আরক

মৌচাকের জন্যে গল্প চেয়েছেন, একটা ভূতের গল্প হলে ভালো হয় লিখেছেন। গল্প একটা দেবো, তবে ভূতের নয়, এবং গল্প নয়— সত্য ঘটনা।

লাহোর মিউজিয়ামে যখন চাকুরি করতাম, সে সময় লাহোরের বিখ্যাত ‘দেশবন্ধু’ কাগজের সম্পাদক বিনায়ক দত্ত সিং মহাশয়ের সঙ্গে আমার যথেষ্ট আলাপ হয়। মি. সিং প্রাচীন সম্ভ্রান্ত বংশের সন্তান, তাঁদের আদি বাসভূমি পাঞ্জাবে নয়, রাজপুতনার কোটা রাজ্যে। তিন পুরুষ পূর্বে তাঁর পিতামহ রাজকার্য উপলক্ষ্যে এসে পাঞ্জাবে বাস করেন। সেই থেকেই তাঁর দেশ ছাড়া। সন্ধ্যার পর তাঁর বৈঠকখানায় গিয়ে বসতাম এবং দেওয়ালে টাঙানো পুরোনো আমলের বর্ম, কুঠার, পতাকা, বল্লম প্রভৃতি রাজপুতের যুদ্ধাস্ত্র সম্বন্ধে নানা ইতিহাস ও আলোচনা শুনতে বড়ো ভালো লাগত। রাজপুতনার, বিশেষ করে কোটা রাজ্যের ইতিহাস সম্বন্ধে মি. সিং-এর জ্ঞান খুবই গভীর।

কিন্তু এ সকল কথা নয়। আমি একটা আশ্চর্য ঘটনা বলব। মি. বিনায়ক দত্ত সিং-এর মতো সম্ভ্রান্ত ও শিক্ষিত লোকের মুখে না-শুনলে আমিও এ কাহিনি হেসে উড়িয়ে দিতাম।

.

একদিন শীতকালে সন্ধ্যার পরে আমি মি. সিং-এর বৈঠকখানায় গিয়ে বসেছি। ভীষণ শীত সেদিন। দু-পেয়ালা গরম চা পানের পর তাওয়ার ভালো তামাক টানছি (মি. সিং ধূমপানে অভ্যস্ত নন)। হঠাৎ কী মনে করে জানিনে, আমি তাঁকে বললাম— মি. সিং, আপনি অপদেবতায় বিশ্বাস করেন?

মি. সিং একটু চিন্তা করে বললেন— হ্যাঁ, করি।

—দেখেছেন ভূত-টুত?

মি. সিং গম্ভীর সুরে বললেন— না, এ আমার কথা নয়। আমার ছোটো ঠাকুরদার জীবনের ঘটনা। যদি এ ঘটনা না-ঘটত আমাদের বংশে, তবে আজও আমরা কোটা রাজ্যে মস্ত বড়ো খানদানি তালুকদার হয়ে থাকতে পারতাম। লাহোরে এসে চাকরি করতে হত না। সে বড়ো আশ্চর্য ঘটনা।

আমি বললাম— কীরকম?

—শুনুন তবে। আমার ছোটোঠাকুরদা আমার পিতামহের আপন ভাই নন, বৈমাত্রেয় ভাই। তিনি মস্ত শৌখিন পুরুষ ছিলেন, আর ছিলেন খুব সুপুরুষ।

আমি বিনায়ক দত্ত সিং-এর দীর্ঘ, গৌরবর্ণ, বলিষ্ঠ দেহের দিকে চেয়ে সে-কথা অবিশ্বাস করতে পারলাম না। তারপর তিনি বলে যেতে লাগলেন— আমি যখন তাঁকে দেখেছি, তখন আমার বয়স খুব কম। কিন্তু তিনি তখন বদ্ধ উন্মাদ—

আমি বিস্ময়ের সুরে বললাম— বদ্ধ উন্মাদ!

