০১. দুপুর প্রায় গড়াইয়া গিয়াছে

প্ৰথম পরিচ্ছেদ

দুপুর প্রায় গড়াইয়া গিয়াছে। রায়চৌধুরীদের বাড়ির বড়ো ফটকে রবিবাসরীয় ভিখারিদের ভিড় এখনও ভাঙে নাই। বীর মুহুরির উপর ভিখারির  চাউল দিবার ভার আছে, কিন্তু ভিখারিদের মধ্যে পর্যন্ত অনেকে সন্দেহ করে যে, জমাদার শম্ভুনাথ সিংহের সঙ্গে যোগ-সাজসের ফলে তাহারা ন্যায্য প্রাপ্য হইতে প্রতিবারই বঞ্চিত হইতেছে। ইহা লইয়া তাহদের ঝগড়া দ্বন্দ্ব কোনকালেই মেটে নাই। শেষ পর্যন্ত দারোয়ানেরা রাগিয়া ওঠে, রামনিইরা সিং দু-চারজনকে গলাধাক্কা দিতে যায়। তখন হয় বুড়ো খাজাঞ্চি মহাশয়, নয়তো গিরীশ গোমস্ত আসিয়া ব্যাপারটা মিটাইয়া দেয়। প্রায় কোন রবিবারই ভিখারি-বিদায় ব্যাপারটা বিনা গোলমালে নিষ্পন্ন হয় না।

রান্না-বাড়িতে কি একটা লইয়া এতক্ষণ রাঁধুনীদের মধ্যে বাচসা চলিতেছিল। রাঁধুনী বামনী মোক্ষদা থালায় নিজের ভাত সাজাইয়া লইয়া রণে ভঙ্গ দিয়া সরিয়া পড়াতে সেখানকার গোলমালও একটু কমিল। রাঁধুনীদের মধ্যে সর্বজয়ার বয়স অপেক্ষাকৃত কম-বড়োলোকের বাড়ি—শহর-বাজার জায়গা, পাড়াগোঁয়ে মেয়ে বলিয়া ইহাদের এসব কথাবার্তায় সে বড়ো একটা থাকে না। তবুও মোক্ষদা বামনী তাঁহাকে মধ্যস্থ মানিয়া সদু-ঝিয়ের কি অবিচারের কথা সবিস্তারে বর্ণনা করিতেছিল। যখন যে দলে থাকে, তখন সে দলের মন জোগাইয়া কথা বলাটা সর্বজয়ার একটা অভ্যাস, এজন্য তাহার উপর কাহারও রাগ নাই। মোক্ষদা সরিয়া পড়ার পর সর্বজয়াও নিজের ভাত বাড়িয়া লইয়া তাহার থাকিবার ছোট ঘরটাতে ফিরিল। এ বাড়িতে প্রথম আসিয়া বছর-দুই ঠাকুরদালানের পাশের যে ঘরটাতে সে থাকিত, এ ঘরটা সেটা নয়; তাহারই সামনাসামনি পশ্চিমের বারান্দার কোণের ঘরটাতে সে এখন থাকে-সেই রকমই অন্ধকার, সেই ধরনেরই স্যাঁতসেঁতে মেজে, তবে সে ঘরটার মতো ইহার পাশে আস্তাবল নাই, এই একটু সুবিধার কথা।

সর্বজয়া তখনও ভালো করিয়া ভাতের থালা ঘরের মেজেতে নামায় নাই, এমন সময় সদু-ঝি অগ্নিমূর্তি হইয়া ঘরের মধ্যে ঢুকিল।

—বলি, মুখি বামনী কী পরিচয় দিচ্ছিল তোমার কাছে শুনি? বদমায়েশ মাগী কোথাকার, আমার নামে যখন-তখন যার-তার কাছে লাগিয়ে করবে কি জিগ্যেস করি? বলে দেয় যেন বড়ো বৌরানীর কাছে—যায় যেন বলতে-তুমিও দেখে নিয়ো বলে দিচ্ছি বাছা, আমি যদি গিন্নিমার কাছে বলে ওকে এ বাড়ি থেকে না তাড়াই তবে আমি রামনিধি ভড়ের মেয়ে নই-নই-নই-এই তোমায় বলে দিলুম।

সর্বজয়া হাসিমুখে বলিল, না সদু-মাসি, সে বললেই অমনি আমি শুনবো কেন? তা ছাড়া ওর স্বভাব তো জানো-ওই রকম, ওর মনে কোন রাগ নেই, মুখে হাউ-হাউ করে বকে-এমন তো কিছু বলেও নি।–আর তা ছাড়া আমি আজ দু-মাস দশ মাস তো নয়, তোমায় দেখচি আজ তিন বছর-বললেই কি আর আমি শুনি? তিন বচ্ছর এ বাড়িতে ঢুকিচি, কই তোমার নামে–

সদু-ঝি একটু নরম হইয়া বলিল, অপু কোথায়, দেখচি নে-আজ তো রবিবার-ইস্কুল তো আজি বন্দ—

সর্বজয়া প্রতিদিন রান্নাঘরের কাজ সারিয়া আসিয়া তবে স্নান করে,  তেলের বাটিতে বোতল হইতে নারিকেল তৈল ঢালিতে ঢালিতে বলিল, কোথায় বেরিয়েচে। ওই শেঠেদের বাড়ির পাশে কোন এক বন্ধুর বাড়ি, সেখানে ছুটির দিন যায় বেড়াতে। তাই বুঝি বেরিয়েচে। ছেলে তো নয়, একটা পাগল-দুপুর রোদুর রোজ মাথার ওপর দিয়ে যাওয়া চাই তার। দাঁড়িয়ে কেন, বোসো না মাসি! সদু বলিল, না, তুমি খাও, আর বসবো না-ভাবলুম, যাই কথাটা গিয়ে শুনে আসি, তাই এলুম। বোলো ওবেলা মুখি বামনীকে, একটু বুঝিয়ে দিয়ো-খোকাবাবুর ভাতে সেই দইয়ের হ্যাঁড়ি বৈ-করা মনে নেই বুঝি? সদুর পেটে অনেক কথা আছে, বুঝলে? দেখতেই ভালোমানুষটি, বোলো বুঝিয়ে–

সদু-ঝি চলিয়া গেলে সর্বজয়া তেল মাখিতে বসিল। একটু পরে দোরের কাছে পায়ের শব্দে মুখ তুলিয়া চাহিয়া দেখিয়া বলিল, ওঃ, রোদ্দুরে ঘুরে তোর মুখ যে একেবারে রাঙা হয়ে গিয়েচে! বোস বোস-আয়-ওমা আমার কি হবে।

অপু ঘরের ভিতর ঢুকিয়া একেবারে সোজা বিছানায় গিয়া একটা বালিশ টানিয়া শুইয়া পড়িল। হাত-পাখ্যাখানা সজোরে নাড়িয়া মিনিটখানেক বাতাস খাইয়া লইয়া মায়ের দিকে চাহিয়া বলিল, এখনও নাও নি? বেলা তো দুটো–

সর্বজয়া বলিল, ভাত খাবি দুটো—

অপু ঘাড় নাড়িয়া বলিল, না—

–খা না দুটোখানি? ভালো ছানার ডালনা আছে, সকালে শুধু তো ডাল আর বেগুনভাজা দিয়ে খেয়ে গিাইচিস। ক্ষিদে পেয়েচে আবার এতক্ষণ–

অপু বলিল, দেখি কেমন?

পরে সে  বিছানা হইতে উঠিয়া আসিয়া মেজেতে ভাতের থালার ঢাকনি উঠাইতে গেল। সর্বজয়া বলিল, ছুঁস নে, ষ্টুস নো-থাক এখন, নেয়ে এসে দেখাচ্চি।

অপু হাসিয়া বলিল, ছুঁস নে ছুঁস নে কেন? কেন? আমি বুঝি মুচি? ব্রাহ্মণকে বুঝি অমনি বলতে আছে? পাপ হয় না?

—যা হয় হবে। ভারি। আমার বামুন, সন্ধে নেই, আহ্নিক নেই, বাচবিচের জ্ঞান নেই, এঁটো জ্ঞান নেই।–ভারি আমার–

খানিকটা পরে সর্বজয়া স্নান সারিয়া আসিয়া ছেলেকে বলিল, আমার পাতে বসিস এখন।

অপু মুখে হাসি টিপিয়া বলিল, আমি কাবুর পাতে বসচি নে, ব্রাহ্মাণের খেতে নেই কারুর এঁটো।

সর্বজয়া খাইতে বসিলে অপু মায়ের মুখের দিকে চাহিয়া সুর নিচু করিয়া বলিল, আজ এক জায়গায় একটা চাকরির কথা বলেচে মা একজন। ইস্টিশানের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে, গাড়ি যখন এসে লাগবে-লোকেদের কাছে নতুন পাঁজি বিক্রি করতে হবে। পাঁচটাকা মাইনে আর জলখাবার। ইস্কুলে পড়তে পড়তেও হবে। একজন বলছিল।

ছেলে যে চাকুরির কথা একে ওকে জিজ্ঞাসা করিয়া বেড়ায় সর্বজয়া একথা জানে। চাকুরি হইলে সে মন্দ কথা নয়, কিন্তু অপুর মুখে চাকুরির কথা তাহার মোটেই ভালো লাগে না। সে তো এমন কিছু বড়ো হয় নাই। তাহা ছাড়া রৌদ্র আছে, বৃষ্টি আছে। শহর-বাজার জায়গা, পথে ঘাটে গাড়ি-ঘোড়া-কত বিপদ! অত বিপদের মুখে ছেলেকে ছাড়িয়া দিতে সে রাজি নয়।

সর্বজয়া কথাটা তেমন গায়ে মাখিল না। ছেলেকে বলিল, আয় বোস পাতে-হয়েচে, আমার। আয়—

অপু খাইতে বসিয়া বলিল, বেশ ভালো হয়, না মা? পাঁচ টাকা করে মইনে। তুমি জমিয়ো। তারপর মাইনে বাড়াবে বলেচে। আমার বন্ধু সতীনদের বাড়ির পাশে খোলার ঘর ভাড়া আছে দুটাকা মাসে। সেখানে আমরা যাবো-এদের বাড়ি তোমার যা খাটুনি! ইস্কুল থেকে আমনি চলে যাবো ইস্টিশানে-খাবার সেখানেই খাবো। কেমন তো?

