১১. পরদিন বিবাহ

একাদশ পরিচ্ছেদ

পরদিন বিবাহ। সকাল হইতে নানা কাজে সে বাড়ির ছেলের মতো খাটিতে লাগিল। নাটমন্দিরে বরাসন সাজানোর ভার পড়িল তাহার উপর। প্রাচীন আমলের বড়ো জাজিম ও শতরঞ্চির উপর সাদা চাদর পাতিয়া ফরাস বিছানো, কাচের সেজ ও বাতির ডুম টাঙানো, দেবদারু পাতার ফটক বাধা, কাগজ কাটিয়া দম্পতির উদ্দেশে আশিসবাণী রচনা, সকাল আটটা হইতে বেলা তিনটা পর্যন্ত এসব কাজে কাটিল।

সন্ধ্যার সময় বর আসিবে। বরের গ্রাম এই নদীরই ধারে, তবে দশ বারো ক্রোশ দূরে, নদীপথেই আসিতে হইবে। বরের পিতা ও-অঞ্চলের নাকি বড়ো গাঁতিদার, তাহা ছাড়া বিস্তৃত মহাজনী কারবারও আছে।

বরের নৌকা আসিতে একটু বিলম্ব হইতে পারে, প্রথম লগ্নে বিবাহ যদি না হয় রাত্রি দশটার লগ্ন বাদ যাইবে না।

ব্যাপার বুঝিয়া অপু বলিল-রাত তো আজ জাগতেই হবে দেখছি, আমি এখন একটু ঘুমিয়ে নিই ভাই, বর এলে আমাকে ডেকে তুলো এখন।

প্রণব তাহাকে তেতলার চিলেকোঠার ঘরে লইয়া গিয়া বলিল—এখানে হৈ-চৈ কম, এখানে ঘুম হবে এখন, আমি ঘণ্টা দুই পরে ডাকবো।

ঘরটা ছোট, কিন্তু খুব হাওয়া, দিনের শ্রান্তিতে সে শুইতে না শুইতে ঘুমাইয়া পড়িল।

 

কতক্ষণ পরে সে ঠিক জানে না, কাহাদের ডাকাডাকিতে তাহার ঘুম ভাঙিয়া গেল।

সে তাড়াতাড়ি উঠিয়া চোখ মুছিতে মুছিতে বলিল, বর এসেছে বুঝি? উঃ, রাত অনেক হয়েছে তো! কিন্তু প্রণবের মুখের দিকে চাহিয়া তাহার মনে হইল—একটা কিছু যেন ঘটিয়াছে। সে বিস্ময়ের সুরে বলিল—কি-কি প্রণব-কিছু হয়েছে নাকি?

উত্তরের পরিবর্তে প্ৰণব তাহার বিছানার পাশে বসিয়া পড়িয়া কাতর মুখে তাহার দিকে চাহিল, পরে হল-ছল চোখে তাহার হাত দুটি ধরিয়া বলিল—ভাই আমাদের মান রক্ষার ভার তোমার হাতে আজ রাত্রে, অপর্ণাকে এখুনি তোমার বিয়ে করতে হবে, আর সময় বেশি নেই, রাত খুব অল্প আছে, আমাদের মান রাখো ভাই।

আকাশ হইতে পড়িলেও অপু এত অবাক হইত না।

প্রণব বলে কি?…প্রণবের মাথা খারাপ হইয়া গেল নাকি? না-কি ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখিতেছে!

এই সময়ে দুজন গ্রামের লোকও ঘরে ঢুকিলেন, একজন বলিলেন—আপনার সঙ্গে যদিও আমার পরিচয় হয় নি, তবুও আপনার কথা সব পুলুর মুখে শুনেছি—এদের আজ বড় বিপদ, সব বলছি আপনাকে, আপনি না বাঁচালে আর উপায় নেই

ততক্ষণে অপু ঘুমের ঘোরটা অনেকখানি কাটাইয়া উঠিয়াছে, সে না-বুঝিতে পারার দৃষ্টিতে একবার প্রণবের, একবার লোক দুইটির মুখের দিকে চাহিতে লাগিল। ব্যাপারখানা কি!

