যাত্রাবদল
ভাটপাড়াতে পিসিমার বাড়ি গিয়েছিলুম বড়োদিনের ছুটিতে। সারাদিন বাড়িতে বসে থেকে ভালো লাগল না। বিকেলের দিকে নৈহাটি স্টেশনে বেড়াতে গেলুম। তখন দেশেই থাকি, বিদেশে বেরুনো অভ্যেস নেই, এত বড়ো স্টেশন ঘনিষ্টভাবে দেখবার সুযোগ বড়ো একটা হয়নি। ডাউন প্ল্যাটফর্মের ওধারে প্রকাণ্ড ইয়ার্ডটা মালের ওয়াগনে ভরতি, ওভারব্রিজের ওপর দিয়ে যাত্রীরা পোঁটলাপুঁটলি নিয়ে যাতায়াত করছে, নানাধরনের লোকের ভিড়, নানারকমের শব্দ—দুখানা পাইলট এঞ্জিন ইয়ার্ডের মধ্যে ওয়াগনের সারি টানাটানিতে ব্যস্ত…ওপারের গাড়ি একখানা ছেড়ে গেল, আর একখানা এখুনি আসবে…বাজারের দিকে সাইডিং লাইনে দু খানা কেরোসিন তেলের ট্যাঙ্ক বসানো গাড়ি থেকে তেল নামাচ্চে।…এত মাছি প্ল্যাটফর্মে, কোথাও স্থির হয়ে দাঁড়াবার জো নেই, বসবার জো নেই, যেখানে যাই সেখানেই মাছি ভন ভন করে; চা খাওয়ার ইচ্ছে ছিল কিন্তু স্টলের অবস্থা দেখে সেখানে বসে কিছু খেতে প্রবৃত্তি হল না। প্ল্যাটফর্মের ওধারে একটা ছোটো ঘর, দোর বন্ধ, ঘরটার আশেপাশে পুরোনো স্লিপার ও ফিশ-প্লেট পড়ে আছে রাশীকৃত, একটি ক্ষুদ্র কুলিপরিবার সেখানে তেরপলের তাঁবু খাটিয়ে তোলা-উনুনে আঁচ দিয়েছে।
হঠাৎ প্ল্যাটফর্মের সবাই একটু সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল। সবাই যেন প্ল্যাটফর্মের ধারে ঝুঁকে কলকাতার দিকে চেয়ে কী দেখবার চেষ্টা করতে লাগল—একজন হিন্দুস্থানী যাত্রী প্ল্যাটফর্মের নিতান্ত ধারে দাঁড়িয়ে চোখ মুছতে ব্যস্ত—ওপার থেকে একজন কুলি তাকে হেঁকে বললে—এ আঁখ পুছনেওয়ালা, হঠ যাইয়ে, ডাকগাড়ি আতা হ্যায়—
কাছের একটি ভদ্রলোক যাত্রীকে জিজ্ঞেস করলুম—কোন ডাকগাড়ি মশাই?
তিনি বলেন, দার্জিলিং মেলের সময় হয়েছে—
একটু পরেই ধুলো-কুটো উড়িয়ে একটা ছোটোখাটো ঘূর্ণিঝড়ের সৃষ্টি করে স্টেশন কাঁপিয়ে দার্জিলিং মেল বেরিয়ে গেল এবং সে শব্দ থামতে-না-থামতে ডাউন প্ল্যাটফর্মে একখানা প্যাসেঞ্জার ট্রেন সশব্দে এসে দাঁড়াল।
একটু পরে দেখি যে প্ল্যাটফর্মে একটা গোলযোগ উঠেছে। অনেক লোক ওভারব্রিজের ওপর দিয়ে ডাউন প্ল্যাটফর্মের দিকে ছুটে যাচ্ছে—সবাই যেন কী বলচে-ট্রেনটা ছাড়তেও খানিকটা দেরি হল। তারপরে ট্রেনখানা ছেড়ে গেলে দেখলাম প্ল্যাটফর্মের এক জায়গায় অনেক লোকের ভিড়, গোল হয়ে ঘিরে দাঁড়িয়ে। সবাই কী যেন দেখছে।
ভিড় ঠেলে ঢুকতে না-পেরে একজনকে জিজ্ঞেস করতে সে যা বললে তার মর্ম এই যে মুর্শিদাবাদের ওদিক থেকে একটি ভদ্রলোক সপরিবারে এইখানে গাড়ি বদলাবার জন্যে নেমেছিলেন পশ্চিমের লাইনে যাবার জন্যে, তাঁর স্ত্রী প্ল্যাটফর্মে নেমেই হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যান, সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে অজ্ঞান নয়, তিনি মারাই গেছেন।