সর্বজয়া বলিল-বুট করে দেবো, বেঁধে নিয়ে যাস।

 

দিন দশেক কাটিয়া গেল। আর কোন কথাবার্তা কোনো পক্ষেই উঠিল না। তাহার পর বড়োবাবু হঠাৎ অসুস্থ হইয়া পড়িলেন এবং অত্যন্ত সঙ্গীন ও সংকটাপন্ন অবস্থার ভিতর দিয়া তাঁহার দিন-পনেরো কাটিল। বাড়িতে সকলের মুখে ঝি-চাকর দারোয়ানের মুখে বড়োবাবুর অসুখের বিভিন্ন অবস্থার কথা ছাড়া আর অন্য কথা নাই।

বড়োবাবু সামলাইয়া উঠিবার দিনকয়েক পর একদিন অপু আসিয়া হাসি-হাসি মুখে মাকে বলিল, আজ মা, বুঝলে, একটা ঘুড়ির দোকানে বলেচে যদি আমি বসে বসে ঘুড়ি জুড়ে দি আঠা দিয়ে, তারা সাত টাকা করে মাইনে আর রোজ দু-খানা করে ঘুড়ি দেবে। মস্ত ঘুড়ির দোকান, ঘুড়ি তৈরি করে  কলকাতায় চালান দেয়-সোমবারে যেতে বলেচে–

এ আশার দৃষ্টি এ হাসি এ সব জিনিস সর্বজয়ার অপরিচিত নয়। দেশে নিশ্চিন্দিপুরের ভিটাতে থাকিতে কতদিন, দীর্ঘ পনেরো-ষোল বৎসব ধরিয়া মাঝে মাঝে কতবার স্বামীর মুখে এই ধরনের কথা সে শুনিয়াছে। এই সুর, এই কথার ভঙ্গি সে চেনে। এইবার একটা কিছু লাগিয়া যাইবেএইবার ঘটিল, অল্পই দেরি। নিশ্চিন্দিপুরের যথাসর্বস্ব বিক্ৰয় করিয়া পথে বাহির হওয়ার মূলেও সেই সুরেরই মোহ।

চারি বৎসর এখনও পূর্ণ হয় নাই, এই দশা ইহাব মধ্যে। কিন্তু সর্বজয়া চিনিয়াও চিনিল না। আজ বহুদিন ধরিয়া তাহার নিজের গৃহ বলিয়া কিছু নাই, অথচ নারীর অস্তনিহিত নীড় বাঁধিবার পিপাসটুকু ভিতবে ভিতরে তাহাকে পীড়া দেয়। অবলম্বন যতই তুচ্ছ ও ক্ষণভঙ্গুর হউক, মন তাঁহাই আঁকড়াইয়া ধরিতে ছুটিয়া যায়, নিজেকে ভুলাইতে চেষ্টা করে।

তাহা ছাড়া পুত্রের অনভিজ্ঞ মনের তরুণ উল্লাসকে পরিণত বয়সের অভিজ্ঞতাব চাপে শ্বাসরোধ করিয়া মারিতে মায়াও হয়।

সে বলিল, তা যাস না সোমবারে! বেশ তো,-দেখে আসিস। হ্যাঁ শুনিস নি, মেজ বৌরানী যে শিগগির আসচেন, আজ শূনছিলাম রান্না-বাড়িতে

অপুর চোখ-মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হইয়া উঠিল, আগ্রহের সুরে জিজ্ঞাসা করিল, কবে মা, কবে?

–এই মাসের মধ্যেই আসবেন। বড়োবাবুর শরীর খারাপ, কাজ-টাজ দেখতে পারেন না, তাই মেজবাবু এসে থাকবেন দিন-কতক।

লীলা আসিবে কি-না একথা দুই-দুইবার মাকে বলি বলি করিয়াও কি জানি কেন সে শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞাসা করিতে পারিল না। বাহিরে যাইতে যাইতে মনে মনে ভাবিল, তাদের বাড়িতে সবাই আসচে, মা বাবা আসচে, আর সে কি সেখানে পড়ে থাকবে? সে-ও আসবে।-ঠিক আসবে।

পরদিন সে স্কুল হইতে ফিরিয়া তাহদের ঘরটাতে ঢুকিতেই তাহার মা বলিল, অপু, আগে খাবার খেয়ে নে। আজ একখানা চিঠি এসেচে, দেখাচ্চি।

আমার আশেপাশের সেরা রেস্টুরেন্ট

অপু বিস্মিতমুখে বলিল, চিঠি? কোথায়? কে দিয়েচে মা?

কাশীতে তাহার বাবার মৃত্যুর পর হইতে এ পর্যন্ত আজি আড়াই বৎসরের উপর এ বাড়িতে তাহারা আসিয়াছে, কই, কেহ তো একখানা পোস্টকর্ডে একছত্ৰ লিখিয়া তাহাদের খোঁজ করে নাই? লোকের যে পত্র আসে, একথা তাহারা তো ভুলিয়াই গিয়াছে!

সে বলিল, কই দেখি?

পত্ৰ-তা আবার খামে। খামিটার উপরে মায়ের নাম লেখা। সে তাড়াতাড়ি পত্ৰখানা খাম হইতে বাহির করিয়া অধীর আগ্রহের সহিত সেখানাকে পড়িতে লাগিল। পড়া শেষ করিয়া বুঝিতেনা-পারার দৃষ্টিতে মায়ের মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, ভবতারণ চক্রবর্তী কে মা?—পরে পত্রের উপরকার ঠিকানাটা আর একবার দেখিয়া বলিল, কাশী থেকে লিখেচে।

সর্বজয়া বলিল, তুই তো ওঁকে নিচিন্দিপুরে দেখেচিস!—সেই সেবার গেলেন, দুয়াকে পুতুলের বাক্স কিনে দিয়ে গেলেন, তুই তখন সাত বছরের। মনে নেই তোর? তিনদিন ছিলেন আমাদের বাড়ি।

–জানি মা, দিদি বলতো তোমার জ্যাঠামশায় হন-না? তা এতদিন তো আর কোনও—

–আপন নয়, দূর সম্পর্কের। জ্যাঠামশায় তো দেশে বড়ো-একটা থাকতেন না, কাশী-গয়া, ঠাকুর-দেবতার জায়গায় ঘুরে ঘুরে বেড়াতেন, এখনও বেড়ান। ওঁদের দেশ হচ্চে মনসাপোতা, আড়ংঘাটার কাছে। সেখেন থেকে ক্রোশ দুই-সেবার আড়ংঘাটায় যুগল দেখতে গিয়ে ওঁদের বাড়ি গিয়ে ছিলাম দু-দিন। বাড়িতে মেয়ে-জামাই থাকত। সে মেয়ে-জামাই তো লিখেচেন মারা গিয়েচেছেলেপিলে কাবুর নেই–

অপু বলিল, হ্যাঁ, তাই তো লিখেচেন। নিশ্চিন্দিপুরে গিয়ে আমাদের খোজ করেচেন। সেখানে শূনেচেন কাশী গিাইচি। তারপর কাশীতে গিয়ে আমাদের সব খবর জেনেচেনি। এখানকার ঠিকানা নিয়েচেন বোধ হয়। রামকৃষ্ণ মিশন থেকে।

সর্বজয়া হাসিয়া বলিল-আমি দুপুরবেলা খেয়ে একটু বলি গড়াই—ক্ষেমিঝি বললে তোমার একখানা চিঠি আছে। হাতে নিয়ে দেখি আমার নাম-আমি তো অবাক হয়ে গেলাম। তারপব খুলে পড়ে দেখি এই—নিতে আসবেন লিখচেন শিগগির। দ্যাখা দিকি, কবে আসবেন লেখা আছে কিছু?

