতে চক্রবর্তীরই শুধু গলা কাঁপিল না, আমারও যেন হৃৎকম্প হইল।

তিনি তাড়াতাড়ি বলিলেন, মস্ত লোক গো মস্ত লোক। অতিথি, ব্রাহ্মণ—নারায়ণ! পথ ভুলে এসে পড়েচেন—শুধু রাত্রিটা—ভোর না হতেই আবার সক্কালেই চলে যাবেন।

ভিতর হইতে জবাব আসিল, হাঁ সবাই আসে পথ ভুলে! মুখপোড়া অতিথের আর কামাই নেই। ঘরে না আছে একমুঠো চাল, না আছে একমুঠো ডাল—খেতে দেবে কি উনুনের পাঁশ?

আমার হাতের হুঁকা হাতেই রহিল। চক্রবর্তী কহিলেন, আহা, কি যে বল তুমি! আমার ঘরে আবার চাল-ডালের অভাব! চল চল, ভেতরে চল, সব ঠিক করে দিচ্চি।

চক্রবর্তীগৃহিণী ভিতরে যাইবার জন্য বাহিরে আসেন নাই। বলিলেন, কি ঠিক করে দেবে শুনি? আছে ত খালি মুঠোখানেক চাল, ছেলেমেয়ে-দুটোকে রাত্তিরের মত সেদ্ধ করে দেবো। বাছাদের উপুসী রেখে ওকে দেব গিলতে? মনেও ক’রো না।

মা ধরিত্রি, দ্বিধা হও! না না করিয়া কি একটা বলিতে গেলাম, কিন্তু চক্রবর্তীর বিপুল ক্রোধে তাহা ভাসিয়া গেল। তিনি তুমি ছাড়িয়া তখন তুই ধরিলেন, এবং অতিথিসৎকার লইয়া স্বামী-স্ত্রীতে যে আলাপ শুরু হইল, তাহার ভাষাও যেমন গভীরতাও তেম্‌নি। আমি টাকা লইয়া বাহির হই নাই, পকেটে সামান্য যাহা-কিছু ছিল তাহাও খরচ হইয়া গিয়াছিল। শুধু গলায় সোনার বোতাম ছিল, কিন্তু কেবা কাহার কথা শোনে! ব্যাকুল হইয়া একবার উঠিয়া দাঁড়াইবার চেষ্টা করিতে চক্রবর্তী সজোরে আমার হাত চাপিয়া ধরিয়া কহিলেন, অতিথি নারায়ণ। বিমুখ হয়ে গেলে গলায় দড়ি দেব।

গৃহিণী কিছুমাত্র ভীত হইলেন না, তৎক্ষণাৎ চ্যালেঞ্জ অ্যাক্‌সেপ্ট করিয়া কহিলেন, তা হলে ত বাঁচি। ভিক্ষে-সিক্ষে করে বাছাদের খাওয়াই।

এদিকে আমার ত প্রায় হিতাহিত জ্ঞান লোপ পাইবার উপক্রম করিয়াছিল; হঠাৎ বলিয়া উঠিলাম, চক্রবর্তীমশাই, সে নাহয় একদিন ভেবেচিন্তে ধীরে-সুস্থে করবেন—করাইভাল কিন্তু সম্প্রতি আমাকে হয় ছাড়ুন, নাহয় একগাছা দড়ি দিন, ঝুলে পড়ে আপনার আতিথ্যের দায় থেকে মুক্ত হই।

চক্রবর্তী অন্তঃপুর লক্ষ্য করিয়া হাঁকিয়া বলিলেন, আক্কেল হ’ল? বলি শিখলি কিছু?