লোকের ভিড় পুলিশ এসে সরিয়ে দিল। তারপর একটা অতিকরুণ দৃশ্য চোখে পড়ল। গোটাদুই স্টিলের তোরঙ্গ, একটা ঝুড়ি, গোটাচারেক ছোটো-বড়ো পুঁটুলি— একটা মানকচু ও এক নাগরি খেজুরের গুড় এদিক-ওদিকে আগোছালো ভাবে ছড়ানো—গৃহস্থালীর এই দ্রব্যাদির মধ্যে একটি পাড়াগাঁয়ের বউয়ের মৃতদেহ, রং ফর্সা, বয়স কুড়ি-বাইশের বেশি নয়। বউটির মাথার কাছে একটি মধ্যবয়সি ভদ্রলোক, গায়ে কালো বুকখোলা কোট—কাঁধে একখানা জমকালোপাড় ও কল্কাদার সস্তা আলোয়ান, পায়ে ডার্বি জুতো, পাড়াগাঁয়ের অর্ধশিক্ষিত ভদ্রলোকের পোশাক। তাঁর কোলে একটি বছর আড়াই বয়সের ছোটো ছেলে—মায়ের মতো ফর্সা, চুলগুলি কোঁকড়া কোঁকড়া, হাতে কী একটা নাড়াচাড়া করচে ও এক একবার বিস্ময়ের দৃষ্টিতে সমাগত লোকের ভিড়ের দিকে চাইচে। মায়ের মৃতদেহের চেয়েও তার কাছে বেশি কৌতূহলের বিষয় হয়েছে চারিধারে এই গোলমাল ও অদৃষ্টপূর্ব লোকের ভিড়।
একটু পরে সাহেব স্টেশনমাস্টার ও তাঁর সঙ্গে একজন ভদ্রলোক এলেন। বুঝতে দেরি হল না যে ভদ্রলোকটি ডাক্তার, তিনি বউটির নাড়ি দেখলেন, চোখ দেখলেন, স্টেশনমাস্টারের সঙ্গে কী কথা হল তাঁর, স্বামীটির সঙ্গেও কী যেন বললেন, তারপর তাঁরা চলে গেলেন।
মৃত্যুই তা হলে ঠিক!…
কৌতূহলী জনতা আরও খানিকক্ষণ তাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে রইল—মৃত পল্লি বধূ, তার শোকস্তবু স্বামী, অবোধ ক্ষুদ্র পুত্র ও তাদের ঘর-গৃহস্থালীর সাধের দ্রব্যাদি। তারপর একে একে যে যার কাজে চলে গেল—আরও নতুন দল এল— তারাও খানিকটা থেকে নিজেদের মধ্যে কী বলাবলি করতে করতে ফিরে গেল। এবার এল রেলওয়ে পুলিশের লোক, তারা খানিকক্ষণ ধরে ভদ্রলোকটিকে কী সব প্রশ্ন করলে, নোটবুকে কী টুকে নিলে—তারপর তারাও চলে গেল—কেবল একজন কনস্টেবল একটু দূরে দাঁড়িয়ে রইল।
এ সবে কাটল প্রায় এক ঘণ্টা। তখন সন্ধে প্রায় হয়-হয়। স্টেশনের আলো জ্বালিয়েচে, আপডাউন দু-দিকের সিগন্যালে লাল সবুজ বাতির সারি জ্বলেচে; কিন্তু তখনও অন্ধকার হয়নি, সিগন্যালের পাখা তখনও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল, আপ লাইনের হোম স্টার্টার নামানো—বোধ হয় কোনো ট্রেন আসছে।
যা হবার তা তো হয়ে গিয়েছে, এখন সৎকারের ব্যবস্থা। এ ধরনের প্রশ্ন কেউ ভদ্রলোকটিকে করলে না—তিনিও কাউকে করলেন না। এদিকে ভিড় ক্রমেই পাতলা হয়ে এল—অনেকেই আপ ট্রেনের যাত্রী কলকাতার দিকে দু-খানা সিগন্যাল নামানো দেখে তারা ওভারব্রিজ দিয়ে উঠি-পড়ি অবস্থায় ছুটল আপ প্ল্যাটফর্মের দিকে। এটা যে গ্রু ট্রেন আসছে, তা ভেবে তখন কে দেখে? ভিড়ের মধ্যে বেশিরভাগ ছিল হিন্দুস্থানী কুলি-খালাসির দল, তারা খৈনি টিপতে টিপতে নিজেদের কাজে চলে গেল।
আমি একটু দুরে দাঁড়িয়েছিলুম-ভদ্রলোক আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকলেন। কাছে যেতেই আকুলভাবে বললেন—মশাই আপনি তো দেখছেন, একটা ব্যবস্থা করুন দয়া করে। এখন কী করি আমার মাথামুণ্ডু, এই অচেনা দেশ, তাতে শীতের রাত। আমরা ব্রাহ্মণ, ব্রাহ্মণের দেহ শেষে কী অন্য জাতে ছোঁবে?…এই একটা বাচ্চা, এরই বা উপায় কী করি?
