স্বপ্ন-বাসুদেব

স্বপ্ন-বাসুদেব

খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের কথা। আজ থেকে প্রায় বাইশশো বছর আগের তক্ষশিলা।

নগরীর রাজপথ কোলাহলমুখর! নবারুণোদয় নিজ মহিমায় ধীরে ধীরে উচ্চ চূড়ায় ও স্তম্ভে নবপ্রভাতের বাণী ঘোষণা করচে। তক্ষশিলায় সম্প্রতি দেবী মিনার্ভার এক মন্দির তৈরি হচ্ছে, পার্থেননের স্থাপত্যের অনুকরণে—গম্বুজ বা ডোম কোথাও নেই—ছাদ সমতল, অগণিত সুসমঞ্জস বিরাট স্তম্ভশ্রেণী। গ্রিক স্থাপত্য গম্বুজের খিলান গড়তে অভ্যস্ত ছিল না। বহু পরবর্তী কালে সারাসেন সভ্যতার যুগে ইউরোপে এর উৎপত্তি, সারাসেন তথা মুর সভ্যতার দান এটি।

বড়ো বড়ো স্প্রিংবিহীন কাঠ ও লোহার তৈরি এক্কার ধরনের গাড়িতে মাঝে মাঝে দু-চারজন ধনী বণিক ও গ্রিক জমিদারগণ যাতায়াত করছেন। সুন্দরী গ্রিক বালিকাও মাঝে মাঝে রথে চড়ে চলেছে—দেবী এথেনির মতো। ব্রোঞ্জের বিরাট জুপিটারমূর্তি প্রস্তরের ছত্রাবরণতলে শোভা পাচ্চে রাজপথের মোড়ে। বণিকগণের আপণশ্রেণীতে কত কি জিনিস—কত দেশ থেকে আহরণ করে আনা।

একটি সুবেশ বালক ভৃত্য একটি দোকানে এসে বল্লে—কলা আছে?

—আছে, দাম বেশি পড়বে।

—কোথাকার কলা?

—এই কাছের গাঁয়ের। বুড়ো রোজ টাটকা দিয়ে যায়।

—আর আঙুর?

—মদ তৈরি করবার জন্যে সামান্য কিছু এনেছিলাম,—নিয়ে যাও।

হঠাৎ রাজপথকে চমকিত করে তুর্য বেজে উঠল। মহারাজ অ্যান্টিআলকিডাসের মহামাত্য ডিওন ভ্রমণে বেরিয়েছেন—রাজপথ কাঁপিয়ে শ্বেতাশ্ববাহিত টাঙ্গায় রাজপুরুষ ডিওন চলে গেলেন—বালক ভৃত্যটি হাঁ করে চেয়ে রইল।

দোকানদার বল্লে—তোমার কর্তা কোথায় চল্লেন?

বালক তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বল্লে—কি জানি বাপু! সে খোঁজে আমার দরকার কি?

—ওঁর ছেলে কি এখনো সেই বিদেশে?

—তিনি কাল এসেছেন মালব থেকে। সেখান থেকে এসেই অসুখ বাধিয়েছেন বলেই ফল নিতে এসেচি এত সকালে। বলব কি–পয়সাকড়ির অবস্থা ভালো না। রাজা মাইনে দেন না ঠিকমতো—লুটেপুটে নিয়ে যা চলে।

দোকানদার অধীরভাবে বলে উঠল—যাও, যাও—আমার দোকানে ওসব— এক্ষুনি কে শুনবে! তোমার কি, বড়োলোকের চাকর—সুন্দর মুখের সব মাপ—

এই কথার মধ্যে কিঞ্চিৎ বক্রোক্তি ছিল। ভৃত্য সে উক্তি গায়ে না-মেখেই চলে গেল।

 

একটু পরে স্বয়ং ডিওনপুত্র  হেলিওডোরাস এসে ফলের দোকানের সামনে দাঁড়াল। সুগঠিতদেহ সৌম্যকান্তি গ্রিক যুবক, রং অনেকটা আধুনিককালের পেশোয়ারি মুসলমানের মতো। দীর্ঘ দেহ, ঈষৎ কুঞ্চিত কেশ, চক্ষু দুটি নীল নয়— কটা। হেলিওডোরাস চাকা ছুড়বার প্রতিযোগিতায় দু-বার সকলকে পরাজিত করে মহারাজ অ্যান্টি আলকিডাসের প্রকাশ্য সভায় পুরস্কার পেয়েছেন। তক্ষশিলার অনেক লোকে তাঁকে চেনে। কপিলা থেকে আনীত বিদেশি সুরা খুব চড়া মূল্যে বিক্রি হয় তক্ষশিলার বাজারে। সাধারণ লোকের সাধ্য নেই তা কেনে—কিন্তু হেলিওডোরাস বন্ধুবান্ধব নিয়ে সরাইখানায় বসে ফুর্তি করবার সময়ে কপিলার সুরা ব্যতীত অন্য কিছু চায় না।

ফলের দোকানের মালিক সসম্ভমে অভিবাদন করে বল্লে—আসুন ছোটোকর্তা, আমার আজ বড়ো সৌভাগ্য—এত সকালে আপনার পায়ের ধুলো পড়ল এ গরীবের দোকানে।

হেলিওডোরাস ঈষৎ গর্বিত সুরে বল্লে–জুজু এখানে এসেছিল?

—হাঁ কর্তা, এইমাত্র চলে গেল।

—আঙুর দিয়ে তাকে?

কথার উত্তর দোকানির কাছ থেকে শুনবার আগেই হেলিওডোরাস চলে গেল। দোকানি অনেকক্ষণ একদৃষ্টে হেলিওডোরাসের অপস্রিয়মাণ সুন্দর চেহারার দিকে চেয়ে রইল।

ডিওনের আর্থিক অবস্থা আজকাল সত্যই ভালো নয়। রাজার দরবারে তিনি সভাসদ বটে, কিন্তু রাজা অ্যান্টি আলকিডাসের নিজেরই আর্থিক অবস্থা যা, তাতে সভাসদদের অর্থসাহায্য করবার অবস্থা নয় তাঁর। গান্ধারের রাজা জোজিফাস ও পুরুষপুরের গ্রিক তালুকদার হিরাক্লিয়াসের সঙ্গে অনবরত যুদ্ধ লেগেই আছে— রাজকোষের যাবতীয় অর্থ এখন ওদিকেই ওড়ে। আপনি বাঁচলে বাপের নাম, সুতরাং ডিওন এবং অন্যান্য কর্মচারীগণ ঠিকমতো বেতন পান না, বাজারের বণিক ও প্রজাদের নিকট নানা ছলে অর্থশোষণ করেন। এঁদের মধ্যে ডিওন প্রধান সভাসদ, সুতরাং তাঁর অত্যাচারে তক্ষশিলার বিত্তশালী প্রজা ও বণিক মাত্রেই তাঁর ওপর যথেষ্ট বিরক্ত।

রাজা অ্যান্টি আলকিডাস ব্যাকট্রিয়ান গ্রিক—সুতরাং ভারতীয় প্রজা যত বেশি উৎপীড়িত হয়—গ্রিক ব্যবসায়ী বা প্রজা তার অর্ধেকও না। দু-বার ভারতীয় বণিকসংঘ প্রতিবাদ করেছিল সভাসদের এ অত্যাচারের বিরুদ্ধে। সভাসদ তাই কি, বিনা পয়সায় জিনিস দেওয়া হবে না—তিনি যিনিই হোন। ধার নিয়ে উপুড় হাত করবেন না সব! কীসের খাতির? এ ব্যবস্থা টেকেনি। গান্ধার থেকে সার্থবাহ বণিকসম্প্রদায় উষ্ট্রপৃষ্ঠে উৎকৃষ্ট সুরা ও বিদেশি ফল নিয়ে আসত—এরা তার উপর অতিরিক্ত শুল্ক বসালে, বাজারে অত চড়া দামে সে-সব খাবার লোক রইল না। দু-বার বাজারে দোকান লুঠ হল—এইসব নানা উপদ্রব। গ্রিক বণিকগণও যে এ অত্যাচার থেকে একেবারে মুক্ত তা নয়, তবুও তাদের প্রতি অত্যাচার এদের তুলনায় অত্যন্ত কম।

আমার আশেপাশের সেরা রেস্টুরেন্ট

হেলিওডোরাসকে ঠিক এইজন্যে কোনো ভারতীয় প্রজা পছন্দ করত না। সে ছিল উদ্ধৃঙ্খল ও উদ্ধত—’গ্রিক ছাড়া অন্য কেউ মানুষ নয়’ এই তার মত। তার আদর্শ পুরুষ হল লিওনিডাস, যিনি থর্মপলির গিরিসংকটে অমর হয়ে আছেন, থেমেস্টোক্লিস যিনি টেম্পি গিরিবর্ক্স রক্ষা করেছিলেন দশ হাজার সৈন্যের অধিনায়ক হয়ে—দিগবিজয়ী আলেকজান্ডার, যাঁর বাহুবলে আজ ভারতে গ্রিক রাজ্য সম্ভব হয়েছে।

ব্যাকট্রিয়ান গ্রিকদের জীবনযাত্রা ও আচারব্যবহার অনেক সময় তার চোখে ভালো লাগত না। একজন খাঁটি গ্রিক স্কুলমাস্টার তক্ষশিলার রাজসভায় দিনকতক এসেছিলেন, ছেলে পড়াতেন বড়লোকের বাড়ির, তাঁর নাম পলিফাইলস— রীতিমতো পণ্ডিত। তাঁকে নিয়ে সে-সময় কাড়াকাড়ি পড়ে গেল বড়োলোকদের মধ্যে, কে তাঁকে গৃহশিক্ষক নিযুক্ত করতে পারে, কারণ এথেন্স থেকে তিনি এসেছিলেন। হেলিওডোরাস তখন বালক, তাকে তিনি বলতেন— তোমাকে দেখে। আমার প্রাচীন যুগের গ্রিক যুবকদের কথা মনে পড়ে। শরীরটা স্পার্টার ছেলেদের মতো শক্ত করো। এদেশে কিছু নেই, নামেই গ্রিক।

—কেন?

