হাসি

স্টেশনের ওয়েটিং রুমের ভেতরে-বাইরে কোথাও অন্য লোক ছিল না, বেহারাটাকেও ডেকে ডেকে পাওয়া গেল না। অগত্যা চায়ের আশায় জলঞ্জলি দিয়ে আমরা কয় বন্ধুতে বেশ করে ‘রাগ’ টেনে নিয়ে ইজিচেয়ারে শুয়ে পড়লাম।

মাঘের শেষ যদিও, শীত কিন্তু বাংলাদেশের পৌষ মাসের চেয়েও বেশি। রমেন বললে— ওহে, তোমরা যা বোঝো করো, আমি কিন্তু চা নইলে রাত কাটাতে পারব না। বসো তোমরা একটা ব্যবস্থা দেখি—

দোর খোলার সঙ্গেসঙ্গে একঝলক তীক্ষ্ন শীতল পশ্চিমে বাতাস তিরের মতো ঘরে ঢুকতেই আমরা হাঁ-হাঁ করে উঠলাম। রমেন ততক্ষণে চলে গিয়েছে। খোলা দরজাটা বন্ধ করে দিতে গিয়ে চেয়ে দেখি বাইরে বেজায় কুয়াশা। পৃথ্বীশ আমাদের দলের দার্শনিক। এতক্ষণ সে ‘রাগ’ দিয়ে আপাদমস্তক আবৃত করে শুয়ে ছিল। হঠাৎ মুখ তুলে গম্ভীরভাবে বললে— দেখো, আমার কিন্তু একটা আনক্যানি সেনসেশন হচ্ছে। কেন বলো তো?

আমি বললাম— কীভাবের আনক্যানি? ভূত-টূত?

সে ‘রাগ’ তুলে ফেলে ইজিচেয়ারে উঠে বসল। চারিধারে চেয়ে দেখে বললে— তা ঠিক জানিনে, কিন্তু কেমন যেন—

আমরা সকলেই ততক্ষণে পুনরায় খাড়া হয়ে উঠে বসেছি। সলিল বললে— বিচিত্র নয়! আমি একটা ব্যাপার জানি, এইরকম একটা স্টেশনের ওয়েটিং রুমে রাত দশটার পর লোক থাকতে পারত না। শুধু তাই নয়, একবার অনেক রাত্রের ট্রেনে এক ভদ্রলোক নেমে রাতের মতো স্টেশনের ওয়েটিং রুমেই ছিলেন। সকালেও তিনি ওঠেন না দেখে সকলে তুলতে গিয়ে দেখলে তিনি অচৈতন্য অবস্থায় মুখ উপুড় করে পড়ে আছেন। তারপর অনেক যত্নে তাঁর জ্ঞান হয়। তিনি সকলের কাছে বলেন— শেষরাত্রির দিকে এক সাহেব এসে তাঁকে ওঠায়। পরে হঠাৎ তিনি পকেট থেকে একটা ক্ষুর বার করে নিজের গলায় বসিয়ে এমন জোরে টানতে থাকেন যে, কাঁচাচামড়া কাটার অস্বস্তিকর খ্যাঁচ-খ্যাঁচ আওয়াজে তাঁর সারাশরীর শিউরে ওঠে! তিনি চিৎকার করে লোক ডাকতে যেতেই দেখেন কেউ কোথাও নেই, সাহেবের চিহ্নও নেই ঘরে; তারপর কী হল তিনি আর জানেন না। সেই স্টেশনের ওয়েটিং রুমের বাথরুমটার মধ্যে এক ছোকরা সাহেব ইঞ্জিনিয়ার কীজন্যে একবার ঠিক ওইভাবে গলায় ক্ষুর বসিয়ে আত্মহত্যা করেছিল। তারপর থেকেই এই ব্যাপার…

আমরা সকলে আমাদের বাথরুমটার দিকে চেয়ে দেখলাম। লুপ-লাইনের নির্জন পাহাড়ে, জঙ্গলের ধারে, লাইনের ওপারে কেবল স্টেশনমাস্টারের কোয়ার্টারটা এবং লেভেল ক্রসিং-এর ফটকে দারোয়ানের গুমটি। ওয়েটিং রুমের বাইরে স্টেশনের হাতার পরেই একটা ছোট্ট পান সিগারেটের ও চায়ের দোকান। দিনমানে, এমনকী সন্ধ্যার পর পর্যন্তও দেখেছিলাম, তার পর থেকেই আর দোকানির পাত্তা নেই, দোকান বন্ধ করে চলে গিয়েছে।