—একদম। কেন তিনি উন্মাদ হলেন, সেই ইতিহাসের মূলেই এই গল্প। তিনি উন্মাদ হওয়াতে কোটা রাজদরবারের আইন অনুসারে তাঁর ভাগের সমস্ত সম্পত্তি আমাদের হাতছাড়া; সে কথা যাকগে। আসল গল্পটা বলি—

বিনায়ক দত্ত সিং তাঁর অনবদ্য উর্দুতে সমস্ত গল্পটা বলে গেলেন। মধ্যে মধ্যে আমি তাঁকে নানা প্রশ্ন করেছিলাম, সে-সব বাদ দিয়ে শুধু গল্পটাই আমার নিজের ভাষায় প্রকাশ করলাম।

.

আমাদের গ্রাম থেকে কিছু দূরে কোটা দরবারের সৈন্যদের একটা আড্ডা ছিল। আমার ঠাকুরদাদা সেই সৈন্যদের আড্ডায় মাঝে মাঝে যেতেন— আরক ফুর্তি করতে। তাঁর দু-একজন বন্ধু সেখানে ছিল। তাঁদের আরকের নেশাতেই সেখানে যাওয়া। একবার জ্যোৎস্না রাত্রে তিনি আর তাঁর দু-বন্ধু খেয়ালের মাথায় বরী নদীতে স্নান করতে যাবেন বলে ঘোড়ায় করে বেরুলেন।

বরী নদী মরুভূমির মধ্যে দিয়ে তিন শাখায় ভাগ হয়ে সবিলাস গতিতে বয়ে চলেছে। যে-সময়ের কথা বলা হচ্ছে, তখন এই ত্রিস্রোতা নদীর প্রথম ধারাটিতে আদৌ  জল ছিল না; মাঝের শাখাটিতে হাঁটু খানেক জল, তারপর মাইলটাক বিস্তৃত চড়া। তার ওপারে আসল ধারা, অনেকখানি জল তাতে।

যাবার কালে এক বন্ধুর কী খেয়াল হল, তিনি প্রথম ধারার বালির ওপরে ঘোড়া থেকে নেমে চিৎপাত হয়ে শুয়ে পড়লেন, আর কিছুতেই উঠতে চাইলেন না। বাকি বন্ধুটি আর আমার ঠাকুরদাদা অগত্যা তাঁকে সেখানেই বালুশয্যায় শায়িত অবস্থায় ফেলে চললেন এগিয়ে। বলা বাহুল্য, তিনজনের মধ্যে কেউ-ই ঠিক প্রকৃতিস্থ অবস্থায় ছিলেন না।

আমার ঠাকুরদাদা বড়ো ধারা অর্থাৎ আসল বরী নদীর কাছে এসে পেছন ফিরে চেয়ে দেখলেন। তাঁর বন্ধুটি ঘোড়া থামিয়ে বালির চড়ার পশ্চিম দিকে ভীত ও বিস্মিত দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন। ঠাকুরদাদা বললেন— ওদিকে কী দেখছ চেয়ে?

বন্ধু মুখে কিছু না-বলে সেদিকে আঙুল দিয়ে দেখালেন আর ইঙ্গিতে ঠাকুরদাদাকে চুপ করে থাকতে বললেন। ঠাকুরদাদা চেয়ে দেখলেন, বালুর চড়ার ঠিক মাঝখানে অস্পষ্ট ধরনের কতকগুলি মনুষ্যমূর্তি— চক্রাকারে ঘুরছে। কিছুক্ষণ চেয়ে দেখে মনে হল ওরা যেই হোক, হাত ধরাধরি করে ঘুরে ঘুরে নৃত্য করছে। সে নির্জন স্থানে রাত্রিকালে কাদের এমন আমোদ লেগেছে যে লোক-লোচনের অন্তরালে নৃত্য করতে যাবে, বুঝতে না-পেরে তাঁরা দু-জনেই অবাক হয়ে রইলেন। কাছে কেউ কেন গেলেন না, সে কথা আমি বলতে পারব না, কারণ শুনিনি। হয়তো তাঁদের মত্ত অবস্থাই সব দৃশ্যটার জন্যে দায়ী ভেবে তাঁরাও কাউকে কথাটা বলেননি সেই সময়। এর পরে আরও বছর তিনেক কেটে গেল।

