নীলগঞ্জের ফালমন সাহেব
সাহেবের নাম এন. এ. ফারমুর। নীলগঞ্জের নীল কুঠিয়াল সাহেবদের বর্তমান বংশধর। আমি বাল্যকাল হইতেই সাহেবকে চিনি। যখন স্কুলে পড়ি, সাহেবদের কুঠিতে একবার বেড়াইতে যাই। ফারমুর সাহেবকে এদেশের লোক ফালমন সাহেব বলিয়া ডাকে। আমার বাল্যকালে ফালমন সাহেবের বয়স ছিল কত? পঞ্চাশ হইবে মনে হয়। সাহেবদের কুঠিতে যাইয়া দেখিতাম সাহেব দুধ দোয়াইতেছেন। অনেকগুলি বড়ো বড়ো গাই ছিল কুঠিতে, বিশ ত্রিশ সের দুধ হইত। নৌকো করিয়া প্রতিদিন ওই দুধ মহকুমার শহরে প্রেরিত হইত। আমাকে বড়ো ভালোবাসিতেন। আমাকে দেখিয়া বলিতেন—সকাল বেলাতেই এসে জুটলে? খাবা কিছু?
–খাব।
–কী খাবা? দুধ?
—যা দেবেন।
—ও মতি, ছেলেটিকে গুড় দিয়ে মুড়ি দাও আর দু-উড়কি দুধ দাও।আমি এই মাত্তর খেয়ে আলাম—বোসো খোকা, বোসো।
নীলকুঠির আমলে ফালমন সাহেবের বাবা লালমন (লালমুর) সাহেবের অসীম প্রতিপত্তি ছিল এদেশে। নীল চাষ উঠিয়া যাইবার পরে বিস্তৃত জমিদারির মালিক হইয়া এ দেশেই তিনি বসবাস করিতে থাকেন। ক্রমে জমিদারিও চলিয়া যায় অনেক, লালমন সাহেবও মারা যান। ফালমন বিস্তৃত আউশ ও আমন ধানের জমি চাষ করিতে থাকেন, বড়ো বড়ো গোরু পুষিতেন, সেই সঙ্গে হাঁস, মুরগি, ছাগল ও ভেড়া। সাহেবের কুঠিতে সারি সারি ধানের গোলা ছিল বিশ-ত্রিশটা। জমিদারিও ছিল, কুঠির পুবদিকের বড়ো হলদে ঘরে (যার সামনে বেগুনি প্যাটেনফুলের প্রকাণ্ড গাছ, কি ফুল জানি না, আমরা বলিতাম ‘প্যাটেন’ ফুল) কুঠিয়াল সাহেবের নায়েব ষড়ানন বকসি কাছারি করিতেন, এবং প্রজাপত্র ঠেঙাইতেন। লালমন সাহেব কোন স্থান হইতে আসিয়াছিলেন বলিতে পারিব না, তবে তাঁহার বৈঠকখানায় একখানা বড়ো ছবির তলায় লেখা ছিল ‘T. Farmour of Bournemouth, England.” ফালমনের জন্ম নীলগঞ্জেই। তাঁহাদের সকলেই যশোর জেলার পাড়াগাঁয়ের কৃষক শ্রেণির ভাষায় কথা বলিতেন।
—কী পড়ো?
—মাইনর, সেকেন ক্লাসে।
—ইউ পি পাস করেচ?
—হ্যাঁ।
—বিত্তি পেয়েছিলে?
—না।
—আমার ইস্কুলে পড়ো?
—আপনার ইস্কুলে না। জেলাববার্ডের স্কুলে, চেতলমারির হাটতলায়। –ও বুঝিচি। তবে তোমার বাড়ি এখানে না?
—আজ্ঞে না। আমার পিসির বাড়ি এখানে।
—কেডা তোমার পিসে?
—ভূষণচন্দ্র মজুমদার।
—আরে মজুমদার মহাশয়ের বাড়ি এসেচ তুমি? বেশ বেশ, নাম কী?
