পঞ্চম খণ্ড
অমরনাথের কথা
প্রথম পরিচ্ছেদ
এই অন্ধ পুষ্পনারী কি মোহিনী জানে, তাহা বলিতে পারি না। চক্ষে কটাক্ষ নাই, অথচ আমার মত সন্ন্যাসীকেও মোহিত করিল। আমি মনে করিয়াছিলাম, লবঙ্গলতার পর আর কখন কাহাকে ভালবাসিব না। মনুষ্যের সকলই অনর্থক দম্ভ! অন্য দূরে থাক, সহজেই এই অন্ধ পুষ্পনারী কর্তৃক মোহিত হইলাম।
মনে করিয়াছিলাম-এ জীবন অমাবস্যার রাত্রির স্বরূপ-অন্ধকারেই কাটিবে-সহসা চন্দ্রোদয় হইল! মনে করিয়াছিলাম-এ জীবনসিন্ধু সাতারিয়াই আমাকে পার হইতে হইবে-সহসা সম্মুখে সুবর্ণসেতু দেখিলাম। মনে করিয়াছিলাম, এ মরুভূমি চিরকাল এমনই দগ্ধক্ষেত্র থাকিবে, রজনী সহসা সেখানে নন্দনকানন আনিয়া বসাইল! আমার এ সুখের আর সীমা নাই। চিরকাল যে অন্ধকার গুহামধ্যে বাস করিয়াছে, সহসা সে যদি এই সূর্যকিরণসমুজ্জ্বল রুপল্লবকুসুমসুশোভিত মনুষ্যলোকে স্থাপিত হয়, তাহার যে আনন্দ, আমার সেই আনন্দ! যে চিরকাল পরাধীন পরপীড়িত দাসানুদাস ছিল, সে যদি হঠাৎ সর্বেশ্বর সার্বভৌম হয়, তাহার যে আনন্দ, আমার সেই আনন্দ! রজনীর মত জন্মান্ধ, হঠাৎ তাহার চক্ষু ফুটিলে যে আনন্দ, রজনীকে ভালবাসিয়া আমার সেই আনন্দ!
কিন্তু এ আনন্দে পরিণামে কি হইবে, তাহা বলিতে পারি না। আমি চোর! আমার পিঠে, আগুনের অক্ষরে লেখা আছে যে, আমি চোর! যেদিন রজনী সেই অক্ষরে হাত দিয়া জিজ্ঞাসা করিবে, এ কিসের দাগ-আমি তাহাকে কি বলিব! বলিব কি যে, ও কিছু নহে? সে অন্ধ, কিছু জানিতে পারিবে না। কিন্তু যাহাকে অবলম্বন করিয়া আমি সংসারে সুখী হইতে চাহিতেছি-তাহাকে আবার প্রতারণা করিব! যে পারে, সে করুক, আমি যখন পারিয়াছি, তখন ইহার অপেক্ষাও গুরুতর দুষ্কার্য করিয়াছি-করিয়া ফলভোগ করিয়াছি-আর কেন? আমি লবঙ্গলতার কাছে বলিয়াছিলাম, সকল কথা রজনীকে বলিব, কিন্তু বলিতে মুখ ফুটে নাই। এখন বলিব।
যে দিন রজনী শচীন্দ্রকে দেখিয়া আসিয়াছিল, সেই দিন অপরাহ্নে আমি রজনীকে এই কথা বলিতে গেলাম। গিয়া দেখিলাম যে, রজনী একা বসিয়া কাঁদিতেছে। আমি তখন তাহাকে কিছু না বলিয়া, রজনীর মাসীকে জিজ্ঞাসা করিলাম যে, রজনী কাঁদিতেছে কেন? তাঁহার মাসী বলিল যে, কি জানি? মিত্রদিগের বাড়ী হইতে আসিয়া অবধি রজনী কাঁদিতেছে। আমি স্বয়ং শচীন্দ্রের নিকট যাই নাই-আমার প্রতি শচীন্দ্র বিরক্ত, যদি আমাকে দেখিয়া তাহার পীড়াবৃদ্ধি হয়, এই আশঙ্কায় যাই নাই-সুতরাং সেখানে কি হইয়াছিল, তাহা জানিতাম না। রজনীকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “কেন কাঁদিতেছ?” রজনী চক্ষু মুছিয়া চুপ করিয়া রহিল।
আমি বড় কাতর হইলাম। বলিলাম, “দেখ রজনী, তোমার যাহা কিছু দু:খ, তাহা জানিতে পারিলে আমি প্রাণপাত করিয়া তাহা নিবারণ করিব-তুমি কি দু:খে কাঁদিতেছ, আমায় বলিবে না?”