—গ্রীষ্মপ্রধান দেশ। এদেশের গ্রিকরা অতিরিক্ত বিলাসী ও আরামপ্রিয় হয়ে পড়েছে। পূর্বপুরুষের রক্তের সে তেজ নেই এদের মধ্যে। শুধু তা নয়, এরা দেশি লোকের সঙ্গে যেভাবে মেশে, অনেকে দেশি খাদ্য খায় ও পরিচ্ছদ ধারণ করে, যেমন সেদিন এক গ্রিক ভদ্রলোকের গায়ে কাশ্মীরি শাল দেখলাম—ছিঃ ছিঃ লজ্জাও করে না!—বেশি কথা কি বলব, অনেকে এদেশি মেয়েদের সঙ্গে

এইসময়ে স্কুলমাস্টারের হঠাৎ মনে পড়ত যে তাঁর শ্রোতা বালক এবং ছাত্র। স্বজাতির অধ:পতনের দুঃখ যা বলে ফেলেছেন তা যথেষ্ট। বলে উঠলেন—তা ছাড়া দেখচো না, গ্রিক রাজধানী তক্ষশিলা বৌদ্ধবিহারে ভরা। যাকগে। কবিতা মুখস্থ বলে যাও—

 

কখনো-কখনো ভীষণ গ্রিষ্মের দিনে তক্ষশিলার কোনো প্রমোদ-উদ্যানের মধ্যে নিভৃত কুঞ্জে ছায়াসনে তিনি ছাত্রদের নিয়ে বসতেন। অতীত যুগের গ্রিকদের বীরত্ব, আত্মত্যাগ প্রভৃতি জ্বলন্ত ভাষায় বর্ণনা করে যেতেন, ইউরিপিডিস ও সাফোর কবিতা আবৃত্তি করতেন, প্লেটোর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপদেশাবলি বুঝিয়ে দিতেন। কয়েক বছর তক্ষশিলার থাকার পরে তিনি হঠাৎ কোথায় চলে যান। জনশ্রুতি যে, তিনি এইসময় স্বদেশে ফিরতে ব্যর্থ হয়ে উঠেছিলেন। মৃত্যুর পূর্বে আর একবার তিনি প্রিয় জন্মভূমির পবিত্র মৃত্তিকা স্পর্শ করতে চান।

সেই থেকে  হেলিওডোরাস পূর্বপুরুষের গৌরবে গৌরবান্বিত, ভারতীয়দের সে ঘৃণাই করে স্পার্টার যুবকদের আদর্শে শরীর গড়ে তুলেচেভারতীয়দের সঙ্গে গ্রিকরা যে বেশি মেলামেশা করে, এটা সে পছন্দ করে না—এমনকী তার পিতা ডিওনকে পর্যন্ত এজন্য সে ঠিক শ্রদ্ধা করতে পারে না। কারণ দু-তিনটি ভারতীয় নর্তকীর বাড়িতে এই বৃদ্ধ বয়সেও তাঁর যাতায়াত। যাক সে-সব কথা। এদিকে হেলিওডোরাসের উচ্ছঙ্খলতা ও অত্যাচারে তক্ষশিলার অনেকেই অতিষ্ঠ। সে লম্পট নয়, কিন্তু সুরাপায়ী, উদ্ধত—লোকের মান রাখে না, দোকানের জিনিস ধারে নিয়ে গিয়ে দাম দেয় না—দু-তিনটি নরহত্যা পর্যন্ত করেছে সুরার ঝোঁকে।

কেন তা বলি।

মেলিবিয়া নামে একটি রূপসী গ্রিক গায়িকা আজ বছর দুই হল ব্যাকট্রিয়া ও গান্ধার হয়ে এখানে আসে উপার্জনের চেষ্টায়। গান্ধাররাজ জোজিফাসের সভায় খুব নাম কিনে এসেছিল। এখানে সে পদার্পণ করার দিনটি থেকে তক্ষশিলার অনেক যুবক ও প্রৌঢ়ের নজরে পড়ে গেল। প্রণয়ের প্রতিদ্বন্দ্বিতার হিড়িক শুরু হল। বহু গ্রিক যুবক, এমনকী বৃদ্ধের প্রণয় উপেক্ষা করে (এদের দলে হেলিওডোরাসও ছিল) সুন্দরী মেলিবিয়া প্রসন্নদৃষ্টিতে চাইল সুমঙ্গল বলে এক ভারতীয় বণিকের প্রতি, এমনি অদৃষ্টের ফের। প্রকাশ্য দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহবান করে হেলিওডোরাস সুমঙ্গলকে। মেলিবিয়া এতে বাধা দেয়—তারপর একদিন এক সরাইখানায় সামান্য ছলে ঝগড়া বাধিয়ে হেলিওডোরাস সুমঙ্গলকে হত্যা করে। খুব গোলমাল বাধে এ নিয়ে।

রাজদরবারে অভিযোগ উপস্থিত হল হেলিওডোরাসের বিরুদ্ধে। ভারতীয় বণিকসংঘ রাজাকে ধরলে এর সুবিচার করতেই হবে। তাদের কাছে টাকা ধার না-করলে রাজার চলে না, ফলে মহারাজ অ্যান্টি আলকিডাস তাঁর সভাসদ ডিওনকে ডেকে বলে দিলেন, কিছুদিনের জন্য হেলিওডোরাসকে সরিয়ে দেওয়া দরকার তক্ষশিলা থেকে। মালবের রাজা ভাগভদ্রের সভায় যে গ্রিকদূত ছিল, তার মৃত্যু হয়েছিল সম্প্রতি—সেখানেই আপাতত ওকে পাঠানো হোক। বলা হবে। রাজার বিচারে ওর নির্বাসন দণ্ড দেওয়া হল।

সুতরাং গত শীত ঋতুর প্রারম্ভে হেলিওডোরাস মালবের রাজা ভাগভদ্রের রাজসভায় প্রেরিত হয়।

তক্ষশিলায় পুনরায় আসার উদ্দেশ্য ছিল—মেলিবিয়ার সন্ধানে। কিন্তু হায়, সেই কেলেঙ্কারির পরে বেচারি গ্রিক গায়িকাকে এ রাজ্য ছাড়তে হয়েছে। মেলিবিয়া এখন পুরুষপুরের তালুকদার হিরাক্লিয়াসের অতিথি, অন্তত সেই রকম জনপ্রবাদ।

ডিওন বললে—হেলিওডোর, এখানে আবার এসে ঘুরঘুর করছো কেন? বুড়ো বয়সে কী চাকরিটা খোয়াব তোমার জন্যে?

–আজ্ঞে না, আমি এসেছিলাম শরীর সারাতে। ওখানে যে দিশি বদ্যি আছে, তাদের হাতের শেকড়-বাকড়ের ওষুধ খেলে হাতি মারা পড়ে, মানুষ কোন ছার! আর দেশটাতেও বড়ো বিষম জ্বরের

—বাবা, তুমি আমার নয়নের আনন্দ। কিন্তু জুপিটারের শপথ করে বলচি, আমার হাতে একটি পয়সা নেই যা তোমার জন্যে রেখে যেতে পারব। এ হতভাগা রাজ্যে কিছু উন্নতি নেই, এদের ঘুণে ধরেচে। ঋণের বোঝা রাজকোষকে ছাপিয়ে উঠেছে। নতুন দেশে যদি কিছু উপার্জন করতে পারো—আখেরে ভালো হবে।

শরতের অপূর্ব জ্যোৎস্নাময়ী রজনী। ডিওন তাঁর প্রণয়িনীর বাড়িতে আরও কয়েকটি বন্ধুবান্ধব নিয়ে আমোদ-প্রমোদ করতে গেলেন। তক্ষশিলার মধ্যেই এক সংকীর্ণ রাস্তার ধারে বাড়িটি। কার্নিশে পাথরের ছোটো ছোটো থামের মাঝে মাঝে ফোকরকাটা ইটের নীচু পাঁচিল।

একজন বললে—শুনেচ হে, কাঞ্চীনগরের তালুকদারের ছেলে অ্যারিস্টোস সম্প্রতি বৌদ্ধ হয়েছে!

অন্য বন্ধু বললে—তুমি যা শুনেচ ন্যানিফাস, সত্যি হওয়া আশ্চর্য নয়। রাজা মিনান্ডার গ্রিক কুলাঙ্গার, নইলে গ্রিক রক্ত যার গায়ে আছে, সে দেশি ধর্ম গ্রহণ করে কী হিসেবে? ওর শ্বশুরকে আমি জানি, ব্যাকট্রিয়ায় তাঁর অনেক তালুকমুলুক, ভালো বংশের ছেলে—অ্যান্টি গোনাস গোনাটাসের মাসতুতো ভাইয়ের শালার বংশ।

—কে?