ত্রিস্রোতা বরী নদীর প্রধান স্রোতোধারার তিন মাইল উত্তরে মরুভূমির মধ্যে একটা বড়ো লবণাক্ত  জলের হ্রদ আছে, এর নাম ‘নাহারা নিপট’ অর্থাৎ ব্যাঘ্র হ্রদ। এই হ্রদের দূরে দূরে একে প্রায় চারদিক থেকে বেষ্টন করে পাহাড়শ্রেণি। এই পাহাড়শ্রেণি কোথাও হাজার ফুট উঁচু, কোথাও তার চেয়ে কিছু উঁচু। হ্রদ ও পাহাড় থেকে খনিজ লবণ পাওয়া যায় বলে কোটা দরবার থেকে মাঝে মাঝে এর ইজারা দেওয়া হত ব্যাবসাদারদের।

আমার ঠাকুরদাদা পূর্বোক্ত ঘটনার প্রায় তিন বছর পরে একদিন এই হ্রদের জলে বালি হাঁস শিকার করতে যাবেন ঠিক করলেন। গভীর রাত্রে বালি হাঁসের দল হ্রদের জলে দলে দলে চরে বেড়ায়, একথা তিনি শুনেছিলেন। একটা ঘাসের লতাপাতার ছোটো ঝুপড়ি বেঁধে তিনি তার মধ্যে লুকিয়ে থাকবেন দিনমান থেকে; কারণ মানুষ দেখলে হাঁসের দল আর নামবে না।

সব ঠিকঠাক হল, কিন্তু দু-একজন বৃদ্ধ লোক নিষেধ করলে, রাত্রিকালে নাহারা হ্রদের ত্রিসীমানাতেও যাওয়া উচিত নয়। কেন? তারা স্পষ্ট করে কিছু বললে না; শুধু বললে, জায়গাটা ভালো নয়। ভৈজি নামে একজন বৃদ্ধ ভিল আমাদের প্রজা ছিল, সে বললে— কোটা দরবারের নিমক মহালের এক বেনিয়ার সে ইজারাদার ছিল তার যৌবন বয়সে। উক্ত বেনিয়ার লবণের গুদাম আর আড়ত ছিল নাহারা হ্রদের পাড় থেকে মাইল খানেক দূরে পাহাড়ের কোলে। সে-সময় সে দেখেছে, হ্রদের ওপরের আকাশ হঠাৎ গভীর রাত্রে যেন দিনের আলোকে আলোকিত হয়ে উঠল— কেমন যেন অদ্ভুত শব্দ হচ্ছে হ্রদের জলে। মোটের ওপর রাত্রে হ্রদের ধারে কেউ যায় না। অনেক দিন থেকেই স্থানীয় লোকেদের মধ্যে এ ভয় রয়েছে। একবার এক মেষপালক রাত্রিকালে হ্রদের ধারে কাটিয়েছিল। সকাল বেলা তাকে সম্পূর্ণ উন্মাদ অবস্থায় নিমকের গুদামের কাছে পায়চারি করতে দেখা যায়। আমার ঠাকুরদাদা এ-সব গালগল্প শোনবার লোক ছিলেন না। তিনি বুঝতেন ফুর্তি, শিকার, হল্লা, হইচই। লোকটিও ছিলেন দুঃসাহসী ও একগুঁয়ে ধরনের। তিনি যাবেনই ঠিক করলেন।

বৃদ্ধ ভিল তাঁকে বললেন— হুজুর, হাঁসের দল যদি জলে নামে, তবে সে রাত্রে কোনো ভয় নেই জানবেন।

ঠাকুরদাদা জিজ্ঞাসা করলেন— কীসের ভয়? বাঘের?

—তার চেয়ে ভয়ানক কোনো জানোয়ার হতে পারে; কী জানি হুজুর, আমার শোনাকথা মাত্র। ঠিক বলতে পারিনে—

—তুই সঙ্গে থাক না? বকশিস দেবো—

—মাপ করবেন হুজুর। এক-শো রুপেয়া দিলেও রাত কাটাবে কে নাহার নিপটের ধারে? প্রাণের ভয় নেই? আমরা ভিল, বাঘের ভয় রাখিনে। এই হাতে তির দিয়ে কত বাঘ মেরেছি। কিন্তু হুজুর, বাঘের চেয়েও ভয়ানক কোনো জীব কি দুনিয়ায় নেই?

