ক্যানভাসার কৃষ্ণলাল

ক্যানভাসার কৃষ্ণলাল

চাকুরি গেল। এত করিয়াও কৃষ্ণলাল চাকুরি রাখিতে পারিল না। সকাল হইতে রাত দশটা পর্যন্ত (ডাউন খুলনা প্যাসেঞ্জার, ১০-৪৫ কলিকাতা টাইম) টিনের সুটকেস হাতে শিয়ালদ হইতে বারাসত এবং বারাসত হইতে শিয়ালদ পর্যন্ত ‘তাঁতের মাকু’র মতো যাতায়াত করিয়া ও ক্রমাগত “দত্তপুকুরের বাতের তেল, দত্তপুকুরের বাতের তেল—বাত, বেদনা, ফুলো, কাটা ঘা, পোড়া-ঘা, দাঁত কনকনানি, এককথায় যতরকম ব্যথা, শূলানি, কামড়ানো আছে—সব এক নিমেষে চলে যাবে—আজ চব্বিশ বছর এই লাইনে, ওষুধটি প্রত্যেক ভদ্রলোক ব্যবহার করছেন, সকলেই এর গুণ জানেন—” বলিয়া চিৎকার করিয়াও চাকুরি রাখা গেল না।

সেদিন বসু মহাশয় (ইন্ডিয়ান সিন্ডিকেটের মালিক নৃত্যগোপাল বসু) কৃষ্ণলালকে ডাক দিয়া বলিলেন—পাল মশায়, কাল রাত্রের ক্যাশ জমা দেননি কেন?

—আজ্ঞে আজ্ঞে—অনেক রাত হয়ে গেল—খুলনার ট্রেন—প্রায় বিশ মিনিট লেট।

—দেখুন, আগেও আমি অন্তত সতেরো বার আপনাকে সাবধান করে দিয়েছি। খুলনা ট্রেন দশটা একুশে স্টেশনে আসে, আমি সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত অফিসে বসেছিলাম শুধু আপনার জন্যে। নিত্যাই দু-বার স্টেশনে দেখে এল ট্রেন রাইটটাইমে এসেছে, লেট এক মিনিটও ছিল না—

–আজ্ঞে বড়োবাবু, শরীরটা কাল বড়োই—

–ও আপনার পুরোনো কথা। ও কথা আর শুনবো না আজ। যাক, ক্যাশ এনেচেন এখন?

কৃষ্ণলাল অপরাধীর মতো বড়োবাবুর মুখের দিকে চাহিল। বলিল—ক্যাশটা আনিগে যাই—না—একটু মুশকিল হয়েচে, আচ্ছা আসি—

—যান আসুন—

কৃষ্ণলাল তবুও দাঁড়াইয়া আছে দেখিয়া নৃত্যগোপালবাবু বলিলেন—কী হল?

—আজ্ঞে ওবেলা দেব ওটা। বাসায় এনে রেখেছিলাম, চাবি দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে, আমি যার সঙ্গে থাকি।

—আপনি কোথায় গিয়েছিলেন?

—একটু বেড়াতে বার হয়েছিলাম ওই গোলদিঘির দিকে—

—সব বাজে কথা। আমি বিশ্বাস করিনে। কেন করিনে তাও আপনি জানেন। রাত দশটার পরেই ক্যাশ এনে দেওয়ার কথা—আপনি বুড়ো হয়ে গেলেন এই ক্যানভাসারের কাজ করে, জানেন না যে ক্যাশ তখুনি জমা দেওয়ার নিয়ম আছে?

—আজ্ঞে, আজ্ঞে—

—এরকম আরও কতবার হয়েছে বলুন দিকি! আপনার কথার ওপর বিশ্বাস করা যায় না আর। বড়োই দুঃখের কথা। আপনি আমাদের পুরোনো ক্যানভাসার বলে আপনার অনেক দোষ সহ্য করেছি আমরা। কিন্তু এবার আর নয়। আপনি এ মাসের এই ক-দিনের মাইনে নিয়ে যাবেন অফিস খুললে—কমিশনের হিসেবটাও সেই সঙ্গে দেবেন। যান এখন।

অবশ্য এত সহজে কৃষ্ণলাল যাইতে রাজি হয় নাই—নৃত্যগোপালবাবুকে সে যথেষ্টই বলিয়াছিল, নৃত্যগোপালবাবুর বুড়োকর্তাকে গিয়া পর্যন্ত ধরিয়াছিল। শেষপর্যন্ত কিছুই হইল না।

মুশকিল এই, চাকুরি যখন যাইবার হয়, তখন তাহাকে কিছুতেই ধরিয়া রাখা যায় না। মৃত্যুপথযাত্রী মানবের মতোই তার গতিপথ নির্মম, ধরাবাঁধা!

সুতরাং চাকুরি গেল।

তখন বেলা আড়াইটা। সকাল হইতে ইহাকে উহাকে ধরাধরির ব্যাপারেই এতক্ষণ সময় কাটিয়াছে। স্নান-আহার হয় নাই।

২৫/২ রামনারায়ণ মিত্রের লেনে ঢুকিয়াই যে টিনের চালওয়ালা লম্বা দোতলা মাটির ঘর, অর্থাৎ যে মাঠকোঠার ঠিক সামনেই আজকাল কর্পোরেশনের সাধারণ স্নানাগার নির্মিত হইয়াছে—তারই পশ্চিম কোণে সতেরো নম্বর ঘরে আজ প্রায় এগারো বছর ধরিয়া কৃষ্ণলালের বাসা।

কৃষ্ণলাল ঘরে একা থাকে না। ছোট্ট ঘরে তিনটি ময়লা বিছানা মেঝেরে উপর পাতা। সে ঢুকিয়া দেখিল ঘরে কেবল যতীন শুইয়া ঘুমাইতেছে। আর একজন রুমমেট ট্রামের কান্ডাকটার, সাড়ে চারটার পরে সে ডিউটি হইতে  ছুটি লইয়া একবার আধঘণ্টার জন্য বাসায় আসে এবং তারপরেই সাজিয়া-গুজিয়া কোথায় বাহির হইয়া যায়।

নীচে পাইস হোটেলে ইহাদের খাইবার বন্দোবস্ত।

কৃষ্ণলালের সাড়া পাইয়া যতীনের ঘুম ভাঙিয়া গেল। সে বলিল—এত বেলায়?

