ষড়বিৎশ পরিচ্ছেদ
দুপুরে একদিন রানু বলিল, অপু, তোর কিছু দেনা আছে–
–কি দেনা রানুদি?
–মনে আছে আমার খাতায় একটা গল্প শেষ করিস নি?
রানু একটা খাতা বাহির কব্যি আনিল। অপু খাতাটা চিনিতে পারিল না। বানু বলিল—এতে একটা গল্প আধখানা লিখেছিলি মনে আছে ছেলেবেলায়? শেষ লিখে দে এবার।.অপু অবাক হইয়া গেল। বলিল—রানুদি, সেই খাতাখানা এতকাল বেখে দিয়েছ তুমি?
রানু মৃদু মৃদু হাসিল।
–কেশ দাও! এখন আমার লেখা কাগজে বেবুচ্ছে, তোমার খাতাখানায় গল্পটা অর্ধেক রাখব। কিন্তু কি ভেবে খাতাখানা রেখেছিলে রানুদি এতদিন?
–শুনবি? একদিন তোর সঙ্গে দেখা হবেই, গল্প শেষ করে দিবিই জানতুম।
অপু মনে ভাবিল—তোমাদের মতো বাল্যসঙ্গিনী জন্ম জন্ম যেন পাই বানুদি। মুখে বলিলসত্যি? দেখি—দেখি খাতাটা।
খাতা খুলিয়া বাল্যের হাতের লেখাটা দেখিয়া কৌতুক বোধ করিল। রানীকে দেখাইয়া হাসিয়া বলিল—একটা পাতে সাতটা বানান ভুল করে বসে আছি দ্যাখো।
সে এই মঙ্গলরূপিণী নারীকেই সারাজীবন দেখিয়া আসিয়াছে—এই স্নেহময়ী, করুণাময়ী নারীকে—হয়তো ইহা সম্ভব হইয়াছে এই জন্য যে, নারীর সঙ্গে তার পরিচয় অল্পকালেব ও ভাসা ভাসা ধরনের বলিয়া—অপর্ণা দু-দিনের জন্য তার ঘর করিয়াছিল লীলাব সহিত যে পরিচয় তাহা সংসারের শত সুখ ও দুঃখ ও সদাজাগ্রত স্বার্থদ্বন্দ্বের মধ্য দিয়া নহে—পটেশ্বরী, রানুদি, নির্মলা, নিরুদি, তেওয়ারী-বধু-সবাই তাই। তাই যদি হয় অপু দুঃখিত নয়—তাই ভালো, এই স্রোতের শ্যাওলার মতো ভাসিয়া বেড়ানো ভবঘুরে পথিক-জীবনে সহচরসহচরীগণের যে কল্যাণপাণি ক্ষুধার সময় তাহাকে অমৃত পরিবেশন করিয়াছে—তাহাতেই সে ধন্য, আরও বেশি মেশামিশি করিয়া তাহাদের দুর্বলতাকে আবিষ্কার করিবার শখ তাহার নাই—সে যাহা পাইয়াছে, চিরকাল সে নারীর নিকট কৃতজ্ঞ হইয়া থাকিবে ইহার জন্য।
ভাদ্রের শেষে আর একবার কলকাতায় আসিয়া খবরের কাগজে একদিন পড়িল, ফিজিপ্রত্যাগত কয়েকজন ভারতীয় আর্যমিশনে আসিয়া উঠিয়াছেন। তখনই সে আৰ্যমিশনে গেল। নিচে কেহ নাই, জিজ্ঞাসা করিলে একজন উপরের তলায় যাইতে বলিল।
ত্রিশ-বত্রিশ বৎসরের একজন যুবক হিন্দিতে তাহার আগমনের উদ্দেশ্য জিজ্ঞাসা করিল। অপু বলিল—আপনারা এসেছেন শুনে দেখা করতে এলুম। ফিজির সব খবর বলবেন দয়া করে? আমার খুব ইচ্ছে সেখানে যেতে।
যুবকটি একজন আর্যসমাজী মিশনারি। সে ইস্ট আফ্রিকা, ট্রিনিদাদ, মরিশস—নানা স্থানে প্রচারকার্য করিয়াছে। অপুকে ঠিকানা দিল, পোস্ট বক্স ১১৭৫, লউটোকা, ফিজি। বলিল, অযোধ্যা জেলায় আমার বাড়ি—এবার যখন ফিজি যাব একসঙ্গেই যাব।
অপু যখন আমিশন হইতে বাহির হইল, বেলা তখন সাড়ে দশটা।
বাসায় আসিয়া টিকিতে পারিল না। কাজল সেখানে নাই, ঘরটার সর্বত্র কাজলের স্মৃতি, ওই জানালাতে কাজল দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া রাস্তার লোক দেখিত-দেওয়ালের ওই পেরেকটা সে-ই পুঁতিয়াছিল, একটা টিনের ভেঁপু ঝুলাইয়া বাখিত-ওই কোণটাতে টুলটার উপব বসিয়া পা দুলাইয়া দুলাইয়া মুড়ি খাইত-অপুর যেন হাঁপ ধরে—ঘরটাতে সত্যই থাকা যায় না।