মুখে অবশ্যি তাকে সাহস দিলুম। কিন্তু তারপর আধ ঘণ্টা এদিক-ওদিক ঘুরেও সৎকারের কোনো ব্যবস্থাই আমায় দিয়ে হয়ে উঠল না। না আমাকে এখানে কেউ চেনে, না আমি কাউকে চিনি—অধিকাংশ লোকই বলে তারা যাত্রী, এই ট্রেনেই তাদের অমুক জায়গায় যেতে হবে। কেউ কথা শোনে না। আকস্মিক ব্যাপারের
উত্তেজনাটুকু কেটে যাবার পর সবাই বুঝেচে বেশি ঘনিষ্ঠতা করতে গেলে এই শীতের রাত্রে দুর্ভোগ আছে কপালে—কাজেই সবাই আমায় এড়িয়ে চলতে চায়। অবশেষে একজন টিকিট কালেক্টরকে কথাটা বললুম। অনেক সাধ্য-সাধনার পরে তাঁকে রাজি করানো গেল। তিনি বললেন, কিন্তু শুধু আমি আর আপনি এতে তো হবে না? আপনি দাঁড়ান—আমি দেখে আসি।
একটু পরে একজন অতি কদর্য চেহারার ময়লা কাপড় পরা লোককে সঙ্গে করে তিনি ফিরে এলেন। আমায় বললেন—শুনুন মশাই, লোক যেতে চায় না কেউ শীতের রাতে। এই লোকটি ভালো বামুন, আমাদের ইস্টিশানে পাঁউরুটির ভেন্ডার, এ যেতে রাজি হয়েছে, এ আরও দুজন লোক আনতে রাজি আছে। কিন্তু–
টিকিটবাবু সুর নীচু করে বল্লেন—জানেন তো ছোটোলোক—ওদের কিছু খাওয়াতে হবে, নইলে রাজি হবে না। একটু ইয়ে—মানে—বুঝলেন তো? ওরা নেশাখোর লোক, লেখাপড়া জানে না—সবই বুঝতে পারচেন। তার একটা ব্যবস্থা করতে হয়–
আমি বললুম—সে কীরকম খরচ পড়বে-না-পড়বে আমায় বলুন, আমি গিয়ে বলচি। ঘাট খরচের হিসাবটাও ধরবেন। টিকিটবাবু টাকা-পনেরোর এক ফর্দ দাখিল করলেন। আমি ফিরে গিয়ে বলতেই ভদ্রলোক মানিব্যাগ খুলে দু-খানা দশ টাকার নোট আমার হাতে দিয়ে বললেন—এই নিন—যা ব্যবস্থা করবার করুন, আমায় এ দায় থেকে উদ্ধার করুন, বাঁচান আপনি—কথা শেষ না-করেই আমার হাত দুটো জড়িয়ে ধরতে এলেন—আর আমার এই খোকার একটা কিছু…ওকে তো এই ঠান্ডায় সেখানে নিয়ে যেতে পারিনে, তাহলে ও কী বাঁচবে?…
আমি ফিরে এসে খোকার কথা তুলতেই তিনি বললেন—আমার তো ফ্যামিলি এখানে নেই, তাহলে আর কী কথা ছিল? আচ্ছা দাঁড়ান, দেখি ছোটোবাবুর বাসায়
ছোটোবাবুর বাসায় খোকার ব্যবস্থা হয়ে গেল। ভদ্রলোকের কাছে গিয়ে বললুম দিন ওকে আমার কাছে। ছোটোবাবুর বাসায় তাঁরা রাখবেন বলেছেন।
ভদ্রলোক বললেন—যাও খোকন বাবা, বাবুর কাছে যাও। তোমার মাসিমার বাড়ি নিয়ে যাবেন, যাও বাবা–
তাঁর চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল পড়তে লাগল। আমায় বললেন অনেকক্ষণ কিছু খায়নি, রানাঘাটে ওর মা গজা কিনে দিয়েছিল—একটু গরম দুধ যদি—
খোকা বেশ সপ্রতিভ। বেশ শান্তভাবেই আমার কাছে এল, হাসি-হাসি মুখে। তাকে কোলে নিয়ে মনে হল খোকার যত বয়স ভেবেছিলুম তার চেয়ে ছোটো এখনও তেমন কথা বলতে পারে না। ছোটোবাবুর বাসায় ঝি তাকে কোলে করে বাড়ির ভিতর নিয়ে গেল। ওকে কোলে তুলে নিয়ে কঁদো-কাঁদো সুরে বললে— আহা, এ যে একেবারে দুধের বাছা! এসো এসো সোনামণি আহা! মাণিক আমার–
