মৌরীফুল

মৌরীফুল

অন্ধকার তখনও ঠিক হয় নাই। মুখুয্যে-বাড়ির পিছনে বাঁশবাগানের জোনাকির দল সাঁজ জ্বালিবার উপক্রম করিতেছিল। তালপুকুরের পাড়ে গাছের মাথায় বাদুড়ের দল কালো হইয়া ঝুলিতেছে—মাঠের ধারে বাঁশবাগানের পিছনটা সূর্যাস্তের শেষ আলোয় উজ্জ্বল। চারিদিক বেশ কবিত্বপূর্ণ হইয়া আসিতেছে, এমন সময় মুখুয্যেদের অন্দর-বাড়ি হইতে এক তুমুল কলরব আর হইচই উঠিল।

বৃদ্ধ রামতনু মুখুয্যে শিবকৃষ্ণ পরমহংসের শিষ্য। তিনি রোজ সন্ধ্যাবেলায় আরতি দিয়া থাকেন, এজন্য প্রায় একপোয়া খাঁটি গাওয়া ঘি তাঁর চাই। তিনি নানা উপায়ে এই ঘি সংগ্রহ করিয়া ঘরে রাখিয়া দেন। অন্যদিনের মতো আজও তাকের উপর একটা বাটিতে ঘি-টা ছিল, তাঁর পুত্রবধূ সুশীলা সেই বাটি তাকের উপর হইতে পাড়িয়া সে ঘি-টার সমস্তই দিয়া খাবার তৈয়ারি করিয়াছে।

রামতনু মুখুয্যে মহকুমার কোর্টে গিয়াছিলেন, ও-পাড়ার চৌধুরীদের পক্ষে একটা মোকদ্দমায় সাক্ষ্য দিতে।

বিপক্ষের উকিল তাঁকে জেরার মুখে জিজ্ঞাসা করেন—আপনি গত মে মাসে পাঁচু রায় আর তার ভাইয়ের পাঁচিলের জায়গা নিয়ে মামলায় প্রধান সাক্ষী ছিলেন না?

রামতনু মুখুয্যে বলিয়াছিলেন—হাঁ তিনি ছিলেন।

উকিল পুনরায় জেরা করিয়াছিলেন—দু-নালির চৌধুরীদের কান-সোনার মাঠের দাঙ্গার মোকদ্দমায় আপনি পুলিশের দিকে সাক্ষ্য দিয়াছিলেন কিনা?

রামতনু মহাশয়কে ঢোঁক গিলিয়া স্বীকার করিতে হইয়াছিল যে তিনি দিয়াছিলেন বটে।

বিপক্ষের উকিল আবার প্রশ্ন করেন—আচ্ছা, এর কিছুদিন পরেই বড়ো তরফের স্বত্বের মামলায় আপনি বাদি-পক্ষের সাক্ষী ছিলেন কিনা?

কবে তিনি এ সাক্ষ্য দিয়াছিলেন, মুখুয্যে মহাশয় প্রথমটা তাহা মনে করিতে পারেন নাই, তারপর বিপক্ষের উকিলের পুনঃ পুনঃ কড়া প্রশ্নে এবং মুনসেফবাবুর ভ্রূকুটি-মিশ্রিত দৃষ্টির সম্মুখে হতভাগ্য রামতনুর মনে পড়িয়াছিল যে তিনি এ সাক্ষ্য দিয়াছিলেন বটে এবং এই গত জুলাই মাসে এই কোর্টেই তাহা তিনি দিয়া গিয়াছেন।

তারপর কোর্টে কি ঘটিয়াছিল, বিপক্ষের উকিল হাকিমের দিকে চাহিয়া রামতনুর উপর কি ব্যাঙ্গোক্তি করিয়াছিলেন, রামতনু উকিল-আমলায় ভর্তি মুনসেফ-বাবুর এজলাসে হঠাৎ কীরূপে সপুষ্প সর্ষপক্ষেত্রের আবিস্কার করেন, সে সকল কথা উল্লেখের আর প্রয়োজন নাই। তবে মোটের উপর বলা যায়, রামতনু মুখুয্যে যখন বাটী আসিয়া পৌঁছিলেন, তখন তাঁর শরীরের ও মনের অবস্থা খুবই খারাপ! কোথায় এ অবস্থায় তিনি ভাবিয়াছিলেন হাত-পা ধুইয়া ঠান্ডা হইয়া শ্রীগুরুর উদ্দেশ্যে আহুতি দিয়া অনিত্য বিষয়-বিষে জর্জরিত মনকে একটু স্থির করিবেন, না-দেখেন যে আহুতির জন্য আলাদা করিয়া তোলা যে ঘি-টুকু তাকে ছিল, তাহার সবটাই একেবারে নষ্ট হইয়াছে।

তারপর প্রায় অর্ধ-ঘণ্টা ধরিয়া মুখুয্যে বাড়ির অন্দরমহলে একটা রীতিমতো কবির লড়াই চলিতে লাগিল। মুখুয্যে মহাশয়ের পুত্রবধূ সুশীলা প্রথমটা একটু অপ্রতিভ হইলেও সামলাইয়া লইয়া এমন-সব কথায় শ্বশুরকে জবাব দিতে লাগিল যাহা একজন আঠারো-বৎসর-বয়স্কা তরুণীর মুখে সাজে না। পক্ষান্তরে কোর্টে বিপক্ষের উকিলের অপমানেও ঘরে আসিয়া পুত্রবধূর নিকট অপমানে ক্ষিপ্তপ্রায় রামতনু মুখুয্যে পুত্রবধূর পিতৃকুল ও তাহার নিজের পিতৃকুলের তুলনামূলক সমালোচনায় প্রবৃত্ত হইয়া এমনসব দুরূহ পারিভাষিক শব্দের ব্যবহার করিতে লাগিলেন যে বোধ হয় বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ডুবালের গল্পে উল্লিখিত কুলাদর্শ বিদ্যা অধ্যয়ন না-করিলে সে-সব বুঝা একেবারেই অসম্ভব।

এমন সময় মুখুয্যে মহাশয়ের ছেলে কিশোরী বাড়ি আসিল। তাহার বয়স পঁচিশ-ছাব্বিশ হইবে, বেশি লেখাপড়া না-শেখায় সে চৌধুরীদের জমিদারি কাছারিতে ন-টাকা বেতনে মুহুরিগিরি করিত।

কিশোরীলাল নিজের ঘরে প্রবেশ করিয়া দেখিল ঘরে আলো দেওয়া হয় নাই, অন্ধকারেই জামাকাপড় ছাড়িয়া সে বাহিরে হাত-পা ধুইতে গেল। তারপর ঘরে ঢুকিয়া শুনিল, ঘুটঘুটে অন্ধকার ঘরে সুশীলা তাহার সম্মুখের বাতাসকে সম্বোধন করিয়া বলিতেছে যে, এ সংসারে থাকিয়া সংসার করা তাহার শক্তিতে কুলাইবে, অতএব কাল সকালেই যেন গোরুরগাড়ি ডাকাইয়া তাহাকে বাপেরবাড়ি পাঠাইয়া দেওয়া হয়।

কিশোরী সে-কথার কোনো বিশেষ জবাব না-দিয়া লণ্ঠন জ্বালিয়া, বাঁশের লাঠিগাছা ঘরের কোণ হইতে লইয়া বাহির হইয়া গেল। ও-পাড়ায় রায়-বাড়িতে চণ্ডীমণ্ডপে গ্রামের নিষ্কর্মা যুবকদিগের যাত্রার আখড়াই ও রিহার্সেল চলিত সেইখানে অনেকক্ষণ কাটাইয়া অনেক রাত্রে বাড়ি ফিরিয়া আসা তাহার নিত্যকর্মের ভিতর।

রামতনু মুখুয্যে মহাশয়ও অনেকক্ষণ বাহিরের ঘরে কাটাইলেন। প্রতিবেশী হরি রায় তামাকের খরচ বাঁচাইবার জন্য সকাল-সন্ধ্যায় মুখুয্যে মহাশয়ের চণ্ডীমণ্ডপ আশ্রয় করিতেন; তাঁহাকে রামতনু জানাইলেন যে তিনি খুব শীঘ্রই কাশী যাইতেছেন, কারণ আর এ-বয়সে, ইত্যাদি।…

তাঁহার এ বানপ্রস্থ অবলম্বনের আকাঙ্ক্ষার জন্য দায়ী একমাত্র তাঁহার পুত্রবধূ সুশীলা। সুশীলা সকাল নাই সন্ধ্যা নাই একটা কিছু না-বাধাইয়া থাকিতে পারে না। সে অত্যন্ত আনাড়ি, কোনো কাজই গুছাইয়া করিতে পারে না, অথচ দোষ দেখাইতে যাইলে ক্ষেপিয়া যায়। তাহার জন্য রামতনু মুখুয্যের বাড়িতে কাক চিল বসিবার উপায় নাই। শ্বশুর-শাশুড়িকে সে হঠাৎ আঁটিয়া উঠিতে পারে না বটে, কিন্তু এজন্য তাহার চেষ্টার ত্রুটি দেখা যায় না।

অনেক রাত্রে কিশোরী বাড়ি ফিরিয়া আসিয়া দেখিল, তাহার ঘরে খাবার ঢাকা আছে এবং স্ত্রী ঘুমাইতেছে। খাবারের ঢাকা খুলিয়া আহারাদি শেষ করিয়া সে শুইতে গিয়া দেখিল, স্ত্রী ঘুম-জড়ানো চক্ষে বিছানার উপর উঠিয়া বসিয়াছে। স্বামীকে দেখিয়া একটু অপ্রতিভের সুরে বলিল—কখন এলে? তা আমায় একটু ডাকলে না কেন?

