শ্ৰীযুক্ত সুধীন্দ্রনাথ সরকার টেলিফোন–সাউথ ৯৩২
১৫৪, হরিশ মুখুজ্যে রোড ৭২, বকুলবাগান রোড
কলিকাতা–২৫ কলিকাতা-২৫
১৫/১০/৫২
প্রীতিভাজনেষু,
সুন্দরবনে সাত বৎসর বইখানি খুব ভালো লাগল, লেখা ছবি ছাপা কাগজ সবই উত্তম। ছোটো ছেলে-মেয়েরা অ্যাডভেঞ্চার পড়তে ভালোবাসে। এরকম রচনা রূপকথা বা ডিটেকটিভ গল্পের চাইতে হিতকর মনে করি, কারণ, পড়লে মনে সাহস হয়, কিছু জ্ঞানলাভও হয়। সাহসিক অভিযান বা বিপদসংকুল ঘটনাবলির জন্য আফ্রিকায় বা চন্দ্রলোকে যাবার দরকার দেখি না, ঘরের কাছে যা পাওয়া যায় তার বর্ণনাই বাস্তবের সঙ্গে বেশি খাপ খায় এবং স্বাভাবিক মনে হয়। সুন্দরবন রহস্যময় স্থান, নিসর্গশোভা নদী সমুদ্র নানারকম গাছপালা বন্যজন্তু আর সংকটের সম্ভাবনা সবই সেখানে আছে। এই সবের বর্ণনা এবং চিত্র থাকায় আপনার বইখানি অতি চিত্তাকর্ষক হয়েছে। যাদের জন্য লিখেছেন তারা পড়লে খুব খুশি হবে সন্দেহ নেই।
ভবদীয়
রাজশেখর বসু
.
মাঘ মাসে মকরসংক্রান্তি উপলক্ষে সাগরদ্বীপে প্রতি বৎসরই একটি খুব বড়ো রকমের মেলা বসিয়া থাকে। মকরসংক্রান্তিতে গঙ্গাসাগর-স্নান করিতে তখন নানাদেশের লোক আসিয়া জড়ো হয়। এইস্থানে সমুদ্রের সহিত গঙ্গার মিলন হইয়াছে, এইজন্য ইহা একটি তীর্থস্থান। প্রতি বৎসর হাজার হাজার লোক বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা এবং নেপাল ও পাঞ্জাব প্রভৃতির দূর দেশ হইতেও এইখানে এই যোগ উপলক্ষে আসিয়া থাকে। বহু সাধুসন্ন্যাসীরও সমাগম হয় এবং মেলায় নানাদেশ হইতে ব্যবসায়ী লোক আসিয়া উপস্থিত হয়।
সমুদ্রতীরে বিস্তীর্ণ বালুকারাশির উপর এই বৃহৎ মেলাটি বসিয়া থাকে। তীর্থের কাজে তিন দিনের বেশি লাগে না বটে, কিন্তু মেলাটি চলে অনেক দিন। যাত্রীরা ভোরে উঠিয়া সাগরে স্নান করে; তারপর পঞ্চরত্ন দিয়া সাগরে পূজা করিয়া কপিল মুনির মন্দিরে গিয়া মুনির প্রতিমূর্তি দর্শন করে এবং সেখানেও পূজা দেয়। মন্দিরের বাহিরে একটি বটগাছ আছে, তাহার তলায় রাম এবং হনুমানের মূর্তি এবং কপিল মুনিরও একটি মূর্তি দেখিতে পাওয়া যায়। মন্দিরের পিছনে একটি কুন্ড আছে তাহার নাম সীতাকুন্ড। যাত্রীরা পান্ডাদিগকে পয়সা দিয়া এই কুন্ডের এক বিন্দু জল প্রত্যেকেই পান করিয়া থাকে। কপিল মুনির মন্দিরের ভিতর যাইতেও প্রত্যেক যাত্রীকে চারি আনা করিয়া দিতে হয়।
পূর্বেই বলিয়াছি, সমুদ্রতীরে বিস্তীর্ণ বালুকারাশির উপর এই মেলাটি বসিয়া থাকে। মেলার জন্য যে-সমস্ত কুঁড়েঘর তোলা হয়, তাহা ছাড়া কোনো ঘরবাড়ি এখানে নাই; অন্তত আমরা যে-সময়ের কথা লিখিতেছি, সেসময়ে দেখি নাই। সুতরাং, নৌকা ভিন্ন অন্য কোনো আশ্রয় যাত্রীদিগের ছিল না। তখন স্টিমার ছিল না, যাত্রীদিগকে নৌকা করিয়াই গঙ্গাসাগরে যাইতে হইত। কিন্তু সেই তীর্থস্থানে নৌকায় বাস করা অপেক্ষা, সেই অনাবৃত বালুকারাশির উপর শয়ন করিয়া রাত্রিযাপন করায় বেশি পুণ্য বলিয়া অনেকে তাহাই করিত!
তীর্থস্থানে অনেকে যেমন পুণ্য সঞ্চয় করিতে যায়, তেমনি অনেকে আবার কু-মতলবেও গিয়া থাকে। একদিকে যেমন সাধু-সন্ন্যাসীরা আসেন, অন্য দিকে তেমনি চোর-ডাকাতেরও অভাব থাকে না। আমরা যে-সময়ের কথা লিখিতেছি, সেসময় দেশে চোর-ডাকাতের অত্যন্ত উপদ্রব ছিল।
তখন আমার বয়স বড়ো বেশি নয়। আমি দাদামহাশয়ের সহিত গঙ্গাসাগর গিয়াছিলাম। দাদামহাশয় সাগরে গিয়াছিলেন পুণ্যস্নানে; আমি গিয়াছিলাম মেলা দেখিতে। বাড়ির কাহারও ইচ্ছা ছিল না যে আমি যাই এবং দাদামহাশয়ও আমাকে প্রথমটা সঙ্গে লইয়া যাইতে রাজি হন নাই। কিন্তু আমি জেদ ধরিয়া বসিলাম–যাইবই। জানিতাম, আমার আবদার কখনোই অপূর্ণ থাকে না। যখনই যে-আবদার করিতাম, তাহা যতই কেন অসংগত হউক না, যতই কেন অসম্ভব হউক না, তাহা অপূর্ণ থাকিত না। ইহার ফল এই দাঁড়াইয়াছিল যে, ন্যায্য আবদার ছাড়িয়া ক্রমে আমি নানাপ্রকার অন্যায় আবদার করিতে সাহসী হইয়াছিলাম। যদি প্রথম হইতেই আমার জেদ বজায় না থাকিত, যদি প্রথম হইতেই একটু শাসন হইত তাহা হইলে আমি অত আবদারে হইতাম না। কিন্তু যখন দেখিলাম, আমি যখনই যে জেদ করি, তাহাই বজায় থাকে; যে আবদার করি, তাহাই পূর্ণ হয় তখন আমার সাহস বাড়িয়া গেল। সে যাহা হউক, আমি তো জেদ করিয়া বসিলাম–যাইব-ই; হইলও তাহাই। দাদামহাশয় আমাকে ফেলিয়া যাইতে পারিলেন না।
যথাসময়ে গঙ্গাসাগরে আমাদের বজরা আসিয়া পৌঁছিল। সাগরযাত্রীদের নৌকাগুলি যেখানে সারি সারি বাঁধা ছিল, আমাদের বজরা সেইখানে বাঁধা হইল। ছোটো-বড়ো অনেকগুলি নৌকা সেখানে ছিল বটে, কিন্তু বজরা আর একখানিও ছিল না। তাই আমাদের বজরা লাগিবামাত্র দলে দলে লোক আসিয়া আমাদের বজরা দেখিতে লাগিল। যাহাদের কাজকর্ম আছে, তাহারা একটু দেখিয়াই চলিয়া গেল। আর যাহাদের কাজকর্ম নাই, তাহারা দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া শেষে বসিল; বসিয়া বসিয়া বজরার আকৃতি সৌন্দর্য সম্বন্ধে অনেক সমালোচনা করিল। বজরার মালিক যে একজন খুব বড়োলোক, সে-সম্বন্ধে সকলেই একমত হইল এবং একজন যে খুব বড়োলোক সাগরস্নানে আসিয়াছে, অল্পক্ষণ মধ্যে সে-সংবাদটা প্রচার হইয়া গেল।
আমরা বজরা হইতে বাহির হইয়া দেখিলাম, বহু নিষ্কর্মা লোক এবং ভিক্ষুক বজরার কাছে জড়ো হইয়াছে। যাহা হউক, আমরা তীরে উঠিলাম। দাদামহাশয় একজন বিশ্বস্ত লোকের হাতে আমার ভার দিয়া নিজে তীর্থকার্য করিতে গেলেন। আমি সেই লোকটির সঙ্গে ঘুরিয়া ঘুরিয়া মেলা দেখিয়া বেড়াইতে লাগিলাম।
দাদামহাশয় সমস্ত দিন তাঁহার নিজের কাজ লইয়া থাকিতেন, আমি কী করিতাম না করিতাম তাহা দেখিবার তাঁহার অবসর ছিল না। আমি সমস্ত দিন মেলায় ঘুরিয়া বেড়াইতাম। মেলায় যে কেবল ঘুরিয়া বেড়াইতাম, তাহা নয়। দাদামহাশয়ের হুকুম ছিল, আমি যখন যাহা চাহিব, তখনই তাহা দিতে হইবে। সুতরাং, আমার খুব মজা। আমি নাগরদোলায় চড়িতাম, যাহা খুশি কিনিতাম–তিন দিন কী আনন্দেই না কাটাইয়াছিলাম! কেবল সেই তিন দিনের মধ্যে মেলায় যে-সমস্ত জিনিস আসিয়াছিল, এটা-ওটা করিয়া তাহার প্রায় সমস্ত জিনিসের অন্তত এক-একটি করিয়া আমি সংগ্রহ করিয়া লইলাম।