বৈকালে খানিকটা বেড়াইল। বাকি চারশ টাকা আদায় হইল। আব কিছুদিন পব কলকাতা ছাড়িয়া চলিয়া যাইবে কত দূর, সপ্তসিন্ধু পারের দেশ…কে জানে আর ফিরিবে কিনা? ভিটা-লেভু, তানি-লেভু, নিউ হেব্রিডিস-সামোয়া!—অর্ধচন্দ্রাকৃতি প্রবালবাধে ঘেরা নিস্তরঙ্গ ঘন নীল উপসাগর, একদিকে সিন্ধু সীমাহারা, অকূল!–দক্ষিণ মেরু পর্যন্ত বিস্তৃত—অন্যদিকে ঘরোয়া ছোট্ট পুকুরের মতো উপসাগরটির তীরে নারিকেল পত্র নির্মিত ছোট ছোট কুটির মধ্যে লৌহ প্রস্তরের পাহাড়ের সূক্ষ্মাগ্র নাসা, উভয়কে দ্বিধাবিভক্ত করিতেছে-রৌদ্রালোকপ্লাবিত সাগরবেলা। পথিক জীবনের যাত্রা আবার নতুন দেশের নতুন আকাশতলে শুরু হইবার দিন ঘনাইয়া আসিতেছে।
পুরাতন দিনের সঙ্গে যে-সব জায়গার সম্পর্ক—আর একবার সে-সব দিকে ঘুবিয়া ঘুরিয়া বেড়াইল…
মায়ের মৃত্যুর পূর্বে যে ছোট একতলা ঘরটাতে থাকিত অভয় নিয়োগী লেনের মধ্যে—সেটার পাশ দিয়াও গেল। বহুকাল এইদিকে আসে নাই।
গলির মুখে একটা গ্যাসপোস্টের কাছে সে চুপ করিয়া খানিকক্ষণ দাঁড়াইয়া রহিল
একটি ছিপছিপে চেহারার উনিশ কুড়ি বছরের পাড়াগাঁয়ের যুবক সামনের ফুটপাতে হাঁ করিয়া দাঁড়াইয়া আছে—কিছু মুখচোরা, কিছু নির্বোধ বোধ হয় নতুন কলিকাতায় আসিয়াছে—বোধহয় পেট ভরিয়া খাইতে পায় নাইক্ষুধাশীৰ্ণ মুখ—অপু ওকে চেনে—ওর নাম অপূর্ব রায়।-তেরো বছর আগে ও এই গলিটার মধ্যে একতলা বাড়িটাতে থাকিত। এক মুঠো হোটেলের রান্না ভাতডালের জন্য হোটেলওয়ালার কত মুখনাড়া সহ্য করিত–মায়ের সঙ্গে দেখা করিবার প্রত্যাশায় পাঁচিলের গায়ে দাগ কাটিয়া ছুটির আর কতদিন বাকি হিসাব রাখিত। দাগগুলি জামরুল গাছটার পাশে লোনাধরা পাঁচিলের গায়ে আজও হয়তো আছে।
সন্ধ্যার অন্ধকারে গ্যাস জ্বলিয়া উঠার সঙ্গে সঙ্গে যুবকের ছবি মিলাইয়া গেল…
বাসার নির্জন ছাদে একা আসিয়া বসিল। মনে কি অদ্ভুত ভাব!—কি অদ্ভুত অনুভূতি নবমীর জ্যোৎস্না উঠিয়াছে—কেমন সব কথা মনে উঠে—বিচিত্র সব কথা-বসিয়া বসিয়া জবে, এই রকম জ্যোৎস্না আজ উঠিয়াছে তাদের মনসাপোতার বাড়িতে, নাগপুরের বনে তার সেই খড়ের বাংলোর সামনের মাঠে, বাল্যে সেই একটিবার গিয়াছিল লক্ষ্মণ মহাজনের বাড়ি, তাদের উঠানের পাশে সেই পুকুর পাড়টাতে, নিশ্চিন্দিপুরের পোডড়া-ভিটাতে, অপর্ণা ও সে শ্বশুরবাড়ির যে ঘরটাতে শুইতোয়ই জানলার গায়ে-চাঁপদানিতে পটেশ্বরীদের বাড়ির উঠানে–দেওয়ানপুরের বোর্ডিংয়ের কম্পাউন্ডে, জীবনের সহিত জড়ানো এই সব স্থানের কথা ভাবিতেই জীবনের বিচিত্ৰতা, প্রগাঢ় রহস্য তাহাকে অভিভূত করিয়া ফেলিল…
