০৯. ছাত্রীকে পড়াইতে যাইবার সময়

নবম পরিচ্ছেদ

ছাত্রীকে পড়াইতে যাইবার সময় অপুর গায়ে যেন জ্বর আসে, ছুটি-ছাটার দিনটা না যাইতে হইলে সে যেন বাঁচিয়া যায়। অদ্ভুত মেয়ে! এমন কারণে-অকারণে প্রভুত্ব জাহির করার চেষ্টা, এমন তাচ্ছিল্যের ভাব—এই রকম সে একমাত্র অতসীদিতে দেখিয়াছে!

একদিন সে ছাত্রীর একটা রুপা-বধানো পেন্সিল হারাইয়া ফেলিল। পকেটে ভুলিয়া লইয়া গিয়াছিল, কোথায় ফেলিয়াছে, তারপর আর কিছু খেয়াল ছিল না, পরদিন প্রীতি সেটা চাহিতেই তাহার তো চক্ষুস্থির! সংকুচিতভাবে বলিল—কোথায় যে হারিয়ে ফেললাম—কাল বরং একটা কিনে–

প্রীতি অপ্রসন্ন মুখে বলিল, ওটা আমার দাদুমণির দেওয়া বার্থ-ডে গিফট ছিল—

ইহার পর আর কিনিয়া আনিবার প্রস্তাবটা উত্থাপিত করা যায় না, মনে মনে ভাবিল, কাল থেকে ছেড়ে দেবো।এখানে আর চলবে না।

কি একটা ছুটির পরদিন সে পড়াইতে গিয়াছে, প্রীতি জিজ্ঞাসা করিল, কাল যে আসেন নি?

অপু বলিল, কাল ছিল ছুটির দিনটা—তাই আর আসি নি।

প্রীতি ফট করিয়া বলিয়া বসিল—কেন, কাল তো আমাদের সরকার, বাইরের দু-জন চাকর, ড্রাইভার সব এসেছিল? আমার পড়াশুনো কিছু হল না, আজ ডিটেন্ করে রাখলে পাঁচটা

অবধি।

অপুর হঠাৎ বড়ো রাগ হইল, দুঃখও হইল। খানিকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, আমি তোমাদের সরকার কি রাঁধুনীঠাকুর তো নই, প্রীতি! কাল স্কুল কলেজ সব বন্ধ ছিল, এজন্য ভাবলাম আজ যাব না। আমার যদি ভুলই হয়ে থাকে-তোমার সেই রকম মাস্টার রেখো যিনি এখানে বাজার-সরকারের মতো থাকবেন। আমি কাল থেকে আর আসব না বলে যাচ্ছি।

বাড়ির বাহিরে আসিয়া মনে হইল—দেওয়ানপুরের নির্মলাদের কথা। তাহারাও তো অবস্থাপন্ন, তাহাদের বাড়িতেও সে প্রাইভেট মাস্টার ছিল, কিন্তু সেখানে সে ছিল বাড়ির ছেলের মতো-নির্মলার মা দেখিতেন ছেলের চোখে, নির্মলা দেখিত ভাইয়ের চোখে—সে স্নেহ কি পথেঘাটে সুলভ? নির্মলার মতো মমতাময়ীকে তখন সে চিনিয়াও চেনে নাই, আজ নতুন করিয়া  তাহাকে আর চিনিয়া লাভ কি? আর লীলা? সে কথা ভাবিতেই বুকের ভিতরটা যেন কেমন করিয়া উঠিল–যাক সে সব কথা।

হাতের টাকায় কিছুদিন চলিল। ইতিমধ্যে কলেজে একটা বড়ো ঘটনা হইয়া গেল, প্রণব লেখাপড়া ছাড়িয়া কি নাকি দেশের কাজ করিতে চলিয়া গেল। সকলে বলিল, সে এনার্কিস্ট দলে যোগ দিয়াছে।

প্রণব চলিয়া যাওয়ার মাসখানেক পর একদিন অপু হোটেলে খাইতে গিয়া দেখিল, সুন্দরঠাকুর হোটেলওয়ালার মুখ ভার-ভার। দু-তিন মাসের টাকা বাকি, পাওনাদার আর কতদিন শোনে? আজ সে স্পষ্ট জানাইল, দেনা শোধ না করিলে আর সে খাইতে পাইবে না। বলিল-বাবু, অন্য খদ্দের হলে মাসের পয়লাটি যেতে দিই নেওই কৃক্টোবাবু খায়, ওদের পাটের কলের হপ্তাটি পেলে দিয়ে দেয়—তুমি বলে আমি কিছু বলছি না—দু-মাসের ওপর আজ নিয়ে সাত দিন। যাক আর পারব না, আপুনি আর আসবেন না-আমার ভাত একজন ভদ্রনোকের ছেলে খেয়েছে ভাবব, আর কি করব?

কথাগুলি খুব ন্যায্য এবং আদৌ অসংগত নয়, কিন্তু খাইতে গিয়া এরুপ বুঢ় প্রত্যাখ্যানে অপুর চোখে  জল আসিল। তাহার তো একদিনও ইচ্ছা ছিল না যে, ঠাকুরকে সে ফাঁকি দিবে, কিন্তু সেই প্রীতির টিউশনিটা ছাড়িয়া দেওয়ার পর আজ দুই-তিন মাস একেবারে নিরুপায় অবস্থায় ঘুরিতেছে যে!

বিপদের উপর বিপদ। দিন-দুই পরে কলেজে দিয়া দেখিল নোটিশ বোর্ডে লিখিয়া দিয়াছে, যাহাদের মাহিনা বাকি আছে, এক সপ্তাহের মধ্যে শোধ না করিলে কাহাকেও বার্ষিক পরীক্ষা দিতে দেওয়া হইবে না। অপু চক্ষে অন্ধকার দেখিল। প্রায় গোটা এক বৎসরের মাহিনাই যে তাহার বাকি!—মাত্র মাস-দুইয়ের মাহিনা দেওয়া আছে—সেই প্রথম দিকে একবার, আর প্রীতির টিউশনির টাকা হইতে একবার—তাহার পর হইতে খাওয়াই জোটে না তো কলেজের মাহিনা! দশ মাসেব বেতন ছটাকা হিসাবে ষাট টাকা বাকি। কোন দিক হইতে একটা কলঙ্কধরা নিকেলের সিকিও আসিবার সুবিধা নাই যাহার, ষাট টাকা সে এক সপ্তাহের মধ্যে কোথা হইতে জোগাড় করিবে? হয়তো তাহাকে পরীক্ষা দিতে দিবে না, গ্রীষ্মের ছুটির পর সেকেন্ড ইয়ারে উঠিতে দিবে না, সারা বছরের কষ্ট ও পরিশ্রম সব ব্যর্থ নিরর্থক হইয়া যাইবে।

কলেজ হইতে বাহির হইয়া আসিয়া সন্ধ্যার সময় সে হাত-খরচের পয়সা হইতে চাউল ও আলু কিনিয়া আনিয়া থাকিবার ঘরের সামনের বারান্দাতে রান্নার জোগাড় করিল। হোটেলে খাওয়া বন্ধ হইবার পর হইতে আজ কয়দিন নিজে রাঁধিয়া খাইতেছে। হিসাব করিয়া দেখিয়াছে ইহাতে খুব সস্তায় হয়, কাঠ কিনিতে হয় না। নিচের কারখানার মিস্ত্রিদের ঘর হইতে কাঠের চেঁচ ও টুকরা কুড়াইয়া আনে, পাচ-ছয় পয়সায় খাওয়া-দাওয়া হয়। আলুভাতে ডিমভাতে আর ভাত। ভাত চড়াইয়া ডাক দিল-ও বহুবহু নিয়ে এসো, আমার হয়ে গেল বলে-ছোট কঁসিটাও এনো

কারখানার দারোয়ান শ্যুদত্ত তেওয়ারীর বৌ একখানা বড়ো পিতলের থালা ও কাসি লইয়া উপরে আসিল—এক লোটা জল ও গোটাকতক কাঁচা লঙ্কাও আনিল।

থালা বাসন নাই বলিয়া সে-ই দুই বেলা থালা আনিয়া দেয়। হাসিমুখে বলিল, মছলিকা তরকারি হম নেহি ছুঁয়ে গা বাবুজি

-কোথায় তোমার মছলি?—ও শুধু আলু–একটু হলুদবাটা এনে দ্যাও না বহু? বোজ বোজ আলুভাতে ভালো লাগে না–

বহুকে ভালো বলিতে হইবে, রোজ উচ্ছিষ্ট থালা নামাইয়া লইয়া যায়, নিজে মাজিয়া লয় হিন্দুস্থানী ব্রাহ্মণ যাহা কখনও করে না—অপু বাধা দিয়াছিল, বহু বলে, তুম তো হামারে লেড়কাকে বরাবর হোগে বাবুজী ইসমে ক্যা হ্যায়?–

দিন কতক পর মায়ের একটা চিঠি আসিল, হঠাৎ পিছলাইয়া পড়িয়া সর্বজয়ার পায়ে বড়ো লাগিয়াছে, পয়সার কষ্ট যাইতেছে। মায়ের অভাবের খবর পাইলে অপু বড়ো ব্যস্ত হইয়া উঠে, মায়ের নানা কাল্পনিক দুঃখের চিন্তায় তাহার মনকে অস্থির করিয়া তোলে, হয়তো আজ পয়সার অভাবে মায়ের খাওয়া হইল না, হয়তো কেহ দেখিতেছে না, মা আজ দু-দিন উপবাস করিয়া আছে, এইসব নানা ভাবনা আসিয়া জোটে, নিজের আলুভাতে ভাতও যেন গলা দিয়া নামিতে চায় না।

এদিকে আর এক গোলমাল-কারখানার ম্যানেজার ইতিপূর্বে তাহাকে বার-দুই ডাকাইয়া বলিয়াছেন উপরে যে ঘরে সে আছে তার সমস্তটাই ঔষধের গুদাম করা হইবে—সে যেন অন্যত্র বাসা দেখিয়া সয়–বলিয়াছেন আজ মাস তিনেক আগে, তাহার পর আর কোনও উচ্চবাচ্য করেন নাই—অপুও থাকিবার স্থানের জন্য কোথায় কি ভাবে কাহার কাছে গিয়া চেষ্টা করিবে বুঝিতে না পারিয়া একরূপ নিশ্চেষ্টই ছিল এবং নিশ্চিন্ত ভাবে দিন যাইতে দেখিয়া ভাবিয়াছিল, ও-কথা হয়তো আর উঠিবে না কিন্তু এইবার যেন সময় পাইয়াই ম্যানেজার বেশি পীড়াপীড়ি আরম্ভ করিলেন।

হাতের পয়সা ফুরাইয়া আসিবার সঙ্গে সঙ্গে অপু এত সাধ করিয়া কেনা শখের আসবাবগুলি বেচিতে আরম্ভ করিল। প্রথমে গেল প্লেটগুলি—তাও কেহই কিনিতে চায় না—অবশেষে চৌদ্দ আনায় এক পুরানো দোকানদারের কাছে বেঁচিয়া দিল। সেই দোকানদারই ফুলদানিটা আট আনায় কিনিল, দু-খানা ছবি দশ আনায়। তবু শেষ পর্যন্ত সে স্যান্ডাের ডাম্বেলটা ও জাপানী পর্দাটা প্রাণপণে আঁকড়াইয়া রহিল।

সে শীঘ্রই আবিষ্কার করিল–ছাতু জিনিসটার অসীম গুণ—সস্তার দিক হইতেও বটে, অল্প খরচে পেট ভরাইবার দিক হইতেও বটে। আগে আগে চৈত্র বৈশাখ মাসে তাহার মা নতুন যবের ছাতু কুটিয়া তাহাদের খাইতে দিতেন—তখন ছাতু ছিল বৎসরের মধ্যে একবার পালা-পাবণে শখ করিয়া খাইবার জিনিস, তাহাই এখন হইয়া পড়িল প্রাণধারণের প্রধান অবলম্বন। আগে একটু-আধটু গুড়ে তাহার ছাতু খাওয়া হইত না, গুড় আরও বেশি করিয়া দিবার জন্য মাকে কত বিরক্ত করিয়াছে, এখন খরচ বাঁচাইবার জন্য শুধু নুন ও তেওয়ারী-বহুর নিকট হইতে কাঁচা লঙ্কা আনাইয়া তাই দিয়া খায়। অভ্যাস নাই, খাইতে ভালো লাগে না।

কিন্তু ছাতু খুব সুস্বাদু না হউক, তাহাও বিনা পয়সায় পাওয়া যায় না। অপু বুঝিতেছিল টানাটানি করিয়া আর বড়জোর দিন দশেক—তারপর কূলকিনারাহীন অজানা মহাসমুদ্র!…তখন কি উপায়?…

সে রোজ সকালে উঠিয়া নিকটবর্তী এক লাইব্রেরিতে গিয়া দৈনিক ইংরেজি বাংলা কাগজে ছেলে-পড়ানোর বিজ্ঞাপন খুঁজিয়া দেখে, গ্যাসপোস্টের গায়েও অনেক সময় এই ধরনের বিজ্ঞাপন মারা থাকে—চলিতে চলিতে গ্যাসপোস্টের বিজ্ঞাপন দেখিয়া বেড়ানো তাহার একটা বাতিক হইয়া দাঁড়াইল। প্রায়ই বাড়ি ভাড়ার বিজ্ঞাপন।আলো ও হাওয়াযুক্ত ভদ্র-পরিবারের থাকিবার উপযোগী দুইখানি কামরা ও রান্নাঘর, ভাড়া নামমাত্র। যদি বা কালেভদ্রে এক-আধটা ছেলে-পড়ানোর বিজ্ঞাপন পাওয়া যায়, তার ঠিকানাটি আগে কেহ ছিড়িয়া দিয়াছে। কাপড় ময়লা হইয়া আসিল বেজায়, সাবানের অভাবে কাচিতে পারিল না। তেওয়ারীর স্ত্রী একদিন সোড়া সাবান দিয়া নিজেদের কাপড় সিদ্ধ করিতে বসিয়াছে, অপু নিজের ময়লা শার্ট ও ধুতিখানা লইয়া গিয়া বলিল, বহু তোমার সাবানের বোল একটু দেবে, আমি এ দুটোয় মাখিয়ে রেখে দিতারপর ওবেলা কলেজ থেকে এসে কলে  জল এলে কেচে নেবো—দেবে?…।

তেওয়ারী-বধু বলিল, দে দিজিয়ে না বাবুজী, হাম্‌ হাঁড়ি মে ডাল দেগা।

অপু ভাবে—আহা, বহু কি ভালো লোক!যদি কখনও পয়সা হয় ওর উপকার করবো–

এক একবার তাহার মনে হয়, যদি কিছু না জোটে, তবে এবার হয়তো কলেজ ছাড়িয়া দিয়া মনসাপোতা ফিরিতে হইবে কিন্তু সেখানেও আর চলিবার কোনও উপায় নাই, তেলি ও কুণ্ডুরা পূজার জন্য অন্যস্থান হইতে পূজারি-বামুন আনাইয়া জায়গা-জমি দিয়া বাস করাইয়াছে। আজ কয়েকদিন হইল মায়ের পত্রে সে-খবর জানিয়াছে, এখন তাহার মাকেও আর তেলিরা সাহায্য করে না, দেখেশোনে না! মায়ের একাই চলে না—তার মধ্যে সে আবার কোথায় গিয়া জুটিবে?—তাহা ছাড়া পড়াশুনা ছাড়া? অসম্ভব!

সে নিজে বেশ বুঝিতে পারে, এই এক বৎসরে তাহার মনের প্রসারতা এত বাড়িয়া গিয়াছে, এমন একটা নতুন ভাবে সে জগৎটাকে, জীবনটাকে দেখিতে আরম্ভ করিয়াছে-যা কিনা দশ বৎসর মনসাপোতা কি দেওয়ানপুরে পড়িয়া হাবুডুবু খাইলেও সম্ভব হইয়া উঠিত না। সে এটুকু বেশ বোঝে, কলেজে পড়িয়া ইহা হয় নাই, কোনও প্রফেসারের বক্তৃতাতেও নাযাহা কিছু হইয়াছে, এই বড়ো আলমারি-ভরা লাইব্রেরিটার জন্য, সে তাহার কাছে কৃতজ্ঞ।

যতক্ষণ সে লাইব্রেরিতে থাকে, ততক্ষণ তাহার খাওয়া-দাওয়ার কথা তত মনে থাকে না। এই সময়টা এক একটা খেয়ালের ঘোরে কাটে। খেয়ালমতো এক একটা বিষয়ে প্রশ্ন জাগে মনে, তাহার উত্তর খুঁজিতে গিয়া বিকারের রোগীর মতো অদম্য পিপাসায় সে সম্বন্ধে যত বই পাওয়া যায় হাতের কাছে—পড়িতে চেষ্টা করে। কখনও খেয়াল-নক্ষত্র জগৎ…কখনও প্রাচীন গ্রীস ও রোমের জীবনযাত্রা প্রণালীর সহিত একটা নিবিড় পরিচয়ের ইচ্ছা—কখনও কীট, কখনও হল্যান্ড রোজের নেপোলিয়ন। কোনো খেয়াল থাকে দুদিন, কোনোটা আবার একমাস! তার কল্পনা সব সময়ই বড়ো একটা কিছুকে আশ্রয় করিয়া পুষ্টিলাভ করিতে চায়—বড়ো ছবি, জাতির উত্থান-পতনের কাহিনী, চাঁদের দেশের পাহাড়শ্রেণী, বর্তমান মহাযুদ্ধ, কোন বড়োলোকের জীবনী।

কারখানার ম্যানেজার আর একদিন তাগিদ দিলেন। খুব সুখের বাসা ছিল না বটে, কিন্তু এখন সে যায় কোথায়? হাতে কিছু না থাকায় সে এবার পর্দাটা একদিন বেচিতে লইয়া গেল। এটা তাহার বড়ো শখের জিনিস ছিল। পর্দাটাতে একটা জাপানী ছবি আঁকা—ফুলে ভরা চেরি গাছ, একটু জলরেখা, মাঝ-জলে বড়ো বড়ো ভিক্টোরিয়া রিজিয়া ফুটিয়া আছে, ওপারে ঢেউখেলানো কাঠের ছাদওয়ালা একটা দেবমন্দির, দূরে ফুজিসানের তুষারাবৃত শিখর একটু একটু নজরে পড়ে। এই ছবিখানার জন্যই সে পর্দাটা কিনিয়াছিল, এইজন্যই এত দিন হাতছাড়া করিতে পারে নাই কিন্তু উপায় কি? সাড়ে তিন টাকা দিয়া কেনা ছিল, বহু দোকান ঘুরিয়া তাহার দাম হইল এক টাকা তিন আনা।

পর্দা বেঁচিয়া অনেকদিন পর সে ভাত রাঁধিবার ব্যবস্থা করিল। ছাতু খাইয়া খাইয়া অরুচি ধরিয়া গিয়াছে, বাজার হইতে এক পয়সার কলমি শাকও কিনিয়া আনিল। মনে পড়িল—সে কলমি শাক ভাজা খাইতে ভালোবাসিত বলিয়া ছেলেবেলায় দিদি যখন-তখন গড়ের পুকুর হইতে কত কলমি তুলিয়া আনিত! দিন সাতেক পর্দা-বেচা পয়সায় চলিল মন্দ নয়, তারপরই যে-কে সেই! আর পর্দা নাই, কিছুই নাই, একেবারে কানাকড়িটা হাতে নাই।

কলেজ যাইতে হইল না-খাইয়া। বৈকালে কলেজ হইতে বাহির হইয়া সত্যই মাথা ঘুরিতে লাগিল, আর সেই মাথা ঝিম্ ঝিম্ করা, পা নড়িতে না চাওয়া। মুশকিল এই যে, ক্লাসে মিথ্যা গর্ব ও বাহাদুরির ফলে সকলেই জানে সে অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে, কাহারও কাছে বলিবার মুখও তো নাই। দু-একজন যাহারা জানে যেমন জানকী—তাহাদের নিজেদের অবস্থাও তথৈবচ।

সারাদিন না খাইয়া সন্ধ্যার সময় বাসায় আসিয়াই শুইয়া পড়িল। রাত আটটার পরে আর না থাকিতে পারিয়া তেওয়ারী-বধুকে গিয়া জিজ্ঞাসা করিল–ছোলা কি অড়হরের ডাল আছে, বহু? আজ আর ক্ষিদে নেই তেমন, রাঁধব না আর, ভিজিয়ে খেতাম।

 

সকালে উঠিয়াই প্রথমে তাহার মনে আসিল যে, আজ সে একেবারে কপর্দকশূন্য। আজও কালকার মতো না খাইয়া কলেজে যাইতে হইবে। কতদিন এভাবে চালাইবে সে? না খাইয়া থাকার কষ্ট ভয়ানককাল লজিকের ঘণ্টার শেষে সেটা সে ভালো করিয়া বুঝিয়াছিল-বিকালের দিকে ক্ষুধাটা পড়িয়া যাওয়াতে তত কষ্ট বোঝা যায় নাই-কিন্তু সেই বেলা দুটোর সময়টা! পেটে ঠিক যেন বোলতার আঁক হুল ফুটাইতেছে—বার দুই  জল খাইবার ঘরে গিয়া গ্লাসকতক জল খাইয়া কাল যন্ত্রণাটা অনেকখানি নিবারণ হইয়াছিল। আজ আবার সেই কষ্ট সম্মুখে!

