একাদশ পরিচ্ছেদ
সেও এক কৃষ্ণপক্ষের গভীর অন্ধকার রাত্রি। মাঝে মাঝে বৃষ্টি পড়ছে আবার থেমে যাচ্চে, অথচ গুমট কাটেনি। আমার ঘরটার উত্তর দিকে একটা মাত্র কাঠের গরাদ দেওয়া জানলা, জানলার সামনাসামনি দরজা। পশ্চিম দিকের দেওয়ালে জানলা নেই–একটা ঘুলঘুলি আছে মাত্র।
রাত প্রায় একটা কী তার বেশি। আমার ঘুম আসেনি, তবে সামান্য একটু তন্দ্রার ভাব এসেচে।
হঠাৎ বাইরে ঘুলঘুলির ঠিক নীচেই যেন কার পায়ের শব্দ শোনা গেল! গোরু কী ছাগলের পায়ের শব্দ হওয়া বিচিত্র নয়–বিশেষ গ্রাহ্য করলাম না।
তারপর শব্দটা সেদিক থেকে আমার শিয়রের জানলার কাছে এসে থামল। তখনও আমি ভাবচি, ওটা গোরুর পায়ের শব্দ। এমন সময় আমার বিস্মিত-দৃষ্টির সামনে দিয়ে অস্পষ্ট অন্ধকারের মধ্যে কার একটা সুদীর্ঘ হাত একেবারে আমার বুকের কাছে–ঠিক বুকের ওপর এসে পৌঁছোলো–হাতে ধারালো একখানা সোজা-ছোরা, অন্ধকারেও যেন ঝকঝক করছে!
ততক্ষণে আমার বিস্ময়ের প্রথম মুহূর্ত কেটে গিয়েছে।
আমি তাড়াতাড়ি পাশমোড়া দিয়ে ছোরা-সমেত হাতখানা ধরতে গিয়ে মুহূর্তের জন্য একটা বাঁশের লাঠিকে চেপে ধরলাম।
পরক্ষণেই কে এক জোর ঝটকায় লাঠিখানা আমার হাত থেকে ছিনিয়ে নিলে। সঙ্গেসঙ্গে ছোরার তীক্ষ্ণ অগ্রভাগের আঘাতে আমার হাতের কবজি ও বুকের খানিকটা চিরে রক্তারক্তি হয়ে গেল।
তাড়াতাড়ি উঠে টর্চ জ্বেলে দেখি, বিছানা রক্তে মাখামাখি হয়ে গিয়েছে। তখুনি নেকড়া ছিঁড়ে হাতে জলপটি বেঁধে লণ্ঠন জ্বালোম।
লাঠির অগ্রভাগে তীক্ষাস্ত্র ছোরা বাঁধা ছিল–আমার বুক লক্ষ করে ঠিক কুড়লের কাপের ধরনে লাঠি উঁচিয়ে কোপ মারলেই ছোরা পিঠের ওদিক দিকে ছুঁড়ে বেরোতো। তারপর বাঁধন আলগা করে ছোরাখানা আমার বিছানার পাশে কিংবা আমার ওপর ফেলে রাখলেই আমি যে আত্মহত্যা করেচি, একথা বিশেষজ্ঞ ভিন্ন অন্য লোককে ভুল করে বোঝানো চলত।
আমি নিরস্ত্র ছিলাম না–মি. সোমের ছাত্র আমি। আমার বালিশের তলায় ছ-নলা অটোমেটিক ওয়েবলি লুকোনো। সেটা হাতে করে তখুনি বাইরে এসে টর্চ ধরে ঘরের সর্বত্র খুঁজলাম–জানালার কাছে জুতোসুদ্ধ টাটকা পায়ের দাগ।
ভালো করে টর্চ ফেলে দেখলাম।
কী জুতো? … রবার-সোল, না, চামড়া? … অন্ধকারে ভালো বোঝা গেল না।
এখুনি এই জুতোর সোলের একটা ছাঁচ নেওয়া দরকার। কিন্তু তার কোনো উপকরণ দুর্ভাগ্যের বিষয় আজ আমার কাছে নেই।
আমার মনে কেমন ভয় করতে লাগল, আকাশের দিকে চাইলাম। কৃষ্ণপক্ষের ঘোর মেঘান্ধকার রজনী।
এমনি রাত্রে ঠিক গত কৃষ্ণপক্ষেই গাঙ্গুলিমশায় খুন হয়েছিলেন।
আমি শ্রীগোপালের বাড়ি গিয়ে ডাকলাম–শ্রীগোপাল, শ্রীগোপাল, ওঠো–ওঠো!
শ্রীগোপাল জড়িত-কণ্ঠে উত্তর দিলে–কে?
–বাইরে এসো–আলো নিয়ে এসো–সব বলছি।
শ্রীগোপাল একটা কেরোসিনের টেমি জ্বালিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বিস্মিতমুখে বার হয়ে এসে বললে–কে? ও, আপনি? এত রাত্রে কী মনে করে?
চলো বসি–সব বলছি। এক গ্লাস জল খাওয়াও তো দেখি!
চা খাবেন? স্টোভ আছে। চা-খোর আমি, সব মজুত রাখি–করে দিই।
চা খেয়ে আমি আর বসতে পারছি না। ঘুমে যেন চোখ ঢুলে আসচে! শ্রীগোপাল বললে– বাকি রাতটুকু আমার এখানেই শুয়ে কাটিয়ে দেবেন-এখন।
ব্যাপার সব শুনে শ্রীগোপাল বললে–এর মধ্যে ননী আছে বলে মনে হয়। এ তারই কাজ।
না।
না? বলেন কী?
না, এ ননীর কাজ নয়।
কী করে জানলেন?
এখানকার লোক ছোরার ব্যবহার জানে না–বাংলা দেশের পাড়াগাঁয়ে ছোরার ব্যবহার নেই।
তবে?
এ-কাজ যে করেচে সে বাংলার বাইরে থাকে। তুমি কাউকে রাতের কথা বোলো না কিন্তু!
আপনাকে খুন করতে আসার উদ্দেশ্য?
আমি দোষী খুঁজে বার করবার কাজে পুলিশকে সাহায্য করচি–এ ছাড়া আর অন্য কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে?
.