খোকা ব্যাপারটা কিছুই বুঝতে পারেনি, বরং এত লোক তাকে কোলে নিয়ে নাচানাচি করাতে সে খুব খুশি।
একটু পরে আমরা কজনে মৃতদেহ বহন করে শ্মশানের দিকে রওনা হলুম। আমি, পাউরুটির ভেন্ডার, টিকিটবাবু ও পাউরুটির ভেন্ডারের একজন বন্ধু। টিকিটবাবুর এক ভাইপো আমাদের সম্মিলিত গরম কোট ও আলোয়ানের পুঁটুলি হাতে ঝুলিয়ে পিছনে পিছনে আসছিল। সকলের পিছনে ভদ্রলোকটি; তাঁকে আমরা অবশ্য শব বহন করতে দিইনি। ভদ্রলোকের জিনিসপত্র মৃতদেহের সঙ্গে ছোঁয়াছুঁয়ি হয়েছে, কারুর বাসায় জায়গা দেবে না, সেগুলি স্টেশনে ক্লোকরুমে জমা দেওয়া হল। নৈহাটির বাজার যেখানে প্রায় শেষ হয়েছে, সেখানটায় এসে ভদ্রলোক বললেন—একটা ভুল হয়ে গিয়েছে, দাঁড়ান আমি সিঁদুর কিনে আনি, ওর কপালে দিয়ে দিতে হবে।
শ্মশানঘাট নৈহাটি স্টেশন থেকে প্রায় তিন পোয়া পথ দূরে। বাজার ছাড়িয়ে দক্ষিণে মাঠের মাঝখান দিয়ে পথ, সুমুখে জ্যোৎস্নারাত, সন্ধ্যার পরে মেঘশূন্য আকাশে ফুটফুটে চাঁদের আলো ফুটেচে, কনকনে হাড়কাঁপানো শীত, মাঝে মাঝে পৌঁষ রাত্রির ঠান্ডা হাওয়া বাধাশূন্য প্রান্তরে আমাদের শিরার-উপশিরার রক্ত জমিয়ে দিচ্ছে, তার ওপরে মুশকিল—আমন ধানের জমির ওপর দিয়ে পথ—ধান কাটা হয়ে গিয়েছে, শীতের ঘায়ে ধানের গোড়াগুলো পায়ে যেন কুশাঙ্কুরের মতো বিঁধছিল।
হঠাৎ পিছন থেকে ভদ্রলোক মেয়েমানুষের মতো আকুল সুরে কেঁদে উঠলেন। আমরা অবাক হয়ে ফিরে চাইলুম। টিকিটবাবু বল্লেন—ওকি মশাই ওকি, অত ইয়ে হলে চলবে কেন—ছিঃ—আসুন এগিয়ে আসুন।
পুরুষমানুষকে অমন অসহায়ভাবে কখনো কাঁদতে শুনিনি, তখন বয়স ছিল অল্প, লোকটির কান্না শুনে যেন আমার চোখও অশ্রুসজল হয়ে উঠল। তারপর তিনি চুপ করলেন, আমরা সবাই আবার চুপচাপ চলতে লাগলুম।
শ্মশানে যখন পৌঁছানো গেল, রাত তখন সাড়ে সাতটা হবে। মৃতদেহ চিতায় উঠানো হল। সেই সময় সর্বপ্রথম লক্ষ করলুম বধূটির দু-পায়ে আলতা—কোথাও বেরুতে হলে গ্রামের মেয়েরা পায়ে আলতা পরে থাকে জানতাম, মনটা কেমন খারাপ হয়ে গেল, মেয়েটি কী ভেবেছিল আজ কোন যাত্রার জন্যে তাকে দুপুরে আলতা পরতে হয়েছিল? কপালে খানিকটা সিঁদুর-ভদ্রলোকটি নিজেই দিয়েছিলেন—বধূটিকে সর্বপ্রথম এই ভালো করে দেখে মনে হল সত্যই সুন্দরী। টানা টানা জোড়া ভুরু, পাণ্ডুর বর্ণের গৌর মুখ, অনিন্দ্য দেহকান্তি। মৃত্যুতেও যেন ম্লান হয়নি, মুখের চেহারা দেখে মনে হয় যেন ঘুমিয়ে পড়েছে। মনে হচ্ছে গোলমালে এখুনি ঘুম ভেঙে পড়বে বুঝি।
জ্বলন্ত চিতার একটু দূরে সেই পাউরুটি ভেন্ডার ও তার বন্ধু। পাউরুটি ভেণ্ডার আমার দিকে চেয়ে দাঁত বার করে হেসে বললে—যাক, আজ শীতের রাতটা কাটবে ভালো—কী বলেন? লালু চক্কোত্তির পরোটার দোকানে পরোটা ভাজতে দিয়ে এসেছি। আমাদের শশী আচার্যিকে বসিয়ে রেখে এসেছি, রাত বারোটার মধ্যে
এখানকার কাজ শেষ হয়ে যাবে—গরম গরম বেশ তার বন্ধু বললে—মাংস কতটা? কুলোবে তো?
