ঘোষপাড়ার দোলের মেলায় যাইবার পথে গঙ্গার ধারে মঠটা পড়ে।
মঠ বলিলে ভুল বলা হয়। ঠিক মঠ বলিতে যাহা বুঝায়, সে-ধরনের কিছু নয়। ছোটো খড়ের খান চার-পাঁচ ঘর মাঠের মধ্যে। একধারে একটা বড়ো তেঁতুল গাছ। গঙ্গার একটা ছোটো খাল মাঠের মধ্যে, খানিকটা ঢুকিয়া শুকাইয়া মজিয়া গিয়াছে। জোয়ারের সময়ে তবুও খালটা কানায়-কানায় ভরিয়া ওঠে। ঠিক সেইসময়ে জেলেরা দোয়াড়ি পাতিয়া রাখে। জোয়ারের তোড়ের মুখে মাছ খালে উঠিয়া পড়ে, ভাটার টানে নামিবার সময় দোয়াড়ির কাঠিতে আটকাইয়া আর বাহির হইতে পারে না। কাছেই একটু দূরে শংকরপুর বলিয়া ছোটো গ্রাম।
কিছুকাল পূর্বে রেল কোম্পানি একটা ব্র্যাঞ্চ লাইন খুলিবার উদ্দেশ্যে খানিকটা জমি সার্ভে করাইয়া মাটির কাজ আরম্ভ করাইয়াছিলেন, কোনো কারণে লাইন বসানো হয় নাই। মাঠের উত্তর-দক্ষিণে লম্বা প্রকাণ্ড উঁচু রেলওয়ে, বাঁধটার দুই পাশের ঢালুতে নানাজাতীয় কাঁটা গাছ, আকন্দ ও অন্যান্য বুনো গাছপালা গজাইয়া বন হইয়া আছে। আকন্দ গাছটাই বেশি।
খুঁটি দেবতার অপূর্ব কাহিনি এইখানেই শুনিয়াছিলাম।
গল্পটা বলা দরকার—
শংকরপুর গ্রামের পাশে ছিল হেলেঞ্চা শিবপুর। এখন তাহার কোনো চিহ্ন নাই। বছর পনেরো পূর্বে গঙ্গায় লাটিয়া গিয়া মাঝগঙ্গার ওই বড়ো চরটার সৃষ্টি করিয়াছে। পূর্বস্থলীর চৌধুরি জমিদারদের সহিত ওই চরার দখল লইয়া পুরোনো প্রজাদের অনেক দাঙ্গা ও মকদ্দমা হইয়াছিল। শেষপর্যন্ত প্রজারাই মামলায় জেতে বটে, কিন্তু চরটা চিরকালই বালুকাময় থাকিয়া গেল, আজ দশ বৎসরের মধ্যে চাষের উপযুক্ত হইল না। পাঞ্জা আসিলেও চরটা প্রজাদের কোনো উপকারে লাগে না, অনাবাদী অবস্থায় পড়িয়াই থাকে। আজকাল কেহ কেহ তরমুজ, কাঁকুড় লাগাইতেছে দেখা যায়।
এই গ্রামে রাঘব চক্রবর্তী পূজারি বামুন ছিলেন।
রাঘব চক্রবর্তীর কেহ ছিল না। পৈতৃক আমলের খড়ের বাড়িতে একা বাস করিতেন, একাই নদীর ঘাট হইতে জল আনিয়া, বনের কাঠ কুড়াইয়া রাঁধিয়া-বাড়িয়া খাইতেন। গায়ে শক্তিও ছিল খুব, পিতামহের আমলের সেকেলে ভারী পিতলের ঘড়া করিয়া দু-টি বেলা এক পোয়া পথ দূরবর্তী গঙ্গা হইতে জল আনিতেন। ক্লান্তি বা আলস্য কাহাকে বলে জানিতেন না।
রাঘব চক্রবর্তী পয়সা চিনিতেন অত্যন্ত বেশি। বাঁশের চটার পালা তৈয়ার করিয়া কুড়ি দরে ডোমেদের কাছে ঘোষপাড়ার দোলে বিক্রয় করিতে পাঠাইয়া দিতেন। আবার সময়ে সময়ে ঝুড়ি, কুলো, ডালা বুনিয়া বিক্রয় করিতেন। মাটির প্রতিমা গড়িতে পারিতেন। উলুখড়ের টুপি, ফুল-ঝাঁটা তৈয়ার করিতেন। সুন্দর কাপড় রিপু করিতে পারিতেন। এসব তাঁহার উপরি আয়ের পন্থা ছিল। সংসারে কেহই নাই, না স্ত্রী, না ছেলে-মেয়ে— কে তাঁহার পয়সা খাইবে; তবুও রাঘব টাকা জমাইয়া যাইতেন। একটা মাটির ভাঁড়ে পয়সাকড়ি রাখিতেন, সপ্তাহে একবার বা দুইবার ভাঁড়টি উপুড় করিয়া ঢালিয়া সব পয়সাগুলি সযত্নে গুনিতেন। ভাঁড়ের মধ্যে যাহা রাখিতেন, পারতপক্ষে তাহা আর বাহির করিতেন না। গ্রামের সবাই বলিত, রাঘব চক্রবর্তী হাতে বেশ দু-পয়সা গুছাইয়া লইয়াছেন।
একদিন দুপুরে পাক সারিয়া রাঘব বসিবার উদ্যোগ করিতেছেন, এমন সময়ে একখানা ছই-ঘেরা গোরুর গাড়ি আসিয়া তাঁহার উঠানে থামিল। গাড়ি হইতে একটি পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের যুবক বাহির হইয়া আসিল। রাঘব চিনিলেন, তাঁর দূর-সম্পর্কীয় ভাগিনেয় নন্দলাল।
নন্দলাল আসিয়া মামার পায়ের ধূলা লইল।
রাঘব বলিলেন— এসো বাবা। ছইয়ের মধ্যে কে?
