প্রত্নতত্ব

প্রত্নতত্ব

আমি এ গল্প আমার বন্ধু সুকুমারবাবুর মুখে শুনেছি।

ইতিহাস ও প্রত্নতত্ব বিষয়ে যাঁহারা কিছু আলোচনা করেছেন, তাঁদের সকলেরই কাছে ডাক্তার সুকুমার সেনের নাম সুপরিচিত। ডাক্তার সেন অনেক দিন গভর্নমেন্টের প্রত্নতত্ব বিভাগে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করেছেন। পাটনা excavation-এর সময় তিনি স্পনার সাহেবের প্রধান সহকারী ছিলেন। মধ্যে দিনকতক তিনি ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামের প্রত্নতত্ব-বিভাগের Curator-ও ছিলেন। বৌদ্ধ Iconography-তেও তিনি সুপণ্ডিত। প্রাগ গুপ্ত-যুগের মূর্তি-শিল্প ও ভারতীয় মূর্তি-শিল্পের ক্রমবিকাশ নামক তাঁর প্রসিদ্ধ বই দু-খানা ছাড়া, এশিয়াটিক সোসাইটির পত্রে এবং বহু দেশি সাময়িক পত্রিকায় এ বিষয়ে তিনি বহু প্রবন্ধ লিখেছেন।

তাঁর পড়বার ঘরটায় নানা স্থানের ভাঙা পুরোনো ইট, ভাঙা কাঠের তক্তি বসানো তুলট কাগজ ও তালপাতার পুথির স্থূপ এবং কালো পাথরের তৈরি দেবদেবীর মূর্তির ভিড়ে পা দেওয়ার স্থান ছিল না। এইসব মূর্তির শ্রেণিবিভাগ করতে তিনি অত্যন্ত পরিশ্রম করতেন। কোনো নতুন-আনা মূর্তি পেলে তিনি বেশ ভালো করে দেখতেন, পুথি মেলাতেন, তারপর টিকিট আঁটতেন ‘বৌদ্ধমূর্তি তারা’। দিনকতক পরে এ বর্ণনা তাঁর মনঃপূত হত না। তিনি আপন মনে বলতেন–উঁহু, ওটা ললিতক্ষেপ Pose হল যে, তারা কী করে হবে? তারপর আবার ‘লেন্স’ হাতে মূর্তিটার এপিঠ-ওপিঠ ভালো করে দেখতেন। মূর্তিটার যে হাত ভাঙা, সেটার দিকে চেয়ে বলতেন—এ হাতটায় নিশ্চয় পদ্ম ছিল। হু—মানে— বেশ বোঝা যাচ্ছে কিনা? তারপর আবার পুরোনো টিকিটের ওপর নতুন টিকিট আঁটতেন ‘বৌদ্ধমূর্তি—জম্ভলা’। তাঁর এ ব্যাপার দেখে আমার হাসি পেত। আমার চেয়েও বিজ্ঞ লোকে ঘাড় নেড়ে বলত—হ্যাঁ, ও-সব চালাকিবাজি রে বাপু, চালাকিবাজি! নইলে কোথাকার পাটলিপুত্র কোথায় চলে গেল, ওঁরা আজ খোঁড়া ইটপাথর সাজিয়ে হুবহু বলে দিলেন—এটা অশোকের নাটমন্দিরের গোড়া, ওটা অশোকের আস্তাবলের কোণ; দেখতে দেখতে এক প্রকাণ্ড রাজবাড়ি মাটির ভেতর থেকে গজিয়ে উঠল!…চাকরি তো বজায় রাখা চাই? কিছু নয় রে বাপু, ওসব চাকরিবাজি!

তবে এসব কথার মূল্য বড়োই কমঃ কারণ জ্ঞানবিজ্ঞানের সঙ্গে আমারও এসব বিজ্ঞ লোকের চিরদিন ভাসুর-ভাদ্ৰবউ সম্পর্ক।

সেদিন দুপুর বেলা ড. সেন যখন তাঁর নিজের লাইব্রেরিতে সেনরাজাদের শাসনকাল নিয়ে অত্যন্ত ব্যস্ত আছেন, আমি তখন একটা রাষ্ট্রবিপ্লবের মতো সেখানে গিয়ে হঠাৎ হাজির হলাম। আমাকে দেখে তিনি অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। খানিকক্ষণ খোশগল্প করে সেখানে সারাদিনের মানসিক পরিশ্রম দূর করতে বুঝলাম তিনি খুব ব্যর্থ হয়ে পড়েছেন। একথা-সেকথার পর ড. সেন বললেন—চা আনাই, একটা গল্প শোনো। এটা আমি কখনো কারুর কাছে বলিনি, তবে শুনার সাহেব কিছু কিছু শুনেছেন।