.

আমার ঠাকুরদাদা নাহারা হ্রদ ভালো জানতেন না। ঠিক আমাদের অঞ্চলে হ্রদটা নয়, আমাদের গ্রাম থেকে চল্লিশ মাইল দূরে। তখন তিনি ভিলেদের গ্রাম থেকে রওনা হয়ে সাত-আট মাইল হেঁটে পাহাড় ডিঙিয়ে সমতল ভূমিতে নামলেন। দূরে মস্ত বড়ো হ্রদটার লবণাক্ত জলরাশি প্রখর সূর্যতাপে চকচক করছে। জনপ্রাণী নেই কোনোদিকে।

বেলা তখনও অনেকখানি আছে, এমন সময় ঠাকুরদাদা হ্রদের ধারে পৌঁছে গেলেন এবং নলখাগড়া ও শুকনো ঘাস দিয়ে সামান্য একটু আবরণ মতো তৈরি করে নিলেন জলের ধারেই, যার আড়ালে তিনি বন্দুক নিয়ে লুকিয়ে থাকতে পারেন, হাঁসের দল যাতে টের না-পায়।

সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হয়ে গেল, রাঙা রোদ দূরের পাহাড়ের গা থেকে মিলিয়ে গিয়েছে অনেকক্ষণ। সুন্দর চাঁদ উঠলে পূবের পাহাড় ডিঙিয়ে, কৃষ্ণপক্ষের আঁধার রাত্রি। একদল সবুজ বনটিয়া জলের ধারে নেমে আবার উড়ে গেল। নির্জন নিস্তব্ধ মরুভূমি আর হ্রদ।

দুই দণ্ড পরে জ্যোৎস্না ফুটে উঠল হ্রদের বুকে। ধবধবে জ্যোৎস্না— কৃষ্ণা দ্বিতীয়া। দু-দিন মাত্র আগে হেমন্ত-পূর্ণিমা চলে গিয়েছে। যত রাত বাড়ে, তত শীত নামে।

শীতের মুখে বালিহাঁস আসবার সময়। কিন্তু কই, একটা হাঁসও আজ নামছে না কেন?

বৃদ্ধ ভিলের কথা মনে পড়ল ঠাকুরদাদার— হাঁসের দল যদি নামে তবে সে রাত্রি বিপদহীন বলে জানবেন। যদি না-নামে তবে কীসের বিপদ! বাঘ  জল খেতে আসে পাহাড় থেকে?

রাত্রি ক্রমে গভীর হল। অপূর্ব জ্যোৎস্নালোকে হ্রদের জল, মরুভূমির নোনা বালি রহস্যময় হয়ে উঠেছে, কোনো শব্দ নেই কোনোদিকে। ঠাকুরদাদা যথেষ্ট দুঃসাহসী হলেও তাঁর যেন গা ছমছম করে উঠল— জ্যোৎস্নার সে ছন্নছাড়া অপার্থিব রূপে। তিনি চামড়ার বোতল বের করে কিছু আরক সেবন করলেন।

হঠাৎ হ্রদের তীরের পশ্চিমাংশে চেয়ে দেখে তাঁর মন আনন্দে দুলে উঠল। জ্যোৎস্নালোকেও আকাশের নীচে একদল বালিহাঁস নামছে। জ্যোৎস্না পড়ে তাদের সাদা দুধের মতো পাখাগুলো কী অদ্ভুত দেখাচ্ছে! দেখতে দেখতে তারা নেমে এসে হ্রদের ধারে বালির চরে বসল।

জায়গাটা ঠাকুরদাদার ঝুপড়ি থেকে দু-শো গজের মধ্যে কিংবা তার কিছু বেশি।

এতদূর থেকে বন্দুকের পাল্লা যাবে না, বিশেষ এই জ্যোৎস্না রাত্রে। ঠাকুরদাদা ভাবলেন, দেখি ওরা কাছে আসে কি না কিংবা আরও হাঁসের দল নামে কি না। শিকারির পক্ষে ধৈর্যের মতো গুণ আর কিছু নেই। একদৃষ্টে হাঁসগুলোকে লক্ষ করাই ভালো। কিন্তু পরক্ষণেই ঠাকুরদাদা বিস্ময়ে নিজের চোখ বার বার মুছলেন। কী ব্যাপার? এ কীরকম হাঁস?

