সোনাকরা যাদুকর

রোহিণী রায় আমাদের গ্রামের জমিদার ছিলেন শুনেছিলাম।

আমাদের পাড়ায় তাঁদের মস্ত দোতলা বাড়ি। তিন-চার শরিকে ভাগ হয়ে এক একখানা ঘরে বাস করে এক-এক শরিক— এই অবস্থা। ধানের জোতজমি যা আছে, তাতে একটা গোলাও ভরে না। রোহিণী রায়ের বর্তমান বংশধরগণ পেটপুরে দু-বেলা খেতেও পান না।

আমি আর নন্তু রোহিণী রায়ের চণ্ডীমণ্ডপে, বেণীমাধব রায়ের পাঠশালায় রোজ পড়তে যাই। রোহিণী রায়ের চণ্ডীমণ্ডপের অবস্থাও ওদের বাড়ির মতোই।

মস্ত বড়ো চণ্ডীমণ্ডপের এধারে-ওধারে টানা রোয়াকে চুন-সুরকি খসে পড়চে, চালের খড় উড়ে যাচ্ছে, দেওয়াল ফেটে গিয়েছিল ১৩০৪ সালের বড়ো ভূমিকম্পে। এখন যদিও ১৩১৮ সাল হল, এই চোদ্দো-পনেরো বছর সে দেওয়াল যেমন তেমনি রয়েছে। সেকেলে চওড়া মজবুত মাটির দেওয়াল, মাটির সঙ্গে কুচো বিচালি, কাঠকয়লা আর পুটিং-চুন মিশিয়ে দেওয়াল তৈরি। ভূমিকম্প না-হলে এক-শো বছরেও জখম হত না।

রায়দের এই চণ্ডীমণ্ডপ দেখতে অনেকদূর থেকে লোক আসে জানি। এমন চমৎকার খড়ের ঘর আর নাকি এ-তল্লাটে নেই। উলো-বীরনগরের বিখ্যাত গড়ু ঘরামির তৈরি এই আটচালা। কী চমৎকার সলা বাখারির কাজ, কী সুন্দর রং করা বাখারির সজ্জা, সবই সুন্দর। গড়ু ঘরামির তৈরি মটকায় নাকি দু-দিকে দুটো ময়ূর ছিল পেখম-ধরা। সে সব অনেক দিনের কথা। আমার বাবার মুখে গল্প শুনেছি।

রোহিণী রায়দের তিন শরিক বর্তমানে দরিদ্র অবস্থায় ওই সেকেলে পৈতৃক আবাস বাটিতে বাস করে। তাদেরই একজন হচ্ছেন বেণীমাধব রায়, যাঁর পাঠশালায় আমরা পড়ি।

গুরুমশায় প্রায়ই আমাকে বলেন— তোমাদের তো অনেক কলাই-মুগ হয় ঘরে? না?

—আজ্ঞে হ্যাঁ।

—কত হয়?

—আমি জানিনে, বাবা জানেন।

—একদিন এককাঠা মুগ নিয়ে আসবি, বুঝলি?

এককাঠা মুগের দাম হল তিন আনা। তাও কিনবার ক্ষমতা নেই বেণী কাকার। আমি বাড়ি গিয়ে মাকে বলতেই মা প্রায় দশ সের মুগ ওদের বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন আমাদের মাইন্দার অর্থাৎ কৃষাণের হাতে।

—ও হাজু, মুগ দিলে কে রে অত?

—মা দিলেন, গুরুমশায়।

—বেশ বেশ। অনেক দিয়েচেন বউমা।

—মা বলেচে, দরকার হলে আমায় জানাবেন।

—না না, আর জানাতে হবে না। একজনের কাছ থেকে সব নিতে হবে তার মানে কী? আর দিতে হবে না। নামতা মুখস্থ করো।

বেণী কাকার দাদার নাম মদনলাল রায়। তাঁর বয়েস হয়েচে বটে, কিন্তু শরীরের গড়ন ও স্বাস্থ্য খুব ভালো। আমাদের গাঁয়ে অমন সুপুরুষ বৃদ্ধ আর একটি নেই। অনেক গ্রামেই নেই। লাঠিখেলা, ঘোড়ায় চড়া ও শড়কি চালানোতে যৌবন বয়সে নাকি পাকা ওস্তাদ ছিলেন শুনেছি, কেউ বলে তাঁর ডাকাতের দল ছিল, পুলিশের জুলুমে সে পেশা ছেড়ে দিয়েচেন।