—বাঃ, জোনাজাৎ দেড়পোয়া হিসেব করে দিয়ে এসেচি—মোট তিন সের— কজন আছি আমরা, তুমি, আমি, যতীনবাবু, যতীনবাবুর ভাইপো লালু, শশী আচার্যি, (আমার দিকে আঙুল দিয়ে) এই বাবু—
আমি বললুম—আমি খাব না।
দুজনেই আশ্চর্য হয়ে আমার দিকে চাইল। আমার কথা যেন বুঝতেই পারলে লো কিংবা বুঝে বিশ্বাস করতে পারলে না। পাউরুটি ভেন্ডার বললে—খাবেন না কিছু? সে কী মশাই! এই হাড় কনকনে পৌঁষ মাসের রাত, খাবেন না তো এলেন কেন?…পাগল!…তার বন্ধু বললে—খাবেন না কেন? ভালো জিনিস মশাই, আমরা নিজে দাঁড়িয়ে থেকে কিনিয়েচি—খাসা চর্বিওয়ালা খাসি। লালু চক্রবর্তি নিজে রাঁধবে, অমন মাংস-রাঁধিয়ে গঙ্গার এপারে পাবেন না। ওই যে দেখচেন নৈহাটির বাজারের চাটের দোকানখানা—শুধু ওর রান্নার গুণে আজ পনেরো বছর একভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে—দেখবেন খেয়ে
এই সময় টিকিটবাবুর ইশারায় দুজনেই অন্যদিকে একটু দূরে কী জন্যে উঠে গেল এবং একটু পরেই আবার নিজেদের জায়গাটিতে মুখ মুছতে মুছতে এসে বসল। আমায় বললে—আপনার চলে না বুঝি?
আমি বললুম—কী?
—একটু-আধটু…এই শীতের রাতে, নইলে চলে কী করে বলুন,…বেশ ভালো মাল। কেন এদের টিকিটবাবু ডেকেচে ওদিকে, তখন ব্যাপারটা বুঝলুম। ও আমার চলে না শুনে তারা আরও আশ্চর্য হয়ে গেল। এই শীতের রাতে শ্মশানে আসবার স্বার্থটা যে আমার কী, এ তারা ভেবেই পেলে না। আমার দিকে আর কোনো মনোযোগ না-দিয়ে তারা নিজেদের বিষয় কথাবার্তা বলতে লাগল। নৈহাটি স্টেশনে পাউরুটির ব্যাবসা করে আর কেউ কিছু করতে পারবে না। রেল কোম্পানির লাইসেন্সের দাম ক্রমেই বাড়ছে, তার ওপরে শিখেরা এসে চায়ের স্টল খুলে ওদের অর্ধেক ব্যাবসা মাটি করেচে। খরচা ওঠাই দায়! দেশে সুবিধে নেই তাই ওরা পেটভাতায় এখানে পড়ে আছে। নইলে কাঁথিতে ওদের অমন চমৎকার দোকান ছিল—
পাউরুটি ভেন্ডারটির নাম বিনোদ বাঁড়য্যে। সে আর একবার উঠে গেল ওদিকে। আমি ওর বন্ধুকে জিজ্ঞেস কললুম—খাবার-টাবার কত খরচ হল?
—তা প্রায় টাকা সাতেক ধরুন। কিছু মিষ্টিও আছে। তা ছাড়া দু-একটা আপনার তো দেখছি ওসব চলে না।
বিনোদ ফিরে এসে নিজেদের মধ্যে আবার গল্প শুরু করলে। হঠাৎ আমার মনে পড়ল আমার গরম কোটের পকেটে বিস্কুট আছে, নৈহাটির প্ল্যাটফর্মে কিনেছিলুম সেই, কিন্তু খাওয়া হয়নি। টিকিটবাবুর ভাইপোকে ডেকে বললুম—আমার কোটের পকেটে বিস্কুট আছে দয়া করে আমার মুখে খানকতক ফেলে দিন না—আমি এই হাত আর ওতে দেব না—
আমায় ওভাবে বিস্কুট খেতে দেখে টিকিটবাবু অবাক হোলেন। আমি শব ছুঁয়ে স্নান না করেই বিস্কুট খাচ্ছি! আমায় বললেন—আপনার খুব খিদে পেয়েছে দেখচি, তা চলুন নৈহাটিতে ফিরে, খুব খাওয়াব
আমি বললুম—আমি খাব না কিছু। তা ছাড়া আমি স্টেশনের দিকেও যাব না —এখান থেকে সোজা ভাটপাড়া চলে যাব।
—খাবেন না আপনি, সে কী মশাই? না না, তা কী হয়?…অতটা মাংস…ওহে বিনোদ, কাঠ দাও ঠেলে—বসে বসে গল্প-গুজব করবার জন্যে তোমাদের আনা হয়নি।
টিকিটবাবু আমার দিকে চেয়ে আবার কী বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু আমি তাঁকে সে সুযোগ না-দিয়েই নিজের জায়গাটিতে গিয়ে বসলুম।
বিনোদ বাঁড়য্যে চিতায় কাঠ ঠেলে দিয়ে ফিরে এসেচে। দুই বন্ধুর মুখের বিরাম নেই। এবার তারা কার বিয়ের কথা আলোচনা করছে—বোধ হল বিনোদ বাঁড়য্যের ভাইয়ের। বিনোদ এক পয়সা সাহায্য করতে পারবে না। ভ্রাতৃদ্বিতীয়াতে বিনোদের বউ ওর কাছে টাকা চেয়েপাঠিয়েছিল, সে দুটো টাকা বাড়িতে মনিঅর্ডার করে দেয়।
—সোজা লিখে দিলাম দু-টাকার বেশি হবে না—এতে ভাইদুতিয়েই করো—
বিনোদের বন্ধুটি বললে—আর বোনদুতিয়েই করো—হি-হি-কী বলো?