ভোর হল। আমি উঠে আমার ঘরে চলে গেলাম।
জানলার বাইরে সেই পায়ের দাগ তেমনি রয়েছে। রবার-সোলের জুতো বেশ স্পষ্ট বোঝা যাচ্চে। ক-নম্বরের জুতো তাও জানা গেল।
বিকেলে আমি ভাবলাম, একবার মামার বাড়ি যাব। এ-গ্রামে ডাক্তার নেই ভালো–মামার বাড়ি গিয়ে আমার ক্ষতস্থানটা দেখিয়ে ওষুধ নিয়ে আসব। ঘরের মধ্যে জামা গায়ে দিতে মনে হল–আমার ঘরের মধ্যে কে যেন ঢুকেছিল।
কিছুই থাকে না ঘরে। একটা ছোটো চামড়ার সুটকেস–তাতে খানকতক কাপড়-জামা। কে ঘরের মধ্যে ঢুকে সুটকেসটা মেঝেতে ফেলে তার মধ্যে হাতড়ে কী খুঁজেচে-কাপড় জামা, বা, একটা মানিব্যাগে গোটা-দুই টাকা ছিল যেগুলি ছোঁয়নি। বালিশের তলা–এমনকী, তোশকটার তলা পর্যন্ত খুঁজেছে।
আমি প্রথমটা ভাবলাম, এ কোনো ছিঁচকে চোরের কাজ। কিন্তু চোর টাকা নেয়নি–তবে কি, রিভলবারটা চুরি করতে এসেছিল? সেটা আমার পকেটেই আছে অবশ্যি–সে উদ্দেশ্য থাকা বিচিত্র নয়।
জানকীবাবুকে ডেকে সব কথা বললাম। জানকীবাবু শুনে বললেন–চলুন, জায়গাটা একবার দেখে আসি।
ঘরে ঢুকে আমরা সব দিক ভালো করে খুঁজে দেখলাম। সব ঠিক আছে। জানকীবাবু আমার চেয়েও ভালো করে খুঁজলেন, তিনিও কিছু বুঝতে পেরেছেন বলে মনে হল না।
বললাম–দেখলেন তো?
টাকাকাড়ি কিছু যায়নি?
কিছু না।
আর কোনো জিনিস আপনার ঘরে ছিল?
কী জিনিস?
অন্য কোনো দরকারি–ইয়ে–মানে–মূল্যবান?
এখানে মূল্যবান জিনিস কী থাকবে?
তাই তো!
হঠাৎ আমার একটা কথা মনে পড়ল। মিসমিদের সেই কবচ আর দাঁতনকাঠির টুকরোটা আমি এই ঘরে কাল পর্যন্ত রেখেছিলাম, কিন্তু কাল কী মনে করে শ্রীগোপালের বাড়ি যাবার সময় সে-জিনিস দু-টি আমি পকেটে করে নিয়ে গিয়েছিলাম–এখনও পর্যন্ত সে দু-টি আমার পকেটেই আছে। কিন্তু কথাটা জানকীবাবুকে বলি বলি করেও বলা হল না।
জানকীবাবু যাবার সময় বললেন–ননীর ওপর আপনার সন্দেহ হয়?
হয় খানিকটা।
একবার ওকে ডাকিয়ে দেখি।
এখন নয়। আমি মামার বাড়ি যাই, তারপর ওকে ডেকে জিজ্ঞেস করবেন।
কিছুক্ষণ পরে আমি জানকীবাবুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মামার বাড়ি চলে এলাম।
.
দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
আমার মামার বাড়ির পাশে সুরেশ ডাক্তারের বাড়ি। সে আমার সমবয়সি–গ্রামে প্র্যাকটিস করে। মোটামুটি যা রোজগার করে, তাতে তার চলে যায়। ওর কাছে ক্ষতস্থান ধুইয়ে ব্যাণ্ডেজ করিয়ে আবার শ্রীগোপালদের গ্রামেই ফিরলাম। জানকীবাবুর সঙ্গে পথে দেখা। তিনি বোধ হয় বেড়াতে বেরিয়েছেন। আমায় বললেন–আজই ফিরলেন?
তাঁর কথার উত্তর দিতে গিয়ে হঠাৎ আমার মনে পড়ল, মিসমিদের কবচখানা আমার পকেটেই আছে এখনও–সামনে রাত আসচে আবার, ও-জিনিসটা সঙ্গে এনে ভালো করিনি, মামার বাড়ি রেখে আসাই উচিত ছিল বোধ হয়।
জানকীবাবুর পরামর্শটা একবার নিলে কেমন হয়, জিনিসটা দেখিয়ে?
কিন্তু ভাবলাম, এ-জিনিসটা ওঁর হাতে দিতে গেলে এখন বহু কৈফিয়ৎ দিতে হবে ওই সঙ্গে। হয়তো তিনি জিনিসটার গুরুত্ব বুঝবেন না–দরকার কী দেখানোর?
জানকীবাবুর শ্বশুরবাড়ি শ্রীগোপালের বাড়ির পাশেই।
ওর বৃদ্ধা শাশুড়ি, দেখি বাইরের রোয়াকে বসে মালা জপ করছেন। আমি তাঁকে আরও জিজ্ঞেস করবার জন্যে সেখানে গিয়ে বসলাম।
বুড়ি বললে–এসো দাদা, বোসো।
ভালো আছেন, দিদিমা?
আমাদের আবার ভালোমন্দ–তোমরা ভালো থাকলেই আমাদের ভালো।
আপনি বুঝি একাই থাকেন?
আর কে থাকবে বল–আছেই-বা কে? এক মেয়ে ছিল, মারা গিয়েছে।
তবে তো আপনার বড়ো কষ্ট, দিদিমা!
কী করব দাদা, অদেষ্টে দুঃখ থাকলে কেউ কি ঠেকাতে পারে?
আমি একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলাম। বুড়ির সামনের গোয়ালের ছিটেবেড়ায় একটা অদ্ভুত জিনিস রয়েছে–জিনিসটা হচ্ছে, খুব বড়ো একটা পাতার টোকা। পাতাগুলো শুকনো তামাক-পাতার মতো ঈষৎ লালচে। পাতার বোনা ওরকম টোকা, বাংলাদেশের পাড়াগাঁয়ে কখনো দেখিনি।
জিজ্ঞেস করলাম–দিদিমা, ও জিনিসটা কী? এখানে তৈরি হয়?
বৃদ্ধা বললেন–ওটা এ-দেশের নয় দাদা!
কোথায় পেয়েছিলেন ওটা?
আমার জামাই এনে দিয়েছিল।
আপনার জামাই? জানকীবাবু বুঝি?
হ্যাঁ দাদা। ও আসামে চ-বাগানে থাকত কিনা, ওই আর বছর এনেছিল।
হঠাৎ আমার মনে কেমন একটা খটকা লাগল… আসাম! …চা বাগান! এই ক্ষুদ্র গ্রামের সঙ্গে সুদূর আসামের যোগ কীভাবে স্থাপিত হতে পারে–এ আমার নিকট একটা মস্ত-বড়ো সমস্যা। একটা ক্ষীণ সূত্র মিলেছে।
আমি বললাম–জানকীবাবু বুঝি আসামে থাকতেন?
হ্যাঁ দাদা, অনেকদিন ছিল। এখন আর থাকে না। আমার সে-মেয়ে মারা গিয়েছে কিনা! তবু জামাই মাঝে মাঝে আসে। গাঙ্গুলিমশায়ের সঙ্গে বড়ো ভাব ছিল। এলেই ওখানে বসে গল্প, চা খাওয়া–
ও!
বুড়ো খুন হয়েছে শুনে জামাইয়ের কী দুঃখু!
গাঙ্গুলিমশায়ের মৃত্যুর ক-দিন পরে এলেন উনি?
তিন-চার দিন পরে দাদা!
আপনার মেয়ে মারা গিয়েছেন কতদিন হল দিদিমা?
তা, বছর-তিনেক হল–এই শ্রাবণে।
মেয়ে মারা যাওযার পর উনি যেমন আসছিলেন, তেমনই আসতেন, না, মধ্যে কিছুদিন আসা বন্ধ ছিল?