ব্যাপার অনেক।

সন্ধ্যার ঘণ্টাখানেক পর বরপক্ষের নৌকা আসিয়া ঘাটে লাগে। লোকজনের ভিড় খুব, তিনখানা গ্রামের প্রজাপত্র উৎসব দেখিতে আসিয়াছে। বরকে হাঙরমুখো সেকেলে বড়ো পালকিতে উঠাইয়া বাজনা-বাদ্য ও ধুমধামের সহিত মহা সমাদরে ঘাট হইতে নাটমন্দিরে বরাসনে আনা হইতেছিল— এমন সময় এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটিল। বাড়ির উঠানে পালকিখানা আসিয়া পৌঁছিয়াছে, হঠাৎ বর নাকি পালকি হইতে লাফাইয়া পড়িয়া চেঁচাইয়া বলিতে থাকে—হুক্কা বোলাও, হুক্কা বোলাও।

সে কি বেজায় চিৎকার!

এক মুহূর্তে সব গোলমাল হইয়া গেল। চিৎকার হঠাৎ থামে না, বরকর্তা স্বয়ং দৌড়িয়া গেলেন, বরপক্ষের প্রবীণ লোকেরা ছুটিয়া গেলেন,—চারিদিকে সকলে অবাক, প্রজারা অবাক, গ্রামসুদ্ধ লোক অবাক! সে এক কাণ্ড! চোখে না দেখিলে বুঝানো কঠিন আর কি যে লজ্জা, সারা উঠান জুড়িয়া প্রজা, প্রতিবেশী, আত্মীয়কুটুম্ব, পাড়ার ও গ্রামের ছোট বড়ো সকলে উপস্থিত, সকলের সামনে-বড়য্যে বাড়ির মেয়ের বিবাহে এ ভাবের ঘটনা ঘটিবে, তাহা স্বপ্নাতীত, এ উহার মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে, মেয়েদের মধ্যে কান্নাকাটি পড়িয়া গেল। বর যে প্রকৃতিস্থ নয়, একথা বুঝিতে কাহারও বাকি রহিল না।

বরপক্ষ যদিও নানাভাবে কথাটা ঢাকিবার যথাসাধ্য চেষ্টা করিলেন, কেহ বলিলেন গরমে ও সারাদিনের উপবাসের কষ্টেও কিছু নয়, ওরকম হইয়া থাকে…কিন্তু ব্যাপারটা অত সহজে চাপা দেওয়া গেল না, ক্রমে ক্রমে নাকি প্রকাশ হইতে লাগিল যে, বরের একটু সামান্য ছিট আছে বটে, কিংবা ছিল বটে, তবে সেটা সবসময় যে থাকে তা নয়, আজকার গরমে, বিশেষ উৎসবের উত্তেজনায় ইত্যাদি। ব্যাপারটা অনেকখানি সহজ হইয়া আসিতেছিল, নানা পক্ষের বোঝানোতে আবার সোজা হাওয়া বহিতে শুরু করিয়াছিল, মেয়ের বাপ শশীনারায়ণ বাঁড়জ্যেও মন হইতে সমস্তটা ঝাড়িয়া ফেলিতে প্রস্তুত ছিলেন—তাহা ছাড়া উপায়ও অবশ্য ছিল না—কিন্তু এদিকে মেয়ের মা অর্থাৎ প্রণবের বড়ো মামিমা মেয়ের হাত ধরিয়া নিজের ঘরে ঢুকিয়া খিল দিয়াছেন,—তিনি বলেন, জানিয়া-শুনিয়া তাহার সোনার প্রতিমা মেয়েকে তিনি ও পাগলের হাতে কখনই তুলিয়া দিতে পারিবেন না, যাহা অদৃষ্টে আছে ঘটিবে। সকলের বহু অনুনয়-বিনয়েও এই তিন-চার ঘণ্টার মধ্যে তিনি আর ঘরের দরজা খোলেন নাই, নাকি তেমন তেমন বুঝিলে মেয়েকে রামদা দিয়া কাটিয়া নিজের গলায় দা বসাইয়া দিবেন এমনও শাসাইয়াছেন, সুতরাং কেহ দরজা ভাঙিতে সাহস করে নাই। অপর্ণাও এমনি মেয়ে, সবাই জানে, মা তাহার গলায় যদি সত্যিই রাম-দা বসাইয়া দেয়, সে প্রতিবাদে মুখে কখনও টু শব্দটি উচ্চারণ করিবে না, মায়ের ব্যবস্থা শান্তভাবেই মানিয়া লইবে।