কিশোরী বলিল—আর ডেকে কী হবে? আমার কী আর হাত-পা নেই! নিতে জানিনে?

হঠাৎ তাহার স্ত্রী রাগিয়া উঠিল—নিতে জানেনা তো জেনো। কাল থেকে আমার এখানে আর বনবে না। এ যেন হয়েছে শক্রপুরীর মধ্যে বাস—বাড়িসুদ্ধ লোক আমার পেছনে এমন করে লেগেছে কেন শুনতে চাই। না-হয় বরং…

কান্নায় ফুলিয়া সে বালিশের উপর মুখ গুঁজিল।

কিশোরী দেখিল স্ত্রী রাতদুপুরের সময় গায়ে পড়িয়া ঝগড়া করিয়া একটা বিভ্রাট বাধাইয়া তোলে বুঝি। এরকম করিয়া আর সংসার করা চলে না—ভাত ঢাকা ছিল, খুলিয়া লইয়া খাইয়াছে, ইহাতেও যদি স্ত্রী চটিয়া যায় তাহা হইলে আর পারা যায় না; কিছু না, ওই একটা ছল; ওই সামান্য সূত্র ধরিয়া এখনি সে একটা রাম রাবণের যুদ্ধ বাধাইয়া তুলিবে।

কিশোরী বলিল—যা খুশি কালকে কোরো—এখন একটু ঘুমুতে দাও। ঘুমুচ্ছিলে বলেই আর ডাকিনি এই তো অপরাধ? তা বেশ, কাল থেকে ওঠাব, চুলের নড়া ধরে ওঠাব।

সুশীলা কথাও বলিল না, মুখও তুলিল না, বালিশে মুখ গুঁজিয়া পড়িয়া রহিল।

পরদিন সকালে উঠিয়া রামতনু মুখুয্যে শুনিলেন, চৌধুরীরা খবর পাঠাইয়াছে কয়েকটি নতুন সাক্ষীর তালিম দিতে হইবে। যাইবার সময় তিনি বলিলেন—ও বউমা। একটু সকাল সকাল ভাত দিয়ো, কোর্টে যেতে হবে।

বেলা নয়টার সময় ফিরিয়া আসিয়া দেখিলেন—সুশীলা স্নান করিয়া আসিয়া রৌদ্রে কাপড় মেলিয়া দিতেছে, গৃহিণী মোক্ষদাসুন্দরী রান্নাঘরে বসিয়া রাঁধিতেছেন। স্বামীকে দেখিয়াই মোক্ষদা চৌকিদার হাঁকার সুরে বলিতে লাগিলেন—হয় আমি একদিকে বেরিয়ে যাই, না-হয় বাপু এর বিহিত করো। সেই সকাল থেকে ঘুরপাক দিয়ে দিয়ে বেড়াচ্ছে, বলছি—ও বউমা, দুটো ভাত চড়িয়ে দাও, ওগো যা হয় দুটো-কিছু রাঁধো—হাতে-পায়ে ধরতে কেবল বাকি রেখেছি। কার কথা কে শোনে?—এই বেলা-দুপুরের সময় রানি এখন এলেন নেয়ে…

সুশীলা রক হইতেই সমান গলায় উত্তর দিল—মাইনে করা দাসী তো নই, আমি যখন পারব রান্না চড়াব—সকাল থেকে বসে আছি নাকি? এত খাটুনি সেরে আবার আটটার মধ্যে ভাত দেব—মানুষের তো আর শরীর নয়—যার না-চলবে সে নিজে গিয়ে বেঁধে নিক।…

একথার উত্তরে মোক্ষদা খুন্তি হাতে রান্নাঘরের দাওয়ায় আসিয়া নটরাজ শিবের তাণ্ডব নর্তনের একটা আধুনিক সংস্করণ শুরু করিতে যাইতেছিলেন—একটা ঘটনায় তাহা বন্ধ হইয়া গেল।

একটা দশ-বারো বৎসরের ছেলে, রংটা বড়োই কালো, ম্যালেরিয়ায় শরীর জীর্ণ শীর্ণ, পরনে অতিময়লা এক গামছা, শীতের দিনেও তাহার গায়ে কিছু নাই, হাতে ছোটো একটা বাখারির ছড়ি লইয়া বাড়ির মধ্যে ঢুকিল। ছেলেটি পাশের গ্রামের আতর আলি ঘরামির ছেলে, গতবৎসর তার বাপ মারা গিয়াছে, দুটি ছোটো ছোটো বোন আর মা ছাড়া তার আর কেহ নাই। অবস্থা খুব খারাপ, সবদিন খাওয়া জোটে না, ছেলেটা পিঠে ছড়ি বাজাইয়া হাপু গাহিয়া মা ও বোন দুটিকে প্রতিপালন করে। সে এ-গ্রামের প্রায় সব বাড়িতে আসিত কিন্তু মুখুয্যে-বাড়ি আর কখনো আসে নাই। তাহার একটা কারণ এই যে, দানশীলতার জন্য রামতনু মুখুয্যে গ্রামের মধ্যে আদৌ প্রসিদ্ধ ছিলেন না।

ছেলেটি উঠোনে দাঁড়াইয়া বগল বাজাইয়া নানারূপ সুর করিয়া উচ্চৈ:সুরে হাপু গাহিতে লাগিল। সঙ্গে সঙ্গে পিঠে জোর করিয়া লাঠির বাড়ি মারিতে লাগিল।

তিনটি নেহাত গোবেচারি সাক্ষীর তালিম দিতে অনেক ধস্তাধস্তি করিয়া রামতনুর মেজাজ ভালো ছিল না, ফিরিয়া চাহিয়া দেখিয়া মুখ খিঁচাইয়া বলিলেন— থাম—থাম ও-সব রাখ—এখন ও-সব দেখবার শখ নেই—যা অন্য বাড়ি দেখগে যা—যা…

সুশীলা কাপড় মেলিয়া দিতে দিতে অবাক হইয়া হাপু গাওয়া দেখিতেছিল— ছেলেটি সংকুচিত হইয়া বাহিরে যাইতেই সে তাড়াতাড়ি বাহিরের রকে গিয়া তাহাকে ডাকিয়া বলিল— শোন, তোর বাড়ি কোথায় রে?

—হরিপুর মা-ঠাকরুন।

—তোর বাড়িতে কে আছে আর?

—মোর বাপ মারা গিয়েছে আর-বছর মা-ঠাকরুন—মোদের আর কেউ নাই, মুই বড়ো, ছোটো দুটো বোন আছে…

–তাই বুঝি তুই হাপু গাস? হ্যাঁ রে, এতে চলে?

রামতনুর ধমক খাইয়া ছেলেমানুষ অত্যন্ত দমিয়া গিয়াছিল, সুশীলার কথার ভিতর সহানুভূতির সুর চিনিয়া লইয়া হঠাৎ তাহার কান্না আসিল—চোখের জল হু হু করিয়া পড়িতেই ম্যালেরিয়া-শীর্ণ হাতটি তুলিয়া চোখ মুছিয়া বলিল—না মা ঠাকরুন, চলে না। এসব লোকে আর দেখতে চায় না। মুই যদি ভালো গান গাইতে পারতাম তো যাত্রার দলে যাতাম, বড়ো কষ্ট মোদের সংসারে—এই শীতি মা ঠাকরুন…

সুশীলা বাধা দিয়া বলিল—দাঁড়া, আমি আসছি।

ঘরের মধ্যে ঢুকিয়া কান্নার বেগ অতিকষ্টে সামলাইয়া চাহিয়া দেখিল আলনায় একখানা নতুন মোটা বিছানার চাদর ঝুলিতেছে, হাতের গোড়ায় সেইখানা পাইয়া টানিয়া লইল। তারপর জানালা দিয়া বাড়ির মধ্যে চাহিয়া দেখিয়া চাদরখানা তাড়াতাড়ি ছেলেটির হাতে দিয়া চুপি চুপি বলিল—এইখানা নিয়ে যা, এতে শীত বেশ কাটবে। কাটবে না? খুব মোটা। শিগগির যা, কেউ যেন না-দেখে…

ছেলেটা চাদর হাতে হতবুদ্ধি হইয়া ইতস্তত করিতেছে দেখিয়া সুশীলা বলিল— ওরে এক্ষুনি কে এসে পড়বে, শিগগির যা…

ছেলেটাকে বিদায় দিয়া সুশীলা ভিতর-বাড়িতে ঢুকিয়া দেখিল শ্বশুর আহার করিতে বসিয়াছেন। ছেলেটার দুঃখে সুশীলার মন খুব নরম হইয়া গিয়াছিল সে গিয়া রান্নাঘরে ঢুকিয়া কাজে মন দিল, শ্বশুরকে জিজ্ঞাসা করিল—আপনাকে কিছু দেব বাবা?