ঠাকুরদাদা আবার চোখ মুছলেন। আরক খেয়েছেন বটে, কিন্তু তাতে জ্ঞানহারা হবার বা চোখে ভুল দেখবার কী কারণ আছে এখনই?

তারপর যা ঘটল তা বিশ্বাস করা না-করা আপনার ইচ্ছা মি; ব্যানার্জি, কিন্তু এ-গল্প আমি বাবার মুখে অনেকবার শুনেছি, বা আমাদের বংশের ঘটনা; কাজেই আমি আপনাকে মিথ্যা বলছি বানিয়ে— অন্তত এটুকু ভাববেন না। ঠাকুরদাদা দেখলেন, সেই হাঁসের মতো নয়, অনেক বড়ো। অনেক— অনেক বড়ো হাঁসগুলো। সাধারণ হাঁসের মতো তাদের চালচলনও নয়। তারপরেই মনে হল, সেগুলো হাঁসই নয় আদপে, সেগুলো মানুষের মতো চেহারাবিশিষ্ট। বেচারা ঠাকুরদাদা আবার চোখ মুছলেন। আরক ওইটুকু খেয়েই আজ আমার এ কী দশা? পরক্ষণেই সেই জীবগুলি  জলে নামল এবং হাঁসের মতো সাঁতার দিয়ে তিনি যেখানে লুকিয়ে আছেন, তার কাছাকাছি জলে এসে গেল। কৃষ্ণা দ্বিতীয়ার পরিপূর্ণ জ্যোৎস্নালোকে বিস্মিত, ভীত, চকিত আমার দুঃসাহসী, আরক সেবনকারী ঠাকুরদাদা দেখলেন— তারা সত্যিই হাঁস নয়, একদল অত্যন্ত সুন্দরী মেয়ে। শুভ্র তাদের বেশ— জ্যোৎস্না পড়ে চিকচিক করছে; তাদের হাসি, মুখশ্রী সবই অতিঅদ্ভুত ধরনের সুন্দর। কতকক্ষণ ধরে তারা নিজেদের মধ্যে খেলা করলে জলে, রাজহংসের মতো সুঠাম ধরনে নিঃশব্দে সুন্দর ভঙ্গিতে হ্রদের বুকে সাঁতার দিতে লাগল। তারপর, কতক্ষণ পরে তা ঠাকুরদাদার আন্দাজ ছিল না— কারণ, তখন ঠাকুরদাদা সময়ের জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছেন। ওরা সবাই জল থেকে উঠল এবং অল্প পরেই জ্যোৎস্নাভরা আকাশ দিয়ে ভেসে হাঁসের মতোই শুভ্র পাখা মেলে অদৃশ্য হয়ে গেল। হ্রদের তীরের বাতাস তখনও তাদের অপূর্ব দেহগন্ধে ভরপুর।

আমার ঠাকুরদাদা নিজের গায়ে চিমটি কেটে দেখলেন তিনি জেগে আছেন কি না। তখন তাঁর আরকের নেশা কেটে গিয়েছে। একটু পরে রাত ফরসা হয়ে জ্যোৎস্না মিলিয়ে গেল। তিনি উদভ্রান্ত মস্তিষ্কে হ্রদের পাড় থেকে হেঁটে চলে এলেন পাহাড়ের কোলে। সেখান থেকে পৌঁছলেন ভিলদের গ্রামে।

বৃদ্ধ ভিল ভৈজি তাঁকে বললে— হুজুর হাঁস নেমেছিল কাল?