নন্দলাল সলজ্জ মুখে বলিল— আপনার বউমা।
—ও! তা কোথায় যাবে? ঘোষপাড়ার দোল দেখতে বুঝি?
নন্দলাল অপ্রতিভের সুরে বলিল— আজ্ঞে না, আপনার আশ্রয়েই— আপাতত— মানে, বামুনহাটির বাড়ি-ঘর তো সব গিয়েছে। গত বছর মাঘ মাসে বিয়ে— তা এতদিন বাপের বাড়িতে ছিল। সেখান থেকে না আনলে আর ভালো দেখাচ্ছে না, তাই নিয়ে আজ একেবারে এখানেই—
রাঘব বিশেষ সন্তুষ্ট হইলেন না। তিনি চিরকালই একা থাকিয়া আসিয়াছেন, একা থাকিতেই ভালোবাসেন। এ আবার কোথা হইতে উপসর্গ আসিয়া জুটিল, দ্যাখো কাণ্ড!
যাহা হউক, আপাতত বিরক্তি চাপিয়া তিনি ভাগিনেয়-বধূকে নামাইয়া লইবার ও পুবদিকের ভিটার ছোটো ঘরখানাতে আলাদা থাকিবার বন্দোবস্ত করিলেন।
সন্ধ্যার পর ভাগিনেয়কে জিজ্ঞাসা করিলেন— এখানে নিয়ে তো এলে, হাতে কিছু আছে-টাছে তো? আমার এখানে আবার বড়ো টানাটানি। ধান অন্যবার যা হয়, এবার তার সিকিও পাইনি। যজমানদের অবস্থাও এবার যা—
নন্দ এ কথার কিছু সন্তোষজনক জবাব দিতে পারিল না।
রাঘব বলিলেন— বউমার হাতে কিছু নেই?
—ও কোথায় পাবে! তবে বিয়ের দরুন গয়না কিছু আছে। ওর ওই হাতবাক্সটাতে আছে, যা আছে।
—জায়গা ভালো নয়। গয়নাগুলো বাক্সে রাখাই আমি বলি বেশ। পাঁচজন টের না-পায়। আমি আবার থাকি গায়ের এক কোণে পড়ে, আর এই তো সময় যাচ্ছে? ওগুলো আরও সাবধান করা দরকার।
দিন দুই পরে নন্দলাল মামাকে বলিল— আমাকে আজ একবার বেরুতে হচ্ছে মামা। একবার বীজপুরে যাব। লোকো কারখানায় একটা কাজের সন্ধান পেয়েছি, একটু দেখে আসি।
নন্দলাল ইতিপূর্বেও বীজপুরের কারখানায় কাজ খুঁজিয়াছে, কিন্তু তেমন লেখাপড়া জানে না বলিয়া কাজ জোটাইতে পারে নাই। বলিল— লোকো কারখানায় যদি মুগুর ঠ্যাঙাতে পারি তবে এক্ষুনি কাজ জোটে। ভদ্দর লোকের ছেলে, তা তো আর পেরে উঠিনে। এই আমার সঙ্গে পাঠশালায় পড়ত মহেন্দ্র, তারা জেতে মুচি। সে বাইসম্যানি করছে, সাড়ে সাত টাকা হপ্তা পায়— দিব্যি আছে। কিন্তু তাদের ওসব সয়। আমাকে বলেছিল হেডমিস্ত্রির কাছে নিয়ে যাবে, তা আমার দ্বারা কি আর হাতুড়ি পিটুনো চলবে?
.
পরদিন খুব ভোরে নন্দলাল বাটি আসিবে। সে রাত্রেই স্টেশনে নামিয়া ছিল, কিন্তু অন্ধকারে এতটা পথ আসিতে না পারিয়া সেখানে শুইয়া ছিল, শেষরাত্রের দিকে জ্যোৎস্না উঠিলে রওনা হইয়াছে।
নন্দলাল বাড়ি ফিরিয়া দেখিল তখনও মামা ওঠেন নাই, পুবের ভিটার ঘরে স্ত্রী-ও তখন ঘুমাইতেছে। স্ত্রীকে জাগাইতে গিয়া দেখিল, গহনার বাক্স ঘরের মধ্যে নাই। স্ত্রীকে উঠাইয়া বলিল— গহনার বাক্স কোথায়?
স্ত্রী অবাক হইয়া গেল। বলিল— আরে ঠাট্টা করা হচ্ছে বুঝি? এই তো শিয়রে এইখেনে ছিল। লুকিয়েছো বুঝি?
