বাটি-চচ্চড়ি

বাটি-চচ্চড়ি

সংসারটা এমন কিছু বড়ো নয়। মাত্র দুটো মেয়েমানুষ এবং একজন পুরুষের সমবায়ে গঠিত। ডাক্তার, ডাক্তারের বউ এবং তাদের এক বিধবা পিসিমা, আবার এই পিসিমা ডক্তারের চেয়ে বছর দশেকের ছোটো। সরকারি হাসপাতালের পুরোনো ডাক্তার। চক্রধরপুরে বদলি হয়েছে সম্প্রতি। ছোট্ট সংসার—আরও ছোট্ট একখানা বাড়িতে অবস্থিত—বেশ ভালোভাবেই চলছিল সুখে, শান্তিতে, হাসিতে ও আনন্দে–উদয়াস্ত সুমহান কাল কেটে যাচ্ছিল মোহন ছন্দে।

এ হেন সময়ে ডাক্তার একখানা চিঠি পেল এই মর্মে, কলকাতা থেকে নাকি তার বাপের ছোটো কাকার বড়ো ছেলের রুগণ বধূ আসছে তার শরীরের ক্ষতিপূরণ করতে এই পাহাড়ের দেশে। অলকার স্বামীই ডাক্তারের চেয়ে অনেক ছোটো।

প্রস্তাবনাটা পিসিমার কাছে উত্থাপিত হলে তো সে প্রতিবাদ করলে, “বেশ, আসুক ছোটো বউদি। আমি কলকাতায় যাব—এখানে থাকতে পারব না।”

ডাক্তার প্রতিবাদ করলে, ‘‘তাহলে এখানে দিন চলবে কী করে?”

“সে আমি কী জানি ভাইপো!” পিসিমা ওই বলেই ডাক্তারকে সম্বোধন করে।

“কিন্তু বউমা আসছেন রোগা মানুষ। তাঁকে দিয়ে তো আর সংসারের কাজ করানো যাবে না। আর তোমাদের বউ তখন হয়ে পড়বে একা—ছেলেপিলে নিয়ে আর ক-দিক সামলাবে বলো, তা ছাড়া কলকাতায় তো দেখছি মানুষের অভাব তেমন নেই।”

সুতরাং পিসিমাকে থেকে যেতে হল। অলকার সঙ্গে তার আজ প্রায় পাঁচ বছরের বিবাদ। সেই বিবাদের ঝাঁঝেই সে প্রতিবাদ করেছিল। তবে সে প্রতিবাদ টিকল না কিছুতেই ডাক্তারের প্রবল যুক্তির কাছে।

ওদিকে অলকা এল যথাসময়ে। দীর্ঘদিন ম্যালেরিয়ায় ভুগে ভুগে তার দেহের সক্রিয় কলকবজাগুলি অচলপ্রায় হয়ে গেছে। শরীরের সে কান্তি বা শোভা নেই। মুখশ্রী হয়েছে কালিমালিপ্ত। গায়ের হাড়গুলো এমনভাবে বার হয়ে পড়েছে যে, তাদের এক-একখানা করে গোনা যায় অক্লেশে।

আসার পরের দিন তো ডাক্তার পরীক্ষা করলে। দেখলে জীবনের আশা বড়ো কম। নিজের মৃত্যুর জন্যে সে নিজে দায়ী। কারণ সে মৃত্যু ডেকে এনেছে অযথা নিজের নির্বুদ্ধিতার ফলে এবং  চিকিৎসার অভাবে। এমনকী এ কথা বললে হয়তো অত্যুক্তি হবে না যে, সে ক্ষয়ে ক্ষয়ে নিঃশেষের পানে এগিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ নিছক ভাইটামিনের অভাবে বা খাদ্যপ্রাণের অকিঞ্চিৎকরতায়। স্বামীর দীর্ঘ দিনের বেকার অবস্থা রোগের আর একটি কারণ বলা যেতে পারে।