পিছনের ভদ্রলোকটি বলিলেন, আপনি না রক্ষা করলে আর কেউ নেই, হয় এদিকে একটা খুনোখুনি হবে, না হয় সকাল হলেই ও-মেয়ে দো-পড়া হয়ে যাবে—এসব দিকের গতিক তো জানেন না, দো-পড়া হলে কি আর ও মেয়ের বিয়ে হবে মশাই?…আহা, অমন সোনার পুতুল মেয়ে, এত কড়ো ঘর, ওরই অদৃষ্টে শেষে কিনা এই কেলেঙ্কারি। এ রাত্রের মধ্যে আপনি ছাড়া এ অঞ্চলে ওমেয়ের উপযুক্ত পাত্র কেউ নেই-বাঁচান আপনি–

অপুর মাথায় যেন কিসের দাপাদাপি, মাতামাতি…মাথার মধ্যে যেন চৈতন্যদেবের নগরসংকীর্তন শুরু হইয়াছে!…এ কি সংকটে তাহাকে ভগবান ফেলিলেন! সকল প্রকার বন্ধনকে সে ভয় করে, তাহার উপর বিবাহের মতো বন্ধন! এই তো সেদিন মা তাহাকে মুক্তি দিয়া গেলেন…আবার এক বৎসর ঘুরিতেই—এ কি!

মেয়েটির মুখ মনে হইল…আজই সকালে নিচের ঘরে তাহাকে দেখিয়াছে…কি শান্ত, সুন্দর গতিভঙ্গি। সোনার প্রতিমাই বটে, তাহার অদৃষ্টে উৎসবের দিনে এই ব্যাপার!…তাহারা ছাড়া রাম-দা-এর কাণ্ডটা…কি করে সে এখন?

কিন্তু ভাবিবার অবসর কোথায়? পিছনে প্রণব দাঁড়াইয়া কি বলিতেছে, সেই ভদ্রলোক দুটি তার হাত ধরিয়াছেন—তাহাও সে ঠেলিয়া ফেলিয়া দিতে পারিত কিন্তু মেয়েটিও যেন শান্ত সাগর চোখ দুটি তুলিয়া তাহার মুখের দিকে চাহিয়া আছে, সেই যে কাল সন্ধ্যায় প্রণবের আহ্বানে ছাদের উপরে যেমন তাহার পানে চাহিয়াছিল—তেমনি অপরূপ স্নিগ্ধ চাহনিতে…নির্বাক মিনতির দৃষ্টিতে সেও যেন তাহার উত্তরের অপেক্ষা করিতেছে।…

সে বলিল, চলো ভাই, যা করতে বলবে, আমি তাই করব, এসো।

নিচে কোথাও কোন শব্দ নাই, উৎসব-কোলাহল থামিয়া গিয়াছে, বরপক্ষ এ বাড়ি হইতে সদলবলে উঠিয়া গিয়া ইহাদের শরিক রামদুর্লভ বড়জ্যের চণ্ডীমণ্ডপে আশ্রয় লইয়াছেন, এ-বাড়ির ঘরে-ঘরে খিল বন্ধ। কেবল নাটমন্দিরে উত্তর বারান্দার স্থানে স্থানে দু-চারজন জটলা করিয়া কি বলাবলি করিতেছে, আশ্চর্য এই যে, সম্প্রদানসভায় পুরোহিত মহাশয় এত গোলমালের মধ্যেও ঠিক নিজের কুশাসনখানির উপর বসিয়া আছেন, তিনি নাকি সেই সন্ধ্যার সময় আসনে বসিয়াছেন আর উঠেন নাই।