পাল্টা জবাব আসিল, হ্যাঁ। মুহূর্ত-কয়েক পরে ভিতর হইতে শুধু একখানি হাত বাহির হইয়া, দুম করিয়া একটা পিতলের ঘড়া বসাইয়া দিয়া আদেশ হইল, যাও, শ্রীমন্তর দোকানে এটা রেখে চাল ডাল তেল নুন নিয়ে এসো গে। দেখো যেন মিন্‌সে হাতে পেয়ে সব কেটে না নেয়।

চক্রবর্তী খুশী হইয়া উঠিলেন। বলিলেন, আরে, না না, একি ছেলের হাতের নাড়ু?

চট করিয়া হুঁকাটা তুলিয়া লইয়া বার-কয়েক টান দিয়া কহিলেন, আগুন নিবে গেছে। গিন্নী, দাও দিকি কলকেটা পালটে, একবার খেয়েই যাই। যাব আর আসব। এই বলিয়া তিনি কলিকাটা হাতে লইয়া অন্দরের দিকে বাড়াইয়া দিলেন।

ব্যস, স্বামী-স্ত্রীতে সন্ধি হইয়া গেল। গৃহিণী তামাক সাজিয়া দিলেন, কর্তা প্রাণ ভরিয়া ধূমপান করলেন। প্রসন্নচিত্তে হুঁকাটি আমার হাতে দিয়া ঘড়া হাতে করিয়া বাহির হইয়া গেলেন।

চাল আসিল, ডাল আসিল, তেল আসিল, নুন আসিল, যথাসময়ে রন্ধনশালায় আমার ডাক পড়িল। আহারে বিন্দুমাত্র রুচি ছিল না, তথাপি নিঃশব্দে গেলাম। কারণ, আপত্তি করা শুধু নিষ্ফল নয়, না বলিতে আমার আতঙ্ক হইল। এ জীবনে বহুবার বহুস্থানেই আমাকে অযাচিত আতিথ্য গ্রহণ করিতে হইয়াছে, সর্বত্রই সমাদৃত হইয়াছি বলিলে অসত্য বলা হইবে, কিন্তু এমন সংবর্ধনাও কখনো ভাগ্যে জুটে নাই; কিন্তু শিক্ষার তখনও বাকি ছিল। গিয়া দেখিলাম, উনুন জ্বলিতেছে, এবং অন্নের পরিবর্তে কলাপাতায় চাল ডাল আলু ও একটা পিতলের হাঁড়ি।

চক্রবর্তী উৎসাহভরে কহিলেন, দিন হাঁড়িটা চড়িয়ে, চটপট হয়ে যাবে। খাঁড়ি-মুসুরের খিচুড়ি, আলুভাতে, তোফা লাগবে খেতে। ঘি আছে, গরম গরম—

চক্রবর্তীর রসনা সরস হইয়া উঠিল কিন্তু আমার কাছে ব্যাপারটা আরও জটিল হইয়া উঠিল। কিন্তু পাছে আমার কোন কথায় বা কাজে আবার একটা প্রলয়কাণ্ড বাধিয়া যায় এই ভয়ে তাঁহার নির্দেশমত হাঁড়ি চড়াইয়া দিলাম, চক্রবর্তীগৃহিণী আড়ালে ছিলেন, স্ত্রীলোকের চক্ষে আমার অপটু হস্ত গোপন রহিল না, এবার তিনি আমাকেই উদ্দেশ করিয়া কথা কহিলেন।

তাঁহার আর যা দোষই থাক, সঙ্কোচ বা চক্ষুলজ্জা বলিয়া যে শব্দগুলা অভিধানে আছে, তাহাদের অতিবাহুল্য দোষ যে ইঁহার ছিল না একথা বোধ করি অতি বড় নিন্দুকেও স্বীকার না করিয়া পারিবে না। তিনি কহিলেন, তুমি ত বাছা রান্নার কিছুই জান না।

আমি তৎক্ষণাৎ মানিয়া লইয়া বলিলাম, আজ্ঞে না।

তিনি বলিলেন, কর্তা বলছিলেন বিদেশী লোক, কে বা জানবে, কে বা শুনবে। আমি বললাম, তা হতে পারে না। একটা রাত্তিরের জন্যে একমুঠো ভাত দিয়ে আমি মানুষের জাত মারতে পারব না। আমরা বাবা অগ্রদানী বামুন।