এবার কলিকাতা হইতে বাড়ি ফিরিবার সময় মাঝেরপাড়া স্টেশনে নামিয়া অপু আর হাঁটিয়া বাড়ি যাইতে পারিল না-খোকাকে আজ দেড়মাস দেখে নাই—ছক্রোশ বাস্তা পায়ে হাঁটিয়া বাড়ি পৌঁছিতে সন্ধ্যা হইয়া যাইবে—খোকার জন্য মন এত অধীর হইয়া উঠিয়াছে যে, এত দেরি করা একেবারেই অসম্ভব।-বাবার কথা মনে হইল—বাবাও ঠিক তাকে দেখিবার জন্য, দিদিকে দেখিবার জন্য এমনি ব্যস্ত হইয়া উঠিতেন—প্রবাস হইতে ফিবিবার পথে তাদের বাল্যে। আজকাল পিতৃহদয়ের এসব কাহিনী সে বুঝিয়াছে—কিন্তু তখন তো হাঁটিয়া যাওয়া ছাড়া পন্থা ছিল না, এখন আর সেদিন নাই, মোটরবাসে এক ঘন্টার মধ্যেই নিশ্চিন্দিপুর। যা একটু দেরি সে কেবল বেত্রবতীর খেয়াঘাটে।
গ্রামে পৌঁছিতে অপুর প্রায় বেলা তিনটা বাজিয়া গেল।
সন্ধ্যার কিছু পূর্বে মাদুর পাতিয়া রানুদিদের রোযাকে ছেলেকে লইয়া বসিল। লীলা আসিল, রানু আসিল, ও-বাড়ির রাজলক্ষ্মী আসিয়া বসিল। বানুদেব বাড়ির চারিধারে হেমন্ত অপরাহু ঘনাইয়াছে—নানা লতাপাতার সুগন্ধ উঠিতেছে…
কি অদ্ভুত ধরনের সোনালি রোদ এই হেমন্ত বৈকালেব! আকাশ ঘন নীল—তার তলে বানুদিদের বাড়ির পিছনে বাঁশের ঝাড়ে সোনালি সড়কির মতো বাঁশের সূচালো ডগায় রাঙা রোদ মাখানো, কোনটার উপর ফিঙে পাখি বসিয়া আছে–বাদুড়ের দল বাসায় ফিরিতেছে!…পাঁচিলের পাশের বনে এক একটা আমড়া গাছে থোলো থোলো কাঁচা আমড়া।
সন্ধ্যার শাঁখ বাজিল। জগতের কি অপূর্ব রূপ!…আবার অপুর মনে হয়, এদের পেছনে কোথায় আর একটা অসাধারণ জগৎ আছে—ওই বাঁশবনের মাথার উপরকার সিঁদুরে মেঘভরা আকাশ, বাঁশের সোনালি সড়কির আগায় বসা ফিঙে পাখির দুলুনি—সেই অপূর্ব, অচিন্ত্য জগৎটার সীমানায় মনকে লইযা গিয়া ফেলে। সন্ধ্যার শখ কি তাদের পোডভিটাতেও বাজিল?. পূজার সময় বাবাব খরচপত্র আসিত না, মা কত কষ্ট পাইত-দিদির চিকিৎসা হয় নাই।সে সব কথা মনে আসিল কেন এখন?
অন্য সবাই উঠিয়া যায়। কাজল পড়িবার বই বাহির কবে। রানু বান্নাঘরে রাঁধে, কুটনো কোটে। অপুকে বলে—এইখানে আয় বসবি, পিড়ি পেতে দি
অপু বলে, তোমার কাছে বেশ থাকি বানুদি। গাঁয়ের ছেলেদেব কথাবার্তা ভালো লাগে না।
রানু বলে—দুটি মুড়ি মেখে দি—খা বসে বসে। দুধটা জ্বাল দিয়েই চা করে দিচ্ছি।
–রানুদি সেই ছেলেবেলাকার ঘটিটা তোমাদের–না?
রানু বলে—আমার ঠাকুরমা জগন্নাথ থেকে এনেছিলেন তার ছেলেবয়সে। আচ্ছা অপু, দুগগার মুখ তোর মনে পড়ে?
অপু হাসিয়া বলেনা রানুদি। একটু যেন আবছায়া—তাও সত্যি কিনা বুঝিনে।
রানু দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া বলিল—আহা! সব স্বপ্ন হয়ে গেল।
অপু ভাবে, আজ যদি সে মারা যায়, খোকাও বোধ হয় তাহার মুখ এমনি ভুলিয়া যাইবে।
রানুর মেয়ে বলিল—ও মামা, আমাদের বাড়ির ওপর দিয়ে আজ এইলোপেলেন গিইল।
কাজল বলিল-হা বাবা, আজ দুপুরে। এই তেঁতুল গাছের ওপর দিয়ে গেল।
অপু বলিল—সত্যি রানুদি?
-হাঁ তাই। কি ইংরেজি বুঝিনে-উড়ো জাহাজ যাকে বলে–কি আওয়াজটা!
নিশ্চিন্দিপুরের সাত বছরের মেয়ে আজকাল এরোপ্লেন দেখিতে পায় তাহা হইলে?