সকলে মিলিয়া সইয়া গিয়া অপুকে বরাসনে বসাইয়া দিল।

এসব ঘটনা পরবর্তী জীবনে অপুর তত মনে ছিল না, বাংলা খবরের কাগজের ছবির মতো অস্পষ্ট ধোঁয়া-ধোঁয়া ঠেকিত। তাহার মন তখন এত দিশাহারা ও অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় ছিল, চারিধারে কি হইতেছে, তাহার আদৌ লক্ষ্য ছিল না।

আবার দু-একটা যাহা লক্ষ করিতেছিল, যতই তুচ্ছ হোক গভীরভাবে মনে আঁকিয়া গিয়াছিল, যেমন—সামিয়ানার কোণের দিকে কে একজন ডাব কাটিতেছিল, ডাবটা গোল ও রাঙা, কাটারির বাঁটটা বাঁশের–অনেকদিন পর্যন্ত মনে ছিল।

রেশমি-চেলি-পরা সালংকাৱা কন্যাকে সভায় আনা হইল, বাড়ির মধ্যে হঠাৎ শাঁখ বাজিয়া উঠিল, উলুধ্বনি শোনা গেল, লোকে ভিড় করিয়া সম্প্রদানসভার চারিদিকে গোল হইয়া দাঁড়াইল। পুরোহিতের কথায় অপু চেলি পরিল, নূতন উপবীত ধারণ করিল, কলের পুতুলের মতো মন্ত্রপাঠ করিয়া গেল। স্ত্রী-আচারের সময় আসিল, তখনও সে অন্যমনস্ক, নববধূর মতো সেও ঘাড় খুঁজিয়া আছে, যে ব্যাপারটা ঘটিতেছে চারিধারে তখনও যেন সে সম্যক ধারণা করিতে পারে নাই কানের পাশ দিয়া কি একটা যেন শিরশির করিয়া উপরের দিকে উঠিতেছেনা, ঠিক উপরের দিকে নয়, যেন নিচের দিকে নামিতেছে।

প্রণবের বড়ো মামিমা কাঁদিতেছিলেন তাহা মনে আছে, তিনিই আবার গরদের শাড়ির আঁচল দিয়া তাহার মুখের ঘাম মুছাইয়া দিলেন, তাহাও মনে ছিল। কে একজন মহিলা বলিলেন—মেয়ের শিবপুজোর জোর ছিল বড়োবৌ তাই এমন বর মিললো। ভাঙা দালান যে রূপে আলো করছে।

শুভদৃষ্টির সময় সে এক অপূর্ব ব্যাপার। মেয়েটি লজ্জায় ডাগর চোখ দুটি নত করিয়া আছে, অপু কৌতূহলের সহিত চাহিয়া দেখিল, ভালো করিয়াই দেখিল, যতক্ষণ কাপড়ের ঢাকাটা ছিল, ততক্ষণ সে মেয়েটির মুখ ছাড়া অন্যদিকে চাহে নাই-চিবুকের গঠন-ভঙ্গিটি এক চমক দেখিয়াই সুঠাম ও সুন্দর মনে হইল। প্রতিমার মতো রুপই বটে, চুর্ণ অলকের দু-এক গাছা কানের আশেপাশে পড়িয়াছে, হিজুল রঙের ললাটে ও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। কানে সোনার দুলে আলো পড়িয়া জ্বলিতেছে।