—ওই রাজা মিনান্ডারের শ্বশুর। জামাইয়ের এই কুমতি শুনবার পরে বেচারি একেবারে শয্যাগ্রহণ করেচেন।

—নিয়ারা কোথায় গেল?…

ডিওন আজ বেশি সুরা পান করেননি। মন তাঁর ভালো নয়, ছেলেটা আজ কি কাল বাড়ি থেকে চলে যাবে, সঙ্গে এবার তিনি তাঁর প্রিয় বালকভৃত্য জোজিফাস ওরফে জুজুকে প্রবাসে ছেলের সেবা করতে পাঠাবেন। ডিওন অনেকদিন বিপত্নীক, বাড়িতে প্রিয়দর্শন পুত্র ও বালক-ভৃত্যটিও অনুপস্থিত থাকবে। একপাল দাসীদের মধ্যে (তাদের মধ্যে অনেকেই অসন্তুষ্ট, কারণ সময়মত বেতন পায় না) সন্ধ্যা কাটানো এই বয়সে ভালো লাগে?…কী যে করবেন–

নিয়ারা প্রবেশ করলে, বয়সে সে ডিওনের চেয়ে অনেক ছোটো তবুও চল্লিশের কম নয়, কিন্তু দেখায় ত্রিশ, সোনালিপাড় দামি রেশমি অঙ্গাবরণ, দুটি বিভিন্ন খণ্ডে বিভক্ত হয়ে ওর গৌর অঙ্গের শোভা বর্ধিত করচে। কিন্তু মাথায় গ্রিক মহিলাদের ন্যায় পুষ্পমাল্য, সুন্দর চোখের ভুরু কাশ্মীরি জাফ্রানের রেণু, চন্দন ও বার্জ বৃক্ষের আটা মিশিয়ে চিত্রিত করা। তাতে চোখের ভুরু দুটি কালো না-দেখিয়ে হলদে দেখাচ্চে। নিয়ারার পিতা ব্যাকট্রিয়ান গ্রিক, কিন্তু মাতা পারস্যদেশীয়া।

ন্যানিফাসের কথার উত্তরে নিয়ারা বল্লে—আমার গুরু এসেছেন, তাই আনন্দে কথাবার্তা বলছিলুম তাঁর সঙ্গে।

ন্যানিফাস বল্লে—সে আবার কে?

—তিনি একজন ভারতীয় যোগী। বারাণসী থেকে এসেছেন—

সবাই একবাক্যে বলে উঠল—আমরা একবার দেখব–

—তিনি কাউকে দেখা দেন না, কারো কাছে কিছু চান না তো তিনি।

ন্যানিফাস বল্লে—আচ্ছা নিয়ারা, তুমি একজন এদেশি ধাপ্পাবাজের পাল্লায় পড়ে গেলে কী বলে? এ যে রকম শুরু হোল দেখচি, কবে আমাদের বন্ধু ডিওন মুণ্ডিতমস্তক বৌদ্ধভিক্ষু না-হয়ে দাঁড়ায়!

সুরাপায়ী, বিলাসী, স্থূলদেহ ডিওন পকেশে পুষ্পমাল্য ধারণ করে একপাশে পর্যঙ্কে শুয়ে ছিলেন, তাঁকে মুণ্ডিত-মস্তক বৌদ্ধভিক্ষুর বেশে কল্পনা করে সর্বপ্রথমে প্রৌঢ়া সুন্দরী নিয়ারা হি-হি করে হেসে গড়িয়ে পড়ল, পরে ডিওনের সব বন্ধুই সেই হাসিতে যোগদান করলে।

এমন সময় দেখা গেল, একজন দীর্ঘদেহ কৌপীনধারী লোক, সর্বাঙ্গে বিভূতি মাখা, হাতে কমণ্ডলু, আয়ত চক্ষুদ্বয় জ্যোতিষ্মন—কোন সময়ে ছাদের ওপর এসে দাঁড়িয়েচেন। সকলে চমকে উঠল—ডিওন বল্লে—কে তুমি?

সন্ন্যাসী বল্লেন—বাবাজিদের জয় হোক।

—কী?…এ উত্তর শুধু ডিওন দিলেন।

—এই মেয়েটি আমায় বড়ো মানে। আমি একে এই পাপজীবন থেকে উদ্ধার করতে চাই। আপনারা এখানে আর আসবেন না।

—কোথায় যাব আমরা? তুমি কোন নবাব এলে জানতে পারি কী?

সন্ন্যাসী রোষকষায়িত নেত্রে বল্লেন—বৃদ্ধ লম্পট! পরকালের দিন সমাগত, ভয় হয় না? এখনও এই সব–

সবাই মিলে হুংকার দিয়ে ঠেলে উঠল—এত বড়ো স্পর্ধা!… কিন্তু আশ্চর্য, কারো সাধ্য নেই যে নিজ নিজ আসন ছেড়ে উত্থিত হয়। ডিওনকে দেখা গেল তাঁর স্থূলদেহ নিয়ে তিনি পর্যঙ্ক থেকে উঠবার চেষ্টায় নানারূপ হাস্যকর অঙ্গভঙ্গি করচেন—এ যেন এক রাত্রির দুঃস্বপ্ন। …সন্নাসী মৃদু হেসে বল্লেন—নিয়ারাকে আমি কন্যার মতো দেখি, মা বলে সম্বোধন করি। ওর পারলৌকিক উন্নতির জন্যে আমি দায়ী। তোমাদের মতো সুরাসক্ত লম্পট ওকে অধ:পতনের পথে নিয়ে চলেচ। তোমাদের সাবধান করে দিয়ে গেলাম। এর পরেও যদি আসো, বিপদে পড়ে যাবে। পরে ন্যানিফাসের দিকে চেয়ে বল্লেন—শোনো, তোমার দিন আসন্ন। এই সুরা ও নারী তোমাকে মৃত্যুর পথে নিয়ে যাবে। পরকালের কথা চিন্তা করো। এখন থেকে পাঁচ মাসের মধ্যে একটি প্রশস্ত রাজপথের পার্শ্ববর্তী পুরাতন কূপে তোমার মৃতদেহ ভাসচে আমি দেখতে পাচ্ছি—

ন্যানিফাসের মুখ হঠাৎ বিবর্ণ, পার হয়ে উঠল। সুরার নেশা ততক্ষণ তার এবং সকলেরই কেটে গিয়েচে।

—আর ডিওন, তোমার বংশে একটি অদ্ভুত পরিবর্তন আসন্ন। কিন্তু সেজন্যে তুমি ভগবানকে ধন্যবাদ দিও—বিদায়!…আমি চলে গেলে তোমরা পূর্ব-অবস্থা প্রাপ্ত হবে— বিদায়!…

সন্ন্যাসী অন্তর্ধান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সবাই নিজ নিজ অবস্থা পুনঃপ্রাপ্ত হলেন। দোরের কাছে নিয়ারা দাঁড়িয়ে, তার মুখে মৃদু হাস্য।

ডিওন বল্লেন—কী?

ন্যানিফাস বল্লে—কী?

অন্য সবাই বল্লে—কী?

নিয়ারা নিরুত্তর। একটি দুজ্ঞেয় রহস্যের মতোই অতিক্ষীণ একটি হাস্যরেখা তার ওষ্ঠপ্রান্তে মিশে রইল।

 

২.

শরৎ ঋতু শেষ হয়েছে, প্রথম হেমন্তের সুশীতল বাতাস গত গ্রীষ্মদিনগুলির দাবদাহ স্মৃতিতে পর্যবসিত করে তুলেচে।  হেলিওডোরাস মালবে আজ মাস দুই ফিরে এসেছে। রাজধানী বিদিশার উপকণ্ঠে একটি বৃহৎ উদ্যানবাটিকা দূর থেকে তার ভালো লাগে। প্রাচীন অশোক, বকুল, বট, নাগকেশর ও সপ্তপর্ণ তরুশ্রেণীর নিবিড় ছায়ায় উদ্যানটি যেন নিভৃত তপোবনের মতো শান্তিপ্রদ ও মনোরম। কত পক্ষীকুলের সমাবেশ ও বিচিত্র কলতানে ছায়াবিতানগুলি যেন মুখর।

কয়েকদিন সেদিকে সে একাই গ্রিক রথ হাঁকিয়ে বেড়াতে যায়। টাঙ্গা-জাতীয় এই গ্রিক যানগুলির চলন তক্ষশিলা এবং প্রায় সর্বত্র সভ্য সভ্য নগর-নগরীতে দেখা যায় আজকাল। স্প্রিং নেই, বড়ো একটা কাঠের বা লোহার খুরোর ওপরে শকটের যতটুকু বসানো,—তাতে বড়ো জোর দুজন লোকের স্থান সংকুলান হতে পারে। একদিন সে কী ভেবে প্রাচীরের একটি নিম্নস্থান উল্লঙ্ঘন করে উদ্যানের মধ্যে প্রবেশ করলে। উদ্যান তো নয়, যেন নিবিড় বন। বহুকালের উদ্যান, বড়ো বড়ো গাছগুলিতে নিভৃত কোণ ও ছায়া রচনা করেচে নানাস্থানে—পাষাণ-বাঁধানো বাপীতটে সুন্দর লতাগৃহ, অশোককুঞ্জ, উৎস, যক্ষমূর্তি ইত্যাদি দ্বারা শোভিত নির্জন উদ্যানের মধ্যে কিছু দূরে প্রাচীন দিনের ভারতীয় স্থাপত্য প্রণালীতে নির্মিত একটি বিশাল অট্টালিকা বৃক্ষশ্রেণীর মধ্যে দিয়ে চোখে পড়ে—কিন্তু সেখানে কেউ বাস করে বলে মনে হল না। হেলিওডোরাস আপন মনে পরিভ্রমণ করতে করতে একটি পাষাণবেদীতে বসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করলে—তারপর সেখানে থেকে বের হয়ে রথ হাঁকিয়ে চলে এল। সেই থেকে মাঝে মাঝে উদ্যানটিতে যায়—কখনও মধ্যাহ্নে, কখনও সন্ধ্যায়, কখনও একাই জ্যোৎস্নাময়ী রজনীতে।