বর্তমানে তাঁর তিন অবিবাহিতা মেয়ে, নিরু দিদি, বাসন্তী দিদি আর শান্তি দিদি। নিরু দিদি দেখতে তত ভালো নয়। বাসন্তী ও শান্তি দিদি সুন্দরী মেয়ে।

মদন জ্যাঠামশায় এখন গরিব লোক। কোঁচার মুড়োয় বেঁধে হাট থেকে এককাঠা করে মোটা আউশ চাল আনেন দু-আনা দিয়ে। দু-আনাও জোগাড় করতে পারেন না সব দিন। পাড়াগাঁয়ে দু-আনা জোগাড় করা সোজা কাজ কি? মেয়ে যতই সুন্দরী হোক, বিনি পয়সায় কে নেবে?

কিন্তু মদন জ্যাঠা গরিব হলেও, শান্ত-প্রকৃতির লোক নন। তাঁর দাপটে গ্রামসুদ্ধ হিন্দু-মুসলমান তটস্থ। কথায় কথায় তাঁর মান যায়, পান থেকে চুন খসবার জো নেই। ভয় করে তাঁকে খুব, সবাই বলে মদন রায় ডাকাত, কখন কী করে বসে তার ঠিক কী?

শড়কির এক হ্যাঁচকা টানে ভুঁড়ি হসকে দেবো—

এই হচ্চে মদন জ্যাঠামশায়ের মুখের বুলি!

এ হেন মদন জ্যাঠামশায়ের একবার—

আচ্ছা, থাক। ও ভাবে নয়, গল্পটা অন্যভাবে বলি।

বর্ষার সকাল বেলা। জন্মাষ্টমীর ছুটি সামনে আসচে। আমাদের গিরিধারীলালের আখড়ায় জাঁকিয়ে জন্মাষ্টমী হয়; লোকজন নিমন্ত্রণ হয়, লুচি, মালপুয়া, সুজি, গজা, চিঁড়ে, দই, আমসত্ত্বের চাটনি— এই সব প্রচুর খাওয়ায়। দু-দিন ছুটি হবে পাঠশালায়, তাতেই আমরা খুশি। সেই কথাবার্তাই আমরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করচি, এমন সময়ে ‘জয় বিশ্বনাথ, হর হর ব্যোম ব্যোম’! বলে একজন সন্নিসি এসে দাঁড়াল।

অদ্ভুত চেহারার এই সন্নিসি— দীর্ঘ জটাজূট, কপালে সিঁদুরের ত্রিপুণ্ড্র এতখানি।

পাঠশালায় হইচই পড়ে গেল। অত বড়ো কড়া বেণী কাকার বেতের ভয় উপেক্ষা করে নিজের নিজের আসন ছেড়ে উঠে এসে সকলে উঠোনে নেমে দূর থেকে সন্নিসিকে দেখতে লাগল।

বেণী কাকা তখনও পাঠশালায় নামেননি। কারণ, তিনি নামবেন পেছনের দোতলা থেকে, সে দোতলা তিনি বা তাঁর দাদা তৈরি করেননি এবং যা চুনকাম করার পয়সাও এখন তাঁদের নেই।

সন্নিসি আমাদের দিকে চোখ পাকিয়ে কটমট করে চাইতে লাগল।

বাপরে! ভসসো করে ফেলে দেবে নাকি? সন্নিসিরা তা পারে। তা ছাড়া এমন সন্নিসি! বয়স্ক লোক উপস্থিত নেই দেখে সন্নিসি ঠাকুর কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।

তারপর বললে— খবর দাও—

—কাকে?

—বাড়ির মালিককে।

খবর দিতে হল না। মদন জ্যাঠামশায় নেমে এসে ভ্রূ কুঁচকে কঠোর স্বরে বললেন— কে তুমি?

—জয় হোক! বাবাজির জয় হোক!

—কী চাই?

সন্নিসি সে-কথার কোনো উত্তর না-দিয়ে একটা রাঙা জবাফুল হাত থেকে বের করে মদন জ্যাঠার কপালে দিতে গেল। মদন জ্যাঠা বিরক্তিভরে সরে যেতে যেতে বললেন— আঃ! কী ওসব?