গল্প ভালো করে জমতে না-জমতে হঠাৎ দোরটা খুলে গেল। একটা কুলির হাতে কাঁসার থালার ওপর গোটা-আষ্টেক পেয়ালা ভরতি চা নিয়ে ঢুকল রমেন। ঢুকেই বললে— দেখছো, হ্যোয়ার দেয়ার ইজ অ্যা উইল, দেয়ার ইজ অ্যা ওয়ে! বলেছিলাম না চায়ের ব্যবস্থা করবই? স্টেশনমাস্টারের সঙ্গে আলাপ হয়ে গেল, তাঁর বাড়িও আমাদের জেলায়। তিনি বললেন— বিলক্ষণ, আপনারা ভদ্রলোকের ছেলে, বাঙালি, চা খাবেন এ তো সৌভাগ্য! ছাড়লেন না কিছুতেই, নিজের বাসা থেকে তৈরি করে পাঠিয়ে দিলেন—

রমেনের কথা শেষ হতে না-হতে দোর ঠেলে এক ভদ্রলোক ঢুকলেন। রমেন প্রায় খেলার পুতুলের মতো লাফিয়ে উঠে বললে— এই যে মিত্তিরমশাই; আসুন, আসুন! পরে আমাদের দিকে চেয়ে বললে— ইনিই এখানকার স্টেশনমাস্টার হরিদাসবাবু। আসুন, বসুন!

ততক্ষণে হরিদাসবাবুর টেবিলের পাশে হাতলশূন্য বেতের কেদারাটাতে আমাদের সকলের উদ্দেশ্যে অভিবাদনের জন্যে হাত উঁচু করে গরুড়ের মতো বসে আছেন। মিত্তিরমশায়ের বয়স পঁয়তাল্লিশের কম নয়; দোহারা গড়ন, কানের পাশের চুলগুলোতে বেশ পাক ধরেছে, গোঁফদাড়ি কামানো। পশ্চিমের আটা-জলে বেশ স্বাস্থ্যবান শরীর।

আমি জিজ্ঞাসা করলাম— আপনি এখানে কতদিন আছেন মিত্তিরমশাই?

—আজ্ঞে এই আসছে ফেব্রুয়ারিতে দেড় বছর হবে। বড়ো কষ্ট মশাই, মাছ তো একেবারে মেলে না, বাঙালির মুখ মোটে দেখতে পাওয়া যায় না। তাই আপনারা আজ এসেছেন শুনে খুব আনন্দ হল। উনি চায়ের কথা যেমন তুললেন আমি বললাম— তা আর কী, আমার বাসা যখন নিকটেই রয়েছে, তখন কী আর— তা আপনারা কতদূর যাবেন সব?

—আমরা সাইকেলে দিল্লি যাব বলে বেরিয়েছি, ওপার থেকে আসছি কিনা? এইখানে নদী পার হয়ে ভাগলপুরের পথ ধরে গিয়ে গ্র্যান্ড ট্র্যাঙ্ক রোডে উঠব ইচ্ছে আছে। ভাগলপুরের গাড়িটা ঠিক এখানে ক-টায় পাওয়া যাবে কাল সকালে?

তারপর অনেক কথাবার্তা ও আমাদের ভ্রমণ সম্বন্ধে অনেক কৌতূহলপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর এবং কথিত ট্রেন-ঘটিত নানা আবশ্যকীয় সংবাদের আদানপ্রদানের পর কথাবার্তার বেগ মন্দীভূত হয়ে পড়ল।