ঠাকুরদাদা মিথ্যা কথা বললেন। হাঁস নেমেছিল, কিন্তু তিনি একটাও মারতে পারেননি। কেন মিথ্যা বললেন শুনুন।

কী এক দুর্বার মোহ তাঁকে টানতে লাগল দুপুরের পর থেকেই; আবার তাঁকে যেতে হবে নাহারা হ্রদের তীরে। রাত্রিকালে ভৈজিকে সত্যি কথা বললে পাছে সে বাধা দেয়।

কিন্তু সে রাত্রে বুনো বালিহাঁসের দল নামল হ্রদের জলে। আসল হাঁসের দল।

পর পর কয়েক রাত্রি শুধু বন্য-হংসের দল নামে, খেলা করে। আমার ঠাকুরদাদা ঝুপড়ির মধ্যে শুয়ে চেয়ে থাকেন, বন্দুকের গুলি করতে তাঁর মন সরে না।

তারপর আর-একদিন শেষ রাত্রের জ্যোৎস্নায় বন্য হংসের বদলে নামল সেই অদ্ভুত জীবের দল। এদিন তারা আরও কাছে এল। বন্য রাজহংসীর মতো সাঁতার দিয়ে বেড়ালো জলজ ঘাসের বনের পাশে-পাশে। তাদের অপূর্ব সুন্দর মুখশ্রী জ্যোৎস্নালোকে ঠাকুরদাদার মুগ্ধ দৃষ্টির সম্মুখে কতবার পড়ল। রাত ভোর হবার বেশি দেরি নেই, তখনও কিছু জ্যোৎস্না আছে; আমার ঠাকুরদাদা কী ভেবে আরকের নেশায় কিংবা ভালো অবস্থায় জানিনে, ঝুপড়ি থেকে উঠে ছুটে  জলের ধারে চললেন। বোধ হয় ওদের কাউকে ধরতে গেলেন। অমনি ত্রস্ত বন্য হংসের মতো সেই অলৌকিক জীবের দল তাড়াতাড়ি সাঁতরে কে কোথায় দূরে চলে গেল এবং পরক্ষণেই শেষ রাত্রের বিলীয়মান চন্দ্রালোকে তাদের লঘু দেহ ভাসিয়ে আকাশ পথে অদৃশ্য হল।

পরদিন দুপুর বেলায় আমার ঠাকুরদাদাকে উন্মাদ অবস্থায় হ্রদের ধারের বালির চরায় লক্ষ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াতে দেখে জনৈক জেলে তাঁকে ভিলদের গ্রামে পৌঁছে দেয়। বৃদ্ধ ভিল ভৈজি ঘাড় নেড়ে বললে— আমি বলেছিলাম, হাঁসের দল যেদিন না-নামে সেদিন বড়ো ভয়।

ঠাকুরদাদা মাঝে মাঝে ভালো হতেন আবার উন্মাদ হয়ে যেতেন। ভালো অবস্থায় বাড়িতে এ-গল্প করেছিলেন, একবার নয়, অনেকবার। মৃত্যুর দশ বছর আগে থেকে তাঁর মোটেই ভালো অবস্থা আসেনি। বদ্ধ উন্মাদ অবস্থায় তাঁর মৃত্যু ঘটে।

বিনায়ক দত্ত সিং গল্প শেষ করলেন।

আমি বললাম— খুব অদ্ভুত ঘটনা, তবে—

মি; সিং বললেন— তবে বিংশ শতাব্দীতে বিশ্বাস করা শক্ত। সে আমিও জানি। আমাদের দেশের সকলে বিশ্বাস করে না। এ আজ পঞ্চাশ বছর আগেকার ঘটনা বলছি। কেউ বলে ঠাকুরদাদার অতিরিক্ত আরক সেবনের ফলে ওই সব চোখের ভুল দেখা, বন্য হংসীকে ভেবেছেন আকাশ-পরি; আবার কেউ বলে, না, আকাশ-পরি দেখলেই লোকে পাগল হয়। সেই বৃদ্ধ ভিল ভৈজি সেই কথাই বলত। কী করে বলব কোনটা সত্যি কোনটা মিথ্যে, তখন আমার জন্মই হয়নি।

আশ্বিন ১৩৪৯, মৌচাক


© 2024 পুরনো বই