হাতমুখ ধুইয়া বাহির হইয়া বেলা দশটা পর্যন্ত সে আবার নানা গ্যাসপোস্টের বিজ্ঞাপন দেখিয়া বেড়াইল, তাহার পর বাসায় না ফিরিয়া সোজা কলেজে গেল। অন্য কেহ কিছু লক্ষ না করিলেও অনিল দু-তিনবার জিজ্ঞাসা করিল—আপনার কোনও অসুখবিসুখ হয়েছে? মুখ শুকনো কেন? অপু অন্য কথা পাড়িয়া প্রশ্নটা এড়াইয়া গেল। বই লইয়া আজ সে কলেজে আসে নাই, খালি হাতে কলেজ হইতে বাহির হইয়া রাস্তায় রাস্তায় খানিকটা ঘুরিল। হঠাৎ তাহার মনে হইল, মা আজ দিন-বারো আগে টাকা চাহিয়া পত্র পাঠাইয়াছিলেন—টাকাও দেওয়া হয় নাই, পত্রের জবাঝও না।

কথাটা ভাবিতেই সে অত্যন্ত ব্যাকুল হইয়া পড়িলনা-খাওয়ার কষ্ট সে ভালো বুঝিয়াছে মায়েরও হয়তো বা এতদিন না-খাওয়া শুরু হইয়াছে, কে জানে? তাহা ছাড়া মায়ের স্বভাবও সে ভালো বোঝে, নিজের কষ্টের বেলা মা কাহাকেও বলিবে না বা জানাইবে না, মুখ বুজিয়া সমুদ্র গিলিবে।

অপু অস্থির হইয়া পড়িল। এখন কি করে সে। জ্যাঠাইমাদের বাড়ি গিয়া সব খুলিয়া বলিবে?—গোটাকতক টাকা যদি এখন ধার পাওয়া যায় সেখানে, মাকে তো আপাতত পাঠাইয়া দেওয়া যাইবে এখন। কিন্তু খানিকটা ভাবিয়া দেখিল, সেখানে গিয়া সে টাকার কথা তুলিতেই পারিবে না-জ্যাঠাইমাকে সে মনে মনে ভয় করে। অখিলবাবু? সামান্য মাহিনা পায়, সেখানে গিয়া টাকা চাহিতে বাধে। তাহার এক সহপাঠীর কথা হঠাৎ তাহার মনে পড়িল, খুব বেশি আলাপ নাই, কিন্তু শুনিয়াছে বড়োলোকের ছেলে—একবার যাইয়া দেখিবে কি? ছেলেটির বাড়ি বৌবাজারের একটা গলিতে,  কলকাতার বনেদি ঘর, বড়ো তেতলা বাড়ি, পূজার দালান, সামনে বড়ো বড়ো সেকেলে ধরনের থাম, কার্নিসে একঝাক পায়রার বাসা; বাহিরের ফ্লোরের খোপটা একজন হিন্দুস্থানী ভুজাওয়ালা ভাড়া লইয়া ছাতুর দোকান খুলিয়াছে। একটু পরেই অপুর সহপাঠী ছেলেটি বাহিরে আসিয়া বলিল—কই, কে ডাকছে—ও-তুমি?—রোল টুএল; এক্সকিউজ মি—তোমার নামটা জানি নে ভাই–sorry—এসো, এসো ভেতরে এসো।

খানিকক্ষণ বসিয়া গল্পগুজব হইল। খানিকক্ষণ গল্প করিতে করিতে অপু বুঝিল, এখানে টাকার কথা তোলাটা তাহার পক্ষে কতদূর দুঃসাধ্য ব্যাপার।–অসম্ভব—তাহা কি কখনও হয়? কি বলিয়া টাকা ধার চাহিবে সে এখানে? এই আমাকে এই—গোটাকতক টাকা ধার দিতে পারো কদিনের জন্যে? কথাটা কি বিশ্রী শোনাইবে! ভাবিতেও যেন লজ্জা ও সংকোচে তাহার মুখ ঘামিয়া রাঙা হইয়া উঠিল। ছেলেটি বলিল-বা রে, এখুনি উঠবে কি?-না না, বোসো, চা খাও-দাঁড়াও, আমি আসছি–

ঘিয়ে-ভাজা চিড়ে নিমকি, পেপে-কাটা, সন্দেশ ও চা। অপু ক্ষুধার মুখে লোভীর মতো সেগুলি ব্যগ্রভাবে গোগ্রাসে গিলিল। গরম চা কয়েক চুমুক খাইতে শরীরের ঝিম ঝিম ভাবটা কাটিয়া মনের স্বাভাবিক অবস্থা যেন ফিরিয়া আসিল এবং আসিবার সঙ্গে সঙ্গে এখানে টাকা ধার চাওয়াটা যে কতদূর অসম্ভব সেটাও বুঝিল। বন্ধুর নিকট হইতে বিদায় লইয়া বাহিরে আসিয়া ভাবিল— ভাগ্যিস—হাউ অ্যাস্পার্ড। তা কি কখনও আমি—দুর!

রাত্রিতে শুইয়া ভাবিতে ভাবিতে তাহার মনে পড়িল, আগামীকাল নববর্ষের প্রথম দিন। কাল কলেজের ছুটি আছে। কাল একবার শ্যামবাজারে জ্যাঠাইমাদের বাড়িতে যাইবে, নববর্ষের দিনটা জ্যাঠাইমাকে প্রণাম করিয়া আসাও হইবে—সেটাও একটা কর্তব্য, তাহা ছাড়া–

মনে মনে ভাবিল-কাল গেলে জেঠিমা কি আর না খাইয়ে ছেড়ে দেবে? বছরকারের দিনটা—সেদিন সুরেশদা তো আর বাড়ির মধ্যে বলে নি–বললে কি আর খেতে বলত না? সুরেশদা ওই রকম ভুলো মানুষ–

ভুল কাহার, পরদিন অপুর বুঝিতে দেরি হইল না। সকালে নটার সময় সুরেশদের বাড়ি গিয়া প্রথমে বাহিরে কাহাকেও পাইল না। বলা না, কওয়া না, হুপ করিয়া কি বাড়ির ভিতর ঢুকিয়া যাইবে? কি সমাচার, না নববর্ষের দিন প্রণাম করিতে আসিয়াছি—দুতাটা যে বড়ো দুর্বল! সাত পাঁচ ভাবিতে ভাবিতে সে খানিকক্ষণ পরে বাড়ির মধ্যে ঢুকিয়া পড়িয়া একেবারে জ্যাঠাইমাকে পাইল দরজার সামনের বোয়াকে। প্রণাম করিয়া পায়ের ধুলা লইল, জ্যাঠাইমার মুখে যে বিশেষ প্রীতি বিকশিত হইল না, তাহা অপু ছাড়া যে-কেহ বুঝিতে পারিত। তাহার সংবাদ লইবার জন্য তিনি বিশেষ কোন আগ্রহ প্রকাশ করিলেন না, সে-ই নিজের সংকোচ ঢাকিবার জন্য অতসীদি কবে শ্বশুরবাড়ি গিয়াছে, সুনীল বুঝি কোথায় বাহির হইয়াছে প্রভৃতি ধরনের মামুলী প্রশ্ন করিয়া যাইতে লাগিল।

তারপর জ্যাঠাইমা কোথায় চলিয়া গেলেন, কেহ বাড়ি নাই, সে দালানের একটি বেঞ্চিতে বসিয়া একখানা এল. রায়ের ক্যাটালগ নাড়িয়া চাড়িয়া দেখিবার ভান করিল। বইখানার মধ্যে একখানা বিবাহের প্রীতি-উপহার, হাতে লইয়া বিস্ময়ের সহিত দেখিল—সেখানা সুরেশের বিবাহের! সে দুঃখিতও হইল, আশ্চর্যও হইল, মাত্র মাসখানেক আগে বিবাহ হইয়াছে, সুরেশদা তাহার ঠিকানা জানে, সবই জানে, অথচ কি জ্যাঠাইমা, কি সুরেশদা, কেহই তাহাকে জানায় নাই।

‘ন যযৌ ন তস্থৌ’ অবস্থায় বেলা সাড়ে দশটা পর্যন্ত বসিয়া থাকিয়া সে জ্যাঠাইমার কাছে বিদায় লইয়া চলিয়া আসিল; জ্যাঠাইমা নির্লিপ্ত, অন্যমনস্ক সুরে বলিল—আচ্ছা তা এসো—থাক

থা—আচ্ছা।

ফুটপাতে নামিয়া সে হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচিল। মনে মনে ভাবিল—সুরেশদার বিয়ে হয়ে গিয়েছে ফালুন মাসে, একবার বললেও না!অথচ আমাদের আপনার লোক-আজ দ্যাখো না নববর্ষের দিনটা খেতেও বললে না–

খানিকদুরে আসিতে আসিতে তাহার কেমন হাসিও পাইল। আচ্ছা যদি বলতাম, জেঠিমা আমি এখানে এবেলা খাবো তাহলে—হি-হি-তাহলে কি হতো!

বাসার কাছে পথে সুন্দর-ঠাকুর হোটেলওয়ালার সঙ্গে দেখা। দু-দুবার নাকি সে অপুর বাসায় গিয়াছে, পায় নাই, আজ পয়লা বৈশাখ, হোটেলের নতুন খাতা টাকা দেওয়া চাই-ই। সুন্দর-ঠাকুর চিৎকারের সুরে বলিল—ভাতের তো এক পয়সা দিলে না—আবার লুচি খেলে বাবু নদিন—সাত আনা হিসাবে সাত নং তেষট্টি আনা—তিন টাকা পনেরো আনা—আজ তিন মাস ঘোরাচ্ছো, আজ খাতা মহরতনা দিলে হবেই না বলে দিচ্ছি।

অপুর দোষ-লোভে পড়িয়া সে কোথা হইতে শোধ দিবে না ভাবিয়াই ধারে আট-নয় দিন লুচি খাইয়াছিল। সুন্দর-ঠাকুরের চড়া চড়া কথায় পথে লোক জুটিয়া গেল—পথে দাঁড়াইয়া অপদস্থ হওয়ার ভয়ে সে কোথা হইতে দিবে বিন্দুবিসর্গ না ভাবিয়াই বলিল, বৈকালে নিশ্চয়ই সব শোধ করিয়া দিবে।

বৈকালে একটা বিজ্ঞাপনে দেখিল কোন্ স্কুলে একজন ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করা শিক্ষক দরকার, টাটকা মারিয়া দিয়া গিয়াছে, এখনও কেহ ঘেঁড়ে নাই। খুঁজিয়া তখনই বাহির করিল, মেছুয়াবাজারের একটা গলির মধ্যে কাহাদের ভাড়া বাড়ির বাহিরের ঘরে স্কুল—আপার প্রাইমারি পাঠশালা। জনকতক বৃদ্ধ বসিয়া দাবা খেলিতেছেন, একজন তাহার মধ্যে নাকি স্কুলের হেডমাস্টার। অঙ্কের শিক্ষক-দশ টাকা মাহিনা—ইত্যাদি। বাজার যা তাতে ইহাই যথেষ্ট।

অপর মন বেজায় দমিয়া গেল। এই অন্ধকার স্কুলঘরটা, দারিদ্র্য, এই ত্ৰিকালোত্তীর্ণ বদ্ধগণের মুখের একটা বুদ্ধিহীন সন্তোষের ভাব ও মনের স্থবিরত্ব, ইহাদের সাহচর্য হইতে তাহাকে দূরে হটাইয়া সইতে চাহিল। যাহা জীবনের বিরোধী, আনন্দের বিরোধী, সর্বোপরি–তাহার অস্থিমজ্জাগত যে রোমাঞ্চের তৃষ্ণা—তাহার বিরোধী, অপু সেখানে একদণ্ড তিষ্ঠিতে পারে না। ইহারা বৃদ্ধ বলিয়া যে এমন ভাব হইল অপুর, তাহা নয়, ইহাদের অপেক্ষাও বৃদ্ধ ছিলেন, শৈশবের সঙ্গী নরোত্তম দাস বাবাজী। কিন্তু সেখানে সদাসর্বদা একটা মুক্তির হাওয়া বহিত, কাশীর কথকঠাকুরকেও এইজন্যই ভালো লাগিয়াছিল। অসহায়, দরিদ্র বৃদ্ধ একটা আশাভরা আনন্দের বাণী বহন করিয়া আনিয়াছিলেন তাহার মনে-যেদিন জিনিসপত্র বাঁধিয়া হাসিমুখে নতুন সংসার বাঁধিবার উৎসাহে রাজঘাটের স্টেশনে ট্রেনে চড়িয়া দেশে রওনা হইয়াছিলেন।

স্কুল হইতে যখন সে বাহির হইল, বেলা প্রায় গিয়াছে। তাহার কেমন একটা ভয় হইল-এ ভয়টা এতদিন হয় নাই। না খাইয়া থাকিবার বাস্তবতা ইতিপূর্বে এভাবে কখনও নিজের জীবনে সে অনুভব করে নাই—বিশেষ করিয়া যখন এখানে খাইতে পাওয়া নির্ভর করিতেছে নিজের কিছু একটা খুঁজিয়া বাহির করিবার সাফল্যের উপর। কিন্তু তাহার সকলের চেয়ে দুর্ভাবনা মায়ের জন্য। একটা পয়সা সে মাকে পাঠাইতে পারিল না, আজ এতদিন মা পত্ৰ দিয়াছেন—কি করিয়া চলিতেছে মায়ের!

কিন্তু এখানে তো কোনও কিছুই আশা দেখা যায় না-এত বড়ো  কলিকাতা শহরে পাড়াগাঁয়ের ছেলে, সহায় নাই, চেনাশোনা নাই, সে কোথায় যাইবে—কি করিবে?

পথে একটা মারোয়াড়ির বাড়িতে বোধহয় বিবাহ। সন্ধ্যার তখনও সামান্য বিলম্ব আছে, কিন্তু এরই মধ্যে সামনের লাল-নীল ইলেকট্রিক  আলোর মালা জ্বালাইয়া দিয়াছে, দু-চারখানা মোটর ও জুড়ি গাড়ি আসিতে শুরু করিয়াছে। লুচি-ভাজার মন মাতানো সুগন্ধে বাড়ির সামনেটা ভরপুর। হঠাৎ অপু দাঁড়াইয়া গেল। ভাবিল—যদি গিয়ে বলি আমি একজন পুওর স্টুডেন্ট—সারাদিন খাই নি তবে খেতে দেবে না?–ঠিক দেবে—এত বড়োলোকের বাড়ি, কত লোক তো খাবে বলতে দোষ কি? কে-ই বা চিনবে আমায় এখানে?…।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারিল না। সে বেশ বুঝিল, মনে মোল আনা ইচ্ছা থাকিলেও মুখ দিয়া এ কথা সে বলিতে পারিবে না কাহারও কাছে লজ্জা করিবে। লজ্জা না করিলে সে যাইত। মুখচোরা হওয়ার অসুবিধা সে জীবনে পদে পদে দেখিয়া আসিতেছে।

কলিকাতা ছাড়িয়া মনসাপোতা ফিরিবে? কথাটা সে ভাবিতে পারে না—প্রত্যেক রক্তবিন্দু বিদ্রোহী হইয়া উঠে। তাহার জীবনসন্ধানী মন তাহাকে বলিয়া দেয় এখানে জীবন, আলো, পুষ্টি, প্রসারতা—সেখানে অন্ধকার, দৈন্য, নিভিয়া যাওয়া। কিন্তু উপায় কই তাহার হাতে? সে তো চেষ্টার ত্রুটি করে নাই। সব দিকেই গোলমাল। কলেজের মাহিনা না দিলে, আপাতত পরীক্ষা দিতে দিলেও, বেতন শোধ না করিলে প্রমোশন বন্ধ। থাকিবার স্থানের এই দশা, দু-বেলা ওষুধের কারখানার ম্যানেজার উঠিয়া যাইবার তাগিদ দেয়, আহার তথৈবচ, সুন্দর-ঠাকুরের দেনা, মায়ের কষ্ট—একেই তত সে সংসারানভিজ্ঞ, স্বপ্নদর্শী প্রকৃতির—কিসে কি সুবিধা হয় এমনিই বোঝে না—তাহাতে এই কয় দিনের ব্যাপার তাহাকে একেবারে দিশাহারা করিয়া তুলিয়াছে।

বাসায় আসিয়া ছাদের উপর বসিল। একখানা খারা কুড়াইয়া আনিয়া ভাবিল—আচ্ছা, দেখি দিকি কোন্ পিঠটা পড়ে? পরে নিশ্চিন্দিপুরে বাল্যে দিদির কাছে যেমন শিখিয়াছিল, সেইভাবে চোখ বুজিয়া খারাটা ঘুড়িয়া ফেলিয়া দেখিল—একবার-দুবারকলিকাতা ছাড়িয়া যাওয়ার দিকটাই পড়ে। তৃতীয়বার ফেলিয়া দেখিতে তাহার সাহস হইল না।

বাল্যকাল হইতে নিশ্চিন্দিপুরের বিশালাক্ষী দেবীর উপর তাহার অসীম শ্রদ্ধা। করুণাময়ী দেবীর কথা কত সে শুনিয়াছে, সে তো তার গ্রামের ছেলে-কলিকাতায় কি তার শক্তি খাটে না?

 

পরীক্ষা হইবার দিনকয়েক পরে একদিন অনিল তাহাকে জানাইল সায়েন্স সেকশনের মধ্যে সে গণিত ও বস্তুবিজ্ঞানে প্রথম হইয়াছে, প্রফেসরের বাড়ি গিয়া নম্বর জানিয়া আসিয়াছে। অপু শুনিয়া আন্তরিক সুখী হইল, অনিলকে সে ভারি ভালোবাসে, সত্যিকার চবিত্রবান বুদ্ধিমান ও উদারমতি ছাত্র। অনিলের যে জিনিসটা তাহার ভালো লাগে না, সেটা তাহার অপরকে তীব্রভাবে আক্রমণ ও সমালোচনা করিবার একটা দুর্দমনীয় প্রবৃত্তি। কিন্তু এ পর্যন্ত কোন তুচ্ছ কাজে বা জিনিসে অপু তাহার আসক্তি দেখে নাই-কোনও ছোট কথা, কি সুবিধার কথা, কি বাজে খোশগল্প তাহার মুখে শোনে নাই।

অপু দেখিয়াছে সব সময় অনিলের মনে একটা চাঞ্চল্য, একটা অতৃপ্তি—তাহার অধীরে মন মহাভারতের বকপী ধর্মরাজের মতো সব সময়ই ফাদিয়া বসিয়া আছেকা চ বার্তা?