—শ্রীরতনলাল চক্রবর্তী।
—পিতার নাম?
—শ্রীমাখনলাল চক্রবর্তী।
—তুমি মাখনলাল মাস্টারের ছেলে? চেতলমারির ইস্কুলির?
—আজ্ঞে হ্যাঁ।
–তাই বলো। মাখন মাস্টার তো আমাদের বন্ধু লোক। বেশ, বোসো, দুধ দিয়ে মুড়ির ফলার করে খাও।
ফালমন সাহেবের সঙ্গে এইভাবেই আলাপ শুরু। তা বাদে মাঝে মাঝে সাহেবকে চিতলমারির খড়ের মাঠে আমিনকে সঙ্গে লইয়া জমি মাপিতে দেখিয়াছি। কতদিন নৌকোয় লোকের সাহায্যে পটল কুমড়া বোঝাই করিতে দেখিয়াছি। লম্বা একহারা সাহেবি চেহারা। ভুড়ি একদম নাই, গায়ে এক আউন্স চর্বি নাই কোথাও। গোঁফজোড়াটা বড্ড লম্বা, দৃঢ় চোয়াল—সবই ঠিক সাহেবি ধরনের। কিন্তু পোশাকটা সবসময় সাহেবের মতো নয়, কখনো ধুতি, কখনো কোটপ্যান্টের উপর মাথায় তালপাতার টোকা। শেষোক্ত বেশটা দেখা যাইত যখন ফালমন মাঠে চাষবাসের তদারক করিতেন, কৃষাণ ছিল সংখ্যায় ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ, লাঙল গোরু চল্লিশখানা, আট-দশখানা গোরুরগাড়ি। অত বড়ো ফলাও চাষ সাধারণ কোনো বাঙালি গৃহস্থ চাষি কল্পনাও করিতে পারে না। তালপাতার টোকা মাথায় কৃষকদের কাজকর্ম দেখাশোনা করিতেন বটে, কিন্তু হুঁকোয় তামাক খাইতে কখনো দেখি নাই —পাইপ সর্বদা মুখে লাগিয়াই থাকিত। কৃষাণদের বলিতেন—বাবলাতলার জমিগুলোতে দোয়ার (অর্থাৎ দ্বিতীয়বার চাষ) দেবা কবে ও সোনাই মণ্ডল? তা দ্যাও, আর দেরি করবা না। রস টেনে গেলি ঘাস বেধে যাবে আনে, তখন লাঙল বেশি লাগবে। এখনও ভুইতে রস আছে।
সোনাই মণ্ডল হয়তো বলিল—বাবলাতলার ভুইতে পানি আর কনে, সাহেব? কে বললে আপনারে?
—নেই? কাল সাঁজের বেলা আমি আর প্যাট (সাহেবের শালা, এখানেই বরাবর থাকিত দেখিতাম, চাষবাসের কাজ দেখে) যাইনি বুঝি? ঝা পানি আছে তাতে কাজ চলে যাবে আনে।
—ছোলা কাটতি হবে এবার?
—এখনো দানা পুরুষ্ট হয়নি, আর চার-পাঁচটে রোদ খাক। সময় হলি ব-অ-ল বো—
এই সময় নদীপপুরের গোপেশ্বর বৈরাগীকে মাঠের পাশের পথ দিয়া যাইতে দেখিয়া মাথার টোকাটা কপালের উপর দুই আঙুল দিয়া একটু উঁচু করিয়া তুলিয়া বলিলেন—ও গোপেশ্বর—শোনো—ও গোপেশ্বর— গোপেশ্বর—
আসিয়া বলিল—সেলাম সাহেব—
সাহেবের দোর্দণ্ডপ্রতাপ এ অঞ্চলে, কারণ অধিকাংশই তাহার প্রজা।
—যাচ্ছ কনে?
—যাব একবার পানচিতে। মেয়ের খবর পাইনি অনেক দিন। জামাইডা কেমন আছে দেখে আসি, পেট-জোড়া পিলে তার। গত অঘ্রান মাসে যায়-যায় হইছিল—
—ম্যালেরিয়া?