যা হোক, বউমার  চিকিৎসা এবার চলতে লাগল যথাসাধ্য। কিন্তু সে চিকিৎসার কোনো সুফল ফলল না মাসখানেকের মধ্যেও। ডাক্তার হতাশ হয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসল। তবু অলকার রোগ কমল না; পরন্তু বৃদ্ধি পেতে লাগল একটু একটু করে দিন দিন, সকল চেষ্টাকে ব্যর্থ প্রতিপন্ন করে।

অলকার নুন খাওয়া নিষেধ। কোনো এক রাজার মেয়ে নাকি তার বাপকে নুনের মতো ভালোবাসত। সুতরাং নুনের প্রয়োজনীয়তা কিংবা গুণ সামান্য নয়। তাই অলকা সচরাচর নুনহীন তরকারি খেত না। ডাক্তারের বউ আবার লোককে খাওয়াতে নাকি বড়ো ভালোবাসত। সুতরাং অলকার খাওয়ার কষ্ট দেখে তার করুণ মন ক্লিষ্ট হত অত্যন্ত। অনেক বলে-কয়ে সে স্বামীর কাছ থেকে বউমার সামান্য একটু বাটি-চচ্চড়ি খাবার অনুমতি পেয়েছিল এবং প্রতিদিন তার জন্যে একটা বাটি-চচ্চড়ি করে দিত সযত্নে।

আমার আশেপাশের সেরা রেস্টুরেন্ট

সেদিন অনেকগুলো বিছানা পরিষ্কার করে উঠতেই ডাক্তারের বউয়ের বেশ বেলা হয়ে গেল। পিসিমা তাড়াতাড়ি স্নান করে এসে রান্না করতে বসল। আর বউমা?—বাতায়নপাশে বসে দূর আকাশের পানে তাকিয়ে দেখতে লাগল অপরূপ মেঘের খেলা। দূরে অতিকায় ধূমের মতো দাঁড়িয়ে আছে আকাশচুম্বী পর্বত। তার নীচে ইতস্তত বৃক্ষলতাশোভিত কালো বর্ণের ছোটো ছোটো পাহাড়। তাদের গায়ে লাল কাঁকরের বঙ্কিম পথরেখা—মনে হয় যেন কোনো অচিন দেশে চলে গেছে পাহাড়ের বুক বয়ে। বউমা অন্যমনস্ক হয়ে ভাবছিল, এমন সময় ডাক্তারের বউ ভিজেচুল মুছতে মুছতে এসে বললে, “বউমা, আজ কী দিয়ে দুধ সাবু খাবে?”

“যা হোক দিয়ে খাব অখন মা।”

“কেন বাটি করতে দিলে না?”

“থাকগে, কুটনো তো সব কোটা হয়ে গেছে!”

“তা হোক, তুমি একটা বাটি করতে দাও মা।” কথা শেষ করে ডাক্তারের বউ গৃহত্যাগ করে আর বউমা উঠে যায় বাটি-চচ্চড়ির কুটনো কুটতে।

পিসিমা কড়ার ওপর মাছ দিয়ে একবার বটির পানে তাকিয়ে নিল, তারপর বললে, “বলি হ্যাঁগা বউদি, আমার গতরে কী এমন পোকা পড়েছে!”

বউমা সবিস্ময়ে কয়, “কেন ঠাকুরঝি?”

মুখরা পিসিমা তখন ফেটে পড়লেন, “আমি কী বাটির কুটনো কুটতে পারি না,–কুটলে হাতে পক্ষাঘাত হত! তেজ করে আমায় একবার বলা হল না। রোগ তো বারো মাস লেগেই আছে, তার আবার অত দেমাক কীসের?”

রুগণ বধূটির শুষ্ক নয়নদ্বয় বিদীর্ণ করে ঝরে পড়ে অঝোরে মুক্তার মতো অশ্রুকণা নিদারুণ ঘৃণায় ও বেদনায়, ননদের এই বাক্যবাণের সুতীব্র আঘাতে। স্বামীর অর্থহীনতা এবং নিজের রোগের চিন্তায় তার সারা কোমল অন্তরাত্মা সহসা রি-রি করে ওঠে। আর পিসিমার মুখে তখন যেন তুবড়ি তে আগুন লেগেছে। সমস্ত বারুদ না-নিঃশেষিত হলে সে নীরব হবে না। বউমা আস্তে আস্তে বাটিটা নিয়ে আসে সকলের অজ্ঞাতসারে।

ঘণ্টাদুয়েক পর পিসিমার বারুদ ফুরিয়ে যেতে ডাক্তারের বউ এসে বললে, “বউমা, বাটি আমায় দাও মা, আমি করে দিচ্ছি। ছিঃ ছিঃ মানুষকে মানুষ অমন করে বলে?”