বাইরে সে দিন খুব শীত পড়েছিল। দরজা বন্ধ করে সুকুমারবাবুর গল্প শোনবার জন্য বসলাম। চা এল, চা খেতে খেতে সুকুমারবাবু তাঁর গল্প বলতে লাগলেন।

 

বিক্রমপুরের পুরোনো ভিটার কথা বোধহয় কিছু কিছু শুনে থাকবে। এটা কতদিনের, তা সেখানকার লোকে কেউ বলতে পারে না। অনেকদিন ধরে ঢিবিটা ওই রকমেই দেখে আসছে— এটা কার বা কোন সময়ের তা তারা কিছুই বলতে পারে না।

ঢাকা মিউজিয়াম থেকে সেবার ওই ঢিবিটা খোঁড়বার কথা উঠল। এর পূর্বে বরেন্দ্র অনুসন্ধান-সমিতি ও ঢাকা-সাহিত্য-পরিষদ শাখা থেকে ওটা কয়েকবার খোঁড়বার প্রস্তাব হয় কিন্তু টাকার জোগাড় করতে না-পেরে তাঁরা পিছিয়ে যান। আমার কাছে যখন কথা উঠল, তখন আমারও মতো ছিল না। কারণ, আমার মনে মনে ধারণা ছিল খরচ যা পড়বে তার তুলনায় আমাদের এমন বিশেষ কিছু পাবার আশা নেই। অবশেষে কিন্তু আমার আপত্তি টিকল না। ওটা খোঁড়বার জন্যে টাকা বরাদ্দ হল। আমি বিশেষ অনুরোধে পড়ে তত্বাবধানের ভার নিলাম।

গিয়ে দেখলাম, যে-ঢিবিটা হবে তার কাছে আর একটা ঠিক তেমনি ঢিবি আছে। এই ঢিবির কাছে একটা প্রকাণ্ড দিঘি আছে, তা প্রায় মজে এসেছে। ঢিবি দুটো খুব বড়ো বড়ো। ময়নাকাঁটার বন আর বড়ো বড়ো আগাছায় পশ্চিমদিকের ঢিবিটার ওপরের অংশ একেবারে দুর্গম। পূর্বদিকের ঢিবিটা একটু ছোটো, তার পেছনের ঢালু দিকটায় খানিকটা ফাঁকা ঘাসের জমি আছে। স্থানটা কতকটা নির্জন।

সাধারণত খননকার্য আরম্ভ করবার সময় আমরা প্রথমটা প্ল্যান তৈরি করে নিয়ে কাজ আরম্ভ করি। তারপর কাজ এগিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে কতকটা আন্দাজে কতকটা খুব ক্ষীণ সূত্র ধরে, আমরা সেই প্ল্যান ক্রমে ক্রমে বদলে চলি। পাটনা excavation-এর সময় এতে খুব কাজ হয়েছিল। কিন্তু ছোটো দুটো গ্রাম্য ঢিবি খুঁড়ে তুলতে আমি এসব করবার আবশ্যক দেখলাম না। আমাদের সঙ্গে প্রত্নতত্ব বিভাগের খননকার্য চালিয়েছে এমন কোনো লোক ছিল না। তার কারণ এই যে, ওটা খোঁড়া হচ্ছিল ঢাকা pwD থেকে।