—তা আমরা কী বুঝি? তাই হবে।
—বেশ। একটা কৃষ্ট বিষয় গান করে শুনিয়ে যাও দিকি?
—কৃষ্ট বিষয়?
—কিংবা শ্যামা বিষয়। না, তুমি বোষ্টম, টুম আবার বুঝি শ্যামা বিষয় গাইবা। ঝা মন চায় একখানা শোনাও। বড্ড রোদ পড়ছে, শরীলির কষ্ট হয়েছে বড্ড। বোসো, এই পিটুলিতলার ছাওয়াপানে।
গোপেশ্বর গান গাহিতে বসিয়া দু-বার কাশিল, সাহেবের দিকে লাজুক দৃষ্টিতে দু-একবার চাহিয়া পরে গান আরম্ভ করিল—
কোনটি তোমার আসল রূপ শুধাই তোমারে
ফালমন সাহেব হাতে তালি দিতে দিতে বলিলেন—বাঃ বাঃ—বেশ গলা— দাশুরায় না-নীলকণ্ঠ?
—নীলকণ্ঠ।
–দাশুরায় একখানা হোক না?
সাহেবের আদেশ অমান্য করিবার ক্ষমতা কাহারও নাই এ অঞ্চলে, সুতরাং গোপেশ্বরকে আর একখানা গান গাহিতেই হইল।
ভয়ে আকূল বসুদেব
দেখে অকূল যমুনা।
কূলে বসে দু-নয়নে বারি ঝরে
কোলে অকূলের কাণ্ডারী তাও জানে না।
একবার ভাবি যদি বর্তমান কংসের পদে
দৈবে দয়া যদি হত পাষাণ হৃদে—
তা হয় না আর
গেল একূল ওকূল দুকূল
অকূল পারে গোকূল
কুলের তিলক রাখতে কূল পেলেম না।
ভয়ে আকূল বসুদেব
দেখে অকূল যমুনা—
ফালমন সাহেব চক্ষু মুদিয়া পাইপ টানিতে টানিতে গান শুনিতেছিলেন। আবার গোপেশ্বরের পিঠ চাপড়াইয়া বলিলেন—বাঃ বাঃ—দাশুরায়ের গানের কাছে আর সবকিছু লাগে না। কী রগম—কী ওরে বলে গোপেশ্বর?
—অনুপ্রাস?
—ওই যা বললে। ভারি চমৎকার, লাগতিই হবে যে। দাশুরায় হুঁঃ—
—আজ উঠি সাহেব।
—আচ্ছা এসো—
ফালমন সাহেবের কাছারিঘরে—রাম শ্যামকে মারিয়াছে, শ্যামের গোরু যদুর পটলের খেত নষ্ট করিয়াছে—এইসব গ্রাম্য মামলার বিচার হইত। বিচার সাধারণত করিত নায়েব ষড়ানন বকসি, গুরুতর মোকর্দমায় ফালমন সাহেব নিজে বিচারাসনে বসিতেন।
আমি দেখিয়াছিলাম যেদিন গুড়ে জেলের ভাই-বউ রেমো ধোপার ছেলে অতুলের সঙ্গে সোজা চম্পট দেওয়ার পরে আড়ংঘাটা স্টেশনে ধরা পড়িয়া পুনরায় গ্রামে আনীত হইল, সেদিন ফালমন সাহেবের বিচার। গ্রামে হইচই কাণ্ড পড়িয়া গিয়াছিল। কারণ দু-দশ বছরে এই ধরনের ব্যাপার কেহ এ অঞ্চলে দেখে নাই, শোনেও নাই।
ফালমন সাহেব অতুলকে কড়াসুরে প্রশ্ন করিলেন—জেলেবউয়ের বয়সটা কত? অতুল কাঁপিতে কাঁপিতে বলিল—তা জানিনে সাহেব।
-তোমার চেয়ে বড়ো না-ত ছোটো?