বছর-দুই আর আসেনি। মন তো খারাপ হয়, বুঝতেই পার দাদা! তারপর এল একবার শীতকালে। এখানে রইল মাসখানেক। বেশ মন লেগে গেল। সেই থেকে প্রায়ই আসে।
আমি বৃদ্ধার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। সেদিন আর কোথাও বেরোলাম না। পরদিন সকালে উঠে স্থির করলাম একবার থানার দারোগাবাবুর সঙ্গে দেখা করা দরকার। বিশেষ আবশ্যক।
পথেই জানকীবাবুর সঙ্গে দেখা। আমায় জিজ্ঞেস করলেন–এই যে! বেড়াচ্ছেন বুঝি?
আমি বললাম–চলুন, ঘুরে আসা যাক একটু। আপত্তি আছে?
হ্যাঁ হ্যাঁ, চলুন না যাই।
আচ্ছা জানকীবাবু, আপনি মন্ত্রতন্ত্রে বিশ্বাস করেন?
হ্যাঁ, খানিকটা করিও বটে, খানিকটা নাও বটে। কেন বলুন তো?
আমার নিজের ওতে একেবারেই বিশ্বাস নেই। তাই বলছি। আপনি তো অনেক দেশ ঘুরেচেন, আপনার অভিজ্ঞতা আমার চেয়ে বেশি।
হঠাৎ জানকীবাবু আমার চোখের সামনে এমন একটা কান্ড করলেন, যাতে আমি স্তম্ভিত ও হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণের জন্যে।
.
ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ
কান্ডটা এমন কিছুই নয়, খুবই সাধারণ।
জানকীবাবু পথের পাশে ঝোঁপের জঙ্গলের দিকে চেয়ে বললেন–দাঁড়ান, একটা দাঁতন ভেঙেনি। সকাল বেলাটা..
তারপর তিনি আমার সামনে পথের ধারে একটা শ্যাওড়াডাল ঘুরিয়ে ভেঙে নিলেন দাঁতনকাঠির জন্যে।
আমার ভাবান্তর অতি অল্পক্ষণের জন্যে।
পরক্ষণেই আমি সামলে নিয়ে তাঁর সঙ্গে সহজভাবে কথাবার্তা বলতে শুরু করলাম।
ঘণ্টাখানেক পরে ঘুরে এসে আমি ভাঙা-শ্যাওড়াডালটা ভালো করে লক্ষ করে দেখি, সঙ্গে সেদিনকার সেই দাঁতনকাঠির শুকনো গোড়াটা এনেছিলাম।
যে বিশেষ ভঙ্গিতে আগের গাছটা ভাঙা হয়েছে, এটাও অবিকল তেমনি ভঙ্গিতে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ভাঙা!
কোনো তফাত নেই।
আমার মাথার মধ্যে ঝিমঝিম করছিল। আসাম, দাঁতনকাঠি–দুটো অতিসাধারণ, অথচ অত্যন্ত অদ্ভুত সূত্র।
জানকীবাবুর এখানে গত এক বছর ধরে ঘনঘন আসা-যাওয়া, পত্নীবিয়োগ সত্ত্বেও শ্বশুরবাড়ি আসার তাগিদ, গাঙ্গুলিমশায়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব!
মি. সোম একবার আমায় বলেছিলেন, অপরাধী বলে যাকে সন্দেহ করবে, তখন তার পদমর্যাদা বা বাইরের ভদ্রতা–এমনকী, সম্বন্ধ, সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা ইত্যাদিকে আদৌ আমল দেবে না।
জানকীবাবুর সম্বন্ধে আমার গুরুতর সন্দেহ জাগল মনে।
একটা সূত্র এবার অনুসন্ধান করা দরকার। অত্যন্ত দরকারি একটা সূত্র।
সকালে উঠে গিয়ে দারোগার সঙ্গে দেখা করলাম থানায়।
দারোগাবাবু আমায় দেখে বললেন–কী? কোনো সন্ধান করা গেল?
করে ফেলেছি প্রায়। এখন–যে-খাতার পাতাখানা আপনার কাছে আছে, সেই খানা একবার দরকার।
ব্যাপার কী, শুনি?
এখন কিছু বলচিনে! হাতের লেখা মেলানোর ব্যাপার আছে একটা।
কীরকম?
গাঙ্গুলিমশায়ের খাতা লিখত যে-ক-জন–তাদের সবার হাতের লেখা জানি, কেবল একটা হাতের লেখার ছিল অভাব–তাই না?
সে তো আমিই আপনাকে বলি।
এখন সেই লোক কে হতে পারে, তার একটা আন্দাজ করে ফেলেচি। তার হাতের লেখার সঙ্গে এখন সেই পাতার লেখাটা মিলিয়ে দেখতে হবে।
লোকটার বর্তমান হাতের লেখা পাওয়ার সুবিধে হবে?
জোগাড় করতে চেষ্টা করছি। যদি মেলে, আমি সন্দেহক্রমে তাকে পুলিশে ধরিয়ে দেবো।
আমায় বলবেন, আমি গিয়ে গ্রেপ্তার করে নিয়ে আসব ওয়ারেন্ট বের করিয়ে নিতে যা দেরি।
বাকিটুকু কিন্তু আপনাদের হাতে।
সে ভাববেন না, যদি আপনার সংগৃহীত প্রমাণের জোর থাকে, তবে বাকি সব আমি করে নেব। এই কাজ করচি আজ সতেরো বছর।
আমি গ্রামে ফিরে একদিনও চুপ করে বসে রইলাম না। এসব ব্যাপারে দেরি করতে নেই, করলেই ঠকতে হয়। জানকীবাবুর শাশুড়ির সঙ্গে দেখা করলাম। শুনলাম, জানকীবাবু মাছ ধরতে গিয়েছেন কোথাকার পুকুরে–আর মাত্র দু-দিন তিনি এখানে আছেন–এই দু-দিনের মধ্যেই সব বন্দোবস্ত করে ফেলতে হবে।
আমি বললাম–দিদিমা, জানকীবাবু আপনাকে কিছু কিছু টাকা পাঠান শুনেচি?
না দাদা, ও-কথা কার কাছে শুনেচ? জামাই তেমন লোকই নয়।
পাঠান না?
আরও উলটে নেয় ছাড়া দেয় না। মেয়ে থাকতে তবুও যা দিত, এখন একেবারে উপুড় হাতটি করে না কোনোদিন।
যাক চিঠিপত্র দিয়ে খোঁজখবর নেন তো–তাহলে হল।
তাও কখনো কখনো। বছরে একবার বিজয়ার প্রণাম জানিয়ে একখানা লেখে।
খাম, না পোস্টকার্ড?
হ্যাঁ, খাম না রেজিস্টারি চিঠি। তুমিও যেমন দাদা! মেয়ে বেঁচে না থাকলেই জামাই পর হয়ে যায়। তার উপর কি কোনো দাবি থাকে দাদা? দু-লাইন লিখে সেরে দেয়।
কই, দেখি? আছে নাকি চিঠি?