এই ঢিবি দুটোর বড়োটাকে ওখানকার লোকে বলে ‘নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা’ ও ছোটোটাকে বলে ‘টোলবাটীর ভিটা’। কারুর মতে এই নাস্তিক পণ্ডিত হলেন বৈষ্ণব ভক্তি-শাস্ত্রকার বল্লভাচার্য। তিনি শেষবয়সে বৈষ্ণবধর্ম ত্যাগ করে শঙ্কর বেদান্তের ভক্ত হয়ে পড়েছিলেন। এজন্য দেশের লোকে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে নারাজ হয়। কেউ কেউ বলেন, বল্লভাচার্য বিক্রমপুরের ত্রিসীমানায়ও জন্মাননি। তাঁদের মতে ওটা ষোড়শ শতাব্দীর প্রসিদ্ধ নৈয়ায়িক শ্রীকৃষ্ণ তর্কালঙ্কারের ভিটা। যাক সে-কথা। আমি কিন্তু জানতে পেরেছি ওখানে কে বাস করতেন। আমি যা জানতে পেরেছি, পূর্বে কেউ কেউ তা আন্দাজ করেছিলেন। কিন্তু জোর করে কিছু বলতে পারেননি। আমি জোর করে বলতে পারি, কিন্তু বলিনি। কেন বলিনি, আর কেমন করে আমি তা জানলাম, সেইটেই বলব।

কিছুকাল ধরে ঢিবির ওপরকার বন কাটানো হল। তারপর প্রকৃতপক্ষে খননকার্য শুরু হল। আমার সঙ্গে আমার বন্ধু ঢাকা মিউজিয়ামের ক—বাবু ছিলেন। তিনি শুধু প্রত্নতত্বজ্ঞ ছিলেন না, তিনি ছিলেন তার চেয়ে বেশি—প্রত্নতত্বগ্রস্ত। প্রধানত তাঁরই আগ্রহে ও উৎসাহে আমরা এ কাজে হাত দিই। দিনের পর দিন ঢিবি দুটোর সামনে একটা প্রকাণ্ড ঘোড়া-নিমগাছের ছায়ায় ক্যাম্প-চেয়ার পেতে আমরা তীর্থের কাকের মতো বসে থাকতাম। আমার বন্ধুর চোখ মুখের ভাব ও উৎসাহ দেখে আমার মনে হত, তিনি আশা করেন, খুঁড়তে খুঁড়তে একটা পুরোনো আমলের রাজবাড়ি-টাড়ি, বা একটা তালপাতায় লেখা আস্ত বাংলা ইতিহাসের পুথি, অভাবপক্ষে সেই অজ্ঞাত নাস্তিক পণ্ডিতের fossil শরীরটাই বা মাটির মধ্যে থেকে বেরিয়ে পড়ে।

খুঁড়তে খুঁড়তে প্রথমে বেরুল একটা মাটির ঘট। ও-রকম গড়নের ঘট এখন আর বাংলার কোনো জায়গায় তৈরি হয় কিনা জানি না। ঘটের গলার নীচে থেকে তলা পর্যন্ত curve-টি যে দিয়েছিল, সে গ্রাম্য কুমোরটিকে আমি শ্রদ্ধা করি। ঘটটার মধ্যে প্রায় আধঘট কড়ি। হিন্দুরাজত্বে কেনা-বেচার জন্যে কড়ি ব্যবহার হত তা জানো তো? কোন অতীত দিনে গৃহস্বামী ভবিষ্যৎ দুর্দিনের ভয়ে কড়িগুলো সযত্নে ঘটে ভরে মাটির মধ্যে পুঁতে রেখে দিয়েছিলেন, সে ভবিষ্যৎ কত দিন হল সুদূর অতীতে মিলিয়ে গিয়েছে, সঞ্চিত অর্থের আর প্রয়োজন হয়নি। ক্রমে ক্রমে আরও অনেক জিনিস বেরুতে লাগল। আরও মাটির অনেক ভাঙা ঘট, কলসি, একখানা মরিচাধরা লাল রঙের তলোয়ার, একটি প্রদীপ, ভাঙা ইটের কুচো এবং সকলের শেষে বেরুল একটা কালো পাথরের দেবীমূর্তি। এই মূর্তিটিকে নিয়েই আমার গল্প, অতএব এইটাই ভালো করে বলি।

দেবীমূর্তিটি পাওয়া যায় টোলবাড়ির ভিটায়। মূর্তিটি রাজমহলে কালো পাথরের তৈরি, চকচকে পালিশ করা। বহু দিন মাটির তলায় থেকে সে পালিশ যদিও নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু মোটের ওপর তখনও যা ছিল, তা খুব কম মূর্তিতেই আমি দেখেছি। মূর্তিটি সরস্বতী দেবীর হলেও, তাতে বৌদ্ধ-ভাস্কর্যের কিছু প্রভাব আছে বলে মনে হয়েছিল। হাতে বীণা না-থাকলেও দেবী না-হয়ে দেবমূর্তি হলে, তাকে মঞ্জুশ্রী মূর্তি বলে অনায়াসে ধরে নেওয়া যেতে পারত।