—কিছু না, প্রসাদি ফুল। এই—

আবার একটা সেই রকমের রাঙা জবাফুল। মুঠোর মধ্যে ছিল। মদন জ্যাঠা কৌতূহলের সঙ্গে ওর হাতের দিকে চাইলেন।

—অমন ফুল অনেক পাই— কামাখ্যা থেকে কুড়িয়ে আনা— এই— আর একটা রাঙাজবা। ও কী!

—এই— খোকা সরে এসো, নাও, আপনার ছেলে?

আর একটা। ব্যাপার ঘোরালো হয়ে উঠচে। পাঠশালা সুদ্ধু ছেলে থ মেরে গিয়েছি! কে ও লোকটা?

—এই নাও। অনেক পাওয়া যায়।— এই—

ও মা! ও বাবা! আমরা সবাই শিউরে উঠলাম। অফুরন্ত টাটকা রাঙা জবার ডান্ডার ওর হাতের ওইটুকু মুঠোয়! ছোটো দু-একটা ছেলে কেঁদে উঠল।

কিন্তু সর্বাপেক্ষা মুখের চেহারা আশ্চর্য রকমের বদলে গিয়েচে মদন জ্যাঠামশায়ের। তাঁর সে কোঁচকানের ভুরু, সেই কড়া গলার সুর কোথায় চলে গিয়েচে উড়ে— মায়ামন্ত্রের বলে যেন! এখন তাঁর মুখে সভয় কৌতূহল, বিস্ময় ও শ্রদ্ধার ভাব। তাঁর পেছনে এসে দাঁড়িয়েচে তাঁর তিন মেয়ে— নিরুদি, বাসন্তীদি ও শান্তিদি। ওরা দোতলায় বারান্দা থেকে ব্যাপার দেখে ছুটে এসেচে।

সন্নিসি ওদের দিকে হাত দিয়ে দেখিয়ে বললে— তোমার মেয়ে। তিনটিই। বিয়ে হয়নি? দেখচি। এগিয়ে এসো মায়েরা! হাত দেখি? তুমি এসো—

সুন্দরী নয় এমন মেয়ে নিরুদিদি এগিয়ে গেল। হাত দেখেই এক সেকেন্ডের মধ্যে বললে— বিয়ে হবে ভালো ঘরে। বর চাকুরি করবে, পঞ্চাশ টাকা মাইনে।

—পঞ্চাশ টাকা মাইনে মাসে?

বেণী কাকা প্রশ্ন করলেন একটু অবিশ্বাসের সুরে। এত টাকা মাসে মাইনে পায় কারা? হাকিম-হুকুম লোকেরা। পঞ্চাশ টাকা সহজ টাকা?

—হ্যাঁ। পঞ্চাশ টাকা মাসে। বলচি শুনে যাও— এই—

একটা রাঙা জবাফুল। হাত শূন্যে নাড়ালেই এসে পড়চে কোথা থেকে কে জানে?

—নাও, প্রসাদি ফুল, খোঁপায় গুঁজে রাখো—

এইবার মদন রায় ও বেণী রায় দুই ভাই একত্রে কুড়ুল দিয়ে কাটা-গাছের মতো সটান সোজা পড়ে গেলেন সন্নিসি ঠাকুরের গায়ে। সাংঘাতিক ঘায়েল হয়েচেন দু-জনে।

সন্নিসি হাত তুলে বললেন— জয় হোক, মঙ্গল হোক, অনেকদূর থেকে আসচি তোদের জন্যে। বাবা বৈদ্যনাথ বলে দিলেন এখানে আসবার জন্যে— তোমার নাম মদনলাল রায়?

ভয়ে ও সম্ভ্রমে বিগলিত হয়ে মদন জ্যাঠামশায় হাত জোড় করে জবাব দিলেন— আজ্ঞে হ্যাঁ।

—তোর কথাই বলেচেন।

—কে বাবা?

—বাবা বৈদ্যনাথ। স্বপ্ন দিয়েচেন। সে-সব গোপন কথা এখন বলব না। নিরিবিলি বলতে হবে। এখন থাক। ধুনি বসাব, জায়গা ঠিক করো।

চণ্ডীমণ্ডপের সামনে বেলতলায় ধুনির আসন হয়ে গেল ঠিক। বর্ষাকাল বলে তালপাতা কেটে দু-খানা ছাউনি দেওয়া হল ওপরে। বেণী কাকা অনেক কাঠ জোগাড় করে আনলেন ধুনির জন্যে। মস্ত এক গর্ত করা হল। আমরা সবাই ঘিরে দাঁড়ালাম রগড় দেখবার জন্যে। খরচপত্র যা হচ্ছে, সবই ওঁদের। আমাদের কী? দুধ আসচে, ঘি আসচে। আলু, আতপচাল, সোনামুগের ডাল, জিরে-মরিচ, লঙ্কা— এলাহি ব্যাপার! নিজেরা পান না-খেলেও কোথা থেকে জুটিয়ে আনতে লাগলে মদন জ্যাঠামশায়।