মোক্ষদা ঝংকার দিয়া উঠিলেন—তোমাকে আর কিছু দিতে হবে না, যে মিষ্টি বচন দিয়েছ তাতেই প্রাণ ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে, নাও এখন পারো তো এদিকে এসো একবার, হাঁড়িটা দেখো, নয় তো বলো নিজে মরি-বাঁচি একরকম করে সাঙ্গ করে তুলি।

রামতনু কোনো কথা বলিলেন না, আপন মনে খাইয়া উঠিয়া চলিয়া গেলেন। এইসব ব্যাপারেই সুশীলা অত্যন্ত চটিয়া যাইত, রামতনু পুত্রবধূর নিকট কোনো জিনিস চাহিয়া খাইলে তাহার রাগ গলিয়া জল হইয়া যাইত, কিন্তু লোকে তাহাকে জব্দ করিতেছে অপমান করিবার ফন্দি খুঁজিতেছে ভাবিলে তাহার আর কাণ্ডজ্ঞান থাকিত না, সেও কোমর বাঁধিয়া রণে আগুয়ান হইত। সেই বা ছাড়িবে কেন?

 

মাস-দুই পরে।

ফাল্গুন মাসের মাঝামাঝি, কিন্তু বেশ গরম পড়িয়াছে। কিশোরী অনেক রাত্রে বাড়ি ফিরিয়াছে। বাড়িতে যে-যাহার ঘরে ঘুমাইতেছে। সে নিজের ঘরে ঢুকিয়া দেখিল সুশীলা ঘরের মেঝেয় বসিয়া একখানা চিঠি লিখিতেছে। কিশোরী সুশীলাকে জিজ্ঞাসা করিল—কাকে চিঠি লেখা হচ্ছে?

সুশীলা চিঠির কাগজখানা তাড়াতাড়ি আঁচল দিয়া চাপিয়া স্বামীর দিকে ফিরিয়া একটু দুষ্টামির হাসি হাসিল, বলিল—বলো কেন?

-–থাক, না বলো, ভাত দাও। রাত কম হয়নি। আবার সকাল থেকেই খাটুনি আরম্ভ হবে।

সুশীলা ভাবিয়াছিল স্বামী আসিয়া সে কি লিখিতেছে দেখিবার জন্য পীড়াপীড়ি আরম্ভ করিবে। প্রকৃতপক্ষে সে চিঠি কাহাকেও লিখিতেছে না, স্বামীকে কথা বলাইবার এ তার একটা পুরোনো কৌশল মাত্র। অনেক দিন সে স্বামীর মুখে দুটো ভালো কথা শুনে নাই, তাহার নারীহৃদয় ইহারই জন্য তৃষিত ছিল এবং ইহারই জন্য সে ঘুমে ঢুলিতে ঢুলিতেও এই সামান্য ফাঁদটি পাতিয়া বসিয়া ছিল—কিন্তু কিশোরী ফাঁদে পা দেওয়া দূরে থাকুক, সেদিকে ঘেঁষিলও না দেখিয়া সুশীলা বড়ো নিরুৎসাহ হইয়া পড়িল।

কাগজ-কলম তুলিয়া রাখিয়া সে স্বামীর ভাত বাড়িয়া দিল। একপ্রকার চুপচাপ অবস্থায় আহারাদি শেষ করিয়া কিশোরী গিয়া শয্যা আশ্রয় করিবার পর, সে নিজে আহারাদি করিয়া শুইতে গিয়া দেখিল কিশোরী ঘুমায় নাই, গরমে এপাশ-ওপাশ করিতেছে। আশায় বুক বাঁধিয়া সে তাহার দ্বিতীয় ফাঁদটি পাতিল।

—একটা গল্প বলো না? অনেকদিন তো বলোনি, বলবে লক্ষ্মীটি…

বিবাহের পর প্রথম কিশোরী তাহার স্ত্রীর নিকট বটতলার আরব্য উপন্যাস হইতে নানা গল্প বলিত। রাত্রির পর রাত্রি তখন এসব গল্প শুনিয়া সুশীলা মুগ্ধ হইয়া যাইত। জনহীন দেশের মধ্যে যেখানে শুধু জিন-পরিদের জগৎ… খেজুর বনের মধ্যে ঠান্ডা জলের ফোয়ারা হইতে মণিমুক্তা উৎক্ষিপ্ত হইতেছে…পথহীন দুরন্ত মরুপ্রান্তরে মৃত্যু যেখানে শিকার সন্ধানে ওঁত পাতিয়া বসিয়া আছে, সমুদ্রের ঝড়…তরুণ শাহজাদাগণের দৈত্যসংকুল অরণ্যের মাঝখান দিয়া নির্ভীক শিকারযাত্রা—এসব শুনিতে শুনিতে তাহার গা শিহরিয়া উঠিত, ঘুম ভাঙিলে ঘরের মধ্যে অর্ধরাত্রির অন্ধকার বিকটাকার জীবদেহের ভিড়ে ভরিয়া গিয়াছে মনে করিয়া ভয়ে সে স্বামীকে জড়াইয়া ধরিত। প্রাচীন যুগের তরুণ শাহজাদাদের কল্পনা করিতে গিয়া অজ্ঞাতসারে সে নিজের স্বামীকে যাত্রার দলের রাজার পোশাক পরাইয়া দূরদেশে বিপদের মুখে পাঠাইত, শাহজাদাদিগের দুঃখে তাহার নিজের স্বামীর উপর সহানুভূতিতেই তাহার চোখে জল আসিত। এইরকমে গল্প শুনিতে শুনিতে অদৃশ্য নায়ক-নায়িকাদের গুণ দৃশ্যমান গল্পাকারের উপরে প্রয়োগ করিয়া সে স্বামীকে প্রথম ভালোবাসে। সে আজ পাঁচ-ছয় বৎসরের কথা, কিন্তু সুশীলার এখনও সে ঘোর কাটে নাই।

কিশোরী স্ত্রীর কথা উড়াইয়া দিল—হ্যাঁ, এখন গল্প বলো! সমস্ত দিন খেটেখুটে এলাম, এখন রাতদুপুরে বকবক করি আর কি। তোমাদের কী? বাড়ি বসে’ সব পোষায়।

অন্য মেয়ে হইলে চুপ করিয়া যাইত। সুশীলার মেজাজ ছিল একগুঁয়ে। সে আবার বলিল, তা হোক, একটা বলো, রাত এখন তো বেশি নয়…

—না বেশি নয়—তোমার তো রাত কম-বেশির জ্ঞান কত! নাও, চুপচাপ শুয়ে পড়ো এখন…

সুশীলা এইবার জিদ ধরিল—বলো না একটা, ছোটো দেখেই না-হয় বলো— এত করে বলছি একটা কথা রাখতে পারো না?

কিশোরী বিরক্ত হইয়া বলিল—আ :! এ তো বড়ো জ্বালা হল! রাতেও একটু ঘুমুবার জো নেই—সমস্ত দিন তো গলাবাজিতে বাড়ি সরগরম রাখবে, রাত্তিরটাও একটু শান্তি নেই?

এইটাই ছিল সুশীলার ব্যথার স্থান। স্বামীর মুখে এ কথা শুনিয়া সে ক্ষেপিয়া গেল—বেশ করি গলাবাজি করি, তাতে অসুবিধা হয় আমাকে পাঠিয়ে দাও এখান থেকে—রাতদুপুর করলে কে! নিজে আসবেন রাতদুপুরের সময় আড্ডা দিয়ে কে এত রাত পর্যন্ত ভাত নিয়ে বসে থাকে? নিজেরই দেহ, পরের আর তো দেহ না! খেটেখুটে এসে একেবারে রাজা করেছেন আর কি? নিজের খাটুনিটাই কেবল…

কিশোরী ঘুমাইবার চেষ্টা পাইতেছিল, স্ত্রীর উত্তরোত্তর চড়া সুরে তাহার ধৈর্যচ্যুতি ঘটিল—উঠিয়া বসিয়া প্রথমে সে স্ত্রীর পিঠে সজোরে ঘা-কতক পাখার বাঁট বসাইল, তাহার পর তাহার চুলের মুঠি ধরিয়া বিছানার উপর হইতে নামাইয়া ধাক্কা মারিয়া ঘরের বাহির করিয়া দিল, বলিল—বেরো, ঘর থেকে বেরো, আপদ

—দূর হ—রাতদুপুরেও একটু শান্তি নেই—যা বেরো—যেখানে খুশি যা…

ঘরের আলোর কাছে আসিয়া কিশোরী দেখিল স্ত্রী দুই হাতের নখ দিয়া আঁচড়াইয়া তাহার হাতের আঙুলগুলিতে রক্তপাত করিয়া দিয়াছে।

ইরানি শাহজাদাগণের নজির না-থাকিলেও কিশোরী মধ্যে মধ্যে দুরন্ত স্ত্রীর প্রতি এরূপ ঔষধি প্রয়োগ করিত।