ওই চালের বাতায় গোঁজা আছে, দেখো না।
খুঁজে খুঁজে নাম দেখে একখানা পুরোনো পোস্টকার্ড চালের বাতা থেকে বের করে বৃদ্ধাকে পড়ে শোনালুম। বৃদ্ধা বললেন–ওই চিঠি দাদা।
আরও দু-একটা কথা বলে চিঠিখানা নিয়ে চলে এলাম সঙ্গে করে। জানকীবাবু যদি একথা এখন শুনতেও পান যে, তাঁর লেখা চিঠি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি, তাতেও আমার কোনো ক্ষতির কারণ নেই।
থানায় দারোগার সামনে বসে হাতের লেখা দুটো মেলানে হল।
অদ্ভুত ধরনের মিল। দু-একটা অক্ষর লেখার বিশেষ ভঙ্গিটা উভয় হাতের লেখাতেই একইরকম।
.
চতুর্দশ পরিচ্ছেদ
দারোগাবাবু বললেন–তবুও একজন হাতের লেখা-বিশেষজ্ঞের মত নেওয়া দরকার নয় কি?
সে তো কোর্টে প্রমাণের সময়। এখন ওসব দরকার নেই। আপনি সন্দেহক্রমে চালান দিন।
আমায় অন্য কারণগুলো সব বলুন।
একে-একে সব বলব–তার আগে একবার কলকাতায় যাওয়া দরকার।
মি. সোমের সঙ্গে দেখা করলাম কলকাতায়। সব বললাম তাঁকে খুলে।
তিনি বললেন–একটা কথা বলি। তোমাদের সাক্ষীসাবুদ প্রমাণ-সূত্রাদির চেয়েও একটা বড়ো জিনিস আছে। এটা সূত্র ধরে অপরাধী বের করতে বড় সাহায্য করে। অন্তত আমায় তো অনেকবার যথেষ্ট সাহায্য করেছে। সেটা হল–অঙ্কশাস্ত্র। অঙ্ক, Chance-এর আঁক কষে বোঝা যায় যে, একজন লোক যে আসামে থাকে বলবে, অথচ দাঁতন করবে, অথচ তার হাতের লেখার সঙ্গে যাকে সন্দেহ করা হচ্চে তার হাতের লেখার হুবহু মিল থাকবে, এ ধরনের ব্যাপার হয়তো তিন হাজারের মধ্যে একটা ঘটে। এক্ষেত্রে যে সে-রকম ঘটেছে, এমন মনে করবার কোনো কারণ নেই–সুতরাং ধরে নিতে হবে ও সেই লোকই।
সেদিন কলকাতা থেকে চলে এলাম। আসবার সময় একবার থানার দারোগাবাবুর সঙ্গে দেখা করি। তিনি বললেন, আপনি লোক পাঠালেই আমি সব ব্যবস্থা করব।
ওয়ারেন্ট বার হয়েছে?
এখনও হস্তগত হয়নি, আজ-কাল পেয়ে যাব।
গ্রামে ফিরে দু-তিন দিন চুপচাপ বসে রইলাম শ্রীগোপালের বাড়িতে। খবর নিয়ে জানলাম, জানকীবাবু দু-একদিনের মধ্যেই এখান থেকে চলে যাবেন। থানার দারোগার কাছে চিঠি দিয়ে আসতে বলে দিলাম।
পকেটে মিসমিদের কবচখানা রেখে আমি জানকীবাবুর সন্ধানে ফিরতে থাকি এবং একটু পরে পেয়েও যাই। জানকীবাবুকে কৌশল করে নির্জনে গাঁয়ের মাঠের দিকে নিয়ে গেলাম।
আজ একবার শেষ পরীক্ষা করে দেখতে হবে। হয় এসপার, নয় ওসপার!
জানকীবাবু বললেন–আপনার কাজ কতদূর এগোলো?
এক পাও না। আপনি কী বলেন?
আমি তো ভাবচি, ননীর সম্বন্ধে থানায় গিয়ে বলব।
সন্দেহের কারণ পেয়েছেন?
না পেলে কি আর বলচি?
আচ্ছা জানকীবাবু, আপনি বুঝি আসামে ছিলেন?
কে বললে?
আমি শুনলাম যেন সেদিন কার মুখে।
না, আমি কখনো আসামে ছিলাম না। যিনি বলেচেন, তিনি জানেন না।
আমার মনে ভীষণ সন্দেহ হল। জানকীবাবু একথা বলতে চান কেন? তবে কি তিনি মিসমিদের কবচ হারানো এবং বিশেষ করে সেখানা যদি আমার হাতে পড়ে বা পুলিশের কোনো সুযোগ্য ডিটেকটিভের হাতে পড়ে তবে তার গুরুত্ব সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অবহিত?
আমি তখন আমার কর্তব্য স্থির করে ফেলেচি। বললাম।–মানে, অন্য কেউ বলেনি, আপনার দেওয়া একটা পাতার টোকা সেদিন আপনার শ্বশুরবাড়িতে দেখে ভাবলাম এ টোকা আসাম সদিয়া অঞ্চল ছাড়া কোথাও পাওয়া যায় না–মিসমিদের দেশে অমন টোকার ব্যবহার আছে।
আপনার ভুল ধারণা।
আমি তাঁর মুখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে পকেট থেকে মিসমিদের কাঠের কবচখানা বের করে তাঁর সামনে ধরে বললাম–দেখুন দিকি এ জিনিসটা কী? … চেনেন? যে-রাত্রে গাঙ্গুলিমশায় খুন হন, সে-রাত্রে তাঁর বাড়ির পেছনে এটা কুড়িয়ে পাই। আসামে মিসমিজাতের মধ্যে এই ধরনের কাঠের কবচ পাওয়া যায় কিনা–তাই।
আমার খবরের সঙ্গেসঙ্গে জানকীবাবুর মুখ সাদা ফ্যাকাশে হয়ে গেল–কিন্তু অত্যন্ত অল্পকালের জন্যে। পরমুহূর্তেই ভীষণ ক্রোধে তাঁর নাক ফুলে উঠল, চোখ বড়ো বড়ো হল। হঠাৎ আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই তিনি আমার ঘাড়ে লাফিয়ে পড়লেন বাঘের মতো এবং সঙ্গেসঙ্গে কবচ-সুদ্ধ হাতখানা চেপে ধরে জিনিসটা ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলেন। তাতে ব্যর্থ হয়ে তিনি দু-হাতেই আমার গলা চেপে ধরলেন পাগলের মতো।
আমি এর জন্যে সম্পূর্ণ প্রস্তুত ছিলাম।
বরং জানকীবাবুই আমার যুযুৎসুর আড়াই-পেঁচির ছুটের জন্যে তৈরি ছিলেন না।
তিনি হাতের মাপের অন্তত তিন হাত দূর ছিটকে পড়ে হাঁপাতে লাগলেন।
আমি হেসে বললাম–এ লাইনে যখন নেমেচেন, তখন অন্তত দু-একটা প্যাঁচ জেনে রাখা আপনার নিতান্ত দরকার ছিল জানকীবাবু। কবচ আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারবেন না। কবচ আপনাকে ছেড়ে দিয়েছে। এখন এটা আমার হাতে। এখন ভাগ্যদেবী আমায় দয়া করবেন।
কী বলছেন আপনি?