—বেলায় তা কী হবে! চাকরিটা গেল আজ।

—সে কী! এতদিনের চাকরিটা—

—কত করে বললুম বড়োবাবুকে। তা শোনে কী কেউ? গরিবের কথা কে রাখে বলো?

—হয়েছিল কী?

—ক্যাশ জমা দিতে দেরি হয়েছিল। বলে, তুমি ক্যাশ ভেঙেচ!

—তাই তো…তাহলে এখন উপায়?

—দেখি কোথাও আবার চেষ্টা—জুটে যাবে একটা-না-একটা। আমাদের এক দোর বন্ধ হাজার দোর খোলা—আমাদের অন্ন মারে কে?

সামান্য কিছু পয়সা হাতে ছিল—পাইস হোটেল হইতে শুধু ডাল-ভাত খাইয়া আসিয়া কৃষ্ণলাল কিছুক্ষণ বিশ্রাম করিল, পরে নবীন কুণ্ডু লেনে একটি খোলার বাড়িতে ঢুকিয়া ডাক দিল—ও গোলাপী—গোলাপী—

তাহার সাড়ায় যে বাহির হইয়া আসিল সে বর্তমানে রূপযৌবনহীনা প্রৌঢ়া, পরনে আধময়লা খয়েরি রং-এর শাড়ি, হাতে গাছকয়েক কাচের চুড়ি, দু-গাছা সোনাবাঁধানো পেটি। মাথার চুলে পাক ধরিয়াছে, গায়ের রং এখনও বেশ ফর্সা।

গোলাপীকে ত্রিশ বছর আগে দেখিলে ঠিক বোঝা যাইত গোলাপী কী ছিল? এখন আর তাহার কী আছে? কৃষ্ণলাল তখন সবে ঔষধের ক্যানভাসারের পদে বহাল হইয়াছে—তাহার চমৎকার চেহারা ও কথাবার্তা বলিবার ভঙ্গিতে রেলগাড়ির প্যাসেঞ্জার কী করিয়া সহজেই ভুলিয়া যাইত-জলের মতো পয়সা আসিতে লাগিল।

এই নবীন কুণ্ডু লেনেই অন্য এক বাড়িতে এক বন্ধুর সহিত আসিয়া সে গোলাপীকে দেখে। তখন নতুন যৌবন, হাতেও কাঁচা পয়সা। গোলাপীর তখন বয়স ষোলো-সতেরো। রূপ দেখিয়া রাস্তার লোক চমকিয়া দাঁড়াইয়া যায়। গোলাপীর মার হাতে বছরে বছরে মোটা টাকা জমে। কৃষ্ণলাল সেই হইতেই নবীন কুণ্ডু লেনের নৈশ অধিবাসী। কত কালের কথা,-গোলাপীর ঘরে মেহগনি কাঠের দেরাজ হইল, ঘরের দেয়ালে বিলম্বিত বড়ো বিলাতি কাচ বসানো আয়না হইল, সেকালে প্রচলিত ম্যাকাসার অয়েলের শিশির পর শিশি ভিড় জমাইয়া তুলিল—বাতায়ন মালতী ফুলের টবে সজ্জিত হইয়া বাড়ির অন্যান্য ঘরের অধিবাসীদের মনে ঈর্ষার উদ্রেক করিল।

কাঁচা পয়সা কৃষ্ণলালের হাতে। প্রতিদিনের আয় তিন টাকা—আড়াই টাকার নীচে নয়।

একদিন গোলাপীর মা অভিমানের সুরে বলিল—যাই বলো বাপু, গোলাপী আমায় প্রায়ই বলে, একখানা বাড়ি তার নিজের না-হলে চলে না আর—তা তেমন কপাল কী—এই এক বাড়িতে ছত্রিশ জনার সঙ্গে

—কেন মা? তার ভাবনা কী? কালই ঘর দেখে দিচ্চি—

—কত টাকা ভাড়ার মধ্যে হবে বলো—এই আমাদের পাড়াতেই আছে—

—যা তুমি বলবে! কুড়ি কী পঁচিশ

—ত্রিশ টাকায় একখানা ভালো বাড়ি এ পাড়াতেই আছে—তাহলে তাই না হয়—

—হ্যাঁ হ্যাঁ—এ আবার আমায় জিজ্ঞেস করতে হয় মা?

গোলাপীরা নতুন বাড়িতে উঠিয়া আসিল। বড়ো পাঁচী বলিল—ওলো, একটু রয়ে-সয়ে নিস—দেখিস যেন আবার দড়ি না হেঁড়ে! খুব বরাত তোর যাহোক গোলাপী—আর আমাদের ওই বুড়ো রায়বাবু রোজ আসেন আর বাঁধানো দাঁত জলের গেলাসে খুলে রাখেন—ক-দিন বললাম একখানা ঢাকাই শাড়ি আর একটা বাজা-ঘড়ি দাও দেয়ালে টাঙানোের, তা বুড়ো মড়া আজ সাত মাস ঘুরুচ্চে—আজ এলে হয় একবার—ওর দাঁত খুলে জলের গেলাসে ডুবিয়ে রাখা বের করে দেব–