পরদিন সন্ধ্যার পর জ্যোৎস্নারাত্রে অভ্যাসমতো নদীর ধারের মাঠে বেড়াইতে গেল।
কতকাল আগে নদীর ধারের ওইখানটিতে একটা সাঁইবাবলাতলায় বসিয়া এইরকম বৈকালে সে মাছ ধরিত—আজকাল সেখানে সাঁইবাবলার বন, ছেলেবেলার সে গাছটা আর চিনিয়া লওয়া যায় না।
ইছামতী এই চঞ্চল জীবনধারার প্রতীক। ওর দুপাড় ভরিয়া প্রতি চৈত্র বৈশাখে কত বনকুসুম, গাছপালা, পাখ-পাখালি, গায়ে গায়ে গ্রামের ঘাট–শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরিয়া কত ফুল ঝরিয়া পড়ে, কত পাখির দল আসে যায়, ধারে ধারে কত জেলেরা জাল ফেলে, তীরবর্তী গৃহস্থবাড়িতে হাসি-কান্নার লীলাখেলা হয়, কত গৃহস্থ আসে, কত গৃহস্থ যায়—কত হাসিমুখ শিশু মায়ের সঙ্গে মাহিতে নামে, আবার বৃদ্ধাবস্থায় তাহাদের নশ্বর দেহের রেণু কলম্বনা ইছামতীর স্রোতোজলে ভাসিয়া যায়—এমন কত মা, কত ছেলেমেয়ে, তরুণতরুণী মহাকালের বীথিপথে আসে যায়—অথচ নদী দেখায় শান্ত, স্নিগ্ধ, ঘরোয়া, নিরীহ।…
আজকাল নির্জনে বসিলেই তাহার মনে হয়, এই পৃথিবীর একটা আধ্যাত্মিক রূপ আছে, এব ফুলফল, আলোছায়ার মধ্যে জন্মগ্রহণ করার দরুন এবং শৈশব হইতে এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয়ের বন্ধনে আবদ্ধ থাকার দরুন এর প্রকৃত রূপটি আমাদের চোখে পড়ে না। এ আমাদের দর্শন ও শ্রবণগ্রাহ্য জিনিসে গড়া হইলেও আমাদের সম্পূর্ণ অজ্ঞাত ও ঘোর রহস্যময়, এর প্রতি রেণু যে অসীম জটিলতায় আচ্ছন্নযা কিনা মানুষের বুদ্ধি ও কল্পনার অতীত, এ সত্যটা হঠাৎ চোখে পড়ে না। যেমন সাহেব বন্ধুটি বলিত, ভারতবর্ষের একটা রূপ আছে, সে তোমরা জানো না। তোমরা এখানে জন্মেছ কিনা, অতি পরিচয়ের দোষে সে চোখ ফোটে নি তোমাদের।
আকাশের রং আর এক রকম—দুরের সে গহন হিরাকসের সমুদ্র ঈষৎ কৃষ্ণাভ হইয়া উঠিয়াছের তলায় সারা সবুজ মাঠটা, মাধবপুরের বাঁশবনটা কি অপূর্ব, অদ্ভুত, অপার্থিব ধবনের ছবি ফুটাইয়া তুলিয়াছে!…ও যেন পরিচিত পৃথিবীটা নয়, অন্য কোন অজানা জগতের কোনও অজ্ঞাত দেবলোকের…
প্রকৃতির একটা যেন নিজস্ব ভাষা আছে। অপু দেখিয়াছে, কতদিন বক্রতোয়ার উপল ছাওয়াতটে শাল-ঝাড়ের নিচে ঠিক দুপুরে বসিয়াদুৱে নীল আকাশের পটভূমিতে একটা পত্রশূন্য প্রকাণ্ড কি গাছ—সেদিকে চাহিলেই এমন সব কথা মনে আসিত যা অন্য সময় আসার কল্পনাও করিতে পারিত না-পাহাড়ের নিচে বনফলের জঙ্গলেরও একটা কি বলিবার ছিল যেন। এই ভাষাটা ছবির ভাষা-প্রকৃতি এই ছবির ভাষায় কথা বলেন—এখানেও সে দেখিল গাছপালায়, উইঢিপির পাশে শুকনো খড়ের ঝোপে, দূরের বাঁশবনের সারিতে—সেই সব কথাই বলে—সেই সব ভাবই মনে আনে। প্রকৃতির এই ছবির ভাষাটা সে বোঝে। তাই নির্জন মাঠে, প্রান্তরে, বনের ধারে একা বেড়াইয়া সে যত প্রেরণা পায়-যে পুলক অনুভব করে তা অপূর্ব-সত্যিকাব Joy of Life-পায়ের তলায় শুকনো লতাকাটি, দেয়াড়ের চরে রাঙা-রোদ মাখানো কষাঢ় ঝোপ, আকন্দের বন, ঘেঁটুবন—তার আত্মাকে এরা ধ্যানের খোরাক জোগায়, এ যেন অদৃশ্য স্বাতী নক্ষত্রের বারি, তারই প্রাণে মুক্তার দানা বাঁধে।