আমার চলাফেরা এবং ভাবগতিক দেখিয়া সকল লোকই আমাকে লক্ষ করিত এবং অনেক নিষ্কর্মা লোক আমাদের সঙ্গে সঙ্গে ঘুরিত। আমরা যেদিন সেখানে পৌঁছিলাম, তাহার পরদিন হইতে দেখিলাম, মগের মতো চেহারা একটা লোক, প্রায় সমস্ত দিনই আমাদের সঙ্গে সঙ্গে ঘুরিল। কিন্তু সে-লোকটি অন্যান্য লোকের মতো আমাদের কাছে কাছে বড়ো থাকে নাই এবং কোনো কথাও আমাদিগকে জিজ্ঞাসা করে নাই, দূরে দূরে থাকিয়া আমাদিগকে লক্ষ করিতেছিল। পরদিন আমরা মেলায় গিয়া সে-লোকটাকে আর দেখিতে পাইলাম না। কিন্তু একটি মগ বালক সেদিন আমার সঙ্গ লইল। সে ছিল আমার সমবয়সি। সুতরাং, অতি অল্পকাল মধ্যেই তাহার সহিত আমার বেশ ভাব হইয়া গেল। মেলায় বেড়াইতে সে সেই স্থানের অনেক বিবরণ আমাকে দিল, অনেক গল্প করিল এবং আমাদের বাড়িঘরের কথাও জিজ্ঞাসা করিল। ছেলেটিকে আমি মেলা হইতে কয়েকটা জিনিস কিনিয়া দিলাম এবং সন্ধ্যার সময় বজরায় ফিরিলাম। মনে পড়ে ছেলেটি আমার সঙ্গে সঙ্গে বজরা পর্যন্ত আসিয়াছিল; আমি বজরায় উঠিলে সে ফিরিয়া যায়। এই মগ বালকটির উপর আমার কেমন একটু মায়া হইয়াছিল, আমি বজরার ভিতরে যাইয়া, সে চলিয়া গিয়াছে কিনা দেখিবার জন্য তীরের দিকে চাহিলাম। চাহিয়া দেখি, সেই বালকটি তীরের কিছু দূরে পূর্বদিনের সেই লোকটার সঙ্গে দাঁড়াইয়া কী যেন কথা কহিতেছে। মগ বালকটির উপর সেদিন আমার যেমন একটু মায়া হইয়াছিল, সেই লোকটার প্রতি তেমনি পূর্বদিন আমার কেমন একটা বিরক্তি জন্মিয়াছিল। তাই সেই মগ বালককে লোকটার সহিত কথা কহিতে দেখিয়া আমার কেমন যেন ভালো বোধ হইল না।
যাহা হউক পরদিন প্রাতঃকালে আমাদের বাড়ি ফিরিবার কথা; সুতরাং তাহার বন্দোবস্ত হইতে লাগিল। দাদামহাশয় সন্ধ্যার সময় আসিয়া বলিয়া গেলেন যে, তিনি সমস্ত রাত্রি কপিল মুনির মন্দিরে বসিয়া জপ-তপ করিবেন, ভোরে বজরায় ফিরিয়া আসিবেন এবং তখনই বজরা খোলা হইবে।
সন্ধ্যার পরেই আমাদের খাওয়া শেষ হইল এবং সমস্ত দিনের ক্লান্তির পর অল্পকাল মধ্যেই আমি ঘুমাইয়া পড়িলাম।
কতক্ষণ ঘুমাইয়াছিলাম জানি না। হঠাৎ কী একটা শব্দে আমার ঘুম ভাঙিয়া গেল। অন্ধকারে জাগিয়া অকারণেই কেমন যেন একটু ভয় ভয় করিতে লাগিল। রাত্রি প্রভাত হইয়াছে কিনা দেখিবার জন্য আমি বজরার এক ধারের জানালা তুলিয়া তীরের দিকে চাহিলাম, কিন্তু এ কী, তীর কোথায়! চাহিয়া দেখিলাম, যত দূর দৃষ্টি যায়, কেবল জল! নদীর দিকের জানালাটা খুলিয়াছি মনে করিয়া, ফিরিয়া গিয়া অন্য দিকের জানালাটা খুলিলাম; দেখিলাম,–সেদিকেও তাহাই, চারিদিকেই জল, কূলকিনারা নাই। বড়ো ভয় হইল। আমার যিনি অভিভাবক ছিলেন তাঁহাকে ডাকিলাম এবং তিনি উঠিলে তাঁহাকে সমস্ত বলিলাম। তিনি আমার কথা শুনিয়া বাহিরে গেলেন, গিয়া দেখিলেন–সত্যসত্যই বজরা আর তীরের কাছে বাঁধা নাই, অকূল সমুদ্রে ভাসিয়া চলিয়াছে। তিনি তৎক্ষণাৎ মাঝিদিগকে ডাকিয়া তুলিলেন। তিনি মনে করিয়াছিলেন বুঝি কোনো প্রকারে বজরার বাঁধন খুলিয়া গিয়াছে এবং সেইজন্য বজরা স্রোতে ভাসিয়া চলিয়াছে। মাঝিরা তাড়াতাড়ি উঠিল এবং উঠিয়া যাহা দেখিল তাহাতে একটু ভীত হইল। একজন মাঝি তাড়াতাড়ি হালের দিকে যাইবে, এমন সময় হালের নিকট হইতে কে অতি কর্কশ কণ্ঠে কহিল, খবরদার, কেউ এক পা নড়েছ কী মরেছ?
মাঝি চাহিয়া দেখিল, হালের কাছে তিনজন লোক তলোয়ার হাতে দাঁড়াইয়া আছে! ওদিকে বজরার সম্মুখের দিকে ছয়-সাতজন লোক নিঃশব্দে বসিয়াছিল, তাহারাও এই কথায় উঠিয়া দাঁড়াইল। রাত্রির ক্ষীণ আলোকে আমি নৌকার ভিতর হইতে দেখিলাম, তাহাদের প্রত্যেকের হাতেই তলোয়ার রহিয়াছে। আমার অভিভাবক তাড়াতাড়ি আমার কাছে আসিয়া বলিলেন, সর্বনাশ হয়েছে, আমরা আরাকানী দস্যুদের হাতে পড়েছি।
ডাকাতের হাতে পড়িয়াছি শুনিয়া আমার সর্বাঙ্গ হিম হইয়া গেল। আমি আর কথা কহিতে পারিলাম না। বজরায় আমাদের সঙ্গে দুইজন বরকন্দাজ ছিল। তাহারাও ঘুমাইতেছিল। গোলমালে ঘুম ভাঙিয়া যাওয়াতে, কোন হ্যায়রে, কোন হ্যায়রে–বলিতে বলিতে তাহারাও উঠিল। উঠিয়া যাহা দেখিল, তাহাতে মুহূর্তের জন্য তাহারাও একটু থতমতো খাইয়া গেল। কিন্তু সে মুহূর্ত মাত্র, পরমুহূর্তে তাহারা তলোয়ার খুলিয়া বজরার দরজা চাপিয়া দুইজনে দাঁড়াইয়া বলিল, খবরদার, এদিকে এসো না, যতক্ষণ হাতে তলোয়ার আছে, ততক্ষণ কারো সাধ্যি নেই যে মনিবের চুলটিও স্পর্শ করে। আমাদের নৌকায় ছয়জন মাঝি, দুইজন বরকন্দাজ, দুইজন চাকর, আমার অভিভাবক ও আমি। এদিকে ডাকাতেরা প্রায় সাত আটজন। বরকন্দাজের কথা শুনিয়া একজন ডাকাত হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিল, অকূল সমুদ্রে রাত্রির নিস্তব্ধতার মধ্যে সেই বিকট হাসি আকাশে প্রতিধ্বনিত হইল; সে-হাসিতে আমার বুকের রক্ত যেন শুকাইয়া গেল। পরমুহূর্তেই অস্ত্রের ঝনঝনা আমার কানে গেল। চাহিয়া দেখি, উভয় পক্ষে ঘোর যুদ্ধ আরম্ভ হইয়াছে। দেখিতে দেখিতে বরকন্দাজদের তলোয়ারের আঘাতে দুইজন দস্যু জলের মধ্যে পড়িয়া গেল। কিন্তু পরমুহূর্তেই আমাদের একজন বরকন্দাজও দস্যুদের হাতে প্রাণ হারাইল। আমি ভয়ে একেবারে আড়ষ্ট হইয়া গিয়াছিলাম, তারপর আবার এই ভয়ানক দৃশ্য চোখের উপর দেখিয়া আমার চক্ষু আপনি মুদ্রিত হইয়া আসিল। ক্রমে যেন চেতনা হারাইলাম। তারপর কী হইল, তাহা আর কিছুই জানিতে পারিলাম না।
কতক্ষণ চেতনাশূন্য হইয়া পড়িয়াছিলাম জানি না, যখন চেতনা হইল, তখন ধীরে ধীরে চাহিলাম। চাহিয়া দেখিলাম, আমাদের সে বজরাও নাই, সঙ্গের লোকজনও নাই। একখানি খোলা নৌকার উপর আমি শুইয়া রহিয়াছি। রাত্রি তখন প্রভাত হইয়াছে। আমি ধীরে ধীরে নৌকার উপরে উঠিয়া বসিলাম। উঠিয়া দেখি, একটা খালের মধ্য দিয়া নৌকাখানি যাইতেছে। সেখানি ছিপ নৌকা। ছিপটি বহিতেছিল আট-দশজন খুব বলিষ্ঠকায় লোক। কাজেই ছিপখানি তিরবেগে ছুটিয়া চলিয়াছে। রাত্রি প্রভাত হইয়াছিল বটে, কিন্তু সেই খালের দুই কূলে এত ঘন জঙ্গল যে সূর্যের কিরণও তাহার মধ্যে প্রবেশ করিতে পারে না। আমি সেই অল্প আলোকে যাহা দেখিলাম, তাহাতেই বুঝিতে পারিলাম যে, ইহারা গত রাত্রের সেই আরাকানি দস্যুদল। আমাদের বজরা লুঠপাট করিয়া ইহারা আমাকে ধরিয়া লইয়া যাইতেছে। আমি উঠিয়া বসিবামাত্র পশ্চাৎ দিক হইতে কে একজন বলিয়া উঠিল, কী গো বাবু, ঘুম ভাঙল? সেই কথায় ফিরিয়া চাহিয়া আমি দেখিলাম, যে-লোকটি মেলায় আমাদের সঙ্গ লইয়াছিল– এ সে-ই! তখন আমি সব বুঝিতে পারিলাম। মেলায় আমার চলাফেরা ভাবগতিক দেখিয়া সকলেই মনে করিয়াছিল যে, আমরা খুবই বড়োলোক। এ লোকটাও তাহাই মনে করিয়া আমাদের সঙ্গ লইয়াছিল এবং দূরে দূরে থাকিয়া খোঁজখবর লইতেছিল। পরদিন যে মগ বালকটি আমার সঙ্গে ফিরিতেছিল এবং যাহাকে শেষে আমি ইহার সঙ্গে কথা কহিতে দেখিয়াছিলাম, সেও বোধ হয় ইহাদেরই লোক এবং বোধ হয় ওই উদ্দেশ্যেই আমার সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত দিন ফিরিতেছিল। তখন সেই মগ বালকটির সঙ্গে অত ভাব করিয়াছিলাম বলিয়া মনে অনুতাপ হইল।