কিছুক্ষণ পরে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই মাথায় হাত দিয়া বসিল। ঘরের কোথাও বাক্স নাই। খোঁজাখুঁজি অনেক করা হইল। মামাও বিছানা ছাড়িয়া উঠিয়া আসিলেন। চুরির কথা শুনিয়া অবাক হইলেন, নিজে চারিদিকে ছুটাছুটি করিয়া বাক্সের বা চোরের খোঁজ করিতে লাগিলেন। প্রতিবেশীরাও আসিল, থানাতে খবর গেল— কিছুই হইল না।
নন্দলালের স্ত্রীর বয়স কুড়ি-একুশ। রং টকটকে ফর্সা, মুখ সুশ্রী, বড়ো শান্ত ও সরল মেয়েটি। তার বাপের বাড়ির অবস্থা বেশ ভালো। কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে তৃতীয় পক্ষে বিবাহ করিয়া তার বাবা পূর্ব পক্ষের সন্তান-সন্তদিগকে এখন আর দেখিতে পারেন না। বিবাহের সময় এই গহনাগুলি তিনিই মেয়েকে দিয়াছিলেন এই হিসেবে যে, গহনাগুলি লইয়া মেয়ে যেন বাপের বাড়ির উপর সকল দাবি-দাওয়া ত্যাগ করে। পিতার কর্তব্য এইখানেই তিনি শেষ করিলেন।
নন্দলালের অবস্থা কোনোকালেই ভালো নয়, বিবাহের পর যেন তাহা আরও খারাপ হইয়া পড়িল। ওই গহনা ক-খানি দাঁড়াইল সংসারের একমাত্র সম্বল। গহনাগুলির উপর নন্দলাল বার-দুই ঝোঁক দিয়াছিল— একবার পাটের ব্যাবসা ফাঁদিতে, আর একবার মুদির দোকান খুলিতে শিমুরালির বাজারে। কিন্তু নন্দলালই শেষপর্যন্ত কী ভাবিয়া দুইবারই পিছাইয়া যায়। বউও বলিয়াছিল— দ্যাখো ওই তো পুঁজিপাটা, আর তো নেই কিছু; যখন আর কোনো উপায় থাকবে না তখন ওতে হাত দিও। এখন থাক।
গহনার বাক্স চুরি যাওয়ার দিন পাঁচ-সাত পরে একদিন ভোরে উঠিয়া দেখিল, স্ত্রী বিছানায় নাই। বাহিরে আসিয়া দেখিল, বউ ঘরের ছাইগাদা ঘাঁটিয়া কী দেখিতেছে। স্বামীকে দেখিয়া কেমন এক ধরনের হাসিয়া বলিল— ওগো, এসো একটু খোঁজো না এর মধ্যে! তুমি উত্তর দিকটা দ্যাখো।
নন্দলাল সস্নেহে স্ত্রীকে ধরিয়া দাওয়ায় আনিয়া বসাইল। পাতকুয়ার ঠান্ডা জল দিয়া স্নান করাইয়া দিল, নানারকমে বুঝাইল, কিন্তু সেই যে বউটির মস্তিষ্ক-বিকৃতি শুরু হইল— এ আর কিছুতেই সারানো গেল না। পাছে স্বামী বা কেহ টের পায়, এই ভয়ে যখন কেউ কোনো দিকে না থাকে, তখন চুপি চুপি ছাইগাদা হাতড়াইয়া খুঁজিয়া কী দেখিতে থাকিবে। এই একমাত্র ব্যাপার ছাড়া তাহার মস্তিষ্ক-বিকৃতির কিন্তু অন্য কোনো লক্ষণ ছিল না। অন্যদিকে সে যেমন গৃহকর্মনিপুণা সেবাপরায়ণা কর্মিষ্ঠা গৃহস্থবধূ— তেমনই রহিল।
একদিন সে মামাশ্বশুরের ঘরে সকালে ঝাঁট দিতে ঢুকিয়াছে, মামাশ্বশুর রাঘব চক্রবর্তী তখন ঘরে ছিলেন না; ঘরের একটা কোণ পরিষ্কার করিবার সময়ে সে একখানা কাগজ সেখানে কুড়াইয়া পাইল। কে যেন দলা পাকাইয়া কাগজখানাকে কোণটাতে ফেলিয়া রাখিয়াছিল। কাগজখানা দেখিয়া সে অবাক হইয়া গেল— এ যে তার গহনার বাক্সের তলায় পাতা ছিল! পাতলা বেগুনি রঙের কাগজ, স্যাকরারা এই কাগজে নতুন তৈয়ার সোনার গহনা জড়াইয়া দেয়।— এ কাগজখানাও সেইভাবে পাওয়া, স্যাকরার দোকান হইতে আসিয়াছিল, সেই হইতে তাহার গহনা বাক্সের তলায় পাতা থাকিত। সেই কোণ ছেঁড়া বেগুনি রঙের পাতলা কাগজখানি!…