বৎসর প্রায় ঘুরে গেল। শীত এল, চলেও গেল। পুরুষপুরে এবার তুষারপাতের সংবাদ পাওয়া গিয়েছে—অতিদুর্দান্ত শীতের দিন এবার! ফাল্গুনী চতুর্দশী তিথির মনোরম জ্যোৎস্নালোকে, অজস্র বিহঙ্গকাকলী ও পুষ্পপ্যাপ্তির মধ্যে হেলিওডোরাসের দিনগুলি যেন স্বপ্নের মতো কাটছে—রাজকার্যের অবসানে নিজের রথটি নিয়ে বার হয়ে নগরীর বহু দূর পর্যন্ত চলে যায়। এখানে সে প্রায় একা, তবে দু-একটি ভারতীয় কর্মচারীর সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছে এবং মালবের ভাষা সে একরকম আয়ত্ত করে ফেলেচে এক বৎসরে।

এই সময়ে একদিন সে তার সেই পরিচিত উদ্যানবাটিকাতে ঢুকল পথের পাশে রথ থামিয়ে। পুষ্প পুষ্পে, নববল্লীপল্লবে, চুতমুকুলের সুবাসে, কোকিল-ঝংকারে প্রাচীন উদ্যান তার বৃদ্ধত্ব পরিহার করে নবযৌবনের রূপ পরিগ্রহ করেচে, নিভৃত লতাগৃহ যেন গ্রিক রতিদেবতার আসন্ন পাদস্পর্শের আগ্রহে উৎসববেশে সজ্জিত হয়েছে। সেই পাষাণবেদীতে সে মুগ্ধ মনে চুপ করে বসে আছে, এমন সময় কার পদক্ষেপের শব্দে চমকে পিছন ফিরে যা দেখলে তাতে সে বিস্মিত ও বিচলিত হয়ে উঠল।

একটি রূপসী তরুণী তার পিছনে কিছুদূরে দাঁড়িয়ে। অপূর্ব তার অঙ্গলাবণ্য, ক্ষীণ কটিতটে রত্নমেখলা, নিবিড় কৃষ্ণ কেশপাশে টাটকা তোলা যূথীগুচ্ছ, গ্রিক মেয়েদের মতো দীর্ঘদেহা অথচ তন্বী। মেয়েটি অবশ্য ভারতীয়, সাজপোশাকেই হেলিওডোরাস বুঝল।

মেয়েটিও তাকে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছে, মনে হল হেলিওডোরাসের। বিস্ময়ে তার চারু আয়ত কৃষ্ণ নেত্ৰদুটি স্তব্ধ অচঞ্চল। কিছুক্ষণ দুজনের কেউ কথা বললে না।

তারপর হেলিওডোরাস উঠে দাঁড়িয়ে বল্লে–ভদ্রে, এ উদ্যান বোধ হয় আপনাদের! আমি পথিক, বেড়াতে এসে একটু বসেছিলাম—

মেয়েটি কোনো কথা না-বলে ফিরে চলে যেতে উদ্যত হল।

হেলিওডোরাসের মূঢ়তা ততক্ষণে ঘুচেছে। সে হাজার হলেও গ্রিক ভদ্রলোক, বিনীত সুরে বল্লে—একটু দাঁড়াবেন দয়া করে? আমার এই অনধিকার প্রবেশের

জন্যে আমি বিশেষ লজ্জিত—আমায় যদি ক্ষমা করেন—

মেয়েটি যেন কম্পিত অগ্নিশিখা, নিজের মহিমায় নিজে দীপ্তিমতী। হেলিওডোরাস এই ভারতীয় মেয়েটির অপরূপ রূপমাধুরীতে কেমন বিস্মিত হয়ে উঠেছে। এত রূপ হয় এদেশের মেয়ের? এমন শ্বেতাঙ্গ সুন্দর দেহকান্তি যেকোনো সুন্দরী গ্রিক তরুণীর পক্ষেও দুর্লভ।… মেলিবিয়া কোথায় লাগে!

হেলিওডোরাস সসংকোচে তার কথা শেষ করবার অতিঅল্পক্ষণ পরেই মেয়েটি নম্নসুরে বল্লে—আপনি কি গ্রিক?

—হাঁ, ভদ্রে—

—অল্পদিন এসেছেন এখানে?

—না ভদ্রে, এক বৎসর হল—আমি রাজসভার তক্ষশিলার গ্রিকদূত—আমার নাম হেলিওডোরাস— রূপসী বালিকা বিস্ময়ে কৃষ্ণ জ্বযুগল ঊধ্বদিকে ঈষৎ তুলে হেলিওডোরাসের দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে চেয়ে বল্লে–ও!…

—কেন? আমার কথা কি আপনি শুনেছিলেন?

—হাঁ। বাবার মুখে শুনেছিলাম, সভায় একজন রাজদূত—

 হেলিওডোরাস মনে মনে ভাবলে, ইনি বোধ হয় কোনো রাজ-অমাত্যের কন্যা হবেন। বল্লে—আপনার পিতা রাজসভায় কি পদে-আমি অনেককেই চিনি—

মেয়েটি কিছু বলবার পূর্বেই আরও দুটি সুন্দরী মেয়ে—ওরই প্রায় সমবয়সি— সেখানে এসে পড়ল কোথা থেকে। ওদের দুজনকে দেখে তারাও যেন অবাক হয়ে গিয়েছে। একজন বল্লে—কত খুঁজে বেড়াচ্চি তোমাকে—বাবাঃ—এখানে কি হচ্চে?

মেয়ে দুটি বিস্ময়ের দৃষ্টিতে হেলিওডোরাসের দিকে চাইলে। সে দৃষ্টির মধ্যে প্রশ্নও ছিল।

হেলিওডোরাস বল্লে—আমি এখানে বেড়াতে এসে একটু বসেছিলাম। আমি জানতাম না যে আপনাদের বাগান! সেই সময় আপনাদের সখী—

মেয়ে দুটি সে-কথার কোনো উত্তর না দিয়ে একটু তাচ্ছিল্যের সঙ্গেই মুখ ঘুরিয়ে তাদের সখীর দিকে চেয়ে বল্লে—চলো! মহাদেবী ভাববেন—কতক্ষণ বেরিয়েচি

এমন সময় আরও তিন-চারটি তরুণী সেখানে এসে দাঁড়াল। তাদের পেছনে দেখা গেল আরও দুটি আসচে। পেছনের মেয়েগুলি কলরব করতে করতে আসছিল। ওদের মধ্যে কে বল্লে—কি হচ্ছে সব, জটলা ওখানে কি হয়েছে?

নব বসন্তের বাতাস যেন মদির হয়ে উঠেচে, ওদের সম্মিলিত কণ্ঠের তরল হাস্যকলরবে চুতমঞ্জরী এই পুষ্পলাবণী তন্বী বালিকাদের নূপুরনিক্কণে।

হেলিওডোরাস প্রথমদৃষ্টা সেই অপরূপ রূপসীকে সম্বোধন করে বল্লে—আমি চলে যাচ্চি, আমায় ক্ষমা করুন—আপনার পিতার নামটি তো শুনতে পেলাম না ভদ্রে?

একজন মেয়ে ভালো করে মুখ না-ফিরিয়েই ঈষৎ উদ্ধত স্বরে বল্লে—তাঁর পিতার নাম মহারাজ ভাগভদ্র।

তারপর সবাই মিলে একদল বন্যহংসীর মতো লঘু পদক্ষেপে লতাবিতানের অন্তরালে অদৃশ্য হল।

হেলিওডোরাস কোনোরকমে বাগান থেকে বার হয়ে এল।

স্বয়ং রাজকন্যা মালবিকা, এঁর রূপের খ্যাতি বিদিশায় এসে পর্যন্ত সমবয়সি দু একজন বন্ধুবান্ধবের মুখে সে যথেষ্ট শুনে এসেচে। নগরচত্বরে ভ্রমণশীল অনেক মেয়েকে দেখে মনে হয়েছে, রাজকন্যা কেমন রূপসী? এই রকম?

আজ এভাবে…

আশ্চর্য! কিন্তু–

হেলিওডোরাসের মাথার মধ্যে কেমন গোলমাল হয়ে যাচ্চে। উঃ, কি গরম আজ! বিশ্রী জায়গা এই বেশনগর। এমন গরমে মানুষ টেকে?

অপূর্ব রূপসী এই রাজকন্যা মালবিকা! অপূর্ব…অপূর্ব…অপূর্ব-দেবী মিনার্ভার মতো মহিমময়ী, অ্যাফ্রদিতির মতো লাস্যময়ী, রূপবতী, সাক্ষাৎ রতিদেবী, অ্যাফ্রদিতি, মূর্তিমতী প্রণয়কবিতা, সাফোর বহ্নিজ্বালাময়ী প্রেমের কবিতা সাফোর—

 

৩.