রজনী আবার কাঁদিতে আরম্ভ করিল। বহু কষ্টে আবার রোদন সম্বরণ করিয়া বলিল, “আপনি এত অনুগ্রহ করেন, কিন্তু আমি তাহার যোগ্য নহি |”
আমি। সে কি রজনী? আমি মনে জানি, আমি তোমার যোগ্য নহি। আমি তোমাকে সেই কথাই বলিতে আসিয়াছি।
র। আমি আপনার অনুগৃহীত দাসী, আমাকে অমন কথা কেন বলেন?
আমি। শুন রজনী। আমি তোমাকে বিবাহ করিয়া, ইহজন্মে সুখে কাটাইব, এই আমার একান্ত ভরসা। এ আশা আমার ভগ্ন হইলে, বুঝি আমি মরিব। কিন্তু সে আশাতেও যে বিঘ্ন, তাহা তোমাকে বলিতে আসিয়াছি। শুনিয়া উত্তর দিও, না শুনিয়া উত্তর দিও না। প্রথম যৌবনে একদিন আমি রূপান্ধ হইয়া উন্মত্ত হইয়াছিলাম-জ্ঞান হারাইয়া চোরের কাজ করিয়াছিলাম। অঙ্গে আজিও তাহার চিহ্ন আছে। সেই কথাই তোমাকে বলিতে আসিয়াছি।
তখন ধীরে ধীরে, নিতান্ত ধৈর্যমাত্র সহায় করিয়া, সেই অকথনীয় কথা রজনীকে বলিলাম। রজনী অন্ধ, তাই বলিতে পারিলাম। চক্ষে চক্ষে সন্দর্শন হইলে বলিতে পারিতাম না।
রজনী নীরব হইয়া রহিল। আমি তখন বলিলাম, “রজনী! রূপোন্মাদে উন্মত্ত হইয়া প্রথম যৌবনে একদিন এই অজ্ঞানের কার্য করিয়াছিলাম। আর কখন কোন অপরাধ করি নাই। চিরজীবন সেই একদিনের অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করিয়াছি। আমাকে কি তুমি গ্রহণ করিবে?”
রজনী কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল, “আপনি যদি চিরকাল দস্যুবৃত্তি করিয়া থাকেন-আপনি যদি সহস্র ব্রহ্মহত্যা, গোহত্যা, স্ত্রীহত্যা করিয়া থাকেন, তাহা হইলেও আপনি আমার কাছে দেবতা। আপনি আমাকে চরণে স্থান দিলেই আমি আপনার দাসী হইব। কিন্তু আমি আপনার যোগ্য নহি। সেই কথাটি আপনার শুনিতে বাকি আছে |”
আমি। সে কি রজনী?
র। আমার এই পাপ মন পরের কাছে বিক্রীত।
আমি চমকিয়া শিহরিয়া উঠিলাম। জিজ্ঞাসা করিলাম, “সে কি রজনী?”
রজনী বলিল, “আমি স্ত্রীলোক-আপনার কাছে ইহার অধিক আর কি প্রকারে বলিব? কিন্তু লবঙ্গ ঠাকুরাণী সকল জানেন। যদি আপনি তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করেন, তবে সকল শুনিতে পাইবেন। বলিবেন, আমি সকল কথা বলিতে বলিয়াছি |”
আমি তখনই মিত্রদিগের গৃহে গেলাম। যে প্রকারে লবঙ্গের সাক্ষাৎ পাইলাম, তাহা লিখিয়া ক্ষুদ্র বিষয়ে কালক্ষেপ করিব না। দেখিলাম, লবঙ্গলতা ধূল্যলুণ্ঠিতা হইয়া শচীন্দ্রের জন্য কাঁদিতেছে। যাইবামাত্র লবঙ্গলতা আমার পা জড়াইয়া আরও কাঁদিতে লাগিল-বলিল, “ক্ষমা কর! অমরনাথ, ক্ষমা কর! তোমার উপর আমি এত অত্যাচার করিয়াছিলাম বলিয়া বিধাতা আমাকে দণ্ডিত করিতেছেন। আমার গর্ভজ পুত্রের অধিক প্রিয় পুত্র শচীন্দ্র বুঝি আমারই দোষে প্রাণ হারায়! আমি বিষ খাইব মরিব! আজি তোমার সম্মুখে বিষ খাইয়া মরিব |”
আমার বুক ভাঙ্গিয়া গেল। রজনী কাঁদিতেছে, লবঙ্গ কাঁদিতেছে। ইহারা স্ত্রীলোক, চক্ষের জল ফেলে ; আমার চক্ষের জল পড়িতেছিল না-কিন্তু রজনীর কথায় আমার হৃদয়ের ভিতর হইতে রোদনধ্বনি উঠিতেছিল। লবঙ্গ কাঁদিতেছে, রজনী কাঁদিতেছে, আমি কাঁদিতেছি-আর শচীন্দ্রের এই দশা! কে বলে সংসার সুখের? সংসার অন্ধকার!