অপুর সহিত এইজন্যেই অনিলের মিলিয়াছিল ভালো। দুজনের আশা আকাঙক্ষা, প্রবৃত্তি এক ধরনের। অপুর বাংলা ও ইংরেজি লেখা খুব ভালো, কবিতা-প্রবন্ধ, মায় একখানা উপন্যাস পর্যন্ত লিখিয়াছে। দু-তিনখানা বাঁধানো খাতা ভর্তি—লেখা এমন কিছু নয়, গল্পগুলি ছেলেমানুষি ধরনের উচ্ছ্বাসে ভরা, কবিতা-রবি ঠাকুরের নকল, উপন্যাসখানাতে-জলদস্যুর দল, প্রেম, আত্মদান, কিছুই বাদ যায় নাই কিন্তু এইগুলি পড়িয়াই অনিল সম্প্রতি অপুর আরও ভক্ত হইয়া উঠিয়াছে।

সপ্তাহের শেষে দুজনে বোটানিক্যাল গার্ডেনে বেড়াইতে গেল। একটা ঝিলের ধারের ঘন সবুজ লম্বা লম্বা ঘাসের মধ্যে বসিয়া অনিল বন্ধুকে একটা সুসংবাদ দিল। বাগানে আসিয়া গাছের ছায়ায় এইভাবে বসিয়া বলিবে বলিয়াই এতক্ষণ অপেক্ষায় ছিল। তাহার বাবার এক বন্ধু তাহাকে খুব ভালোবাসেন, বড়বনীর অভ্রের খনির তিনি ছিলেন একজন অংশীদার, তিনি গত পরীক্ষার ফলে অনিলের উপর অত্যন্ত সন্তুষ্ট হইয়া নিজের খরচে বিদেশে পাঠাইতে চাহিতেছেন, আই.এসসি.-টা পাস দিলেই সোজা বিলাত বা ফ্রান্স।

কেমব্রিজে কি ইম্পিরিয়াল কলেজ অব  সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে পড়ব, রাদারফোর্ড আছেন, টমসন আছেন—এঁদের সব দুবেলা দেখতে পাওয়া একটা পুণ্য-যুদ্ধ থামলে জার্মানিতে যাব, মস্ত জাত-বিরাট ভাইটালিটি—গয়টে, অস্টওয়ালডের দেশ-ওখানে কি আর না যাব?

অনিল অপুর বিদেশে যাইবার টান জানে-বলিল, আপনাকে নিয়ে যাবার চেষ্টা করব। নাহয় দু-জনে আমেরিকায় চলে যাব–আমি সব ঠিক করব দেখবেন।

অনিলের প্রভাব যেমন অপুর জীবনে বিস্তার লাভ করিতেছিল, সঙ্গে সঙ্গে অপুর চরিত্রের পবিত্রতা, মনের ছেলেমানুষি ও ভাবগ্রাহিতা অনিলের কঠোর সমালোচনা ও অযথা আক্রমণপ্রবৃত্তিকে অনেকটা সংযত করিয়া তুলিতেছিল। দূরের পিপাসা অপুর আরও অনেক বেশি, অনেক উদ্দাম-কলিকাতার ধোঁয়াভরা, সংকীর্ণ, ভ্যাপসা-গন্ধ সিওয়ার্ড ডিচের ভিতর হইতে বাহির হইয়া হঠাৎ যেন একটা উদার প্রান্তর, জ্যোৎস্নামাখা মুক্ত আকাশ, পাখিদের আনন্দভরা পক্ষ-সংগীতের, একটা বন-প্রান্তের রহস্যের সাক্ষাৎ পাওয়া যায় অপুর কথার সুরে, জীবন-পিপাসু নবীন চোখের দৃষ্টিতে, অন্তত অনিলের তো মনে হয়।

কোন্ পথে যাওয়া হইবে সে কথা উঠিল। অপু উৎসাহে অনিলের কাছে ঘেঁষিয়া বলিল–এসো একটা প্যাক্ট করি—দেখি হাত? এসো আমরা কখনো কেরানীগিরি করব না, পয়সা পয়সা করব না কখখনো সামান্য জিনিসে ভুলব না কখনও-ব্যাস?…পরে মাটিতে একটা ঘুষি মারিয়া বলিল-খুব বড় কিছু একটা করব জীবনে।

অনিল সাধারণত অপুর মতো নিজের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হইয়া উঠে না, তবুও আজ উৎসাহের মুখে অনেক কথা বলিয়া ফেলিল, বিলাতে পড়া শেষ করিয়া সে আমেরিকায় যাইবে, জাপান হইয়া দেশে ফিরিবে। বিদেশ হইতে ফিরিয়া সারাজীবন  বৈজ্ঞানিক গবেষণা লইয়াই থাকিবে।

অপু বলিল—যখন দেশে ছিলাম, তখন আমার একখানা ‘প্রাকৃতিক ভূগোল’ বলে ছেঁড়া, পুরোনো বই ছিল—তাতে লেখা ছিল, এমন সব নক্ষত্র আছে, যাদের আলো আজও এসে পৃথিবীতে পেীছয় নি, সে-সব এত দূরে-মনে আছে, সন্ধ্যের সময় একটা নদীতে নৌকা ছেড়ে দিয়ে নৌকার ওপর বসে সে কথা ভাবতাম, ওপারে একটা কদম গাছ ছিল, তার মাথাতে একটা তারা উঠত সকলের আগে, তারাটার দিকে অবাক হয়ে চেয়ে চেয়ে দেখতাম—কি যে একটা ভাব হত মনে! একটা mystery. একটা uplift-এর ভাব—ছেলেমানুষ তখন, সে-সব বুঝতাম না, কিন্তু সেই থেকে যখনই মনে দুঃখ হয়েছে, কি কোনও ছোট কাজে গিয়েছে, তখনই আকাশের নক্ষত্রদের দিকে চাইলেই আবার ছেলেবেলার সেই uplift-এর ভাবটা, একটা joy, বুঝলে? একটা অদ্ভুত transcendental joy–সে ভাই মুখে তোমাকে–

বেলা পড়িলে দু-জনে স্টিমারে কলিকাতায় ফিরিল।

 

পরদিন কলেজের কমনরুমে অনেকক্ষণ আবার সেই কথা।

কলেজ হইতে উৎফুল্ল মনে বাহির হইয়া অনিল প্রথমে দোকানে এক কাপ চা খাইল, পরে ফুটপাতের ধারে দাঁড়াইয়া একটুখানি ভাবিল, কালীঘাটে মাসির বাড়ি যাওয়ার কথা আছে, এখন যাইবে কিনা। একখানা বই কিনিবার জন্য একবার কলেজ স্ট্রীটেও যাওয়া দরকার। কোথায় আগে যায়? অপূর্ব একমাত্র ছেলে, যার কথা তার সব সময় মনে হয়। যে কোনরূপে হউক অপূর্বকে সে নিশ্চয়ই বিদেশ দেখাইবে।

তলপেটে অনেকক্ষণ হইতে একটা কী বেদনা বোধ হইতেছিল, এইবার যেন একটু বাড়িয়াছে, হাঁটিয়া চৌরঙ্গির মোড় পর্যন্ত যাওয়ার ইচ্ছা ছিল, সেটা আর না যাওয়াই ভালো। সম্মুখেই ডালহাউসি স্কোয়ারের ট্রাম, সে ভাবিল—পরেরটাতে যাব, বেজায় ভিড়, ততক্ষণ বরং চিঠিখানা ডাকে ফেলে আসি।

নিকটেই লাল রংয়ের গোল ডাকবাক্স ফুটপাথের ধারে, ডাকবাক্সটার গা ঘেঁষিয়া একজন মুসলমান ফেরিওয়ালা পাকা কাঁচকলা বিক্রি করিতেছে, তাহার বাজরায় পা না লাগে এইজন্য এক পায়ে ভর করিয়া অন্য পা-খানা একটু অস্বাভাবিক রকমে পিছনে বাঁকাভাবে পাতিয়া সে সবে চিঠিখানা ডাকবাক্সের মুখে ছাড়িয়া দিয়াছে—এমন সময় হঠাৎ পিছন হইতে যেন এক তীক্ষ্ণ বর্শা দিয়া তাহার দেহটা এফোঁড়-ওফোঁড় করিয়া দিল, এক নিমেষে, অনিল সেটাতে হাত দিয়া সামলাইতেও যেন অবকাশ পাইল না। হঠাৎ যেন পায়ের তলা হইতে মাটিটা সরিয়া গেল…চোখে অন্ধকাব—কাঁচকলার বাজরার কানাটা মাথায় লাগিতেই মাথাটায় একটা বেদনা—মুসলমানটি কি বলিয়া উঠিল—হৈ হৈ, বহু লোক—কি হয়েছে মশায়?…কি হল মশায়?…সবো সরো-বাতাস করো…বরফ নিয়ে এসো…এই যে আমার রুমাল নিন না…।

অনিলের দুটি মাত্র কথা শুধু মনে ছিল—একবার সে অতিকষ্টে গোঙাইয়া গোঙাইয়া বলিল—রি-রিপন কলেজ-অপুর্ব রায়-রিপন

আর মনে ছিল সামনের একটা সাইন বোর্ড-গণেশচন্দ্র দা এন্ড কোং-কারবাইডের মশলা, তারপরেই সেই তীক্ষ্ণ বর্শাটা পুনরায় কে যেন সজোরে তলপেটে ঢুকাইয়া দিল—সঙ্গে সঙ্গে সব অন্ধকার–

কতক্ষণ পরে সে জানে না, তাহার জ্ঞান হইল। একটা বাক্স বা ঘরের মধ্যে সে শুইয়া আছে, ঘরটা বেজায় দুলিতেছে—পেটে ভয়ানক যন্ত্রণাকাহারা কি বলিতেছে, অনেক মোটরগাড়ির ভেঁপুর শব্দ—আবার ধোঁয়া ধোঁয়া…

পুনরায় যখন অনিলের জ্ঞান হইল, সে চোখ মেলিয়া চাহিয়া দেখিল একটা বড়ো সাদা দেওয়ালের পাশে একখানা খাটে সে শুইয়া আছে। পাশে তাহার বাবা ও ছোটকাকা বসিয়া, আরও তিনজন অপরিচিত লোক। নার্সের পোশাক পরা দু-জন মেম। এটা হাসপাতাল? কোন্ হাসপাতাল? কি হইয়াছে তাহার? তলপেটে যন্ত্রণা তখনও সমান, শরীর ঝিম্ ঝিম্ করিতেছে, সারা দেহ যেন অবশ।

 

পরদিন বেলা দশটার সময় অপু গেল। সেই কাল খবর পাইয়া তখনই ছুটিয়া শিয়ালদহের মোড়ে গিয়াছিল। সঙ্গে ছিল সত্যেন ও চার-পাঁচজন ছেলে। টেলিফোনে অ্যাম্বুলেন্সে গাড়ি আনাইয়া তখনই সকলে মিলিয়া তাহাকে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আনা হয় ও বাড়িতে খবর দেওয়া হয়। ডাক্তার বলেন, হার্নিয়া…স্ক্রাঙ্গুলেটেড হার্নিয়া, তখনই অস্ত্র করা হইয়াছে…

বৈকালেও সে গেল। কেবিন ভাড়া করা হইয়াছে, অনিলের মা বসিয়াছিলেন, অপু গিয়া পায়ের ধুলা লইয়া প্রণাম করিল। অনিল এখন অনেকটা ভালো আছে, অস্ত্র করার পরে বেজায় যন্ত্রণা পাইয়াছিল, সারারাত ও সারাদিন দুপুরের পর সেটা একটু কম। মুখ রক্তশূন্য পাণ্ডুর। সে হাসিয়া অপুর হাত ধরিয়া কাছে বসাইল, বলিল—স্বাস্থ্যের মতন জিনিস আর নেই, যতই বলুন—এই তিনটে দিন যেন একেবারে মুছে গিয়েছে জীবন থেকে।

অপু বলিল—বেশি কথা বোলো না, যন্ত্রণা কেমন এখন?

অনিলের মা বলিলেন, তোমার কথা সব শুনেছি, ভাগ্যিস তুমি ছিলে বাবা সেদিন!

অনিল বলিল,-দেখবেন মজা, ঘণ্টা নাড়লেই নার্স এখুনি ছুটে আসবে—বাজাবো দেখবেন?—সে হাসিয়া একটা হাত-ঘণ্টা বাজাইতেই লম্বা একজন নার্স আসিয়া হাজিব। সে চলিয়া গেলে অনিলের মা বলিলেন—কি যে করিস মিছিমিছি? ছিঃ–

দুজনেই খুব হাসিতে লাগিল।

খানিকক্ষণ গড়ের মাঠের দিকে বেড়াইয়া সন্ধ্যার পর বাসায় ফিরিয়া অপু সবে আলোটি জ্বালিয়াছে, এমন সময় সত্যেন ও অনিলের পিসতুতো ভাই ফণী—অপু তাহাকে হাসপাতালে প্রথম দেখিয়াছে, সেখানেই প্রথম আলাপ—ব্যস্তসমস্ত অবস্থায় ঘরে ঢুকিল। সত্যেন বলিল—ও, তোমাকে দু-বার এর আগে খুঁজে গেছি—এখুনি হাসপাতালে এসো—জানো না?…

অপু জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে উহাদের মুখের দিকে চাহিতেই ফণী বলিল—অনিল মাবা গিয়েছে এই সাড়ে ছয়টার সময় হঠাৎ।

সকলে ছুটিতে ছুটিতে হাসপাতালে গেল। অনিলের মৃতদেহ খাট হইতে নামাইয়া সাদা চাদর দিয়া ঢাকিয়া মেজেতে রাখিয়াছে। বহু আত্মীয়স্বজনে কেবিন ভবিয়া গিয়াছে, ক্লাসের অনেক ছেলে উপস্থিত, একদল ছেলে এইমাত্র এসেন্স ও ফুলের তোড়া লইয়া কেবিনে ঢুকিল। অল্প পরেই মৃতদেহ নিমতলায় লইয়া যাওয়া হইল।

সব কাজ শেষ হইতে বাত্রি তিনটা বাজিয়া গেল।

অন্য সকলে গঙ্গাস্নান করিতে লাগিল। অপু বলিল, তোমরা নাও, আমি গঙ্গায় নাইবো না, কলের  জলে সকালবেলা নাইবো। কলকাতাব গঙ্গায় নাইতে আমার মন যায় না।

অনিলের বাবার মতো লোক সে কখনও দেখে নাই। এত বিপদেও তিনি সারারাত বাঁধানো চাতালে বসিয়া ধীবভাবে কাঠের নল বসানো সটকাতে তামাক টানিতেছেন! অপুকে বার-দুই জিজ্ঞাসা করিয়াছেন—বাবা তোমার ঘুম লাগে নি তো?…কোন কষ্ট হয় তো বলল বাবা।

অপু শুনিয়া চোখের  জল রাখিতে পারে নাই।

সুনীল সিগারেট কেসটা তাহার জিম্মায় রাখিয়া জলে নামিলে সে ঘাটের ধাপের উপর বসিয়া রহিল। অন্ধকার আকাশে অসংখ্য জ্বলজ্বলে নক্ষত্র, রাত্রিশেষের আকাশে উজ্জ্বল সপ্তর্ষিমণ্ডল ওপারে জেসপ কোম্পানির কারখানার মাথায় ঝুঁকিয়া পড়িতেছে, পূর্ব-আকাশে চিত্রা প্রত্যাসন্ন দিবালোকের মুখে মিলাইয়া যাইতেছে। অপু মনের মধ্যে কোনও শোক কি দুঃখের ভাব খুঁজিয়া পাইল না—কিন্তু মাত্র তিনদিন আগে কোম্পানির বাগানে বসিয়া যেমন অনিলের সঙ্গে গল্প করিয়াছিল, সারা আকাশের অসংখ্য নক্ষত্ররাজির দিকে চাহিয়া বাল্যে নদীর ধারে বসিয়া সন্ধ্যার প্রথম নক্ষত্রটি দেখিবার দিনগুলির মতো এক অপূর্ব, অবর্ণনীয় রহস্যের ভাবে তাহার মন পরিপূর্ণ হইয়া গেল কেমন মনে হইতে লাগিল, কি একটা অসীম রহস্য ও বিপুলতার আবেগে নির্বাক নক্ষত্রজগৎটা যেন মুহূর্তে মুহূর্তে স্পন্দিত হইতেছে।

 

অনিলের মৃত্যুর পর অপু বড়ো মুষড়াইয়া পড়িল। কেমন এক ধরনের অবসাদ শরীরে ও মনে আশ্রয় করিয়াছে, কোন কাজে উৎসাহ আসে না, হাত-পা উঠে না।

বৈকালে ঘুরিতে ঘুরিতে সে কলেজ স্কোয়ারের একখানা বেঞ্চির উপর বসিল। এতদিন তো এখানে রহিল, কিছুই স্থির হইল না, এভাবে আর কতদিন চলে? ভাবিল, না হয় অ্যাম্বুলেন্সে যেতাম, কলেজের অনেকে তো যাচ্ছে, কিন্তু মা কি তা যেতে দেবে?

পরে ভাবিল—বাড়ি চলে যাই, মাসখানেক অর্ডারলি রিট্রিট করা যাক।

পাশে একজন দাড়িওয়ালা ভদ্রলোক অনেকক্ষণ হইতে বসিয়া ছিলেন। মধ্যবয়সি লোক, চোখে চশমা, হাতের শিরগুলি দড়ির মতো মোটা। তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, সাঁতারের ম্যাচ কবে হবে জানেন?

অপু জানে না, বলিতে পারিল না। ক্রমে দু-চার কথায় আলাপ জমিল। সাঁতারেরই গল্প। কথায় কথায় প্রকাশ পাইল—তিনি ইউরোপ ও আমেরিকার বহুস্থান ঘুরিয়াছেন। অপু কৌতূহল দমন করিতে না পারিয়া তাহার নাম জিজ্ঞাসা করিল।

ভদ্রলোক বলিলেন,-আমার নাম সুরেন্দ্রনাথ বসু মল্লিক–

অনেকদিনের একটা কথা অপুর মনে পড়িয়া গেল, সে সোজা হইয়া তাঁহার মুখের দিকে চাহিল। কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল—আমি আপনাকে চিনি, আপনি অনেকদিন আগে বঙ্গবাসীতে বিলাত-যাত্রীর চিঠি লিখতেন।

—হ্যাঁ হ্যাঁ—ঠিক, সে দশ এগাবো বছর আগেকার কথা—তুমি কি করে জানলে? পড়তে নাকি?

