আজ সে সত্যিই বড় একটা ইউরোপীয় ধরনের শহরের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে। বড় বড় বাড়ি, ব্যাঙ্ক, হোটেল, দোকান, পিচঢালা চওড়া রাস্তা, একপাশ দিয়ে ইলেকট্রিক ট্রাম চলছে, জুলু রিকশাওয়ালা রিক্সা টানছে, কাগজওয়ালা কাগজ বিক্রি করছে। সবই যেন নতুন, যেন এসব দৃশ্য জীবনে কখনো সে দেখেনি।
লোকালয়ে তো এসেছে, কিন্তু একেবারে কপর্দকশূন্য। এক পেয়ালা চা খাবার পয়সাও তার নেই। কাছে একটা ভারতীয় দোকান দেখে তার বড় আনন্দ হল। কতদিন যেন দেখেনি স্বদেশবাসীর মুখ। দোকানদার মুসলমান, সাবান ও গন্ধদ্রব্যের পাইকারী বিক্রেতা। খুব বড় দোকান। শঙ্করকে দেখেই সে বুঝলে এ দুঃস্থ ও বিপদগ্রস্ত। নিজে দু’টাকা সাহায্য করলে ও একজন বড় ভারতীয় সওদাগরের সঙ্গে দেখা করতে বলে দিলে।
টাকা দুটি পকেটে নিয়ে শঙ্কর আবার পথে এসে দাঁড়াল। আসবার সময় বলে এল— অসীম ধন্যবাদ টাকা দুটির জন্যে। এ আমি আপনার কাছে ধার নিলাম, আমার হাতে পয়সা এলে আপনাকে কিন্তু এ টাকা নিতে হবে। সামনেই একটা ভারতীয় রেস্তোরাঁ। সে ভালো কিছু খাবার লোভ সম্বরণ করতে পারলে না, কতদিন সভ্যখাদ্য মুখে দেয়নি! সেখানে ঢুকে এক টাকার পুরি, কচুরি, হালুয়া, মাংসের চপ, কেক পেট ভরে খেল। সেই সঙ্গে দু-তিন পেয়ালা কফি।
চায়ের টেবিলে একখানা পুরনো কাগজের দিকে তার নজর পড়ল। তাতে এক জায়গায় হেড লাইনে বড় বড় অক্ষরে লেখা আছে—
National Park Survey Party’s Singular Experience
A lonely Indian found in the desert
Dying of thirst and exhaustion
His strange story
শঙ্কর দেখলে, তার একটা ফটোও ছাপা হয়েছে কাগজে। তার মুখে সম্পূর্ণ কাল্পনিক একটা গল্পও দেওয়া হয়েছে। এ রকম গল্প সে কারো কাছে করেনি।
খবরের কাগজখানার নাম ‘সলস্বেরি ডেলি ক্রনিকল’। সে খবরের কাগজের অফিসে গিয়ে নিজের পরিচয় দিলে। তার চারপাশে ভিড় জমে গেল। ওকে খুঁজে বার করবার জন্যে রিপোর্টারের দল অনেক চেষ্টা করেছিল জানা গেল। সেখানে চিমানিমানি পর্বতে পা-ভেঙে পড়ে থাকার গল্প বলে ও ফটো তুলতে দিয়ে শঙ্কর পঞ্চাশ টাকা পেলে। তা থেকে সে আগে সেই সহৃদয় মুসলমান দোকানদারের টাকা দুটি দিয়ে এল।
আগ্নেয়গিরিটার সম্বন্ধে সে কাগজে একটা প্রবন্ধ লিখলে। তাতে আগ্নেয়গিরিটার নামকরণ করলে— ‘মাউন্ট আলভারেজ’। তবে মধ্য-আফ্রিকার অরণ্যে লুকানো এত বড় একটা আস্ত জীবন্ত আগ্নেয়গিরির এই গল্প— কেউ বিশ্বাস করলে, কেউ করলে না। অবিশ্যি রত্নের গুহার বাষ্পও সে কাউকে জানতে দেয়নি। দিলে দলে দলে লোক ছুটবে ওর সন্ধানে।
তারপরে একটা বইয়ের দোকানে গিয়ে এক রাশ ইংরেজী বই ও মাসিক পত্রিকা কিনলে। বই পড়েনি কতকাল! সন্ধ্যায় একটা সিনেমায় ছবি দেখলে। কতকাল পরে, রাত্রে হোটেলের ভালো বিছানায় ইলেকট্রিক আলোর তলায় শুয়ে বই পড়তে পড়তে সে মাঝে মাঝে জানালা দিয়ে নিচের প্রিন্স আলবার্ট ভিক্টর স্ট্রীটের দিকে চেয়ে চেয়ে দেখছিল। ট্রাম যাচ্ছে নিচ দিয়ে, রিকশা যাচ্ছে, ভারতীয় কফিখানায় ঠুনঠুন করে ঘন্টা বাজছে, মাঝে মাঝে দু-চারখানা মোটরও যাচ্ছে। এর সঙ্গে মনে হল আরেকটা ছবি— সামনে আগুনের কুন্ড, কিছুদূরে বৃত্তাকারে ঘিরে বসে আছে কোয়োট ও হায়েনার দল। ওদের পিছনে নেকড়েটার দুটো গোল গোল চোখ আগুনের ভাঁটার মতো জ্বলছে অন্ধকারের মধ্যে।
কোনটা স্বপ্ন? চিমানিমানি পর্বতে যাপিত সেই ভয়ঙ্কর রাত্রি, না আজকের এই রাত্রি?