আমার যে আপত্তি নাই, এবং ইহা অপেক্ষাও গুরুতর পাপ ইতিপূর্বে করিয়াছি—একথা বলিতেও কিন্তু আমার সাহস হইল না পাছে স্বীকার করিলেও কোন বিভ্রাট ঘটে। মনের মধ্যে শুধু একটিমাত্র চিন্তা ছিল কেমন করিয়া রাত্রি কাটিবে এবং এই বাড়ির নাগপাশ হইতে অব্যাহতি লাভ করিব। সুতরাং, নির্দেশমত খিচুড়িও রাঁধিলাম, এবং পিণ্ড পাকাইয়া গরম ঘি দিয়া তোফা গিলিবার চেষ্টাও করিলাম। এ অসাধ্য যে কি করিয়া সম্পন্ন করিলাম আজও বিদিত নই, কেবলই মনে হইতে লাগিল চাল-ডালের তোফা পিণ্ড পেটের মধ্যে গিয়া পাথরের পিণ্ড পাকাইতেছে।

অধ্যবসায়ে অনেক-কিছুই হয়, কিন্তু তাহারও সীমা আছে। হাতমুখ ধুইবারও অবসর মিলিল না, সমস্ত বাহির হইয়া গেল। ভয়ে শীর্ণ হইয়া উঠিলাম, কারণ এগুলো যে আমাকেই পরিষ্কার করিতে হইবে তাহাতে সন্দেহ নাই; কিন্তু সে শক্তি আর ছিল না। চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হইয়া উঠিল, কোনমতে বলিয়া ফেলিলাম, কোথাও আমাকে একটু শোবার জায়গা দিন, মিনিট-পাঁচেক সামলে নিয়েই আমি সমস্ত পরিষ্কার করে দেব। ভাবিয়াছিলাম প্রত্যুত্তরে কি যে শুনিব জানি না, কিন্তু আশ্চর্য এই চক্রবর্তীগৃহিণীর ভয়ানক কণ্ঠস্বর অকস্মাৎ কোমল হইয়া উঠিল। এতক্ষণে তিনি অন্ধকার হইতে আমার সম্মুখে আসিলেন। বলিলেন, তুমি কেন বাবা পরিষ্কার করতে যাবে, আমিই সব সাফ করে ফেলচি। বাইরের বিছানাটা এখনও করে উঠতে পারিনি, ততক্ষণ এসো তুমি আমার ঘরে গিয়ে শোবে।

না বলিবার সামর্থ্যও নাই, নীরবে অনুসরণ করিয়া তাঁহারই শতচ্ছিন্ন শয্যায় আসিয়া চোখ বুজিয়া শুইয়া পড়িলাম।

অনেক বেলায় যখন ঘুম ভাঙ্গিল, তখন মাথা তুলিবারও শক্তি ছিল না এম্‌নি জ্বর।

সহজে চোখ দিয়া আমার জল পড়ে না, কিন্তু এত বড় অপরাধের যে এখন কেমন করিয়া কি জবাবদিহি করিব এই কথা ভাবিয়া নিছক ও নিরবচ্ছিন্ন আতঙ্কেই আমার দুই চক্ষু অশ্রু পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল। মনে হইল বহুবার বহু নিরুদ্দেশ-যাত্রাতেই বাহির হইয়াছি, কিন্তু এতখানি বিড়ম্বনা জগদীশ্বর আর কখনও অদৃষ্টে লিখেন নাই। আর একবার প্রাণপণে উঠিয়া বসিবার প্রয়াস করিলাম, কিন্তু কোনমতেই মাথা সোজা করিতে না পারিয়া চোখ বুজিয়া শুইয়া পড়িলাম।