শুধু বাড়ি? গোলাপীর টেবিল-হারমোনিয়ম হইল, জোড়া জোড়া শাড়ি, চেয়ার, এমনকী শেষে কলের গান পর্যন্ত। কোন সুখ গোলাপীর বাকি ছিল? প্রতি রবিবারে কৃষ্ণলালের সঙ্গে গাড়ি করিয়া (অবশ্য ঘোড়ার গাড়ি) কালীঘাটে গঙ্গাস্নান ও দেবীদর্শন করিতে যাওয়া তাহার অভ্যাসের মধ্যে দাঁড়াইয়া গিয়াছিল। বছরের পর বছর কাটিয়া গেল।

গোলাপী আর কৃষ্ণলাল, কৃষ্ণলাল আর গোলাপী।

ইতিমধ্যে গোলাপীকে সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে প্রতিষ্ঠিতা দেখিয়া তাহার মা একদিন নবীন কুণ্ডু লেনের মায়া কাটাইয়া বোধ হয় ঊর্বশী বা তিলোত্তমালোকে প্রস্থান করিল। অমন জাঁকের শ্রাদ্ধ এ অঞ্চলে কেহ দেখে নাই তার আগে।

ক্রমে ক্রমে গোলাপীর যৌবনে ভাটা পড়িল। কৃষ্ণলালেরও আয়ের অঙ্ক কমিতে লাগিল। দত্তপুকুরের তেলের অনুকরণে শত শত বাতের তেল বাজারে বাহির হইল—রেলগাড়ির কামরাও নিত্যনূতন ক্যানভাসারে ভরিয়া গেল। যা ছিল কৃষ্ণলালের একার—তাহার মধ্যে অনেক ভাগ বসিল। পূর্বের সচ্ছলতা কমিতে লাগিল।

 

তারপর দশ-বারো বছর কাটিয়া গিয়াছে।

এই দশ-বারো বছরে সুন্দরী গোলাপী কুরূপা প্রৌঢ়াতে পরিবর্তিত হইয়াছে— তাহার সে বাড়ি চলিয়া গিয়া আবার সাত-আটটি নানা বয়সের সঙ্গিনীর সঙ্গে পূর্বের বাড়িটিতে থাকিতে হয়।

তবুও কৃষ্ণালের যাহা কিছু উপার্জন, এইখানেই তাহার সদব্যয়। গোলাপীও তাহা বোঝে—এই ত্রিশ বছরের মধ্যে সে কৃষ্ণলালকে ছাড়িয়া অন্য কোথাও যায় নাই।

কৃষ্ণলাল বলিল—গোলাপী, চাকরিটা গেল!

গোলাপী বিস্ময়ের সুরে বলিল—সে কী গা!

—বড়োবাবু রাগ করেচে, কাল ক্যাশ জমা দিইনি বলে।

—কী করলে সে টাকা?

–খরচ হয়ে গেল।

—কোথায় খরচ হয়ে গেল—কীসে খরচ হয়ে গেল? তোমার এখনও দোষ গেল না, তা ওরা কী করে রাখে তোমায়? কাল কোথায় গিয়েছিলে?

—সে খরচ নয় গোলাপী। দক্ষিণেশ্বর সেদিন যাওয়ার দরুণ দেনা ছিল, মনে নেই? কাবুলির কাছ থেকে টাকা নিইনি? রাত দশটার পরে ইস্টিশনের গেটে আমায় ধরেচে–রূপি দেও। শেষে ভাবলাম কী, ছোরা মারবে নাকি? ভয়ে পড়ে দিয়ে দিলাম টাকা। কাবুলির দেনা, ও হজম করা কঠিন।

—তা নেও বেশ হয়েছে। এখন খাওয়া হয়েছে, না হয়নি? আমার অদেষ্টে ঝি গিরি নাচছে সে তো দেখতে পাচ্ছি! তখন বনু, পাড়াগাঁয়ের দিকে চলো—কোথাও একখানা ঘরদোর বেঁধে দুজনে থাকা যাবে—তা না, তোমার বাপু কলকেতা আর কলকেতা! কলকেতা ছেড়ে আমি থাকতে পারবোনি! এখন থাক কলকেতায়! কে। এখানে খাওয়ায় দেখি!

—জুটে যাবে, এখানেই জুটে যাবে। অত ভাবনার কারণ নেই—

—তোমার এ বুড়ো বয়সে চাকরি নিয়ে তোমার জন্যে বসে আছে। এখন আর কি তোমার হাত পা নেড়ে বক্তিমে করবার গতর আছে নাকি?

—দেখিয়ে দেব, গোলাপী, দেখবি! ভদ্রমহোদয়গণ, এই সেই বিখ্যাত আদি ও অকৃত্রিম দত্তপুকুরের বাতের তেল—ইহা ব্যবহারে সর্বপ্রকার বাত, বেদনা, মাথাধরা, দাঁত-কনকনানি, কাউর, ছুলি, কাটা-ঘা, পোড়া-ঘা—

গোলাপী হাসিতে হাসিতে বলিল—থাক গো গোঁসাই, আর বিদ্যে দেখাতে হবে …সবাই জানে তুমি খুব ভালো বক্তিমে দিতে পারো—আহা, কী হাত পা নাড়ার ছিরি! যেন থিয়েটারের অ্যাক্টো করছেন!

—তাহলে বল চাকুরিতে নেবে কিনা?

—নেবে না আবার! একশোবার নেবে—আমি যাই এখন ঝি-গিরি করে নিজের পেট চালাবার চেষ্টা দেখি—নিজেই খেতে পাবে না তা আমায় আর খাওয়াবে কোত্থেকে! কী অদেষ্ট যে নিয়ে এসেছিলাম!

কৃষ্ণলাল চলিয়া যাইতে উদ্যত হইয়াছে দেখিয়া গোলাপী বলিল—বোসো, দুটো মুড়িটুড়ি মেখে দি—খেয়ে একটু চা খেয়ে যাও—

অগত্যা কৃষ্ণলাল বসিল। বলিল—তাহলে বক্তৃতা এখনও দিতে পারি, কি বলো?