বিনোদ দু-পাটি দাঁত বার করে হেসে বলল—হ্যাঁ হ্যাঁ–তাই বলি, বিয়ে করলেই হয় না। তুলো দেখতে নরম, ধুনতে লবেজান—বিয়ে করে এই বাজারে সংসারটি চালানো—সে বড়ো ঠ্যালা।…
রাত অনেক বেশি—বোধ হয় এগারোটা। হালিশহর জুট মিলের আলোর সারি নিবে গিয়েছে। প্রকাণ্ড একটা অশরীরী পাখি যেন জ্যোতির্ময় পাখা মেলে গঙ্গার ওপর উড়ে বেড়াচ্ছে, এক-একবার সেটা যেন জলের কাছাকাছি আসচে, স্নিগ্ধ জ্যোতির বিশাল প্রতিবিম্ব ফুটে উঠচে গঙ্গার বুকে—আবার যখন দূরে চলে যাচ্ছে, তখন অল্প সময়ের জন্য সে জায়গাটা অন্ধকার—আবার আলো ফুটে উঠল, আবার অন্ধকার।
এতক্ষণ ভদ্রলোকটি চিতার শিয়রের একটু দূরে চুপ করে বসেছিলেন। হঠাৎ তিনি আমার পাশে উঠে এলেন। বল্লেন—খোকা বোধ হয় এতক্ষণ ঘুমিয়ে পড়েছে—কী বলেন?
—হ্যাঁ এতক্ষণ নিশ্চয়ই।
খানিকটা চুপ করে থেকে বল্লেন—কাল সকালে নৈহাটিতে দুধ পাওয়া যাবে না মশাই?
—অভাব কী? সেজন্য ভাববেন না। সে জোগাড় হয়ে যাবে।
একটু চুপ করে থেকে আমি জিজ্ঞেস করলুম—আপনারা কোথায় যেতেন? পশ্চিমে কোথাও বুঝি?
ভদ্রলোক বললেন–পশ্চিমে বেশি দূর নয়—আমি যাচ্ছিলাম আসানসোেলে। সেখানে চাকরি করি। অনেক দিন চাকরি খুঁজে বেড়িয়ে বেড়িয়ে শেষে ওইটি জুটিয়েছিলাম। তা চাকরিও করচি আজ এক বছর। এতদিন রেলবাবুদের মেসে খেতাম, আশ্বিন মাসে মেসে খেয়ে খেয়ে ডিসপেপসিয়া গোছের দাঁড়াল। এত ঝাল দেয় মশাই, অত ঝাল খাওয়া আমার অভ্যাস নেই। আমার স্ত্রী বললে—যা পাও, একটা বাসা করো, আমাদের দুজনের খুব চলে যাবে। তোমারও কষ্ট থাকবে না, আমারও এখানে তোমায় বিদেশে ফেলে থাকতে ভালো লাগে না। তাই এবার বাসা করে বড়োদিনের ছুটিতে একে আনতে যাই শ্বশুরবাড়িতে—সেখানেই বিয়ের পর আজ চার-পাঁচ বছর রেখেছিলাম। দেশে আমার বাড়িঘর সবই আছে, কিন্তু সেখানে মশাই শরিকি গোলমাল। সেখানে ওকে রাখার অনেক অসুবিধে-বার দুই নিয়ে গিয়েছিলাম, তাতেই জানি।
আমি বললুম—ওঁর কী কোনো অসুখ ছিল—হঠাৎ এমন—
—অসুখের কথা তো কিছুই জানিনে। তবে মাঝে মাঝে বুক ধড়ফড় করত বলতে শুনেচি।…অসুখটা আমার বাড়িতে যখন আনি আর-বছর, তখন বড়ো বেড়েছিল। আমার সে সময় নেই চাকরি, হাতে নেই পয়সা, আর এদিকে বাড়িতে আমার জাঠতুতো ভাইয়ের স্ত্রী—তার যৎপরোনাস্তি দুর্ব্যবহার। এইসবে সংসারে শান্তি তো ছিল না একদণ্ড।…ও আবার ছিল একটু ভালোমানুষ মতো—ওর ওপরই যত ঝক্কি।
খানিকটা আপন মনেই যেন বলতে লাগলেন—কালও বিকেলে কত কথা বলেচে। বাসার কথা আমায় কত জিজ্ঞেস করলে। বলছিল, সেখানে পাতকুয়ো না পুকুর? আমি বললাম—দুই-ই আছে। তবে পুকুরে রেলের কুলি চাপরাশিরা নায় আর কাপড় কাচে—তার চেয়ে তুমি বাসার পাতকুয়োর জলেই নেও। খাবার জন্যে রেলের বাবুদের কোয়ার্টারে টিউবওয়েল আছে—নিকটেই সেখান থেকে জল আনাব। বাসায় পেঁপে গাছ আছে শুনে কত খুশি! বললে, হ্যাঁ গা, ওদেশের পেঁপে নাকি খুব বড়ো বড়ো? কাল দুপুরের পর থেকে বাক্স গুছিয়েছে…মানকচু সঙ্গে নিয়ে যাবে বলে বিকেলে বেছে বেছে বড় মানকচুটা ওর ভাইকে দিয়ে তোলালে। রাত্রে ঘুমোয় না—কেবল বাসার গল্প করে…এ করব…ও করব…আমায় বললে–পেতলের ডেকচিতে খেয়ে খেয়ে তোমার অসুখ হয়েছে…তারা তো আর তেমন মাজে না?