ইতিমধ্যে সলস্বেরিতে শঙ্কর একজন বিখ্যাত লোক হয়ে উঠেছে।
রিপোর্টারের ভিড়ে তার হোটেলের হল সব সময় ভর্তি। খবরের কাগজের লোক আসে তার ভ্রমণ বৃত্তান্ত ছাপবার কন্ট্রাক্ট করতে, কেউ আসে ফটো নিতে।
আত্তিলিও গাত্তির কথা সে ইটালিয়ান কনসাল জেনারেলকে জানালে। তাঁর অফিসের পুরোনো কাগজপত্র ঘেঁটে জানা গেল আত্তিলিও গাত্তি নামে একজন সম্ভ্রান্ত ইটালিয়ান যুবক ১৮৭৯ সালের আগস্ট মাসে পর্তুগিজ পশ্চিম আফ্রিকার উপকূলে জাহাজডুবি হবার পর নামে। তারপর যুবকটির আর কোনো পাত্তা পাওয়া যায়নি। তার আত্মীয়-স্বজন ধনী ও সম্ভ্রান্ত লোক। ১৮৯০-৯৫ সাল পর্যন্ত তারা তাদের নিরুদ্দিষ্ট আত্মীয়ের সন্ধানের জন্যে পূর্ব, পশ্চিম ও দক্ষিণ আফ্রিকার কনসুলেট অফিসকে জ্বালিয়ে খেয়েছিল, পুরষ্কার ঘোষণা করাও হয়েছিল তার সন্ধানের জন্যে। ১৮৯৫ সাল থেকে তারা হাল ছেড়ে দিয়েছিল।
পূর্বোক্ত মুসলমান দোকানদারটির সাহায্যে সে ব্ল্যাকমুন স্ট্রীটের বড় জহুরী রাইডাল ও মরস্বির দোকানে চারখানা পাথর সাড়ে বত্রিশ হাজার টাকায় বিক্রি করল। বাকি দু’খানার দর আরও বেশি উঠেছিল, কিন্তু শঙ্কর সে দু’খানা পাথর তার মাকে দেখাবার জন্যে দেশে নিয়ে যেতে চায়। এখন বিক্রি করবার তার ইচ্ছে নেই।
নীল সমুদ্র…
বম্বেগামী জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে পর্তুগিজ পূর্ব-আফ্রিকার বেইরা বন্দরের নারিকেল বনশ্যাম তীরভূমিকে মিলিয়ে যেতে দেখতে দেখতে শঙ্কর ভাবছিল তার জীবনের এই এ্যাডভেঞ্চারের কথা। এই তো জীবন, এইভাবেই তো জীবনকে ভোগ করতে চেয়েছিল সে। মানুষের আয়ু মানুষের জীবনের ভুল মাপকাঠি। দশ বছরের জীবন উপভোগ করেছে সে এই দেড় বছরে। আজ সে শুধু একজন ভবঘুরে পথিক নয়, একটা জীবন্ত আগ্নেয়গিরির সহ-আবিষ্কারক। মাউন্ট আলভারেজকে সে জগতে প্রসিদ্ধ করবে। দূরে ভারত মহাসমুদ্রের পারে জননী জন্মভূমি পূণ্যভূমি ভারতবর্ষের জন্য এখন মন তার চঞ্চল হয়ে উঠেছে। তার মন উত্সুক হয়ে আছে, কবে দূর থেকে বোম্বাইয়ের রাজাবাঈ টাওয়ারের উঁচু চূড়োটা মাতৃভূমির উপকূলের সান্নিধ্য ঘোষণা করবে… তারপর বাউল কীর্তনগান মুখরিত বাঙলাদেশের প্রান্তে তাদের শ্যামল গ্রামটি… সামনে আসছে বসন্তকাল… পল্লীপথে যখন একদিন সজনে ফুলের দল পথ বিছিয়ে পড়ে থাকবে, বৌ-কথা-ক ডাকবে ওদের বকুল গাছটায়… নদীর ঘাটে লাগবে গিয়ে ওর ডিঙি।
বিদায়! আলভারেজ বন্ধু! …স্বদেশে ফিরে যাওয়ার এই আনন্দের মুহূর্তে তোমার কথাই মনে হচ্ছে আজ। তুমি সেই দলের মানুষ, সারা আকাশ যাদের ঘরের ছাদ, সারা পৃথিবী যাদের পায়ে চলার পথ। আশীর্বাদ কোরো তোমার মহারণ্যের নির্জন সমাধি থেকে, যেন তোমার মতো হতে পারি জীবনে, অমনি সুখ-দুঃখে নিস্পৃহ, অমনি নির্ভীক।