বাকি আশ্চর্য ব্যাপারটুকু সবই মদন জ্যাঠার বড়ো মেয়ে নিরুদিদির মুখে আমার শোনা। যে-ভাবে শোনা, সে-ভাবেই বনে যাচ্ছি, তেমনি পরপর।

নিরুদিদি কেন জানিনে আমায় বড়ো ভালোবাসে। আমিও ওকে ভালোবাসি। বাসন্তী দিদি ও শান্তি দিদি বড়ো গুমুরে, আমার মতো দেখতে খারাপ ছোটো ছেলের সঙ্গে কথা কইতে তত পছন্দ করেন না। আমিও কাছে ঘেঁষিনে ওঁদের। নিরুদিদি ডেকে আমায় কুলের আচার খাওয়াবে, আমসত্ত্ব খাওয়াবে। আমি বড়ো চারতলা থেকে নোয়াড় পেড়ে দিই ওকে। নোয়াড় খেতে অম্লমধুর, বেশি খেলে জ্বর হয়, অথচ পাকে বর্ষাকালেই ম্যালেরিয়ার সময়েই। লুকিয়ে পড়তে হয়, লুকিয়ে খেতে হয়।

যাক গে।

প্রথম দিনই রাত্রে সন্নিসি ঠাকুর মদন জ্যাঠামশায়কে বললেন— অনেকদূর থেকে আসচি, শুধু তোর জন্যে। সে কথা এখন বলি। কেউ নেই এখানে?

—আজ্ঞে না।

—তোর বয়েস কত?

—আজ্ঞে ষাট।

—আমিও তাই শুনেছিলাম।

—ও।

বেশি কিছু বলতে সাহস হয় না মদন জ্যাঠামশায়ের। ও-বেলার ব্যাপারে মদন জ্যাঠা হেন চিজ, একেবারে জল হয়ে গিয়েচেন।

—তুই রাজা হবি বলে আমাকে স্বপ্ন দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন। গ্রাম হবিবপুর, রানাঘাটের কাছে। বড়ো ছিল, ছোটো হয়ে গিয়েচ, আবার বড়ো হবে।

—বাবার কৃপা।

—যা বলব, তাই করবি?

—নিশ্চয়ই। বাবার হুকুম অমান্য করব?

—কাউকে বলবিনে?

—সে কী কথা?

—যা একটা পেতলের আংটি নিয়ে আয়—

—অষ্টধাতুর হলে হবে? হাতেই আছে।

—হবে। ধুনির আগুনে ফেলে দে—

কিছুক্ষণ কেটে গেল সন্নিসি ঠাকুর চিমটে দিয়ে ছাই সরিয়ে ছাইমাখানো আংটিটা একধারে নিয়ে এসে চিমটের আগা দিয়ে ছুড়ে দিলে মদন জ্যাঠার দিকে।

মদন জ্যাঠা হাতে তুলে নিয়ে ছাই মুছে দেখে বিস্ময়ে কাঠপানা হয়ে গেলেন!

অষ্টধাতুর আংটিটা সোনা হয়ে গিয়েছে! সেই আংটিটাই, কোনো ভুল নেই।

সেই রাত্রে হরু গোয়ালার বাড়ি থেকে খাঁটি গাওয়া ঘি কেনা হল এক সের, সন্নিসি ঠাকুরের ভোজনের জন্য। পাঁচ সিকে দাম নিল গরজ বুঝে।

বেণীমাধব রায়কে বিশেষ আমল দেয়নি সন্নিসি ঠাকুর। তিনি গরুড় পক্ষীর মতো হাতজোড় করে বসে থাকলেও তাঁকে না-সরিয়ে কোনো দরকার কথা বলত না সন্নিসি। মদন জ্যাঠামশায় নীরবে সেবা করে যাচ্ছেন। বিনিময়ে মুখ ফুটে কিছু চান না। হাজার হোক বনেদি বড়ো বংশের ছেলে! কিছু নেই হাতে, তাহলেও খাইয়ে-দাইয়ে তার কাছে কিছু আদায় করে নেবে, এ ক্ষুদ্রত্ব মদন জ্যাঠামশায়ের বংশের ধারা নয়।

তৃতীয় দিন রাত্রে সন্নিসি ঠাকুর বলল— তোর প্রতি প্রসন্ন হয়েছি।

হাতজোড় করে মদন জ্যাঠা বিনীত কণ্ঠে বললেন— বাবার দয়া।

—লোহার কিছু জিনিস ঘরে আছে?