কারুরই ঘুম পাচ্ছিল না। বিশেষ করে গরম চা খাবার পরেই আলস্য ও তন্দ্রার ভাবটা কেটে গিয়ে সকলের শরীর যেন বেশ তাজা হয়ে উঠেছিল। নির্বাণোন্মুখ কথাবার্তার শিখাটাকে পুনরায় খোঁচা দিয়ে প্রদীপ্ত করার জন্যেই আমি হঠাৎ বলে উঠলাম— হ্যাঁ মশাই, আপনাদের এ ওয়েটিং রুমের বাথরুমে ভূত-টুত নেই তো? এ প্রশ্নের পরেই সলিলের সেই অজ্ঞাত স্টেশনটির বাথরুম ও ছোকরা ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের গল্প পুনরায় ফিরে এল। পুনরায় আমাদের একচোট হাসি হল এবং কেউ কেউ এমন ভাবের ভান করলেন যে এ স্টেশনের বাথরুম সম্বন্ধেও তাঁরা ভয়ের ধারণা পোষণ করেন।

রমেন বললে— যত সব গাঁজাখুরি…

হরিদাসবাবু অনেকক্ষণ কোনো কথা বলেননি। আমাদের উপহার দেওয়া সিগারেটের চতুর্থটির ছাই ঝাড়তে ঝাড়তে তিনি হাই তুলে খাড়া হয়ে বসলেন। বললেন— আপনারা হাসবেন হয়তো, কিন্তু আমার নিজের জীবনের একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা এখানে বলছি শুনুন।

পরে তিনি পঞ্চম সিগারেটটি ধরিয়ে নিজের অদ্ভুত গল্পটি বলে গেলেন—

.

অনেক দিনের কথা। আমার বয়স তখন খুব বেশি না-হলেও বারো-তেরোর কম নয়। আমার কাকা ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টে কাজ করতেন এবং সে-সময়ে তিনি খুলনা মরেলগঞ্জ আউটপোস্টে থাকতেন। একবার কী উপলক্ষ্যে, তা এখন ঠিক স্মরণ হয় না, আমি আমাদের বাড়ির সকলের সঙ্গে কাকার কাছে বেড়াতে যাই। কাকা তখন ছিলেন খুলনার বাসাতে। সেইখানেই অনেক দিন আমরা ছিলাম। বেশিদিন থাকবার কথাবার্তা হওয়াতে আমি সেখানকার একটা স্কুলে ভরতি হয়ে গেলাম।

আমরা পুজোর পরটাতেই সেবার খুলনা যাই। কয়েক মাস পড়বার পর গ্রীষ্মের ছুটি হল প্রায় এক মাসের ওপর। কাকাকে ধরলাম তাঁর সঙ্গে তাঁর কার্যস্থান মরেলগঞ্জে যাব। কাকা আমাকে নিয়েও গেলেন। সেই সময়টা মোম-মধু সংগ্রাহকদের লাইসেন্স নতুন করে করবার সময়। কেউ ফাঁকি দিয়ে পুরোনো লাইসেন্সের বলে জঙ্গলে মোম-মধু সংগ্রহ করে কিনা পাহারা দেবার জন্যে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের বোট ও স্টিম লঞ্চ সবসময় সুন্দরবনের নদী, খাঁড়ি ও খালের মধ্যে ঘুরে ঘুরে পাহারা দিত। কতবার আমি কাকার সঙ্গে এই সরকারি বোটে সুন্দরবনের মধ্যে বেড়াতে গিয়েছি।

আমার মনে এই সুন্দরবনের একটা অপূর্ব স্বপ্নছবি মুদ্রিত আছে। তখন আমি ছেলেমানুষ, সবে তেরো; শহর থেকে গিয়েছি। সুন্দরবনের অপূর্ব বন্যসৌন্দর্য এই এক মাসে প্রতিদিন আমার ক্ষুধার্ত ব্যগ্র বালক মনে কী আনন্দের বার্তা বয়ে আনত, তা আমি মুখে আপনাদের বোঝাতে পারি না। আর কখনো সে দেশে যাইনি। অনেক দিনের কথা হলেও এখনও মধ্যে মধ্যে সুন্দরবনের, বিশেষ করে জ্যোৎস্না-ওঠা সুন্দরবনের ছবি, অপরিসর খালের মাটির জঙ্গলে ভরা ঢালু পাড়, নতুন পাতা-ওঠা গাব গাছের ও বন্য গোল গাছের সারি, খাঁড়ির মুখে জোয়ারের শব্দ যখনই মনে হয়; একটা জিনিসের জন্যে বেদনায় এ বয়সেও মনটা কেমন করে ওঠে।