আপনার দু:খ রাখিয়া আগে লবঙ্গের দু:খের কথা জিজ্ঞাসা করিলাম। লবঙ্গ তখন কাঁদিতে কাঁদিতে শচীন্দ্রের পীড়ার বৃত্তান্ত সমুদয় বলিল। সন্ন্যাসীর বিদ্যা পরীক্ষা হইতে রুগ্নশয্যায় রজনীর সাক্ষাৎ পর্যন্ত লবঙ্গ সকল বলিল।
তার পর রজনীর কথা জিজ্ঞাসা করিলাম। বলিলাম, “রজনী সকল কথা বলিতে বলিয়াছে-
বল |” লবঙ্গ তখন, রজনীর কাছে যাহা যাহা শুনিয়াছিল, অকপটে সকল বলিল।
রজনী শচীন্দ্রের, শচীন্দ্র রজনীর ; মাঝখানে আমি কে?
এবার বস্ত্রে মুখ লুকাইয়া কাঁদিতে কাঁদিতে আমি ঘরে ফিরিয়া আসিলাম।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
এ ভবের হাট হইতে আমার দোকানপাট উঠাইতে হইল। আমার অদৃষ্টে সুখ বিধাতা লিখেন নাই-পরের সুখ কাড়িয়া লইব কেন? শচীন্দ্রের রজনী শচীন্দ্রকে দিয়া আমি এ সংসার ত্যাগ করিব। এ হাট ভাঙ্গিব, এ হৃদয়কে শাসিত করিব-যিনি সুখদু:খের অতীত, তাঁহারই চরণে সকল সমর্পণ করিব।
প্রভো, তোমায় অনেক সন্ধান করিয়াছি, কই তুমি? দর্শনে বিজ্ঞানে তুমি নাই। জ্ঞানীর জ্ঞানে, ধ্যানীর ধ্যানে তুমি নাই। তুমি অপ্রমেয়, এজন্য তোমার পক্ষে প্রমাণ নাই। এই স্ফুটিতোন্মুখ হৃদ্পদ্মই তোমার প্রমাণ-ইহাতে তুমি আরোহণ কর। আমি অন্ধ পুষ্পনারীকে পরিত্যাগ করিয়া, তোমার ছায়া সেখানে স্থাপন করি।
তুমি নাই? না থাক, তোমার নামে আমি সকল উৎসর্গ করিব। অখণ্ডমণ্ডলাকারং ব্যাপ্তং যেন চরাচরং তস্মৈ নম: বলিয়া এ কলঙ্কলাঞ্ছিত দেহ উৎসর্গ করিব। তুমি যাহা দিয়াছ, তুমি কি তাহা লইবে না? তুমি লইবে, নহিলে এ কলঙ্কের ভার আর কে পবিত্র করিবে?
প্রভো! আপনার কাছে একটা নিবেদন আছে। এ দেহ কলঙ্কিত করাইল কে, তুমি, না আমি? আমি যে অসৎ অসার, দোষ আমার, না তোমার? আমার এ মনিহারির দোকান সাজাইল কে, তুমি, না আমি? যাহা তুমি সাজাইয়াছ, তাহা তোমাকেই দিব। আমি এ ব্যবসা আর রাখিব না।
সুখ! তোমাকে সর্বত্র খুঁজিলাম-পাইলাম না। সুখ নাই-তবে আশায় কাজ কি? যে দেশে অগ্নি নাই, সে দেশে ইন্ধন আহরণ করিয়া কি হইবে?