বাসর হইল খুব অল্পক্ষণ, রাত্রি অল্পই ছিল। মেয়েদের ভিড়ে বাসর ভাঙিয়া পড়িবার উপক্রম হইল। ইহাদের অনেকেই বিবাহ ভাঙিয়া যাইতে নিজের নিজের বাড়ি চলিয়া গিয়াছিলেন, কোথা হইতে একজনকে ধরিয়া আনিয়া অপর্ণার বিবাহ দেওয়া হইতেছে শুনিয়া তাহারা পুনরায় ব্যাপারটা দেখিতে আসিলেন। একরাত্রে এত মজা এ অঞ্চলের অধিবাসীর ভাগ্যে কখনও জোটে নাই কিন্তু পথ-ইতেধরিয়া-আনা বরকে দেখিয়া সকলে একবাক্যে স্বীকার করিলেন-এইবার অপর্ণার উপযুক্ত বর হইয়াছে বটে।

প্রণবের বড়ো মামিমা তেজস্বিনী মহিলা, তিনি বাকিয়া না বসিলে ওই বায়ুরোগগ্রস্ত পাত্রটির সহিতই আজ তাঁহার মেয়ের বিবাহ হইয়া যাইত নিশ্চয়ই। এমন কি তাহার অমন রাশভারী স্বামী শশীনারায়ণ বাঁড়ুজ্যে যখন নিজে বন্ধ দরজার কাছে দাঁড়াইয়া বলিয়াছিলেন—বড়োবৌ, কি করো পাগলের মতো, দোর খোলো, আমার মুখ রাখো-ছিঃ—তখনও তিনি অচল ছিলেন। তিনি বলিলেন—মা, যখনই একে পুলুর সঙ্গে দেখেছি, তখনই আমার মন যেন বলেছে এ আমার আপনার লোক—ছেলে তো আরও অনেক পুলুর সঙ্গে এসেছে গিয়েছে কিন্তু এত মায়া কারোর উপর হয়নি কখনও-ভেবে দ্যাখো মা, এ মুখ আর লোকালয়ে দেখাব না ভেবেছিলাম—ও ছেলে যদি আজ পুলুর সঙ্গে এ বাড়ি না আসত।

পূর্বের সেই প্রৌঢ় বাধা দিয়া বলিলেন—তা কি করে হবে মা, ওই যে তোমার অপর্ণার স্বামী, তুমি আমি কেনারাম মুখুজ্যের ছেলের সঙ্গে ওর সম্বন্ধ ঠিক করতে গেলে কি হবে, ভগবান যে ওদের দুজনের জন্যে দুজনকে গড়েছেন, ও ছেলেকে যে আজ এখানে আসতেই হবে মা

প্রণবের মামিমা বলিলেন—আবার যে এমন করে কথা বলব তা আজ দুঘন্টা আগেও ভাবিনি—এখন আপনারা পাচজনে আশীর্বাদ করুন, যাতে—যাতে

চোখের জলে তাহার গলা আড়ষ্ট হইয়া গেল। উপস্থিত কাহারও চোখ শুষ্ক ছিল না, অপুও অতি কষ্টে উদগত অঞ চাপিয়া বসিয়া রহিল। প্রণবের মামিমার উপর শ্রদ্ধা ও ভক্তিতে তাহার মন-মায়ের পরই বোধ হয় এমন আর কাহাবও উপর—কেবল আর একজন আছেন-মেজ বৌরানী—তিনি লীলার মা।

তা ছাড়া মায়ের উপর তাহার মনোভাব, শ্রদ্ধা বা ভক্তির ভাব নয়, তাহা আরও অনেক ঘনিষ্ঠ, অনেক গভীর, অনেক আপন—বত্রিশ নাড়ীর বাঁধনের সঙ্গে সেখানে যেন যোগ-সে-সব কথা বুঝাইয়া বলা যায় না—যাক সে কথা।