বউমাটি কাহাকেও কিছু বলিল না, স্বামীকেও নয়। মনের সন্দেহ খুলিয়া কাহারও কাছে প্রকাশ করিতে পারিল না। কিন্তু ভাবিয়া ভাবিয়া শেষে তাহার খুব অসুখ হইল। জ্বর অবস্থায় নির্জন ঘরে একা বিছানায় শুইয়া তক্তপোশের একটা বাঁশের খুঁটিকে সম্বোধন করিয়া সে করজোড়ে বার বার বলিত— ওগো খুঁটি, আমি তোমার কাছে দরখাস্ত করছি, তুমি এর একটা উপায় করে দাও, পায়ে পড়ি তোমার! একটা উপায় তোমায় করতেই হবে! আর কাউকে বলতে পারিনে, তোমাকেই বলছি…
বাঁশের খুঁটিটা ছাড়া তার প্রাণের এ আগ্রহ ভরা কাতর আকুতি আর কেহই শুনিত না। কতবার রাত্রে, দিনে, নির্জনে খুঁটিটার কাছে এ নিবেদন সে করিত; সে-ই জানে।
তাহাদের বাড়ির সামনে প্রকাণ্ড মাঠ গঙ্গার কিনারা পর্যন্ত সবুজ ঘাসে ভরা। তারপরেই খাড়া পাড় নামিয়া গিয়া জল ছুঁইয়াছে। জল সেখানে অগভীর, চওড়াতেও হাত দশ-বারো মাত্র, পরেই গঙ্গার বড়ো চরটা। সারা বছরেই চরায় জলচর পক্ষীর ঝাঁক চরিয়া বেড়ায়। চরার বাহিরের গভীর বড়ো গঙ্গার দিকে না-গিয়া তারা গঙ্গার এই ছোটো অপরিসর অংশটা ঘেঁষিয়া থাকে। কন্টিকারীর বনে চরার বালি প্রায় ঢাকিয়া ফেলিয়াছে। বারো মাস বেগুনি ফুল ফুটিয়া নির্জন বালির চরা আলো করিয়া রাখে। মাঠে কোনো গাছপালা নাই। ছেলেদের ফুটবল খেলার মাঠের মতো সমতল ও তৃণাবৃত; দক্ষিণে ও বাঁয়ে একদিকে বড়ো রেলওয়ে বাঁধটা ও অন্যদিকে দূরবর্তী গ্রামসীমার বনরেখার কোল পর্যন্ত বিস্তৃত। দুই-এক সারি তালগাছ এখানে-ওখানে ছাড়া এই বড়ো মাঠটাতে অন্য কোনো গাছ চোখে পড়ে না কোনো দিকে।
এই বিশাল মাঠে প্রতিদিন সকাল হয়, সূর্য মাঝ-আকাশে দুপুরে আগুন ছড়ায়, বেলা ঢলিয়া বৈকাল নামিয়া আসে, গোধূলিতে পশ্চিম দিক কত কী রঙে রঞ্জিত হয়। চাঁদ ওঠে— সারা মাঠ, চরা, রেলওয়ে বাঁধ, ওপাশের বড়ো গঙ্গাটা, জ্যোৎস্নায় প্লাবিত হইয়া যায়। কিন্তু কখনো কোনোকালে রাঘব চক্রবর্তী বা তাঁহার প্রতিবেশীরা এই সুন্দর পল্লিপ্রান্তরের প্রাকৃতিক লীলার মধ্যে কোনো দেবতার পূণ্য আবির্ভাব কল্পনা করেন নাই, প্রয়োজন বোধও করেন নাই। সেখানে আজ সর্বপ্রথম এই নিরক্ষরা বিকৃত-মস্তিষ্কা বধূটি বৈদিক যুগের মন্ত্রদ্রষ্টা বিদূষীর মতো মনে-প্রাণে খুঁটি-দেবতার আহ্বান করিল।
আমি এই মাঠেই বৈকালে দাঁড়াইয়া কথাটা ভাবিতেছিলাম। কথাটার গভীরতা সেদিন সেখানে যতটা উপলব্ধি করিয়াছিলাম, এমন আর বোধ হয় কোথাও করিব না।
নন্দলাল স্ত্রীর অবস্থা দেখিয়া বড়ো বিব্রত হইয়া পড়িল। সে স্ত্রীকে ভালোবাসিত, নানারকম ঔষধ, জড়িবুটি, শিকড়-বাকড় আনিয়া স্ত্রীকে ব্যবহার করাইল। তিরোলের পাগলি-কালীর বালা পরাইল, যে-যাহা বলে তাহাই করিতে লাগিল; কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না। একটা সুফল দেখিয়া সে খুশি হইল যে, আজকাল স্ত্রী সকালে উঠিয়া ছাইগাদা হাতড়াইতে বসে না। তবুও সংসারের কাজকর্মগুলি অন্যমনস্কভাবে করে, ভাত বা তরকারি পুড়াইয়া ধরাইয়া ফেলে, নয় তো ডালে খানিকটা বেশি নুন দেয়, ভালো করিয়া কথা বলে না— ইহাই হইল তাহার বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ।