একথার জবাব দেবেন অন্য জায়গায়। দাঁড়ান একটু এখানে।
থানার দারোগাবাবু কাছেই ছিলেন, আমার ইঙ্গিতে তিনি এসে হাসিমুখে বললেন–দয়া করে একটু এগিয়ে আসুন জানকীবাবু! খুনের অপরাধে আপনাকে আমি গ্রেপ্তার করলাম। …এই, লাগাও!
কনস্টেবলরা এগিয়ে গিয়ে জানকীবাবুর হাতে হাতকড়ি লাগাল।
জানকীবাবু কী বলতে চাইলেন। দারোগাবাবু বললেন–আপনি এখন যা-কিছু বলবেন, আপনার বিরুদ্ধে তা প্রয়োগ করা হবে, বুঝেসুঝে কথা বলবেন।
জানকীবাবুর বিরুদ্ধে পুলিশ আরও অনেক প্রমাণ সংগ্রহ করে। গাঙ্গুলিমশায় খুন হওয়ার পাঁচদিনের মধ্যে তিনি জেলার লোন-অফিস ব্যাংকে সাড়ে ন-শো টাকা জমা রেখেছেন, পুলিশের থানা-তল্লাশিতে তার কাগজ বার হয়ে পড়ল।
তারপর বিচারে জানকীবাবুর যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের আদেশ হয়।
.
পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ
একটা বিষয়ে আমার আগ্রহ ছিল জানবার। জানকীবাবুর সঙ্গে আমি জেলের মধ্যে দেখা করলাম। তখন তাঁর প্রতি দন্ডাদেশ হয়ে গিয়েছে।
আমাকে দেখে জানকীবাবু ভ্রূ কুঞ্চিত করলেন।
আমি জিজ্ঞেস করলাম–কেমন আছেন জানকীবাবু?
ধন্যবাদ! কোনো কথা জিজ্ঞেস করতে হবে না আপনাকে।
একটু বেশি রাগ করেচেন বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু আমায় কর্তব্য পালন করতে হয়েছে, তা বুঝতেই পারছেন।
থাক ওতেই হবে।
দেখুন জানকীবাবু, মনের অগোচর পাপ নেই। আপনি খুব ভালোভাবেই জানেন, আপনি কতদূর হীন কাজ করেছেন। একজন অসহায়, সরল বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ–যিনি আপনাকে গাঁয়ের জামাই জেনে আপনার প্রতি আত্মীয়ের মতো–এমনকী, আপনার শ্বশুরের মতো ব্যবহার করতেন, আপনাকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করে তাঁর টাকাকড়ির হিসেব আপনাকে দিয়ে লেখাতেন –তাঁকে আপনি খুন করেছেন। পরকালে এর জবাবদিহি দিতে হবে যখন, তখন কী করবেন ভাবলেন না একবার?
মশায়, আপনাকে পাদ্রি-সাহেবের মতো লেকচার দিতে হবে না। আপনি যদি এখনই এখান থেকে না যান–আমি ওয়ার্ডারকে ডেকে আপনাকে তাড়িয়ে দেব–বিরক্ত করবেন না।
লোকটা সত্যিই অত্যন্ত কঠোর প্রকৃতির। নররক্তে হাত কলুষিত করেছে, অথচ এখন মনে অনুতাপের অঙ্কুর পর্যন্ত জাগেনি ওর।
আমি বললাম–আপনি সংসারে একা, ছেলেপুলে নেই, স্ত্রী নেই। তাঁরা স্বর্গে গিয়েছেন, কিন্তু আপনার এই কাজ স্বর্গ থেকে কি তাঁরা দেখবেন না আপনি ভেবেচেন? তাঁদের কাছে মুখ দেখাবেন কী করে?
জানকীবাবু চুপ করে রইলেন এবার। আমি ভাবলুম, ওষুধ ধরেচে। আগের-কথাটা আরও সুস্পষ্টভাবে বললাম। জানি না আজ জানকীবাবুর হৃদয়ের নিভৃত কোণে তাঁর পরলোকগত স্ত্রী-পুত্রের জন্য এতটুকু স্নেহপ্রীতি জাগ্রত আছে কিনা! কিন্তু আমার যতদূর সাধ্য তাঁর মনের সে দিকটাতে আঘাত দেবার চেষ্টা করলাম–বহুদিনের মরচেপড়া হৃদয়ের দোর যদি এতটুকু খোলে!
বললাম–ভেবে দেখুন জানকীবাবু, আপনার কাছে কত পবিত্র স্মৃতির আধার হওয়া উচিত যে গ্রাম, সেই গ্রামে বসে আপনি নরহত্যা করেছেন–এ যে কত পাপের কাজ তা যদি আজও বোঝেন, তবুও অনুতাপের আগুনে হৃদয় শুদ্ধ হয়ে যেতে পারে। অনুতাপে মানুষকে নিষ্পাপ করে, মহাপুরুষেরা বলেছেন। আপনি বিশ্বাস করুন বা না-ই করুন, মহাপুরুষদের বাণী তা বলে মিথ্যা হয়ে যাবে না।
জানকীবাবু আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে চেয়ে বললেন–মশায়, আপনি কী কাজ করেন? এই কি আপনার পেশা?
খারাপ পেশা নয় তা স্বীকার করবেন বোধ হয়!
খারাপ আর কী!
দোষীকে প্রায়শ্চিত্ত করবার সুবিধে করে দিই, যাতে তার পরকালে ভালো হয়।
আচ্ছা, এ আপনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন?
নিশ্চয়ই করি।
তবে শুনুন বলি, বসুন।
বেশ কথা, বলুন।
আমার দ্বারাই এ-কাজ হয়েছে।
অর্থাৎ গাঙ্গুলিমশায়কে আপনি…
ও-কথা আর বলবেন না।
বেশ। কেন করলেন?
সে অনেক কথা। আমার উপায় ছিল না।
কেন?
আমি ব্যাবসা করতুম শুনেচেন তো? ব্যাবসা ফেল পড়ে কপর্দকশূন্য হয়ে পড়েছিলাম, চারিদিকে দেনা। লোভ সামলাতে পারলাম না।
আপনার সান্ত্বনা আপনার কাছে। কিন্তু এটা লাগসই কৈফিয়ৎ হল না।
আমি তা জানি। দুর্বল মন আমাদের–কিন্তু আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে বড়ো ইচ্ছে হয়।
স্বচ্ছন্দে বলুন।
আপনি ওই কবচখানা পেয়েছিলেন যেদিন, সেদিন আপনি বুঝতে পেরেছিলেন ওখানা কী?
না।
কবে পারলেন?
আমার শিক্ষাগুরু মি. সোমের কাছে কবচের বিষয় সব জেনেছিলাম। আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব?
বলুন!
আপনি কেন আবার এ-গ্রামে এসেছিলেন, খুনের পরে?
আপনি নিশ্চয়ই তা বুঝেছেন।
আন্দাজ করেছি। কবচখানা হারিয়ে গিয়েছিল খুনের রাত্রেই–সেখানা খুঁজতে এসেছিলেন।
ঠিক তাই।
সেদিন গাঙ্গুলিমশায়ের বাড়ির পেছনের জঙ্গলে অন্ধকারে ওটা খুঁজছিলেন কেন, দিনমানে না খুঁজে?