শেষরাত্রে একাদশীর জ্যোৎস্নায় চারিদিক যখন ফুলের পাপড়ির মতো সাদা, ভোর রাত্রের বাতাস নেবু-ফুলের গন্ধে আর পাপিয়ার গানে মাখামাখি, সুশীলা তখন ঘরের দোরের বাহিরে আঁচল পাতিয়া অকাতরে ঘুমাইতেছিল।

সকাল হইলে যে-যার কাজে মন দিল। মোক্ষদা বলিলেন—বউমা, আজ চৌধুরীরা শিবতলায় পুজো দিতে যাবে, আমাদের যেতে বলেছে, সকাল-সকাল সেরে নাও।

এই চৌধুরীটি ছিলেন প্রকৃতপক্ষে রামতনু মুখুয্যের প্রতিপালক, হঁহারাই গ্রামের জমিদার এবং ইহাদেরই জমিজমা সংক্রান্ত মোকদ্দমার তদবির ও সাহায্য করিয়া রামতনু অন্নসংস্থান করিতেন।

বেলা দশটার মধ্যে আহারাদি শেষ করিয়া ভালো কাপড় পরিয়া সকলে নৌকায় উঠিল— দুই ঘণ্টার পথ। চৌধুরী-বাড়িতে কলিকাতা হইতে একটি বউ আসিয়াছিল। তাহার স্বামী বড়োলোকের ছেলে এম-এ পাস করিয়া বছর-দুই হইল ডেপুটিগিরি চাকরি পাইয়াছে। বউটি কলিকাতার মেয়ে, চৌধুরীদের সহিত তাহার স্বামীর কীরূপ সম্পর্ক আছে, এজন্য চৌধুরীগৃহিণী রাসপূর্ণিমার সময় তাহাকে আনাইয়াছিলেন। ইতিপূর্বে সে কখনো পাড়াগাঁয়ে আসে নাই। নৌকায় খানিকটা বসিয়া থাকিবার পর বউটি দেখিল, নীলাম্বরী কাপড় পরনে তাহারই সমবয়সি আর-একটি বউ নৌকায় উঠিল। নৌকা ছাড়িয়া দিল, নৌকায় সমবয়সি সঙ্গিনী পাইয়া কলিকাতার বউটি খুব সন্তুষ্ট হইলেও প্রথমে আলাপ করিতে বাধ-বাধ ঠেকিতে লাগিল। সঙ্গিনীর কাপড়চোপড় পরিবার আগোছাল ধরন দেখিয়া বউটি বুঝিয়াছিল তাহার সঙ্গিনী নিতান্ত পাড়াগাঁয়ের মেয়ে, অবস্থাও খুব ভালো নয়। নৌকার ওধারে চৌধুরীগৃহিণী মোক্ষদার সহিত সাবিত্রী-ব্রত প্রতিষ্ঠার কী আয়োজন করিয়াছেন, তাহারই বিস্তৃত বড়োমানুষি ফর্দ আবৃত্তি করিতেছিলেন। নৌকায় কোনো পরিচিত মেয়েও নাই, কাজেই বউটি অনেকক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। বউটি লেখাপড়া জানিত এবং দেশ-বিদেশের খবরাখবরও কিছু কিছু রাখিত— চৌধুরীগৃহিণীর একঘেয়ে বড়োমানুষি চালের কথাবার্তায় সে বড়ো বিরক্ত হইয়া উঠিল। খানিকক্ষণ বসিয়া থাকিবার পর সে লক্ষ করিল তাহার সঙ্গিনী ঘোমটার ভিতর হইতে কালো-কালো ডাগর চোখে তাহার দিকে সকৌতুকে চাহিতেছে। বউটির হাসি পাইল, জিজ্ঞাসা করিল—তোমার নাম কী ভাই?

সুশীলা সন্দিগ্ধ সুরে বলিল—শ্রীমতী সুশীলাসুন্দরী দেবী।

সুশীলার রকম-সকম দেখিয়া বউটির খুব হাসি পাইতে লাগিল। সে বলিল— এত ঘোমটা কীসের ভাই? তুমি আর আমি ছাড়া তো আর কেউ এদিকে নেই, নাও এসো, ঘোমটা খোলো, একটু গল্প করি।

এই কথা বলিয়া বউটি নিজেই সুশীলার ঘোমটা খুলিয়া দিল—সুশীলার সুন্দর মুখের দিকে চাহিয়া সে যেন মুগ্ধ হইয়া গেল; রং যদিও ততটা ফরসা নয়, কিন্তু কালোর উপর অত শ্রী সে কখনো দেখে নাই, নদীর ধারের সরস সতেজ চিক্কণ শ্যাম-কলমিলতারই মতো একটা সবুজ লাবণ্য যেন সারা মুখখানায় মাখানো। মুখখানি দেখিয়াই সে এই নিরাভরণা পাড়াগাঁয়ের মেয়েটিকে ভালোবাসিয়া ফেলিল। জিজ্ঞাসা করিল—উনি বসে আছেন কে ভাই, শাশুড়ি?

—হ্যাঁ।

–এসো, আর একটু সরে এসো ভাই, দুজনে গল্প করি আর দেখতে দেখতে যাই। তোমার বাপেরবাড়ি কোথায় ভাই?

সুশীলার ভয় কাটিয়া যাইতেছিল, সে বলিল—সে হল শিমলে।

—কোন শিমলে? কলকাতা শিমলে?

কলকাতায় শিমলে আছে নাকি? কই তাহা তো সুশীলা কোনোদিন শোনে নাই। সে বলিল—আমার বাপেরবাড়ি এখান থেকে বেশি দূর নয়, পাঁচ-ছ ক্রোশ পথ, গোরুরগাড়ি করে যেতে হয়।

নদীর ধারে যবখেত, সর্ষেখেত, বুনো গাছপালা দেখিয়া বউটি খুব খুশি। এসব সে পূর্বে বড়ো দেখে নাই, আঙুল দিয়া একটা মাছরাঙা পাখি দেখাইয়া বলিল— বাঃ বড়ো সুন্দর তো! ওটা কী পাখি ভাই?

–ওটা তো মাছরাঙা পাখি, তুমি দেখোনি কখনো?

বউটি বলিল—ভাই, আমি কলকাতার বাইরে অ্যাদ্দিন পা দিইনি, খুব ছেলেবেলায় একবার বাবার সঙ্গে চন্দননগরে বাগানবাড়িতে যাবার কথা মনে আছে, তারপর এই আসছি—তুমি আমায় একটু দেখিয়ে নিয়ে চলো। এটা কীসের খেত ভাই?

সুশীলা দেখিল তাহার সঙ্গিনী আঙুল দিয়া নদীর ধারের একটা মৌরীর খেত দেখাইতেছে—প্রথমটা সে সঙ্গিনীর চোখ-ঝলসানো রং, অদৃষ্টপূর্ব দামি সিল্কের শাড়ি, ব্লাউজ এবং চিকচিকে নেকলেসের বাহার দেখিয়া যে ভয় অনুভব করিতেছিল, তাহার অজ্ঞতা দেখিয়া সুশীলার সে ভয় কাটিয়া অজ্ঞ সঙ্গিনীর উপর একটু স্নেহ আসিল—কলিকাতায় মাছরাঙা পাখি, মৌরীখেত, এসব সামান্য জিনিসও নাই নাকি? সুশীলা হাসিয়া বলিল—তুমি ফুলের গন্ধ দেখে বুঝতে পারো না ভাই? ও তো মৌরীর খেত। কেন, আমাদের বাপেরবাড়ির গাঁয়ে কত তো মৌরীর খেত আছে—মৌরীর শাক কখনো খাওনি? কলকাতায় বুঝি নেই?

কলিকাতার বউটি বুঝাইয়া দিল যে কলিকাতার অতীত ইতিহাসের সে খবর রাখে না, বর্তমান অবস্থায় সেখানে মৌরীখেত প্রভৃতি থাকা সম্ভবপর নয়, তবে ভবিষ্যতে কী হয় বলা যায় না।

ঘণ্টাখানেক পরে যখন নৌকা শিবতলার ঘাটে গিয়া লাগিল, তখন তাহাদের দুজনের মধ্যে অনেক ঘনিষ্ঠ রকমের কথাবার্তা হইয়া গিয়াছে। সঙ্গিনীর মুখে স্বামীর আদরের গল্প শুনিয়া সুশীলার মনের মধ্যে একটা গোপন ব্যথা জাগিয়া উঠিল—সেটা সে অনবরত চাপিবার চেষ্টা করে, তবু কী জানি সেটা ফাঁক পাইলেই মাথা তোলে। প্রথম বিবাহের পর তাহার স্বামীও তো তাহাকে কত আদর করিত, রাত্রে ঘুমাইতে না-দিয়া নানা গল্পে ভুলাইয়া জাগাইয়া রাখিত, সুশীল পান খাইতে চাহিত না বলিয়া কত সাধ্যসাধনা করিয়া পান মুখে তুলিয়া দিত— সেই স্বামী তাহার কেন এমন হইল? তাহার বুকটার মধ্যে কেমন হু হু করিয়া উঠিল।

দুজনে তাহারা খানিকক্ষণ গাছের ছায়ায় নদীর ধারে এদিকে-ওদিকে বেড়াইল, কী সুন্দর দেখায় চারিদিক!…নীল আকাশ সবুজ মাঠের উপর কেমন উপুড় হইয়া আছে!…ওমা, পানকৌড়ির ঝাঁক চরের উপর বসিয়া বসিয়া কেমন ঝিমায়!…

কলিকাতার বউটি বলিল—এসো ভাই, আমরা একটা কিছু পাতাই। কেমন?