মূর্তিটা যখন পরিষ্কার করে আমার সামনে আনা হল, তখন তার দিকে চেয়েই আমি চেয়ার থেকে উঠে পড়লাম। অনেক মূর্তি গত পনেরো বৎসর ধরে পরীক্ষা করে আসছি—কিন্তু এ কী? বাটালির মুখে পাথর থেকে হাসি ফুটিয়ে তুলেছে কী করে! খানিকক্ষণ একদৃষ্টে মূর্তিটার দিকে চেয়ে রইলাম। আমি খুব কল্পনাপ্রবণ নই, কিন্তু সেদিন সেই নিস্তব্ধ দুপুরবেলায় পত্রবিরল ঘোড়া-নিমগাছটার তলায় দাঁড়িয়ে আমার মনের মধ্যে কেমন গোলমাল হয়ে গেল। অল্পক্ষণ.অবশ্য খুব অল্পক্ষণের জন্যে মনের মধ্যে এক অপূর্ব ভাব…সৌন্দর্যে ঝলমল চকচকে কালো পাথরের পালিশ করা নিটোল সে দেবীমূর্তির, তার মুখের দৃঢ়রেখাগুলির, দেহের গঠনের শিল্প-ভঙ্গির, হাতের আঙুলগুলি বিন্যাসের সুন্দর ধরনের…সকলের ওপর মূর্তির মুখের সে-হাসিমাখা জীবন্ত সৌন্দর্যের দিকে চেয়ে অনেকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। শিল্পের যে প্রভাব কালকে তুচ্ছ করে যুগে যুগে মানুষের প্রাণ স্পর্শ করছে, তার সঙ্গে সত্যিকার পরিচয় সেই আমার প্রথম হল।…জয় হোক সে অতীত যুগের অজ্ঞাতনামা শিল্পীর…জয় হোক তার  মৃত্যুঞ্জয়ী প্রতিভার!

মূর্তিটাকে বাড়ি নিয়ে এসে, আমার লাইব্রেরিতে কাগজ-চাপা ধ্যানিবুদ্ধের দলের মধ্যে তাকে রেখে দিলাম। রোজ সকালে উঠে দেখতাম—দীর্ঘ ভ্রু-রেখার নীচে বাঁশপাতার মতো টানা চোখ দুটোর কোণ হাসিতে যেন দিনদিন উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। কয়েকদিন ধরে নানা কথা মনে হতে লাগল। খুঁড়তে খুঁড়তে এমন কোনো জিনিস পাইনি, যাতে মূর্তিটির ভিটার সময় নিরূপণ করতে পারি। তবে মূর্তিটি গুপ্তযুগের পরবর্তী সময়ের এবং পূর্ববঙ্গের শিল্পীর হাতে তৈরি, এটা আমি তার মাথার ওপর ছাতার মতো চিহ্ন দেখে কতকটা আন্দাজ করতাম। পাথরের মূর্তির মাথার ওপর এই গোল ছাতার মতো চিহ্ন, পূর্ববঙ্গের ভাস্কর্যের একটা রীতি—এ আমি অন্য অন্য মূর্তিতেও দেখেছি।

সেদিন রবিবার। সন্ধ্যাবেলাটা আমার এক প্রতিবেশী বন্ধুর সঙ্গে এক বাজি দাবা খেলে সকাল সকাল শুতে গেলাম।