মাস-দুই কাটিয়া গেল। শ্রাবণ মাস। বর্ষায় ঢল নামিয়া বড়ো গঙ্গা ও ছোটো গঙ্গা একাকার করিয়া দিল। চরা ডুবিয়া গেল। কূলে কূলে গেরিমাটির রঙের জলে ভরতি। এই সময়ে নন্দলালের আর্থিক অবস্থা অত্যন্ত খারাপ হইয়া উঠিল। হাতে পূর্বে যাহা কিছু ছিল, সবই খরচ হইয়া গিয়াছে— এদিকে চাকরিও জুটিল না।
রাঘব চক্রবর্তী ভাগিনেয়কে ডাকিয়া বলিলেন— কোনো কিছু একটা দেখে নিতে পারলে না। তা দিন কতক এখন বউমাকে বাপের বাড়ি রেখে তুমি কলকাতার দিকে গিয়ে কাজকর্মের চেষ্টা করো, নইলে আর কী করে চালাই বলো! এই তো দেখছ অবস্থা— ইত্যাদি।
নন্দলাল পড়িয়া গেল মহা বিপদে। না আছে চাকরি, না আছে সম্বল। ওদিকে অসুস্থা তরুণী বধূ ঘরে। বীজপুরের কারখানায় কয়েক বার যাতায়াতের ফলে একজন রঙের মিস্ত্রির সঙ্গে বন্ধুত্ব হইয়া গিয়াছিল। তাহাকে বলিয়া-কহিয়া তাহার বাসায় বউকে লইয়া গিয়া আপাতত তুলিল। দুইটি মাত্র ঘর— একখানা ঘরে মিস্ত্রি একলা থাকে, অন্য খরঘানি নন্দলালকে ছাড়িয়া দিল। মিস্ত্রি গাড়িতে অক্ষর লেখে, সে চেষ্টা করিয়া সাহেবকে ধরিয়া নন্দলালের জন্য একটা ঠিকা কাজ জুটাইয়া দিল। একটা বড়ো লম্বা রেক আগাগোড়া পুরোনো রং উঠাইয়া নতুন রঙা করা হইবে, নন্দলাল সেটিকে রং করিবার জন্য এক মাসের চুক্তিতে নিযুক্ত হইল।
রাঘব চক্রবর্তী কিছুকালের জন্য হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিলেন। হঠাৎ একদিন তিনি অনেক জনমজুর ধরিয়া বাড়ির উঠান পরিষ্কার করাইতে লাগিলেন, ভালো করিয়া একজোড়া হরিণের চামড়ার জুতো কিনিয়া আনিলেন, এমনকী পূজার সময় একবার কাশী বেড়াইতে যাইবা সংকল্প করিয়া ফেলিলেন।
আশ্বিনের প্রথমে বর্ষা একটু কমিল। রাঘব চক্রবর্তী বাড়ির চারিধারে পাঁচিল গাঁথিবার মিস্ত্রি খাটাইতে ছিলেন। সারাদিন পরিশ্রমের পর, গঙ্গায় গা ধুইয়া আসিয়া সন্ধ্যার পরই তিনি শুইয়া পড়িলেন।
অত পরিশ্রম করিবার পর তিনি শুইলেন বটে, কিন্তু তাঁহার ঘুম আদৌ আসিল না। ঘুমাইবার বৃথা চেষ্টায় সারারাত্রি ছটফট করিয়া শেষরাত্রে উঠিয়া তামাক খাইতে বসিলেন। দিনমানেও দুপুরে ঘুমাইবার চেষ্টা করিলেন, কিছুতেই ঘুম হইল না। সারাদিনের মজুর খাটাইবার পরিশ্রমের ফলে শরীর যা গরম হইয়াছে। সেদিনও যখন ঘুম আসিল না, তখন পাঁচিল গাঁথার জনমজুরকে বলিয়া দিলেন— এখন দিন-দুই কাজ বন্ধ থাকুক।
পরদিন রাত্রে সামান্য কিছু আহার করিয়া ঠান্ডা জল মাথায় দিয়া ও হাত-পা ধুইয়া সকাল সকাল শুইয়া পড়িলেন। প্রথমটা ঘুম না আসাতে ভাবিলেন ঘুমের সময় এখনও ঠিক হয় নাই কিনা, তাই ঘুম আসিতেছে না। এ-পাশ ও-পাশ করিতে লাগিলেন। দশটা…এগারোটা…রোটা…রাঘব প্রাণপণে চক্ষু বুজিয়া রহিলেন। নানাভাবে ঘুরিয়া ফিরিয়া শুইয়া দেখিলেন— ঘুম এখনও আসে না কেন? আরও ঘণ্টা দুই কাটিয়া গেল, ঘুমের চিহ্নও নাই। চাঁদ ঢলিয়া পড়িল, জানলা দিয়া যে-বাতাস বহিতেছে তাহা আগেকার অপেক্ষা ঠান্ডা। রাঘবের কেমন ভয় হইল, তবে বোধ হয় আজও ঘুম হইবে না। ভাবিতেও বুকটা কেমন করিয়া উঠিল। আজ রাত্রে ঘুম না হইলে কাল তিনি বাঁচিবেন কী করিয়া? উঠিয়া মাথায় আর একবার জল দিলেন— আবার শুইলেন, আবার প্রাণপণে ঘুমাইবার চেষ্টা করিলেন। কিন্তু এই ভাবিয়া তাঁহার মাথা গরম হইয়া উঠিল— ঘুম, ঘুম যদি না-আসে? তাহা হইলে? রাত্রি ফরসা হইয়া কাক-কোকিল ডাকিয়া উঠিল, তখনও হতভাগ্য রাঘব চক্রবর্তী বিছানায় ছটফট করিতে করিতে ঘুমাইবার বৃথা চেষ্টা করিতেছেন।