—নেও, আর আদিখ্যেতায় কাজ নেই। দিতে পারো তো—সত্যি কথা যদি বলি তবে তো পায়া ভারী হয়ে যাবে!

—কী, বলো না গোলাপী, বলতেই হবে।

—তোমার মতো অমন কারো হয় না, আমি তো কতই দেখলাম দাঁতের মাজনের, ওষুধের ফিরিওয়ালা আমাদের এই গলির মুখে হারমোনিয়াম গলায় বেঁধে নাচে, বক্তিমে দেয় পোড়ারমুখোরা—কিন্তু সে-সব ফিরিওয়ালা তোমার মতো নয়—

কৃষ্ণলাল রাগের সুরে বাধা দিয়া বলিল—কীসের সঙ্গে কীসের তুলনা! তোকে নিয়ে আর পারিনে দেখচি—তারা হল ফিরিওয়ালা—আমরা হলুম ক্যানভাসার— হারমোনিয়াম পিঠে বেঁধে যারা গান গেয়ে ঘুঙুর পায়ে দিয়ে নেচে বেড়ায়, আমরা

কী সেই দলের? অপমান হয়, ওকথা আমাদের বোলো না।

–যাক যাক, ভুল হয়েছে, তুমি এখন ঠান্ডা হয়ে বসে চা খেয়ে নেও।

গোলাপীর মন আজ বেশ খুশি। কতদিন পরে যেন যুবক কৃষ্ণলালের অঙ্গভঙ্গি ও সুন্দর সতেজ গলার স্বর সে আবার শুনিল! ত্রিশ বৎসরের অন্ধকার কালো হেঁড়া পর্দাটা কে টানিয়া সরাইয়া দিল!

সে যত্ন করিয়া কৃষ্ণলালকে খাওয়াইল—কৃষ্ণলাল বিদায় লইয়া যখন আসে তখন বলিল—একটা কথা বলি শোনো। যদি খাওয়া-দাওয়ার কোনো কষ্ট হয়, তবে আমার কাছে এসে অবিশ্যি খেয়ে যাবে। এই বেদ্দ বয়েসে না-খেলে শরীর থাকবে কেন? আমায় কিছু দিতে হবে না এখন। ওই সোনারবেনেদের ঠাকুরবাড়িতে একটা ঝিয়ের দরকার, সকাল-সন্ধে কাজ করব—আমি কাল থেকে সেখানে কাজে লেগে যাব—তা তোমায় বলাও যা না বলাও তাই—তুমি কি আসবে? তোমায় আমি চিনি কিনা?

কৃষ্ণলাল হাসিয়া বলিল—ভালোই তো। তোর রোজগারে এইবার খাই দিনকতক—সে সাধ আমার কাছে অনেকদিন থেকেই। আচ্ছা তাহলে এখন আসি, ওবেলা হয়তো আসব—সন্ধের পর।

তাহার পর এক মাস কাটিয়া যায়, কিন্তু গোলাপীর বাড়ি কৃষ্ণলাল আর আসিল। সুখের দিনে গোলাপীকে সে অনেক দিয়াছে—এখন দুঃখের দিনে বসিয়া বসিয়া গোলাপীর অন্ন ধ্বংস করিবে, তেমন-বংশে জন্ম নয় কৃষ্ণলালের। বিশেষত দেখিতে হইবে, গোলাপীও প্রৌঢ়া—ঝি-গিরি ভিন্ন এখন আর তার কোনো উপায় নাই!

মেসের ভাড়া বাকি পড়িয়াছিল দু-মাসের, মেসের অধ্যক্ষ কৃষ্ণলালকে ডাকিয়া বলিল—কী কৃষ্ণবাবু, আমাদের রেন্ট টার কী হবে?

—আজ্ঞে ক্ষেত্রবাবু, দেখতেই তো পাচ্ছেন—চাকুরিটা গেল, হাতে কিছু নেই। এ অবস্থায়

—ফি-মাসে আমি পকেট থেকে ঘরভাড়া জোগাব কোথা থেকে, সেটাও তো দেখতে হবে! দু-দিন সময় নিন—তারপর আপনি দয়া করে সিট ছেড়ে দিন, আমি অন্য ব্যবস্থা দেখি।

কৃষ্ণলাল পড়িল মহা বিপদে। একে খাইবার পয়সা নাই—তাহার উপর মাথা পুঁজিবার যে জায়গাটুকু ছিল, তাহাও তো আর থাকে না। তিনদিন কাটিয়া গেল, দু-একটি পূর্বপরিচিত বন্ধুর নিকট হইতে চাহিয়া-চিন্তিয়া দু-চার আনা ধার লইয়া পাইস হোটেলের ডাল-ভাতে কোনোরকমে ক্ষুধানিবৃত্তি করিয়া এই তিনদিন পরে তাহার সত্যই অনাহার শুরু হইল। দু-পয়সায় ছাতু বা মুড়ি সারাদিনে—শুধু ছাতু, একটু গুড় বা চিনি জোটে না তাহার সঙ্গে! তাহার পর পেট পুরিয়া জল, কলের নির্মল জল!

মেসে ম্যানেজার আবার ডাক দিলেন। বলিলেন—কিছু হল?