—আমার চেয়ে বড়ো।
—তোমার বয়েস কত?
—আজ্ঞে, এই তেইশ। রেমো ধোপার দিকে চাহিয়া সাহেব বলিলেন—এই রেমো, বয়েস ঠিক বলচে তো?
রেমো বলিল—হাঁ, সাহেব।
—আর জেলে-বউ-এর বয়স কত?
গুড়ে জেলে বলিল—আজ্ঞে, বত্রিশ।
–বত্রিশ?
—আজ্ঞে।
সাহেব রাগে কাঁপিতে কাঁপিতে অতুলের দিকে চাহিয়া বলিলেন—তোর বড়ো দিদির বয়েসি যে-রে হারামজাদা—তোর লঘু-গুরু জ্ঞান নেই? মারো দশ জুতো সকলের সামনে—আর পঞ্চাশ টাকা জরিমানা, যাও—
ব্যস বিচার শেষ।
আর কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ বা ওকালতি খাটিবে না।
The great Khan has spoken—মিটিয়া গেল।
সেকালের নীলকুঠির অটোক্র্যাট ভূম্যধিকারীর রক্ত ছিল ফালমন সাহেবের গায়ে, প্রজা পীড়ন ও শোষণে তিনি তেমনি পটু, তবে যুগপ্রভাবে নখ-দন্ত অপেক্ষাকৃত ভোঁতা—এইমাত্র।
সেবার মস্ত বড়ো দাঙ্গা বাধিল বাগদি ও জেলে প্রজাদের মালার বিলের দখল লইয়া। মালার বিল বরাবর বাগদি প্রজাদের কাজে বন্দোবস্ত করা ছিল রানি রাসমণি এস্টেটের স্বরূপনগর কাছারি থেকে। কখনো এক পয়সা খাজনা আদায় হইত না। মামলা-মোকর্দমা করিয়াও কিছু হয় না—তখন রানি-এস্টেটের নায়েব ভৈরব চক্রবর্তী মালার বিল দশ বৎসরের জন্য ইজারা দিলেন ফালমন সাহেবকে। সেলামি এক পয়সাও নয়, কেবল শালিয়ানা আড়াইশো টাকা খাজনা। কারণ দুর্ধর্ষ জেলে ও বাগদি প্রজাদের কাছ থেকে বিলের দখল পাওয়াই ছিল সমস্যা— সাহেবের দ্বারা সে-সমস্যা পূরণ হইবে, ভৈরব চক্রবর্তীর এ আশা ছিল এবং সে আশা যে নিতান্ত ভিত্তিহীন নয়—বিল ইজারা দেওয়ার এক পক্ষকালের মধ্যেই পদ্মফোটা মালা বিলের রক্ত-রঞ্জিত জল তাহার প্রমাণ দিল। প্রকাশ ফালমন সায়েব স্বয়ং টোকা মাথায় দিয়া ঘোড়ায় চড়িয়া দাঙ্গা পরিচালনা করিয়াছিলেন। যদিও পুলিশ রিপোর্টে পরে প্রকাশ হইল, দাঙ্গার সময় ফালমন সাহেব তাঁর বড়ো মেয়ে মার্জোরির টনসিল অস্ত্র করিবার জন্যে তাহাকে লইয়া কৃষ্ণনগর মিশন হাসপাতালে যান।
মামলাবাজ ও-ধরনের আর একটি লোক সারা জেলা খুঁজিলে পাওয়া যায় কিনা সন্দেহ।
প্রায়ই মহকুমায় মামলা পড়িত।
সাহেবের চারদাঁড়ের ডিঙি সাতটার সময় ছাড়িত কুঠিঘাট থেকে। ছইয়ের মধ্যে ফালমন সাহেব ও তাঁর খাওয়ার জন্য ফলের ঝুড়ি, জলের কুঁজো, দুধের বোতল, নায়েব ষড়ানন বাবু ও তাঁর বিছানাপত্র, দুজন মাঝি (তার মধ্যে একজনের নাম গোপাল পাইক, জাতে বাগদি, খুব ভালো গান গাহিতে পারে)—এই লইয়া তিরবেগে নৌকো ছুটিত দশ মাইল দূরবর্তী মহকুমার শহরের দিকে। হু-হু করিয়া মুখোড় বাতাস বহিত। গাঙে সাহেবের প্রিয় অনুচর গোপাল পাইক প্রভুর ইঙ্গিতে নৌকোর গলুইয়ের কাছ থেকে ছইয়ের কাছে সরিয়া আসিত। সাহেব বলিতেন— একটা কৃষ্ণ-বিষয় কিংবা শ্যামা-বিষয় গাও গোপাল—