…অসুখের আর দোষ কি? সেখানে মাটির হাঁড়ি-কুড়ি পাওয়া যাবে তো?…রাত অনেক হয়েছে দেখে আমি বললাম—শোও ঘুমোও, কাল আবার সারাদিন গাড়ির কষ্ট হবে…রাতদুপুর হল…ঘুমিয়ে পড়ো…কোথায় চলে গেল আজ…আর আমায় বেঁধে খাওয়াতে আসবে না।…
হঠাৎ একটা গোলমাল ও বচসার আওয়াজে ভদ্রলোক ও আমি দুজনেই ফিরে চাইলুম। বিনোদ বাঁড়য্যে ও তার বন্ধু টিকিটবাবুর সঙ্গে কী নিয়ে ঝগড়া বাধিয়েছে এবং আমার মনে হল তারা এমন সব কথা বলচে যা হয়তো তারা স্বাভাবিক অবস্থায় বলতে সাহস করত না টিকিটবাবুকে। বিনোদ বাঁড়য্যে বলচে, যান যান মশাই, অনেক দেখেচি ওরকম—আমরা গড়বাড়ির বাঁড়য্যে-সুতোহাটা পরগনার মধ্যে যেখানে যাবেন ওদিকে তমলুক এস্তেক—আমাদের একডাকে চেনে— ছোটো নজর যেখানে দেখি সেখানে আমরা থাকি না। এই শীতের রাতে কে আসত মশাই?—আমাদের আগে খোলসা করে আপনার বলা উচিত ছিল, তা হলে দেখতাম নৈহাটির বাজার থেকে কোন ব্যাটা পৈতেওলা বামুন আজ মড়া নিয়ে আসত …মুর্দফরাস দিয়ে না-যদি…
ব্যাপার কী উঠে দেখতে গেলুম; বিনোদ বাঁড়য্যে আমায় দেখে বললে, এই তো এই ভদ্দর–লোক রয়েছেন—আচ্ছা বলুন তো আপনি? আমরা সকলের আগে বলে দিয়েছি আমাদের এই চাই, এই চাই…এখন আসলে হাত গুটোলে চলবে কেন? আপনিই বলুন তো?…হ্যাঁ, মানুষ বলি এই বাবুকে…কোনো লোভ নেই, উনি খাবেন না, কিছু করবেন না—উনি এসেছেন মড়া নিয়ে এই শীতে। উনি বলতে পারেন—ওঁর পায়ের ধুলো নিয়ে মাথায় দিতে হয়—
ঝোঁকের মাথায় বিনোদ বাঁড়য্যে সত্যিই আমার পায়ে হাত দেবার জন্যে ছুটে এল। আমি সেখান থেকে সরে পড়লুম—এদের অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় ভাগ–বাঁটোয়ারা সংক্রান্ত কথার মধ্যে আমার থাকবার দরকার কীসের?
মনে কেমন একটা দুঃখ হল। এই অভাগিনী পল্লিবধূর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার উপযুক্ত সম্মান এখানে রক্ষিত হল না। মনে হল ও এখানে কেন? এই জ্যোৎস্নাপ্লাবিত গঙ্গার উদ্দাম তরঙ্গ-ভঙ্গ, এই হিমবর্ষী নক্ষত্রবিরল বিরাট আকাশ, এই অমঙ্গলময়ী মহানিশার মৃত্যু অভিযান—জীবনের নানা ছোটোখাটো সাধ যাঁদের মেটেনি, এ রুদ্ধ আহ্বান তাদের বেলা আর কিছুদিন স্থগিত রাখলে বিশ্বকর্মার কাজের কী ক্ষতিটা হত?…ছোট্ট একটি গৃহস্থবাড়ির দাওয়ায় মেয়েটি খোকাকে কোলে নিয়ে দুধ খাওয়াচ্ছে, সবে সে নদীর ঘাট থেকে গা ধুয়ে এসেছে, পায়ে আলতা, কপালে টিপ, খোঁপাটি বাঁধা—ওকে মানায় জীবনের সেই শান্ত পটভূমিতে—শ্মশানে মাতালের হুড়োহুড়ির মধ্যে ওকে এনে ফেলা যেমনি নিষ্ঠুর তেমনি অশ্লীল…
রাতদুপুর…
বিনোদ বাঁড়য্যে হঠাৎ কী মনে করে আমার পাশে এসে বসল। সে আমার প্রতি অত্যন্ত ভক্তিমান হয়ে উঠেছে…আমি কী করি কোথায় থাকি, বাড়িতে কে কে আছে,–এইসব নানা প্রশ্নে ব্যতিব্যস্ত করে তুলল।