আজ চক্রবর্তীগৃহিণীর সহিত মুখোমুখি আলাপ হইল। বোধ হয় অত্যন্ত দুঃখের মধ্যে দিয়াই নারীর সত্যকার গভীর পরিচয়টুকু লাভ করা যায়। তাঁহাকে চিনিয়া লইবার এমন কষ্টিপাথরও আর নাই, তাঁহার হৃদয় জয় করিবার এতবড় অস্ত্রও পুরুষের হাতে আর দ্বিতীয় নাই। আমার শয্যাপার্শ্বে আসিয়া বলিলেন, ঘুম ভেঙ্গেচে বাবা?

চাহিয়া দেখিলাম। তাঁহার বয়স বোধ হয় চল্লিশের কাছাকাছি—কিছু বেশি হইতেও পারে। রঙটি কালো, কিন্তু চোখমুখ সাধারণ ভদ্র গৃহস্থঘরের মেয়েদের মতই। রুক্ষতার কোথাও কিছু নাই, আছে শুধু সর্বাঙ্গ ব্যাপ্ত করিয়া গভীর দারিদ্র্য ও অনশনের চিহ্ন আঁকা—চোখ মেলিয়া চাহিলেই তাহা ধরা পড়ে। কহিলেন, কাল আঁধারে দেখতে পাইনি বাবা, কিন্তু আমার বড়ছেলে বেঁচে থাকলে তার তোমার বয়সই হ’ত।

ইহার আর উত্তর কি। তিনি হঠাৎ কপালে হাত ঠেকাইয়া বলিলেন, জ্বরটা এখনও খুব রয়েচে।

আমি চোখ বুজিয়া ছিলাম, চোখ বুজিয়াই কহিলাম, কেউ একটুখানি সাহায্য করলে বোধ হয় হাসপাতালে যেতে পারব—সে ত আর বেশি দূর নয়।

তাঁহার মুখ দেখিতে পাইলাম না, কিন্তু আমার কথায় তাঁহার কণ্ঠস্বর যেন বেদনায় ভরিয়া গেল। বলিলেন, দুঃখের জ্বালায় কাল কি-একটা বলেচি বলেই বাবা, রাগ করে ওই যমপুরীতে চলে যাবে? আর যাবে বললেই আমি যেতে দেব? এই বলিয়া তিনি ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া ধীরে ধীরে কহিলেন, আতুরের নিয়ম নেই বাবা। এই যে লোকে হাসপাতালে গিয়ে থাকে সেখানে কাদের ছোঁওয়া খেতে হয় বল ত? কিন্তু তাতে কি জাত যায়? আমি সাগুবার্লি তৈরি করে দিলে কি তুমি খাবে না?

আমি ঘাড় নাড়িয়া জানাইলাম যে, বিন্দুমাত্র আপত্তি নাই এবং শুধু পীড়িত বলিয়া নয়, অত্যন্ত নীরোগ শরীরেও আমার ইহাতে বাধা হয় না।