দিনেই খুঁজতে শুরু করেছিলাম, রাত হয়ে পড়ল।
ওখানেই যে হারিয়েছিলেন, তা জানলেন কী করে?
ওটা সম্পূর্ণ আন্দাজি-ব্যাপার! কোনো জায়গায় যখন খুঁজে পেলাম না তখন মনে পড়ল, ওই জঙ্গলে দাঁতন ভেঙেছিলাম, তখন পকেট থেকে পড়ে যেতে পারে। তাই–
আমি ওঁর মুখে একটা ভয়ের চিহ্ন পরিস্ফুট হতে দেখলাম। বললাম–সব কথা খুলে বলুন। আমি এখনও আপনার সব কথা শুনিনি! তবে আপনার মুখ দেখে তা বুঝতে পারছি।
জানকীবাবু ফিসফিস করে কথা বলতে লাগলেন, যেন তাঁর গোপনীয় কথা শুনবার জন্যে জেলে সেই ক্ষুদ্র কামরার মধ্যে কেউ লুকিয়ে ওৎ পেতে বসে রয়েছে। তাঁর এ ভাব পরিবর্তনে আমি একটু আশ্চর্য হয়ে গেলাম। ভয়ে দুঃখে লোকটার মাথা খারাপ হয়ে গেল না কি?
আমায় বললেন–ওখানা এখন কোথায়?
একজিবিট হিসেবে কোর্টেই জমা আছে।
তারপর কে নিয়ে নেবে?
আপনার সম্পত্তি, আপনার ওয়ারিশান কোর্টে দরখাস্ত করলে–
জানকীবাবু ভয়ে যেন কোনো অদৃশ্য শত্রুকে দু-হাত দিয়ে ঠেলে দেবার ভঙ্গিতে হাত নাড়তে নাড়তে বললেন–না না আমি ও চাইনে, আমার ওয়ারিশান কেউ নেই, ও আমি চাইনে–ওই সর্বনেশে কবচই আমাকে আজ এ-অবস্থায় এনেচে। আপনি জানেন না ও কী!
এই পর্যন্ত বলে তিনি চুপ করে গেলেন। যেন অনেকখানি বেশি বলে ফেলেচেন– যা বলবার ইচ্ছে ছিল তার চেয়েও বেশি। আর তিনি কিছু বলতে চান না বা ইচ্ছে করেন না।
আমি বললাম–আপনি যদি না নিতে চান, আমি কাছে রাখতে পারি।
আমার দিকে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে চেয়ে জানকীবাবু বললেন–আপনি সাহস করেন?
এর মধ্যে সাহস করবার কী আছে? আমায় দেবেন।
আপনি আমায় পুলিশে ধরিয়ে দিয়েছেন, আপনি আমার শত্রু–তবুও এখন ভেবে দেখচি, আমার পাপের প্রায়শ্চিত্তের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন আপনি! আপনার ওপর আমার রাগ নেই। আমি আপনাকে বন্ধুর মতো পরামর্শ দিচ্চিও-কবচ আপনি কাছে রাখতে যাবেন না।
কেন?
সে-অনেক কথা। সংক্ষেপে বললাম–ও-জিনিসটা দূরে রেখে চলবেন।
আমি যেজন্যে আজ জানকীবাবুর কাছে এসেছিলাম, সে উদ্দেশ্য সফল হতে চলেছে। আমি এসেছিলাম আজ ওঁর মুখে কবচের ইতিহাস কিছু শুনব বলে। আমার ওভাবে কথা পাড়বার মূলে এই একটা উদ্দেশ্য ছিল। অনুনয়ের সুরে কোনো কথা বলে জানকীবাবুর কাছে কাজ আদায় করা যাবে না এ আমি আগেই বুঝেছিলাম, সুতরাং আমি তাচ্ছিল্যের সুরে বললাম–আমার কোনো কুসংস্কার নেই জানবেন।
জানকীবাবু খোঁচা খেয়ে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠে বললেন–কুসংস্কার কাকে বলেন আপনি?
আপনার মতো ওইসব মন্ত্র-তন্ত্র-কবচে বিশ্বাস–ওর নাম যদি কুসংস্কার না হয়, তবে কুসংস্কার আর কাকে বলব?
জানকীবাবু ক্রোধের সুরে বললেন–আপনি হয়তো ভালো ডিটেকটিভ হতে পারেন, কিন্তু দুনিয়ার সব জিনিসই তা বলে আপনি জানবেন?
আমি পূর্বের মতো তাচ্ছিল্যের সুরেই বললাম–আমার শিক্ষাগুরু একজন আছেন, তাঁর বাড়িতে ওরকম একখানা কবচ আছে।
কে তিনি?
মি. সোম, বিখ্যাত প্রাইভেট ডিটেকটিভ।
যিনিই হোন, আমার তা জানবার দরকার নেই। একটা কথা আপনাকে বলি। যদি আপনি তাঁর মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী হন, তবে অবিলম্বে তাঁকে বলবেন সেখানা গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দিতে। কতদিন থেকে তাঁর সঙ্গে সেখানা আছে, জানেন।
তা জানিনে, তবে খুব অল্পদিনও নয়। দু-তিন বছর হবে।
আর আমার সঙ্গে এ-কবচ আছে সাত বছর। কিন্তু থাকগে।
বলেই জানকীবাবু চুপ করলেন। আর যেন তিনি মুখই খুলবেন না, এমন ভাব দেখালেন।
আমি বললাম–বলুন, কী বলতে চাইছিলেন?
অন্য কিছু নয়, ও-কবচখানা আপনি আপনার গুরুকে টান মেরে ভাসিয়ে দিতে বলবেন– আর, এখানাও আপনি কাছে রাখবেন না।
আমি তো বলেচি আমার কোনো কুসংস্কার নেই।
অভিজ্ঞতা দ্বারা যা জেনেছি, তাকে কুসংস্কার বলে মানতে রাজি নই। বেশি তর্ক আপনার সঙ্গে করব না। আপনি থাকুন কী উচ্ছন্নে যান, তাতে আমার কী?
এই যে খানিক আগে বলেছিলেন, আমার ওপর আপনার কোনো রাগ নেই?
ছিল না, কিন্তু আপনার নির্বুদ্ধিতা আর দেমাক দেখে রাগ হয়ে পড়েছে।
দেমাক দেখলেন কোথায়? আপনি তো কোনো কারণ দেখাননি। শুধুই বলে যাচ্ছেন– কবচ ফেলে দাও। আজকাল কোনো দেশে এসব মন্ত্রে-তন্ত্রে বিশ্বাস করে ভেবেচেন? একখানা কাঠের পাত মানুষের অনিষ্ট করতে পারে বলে আপনিও বিশ্বাস করেন?
আমিও আগে ঠিক এই কথাই ভাবতাম, কিন্তু এখন আমি বুঝেছি। কিন্তু বুঝেছি এমন সময় যে, যখন আর কোনো চারা নেই।
জিনিসটা কী, খুলে বলুন না দয়া করে!