ঠিক এইভাবে কাটিয়া গেল আরও আট দিন। এই আট দিনের মধ্যে কী দিনে, কী রাতে রাঘবের চোখে এতটুকু ঘুম আসিল না। পলকের নিমিত্ত রাঘব পাগলের মতো হইলেন, যে যাহা বলিল তাহাই করিয়া দেখিলেন। ডাব খাইয়া ও পুকুরের পচা পাঁক মাথায় দিন-রাত দিয়া থাকিতে থাকিতে নিউমোনিয়া হইবার উপক্রম হইল। অবশেষে বাঁশবেড়ের মনোহর ডাক্তারের ঔষধ ব্যবহার করিয়া দেখিলেন।
কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না। আরও দিন ছয়-সাত কাটিয়া গেল। রাঘব সন্ধ্যার পরেই হাত-পা ধুইয়া মন স্থির করিয়া শুইতে যান। কিন্তু বালিশে মাথা দিয়াই বুকের মধ্যে গুরু-গুরু করে, আজও বোধ হয় ঘুম…বাকিটা আর রাঘব ভাবিতে পারেন না।
রাজমিস্ত্রির দল কাজ শেষ না-করিয়াই চলিয়া গেল। উঠানে জঙ্গল বাঁধিয়া উঠিল। রাঘব স্নানাহার করিতে চান না, চলাফেরা করিতে চান না, সব সময়েই ঘরের দাওয়ায় চুপ করিয়া বসিয়া থাকেন। তামাক খাইবার রুচিও ক্রমে হারাইয়া ফেলিলেন। লোকজনের সঙ্গে ভালো করিয়া কথাবার্তা কহিতে ভালোবাসেন না, পয়সার ভাঁড় উপুড় করিয়া গুনিয়া দেখিবার স্পৃহাও চলিয়া গেল।
চিকিৎসা তখনও চলিতেছিল। গ্রামের বৃদ্ধ শিব কবিরাজ বলিলেন— তোমার রোগটা হচ্ছে মানসিক। ঘুম হবে না এ-কথা ভাবো কেন শোবার আগে? খুব সাহস করবে, মনে মনে জোর করে ভাববে— আজ ঘুম হবে, নিশ্চয়ই হবে, আজ ঠিক ঘুমুবো— এরকম করে দেখো দিকি? আর, সকাল সকাল শুতে যেও না; যে সময় যেতে, সেই সময় যাবে।
কবিরাজের পরামর্শ মতো রাঘব সন্ধ্যার পর পুরোনো দিনের মতো রন্ধন করিয়া আহার করিলেন। দাওয়ায় বসিয়া গুন-গুন করিয়া গানও গাহিলেন। তারপর ঠান্ডা জলে হাত-পা ও মাথা ধুইয়া শয়ন করিতে গেলেন। মনে মনে দৃঢ় সংকল্প করিলেন— আজ তিনি নিশ্চয়ই ঘুমাইবেন— নিশ্চয়ই!
কিন্তু বালিশে মাথা দিয়াই বুকটা কেমন যেন করিয়া উঠিল। ঘুম যদি না-হয়? পরক্ষণেই মন হইতে সে-কথা ঝাড়িয়া ফেলিয়া দিলেন— নিশ্চয়ই ঘুম হইবে। পাশ ফিরিয়া পাশবালিশটা আঁকড়াইয়া শুইলেন। ঘরের দেওয়ালের একখানা বাঁধানো রাধাকৃষ্ণের ছবি বাতাস লাগিয়া ঠক-ঠক শব্দ করিতেছে দেখিয়া আবার বিছানা হইতে উঠিয়া সেখানি নামাইয়া রাখিলেন। পুনরায় শুইয়া পড়িয়া জোর করিয়া চোখ বুজিয়া রহিলেন। আধঘণ্টা… একঘণ্টা…এইবার তিনি নিশ্চয়ই ঘুমাইবেন। বুকের মধ্যে গুর-গুর করিতেছে কেন?— না, এইবার ঘুমাইবেনই।
দুই ঘণ্টা…তিন ঘণ্টা…। রাত একটা, গ্রাম নিশুতি, কোনোদিকে সাড়াশব্দ নাই। ক্যাওরা-পাড়ায় এক-আধটা কুকুরের ঘেউ ঘেউ ছাড়া।
না— রাত বেশি হইয়াছে, আর রাঘব জাগিয়া থাকিবেন না— এইবার ঘুমাইবেন। বাঁ-দিকে শুইয়া সুবিধা হইতেছে না। হাতখানা বেকায়দায় কেমন যেন মুচড়াইয়া আছে। ডানদিকে ফিরিয়া শুইবেন। ছারপোকা— না! ছারপোকা তো বিছানায় নাই? যাহা হউক জায়গাটা এইবার হাত বুলাইয়া লওয়া ভালো।— যাক, এইবার ঘুমাইবেন। এতক্ষণে নিশ্চিন্ত হইলেন। রাত দুইটা।