বিশ বছরের রোগশীর্ণ বধূটি আজ সারাহৃদয় মথিত করে কেঁদে ফেলল বিপুল বেদনায়। শ্বশুর-শাশুড়িকে অকালে হারিয়ে সে আর বিধবা ননদের গঞ্জনা সহ্য করতে পারছে না। ডাক্তারের বউ আঁচল দিয়ে তার চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বললে, “কেঁদো না মা, বাটিটা আমায় দাও।’

“না, থাক মা। বাটি আমি আর জীবনে খাব না।”

“ছিঃ সে কী হয় মা!”

“খুব হয়।”

ডাক্তারের বউয়ের বহু অনুনয়-বিনয় সত্বেও বউমা বাটি বার করে দিলে না। ডাক্তারের বউ বেলা একটা পর্যন্ত বাটির খোঁজে সমস্ত কিছু তন্ন তন্ন করে দেখল, কিন্তু কোথাও সে  বাটি পাওয়া গেল না, আর পাওয়া গেল না সেই কোটা তরকারিগুলো।

সেদিন রাতে ডাক্তার গিয়েছে রিহার্সাল দিতে। এবার পূজায় নাকি ভারি ধুম করে থিয়েটার হবে। ডাক্তারের বউ মুখের মধ্যে অনেকগুলো এলাচ পুরে ছারপোকা মারতে বিছানা পাতিপাতি করে খোঁজে—এ তার নিত্যকার অভ্যাস। রাতে সে বড়ো একটা ঘুমোয় না। এমন সময় পাশের ঘরে বউমা উত্ত্যক্ত হয়ে বললে, “ভালো জ্বালা, দরজাটা যে কিছুতেই খুলছে না মা!”

ডাক্তারের বউ আলো নিয়ে এগিয়ে এল, “কী হয়েছে বউমা?”

“দরজা তো খোলা বউমা!”

“তবে খিল কোথায় গেল?”

ডাক্তারের বউ জানে যে, তার জ্যাঠাইমা মৃত্যুর পূর্বে ওইরকম দিকভ্রান্ত হয়ে গেছিল। বউমার এই রহস্যজনক আচরণে সে রীতিমতো ভয় পেয়ে গেল। আস্তে আস্তে নিজে এসে দরজাটা খুলে দিলে।

সামান্য পরে বউমা বাইরে থেকে ফিরে এসে আবার নিজের বিছানায় শোয় এবং ডাক্তারের বউ মশা তাড়িয়ে পুনরায় মশারিটা গদির তলায় গুঁজে দেয়। তারপর কখন ঘুমিয়ে পড়ে জানে না। ডাক্তারের ডাকে ধড়মড় করে উঠে দরজা খুলে দিল।

ডাক্তার বললে, “যেন মোষ একেবারে! ঘুমে অচেতন!”

“থাক, খুব হয়েছে!”

“আধঘণ্টা ধরে একজন ভদ্রলোক ডাকছে।”

“সকালে অতগুলো কাঁথা তোশক কাচলে ওভদ্রলোকেরও এই দশা হত নিশ্চয়।”

ডাক্তার শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। কতক্ষণ যে ঘুমঘোরে কেটেছিল দুজনের তা হয়তো তারা জানে না। ডাক্তারের বউ সহসা সচেতন হল স্বামীর আহ্বানে, “ওগো, দেখো তো ও ঘরে বউমা কী যেন বলছেন।”

ডাক্তারের বউ শুনলে বউমা পাশের ঘরে বলছে, “দূর ছাই, কিছুতেই তো আলো জ্বলছে না!”