গোপাল অমনি ধরিত—
নীলবরণী নবীনা রমণী নাগিনী জড়িত জটা সুশোভিনী
নীল নয়নী জিনি ত্রিনয়নী কিবা শোভে নিশানাথ নিভাননী—
তারপর গাহিত—
কী কর কী কর শ্যাম নটবর, ছাড় যাই নিজ কাজে—
গোপাল পাইক যাত্রাদলে অল্পবয়সে গাহিত, সাহেবের সংগীতপ্রিয়তার কথা শুনিয়া কিঞ্চিৎ পুরস্কার আশায় একদিন সে নীলগঞ্জের কুঠিতে গাহিতে আসে— গান শুনিয়া সাহেবের বড়ো ভালো লাগিল এবং সেই হইতে গোপাল সাহেবের এস্টেটের চাকুরিতে বহাল হইয়া গেল।
এক পয়সা খাজনা বাকি থাকিলেও যেমন সাহেবের এস্টেট হইতে নালিশ হইত, আবার ধরিয়া পড়িলে ক্ষমা করিতেও ফালমন সাহেব ছিলেন বিশেষ পটু। কতবার এরকম হইয়াছে। দুর্বুদ্ধি প্রজা ভবিষ্যৎ না-ভাবিয়া কিংবা উকিল মোক্তারদের উৎসাহে নীলগঞ্জ এস্টেটের বিরুদ্ধে মামলা লড়িয়াছে। একবার ফৌজদারি, তারপর স্বাভাবিক নিয়মানুযায়ী দেওয়ানি, মহকুমা হইতে সাব-জজ কোর্ট, সেখান হইতে আবার পুনর্বিচারের জন্য মহকুমায় মুনসেফ কোর্ট—এই করিতে করিতে প্রজা এস্টেটকে হয়রান করিয়া এবং নিজেও সর্বস্বান্ত হইয়া যখন জ্ঞানচক্ষু লাভ করিল, তখন হিতৈষী বন্ধুদের পরামর্শে কোর্টের বটতলাতেই একেবারে ফালমন সাহেবের পা জড়াইয়া উপুড় হইয়া পড়িল পায়ে।
—আরে কী কী, কে?
—আজ্ঞে আমি মুকুন্দ বিশ্বেস।
সাহেব পায়ের ঝটকা মারিয়া বলিলেন—বেরো হারামজাদা—বেরো—বেরো–
ফালমন হিন্দি কথাই জানিতেন না, খাঁটি বাংলা ইডিয়মযুক্ত ভাষা ব্যবহার করিতেন এবং সে শুধু এইজন্য যে নীলগঞ্জের কুঠিই তাঁহার জন্মস্থান, এই গ্রাম্য আম-জাম-নিকুঞ্জ ছায়ার শ্যামলতায় ও কৃষকদের সাহচর্যে তিনি আবাল্য লালিতপালিত ও বর্ধিত। ডরসেট শায়ারের ইংরাজরক্ত ধমনিতে থাকিলেও মনেপ্রাণে খাঁটি বাঙালি, ঊনবিংশ শতাব্দীর নিশ্চিন্ত শান্তি ও আলস্যের মধ্যে যাহার যৌবন কাটিয়াছে, সেই স্বচ্ছল বাঙালি জমিদার। মুকুন্দ বিশ্বাস ডুকরাইয়া কাঁদিয়া উঠিল। ব্যাপার দেখিতে লোক ছুটিয়া ভিড় বাধাইল। সকলেই ভাবিল সাহেব কি অত্যাচারী! গরিব প্রজাকে কি করিয়া পীড়ন করিতেছে দ্যাখো। একেবারে এইভাবেই সর্বস্বান্ত হয়? ছিঃ—
কেহ বুঝিল না কীরূপ ত্যাঁদড় ও উঁদে প্রজা মুকুন্দ কলু।
—কী চাই? কী?