-ওঃ, শুধু পড়তাম না, হাঁ করে বসে থাকতাম কাগজখানার জন্যে—তখন আমার বয়েস বছর দশ। পাড়াগাঁয়ে থাকতাম—কি inspiration যে পেতাম আপনার লেখা থেকে!…

ভদ্রলোকটি ভারি খুশি হইলেন। সে কি করে, কোথায় থাকে জিজ্ঞাসাবাদ করিলেন। বলিলেন,–দ্যাখো কোথায় বসে কে লেখে আর কোথায় গিয়ে তার বীজ উড়ে পড়ে—বিলেতে হ্যাম্পস্টেডের একটা বোর্ডিং-এ বসে লিখতাম, আর বাংলায় এক obscure পাড়াগাঁয়ের এক ছোট ছেলে আমার লেখা পড়ে—বাঃ বাঃ–

ভদ্রলোকটির ব্যবসাবাণিজ্যে খুব উৎসাহ দেখা গেল। মাদ্রাজে সমুদ্রের ধারে জমি লইয়াছেন, নারিকেল ও ভ্যানিলার চাষ করিবেন। নিঃসম্বল তেরো বৎসরের নিগ্রো বালককে ইউরোপে আসিয়া নিজের উপার্জন নিজে করিতে দেখিয়াছেন, দেশের যুবকদের চাষবাস করিতে উপদেশ দেন।

ভদ্রলোকটিকে আর অপুর অপরিচিত মনে হইল না। তাহার বাল্যজীবনের কতকগুলি অবর্ণনীয়, আনন্দ-মুহূর্তের জন্য এই প্রৌঢ় ব্যক্তিটি দায়ী, ইহারই লেখার ভিতর দিয়া বাহিরের জগতের সঙ্গে সেই আনন্দভরা প্রথম পরিচয়

সম্পূর্ণ নতুন ধরনের উৎসাহ লইয়া সে ফিরিল। কে জানিত বঙ্গবাসীর সে লেখকের সঙ্গে এভাবে দেখা হইয়া যাইবে।…শুধু বাঁচিয়া থাকাই এক সম্পদ, তোমার বিনা চেষ্টাতেই এই অমৃতময়ী জীবনধারা প্রতি পলের রসপাত্র, পূর্ণ করিয়া তোমার অন্যমনস্ক, অসতর্ক মনে অমৃত পরিবেশন করিবে…সে যে করিয়া হউক বাঁচিবে।

 

সন্ধ্যা ঠিক হয় নাই, উঠানে তেলি-বাড়ির বড়ো-বৌ দাঁড়াইয়া কি গল্প করিতেছিল, দুর হইতে অপুকে আসিতে দেখিয়া হাসিমুখে বলিল—কে আসছে বলুন তো মা-ঠাকুন?—সর্বজয়ার বুকের ভিতরটা কেমন করিয়া উঠিল, অপু নয় তো—অসম্ভব—সে এখন কেন

পরক্ষণেই সে ছুটিয়া আসিয়া অপুকে বুকের ভিতর জড়াইয়া ধরিল। সর্বজয়ার চোখের  জলে তাহার জামার হাতটা ভিজিয়া উঠিল। মাকে যেন এবার নিজের অপেক্ষা মাথায় ছোট, দুর্বল ও অসহায় বলিয়া অপুর মনে হইতে লাগিল। তপঃকৃশ শবরীর মতো ক্ষীণাঙ্গী, আলুথালু, অধরুক্ষ চুলের গোছা একদিকে পড়িয়াছে, মুখের চেহারা এখনও সুন্দর, গ্রীবা ও কপালের রেখাবলী এখনও অনেকাংশে ঋজু ও সুকুমার। তবে এবার মায়ের চুল পাকিয়াছে, কানের পাশের চুলে পাক ধরিয়াছে। নিজের সবল দৃঢ় বাহুবেষ্টনে, সরলা, চিরদুঃখিনী মাকে সংসারের সহস্র দুঃখ-বিপদ হইতে বাঁচাইয়া রাখিতে অপুর ইচ্ছা যায়। এ ভাবটা এইবার প্রথম সে মনের মধ্যে অনুভব করিল, ইতিপূর্বে কখনও হয় নাই।

বড়ো-বৌ একপাশে হাসিমুখে দাঁড়াইয়াছিল, সে অপুকে ছোট দেখিয়াছে, এখন আর তাহাকে দেখিয়া ঘোমটা দেয় না। সর্বজয়া বলিল,-এবার ও এসেছে বৌমা, এবার কালই কিন্তু

অপু নিকটে গিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কি খুড়িমা, কাল কি?

বড়ো-বৌ হাসিয়া বলিল,-দেখো কাল,—আজ বলব না তো!

খিচুড়ি খাইতে ভালোবাসে বলিয়া সর্বজয়া অপুকে রাত্রে খিচুড়ি রাঁধিয়া দিল; পেট ভবিয়া খাওয়া ঘটিল, এই সাত-আটদিন পর আজ মায়ের কাছে। সর্বজয়া জিজ্ঞাসা করিল,হ্যাঁ রে, সেখানে খিচুড়ি খেতে পাস?

অপুর শৈশবে তাহার মা শত প্রতারণার আবরণে নগ্ন দারিদ্র্যের নিষ্ঠুর রূপকে তাহাদের শিশুচক্ষুর আড়াল করিয়া রাখিতেন, এখন আবার অপুর পালা। সে বলিল,-, বাদলা হলেই খিচুড়ি হয়।

–কি ডালের করে?

–মুগের বেশি, মসুরীরও করে, খাঁড়ি মসুরী।

—সকালে জলখাবার খেতে দেয় কি কি?

অপু প্রাতঃকালীন জলযোগের এক কাল্পনিক বিবরণ খুব উৎসাহের সহিত বিবৃত করিয়া গেল। মোহনভোগ, চা, এক-একদিন লুচিও দেয়। খাওয়ার বেশ সুবিধা!

প্রীতির টুইশানি কোনকালে চলিয়া গিয়াছে, কিন্তু অপু সে কথা মাকে জানায় নাই; সর্বজয়া বলিল—হাঁ রে, তুই যে সে মেয়েটিকে পড়াস—তাকে কি বলে ডাকিস? খুব বড়োলোকের মেয়ে, না?

—তার নাম ধরেই ডাকি—

–দেখতে-শুনতে বেশ ভালো?

–বেশ দেখতে—

–হ্যাঁ রে, তোর সঙ্গে বিয়ে দেয় না? বেশ হয় তা হলে–

অপু লজ্জার মুখে বলিল,-হা–তারা হল বড়োলোক আমার সঙ্গে—তা কি কখনও তোমার যেমন কথা!

সর্বজয়ার কিন্তু মনে মনে বিশ্বাস অপুর মতো ছেলে পাইলে লোকে এখনি লুফিয়া লইবে। অপু ভাবে, তবুও তো মা আসল কথা কিছুই জানে না। প্রীতির টুইশানি থাকিলে কি আর না খাইয়া দিন যায়  কলিকাতায়?

অপু দেখিল-সে যে টাকা পাঠায় নাই, মা একটিবারও সে-কথা উত্থাপন করিল মা, শুধুই তাহার কলিকাতার অবস্থানের সুবিধা-অসুবিধা সংক্রান্ত নানা আগ্রহ-ভরা প্রশ্ন। নিজেকে এমনভাবে সর্বপ্রকারে মুছিয়া বিলোপ করিতে তাহার মায়ের মতো সে আর কাহাকেও এ পর্যন্ত দেখে নাই। সে জানিত বাড়ি গেলে এ লইয়া মা কোন কথা তুলিবে না।

সর্বজয়া একটা এনামেলের বাটি ও গ্লাস ঘরের ভিতর হইতে আনিয়া হাসিমুখে বলিল,—এই দ্যাখ, এই দু-খানা ছেঁড়া কাপড় বদলে তোর জন্যে নিইচিবেশ ভালো, না?…কত বড়ো বাটিটা দ্যাখ।

অপু ভাবিল, মা যা দ্যাখে তাই বলে ভালো, এ আর কি ভালো, যদি আমার সেই পুরানোদোকানে কেনা প্লেটগুলো মা দেখত।

কলিকাতায় সে দুরুহ জীবনসংগ্রামের পর এখানে বেশ আনন্দে ও নির্ভাবনায় দিন কাটে। রাত্রে মায়ের কাছে শুইয়া সে আবার নিজেকে ছেলেমানুষের মতো মনে করে বলে, সেই গানটা কি মা, ছেলেবেলায় তুমি আর আমি শুয়ে শুয়ে রাত্রে গাইতাম—এক-একদিন দিদিও—সেই চিরদিন কখনও সমান না যায়-কভু বনে বনে রাখালেরি সনে, কভু বা রাজত্ব পায়

পরে আবদারের সুরে বলে–গাও না মা, গানটা?

সর্বজয়া হাসিয়া বলে–হ্যাঁ, এখন কি আর গলা আছে—দূর–

–এসো দু-জনে গাই—এসো না মা-খুব হবে, এসো–

সর্বজয়ার মনে আছে—অপু যখন ছোট ছিল তখন কোনও কোনও মেয়ে-মজলিশে, ঘোট ছোট ছেলেমেয়েদের গান হয়তো হইত, অপুর গলা ছিল খুব মিষ্ট, কিন্তু তাহাকে প্রথমে কিছুতেই গান গাওয়ানো যাইত না—অথচ যেদিন তাহার গাহিবার ইচ্ছা হইত, সেদিন মায়ের কাছে চুপি চুপি বার বার বলিত, আমি কিন্তু আজ গান গাইবো না, গাইতে বোলো না। অর্থাৎ সেদিন তাকে এক-আধবার বলিলেই সে গাহিবে। সর্বজয়া ছেলের মন বুঝিয়া অমনি বলিত—তা অপু এবার কেন একটা গান কর না?…দু-একবার লাজুক মুখে অস্বীকার করার পর অমনি অপু গান শুরু করিয়া দিত।

সে অপু এখন একজন মানুষের মতন মানুষ। এত রূপ এ অঞ্চলের মধ্যে কে কবে দেখিয়াছে? একহারা চেহারা বটে, কিন্তু সবল, দীর্ঘ, শক্ত হাত-পা। কি মাথার চুল, কি ডাগর চোখের নিষ্পাপ পবিত্র দৃষ্টি; রাঙা ঠোঁটের দু-পাশে বাল্যের সে সুকুমার ভঙ্গি এখনও বিলুপ্ত হয় নাই, শুধু সর্বজয়াই তাহা ধরিতে পারে।

অপু কিন্তু সে ছেলেবেলার অপু আর নাই। প্রায় সবই বদলাইয়া গিয়াছে, সে অপূর্ব হাসি, সে ছেলেমানুষি, সে কথায় কথায় মান অভিমান, আবদার, গলার সে রিনরিনে মিষ্টি সুর—এখনও অপুর স্বর খুবই মিষ্টি—তবুও সে অপরূপ বাল্যস্বর, সে চাঞ্চল্য—পাগলামি—সে সবের কিছুই নাই। সব ছেলেই বাল্যে সমান ছেলেমানুষ থাকে না কিন্তু অপু ছিল মূর্তিমান শৈশব। সরলতায়, দুষ্টামিতে, রূপে, ভাবুকতায়—দেবশিশুর মতো! এক ছেলে ছিল তাই কি, শত ছেলেতে কি হয়? সর্বজয়া মনে মনে বলে-বেশি চাই নে, দশটা পাঁচটা চাই নে ঠাকুর, ওকেই আর জন্মে আবার কোলজোড়া করে দিয়ো।

সর্বজয়ার জীবনের পাত্র পরিপূর্ণ করিয়া অপু যে অমৃত শৈশবে পরিবেশন করিয়াছে, তারই স্মৃতি তার দুঃখভরা জীবন-পথের পাথেয়। আর কিছুই সে চায় না।

কোনও কোনও দিন রাত্রে অপু মায়ের কাছে গল্প শুনিতে চায়। সর্বজয়া বলে—তুই তো কত ইংরেজি বই পড়িস, কত কি—তুই একটা গল্প বল না বরং শুনি। অপু গল্প করে। দু-জনে নানা পরামর্শ করে; সর্বজয়া পুত্রের বিবাহ দিবার ইচ্ছা প্রকাশ করে। কাটাদহের সান্ডাল বাড়ি নাকি ভালো মেয়ে আছে সে শুনিয়াছে, অপু পাশটা দিলেই এইবার…।

তারপর অপু বলিল,ভালো কথা মা—আজকাল জেঠিমারা  কলকাতায় বাড়ি পেয়েছে যে! সেদিন তাদের বাড়ি গেছলাম–

সর্বজয়া বলে,-তাই নাকি?…তোকে খুব যত্নটত্ন করলে?—কি খেতে দিলে—

অপু নানা কথা সাজাইয়া বানাইয়া বলে। সর্বজয়া বলে,—আমায় একবার নিয়ে যাবি–কলকাতা কখনও দেখি নি, বটঠাকুরদের বাড়ি দুদিন থেকে মা-কালীর চরণ দর্শন করে আসি তা হলে?…

অপু বলে,—বেশ তো মা, নিয়ে যাব, যেয়ো সেই পুজোর সময়।

সর্বজয়া বলে,—একটা সাধ আছে অপু, বঠাকুরদের দরুন নিশ্চিন্দিপুরের বাগানখানা তুই মানুষ হয়ে যদি নিতে পারতিস ভুবন মুখুজ্যেদের কাছ থেকে, তবে

সামান্য সাধ, সামান্য আশা। কিন্তু যার সাধ, যার আশা, তার কাছে তা হোটও নয়, সামান্যও নয়। মায়ের ব্যথা কোন্‌খানে অপুর তাহা বুঝিতে দেরি হয় না। মায়ের অত্যন্ত ইচ্ছা নিশ্চিন্দিপুরে গিয়া বাস করা, সে অপু জানে। সর্বজয়া বলে,—তুই মানুষ হলে, তোর একটা ভালো চাকরি হলে, তোর বৌ নিয়ে তখন আবার নিশ্চিন্দিপুরে গিয়ে ভিটেতে কোঠা উঠিয়ে বাস করব। বাগানখানা কিন্তু যদি নিতে পারিস—বড়ো ইচ্ছে হয়।

অপুর কিন্তু একটা কথা মনে হইল, মা আর বেশিদিন বাঁচিবে না। মায়ের চেহারা অত্যন্ত রোগা হইয়া গিয়াছে এবার, কেবলই অসুখে ভুগিতেছে। মুখে যত সান্ত্বনা দেওয়া, যত আশার কথা বলাসব বলে। জানালার ধারে তক্তপোশে দুপুরের পর মা একটু ঘুমাইয়া পড়ে, অনেক বেলা পড়িয়া যায়। অপু কাছে আসিয়া বসে, গায়ে হাত দিয়া বলে,—গা যে তোমার বেশ গরম, দেখি?

সর্বজয়া সেসব কথা উড়াইয়া দেয়। এ-গল্প ও-গল্প করে। বলে,-হা, অতসীর মা আমার কথাটথা কিছু বলে?

অপু মনে মনে ভাবে—মা আর বাঁচবে না—বেশি দিন। কেমন যেন-কেমন-কি করে থাকব মা মারা গেলে?

অনেক বেলা পড়িয়া যায়–

জানালার পাশেই একটা আতা গাছ। আতা ফুলের মিষ্টি ভুরভুবে গন্ধ বৈকালের বাতাসে। একটু পোড়ড়া জমি। এক ঢিবি সুরকি। একটা চারা জামরুল গাছ। পুরোনো বাড়ির দেওয়ালের ধারে ধারে বনমূলার গাছ। কন্টিকারির ঝাড়। একটা জায়গায় কঞ্চি দিয়া ঘিরিয়া সর্বজয়া শাকের ক্ষেত করিয়াছে।

একটা অদ্ভুত ধরনের মনের ভাব হয় অপুর। কেমন এক ধরনের গভীর বিষাদ…মায়ের এই সব ছোটখাটো আশা, তুচ্ছ সাধ—কত নিষ্ফল।…মা কি ওই শাকের ক্ষেতের শাক খাইতে পারিবে?কালীঘাটের কালীদর্শন করিবে জ্যাঠাইমার বাসায় থাকিয়া!…নিশ্চিন্দিপুরের আমবাগান…

এক ধরনের নির্জনতা-সঙ্গীহীনতার ভাব…মায়ের উপর গভীর করুণা …রাঙা রোদ মিলাইতেছে চারা জামরুল গাছটাতে…সন্ধ্যা ঘনাইতেছে। ছাতারে ও শালিক পাখির দল কিচমিচ ও ঝটাপটি করিতেছে।…।

অপুর চোখে  জল আসিল…কি অদ্ভুত নির্জনতা-মাখানো সন্ধ্যাটা! মুখে হাসিয়া সস্নেহে মায়ের গায়ে হাত বুলাইতে বুলাইতে বলিল,—আচ্ছা, মা, বড়ো বৌয়ের সঙ্গে বাজি রেখেছিলে কি নিয়ে বলল না-বললে না তো সেদিন?…

 

ছুটি ফুরাইলে অপু বাড়ি হইতে রওনা হইল।

স্টেশনে আসিয়া কিন্তু ট্রেন পাইল না, গহনার নৌকা আসিতে অত্যন্ত দেরি হইয়াছে, ট্রেন আধ ঘণ্টা পূর্বে ছাড়িয়া গিয়াছে।

সর্বজয়া ছেলের বাড়ি হইতে যাইবার দিনটাতে অন্যমনস্ক থাকিবার জন্য কাপড়, বালিশের ওয়াড় সাজিমাটি দিয়া সিদ্ধ করিয়া বাঁশবনের ডোবার জলে কাচিতে নামিয়াছে—সন্ধ্যার কিছু পূর্বে অপু বাড়ির দাওয়ায় জিনিসপত্র নামাইয়া ছুটিয়া ডোবার ধারে গিয়া পিছন হইতে ডাকিল,-মা!…

সর্বজয়া ভুলিয়া থাকিবার জন্য দুপুর হইতে কাপড় সিদ্ধ লইয়া ব্যস্ত আছে, চমকিয়া পিছন দিকে চাহিয়া আনন্দ-মিশ্রিত সুরে বলে,—তুই!-যাওয়া হল না?

অপু হাসিমুখে বলিল,-গাড়ি পাওয়া গেল না—এসো বাড়ি–

বাঁশবনের ছায়ায় মায়ের মুখে সেদিন যে অপূর্ব আনন্দের ও তৃপ্তির ছাপ পড়িয়াছিল, অপু পূর্বে কোনও দিন তাহা দেখে নাই-বহুকাল পর্যন্ত মায়ের এ মুখখানা তাহার মনে ছিল। সেদিন রাত্রে দু-জনে নানা কথা! অপু আবার ছেলেবেলাকার গল্প শুনিতে চায় মার মুখে—সর্বজয়া লজ্জিত সুরে বলে-হ্যাঁ, আমার আবার গল্প!…সেসব ছেলেবয়সের গল্প-বুঝি এখন শুনে তোর ভালো লাগবে? অপুকে আর সর্বজয়া বুঝিতে পারে না—এ সে ছোট্ট অপু নয়, সে ঠোঁট ফুলাইলেই সর্বজয়া বুঝিত ছেলে কি চাহিতেছে…এ কলেজের ছেলে, তরুণ অপু, এর মন, মতিগতি, আশা আকাঙক্ষা—সর্বজয়ার অভিজ্ঞতার বাহিরে অপু বলেনা মা, তুমি সেই ছেলেবেলার শ্যামলঙ্কার গল্পটা করো। সর্বজয়া বলে,—তা আবার কি শুনবি—তুই বরং তোর বইয়ের একটা গল্প বল্ক ত ভালো গল্প তো পড়িস?…

 

পরদিন সে  কলিকাতায় ফিরিল।

কলেজ সেই দিনই প্রথম খুলিয়াছে, প্রমোশন পাওয়া ছেলেদের তালিকা বাহির হইয়াছে, নোটিশ বোর্ডের কাছে রথযাত্রার ভিড়—সে অধীর আগ্রহে ভিড় ঠেলিয়া নিজের নামটা আছে কিনা দেখিতে গেল।

আছে। দু-তিনবার বেশ ভালো করিয়া দেখিল। আরও আশ্চর্য এই যে, পাশেই যে সব ছেলে পাশ করিয়াছে অথচ বেতন বাকি তাহার দরুন প্রমোশন পায় নাই, তাহাদের একটা তালিকা দেওয়া হইয়াছে, কিন্তু তাহার মধ্যে অপুর নাম নাই, অথচ অপু জানে তাহারই সর্বাপেক্ষা বেশি বেতন বাকি।

সে ব্যাপারটা বুঝিতে না পারিয়া ভিড়ের বাহিরে আসিল। কেমন করিয়া এরূপ অসম্ভব সম্ভব হইল, নানাদিক হইতে বুঝিবার চেষ্টা করিয়াও তকন কিছু ঠাহর করিতে পারিল না।

দু-তিনদিন পরে তাহার এক সহপাঠী নিজের প্রমোশন বন্ধ হওয়ার কারণ জানিতে অফিসঘরে কেরানীর কাছে গেল, সে-ও গেল সঙ্গে। হেড ক্লার্ক বলিল—এ কি ছেলের হাতের মোয়া হে ছোকরা! কত রোল?…পরে একখানা বাঁধানো খাতা খুলিয়া আঙুল দিয়া দেখাইয়া বলিল—এই দ্যাখো রোল টেনলাল কালির মার্কা মারা রয়েছে—দু-মাসের মাইনে বাকি-মাইনে শোধ না দিলে প্রমোশন দেওয়া হবে না, প্রিন্সিপালের কাছে যাও, আমি আর কি করবো?