আরও এক মাস কেটে গেল। গ্রীষ্মকাল এসে পড়েছে। বৃদ্ধা স্ত্রীলোকেরা মাথায় করে ঝাঁকে ঝাঁকে খরমুজা বিক্রি করতে আনচে বাজারে। এই একমাস কি কষ্টে যাপন করচে হেলিওডোরাস— সেই জানে। কাউকে বলতে পারেনি যে, তার সঙ্গে রাজকন্যা মালবিকার দেখা হয়েছিল, কে কি মনে করবে, কার কানে কি কথা উঠবে! এসব হিন্দুরাজ্যের আইনকানুন বড়ো কড়া কথায় কথায় প্রাণদণ্ড! মৃত্যুকে সে ভয় করে না কিন্তু নির্বোধের মতো মৃত্যুকে ডেকে আনার দরকার কি!… সেই দিনটি থেকে তার শয়নে-স্বপনে রাজকন্যা মালবিকা। কতবার সেই উদ্যানের আশেপাশে বেড়িয়েচে… দু-দিন প্রাণ তুচ্ছ করে ঢুকেও ছিল, সেই পাষাণবেদীতে গিয়ে বসেছিল, কিন্তু সে উদ্যান যেমন সে দিনটির পূর্বে ছিল জনহীন, তেমনি তখনও। অবহেলিত উৎসমুখ, ভগ্ন যক্ষমূর্তি, বনেজঙ্গলে সমাচ্ছন্ন পুষ্পবাটিকা, লতাগৃহ…শৈবালাচ্ছন্ন পাষাণ-প্রাসাদ…জনশূন্য অলিন্দ…কিন্তু হেলিওডোরাস আর বাঁচে না…সত্যিকার প্রেমজীবনে এই প্রথম এসেচে তার বহ্নিজ্বালা নিয়ে। জীবনে আর সব কিছু তুচ্ছ হয়ে গিয়েচে.আর একটিবার সেই অপরূপ রূপসী তরুণী দেবীর সঙ্গে দেখা হয় না? সব কিছু দিয়ে দিতে পারে হেলিওডোরাস…একটিবার চোখের দেখা…সব দিক থেকে অসম্ভব…সে সামান্য রাজদূত, কর্মচারী মাত্র—তাতে বিদেশি, বিধর্মী… অন্যদিকে প্রবলপ্রতাপ মহারাজ ভাগভদ্রের কন্যা সে…

বৈশাখের শেষের দিকে গ্রীষ্মের দাবদাহ আরও বেড়েচে, হেলিওডোরাস কি মনে করে অপরাহুের দিকে সেই উদ্যানবাটিকাতে যদৃচ্ছাক্রমে ভ্রমণ করতে করতে গিয়ে হাজির হল। পক্ক আম্রফলের গন্ধ বৈশাখ-অপরাহের উষ্ণ বাতাসে। সেই পাষাণবেদীতে আগেকার আরও দু-বারের মতো এবারও বসল। দু-বার নিষ্ফল হয়েছে এই বৃথা প্রতীক্ষা, এবারও হবে সে জানে। তা নয়, সেজন্যে সে আসেনি —কিন্তু এই লতাগৃহের বাতাসে যেন তার দেহগন্ধ মিশিয়ে আছে—পক আম্রফলের গন্ধ যেমন মিশে রয়েছে এই নিদাঘ-অপরাহ্রে বাতাসে। সে স্বপ্ন দেখতে চায়—ভাবতে চায়—কোথায় কোন সুখী প্রেমিকযুগল এমনি জনহীন নিস্তব্ধ সন্ধ্যায় পরস্পরের হাত ধরে যূথীবনে বিচরণশীল—কত কথা, কত প্রণয় গুঞ্জন, কত চুম্বন উভয়ের মধ্যে,—সে আর রাজকন্যা মালবিকা।…এমন যদি কোনোদিন—

ভাবতে ভাবতে বোধ হয় তার তন্দ্রাকর্ষণ হয়ে থাকবে। গরম তো বটেই… হঠাৎ যেন একটি সুন্দর হাস্যমুখ কিশোরমূর্তি তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে তাকে এক ঠেলা দিয়ে জাগিয়ে তুলে বল্লে—আমি কতকাল অপেক্ষা করব তোমার জন্যে? ওঠো, ওঠো—

কত এলোমেলো স্বপ্ন থাকে মাথায়।

 হেলিওডোরাস জেগে উঠল। বেদীর গায়ে তার খড়গখানা ঠেকানো রয়েছে, হাতে নিয়ে বাগানের বাইরে তার রথের কাছে এল।

সত্যিই সে উদভ্রান্ত, এমন অবস্থায় সে বেশিদিন এখানে কাটাতে পারবে না। পাগল হয়ে যাবে নাকি শেষে?

পথে পা দিতেই বৃদ্ধ ভিক্ষুক ওর কাছে ভিক্ষা চাইলে। ও অন্যমনস্কভাবে কিছু মুদ্রা ওর হাতে দিতে গেল—দেখলে, সেটি একটি স্বর্ণমুদ্রা—ফিরিয়ে নিতে যাবে, কিন্তু পরক্ষণেই অপরিসীম ঔদাসীন্যের সঙ্গে মুদ্রাটি ভিক্ষুকের হাতে ফেলে দিলে। কি হবে অর্থ তার জীবনে? নীরস জীবন, মরুময় জীবন। পিতা ডিওন সুখে থাকুন, কিন্তু তাঁর বংশের পাপ—প্রজাদের অর্থশোষণ, তাদের উপর অত্যাচার

ভিক্ষুক স্বর্ণমুদ্রা হাতে পেয়ে অপ্রত্যাশিত আনন্দে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে উঠল— বাসুদেব আপনার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করুন—

হেলিওডোরাসের অন্যমনস্কতা একচমকে কেটে গেল। বল্লে—কি বলছিস তুই? এই দাঁড়া—

ভিক্ষুক ভয়ে ভয়ে বল্লে—খারাপ কিছু বলিনি বাবা, বাসুদেব আপনার মনের বাসনা পূর্ণ করুন, তাই বলচি—

—কে তিনি?

—মস্ত বড়ো মন্দির বাসুদেবের—জানেন না?

–খুব জানি। কেন জানব না—ভারতীয় দেবতার মন্দির। দেখেচি—

—তিনি যে জাগ্রত দেবতা বাবা, যে যা ভেবে মানত করে, তিনি তার মনের ইচ্ছা পূর্ণ করেন। আমি একবার—

হেলিওডোরাস আর একটি মুদ্রা তার হাতে দিয়ে বল্লে—যা পালা—মুণ্ডু কেটে ফেলে দেব, আর একটি কথা বল্লে—

 

সেই বৈশাখী জ্যোৎস্নারাত্রে উদভ্রান্ত হেলিওডোরাসের মনে ভিখিরির এই কথা যেন দৈববাণীর আশ্বাস নিয়ে এল। বাসুদেব…ভারতীয় দেবতা বাসুদেব…

মনের বাসনা পূর্ণ হবে তার? সে যা চায়? মালবিকাকে না-পেলে বিশাল ইরিথিয়ান সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ছাগপদ বনদেবতাদের খুঁজে বের করবে সামোস দ্বীপের বন্য দ্রাক্ষাকুঞ্জের নিভৃত আশ্রয়ে, জলপাই ও মার্টল বৃক্ষের ঝোপে ঝোপে আর্দ্র পাষাণমঞ্চে শুয়ে ওক পাইনের তলে সারাজীবন কাটিয়ে দেবে বন্যফল খেয়ে—ছাগপদ স্যাটিরদের দলে মিশে চিরযৌবনা বনদেবীদের সন্ধানে…অথবা বনদেবীদের প্রয়োজন নেই… রাজনন্দিনী মালবিকার সন্ধানে সে চিরযুগ ঘুরবে—

পরদিন বৈশাখী পূর্ণিমা। সন্ধ্যার সময় সে গিয়ে বাসুদেবের মন্দিরের বিশাল চত্বরের একপাশে এক গাছতলায় দাঁড়াল। বিরাট পাষাণমন্দিরের চূড়া ঊধর্বাকাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে—মন্দিরের অভ্যন্তরে শঙ্খঘণ্টার ধ্বনি—মন্দিরের প্রাঙ্গণে শত শত নরনারীর ভিড়—স্থানে স্থানে পুষ্পবিক্রেতা বসে আছে নানা বর্ণের পুষ্পের ডালি সাজিয়ে, দলে দলে মেয়ে-পুরুষ চলেচে মন্দিরে। সে জানে তাকে মন্দিরের মধ্যে প্রবেশ করতে হয়তো বাধা দেবে, তবুও সে ভিড়ের মধ্যে ঢুকে পড়ল সন্ধ্যার অন্ধকারে গা মিশিয়ে। বেশি দূর যেতে সাহস হল না কিন্তু।

দূর থেকে দেখা গেল গর্ভদেউলের অন্ধকারে ধাতুপ্রদীপের আলোয় বাসুদেবের প্রস্তরমূর্তির মুখ। কোথায় যেন সে এ মুখ দেখেচে, ঠিক মনে করতে পারলে না। কোথায়?…কবে?

অন্য লোকের দেখাদেখি হাতজোড় করে প্রার্থনা করলে—হে বাসুদেব, আমি বিদেশি, বিধর্মী। তোমার কাছে এসেছি, তুমি নাকি মানুষের মনের বাসনা পূর্ণ করো। আমার মনের বাসনা তুমি জানো, আমি অন্য ধর্মের লোক বলে তুমি আমার প্রার্থনা অবহেলা করতে পারবে না কিন্তু। আমার নাম হেলিওডোরাস— তক্ষশিলায় আমার বাড়ি। মনে করে রেখো

বাসুদেবের বিশাল মন্দিরের পাষাণচূড়া বৈশাখী পূর্ণিমার জ্যোৎস্নায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। নরনারীর ভিড় ক্রমশই বাড়ছে—হয়তো এখানে আজ কোনো উৎসব আছে। নরনারীদের মধ্যে কেউ কেউ তার দিকে কৌতূহলের দৃষ্টিতে চেয়ে চেয়ে গেল—হয়তো ভাবলে একজন গ্রিক যুবক বাসুদেবের মন্দিরে কি করছে?

একটি লোককে দেখে হেলিওডোরাস তাকে ডাক দিলে। লোকটি ছুটে এল তার কাছে, তার গলায় উপবীত, কপালে চন্দনের ফোঁটা, শিখায় পুষ্প বাঁধা।

হেলিওড়োরাসের অনুমান যথার্থ, সে মন্দিরের একজন পরিচারক ব্রাহ্মণ বটে। লোকটিকে সে বল্লে—কত লাগে তোমাদের দেবতাকে কিছু ফলমূল মিষ্টান্ন কিনে দিতে?

একজন গ্রিকের এত ভক্তি দেখে বোধ হয় লোকটি একটু অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে বল্লে—আপনি কি পূজো দেবেন?