সন্ধ্যার পূরবী কি গৌরীরাগিণীর মতো বিষাদ ভরা আনন্দ, নির্লিপ্ত ও নির্বিকার–বহুদূরের ওই নীল কৃষ্ণাভ মেঘরাশি, ঘন নীল, নিথর, গহন আকাশটা মনে যে ছবি আঁকে, যে চিন্তা জোগায়, তার গতি গোমুখী-গঙ্গার মতো অনন্তের দিকে, সে সৃষ্টি-স্থিতি-লয়ের কথা বলে, মৃত্যুপারের দেশের কথা কয়,ভালোবাসা-বেদনা-ভালোবাসিয়া হারানো-বহুদুরের এক প্রতিভরা পুনর্জন্মের বাণী…
এইসব শান্ত সন্ধ্যায় ইছামতীর তীরের মাঠে বসিলেই রক্তমেঘপ ও নীলাকাশের দিকে চাহিয়া চারিপাশের সেই অনত বিশ্বের কথাই মনে পড়ে। বাল্যে এই ফাটাভরা সাঁইবাবলার ছায়ায় বসিয়া মাছ ধরিতে ধরিতে সে দূর দেশের স্বপ্ন দেখিত–আজকাল চেতনা তাহার বাল্যের সে ক্ষুদ্র গণ্ডি পার হইয়া ক্রমেই দূর হইতে দূরে আলোকের পাখায় চলিয়াছে—এই ভাবিয়া এক এক সময় সে আনন্দ পায়—কোথাও না যাক—যে বিশ্বের সে একজন নাগরিক, তা ক্ষুদ্র, দীন বিশ্ব নয়। লক্ষ কোটি আলোকবর্ষ যার গণনার মাপকাঠি, দিকে দিকে অন্ধকারে ডুবিয়া ডুবিয়া নক্ষত্রপুঞ্জ, নীহারিকাদের দেশ, অদৃশ্য ঈথারের বিশ্ব যেখানে মানুষের চিন্তাতীত, কল্পনাতীত দূরত্বের ক্রমবর্ধমান পরিধিপানে বিস্তৃত—সেই বিশ্বে সে জন্মিয়াছে…
ওই অসীম শূন্য কত জীবলোকে ভরা-কি তাদের অদ্ভুত ইতিহাস! অজানা নদীতটে প্রণয়ীদের কত অশ্রুভরা আনন্দতীর্থসারা শূন্য ভরিয়া আনন্দস্পন্দনের মেলা—ঈথারের নীল সমুদ্র বাহিয়া বহু দূরের বৃহত্তর বিশ্বের সে-সব জীবনধারার ঢেউ প্রাতে, দুপুরে, রাতে, নির্জনে একা বসিলেই তাহারা মনের বেলায় আসিয়া লাগে—অসীম আনন্দ ও গভীর অনুভূতিতে মন ভরিয়া উঠে-পরে সে বুঝিতে পারে শুধু প্রসারতার দিকে নয়—যদিও তা বিপুল ও অপরিমেয় কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে চেতনা স্তরের আর একটা Dimension যেন তার মন খুঁজিয়া পায়—এই নিস্তব্ধ শরৎ দুপুর যখন অতীতকালের এমনি এক মধুর মুগ্ধ শৈশব দুপুরের ছায়াপাতে স্নিগ্ধ ও করুণ হইয়া উঠে তখনই সে বুঝিতে পারে চেতনার এ স্তর বাহিয়া সে বহুদূর যাইতে পারে—হয়তো কোন অজ্ঞাত সৌন্দর্যময় রাজ্যে, দৈনন্দিন ঘটনার গতানুগতিক অনুভূতিরাজি ও একঘেয়ে মনোভাব যে রাজ্যের সন্ধান দিতে পারিতই না কোনদিন।
নদীর ধারে আজিকার এই আসন্ন সন্ধ্যায় মৃত্যুর নব রূপ সে দেখিতে পাইল। মনে হইল, যুগে যুগে এ জন্মমৃত্যুচক্র কোন্ বিশাল-আত্মা দেবশিল্পীর হাতে আবর্তিত হইতেছে—তিনি জানেন কোন জীবনের পর কোন অবস্থার জীবনে আসিতে হয়, কখনও বা সঙ্গতি, কখনও বা বৈষম্য—সবটা মিলিয়া অপূর্ব রসসৃষ্টি-বৃহত্তর জীবনসৃষ্টির আর্ট
ছহাজার বছর আগে হয়তো সে জন্মিয়াছিল প্রাচীন ঈজিপ্টে—সেখানে নলখাগড়া প্যাপিরাসের বনে, নীলনদের রৌদ্রদীপ্ত তটে কোন্ দরিদ্রঘরের মা বোন বাপ ভাই বন্ধুবান্ধবদের দলে কবে সে এক ধূসর শৈশব কাটাইয়া গিয়াছে—আবার হয়তো জন্ম নিয়াছিল রাইন নদীর ধারে কর্ক-ওক, বার্চ ও বীচবনের শ্যামল ছায়ায় বনেদী ঘরের প্রাচীন প্রাসাদে, মধ্যযুগের আড়ম্বরপূর্ণ আবহাওয়ায়, সুন্দরমুখ সখীদের দল। হাজার বছর পর আবার হয়তো সে পৃথিবীতে ফিরিয়া আসিবে–তখন কি মনে পড়িবে এবারকারের এই জীবনটা? কিংবা কে জানে আর হয়তো এ পৃথিবীতে আসিবে না—ওই যে বটগাছের সারির মাথায় সন্ধ্যার ক্ষীণ প্রথম তারকাটি—ওদের জগতে অজানা জীবনধারার মধ্যে হয়তো এবার নবজন্ম!