শুনবেন তবে? ওই কবচই আমার এই সর্বনাশের কারণ। আমি বুঝেছিলাম এ-সম্বন্ধে জানকীবাবু কী একটা কথা আমার কাছে চেপে যাচ্ছেন। আগে একবার বলতে গিয়েও বলেননি, হঠাৎ গুম খেয়ে চুপ করে গিয়ে অন্য কথা পেড়েছিলেন। এবার হয়তো তার পুনরাবৃত্তি করবেন।
সুতরাং, আমি যেন তাঁর আসল কথার অর্থ বুঝতে পারিনি এমন ভাব দেখিয়ে বললাম– তা বটে। একদিক থেকে দেখতে হলে, ওই কবচখানাই তো আপনার বর্তমান অবস্থার জন্যে দায়ী।
জানকীবাবু আমার দিকে কৌতূহলের দৃষ্টিতে চেয়ে বললেন–আপনি কী বুঝেছেন, বলুন তো? কীভাবে দায়ী।
মানে, ওখানা না হারিয়ে গেলে তো আপনি আজ ধরা পড়তেন না–যদি ওখানা পকেট থেকে না পড়ে যেত?
কিছুই বোঝেননি।
এ-ছাড়া আর কী বোঝবার আছে?
আজ যে আমি একজন খুনি, তাও জানবেন ওই সর্বনেশে কবচের জন্যে। কবচ যদি আমার কাছে না থাকত তবে আজ আমি একজন মার্চেন্ট হতে পারে ব্যাবসাতে লোকসান দিয়েছিলাম–কিন্তু ব্যাবসা করতে গেলে লাভ-লোকসান কার না হয়? আমার বুকে সাহস ছিল, লোকসান আমি লাভে দাঁড় করাতে পারতাম। কিন্তু ওই কবচ তা আমায় করতে দেয়নি। ওই কবচ আমার ইহকাল-পরকাল নষ্ট করেছে!
জানকীবাবুর মুখের দিকে চেয়ে বুঝলাম, গল্প বলবার আসন্ন নেশায় তিনি উত্তেজিত হয়ে উঠেচেন। চুপ করে জিজ্ঞাসু-দৃষ্টিতে তাঁর মুখের দিকে চেয়ে রইলাম।
জানকীবাবু বললেন–আজ প্রায় পঁচিশ বছর আমি সদিয়া অঞ্চলে ব্যাবসা করছি। পরশুরামপুর-তীর্থের নাম শুনেছেন?
খুব।
ঘন জঙ্গলের পাশে ওই তীর্থটা পড়ে। ওখান থেকে আরও সত্তর মাইল দূরে ভীষণ দুর্গম বনের মধ্যে আমি জঙ্গল ইজারা নিয়ে পাটের ব্যাবসা শুরু করি। ওখানে দফলা, মিরি, মিসমি এইসব নামের পার্বত্য-জাতির বাস। একদিন একটা বনের মধ্যে কুলিদের নিয়ে ঢুকেছি। জায়গাটার একদিকে ঝরনা, একদিকে উঁচু পাহাড়। তার গায়ে ঘন বাঁশবন। ওদিকে প্রায় সব পাহাড়েই বাঁশবন অত্যন্ত বেশি। কখনো গিয়েছেন ওদিকে?
আমি বললাম–না, তবে খাসিয়া পাহাড়ে এমন বাঁশবন দেখেচি, শিলং যাওয়ার পথে।
জানকীবাবুর গল্পটা আমি আমার নিজের ধরনেই বলি।
সেই পাহাড়ি-বাঁশবনে বন কাটবার জন্যে ঢুকে তাঁরা দেখলেন, এক জায়গায় একটা বড়ো শালগাছের নীচে আমাদের দেশের বৃষ-কাষ্ঠের মতো লম্বা ধরনের কাঠের খোদাই এক বিকট-মূর্তি দেবতার বিগ্রহ।
কুলিরা বললে–বাবু, এ মিসমিদের অপদেবতার মূর্তি, ওদিকে যাবেন না।
জানকীবাবুর সঙ্গে ক্যামেরা ছিল, তাঁর শখ হল মূর্তিটার ফোটো নেবেন। কুলিরা বারণ করলে, জানকীবাবু তাদের কথায় কর্ণপাত না করে ক্যামেরা তেপায়ার উপর দাঁড় করিয়েছেন, এমন সময় একজন বৃদ্ধ মিসমি এসে তাদের ভাষায় কী বললে। জানকীবাবুর একজন কুলি সে ভাষা জানত। সে বললে–বাবু, ফোটো নিও না, ও বারণ করছে।
অন্য অন্য কুলিরাও বললে–বাবু, এরা জবর জাত–সরকারকে পর্যন্ত মানে না। ওদের দেবতাকে অপমান করলে গাঁ-সুদ্ধ তির ধনুক দিয়ে এসে হাজির হয়ে আমাদের সবগুলোকে গাছের সঙ্গে গেঁথে ফেলবে। ওরা দুনিয়ার কাউকে ভয় করে না, কারো তোয়াক্কা রাখে না– ওদের দেবতার ফোটো খিচবার দরকার নেই।
জানকীবাবু ক্যামেরা বন্ধ করলেন–এতগুলি লোকের কথা ঠেলতে পারলেন না। তারপর নিজের কাজকর্ম সেরে তিনি যখন জঙ্গল থেকে ফিরবেন, তখন আর-একবার সেই দেবমূর্তি দেখবার আগ্রহ হল।
সন্ধ্যার তখন বেশি দেরি নেই, পাহাড়ি-বাঁশবনের নিবিড় ছায়া-গহন পথে বন্য-জন্তুদের অতর্কিত আক্রমণের ভয়, বেণুবনশীর্ষে ক্ষীণ সূর্যালোক ও পার্বত্য-উপত্যকার নিস্তব্ধতা সকলের মনে একটা রহস্যের ভাব এনে দিয়েচে, কুলিদের বারণ সত্ত্বেও তিনি সেখানে গেলেন।
সবাই ভীত ও বিস্মিত হয়ে উঠল যখন সেখানে গিয়ে দেখলে, কোন সময় সেখানে একটি শিশু বলি দেওয়া হয়েছে। শিশুটির ধড় ও মুন্ড পৃথক পৃথক পড়ে আছে, কাঠে-খোদাই বৃষকাষ্ঠ-জাতীয় দেবতার পাদমূলে! অনেকটা জায়গা নিয়ে কাঁচা আধশুকনো রক্ত।
সেখানে সেদিন আর তাঁরা বেশিক্ষণ দাঁড়ালেন না।…
জানকীবাবু বললেন–আমার কী কুগ্রহ মশায়, আর যদি সেখানে না যাই তবে সবচেয়ে ভালো হয়, কিন্তু তা না করে আমি আবার পরের দিন সেখানে গিয়ে হাজির হলাম। কুলিদের মধ্যে একজন লোক আমায় যথেষ্ট নিষেধ করেছিল, সে বলেছিল, বাবু, তুমি কলকাতার লোক, এসব দেশের গতিক কিছু জান না। জংলি-দেবতা হলেও ওদের একটা শক্তি আছে– তা তোমাকে ওদের পথে নিয়ে যাবে, তোমার অনিষ্ট করবার চেষ্টা করবে–ওখানে অত যাতায়াত কোরো না বাবু। কিন্তু কারো কথা শুনলাম না, গেলাম শেষপর্যন্ত। লুকিয়েই গেলাম, পাছে কুলিরা টের পায়।
কেন যে জানকীবাবু সেখানে গেলেন, তিনি তা আজও ভালো জানেন না।
কিংবা হয়তো রক্তপিপাসু বর্বর দেবতার শক্তিই তাঁকে সেখানে যাবার প্ররোচনা দিয়েছিল… কে জানে!