—সায়েব মা-বাপ—ধরম বাপ—মোরে বাঁচাও ধরম বাপ—
—কেমন? মোকদ্দমা করবিনে? কর ছানি—শোনছেন ও হরিশবাবু, শোনেন ই দিকি।
চোগা-চাপকান পরনে বড়ো উকিল হরিশ্চন্দ্র গাঙ্গুলী ঘটনাস্থলের কিছু দূর দিয়া যাইতেছিলেন। সাহেবের আহ্বানে নিকটে আসিতে আসিতে বলিলেন—গুড মর্নিং মি. ফারমুর, বলি ব্যাপার কী?
—আরে দেখেন না কাণ্ডখানা। চেনেন না মুকুন্দ বিশ্বাসকে? পাঁচপোতার মুকুন্দ বিশ্বাস। বদমায়েশের নাজির, ওর বদমায়েশি দেখতে দেখতে মাথার চুল আমি পাকিয়ে ফ্যালোম হরিশবাবু, ওরে আর আমি চিনিনে? শুনুন তবে—আরে নায়েব। মশায়, বলুন দিকি সব খুলে–
সব শুনিয়া হরিশবাবু মুকুন্দ কলুকে ধমক দিয়া কিঞ্চিৎ সদুপদেশ দিলেন। সাহেবের বিরুদ্ধে মামলা! তাহার মতো ট্যানাপরা লোকের পক্ষে? যাক, যাহা হইবার হইয়াছে, সাহেব নিজগুণে এবারটি গরিবকে মাপ করিয়া দিন।
সাহেবকে হরিশবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন—আজ বুঝি ডিক্রির দিন?
—নিশ্চয়। ও এতদিন আমার সঙ্গে একটা কথা কইত না। আজ একেবারে পায়ে ধরেছে।
ষড়ানন বকসি বলিল—শুধু পায়ে ধরা নয়, একেবারে মড়াকান্না কেঁদে লোক জড়ো করে ফেলেছে–
সাহেব জনতার উদ্দেশ্যে বলিলেন—এই, যাও সব এখান থেকে। এখানে কী? চলে যাও সব—
হরিশবাবু উকিলও সেই সঙ্গে যোগ দিয়া কহিলেন—হ্যাঁ, তোমরা কেন এখানে বাপু? কাছারির সামনে ভিড় কোরো না—হাকিম চটবেন—যাও এখন—এখানে কি ঠাকুর উঠেছে?
হিসাব করিয়া ষড়ানন বকসি সাহেবকে জানাইল, এই মামলায় এ পর্যন্ত সাতশো সাড়ে-সাতশো টাকা খরচ হইয়া গিয়াছে।
সাহেব বলিলেন—আচ্ছা যা, মাপ করলাম। নায়েববাবু, মামলা মিটিয়ে নেবেন। ষড়ানন বকসি বলিল—খরচার টাকা?
–ওর সঙ্গে না-হয় ষড় করি নেবেন। তবে বলে দিন, আবার কুঠিতে গিয়ে নাকে খত দিতি হবে ওকে—নইলে আমি ওকে ছাড়ব না। ও নাকে খত দিতে রাজি কিনা?