—কতবার যেন সে আসিয়াছে….জন্ম হইতে জন্মান্তরে, মৃত্যু হইতে মৃত্যুর মধ্য দিয়া…বহু দূর অতীতে ও ভবিষ্যতে বিস্মৃত সে পথটা যেন বেশ দেখিতে পাইল…কত নিশ্চিন্দিপুর, কত অপর্ণা, কত দুর্গা দিদি-জীবনের ও জন্মমৃত্যুর বীথিপথ বাহিয়া ক্লান্ত ও আনন্দিত আত্মার সে কি অপরুপ অভিযান…শুধু আনন্দে, যৌবনে, জীবনে, পুণ্যে ও দুঃৰে, শোকে ও শান্তিতে।…এই সবটা লইয়া যে আসল বৃহত্তর জীবন—পৃথিবীর জীবনটুকু যার ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ মাত্র—তার স্বপ্ন যে শুধুই কল্পনাবিলাস, এ যে হয় তা কে জানে-বৃহত্তর জীবনচক্র কোন্ দেবতার হাতে আবর্তিত হয় কে জানে?…হয়তো এমন সব প্রাণী আছেন যারা মানুষের মতো ছবিতে, উপন্যাসে, কবিতায় নিজেদের শিল্পসৃষ্টির আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করেন না—তারা এক এক বিশ্ব সৃষ্টি করেন—তার মানুষের সুখে-দুঃখে উখানে-পতনে আত্মপ্রকাশ করাই তাদের পদ্ধতি-কোন্ মহান বিবর্তনের জীব তার অচিন্তনীয় কলাকুশলতাকে গ্রহে গ্রহে নক্ষত্রে নক্ষত্রে এ-রকম রূপ দিয়াছেন কে তাঁকে জানে?…
একটি অবর্ণনীয় আনন্দে, আশায়, অনুভূতিতে, রহস্যে মন ভরিয়া উঠিল। প্রাণবন্ত তার আশা, সে অমর ও অনন্ত জীবনের বাণী বনলতার রৌদ্রদগ্ধ শাখাপত্রের তিক্ত গন্ধ আনেশীলশূন্যে বালিহাঁসের সাঁই সাঁই রব শোনায়। সে জীবনের অধিকার হইতে তাহাকে কাহারও বঞ্চনা করিবার শক্তি নাই—তার মনে হইল সে দীন নয়, দুঃখী নয়, তুচ্ছ নয়-ওটুকু শেষ নয়, এখানে আরও নয়। সে জন্মজন্মান্তরের পথিক আত্মা, দূর হইতে কোন সুদূরের নিত্য নূতন পথহীন পথে তার গতি, এই বিপুল নীল আকাশ, অগম্য জ্যোতিলোক, সপ্তর্ষিমণ্ডল, হায়াপথ, বিশাল অ্যান্ড্রোমিডা নীহারিকার জগৎ, বহিৰ্যদ পিতৃলোক—এই শত সহস্র শতাব্দী, তার পায়ে-চলার পথতার ও সকলের মৃত্যুদ্বারা অস্পষ্ট সে বিরাট জীবনটা নিউটনের মহাসমুদ্রের মতো সকলেরই পুরোভাগে অক্ষুন্ন ভাবে বর্তমান-নিঃসীম সময় বাহিয়া সে গতি সারা মানবের যুগে যুগে বাধাহীন হউক।…
অপু তাহাদের ঘাটের ধারে আসিল। ওইখানটিতে এমন এক সন্ধ্যার অন্ধকারে বনদেবী বিশালাক্ষী স্বরূপ চক্রবর্তীকে দেখা দিয়েছিলেন কতকাল আগে।
আজ যদি আবার তাহাকে দেখা দেন।
-তুমি কে?
—আমি অপু।
–তুমি বড়ো ভালো ছেলে। তুমি কি বর চাও?
–অন্য কিছুই চাই নে, এ গাঁয়ের বনঝোপ, নদী, মাঠ, বাঁশবনের ছায়ায় অবোধ, উগ্রীব, স্বপ্নময় আমার সেই যে দশ বৎসর বয়সের শৈশবটি—তাকে আর একটিবার ফিরিয়ে দেবে দেবী?–
“You enter it by the Ancient way
Through Ivory Gate and golden”
ঠিক দুপুর বেলা।
রানী কাজলকে আটকাইয়া রাখিতে পারে না–বেজায় চঞ্চল। এই আছে, কোথা গিযা যে কখন বাহির হইয়া গিয়াছে—কেহ বলিতে পারে না।
সে রোজ জিজ্ঞাসা করে পিসিমা, বাবা কবে আসবে? কতদিন দেরি হবে?