প্রতিজ্ঞা করিয়াছি, সব বিসর্জন দিব।
* * *
আমি পরদিন শচীন্দ্রকে দেখিতে গেলাম। দেখিলাম, শচীন্দ্র অধিকতর স্থির-অপেক্ষাকৃত প্রফুল্ল। তাঁহার সঙ্গে অনেকক্ষণ কথোপকথন করিতে লাগিলাম। বুঝিলাম, আমার উপর যে বিরক্তি, শচীন্দ্রের মন হইতে তাহা যায় নাই।
পরদিন পুনরপি তাঁহাকে দেখিতে গেলাম। প্রত্যহই তাঁহাকে দেখিতে যাইতে লাগিলাম। শচীন্দ্রের দুর্বলতা ও ক্লিষ্টভাব কমিল না, কিন্তু ক্রমে স্থৈর্য জন্মিতে লাগিল। প্রলাপ দূর হইল। ক্রমে শচীন্দ্র প্রকৃতিস্থ হইলেন।
রজনীর কথা একদিনও শচীন্দ্রের মুখে শুনি নাই। কিন্তু ইহা দেখিয়াছি যে, যে দিন হইতে রজনী আসিয়াছিল, সেই দিন হইতে তাঁহার পীড়া উপশমিত হইয়া আসিতেছিল।
একদিন, যখন আর কেহ শচীন্দ্রের কাছে ছিল না, তখন আমি ধীরে ধীরে বিনা আড়ম্বরে রজনীর কথা পাড়িলাম। ক্রমে তাহার অন্ধতার কথা পাড়িলাম, অন্ধের দু:খের কথা বলিতে লাগিলাম, এই জগৎসংসারশোভা দর্শনে সে যে বঞ্চিত,-প্রিয়জনদর্শনসুখে সে যে আজন্মমৃত্যু পর্যন্ত বঞ্চিত, এই সকল কথা তাঁহার সাক্ষাতে বলিতে লাগিলাম। দেখিলাম, শচীন্দ্র মুখ ফিরাইলেন, তাঁহার চক্ষু জলপূর্ণ হইল।
অনুরাগ বটে।
তখন বলিলাম, “আপনি রজনীর মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী। আমি সেই জন্যই একটি কথার পরামর্শ জিজ্ঞাসা করিতে চাই। রজনী একে বিধাতাকর্তৃক পীড়িতা, আবার আমাকর্তৃক আরও গুরুতর পীড়িতা হইয়াছে |”
শচীন্দ্র আমার প্রতি বিকট কটাক্ষ নিক্ষেপ করিলেন।
আমি বলিলাম, “আপনি যদি সমুদয় মনোযোগপূর্বক শুনেন, তবেই আমি বলিতে প্রবৃত্ত হই |”
শচীন্দ্র বলিলেন, “বলুন |”
আমি বলিলাম, “আমি অত্যন্ত লোভী এবং স্বার্থপর। আমি তাহার চরিত্রে মোহিত হইয়া, তাহাকে বিবাহ করিতে উদ্যোগী হইয়াছি। সে আমার নিকট কৃতজ্ঞতাপাশে বদ্ধ ছিল, সেইজন্য আমার অভিপ্রায়ে সম্মত হইয়াছে |”
শচীন্দ্র বলিলেন, “মহাশয়, এ সকল কথা আমাকে বলিতেছেন কেন?”
আমি বলিলাম, “আমি ভাবিয়া দেখিলাম, আমি সন্ন্যাসী, আমি নানা দেশ ভ্রমণ করিয়া বেড়াই;
অন্ধ রজনী কি প্রকারে সঙ্গে দেশে দেশে বেড়াইবে? আমি এখন ভাবিতেছি অন্য কোন ভদ্রলোক তাহাকে বিবাহ করে, তবে সুখের হয়। আমি তাহাকে অন্য পাত্রস্থ করিতে চাই। যদি কেহ আপনার সন্ধানে থাকে, সেই জন্য আপনাকে এত কথা বলিতেছি |”
শচীন্দ্র একটু বেগের সহিত বলিলেন, “রজনীর পাত্রের অভাব নাই |”
আমি বুঝিলাম, রজনীর বরপাত্র কে।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
পরদিন আবার মিত্রদিগের আলয়ে গিয়া দেখা দিলাম। লবঙ্গলতাকে বলিয়া পাঠাইলাম যে, আমি কলিকাতা ত্যাগ করিয়া যাইব। এক্ষণে সম্প্রতি প্রত্যাগমন করিব না-তিনি আমার শিষ্যা, আমি তাঁহাকে আশীর্বাদ করিব।
লবঙ্গলতা আমার সহিত পুনশ্চ সাক্ষাৎ করিল। আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “আমি কালি যাহা শচীন্দ্রকে বলিয়া গিয়াছি, তাহা শুনিয়াছ কি?”