—হ্যাঁ।

—যা দেবেন আপনি! দু-দিনার, দশ দিনার–

—তক্ষশিলার স্বর্ণমুদ্রা এখানে চলবে?

—কেন চলবে না হুজুর? শ্ৰেষ্ঠীর দোকানে ভাঙিয়ে নিলেই চলবে—

—আচ্ছা নিয়ে যাও। আমার নাম হেলিওড়োরাস, নাম মনে থাকবে? আমার নামে এই মুদ্রার পরিমাণ ফল-ফুল মিষ্টান্ন কিনে দেবে—কেমন তো?

—নিশ্চয়ই। বাসুদেবের নামে দিচ্চেন—আপনি দেখচি একজন ভক্ত।

—আচ্ছা যাও–

—আমার দক্ষিণাটা—

 হেলিওডোরাস পূজারিকে আরও কিছু দিয়ে সেখান থেকে বার হয়ে মন্দিরের সিংহদ্বারের কাছে এল।

সেই দিনটির পর সে মাঝে মাঝে প্রায়ই বাসুদেবের মন্দিরে এসে একবার করে দেবতাকে তার প্রার্থনা জানিয়ে যায়। মাসের পর মাস চলে গেল, মন্দিরের দেবতা তার প্রার্থনা শুনলেন কই? কোথায় তার মানসীপ্রতিমা…যার জন্যে এত আকুল প্রতীক্ষা—কেবল হাঁটাহাঁটিই সার।

 

৪.

একদিন এই অবস্থায় মন্দির থেকে বাড়ি ফিরে দেখলে তক্ষশিলা থেকে দূত এসেচে রাজা অ্যান্টিআলকিডাসের সেনাপতি অ্যারিওস্টোসের পত্র নিয়ে। পত্র খুলে পড়লে, এক্ষুনি তাকে ফিরে আসতে হবে তক্ষশিলায়। জরুরি দরকার।

হেলিওডোরাস বিস্মিত হল। দূতকে বল্লে—তুমি কিছু জানো?

সে ব্যক্তি বিশেষ কিছু জানে না। কোনো গোপনীয় রাজকার্য হবে।

সেইদিনই হেলিওডোরাস তক্ষশিলার প্রত্যাবর্তন করলে। সেখানে গিয়ে শুনলে ব্যাপার গুরুতর বটে। মধ্য-এশিয়া থেকে যুদ্ধদুর্মদ শ্বেতকায় হৃদল গান্ধার আক্রমণ করে ভারতের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তাদের অত্যাচারে গান্ধার ও কপিলার বহু গ্রাম, জনপদ ধ্বংস হয়েছে, বহু নগরী বিধ্বস্ত হয়েছে। পুরুষপুর, বেণুপত্র, মাত্রাবতী, বলভী প্রভৃতি রাজ্য বিপন্ন। পুরুষপুরের গ্রিকরাজ হিরাক্লিয়াস ও বেণুপত্রের মহাসামন্ত কুজ বিষ্ণুবর্ধন তক্ষশিলার সাহায্য প্রার্থনা করেছেন। রাজা সৈন্যদল পাঠাচ্চেন—হেলিওডোরাসকে যেতে হবে যুদ্ধে। হেলিওডোরাস আদেশ পেলে—সেনাপতি অ্যারিওস্টোস ও মহাসামন্ত কুজ বিষ্ণুবর্ধনের অধিনায়কত্বে একদল সৈন্য ‘চন্দ্রভাগা’ পার হয়ে গান্ধারের দিকে অগ্রসর হচ্ছে—ওদের সঙ্গে অবিলম্বে যোগ দিতে হবে।

 

তিন বছর কাটল। আজ বলভী, কাল অন্যত্র, পরশু কপিলা। পর্বত, প্রান্তর, নদী—গান্ধার থেকে পুরুষপুর, পুরুষপুর থেকে গান্ধার। শ্বেতকায় হুণেরা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত—অনেকবার তাদের সঙ্গে খণ্ডযুদ্ধ হল মরুভূমিতে, পর্বতের সংকীর্ণ অধিত্যকায়, কত গণ্ডগ্রামের রাজপথে। মানুষ মরে পাহাড় হয়ে গেল–যত না যুদ্ধে, তত দুঃখে কষ্টে অনাহারে। হুণের দল রক্তলোলুপ পশুর মতো জনপদবাসীদের উপর অত্যাচার করতে লাগল। রাত্রের আকাশে আলো হয়ে ওঠে দুহ্যমান শস্যক্ষেত্রের বা গ্রাম-জনপদের বাসগৃহের রক্ত অগ্নিশিখায়। মানুষ নৃশংস হত্যার লালসায় ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে। যুধ্যমান সৈন্যবাহিনির নির্মম রথচক্রতলে শত শত নিরীহ নারী, শিশু, অসহায় বৃদ্ধ পিষ্ট হয়ে মেদরক্তে পথের ধূলি কর্দমাক্ত করে তোলে। সর্বগ্রাসী প্রলয়দেব করাল কৃপাণ দু-হাতে বন বন করে ঘোরান— শাণিত খড়েগর ফলকে ফলকে সূর্যকিরণ ঠিকরে পড়ে। কপিলার উত্তরভাগ শ্মশান হয়ে গেল এই তিন বৎসরে। গভীর নিশীথে সেখানে মুণ্ডমালিনী করালিনী কালভৈরবীর রক্তসিক্ত জিহ্বা লকলক করে অন্ধকারে। শিবাদলের অমঙ্গল চীৎকারে অন্তরাত্মা কাঁপে।

একটি খণ্ডযুদ্ধে হেলিওডোরাস হূণদের হাতে বন্দি হল। কেন তারা তাকে হত্যা করলে না, সে নিজেই জানে না…অবাক হয়ে গেল সে। পশুচর্মের তাঁবুতে উটের দুধ ও ছাতু খেয়ে পর্যুষিত পশুমাংস খেয়ে সে এক মাস অতিকষ্টে কাটাল। প্রতিক্ষণেই মৃত্যুর প্রতীক্ষা করে—অথচ কেন তাকে ওরা মারে না কেন জানে? একদিন সে শুয়ে আছে তাঁবুতে, স্বপ্ন দেখলে এক সুন্দর তরুণ তাকে ঠেলা মেরে উঠিয়ে বলচে—আমার সঙ্গে এসো, আমি তোমায় পথ দেখিয়ে দিচ্চি পালাবার—

বাইরের অন্ধকার ছুরি দিয়ে কাটা যায়। এখানে-ওখানে হূণ-প্রহরীদের অগ্নিকুণ্ড। আবছায়া অন্ধকারে চলেচে দুজনে, তরুণ আগেও পিছনে। পথপ্রদর্শক তরুণের মূর্তি অন্ধকারে অস্পষ্ট, ভালো দেখা যায় না। সম্মুখেই অজিরাবতী নদী…

—নামো নামো, জলে নামো। মাভৈঃ—

স্বপ্নাচ্ছন্নের মতো নামচে হেলিওডোরাস। কনকনে বরফগলা জল, প্রথমে একহাঁটু, পরে কোমর, তারপরে একগলা।

আগে যে যাচ্ছে সে বলচে, ভয় নেই, চলে এসো। এই জায়গায় নদীর জল কম, চিনে রাখো এই শালগাছ—ডুবে যাবে না।

একগলা জলে পড়তেই হেলিওডোরাসের ঘুম ভেঙে গেল…ভোর হয়েছে। স্বপ্নের কথা সে ভাবলে। কে এই কিশোর, একে সে কোথাও আরও স্বপ্নে দেখেচে —পরিচিত মুখ! হঠাৎ মনে পড়ল—সেই বিদিশার প্রাচীন উদ্যানবীথি…সেই বাপীতট (স্বপ্নযোগে উদভ্রান্ত সে এক দিন একেই দেখেছিল।)—কেন সে বার বার এই কিশোরকে স্বপ্নে দেখে? কে এই তরুণ?

সারাদিন সে স্বপ্নের কথা ভাবলে। তার দৃঢ় বিশ্বাস হল, আজ রাত্রে সে পালাতে চেষ্টা করলে কৃতকার্য হবে। গভীর নিশীথে তাঁবুর বার হয়ে এল সে—হাতে-পায়ে শৃঙ্খল ছিল না। আসবপানমত্ত হূণ-প্রহরীরা অগ্নিকুণ্ডের ধারে তন্দ্রামগ্ন। অদূরে অজিরাবতী নদী, ওই সেই শালগাছ। নিঃশব্দে জলে নেমে চক্ষের নিমেষে সে ওপারে উঠল গিয়ে শালবনের মধ্যে কুজ বিষ্ণুবর্ধনের স্কন্ধাবারে।

 

যুদ্ধ শেষ হয়ে গেল সেই শীতকালের প্রথমেই। দীর্ঘকাল পরে  হেলিওডোরাস তক্ষশিলায় ফিরলে। মাসখানেকের মধ্যেই রাজার কাছে প্রার্থনা জানিয়ে মালবে সে পূর্বপদে ফিরে এল। কীসের যেন আকর্ষণ, কে যেন টানে!