এইবার যে-কথা বলব, সে কেবল তুমি বলেই তোমার কাছে বলছি—অপরের কাছে এ কথা বলতে আমার বাধে; কারণ তাঁরা আমায় বিশ্বাস করবেন না। অনেক রাতে কী জানি কেন হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। ঘরের মধ্যে কীসের অত্যন্ত সুগন্ধ পেলাম। পূজার মন্দিরে যেমন ধূপধুনো গুগগুল, ফুল, ঘি-চন্দন সবসুদ্ধ মিলে একটা স্নিগ্ধ সৌরভ পাওয়া যায়, এটা ঠিক সেই ভাবের। সুগন্ধটা আমার নিদ্রালস মস্তিষ্কের মধ্যে গিয়ে আমায় কেমন একটা নেশায় অভিভূত করে ফেলল। রাত ক টা হবে ঠিক জানি না…মাথার কাছে ঘড়িটা টিকটিক করছিল…হঠাৎ দেখলাম, খাট থেকে কিছুদূরে ঘরের মেঝেয় কে একজন দাঁড়িয়ে…তাঁর মস্তক মুণ্ডিত, পরনে বৌদ্ধ পুরোহিতের মতো হলদে পরিচ্ছদ…মুখের হাতের অনাবৃত অংশের রং যেন সাদা আগুনের মতো জ্বলছে…বিস্মিত হয়ে জোর করে চোখ চাইতেই সে মূর্তি কোথায় মিলিয়ে গেল!…বিছানায় তাড়াতাড়ি উঠে বসলাম, ঘড়িতে দেখলাম রাত দুটো…ভালো করে চোখ মুছলাম, ঘরে কেউ কোথাও নেই। ভাবলাম আরে গেল যা, রাতদুপুরের সময় এ যে দেখছি ছেলেবেলাকার সেই Abou Ben Adhem (may his tribe increase)! খানিকক্ষণ বিছানায় বসে থাকবার পর ঠিক করে নিলাম, ওটা ঘুমের ঘোরে কীরকম চোখের ধাঁধা দেখে থাকব। তারপর আবার শুয়ে পড়লাম, একটু পরে বেশ ঘুম এল। কতক্ষণ পরে জানি না, আবার কী জানি কেন হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল…ঘুম ভাঙবার সঙ্গে সঙ্গে আবার সে সুগন্ধটা পেলাম…আবার সেই নেশা! এবার নেশাটা যেন আমায় পূর্বের চেয়েও বেশি অভিভূত করে ফেললে…তারপরই দেখি, সেই মুণ্ডিত-মস্তক পীতবসন জ্যোতির্ময় বৌদ্ধভিক্ষু আমার খাটের অত্যন্ত কাছে দাঁড়িয়ে আমার দিকে চেয়ে আছেন!…

তারপর আরও কতকগুলো অদ্ভুত ব্যাপার খুব অল্পসময়ের মধ্যেই ঘটল।

হঠাৎ আমার ঘরের দৃশ্যটা আমার চোখের সামনে থেকে মিলিয়ে গেল…দেখলাম, এক বিস্তীর্ণ স্থান, কত বাড়ি, শ্বেতপাথরে বাঁধানো কত চত্বর, কত গম্বুজ, দেউল…অনেক মুণ্ডিতমস্তক বৌদ্ধ ভিক্ষুর মতো পরিচ্ছদ-পরা লোকেরা এদিক-ওদিক যাতায়াত করছেন, অসংখ্য ছাত্র ঘরে ঘরে পাঠনিরত…একস্থানে অশোক-বৃক্ষের ছায়ায় শ্বেতপাথরের বেদীতে একদল তরুণ যুবক পরিবৃত হয়ে বসে আমার পরিচিত সেই বৌদ্ধ ভিক্ষু! দেখে মনে হল, তিনি অধ্যাপনায় নিরত এবং যুবক-মণ্ডলী তাঁর ছাত্র। অশোককুঞ্জের ঘন-পল্লবের প্রান্তস্থিত রক্ত পুষ্পগুচ্ছের পাপড়ি গুরু ও শিষ্যবর্গের মাথার ওপর বর্ষিত হতে লাগল।

দেখতে দেখতে সে দৃশ্য মিলিয়ে গেল…আমার তন্দ্রালস কানের মধ্যে নানা বাজনার একটা সম্মিলিত সুর বেজে উঠল…এক বিরাট উৎসবসভা! উৎসব-বেশে সজ্জিত নরনারীতে সভা ভরে ফেলেছে…সব যেন অজন্তার গুহার চিত্রিত নরনারীরা জীবন্ত হয়ে উঠে বেড়াচ্ছে। কোন প্রাচীন যুগের হাবভাব, পোশাক-পরিচ্ছদ…সভার চারিধারে বর্শাহাতে দীর্ঘদেহ সৈনিকরা দাঁড়িয়ে, তেজস্বী যুদ্ধের ঘোড়াগুলো মূল্যবান সাজ পরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পা ঠুকছে…সভার মাঝখানে রক্তাম্বর-পরণে চম্পক-গৌরী কে এক মেয়ে…মেয়েটিরে সামনে দাঁড়িয়ে উজ্জ্বল ইস্পাতের বর্ম আঁটা এক যুবক…তার কোমরে ঝকঝকে ইস্পাতের খাপে বাঁকা তলোয়ার দুলছে…গলায় ফুলের মালা…মুখে বালকের মতো সরল সুকুমার হাসির রেখা। মেয়েটির নিটোল সুন্দর হাতটি ধরে যুবকের দৃঢ় পেশিবহুল হস্তে যিনি স্থাপন করলেন—ভালো করে চেয়ে দেখলাম, তিনি আমার রাতের বিশ্রামের ব্যাঘাতকারী সেই বৌদ্ধ-ভিক্ষু।