অপু যাইবার সময় বলিয়া গিয়াছিল-রানুদি, খোকাকে তোমার হাতে দিয়ে যাচ্ছি, ওকে এখানে রাখবে, ওকে বোলো না আমি কোথা যাচ্ছি। যদি আমার জন্য কাঁদে, ভুলিয়ে রেখো তুমি ছাড়া ও-কাজ আর কেউ পারবে না।
রানু চোখ মুছিয়া বলিয়াছিল—ওকে এ-রকম ফাঁকি দিতে তোর মন সরছে? বোকা ছেলে তাই বুঝিয়ে গেলি—যদি চালাক হত?
অপু বলিয়াছিল, দেখ আর একটা কথা বলি। ওই বাঁশবনের জায়গাটা—তোমায় চল দেখিয়ে রাখি—একটা সোনার কৌটো মাটিতে পোঁতা আছে আজ অনেকদিন-মাটি খুঁড়লেই পাবে। আর যদি না ফিরি আর খোকা যদি বাঁচে-বৌমাকে কৌটোটা দিয়ো সিঁদুর রাখতে। খোকাও কষ্ট পেয়ে মানুষ হোক—এত তাড়াতাড়ি স্কুলে ভর্তি করবার দরকার নেই। যেখানে যায় যেতে দিয়ো-কেবল যখন ঘাটে যাবে, তুমি নিজে নাইতে নিয়ে যেয়ো-সাঁতার জানে না, ছেলেমানুষ ডুবে যাবে। ও একটু ভীতু আছে, কিন্তু সে ভয় এ নেই তা নেই বলে ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা কোরো না—কি আছে কি নেই তা বলতে কেউ পারে না রানুদি। কোনোদিবই গোঁড়ামি ভালো নয়—তা ওর ওপর চাপাতে যাওয়ারও দরকার নেই। যা বোঝে বুঝুক, সেই ভালো।
অপু জানিত, কাজল শুধু তার কল্পনা-প্রবণতার জন্য ভীতু। এই কাল্পনিক ভয় সকল আনন্দ রোমান্স ও অজানা কল্পনার উৎসমুখ। মুক্ত প্রকৃতির তলায় থোকার মনের সব বৈকাল ও রাত্রিগুলি অপূর্ব রহস্যে রঙিন হইয়া উইক-মনেপ্রাণে এই তাহার আশীর্বাদ।
ভবঘুরে অপু আবার কোথায় চলিয়া গিয়াছে। হয়তো লীলার মুখের শেষ অনুরোধ রাখিতে কোন পোর্তো প্লাতার ডুবো জাহাজের সোনার সন্ধানেই বা বাহির হইয়াছে। গিয়াছেও প্রায় ছসাত মাস হইল।
সতুও অপুর ছেলেকে ভালোবাসে। সে ছেলেবয়সের সেই দুষ্টু সতু আর নাই, এখন সংসারের কাছে ঠেকিয়া সম্পূর্ণ বদলাইয়া গিয়াছে। এখন সে আবার খুব হরিভক্ত। গলায় মালা, মাথায় লম্বা চুল। দোকান হইতে ফিরিয়া হাত মুখ ধুইয়া বোয়াকে বসিয়া খোল লইয়া কীর্তন গায়। নীলমণি রায়ের দরুন জমার বাগান বিক্রয় করিয়া অপুর কাছে সত্তর টাকা পাইয়াছিল—তাহা ছাড়া কাটিহার তামাকের চালান আনিবার জন্য অপুর নিকট আরও পঞ্চাশটি টাকা ধার স্বরুপ লইয়াছিল। এটা রানীকে লুকাইয়া–কারণ রানী জানিতে পারিলে মহা অনর্থ বাধাইত-কখনই টাকা লইতে দিত না।
কাজলের ঝোঁক পাখির উপর। এত পাখি সে কখনও দেখে নাই—তাহার মামার বাড়ির দেশে ঘিঞ্জি বসতি, এত বড়ো বন, মাঠ নাই—এখানে আসিয়া সে অবাক হইয়া গিয়াছে। রাত্রে শুইয়া শুইয়া মনে হয় পিছনের সমস্ত মাঠ, বন রাত্রির অন্ধকারের মধ্যে দৈত্যদানো, ভূত ও শিয়ালের ভিড়ে ভরিয়া গিয়াছে-পিসিমার কাছে আরও ঘেঁষিয়া শোয়। কিন্তু দিনমানে আর ভয় থাকে না, তখন পাখির ডিম ও বাসা খুঁজিয়া বেড়াইবার খুব সুযোগ। রানু বারণ করিয়াছে—গাঙের ধারের পাখির গর্তে হাত দিয়ো না কাজল, সাপ থাকে। শোনে না, সেদিনও গিয়াছিল পিসিমাকে লুকাইয়া কিন্তু অন্ধকার হইয়া গেলেই তার যত ভয়।
দুপুরে সেদিন পিসিমাদের বাড়ির পিছনে বাঁশবনে পাখির বাসা খুঁজিতে বাহির হইয়াছিল। সবে শীতকাল শেষ হইয়া রৌদ্র বেজায় চড়িযাছে, আকাশে বাতাসে বনে কেমন গন্ধ। বাবা তাহাকে কত বনের গাছ, পাখি চিনাইয়া দিয়া গিয়াছে, তাই সে জানে কোথায় বনমরিচাব লতায় থোকা থোকা সুগন্ধ ফুল ধরিয়াছে, কেলেফেঁড়ার লতার কচি ডগা ঝোপের মাথায় মাথায় সাপের মতো দুলিতেছে।
কখনও সে ঠাকুবদাদার পোডড়া ভিটাটাতে ঢোকে নাই। বাহির হইতে তাহার বাবা তাহাকে দেখাইয়াছিল, বোধ হয় ঘন বন বলিয়া ভিতরে লইয়া যায় নাই। একবার ঢুকিয়া দেখিতে খুব কৌতূহল হইল।
জায়গাটা খুব উঁচু ঢিবিমতো। কাজল এদিক ওদিক চাহিয়া ঢিবিটার উপরে উঠিল— তারপরে ঘন কুঁচকাটা ও শ্যাওড়া বনের বেড়া ঠেলিযা নিচের উঠানে নামিল। চারিধারে ইট, বাঁশের কঞ্চি, ঝোপঝাপ। পাখি নাই এখানে? এখানে তো কেউ আসে না—কত পাখির বাসা আছে হয়তো—কে বা খোঁজ রাখে?