একদিন সে নগরীর বাইরে বেড়াতে-বেড়াতে সেই উদ্যানবাটীতে প্রবেশ করলে। সেই শৈবালাচ্ছাদিত পাষাণবেদী, সেই লতাগৃহ, সেই যক্ষমূর্তি-শোভিত বাপীতট—সব তেমনি আছে। যেন কতকাল আগের স্বপ্ন! একদিন সেই রূপসীকে যেন স্বপ্নে দেখেছিল এখানে—সেই বসন্তকালের পুষ্পসৌরভ, সেদিনকার সে সন্ধ্যাটি—সব যেন হিপোলিটাসের সেই করুণ কবিতাটি স্মরণ করিয়ে দেয় —’আপেলগাছের ছায়া, রূপসী-কণ্ঠের গান, সুবর্ণের দ্যুতি—’ প্রথম যৌবনের হারানো দিনগুলির দূরাগত বংশীধ্বনি। হায় ভারতীয় দেবতা বাসুদেব, তোমার পাষাণদেউলের মতো তুমিও কি কঠিন? কিংবা আমি গ্রিক বলে, বিধর্মী বলে আমায় অবহেলা করলে? কথা কানে তুললে না? সে আজ নেই, সে রূপসী কোনো দূররাজ্যের রাজমহিষী। জীবনে আর তার সঙ্গে দেখা হবে না, সে জানে। কেউ বসে নেই তার জন্যে তিন বৎসর পরে।

 

৫.

আবার বসন্তকাল। সুদীর্ঘ তিন বৎসর পূর্বে এই বসন্তকালে এই সময় মালবিকার সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল। হেলিওডোরাস কি মনে করে এবার ঠিক তেমনি প্রস্ফুটিত কুসুমগন্ধে আমোদিত পথ দিয়ে যেতে যেতে রথ থামিয়ে সেই উদ্যানটিতে প্রবেশ করলে। কতদিন এখানে আসেনি। সম্পূর্ণ বাস্তব এই পাষাণবেদী। স্বপ্ন তো নয়—বিশাল রাজপুরীর অন্ত :পুর-প্রান্তে সেই রূপবতী রাজনন্দিনীও তো স্বপ্ন নয়। এখানে এসে তবুও যেন কেমন একটু স্পর্শ…একদিন এখানকার এই মৃত্তিকায় তো সে এসে দাঁড়িয়েছিল। আজ সে হয়তো বিবাহিতা— কোনো দূর রাজ্যের রাজমহিষী।

কতক্ষণ কেটে গেল। অপরাহু অবসান-প্রায়। বনলক্ষ্মী স্নিগ্ধ বাতাস কুসুমগন্ধে ভরেঃদিয়েছেন।

হিপোলিটাসের সেই কবিতা—’আপেলগাছের ছায়া, তরুণীকণ্ঠের গীতধ্বনি, সুবর্ণেরদ্যুতি—’

হঠাৎ পাষাণবেদিকার পিছনে বৃক্ষশ্রেণীর মধ্যে কার পদধ্বনি শোনা গেল। তবে কি সেই কৃষ্ণকায় উদ্যানরক্ষক, যাকে একবার সে কিছু পুরস্কার দিয়েছিল! মুখ ফিরিয়ে চেয়ে দেখেই হেলিওডোরাস স্তব্ধ হয়ে রইল বিস্ময়ে, ঘটনার অপ্রত্যাশিত আকস্মিকতায়। সেই অপরূপ রূপসী তরুণী স্বয়ং।

হেলিওডোরাস উঠে দাঁড়াল। মেঘাবরোধ ছিন্ন করে বিদ্যুৎশিখা একেবারে তার সামনে—কতদিনের স্বপ্নে চাওয়া তার সেই মানসী প্রতিমা! দীর্ঘ তিন বৎসরে তার রূপ একটুকু ম্লান হয়নি—বরং বেড়েছে।

তার চেয়েও আশ্চর্য, তরুণী তার দিকে চেয়ে হাসিমুখে বল্লে–ও, আপনি!

হেলিওডোরাসের ঘোর তখনও যেন কাটেনি—মাথা ও শরীর ঝিমঝিম করচে। সে উত্তর দিল, হাঁ ভদ্রে—

মেয়েটি বল্লে—আপনি অনেকদিন এদিকে আসেননি—আপনি ছিলেন না এখানে তাও জানি। হূণদের সঙ্গে যুদ্ধে ব্যস্ত ছিলেন—বীর আপনি, কিন্তু ফিরেছেন কবে তা শুনিনি।

হেলিওডোরাসের গ্রিক রক্ত শরীরের মধ্যকার শিরায় উপশিরায় আগুন ছুটিয়ে দিলে। সে স্থিরদৃষ্টিতে তার প্রেমাস্পদার দিকে চেয়ে বল্লে—আমি ফিরে এসেছি এবং এই উদ্যানেও এসেচি কয়েকবার—কিন্তু আপনাকে দেখিনি—

মেয়েটি অবাক হয়ে বল্লে—আমাকে?

—আপনাকে খুঁজেছি যে—এই তিন মাস ধরে। গান্ধার থেকে ফিরে পর্যন্ত কতদিন এসেছি।

মেয়েটির মুখে যেন অতিঅল্প সময়ের জন্য কীসের দীপ্তি, ওর শ্বেতপদ্মের আভাযুক্ত গণ্ডস্থল যেন অতিঅল্প সময়ের জন্য রক্তিম হয়ে উঠল—সে বল্লে আচ্ছা, আমি শুনেছি, আপনি নাকি যুদ্ধে যাওয়ার পূর্বে বাসুদেবের মন্দিরে যাতায়াত করতেন প্রায়ই

—হ্যাঁ, ভদ্রে—কে বল্লে?

—সবাই বলে। আপনি গ্রিক, আপনার ওখানে যাতায়াত নিয়ে নগরীর লোকজনের মধ্যে একটা কৌতূহলের সৃষ্টি হবেই তো—আপনি কি আমাদের দেবতা মানেন?

—মানি। আজ বিশেষ করে মানচি। বাসুদেব অতিদয়ালু দেবতা, মানুষের প্রার্থনা উনি শোনেন, আজ বুঝলাম।

মেয়েটি বিস্ময়ের সুরে বল্লে—আজ? কেন?

—আজই। অভয় দেবেন ভদ্রে? মার্জনা করবেন একজন বিদেশি লোকের প্রগলভতা?

মেয়েটির মুখ হঠাৎ যেন বিবর্ণ হয়ে গেল, পরক্ষণেই সে-মুখে সাহস ও কৌতূহলের দীপ্তি ফুটে উঠল—সেই সঙ্গে যেন লজ্জাও। মেয়েটি যেন আগে থেকে অনুমান করেছে—সে কি শুনবে এই রূপবান গ্রিক যুবকের মুখ থেকে।

হেলিওডোরাস বল্লেভদ্রে, আপনাকে আর একটিবার দেখব এই প্রার্থনা করেছিলাম দেবতার কাছে।

মেয়েটি রক্তিম মুখে চুপ করে রইল মাটির দিকে চেয়ে। কি দীপ্তিময়ী, মহিমময়ী মূর্তি! নিবিড় কৃষ্ণ কেশপাশে সেদিনকার মতোই রক্তজবা ও যূথীগুচ্ছ। গ্রীবার কি অদ্ভুত ভঙ্গি!

 হেলিওডোরাস বল্লে—আপনাকে না-দেখলে বাঁচব না। আমি এই তিন বৎসর উদভ্রান্তের মতো বেড়িয়েছি।

মেয়েটি প্রসন্নহাস্যে বল্লে—কি হবে দেখে বলুন।

দেবী যেন জাগ্রতা হয়ে উঠেছেন—এই অদ্ভুত প্রসন্ন হাসির মধ্য দিয়ে অন্তরশয্যা থেকে সদ্যজাগ্রতা প্রেমের ও করুণার দেবী যেন মূর্ত হয়ে উঠেছেন।

হেলিওডোরাস সহাস্যে বল্লে—শুধু দেখব দেবী, আমার হৃদয়ের সমস্ত অর্ঘ্য–যদি কোনোদিন—

—এই জন্যে যেতেন আপনি বাসুদেবের মন্দিরে? ঠিক বলচেন?

—মিথ্যা বলিনি। কত পূজো দিয়েচি পূজারিদের হাতে—আর—

হেলিওডোরাস কুণ্ঠিত মুখে চুপ করে রইল।

—আর কি?

—মনোবাসনা পূর্ণ হলে বাসুদেবকে মূল্যবান কিছু উপহার দেব–।

রাজকন্যার মুখে মৃদু হাসি ফুটে উঠল। বাসুদেব ওর মূল্যবান উপহার পাবার প্রত্যাশা করেন কিনা! এই বিদেশি যুবক বড়ো সরল, মায়া হয় ওর ওপর।

মুখে বল্লেন মৃদু হেসে—তারপর বাসুদেবকে ভুলে যাবেন বুঝি?

—জীবন থাকতে নয় দেবী, আপনি আর বাসুদেব এক তারে গাঁথা রইলেন আমার হৃদয়ে। দুজনের কাউকেই ভুলব না।

রাজকন্যা বল্লেন—একদিন আমরা বাসুদেবের মন্দিরে গিয়ে আপনাকে দেখি।

হেলিওডোরাস বল্লে—আমাকে?

—মন্দিরের সিংহদ্বারের কাছে আপনি একজন পূজারি ব্রাহ্মণের সঙ্গে কথা বলছিলেন। আমি আমার সখীদের সঙ্গে মন্দিরে ঢুকচি—সুনেত্রা আমাকে দেখালে। সুনেত্রাকে ডাকি

একটু পরে যে মেয়েটিকে সঙ্গে নিয়ে রাজকন্যা ফিরলেন, তাকে প্রথম দিন হেলিওডোরাস এখানে দেখেচে।

সুনেত্রা এসেই হেসে বল্লে—আপনাকে আমরা কতদিন এখানে খোঁজ করেছি —আমার সখী—

রাজকন্যা তর্জনী তুলে শাসনের ছলে লজ্জারুণ মুখে বল্লেন—চুপ—সাবধান!

সুনেত্রা বল্লে—এখানে আর আসতেন না কেন? যুদ্ধে গিয়েছিলেন বুঝি?

—হ্যাঁ—কিন্তু ফিরে এসেও তো কতবার এসেচি ভদ্রে—রোজ রোজ তো আর পরের বাগানে আসতে পারি না?