অতএব রহিয়া গেলাম। বোধ হয় সর্বসমেত দিন-চারেক ছিলাম। তথাপি সেই চারিদিনের স্মৃতি সহজে ভুলিবার নয়। জ্বর একদিনেই গেল, কিন্তু বাকী দিন-কয়টা দুর্বল বলিয়া তাঁহারা নড়িতে দিলেন না। কি ভয়ানক দারিদ্র্যের মধ্যে দিয়াই এই ব্রাহ্মণ-পরিবারের দিন কাটিতেছে এবং দুর্গতিকে সহস্রগুণে তিক্ত করিয়া তুলিয়াছে বিনাদোষে সমাজের অর্থহীন পীড়ন। চক্রবর্তীগৃহিণী তাঁহার অবিশ্রান্ত খাটুনির মধ্যেও এতটুকুও অবসর পাইলে আমার কাছে আসিয়া বসিতেন। মাথায়, কপালে হাত বুলাইয়া দিতেন, ঘটা করিয়া রোগের পথ্য যোগাইতে পারিতেন না, এই ত্রুটি যত্ন দিয়া পূর্ণ করিয়া দিবার কি ঐকান্তিক চেষ্টাই না তাঁহার দেখিতে পাইতাম। পূর্বে অবস্থা সচ্ছল ছিল, জমিজমাও মন্দ ছিল না, কিন্তু তাঁহার নির্বোধ স্বামীকে লোকে প্রতারিত করিয়াই এই দুঃখে ফেলিয়াছে। তাহারা আসিয়া ঋণ চাহিত, বলিত, দেশে বড়লোক ঢের আছে, কিন্তু এত বড় বুকের পাটা কয়জনের আছে? অতএব এই বুকের পাটা সপ্রমাণ করিতে তিনি ঋণ করিয়া ঋণ দিতেন। প্রথমে হ্যান্ডনোট কাটিয়া এবং পরে স্ত্রীকে গোপন করিয়া সম্পত্তি বন্ধক দিয়া। ইহার ফল অধিকাংশ স্থলেই যাহা হয় এখানেও তাহাই হইয়াছে।

এ কুকার্য যে চক্রবর্তীর অসাধ্য নয় তাহা একটা রাত্রির অভিজ্ঞতা হইতেই সম্পূর্ণ বিশ্বাস করিলাম। বুদ্ধির দোষে বিষয়-সম্পত্তি অনেকেরই যায় এবং তাহার পরিণামও অত্যন্ত দুঃখের হয়, কিন্তু এই দুঃখ যে সমাজের অনাবশ্যক, অন্ধ নিষ্ঠুরতায় কতখানি বাড়িতে পারে তাহা চক্রবর্তীগৃহিণীর প্রতি কথায় অস্থিমজ্জায় অনুভব করিলাম। তাঁহাদের দুইটিমাত্র শোবার ঘর। একটিতে ছেলেমেয়েরা থাকে এবং অন্যটি সম্পূর্ণ অপরিচিত ও বাহিরের লোক হইয়াও আমি অধিকার করিয়া আছি।

ইহাতে আমার সঙ্কোচের অবধি ছিল না। বলিলাম, আজ ত আমার জ্বর ছেড়েচে এবং আপনাদেরও ভারি কষ্ট হচ্ছে। যদি বাইরের ঘরে একটা বিছানা করে দেন ত আমি ভারি তৃপ্তি পাই।

গৃহিণী ঘাড় নাড়িয়া কহিলেন, সে কি হয় বাছা, আকাশে মেঘ করে আছে, বৃষ্টি যদি হয় ত ও-ঘরে এমন ঠাঁই নেই যে মাথাটুকু রাখা যায়। তুমি রোগা মানুষ, এ ভরসা ত করতে পারিনে বাবা।

তাঁহাদের প্রাঙ্গণের একধারে কিছু খড় সঞ্চিত ছিল তাহা লক্ষ্য করিয়াছিলাম, তাহাই ইঙ্গিত করিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, সময়ে মেরামত করে নেননি কেন? জলঝড়ের ত দিন এসে পড়চে।