বিশ্বাসঘাতক প্রণব কোথা হইতে আসিয়া সকলকে জানাইয়া দিল যে, নূতন জামাই খুব ভালো গাহিতে পারে। অপর্ণার মা তখনই বাসর হইতে চলিয়া গেলেন; বালিকা ও তরুণীর দল একে চায় তো আরে পায়, এদিকে অপু ঘামিয়া রাঙা হইয়া উঠিয়াছে। না সে পারে ভালো করিয়া কাহারও দিকে চাহিতে, না মুখ দিয়া বাহির হয় কোন কথা। নিতান্ত পীড়াপীড়িতে একটা রবিবাবুর গান গাহিল, তারপর আর কেহ ছাড়িতে চায় না–সুতরাং আর একটা মেয়েরাও গাহিলেন, একটি বধুর কণ্ঠস্বর ভারি সুমিষ্ট। প্রৌঢ়া ঠানদি নববধুর গা ঠেলিয়া দিয়া বলিলেন–ওরে ও নাতনি, তোর বর ভেবেছে ও বাঙাল দেশে এসে নিজেই গান গেয়ে আসর মাতিয়ে দেবে—শুনিয়ে দে না তোর গলাজারিজুরি একবার দে না ভেঙে

অপু মনে মনে ভাবেকার বর?…সে আবার কার বর?…এই সুসজ্জিতা সুন্দরী মতমুখী মেয়েটি তাহার পাশে বসিয়া, এ তার কে হয়?…স্ত্রী…তাহারই স্ত্রী?

পরদিন সকালে পূর্বতন বরপক্ষের সহিত তুল কা৩ বাধিল। উভয়পক্ষে বিস্তর তক, ঝগড়া, শাপাশি, মামলার ভয় প্রদর্শনের পর কেনারাম মুখুজ্যে দলবলসহ নৌকা করিয়া স্বগ্রামের দিকে যাত্রা করিলেন। প্রণব বড়োমামাকে বলিল—ওসব বড়োলোকের মুখ জড়ভরত ছেলের চেয়ে আমি যে অপূর্বকে কত বড়ো মনে করি।…একা কলকাতা শহরে সহায়হীন অবস্থায় ওকে যা দুঃখের সঙ্গে লড়াই করতে দেখেছি আজ তিন বছর ধরে, ওকে একটা সত্যিকার মানুষ বলে ভাবি।

অপুর ঘর-বাড়ি নাই, ফুলশয্যা এখানেই হইল। রাত্রে অপু ঘরে ঢুকিয়া দেখিল ঘরের চারিধার ফুল ও ফুলের মালায় সাজানো, পালকের উপর বিছানায় মেয়েরা একরাশ বৈশাখী চাপাফুল ছড়াইয়া রাখিয়াছে, ঘরের বাতাসে পুস্পসারের মৃদু সৌরভ। অপু সাগ্রহে নববধুর আগমন প্রতীক্ষা করিতেছিল। বাসরের রাত্রের পর আর মেয়েটির সহিত দেখা হয় নাই বা এ পর্যন্ত তাহার সঙ্গে কথাবার্তা হয় নাই আদৌ আচ্ছা ব্যাপারটা কি রকম ঘটিবে? অপুর বুক কৌতূহলে ও আগ্রহে টিপ টিপ করিতেছিল।

খানিক রাত্রে নববধূ ঘরে ঢুকিল। সঙ্গে সঙ্গে অপুর মনে আর একদফা একটা অবাস্তবতার ভাব জাগিয়া উঠিল। এ মেয়েটি তাহারই স্ত্রী!…স্ত্রী বলিতে যাহা বোঝায় অপুর ধারণা ছিল, তা যেন এ নয়…কিংবা হয়তো স্ত্রী বলিতে ইহাই বোঝায়, তাহার ধারণা ভুল ছিল। মেয়েটি দোরের কাছে ন যযৌ ন তস্থে অবস্থায় দাঁড়াইয়া ঘামিতেছিল—অপু অতিকষ্টে সংকোচ কাটাইয়া মৃদুস্বরে বলিল— আপনি—তু—তুমি দাঁড়িয়ে কেন? এখানে এসে বোসো