সেই লোকটার কথায় কোনো উত্তর না দিয়া আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, আমাদের বজরা কোথায়, আমাদের লোকজন কোথায়, তোমরা আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ? যাব না আমি তোমাদের সঙ্গে, তোমরা আমাকে আমার সঙ্গীদের কাছে দিয়ে এসো। এই কথা শুনিয়া ছিপের লোকগুলি সকলেই একসঙ্গে বিকট রবে হাসিয়া উঠিল। সে-হাসিতে আমি চমকিয়া উঠিলাম। তোমরা হয়তো মনে করিতেছ, হাসির রবে আবার চমকায় কে? কিন্তু তোমরা নিশ্চয় তেমন বিকট হাসি শুনো নাই, তাই ও-কথা মনে করিতেছ। আমি তো বালক মাত্র, একটা হিংস্র জন্তু পর্যন্ত সে-হাসির রবে ভয় পাইয়াছিল। হঠাৎ সেই সময় তীরের দিকে চোখ পড়ায় আমি দেখিলাম, তীরের কাছে জঙ্গলের মধ্যে একটা চিতাবাঘ বোধ হয় মাছ ধরিতেছিল, হঠাৎ সেই বিকট হাসির রবে চমকিয়া উঠিয়া সে দৌড় দিল।
যাহা হউক, লোকটা আমাকে বলিল, তোমাদের বজরা এবং লোকজন এতক্ষণ জলের নীচে বিশ্রাম করছে। সেখানে যাওয়ার চেয়ে, বোধ হয় আমাদের সঙ্গে যাওয়া মন্দ নয়। আর কে-ই বা তোমাকে সেখানে দিয়ে আসতে যাবে, কী বল? বুঝিলাম, ডাকাতেরা আমাদের সঙ্গের লোকজনকে হত্যা করিয়া বজরা সমেত সমুদ্র-জলে ডুবাইয়া দিয়াছে।
প্রথম প্রথম আমার মনে খুব ভয় হইয়াছিল বটে, কিন্তু যখন শুনিলাম যে ডাকাতেরা আমাদের বজরা ডুবাইয়া দিয়াছে, লোকজনদিগকেও হত্যা করিয়া ফেলিয়াছে এবং যখন দেখিলাম যে, আমি সম্পূর্ণরূপে ইহাদের হাতেই পড়িয়াছি, তখন আমার ভয় একেবারে চলিয়া গেল। বিপদে পড়িবার ভয়েই লোকে ভয় পায়। কিন্তু বিপদের মধ্যে পড়িলে তখন আর সে ভয় থাকে না। আমারও তাহাই হইল। আমি রাগিয়া উঠিয়া বলিলাম, জলে ডুবে মরতে হয় সেও ভালো, তবু আমি তোমাদের সঙ্গে যাব না; চোর-ডাকাতের সঙ্গে একত্রে থাকার চেয়ে মরাও ভালো। নামিয়ে দাও তোমরা আমাকে এইখানেই।
লোকটি আবার তেমনি বিকট করিয়া হাসিয়া উঠিল এবং অন্যেরাও তাহার হাসিতে যোগ দিল। বলিল, কোথায় নামবে এখানে? এ যে সুন্দরবন! এখানে জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ, সে-কথা কি জান না? বিশ্বাস না হয়, ওই দেখো–এই বলিয়া সে কূলের দিকে আঙুল দিয়া দেখাইয়া দিল। আমি চাহিয়া দেখিলাম একটা বাঘ খালের তীরে আসিয়া জলপান করিতেছে। তখন ভাবিলাম, কথা তো মিথ্যা নয়। আমাকে ডাকাতেরা সুন্দরবনের মধ্যে লইয়া আসিয়াছে, এখানে এই ভয়ংকর স্থানে কোথায় গিয়া আমি দাঁড়াইব? বুঝিলাম ইহাদের সঙ্গে জোর করিয়া লাভ নাই। বাধ্য হইয়াই আমাকে ইহাদের প্রস্তাবে রাজি হইতে হইল, সুতরাং, আমি আর কোনো কথা কহিলাম না। নীরবে সহিয়া নিজের অদৃষ্ট চিন্তা করিতে লাগিলাম। সেই ছিপের উপর বসিয়া বসিয়া বাড়ির কথা, দাদামহাশয়ের কথা, মা-বাবার কথা, ভাই বোনের কথা–সমস্ত একে একে মনে উঠিতে লাগিল। তখন একবার মনে হইয়াছিল, কেন সকলের অবাধ্য হইয়া গঙ্গাসাগরে আসিয়াছিলাম? এই ঘটনার মূলই আমি। আমার জন্যই এতগুলি লোক ডাকাতের হাতে প্রাণ হারাইল। আমার চলাফেরা ভাবগতিক দেখিয়াই তো ডাকাতেরা ঠাহর পাইয়াছিল; আমি না আসিলে তাহারা কোনো সন্ধানই পাইত না। দাদামহাশয় সমস্ত রাত্রি কপিল মুনির মন্দিরে ছিলেন, ভোর বেলা নদীতীরে আসিয়া বজরা দেখিতে না পাইয়া তিনিই বা কী করিতেছেন? ডাকাতেরা সকলকে হত্যা করিল, আমাকে কেন হত্যা করিল না এবং কেনই-বা আমাকে তাহারা লইয়া আসিল? এই সকল নানা চিন্তায় আমি একেবারে ডুবিয়া গেলাম। সেই সময় হঠাৎ একটা বিকট শব্দ শুনিয়া চমকিয়া উঠিলাম। সেই লোকটা বলিল, ওই শুনছ, এখানে নামবে? ওই চেয়ে দেখো! আমি কূলের দিকে চাহিয়া দেখিলাম, একটা প্রকান্ড বাঘ দাঁড়াইয়া রহিয়াছে, বুঝিলাম সে বিকট রব আর কিছু নয়, এই বাঘেরই ডাক।
সেই গভীর জঙ্গলের মধ্যে সেই খালে অনেক ঘুরিয়া-ফিরিয়া ছিপখানি এক স্থানে গিয়া লাগিল। আমরা সেখানে উপস্থিত হইবামাত্র, পূর্বদিনের সেই বালকটি কোথা হইতে দৌড়িয়া আসিল এবং চিরপরিচিতের ন্যায় আমাকে আসিয়া বলিল, ভাই এসেছ, এই আমাদের বাড়ি! আমি আশ্চর্য হইয়া তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, কেন, আমি যে আসব তুমি কি তা জানতে? সে বলিল, বাবা বলেছিল যে আমি যদি তার কথামতো কাজ করি, তবে আমার খেলবার সাথি করবার জন্য তোমাকে এনে দেবে।
সে যাহাই হউক, নৌকায় বসিয়া আমি মনে করিয়াছিলাম যে ইহারা যেখানে গিয়া নৌকা রাখিবে, আমি সেইখান হইতে চলিয়া যাইব। কিন্তু পরে দেখিলাম এই অচেনা অজানা স্থানে, এই ভয়ংকর সুন্দরবনের মধ্যে ইহারাই আমার একমাত্র আশ্রয়। ইহাদিগের নিকট হইতে পলাইতে চেষ্টা করা বৃথা এবং পলাইয়া যাইবই-বা কোথায়? চারিদিকে হিংস্র জন্তুর ভয়। সেই দিন বিকালেই একটি ঘটনায় আমি প্রাণ হারাইতেছিলাম। বিকালে আমি ও সেই মগ বালকটি বেড়াইতে গিয়াছিলাম। একস্থানে দেখিলাম একরকম বনফুল ফুটিয়া রহিয়াছে, তাহারই একটি লইবার বড়ো ইচ্ছা হইল এবং আমি ধীরে ধীরে জলের কাছে গেলাম। একটি ফুল ধরিবার জন্য যেমন হাত বাড়াইয়াছি, অমনি সেই মগ বালকটি একটা চিৎকার করিয়া উঠিল। আমি সেই চিঙ্কারে চমকিত হইয়া পা পিছলাইয়া জলে পড়িয়া গেলাম, জলের স্রোতে খানিকটা দূরে গিয়া ভাসিয়া উঠিলাম, কিন্তু উঠিয়া যাহা দেখিলাম, তাহাতে আমার হাত-পা একেবারে আড়ষ্ট হইয়া গেল। আমার সেই অবস্থা দেখিয়া আমার সঙ্গী দৌড়াইয়া আসিয়া জলে ঝাঁপাইয়া পড়িল এবং হাতে ধরিয়া আমাকে টানিয়া তীরে তুলিল।
আমি যখন ফুলটির প্রত্যাশায় জলের কাছে যাইতেছিলাম, তখন জঙ্গলের ভিতর হইতে একটা প্রকান্ড বাঘ ও একটা প্রকান্ড কুমির একই সময় আমাকে লক্ষ করিতেছিল। বাঘ যখন আমাকে ধরিবার জন্য লাফ দেয়, তখন আমার সঙ্গী বালক তাহা দেখিতে পাইয়া চিৎকার করিয়া উঠে এবং আমি ঠিক সেই সময়েই জলের মধ্যে পড়িয়া যাই। এদিকে ঠিক যে-সময় বাঘ লাফ দেয়, কুমিরও সেই সময় আমাকে ধরিতে আসে। কিন্তু ভগবানের কৃপায় পা পিছলাইয়া জলে পড়িয়া যাওয়াতে আমি উভয়ের হাত হইতে রক্ষা পাই। বাঘটা লম্ফ দিয়া কোথায় আমাকে ধরিবে না কুমিরের মুখের মধ্যে পড়িয়া গেল!