ইহার প্রত্যুত্তরে জানিলাম যে, তাহা সহজে হইবার নয়। পতিত ব্রাহ্মণ বলিয়া এ অঞ্চলের চাষীরা তাঁহাদের কাজ করে না। গ্রামান্তরে মুসলমান ঘরামী আছে, তাহারাই ঘর ছাইয়া দেয়। যে-কোন কারণে হোক, এ বৎসর তাহারা আসিতে পারে নাই। এই প্রসঙ্গে তিনি সহসা কাঁদিয়া ফেলিয়া কহিলেন, বাবা, আমাদের দুঃখের কি সীমা আছে? সে বছর আমার সাত-আট বছরের মেয়েটা হঠাৎ কলেরায় মারা গেল; পুজোর সময় আমার ভাইয়েরা গিয়েছিল কাশী বেড়াতে, তাই আর লোক পাওয়া গেল না, ছোট ছেলেটাকে সঙ্গে নিয়ে একা এঁকেই শ্মশানে নিয়ে যেতে হ’ল। তাও কি সৎকার করা গেল? কাঠকুটো কেউ কেটে দিলে না, বাপ হয়ে গর্ত খুঁড়ে বাছাকে পুঁতে রেখে ইনি ঘরে ফিরে এলেন। বলিতে বলিতে তাঁহার পুরাতন শোক একেবারে নূতন করিয়া দেখা দিল। চোখ মুছিতে মুছিতে যাহা বলিতে লাগিলেন তাহার মোট অভিযোগ এই যে, তাঁহাদের পূর্বপুরুষদের কোন্‌ কালে কে শ্রাদ্ধের দান গ্রহণ করিয়াছিলেন, সেই ত অপরাধ? অথচ, শ্রাদ্ধ হিন্দুর অবশ্য কর্তব্য এবং কেহ-না-কেহ দান গ্রহণ না করিলে সে শ্রাদ্ধ অসিদ্ধ ও নিষ্ফল হইয়া যায়। তবে দোষটা কোথায়? আর দোষই যদি থাকে ত মানুষকে প্রলুব্ধ করিয়া সে কাজে প্রবৃত্ত করান কিসের জন্য?

এ-সকল প্রশ্নের উত্তর দেওয়াও যেমন কঠিন, পূর্ব-পিতামহগণের কোন্‌ দুষ্কৃতির শাস্তিস্বরূপ তাঁহাদের বংশধরগণ এরূপ বিড়ম্বনা ভোগ করিতেছেন তাহা এতকাল পরে আবিষ্কার করাও তেম্‌নি দুঃসাধ্য। শ্রাদ্ধের দান লওয়া ভাল কি মন্দ জানি না। মন্দ হইলেও এ-কথা সত্য যে, ব্যক্তিগতভাবে এ কাজ তাঁহারা করেন না, অতএব নিরপরাধ। অথচ প্রতিবেশী হইয়া আর একজন প্রতিবেশীর জীবনযাত্রার পথ বিনাদোষে মানুষে এতখানি দুর্গম ও দুঃখময় করিয়া দিতে পারে, এমন হৃদয়হীন নির্দয় বর্বরতার উদাহরণ জগতে বোধ করি এক হিন্দু সমাজ ব্যতীত আর কোথাও নাই।

তিনি পুনশ্চ কহিলেন, এ গ্রামে লোক বেশি নেই, জ্বর আর ওলাউঠায় অর্ধেক মরে গেছে। এখন আছে শুধু ব্রাহ্মণ, কায়স্থ আর রাজপুত। আমাদের যে কোন উপায় নেই বাবা, নইলে ইচ্ছে হয়, কোন মুসলমানের গ্রামে গিয়ে বাস করি।

বলিলাম, কিন্তু সেখানে ত জাত যেতে পারে।

চক্রবর্তীগৃহিণী এ প্রশ্নের ঠিক জবাব দিলেন না, কহিলেন, আমার সম্পর্কে একজন খুড়শ্বশুর আছেন, তিনি দুমকায় চাকরি করতে গিয়ে খ্রিস্টান হয়েচেন। তাঁর ত আর কোন কষ্টই নেই।