অপু বলিল, বেশ হয়, না মা? এদের এখেনে একদণ্ড ভালো লাগে না। তোমার খাটুনিটা কমে-সেই সকালে উঠে রান্না-বাড়ি ঢোকো, আর দুটো তিনটে–

ব্যাপারটা এখনও সর্বজয়া বিশ্বাস করে নাই। আবার গৃহ মিলিবে, আশ্রয় মিলিবে, নিজের মনোমতো ঘর গড়া চলিবে! বড়োলোকের বাড়ির এ রাঁধুনীবৃত্তি, এ ছন্নছাড়া জীবনযাত্রায় কি এতদিনে-বিশ্বাস হয় না। অদৃষ্ট তেমন নয় বলিয়া ভয় কবে।

তাহার পর দু-জনে মিলিয়া নানা কথাবার্তা চলিল। জ্যাঠামশায় কি রকম লোক, সেখানে যাওয়া ঘটিলে কেমন হয়,–নানা কথা, উঠিবার সময় অপু বলিল-শেঠেদের বাড়িব পাশে কাঠগোলায় পুতুলনাচ হবে একটু পরে। দেখে আসবো মা?

–সকাল সকাল ফিরবি, যেন ফটক বন্ধ করে দেয় না, দেখিস—

পথে যাইতে যাইতে খুশিতে তাহার গা কেমন করিতে লাগিল। মন যেন শোলার মতো হালকা। মুক্তি, এতদিন পরে মুক্তি! কিন্তু লীলা যে আসিতেছে? পুতুলনাচের আসরে বসিয়া কেবলই লীলার কথা মনে হইতে লাগিল। লীলা আসিয়া তাহার সহিত মিশিবে তো? হয়তো এখন বড়ো হইয়াছে, হয়তো আর তাহার সঙ্গে কথা বলিবে না।

পুতুলনাচ আরম্ভ হইতে অনেক দেরি হইয়া গেল। না দেখিয়াও সে যাইতে পারিল না। অনেক রাত্রে যখন আসর ভাঙিয়া গেল, তখন তাহার মনে পড়িল, এত রাত্রে বাড়ি ঢোকা যাইবে না, ফটক বন্ধ করিয়া দিয়াছে, বড়োলোকের বাড়ির দারোয়ানেরা কেহ তাহার জন্য গরজ করিয়া ফটক খুলিয়া দিবে না। সঙ্গে সঙ্গে বড়ো ভয়ও হইল। রাত্ৰিতে এ রকম একা সে বাড়ির বাহিরে কাটায় নাই। কোথায় এখন সে থাকে? মা-ই বা কি বলিবে!

আসরের সব লোক চলিয়া গেল। আসরের কোণে একটা পান-লেমনেডের দোকানো তখনও বেচা-কেনা চলিতেছে। সেখানে একটা কাঠের বাক্সের উপর সে চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। তারপর কখন সে ঘুমাইয়া পড়িয়াছে জানে না, ঘুম ভাঙিয়া দেখিল ভোর হইয়া গিয়াছে, পথে লোক চলাচল আরম্ভ হইয়াছে।

সে একটু বেলা করিয়া বাড়ি ফিরিল। ফটকের কাছে বাড়ির গাড়ি দুইখানি তৈয়ার হইয়া দাঁড়াইয়া আছে। দেউড়িতে ঢুকিয়া খানিকটা আসিয়া দেখিল বাড়ির তিন-চার জন ছেলে সাজিয়া গুজিয়া কোথায় চলিয়াছে। নিজেদের ঘরের সামনে নিস্তারিণী বিকে পাইয়া জিজ্ঞাসা করিল, মাসিম, এত সকালে গাড়ি যাচ্ছে কোথায়? মেজবাবুরা কি আজকে আসবে?

নিস্তারিণী বলিল, তাই তো পুনছি। কাল চিঠি এসেচে-শুধু মেজবাবু আর বৌরানী আসবে, লীলা দিদিমণি এখন আসবেন না-ইস্কুলের এগজামিন। সেই বড়োদিনের সময় তবে আসবে। গিন্নিমা বলছিলেন বিকেলে–

অপুর মনটা একমুহূর্তে দমিয়া গেল। লীলা আসিবে না! বড়োদিনের ছুটিতে আসিলেই বা কি-সে তো তাহার আগে এখান হইতে চলিয়া যাইবে। যাইবার আগে একবার দেখা হইয়া যাইত এই সময় আসিলে। কতদিন সে আসে নাই।

তাহার মা বলিল, বেশ ছেলে তো, কোথায় ছিলি রাত্তিরে? আমার ভেবে সারারাত চোখের পাতা বোজেনি কাল।

অপু বলিল, রাত বেশি হয়ে গেল, ফটক বন্ধ করে দেবে জানি, তাই আমার এক বন্ধু ছিল, আমার সঙ্গে পড়ে, তাদেরই বাড়িতে-। পরে হাসিয়া ফেলিয়া বলিল, না মা, সেখানে পানের দোকানে একটা কেরোসিন কাঠের বাক্স পড়ে ছিল, তার উপর শুয়ে–

সর্বজয়া বলিল, ওমা, আমার কি হবে। এই সারারাত ঠাণ্ডায় সেখেনে-লক্ষ্মীছাড়া ছেলে, যেয়ো তুমি ফের কোনদিন সন্দেব পর কোথাও-তোমার বড়ো ইয়ে হয়েচে, না?

অপু হাসিয়া বলিল-তা আমি কি করে ঢুকবো বলো না? ফটিক ভেঙে ঢুকবো?

রাগটা একটু কমিয়া আসিলে সর্বজয়া বলিল-তারপর জ্যাঠামশায় তো কাল এসেচেন। তুই বেরিয়ে গেলে একটু পরেই এলেন, তোর খোঁজ করলেন, আজ ওবেলা আবার আসবেন। বললেন, এখেনে কোথায় তার জানাশশুনো লোক আছে, তাদের বাড়ি থাকবেন। এদের বাড়ি থাকবার অসুবিধে-পবণ্ড নিয়ে যেতে চাচ্চেন।

অপু বলিল, সত্যি? কি কি বলো না মা, কি সব কথা হল?

আগ্রহে অপু মায়ের পাশে চৌকির ধারে বসিয়া পড়িয়া মায়ের মুখের দিকে চাহিল। দু-জনের অনেক কথাবার্তা হইল। জ্যাঠামশায় বলিয়াছেন, তাহার। আর কেহ নাই, ইহাদেবীই উপর সব ভার দিয়া তিনি কাশী যাইবেন। অনেকদিন পরে সংসার পাতিবার আশায় সর্বজয়া আনন্দে উৎফুল্প। ইহাদের বাড়ি হইতে নানা টুকটাক গৃহস্থালিব প্রযোজনীয় জিনিস নানা সময় সংগ্ৰহ করিযা সযত্নে বাখিযা দিয়াছে। একটা বড়ো টিনের টেমি দেখাইয়া বলিল, সেখেনে রান্নাঘবে জ্বালবো-কত বড়ো লম্পটা দেখেচিস? দু-পয়সোব  তেল ধবে।

 

দুপুরের পব সে মায়ের পাতে ভাত খাইতে বসিয়াচে, এমন সময় দুয়ারের সামনে কাহার ছায়া পড়িল। চাহিয়া দেখিয়া সে ভাতের গ্রাস আর মুখে তুলিতে পারিল না।

লীলা!

পরীক্ষণেই লীলা হাসিমুখে ঘরে ঢুকিল; কিন্তু অপুর দিকে চাহিয়া সে যেন একটু অবাক হইযা গেল। অপুকে যেন আর চেনা যায় না।-সে তো দেখিতে বরাববই সুন্দব, কিন্তু এই দেড় বৎসরে কি হইয়া উঠিয়াছে সে? কি গায়ের রং, কি মুখের শ্ৰী, কি সুন্দর স্বপ্ন-মাখা চোখদুটি! লীলার যেন একটু লজ্জা হইল। বলিল, উঃ, আগের চেয়ে মাথাতে কত বড়ো হয়ে গিয়েচ!

লীলার সম্বন্ধেও অপুর ঠিক সেই কথাই মনে হইল। এ যেন সে লীলা নয়, যাহার সঙ্গে সে দেড় বৎসর পূর্বে অবাধে মিলিয়া মিশিয়া কত গল্প ও খেলা করিয়াছে। তাহার তো মনে হয় না। লীলার মতো সুন্দরী মেয়ে সে কোথাও দেখিয়াছে।–রানুদিও নয়। খানিকক্ষণ সে যেন চোখ ফিরাইতে পারিল না।

দুজনেই যেন একটু সংকোচ বোধ করিতে লাগিল।

অপু বলিল, তুমি কি করে এলে? আমি আজ সকালেও জিজ্ঞেস করিচি। নিস্তারিণী মাসি বললে, তুমি আসবে না, এখন স্কুলের ছুটি নেই-সেই বড়োদিনের সময় নাকি আসবে?

লীলা বলিল, আমার কথা তোমার মনে ছিল?

–না, তা কেন? তারপর এতদিন পরে বুঝি-বেশ-একেবারে ড়ুমুরের ফুল-

–ড়ুমুরের ফুল আমি, না তুমি? খোকামণির ভাতের সময় তোমাকে যাওয়ার জন্যে চিঠি লেখোলাম ঠাকুরমায়ের কাছে, এ বাড়ির সবাই গেল, যাও নি কেন?