মগ বালকটির সহিত অতি অল্পদিনের মধ্যেই আমার খুব ভাব হইয়া গেল। কীসে আমি সুখী হইব, কী করিলে সুন্দরবনের সেই জঙ্গলবাসের কষ্ট আমার দূর হইবে, সে কেবল দিনরাত্রি সেই চেষ্টায় থাকিত। তাহার নাম ছিল মউংনু। আমি তাহাকে মনু বলিয়া ডাকিতাম। মনুর মা-ও আমাকে আপনার ছেলের মতো দেখিতেন। আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবহীন সেই জঙ্গলে যাহাতে আমি মায়ের অভাব না বুঝিতে পারি, তিনি প্রাণপণে সে চেষ্টা করিতেন।
সেই নিষ্ঠুর দস্যুদলের মধ্যে যে এমন দুইটি স্নেহমাখা কোমল হৃদয় আছে, তাহা আমি আগে বুঝিতে পারি নাই। এবং এমন যে থাকিতে পারে, তাহাও বিশ্বাস করিতে পারি নাই। বাস্তবিকই মনু ও তাহার মায়ের যত্ন, আদর স্নেহ ও ভালোবাসায় আমি কোনো কষ্ট বা অভাবই বোধ করিতাম না। বাড়ির জন্য প্রথম প্রথম যে কষ্ট হইত, তাহাও যেন ক্রমে ভুলিয়া যাইতে লাগিলাম।
মনু ছায়ার মতো সর্বদাই আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকে; আমরা একত্রে খাই, একত্রে শয়ন করি, একত্রে বেড়াইতে যাই। মনুর বুদ্ধি বেশ তীক্ষ্ণ ছিল এবং সে আমার সমবয়স্ক ছিল। আমার বয়স তখন তেরো বৎসর। ইংরেজিতে আমি যে-সকল বাঘ-ভালুকের গল্প পড়িয়াছিলাম, মনুকে তাহা বলিতাম, তাহা ছাড়া, রামায়ণ-মহাভারতের গল্প তাহাকে শুনাইতাম। খেলা করা, গল্প করা এবং ক্ষুধার সময় খাওয়া ভিন্ন আমাদের আর কোনো কাজ ছিল না। মনুও সন্দুরবনের বাঘ-ভালুকের অনেক গল্প আমাকে শুনাইত। কিন্তু রামায়ণ মহাভারতের গল্প তাহার কাছে সম্পূর্ণ নতুন ছিল। সে খুব আগ্রহের সহিত সেই সকল গল্প শুনিত। ক্রমে তাহার সেই সকল পড়িবার একটা আগ্রহ জন্মিল। আমারও ইচ্ছা হইল, তাহাকে লিখিতে-পড়িতে শিখাই।
মনু একদিন তাহার বাবাকে গিয়া বলিল, আমাকে বই এনে দাও, আমি লেখাপড়া শিখব। মনুর বাবা তাহার কথা শুনিয়া হাসিয়া উঠিল এবং বলিল– বাঙালির ছেলেটা দেখছি তোকে একেবারে বাঙালি করে তুলেছে! লেখাপড়া শিখে তুই কি পন্ডিতি রকমে ডাকাতি করবি নাকি? লেখাপড়া শিখলে তুই কি আর মানুষ থাকবি, ওই বাঙালির ছেলেদের মতো ভীরু হয়ে যাবি, জুজু হয়ে থাকবি। কলম বাঙালির ছেলের অস্ত্র, আমাদের অস্ত্র তিরধনুক, তলোয়ার-বন্দুক। বাঙালির অস্ত্র কলমে বাঘ-ভালুকও শিকার করা যায় না, ডাকাতিও চলে না। যে-বিদ্যে তোর কাজে লাগবে তুই তাই শেখ, অন্য বিদ্যে শিখে তোর দরকার নেই। মনু ছাড়িবার পাত্র নয়। সে বলিল, তুমি জান না তাই ও-কথা বলছ, বইয়ে যে-সকল বীর পুরুষদিগের কথা লেখা আছে, যে-সকল যুদ্ধের কথা লেখা আছে, তা শুনেই আমার শরীর গরম হয়ে ওঠে, সেসব যদি নিজে পড়তে পারি, তবে তাতে আমার সাহস আরও বেড়ে যাবে। তোমরা ডাকাতি করো লুঠপাট করো, আমি রাজাদের সঙ্গে যুদ্ধ করব, আর তাদের হারিয়ে দিয়ে রাজা হব। কথাগুলি বলিবার সময় যেন মনুর শরীর উৎসাহে স্ফীত হইয়া উঠিয়াছিল। চক্ষু দিয়া যেন একটা তেজ বাহির হইতেছিল। মনুর বাবা তাহার কথায় একটু অবাক হইয়া গেল। আর কোনো কথা না বলিয়া তাহাকে বিদায় করিল।
মনু আমার সমবয়স্ক হইলেও তাহার শরীর খুব বলিষ্ঠ ছিল। এত অল্প বয়সে এ প্রকার সাহসী বালক আমি এ পর্যন্ত দেখি নাই। তির চালনা, তলোয়ার খেলা এবং বন্দুকের ব্যবহার সে এই বয়সেই সুন্দর শিখিয়াছে। তাহার সঙ্গে থাকিয়া আমারও সে-সকল কিছু অভ্যাস হইয়াছিল।
সুন্দরবনে অনেক মধুর চাক জন্মে। সেই সকল চাক ভাঙিয়া মধু সংগ্রহ করা কতকগুলি লোকের ব্যবসায় আছে। আমাদেরও একদিন সখ হইল, একটি চাক ভাঙিব। খুঁজিয়া খুঁজিয়া একটি চাকও পাইলাম। কিন্তু কাছে গিয়া দেখি, তাহাতে এত মৌমাছি বসিয়া আছে যে, একবার যদি তাহারা টের পায়, তাহা হইলে আমাদের চাক ভাঙার শখ মিটাইবে। সুতরাং আমাদের চাক ভাঙা হইল না। আমরা দুঃখিত মনে বাড়ি ফিরিয়া আসিতেছি, এমন সময় একটা হরিণ দেখিতে পাইলাম। আমরা যখনই বাড়ির বাহির হইতাম, তখনই তিরধনুক ও বন্দুক লইয়া বাহির হইতাম, কেননা কখন কোন বিপদে পড়ি তাহার ঠিকানা নাই। হরিণটা দেখিয়া মনু বলিল, বেশ হয়েছে, শুধু-হাতে আর বাড়ি ফিরতে হল না। কিন্তু এখান থেকে হরিণটাকে মারবার সুবিধা হবে না, মাঝখানে ওই একটা ঝোঁপ রয়েছে। খুব পা টিপে টিপে আমার পেছনে পেছনে এসো, একটু ঘুরে গেলে বেশ সুবিধা পাওয়া যাবে? মনুর কথামতো আমি তাহার পিছনে চলিলাম। কিন্তু একটু যাইয়াই মনু থমকিয়া দাঁড়াইল। আমি হরিণটার দিকে চাহিতে চাহিতে চলিতেছিলাম, একেবারে মনুর গায়ের উপর গিয়া পড়িলাম।
সে আমার গা টিপিয়া কানে কানে বলিল, চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকো। এক চুলও নড়ো না কথাও কয়ো না, ওই দেখো। মনু হাত বাড়াইয়া সম্মুখের দিকে দেখাইয়া দিল। চাহিয়া যাহা দেখিলাম, তাহাতে আমার সমস্ত শরীর থর থর করিয়া কাঁপিতে লাগিল। দেখিলাম, আমাদের সম্মুখে ৮/১০ হাত দূরে একটা মাটির ঢিবির কোলে একটা বাঘ ওই হরিণটাকে লক্ষ করিয়া আড়ি পাতিয়াছে। আমার বাকরোধ হইয়া গিয়াছিল, নতুবা হয়তো চিৎকার করিয়াই উঠিতাম। তাহা হইলে আমাদের যে দশা হইত তাহা তো বুঝিতেই পারিতেছ। মনুর দেখিলাম অসীম সাহস, সে এক হাতে আমাকে এবং আর এক হাতে বন্দুকটি লইয়া স্থির হইয়া একদৃষ্টে বাঘের দিকে চাহিয়া রহিয়াছে। বোধ হইল, তাহার নিঃশ্বাসও পড়িতেছে না। বাঘটা প্রকান্ড, অত বড়ো একটা জানোয়ার চলিতেছে, অথচ একটুও শব্দ হইতেছে না। এও বড়ো আশ্চর্য বোধ হইল। পরে জানিতে পারিলাম যে কীজন্য ইহারা এত নিঃশব্দে চলিতে পারে। বিড়ালের পায়ের পাতার গঠন তোমরা দেখিয়া থাকিবে, ইহাদের পাও ঠিক সেইরকম, ইহাদের আঙুলের মাথায় খুব তীক্ষ্ণ নখ আছে, আবশ্যক মতো এই নখ বাহির হয় এবং অন্য সময়ে ইহা কচ্ছপের শুড়ের ন্যায় ভিতরে ঢুকিয়া থাকে, তখন পায়ের পাতাটি বেশ গদির মতো হয়। সুতরাং হাঁটিবার সময় কিছুমাত্র শব্দ হয় না। সে যাহাই হউক, বাঘ আড়ি পাতিয়া এক লাফে গিয়া হরিণটার উপর পড়িল এবং তাহার সম্মুখের পায়ের এক আঘাতেই হরিণটার ঘাড় ভাঙিয়া ফেলিল, তারপর তাহাকে লইয়া জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করিল। আমরাও প্রাণ লইয়া সে যাত্রায় বাড়ি ফিরিলাম।
আর একদিন একটা বাঘ ভারি জব্দ হইয়াছিল। তাহার যে-দুর্দশা হইয়াছিল, বলি শুনো। বাঘ সুন্দরবনের বলিলেই হয়, কিন্তু সুন্দরবনের মহিষগুলিও বড়ো ভয়ংকর, অত বড়ো ও বলবান মহিষ অন্য কোথাও আছে কিনা সন্দেহ। বাঘে-মহিষে সুন্দরবনে প্রায়ই লড়াই হয়। কখনো বাঘের জিত হয়, কখনো-বা মহিষকে জিতিতে দেখা গিয়া থাকে। সে যাহাই হউক, একদিন একটা মহিষের বাচ্চা চরিতে চরিতে বাথান হইতে একটু দূরে গিয়া পড়িয়াছিল। একটা বাঘ বেচারাকে দেখিয়া লোভ সামলাতে না পারিয়া, যেমন তাহাকে ধরিবার জন্য লাফ দিতে যাইবে, এমন সময় বাচ্চাটি তাহা দেখিতে পাইয়া চিৎকার করিয়া উঠিল। সেই শব্দে একেবারে ছয়-সাতটা মহিষ সেইদিকে দৌড়িয়া আসিল। বাঘ তখন আর পালাইবার অবসরটুকুও পাইল না। সেই ছয়-সাতটা মহিষে মিলিয়া শিং এবং পায়ের আঘাতে বাঘটাকে ক্ষতবিক্ষত করিয়া মারিয়া ফেলিল।