অপু তাড়াতাড়ি ঝুঁকিয়া পড়িয়া দেখিতে গেল—তাহার রোল নম্বর কুড়ি—একই পাতায়। দেখিল অনেক ছেলের নামের সঙ্গে সঙ্গে কালিতে ডি লেখা আছে অর্থাৎ ডিফল্টার—মাহিনা দেয় নাই। সঙ্গে সঙ্গে নামের উলটাদিকে মন্তব্যের ঘরে কোন্ কোন্ মাসের মাহিনা বাকি তাহা লেখা আছে। কিন্তু তাহার নামটাতে কোন কিছু দাগ বা আঁচড় নাই—একেবারে পরিষ্কার মুক্তার মতো হাতের লেখা জুলজুল করিতেছে—রায় অপূর্বকুমার-লাল কালির একটা বিন্দু পর্যন্ত নাই…

ঘটনা হয়তো খুব সামান্য, কিছুই না-হয়তো একটা সম্পূর্ণ কমের ভুল, না হয় কেরানীর হিসাবের ভুল, কিন্তু অপুর মনে ঘটনাটা গভীর রেখাপাত করিল।

মনে আছে—অনেকদিন আগে ছেলেবেলায় তাহার দিদি যেবার মারা গিয়াছিল, সেবার শীতের দিনে বৈকালে নদীর ধারে বসিয়া ভাবিত, দিদি কি নরকে গিয়াছে? সেখানকার বর্ণনা সে মহাভারতে পড়িয়াছিল, ঘোর অন্ধকার নরকে শত শত বিকটাকার পাখি ও তাহাদের চেয়েও বিকটাকার যমদুতের হাতে পড়িয়া তাহার দিদির কি অবস্থা হইতেছে! কথাটা মনে আসিতেই বুকের কাছটায় কি একটা আটকাইয়া যেন গলা বন্ধ হইয়া আসিত—চোখের  জলে কাশবন শিমুলগাছ ঝাপসা হইয়া আসিত, কি জানি কেন, সে তাহার হাস্যমুখী দিদির সঙ্গে মহাভারতেক্ত নরকের পারিপার্শ্বিক অবস্থার যেন কোন মতেই খাপ খাইয়াইতে পারিত না। তাহার মন বলিত, নানাদিদি সেখানে নাই—সে জায়গা দিদির জন্য নয়।

তারপর ওপারে কাশবনে ম্লান সন্ধ্যার রাঙা আলো যেন অপূর্ব রহস্য মাখানো মনে হইত–আপনা-আপনি তাহার শিশুমন কোন্ অদৃশ্য শক্তির নিকট হাতজোড় করিয়া প্রার্থনা করিত-আমার দিদিকে তোমরা কোন কষ্ট দিয়ো না-সে অনেক কষ্ট পেয়ে গেছে তোমাদের পায়ে পড়ি, তাকে কিছু বোলো না

ছেলেবেলার সে সহজ নির্ভরতার ভাব সে এখনও হারায় নাই। এই সেদিনও কলিকাতায় পড়িতে আসিবার সময়ও তাহার মনে হইয়াছিল—যাই না, আমি তো একটা ভালো কাজে যাচ্ছি কত লোক তো কত চায়, আমি বিদ্যে চাইছি-আমায় এর উপায় ভগবান ঠিক করে দেবেন। তাহার এ নির্ভরতা আরও দৃঢ় ভিত্তির উপর দাঁড় করাইয়াছিলেন দেওয়ানপুরের হেডমাস্টার মিঃ দত্ত। তিনি ছিলেন—ভক্ত ও বিশ্বাসী খ্রিস্টান। তিনি তাহাকে যে-সব কথা বলিতেন অন্য কোনও ছেলের সঙ্গে সে ভাবের কথা বলিতেন না। শুধু গ্রামার অ্যালজেব্রা নয়—কত উপদেশের কথা, গভীর বিশ্বাসেব কথা, ঈশ্বর, পরলোক, অন্তরতম অন্তরের নানা গোপনবাণী। হয়তো বা তাহার মনে হইয়াছিল, এ বালকের মনের ক্ষেত্রে এ-সকল উপদেশ সময়ে অঙ্কুরিত হইবে।

 

শ্রাবণ মাসের মাঝামাঝি, বাস্তার ফেরিওয়ালা হাঁকিতেছে, পেয়ারাফুলি আম, ল্যাংড়া আমদিনবাত টিপ টিপ বৃষ্টি, পথঘাটে জল কাদা। এই সময়টার সঙ্গে অপুর কেমন একটা নিরাশ্রয়তা ও নিঃসম্বলতার ভাব জড়িত হইয়া আছে, আর-বছর ঠিক এই সময়টিতে  কলিকাতায় নূতন আসিয়া অবলম্বন-শূন্য অবস্থায় পথে পথে ঘুরিতে হইয়াছিল, কি না জানি হয়, কোথায় না জানি কি সুবিধা জুটিবে—এবারও তাই।

ঔষধের কারখানায় এবার আর স্থান হয় নাই। এক বন্ধুর মেসে দিনকতক উঠিয়াছিল, এখন আবার অন্য একটি বন্ধুর মেসে আছে। নানাস্থানে ছেলে পড়ানোব চেষ্টা করিযা কিছুই জুটিল না, পরের মেসেই বা চলে কি কবিয়া? তাহা ছাড়া এই বন্ধুর ব্যবহার তত ভালো নয়, কেমন যেন বিরক্তির ভাব সর্বদাই—তাহার অবস্থা সবই জানে অথচ একদিন তাহাকে জিজ্ঞাসা করিয়া বসিল, সে মেস খুঁজিয়া লইতে এত দেরি কেন করিতেছে—এ মাসটার পরে আর কোথাও সিট খালি পাওয়া যাইবে? অপু মনে বড়ো আহত হইল। একদিন তাহার হঠাৎ মনে হইল খবরের কাগজ বিক্রয় করিলে কেমন হয়? কলিকাতার খবচ চলে না? মাকেও তত…

অপু সব সন্ধান লইল। তিন পয়সা দিয়া নগদ কিনিয়া আনিতে হয় খবরের কাগজের অফিস হইতে, চার পয়সায় বিক্রি, এক পয়সা লাভ কাগজ পিছু; কিন্তু মূলধন তো চাই; কাহারও কাছে হাত পাতিতে লজ্জা করে, দিবেই বা কে? এই কলিকাতা শহরে এমন একজনও নাই যে তাহাকে টাকা দেয়? সে সুদ দিতে রাজি আছে। সমীবের কাছে যাইতে ইচ্ছা হয় না, সে ভালো করিয়া কথা কয় না। ভাবিয়া-চিন্তিয়া অবশেষে কারখানাব তেওয়ারী-বৌয়ের কাছে গিয়া সব বলিল। তেওয়ারী-বৌ সুদ লইবে না। লুকাইয়া দুটা মাত্র টাকা বাহির করিয়া দিল, তবে আশ্বিন মাসে তাহারা দেশে যাইবে, তাহার পূর্বে টাকাটা দেওয়া চাই।

ফিরিবার পথে অপু ভাবিল…বহুর পায়ের ধুলো নিতে ইচ্ছে করে, মায়ের মতো দ্যাখে, আহা কি ভালো লোক।

পরদিন সকালে সে দুটিল অমৃতবাজার পত্রিকা অফিসে। সেখানে কাগজ-বিক্রেতাদের মারামারি, সবাই আগে কাগজ চায়। অপু ভিড়ের মধ্যে ঢুকিতে পারিল না—কাগজ পাইতে বেলা হইয়া গেল। তাহার পর আর এক নূতন বিপদ—অন্য কাগজওয়ালাদের মতো কাগজ হাঁকিতে পারা তো দূরের কথা, লোকে তাহার দিকে চাহিলে সে সংকুচিত হইয়া পড়ে, গলা দিয়া কথা বাহির হয় না। সকলেই তাহার দিকে চায়, সুশ্রী সুন্দর ভদ্রলোকের ছেলে কাগজ বিক্রয় করিতেছে, এ দৃশ্য তখনকার সময়ে কেহ দেখে নাই—অপু ভাবে—বা রে, আমি কি চড়কের নতুন সঙ নাকি? খানিক দুরে আর একটা জায়গায় চলিয়া যায়। কাহাকেও বিনীত ভাবে মুখের দিকে না চাহিয়া বলেএকখানা  খবরের কাগজ নেবেন? অমৃতবাজার?

কলেজে যাইবার পূর্বে মাত্র আঠারোখানি বিক্রয় হইল। বাকিগুলি এক খবরের কাগজের ফেরিওয়ালা তিন পয়সা দরে কিনিয়া লইল। পরদিন লজ্জাটা অনেকটা কমিল, ট্রামে অনেকগুলি কাগজ কাটিল, বোধ হয় বাঙালি ভদ্রলোকের ছেলে বলিয়াই তাহার নিকট হইতে অনেকে কাগজ লইল।

মাসের শেষে একদিন কলেজে হৈ-চৈ উঠিল। গিয়া দেখে কোথাকার এক ছেলে লাইব্রেরির একখানা বই চুরি করিয়া পালাইতেছিল, ধরা পড়িয়াছে–তাহারই গোলমাল। অপু তাহাকে চিনিল একদিন আর বছর সে ঠাকুরবাড়িতে খাইতে যাইতেছিল, ওই ছেলেটিও বারাণসী ঘোষ স্ট্রীটের দত্তবাড়ি দরিদ্র ছাত্র হিসাবে খাইতে যাইতেছিল। শীতের রাত্রি, খুব বৃষ্টি আসাতে দুজনে এক গাড়িবারান্দার নিচে ঝাড়া দু-ঘন্টা দাঁড়াইয়া থাকে। ছেলেটি তখন অনেক দূর হইতে হাঁটিয়া অতদূর খাইতে যায় শুনিয়া অপুর মনে বড়ো দয়া হয়। সে নামও জানিত, মেট্রেপলিটন কলেজে থার্ড ইয়ারের ছেলে তাহাও জানিত, কিন্তু কোনও কথা প্রকাশ করিল না। কলেজ-সুপারিন্টেন্ডেন্ট পুলিশের হাতে দিবার ব্যবস্থা করিতেছিলেন, দর্শনের অধ্যাপক বৃদ্ধ প্রসাদদাস মিত্র মধ্যস্থতা করিয়া ছাড়িয়া দিলেন।

অপুর যেন বড়ো আঘাত লাগিল-সে পিছু পিছু গিয়া অখিল মিস্ত্রি লেনের মোড়ে ছেলেটিকে ধরিল। ছেলেটির নাম হরেন, সে দিশাহারার মতো হাঁটিতেছিল। অপুকে চিনিতে পারিয়া ঝ ঝর করিয়া কাঁদিয়া ফেলিল। অত্যন্ত অচল হইয়াছে, ভেঁড়া কাপড়, চারিদিকে দেনা, দত্তবাড়ি আজকাল আর খাইতে দেয় না–বর্ধমান জেলায় দেশ, এখানে কোনও আত্মীয়স্বজন নাই। অপু মির্জাপুর পার্কে একখানা বেঞ্চিতে তাহাকে টানিয়া লইয়া গিয়া বসাইল, ছেলেটার মুখে বসন্তের দাগ, রং কালো, চুল রুক্ষ, গায়ের শার্ট কজির অনেকটা উপর পর্যন্ত হেঁড়া। অপুর চোখে  জল আসিতেছিল, বলিল-তোমাকে একটা পরামর্শ দিই শোনোখবরের কাগজ বিক্রি করবে? বাদামভাজা খাওয়া যাক এসো—এই বাদামভাজা

পূজা পর্যন্ত দুজনের বেশ চলিল। পূজার পরই পুনমূষিক–তেওয়ারীবৌয়ের দেনা শোধ করিয়া যাহা থাকিল, তাহাতে মাসিক খরচের কিছু অংশ কুলান হয় বটে, বেশিটাই হয় না। সেকেন্ড ইয়ারের টেস্ট পরীক্ষাও হইয়া গেল, এইবারই গোলমাল—সারা বছরের মাহিনা ও পরীক্ষার ফী দিতে হইবে অল্পদিন পরেই।

উপায় কিছুই নাই। সে কাহারও কাছে কিছু চাহিতে পারিবে না। হয়তো পরীক্ষা দেওয়াই হইবে না। সত্যই তো, এত টাকা—এ তো আর ছেলেখেলা নয়? মন্মথকে একদিন হাসিয়া সব কথা খুলিয়া বলে। মন্মথ শুনিয়া অবাক হইয়া গেল, বলিল—এসব কথা আগে জানাতে হয় আমাকে। মন্মথ সত্যই খুব খাটিল। নিজের দেশের বার লাইব্রেরিতে চাঁদা তুলিয়া প্রায় পঞ্চাশ টাকা আনিয়া দিল, কলেজে প্রফেসারদের মধ্যে চাঁদা তুলিয়া ফেলিল, অল্পদিনের মধ্যে অপ্রত্যাশিতভাবে অনেকগুলি টাকা আসিতে দেখিয়া অপু নিজেই আশ্চর্য হইয়া গেল। কিন্তু বাকি বেতন একরূপ শোধ হইলেও তখনও পরীক্ষার ফী-এর এক পয়সাও জোগাড় হয় নাই, মন্মথ ও বৌবাজারের সেই ছেলেটি বিশ্বনাথ—দু-জনে মিলিয়া ভাইস-প্রিন্সিপ্যালকে গিয়া ধরিল, অপূর্বকে কলেজের বাকি বেতন কিছু ছাড়িয়া দিতে হইবে।

এদিকে ঔষধের কারখানায় থাকিবার সুবিধার জন্য অপু পুনরায় কারখানার মানেজারের নিকটে গেল। এই মাস তিনেক যদি সেখানে থাকিবার সুবিধা পায়, তবে পরীক্ষার পড়াটা করিতে পারে। এর-ওর-তার মেসে সারা বছর অস্থিতপঞ্চকভাবে থাকিয়া তেমন পড়াশুনা হয় নাই। কারখানার আর সকলে অপুকে চিনিত, পছন্দও করিত, তাহারা বলিল—ওহে, তুমি একবার মিঃ লাহিড়ীর কাছে যেতে পারো? ওর কাছে বলাই ভুল-মিঃ লাহিড়ী কারখানার একজন ডিরেক্টর, তাঁর চিঠি যদি আনতে পার, ও সুড়সুড় করে রাজি হবে এখন। ঠিকানা লইয়া অপু উপরি উপরি তিন-চার দিন ভবানীপুরে মিঃ লাহিড়ীর বাড়ি গেল, দেখা পাইল না,-বড়োলোকের গাড়িবারান্দার ধারে বেঞ্চের উপর বসিয়া চলিয়া আসে। দিনকতক কাটিল।

সেদিন রবিবার। ভাবিল, আজ আর দেখা না করিয়া আসিবে না। মিঃ লাহিড়ী বাড়ি নাই বটে, তবে বেলা এগারোটার মধ্যে আসিবেন। খানিকক্ষণ বসিয়া আছে, এমন সময় একজন ঝি আসিয়া বলিল—আপনাকে দিদিমণি ডাকছেন—

অপু আশ্চর্য হইয়া গেল। কোন্ দিদিমণি তাহাকে ডাকিবেন এখানে? সে বিস্ময়ের সুরে বলিল—আমাকে? না—আমি তো

ঝি ভুল করে নাই, তাহাকেই ডানধারে একটা বড়ো কামরা, অনেকগুলো বড়ো বড়ো আলমারি, প্রকাণ্ড বনাত-মোড়া টেবিল, চামড়ার গদি-আঁটা আরাম চেয়ার ও বসিবার চেয়ার। সরু বারান্দা পার হইয়া একটা চকমিলানো হোট পাথর-বধানো উঠান; পাশের ছোট ঘরটায় হাতলহীন চেয়ারে একটি আঠারো-উনিশ বছর বয়সের তরুণী বসিয়া টেবিলে বই কাগজ ছড়াইয়া কি লিখিতেছে, পরনে সাদাসিদে আটপৌরে লালপাড় শাড়ি, ব্লাউজ, ঢিলে-খোঁপা, গলায সরু চেন, হাতে প্লেন বালা–অপরূপ সুন্দরী! সে ঘরে ঢুকিতেই মেয়েটি হাসিমুখে চেয়ার হইতে উঠিযা দাঁড়াইল।

অপু স্বপ্ন দেখিতেছে না তো? সকালে সে আজ কাহার মুখ দেখিয়া উঠিয়াছে! …নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস করিয়াও করা যায় না—আপনা-আপনি তাহার মুখ দিয়া বাহির হইল লীলা।

লীলা মৃদু মৃদু হাসিমুখে তাহার দিকে চাহিয়া ছিল। বলিল—চিনতে পেরেছেন তো দেখছি? আপনাকে কিন্তু চেনা যায় না—ওঃ কতকাল পর—আট বছর খুব হবেনা?

অপু এতক্ষণ পর কথা ফিবিয়া পাইল। সম্মুখের এই অনিন্দ্যসুন্দরী তরুণী লীলাও বটে, না-ও বটে। কেবল হাসির ভঙ্গি ও এক ধরনের হাত রাখিবার ভঙ্গিটা পরিচিত পুরোন।

সে বলিল, আট বছর—হ্যাঁ তা—তোতোমাকেও দেখলে চেনা যায় না। অপু আপনি বলিতে পারিল না, মুখে বাধিল, লীলাব সম্বোধনে সে মনে আঘাত পাইয়াছিল।

লীলা বলিল—আপনাকে দু-দিন দেখেছি, পশু কলেজে যাবার সময় গাড়িতে উঠছি, দেখি কে একজন গাড়িবারান্দার ধারে বেঞ্চিতে বসে—দেখে মনে হল কোথায় দেখেছি যেন—আবার কালও দেখি বসে—আজ সকালে বাহিরের ঘরে খবরের কাগজখানা এসেছে কিনা দেখতে জানালা দিয়ে দেখি আজও বসে-তখন হঠাৎ মনে হল আপনি…তখন মাকে বলেছি, মা আসছেন—কি করছেন  কলকাতায়? রিপনে?-বাঃ, তা এতদিন আছেন, একদিন এখানে আসতে নেই?