অপু এসব কথা কিছুই জানে না। তাহাকে কেহ বলে নাই। জিজ্ঞাসা করিল, খোকামণি কে?

লীলা বলিল, বাঃ, আমার ভাই! জানো না?…এই এক বছরের হলো।

লীলার জন্য অপুর মনে একটু দুঃখ হইল। লীলা জানে না। যাহাকে সে এত আগ্ৰহ করিয়া ভাইয়ের অন্নপ্রাশনে নিমন্ত্রণ করিয়াছিল, এ বাড়িতে তাহার স্থান কোথায় বা অবস্থা কি। সে বলিলদেড় বছর আসো নি-না? পড়চ কোন ক্লাসে?

লীলা তক্তপোশের কোণে বসিয়া পড়িল। বলিল, আমি আমার কথা কিছু বলবো না আগে– আগে তোমার কথা বলো। তোমার মা ভালো আছেন? তুমিও তো পড়ো-না?

-আমি এবারে মাইনর ক্লাসে উঠবো-পরে একটু গর্বিতমুখে বলিল, আর বছর ফাস্ট হয়ে ক্লাসে উঠেচি, প্রাইজ দিয়েচে।

লীলা অপুর দিকে চাহিল। বেলা তিনটার কম নয়। এত বেলায় সে খাইতে বসিয়াছে! বিস্ময়ের সুরে বলিল, এখন খেতে বসেচ, এত বেলায়?

অপুর লজ্জা হইল। সে সকালে সরকারদের ঘরে বসিয়া খাইয়া স্কুলে যায়—শুধু ডালভাত-তাও শ্ৰীকণ্ঠ ঠাকুর বেগার-শোধ ভাবে দিয়া যায়, খাইয়া পেট ভরে না, স্কুলেই ক্ষুধা পায়, সেখান হইতে ফিরিয়া মায়ের পাতে ভাত ঢাকা থাকে, বৈকালে তাঁহাই খায়। আজ ছুটির দিন বলিয়া সকালেই মায়ের পাতে খাইতে বসিয়াছে।

অপু ভালো করিয়া উত্তর দিতে পারিল না বটে, কিন্তু লীলা ব্যাপারটা কতক না বুঝিল এমন নহে। ঘরের হীন আসবাব-পত্র, অপুর হীন বেশ-অবেলায় নিরুপকরণ দুটি ভাত সাগ্রহে খাওয়া– লীলার কেন যেন মনে বড়ো বিঁধিল। সে কোন কথা বলিল না।

অপু বলিল, তোমার সব বই এনেচ। এখেনে? দেখাতে হবে আমাকে। ভালো গল্প কি ছবির বই নেই?

লীলা বলিল, তোমার জন্যে কিনে এনেচি আসিবার সময়। তুমি গল্পের বই ভালোবাসো বলে একখানা সাগরের কথা’ এনেচি, আরও দু-তিনখানা এনেচি, আনচি, তুমি খেয়ে ওঠে।

অপুর খাওয়া প্রায় শেষ হইয়াছিল, খুশিতে বাকিটা কোনোরকমে শেষ করিয়া উঠিয়া পড়িল। লীলা লক্ষ করিয়া দেখিল, সে পাতের সবটা এমন করিয়া খাইয়াছে, পাতে একটা দানাও পড়িয়া নাই। সঙ্গে সঙ্গে তাহার উপর লীলার কেমন একটা অপুর্ব মনের ভাব হইল-সে ধরনের অনুভূতি লীলার জীবনে এই প্রথম, আর কাহারও সম্পর্কে সে ধরনের কিছু তো কখনও হয়। নাই।

একটু পরে লীলা অনেক বই আনিল। অপুর মনে হইল, লীলা কেমন করিয়া তাহার মনের কথাটি জানিয়া, সে যাহা পড়িতে জানিতে ভালোবাসে সেই ধরনের বইগুলি আনিয়াছে। সাগরের কথা’ বইখানাতে অদ্ভুত অদ্ভুত গল্প। সাগরের তলায় বড়ো বড়ো পাহাড় আছে, আগ্নেয়গিরি আছে, প্রবাল নামক এক প্রকার প্রাণী আছে, দেখিতে গাছপালার মতো-কোথায় এক মহাদেশ নাকি সমুদ্রের গর্ভে ড়ুবিয়া আছে-এই সব।

লীলা একখানা পুরাতন খাতা দেখাইল। তাহার ঝোঁক ছবি আঁকিবার দিকে; বলিল-সেই তোমায় একবার ফুলগাছ একে দেখতে দিলাম মনে আছে? তারপর কত একেচি দেখবে?

অপুর মনে হইল লীলার হাতের আঁকা আগের চেয়ে এখন ভালো হইয়াছে। সে নিজে একটা রেখা কখনও সোজা করিয়া টানিতে পারে না-ড্রইংগুলি দেখিতে দেখিতে লীলার দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিল, বেশ এঁকেচো তো। তোমাদের ইস্কুলে করায়, না এমনি আঁকো?

এতক্ষণ পরে অপুর মনে পড়িল লীলা কোন স্কুলে পড়ে, কোন ক্লাসে পড়ে সে কথা কিছুই জিজ্ঞাসা করা হয় নাই। বলিল-তোমাদের কি ইস্কুল? এবার কোন ক্লাসে পড়চো?

-এবার মাইনর সেকেন্ড ক্লাসে উঠেছি-গিরীন্দ্রমোহিনী গার্লস স্কুল—আমাদের বাড়ির পাশেই–

অপু বলিল, জিজ্ঞেস করবো?

লীলা হাসি মুখে ঘাড় নাড়িয়া চুপ করিয়া রহিল।

অপু বলিল, আচ্ছা বলো-চট্টগ্রাম কর্ণফুলির মোহনায়-কি ইংরেজি হবে?

লীলা ভাবিয়া বলিল, চিটাগং ইজ অন দি মাউথ অফ দি কর্ণফুলি।

অপু বলিল, ক’জন মাস্টার তোমাদের সেখেনে?

-আটজন, হেড মিস্ট্রেস এন্ট্রান্স পাশ, আমাদের গ্রামার পড়ান। পরে সে বলিল-মা’র সঙ্গে দেখা করবে না?

-এখন যাবো, না একটু পরে যাবো? বিকেলে যাবো এখন, সেই ভালো।

তাহার পরে সে একটু থামিয়া বলিল, তুমি শোনো নি লীলা, আমরা যে এখান থেকে চলে যাচি!

লীলা আশ্চর্য হইয়া অপুর দিকে চাহিল। বলিল-কোথায়?

–আমার এক দাদামশায় আছেন, তিনি এতদিন পরে আমাদের খোঁজ পেয়ে তাদের দেশের বাড়িতে নিয়ে যেতে এসেছেন।

অপু সংক্ষেপে সব বলিল।

লীলা বলিয়া উঠিল-চলে যাবে? বাঃ রে!

হয়তো সে কি আপত্তি করিতে যাইতেছিল, কিন্তু পরীক্ষণেই বুঝিল, যাওয়া না-যাওয়ার উপর অপুর তো কোনও হাত নাই, কোনও কথাই এক্ষেত্রে বলা চলিতে পারে না।

খানিকক্ষণ কেহই কথা বলিল না।

লীলা বলিল, তুমি বেশ এখানে থেকে ইস্কুলে পড়ো না কেন? সেখানে কি ইস্কুল আছে? পড়বে কোথায়? সে তো পাড়াগা।

—আমি থাকতে পারি। কিন্তু মা তো আমায়। এখেনে রেখে থাকতে পারবে না, নইলে আর কি–

–না হয় এক কাজ করো না কেন?  কলকাতায় আমাদের বাড়ি থেকে পড়বে। আমি মাকে বলবো, অপূর্ব আমাদের বাড়িতে থাকবে; বেশ সুবিধে—আমাদের বাড়ির সামনে আজকাল ইলেকট্রিক ট্রাম হয়েছে—এঞ্জিনও নেই, ঘোড়াও নেই, এমনি চলে-তারের মধ্যে বিদ্যুৎ পোরা আছে, তাতে চলে।

–কি রকম গাড়ি? তারের ওপর দিয়ে চলে?