বসন্তবৌরী ডাকে—টুলি, টুকলি—তাহার বাবা চিনাইয়াছিল, কোথায় বাসাটা? না, এমনি ডালে বসিয়া ডাকিতেছে?
মুখ উঁচু করিয়া থোকা ঝিড়ে গাছের ঘন ডালপালার দিকে উৎসুক চোখে দেখিতে লাগিল।
এক ঝলক হাওয়া যেন পাশের পোড়া ঢিবিটার দিক হইতে অভিনন্দন বহন করিয়া আনিল—সঙ্গে সঙ্গে ভিটার মালিক ব্রজ চক্রবর্তী, ঠ্যাঙাড়ে বীরু রায়, ঠাকুরদাদা হরিহর রায়, ঠাকুরমা সর্বজয়া, পিসিমা দুর্গা—জানা-অজানা সমস্ত পূর্বপুরুষ দিবসের প্রসন্ন হাসিতে অভ্যর্থনা করিয়া বলিল—এই যে তুমি আমাদের হয়ে ফিরে এসেছ, আমাদের সকলের প্রতিনিধি যে আজ তুমিআমাদের আশীর্বাদ নাও, বংশের উপযুক্ত হও।
আরও হইল। সোঁদালি বনের ছায়া হইতে জল আহরণরত সহদেব, ঠাকুরমাদের বেলতলা হইতে শরশয্যাশায়িত ভীষ্ম, এ-ঝোপের ও-ঝোপের তলা হইতে বীর কর্ণ, গাণ্ডীবধারী অর্জুন, অভাগিনী ভানুমতী, কপিধ্বজ রথে সারথি শ্রীকৃষ্ণ, পরাজিত রাজপুত্র দুর্যোধন, তমসাতীরের পর্ণকুটিরে প্রীতিমতী তাপসবধূবেষ্টিতা অশ্রুমুখী ভগবতী দেবী জানকী, স্বয়ংবর সভায় বরমাল্যহস্তে ভ্রাম্যমাণ আনতবদনা সুন্দরী সুভদ্রা, মধ্যাহ্নের খররৌদ্রে মাঠে মাঠে গোচারণরত সহায়-সম্পদহীন দরিদ্র ব্রাহ্মণপুত্র ব্রিজট-হাতছানি দিয়া হাসিমুখে অভ্যর্থনা করিয়া বলিল-এই যে তুমি, এই যে আবার ফিরে এসেছ। চেনো না আমাদের? কত দুপুরে ভাঙা জানলাটায় বসে বসে আমাদের সঙ্গে মুখোমুখি যে কত পরিচয়! এস…এসো…এ…
সঙ্গে সঙ্গে রানুর গলা শোনা গেল-ও খোকা, ওরে দুষ্টু ছেলে, এই একগলা বনের মধ্যে ঢুকে তোমার কি হচ্ছে জিজ্ঞেস করি—বেরিয়ে আয় বলছি! খোকা হাসিমুখে বাহির হইয়া আসিল। সে পিসিমাকে মোটেই ভয় করে না। সে জানে পিসিমা তাকে খুব ভালোবাসে-দিদিমার পরে এক বাবা ছাড়া তাকে এমন ভালো আর কেউ বাসে নাই।
হঠাৎ সেই সময় রানুর মনে হইল, অপু ঠিক এমনি দুই মুখের ভঙ্গি করিত ছেলেবেলায় ঠিক এমনটি।
যুগে যুগে অপরাজিত জীবন-রহস্য কি অপূর্ব মহিমাতেই আবার আত্মপ্রকাশ করে।
খোকার বাবা একটু ভুল করিয়াছিল।
চব্বিশ বৎসরের অনুপস্থিতির পর অবোধ বালক অপু আবার নিশ্চিন্দিপুরে ফিরিয়া আসিয়াছে।