সুশীলা খুশি হইয়া বলিল—খুব ভালো ভাই, কি পাতাব বলো?…

—এক কাজ করি এসো—আসতে আসতে নদীর ধারে যে মৌরীফুল দেখে এলাম, এসো আমরা দুজনে পাতাই। কেমন!

সুশীলা আহ্লাদের সঙ্গে এ প্রস্তাবে সম্মতি দিল। নদী হইতে অঞ্জলি করিয়া জল তুলিয়া তাহারা মৌরীফুল পাতাইল।

এমন সময় মোক্ষদা ডাকিলেন—বউমারা এদিকে এসো।

তাহারা গিয়া দেখিল গাছতলায় অনেক লোক—সেদিন পূজা দিতে অনেক লোক আসিয়াছিল। প্রকাণ্ড বটগাছ, তলায় ভাঙা ইটের মন্দির। গাছতলা হইতে একটু দূরে এক বুড়ি নানা ঔষধ বিক্রয় করিতেছে। সুশীলা ও তাহার সঙ্গিনী সেখানে গিয়া জিজ্ঞাসা করিয়া জানিল, রোগ সারা, ছেলে হওয়া হইতে শুরু করিয়া সকল রকমের ঔষধই আছে, গোরু হারাইলে খুঁজিয়া বাহির করিবার পর্যন্ত। মেয়েরা সেখানে ভিড় করিয়া দাঁড়াইয়া ঔষধ কিনিতেছে। সুশীলারসঙ্গিনী হাসিয়া তাহার হাত ধরিয়া টানিয়া তাহাকে সেখান হইতে মন্দিরের দিকে লইয়া চলিল, বলিল—চলো মৌরীফুল, দেখিগে কেমন পুজো হচ্ছে।

একটুখানি মন্দিরে দাঁড়াইয়া সুশীলা একটা ছুতায় সেখান হইতে বাহির হইয়া আসিয়া ঔষধ-বেচা বুড়ির নিকট দাঁড়াইল। সেখানে তখন কেহ ছিল না, বুড়ি বলিল—কী চাই?

সুশীলার মুখ লজ্জায় আরক্ত হইয়া উঠিল।

বুড়ি বলিল—আর বলতে হবে না মা-ঠাকরুন। তা তোমার তো এখনও ছেলে পিলে হবার বয়েস যায়নি, ও বয়েসে অনেকের…

সুশীলা সলজ্জভাবে বলিল—তা নয়।

বুড়ি বলিল—এবার বুঝলাম মা-ঠাকরুন—তা যদি হয়, তাহলে তোমার সোয়ামীর বারমুখো টান আছে। একটা ওষুধ দিই, নিয়ে যাও, একমাসের মধ্যে সব ঠিক হয়ে যাবে—সব ঠিক হয়ে যাবে—ও-রকম কত হয় মা-ঠাকরুন।

বুড়ি একটা শিকড় তুলিয়া বলিল—এই নাও, বেটে খাইয়ে দিয়ো। যেন কেউ টের না-পায়, টের পেলে আর ফল হবে না। আট আনা লাগবে।

স্বামীর বার-মুখো টান আছে—এ-কথা শুনিয়া সুশীলা খুব দমিয়া গেল। তাহার আঁচলে একটা আধুলি বাঁধা ছিল, আজকার দিনে জিনিসটা-আসটা কিনিবার জন্যে সে ইহা বাড়ি হইতে শাশুড়িকে লুকাইয়া আনিয়াছিল। বাড়ির বার হওয়া তো বড়ো ঘটে না, কাজেই এটা তাহার পক্ষে একটা উৎসবের দিন। আধুলিটি শাশুড়িকে লুকাইয়া আনিবার কারণ—মোক্ষদা ঠাকরুন জানিতে পারিলে ইহা এতক্ষণ তাহার আঁচলে থাকিত না। সুশীলা আঁচল হইতে আধুলিটি খুলিয়া বুড়িকে দিল এবং খাওয়াইবার প্রণালী জানিয়া লইয়া শিকড়টি কাপড়ের মধ্যে গোপনে

বাঁধিয়া লইল।

পূজা দেওয়া সাঙ্গ হইয়া গেল। সকলে আবার আসিয়া নৌকায় উঠিল। গ্রামের ঘাটের কাছাকাছি আসিলে সুশীলা বলিল—ভাই, তুমি এখন দিনকতক আছ তো?

—না ভাই, আমি কাল কী পরশু চলে যাব। তাহলেও তোমায় ভুলব না মৌরীফুল, তোমার মুখখানি আমার মনে থাকবে ভাই—চিঠিপত্র দেবে তো? এবার পাড়াগাঁয়ে এসে তোমায় কুড়িয়ে পেলাম—তোমায় কখনো ভুলব না।

সুশীলার চোখে জল আসল, এত মিষ্ট কথা তাহাকে কে বলে? সে কেবল শুনিয়া আসিতেছে সে দুঙ্কু, একগুঁয়ে ঝগড়াটে।

তাহার হাতে একটি সোনার আংটি ছিল, ইহা তাহার মায়ের দেওয়া আংটি, বিবাহের পর প্রথম তাহার মা তাহার হাতে এটি পরাইয়া দিয়াছিলেন। সেটি হাত হইতে খুলিয়া সে সঙ্গিনীর হাত ধরিয়া বলিল—দেখি ভাই তোমার আঙুল, তুমি হলে মৌরীফুল, তোমায় খাওয়াবার কথা, কাপড় দেওয়ার কথা—এই আংটিটা আমার মায়ের দেওয়া, তোমায় দিলাম, তবু এটা দেখে তুমি গরিব মৌরীফুলকে ভুলে যাবে না।

সুশীলা আংটিটা সঙ্গিনীর হাতে পরাইয়া দিতে গেল,—বউটি চট করিয়া হাত টানিয়া লইয়া বলিল—দূর পাগল! না ভাই এ রাখখা—তোমার মায়ের দেওয়া

আংটি—এ কেন আমায় দিতে যাবে? না ভাই…

সুশীলা জোর করিতে গেল—হোক ভাই, দেখি—মায়ের দেওয়া বলেই… বউটি বলিল—দূর! না ভাই ও-সব রাখখা—সে বরং…

সুশীলা খুব হতাশ হইল। মুখটি তাহার অন্ধকার হইয়া গেল—সে চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। গ্রামের ঘাটে নৌকা লাগিল। বউটি সুশীলার হাত ধরিয়া বলিল— পায়ে পড়ি ভাই মৌরীফুল, রাগ কোরো না। আচ্ছা, কেন তুমি শুধু শুধু তোমার মায়ের দেওয়া আংটি আমায় দিতে যাবে ভাই? আচ্ছা, তুমি যদি দিতেই চাও, এই পুজোর সময় আসব—অন্য কিছু বরং দিয়ো—একদিন না-হয় খাইয়ো—আংটি কেন দেবে ভাই!—আর আমায় ভুলবে না তো ভাই?

সুশীলা ব্যগ্রভাবে বলিল—তোমায় ভুলব না ভাই মৌরীফুল! কখখোনন না— তুমি কোন জন্মে যে আমার মায়ের পেটের বোন ছিলে ভাই মৌরীফুল…

তাহার পরে সে একটু আনাড়ি ধরনে হাসিয়া উঠিল—হিঃ হিঃ হিঃ! কেমন সুন্দর কথাটি—মৌরীফুল—মৌরীফুল—মৌরীফুল—তুমি যে হলে গিয়ে আমার নদীর ধারের মৌরীফুল—তোমায় কি ভুলতে পারি?…

কথা শেষ না-করিয়াই সে দুই হাতে সঙ্গিনীর গলা জড়াইয়া ধরিল, সঙ্গে সঙ্গে তাহার কালো চোখ দুটি জলে ভরিয়া গেল।

কলিকাতার বড়ো এই অদ্ভুত প্রকৃতির সঙ্গিনীর অশ্রুপ্লাবিত সুন্দর মুখখানা বার বার সস্নেহে চুম্বন করিল—তারপর দুজনেই চোখের জলে ঝাপসাদৃষ্টি লইয়া দুজনের কাছে বিদায় লইল।…

দিন কতক কাটিয়া গেল। কিশোরী বাটী নাই, কী-একটা কাজে অন্য গ্রামে। গিয়াছে, ফিরিতে দু-একদিন দেরি হইবে। মোক্ষদা সকালে উঠিয়া জমিদার-গৃহিণীর আহ্বানে তাঁহার সাবিত্রী-ব্ৰত-প্রতিষ্ঠার আয়োজনে সাহায্য করিতে চৌধুরী-বাড়ি চলিয়া গেলেন। যাইবার সময় বলিয়া গেলেন—বউমা আমার ফেরবার কোনো ঠিক নেই, রান্না-বান্না করে রেখো, আমি আজ আর কিছু দেখতে পারব না, চৌধুরী-বাড়ির কাজ—কখন মেটে বলা যায় না।