বায়স্কোপের ছবির মতো বিবাহ-সভা মিলিয়ে গেল। হঠাৎ আমার হাত-পা যেন খুব ঠান্ডা হয়ে উঠল। শীতে দাঁতে দাঁত লাগতে লাগল…পায়ের আঙুল যেন আড়ষ্ট হয়ে উঠল। চোখের সামনে এক বিস্তীর্ণ সাদা বরফের রাজ্য…ওপর থেকে বরফ পড়ছে…তুষার-বাষ্পে চারিধার অস্পষ্ট…সামনে পেছনে সুউচ্চ পর্বতের চূড়া…সামনে এক সংকীর্ণ পথ এঁকেবেঁকে উচ্চ হতে উচ্চতর পার্বত্য প্রদেশে উঠে গিয়েছে। এক দীর্ঘদেহ ভিক্ষু সেই ভীষণ দুর্গমপথ বেয়ে ভীষণতর হিম-বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে মাতালের মতো টলতে টলতে পথ চলেছেন…তাঁর মাথা যেন ক্রমে নুয়ে বুকের ওপর এসে পড়ছে…কিন্তু তবু তিনি না-থেমে ক্রমাগত পথ চলেছেন…বহুদূরের এক উত্তুঙ্গ তুষারমণ্ডিত পর্বতচূড়া কীসের আলোয় রক্তাভ হয়ে দৈত্যের হাতের মশালের মতো সে বিশাল তুহিন-রাজ্যের দূর প্রান্ত আলোকিত করে ধক ধক করে জ্বলছে।…

তুষার-বাষ্প ঘন হতে ঘনতর হয়ে সমস্ত দৃশ্যটা ঢেকে ফেলল। তারপরই চোখের সামনে—এ যে আমারই চিরপরিচিত বাংলা দেশের পাড়াগাঁ…খড়ের ঘরের পেছনে ছায়াগহন বাঁশবনে বিকাল নেমে আসছে। বৈঁচি-ঝোপে শালিক দল কিচ কিচ করছে। কাঁঠালতলায় কোন গৃহস্থের গোরু বাঁধা। মাটির ঘরের দাওয়ায় বসে এক তরুণ যুবক! তার সামনে আমার খুঁড়ে-বার করা সেই দেবীমূর্তি।…দেখে মনে হল, যুবকের অনেক দিনের স্বপ্ন ওই পাথরের মূর্তিতে সফল হয়েছে…বর্ষা-সন্ধ্যার মেঘ-মেদুর আকাশের নীচে ঘনশ্যাম কেতকী-পল্লবের মতো কালো ভাবগম্ভীর চোখদুটি মেলে সে পাথরের মূর্তির মুখের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে।…