কয়েকদিন ধরিয়া একটা বাঘ আমাদের বাড়ির কাছে ভারি দৌরাত্ম আরম্ভ করিয়াছে। রাত্রিতে তাহার ভয়ে আমাদিগকে শশব্যস্ত থাকিতে হয়। কখনো ঘরের আনাচে-কানাচে কোনো ছোটো জন্তুর উপর লাফাইয়া পড়িতেছে, কখনো উঠানের উপর দাঁড়াইয়া ডাক ছাড়িতেছে। সকালে উঠিয়া প্রতিদিনই দেখিতে পাই–এখানে একটা হরিণের মাথা, ওখানে দুটো শুয়োরের দাঁত, কোথাও-বা খানিকটা মহিষের পা। দিনকতক বড়োই ব্যতিব্যস্ত করিয়া তুলিল। বাঘটাকে মারিবার জন্য খুব চেষ্টা হইতে লাগিল। তিরধনুক ও বন্দুক লইয়া সকলে ফিরিতে লাগিলাম, কিন্তু সে এত সতর্কভাবে চলাফেরা করিত যে, কোনোমতেই তাহাকে মারিতে পারা গেল না। একদিন এক ঝোঁপের কাছ দিয়া আমরা যাইতেছি, এমন সময় ঝোঁপের আড়ালে পায়ের শব্দ পাইয়া মনে করিলাম, বোধ হয় বাঘ যাইতেছে। বন্দুক ভরাই ছিল। ঠিক করিয়া হাতে লইয়া ঝোঁপের ভেতর দিয়া উঁকি মারিয়া দেখিতে গেলাম; কিন্তু দেখিলাম–বাঘ নয়, একটা গন্ডার। যথা লাভ, আর গন্ডারও বড়ড়া সাধারণ শিকার নয়– গন্ডার গন্ডারই সই। মনু বলিল, খুব আস্তে আস্তে আমার সঙ্গে এসো, একটু ঘুরে গিয়ে গুলি করতে হবে। আমি দেখিলাম, সেই ঝোঁপের আড়াল থেকে গুলি করাই সুবিধা। আমরা গন্ডারটিকে বেশ দেখিতে পাইতেছি; অথচ সে আমাদিগকে দেখিতে পাইতেছে না। কোনো বিপদের আশঙ্কা নাই, নির্বিঘ্নে গুলি করা যাইবে। মনুকে সে-কথা বলায় সে বলিল, সে কী। তুমি কি জান না যে গন্ডারের চামড়া এত পুরু যে তাতে গুলি বসে না? এখান থেকে ওর শরীরের একটা পাশ দেখা যাচ্ছে, গুলি করলে সে গুলি ওর গায়ে বসবে না, অথচ বন্দুকের আওয়াজে শিকার পালাবে। গন্ডারকে মারতে হলে ওর নাকের ভেতর দিয়ে গুলি করতে হবে। কাজেই ঘুরে সমুখদিকে না গেলে ওকে মারতে পারা যাবে না। এই বলিয়া মনু আগে আগে চলিল। আমিও তার সঙ্গে সঙ্গে গেলাম এবং এমন একটি জায়গায় গিয়া দাঁড়াইলাম, যেখান থেকে গন্ডারের নাকটি বেশ লক্ষ হয়। তখন মনু আমাকে গুলি করিতে বলিল। অত বড়ো একটা জানোয়ার শিকার করিয়া একটু যশলাভ করিবার আশা আমার না হইয়াছিল তা নয়, কিন্তু আমার হাত তখনও খুব সই হয় নাই। বিশেষত অত বড়ো শরীরটার সমস্তই বাদ দিয়া কোথায় নাকের একটা ক্ষুদ্র ছিদ্র, সেইখানে গুলি করিতে হইবে, কাজেই আমি রাজি হইলাম না। তখন মনু বলিল, তবে বন্দুকটা ঠিক করে দাঁড়াও, যদি গুলি নাকে না লাগে আর আমাদের দিকে রোখ করে আসে, তবে আর রক্ষে থাকবে না। এই বলিয়া সে বন্দুক সই করিল। গন্ডারটা চোখ বুজিয়াছিল, আমাদিগকে দেখিতে পায় নাই। আমরা মনে করিলাম, ভারি সুবিধাই হইয়াছে। গন্ডারটা আমাদের দেখিতে পায় নাই বটে, কিন্তু তাহার শরীরের উপর গোটাকতক পাখি বসিয়াছিল, তাহারা আমাদিগকে দেখিয়া ভারি ডাকাডাকি আরম্ভ করিল। শেষে ডাকাডাকি ছাড়িয়া গন্ডারটার চোখে-মুখে পাখার ঝাঁপটা মারিতে লাগিল। ঝাঁপটা খাইয়া গন্ডারটা তখন চোখ খুলিল। চোখ খুলিয়াই আমাদিগকে দেখিয়া ভোঁ-দৌড়। মনু যদিও ঠিক সেই সময়েই বন্দুকের ঘোড়া টানিয়াছিল, কিন্তু সে-পর্যন্ত পৌঁছিতে-না পৌঁছিতে গন্ডারটা সরিয়া যাওয়ায়, গুলিও লাগিল না, শিকারও পলাইল। বেলা তখন অনেক হইয়াছে, কাজেই সেদিনকার মতো আমাদের বাড়ি ফিরিতে হইল।
বাড়ি ফিরিয়া গেলে মনুর বাবা জিজ্ঞাসা করিল, কী, আজ কী শিকার করলে? আমরা সকল ঘটনা তাহাকে বলিলাম এবং এমন শিকারটা পাখিগুলোর জ্বালায় হাতছাড়া হইল বলিয়া দুঃখপ্রকাশ করিলাম। মনুর বাবা সেই কথা শুনিয়া, আমার প্রায়ই হয়। কেবল গন্ডার কেন, পাখির জ্বালায় অনেক শিকারই ওইরকম করে হাতছাড়া হয়। গন্ডারের গায়ে একরকম খুব ছোটো ছোটো কীট আছে তারা গন্ডারকে বড়ো যাতনা দেয়। পাখিরা সেই কীট ঠোঁট দিয়ে খুঁটেখুটে খায়, এতে গন্ডারেরও উপকার হয়, তাদেরও পেট ভরে। শুধু শরীরের নয়, নাকের মধ্যে, চোখের কোণে, কানের বা মুখের ভেতর থেকেও এরা ওই কীট খুঁটে খুঁটে বার করে। চোখ বা কান প্রভৃতি নরম জায়গা থেকে কীট বার করবার সময় গন্ডারদের সময় সময় বেশ একটু যাতনা পেতে হয়। কিন্তু কীটের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য তারা সে কষ্ট সহ্য করে থাকে। এই পাখিরা যে কেবল কীটের হাত থেকেই গন্ডারকে রক্ষা করে তা নয়, মানুষের হাত থেকেও এদের রক্ষা করে। যখনই গন্ডারের কোনো বিপদ দেখে, তখনই এরা খুব চিৎকার আরম্ভ করে এবং তাতেই গন্ডারের হুশ হয়–গন্ডার তখন বিপদ বুঝতে পেরে পালায়।
গোরু-মহিষ প্রভৃতির গায়ে ও মাথায় বসে একরকম পাখিকে তোমরা ঠোকরাতে দেখে থাকবে। তাদেরও ওই কাজ। গোরু বা মহিষের গায়েও একরকম কীট আছে, তারা এদের বড়ো কষ্ট দেয়, পাখিরা ওই সকল কীট ঠুকরে খায় এবং কোনো বিপদের আশঙ্কা দেখলে তারা ওইরকম করে গোরু, মহিষ প্রভৃতিকে সতর্ক করে দেয়।
এ তো গেল গোরু, মহিষ, গন্ডার প্রভৃতির কথা। পাখিদের ঠোকরানিতে ওরা ব্যথা পেলেও তাদের কিছু বলে না। আর কিছু করবার ক্ষমতাও তাদের বড়ো একটা নেই। পিঠের ওপর বেশ ঠোকরাচ্ছে, ব্যথা পেলে বড়ো জোর একবার শিং নাড়া দেবে, আর তখনি পাখিরা উড়ে সরে যায়, শিং নাড়াই সার। যেখানে বিপদের বিলক্ষণ আশঙ্কা আছে, সেখানেও পাখিদের খুব যেতে দেখা যায়। একবার আমি দেখলাম জলার ধারে একটা প্রকান্ড কুমির চোখ বুজে হাঁ করে বেশ স্থিরভাবে পড়ে আছে। আমি মনে করলাম, বেশ সুবিধাই হয়েছে– হাঁ করে আছে, ঠিক মুখের ভেতর গুলিটি চালিয়ে দিলেই কাজ হবে। এই ভেবে যেমন বন্দুক তুলেছি অমনি কতকগুলি পাখি ভারি ডাকাডাকি আরম্ভ করল। কুমিরটা সেই ডাকে চোখ খুলেই মুহূর্তের মধ্যে জলে লাফিয়ে পড়লে। আমার আর গুলি করা হল না। কুমিরের দাঁতের ভেতর একরকম কীট জন্মায়, সেই কীটের জ্বালায় দাঁতের গোড়া ফুলে কুমিরকে এক সময় ভারি কষ্ট পেতে হয়। তাই প্রায়ই সন্ধ্যার আগে দেখতে পাওয়া যায় যে, জলের ধারে কুমির হাঁ করে পড়ে আছে আর এক জাতীয় পাখি নিঃসংকোচে নির্ভয়ে তার সেই মুখের ভেতর গিয়ে দাঁতের ভেতর থেকে পোকাগুলো খুঁটেখুঁটে বার করছে। এমন ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলে যাচ্ছে। কুমির, হাঁ করেই আছে, পাখিরাও ঘুরে-ফিরে পোকা খুঁজে বেড়াচ্ছে। কুমির বিলক্ষণ হিংস্র জন্তু, যখন হাঁ করে থাকে, তখন এক-একবারে চার-পাঁচটারও বেশি পাখি তাদের মুখের মধ্যে যায়। ইচ্ছা করলে একবার মুখ বন্ধ করলেই পাখিগুলি উদরসাৎ হয়। কিন্তু যারা তাদের এত উপকার করে দাঁতের পোকা ভালো করে, তাদের সঙ্গে তারা এমন অধর্ম করে না। তবে কখনো কখনো এমন হয় যে, খুব বেশিক্ষণ হাঁ করে থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে হয়তো হঠাৎ মুখ বন্ধ করে বসে। তখন যদি কোনো পাখি বেরোতে না পেরে মুখের ভেতর থেকে যায়, তবে সে এমন জোরে ঠোঁট দিয়ে মুখের ভেতরে আঘাত করতে থাকে যে, কুমিরকে বাপের সুপুত্তুর হয়ে তখনই আবার হাঁ করতে হয়।
সে যাহা হউক, কথায় কথায় আমরা আসল কথাই ভুলিয়া গিয়াছি, বাঘটা তো এ পর্যন্ত কোনো মতেই মারা পড়িল না। কিন্তু একদিন ভারি মজা হইল। সকাল বেলা বাঘের ভয়ানক ডাকে আমাদের ঘুম ভাঙিয়া গেল, আমি তো চমকিয়া উঠিলাম। উঠিয়া শুনিলাম, মনুর বাবা বলিতেছে, আপদ চুকেছে, বাঘ ফাঁদে পড়েছে। তখন আর বিলম্ব না করিয়া তিরধনুক, বন্দুক ও লাঠি প্রভৃতি লইয়া সকলেই বাহির হইয়া পড়িল। আমরাও সঙ্গে গেলাম। বাঘটাকে মারিবার জন্য যেমন সকলে বন্দুক ও তিরধনুক লইয়া বেড়াইত, তেমনি এক জায়গায় জাল দিয়া একটা ফাঁদও পাতিয়া রাখা হইয়াছিল। অনেক সময় এই সকল ফাঁদে বাঘ ধরা পড়ে।
আমরা গিয়া দেখিলাম, আমাদের সেই জালে বাঘটা ধরা পড়িয়া ভয়ানক তর্জন-গর্জন করিতেছে এবং জাল ছিঁড়িয়া বাহির হইবার জন্য ভারি লম্ফঝম্ফ করিতেছে। কিন্তু বড়ো বেশিক্ষণ লম্ফঝম্প করিতে হইল না। জালের মধ্যে অধিকক্ষণ রাখাটা নিরাপদ নয় বলিয়া তখনই গুলি করিয়া তাহাকে মারিয়া ফেলা হইল।
কিছুকাল পরে মনু একদিন আমায় চুপি চুপি বলিল– চলো, আজ শিকারে যাওয়া যাক–
বলিলাম– কোথায়?
সে বলিল– সেখের ট্যাঁকে।
সে আবার কোথায়?
চলো দেখাব।
একদিন দুপুরের আগে আহারাদি সারিয়া দু-জনেই রওনা হইলাম। উহাদের বাড়িতে ভাত খাইতে আমার প্রথম প্রথম বড়োই অসুবিধা হইত। মনুকে বলি–কী রে এটা?