এ কথা মোক্ষদার না-বলিলেও চলিত। কারণ ভোরে উঠিয়া বাসন-মাজা, জল তোলা হইতে আরম্ভ করিয়া এ সংসারের সমস্ত কাজের ভারই ছিল সুশীলার উপর। এ সংসারে কিশোরীর বিবাহের পর কোনোদিন ঝি-চাকর প্রবেশ করে নাই —যদিও পূর্বে বাড়িতে বরাবরই একজন করিয়া ঝি থাকিত। সুশীলার খাটুনিতে কোনো ক্লান্তি ছিল না, খাটিবার ক্ষমতা তাহার যথেষ্ট ছিল—যখন মেজাজ ভালো থাকিত, তখন সমস্ত দিন নীরবে ভূতের মতো খাটিয়াও সে বিরক্ত হইত না।

শাশুড়ি চলিয়া গেলে অন্যান্য কাজকর্ম সারিয়া সুশীলা রান্নাঘরে গিয়া দেখিল একখানিও কাঠ নাই। কাঠ অনেক দিনই ফুরাইয়া গিয়াছে, এ কথা সুশীলা বহুবার শ্বশুরকে জানাইয়াছে। রামতনু মধ্যে মধ্যে মজুর ডাকাইয়া কাঠ কাটাইয়া লইতেন, এবার কিন্তু অনেক দিন হইল তিনি আর এদিকে দৃষ্টি দেন নাই, কিশোরীর দোষ নাই, কেননা সে বড়ো একটা বাড়িতে থাকিত না, সংসারের সংবাদ তেমন রাখিতও না। আসল কথা হইতেছে এই যে রান্নাঘরের পিছনে খিড়কির বাহিরে অনেক শুকনা বাঁশ ও ডালপালা পড়িয়া আছে—সুশীলা রান্না চড়ানোর পূর্বে বা রান্না করিতে করিতে প্রয়োজন মতো এগুলি দা দিয়া কাটিয়া লইয়া কাজ চালাইত। রামতনু দেখিলেন, কাজ যখন চলিয়া যাইতেছে তখন কেন অনর্থক কাঠ কাটিবার লোক ডাকিয়া আনা—আনিলেই এখনই একটা টাকা খরচ তো? পুত্রবধূ বকিতেছে বকুক, কারণ বকুনিই উহার স্বভাব।

কাঠ নাই দেখিয়া সুশীলা অত্যন্ত চটিয়া গেল। এদিকে বাড়িতেও এমন কেহ নাই যাহাকে বকিয়া গায়ের ঝাল মিটায়, কাজেই সে আপন মনে চীৎকার করিতে লাগিল—পারব না, রোজ রোজ এমন করে সংসার করা আমায় দিয়ে হয়ে উঠবে না—আজ দু-মাস ধরে বলছি কাঠ নেই কাঠ নেই—এদিকে রান্নার বেলা ঠিক আছেন সব, তার একটু এদিক-ওদিক হবার জো নেই—কী দিয়ে রাঁধবে? হাত পা উনুনের মধ্যে দিয়ে রাঁধবে নাকি? রোজ রোজ কাঠ কাটো, কেটে রাঁধো—অত সুখে আর কাজ নেই—থাকল হাঁড়ি পড়ে, যিনি যখন আসবেন, তিনি তখন করে নেবেন…

রাঁধিবার কোনো আয়োজন সে করিল না। খানিকটা বসিয়া বসিয়া তাহার মনে হইল ততক্ষণ মশলাগুলা বাটিয়া রাখা যাক। সে মাঝে মাঝে কাজের সুবিধার জন্য কয়েকদিনের মশলা একসঙ্গে বাটিয়া রাখিত।

বেলা প্রায় দশটার সময় একটি অল্পবয়সি ফুটফুটে বউ, পরনে একখানা পুরোনো চেলীর কাপড়, হাতে থাকিবার মধ্যে দু-গাছি শাঁখা—একটি বাটি হাতে রান্নাঘরের দোরের কাছে ভয়ে ভয়ে উঁকি মারিয়া বলিল—দিদি আছ নাকি?

সুশীলা মশলা বাটিতে বাটিতে মুখ তুলিয়া চাহিয়া বলিল—আয় আয় ছোটো বউ—আয় না ঘরের মধ্যে—ঠাকরুন নেই…

বউটি ঘরে ঢুকিয়া বলিল—একি দিদি, এত বেলা হল এখনও রান্না চড়াওনি যে!

সুশীলা মুখ ঘুরাইয়া বলিল—রান্না চড়াব! হাঁড়িকুড়ি ভেঙে ফেলিনি এই কত!…

বউটির চোখে ভয়ের চিহ্ন পরিস্ফুট হইল, সে বলিল—না দিদি, ওসব কিছু কোরো না, ভাত চড়িয়ে দাও লক্ষ্মীটি, নইলে জানো তো কীরকম লোক সব…

—দেব—দেখবে সব আজ কীরকম মজা, রোজ রোজ কাঠ কাটব আর ভাত রাঁধব, উঃ!

—কাঠ নেই বুঝি? আচ্ছা, দা-খানা দাও দিদি, আমি দিচ্ছি কেটে।

—তোর কী দায় তুই দিতে যাবি? বোস ঠান্ডা হয়ে—যাদের গরজ আছে তারা নিজেরা বুঝুক গিয়ে…।

—তোমার পায়ে পড়ি দিদি, দাও রান্নাটা চড়িয়ে, জানো তো ওরা…

—তুই বোস দেখি ওখানে চুপ করে, দেখিস এখন মজা—আজ দু-মাস ধরে রোজ বলছি কাঠ নেই, কথা কানে যায় না কারুর—আজ মজাটি দেখাব…

সুশীলার একগুঁয়েমিতে বউটি কিছু ভীতা হইল, কারণ মজা কোন পক্ষ দেখিবে এ সম্বন্ধে তাহার একটু সন্দেহ ছিল। কিন্তু সাহস করিয়া আর কিছু বলিতে না পারিয়া সে চুপ করিয়া রহিল।

এই বউটি রামতনু মুখুয্যের জ্যাঠতুতো ভাই রামলোচন মুখুয্যের পুত্রবধূ। পাশেই এদের বাড়ি। রামলোচনের অবস্থা খুবই খারাপ—তা সত্বেও তিনি বছর দুই হইল ছেলের বিবাহ দিয়েছেন—রামলোচনের স্ত্রী ছিল না, পুত্রবধূই গৃহিণী। দুরবস্থায় সংসারে ছেলেমানুষ বউকে সংসার করিতে অত্যন্ত বেগ পাইতে হইত, সে সময়ে-অসময়ে বাটি হাতে খুঁচি হাতে এ বাড়িতে হাত পাতিয়া তেলটা নুনটা লইয়া যাইত, চাউল না-থাকিলে আঁচলে করিয়া চাউল লইয়া যাইত—ধার বলিয়াই লইয়া যাইত—কখনও শোধ করিতে পারিত, কখনও পারিত না।

মোক্ষদা ঠাকরুনকে বউটি বড়ো ভয় করে তিনি থাকিলে জিনিসপত্র তো দেনই না, যদি বা দেন তাহা বহু মিষ্ট বাক্যবর্ষণ করিবার পর। তবু বউটির আসিতে হয়, কী করিবে, অভাব। সুশীলা তাহাকে মোক্ষদা ঠাকরুনের হাত হইতে বাঁচাইয়া গোপনে এটা-ওটা যখন যাহা দরকার সাধ্যমতো সাহায্য করিত। সামান্য একবাটি তেল লইয়া গেলেও হুঁশিয়ার মোক্ষদা ঠাকরুন তাহা কখনও ভুলিতেন না —গলা টিপিয়া কড়া-ক্রান্তিতে তাহা আদায় করিয়া ছাড়িতেন। সুশীলা ছিল অগোছাল ও অন্যমনস্ক ধরনের মানুষ, সে ধার দিয়া অতশত মনেও রাখিত না, বা সামান্য তেল-নুন ধার দিয়া আদায় করিবার কোন চেষ্টাও করিত না—শোধ দিতে আসিলে অনেক সময় বলিত—ওই তুই আবার দিতে এলি কেন ভাই ছোটো বউ, ওর আবার নেব কী? যা, ও তুই নিয়ে যা ভাই।

সুশীলা আপন মনে খানিকক্ষণ বকিয়া বউটির দিকে চাহিয়া বলিল—তারপর, তোর রান্নাবান্না?