—দা আছে, কুড়ুল আছে, একটা মুগুর আছে আমি ভাঁজতাম, খাঁড়া আছে।

—আচ্ছা—

অল্পক্ষণ ভেবে বললেন— তোর ক-মেয়ের বিবাহ বাকি?

—সব ক-জনের। একটিরও বিয়ে হয়নি। তিনটি।

—কত টাকা দরকার?

—চার হাজারের কম তিনটিকে পার করতে পারব না। বড়োটিতে কিছু বেশি গেলেও যেতে পারে, সে তত দেখতে ভালো না। ওই যে দুধ নিয়ে আসে—

—ওরই কপাল সব চেয়ে ভালো, সব চেয়ে ভালো বর ও-ই পাবে।

—বাবার দয়া।

—আমার দয়া নয়, তোর মেয়ের কপাল। কত টাকার দরকার বললি?

—পাঁচ হাজার।

—যা, দা একখানা নিয়ে আয়।

—বাবা, আঠারো টাকা করে সোনার ভরি। একখানা দা যদি সোনার হয়ে যায়, তাতে পাঁচ হাজার হবে না বাবা!

—বেশ, আর একটা যা-হয় কিছু নিয়ে আয়। তবে লোভ করবিনে, বড়ো মানুষ হবার চেষ্টা করবিনে; ওতে ভগবান বিরূপ হন।

অবশেষে কী-কী জিনিস নিয়ে গেলেন মদন জ্যাঠামশায় সেই রাত্রেই। সন্নিসি ঠাকুর বললেন— আর একটা কাজ বাকি। কত সোনার গহনা আছে তোর বাড়ি?

মদন জ্যাঠামশায় ভেবে বললেন— এই ভরি দশ-বারো।

—সেগুলো নিয়ে আয়।

রাত দুটোর সময় স্ত্রী-কন্যাদের উঠিয়ে তাদের গায়ের গহনা মদন জ্যাঠামশায় নিয়ে গেলেন চেয়ে। নিরুদিদির কানে দুটো ছোটো মাকড়ি ছাড়া আর কোনো সোনা ছিল না, রাত্রে মাকড়ি দুটো খোলা গেল না, খুলতে গেলে কানে লাগে, তাই সে দুটো আর নেওয়া হয়নি।

সন্নিসির পায়ের কাছে সেগুলো নিয়ে রাখতেই তিনি ঈষৎ চটে মদন জ্যাঠাকে বললেন— আমার কাছে নয়, একটা ভাঁড় নিয়ে আয়। তাতে পুরে ধুনির মধ্যে রেখে দে।

তারপর লোহার জিনিসগুলোও ধুনির আগুনে রাখা গেল, কিন্তু তার আগে সন্নিসি ঠাকুর বললেন— তুই এখানে থেকে যা।

মদন জ্যাঠা চলে যাচ্ছেন, হঠাৎ সন্নিসি ওঁকে ডেকে বললেন— আজ হবে না। সব নিয়ে যা।

—হবে না?

—না। আমি আসল কাজ ভুলে গিয়েছি। একটা লতার রস মাখাতে হবে লোহার জিনিসে। সে লতা আছে কি না এ গাঁয়ের বনেজঙ্গলে, কাল খুঁজে দেখব। যদি পাই, তবে আবার কাল এসব জিনিস আনিস। আজ সব নিয়ে যা—

কী করা যাবে! সন্নিসি ঠাকুরের মর্জি যে চরম, সেইমতো চলতে হবে, উপায় নেই।

পরদিন সন্নিসি ঠাকুর ধুনি ছেড়ে কোথায় চলে গেলেন, সন্ধে হয়ে গেল, তবুও আসে না। কিছু খেয়ে যায়নি সে, মদন জ্যাঠামশায়ের বাড়িসুদ্ধু উপবাসী আছে সেজন্যে, অত বড়ো অতিথিকে না-খাইয়ে ওরা খাবে কী করে! রাত আটটা আন্দাজ সময় সন্নিসি ঠাকুর ফিরল। মদন জ্যাঠা কিছু জিজ্ঞেস করতে সাহস করলেন না, শুধু বললেন— দুধ নিয়ে আসি?