—আজ্ঞা এখনো—এই ভাবচি

—আমার লোক এসে গিয়েচে-কাল মাসের পয়লা। দু-মাসের ভাড়া পকেট থেকে দিয়েচি—এ মাসেরও দিতে হবে? আমিও ছাপোষা মানুষ মশাই—কত লোকসান হজম করি বলুন! আপনি জিনিসপত্তর নিয়ে চলে যান—আমার ভাড়ার দরকার নেই।

পরদিন সকালেই জিনিসপত্রসমেত (একটা টিনের ট্রাঙ্ক ও একটি ময়লা বিছানা) কৃষ্ণলালকে পথে দাঁড়াইতে হইল। বর্ষাকাল—জিনিসপত্র রাখিবার মতো জায়গা কোথায় পাওয়া যায়? গোলাপী অনেকবার মেসে খবর লইয়াছে—মধ্যে একদিন দু-ঘণ্টা মেসের বাহিরের ফুটপাতে বসিয়াছিল তাহার অপেক্ষায় (কারণ ম্যানেজার তাহাকে চেনে, মেসে কুচরিত্রা স্ত্রীলোক ঢুকিতে দিবে না)—কৃষ্ণলাল দুর হইতে দেখিয়া সরিয়া পড়িয়াছিল। এখন গোলাপীর বাড়ি গেলে সে কান্নাকাটি করিবে, আটকাইয়া রাখিতে চাহিবে। নতুবা সেখানে জিনিসপত্র রাখা চলিত।

মেস হইতে কিছু দূরে বড়ো রাস্তার উপর একটা চায়ের দোকানের মালিকের সঙ্গে কৃষ্ণলালের পরিচয় ছিল। বলিয়া-কহিয়া সেখানে কৃষ্ণলাল জিনিসপত্র আপাতত রাখিয়া দিল। তাহার পর উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরিতে ঘুরিতে হঠাৎ দেখিল সে গঙ্গার ধারে আহিরীটোলার স্টিমারঘাটে আসিয়া পড়িয়াছে।

সকাল হইতে কিছু খাওয়া হয় নাই। ঘাটের ধারে একটা গাছতলায় হিন্দুস্থানী ফিরিওয়ালা ভুট্টা পোড়াইতেছে, কৃষ্ণলাল এক পয়সায় একটা ভুট্টা কিনিয়া জলের ধারে বসিয়া সেটি পরম তৃপ্তির সহিত খাইল।

একটা বিড়ি পাইলে হইত এই সময়।

এই সময় একটি ছোকরা ব্যাগহাতে আসিয়া তাহার পাশে ব্যাগটি নামাইয়া পকেট হইতে ঝাড়ন বাহির করিয়া সিমেন্ট বাঁধানো রানার উপর পাতিল। বসিতে যাইবে এমন সময় ছোকরা হঠাৎ পকেটে হাত দিয়া কী দেখিয়া একবার চারিদিকে চাহিল এবং কাছেই কৃষ্ণলালকে দেখিয়া বলিল—একটু দয়া করে ব্যাগটা দেখবেন? এক পয়সার বিড়ি কিনে আনি—

বিড়ি কিনিয়া আনিয়া সে কৃষ্ণলালকে একটি বিড়ি দিল। কৃষ্ণলাল আগেই আন্দাজ করিয়াছিল, ছোকরা একজন ক্যানভাসার। এখন জিজ্ঞাসা করিল—আপনি বুঝি ক্যানভাস করেন?

–আজ্ঞে হ্যাঁ—

—কী জিনিস?

—হাতকাটা তেল—সার্জিক্যাল মলম—

—বেশ পাওয়া যায়? কমিশন কেমন?

—ভালোই। খদ্দেরকে হাত কেটে দেখাতে—সঙ্গে ছুরি থাকে—এই যে—

ছোকরা জামার আস্তিন গুটাইয়া দেখাইল—কবজি হইতে কনুই পর্যন্ত হাতের সমস্ত অংশটা ছুরি দিয়া ফালা ফালা করিয়া চেরা! কৃষ্ণলাল শিহরিয়া উঠিয়া বলিল—এ কী, লাগে না?

ছোকরা হাসিয়া বলিল—লাগে—আবার মলম লাগালে সেরে যায়।

—কীরকম আয় করেন?

—চব্বিশ টাকা থেকে ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ টাকা মাসে।

কৃষ্ণলালের মন বেজায় দমিয়া গেল। এত কাণ্ড করিয়া ত্রিশ টাকা! অথচ এমন সময় গিয়াছে—যখন দত্তপুকুরের বাতের তেল ফিরি করিয়া সে মাসে ষাট-সত্তর টাকা অনায়াসে রোজগার করিয়াছে—তাহার জন্য নিজের হাত ছুরি দিয়া ফালা ফালা করিয়া কাটিবার প্রয়োজন হয় নাইঅ্যা

ক্যানভাসারের কাজে আর সুখ নাই। আর সে এ কাজ করিবে না।

পরদিন কৃষ্ণলাল কলিকাতা ছাড়িয়া স্বগ্রামে রওনা হইল। বসিরহাট স্টেশনে নামিয়া সাত ক্রোশ হাঁটিয়া তাহার পৈতৃক গ্রাম ইলশেখালি পৌঁছিতে বেলা তিনটা বাজিল। গ্রামে তাহার দূর-সম্পর্কের জ্ঞাতি ছাড়া অন্য কেহ আপনারজন নাই— নিজের পৈতৃক ভিটা জঙ্গলাকীর্ণ হইয়া পড়িয়া আছে। বহুদিন এদিকে আসে নাই, দেখাশোনাও করে নাই—খড়ের ঘর কতদিন টেকে? আজ প্রায় সতেরো-আঠারো বছর পূর্বে দু-পাঁচ দিনের জন্য একবার পিসিমার শ্রাদ্ধে গ্রামে আসিয়াছিল—সেই আর এই!