মুকুন্দ বিশ্বাস খুব রাজি। সে এখনই নাকে খত দিতে প্রস্তুত আছে। সাহেবের আশ্বাস পাইয়া সে চলিয়া গেল।
সেবার শীতকালের মাঝামাঝি মিসেস ফালমন লিভারের অসুখে ভুগিয়া কলিকাতার হাসপাতালে মারা গেলেন। দিনসাতেক পরে নীলগঞ্জের চারিপাশের পাঁচ-ছয়খানি গ্রামের সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ গৃহস্থদিগের কাছে তাহাদের মত জিজ্ঞাসা করা হইল—মেমসাহেবের আত্মারমঙ্গলকামনায় যদি ব্রাহ্মণভোজনের ব্যবস্থা হয়, তাঁহারা খাইবেন কিনা। তখনকার দিনে এসব ধরনের খাওয়ায় সামাজিক কড়াকড়ি অনেক বেশি ছিল, কিন্তু ব্রাহ্মণদের রাজি না-হইয়া এক্ষেত্রে উপায় ছিল না। সাহেবকে চটাইতে কেহই রাজি নয়।
নীলগঞ্জের কাছারিঘরের সামনে তুততলায় দু-দিন ধরিয়া কালী ময়রা সন্দেশ, বোঁদে, পানতুয়া ভিয়ান করিল। কাছারিবাড়ির হলে ব্রাহ্মণভোজনের যে বিরাট ব্যবস্থা হইয়াছিল, ও অঞ্চলে সেরকম খাওয়ানো কখনো কেহ দেখে নাই।
ফালমন সাহেব কুঠির গেটে নিজে দাঁড়াইয়া প্রত্যেককে বলিতেছিলেন—পেট আপনাদের ভরেছে? কষ্ট দেলাম আপনাদের এনে, কিছু মনে করবেন না–
আমিও সে দলে ছিলাম, তখন স্কুলের বালক, ভূরিভোজন করিয়া বাহির হইয়া আসিতেছিলাম। দীর্ঘাকৃতি ফালমন সাহেবের সে বিনীত মুখভাব, সৌজন্যপূর্ণ সহৃদয় দৃষ্টি এখনো মনে আছে। মানবতার উদার গতিপথের পার্শ্বে অবস্থিত এই ছবিখানি আজিকার এই হিংসা দ্বেষ ও সাম্প্রতিক ধর্মমতের দ্বন্দ্বের দিনে বেশি করিয়া স্মরণে উদিত হয়।
বারোয়ারি যাত্রার আসরে ফালমন সাহেব সকলের সামনের চেয়ার পাতিয়া বসিতেন। যাত্রাগানের অমন ভক্ত দুটি দেখা যাইত না।
—ও বেয়ালাদার, একটা একালে গৎ ধরো বাবা–জুড়িদের এগিয়ে দাও—
সাহেবের ফাইফরমাশ খাটিতে খাটিতে যাত্রাদলের গাইয়ে-বাজিয়ে ব্যতিব্যস্ত।
আর কৃষ্ণ সাজিয়া আসিয়া গান ধরিলেই হইল, অমনি মেডেল ঘোষণা।
সাহেব দাঁড়াইয়া উঠিয়া বলিবেনই—এই যে ছোঁড়াডা কৃষ্ট সেজে এসে গানখানা করে গেল, ওরে আমি একটা রূপোর মেডেল দেব। কথা শেষ করিয়াই চারিদিকে ঘুরিয়া ঘুরিয়া হাসিমুখে চাহিয়া বলিতেন—হাততালি–হাততালি—
অমনি চটপট করিয়া চতুর্দিকে হাততালি পড়িবে। নিজে সকলের আগে হাততালি দিবেন।
কোনো করুণ ভক্তিরসের ব্যাপার ঘটিলে সাহেব সকলের সঙ্গে ‘হরিবোল’ দিয়া উঠিবেন।
বারোয়ারিতে চাঁদা দিতে সাহেব যেমন মুক্তহস্ত, তেমনি রক্ষাকালীপূজা বা শীতলাপূজার অনুষ্ঠানে। তখনকার দিনে বারোয়ারি দুর্গাপূজা বা শ্যামাপূজার রেওয়াজ ছিল না।