ও বলে–শুঁটকি মাছ।
পারব না খেতে। কখনো না।
কেন?
অন্নপ্রাশনের ভাত উঠে আসবে যে রে!
দু-পাঁচ দিন খেতে খেতে ভালো লাগবে দেখো।
হ্যাঁ, তা আবার কখনো লাগে?
আচ্ছা দেখে নিও।
সেই থেকে মাস দুই কাটে। শুঁটকি মাছে আর দুর্গন্ধ পাই না। মন্দ লাগে না ও জিনিসটা আজকাল। মনুর কথাই ঠিক।
মনুদের বাড়ির নীচে ছোট্ট একটা খাল। এই খালের ধারে ছিল একটা ডিঙি বাঁধা। দু-জনে ডিঙিতে গিয়া তো উঠিলাম। খানিক পরে আর একজন ছেলে আসিয়া আমাদের সঙ্গে যোগ দিল। জিজ্ঞাসা করিয়া জানিলাম, উহার নাম নিবারণ মাঝি। মনুদের নৌকা চালায় যে মাঝি তাহারই ছেলে। সে খুব ভালো নৌকা চালায় বলিয়াই তাহাকে লওয়া হইল।
একটা জিনিস দেখিলাম। নিবারণ একটা থলিতে অনেক চিড়ামুড়ি আনিয়াছে। এত চিড়ামুড়ি আনার কারণ কী তখন বোঝা যায় নাই বটে, কিন্তু বেশি দেরিও হয় নাই বুঝিতে।
খালের পাশে কেওড়া ও গোলপাতা বনের গায়ে ছলাৎ ছলাৎ করিয়া জোয়ারের জল লাগিতেছে। রোদ পড়িয়া চকচক করিতেছে নদীজল। ঘন নিবিড় অরণ্যের বন্যবৃক্ষের গুঁড়িতে গুঁড়িতে জলের কম্পমান স্রোতধারার ছায়া।
আমার মনে চমৎকার একটা আনন্দ। মুক্তির একটা আনন্দ–যাহার ঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারিব না। দাদামশায়ের সঙ্গে সুন্দরবনে না আসিলে এ আনন্দ পাইতাম কি? ছিলাম ক্ষুদ্র গৃহকোণে আবদ্ধ তেরো বছরের বালক। বিশাল পৃথিবীর বুকে যে কত আনন্দ, কী যে তাহার মুক্তিরূপা মহিমা, আমার কাছে ছিল অজানা। নিবারণ অনেক দূরে লইয়া আসিয়াছে, বনের প্রকৃতি এখানে একটু অন্যরকম। বনের দিকে চাহিয়া দেখি একটা গাছে অনেক বাতাবি লেবু ফলিয়া আছে–ডাঙার খুব কাছে।
বলিলাম–নিবারণ, নিবারণ, থামাও না ভাই। ওই দেখো—
নিবারণ ডিঙি ভালো করিয়া না থামাইয়াই ডাঙার দিকে চাহিয়া বলিল–কী?
ওই দেখো। পাকা বাতাবি লেবু!
না বাবু।
ওই যে, দেখো না! মনু, চেয়ে দেখো ভাই—
নিবারণ হাসিয়া বলিল–একটা খেয়ে দেখবে বাবু?
কেন?
ওকে বলে পশুর ফল। পাখিতে খায়। মানুষের খাবার লোভে গাছে থাকত?
মনুও হাসিয়া নিবারণের কথায় সায় দিল।
খালের মুখ গিয়া একটা বড়ো নদীতে পড়িল–তাহার অপর পাড় দেখা যায় না। এইবার আমাদের ডিঙি সামনের এই বড়ো নদীতে পড়িবে। নদীর চেহারা দেখিয়া আমার বুকের মধ্যে কেমন করিয়া উঠিল। এত ঢেউ কেন এ নদীতে?
বলিলাম–এ কী নদী ভাই?
নিবারণ এ অঞ্চলের অনেক খবর রাখে। সে বলিল–পশোর নদী। খুলনা জেলার বিখ্যাত নদী। হাঙর-কুমিরে ভরা। শিবসা আর পশোর যেখানে মিশেছে, সে-জায়গা দেখলে তো তোমার দাঁত লেগে যাবে ভাই।
খুব বড়ো?
সাগরের মতো। চলো সেখানে একটা জিনিস আছে, একদিন নিয়ে যাব।
কী জিনিস?
এখন বলব না। আগে সেখানে নিয়ে যাব একদিন। এইবার পশশার নদীতে আমাদের ডিঙি পড়িয়া কূল হইতে ক্রমশ দূরে চলিল। খানিকটা গিয়া হঠাৎ নিবারণ দাঁড় ছাড়িয়া দাঁড়াইয়া উঠিয়া বহুদূর ওপারের দিকে চাহিয়া বলিল–কী ওটা?
মনু বলিল–কই কী?
ওই দেখো। একটু একটু দেখা যাচ্ছে।
ভালো দেখা গেল না কি?
কী জিনিস ওটা?
আমিও ততক্ষণে ডিঙির ওপর দাঁড়াইয়া উঠিয়াছি। ভালো করিয়া চাহিলাম বটে, কিন্তু কিছু দেখা গেল না। নিবারণ নদীতে পাড়ি দিতে দিতে প্রায় মাঝখানে আসিল। এবার বেশ দেখা যাইতেছিল ব্যাপারটা কী। এক পাল হরিণ কেওড়াবনে জলের ধারে চরিতেছে। একটা হরিণ কেওড়া গাছের গুঁড়ির গায়ে সামনের দুই পা দিয়া উঁচু হইয়া গাছের ডালের কচিপাতা চর্বণ করিতেছে। কী সুন্দর ছবিটা! নিবারণ মনুকে বলিল–ভাই, আজ যাত্রা ভালো। ওই হরিণের পালের মধ্যে একটা মারা পড়বে না? এক-একটাতে এক মণ মাংস। দু-মণ মাংসওয়ালা হরিণও ওর মধ্যে আছে।
মনু বলিল–চলো।
নিবারণ বলিল–শক্ত করে হাল ধরতে যদি না সাহস করো, তবে তুমি দাঁড় নাও। এর নাম পশশার নদী। খুব সাবধান এখানে।
আমি সভয়ে বলিলাম– দে মনু, ওর হাতে হাল।
মনু নির্ভয় কণ্ঠে বলিল–মগের ছেলে অত ভয় করে না। হাল ধরতে পারব না তো কী? খুব পারব। টানো দাঁড়।
অত বড়ো নদীতে পাড়ি দিতে অনেকক্ষণ লাগিল। আমরা যেখানে নামিলাম, সে জায়গাটা একবারে জনহীন অরণ্য, একটু দূরে একটা ছোটো খাল জঙ্গলের মধ্যে ঢুকিয়াছে, তীরে গোলপাতা ও বেতের ঝোঁপ।
কোথায় হরিণ। সব সরিয়া পড়িয়াছে।
মনু ছাড়িবার পাত্র নয়। সে নৌকা থামাইয়া আমাদের সঙ্গে করিয়া ডাঙায় নামিল। বলিল –চলো, জঙ্গলের মধ্যে এগিয়ে দেখি–
নিবারণ হরিণের পায়ের দাগ অনুসরণ করিয়া অনেকদূর লইয়া চলিল আমাদের। এক জায়গায় কী একটা সরু দুচোলো জিনিস আমার পায়ে ঢুকিয়া যাইতেই আমি বসিয়া পড়িলাম। ভয় হইল সাপে কামড়ায় নাই তো?
নিবারণ ছুটিয়া আসিয়া আমাকে তুলিয়া দাঁড় করাইল। বলিল– এঃ রক্ত পড়ছে যে? শুলো ফুটেছে দেখছি–সাবধানে যেতে হয় জঙ্গলের মধ্যে
শূলো কী?
গাছের শেকড় উঁচু হয়ে থাকে কাদার ওপরে। তাকে শূলো বলে।
মনু বলিল–আমার বলতে ভুল হয়ে গিয়েছিল। শুলোর জন্যে একটু সাবধানে হেঁটো জঙ্গলে।
জঙ্গলের শোভা সে-স্থানটিকে মনোহর করিয়াছে। কেওড়া ও গরান গাছের মাথায় একরকম কী লতার বেগুনি ফুল। বড়ো গাছে এক প্রকারের সাদা ফুল জোয়ারের জলে নামিয়া শূলোর দল কাদার উপর মাথা তুলিয়া সারবন্দি বর্শার ফলার মতো খাড়া হইয়া আছে। কুস্বরে কী একটা পাখি ডাকিতেছে গাছের মগডালে।
নিবারণ থমকাইয়া দাঁড়াইয়া বলিল–দাঁড়াও না? মাছজটা ডাকছে, নিকটে বাঘ আছে। কোথাও, ওরা হরিণদের জানিয়ে দেয় ডাক দিয়ে। ভারি চালাক পাখি।
মনু বলিল–বাঘ নয়। মানুষ-বাঘা, মানে আমরা।
–তাও হতে পারে। এ ত্রিসীমানায় হরিণ থাকবে না আর।
আমি বিস্ময়ের সুরে বলিলাম–সত্যি?
নিবারণ বলিল–দেখো। ও আমার কতবার পরখ করা। এসব বনে নানা অদ্ভুত জিনিস আছে। একরকম গুবরে পোকা আছে, তাদের গা অন্ধকারে জ্বলে। হাঙুরে শিঙি মাছ আছে, কাঁটা হেনে তোমার সমস্ত শরীর অবশ করে দেবে।
নিবারণের কথাই ঠিক। আমরা খালের পাড় পর্যন্ত খোঁজ করিয়াও হরিণের দলের কোনো সন্ধানই পাইলাম না। এক জায়গায় কাদার উপর মোটা কাঠের গুঁড়ি টানিয়া লইয়া যাইবার দাগ দেখিতে পাইয়া নিবারণ মনু একসঙ্গেই ভয়ের সুরে বলিয়া উঠিল–ওরে বাবা!–এ কী?
চাহিয়া দেখিয়া কিছু বুঝিতে না পরিয়া বলিলাম–কী এটা?
নিবারণ বলিল–বড়ো অজগর সাপ এখান দিয়ে চলে গিয়েছে, এটা তারই দাগ। একটু সাবধানে থাকবে সবাই–অজগর বড়ো ভয়ানক জিনিস। একবার ধরলে ওর হাত থেকে আর নিস্তার নেই। বলিতে বলিতে একটা কেওড়া গাছের দিকে উত্তেজিতভাবে আঙুল দিয়া দেখাইয়া বলিতে লাগিল–ওই দেখোচট করে এসো–
দেখি, এক বিরাটকায় সর্প কেওড়া গাছের ডালে ল্যাজ জড়াইয়া নিশ্চলভাবে খালের জলের হাতচারেক উপরে ঝুলিয়া আছে। সর্পের গায়ের রং গাছের ডালের রঙের সঙ্গে মিশিয়া এমন হইয়া গিয়াছে যে সর্পদেহকে মোটা ডাল বলিয়া ভ্রম হওয়া খুবই স্বাভাবিক। নিশ্চল হইয়া থাকার দরুন এ ভ্রম না হইয়া উপায় নাই।
আমি কী বলিতে যাইতেছিলাম, নিবারণ বলিল–আস্তে, একদম চুপ–
কী?