জ্ঞাতিরা অবশ্য কৃষ্ণলালকে জায়গা দিল। কিন্তু কিছুদিন থাকিয়া কৃষ্ণলালের কেমন অসহ্য বোধ হইতে লাগিল। গ্রামে তাহার মন টেকে না। কখনো সে দীর্ঘদিন ধরিয়া গ্রামে বাস করে নাই—এখানকার লোকে কথাবার্তা বলিতে জানে না, ভালো করিয়া মিশিতে জানে না, চা খায় না। কলিকাতায় রাস্তার ভিখারিও চা খায়। তাহার উপর এই পাড়াগাঁয়ে যেমন জলকাদা, তেমনি জঙ্গল—রাত্রে মশার উৎপাতে নিদ্রা হয় না। এর মধ্যে ম্যালেরিয়া প্রায় সকল বাড়িতেই দেখা দিয়াছে।

না, এখানে মন টেকে না। কৃষ্ণলাল চেষ্টা করিয়া দেখিল—এখানে সবাই যেন সারাদিন ঘুমাইয়া আছে। সকাল হইতে সন্ধ্যা পর্যন্ত ইহারা চড়কতলার ক্ষুদ্র মাঠে বেলতলায় বসিয়া হুকা হাতে আড্ডা দেয়, পরচর্চা করে। কোনো কাজ নাই অথচ দুপুরের ভাত দুটি মুখে দিতে না-দিতে এদের চোখ ঘুমে ঢুলিয়া পড়ে। দিবানিদ্রা চলে চারিটা পর্যন্ত—তারপর ঘুম হইতে রক্তবর্ণ চোখে উঠিয়া কেহ-বা বাজারে দু-পয়সার সওদা করিতে যায়—সেখানেও আবার আড্ডা…এ দোকানে ও দোকানে বসিয়া তামাক খাওয়া…চার পয়সার সওদা করিতে তিন ঘণ্টা লাগাইয়া সন্ধ্যার পর বাড়ি আসে। তারপরই আহার ও নিদ্রা। কেরোসিন তেলের দাম চড়িয়া গিয়াছে—তেল খরচ করিয়া আলো জ্বালাইয়া রাখিতে কেহ রাজি নয়। কয়েক বাড়ি যাও—অন্ধকারে বসিয়া দু-একটা কথা বলো, গল্প করো—এক-আধ কল্কে তামাক খাও—তাহার পর বাড়ি ফিরিয়া আবার বিছানা আশ্রয় করো, দিন শেষ। হইয়া গেল।

কৃষ্ণলাল এরকম জীবনে অভ্যস্ত নয়। এ কী জীবন? অথচ সকলেই বলিবে, দাদা, সংসার আর চলে না, বড়ো কষ্ট! কষ্ট ঘুচাইবার চেষ্টা কোথায়? আজ দীর্ঘ পঁচিশ-ত্রিশ বছর ধরিয়া যার কলিকাতায় ভীষণ কর্মব্যস্ত জীবন কাটিয়াছে—এ ধরনের অলস, শ্রমবিমুখ জীবনের ধারণাই করিতে পারে না সে!

সকালে উঠিয়াই নীচের তলার কলে স্নান সারিয়া লইতে হইত। খুব ভোরে স্নান না-সারিলে এমন ভিড় জমিয়া যাইবে কলে যে আর স্নান করা চলিবে না। নীচের তলায় সেকরার দোকানের লোকেরা, শালওয়ালা, দরজি, পুব দিকের ঘরে যে মুটেরা থাকে সবাই আসিয়া কলে ভিড় লাগাইয়া দিবে। ইহার পর আসিবে একদল বালতি হাতে জল ধরিতে ও চাউল ধুইতে। সারি সারি লোক দাঁড়াইয়া যাইবে কলসি হাতে জল ভরিতে। ওপরে তিনতলায় তিনটি মেসের চাকরেরা— সকলেই কর্মব্যস্ত, ঘড়ি ধরিয়া কাজ কলিকাতায়, “সময় গেল। ছ-টা বাজে, কখন কী হবে?” দিন আরম্ভ হইয়াছে…এখনি বাবুরা আসিয়া ভাত চাহিবে আটটা বাজিতে-না-বাজিতে, এতটুকু দেরি করিলে চলিবে না!

স্নান সারিয়া কৃষ্ণলাল ব্যাগ হাতে বাহির হইত শেয়ালদ’ স্টেশনে, প্রথমেই সাতটা দশ বারাসত, সাতটা পঁচিশ নৈহাটি, পৌঁনে আটটা রানাঘাট প্যাসেঞ্জার; সাড়ে আট-টা বনগাঁ লোকাল, আটটা পঞ্চাশ দত্তপুকুর, ন-টা কেষ্টনগর লোকাল…শুরু হইয়া গেল দিনের কাজ। বাতের তেল! বাতের তেল! যত প্রকার বাত, ফোলা, শূলানি, কনকনানি, মাথাধরা, পেটবেদনা, ইহার একমাত্রা ব্যবহারে…ভদ্রমহোদয়গণ, এই ওষুধটি আজ ত্রিশ বছর যাবৎ এই লাইনে সুখ্যাতির সহিত চলিতেছে,—এই চলিল বেলা বারোটা পর্যন্ত। বারোটা পঞ্চান্ন শান্তিপুর ছাড়িয়া গেলে তবে সকালের কাজ মিটিল। কী জীবন! কী আনন্দ! কী পয়সা রোজগার! কাঁচাপয়সা রোজ আসে, রোজ সন্ধ্যায় উড়িয়া যায়। যে পয়সা আয় করিতে জানে, সে-ই জানে খরচ করিতে, ইহাতে ক্ষোভ কী?