ল। শুনিয়াছি। তুমি অদ্বিতীয়। আমাকে ক্ষমা করিও; আমি তোমার গুণ জানিতাম না।
আমি নীরব হইয়া রহিলাম। তখন অবসর পাইয়া লবঙ্গলতা জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি আমার সঙ্গে সাক্ষাতের ইচ্ছা করিয়াছ কেন? তুমি নাকি কলিকাতা হইতে উঠিয়া যাইতেছ?”
আমি । যাইব।
ল। কেন?
আমি । যাইব না কেন? আমাকে যাইতে বারণ করিবার ত কেহ নাই।
ল। যদি আমি বারণ করি?
আমি । আমি তোমার কে যে, বারণ করিবে?
ল। তুমি আমার কে? তা ত জানি না। এ পৃথিবীতে তুমি আমার কেহ নও। কিন্তু যদি লোকান্তর থাকে-
লবঙ্গলতা আর কিছু বলিল না। আমি ক্ষণেক অপেক্ষা করিয়া বলিলাম, “যদি লোকান্তর থাকে, তবে?”
লবঙ্গলতা বলিল, “আমি স্ত্রীলোক-সহজে দুর্বলা। আমার কত বল, দেখিয়া তোমার কি হইবে? আমি ইহাই বলিতে পারি, আমি তোমার পরম মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী |”
আমি বড় বিচলিত হইলাম, বলিলাম, “আমি সে কথায় বিশ্বাস করি। কিন্তু একটি কথা আমি কখন বুঝিতে পারিলাম না। তুমি যদি মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী, তবে আমার গায়ে চিরদিনের জন্য এ কলঙ্ক লিখিয়া দিলে কেন? এ যে মুছিলে যায় না-কখন মুছিলে যাইবে না।
লবঙ্গ অধোবদনে রহিল। ক্ষণেক ভাবিল। বলিল, “তুমি কুকাজ করিয়াছিলে, আমিও বালিকাবুদ্ধিতেই কুকাজ করিয়াছিলাম। যাহার যে দণ্ড, বিধাতা তাহার বিচার করিবেন,-আমি বিচারের কে? এখন সে অনুতাপ আমার-কিন্তু সে সকল কথা না বলাই ভাল। তুমি আমার সে অপরাধ ক্ষমা করিবে?”
আমি। তুমি না বলিতেই আমি ক্ষমা করিয়াছি। ক্ষমাই বা কি? উচিত দণ্ড করিয়াছিলে- তোমার অপরাধ নাই। আমি আর আসিব না-আর কখন তোমার সঙ্গে সাক্ষাৎ হইবে না। কিন্তু যদি তুমি কখন ইহার পরে শোন যে, অমরনাথ কুচরিত্র নহে, তবে তুমি আমার প্রতি একটু-অণুমাত্র-স্নেহ করিবে?
ল। তোমাকে স্নেহ করিলে আমি ধর্মে পতিত হইব।
আমি। না, আমি সে স্নেহের ভিখারী আর নহি। তোমার এই সমুদ্রতুল্য হৃদয়ে কি আমার জন্য এতটুকু স্থান নাই?
ল। না-যে আমার স্বামী না হইয়া একবার আমার প্রণয়াকাঙ্ক্ষী হইয়াছিল, তিনি স্বয়ং মহাদেব হইলেও তাঁহার জন্য আমার হৃদয়ে এতটুকু স্থান নাই। লোকে পাখী পুষিলে যে স্নেহ করে, ইহলোকে তোমার প্রতি সে স্নেহ কখন হইবে না।
আবার “ইহলোক |” যাক-আমি লবঙ্গের কথা বুঝিলাম কি না, বলিতে পারি না; কিন্তু লবঙ্গ আমার কথা বুঝিল না। কিন্তু দেখিলাম, লবঙ্গ ঈষৎ কাঁদিতেছে।
আমি বলিলাম, “আমার যাহা বলিবার অবশিষ্ট আছে, তাহা বলিয়া যাই। আমার কিছু ভূসম্পত্তি আছে, আমার তাহাতে প্রয়োজন নাই। তাহা আমি দান করিয়া যাইতেছি |”
ল। কাহাকে?