দেখো না—চুপ–
আমরা গাছের গুঁড়ির আড়ালে নিস্পন্দ অবস্থায় দাঁড়াইয়া। নিবারণ আমাদের আগের দিকে। কী হয় কী হয় অবস্থা! মনু হয়তো কিছু বোঝে, আমি নতুন লোক কিছুই বুঝি না ব্যাপার কী। ঘণ্টাখানেক এইভাবে কাটিল। আমি বিরক্ত হইয়া উঠিলাম। কতক্ষণ এভাবে থাকা যায়। কেনই-বা এখানে খাড়া হইয়া আছি কাঠের পুতুলের মতো? সর্পদেহও আমাদের মতো নিশ্চল। গাছের ডাল নড়ে তো সাপ নড়ে না। এমন সময়ে এক আশ্চর্য কান্ড ঘটিল। আজও সে-ছবি আমার চোখের সম্মুখে ভাসিতেছে।
একটা বড়ো শিঙেল হরিণ বেতঝোঁপের পিছন থেকে সন্তর্পণে খালের দিকে আসিতে লাগিল। বেতঝোঁপের ডান দিকে একটা ছোটো হেঁতাল গাছ; তারপরই বড়ো গাছটা, যাহার ডালে সর্প ঝুলিতেছে। হরিণটা একবার আসে, শুকনো পাতার মচমচ শব্দ হয়, আবার খানিকটা দাঁড়ায়, আবার কী শোনে, আর একটু আসে, সর্পের ধ্যানমগ্ন অবস্থা– সে কি হরিণটা দেখিতে পায় নাই? নড়ে না তো? হরিণটা এইবার আসিয়া খালের কাদা পার হইয়া জলে নামিয়া চকিতে একবার এদিক-ওদিক চাহিয়া জলে মুখ দিল। জল খানিকটা পানও করিল। যেখানে হরিণ জলপানরত, সর্পের দূরত্ব সেস্থান হইতে দু-হাতের বেশি। হঠাৎ সর্পের ধ্যান ভাঙিয়া গেল। বিদ্যুতের চেয়েও বেশি বেগে সেই বিশালদেহ অজগর দেহ লম্বা করিয়া দিয়া হরিণের ঘাড় কামড়াইয়া ধরিতেই হরিণ আর্তস্বরে চিৎকার করিয়া উঠিল। তারপর সব চুপ। সাপটা ডাল হইতে নিজের দেহ ছাড়াইয়া ক্রমে ক্রমে হরিণের সমস্ত দেহ জড়াইয়া প্যাঁচের উপর প্যাঁচ দিতে লাগিল। খানিকটা পরে হরিণের শিং আর পা দুটো ছাড়া আর কিছুই দেখা যাইতেছিল না। গলাটা বোধ হয় প্রথমেই চাপিয়াছিল।
মনু ইশারা করিয়া জানাইল সে তির ছুড়িবে কিনা।
নিবারণ ইঙ্গিতে বারণ করিল।
সাপ তখন হরিণের দেহটাকে পায়ের দিক হইতে গিলিতে শুরু করিয়াছে। অজস্র লালারস সর্পের মুখবিবর হইতে নিঃসৃত হইয়া হরিণের সর্বদেহ সিক্ত হইতেছে, স্পষ্ট দেখা যাইতেছিল। যখন পা দু-খানা সম্পূর্ণ গেলা হইয়া গিয়াছে, তখন নিবারণ প্রথম কথা কহিয়া বলিল–ব্যাস! এইবার সবাই কথা বলো–
আমি বলিলাম–বলব?
কোনো ভয় নেই, বলো।
চোখের সামনে এই ভীষণ দৃশ্য ঘটিতেছে, বিস্ময়ে ও ভয়ে কেমন হইয়া গিয়াছি দু জনেই। অত সাহসী মগ বালক মনুর মুখ শুকাইয়া গিয়াছে, চোখে অদ্ভুত বিস্ময়ের দৃষ্টি। সে প্রথম কথা বলিল–পালাই চলো।
নিবারণ বলিল–পালানোর দরকার ছিল বরং আগে। এখন আর কী।
আমি বলিলাম– কেন?
ও সাপ যদি আগে আমাদের টের পেত তবে ডালের প্যাঁচ খুলে আমাদের আক্রমণ করবার চেষ্টা করত–এখন ওর নড়নচড়ন বন্ধ, শিকার গিলছে যে।
তাহলে আমরা ওকে শেষ করে দিই?
মনু ও নিবারণ দুইজনে হাসিয়া উঠিল। নিবারণ বলিল–অত সোজা নয়।
বলিলাম– কেন, তির ছুঁড়ে?
ছুঁড়ে দেখতে পার। কিছুই হবে না। দু-একটা তিরের কর্ম নয় অজগর শিকার।
তবে?
ওর অন্য উপায় আছে। এখন শুধু দেখে যাও।
দেখব আর কী সে বীভৎস দৃশ্য! অত বড়ো শিঙেল হরিণের প্রায় সমস্তটা অজগর গিলিয়া ফেলিয়াছে, কেবল মুখ আর শিং দুইটা বাদে। কিছুক্ষণ পরে মনে হইল একটা বিশালকায় শিংওয়ালা অজগর জলের ধারে হেঁতাল গাছের নীচে শুইয়া আছে। চার ঘণ্টা লাগিল সমস্ত ব্যাপারটা ঘটিতে। আমরা আসিয়া আমাদের ডিঙিতে চড়িলাম। বেলা বেশি নাই। নিবারণ ডিঙি ছাড়িল। পরে নদীতে জোয়ার আসিতেছে। একটু একটু বাতাস উঠিতেছে দেখিয়া মনু বলিল–সাবধান–সাবধান–
নিবারণ বলিল– জোর করে হাল ধরো।
আমি বলিলাম– কেন, কী হয়েছে?
কিছু না। সাবধান থেকো।
কীসের ভয়?
পরে সেকথা হবে।
বেশি দূর যাইতে-না-যাইতেই নিবারণের কথার অর্থ বুঝিতে পারিলাম। জোয়ার বাড়িবার সঙ্গে সঙ্গে মাঝনদীতে জোরে হাওয়া উঠিল। এক-একটা ঢেউয়ের আকার দেখিয়া আমার মুখ শুকাইয়া গেল, বুকের মধ্যে কেমন করিতে লাগিল। সে কী ঢেউ! ঢেউ যে অত বড়ো হয়, তাহা কী করিয়া জানিব? সমুদ্রে বড়ো ঢেউ হয় শুনিয়াছি কিন্তু এ তো নদী, এখানে এমন ঢেউ? আমাদের ডিঙি দুই পাশের পর্বত-প্রমাণ ঢেউয়ের খোলের মধ্যে একবার একবার পড়িতে লাগিল, আবার খানিকক্ষণ বেশ যায়, আবার ঢেউয়ের পাহাড় উত্তাল হইয়া উঠে।
মনুর দেখিলাম ভয় হইয়াছে। বলিল–নিবারণ!
কী?
তুমি হালে এসো—
এখন দাঁড় ছেড়ে দিলে ডিঙি বানচাল হয়ে যাবে।
তুমি এসো, আমি ঠিক বুঝতে পারছি নে!
ঠিক থাকো। বাঁয়ে চাপো।
কতটা আছে?
কী জানি, ডাঙা দেখা যায় না। তুমি বসে থেকো না, দাঁড়িয়ে উঠে হাল ধরো। বসে হাল ধরলে জোর পাবে না।
আমার এসময় হঠাৎ একরকম মরিয়ার সাহস জোগাইল। যদি ওরা বিপন্ন হয়, তবে আমার কি উচিত নয় এদের সাহায্য করা?
বলিলাম–নিবারণ, ও নিবারণ!
সে বিরক্ত হইয়া বলিল–কী?
আমি তোমার হয়ে বাইব?
যেখানে বসে আছ বসে থাকো। মরবে?
তোমাদের সাহায্য করব।
আবার বকবক বকে? দেখছ না নৌকোর অবস্থা?
দেখেই তো বলছি।
কোনো কথা বলবে না।
এবার বিশালকায় পশোর উত্তাল হইয়া উঠিয়াছে। এমন দৃশ্য কখনো দেখিনি। ডিঙির ডাইনে বাঁয়ে আর কিছু দেখা যায় না, শুধু পাহাড়ের মতো ঢেউ, জলের পাহাড়। সেই পাহাড়ের জলময় অধিত্যকায় আমাদের ডিঙিখানা মোচার খোলার মতো দুলিতেছে, নাচিতেছে, উঠিতেছে, পড়িতেছে, নাকানি-চুবানি খাইতেছে।
একবার বোঁ করিয়া ডিঙিখানা ঘুরিয়া গেল।
নিবারণ চিৎকার করিয়া উঠিল–সামাল! সামাল!
ডিঙি একধারে কাত হইয়া ছপাৎ করিয়া বড়ো এক ঝলক জল উঠিয়া পড়িল ডিঙির খোলে। নিবারণ আমাকে হাঁকিয়া বলিল–ডান দিকে চেপে–
কী করিতেছি না বুঝিয়া ডান দিকে চাপ দিতেই ডিঙি সেদিকে ভীষণ কাত হইয়া গেল। বোধ হয় ডিঙি উপুড় হইয়া পড়িত, নিবারণ দাঁড় দিয়া এক হ্যাঁচকা টান দিতে ডিঙি খানিকটা সোজা হইল।
নিবারণ বলিল–জল হেঁচতে হবে বাবু, পারবে?
বলিলাম–নিশ্চয়ই।
কিন্তু খুব সাবধানে। একটু টলে গেলেই নদীতে ডুবে মরবে।
ঠিক আছে।
সেঁউতি খুঁজে বার করো সাবধানে। খোলের মধ্যে আছে। মনু ভাই, সামলে–বাঁয়ে কসো। আমি সেঁউতি খুঁজিতে উপুড় হইয়া খোলের মধ্যে মুখ দিতে গিয়াছি, এমন সময় পিছন হইতে কে যেন আমায় এক প্রবল ধাক্কা দিয়া একেবারে খোলের মধ্যে আমাকে চাপিয়া ধরিল। আর একটু হইলে মাথাটা নৌকার নীচের বাড়ে লাগিয়া ভাঙিয়া যাইত। সঙ্গেসঙ্গে আমি ডিঙির উপরের পাটাতনের বাড় ডান হাতে সজোরে চাপিয়া না ধরিলে দ্বিতীয় ধাক্কার বেগ সামলাইতে-না-সামলাইতে তৃতীয় ধাক্কার প্রবল ঝাঁপটায় একেবারে জলসই হইতাম।
মনু আর্তস্বরে বলিয়া উঠিল– গেল! গেল!