সেদিনের কথাটা আমার বেশ মনে আছে। সুন্দরবনের সেই অংশটা তখন জরিপ হচ্ছিল। তাদের একটা বড়ো লঞ্চ বড়ো গাঙের মাঝখানে বাঁধা থাকত। দুপুর বেলা সেদিন সেই লঞ্চটাতে আমাদের নিমন্ত্রণ ছিল। চার-পাঁচজন, আমি, একজন কানুনগো, একজন কেরানি— সবাই বাঙালি, সবসুদ্ধ সাত-আটজন লোক লঞ্চটাতে। খাওয়া-দাওয়াটা খুব গুরুতর রকমের হল, তারপর একটু গান বাজনাও হল। বেলা পড়ে গেলে সেখান থেকে বিদায় নিয়ে আমাদের বজরাটা ছাড়লাম।

ক্রমে রাত হল, জ্যোৎস্না উঠল। খালের দু-ধারে নতুন পাতা-ওঠা বনের মাথাটা জ্যোৎস্নায় চিক চিক করছিল। দূর থেকে নৈশ-পাখির দু-একটা অদ্ভুত রকমের ডাক কানে আসছিল। জোয়ারের জলে মগ্ন গোলগাছের আনত শাখাগুলো ভাটার পরে একটু একটু করে জল থেকে জেগে উঠতে লাগল। বাঘের উপদ্রবের ভয়ে সবসময়ে আমাদের বজরাতে দু-জন বন্দুকধারী সিপাই থাকত, তারা বজরার ওধারের তোলা উনুনে রান্না চাপিয়ে দিলে।

রাতটা বড়ো গরম, গুমোট ধরনের। গাছের পাতাটি পর্যন্ত নড়ছিল না, চারিদিকে একটা নীরব থমথমে ভাব। ছইয়ের ভেতরে থাকবার উপায় নেই। বজরার ছাদে তক্তার পাটাতনের ওপর এসব গ্রীষ্মের রাতে শুয়ে থাকতে খুব আরাম বটে, কিন্তু অপরিসর খালের দু-ধারের ঘন বন থেকে বাঘ লাফিয়ে পড়বার ভয়ে সেখানে থাকবার জোর ছিল না। ছইয়ের মধ্যে কাকা ও বিনোদবাবু দাবা খেলছিলেন। ছইয়ের ঘুলঘুলিগুলো সব খোলা, আমি নিকটে বসে বই পড়ছি।

অনলাইনে বেস্টসেলিং বই কিনুন

খেলতে খেলতে রাত হয়ে গেল দশটার বেশি। সিপাইদের রান্না হয়ে গেল।

কাকা কী একটা কঠিন চাল সামলাবার কথা একমনে ভাবছেন, আমি মিটমিটে আলোতে আখ্যানমঞ্জরী পড়ছি, বিনোদবাবু খেলোয়াড়কে সমস্যায় ফেলবার আত্মপ্রসাদে তাকিয়ে ঠেস দিয়ে ঘুলঘুলির বাইরে ভাটার টান ধরা জলের দিকে চেয়ে আছেন। দীর্ঘ বন গাছের ছায়া পড়েছে জলের ওপর।

এমন সময় একটা ব্যাপার ঘটল।

সামনের ঘন বনের মধ্যে অনেক দূর থেকে একটা উচ্চ সুস্পষ্ট কর্কশ অট্টহাসির রব উঠল— হাঃ-হাঃ-হাঃ-হাঃ-হাঃ—

অবিকল মানুষের গলার আওয়াজের মতো হলেও মনে হল যেন এটা অমানুষিক অস্বাভাবিক স্বর। আমরা কিছু ভাববার পূর্বেই সেইরকম আর একবার, এবং তারপর আবার। হাসির শব্দটা এত উচ্চ ও তীক্ষ্ন, যে মনে হল বনের গাছগুলো কেঁপে-কেঁপে উঠছে, মাটি যেন কাঁপছে, বোটটা যেন দুলছে!