আমি। যে রজনীকে বিবাহ করিবে, তাহাকে।
ল। তোমার সমুদয় স্থাবর সম্পত্তি?
আমি। হাঁ। তুমি এই দানপত্র এক্ষণে তোমার কাছে অতি গোপনে রাখিবে। যত দিন না রজনীর বিবাহ হয়, ততদিন ইহার কথা প্রকাশ করিও না। বিবাহ হইয়া গেলে, রজনীর স্বামীকে দানপত্র দিও।
এই কথা বলিয়া, ললিতলবঙ্গলতার উত্তরের অপেক্ষা না করিয়া, দানপত্র আমি তাহার নিকট ফেলিয়া দিয়া চলিয়া গেলাম। আমি সকল বন্দোবস্ত ঠিক করিয়া আসিয়াছিলাম-আমি আর বাড়ী গেলাম না। একেবারে ষ্টেশনে গিয়া বাষ্পীয় শকটারোহণে কাশ্মীর যাত্রা করিলাম।
দোকানপাট উঠিল।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
ইহার দুই বৎসর পরে, একদা ভ্রমণ করিতে করিতে আমি ভবানীনগর গেলাম। শুনিলাম যে, মিত্রবংশীয় কেহ তথায় আসিয়া বাস করিতেছেন। কৌতূহলপ্রযুক্ত আমি দেখিতে গেলাম। দ্বারদেশে শচীন্দ্রের সহিত সাক্ষাৎ হইল।
শচীন্দ্র আমাকে চিনিতে পারিয়া, নমস্কার আলিঙ্গনপূর্বক আমার হস্ত ধারণ করিয়া লইয়া উত্তমাসনে বসাইলেন। অনেকক্ষণ তাঁহার সঙ্গে নানাবিধ কথোপকথন হইল। তাঁহার নিকট শুনিলাম যে, তিনি রজনীকে বিবাহ করিয়াছেন। কিন্তু রজনী ফুলওয়ালী ছিল, পাছে কলিকাতায় ইহাতে লোকে ঘৃণা করে, এই ভাবিয়া, তিনি কলিকাতা পরিত্যাগ করিয়া ভবানীনগরে বাস করিতেছেন। তাঁহার পিতা ও ভ্রাতা কলিকাতাতেই বাস করিতেছেন।
আমার নিজসম্পত্তি প্রতিগ্রহণ করিবার জন্য শচীন্দ্র আমারে বিস্তর অনুরোধ করিলেন। কিন্তু বলা বাহুল্য যে, আমি তাহাতে স্বীকৃত হইলাম না। শেষে শচীন্দ্র রজনীর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য আমাকে অনুরোধ করিলেন। আমারও সে ইচ্ছা ছিল। শচীন্দ্র আমাকে অন্ত:পুরে রজনীর নিকটে লইয়া গেলেন।
রজনীর নিকট গেলে, সে আমাকে প্রণামপূর্বক পদধূলি গ্রহণ করিল। আমি দেখিলাম যে, ধূলিগ্রহণকালে, পাদস্পর্শ জন্য, অন্ধগণের স্বাভাবিক নিয়মানুযায়ী সে ইতস্তত: হস্তসঞ্চালন করিল না, এককালেই আমার পাদস্পর্শ করিল। কিছু বিস্মিত হইলাম।
সে আমাকে প্রণাম করিয়া দাঁড়াইল। কিন্তু মুখ অবনত করিয়া রহিল। আমার বিস্ময় বাড়িল। অন্ধদিগের লজ্জা চক্ষুর্গত নহে। চক্ষে চক্ষে মিলনজনিত যে লজ্জা, তাহা তাহাদিগের ঘটিতে পারে না বলিয়া, তাহারা দৃষ্টি লুকাইবার জন্য মুখ নত করে না। একটা কি কথা জিজ্ঞাসা করিলাম, রজনী মুখ তুলিয়া আবার নত করিল, দেখিলাম-নিশ্চিত দেখিলাম-সে চক্ষে কটাক্ষ!