বউটি বাটিটা আঁচল দিয়া ঢাকিয়া রাখিয়াছিল, বাহির করিয়া কুণ্ঠিতভাবে বলিল —সেদিনকার সেই তেল নিয়ে গিয়েছিলাম দিদি, তা আমাদের এখনও আনা হয়নি। আজ রাঁধবার তেল নেই—একসঙ্গে দু-দিনের দিয়ে যাব—সেইজন্যে…

সুশীলা বলিল—আচ্ছা, নিয়ে আয় দেখি বাটি। দেখি কী আছে, আমাদেরও বুঝি তেল আনা হয়নি।

পাত্রে যতটুকু তেল ছিল সুশীলা সবটুকু এই কুণ্ঠিতা দরিদ্রা গৃহলক্ষ্মীটিকে ঢালিয়া দিল। বউটি চলিয়া যাইবার সময় মিনতিপূর্ণ দৃষ্টিতে চাহিয়া বলিল—লক্ষ্মী দিদি, দাও রান্না চড়িয়ে…

সুশীলা বলিল—তুই পালা দেখি—আমি ওদের মজা না-দেখিয়ে আজ আর কিছুতেই ছাড়ছি নে…

বেলা বারোটার সময় মোক্ষদা ঠাকরুন আসিয়া দেখিয়া-শুনিয়া হইচই বাধাইয়া দিলেন। প্রকৃতই ইহাতে রাগ হইবার কথা। একটু পরে রামতনু আসিলেন, তিনি ব্যাপার দেখিয়া দালানে গিয়া আপন মনে তামাক টানিতে শুরু করিলেন। ঝগড়া ক্রমে খুব চাগাইয়া উঠিল, মোক্ষদা উচ্চৈ:স্বরে সুশীলার কুলজি গাহিতে লাগিলেন। —সুশীলাও যে খুব শান্তশিষ্ট, এ অপবাদ তাহাকে শত্রুতেও দিতে পারিত না, কাজেই ব্যাপার যখন খুব বাধিয়া উঠিয়াছে, এমন সময় কোথা হইতে কিশোরী আসিয়া হাজির হইল—যদিও আজ তাহার ফিরিবার কথা ছিল না, তবুও কাজ মিটিয়া যাওয়াতে সে আর সেখানে অপেক্ষা করে নাই। মোক্ষদা ছেলেকে পাইয়া হাঁকডাক আরও বাড়াইয়া দিলেন। কিশোরী এত বেলায় বাড়ি আসিয়া এ অশান্তির মধ্যে পড়িয়া অত্যন্ত চটিয়া গেল—তাহার সমস্ত রাগ গিয়া পড়িল স্ত্রীর উপর। হাতের গোড়ায় একখানা শুকনো চেলা-কাঠ পড়িয়াছিল, সেইটা লইয়াই লাফাইয়া সে রান্নাঘরের দাওয়ায় উঠিল। সুশীলা তখনও বসিয়া বাটনা বাটিতেছিল—স্বামীকে শুকনা কাঠ হাতে লইয়া বীরদর্পে রান্নাঘরে লাফাইয়া উঠিতে দেখিয়া ভয়ে তাহার মুখ শুকাইয়া গেল—আত্মরক্ষার অন্য কোনো উপায় না-দেখিয়া হাত দুটা তুলিয়া নিজের দেহটা আড়াল করিবার চেষ্টা করিল—কিশোরী প্রথমত স্ত্রীর খোঁপা ধরিয়া এক হেঁচকা টান দিয়া তাহাকে মাটিতে ফেলিয়া দিল, তারপর তাহার পিঠে কয়েক ঘা চেলা-কাঠের বাড়ি মারিয়া তাহার গলা ধরিয়া প্রথমে এক ধাক্কা মারিল রান্নাঘরের দাওয়ায় এবং তথা হইতে এক ধাক্কা দিল একেবারে উঠানে। ধাক্কার বেগ সামলাইতে না-পারিয়া সুশীলা মুখ থুবড়িয়া উঠানে পড়িয়া গেল—মার আরও চলিত, কিন্তু রামতনু তামাক খাইতে খাইতে ছেলের কাণ্ড দেখিয়া হাঁ হাঁ করিয়া আসিয়া পড়িলেন।

পাশের বাড়ির বউটি তখন শ্বশুর ও স্বামীকে খাওয়াইয়া সবে নিজে খাইতে বসিতেছিল, হঠাৎ এ-বাড়ির মধ্যে মারের শব্দ শুনিয়া সে খাওয়া ফেলিয়া সুশীলাদের খিড়কিতে ছুটিয়া আসিয়া উঁকি মারিয়া দেখিল—সুশীলা উঠানে দাঁড়াইয়া আছে, বাটনার পাত্রের উপর পড়িয়া গিয়াছিল, কাপড়ে-চোপড়ে হলুদের ছোপ; মাথার খোঁপা একেবারে খুলিয়া কতক চুল মুখের উপর কতক পিঠের উপর পড়িয়াছে; গাঙ্গুলী-বাড়ি হইতে দুটো ছেলে ব্যাপার দেখিবার জন্য ছুটিয়া আসিয়াছে, আরও দু-একজন পাড়ার মেয়ে সামনের দরজা দিয়া উঁকি মারিতেছে —ওদিকে পাঁচিলের উপর দিয়া মুখ বাড়াইয়া তাহার নিজের শ্বশুর রামলোচন মজা দেখিতেছেন।

চারিদিকের কৌতূহলদৃষ্টির মাঝখানে, সর্বাঙ্গে হলুদের ছোপ ও ধূলিমাখা বিস্ৰস্তকুন্তলা, অপমানিতা দিদিকে অসহায়ভাবে উঠানে দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখিয়া তাহার বুকের মধ্যে কীরকম করিয়া উঠিল—কিন্তু সে একে ছেলেমানুষ তাহাতে অত্যন্ত লজ্জাশীলা, শ্বশুর ভাসুর এবং এক-উঠান লোকের মধ্যে বাড়ির ভিতর ঢুকিতে না-পারিয়া প্রথমটা সে খিড়কির বাহিরে আকুলি-বিকুলি করিতে লাগিল, কিন্তু গাঙ্গুলী-বাড়ির প্রৌঢ় গাঙ্গুলী মহাশয়ও যখন হুকা হাতে—কী হে রামতনু, বলি ব্যাপারখানা কী শুনি—বলিয়া বাড়ির মধ্যের উঠানে আসিয়া হাজির হইলেন, তখন সে আর থাকিতে না-পারিয়া বাড়ির মধ্যে ঢুকিয়া পড়িল এবং সুশীলার হাত ধরিয়া খিড়কি-দোর দিয়া বাহিরে লইয়া গিয়াই হঠাৎ ফুপাইয়া কাঁদিয়া উঠিয়া বলিল—কেন ও-রকম করতে গেলে দিদিমণি, লক্ষ্মীটি, তখনই যে বারণ করলাম?…

তার পরদিন দুপুরবেলা সুশীলা রান্নাঘরে রাঁধিতেছিল। কিশোরী খাইতে বসিয়াছে, মোক্ষদা ঠাকরুন কী প্রয়োজনে রান্নাঘরে ঢুকিয়া দেখিলেন, সুশীলা পিছনে ফিরিয়া ভাত বাড়িতে বাড়িতে স্বামীর ডালের বাটিতে কী গুলিতেছে, পাশে একটা ছোটো বাটি। মোক্ষদার কীরকম সন্দেহ হইল, তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন— বউমা, তোমার বাটিতে কী?—কি মেশাচ্ছ ডালের বাটিতে?

সুশীলা পিছন ফিরিয়াই শাশুড়িকে দেখিয়া যেন কেমন হইয়া গেল। তাহার চোখমুখের ভাব দেখিয়া মোক্ষদার সন্দেহ আরও বাড়িল—তিনি বাটিটা হাতে তুলিয়া লইয়া দেখিলেন তাহাতে সবুজ মতো কী একটা বাটা।

তিনি কড়াসুরে জিজ্ঞাসা করিলেন—কী বেটেছ এতে?

তিনি দেখিলেন পুত্রবধূ উত্তর দিতে পারিতেছে না, তাহার মুখ লাল হইয়া উঠিয়াছে।

ইহার পর একটা ভয়ানক কাণ্ড ঘটিল। মোক্ষদা ঠাকরুন বাটি হাতে—ওমা কী সর্বনাশ! আর একটু হলেই হয়েছিল গো,—বলিয়া উঠানে আসিয়া চীৎকার করিয়া হাট বাধাইলেন।

কিশোরী দালান হইতে উঠিয়া আসিল, রামতনু আসিলেন, গাঙ্গুলী-বাড়ির মেয়ে-পুরুষ আসিল, আরও অনেকে আসিল।

মোক্ষদা সকলের সামনে সেই বাটিটা দেখাইয়া বলিতে লাগিলেন, দ্যাখো তোমরা সকলে, তোমরা ভাব শাশুড়ি-মাগি বড়ো দুষ্টু—নিজের চোখে দেখে নাও ব্যাপার, কী সর্বনাশ হয়ে যেত এখনি, যদি আমি না-দেখতাম—দোহাই বাবা তারকনাথ, কী ঠেকানই আজ ঠেকিয়েছ…