মিসেস ফালমন মারা যাওয়ার পর নীলগঞ্জের কুঠির রাঙা ‘প্যাটেন’ ফুলের গাছ, নদীর ধারের অত বড়ো বাড়ি, লেবু ও আমের বাগান, পসার-প্রতিপত্তি, অর্থসম্পত্তি সব কিছু শ্রীহীন হইয়া পড়িল। বাড়ির এক নিম্নজাতীয়া দাসীর সঙ্গে সাহেবের নাম জড়িত হইয়া চারিদিকে প্রচার হইতে লাগিল। মার্জোরি ও ডোরা বিবাহ করিয়া বাহিরে চলিয়া গেল। সাহেবের যে ছেলে বিলাতে পড়িত, সে আর এদেশে আসিলই না। শোনা গেল, ইংলন্ডেই বিবাহ করিয়া সেখানেই সংসার পাতাইয়া সে ইংলন্ডের প্রজাবৃদ্ধির দিকে মন দিয়াছে।
এই সময় নীলগঞ্জের কুঠিতে এক ঘটনা ঘটিল।
বাহির হইতে কে একজন সাহেব আসিয়া কিছুদিন কুঠিতে রহিল। এ সময়ে প্যাটও কুঠি হইতে চলিয়া গিয়াছিল। নবাগত সাহেবের নাম মি. মুডি। এ অঞ্চলে তাহাকে ‘মুদি সাহেব’ বলিত সবাই। মুদি সাহেব একটু অতিরিক্তমাত্রায় মদ খাইত।
একদিন কী ঘটিয়াছিল কেহ জানে না, গভীর রাত্রে মি. ফালমনের সঙ্গে মুদি সাহেবের বচসার শব্দ শোনা গেল। বাহির হইতে চাকরেবাকরে কিছু বুঝিল না, হঠাৎ বন্দুকের আওয়াজ হইল, সকলে ছুটিয়া গিয়া দেখে মুদি সাহেবের রক্তাক্ত প্রাণহীন দেহ ঘরের মেঝেতে লুটাইতেছে এবং ঘরের কোণে সেই নীচজাতীয়া দাসীটা দাঁড়াইয়া থরথর করিয়া কাঁপিতেছে।
পুলিশ তদন্ত হইল। কিন্তু মি. ফালমনের কিছু হয় নাই, ব্যাপার নীলকুঠির শক্ত কম্পাউন্ডের বাহিরে এক পাও গড়ায় নাই।
এই ঘটনার পরেও ফালমন সাহেব অনেকদিন বাঁচিয়া ছিলেন। একাই থাকিতেন। পুত্র-কন্যা কখনো আসিত না। সাহেবের এক ভাই শোনা যায় ইংলন্ড হইতে কতবার তাঁহাকে সেখানে যাইতে লিখিয়াছিল, ফালমন সাহেব বলিতেন— এদেশেই জন্ম, এদেশ ভালোবাসি, যাব কোথায়? যখন মরে যাব ওই নিমতলাডায় কবর দিও, বাবা আর মায়ের পাশে। এদেশেই জন্ম, এদেশেই মাটি মুড়ি দেবে।
ফালমন সাহেব এদেশেই মাটি মুড়ি দিয়াছিলেন। তাঁহার মৃত্যু হইয়াছিল আজ হইতে পঁচিশ বৎসর পূর্বে। নীলগঞ্জের কুঠি ভাঙিয়াচুরিয়া জঙ্গল হইয়া গিয়াছে। এখন সেখানে দিনমানেও বাঘ বুনো-শুয়োরের ভয়ে কেউ যায় না। কুঠির নিমতলায় ঘন কুঁচকাঁটায় দুর্ভেদ্য ঝোপের ছায়ায় খুঁজিলে ফালমন সাহেবের কবরের ভগ্নাবশেষ এখন কৌতূহলী রাখাল বালকদের চোখে পড়ে। আলমপুর পরগনার বড়ো তরফের দে চৌধুরী জমিদারবাবুরা নীলগঞ্জের জমিদারি গবর্নমেন্টের নীলামে ক্রয় করিয়াছিলেন।