–একটা ডাণ্ডা আছে। তারে ঠেকে থাকে, তাতেই চলে।  কলকাতা গেলে দেখবে এখনছ-সাত বছর হল ইলেকট্রিক ট্রাম হয়েছে, আগে ঘোড়ায় টানতো–

আরও অনেকক্ষণ দু-জনের কথাবার্তা চলিল।

বৈকালে সর্বজয়ার জ্যাঠামশায় ভবতারণ চক্ৰবর্তী আসিলেন। অপুকে কাছে ডাকিয়া জিজ্ঞাসাবাদ করিলেন। ঠিক করিলেন, দুইদিন পরে বুধবারের দিন লইয়া যাইবেন। অপু দু-একবার ভাবিল লীলার প্রস্তাবটা একবার মায়ের কাছে তোলে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কথাটা আর কার্যে পরিণত হইল না।

 

সকালের রৌদ্র ফুটিয়া উঠিবার সঙ্গে সঙ্গেই উলা স্টেশনে গাড়ি আসিয়া দাঁড়াইল। এখান হইতেই মনসাপোত যাইবার সুবিধা। ভবতারণ চক্ৰবর্তী পূর্ব হইতেই পত্ৰ দিয়া গোরুর গাড়ির ব্যবস্থা করিয়া রাখিয়াছিলেন। কাল রাত্রে একটু কষ্ট হইয়াছিল। এক্সপ্রেস ট্রেনখানা দেরিতে পৌঁছানোর জন্য ব্যান্ডেল হইতে নৈহাটির গাড়িখানা পাওয়া যায় নাই। ফলে বেশি রাত্রে নৈহাটিতে আসিয়া অনেকক্ষণ বসিয়া থাকিতে হইয়াছিল।

সারারাত্রি জাগরণের ফলে অপু কখন ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল সে জানে না। চক্ৰবর্তী মহাশয়ের ডাকে উঠিয়া জানোলা দিয়া মুখ বাড়াইয়া দেখিল একটা স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে গাড়ি লাগিয়াছে। সেখানেই তাদের নামিতে হইবে। কুলিরা ইতিমধ্যে তাহাদের কিছু জিনিসপত্র নামাইয়াছে।

গোবুর গাড়িতে উঠিয়া চক্ৰবর্তী মহাশয় অনবরত তামাক টানিতে লাগিলেন। বয়স সত্তরের কাছাকাছি হইবে, একহারা পাতলা চেহারা, মুখে দাড়ি গোফ নাই, মাথার চুল সব পাকা। বলিলেনজয়া, ঘুম পাচ্ছে না তো?

সর্বজয়া হাসিয়া বলিল, আমি তো নৈহাটিতে ঘুমিয়ে নিইচি আধঘণ্টা, অপুও ঘুমিয়েচে। আপনারই ঘুম হয় নি

চক্ৰবর্তী মহাশয় খুব খানিকটা কাশিয়া লইয়া বলিলেন,-ওঃ, সোজা খোজটা করেছি। তোদের! আর-বছর বোশেখে মেয়েটা গেল মারা, হরিধান তো তার আগেই। এই বয়সে হাত পুড়িয়ে রোধেও খেতে হয়েছে,-কেউ নেই সংসারে। তাই ভাবলাম হরিহর বাবাজীর তো নিশ্চিন্দিপুর থেকে উঠে যাবার ইচ্ছে ছিল অনেকদিন থেকেই, যাই এখানেই নিয়ে আসি। একটু ধানের জমি আছে, গৃহদেবতার সেবাটাও হবে। গ্রামে ব্রাহ্মণ তেমন নেই,–আর আমি তো এখানে থাকব না। আমি একটু কিছু ঠিক করে দিয়েই কাশী চলে যাবো। একরকম করে হরিহর নেবেন চালিয়ে। তাই গেলাম নিশ্চিন্দিপুর–

সর্বজয়া বলিল, আপনি বুঝি আমাদের কাশী যাওয়ার কথা শোনেননি?

—তা কি করে শুনবো? তোমাদের দেশে গিয়ে শুনলাম তোমরা নেই। সেখানে। কেউ তোমাদের কথা বলতে পারে না-সবাই বলে তারা এখান থেকে বেচে-কিনে তিন-চার বছর হল কাশী চলে গিয়েছে। তখন কাশী যাই। কাশী আমি আছি আজ দশ বছর। খুঁজতেই সব বেরিয়ে পড়লো। হিসেব করে দেখলাম হরিহর যখন মারা যান, তখন আমিও কাশীতেই আছি, অথচ কখনও দেখাশুনো হয় নি, তা হলে কি আর–

অপু আগ্রহের সুরে বলিল, নিশ্চিন্দিপুরে আমাদের বাড়িটা কেমন আচে, দাদামশায়?

–সেদিকে আমি গোলাম কাই! পথেই সব খবর পেলাম কি-না। আমি আর সেখানে দাঁড়াই নি। কেউ ঠিকানা দিতে পারলে না। ভুবন মুখুজ্যে মশায় অবিশ্যি খাওয়া-দাওয়া করতে বললেন, আর তোমার বাপের একশো নিন্দে-বুদ্ধি নেই, সাংসারিক জ্ঞান নেই।–হেন তেন। যাক সেসব কথা, তোমরা এলে ভালো হল। যে ক’ঘর যজমান আছে তোমাদের বছর তাতে কেটে যাবে। পাশেই তেলিরা বেশ অবস্থাপন্ন, তাদের ঠাকুর প্রতিষ্ঠা আছে। আমি পুজোটুজো করতাম অবিশ্যি, সেটাও হাতে নিতে হবে ক্ৰমে। তোমাদের নিজেদের জিনিস দেখে শূনে নিতে হবে–

উলা গ্রামের মধ্যেও খুব বন, গ্রাম ছাড়াইয়া মাঠের পথেও বনঝোপ। সূৰ্য আকাশে অনেকখানি উঠিয়া গিয়াছে, চারিধারে প্রভাতী রৌদ্রের মেলা। পথের ধারে বনতুলসীর জঙ্গল, মাঠের ঘাসে এখনও স্থানে স্থানে শিশির জমিয়া আছে, কোন বুপকথার দেশের মাকড়সা যেন বুপলি জাল বুনিয়া রাখিয়াছে। মাঝে মাঝে কিসের একটা গন্ধ, বিশেষ কোনও ফুল ফলের গন্ধ নয়। কিন্তু। শিশিরসিক্ত ঘাস, সকালের বাতাস, অড়হরের ক্ষেত, এখানে ওখানে বনজ গাছপালা, সবসুদ্ধ মিলাইয়া একটা সুন্দর সুগন্ধ।

অনেকদিন পরে এই সব গাছপালার প্রথম দৰ্শন অপুর প্রাণে একটা উল্লাসের ঢেউ উঠিল। অপূর্ব অদ্ভুত, সুতীব্র; মিনমিনে ধরনের নয়, পানসে গানসে জোলো ধরনের নয়। অপুর মন সে শ্রেণীরই নয় আদৌ, তাহা সেই শ্রেণীর যাহা জীবনের সকল অবদানকে, ঐশ্বর্যকে প্ৰাণপণে নিংড়াইয়া চুযিয়া আঁটিসার করিয়া খাইবার ক্ষমতা রাখে। অল্পেই নাচিয়া ওঠে, অল্পে দমিয়াও যায়—যদিও পুনরায় নাচিয়া উঠিতে বেশি বিলম্ব করে না।

মনসাপোতা গ্রামে যখন গাড়ি ঢুকিল তখন বেলা দুপুর। সর্বজয়া ছাইয়ের পিছন দিকের ফাঁক দিয়া চাহিয়া দেখিতেছে তাহার নূতনতম জীবনযাত্রা আরম্ভ করিবার স্থানটা কি রকম। তাহার মনে হইল গ্রামটাতে লোকের বাস একটু বেশি, একটু যেন বেশি ঠেসাঠেসি, ফাকা জায়গা বেশি নাই, গ্রামের মধ্যে বেশি বনজঙ্গলের বালাইও নাই। একটা কাহাদের বাড়ি, বাহির-বাটীর দাওয়ায় জনকয়েক লোক গল্প করিতেছিল, গোরুর গাড়িতে কাহারা আসিতেছে দেখিয়া চাহিয়া চাহিয়া দেখিতে লাগিল। উঠানে বাঁশের আলনায় মাছ ধরিবার জাল শুকাইতে দিয়াছে। বোধ হয়। গ্রামের জেলেপাড়া।

আরও খানিক গিয়া গাড়ি দাঁড়াইল। ছোট্ট উঠানের সামনে একখানি মাঝারি গোছের চালাঘর, দু-খানা ছোট্ট দোচালা ঘর, উঠানে একটা পেয়ারা গাছ ও একপাশে একটা পাতকুয়া। বাড়ির পিছনে একটা তেঁতুল গাছ–তাহার ডালপালা বড়ো চালাঘরখানার উপর ঝুঁকিয়া পড়িয়াছে। সামনের উঠানটা বাঁশের জাফরি দিয়া ঘেরা। চক্ৰবর্তী মহাশয় গাড়ি হইতে নামিলেন। অপু মা’কে হাত ধরিয়া নামাইল।

চক্ৰবর্তী মহাশয় আসিবার সময় যে তেলিবাড়ির উল্লেখ করিয়াছিলেন, বৈকালের দিকে তাহাদের বাড়ির সকলে দেখিতে আসিল। তেলি-গিন্নি খুব মোটা, রং বেজায় কালো। সঙ্গে চারপাঁচটি ছেলেমেয়ে, দুটি পুত্রবধু। প্রায় সকলেরই হাতে মোটা মোটা সোনার অনন্ত দেখিয়া সর্বজয়ার মন সম্রামে পূর্ণ হইয়া উঠিল। ঘরের ভিতর হইতে দু-খানা কুশাসন বাহির করিয়া আনিয়া সলজ্জা ভাবে বলিল, আসুন আসুন, বসুন।

তেলি-গিন্নি পায়েরু ধূলা লইয়া প্ৰণাম করিলে ছেলেমেয়ে ও পুত্রবধুরাও দেখাদেখি তাহাই করিল। তেলি-গিন্নি হাসিমুখে বলিল, দুপুরবেলা এলেন মা-ঠাকরুন। একবার বলি যাই। এই যে পাশেই বাড়ি, তা আসতে পেলাম না। মেজছেলে এলো গোয়াড়ী থেকে-গোয়াড়ীতে দোকান আছে কি-না! মেজ বৌমার মেয়েটাও ন্যাওটো, মা দেখতে ফুরসত পায় না, দুপুরবেলা আমাকে একেবারে পেয়ে বসে-ঘুম পাড়াতে পাড়াতে বেলা দুটো! ঘুঙড়ি কাশি, গুপী কবরেজ বলেছে ময়ূরপুচ্ছ পুড়িয়ে মধু দিয়ে খাওয়াতে। তাই কি সোজাসুজি পুড়ুলে হবে মা, চৌষট্টি ফৈজৎ—কাসার ঘটির মধ্যে পোরো, তা ঘুটের জ্বাল করো, তা টিমে আঁচে চড়াও। হ্যারে হাজরী, ভোঁদা গোয়াড়ী থেকে কাল মধু এনেছে কি-না জানিস?