চুপ করিয়া রহিলাম। হিন্দুধর্ম ত্যাগ করিয়া কেহ ধর্মান্তর-গ্রহণে মনে মনে উৎসুক হইয়া উঠিয়াছে শুনিলে ক্লেশবোধ হয়, কিন্তু সান্ত্বনাই বা দিব কি বলিয়া? এতদিন জানিতাম অস্পৃশ্য, নীচ জাতি যাহারা আছে তাহারাই শুধু হিন্দু সমাজের মধ্যে নির্যাতন ভোগ করে, কিন্তু আজ জানিলাম কেহই বাদ যায় না। অর্থহীন অবিবেচনায় পরস্পরের জীবন দুর্ভর করিয়া তোলাই যেন এ সমাজের মজ্জাগত সংস্কার। পরে অনেককেই জিজ্ঞাসা করিয়াছি, অনেকেই স্বীকার করিয়া বলিয়াছেন, ইহা অন্যায়, ইহা গর্হিত, তথাপি নিরাকরণেরও কোন পন্থাই তাঁহারা নির্দেশ করিতে পারেন না। এই অন্যায়েরই মধ্য দিয়া তাঁহারা জন্ম হইতে মৃত্যু পর্যন্ত চলিতে সম্মত আছেন, কিন্তু প্রতিকারের প্রবৃত্তি বা সাহস কোনটাই তাঁহাদের নাই। জানিয়া বুঝিয়াও অবিচারের প্রতিবিধান করিবার শক্তি যাহাদের এমন করিয়া তিরোহিত হইয়াছে, সে জাতি যে দীর্ঘকাল বাঁচিবে কি করিয়া ভাবিয়া পাওয়া শক্ত।

দিন-তিনেক পরে সুস্থ হইয়া একদিন সকালে যাইবার জন্য প্রস্তুত হইয়া বলিলাম, মা, আজ আমাকে বিদায় দিন।

চক্রবর্তীগৃহিণীর দুই চক্ষু জলে ভাসিয়া গেল; বলিলেন, দুঃখীর ঘরে অনেক দুঃখ পেলে বাবা, তোমাকে কটুকথাও কম বলিনি।

এ কথার উত্তর খুঁজিয়া পাইলাম না। না না, সে কিছুই না—আমি মহাসুখে ছিলাম, আমার কৃতজ্ঞতা—ইত্যাদি মামুলি ভদ্রবাক্য উচ্চারণ করিতেও আমার লজ্জা বোধ হইল। বজ্রানন্দের কথা মনে পড়িল। সে একদিন বলিয়াছিল, ঘর ছাড়িয়া আসিলে কি হইবে! এই বাঙ্গলাদেশের গৃহে গৃহে মা-বোন, সাধ্য কি তাঁহাদের স্নেহের আকর্ষণ এড়াইয়া যাই। কথাটা কতবড়ই না সত্য!

নিরতিশয় দারিদ্র্য ও নির্বোধ স্বামীর অবিবেচনার আতিশয্য এই গৃহস্থঘরের গৃহিণীকে প্রায় পাগল করিয়া দিয়াছে, কিন্তু যে মুহূর্তেই তিনি অনুভব করিলেন আমি পীড়িত, আমি নিরুপায়—আর তাঁহার ভাবিবার কিছু রহিল না। মাতৃত্বের সীমাহীন স্নেহে আমার রোগ ও পরগৃহবাসের সমস্ত দুঃখ যেন দুই হাত দিয়া মুছিয়া লইলেন।

চক্রবর্তী চেষ্টা করিয়া একখানি গো-যান সংগ্রহ করিয়া আনিলেন, গৃহিণীর ভারি ইচ্ছা ছিল আমি স্নানাহার করিয়া যাই, কিন্তু রৌদ্র বাড়িবার আশঙ্কায় পীড়াপীড়ি করিলেন না। শুধু যাত্রাকালে দেবদেবীর নাম স্মরণ করিয়া চোখ মুছিয়া কহিলেন, বাবা, যদি কখনও এদিকে এস আর একবার দেখা দিয়ে যেয়ো।

এদিকে আসাও কখনও হয় নাই, দেখা দিতেও আর পারি নাই, শুধু বহুদিন পরে শুনিয়াছিলাম, রাজলক্ষ্মী কুশারীমহাশয়ের হাত দিয়া তাঁহাদের অনেকখানি ঋণের অংশ গ্রহণ করিয়াছিল।


© 2024 পুরনো বই