কৃষ্ণলাল আরও মাসখানেক কোনোরকমে কাটাইল।

আর চলে না। এ অলস জীবন তাহার অসহ্য। কখনো পা গুটাইয়া কূর্মবৃত্তি অবলম্বন করিয়া এভাবে সে থাকে নাই। বেশিদিন এভাবে থাকিলে সে পাগল হইয়া যাইবে, নয়তো মরিয়া যাইবে।

কিন্তু কলিকাতায় গিয়া সে খাইবে কী? কোনো উপায় তো দেখা যাইতেছে না! ইন্ডিয়ান ড্রাগ সিন্ডিকেটে আর চাকরি হইবার সম্ভাবনা নাই। তবুও একবার বসু মহাশয়কে গিয়া ধরিয়া দেখিলে কেমন হয়? কিছু যদি না-জোটে, তবে আহিরীটোলার ঘাটে সেই হাতকাটা তেলের ক্যানভাসার ছোকরার সঙ্গে দেখা করিয়া…তবে ছুরি দিয়া নিজের হাতটা ফালা ফালা করিয়া কাটা—এ বৃদ্ধ বয়সে, ক্যানভাসারের চাকুরির মতো সম্মানের চাকুরি, আরামের চাকুরি আর নাই, কিন্তু হাত কাটিয়া দেখাইয়া জিনিস বিক্রয় করা! ওতে মানসম্ভম থাকে না।

এভাবে গ্রামে বসিয়া থাকা জীবন নয়। চিরকাল কাজের মধ্যে থাকিয়া আজ বাঁচিয়া মরিয়া থাকা তাহার পোষাইবে না। গ্রামেও তো হাওয়া খাইয়া জীবনধারণ করা যায় না— কেহ কেহ তাহাকে সামনের বছর দু-এক বিঘা ধান করিতে পরামর্শ দিল—কেহ বলিল, ডোবার ধারে জমিটা পড়ে আছে কেষ্ট খুড়ো, তোমারই পৈতৃক জমি, এই শীতকালে মানকচু লাগাও ওটাতে, তবু হাটে হাটে কিছু ঘরে আসবে, সামনের শীতকাল নাগাৎকৃষ্ণলালের হাসি পায়।

কলিকাতায় রোজগার যে কী ধরনের, সেখানে ক্যানভাসারের কাজে মাসে যে টাকা এক সময় তাহার আয় ছিল, এখানে গোটা বছর ধরিয়া কচু, কুমড়ো বেচিয়াও যে সে আয় হওয়া অসম্ভব—এই মূর্খ, অর্বাচীনেরা তাহা কী করিয়া বুঝিবে?

 

অবশেষে সে একদিন বাক্সবিছানা বাঁধিয়া কলিকাতায় আসিয়া হাজির হইল।

বাঁচিতে হয় তো ভালো করিয়াই সে বাঁচিবে।

ট্রেনে পুরোনো ক্যানভাসারদের সঙ্গে দেখা। নবশক্তি ঔষধালয়, কবিরাজ অনঙ্গমোহন দেব, বিশ্বাস কোম্পানি—ইন্ডিয়ান ড্রাগ সিন্ডিকেট প্রভৃতি ফার্মের লোক সব। সবাই জানে, সবাই খাতির করে।

—আরে এই যে কেষ্টদা, আজকাল আর দেখিনে যে?

—কেষ্টদা, কোত্থেকে? বিয়েথাওয়া করলেন নাকি এ বয়সে?

—আজকাল কোনো কোম্পানিতে আছেন কেষ্টদা? দেখিনে ট্রেনে আর?

—জমিজমা দেখতে গেছলে ভায়া? তা দেখবেই তো, থাকলেই দেখে–আমাদের কোনো চুলোয় কিছু নেই, যা করে এই বিশ্বাস কোম্পানি, হিংসা হয় তোমায় দেখে, দু-শো টাকা বছরে আয়ের সম্পত্তি? বলো কী! তবে তো তুমি– ইত্যাদি, ইত্যাদি।

কৃষ্ণলালকে এ বিড়ি দেয়, ও পানের কৌটো খুলিয়া সামনে ধরে। পুরাতন বন্ধুর দল। ইহাদের ফেলিয়া সে এতকাল ঘুমন্তপুরীতে কাল কাটাইল যে কী ভাবিয়া? এখানে কাজ আছে, আমোদ আছে, পয়সা রোজগার আছে, তারপর ইয়ে আছে। আর সে কোথাও যাইবে না কলিকাতা ছাড়িয়া। মরিতে হয় এখানেই মরিবে।

পনেরো-বিশ দিন এখানে ওখানে হাঁটাহাঁটি করিয়াও কিন্তু চাকুরি মিলিল না। বসু মহাশয় ঝাড়া জবাব দিলেন। এখন সুশ্রী চেহারার ছোকরা ক্যানভাসার—বেশ লম্বা জুলপি, ঘাড় বাহির করিয়া চুল ছাঁটা, লপেটা জুতা পায়ে, থিয়েটারের রামের মতো গলা, এই সবাই চায়। বয়স হইয়া গেলে, মানে, উহাদের লোক আছে, দরকার হইলে চিঠি লিখিয়া জানাইবেন পরে।

পুরোনো মেসেই উঠিয়াছিল, বারান্দাতে আছে। গোলাপীর সঙ্গে দেখা করে নাই। এখন করিতে চাহেও না সে। অনাহারে দু-দিন কাটিল মধ্যে। অবশেষে একদিন আহিরীটোলার ঘাটেই গিয়া হাজির হইল, যদি হাতকাটা তেলওয়ালা সেই ছোকরার সঙ্গে দেখা হইয়া যায়! সে সাড়ে বারোটার স্টিমারে রোজ বালি হইতে আসে বলিয়াছিল। সাত-আট দিন ক্রমাগত ঘুরিয়াও কিন্তু ছোকরার দেখা মিলিল না। কৃষ্ণলালের দুঃখ শেষ সীমায় আসিয়া পোঁছিয়াছে। আর চলে না। আচ্ছা, সে ক্যানভাসারি ভুলিয়া যাইতেছে না তো? আজ কতদিন চাকুরি নাই, কতদিন বক্তৃতা দিবার অভ্যাস নাই। চর্চা-অভাবে শেষে কিনা ছোকরা ক্যানভাসারেরা তাহাকে— কৃষ্ণলালকে ছাড়াইয়া যাইবে!