আঠারো-উনিশ বছরের একটি মেয়ে ঘাড় নাড়িয়া কথাব উত্তর দিবার পূর্বেই তেলি-গিন্নি তাহাকে দেখাইয়া বলিল, ওইটি আমার মেজ মেয়ে-বহরমপুরে বিয়ে দিয়েচি। জামাই বড়োবাজারে এদের দোকানে কাজকর্ম করেন। নিজেদেরও গোলা, দোকান রয়োচে কালনা-বেয়াই সেখানে দেখেন শোনেন। কিন্তু হলে হবে কি মা—এমন কথা ভূভারতে কেউ কখনও শোনে নি। দুই ছেলে, নাতি নাতনী, বেয়ান মারা গেলেন ভাদর মাসে, মাঘ মাসে বুড়ো আবার বিয়ে করে আনলে। এখন ছেলেদের সব দিয়েছে ভেন্ন করে। জামাইয়ের মুশকিল, ছেলেমানুষ-তা। উনি বলেছেন, তা এখন তুমি বাবা আমাদের দোকানেই থাকো, কাজ দেখো শোনো শেখো, ব্যবসাদারের ছেলে, তারপর একটা হিল্পে লাগিয়ে দেওয়া যাবে।

বড়ো পুত্রবধূ এতক্ষণ কথা বলে নাই। সেইহাদের মতো জুড়ু বানিস নয়, বেশ টকটকে রং। বোধ হয় শহর-অঞ্চলের মেয়ে। এ-দলের মধ্যে সেই সুন্দরী, বয়স বাইশ-তেইশ হইবে। সে নিচের ঠোঁটের কেমন চমৎকার এক প্রকার ভঙ্গি করিয়া বলিল, এরা এসেছেন, সারাদিন খাওয়া-দাওয়া হয় নি, এঁদের আজকের সব ব্যবস্থা তো করে দিতে হবে? বেলাও তো গিয়েছে, এঁরা আবার রান্না করবেন!

এই সময় অপু বাড়ির উঠানে ঢুকিল। সে আসিয়াই গ্রামখানা বেড়াইয়া দেখিতে বাহিরে গিয়াছিল। তেলি-গিন্নি বলিল-কে মা-ঠাকরুন? ছেলে বুঝি? এই এক ছেলে? বাঃ, চেহারা যেন রাজপুত্ত্বর।

সকলেরই চোখ তাহার উপর পড়িল। অপু উঠানে ঢুকিয়াই এতগুলি অপরিচিতের সম্মুখে পড়িয়া কিছু লজ্জিত ও সংকুচিত হইয়া উঠিল। পাশ কাটাইয়া ঘরের মধ্যে ঢুকিতেছিল, তাহার মা বলিল, দাঁড়া না। এখেনে। ভারি লাজুক ছেলে মা-এখন ওইটুকুতে দাঁড়িয়েচে-আর এক মেয়ে ছিল, তা-সর্বজয়ার গলার স্বর ভারী হইয়া আসিল। গিন্নি ও বড়ো পুত্রবধূ একসঙ্গে বলিল, নেই, হ্যাঁ মা? সর্বজয়া বলিল, সে কি মেয়ে মা! আমায় ছলতে এসেছিল, কি চুল, কি চোখ, কি মিষ্টি কথা? বকো-ঝাঁকো, গাল দাও, মা’র মুখে উঁচু কথাটি কেউ শোনে নি কোনদিন।

ছোট বউ বলিল, কত বয়সে গেল মা?

–এই তেরোয় পড়েই-ভাদ্র মাসে তেরোয় পড়ল, আশ্বিন মাসের ৭ই-দেখতে দেখতে চার বছর হয়ে গেল।

তেলি-গিন্নি দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়িয়া কহিল-আহা মা, তা কি করবে বলো, সংসারে থাকতে গেলে সবই…তাই উনি বললেন-আমি বললাম। আসুন তারা-চাকতি মশায় পূজা-আচ্চা করেনতা উনি মেয়েজামাই মারা যাওয়ার পর থেকে বড়ো থাকেন না। গায়ে একঘর বামুন নেই।– কাজকর্মে সেই গোয়াড়ী দৌড়তে হয়-থাকলে ভালো! বীরভূম না বাঁকড়ো জেলা থেকে সেবার এলো কি চাটুজ্যে। কি নামটা রে পাঁচী? বললে বাস করবো। বাড়ি থেকে চালডাল সিধে পাঠিয়ে দিই। তিন মাস রইল, বলে আজ ছেলেপিলে আনব্য-কাল ছেলেপিলে আনব-ও মা, এক মাগী গোয়ালার মেয়ে উঠোন ঝাঁট দিত। আমাদের, তা বলি বামুন মানুষ এসেছে, ওঁরাও কাজটা করে দিস।। ঘেন্নার কথা শোনো মা, আবা বছর শিবরাত্রির দিন-তাকে নিয়ে—

বউ-দুটি ও মেয়েরা খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল।

সর্বজয়া অবাক হইয়া বলিল, পালালো নাকি?

–পালালো কি এমন তেমন পালালো মা? সেই সঙ্গে আমাদের এক প্রস্থ বাসন। কিছুই জানি নে মা, সব নিজের ঘর থেকে.বলি আহা বামুন এসেচে-সবুক, আছে বাড়তি। তা সেই বাসন সবসুদ্ধ নিয়ে দুজনে নিউদ্দিশ! যাক সে সব কথা মা, উঠি তাহলে আজ। রান্নার কি আছে না-আছে বলে মা, সব দিই বন্দোবস্ত করে।

 

আট-দশ দিন কাটিয়া গেল; সর্বজয়া ঘরবাড়ি মনের মতো করিয়া সাজাইয়াছে। দেওয়াল উঠান নিকাইয়া পুঁছিয়া লইয়াছে। নিজস্ব ঘরদের অনেকদিন ছিল না, নিশ্চিন্দিপুর ছাড়িয়া অবধিই নাই-এতদিন পরে একটা সংসারের সমস্ত ভার হাতে পাইয়া সে গত চার বৎসরের সঞ্চিত সাধ মিটাইতে ব্যস্ত হইয়া পড়িল।

জ্যাঠামশায় লোক মন্দ নহেন বটে, কিন্তু শীঘ্রই সর্বজয়া দেখিল তিনি একটু বেশি কৃপণ। ক্ৰমে ইহাও বোঝা গেল—তিনি যে নিছক পরার্থপরতার ঝোঁকেই ইহাদের এখানে আনিয়াছেন অহা নহে, অনেকটা আনিয়াছেন নিজের গরজে। তেলিদের প্রতিষ্ঠিত ঠাকুরটি পূজা না করিলে সংসায় ভালো রূপ চলে না, তাহাদের বার্ষিক বৃত্তিও বন্ধ হইয়া যায়। এই বার্ষিক বৃত্তি সম্বল করিয়াই তিনি কাশী থাকেন। পাকা লোক, অনেক ভাবিয়া-চিন্তিয়া তবে তিনি ইহাদের আনিয়া তুলিয়াছেন। সর্বজয়াকে প্রায়ই বলেন–জয়া, তোর ছেলেকে বল কাজকর্ম সব দেখে নিতে। আমার মেয়াদ আর কতদিন? ওদের বাড়ির কাজটা দিক না আরম্ভ করে-সিধের চালেই তো মাস চলে যাবে।

সর্বজয় তাহাতে খুব খুশি।

সকলের তাগিদে শীঘ্রই অপু পূজার কাজ আরম্ভ কুরিল-দুটি একটি করিয়া কাজকর্ম আরম্ভ হইতে হইতে ক্ৰমে এপাড়ায় ওপাড়ায় অনেক বাড়ি হইতেই লক্ষ্মীপূজায় মাকালীপূজায় তাহার ডাক আসে। অপু মহা উৎসাহে প্ৰাতঃস্নান করিয়া উপনয়নের চেলির কাপড় পরিয়া নিজের টিনের বাক্সের বাংলা নিত্যকর্মপদ্ধতিখানা হাতে লইয়া পূজা করিতে যায়। পূজা করিতে বসিয়া আনাড়ির মতো কোন অনুষ্ঠান করিতে কোন অনুষ্ঠান করে। পূজার কোন পদ্ধতি জানে না-বার বার বইয়ের উপর বুকিয়া পড়িয়া দেখে কি লেখা আছে-“বজায় তুং বলিবার পর শিবের মাথায় বঞ্জের কি গতি করিতে হইবে—‘ওঁ ব্ৰহ্মপৃষ্ঠ ঋষি সূতলছন্দঃ কূর্মো দেবতা’ বলিয়া কোন মুদ্রায় আসনের কোণ কি ভাবে ধরিতে হইবে।-কোনরকমে গোজামিল দিয়া কোজ সারিবার মতো পটুত্বও তাহার আয়ত্ত হয়। নাই, সুতরাং পদে পদে আনাড়িপনা টুকু ধরা পড়ে।