কিন্তু নিশ্চিন্ত হইতে পারিলেন না। একটা হাট কী মেলা কোথায় যেন বসিয়াছে। রাঘব দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া দেখিতেছেন। সব লোক চলিয়া গেল, তবুও দু-দশ জন এখনও হাটচালিতে ভিড় করিয়া দাঁড়াইয়া শুঁটকি-চিংড়ি মাছের দর কষাকষি করিতেছে। ইহারা বিদায় হইলেই রাঘব নিশ্চিন্ত মনে ঘুমাইবেন। একটা লোক চলিয়া গেল— দুইটা— তিনটা— এখনও জন সাতেক লোক বাকি। রাঘব তাহাদের নিকট গিয়া চলিয়া যাইবার অনুরোধ করিতেছেন, অনুনয় বিনয় করিতেছেন, হাত জোড় করিতেছেন— তিনি এইবার একটু ঘুমাইবেন। দোহাই তাহাদের, তাহারা চলিয়া যাক। এখনও জন তিনেক বাকি। রাঘবের মনে উল্লাস হইল, আর বিলম্ব নাই।— এখনও দুইজন। এই দুইজন চলিয়া গেলেই ঘুমাইবেন। আর একজন মাত্র!…মিনিট পনেরো দেরি— তাহা হইলেই ঘুমাইবেন।
হঠাৎ রাঘব বিছানার উপর উঠিয়া বসিলেন। হাট তো কোথাও বসে নাই? কীসের হাট? কোথাকার হাট?— এসব কী আবোল-তাবোল ভাবিতেছেন তিনি? ঘুম তাহা হইলে বোধ হয়…
রাঘব কথাটা ভাবিতেও সাহস করিলেন না।
কত রাত?— ওটা কীসের শব্দ? বীজপুরের কারখানায় ভোরের বাঁশি বাজিতেছে নাকি?— সে তো রাত চারটায় বাজে। এখনই রাত চারটা বাজিল। অসম্ভব! যাক, যথেষ্ট বাজে কথা ভাবিয়া তিনি রাত কাটাইয়াছেন। আর নয়। এবার তিনি ঘুমাইবেন।
অল্প একটু ঘোর আসিয়াছিল কি না কে জানে? ভোরের ঠান্ডা বাতাসে তা তো একটু আসিতেও পারে। কিন্তু রাঘবের দৃঢ় বিশ্বাস তিনি এতটুকু ঘুমান নাই— চোখ চাহিয়াই ছিলেন। হঠাৎ একটা ব্যাপার ঘটিল। বিস্মিত রাঘব দেখিলেন, তাঁহার খাটের পাশের বাঁশের খুঁটিটা যেন ধীরে ধীরে একটা বিরাটকায় মূর্তি পরিগ্রহ করিয়া তাঁহার মাথার শিয়রে আসিয়া দাঁড়াইল; ব্যঙ্গের সুরে অঙ্গুলি হেলাইয়া বলিল— মূর্খ! ঘুমাইবার ইচ্ছা থাকে তো কালই গহনার বাক্স ফেরত দিস! ভাগ্নে-বউয়ের গহনা চুরি করেছিস, লজ্জা করে না?…
বীজপুরের কারখানার বাঁশির শব্দে রাঘবের ঘোর কাটিয়া গেল। ফরসা হইয়া গিয়াছে। রাঘবের বুক ধড়ফড় করিতেছে, চোখ জ্বালা করিতেছে, মাথা যেন বোঝা, শরীর ভাঙিয়া পড়িতে চাহিতেছে। না, তিনি একটুও ঘুমান নাই— এতটুকু না। বাঁশের খুঁটিটুঁটি কিছু না— ও সব মাথা গরমের দরুন…
কিন্তু ঠিক একই স্বপ্ন রাঘব পর পর দুইদিন দেখিলেন। ঠিক একই সময়ে— ভোর রাত্রে, বীজপুরের কারখানার বাঁশি বাজিবার পূর্বে।…ঘুমাই নাই, তবে স্বপ্ন কোথা হইতে আসিবে?
.
বীজপুরের বাসায় অন্য কেহ তখন ছিল না। নন্দলাল কাজে বাহির হইয়াছে, নন্দলালের স্ত্রী সাবান দিয়া কাপড় কাচিতেছিল। হঠাৎ রুক্ষ চুল, জীর্ণ চেহারার মামাশ্বশুরকে বাসায় ঢুকিতে দেখিয়া সে বিস্মিত মুখে একবার চাহিয়া লজ্জায় ঘোমটা দিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। রাঘব চক্রবর্তী একবার চারিদিকে চাহিয়াই কাছে আসিয়া ভাগিনেয়-বধূর পা জড়াইয়া ধরিয়া কাঁদিয়া ফেলিলেন। বলিলেন— মা তুমি মানুষ নও, তুমি কোনো ঠাকুর-দেবতা হবে! ছেলে বলে আমায় মাপ করো!
তারপর পুঁটুলি খুলিয়া সব গহনাগুলি ভাগিনেয় বধূর হাতে প্রত্যার্পণ করিলেন, কিন্তু বাসায় থাকিতে রাজি হইলেন না।
—নন্দলালের কাছে কিছু বলবার মুখ নেই আমার। তুমি মা, তোমার কাছে বলতে লজ্জা নেই, বুঝলে না? কিন্তু তার কাছে…
.