সেদিন কৃষ্ণলাল নিজের টিনের ছোটো সুটকেসটি হাতে লইয়া ড্যালহাউসি স্কোয়ারের মোড়ে দাঁড়াইয়া হাত-পা নাড়িয়া ক্যানভাসারের বক্তৃতা জুড়িয়া দিল, চর্চা রাখা দরকার তো বটেই, তা ছাড়া সে নিজের শক্তি পরীক্ষা করিতে চায়, খরিদ্দার জোটে কিনা সে একবার দেখিবে। এখনও তাহার যাহা গলা আছে, থিয়েটারের রামের মতো গলাওয়ালা কোনো ছোকরা ক্যানভাসার তাহার সঙ্গে পাল্লা দিবে, সে দেখিতে চায়!—দত্তপুকুরের বাতের তেল! ব্যবহারে সর্বপ্রকার বাতবেদনা, মাথা ধরা, দাঁতশূলানি, হাত-বেদনা, পিঠ-বেদনা…ভদ্রমহোদয়গণ! এই ঔষধটি আজ ত্রিশ বছর ধরিয়া এই লালদিঘির মোড়ে…

কৃষ্ণলাল মিনিট পাঁচ-ছয় পরে সগর্বে একবার চারিদিকে পচহিয়া দেখিয়া লইল। বেশ ভিড় জমিয়া গিয়াছে। একজন ভিড় ঠেলিয়া কাছে আসিয়া বলিল—আমায় একটা ছোটো ফাইল—

কৃষ্ণলাল গম্ভীরভাবে বলিল—আমার কাছে ওষুধ নেই—আমি বসু ইন্ডিয়ান ড্রাগ সিন্ডিকেটের পাবলিসিটি ডিপার্টমেন্টে র লোক, যাঁদের দরকার হবে, তাঁরা একশো ছয়ের সি হরিধন পোদ্দার লেনে বসু ইন্ডিয়ান ড্রাগ সিন্ডিকেটের অফিসে…আমার নামের এই স্লিপটা নিয়ে যান দয়া করে, টাকায় চার আনা কমিশন পাবেন—দাঁড়ান লিখে দিচ্ছি—

দিন পাঁচ-ছয় কাটিল। কৃষ্ণলালের নেশা লাগিয়া গিয়াছে। সে বেলা তিনটার সময় রোজ সুটকেস হাতে ঝুলাইয়া ডালহাউসি স্কোয়ারের মোড়ে গিয়া বক্তৃতা জুড়িয়া দেয়। আফিস–ফেরতা লোকেরা ভিড় করিয়া শোনে।

সেদিন কৃষ্ণলাল দাঁড়াইয়া দত্তপুকুরের বাতের তেলের গুণ ব্যাখ্যা করিতেছে। এমন সময় একজন ভদ্রলোক ভিড় ঠেলিয়া একেবারে তাহার সামনে আসিয়া দাঁড়াইলেন।

কৃষ্ণলাল চমকিয়া উঠিল, বসু ড্রাগ সিন্ডিকেটের মালিক নৃত্যগোপাল বসু মহাশয় স্বয়ং।

বসু মহাশয় কৃষ্ণলালের দিকে স্থিরদৃষ্টিতে চাহিয়া বলিলেন, শুনুন একবার এদিকে—

কৃষ্ণলাল ভিড়ের পাশ কাটাইয়া কিছু দূরে বসু মহাশয়ের সঙ্গে গিয়া অপ্রতিভের মতো দাঁড়াইল। বসু মহাশয় বলিলেন, এ কী হচ্ছে?

কৃষ্ণলাল অপরাধীর মতো মাথা চুলকাইতে চুলকাইতে বলিল,–আজ্ঞে, আজ্ঞে, একবার চর্চাটা রাখচি, নইলে–

বসু মহাশয় বলিলেন, তাই তো বলি, এ কী কাণ্ড! গত দিন পাঁচ-ছয়ের মধ্যে আফিসে আপনার নামের স্লিপ নিয়ে বোধ হয় একশো কী দেড়শো খদ্দের গিয়েছে। এত ওষুধ বিক্রি গত ক-মাসের মধ্যে হয়নি। একে তো এই ডাল সিজন যাচ্ছে, আমি তো অবাক! সবাই বলে লালদিঘির মোড়ে আপনাদের পাবলিসিটি অফিসার, তাঁরই মুখে শুনে…আমি বলি আজ নিজে গিয়ে ব্যাপারটা কী দেখি তো নিজের চোখে! তা আমি খুব সন্তুষ্ট হয়েচি, আপনার এরকম কাজে–

কৃষ্ণলাল বিনীতভাবে বলিল, আজ্ঞে, ভাবলাম ছোকরা ক্যানভাসারদের মতো থিয়েটারি রামের গলা কোথায় পাব—তবুও একবার দেখি দিকি—

বসু মহাশয় বলিলেন, শুনুন, ওসব থাক, আপনি আজই অফিসে আসুন এক্ষুনি।

আপনাকে আজ থেকে হেড ক্যানভাসার অ্যাপয়েন্ট করলাম। ষাট টাকা মাইনে পাবেন আর কমিশন, শুধু তদারক করে বেড়াবেন কে কেমন কাজ করছে, আর ছোকরাদের একটু তালিম দিয়ে দেবেন, বুঝলেন না? আসুন চলে আমার গাড়িতে–

সন্ধ্যাবেলা।…নবীন কুণ্ডুর লেনে খোলর ঘরের সংকীর্ণ রোয়াকে গোলাপী ক্যানেস্ত্রারাকাটা তোলা উনুনে আঁচ দিয়া প্রাণপণে পাখার বাতাস করিতেছে, এমন সময় বাহিরে কে পরিচিত গলায় ডাকিল—গোলাপী, ও গোলাপী, বাইরে এসে জিনিসগুলো ধরো দিকি! হাত ধরে গিয়েছে—


© 2024 পুরনো বই