জানকীবাবু বললেন–ক্যামেরা নিয়ে যদি যেতাম, তাহলে তো বুঝতাম ফোটো নিতে যাচ্ছি–তাই বলেছিলাম, কেন যে সেখানে গেলাম, তা নিজেই ভালো জানি নে!
আমি বললাম–সে-মূর্তির ফোটো নিয়েছিলেন?
–না, কোনো দিনই না। কিন্তু তার চেয়ে খারাপ কাজ করেছিলাম, এখন তা বুঝতে পারচি।
জানকীবাবু যখন সেখানে গেলেন, তখন ঠিক থমথম করচে দুপুর বেলা, পাহাড়ি পাখিদের ডাক থেমে গিয়েছে, বনতল নীরব, বাঁশের ঝাড়ে ঝাড়ে শুকনো বাঁশের খোলা পাতা পড়বার শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই।
দেবমূর্তির একেবারে কাছে যাবার অত্যন্ত লোভ হল–কারণ, কুলিরা সঙ্গে থাকায় এতক্ষণ তা তিনি করতে পারেননি।
গিয়ে দেখলেন, শিশুর শবের চিহ্নও সেখানে নেই। রাত্রে বন্যজন্তুতে খেয়েই ফেলুক, বা জংলিরাই নিজেরা খাবার জন্যে সরিয়ে নিয়ে যাক। অনেকক্ষণ তিনি মূর্তিটার সামনে দাঁড়িয়ে রইলেন– কেমন এক ধরনের মোহ, একটা সুতীব্র আকর্ষণ! সত্যিকার নরবলি দেওয়া হয় যে দেবতার কাছে, এমন দেবতা কখনো দেখেননি বলেই বোধ হয় আকর্ষণটা বেশি প্রবল হল, কিংবা অন্য কিছু তা বলতে পারেন না তিনি।
সেই সময় এই কাঠের কবচখানা দেবমূর্তির গলায় ঝুলতে দেখে জানকীবাবু কিছু না ভেবে –চারিদিকে কেউ কোথাও নেই দেখে– সেখানা চট করে মূর্তিটার গলা থেকে খুলে নিলে।…
আমি বিস্মিতসুরে বললাম–খুলে নিলেন! কী ভেবে নিলেন হঠাৎ?
ভাবলাম একটা নিদর্শন নিয়ে যাব এদেশের জঙ্গলের দেবতার, আমাদের দেশের পাঁচজনের কাছে দেখাব! নরবলি খায় যে দেবতা, তার সম্বন্ধে যখন বৈঠকখানায় জাঁকিয়ে বসে গল্প করব তখন সঙ্গে সঙ্গে এখানা বার করে দেখাব। লোককে আশ্চর্য করে দেব, বোধ হয় এইরকমই একটা উদ্দেশ্য তখন থেকে থাকবে। কিন্তু যখন নিলাম গলা থেকে খুলে, তখনই মশায় আমার সর্বশরীর যেন কেঁপে উঠল। যেন মনে হল একটা কী অমঙ্গল ঘনিয়ে আসচে আমার জীবনে। ও-ধরনের দুর্বলতাকে কখনোই আমল দিইনি– সেটা খুলে নিয়ে পকেটজাত করে ফেললাম একবারে। মিসমিদের অনেকে এ-রকম কবচ গলায় ধারণ করে, সেটাও দেখেছি কিন্তু তারপরে। শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে যাবার সময় বিশেষ করে এ-কবচ তারা পরবেই।
তারপর?
তারপর আর কিছুই না। সাতবছর কবচ আছে আমার কাছে। জংলি-জাতের জংলি দেবতার কবচ, ও ধীরে ধীরে আমায় নামিয়েছে এই সাতবছরে। এক-একটা জিনিসের এক একটা শক্তি আছে। আমায় জাল করিয়েছে, পাওনাদারের টাকা মেরে দেবার ফন্দি দিয়েছে– শেষকালে মানুষের রক্তে হাত রাঙিয়ে দিলে পর্যন্ত। একজন সম্ভ্রান্ত ভদ্র ব্যাবসাদার ছিলুম মশায়–আজ কোথায় এসে নেমেছি দেখুন! এ-প্রবৃত্তি জাগাবার মূলে ওই কবচখানা! আমি দেখেচি, যখনই ওখানা আমার কাছে থাকত, তখনই নানা রকম দুষ্টুবুদ্ধি জাগত মনে– কাকে মারি, কাকে ফাঁকি দিই। লোভ জিনিসটা দুর্দমনীয় হয়ে উঠত। গাঙ্গুলিমশায়ের খুনের দিনের রাত্রে আমি দশটার গাড়িতে অন্ধকারে ইস্টিশানে নামি। কেউ আমায় দেখেনি। আমার পকেটে ওই কবচ–কিন্তু যাক সে-কথা, আর এখন বলব না।
বলুন না।
না। আমার ঘাড় থেকে এখন ভূত নেমে গিয়েছে, আর সে-ছবি মনে করতে পারব না। এখন করলে ভয় হয়। নিজের কাজ করেই কবচ সরে পড়ল সে-রাত্রেই। আমার সর্বনাশ করে ওর প্রতিহিংসা পূর্ণ হল বোধ হয়–কে বলবে বলুন! স্টিমারে আমায় একজন বারণ করেছিল কিন্তু। আসাম থেকে ফিরবার পথে ব্রহ্মপুত্রের ওপর স্টিমারে একজন বৃদ্ধ আসামি ভদ্রলোককে ওখানা দেখাই। তিনি আমায় বললেন, এ কোথায় পেলেন আপনি? এ মিরি আর মিসমিদের কবচ, পশু এখানে মানুষের স্থান নিয়েছে, ওরা যখন অপরের গ্রাম আক্রমণ করতে যেত–অপরকে খুন-জখম করতে যেত–তখন দেবতার মন্ত্রপূত এই কবচ পরত গলায়। এ-আপনি কাছে রাখবেন না, আপনাকে এ অমঙ্গলের পথে নিয়ে যাবে। তখনও যদি তার কথা শুনি তাহলে কি আজ এমন হয়? তাই আপনাকে আমি বলছি, আমি তো গেলামই–ও-কবচ আপনি আপনার কাছে কখনো রাখবেন না।
জানকীবাবু চুপ করলেন। যে উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছিলাম তা পূর্ণ হয়েছে। জানকীবাবুর মুখে কবচের ইতিহাসটা শুনবার জন্যেই আসা।
বললাম–আমি যা করেচি, কর্তব্যের খাতিরে করেছি। আমার বিরুদ্ধে রাগ পুষে রাখবেন না মনে। আমায় ক্ষমা করবেন। নমস্কার!
বিদায় নিয়ে চলে এলাম ওর কাছ থেকে।
* * * *
যতদূর জানি–এখন তিনি আন্দামানে।