বাহিরে বহু বালিকাকণ্ঠের একটা সম্মিলিত কলহাস্যধ্বনি উঠিল। মেয়েটিও মৃদু হাসিয়া পালঙ্কের একধারে বসিল-লজ্জায় অপুর নিকট হইতে দূরে বসিল। এই সময় প্রণবের ছোটমামিমা আসিয়া বালিকার দলকে বকিয়া-ঝকিয়া নিচে নামাইয়া লইয়া যাইতে অপু খানিকটা স্বস্তি বোধ করিল। মেয়েটির দিকে চাহিয়া বলিল—তোমার নাম কি?

মেয়েটি মৃদুস্বরে নতমুখে বলিল—শ্ৰীমতী অপর্ণা দেবী—সঙ্গে সঙ্গে সে অল্প একটু হাসিল। যেমন সুন্দর মুখ তেমনি সুন্দর মুখের হাসিটা কি রং!…কি গ্রীবার ভঙ্গি। চিবুকের গঠনটি কি অপরূপ—মুখের দিকে চাহিয়া উজ্জ্বল বাতির আলোয় অপুর যেন কিসের নেশা লাগিয়া গেল।

দু-জনেই খানিকক্ষণ চুপ। অপুর গলা শুকাইয়া আসিয়াছিল। কুঁজা হইতে জল ঢালিয়া এক গ্লাস জলই সে খাইয়া ফেলিল। কি কথা বলিবে সে খুঁজিয়া পাইতেছিল না, ভাবিয়া ভাবিয়া অবশেষে বলিল—আচ্ছা, আমার সঙ্গে বিয়ে হওয়াতে তোমার মনে খুব কষ্ট হয়েছে—না?

বধু মৃদু হাসিল।–বুঝতে পেরেছি ভারি কষ্ট হয়েছে-তা আমার–

—যান–

এই প্রথম কথা, তাহাকে এই প্রথম সম্বোধন। অপুর সারাদেহে যেন বিদ্যুৎ খেলিয়া গেল, অনেক মেয়ে তো ইতিপূর্বে তাহার সঙ্গে কথা বলিয়াছে, এ রকম তো কখনও হয় নাই?…

দক্ষিণের জানালা দিয়া মিঠা হাওয়া বহিতেছিল, চাপাফুলের সুগন্ধে ঘরের বাতাস ভরপুর।

অপু বলিল—রাত দুটো বাজে, শোবে না? ইয়ে—এখানেই তো শোবে?

মা ও দিদির সঙ্গে ভিন্ন কখনও অন্য কোনও মেয়ের সঙ্গে এক বিছানায় সে শোয় নাই, একা একঘরে এতবড় অনাত্মীয়, নিঃসম্পর্কীয় মেয়ের পাশে এক বিছানায় শোওয়া—সেটা ভালো দেখাইবে? কেমন যেন বাধ-বাধ ঠেকিতেছিল। একবার তাহার হাতখানা মেয়েটির গায়ে অসাবধানতাবশত ঠেকিয়া গেল—সঙ্গে সঙ্গে সারা গা শিহরিয়া উঠিল। কৌতূহলে ও ব্যাপারের অভিনবতায় তাহার শরীরের রক্ত টগবগ করিয়া ফুটিতেছিল—ঘরের উজ্জ্বল আলোয় অপুর সুন্দর মুখ রাঙা ও একটা অস্বাভাবিক দীপ্তিসম্পন্ন দেখাইতেছিল।

হঠাৎ সে কিসের টানে পাশ ফিরিয়া মেয়েটির গায়ে ভয়ে ভয়ে হাত তুলিয়া দিল। বলিল সেদিন যখন আমার সঙ্গে প্রথম দেখা হল, তুমি কি ভেবেছিলে?