—না। কাজ আছে। বাড়ির কেউ অভুক্ত আছে?

—না, না, সে কী কথা? সবাই খেয়ে নেবে? আপনি অভুক্ত যেখানে…।

—সবাই খাবে কেবল তুই ছাড়া।

রাতদুপুরের সময় সন্নিসি ঠাকুর বললেন— যা, সব জিনিস আবার নিয়ে আয়। গহনা ভাঁড়ে নিয়ে আসবি।

মদন জ্যাঠা লোহার ও সোনার জিনিসগুলো নিয়ে এলেন। ছোট্ট একটা মাটির খুরিতে কী একটা সবুজ রস ছিল, সন্নিসি নিজের হাতে লোহার জিনিসে রস মাখল, সোনার জিনিস ছুঁলও না। ধুনির আগুনে লোহার জিনিসগুলো দিয়ে ছাই চাপা দিল।

এই পর্যন্ত মদন জ্যাঠা জানেন, কারণ তারপরেই সন্নিসি ঠাকুরের আদেশে তাঁকে সে স্থান ত্যাগ করতে হল। কেবল মদন জ্যাঠাকে যাবার সময় সন্নিসি বললেন— সোনার গহনা ভালো মনে দিয়ে গেলি তো?

—হ্যাঁ বাবা?

—ঘুমুতে পারবি নিশ্চিন্ত মনে?

—কী যে বলেন বাবা!

—যা।

.

ভোর হয়েছে। খুব ভোর, এখনও অন্ধকার আছে। মদন জ্যাঠামশায় ঘুমুতে পারেননি উত্তেজনায় ও কৌতূহলে। দোতলার ছাদ থেকে মুখ বাড়িয়ে ধুনির জায়গা দেখবার চেষ্টা করলেন মদন জ্যাঠা। সন্নিসি আছেন কি না ভালো বোঝা গেল না।

মদন জ্যাঠা নেমে এলেন। তাড়াতাড়ি গেলেন ধুনির বেলতলায়।

সন্নিসি নেই। তাঁর ঘটি, চিমটে, লাউয়ের খোল কিছুই নেই।

মদন জ্যাঠা অবাক হয়ে গেলেন। সরল লোক, সরল অন্তঃকরণে ভাবলেন, নদীতে চান করতে গেলেন কি উনি? তারপর সংকোচের সঙ্গে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন ধুনির একেবারে সামনে।

ওই তো ভাঁড়টা আছে। ধুনির ছাইয়ে লোহার জিনিসগুলো দেখা যাচ্ছে না। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন। ধুনি ছুঁতে সাহস হল না। বেলা হল। রোদ অনেকখানি উঠে গেল। তখনও সন্নিসি ঠাকুরের দেখা নেই। মদন জ্যাঠা কম্পিত হস্তে কম্পিতবক্ষে ধুনির মধ্যে হাত দিয়ে ভাঁড় উঠিয়ে নিলেন।

ভাঁড়ের মধ্যে সোনার গহনাগুলো সব ঠিক আছে।

ধুনির ছাই সরালেন, লোহার জিনিসগুলো সত্যিকার সোনার জিনিস হয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। সব ঠিক আছে।

মদন জ্যাঠা সেগুলো ফেলে দিয়ে কেঁদে উঠলেন।

—বাবা, ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে গেলে কেন? আমি সোনা চাইনে, তুমি ফিরে এসো, তোমাকে দেখতে চাই বাবা— ফিরে এসো— ও বাবা, ফিরে এসো—

.

লোক জমে গেল। আমরা পাঠশালায় গিয়ে মদন জ্যাঠামশায়ের চারিপাশে মুগ্ধ, ত্রস্ত, বিস্মিত গ্রাম্য লোকের ভিড় দেখতে পেলাম। সবাই হাতে করে সোনার দা, সোনার চাবিতালা দেখতে লাগল। এ ওর হাতে দ্যায়।

সন্নিসিকে খুঁজতে চারিদিকে লোক ছুটল। সারাদিন খোঁজা হল, কেউ কোনো সন্ধানই আনতে পারলে না। মদন জ্যাঠামশায় তখনও কাঁদছেন।


© 2024 পুরনো বই