এইটুকু শুনিতে না শুনিতে আবার প্রবল এক ধাক্কায় আমাকে যেন আড়কোলা করিয়া তুলিয়া উপরের পাটাতনে চিত করিয়া শুয়াইয়া দিয়া গেল। কী করিয়া এমন সম্ভব হইল বুঝিলাম না। আমার তখন প্রায় অজ্ঞান অবস্থা। চক্ষে অন্ধকার নামিয়া আসিয়াছে। শুধু নিবারণের কী একটা চিৎকার আমার কানে গেল অতি অল্পক্ষণের জন্যে।
তারপর বাঁ-হাতের উপরের দিকে একটা যন্ত্রণা অনুভব করিলাম। দম যেন বন্ধ হইয়া আসিতেছে। তখন দেখি নিবারণ ও মনু আমার পাশে আসিয়া হাজির হইয়াছে দাঁড় ও হাল ছাড়িয়া। এ উত্তাল নদীগর্ভে এ কাজ যে কতদূর বিপজ্জনক, এটুকু বুঝিবার শক্তি তখনও আমার ছিল। আমি বলিলাম–ঠিক আছি, তোমরা যাও, ডিঙি সামলাও–
ভগবানের আশীর্বাদে আমার বিপদ সে-যাত্ৰা কাটিয়া গেল। একটু পরে আমি উঠিয়া বসিলাম। তখনও আমাদের ডিঙি অকূল জলে, সেইরকম পর্বতপ্রমাণ ঢেউ চারদিকে, জল ছাড়া আর কিছু দেখা যায় না। নিবারণ আমাকে হাঁক দিয়া আবার বলিল– সেঁউতি খোঁজো–ডিঙি যাবে এবার–ডুবু-ডুবু হয়ে আসছে।
সেবার সেঁউতি খুঁজতে গিয়াই বিপন্ন হইয়াছিলাম। এবার অতি কষ্টে আধখোল ভরতি জলের মধ্যে হাতড়াইয়া সেঁউতি বাহির করিয়া দুই হাতে প্রাণপণে জল হেঁচিতে লাগিলাম। দেহে যেন মত্ত হস্তীর বল আসিল। আমার অক্ষমতার জন্যে আমার দুই বালক-বন্ধু জলে ডুবিয়া মারা যাইবে? তাহা কখনো হইতে দিব না। ভগবান আমার সহায় হউন। অনেকখানি জল হেঁচিয়া ফেলিলাম। সেই অবস্থাতেও আমার ঘাম বাহির হইতেছিল। ভগবান আমার প্রার্থনা শুনিলেন। ডিঙি অনেকটা হালকা হইয়া গেল। মনু বা নিবারণ কেহ কথা বলে নাই। এবার নিবারণ বলিয়া উঠিল–সাবাস!
কী?
ডিঙি হালকা লাগছে।
কেন, বলছিলে যে আমার কিছু করবার নেই?
বেশ করেছ।
ডিঙি ভেড়াতে পারবে ডাঙায়?
আলবৎ। স্থির জলে এসে পড়েছি, আর ভয় নেই। নদীর সব জায়গায় সমান স্রোত কাটিয়ে এসেছি।
আরও এক ঘণ্টা পরে আমাদের পাড়ে ডিঙি আনিয়া লাগাইয়া দিল নিবারণ।
একদিন রাত্রে মনু আমায় চুপি চুপি বলিল–এক জায়গায় যাবে? কাউকে না বলে বেরিয়ে চলো–
দ্বিতীয়বার অনুরোধের অপেক্ষা না করিয়া উহার সঙ্গে বাড়ির বাহির হইলাম। দেখিলাম, একটু দূরে নিবারণ দাঁড়াইয়া। যেখানে নিবারণ সেইখানে মস্ত বড়ো কিছু আমাদের জন্য অপেক্ষা করিতেছে
নিবারণ বলিল–বাবু, চলো রাত্রে একটা কাজ করে আসি–
কী কাজ এত রাত্রে?
বাঘ মারব।
বাঘ কী করে মারবে? বন্দুক কই?
দেখবে চলো।
তিনজনে গিয়া খালের নীচে ডিঙিতে চড়িলাম। ছোটো খাল, দুই ধারে গোলপাতার জঙ্গল নত হইয়া জল স্পর্শ করিয়াছে। জোনাকি-জ্বলা অন্ধকার রাত্রে এই নিবিড় বনভূমির শোভা এমনভাবে কখনো দেখি নাই। মনু ও নিবারণকে মনে মনে অনেক ভালোবাসা জানাইলাম আমাকে এভাবে জঙ্গলের রূপ দেখাইবার জন্য।
এক জায়গায় ডিঙি বাঁধা হইল কেওড়া গাছের গুঁড়িতে।
আমি বলিলাম–অন্ধকারে নামব?
নিবারণ গিয়া খোলের ভিতর হইতে দুইটা মশাল বাহির করিল। মনু ও আমি দুইটা মশাল হাতে আগে আগে চলি, ও আমাদের পিছনে পিছনে আসে। কিছু দূরে জঙ্গলের মধ্যে গিয়া নিবারণ হঠাৎ দাঁড়াইয়া গেল! আনন্দের সুরে বলিয়া উঠিল– বোধ হয় হয়েছে।
মনু বলিল–পড়েছে?
তাই তো মনে হচ্ছে।
এগিয়ে চলো।
একটা গাছের তলায় দেখি অদ্ভুত উপায়ে পাতা একটা ফাঁদে একটা ছোটো বাঘের ছানা ধরা পড়িয়া বেড়ালের মতো মিউমিউ করিতেছে। বড়ো একটা গাছের গুঁড়ির দুই দিক দিয়া দুইটা তার বাঁধিয়া সামনের ফাঁদের ফাঁস বাঁধা। একটি বড়ো তার গাছটি বেষ্টন করিয়া ফাঁদ পর্যন্ত গিয়াছে। এই তারের কাজ বোধ হয় ফাঁদের ফাঁস শক্ত ও আঁটো করিয়া রাখা। বাঘ বা যেকোনো জানোয়ার অন্ধকারে এই স্থান দিয়া যাইবার সময় তারটি ঢিলা করিয়া দিবে, দিলেই তৎক্ষণাৎ নীচের ফাঁদে ফাঁস পড়িয়া যাইবে এবং জন্তুটি ফাঁসের মধ্যে আটকা পড়িবে।
আমাদের অত্যন্ত নিকটে আসিতে দেখিয়া ধৃত জন্তুটি লম্ফঝম্প দিতে আরম্ভ করিল। আমরা সকলেই বিষম আগ্রহে ও কৌতূহলে ছুটিয়া কাছে গেলাম। শুনিতে পাইলাম জন্তুটির ক্রুদ্ধ গর্জন।
হঠাৎ নিবারণ ও মনু হতাশ সুরে বলিয়া উঠিল–এঃ—
বলিলাম–কী? পালাচ্ছে নাকি?
নিবারণ বলিল–যাদু পালাবে সে-পথ নেই। কিন্তু দেখছ না—
দেখছি তো! বাঘের বাচ্ছা!
বাঘের বাচ্ছা অত সোজা নয়। মিথ্যে মিথ্যে ফাঁদ পাতা পরিশ্রম।
এঃ—
কী এটা তবে?
জানোয়ার চেনো না? এটা কী জানোয়ার ভালো করে দেখে বলো না?
বাঘের বাচ্ছা।
ছাই! তাহলে তো দুঃখ করতাম না।
মনু বলিল–ছুঁচো মেরে হাত কালো!
বলিলাম–তবে কী বেড়াল?
ঠিক ধরেছেন। সাবাস–এটা বনবেড়াল, তবে খুব বড়ো বনবেড়ালও নয়। এর চেয়েও বড়ো বনবেড়াল সুন্দরবনে অনেক আছে দেখতে পাবে। এটা ছোটো বনবেড়াল। সব মাটি!
বাঘ মারা পড়ে কিনা এমন ফাঁদে–আমি উহাকে জিজ্ঞাসা করি।
ও বলিল–নিশ্চয়ই।
এইরকম বাঘ?
না। দেখলে তোমার দাঁত লাগবে এমন বড়ো।
এখন এই বনবেড়ালটা নিয়ে কী করবে? ছেড়ে দেবে?
ও তো এখুনি ছাড়তে হবে। বাড়ি নিয়ে গেলে বকুনি শুনবে কে?
ফাঁস খুলিয়া বনবিড়ালটিকে মুক্ত করিয়া দিবার সঙ্গেসঙ্গে সেটা পালাইবার চেষ্টা করিল, কিন্তু পারিল না। উহার একখানা পা সম্ভবত খোঁড়া হইয়া গিয়াছিল। আমি কাছে গেলাম ধরিতে, কিন্তু সেটার গায়ে হাত দিবার আগেই থাবা তুলিয়া ফ্যাঁচ করিয়া কামড়াইতে আসিল।
মনু বলিল– আঁচড়ে কামড়ে দেবে, বনের জানোয়ার, খবরদার ওর কাছেও যেও না।
তা তো যাব না, কিন্তু বাঘের কী হল?
নিবারণ জানে।
নিবারণ মুখ ফিরাইয়া বলিল–বাঘ দেখাব তবে ছাড়ব, বড় হাসাহাসি হচ্ছে!
মনু বলিল–না ভাই, আমি হাসিনি। আমি তো জানি তোমায়।
আজই পারব না, তবে বাঘ দেখাবই। তবে আমার নাম নিবারণ।
বলিলাম– বেশ দেখিও। ফাঁদটা পাতো দেখি।
রাত্রে?
দোষ কী?
আজ রাত্রেই এ ফাঁদে বাঘ এনে ফেলতে পারি, তবে একটা টোপ চাই তাহলে।
কীসের টোপ? ছাগল?
ধৎ! বড়ো বাঘে ছাগল খেতে আসবে না, ও আসে কেঁদো বাঘে। হয় গোরু নয়তো দু বছরের বাছুর; কিন্তু মোষ হলে সবচেয়ে ভালো টোপ হত– মোষ বা মোষের বাচ্ছা। চলো আজ রাত্রে ফিরি। কাল সকালে ফাঁদ আবার পাতব।
নিবারণের কথা শেষ হওয়ার সঙ্গেসঙ্গেই হঠাৎ এক ভীষণ গর্জন শোনা গেল বাঘের। যেন হাঁড়ির ভেতর হইতে শব্দ বাহির হইতেছে নিকটে কোথাও। সমস্ত বন যেন কাঁপিয়া উঠিল। নিবারণ বলিল–আরে!
মনু বলিল–গাছে উঠবে?
না দাঁড়াও, আবার ডাকবে এখুনি। আগে বুঝি ও কী করছে।
তখন আবার সেই বিকট গর্জনধ্বনি। কেওড়া গাছের ডালপালা যেন কাঁপিয়া উঠিল। এত রাত্রে গভীর বনমধ্যে বাঘের ডাক কখনো শুনি নাই। এ এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা।
আবার একবার গর্জন। এবার খুব যেন কাছে।