একদিন সেটুকু বেশি করিয়া ধরা পড়িল ওপাড়ার সরকারদের বাড়ি। যে ব্ৰাহ্মণ তাহাদের বাড়িতে পূজা করিত, সে কি জন্য রাগ করিয়া চলিয়া গিয়াছে, গৃহদেবতা নারায়ণের পূজার জন্য তাহাদের লোক অপুকে ডাকিয়া লইয়া গেল। বাড়ির বড়ো মেয়ে নিরুপমা পূজার জোগাড় করিয়া দিতেছিল, চৌদ্দ বৎসরের ছেলেকে চেলি পরিয়া পুঁথি বগলে গভীর মুখে আসিতে দেখিয়া সে একটু অবাক হইল। জিজ্ঞাসা করিল, তুমি পুজো করতে পারবে? কি নাম তোমার? চাকতি মশায় তোমার কে হন?

মুখচোরা অপুর মুখে বেশি কথা জোগাইল না, লাজুক মুখে সে গিয়া আনাড়ির মতো আসনের উপর বসিল।

পূজা কিছুদূর অগ্রসর হইতে না হইতে নিরুপমার কাছে পূজারির বিদ্যা ধরা পড়িয়া গেল। নিরুপমা হাসিয়া বলিল, ওকি? ঠাকুর নামিয়ে আগে নাইয়ে নাও, তবে তো তুলসী দেবে?–

অপু থতমত খাইয়া ঠাকুর নামাইতে গেল।

নিরুপমা বসিয়া পড়িয়া বলিল-উঁহু, তাড়াতাড়ি কোরো না। এই টাটে আগে ঠাকুর নামাও-আচ্ছা, এখন বড়ো তাম্রকুণ্ডুতে জল ঢালো–

অপু ঝুঁকিয়া পড়িয়া বইয়ের পাতা উলটাইয়া স্নানের মন্ত্র খুঁজতে লাগিল। তুলসীপত্র পরাইয়া শালগ্রামকে সিংহাসনে উঠাইতে যাইতেছে, নিরুপমা বলিল, ওকি? তুলসীপাত উপুড় করে পরাতে হয় বুঝি? চিৎ করে পরাও–

ঘামে রাঙামুখ হইয়া কোনরকমে পূজা সাঙ্গ করিয়া অপু চলিয়া আসিতেছিল, নিরুপমা ও বাড়ির অন্যান্য মেয়েরা তাহাকে আসন পাতিয়া বসাইয়া ভোগের ফলমূল ও সন্দেশ জলযোগ করাইয়া। তবে ছাড়িয়া দিল।

 

মাসখানেক কাটিয়া গেল।

অপুর কেমন মনে হয় নিশ্চিন্দিপুরের সে অপূর্ব মায়ারূপ এখানকার কিছুতেই নাই। এই গ্রামে নদী নাই, মাঠ থাকিলেও সে মাঠ নাই, লোকজন বেশি, গ্রামের মধ্যেও লোকজন বেশি। নিশ্চিন্দিপুরের সেই উদার স্বপ্নমাখানো মাঠ, সে নদীতীর এখানে নাই, তাদের দেশের মতো গাছপালা, কত ফুলফল, পাখি, নিশ্চিন্দিপুরের সে অপূর্ব বন-বৈচিত্র্য, কোথায় সে সব? কোথায় সে নিবিড় পুম্পিত ছাতিম বন, ডালে ডালে সোনার সিঁদুর ছড়ানো সন্ধ্যা?

সরকার-বাড়ি হইতে আজকাল প্রায়ই পূজা করিবার ডাক আসে। শান্তস্বভাব, সুন্দর ও চেহারার গুণে অপুকেই আগে চায়। বিশেষ বারব্রতের দিনে পূজাপত্র সারিয়া অনেক বেলায় সে ধামা করিয়া নানাবাড়ির পূজার নৈবেদ্য ও চাল-কলা বহিয়া বাড়ি আনে। সর্বজয়া হাসিমুখে বলে, ওঃ, আজ  চাল তো অনেক হয়েচে!–দেখি! সন্দেশ কদের বাড়ির নৈবিদ্যিতে দিল রে!

অপু খুশির সহিত দেখাইয়া বলে, কুণ্ডুবাড়ি থেকে কেমন একছড়া কলা দিয়েচে, দেখেচো মা?

সর্বজয়া বলে, এবার বোধহয় ভগবান মুখ তুলে চেয়েছেন, এদের ধরে থাকা যাক, গিন্নি লোক বড়ো ভালো। মেজছেলের শ্বশুরবাড়ি থেকে তত্ত্ব পাঠিয়েচে-অসময়ের আম-অমনি আমার এখানে পাঠিয়ে দিয়েচে-খাস এখন দুধ দিয়ে।

এত নানারকমের ভালো জিনিস সর্বজয়া কখনও নিজের আয়ত্তের মধ্যে পায় নাই। তাহার কতকালের স্বপ্ন! নিশ্চিন্দিপুরের বাড়িতে কত নিস্তব্ধ মধ্যাহ্নে, উঠানের উপর ঝুঁকিয়া-পড়া বাঁশবনের পত্ৰস্পন্দনে, ঘুঘুর ডাকে, তাহার অবসন্ন অন্যমনস্ক মন যে অবাস্তব সচ্ছলতার ছবি আপন মনে ভাঙ্গিত গড়িত-হাতে খরচ নাই, ফুটা বাড়িতে জল পড়ে বৃষ্টির রাত্রে, পাড়ায় মুখ পায় না, সকলে তুচ্ছ করে, তাচ্ছিল্য করে, মানুষ বলিয়াই গণ্য করে না-সে সব দিনের স্মৃতির সঙ্গে, আমবুল শাকের বনে পুরানো পাচিলের দীর্ঘছায়ার সঙ্গে যে সব দূরকালের দুরাশার রঙে রঙিন ভবিষ্যৎ জড়ানো ছিল–এই তো এতদিনে তাহারা পৃথিবীর মাটিতে নামিয়া আসিয়াছে।

পূজার কাজে অপুর অত্যন্ত উৎসাহী। রোজ সকালে উঠিয়া সে কলুপাড়ার একটা গাছ হইতে রাশীকৃত কচি কচি বেলপাতা পাড়িয়া আনে। একটা খাতা বাঁধিয়াছে, তাহাতে সর্বদা ব্যবহারের সুবিধার জন্য নানা দেব-দেবীর স্তবের মন্ত্র, মানের মন্ত্র, তুলসীদান প্ৰণালী লিখিয়া লইয়াছে। পাড়ায় পূজা করিতে নিজের তোলা ফুল-বেলপাতা লইয়া যায়, পূজার সকল পদ্ধতি নিখুঁতভাবে জানা না থাকিলেও উৎসাহ ও একাগ্রতায় সে সকল অভাব পূরণ করিয়া লয়।

 

বর্ষাকালের মাঝামাঝি অপু একদিন মাকে বলিল যে, সে স্কুলে পড়িতে যাইবে। সর্বজয়া আশ্চর্য হইয়া তাহার মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, কোন ইস্কুল রে?

–কেন, এই তো আড়াবোয়ালেতে বেশ ইস্কুল রয়েচে।

–সে তো এখেন থেকে যেতে-আসতে চার ক্রোশ পথ। সেখেনে যাবি হেঁটে পড়তে?