—আপনি মশাই এর মধ্যে মানুষ। মানুষ চিনি মশাই, আজ না-হয় দেখছেন ইস্টিশানে পাউরুটি ফিরি করি…আমরা গড়বাড়ির বাঁড়য্যে…যান যদি কখনো ওদিকে, পায়ের ধুলো ঝেড়ে দিলেই বুঝতে পারবেন—সুতোহাটা পরগনার মধ্যে—
সব শেষ হতে রাত একটা বাজল। চাঁদ ঢলে পড়েছে।
চিতা ধুতে গিয়ে ভদ্রলোক আবার হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলেন—আমরা অনেক সান্ত্বনা দিয়ে তাঁকে থামালুম। আমি ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সোজা পিসিমার বাড়ি চলে আসব—ওরা কিছুতেই ছাড়ে না। টিকিটবাবু বললেন— আসুন আসুন, অতটা মাংস খাবে কে? সব গরম গরম পাবেন—আমার বলে দেওয়া আছে—রাত বারোটার পর তবে ময়দায় জল দেবে। গিয়েই গরম গরম…চলুন মশাই…
অতিকষ্টে ওদের হাত এড়িয়ে পিসিমার বাড়ি ফিরলুম। কিন্তু সকালে উঠেই খোকাকে দেখবার ইচ্ছে হল। সাড়ে সাতটার ট্রেনে নৈহাটি গিয়ে ছোটোবাবুর বাসায় হাজির। খোকা নাকি অনেকক্ষণ উঠেছে। ভোরবেলা থেকে মায়ের কাছে যাবার জন্যে কাঁদছিল, বাসার মেয়েরা অনেক কৌশলে থামিয়ে রেখেছেন।
ভদ্রলোকটিও এলেন। তিনি টিকিটবাবুর বাসায় রাত্রে শুয়েছিলেন—দেখে মনে হল রাতে বেশ ঘুমিয়েচেন। খোকা এখন আর কাঁদছে না। বাসার মেয়েরা কমলালেবু দিয়েচে হাতে; তাই খেতে খেতে ঝিয়ের কোলে বাইরে এল। ঝি বললে—কাল ছোটোবাবুর বউ নিজের কোলের কাছে ওকে নিয়ে শুয়েছিলেন। জেগে উঠলেই মুখে মাই দিয়েছেন, রাতের ঘুমের ঘোরে ও ভেবেচে ওর মা। কিন্তু ভোরে উঠেই সে কী কান্নাটা! কেবল বলে ‘মা যাব’ ‘মা যাব’—আহা বাছা আমার, মানিক আমার…
একটু পরে আমি ভদ্রলোককে ট্রেনে তুলে দিতে গেলুম, খোকাকে কোলে নিয়ে। তিনি এই ট্রেনে মুর্শিদাবাদে শ্বশুরবাড়ি ফিরে যাবেন। আমায় বল্লেন—কি করে সেখানে ঢুকব মশাই, ভেবে আমার হাত-পা আসছে না। তবে যেতেই হবে, খোকাকে ওর দিদিমার কাছে দিয়ে আসব—নইলে কে দেখবে আর ওকে?
তারপর পাগলের মতো হাসি হেসে বললেন—যাত্রাটা বদলে আসি মশাই, কী বলেন?…হ্যাঁ-হ্যাঁ—
আমি বললুম—টিকিটবাবু কাল আপনাকে কিছু ফেরত দিয়েছেন?
—না, আমিও চাইনি। তবে আজ সকালে একটা ফর্দ দেখাচ্ছিলেন, বলেন সব খরচ হয়ে গেছে। সে ফর্দ আমি দেখিওনি—যা উপকার করেছেন আপনারা, তার শোধ কী কখনো দিতে পারব?…
ট্রেন ছেড়ে চলে গেল।…
প্ল্যাটফর্মে বিনোদ বাঁড়য্যের সঙ্গে দেখা। আমায় একপাশে ডেকে মুখ ভার করে বললে—শুনেচেন টিকিটবাবুর আক্কেলটা? সাড়ে সাত টাকা হাতে ছিল কালকের দরুন। কাল রাতে খাওয়া-দাওয়ার পরে বললাম—ভাগ করো। তা আমাদের দিলে এক টাকা করে—দুজনকে দু-টাকা। নিজে নিলে সাড়ে পাঁচ টাকা। বলে ওদের দুজনের ভাগ, ও আর ওর ভাইপো। আচ্ছা, ভাইপো কী করেচে মশাই? শুধু কাপড়ের পুঁটলিটা হাতে ঝুলিয়ে গিয়েছে বইতো নয়?…আর আমাদের অত ছোটো নজর নেই…হাজার হোক, কুলিন বামুনের ছেলে মশাই…না–হয় পেটের দায়ে আজ পাউরুটি ফিরিই করি…