বিদায়! বন্ধু আত্তিলিও গাত্তি! অনেক জন্মের বন্ধু ছিলে তুমি।
তোমরা সবাই মিলে শিখিয়েছ চীন দেশের সেই প্রাচীন ছড়াটি কত সত্য—
ছাদের আলসের দিব্যি চৌরস একখানা টালি হয়ে অনড় অবস্থায় সুখে-স্বচ্ছন্দে থাকার চেয়ে স্ফটিক প্রস্তর হয়ে ভেঙে যাওয়া অনেক ভালো, অনেক ভালো, অনেক ভালো।
আবার তাকে আফ্রিকায় ফিরতে হবে। এখন জন্মভূমির টান বড় টান। এখন জন্মভূমির কোলে সে কিছুদিন কাটাবে। তারপর দেশে সে কোম্পানী গঠন করবার চেষ্টা করবে— আবার সুদূর রিখটারসভেল্ড পর্বতে ফিরবে রত্নখনির পুনর্বার অনুসন্ধানে— খুঁজে সে বার করবেই…
।। পরিশিষ্ট ।।
সলস্বেরি থাকতে শঙ্কর সাউথ রোডেসিয়ান মিউজিয়ামের কিউরেটর প্রসিদ্ধ জীবতত্ত্ববিদ ডক্টর ফিটজেরাল্ডের সঙ্গে দেখা করেছিল, বিশেষ করে বুনিপের কথাটা তাঁকে বলবার জন্যে। দেশে ফিরে আসবার কিছুদিন পরে ডক্টর ফিটজেরাল্ডের কাছ থেকে নিম্নলিখিত পত্রখানা সে পায়—
The South Rhodesian Museum
Salisbury, Rhodesia,
South Africa
January 12,1911
Dear Mr. Chowdhury,
I am writing this letter to fulfil my promise to you to let you know what I thought about your report of a strange three toed monster in the wilds of the Richtersveld Mountains. On looking up my files I find other similar accounts by explorers who had been to the region before you, specially by Sir Robert McCulloch, the famous naturalist, whose report has not yet been published, owing to his sudden and untimely death last year. On thinking the matter over, I am inclined to belive that the monster you saw was nothing more than a species of anthropoid ape, closely related to the gorilla, but much bigger in size and more savage than the specimens found in the Ruwenzori and Virunga Mountains. This species is becoming rarer and rarer every day, and such numbers as do exist are not easily to be got at on account of their shyness and the habit of hiding themselves in the depths of the high-altitude rain forests of the Richtersveld. It is only the very fortunate traveller who gets glimpses of them, and I should think that in meeting them he runs risks proportionate to his good luck.
Congratulating you on both your luck and pluck.
I remain,
Yours sincerely
J.G. Fitzgerald
।। সমাপ্ত ।।