মেয়েটি মৃদু হাসিয়া তাহার হাতখানা আস্তে আস্তে সরাইয়া দিয়া বলিল—আপনি কি ভেবেছিলেন আগে বলুন?…সঙ্গে সঙ্গে সে নিজের সুঠাম, পুষ্পপেলব হাতখানি বাতির আলোয় তুলিয়া ধরিয়া হাসিমুখে বলিল—গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছে—এই দেখুন কাঁটা দিয়েছে—কেন বলুন না?…কথা শেষ করিয়া সে আবার মৃদু হাসিল।

এতগুলি কথা একসঙ্গে এই প্রথম! কি অপূর্ব রোমান্স এ! ইহার অপেক্ষা কোন রোমান্স আছে আর এ জগতে, না চিনিয়া, না বুঝিয়া সে এতদিন কি হিজিবিজি ভাবিয়া বেড়াইয়াছে?…জীবনের জগতের সঙ্গে এ কি অপূর্ব ঘনিষ্ঠ পরিচয়…তাহার মাথার মধ্যে কেমন যেন করিতেছে, মদ খাইলে বোধ হয় এরকম নেশা হয়…ঘরের হাওয়া যেন …ঘরের মধ্যে যেন আর থাকা যায় না…বেজায় গরম। সে বলিল—একটু বাইরের ছাদে বেড়িয়ে আসি, খুব গরম না? আসছি এখুনি।

বৈশাখের জ্যোৎস্না রাত্রি-রাত্রি বেশি হইলেও বাড়ির লোক এখনও ঘুমায় নাই, কাল এখানে বৌভাত হইবে, নিচে তাহারই উদ্যোগ আয়োজন চলিতেছে। দালানের পাশে বড়ো রোয়াকে ঝিয়েরা কচুর শাক কুটিতেছে, রান্না-কোঠার পিছনে নতুন খড়ের চালা বাঁধা হইয়াছে, সেখানে এত রাত্রে পানতুয়া ভিয়ান হইতেছে—সে ছাদের আলিসার ধারে দাঁড়াইয়া দেখিল।

ছাদে কেহ নাই, দূরের নদীর দিক হইতে একটা ঝিরঝিরে হাওয়া বহিতেছে। দু-দিন যে কি ঘটিয়াছে তাহা যেন সে ভালো করিয়া বুঝিতেই পারে নাই—আজ বুঝিয়াছে। কয়েকদিন পূর্বেও সে ছিল সহায়শূন্য, বন্ধুশুন্য, গৃহশূন্য, আত্মীয়শূন্য, জগতে সম্পূর্ণ একাকী, মুখের দিকে চাহিবার ছিল না কেহই। কিন্তু আজ তো তাহা নয়, আজ ওই মেয়েটি যে কোথা হইতে আসিয়া পাশে দাঁড়াইয়াছে, মনে হইতেছে যেন ও জীবনের পরম বন্ধু।

মা এ-সময় কোথায়?…মায়ের যে বড়ো সাধ ছিল…মনসাপোতার বাড়িতে শুইয়া শুইয়া কত রাত্রে সে-সব কত সাধ, কত আশার গল্প…মায়ের সোনার দেহ কোদলাতীরের শ্মশানে চিতাগ্নিতে পুড়িবার রাত্রি হইতে সে আশা-আকাঙ্ক্ষার তো সমাধি হইয়াছিল…মাকে বাদ দিয়া জীবনের কোন্ উৎসব…

তপ্ত আকুল চোখের জলে চারিদিক ঝাপসা হইয়া আসিল।

বৈশাখী শুক্লা দ্বাদশী রাত্রির জ্যোৎস্না যেন তাহার পরলোকগত দুঃখিনী মায়ের আশীর্বাদের মতো তাহার বিভ্রান্ত হৃদয়কে স্পর্শ করিয়া সরল শুভ্র মহিমায় স্বর্গ হইতে ঝরিয়া পড়িতেছে।


© 2024 পুরনো বই