ইহার মাস-ছয় পরে রাঘব চক্রর্তীর গুরুতর অসুখের সংবাদ পাইয়া নন্দলাল সস্ত্রীক গোরুর গাড়ি করিয়া তাঁহাকে দেখিতে গেল। ইহারা যাইবার দিন সাতেক পরে রাঘবের মৃত্যু হইল। মৃত্যুর পূর্বে তিনি তাঁহার যাহা কিছু জমিজমা সব উইল করিয়া ভাগিনেয়-বধূকে দিয়া গেলেন। কিছু পোঁতা-টাকার সন্ধানও দিয়া গেলেন।
নন্দলালের স্ত্রীকে কাছে বসাইয়া নিজের স্বপ্নবৃত্তান্ত বলিয়া গেলেন। বলিলেন— এই যে দেখছ ঘর, এই যে বাঁশের খুঁটি, এর মধ্যে দেবতা আছেন মা! বিশ্বাস করো আমার কথা।
ভাগিনেয়-বধূ শিহরিয়া উঠিল। সেই ঘর, সেই বাঁশের খুঁটি!…
.
রাঘবের মৃত্যুর পরে ষোলো সতেরো বছর নন্দলাল মামার ভিটাতে সংসার পাতিয়া বাস করিয়াছিল। বধূটি ছেলেমেয়েদের মা হইয়া সচ্ছল ঘরকন্নার গৃহিণীপনা করিতে করিতে প্রথম জীবনের দুঃখকষ্টের কথা ভুলিয়া গিয়াছিল এবং সঙ্গে সঙ্গে খুঁটি দেবতার কথাও ভুলিয়াছিল। হয়তো দুঃখের মধ্যদিয়া যে আন্তরিকতাপূর্ণ আবেগকে জীবনে একবার মাত্র লাভ করিয়াছিল, আর কখনো জীবনপথে তাহার সন্ধান মেলে নাই।
.
বছর সতেরো পরে নন্দলালের স্ত্রী মারা গেল। নন্দলালের বড়ো ছেলের তখন বিবাহ হইয়াছে ও বধূ ঘরে আসিয়াছে। বিবাহের বৎসর চারেকের মধ্যে এই বউটি দুরন্ত ক্যানসার রোগে আক্রান্ত হইয়া পড়িল। ক্যানসার হইল জিহ্বায়, ক্ষত ক্রমে গভীর হইতে লাগিল। কতরকম চিকিৎসা করা হইল, কিছুতে উপকার দেখা গেল না। সে শুইয়া যন্ত্রণায় ছটফট করিত। ইদানং কথা পর্যন্ত কহিত পারিত না। তাহার যন্ত্রণা দেখিয়া সকলে তাহার মৃত্যু কামনা করিত। কিন্তু বছর কাটিয়া গেল, মৃত্যুর কোনো লক্ষণ নাই; অথচ নিজে যন্ত্রণা পাইয়া, আরও পাঁচজনকে যন্ত্রণা দিয়া সে জীবন্মৃত অবস্থায় বাঁচিয়া রহিল।
বউটি শাশুড়ির কাছে খুঁটি দেবতার গল্প শোনেও নাই, জানিতও না। একদিন সে সারারাত রোগের যন্ত্রণায় ছটফট করিতেছিল। শ্রাবণ মাস। শেষরাতের দিকে ভয়ানক বৃষ্টি নামিল, ঠান্ডাও খুব, বাহিরে জোর বাতাসও বহিতেছিল। মাথার শিয়রে একটা কাঁসার ছোটো ঘটিতে জল ছিল, এক চুমুক জল খাইয়া সে পাশ ফিরিয়া শুইতেই একটু তন্দ্রা-মতো আসিল।
তাহার মনে হইল, পাশের খুঁটিটা আর খুঁটি নাই। তাহাদের গ্রামে শ্যামরায়ের মন্দিরের শ্যামরায় ঠাকুর যেন সেখানে দাঁড়াইয়া মৃদু হাসিমুখে তাহার দিকে চাহিয়া আছেন। ছেলেবেলা হইতে কতবার সে শ্যামরায়কে দেখিয়াছে, কতবার বৈকালে উঠানের বেলফুলের গাছ হইতে বেলফুল তুলিয়া মালা গাঁথিয়া বৈকালিতে ঠাকুরের গলায় দিয়াছে। শ্যামরায়ের মূর্তি তাহার অপরিচিত নয়— তেমনি সুন্দর, সুঠাম, সুবেশ, কমনীয়, তরুণ দেবমূর্তি।
বিশ্বাসে মানুষের রোগ সারে, হয়তো বধূটির তাহাই ঘটিয়াছিল। হয়তো সবটাই তার মনের কল্পনা। রাঘব চক্রবর্তী যে বিরাটকায় পুরুষ দেখিয়াছিলেন, সে ও তাঁহার অনিদ্রা-প্রসূত অনুতাপবিদ্ধ মনের সৃষ্টিমাত্র হয়তো; কারণ খুঁটির মধ্যে দেবতা সেই রূপেই তাহার সম্মুখে দেখা দিয়াছিলেন, যার পক্ষে যে-রূপের কল্পনা স্বাভাবিক।
সত্য মিথ্যা জানি না, কিন্তু খুঁটি-দেবতা সেই হইতে এই অঞ্চলে প্রসিদ্ধ হইয়া আছেন।
ভাদ্র ১৩৯৯, মৌরীফুল