রুগণকণ্ঠে ক্ষীণস্বরে নিশীথের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে অট্টহাসি হেসে ওঠে যেন কীসের ব্যাকুল প্রচেষ্টায়। ডাক্তারের বউ গৃহে প্রবেশ করে দেখে সে এক অদ্ভুত ব্যাপার। বউমা মশারির মধ্যে হ্যারিকেনের ল্যাম্প নিয়ে গিয়ে অনবরত ফস ফস করে দেশলাইয়ের কাঠি জ্বেলে যাচ্ছে আর সেই প্রজ্বলিত কাঠি চিমনিতে ঠুকে ঠুকে নিবিয়ে ফেলছে প্রতিবার। এমনি করে জ্বালাতন হচ্ছে ব্যর্থতার বেদনায়। ডাক্তারের বউ স্তম্ভিত হয়ে স্থাণুর মতো স্থির হয়ে থাকল এক মুহূর্ত, তারপর বললে, “বউমা, ও কী করছ মা?”

বউ মৃদু ক্রন্দনের সুরে বললে, “দেখো দিকিন মা, আলোটা কিছুতেই জ্বলছে না!”

বউমার জ্ঞান সহসা ফিরে আসে। কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মতো তাকিয়ে থাকে ডাক্তারের বউ-এর পানে। ডাক্তারও এগিয়ে আসে—তারপর ত্বরিতে বউমাকে পরীক্ষা করে বলে, “শিগগির আগুন করে ওঁর হাত-পা সেঁক করো।”

এতক্ষণে পিসিমার ঘুম ভাঙে। সে আলস্য ত্যাগ করে পিট পিট করে তাকিয়ে থাকে। ডাক্তার এসে তাড়াতাড়ি বউমাকে একটা ইনজেকশন করে দিলে, তারপর বাইরে গিয়ে বললে, “না, এত করেও বউমাকে বাঁচাতে পারলুম না!’’

নয়নকোণ থেকে ঝরে পড়ে বিন্দু বিন্দু অশ্রুকণা। ডাক্তারের বউ-এরও চক্ষু হয় বাদল দিনের সজল আকাশের ন্যায়।

মুহূর্তে সব কিছু এলোমেলো হয়ে যায়। কলকাতায় টেলিগ্রাম করা হয় বউমার স্বামীর কাছে। তবুও যদি একবার শেষ দেখা করতে পারে পারের ঘাটে।

ডাক্তার যথাসাধ্য চেষ্টা করলে। স্বামী এল দুরান্তর থেকে আর এল তার মেজদি, গলার বোতাম বাঁধা দিয়ে একেবারে শেষক্ষণে। তবুও বউমা বাঁচল না। ডাক্তার কাঁদল আর কাঁদল তার বউ, মৃতার স্বামী ও মেজো ননদ। শুধু কাঁদেনি তার বিধবা ছোটো ননদ; কারণ মৃতার সঙ্গে তার কথা বন্ধ প্রায় পাঁচ-ছয় বৎসর যাবৎ। আর সেই কারণেই সারারাত দিকভ্রান্ত একজনকে মশারির মধ্যে দেশলাই জ্বালাতে দেখেও নিবারণ করতে পারেনি কিছুতেই।

এই ঘটনার দিনসাতেক পর ডাক্তারের বউ কোনো এক মধ্যাহ্নে ভাঁড়ারঘর গোছাতে গোছাতে একটা খালি হাঁড়ির মধ্যে পেল সেই বাটিটা আর তার মধ্যেকার কতকগুলো শুকনো তরকারি। পুরোনো ক্ষতে আবার যেন নতুন করে আঘাত লাগল, একটা ব্যথিত দীর্ঘনিঃশ্বাস বুকের মধ্যেই চেপে ধরল। মর্মন্তুদ বিচ্ছেদবেদনা লাঘব করলে না সশব্দ শোকার্ত বাক্য–বিন্যাসে, কেবল সজল নয়নে তাকিয়ে রইল সেই  বাটির পানে আর শুকনো তরকারিগুলোর পানে।


© 2024 পুরনো বই