বাল্যের সেই লীলা!—একজন অত্যন্ত পরিচিত, অত্যন্ত আপনার লোক যেন দূরে চলিয়া গিয়া পর হইয়া পড়িয়াছে। আপনি বলিবে না তুমি বলিবে, দিশাহারা অপু তাহা ঠাহর করিতে পারিল না। বলিল, কি করে আসব? আমি কি ঠিকানা জানি?

লীলা বলিল—ভালো কথা, আজ এখানে হঠাৎ কি করে এসে পড়লেন?

অপু লজ্জায় বলিতে পারিল না যে, সে এখানে থাকিবার স্থানের সুপারিশ ধরিতে আশিয়াছে। লীলা জিজ্ঞাসা করিল—মা ভালো আছেন? বেশ—আপনার বুঝি সেকেন্ড ইয়ার? আমার ফার্স্ট ইয়ার আটস্।

একটি মহিলা ঘরে ঢুকিলেন। অপু চিনিল, বিস্মিতও হইল। লীলার মা মেজ-বৌরানী কিন্তু বিধবার বেশ। আট দশ বৎসর পূর্বের সে অতুলনীয় ৰূপরাশি এখন একেবারে নিশ্চিহ্ন হইয়া না গেলেও দেখিলে হঠাৎ চেনা যায় না। অপু পায়ের ধুলা লইয়া প্রণাম করিল। মেজ-বৌরানী বলিলেন—এসো বাবা এসো, লীলা কালও বলেছে, কে একজন বসে আছে মা, ঠিক বর্ধমানের সেই অপূর্বর মতো—আজ আমাকে গিয়ে বললে, ও আর কেউ নয় ঠিক অপূর্ব—তখনই আমি ঝিকে দিয়ে ডাকতে পাঠালাম—বসো। দাঁড়িয়ে কেন বাবা? ভালো আছ বেশ? তোমার মা কোথায়?

অপু সংকুচিতভাবে কথার উত্তর দিয়া গেল। মেজ-বৌরানীর কথায় কি আন্তরিকতার সুর। যেন কত কালের পুরাতন পরিচিত আত্মীয়তার আবহাওয়া। অপু কি করিতেছে, কোথায় থাকে, মা কোথায় থাকেন, কি করিয়া চলে, এবার পরীক্ষা দিয়া পুনরায় পড়িবে কি না, নানা খুঁটিনাটি প্রশ্ন। তারপর তিনি চা ও খাবারের বন্দোবস্ত করিতে বাড়ির মধ্যে চলিয়া গেলে অপু বলিল—ইয়ে, তোমার বাবা কি

লীলা ধরা গলায় বলিল—বাবা তো, এই তিন বছর হল—এটা মামার বাড়ি–

অপু বলিল—ও! তাই ঝি বললে দিদিমণি ডাকছেন—মানে উনি?…মিঃ লাহিড়ী কে হন তোমার?

–দাদামশায়—উনি ব্যারিস্টার, তবে আজকাল আর প্র্যাকটিস করেন না—বড়ো মামা হাইকোর্টে বেরুচ্ছেন। ও-বছর বিলেত থেকে এসেছেন।

চা ও খাবার খাইয়া অপু বিদায় লইল। লীলা বলিল—বড়ো মামার মেয়ের নে-ডে পার্টি, সামনের বুধবারে। এখানে বিকালে আসবেন অবিশ্যি অপূর্বাবু—ভুলবেন না যেন—ঠিক কিন্তু ভুলবেন না।

পথে আসিয়া অপুর চোখে প্রায়  জল আসিল। অপূর্ববাবু!—

লীলাই বটে, কিন্তু ঠিক কি সেই এগারো বছরের কৌতুকময়ী সরলা স্নেহময়ী লীলা?…সে লীলা কি তাহাকে অপূর্ববাবু বলিয়া ডাকিত? তবুও কি আন্তরিকতা ও আত্মীয়তা। আর নিজের আপনার লোক জ্যাঠাইমাও তো কলিকাতায় আছেন-মেজ-বৌরানী সম্পূর্ণ পর হইয়া আজ তাহার বিষয়েতে যত খুঁটিনাটি আন্তরিক আগ্রহে প্রশ্ন করিলেন, জ্যাঠাইমা কোনও দিন তাহা করিয়াছেন?…

বাসায় ফিরিয়া কেবলই লীলার কথা ভাবিল। তাহার মনের যে স্থান লীলা দখল করিয়া আছে ঠিক সে স্থানটিতে আর কেহই তো নাই? কিন্তু সে এ লীলা নয়। সে লীলা স্বপ্ন হইয়া কোথায় মিলাইয়া গিয়াছে—আর কি তাহার দেখা মিলিবে কোনও কালে? সে ঠিক বুঝিতে পারিল না— আজকার সাক্ষাতে সে আনন্দিত হইয়াছে কি ব্যথিত হইয়াছে।

বুধবারে পার্টির জন্য সে টুইল শার্টটা সাবান দিয়া কাচিয়া লইল। ভাবিল, নিজের যাহা আছে তাহাই পরিয়া যাইবে, চাহিবার চিন্তিবার আবশ্যক নাই। তবুও যেন বড়ো হীনবেশ হইল। মনে মনে ভাবিল, হাতে যখন পয়সা ছিল, তখন লীলার সঙ্গে দেখা হল না—আর এখন একেবারে এই দশা, এখন কিনা–!

লীলার দাদামশায় মিঃ লাহিড়ী খুব মিশুক লোক। অপুকে বৈঠকখানায় বসাইয়া খানিকক্ষণ গল্পগুজব করিলেন। লীলা আসিল, সে ভারি ব্যস্ত, একবার দু-চার কথা বলিয়াই চলিয়া গেল। কোনও পার্টিতে কেহ কখনও তাহাকে নিমন্ত্রণ করে নাই। যখন এক এক করিয়া নিমন্ত্রিত ভদ্রলোক ও মহিলাগণ আসিতে আরম্ভ করিলেন, তখন অপু খুব খুশি হইল। কলিকাতা শহরে এ রকম ধনী উচ্চ শিক্ষিত পরিবারে মিশিবার সুযোগ—এ বুঝি সকলের হয়? মাকে গিয়া গল্প করিবার মতো একটা জিনিস পাইয়াছে এতদিন পরে! মা শুনিয়া কি খুশিই যে হইবেন।

বৈঠকখানায় অনেক সুবেশ যুবকের ভিড়, প্রায় সকলেই বড়োললকের ছেলে, কেহ বা নতুন ব্যারিস্টারি পাশ করিয়া আসিয়াছে, কেহ বা ডাক্তার, বেশির ভাগ বিলাতফেরত। কি লইয়া অনেকক্ষণ ধরিয়া তর্ক হইতেছিল। কর্পোরেশন ইলেকশন লইয়া কথা কাটাকাটি। অপু এ বিষয়ে কিছু জানে না, সে একপাশে চুপ করিয়া বসিয়া রহিল।

পাড়াগাঁয়ের কোন একটা মিউনিসিপ্যালিটির কথায় সেখানকার নানা অসুবিধার কথাও উঠিল।

একজন মধ্যবয়সি ভদ্রলোক, মাথায় কাঁচাপাকা চুল, চোখে সোনা-বাঁধানো চশমা, একটু টানিয়া টানিয়া কথা বলিবার অভ্যাস, মাঝে মাঝে মোটা চুরুটে টান দিয়া কথা বলিতেছিলেন–দেখুন মিঃ সেন, এগ্রিকালচারের কথা যে বলছেন, ও শখের ব্যাপার নয়—ও কাজ আপনার আমার নয়, ইট মাস্ট বি ব্রেড ইন্ দি বোন্জ ন্মগত একটা ধাত গড়ে না উঠলে শুধু কলের লাঙল কিনলে ও হয় না

প্রতিপক্ষ একজন ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বৎসরের যুবক, সাহেবি পোশাক-পরা, কেশ সবল ও সুস্থকায়। তিনি অধীরভাবে সামনে ঝুঁকিয়া বলিলেন—মাপ করবেন রমেশবাবু, কিন্তু একথার কোনও ভিত্তি আছে বলে আমার মনে হয় না। আপনি কি বলতে চান তা হলে এডুকেশন, অর্গানিজেশন, ক্যাপিটাল—এসবের মূল্য নেই এগ্রিকালচারে? এই যে–

—আছে, সেকেন্ডারি—

—তবে চাষার ছেলে ভিন্ন কোনও শিক্ষিত লোক কখনও ওসবে যাবে না?…কারণ ইট ইজ নট ব্রেড ইন হিজ বোন্? অদ্ভুত কথা আপনার আমার সঙ্গে কেম্বুিজে একজন আইরিশ ছাত্র পড়ত-লম্বা লম্বা চুল মাথায়, সুন্দর চেহারা, ধরনধারনে টু পোয়েট। হয়তো সারারাত জেগে হল্লা করছে, একটা বেহালা নিয়ে বাজাচ্ছে—আবার হয়তো দেখুন সারাদিন পড়ছে, বসে কি লিখছেনয় তো ভাবছে—ডিগ্রি নিয়ে চলে গেল বেরিয়ে কানাডায়—গবর্নমেন্ট হোমস্টেড ল্যান্ডে জংলী জমি নিলে-ছোট্ট একটা কাঠের কুঁড়েঘরে সেই দুর্ধর্ষ শীতের মধ্যে তিন-চার বৎসর কাটালে হোমস্টেড ল্যান্ডের নিয়ম হচ্ছে টাইট হবার আগে পাঁচ বৎসর জমির ওপব বাস করা চাই–থেকে জমি পরিষ্কার করলে, নিজের হাতে রোজ জমি সাফ করে—লোকজন নেই, দুশো একর জমি, ভাবুন কতদিনে–

ওদিকে একদলের মধ্যে আলোচনা বেশ ঘনাইয়া আসিল। একজন কে বলিয়া উঠিল—এসব মর্যালিটি, আপনি যা বলছেন, সেকেলে হয়ে পড়েছে—এটা তো মানেন যে, ওসব তৈবি হয়েছে বিশেষ কোনও সামাজিক অবস্থায়, সমাজকে বা ইনডিভিজুয়ালকে প্রোটেকশান দেবার জন্যে, সুতরাং–

-বটে, তাহলে সবাই সুবিধাবাদী আপনারা। নর্ম্যাটিভ ভ্যালু বলে কোনও কিছুর স্থান নেই দুনিয়ায়?…ধরুন যদি–

অপু খুব খুশি হইল।  কলিকাতার বড়োলোকর বাড়ির পার্টিতে সে নিমন্ত্রিত হইয়া আসিয়াছে, তাহা ছাড়া শিক্ষিত বিলাতফেরত দলের মধ্যে এভাবে। নাটক-নভেলে পড়িয়াছিল বটে, কিন্তু জীবনের অভিজ্ঞতা কখনও হয় নাই। সে অতীব খুশির সহিত চারিধারে চাহিয়া একবার দেখিল মার্বেলের বড়ো ইলেকট্রিক ল্যাম্প কড়ি হইতে ঝুলিতেছে, সুন্দর ফুলকাটা ছিটের কাপড়ে ঢাকা কৌচ, সোফা, দামি আয়না-বড়ো বড়ো গোলাপ, মোরাদাবাদের পিতলের গোলাপদানি। নিজের বসিবার কোঁচখানা সে দু-একবার অপরের অলক্ষিতে টিপিয়া দেখিল। তাহা ছাড়া এ ধরনের কথাবার্তা—এই তো সে চায়! কোথায় সে ছিল পাড়াগাঁয়ের গরিব ঘরের ছেলে—তিন ক্রোশ পথ হাঁটিয়া মাম্‌জোয়ানের স্কুলে পড়িতে যাইত, সে এখন কোথায় আসিয়া পড়িয়াছে! এ-ধরনের একটা উৎসবের মধ্যে তাহার উপস্থিতি ও পাঁচজনের একজন হইয়া বসিবার আত্মপ্রসাদে ঘরের তাবৎ উপকরণ ও অনুষ্ঠানকে যেন সে সারা দেহ-মন দ্বারা উপভোগ করিতেছিল।

কৃষিকার্যে উৎসাহী ভদ্রলোকটি অন্য কথা তুলিয়াছেন, কিন্তু অপুর দক্ষিণ ধারের দলটি পূর্ব আলোচনাই চালাইতেছেন এখনও। অপুর মনে হইল সে-ও এ-আলোচনায় যোগদান করিবে,আর হয়তো এধরনের সম্রান্ত সমাজে মিশিবার সুযোগ জীবনে কখনও ঘটিবে না। এই সময় দু-এক কথা এখানে বলিলে সে-ও একটা আত্মপ্রসাদ। ভবিষ্যতে ভাবিয়া আনন্দ পাওয়া যাইবে। পাস-নে চশমাপরা যুবকটির নাম হীরক সেন। নতুন পাশ করা ব্যারিস্টার! মুখে বেশ বুদ্ধির ছাপ—কি কথায় সে বলিল—ওসব মানি নে বিমলবাব, দেহ একটা এঞ্জিন—এঞ্জিনের যতক্ষণ স্টিম থাকে, চলে যেই কলকজা বিগড়ে যায়, সব বন্ধ–

অপু অবসর খুঁজিতেছিল, এই সময় তাহার মনে হইল এ-বিষয়ে সে কিছু কথা বলিতে পারে। সে দু-একবার চেষ্টা করিয়া সাহস সঞ্চয় করিয়া কতকটা আনাড়ি, কতকটা মরীয়ার মতো আরক্ত মুখে বলিল-দেখুন মাপ করবেন, আমি আপনার মতে ঠিক মত দিতে পারি নে-দেহটাকে এঞ্জিনের সঙ্গে তুলনা করুন ক্ষতি নেই, কিন্তু যদি বলেন দেহ ছাড়া আর কিছু নেই।

ঘরের সকলেই তাহার দিকে যে কতকটা বিস্ময়ে, কতকটা কৌতুকের সহিত চাহিতেছে, সেটুকু সে বুঝিতে পারিল—তাহাতে সে আরও অভিভূত হইয়া পড়িলসঙ্গে সঙ্গে সেটুকু চাপিবার চেষ্টায় আরও মরীয়া হইয়া উঠিল।

একজন বাধা দিয়া বলিল—মশায় কি করেন, জানতে পারি কি?

—আমি এবার আই.এ. দেবো।

পাঁস-নে চশমা-পরা যে যুবকটি এঞ্জিনের কথা তুলিয়াছিল, সে বলিল,-ইউনিভার্সিটির আরও দু-এক ক্লাস পড়ে এ তর্কগুলো করলে ভালো হয় না?

সে এমন অতিরিক্ত শান্তভাবে কথাগুলি বলিল যে, ঘরসুদ্ধ লোক হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিল। অপুর মুখ দাড়িমের মতো লাল হইয়া উঠিল।

যদি সে পূর্ব হইতেই ধারণা করিয়া না লইত যে, সে এ-সভায় ক্ষুদ্রাদপি ক্ষুদ্র এবং উহারা দয়া করিয়া তাহার এখানে উপস্থিতি সহ্য করিতেছে—তাহা হইলে এমন উগ্র ও অভদ্র ভাবের প্রত্যুত্তরে হয়তো তাহার রাগ হইত—কিন্তু সে তো কোনও কিছুতেই এদের সমকক্ষ নয়!—রাগ করিবার মতো ভরসা সে নিজের মধ্যে খুঁজিয়া পাইল না। তার অত্যন্ত লজ্জা হইল—এবং সঙ্গে সঙ্গে সেটা ঢাকিবার জন্য সে আরও মরীয়ার সুরে বলিল—ইউনিভার্সিটির ক্লাসে না পড়লে যে কিছু জানা যায় না একথা আমি বিশ্বাস করি নে—আমি একথা বলতে পারি কোনও ফোর্থ ইয়ারের ছাত্র যে-কোনও কলেজের হিস্ট্রিতে কি ইংলিশ পোইট্রিতে কিংবা জেনারেল নলেজে পারবে না আমার সঙ্গে।

নিতান্ত অপটু ধরনের কথা সকলে আরও একদফা হাসিয়া উঠিল।

তারপর তাহারা নিজেদের মধ্যে অন্য কথাবার্তায় প্রবৃত্ত হইল। অপু আধঘণ্টা থাকিলেও তাহার অস্তিত্বই যেন সকলে ভুলিয়া গেল। উঠিবার সময় তাহারা নিজেদের মধ্যে করমর্দন ও পরস্পরের নিকট বিদায় গ্রহণ করিল, তাহার দিকে কেহ ফিরিয়াও চাহিল না।

যেভাবে সকলে তাহাকে উড়াইয়া দিল বা মানুষের মধ্যে গণ্য করিল না, তাহাতে সত্যই অপু অপমান ও লজ্জায় অভিভূত হইয়া পড়িল। তাহার পাশ কাটাইয়া সকলে চলিয়া গেল—কে একটা প্রশ্নও জিজ্ঞাসা করিল না, তাহার সম্বন্ধে কেহ কোন কৌতূহলও দেখাইল না। অপু মনে মনে ভাবিল—বেশ, না বলুক কথা—আমি কি জানি না-জানি, তার খবর ওরা কি জানে? সে জানত অনিল…

সে চলিয়া যাইতেছে, এমন সময় লীলা আসিয়া তাহাকে নিজে বাড়ির মধ্যে লইয়া গেল। বলিল,-মা, অপূর্ববাবু না খেয়েই চুপি চুপি পালাচ্ছিলেন।

লীলা বৈঠকখানার ব্যাপারটা না জানিতে পারে…

একটি ছোট আট-নয় বৎসরের ছেলেকে দেখাইয়া বলিল—একে চেনেন অপূর্ববাবু? এ সেই খোকামণি, আমার ছোট ভাই, এর অন্নপ্রাশনেই আপনাকে একবার আসতে বলেছিলুম, মনে নেই?

লীলার কয়েকটি সহপাঠিনী সেখানে উপস্থিত, সে সকলকে বলিল—তোমরা জানো না, অপূর্ববাবুর গলা খুব ভালো, তবে গান গাইবেন কিনা জানি নে, মানে বেজায় লাজুক, আমি ছেলেবেলা থেকে দেখে আসছি, একটা অনুরোধ রাখবেন অপুর্বাবু?

অপু অনেকের অনুরোধ-উপরোধে অবশেষে বলিল—আমি বাজাতে জানি নে—কেউ যদি বরং বাজান।–

খাওয়াটা ভালোই হইল। তবুও রাত্রে বাসায় ফিরিতে ফিরিতে তাহার মনে হইতেছিল—আর কখনও এখানে সে আসিবে না। বড়োলোকর সঙ্গে তাহার কিসের খাতির-দরকার কি আসিবার? দারুণ অতৃপ্তি।

 

যেদিন অপুর পরীক্ষা আরম্ভ হইবে তাহার দিন-পাঁচেক আগে অপু পত্রে জানিল মায়ের অসুখ, হস্তাক্ষর তেলিবাড়ির বড়ো বৌয়ের।

সন্ধ্যার সময় অপু বাড়ি পৌঁছিল।

সর্বজয়া কাঁথা গায়ে দিয়া শুইয়া আছে, দুর্বল হইয়া পড়িয়াছে দেখিয়া মনে হয়। অপুকে দেখিয়া তাড়াতাড়ি বিছানার উপর উঠিয়া বসিল। অনেক দিন হইতেই অসুখে ভুগিতেছে, পরীক্ষার পড়ার ব্যাঘাত হওয়ার ভয়ে খবর দেয় নাই, সেদিন তেলি-বৌ জোর করিয়া নিজে পত্র দিয়াছে। এমন যে কিছু শয্যাগত অবস্থা তাহা নয়, খায়-দায়, কাজকর্ম করে। আবার অসুখও হয়। সন্ধ্যা হইলেই শয্যা আশ্রয় করে, আবার সকালে উঠিয়া গৃহকর্ম শুরু করে। চিরদিনের গৃহিণীপনা এ অসুস্থ শরীরেও তাহাকে ত্যাগ করে নাই।

অপু বলিল-উঠো না বিছানা থেকে মা—শুয়ে থাকো—দেখি গা!