এক-উঠান লোক—সকলেই শুনিল রামতনুর দুরন্ত পুত্রবধূ স্বামীর ভাতে বিষ না কী মিশাইয়া খাওয়াইতে গিয়া ধরা পড়িয়াছে। কেউ অবাক হইয়া গেল, কেউ মুচকি হাসিয়া বলিল—ও-সব আমরা অনেককাল জানি, আমরা রীত দেখলেই মানুষ চিনি, তবে পাড়ার মধ্যে বলে এতদিন…

কে একজন বলিল—জিনিসটা কী তা দেখা হয়েছে?…

মোক্ষদা ঠাকরুনের গাল-বাদ্যের রবে সে কথা চাপা পড়িয়া গেল।

গাঙ্গুলী মহাশয় রামতনুকে বলিলেন—গুরু রক্ষা করেছেন। এখন যত শিগগির বিদেয় করতে পারো তার চেষ্টা করো, শাস্ত্রে বলে, দুষ্টা ভার্যে! আর একদিনও এখানে রেখো না।

সমস্ত দিন পরামর্শ চলিল।

সন্ধ্যার সময় ঠিক হইল কাল সকালেই গাড়ি ডাকিয়া আপদ বিদায় করা হইবে, আর একদিনও এখানে না, কী জানি কখন কী বিপদ ঘটাইবে। বিশেষত পাড়ার মধ্যে ও-রকম দজ্জাল বউ থাকিলে পাড়ার অন্য বউ-ঝিও দেখাদেখি ওইরকমই হইয়া উঠিবে।

সেদিন রাত্রে সুশীলাকে অন্য এক ঘরে শুইতে দেওয়া হইল—ইহা মোক্ষদা ঠাকরুনের বন্দোবস্ত—কাল সকালেই যখন যেখানকার আপদ সেখানে বিদায় করিয়া দেওয়া হইবে, তখন আর তাহার সঙ্গে সম্পর্ক কীসের?

রাত্রে শুইয়া শুইয়া কত রাত পর্যন্ত তাহার ঘুম আসিল না। ঘরের জানালা সব খোলা, বাহিরের জ্যোৎস্না ঘরে আসিয়া পড়িয়াছিল। তাহার মনে কাল ও আজ এই দুইদিন অত্যন্ত কষ্ট হইয়াছে—সে স্বভাবত নির্বোধ, লাঞ্ছনা ভোগের অপমান সে ইহার পূর্বে কখনও তেমন করিয়া অনুভব করে নাই, যদিও মারধর ইহার পূর্বে বহুবার খাইয়াছে। তাহার একটা কারণ এই যে আজ ও কালকার দিনের মতো শ্বশুর-শাশুড়ি ও এক-উঠান লোকের সামনে এভাবে অপমানিতাও সে কোনোদিন হয় নাই। তাই আজ সমস্ত দিন ধরিয়া তাহার চোখের জল বাঁধ মানিতেছে না— কাল মার খাইয়া পিঠ কাটিয়া গিয়াছে ও হাত দিয়া ঠেকাইতে গিয়া হাতের কাচের চুড়ি ভাঙিয়া হাতও ক্ষতবিক্ষত হইয়াছে। তাহার সেই স্বামী, যে স্বামী পাঁচ-ছয় বৎসর পূর্বে এমন সব রাতে তাহাকে সমস্ত রাত ঘুমাইতে দিত না, সে পান খাইতে চাহিত না-বলিয়া কত ভুলাইয়া পান মুখে গুজিয়া দিত—সেই স্বামী এরূপ করিল?

পান খাওয়ানোর কথাটিই সুশীলার বারবার মনে আসিতে লাগিল। রাত্রের জ্যোৎস্না ক্রমে আরও ফুটিল। তখন চৈত্রমাসের মাঝামাঝি, দিনে তখন নতুন-কচি পাতা-ওঠা গাছের মাথার উপর উদাস অলস বসন্ত-মধ্যাহ্ন ধোঁয়া ধোঁয়া রৌদ্রের উত্তরীয় উড়াইয়া বেড়ায়…দীর্ঘ দীর্ঘ দিনগুলি প্রস্ফুট-প্রসূন-সুরভির মধ্য দিয়া চলিয়া চলিয়া নদীর ধারের শিমুলতলায় সন্ধ্যার ছায়ার কোলে গিয়া ঢলিয়া পড়ে…পাড়াগাঁয়ের আমবনে, বাঁশবনে জ্যোৎস্না-ঝরা বাতাসে সারারাত কত-কী পাখির আনন্দ-কাকলী…বসন্ত লক্ষ্মীর প্রথম প্রহরের আরতির শেষে বনের গাছপালা তখন আবার নূতন করিয়া টাটকা ফুলের ডালি সাজাইতেছে।…

শুইয়া শুইয়া সুশীলা ভাবিল, জগতে কেউ তাহাকে ভালোবাসে না—কেবল ভালোবাসে তাহার মৌরীফুল। মৌরীফুল পত্র লিখিয়াছে, তাহার কথা মনে করিয়া সে রোজ রাত্রে কাঁদে, তাহাকে না-দেখিয়া কলিকাতার ফিরিয়া তাহার কষ্ট হইতেছে। সত্যই যদি কেউ তাহাকে ভালোবাসে তো সে ওই মৌরীফুল— ভালোবাসে ওই ছোটো-বউটা। আহা, ছোটো-বউ-এর বড়ো কষ্ট! ভগবান দিন দিলে সে ছোটো-বউ-এর দুঃখ ঘুচাইবে।…কিন্তু স্বামী যে তাহাকে বিদায় করিয়া দিতেছে? ও কিছু না, অভাবে পড়িয়া উহার মাথা খারাপ হইয়া যাইতেছে, নহিলে সেও কী এমন ছিল? মৌরীফুলের বর তো কত জায়গায় বেড়ায়, মৌরীফুলকে একখানা পত্র লিখিয়া দেখিলে হয়, যদি উহার কোনো চাকরি করিয়া দিতে পারে। চাকরি হইলে সে আর তার স্বামী একটা আলাদা বাসায় থাকিবে, আর কেহই সেখানে থাকিবে না, মাঠের ধারের ছোটো ঘরখানি সে মনের মতো করিয়া সাজাইয়া রাখিবে, উঠানে কুমড়ার মাচা বাঁধিবে, বাজার-খরচ কমিয়া যাইবে। লোকে বলে সে গোছালো নয়, একবার বাসায় যাইলে সে দেখাইয়া দিবে যে সে গোছালো কিনা। আচ্ছা, ওই বাড়িখানায় যদি আগুন লাগে! না—আগুন দিবে কে? ছোটো-বউ, উঁহু, দিলে তাহার শাশুড়ি ঠাকরুনই দিবে, যে রকম লোক!

জানালার বাহিরে জ্যোৎস্নায় ওগুলো কি ভাসিতেছে? সেই যে তাহার স্বামী গল্প করিত জ্যোৎস্না-রাত্রে পরিরা সব খেলা করিয়া বেড়ায়, তাহারা নয় তো?…তাহার বিবাহের রাত্রে কেমন বাঁশি বাজাইয়াছিল, কেমন সুন্দর বাঁশি, ওরকম বাঁশি নদীর ধারে কত পড়িয়া থাকে…আচ্ছা পিয়োনে মৌরীফুলের একখানা চিঠি দিয়া গেল না কেন? লাল চৌকা খাম, খুব বড়ো, সোনার জল দেওয়া, আতর না কী মাখানো…

পরদিন সকালবেলা পুত্রবধূর উঠিবার দেরি হইতে লাগিল দেখিয়া মোক্ষদা ঠাকরুন ঘরের মধ্যে উঁকি মারিয়া দেখিলেন, পুত্রবধূ জ্বরের ঘোরে অঘোর অচৈতন্য অবস্থায় হেঁড়া মাদুরের উপর পড়িয়া আছে, চোখ দুটা জবাফুলের মতো লাল।…

সেদিন সমস্ত রাত একভাবেই কাটিয়া গেল, তাহার দিকে বিশেষ কেহ নজর করিল না, তার পরদিন বেগতিক বুঝিয়া রামতনু ডাক্তার আনিলেন। দুপুরের পর হইতে সে জ্বরের ঘোরে ভুল বাকিতে লাগিল—সত্যি মৌরীফুল তা নয়, ওরা যা বলছে—আমি অন্য ভেবে…

সন্ধ্যার কিছুপূর্বে সে মারা গেল।

তাহার মৃত্যুতে গাঙ্গুলী-পাড়ার হাড় জুড়াইয়া গেল, পাড়ার কাক-চিলগুলাও একটু সুস্থির হইল। কিছুদিন পরেই কিশোরীর দ্বিতীয় পক্ষের বউ মেঘলতা ঘরে আসিল। দেখিলে চোখ জুড়ায় এমন সুন্দর মেয়ে, কর্মপটু, হুঁশিয়ার, গোছালো দ্বিতীয়বার বিবাহের অল্পদিন পরেই যখন কিশোরী পালেদের স্টেটে ভালো চাকরিটা পাইল, তখন নূতন বউ-এর লক্ষ্মীভাগ্য দেখিয়া সকলেই খুব খুশি হইল।

সংসারের অলক্ষ্মীস্বরূপা আগের পক্ষের বউ-এর নাম সে সংসারে আর কোনোদিন কেহ করে না।


© 2024 পুরনো বই