সিপাইরা তাড়াতাড়ি খাওয়া ছেড়ে উঠে এল। কাকা, বিনোদবাবু, আমি সকলেই ছইয়ের বাইরে এলাম। গাছপালা ছবির মতো দাঁড়িয়ে আছে। কোথাও হাওয়া নেই, পাতাটি পর্যন্ত নড়ে না; সমুখে জ্যোৎস্নারাতের চাঁদ বনগাছের আড়ালে ঢলে পড়েছে।

বিনোদবাবু বললেন— কী মশায় রামবাবু? ব্যাপারটা কী?

মাঝিরা ভারি ভয় পেয়ে গিয়েছে। তারা বজরার মাস্তুলের তলায় গোল হয়ে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে বনের দিকে চেয়ে আছে।

আমরা সকলে ছইয়ের মধ্যে ঢুকতে যাচ্ছি, এমন সময় আবার সেই হাসির শব্দটা উঠল— হাঃ-হাঃ-হাঃ-হাঃ…

শব্দ এত ক্রূর ও মর্মস্পর্শী যে আমাদের সকলের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। মাঝিও দুই কানে হাত দিয়ে বলে উঠল— আল্লা! আল্লা! কাকা ও বিনোদবাবু ছইয়ের মধ্যে পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন। কাকা বললেন— কী মশাই, হায়না নাকি? কিন্তু তাঁর মুখ দেখে ও গলার সুরে মনে হল তিনি কথাটা নিজেই বিশ্বাস করেন না। তারপর পরামর্শ হল নৌকোটা সেখান থেকে সরানো যায় কি না। কিন্তু ভাটার টান এত বেশি যে বড়ো গাঙের টান ঠেলে অত রাত্রে কোনোমতেই অত ভারী বজরাটা উজানে নেওয়া চলে না। অগত্যা সেইখানেই রাত কাটাতে হল। সবাই জেগে রইল। কারুর চোখে ঘুম এল না সে রাত্রে।

শেষরাত্রে আর একবার শব্দটা শুনলাম। বনভূমি তখন নিস্তব্ধ, চাঁদ ডুবে গিয়ে নদী-আকাশ-বন সব অন্ধকারে একাকার। আমার চোখ ঘুমে ঢুলে এসেছে, এমন সময় অন্ধকার-ভরা গভীর বনভূমির দিক থেকে আর একবার সেই বিকট হাসির রোল উঠল। শেষরাত্রের চাঁদ-ডোবা অন্ধকারে সেটা এত অমানুষিক, এত পৈশাচিক ঠেকল যে তখন আমার বালক বয়স হলেও হাসিটার প্রকৃত রূপ বুঝে বুকের রক্ত যেন হিম হয়ে গেল!

সকালে জোয়ারের মুখে বজরা ছেড়ে আমরা দুপুরের সময় স্টিম-লঞ্চে ফিরে এলাম। সেখানে সব কথা শুনে প্রধান সারেঙ খালাসিদের মধ্যে কেউ কেউ বললে— ওই শব্দটা এর আগেও তারা শুনেছে, তবে স্থানটা বড়ো গভীর বনের মধ্যে বলে সেদিকটায় লোক চলাচল খুব কম। শোনা গেল, ওই বনের মধ্যে নাকি অনেক দূর গেলে প্রাচীনকালের ঘরবাড়ির চিহ্ন পাওয়া যায়। জঙ্গলের মধ্যে শ্রেণিবদ্ধ প্রাচীন বকুলগাছের সারি দেখে মনে হয় কোনো সময়ে সে-সব স্থানে লোকের বাস ছিল।

সে যাই থাকুক, আজও এতদিন পরে যখনই কথাটা মনে পড়ে তখন এই কথাটাই মনে হয়— গভীর রাত্রির অন্ধকারে জনহীন জনপদের ধ্বংসস্তূপের চারিপাশে ঘূর্ণায়মান কোনো অভিশপ্ত অশরীরী আত্মার পৈশাচিক উল্লাস-ভরা অট্টহাসিই সেদিন কানে গিয়েছিল। তাই হাসির রোলটা যখনই মনে আসে, আজও— এতকাল পরেও যেন সারা শরীর শিউরে উঠে!

ভাদ্র ১৩৩৯, মৌরীফুল


© 2024 পুরনো বই