—তুই আয় বোস-ও কিছু না—একটু জ্বর হয়, খাই-দাই—ও এমন সময়ে হযেই থাকে। বোশেখ মাসের দিকে সেরে যাবে—তুই যে মেয়েকে পড়াস, সে ভালো আছে তো?

সর্বজয়ার বোগশীর্ণ মুখের হাসিতে অপুর চোখে  জল আসিল। সে পুটুলি খুলিয়া গোটাকতক কমলালেবু, বেদানা, আপেল বাহির করিয়া দেখাইল। জিনিসপত্র সস্তায় কিনিতে পাবিলে সর্বজয়া ভারি খুশি হয়। অপু জানে মাকে আমোদ দিবার এটা একটা প্রকৃষ্ট পন্থা। কমলালেবু দেখাইয়া বলে-কত সস্তায়  কলকাতায় জিনিসপত্র পাওয়া যায় দ্যাখো-লেবুগুলো দশপয়সা

প্রকৃতপক্ষে লেবু কটির দাম ছআনা।

সর্বজয়া আগ্রহের সহিত বলিল—দেখি? ওমা, এখানে যে ওগুলোর দাম বারো আনাব কম নয়—এখানে সব ডাকাত।

চার পয়সার এক তাড়া পান দেখাইয়া বলিল-বৈঠকখানা বাজার থেকে দু-পয়সায়—দ্যাখো মা

সর্বজয়া ভাবে—এবার ছেলের সংসারী হইবাব দিকে মন গিয়াছে, হিসাব করিয়া সে চলিতে শিখিয়াছে।

অপু ইচ্ছা করিয়াই লীলার সঙ্গে সাক্ষাতের কথাটা উঠায় না। ভাবে, মা মনে মনে দুরাশা পোষণ করে, হয়তো এখনই বলিয়া বসিবেলীলার সঙ্গে তোর বিয়ে হয় না?. দরকার কি, অসুস্থ মায়ের মনে সে-সব দুরাশার ঢেউ তুলিয়া?

এমন সব কথা কখনও অপু মায়ের সামনে বলে না, যাহা কিনা মা বুঝিবে না। জগৎ সংসারটাকে মায়ের সীমাবদ্ধ জ্ঞানের উপযোগী করিয়াই সে মায়ের সম্মুখে উপস্থিত করে। দিনতিনেক সে বাড়ি রহিল। রোজ দুপুরে জানলার ধারের বিছানাটিতে সর্বজয়া শুইয়া থাকে, পার্ক সে বসিয়া নানা গল্প করে। ক্রমে বেলা যায়, রোদ প্রথমে ওঠে রান্নাঘরের চালায়, পরে বেড়ার বারের পাতেমাদার গাছটার মাথায়, ক্রমে বাঁশঝাড়ের ডগায়। ছায়া পড়িয়া যায়-বৈকালের ঘন ছায়ায় অপুর মনে আবার একটা বিপুল নির্জনতা ও সঙ্গহীনতার ভাব আনে—গত গ্রীষ্মের ছুটির দিনের মতো।

সর্বজয়া হাসিয়া বলে—পাশটা হলে এবার তোর বিয়ের ঠিক করেছি এক জায়গায়। মেয়ের দিদিমা এসেছিল এখানে, বেশ লোক—

ঘরের কোণে একটা তাকে সংসারের জিনিসপত্র সর্বজয়া রাখিয়া দেয়—একটা হাঁড়িতে আমসত্ত্ব, একটা পাত্রে আচার। অপু চিরকালের অভ্যাস অনুসারে মাঝে মাঝে ভাড় হাঁড়ি খুঁজিয়াপাতিয়া মাকে লুকাইয়া এটা-ওটা চুরি করিয়া খায়! এ কয়দিনও খাইয়াছে। সর্বজয়া বিছানায় চোখ বুজিয়া শুইয়া থাকে, টের পায় না—সেদিন দুপুরে অপু জানালাটার কাছে দাঁড়াইয়া আছে-গায়ে মায়ের গামছাখানা। হঠাৎ সর্বজয়া চোখ চাহিয়া বলিল-আমার গামছাখানা আবার পিষচো কেন?—ওখানা তিলে বড়ি দেবো বলে রেখে দিইচি-কুণ্ডুদের বাড়ির গামছা ওখানা, ভারি ঠুকোআর সরে সরে তাকটার ঘাড়ে যাচ্ছ কেন?–হুঁসনে তাক-তুমি এমন দুষ্টু হয়েচো, বাসি কাপড়ে ছুঁয়েছিলে তাকটা?

কথাটা অপুর বুকে কেমন বিধিল মা সেরে উঠে তিলে বড়ি দেবে? তা দিয়েছে! মা আর উঠছে না হঠাৎ তাহার মনে হইল, এই সেদিনও তো সে তাক হইতে আমসত্ত্ব চুরি করিয়াছে…মা, অসহায় মা বিছানায় জ্বরের ঘোরে পড়িয়া ছিল…একুশ বৎসর ধরিয়া মায়ের যে শাসন চলিয়াছিল আজ তাহা শিথিল হইয়া পড়িতেছে, দুর্বল হইয়া পড়িতেছে, নিজের অধিকার আর বোধ হয় প্রতিষ্ঠিত করিতে পারিবে না কখনও…।

অপু চতুর্থদিন সকালে চলিয়া গেল, কালই পরীক্ষা। চুকিয়া গেলেই আবার আসিবে। শেষবাত্রে ঘুম ভাঙিয়া শোনে, সর্বজয়া রান্নাঘরে ইতিমধ্যে কখন ঘুম হইতে উঠিয়া চলিয়া গিয়াছে, ছেলের সঙ্গে গরম পরোটা দেওয়া যাইবে।

 

সর্বজয়ার এরকম কোনও দিন হয় নাই। অপু চলিয়া যাওয়ার দিনটা হইতে বৈকালে তাহার এত মন হু হু করিতে লাগিল, যেন কেহ কোথাও নাই, একটা অসহায় ভাব, মনের উদাস অবস্থা। কত কথা, সারা জীবনের কত ঘটনা, কত আনন্দ ও অশ্রুর ইতিহাস একে একে মনে আসিয়া উদয় হয়। গত একমাস ধরিয়া এসব কথা মনে হইতেছে। নির্জনে বসিলেই বিশেষ করিয়া …। ছেলেবেলায় বুধী বলিয়া গাই ছিল বাড়িতে…বাল্যসঙ্গিনী হিমিদি দুজনে একসঙ্গে দো-পেটে গাঁদাগাছ পুঁতিয়া জল দিত। একদিন হিমিদি ও সে বন্যাব জলে মাঠে ঘড়া বুকে সাঁতার কাটিতে গিয়া ডুবিয়া গিয়াছিল আব একটু হইলেই…

বিবাহ…মনে আছে সেদিন দুপুরে খুব বৃষ্টি হইয়াছিল, তাহার ছোট ভাই তখন বাঁচিয়া, লুকাইয়া তাহাকে নাড় দিয়া গিয়াছিল হাতের মুঠায়। ছোট্ট ছেলেবেলার অপু…কাচের পুতুলের মতো রুপ…প্রথম স্পষ্ট কথা শিখিল, কি জানি কি করিয়া শিখিল ভিজে। একদিন অপুকে কদমা হাতে বসাইয়া রাখিয়াছিল।-কেমন খেলি ও খোকা?

অপু দন্তহীন মুখে কদমা চিবাইতে চিবাইতে ফুলের মতো মুখটি তুলিয়া মায়ের দিকে চাহিয়া বলিল—‘ভিজে’। হি হি—ভাবিলে এখনও সর্বজয়ার হাসি পায়।

সেদিন দুপুর হইতেই বুকে মাঝে মাঝে ফিক-ধরা বেদনা হইতে লাগিল। তেলি-বৌ আসিয়া তেল গরম করিয়া দিয়া গেল। দু-তিনবার দেখিয়াও গেল। সন্ধ্যার পর কেহ কোথাও নাই। একা নির্জন বাড়ি। জ্বরও আসিল।

রাত্রে খুব পরিষ্কার আকাশে ত্রয়োদশীর প্রকাণ্ড বড়ো চাদ উঠিয়াছে। জীবনে এই প্রথম সর্বজয়ার একা থাকিতে ভয়-ভয় করিতে লাগিল। খানিক রাত্রে একবার যেন মনে হইল, সে  জলের তলায় পড়িয়া আছে, নাকে মুখে  জল ঢুকিয়া নিঃশ্বাস একেবারে বন্ধ হইয়া আসিতেছে…একেবারে বন্ধ। সে ভয়ে এক-গা ঘামিয়া ধড়মড় করিয়া বিছানার উপর উঠিয়া বসিল। সে কি মরিয়া যাইতেছে? এই কি মৃত্যু?—সে এখন কাহাকে ডাকে? জীবনে সর্বপ্রথম এই তাহার জীবনের ভয় হইল—ইহার আগে কখনও তো এমন হয় নাই! পরে নিজের ভয় দেখিয়া তাহার আর একদফা ভয় হইল। ভয় কিসের? না—না–মৃত্যু, সে এরকম নয়। ও কিছু না।

কত চুরি, কত পাপ…চুরিই যে কত করিয়াছে তাহার কি ঠিক আছে? ছেলেমেয়েকে খাওয়াইতে অমুকের গাছের কলার কাঁদিটা, অমুকের গাছের শসাটা লুকাইয়া রাখিত তক্তপোশের তুলায়-ভুবন মুখুজ্যেদের বাড়ি হইতে একবার দশ পলা তেল ধার করিয়া আনিয়া ভালোমানুষ রানুর মার কাছে পাঁচ পলা শোধ দিয়া আসিয়াছিল, মিথ্যা করিয়া বলিয়াছিল—পাঁচ পলাই তো নিয়ে গিছলাম নদিবোলো সেজ ঠাকুরঝিকে। সারাজীবন ধরিয়া শুধু দুঃখ ও অপমান। কেন আজ এসব কথা মনে উঠিতেছে?

ঘর অন্ধকার। …খাটের তলায় নেংটি ইদুর ঘুট ঘুটু করিতেছে। সর্বজয়া ভাবিল, ওদের বাড়ির কলটা না আনলে আর চলে না—নতুন মুগগুলো সব খেয়ে ফেললে। কিন্তু নেংটি ইদুরের শব্দ তো?—সর্বজয়ার আবার সেই ভয়টা আসিল, দুর্দমনীয় ভয়…সারা শরীর যেন ধীরে ধীরে অসাড় হইয়া আসিতেছে ভয়ে…পায়ের দিক হইতে ভয়টা সুড়সুড়ি কাটিয়া উপরের দিকে উঠিতেছে, যতটা উঠিতেছে, ততটা অসাড় করিয়া দিতেছে…না—পায়ের দিক হইতে না-হাতের আঙুলের দিক হইতে…কিন্তু তাহার সন্দেহ হইতেছে কেন? ইদুরের শব্দ নয় কেন? কিসের শব্দ? কখনও তো এমন সন্দেহ হয় না?…হঠাৎ সর্বজয়ার মনে হইল, না—পায়ের ও হাতের দিক হইতে সুড়সড়ি কাটিয়া যাহা উপরের দিকে উঠিতেছে তাহা ভয় নয়—তাহা মৃত্যু। মৃত্যু? ভীষণ ভয়ে সর্বজয়া ধড়মড় করিয়া আবার বিছানা হইতে উঠিতে গেল… চিৎকার করিতে গেল…খুব…খুব চিৎকার, আকাশফাটা চিৎকার–অনেকক্ষণ চিৎকার করিয়াছে, আর সে চেঁচাইতে পারে না…গলা ভাঙিয়া আসিয়াছে…কেউ আসিল না তো?…কিন্তু সে তো বিছানা হইতে…বিছানা হইতে উঠিল কখন?…সে তো উঠে নাই–ভয়টা সুড়সুড়ি কাটিয়া সারা দেহ ছাইয়া ফেলিয়াছে, যেন খুব বড়ো একটা কালো মাকড়সা…খুঁড়েব বিষে দেহ অবশ…অসাড় হাতও নাড়ানো যায় না…পা-ও না…সে চিৎকার করে নাই… ভুল।…

সুন্দর জ্যোৎস্না উঠিয়াছে…একজনের কথাই মনে হয়…অপু…অপু…অপুকে ফেলিয়া সে থাকিতে পারিতেছে না…অসম্ভব।…বিস্ময়ের সহিত দেখিল-সে নিজে অনেকক্ষণ কাঁদিতেছে!… এতক্ষণ তো টের পায় নাই!…আশ্চর্য!…চোখের জলে বালিশ ভিজিয়া গিয়াছে যে!…

জ্যোৎস্না অপূর্ব, ভয় হয় না…কেমন একটা আনন্দ…আকাশটা, পুরাতন আকাশটা যেন স্নেহে প্রেমে জ্যোৎস্না হইয়া গলিয়া ঝরিয়া বিন্দুতে বিন্দুতে নিজেকে নিঃশেষ করিয়া দিতেছে…টুপ…চুপ…টুপ…টাপ। আবার কান্না পায়…জ্যোৎস্নার আলোয় জানালার গরাদে ধরিযা হাসিমুখে ও কে দাঁড়াইয়া আছে?…সর্বজয়ার দৃষ্টি পাশের জানলাব দিকে নিবদ্ধ হইল… বিস্ময়ে আনন্দে রোগশীর্ণ মুখখানা মুহূর্তে উজ্জ্বল হইয়া উঠিল…অপু…দাঁড়াইয়া আছে।…এ অপু নয়…সেই ছেলেবেলাকার ছোট্ট অপু…এতটুকু অপু…নিশ্চিন্দিপুরের বাঁশবনের ভিটেতে এমন কত চৈত্রজ্যোৎস্নারাতে ভাঙা জানালার ফাঁক দিয়া জ্যোৎস্নার আলো আসিয়া পড়িত যাহার দন্তহীন ফুলের কুঁড়ির মতো কচি মুখে…সেই অপু…ওর ছেলেমানুষ খঞ্জন পাখির মতো ডাগর ডাগর চোখের নীল চাহনি…চুল কোকড়া কোকড়া…মুখচোরা, ভালোমানুষ লাজুক বোকা, জগতের ঘোরপ্যাঁচ কিছুই একেবারে বোঝে না…কোথায় যেন সে যায়…নীল আকাশ বাহিয়া বহু দূরে…বহু দূরের দিকে, সুনীল মেঘপদবীর অনেক উপরে…যায়…যায়…যায়…যায়…মেঘের ফাঁকে যাইতে যাইতে মিলাইয়া যায়…

বুঝি মৃত্যু আসিয়াছে। …কিন্তু তার ছেলের বেশে, তাকে আদর করিয়া আগু বাড়াইয়া লইতে…এতই সুন্দর…।

কি হাসি!…কি মিষ্টি হাসি ওর মুখের!…

 

পরদিন সকালে তেলি-বাড়ির বড়ো বৌ আসিল। দরজায় রাত্রে খিল খেওয়া হয় নাই, খোলাই আছে। বড়ো-বৌ আপন মনে বলিল–রাত্রে দেখছি মা-ঠাকরুনের অসুখ খুব বেড়েছে, খিলটাও দিতে পারেন নি।

বিছানার উপর সর্বজয়া যেন ঘুমাইতেছেন। তেলি-বৌ একবার ভাবিল-ডাকিবে না কিন্তু পথ্যের কথা জিজ্ঞাসা করিবার জন্য ডাকিয়া উঠাইতে গেল। সর্বজয়া কোনও সাড়া দিলেন না, নড়িলেনও না। বড়ো-বৌ আরও দু-একবার ডাকাডাকি করিল, পরে হঠাৎ কি ভাবিয়া নিকটে আসিয়া ভালো করিয়া দেখিল।

পরক্ষণেই সে সব বুঝিল।

সর্বজয়ার মৃত্যুর পর কিছুকাল অপু এক অদ্ভুত মনোভাবের সহিত পরিচিত হইল। প্রথম অংশটা আনন্দ-মিশ্রিত—এমন কি মায়ের মৃত্যু-সংবাদ প্রথম যখন সে তেলি-বাড়ির তারের খবরে জানিল, তখন প্রথমটা তাহার মনে একটা আনন্দ, একটা যেন মুক্তির নিঃশ্বাস…একটা বাঁধন-ছেঁড়ার উল্লাস…অতি অল্পক্ষণের জন্য নিজের অজ্ঞাতসারে। তাহার পরই নিজের মনোভাবে তাহার দুঃখ ও আতঙ্ক উপস্থিত হইল। এ কি! সে চায় কি! মা যে নিজেকে একেবারে বিলোপ করিয়া ফেলিয়াছিলেন তাহার সুবিধার জন্য। মা কি তাহার জীবনপথের বাধা?—কেমন করিয়া সে এমন নিষ্ঠুর, এমন হৃদয়হীন— তবুও সত্যকে সে অস্বীকার করিতে পারিল না। মাকে এত ভালোবাসিত তো, কিন্তু মায়ের মৃত্যু-সংবাদটা প্রথমে যে একটা উল্লাসের স্পর্শ মনে আনিয়াছিল—ইহা সত্য— সত্য–তাহাকে উড়াইয়া দিবার উপায় নাই। তাহার পর সে বাড়ি রওনা হইল। উলা স্টেশনে নামিয়া হাঁটিতে শুরু করিল। এই প্রথম এ পথে সে যাইতেছে—যেদিন মা নাই! গ্রামে ঢুকিবার কিছু আগে আধমজা কোদলা নদী, এ সময়ে হাঁটিয়া পার হওয়া যায়—এরই তীরে কাল মাকে সবাই দাহ করিয়া গিয়াছে! বাড়ি পৌঁছিল বৈকালে। এই সেদিন বাড়ি হইতে গিয়াছে, মা তখনও ছিলেন…ঘরে তালা দেওয়া, চাবি কাহাদের কাছে? বোধ হয় তেলি-বাড়ির ওরা লইয়া গিয়াছে। ঘরের পৈঠায় অপু চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। উঠানের বাহিরে আগড়ের কাছে এক জায়গায় পোড়া খড় জড়ো করা। সেদিকে চোখ পড়িতেই অপু শিহরিয়া উঠিল—সে বুঝিয়াছে—মাকে যাহারা সৎকার করিতে গিয়াছিল, দাহ অন্তে তাহাবা কাল এখানে আগুন ছুঁইয়া নিমপাতা খাইয়া শুদ্ধ হইয়াছে—প্রথাটা অপু জানে…মা মারা গিয়াছেন এখনও অপুর বিশ্বাস হয় নাই…একুশ বৎসরের বন্ধন, মন এক মুহূর্তে টানিয়া ছিড়িয়া ফেলিতে পাবে নাই… কিন্তু পোড়া খড়গুলাতে নগ্ন, রূঢ় নিষ্ঠুর সত্যটা…মা নাই! মা নাই।.বৈকালের কি রূপটা! নির্জন, নিরালা, কোনও দিকে কেহ নাই। উদাস পৃথিবী, নিস্তব্ধ বিবাগী রাঙা রোদভরা আকাশটা।…অপু অর্থহীন দৃষ্টিতে পোড়া খড়গুলার দিকে চাহিয়া রহিল।

কিন্তু মায়ের গায়ের কথাখানা উঠানের আলনায় মেলিয়া দেওয়া কেন? কথাখানা মায়ের গায়ে ছিল…সঙ্গেই তো যাওয়ার কথা। অনেক দিনের নিশ্চিন্দিপুরের আমলের, মায়ের হাতে সেলাই করা কল্কা-কাটা রাঙা সুতার কাজ। …কতক্ষণ সে বসিয়া ছিল জানে না, রোদ প্রায় পড়িয়া আসিল। তেলি-বাড়ির বড়ো ছেলে নাদুর ডাকে চমক ভাঙিতেই সে তাড়াতাড়ি উঠিয়া দাঁড়াইল। ম্লান হাসিয়া বলিল-এই যে, আমার ঘরের চাবিটা তোমাদের বাড়ি?…

নাদু বলিল—কখন এলে, এখানে বসে একলাটি-~-বেশ তো দাদাঠাকুর-এসো আমাদের বাড়ি।

অপু বলিল, না ভাই, তুমি চাবিটা নিয়ে এসো—ঘরের মধ্যে দেখি জিনিসগুলোর কি ব্যবস্থা। চাবি দিয়া নাদু চলিয়া গেল।

—ঘর খুলে দ্যাখো, আমি আসছি এখুনি।

অপু ঘরে ঢুকিল। তক্তপোশের উপর বিছানা নাই, বালিশ, মাদুর কিছু নাই—তক্তপোশটা পড়িয়া আছে—তক্তপোশের তলায় একটা পাথরের খোরায় কি ভিজানো—খোরাটা হাতে তুলিয়া দেখিল। চিরতা না নিমছাল কি ভিজানো-মায়ের ওষুধ।

বাহিরে পায়ের শব্দ শোনা গেল। কে বলিল—ঘরের মধ্যে কে?—অপু খোরাটা তক্তপোশের কোণে নামাইয়া রাখিয়া বাহিরের দাওয়ায় আসিল। নিরুপমা দিদি নিরুপমাও অবাক-গালে আঙুল দিয়া বলিল—তুমি! কখন এলে ভাই?-কই কেউ তো বলে নি!…

অপু বলিলনা, এই তো এলাম,—এই এখনও আধঘণ্টা হয় নি।

নিরুপমা বলিল—আমি বলি রোদ পড়ে গিয়েছে, কাঁথাটা কেচে মেলে দিয়ে এসেছি বাইরে, যাই কাঁথাখানা তুলে রেখে আসি কুতুদের বাড়ি। তাই আসছি—

অপু বলিল—কাঁথাখানা মায়ের গায়ে ছিল, না নিরুদি?