জন্মান্ধ রজনী কি এখন তবে দেখিতে পায়? আমি শচীন্দ্রকে এই কথা জিজ্ঞাসা করিতে যাইতেছিলাম, এমত সময়ে শচীন্দ্র আমাকে বসিবার আসন দিবার জন্য রজনীকে আজ্ঞা করিলেন। রজনী একখানা কার্পেট লইয়া পাতিতেছিল-যেখানে পাতিতেছিল, সেখানে অল্প এক বিন্দু জল পড়িয়াছিল; রজনী আসন রাখিয়া, অগ্রে অঞ্চলের দ্বারা জল মুছিয়া লইয়া আসন পাতিল। আমি বিলক্ষণ দেখিয়াছিলাম যে, রজনী সেই জল স্পর্শ না করিয়াই আসন পাতা বন্ধ করিয়া জল মুছিয়া লইয়াছিল। অতএব স্পর্শের দ্বারা কখনই সে জানিতে পারে নাই যে, সেখানে জল আছে। অবশ্য সে জল দেখিতে পাইয়াছিল।
আমি আর থাকিতে পারিলাম না। জিজ্ঞাসা করিলাম, “রজনী, এখন তুমি কি দেখিতে পাও?”
রজনী মুখ নত করিয়া, ঈষৎ হাসিয়া বলিল, “হাঁ |”
আমি বিস্মিত হইয়া শচীন্দ্রের মুখপানে চাহিলাম। শচীন্দ্র বলিলেন, “আশ্চর্য বটে, কিন্তু ঈশ্বরকৃপায় না হইতে পারে, এমন কি আছে? আমাদিগের ভারতবর্ষে চিকিৎসা সম্বন্ধে কতকগুলি অতি আশ্চর্য প্রকরণ ছিল-সেসকল তত্ত্ব ইউরোপীয়েরা বহুকাল পরিশ্রম করিলেও আবিষ্কৃত করিতে পারিবেন না। চিকিৎসাবিদ্যায় কেন, সকল বিদ্যাতেই এইরূপ। কিন্তু সেসকল এক্ষণে লোপ পাইয়াছে, কেবল দুই একজন সন্ন্যাসী উদাসীন প্রভৃতির কাছে সে সকল লুপ্ত বিদ্যার কিয়দংশ অতি গুহ্যভাবে অবস্থিতি করিতেছে। আমাদিগের বাড়ীতে একজন সন্ন্যাসী কখন কখন যাতায়াত করিয়া থাকেন, তিনি আমাকে ভালবাসিতেন। তিনি যখন শুনিলেন, আমি রজনীকে বিবাহ করিব, তখন বলিলেন, ‘শুভদৃষ্টি হইবে কি প্রকারে? কন্যা যে অন্ধ |’ আমি রহস্য করিয়া বলিলাম, ‘আপনি অন্ধত্ব আরোগ্য করুন |’ তিনি বলিলেন, ‘করিব-এক মাসে |’ ঔষধ দিয়া, তিনি এক মাসে রজনীর চক্ষের দৃষ্টি সৃজন করিলেন |”
আমি আরও বিস্মিত হইলাম; বলিলাম, “না দেখিলে, আমি ইহা বিশ্বাস করিতাম না। ইউরোপীয় চিকিৎসাশাস্ত্রানুসারে ইহা অসাধ্য |”
এই কথা হইতেছিল, এমত সময়ে এক বৎসরের একটি শিশু টলিতে টলিতে, চলিতে চলিতে, পড়িতে পড়িতে, উঠিতে উঠিতে সেইখানে আসিয়া উপস্থিত হইল। শিশু আসিয়া, রজনীর পায়ের কাছে দুই একটা আছাড় খাইয়া, তাহার বস্ত্রের একাংশ ধৃত করিয়া টানাটানি করিয়া উঠিয়া, রজনীর হাঁটু ধরিয়া তাহার মুখপানে চাহিয়া, উচ্চহাসি হাসিয়া উঠিল। তাহার পরে, ক্ষণেক পরে আমার মুখপানে চাহিয়া হস্তোত্তোলন করিয়া আমাকে বলিল, “দা!” (যা!)
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “কে এটি?”
শচীন্দ্র বলিলেন, “আমার ছেলে |”
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “ইহার নাম কি রাখিয়াছেন?”
শচীন্দ্র বলিলেন, “অমরপ্রসাদ |”
আমি আর সেখানে দাঁড়াইলাম না।