হঠাৎ সে দৃশ্যও মিলিয়ে গেল। দেখি আমি আমার ঘরে খাটেই শুয়ে আছি, পাশে সেই বৌদ্ধ-ভিক্ষু। এবার তিনি কথা বললেন। তাঁর কথাগুলি আমার খুব স্পষ্ট মনে আছে। তিনি বললেন—তুমি যে মূর্তিটি মাটি খুঁড়ে বার করেছ, তারই টানে অনেকদিন পরে আজ আবার পৃথিবীতে ফিরে এলাম। নয়শো বৎসর আগে আমি তোমার মতোই পৃথিবীর মানুষ ছিলাম। যে স্থান তোমরা খুঁড়েছ, ওই আমার বাস্তুভিটা ছিল। তুমি জ্ঞানচর্চায় সমস্ত জীবনযাপন করেছ, এই জন্যেই তোমার কাছে আসা আমার সম্ভব হয়েছে; এবং এই জন্যেই আমি অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে আমার জীবনের কতকগুলি প্রধান প্রধান ঘটনা তোমাকে দেখালাম। আমি দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান, –নয়পালদেবের সময়ে আমি নালন্দা মহাবিহারের সংঘস্থবির ছিলাম। ভগবান তথাগতের অমৃতময়ী বাণীতে আমার মন মুগ্ধ হয়েছিল; সে জন্য দেশের হিন্দুসমাজে আমার জনপ্রিয়তা নষ্ট হয়। দেশের টোলের অধ্যাপনা ছেড়ে আমি নালন্দা যাই। বুদ্ধের নির্মল ধর্ম যখন তিব্বতে অনাচারগ্রস্ত হয়ে উঠেছিল, তখন ভগবান শাক্যশ্রীর পরে আমি তিব্বত যাই সে-ধর্ম পুনরুদ্ধারের জন্যে। আমার সময়কার এক গৌরবময় দিনের কথা আজও আমার স্মরণ হয়। আজ অনেকদিন পরে পৃথিবীতে—বাংলায় ফিরে এসে সে-কথা বেশি করে মনে পড়েছে।…চেদীরাজ কর্ণ দিগবিজয়ে বার হয়ে দেশ জয় করতে করতে গৌড় মগধ-বঙ্গের রাজা নয়পালদেবের সঙ্গে যুদ্ধে হেরে গিয়ে যে-দিন সন্ধি করলেন; আমি তখন নালন্দার অধ্যাপক। মনে আছে, উৎসাহে সে-দিন সারারাত্রি আমার নিদ্রা হয়নি। এই সন্ধির কিছুদিন পরেই কর্ণের কন্যা যৌবনশ্রীর সঙ্গে নয়পালদেবের পুত্র তৃতীয় বিগ্রহপালের যে-বিবাহ হয়, আমিই সে বিবাহের পুরোহিত ছিলাম।…অল্পবয়সে আমি একজন গ্রাম্য শিল্পীর কাছে পাথরের মূর্তি গড়তে শিখি এবং অবসর মতো আমি তার চর্চা রাখতাম। তারপর আমি যখন পিতামহের টোলে সারস্বত ব্যাকরণের ছাত্র,তখন সমস্ত শক্তি ও কল্পনা ব্যয় করে জ্ঞানের অধিষ্ঠাত্রী দেবীর এক মূর্তি গড়ি। মূর্তিটি আমার বড়ো প্রিয় ছিল। ওই মূর্তিটির টানেই অনেকদিন পরে আবার পৃথিবীতে ফিরে এলাম। দেশের লোকে আমায় নাস্তিক বলত; কারণ আমি একেই বৌদ্ধ ছিলাম, তার ওপর সাধারণভাবের ধর্মবিশ্বাস আমায় ছিল না। যে অরুণচ্ছটারক্ত হিমবান শৃঙ্গ জনহীন তুষার-রাজ্য আলোকিত করেছে—যা তোমায় দেখিয়েছি, তা সত্যের রূপ! সাধারণ লোকের পক্ষে সে-সত্য দুরধিগম্য। আমার কথা ধরি না, কারণ আমি নগণ্য। কিন্তু যে বিশাল সংঘারাম আমাদের সময়ে সমস্ত ভারতবর্ষে জ্ঞানের আলো জ্বালিয়ে রেখেছিল, তার সমস্ত অধ্যাপকই সে-উচ্চ দার্শনিক সত্যকে চিরদিন লক্ষ রেখে চলেছিলেন। আমিও অনেক বিপদ মাথা পেতে নিয়ে, সাধ্যমতো তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছিলাম। যেখানে এখন আছি, সেখানে সে-সব যুগপূজ্য জ্ঞান-তপস্বী আমার নিত্য সঙ্গী। তোমরাও অমৃতের পুত্র—সে-লোক তোমাদের জন্যেও নির্দিষ্ট আছে।…অজ্ঞানতার বিরুদ্ধে তোমাদের অভিযান জয়যুক্ত হোক।…

বৌদ্ধভিক্ষু কোথায় মিলিয়ে গেলেন।…কীসের শব্দে চমক ভেঙে গিয়ে দেখি ভোর হয়েছে, বাইরের বারান্দায় চাকরের ঝাঁটার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে।

ড. সেন গল্প শেষ করলেন। আমি জিজ্ঞাসা করলাম—মূর্তিটা কোথায়?

ড. সেন বললেন—ঢাকা মিউজিয়ামে।


© 2024 পুরনো বই