-কোথায়?…পরশু রাতে তো তারপরও বিকেলে বড়ো-বৌকে বলেছেন কাঁথাখানা সরিয়ে রাখো মা-ও আমার অপুর জন্যে, বর্ষাকালে কলকাতা পাঠাতে হবে—সেই পুরানো তুলো জমানো কালো কম্বলটা ছিল…সেইখানা গায়ে দিয়েছিলেন—তিনি আবার প্রাণ ধরে তোমার কথা নষ্ট করবেন?…তাই কাল যখন ওরা তাকে নিয়ে-থুয়ে গেল তখন ভাবলাম রুগীর বিছানায় তো ছিল কাঁথাখানা, জলকাঁচা করে রোদে দিইকাল আর পারি নি আজ সকালে ধুয়ে আলনায় দিয়ে গেলাম—তা এসো-আমাদের বাড়ি-ওসব শুনবো না—মুখ শুকনোহবিষ্যি হয় নি? এসো

নিরুপমার আগে আগে সে কলের পুতুলের মতো তাদের বাড়ি গেল। সরকার মহাশয় কাছে ডাকিয়া বাইয়া অনেক সান্ত্বনার কথা বলিলেন।

নিরুদি কি করিয়া মুখ দেখিয়া বুঝিল খাওয়া হয় নাই! নাদুও তত ছিলকই কোনও কথা তো বলে নাই?

সন্ধ্যার পর নিরুপমা একখানা রেকাবিতে আখ ও ফলমূল কাটিয়া আনিল। একটা কাসাব বাটিতে কাঁচামুগের ডাল-ভিজা, কলা ও আখের গুড় নিয়া নিজে একসঙ্গে মাখিয়া আনিয়াছে। অপু কারুর হাতে চটকানো জিনিস খায় না, ঘেন্না-ঘেন্না করে…প্রথমটা মুখে তুলিতে একটুখানি গা কেমন করিতেছিল। তারপর দুই-এক গ্রাস খাইয়া মনে হইল সম্পূর্ণ স্বাভাবিক আস্বাদই তো!…নিজের হাতে বা মায়ের হাতে মাখিলে যা হইত—তাই। পরদিন হবিষ্যের সময় নিরুপমা গোয়ালে সব জোগাড়পত্র করিয়া অপুকে ডাক দিল। উনুনে ফু পাড়িয়া কাঠ ধরাইয়া দিল। ফুটিয়া উঠিলে বলিল-এইবার নামিয়ে ফ্যালো, ভাই।

অপু বলিল—আর একটু হবে না—নিরুদি?

নিরুপমা বলিল—নামাও দেখি, ও হয়ে গিয়েছে। ডালবাটাটা জুড়োতে দাও—

 

সব মিটিয়া গেলে সে  কলিকাতায় ফিরিবার উদ্যোগ করিল। সর্বজয়ার জাতিখানা, সর্বজয়ার হাতে সইকরা খানদুই মনিঅর্ডারের রসিদ চালের বাতায় গোঁজা ছিল—সেগুলি, সর্বজয়ার নখ কাটিবার নরুণটা পুটলির মধ্যে বাঁধিয়া লইল। দোরের পাশে ঘরের কোণে সেই তাকটা—আসিবার সময় সেদিকে নজর পড়িল। আচারভরা ভাড়, আমসত্ত্বের হাঁড়িটা, কুলচুর, মায়ের গঙ্গাজলের পিতলের ঘটি, সবই পড়িয়া আছে…যে যত ইচ্ছা খুশি খাইতে পারে, যাহা খুশি দুইতে পারে, কেহ বকিবার নাই, বাধা দিবার নাই। তাহার প্রাণ ডুকরিয়া কাঁদিয়া উঠিল। সে মুক্তি চায় না…অবাধ অধিকার চায় নাতুমি এসে শাসন করো, এসব ছুঁতে দিয়ো না, হাত দিতে দিয়ো না ফিরে এসো মা…ফিরে এসো…

কলিকাতায় ফিরিয়া আসিল, একটা তীব্র ঔদাসীন্য সব বিষয়ে, সকল কাজে এবং সঙ্গে সঙ্গে সেই ভয়ানক নির্জনতার ভাবটা। পরীক্ষা শেষ হইয়া গিয়াছিল, কলিকাতায় থাকিতে একদণ্ড ইচ্ছা হয় না…মন পাগল হইয়া উঠে, কেমন যেন পালাই-পালাই ভাব হয় সর্বদা, অথচ পালাইবার স্থান নাই, জগতে সে একেবারে একাল-সত্যসত্যই একাকী।

এই ভয়ানক নির্জনতার ভাব এক এক সময় অপুর বুকে পাথরের মতো চাপিয়া বসে, কিছুতেই সেটা সে কাটাইয়া উঠিতে পারে না, ঘরে থাকা তাহার পক্ষে তখন আর সম্ভব হয় না। গলিটার বাহিরে বড়ো রাস্তা, সামনে গোলদিঘি, বৈকালে গাড়ি, মোটর, লোকজন ছেলেমেয়ে। বড়ো মোটরগাড়িতে কোন সম্রান্ত গৃহস্থের মেয়েরা বাড়ির ছেলেমেয়েদের লইয়া বেড়াইতে বাহির হইয়াছে, অপুর মনে হয় কেন সুখী পরিবার!—ভাই, বোন, মা, ঠাকুরমা, পিসিমা, রাঙাদি, বড়দা, ছোটকা। যাহাদের থাকে তাহাদের কি সব দিক দিয়াই এমন করিয়া ভগবান দিয়া দেন। অন্যমনস্ক হইবার জন্য এক-একদিন সে ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটের লাইব্রেরিতে গিয়া বিলাতি ম্যাগাজিনের পাতা উলটাইয়া থাকে। কিন্তু কোথাও বেশিক্ষণ বসিবার ইচ্ছা হয় না, শুধুই কেবল এখানে-ওখানে ফুটপাথ হইতে বাসায়, বাসা হইতে ফুটপাতে। এক জায়গায় বসিলেই শুধু মায়ের কথা মনে আসে, উঠিয়া ভাবে গোলদিঘিতে আজ সাঁতারের ম্যাচের কি হল দেখে আসি বরংকলিকাতায় থাকিতে ইচ্ছা করে না, মনে হয় বাহিরে কোথাও চলিয়া গেলে শান্তি পাওয়া যাইত—যে কোনও জায়গায়, যে কোন জায়গায়-পাহাড়ে, জঙ্গলে, হরিদ্বাবে কেদার-বদরীর পথে—মাঝে মাঝে ঝরনা, নির্জন অধিত্যকায় কত ধরনের বিচিত্র বন্যপুষ্প, দেওদার ও পাইন বনের ঘন ছায়া। সাধু সন্ন্যাসী দেবমন্দির, রামচটি, শ্যামচটি কত বর্ণনা তো সে বইয়ে পড়ে, একা বাহির হইয়া পড়া মন্দ কি? কি হইবে এখানে শহরের ঘিঞ্জি ও ধোঁয়ার বেড়াজালের মধ্যে?

কিন্তু পয়সা কই? তাও তো পয়সার দরকার। তেলিরা কুড়ি টাকা দিয়াছিল মাতৃশ্রাদ্ধের দরুন, নিরুপমা নিজে হইতে পনেরো, বড়ো-বৌ আলাদা দশ। অপু সে টাকার এক পয়সাও রাখে নাই, অনেক লোকজন খাওয়াইয়াছে। তবু তো সামান্যভাবে তিলকাঞ্চন শ্রাদ্ধ!

দশপিণ্ড দানেব দিন সে কি তীব্র বেদনা! পুরোহিত বলিতেছেন-প্রেতা শ্রীসর্বজয়া দেবী— অপু ভাবে কাহাকে প্রেত বলিতেছে? সর্বজয়া দেবী প্রেত? তাহার মা, প্রীতি আনন্দ ও দুঃখ-মুহূর্তের সঙ্গিনী, এত আশাময়ী, হাস্যময়ী, এত জীবন্ত যে ছিল কিছুদিন আগেও, সে প্রেত? সে আকাশছো নিরালম্বো বায়ুভূত-নিরাশ্রয়ঃ?

তারপরই মধুর আশার বাণী—আকাশ মধুময় হউক, বাতাস মধুময় হউক, পথের ধূলি মধুময় হউক, ওষধি সকল মধুময় হউক, বনস্পতি মধুময় হউক, সূর্য চন্দ্র, অন্তরীক্ষস্থিত আমাদের পিতা মধুময় হউন।

সারাদিনব্যাপী উপবাস অবসাদ, শোকের পর এ মন্ত্র অপুর মনে সত্য সত্যই মধুবৰ্ষণ করিয়াছিল, চোখের  জল সে রাখিতে পারে নাই। হে আকাশের দেবতা, বাতাসের দেবতা, তাই করো, মা আমার অনেক কষ্ট কবে গিয়েছেন, তার প্রাণে তোমাদের উদার আশীর্বাদের অমৃতধারা বর্ষণ করো।

এই অবস্থায় শুধুই ইচ্ছা কবে যারা আপনার লোক, যারা তাহাকে জানে ও মাকে জানিত তাহাদের কাছে যাইতে। এক জ্যাঠাইমারা আছেন—কিন্তু তাঁহাদেব সহানুভূতি নাই, তবু সেখানেই যাইতে ইচ্ছা করে। তবুও মনে হয়, হয়তো জ্যাঠাইমা মায়ের দু-পাঁচটা কথা বলিবেন এখন, দুটা সহানুভূতির কথা হয়তো বলিবেন—

 

মাস-তিনেক এভাবে কাটিল। এ তিন মাসের কাহিনী তাহার জীবনের ইতিহাসে একটা একটানা নিরবচ্ছিন্ন দুঃখের কাহিনী। ভবিষ্যৎ জীবনে অপু এ গলিটাব নিকট দিয়া যাইতে যাইতে নিজের অজ্ঞাতসারে একবার বড়ো রাস্তা হইতে গলির মোড়ে চাহিয়া দেখিত, আর কখনও সে ইহার মধ্যে ঢোকে নাই।

জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষে সে একদিন খবরের কাগজে দেখিল-যুদ্ধের জন্য তোক লওয়া হইতেছে, পার্ক স্ট্রীটে তাহার অফিস। দুপুরে ঘুরিতে ঘুরিতে সে গেল পার্ক স্ট্রীটে।

টেবিলে একরাশ আপানো ফর্ম পড়িয়া ছিল, অপু একখানা তুলিয়া পড়িয়া রিক্রুটিং অফিসারকে বলিল-কোথাকার জন্য লোক নেওয়া হবে?

–মেসোপটেমিয়া, রেলওয়ে ও ট্রান্সপোর্ট বিভাগের জন্য। তুমি কি টেলিগ্রাফ জানোনা মোটর মিন্ত্রি?

অপু বলিল—সে কিছুই নহে। ও-সব কাজ জানে না, তবে অন্য যে কোন কাজ—কি কেরানীগিরি।

সাহেব বলিল-না, দুঃখিত আমরা শুধু কাজ জানা লোক নিচ্ছি—বেশির ভাগ মোটর ড্রাইভার, সিগন্যালার, স্টেশন মাস্টার সব।

এই অবস্থায় একদিন লীলার সঙ্গে দেখা। ইতস্তত লক্ষ্যহীনভাবে ঘুরিতে ঘুরিতে একদিন ডালহাউসি স্কোয়ারের মোড়ে সে রাস্তা পার হইবার জন্য অপেক্ষা করিতেছে, সামনে একখানা হলদে রঙের বড়ো মিনার্ভা গাড়ি ট্রাফিক পুলিশে দাঁড় করাইয়া রাখিয়াছিল হঠাৎ গাড়িখানার দিক হইতে তাহার নাম ধরিয়া কে ডাকিল।

সে গাড়ির কাছে গিয়া দেখিল, লীলা ও আর দুই-তিনটি অপরিচিত মেয়ে। লীলার ছোটভাই ড্রাইভারের পাশে বসিয়া। লীলা আগ্রহের সুরে বলিল—আপনি আচ্ছা তো অপূর্ববাবু? তিন-চার মাসের মধ্যে দেখা করলেন না, কেন বলুন তো? মা সেদিনও আপনার কথা—

অপুর আকৃতিতে একটা কিছু লক্ষ করিয়া সে বিস্ময়ের সুরে বলিল–আপনার কি হয়েছে? অসুখ থেকে উঠেছেন নাকি, শরীর-মাথার চুল অমন ছোেট-ঘোট, কি হয়েছে বলুন তো?

অপু হাসিয়া বলিল-কই না, কি হবে কিছু তো হয় নি?

–মা কেমন আছেন?

—মা? তা মামা তো নেই। ফাগুন মাসে মারা গিয়েছেন।

কথা শেষ করিয়া অপু আর এক দফা পাগলের মতো হাসিল।

হয়তো বাল্যের সে প্রীতি নানা ঘটনায়, বহু বৎসরের চাপে লীলার মনে নিষ্প্রভ হইয়া গিয়াছিল, হয়তো ঐশ্বর্যের আঁচ লাগিয়া সে মধুর বাল্যমন অন্যভাবে পরিবর্তিত হইয়াছিল ধীরে ধীরে, অপুর মুখের এই অর্থহীন হাসিটা যেন একখানা তীক্ষ্ণ ছুরির মতো গিয়া তাহার মনের কোন গোপন মণিমঞ্জুষার রুদ্ধ ঢাকনির ফাঁকটাকে হঠাৎ একটা সজোরে চাড়া দিল, এক মুহূর্তে অপুর সমস্ত ছবিটা তাহার মনের চোখে ভাসিয়া উঠিল—সহায়হীন, মাতৃহীন, আশ্রয়হীন, পথে-পথে বেড়াইতেছে-কে মুখের দিকে চাহিবার আছে?

লীলার গলা আড়ষ্ট হইয়া গেল, একটু চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল,আপনি আমাদের ওখানে কবে আসবেন বলুন-না, ও রকম বললে হবে না। এ-কথা আমাদের জানানো আপনার উচিত ছিল না? অন্তত মাকেও বলা তো কাল সকালে আসুন—ঠিক বলুন আসবেন? কেমন ঠিক তাসেবারকার মতো করবেন না কিন্তু ভালো কথা, আপনার ঠিকানাটা বলুন তো, কি—ভুলবেন না কিন্তু–।

গাড়ি চলিয়া গেল।

বাসায় ফিরিয়া অপু মনের মধ্যে অনেক তোলাপাড়া করিল। লীলার মুখে সে একটা কিসের ছাপ দেখিয়াছে, বর্তমান অবস্থায় মন তাহার এই আন্তরিকতার স্নেহস্পর্শটুকুরই কাঙ্গাল বটে—কিন্তু এই বেশে কোথাও যাইতে ইচ্ছা হয় না, এই জামায়, এই কাপড়ে, এই ভাবে। থাক বরং।

তিনদিন পর নিজের নামে একখানা পত্ৰ আসিতে দেখিয়া সে বিস্মিত হইল—মা ছাড়া আর তো কাহারও পত্র সে পায় নাই। কে পত্ৰ দিল? পত্ৰ খুলিয়া পড়িল :

অপূর্ববাবু,

আপনার এখানে আসবার কথা ছিল সোমবারে, কিন্তু আজ শুক্রবার হয়ে গেল আপনি এলেন। আপনাকে মা একবার অবিশ্যি অবিশ্যি আসতে বলেছেন, না এলে তিনি খুব দুঃখিত হবেন। আজ বিকেলে পাচটার সময় আপনার আসা চাই-ই। নমস্কার নেবেন।

কথাটা লইয়া মনের মধ্যে সে অনেক বোঝাপড়া করিল। কি লাভ গিয়া? ওরা বড়োমানুষ, কোন্ বিষয়ে সে ওদের সঙ্গে সমান যে, ওদের বাড়ি যখন-তখন যাইবে? মেজ-বৌরানী যে তাহার কথা জিজ্ঞাসা করিয়াছেন, সেই কথাটা তাহার মনে অনেকবার যাওয়া-আসা করিল—সেইটা, আর লীলার আন্তরিকতা। কিন্তু মেজ-বৌরানী কি আর তার মায়ের অভাব দূর করিতে পারিবেন? তিনি বড়োলোকের মেয়ে, বড়োলোকের বধূ! তাহার মায়ের আসন হৃদয়ের যে স্থানটিতে, সে শুধু তাহার দুঃখিনী মা অর্জন করিয়াছে তাহার বেদনা, ব্যর্থতা, দৈন্য-দুঃখ, শত অপমান দ্বারা—ছয় সিলিন্ডারের মিনার্ভা গাড়িতে চড়িয়া কোনও ধনীবধূ-হউন তিনি স্নেহময়ী, হউন তিনি মহিমময়ী—তাঁহার সেখানে প্রবেশাধিকার কোথায়?

জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষে পরীক্ষার ফল বাহির হইল। প্রথম বিভাগের প্রথম সতের জনের মধ্যে তাহার নাম, বাংলাতে সকলের মধ্যে প্রথম হইয়াছে, এজন্য একটা সোনার মেডেল পাইবে। এমন কেহ নাই যাহার কাছে খবরটা বলিয়া বাহাদুরি করা যাইতে পারে। কোনও পরিচিত বন্ধুবান্ধব পর্যন্ত এখানে নাই—ছুটিতে সব দেশে গিয়াছে। জ্যাঠাইমার কাছে যাইবে?…গিয়া জানাইবে জ্যাঠাইমাকে?…কি লাভ, হয়তো তিনি বিরক্ত হইবেন, দরকার নাই যাওয়ার।


© 2024 পুরনো বই