সুনেত্রা কুঞ্চিত করে বল্লে—রোজ রোজ কি আমরা আপনার সন্ধান করতাম নাকি? আপনি দেখচি বড়ো ধৃষ্ট—যান এখান থেকে আজ! জানেন এটা আমাদের সখীর মাতামহ সঞ্জয় দত্তের বাগান? নাতনিকে দিয়ে গিয়েছেন তিনি। এ শুধু আমার সখীর নিজস্ব বাগান—কার অনুমতি নিয়ে আপনি এখানে ঢুকেচেন, জিগ্যেস করতে পারি কি?

রাজকন্যা সকুণ্ঠ প্রতিবাদের সুরে বল্লেন—ও কি সুনেত্রা!

পরে হাসিমুখে হেলিওডোরাসের দিকে চেয়ে বল্লেন—আমাদের হুণযুদ্ধের গল্প শোনাবেন?

 

৬.

হায় দেবতা অ্যাপোলো বেলভেডিয়ার। প্রতিদিন চতুরশ্বযোজিত রথে সারা আকাশ পরিভ্রমণ করে সন্ধ্যায় ফিরে আসেন নিজ গৃহে—আপনি দেখেননি হেলিওডোরাসের দুঃখ… ডিওন-পুত্র হেলিওডোরাসের? আপনি কি এখন আবার দেখচেন না, কত দুপুরে কত সুন্দর শরৎ ও শীতের অপরাহে বিদিশার পূর্বতন মহামাত্য সঞ্জয় দত্তের প্রাচীন উদ্যানবাটিকায় দুটি প্রেমিক হৃদয়ের গোপন লীলা খেলা, শুনচেন না তাদের আনন্দগুঞ্জন? মাধবীপুষ্পমঞ্জরীর আড়ালে যার বিকাশ, উদ্যানবাটিকার অরণ্যছায়ায় তার ব্যাপ্তি—দুটি তরুণ হৃদয়ের সে সসংকোচ প্রেম, বিচ্ছেদকালীন ব্যাকুলতা—দেখেননি এসব? না দেখেছেন না দেখেছেন, হেলিওডোরাস আর আপনাকে চায় না। দুঃখের দিনে যিনি কৃপা করে তার মনোবাসনা পূর্ণ করেছেন, সেই দেবতাই হেলিওডোরাসের একমাত্র উপাস্য। ভারতবর্ষের পবিত্র মৃত্তিকায় সেই দেবতার অপার করুণার এ ইতিহাস সে অক্ষয় করে রেখে যাবে—যদি গ্রিক রক্ত তার দেহে থাকে।

একদিন মালবিকা বল্লে—হেলিওডোর, বাবাকে বলো—

—মহারাজ শুনবেন?

—তাহলেও তুমি বলো—গুপ্তভাবে আমাদের এমন সাক্ষাৎ আর বেশিদিন চলবে না।

—আমিও তোমাকে চাই মালবিকা—আমারও চলবে না তোমাকে না-পেলে—

—সব হয়ে যাবে বাসুদেবের কৃপায়। চলো আজ দুজনে মন্দিরে যাই—তুমি একদিক থেকে, আমি অন্যদিকে থেকে। মানত করে আসি তাঁর কাছে। তাঁর কৃপায় সব সম্ভব।

হেলিওডোরাস ইতিমধ্যে রাজসভায় যথেষ্ট সুখ্যাতি অর্জন করেছিল নানাদিক থেকে। তক্ষশিলার প্রধান অমাত্যের পুত্র সে—উভয় রাজ্যের মধ্যে একটা মৈত্রীবন্ধন দৃঢ় হয়ে উঠচে হেলিওডোরাসের রাজদূতরূপে উপস্থিতিতে। তরুণ দলের সে একজন নেতা—তার সুঠাম দেহকান্তি ও পুরুষোচিত ক্রীড়া ও ব্যায়ামনৈপুণ্যের জন্য তরুণ নাগরিকগণ তাকে অত্যন্ত মানে। তার ওপর হেলিওডোরাসের খ্যাতি রটে গিয়েছিল যে সে গ্রিক হলেও বাসুদেবের একজন ভক্ত।…

নৃপতি ভাগভদ্র প্রথমে আপত্তি করেছিলেন, কিন্তু শেষপর্যন্ত তিনি হঠাৎ কেন এ বিবাহে সম্মতি দিলেন তা কেউ জানে না।

স্বয়ং মহারানি পট্টমহাদেবী কুমারললিতা তার খবর রাখেন।

সেদিন নিশীথরাত্রে রাজা ঘর্মাক্ত-কলেবরে পর্যাঙ্ক থেকে ধড়মড় করে ঘুম ভেঙে উঠলেন।

রাজ্ঞী ব্যস্তভাবে বল্লেন—কি হয়েচে গো, অমন করছো কেন?

–একটু জল দাও—উঃ, কি ভীষণ! জল দাও—

রাজ্ঞী স্বর্ণভৃঙ্গার থেকে জল দিয়ে বল্লেন—কি হয়েছে—কি হয়েছে—

নৃপতি এক দুঃস্বপ্ন দেখেছেন। এক চণ্ডপুরুষ তাঁর কাছে এসে এক বিশাল শূল আস্ফালন করে হুংকার দিয়ে বলচেন…রে ভাগভদ্র, আমি কে চেনো? তোমার বংশের কুলদেবতা। হেলিওডোরাসের সঙ্গে তোমার কন্যার বিবাহে যদি সম্মতি না দাও—তবে তোমার মালবরাজ্য এই শূলের আগায় উড়িয়ে দক্ষিণ সমুদ্রে ফেলে দেব—ও আমার জন্ম-জন্মান্তরের ভক্ত। বলেই সেই চণ্ডপুরুষ কি ভীষণ হুংকার ছাড়লেন!…শূলের অগ্রভাগ থেকে রক্ত অগ্নিশিখা যেন দাউ দাউ করে পরিব্যাপ্ত হয়ে পড়ল ঘরে ঘরে…উঃ, কি ভীষণ দুঃস্বপ্ন!

রাজ্ঞী বল্লেন—বেশ তো,  হেলিওডোরাস সুন্দর ছেলেটি, তাকে আমি দেখেছি —মালবিকার সঙ্গে বড়ো সুন্দর মানাবে। তোমার মেয়েরও সম্পূর্ণ ইচ্ছে—

-বলো কি রাজ্ঞী! মেয়ে কি ওকে দেখেচে?

রাজ্ঞী হতাশার সুরে হাত-দুটি শূন্যের দিকে ছুড়ে বল্লেন—নির্বোধ নিয়ে ঘর করা যায় তো অল্পবুদ্ধি নিয়ে ঘর করা চলে না—কথাতেই বলেচে। ওরা হল আজকালকার মেয়ে—আর কি আমাদের মতো সেকাল আছে? কোনো অমত কোরো না। হেলিওডোরাস আমাদের ধর্ম গ্রহণ করবে বিয়ে হলেই, তুমি দেখো। আর ওরকম আজকাল তো হচ্ছেই। তক্ষশিলায় আমার এক পিসতুতো বোনের ননদের যে একজন গ্রিক তালুকদারের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে–

অতএব হেলিওডোরাসের সঙ্গে মালবিকার বিবাহে বাধা রইল না।

পিতা ডিওন পত্রবাহকের হাতে লিখে পাঠালেন—খুব সুখের কথা বাবা। আমি তোমাকে একপয়সা দিয়ে যেতে পারব না, নিজের আখের যাতে ভালো হয় তাই করো। অর্থই গান্ধারের আপেল, কপিলার সুরা এবং কাশ্মীরি শাল। রাজকন্যাকে বিবাহ করো ক্ষতি নেই, আখের দেখে নিও!

 

হেলিওডোরাসের সঙ্গে মালবিকার বিবাহের কয়েকদিন পরে রাত্রে গভীর সুষুপ্তির মধ্যে হেলিওডোরাস দেখলে, সেই নবীন সুন্দর কিশোর তাকে ঘুমের মধ্যে ঠেলে দিয়ে আবদারের সুরে অভিমানে রাঙা ঠোঁট ফুলিয়ে বলচে—আমার কথা মনে আছে? আমায় যা দেবে—কবে দেবে? মনে থাকবে?

হেলিওডোরাস চিনলে—দু-বৎসর পূর্বে মহামাত্য সঞ্জয় দত্তের উদ্যানে এই কিশোরকে সে স্বপ্নে দেখেছিল—হূণ-তাঁবুতে রাতের অন্ধকারে একেই সে স্বপ্নে দেখে। একদিন মন্দিরে গিয়ে বিগ্রহের মুখ দেখে তার মনে হয়েছিল, কোথায় যেন এ মুখ সে দেখেচে। আজ সে বুঝেছে—

হেলিওডোরাস বিস্ময়ে ও আনন্দে শিউরে উঠল ঘুমের মধ্যে। ইনিই সেই পরমকরুণাময় বাসুদেব! জয় হোক তাঁর। জয় হোক স্বপ্ন-বাসুদেবের। হেলিওডোরাস তোমাকে ভুলবে না।

 

হেলিওডোরাস ভোলেনি। দু-হাজার বছর মহাকালের বীথিপথের অস্পষ্ট কুজঝটিকায় কোথায় মিলিয়ে গিয়েছে—বিদিশা নগরী ও তার বাসুদেব-মন্দির আজ অতীতের ভগ্নস্তূপ—কিন্তু তার প্রাঙ্গণতলে পরমভাগবত হেলিওডোরাসের বিশাল গরুড়-স্তম্ভ ও ভগবানের স্মৃতিচিহ্ন বহন করে আজও মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে।…ওঁ নমো ভগবতে বাসুদেবায়।…


© 2024 পুরনো বই