সর্বজয়া কথাটা তখনকার মতো উড়াইয়া দিল বটে, কিন্তু ছেলের মুখে কয়েকদিন ধরিয়া বার বার কথাটা শুনিয়া সে শেষে বিরক্ত হইয়া বলিল, যা খুশি করো অপু, আমি জানি নে। তোমরা কোনো কালে কাবুর কথা তো শুনলে না? শুনবেও না-সেই একজন নিজের খেয়ালে সারাজন্ম কাটিয়ে গেল, তোমারও তো সে ধারা বজায় রাখা চাই! ইস্কুলে পড়বো! ইস্কুলে পড়বি তো এদিকে কি হবে? দিব্যি একটা যাহোক দাঁড়াবার পথ তুবু হয়ে আসছে—এখন তুমি দাও ছেড়ে–তারপর ইদিকেও যাক, ওদিকেও যাক

মায়ের কথায় সে চুপ করিয়া গেল। চক্ৰবর্তী মহাশয় গত পৌষ মাসে কাশী চলিয়া গিয়াছেন, আজকাল তাহাকেই সমস্ত দেখিতে শুনিতে হয়। সামান্য একটু জমি-জমা আছে, তাহার খাজনা আদায়, ধান কাটাইবার বন্দোবস্তু, দশকর্ম, গৃহদেবতার পূজা। গ্রামে ব্রাহ্মণ নাই, তাহারাই একঘর মোটে। চাষি কৈবর্ত ও অন্যান্য জাতির বাস, তাহা ছাড়া এ-পাড়ার কুণ্ডুরা ও ও-পাড়ার সরকারেরা। কাজে কর্মে ইহাদের সকলেরই বাড়ি অপুকে ষষ্ঠীপূজা, মাকালীপূজা করিয়া বেড়াইতে হয়। সবাই মানে, জিনিসপত্র দেয়।

সেদিন কি একটা তিথি উপলক্ষে সরকার-বাড়ি লক্ষ্মীপূজা ছিল। পূজা সারিয়া খানিক রাত্রে জিনিসপত্র একটা পুঁটুলি বাঁধিয়া লইয়া সে পথ বাহিয়া বাড়ির দিকে আসিতেছিল; খুব জ্যোৎস্না, সরকার বাড়ির সামনে নারিকেল গাছে কাঠঠোকরা শব্দ করিতেছে। শীত বেশ পড়িয়াছে; বাতাস খুব ঠাণ্ডা, পথে ক্ষেত্র কাপালির বেড়ায় আমড়া গাছে বাউল ধরিয়াছে। কাপালিদের বাড়ির বেগুনক্ষেতের উঁচুনিচু জমিতে এক জায়গায় জ্যোৎস্না পড়িয়া চক চক করিতেছে-পাশের অন্ধকার। অপু মনে মনে কল্পনা করিতে করিতে যাইতেছিল যে, উঁচু জায়গাটা একটা ভালুক, নিচুটা জলের চৌবাচ্চা, তার পরের উঁচুটা নুনের টিবি। মনে মনে ভাবিল-কমললেবু দিয়েচে, বাড়ি গিয়ে কমলালেবুখাবো। মনের সুখে শহরে-শেখা একটা গানের একটা চরণ সে গুনগুন করিয়া ধরিল—

সাগর-কূলে বসিয়া বিরলে হেরিব লহরীমালা–

অনেকদিনের স্বপ্ন যেন আবার ফিরিয়া আসে। নিশ্চিন্দিপুরে থাকিতে ইছামতীর তীরের বনে, মাঠে কত ধূসর অপরাহ্নের কত জ্যোৎস্না-রাতের সে-সব স্বপ্ন! এই ছোট্ট চাষাগাঁয়ে চিরকালই এ রকম ষষ্ঠীপূজা মাকালীপূজা করিয়া কাঁটাইতে হইবে?

সারাদিনের রোদো-পোড়া মাটি নৈশ শিশিরে স্নিগ্ধ হইয়া আসিয়াছে, এখন শীতের রাতের ঠাণ্ডা হাওয়ায় তাহারই সুগন্ধ।

অপুর মনে হইল রেলগাড়ির চাকায় চাকায় যেন শব্দ হয়—ছোটঠাকুর-পো-বটঠাকুরপো-ছোটুঠাকুর-পো-বটঠাকুর-পো-

 

দুই-এক দিনের মধ্যে সে মায়ের কাছে কথাটা আবার তুলিল। এবার শুধু তোলা নয়, নিতান্ত নাছোড়বান্দা হইয়া পড়িল। আড়বোয়ালের স্কুল দুই ক্রোশ দূরে, তাই কি? সে খুব হ্যাঁটিতে পরিবে: এটুকু। সে বুঝি চিরকাল এই রকম চাষাগায়ে বসিয়া বসিয়া ঠাকুরপূজা করিবে? বাহিরে যাইতে পাবিবে না বুঝি?

তবু আরও মাস দুই কাটিল। স্কুলের পড়াশোনা সর্বজয়া বোঝে না, সে যাহা বোঝে তাহা পাইয়াছে। তবে আবার ইস্কুলে পড়িয়া কি লাভ? বেশ তো সংসার গুছাইয়া উঠিতেছে। আর বছর কয়েক পরে ছেলের বিবাহ–তারপরই একঘর মানুষের মতো মানুষ।

সর্বজয়ার স্বপ্ন সার্থক হইয়াছে।

কিন্তু অপুর তাহা হয় নাই। তাহাকে ধরিয়া রাখা গেল না-শ্রাবণের প্রথমে সে আড়বোয়ালের মাইনর স্কুলে ভর্তি হইয়া যাতায়াত শুবু করিল।

এই পথের কথা সে জীবনের কোনোদিন ভোলে নাই-এই একটি বৎসর ধরিয়া কি অপরূপ আনন্দই পাইয়াছিল-প্রতিদিন সকালে-বিকালে এই পথ হ্যাঁটিবার সময়টাতে। …নিশ্চিন্দিপুর ছাড়িয়া অবধি এত আনন্দ আর হয় নাই।

ক্রোশ দুই পথ। দুধারে বট, তুঁতের ছায়া, ঝোপঝাপ, মাঠ, মাঝে মাঝে অনেকখানি ফাকা আকাশ। স্কুলে বসিয়া অপুর মনে হইত। সে যেন একা কতদূর বিদেশে আসিয়াছে, মন চঞ্চল হইয়া উঠিত-ছুটির পরে নির্জন পথে বাহির হইয়া পড়িত।-বৈকালের ছায়ায় ঢাঙা তাল-খেজুরগাছগুলা যেন দিগন্তের আকাশ ছুইতে চাহিতেছে-পিড়িং পিড়িং পাখির ডাক-ঘু হু মাঠের হাওয়ায় পাকা ফসলের গন্ধ আনিতেছে-সর্বত্র একটা মুক্তি, একটা আনন্দের বার্তা।…

কিন্তু সর্বাপেক্ষা সে আনন্দ পাইত পথচলতি লোকজনের সঙ্গে কথা কহিয়া। কত ধরনের লোকের সঙ্গে পথে দেখা হইত-কত দূর-গ্রামের লোক পথ দিয়া হ্যাঁটিত, কত দেশের লোক কত দেশে যাইত। অপু সবেমাত্র একা পথে বাহির হইয়াছে, বাহিরের পৃথিবীটার সহিত নতুন ভাবে পরিচয় হইতেছে, পথে ঘাটে সকলেব সঙ্গে আলাপ করিয়া তাহদের কথা জানিতে তাহার প্রবল আগ্রহ। পথ চলিবার সময়টা এইজন্য বড়ো ভালো লাগে, সাগ্রহে সে ইহার প্রতীক্ষা করে, স্কুলের ছুটির পর পথে নামিয়াই ভাবে-এইবার গল্প শুনবো। পরে ক্ষিপ্ৰপদে আগইয়া আসিয়া কোনো অপরিচিত লোকের নাগাল ধরিয়া ফেলে। প্রায়ই চাষালোক, হাতে খুঁকোকন্ধে। অপু জিজ্ঞাসা কবেকোথায় যোচ্ছ, হ্যাঁ কাক? চলো আমি মনসাপোতা পর্যন্ত তোমার সঙ্গে যাবো। মামজোয়ান গিাইছিলে? তোমাদের বাড়ি বুঝি? না? শিকড়ে? নাম শুনেচি, কোনদিকে জানি নে। কি খেয়ে সকালে বেরিয়েছ, হ্যাঁ কাকা?…

তারপর সে নানা খুঁটিনাটি কথা জিজ্ঞাসা করে-কেমন সে গ্রাম, ক’ঘর লোকের বাস, কোন নদীর ধারে? ক’জন লোক তাদের বাড়ি, কত ছেলেমেয়ে, তারা কি করে?.

কত গল্প, কত গ্রামের কিংবদন্তি, সেকাল-একালের কত কথা, পল্পী-গৃহস্থের কত সুখদুঃখের কাহিনী-সে। শুনিয়াছিল এই এক বৎসরে। সে চিরদিন গল্প-পাগলা, গল্প শুনিতে শুনিতে আহার-নিদ্ৰা ভুলিয়া যায়-যন্ত সামান্য ঘটনাই হোক, তাহার ভালো লাগে। একটা ঘটনা মনে কি গভীর রেখাপাতই করিয়াছিল!

কোন গ্রামের এক ব্ৰাহ্মণবাড়ির বৌ এক বাগদীর সঙ্গে কুলের বাহির হইয়া গিয়াছিল-আজ অপুর সঙ্গীটি এইমাত্র তাকে শামুকপোতার বিলে গুগলি তুলিতে দেখিয়া আসিয়াছে। পরনে ছেঁড়া কাপড়, গায়ে গহনা নাই, ডাঙায় একটি ছোটছেলে বসিয়া আছে, বোধ হয় তাহারই। অপু আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, তোমার দেশের মেয়ে? তোমায় চিনতে পারলে?

হ্যাঁ, চিনিতে পারিয়াছিল। কত কাঁদিল, চোখের জল ফেলিল, বাপ-মায়ের কথা জিজ্ঞাসা করিল। অনুরোধ করিল যেন এসব কথা দেশে গিয়া সে না বলে। বাপ-মা শুনিয়া কষ্ট পাইবে। সে বেশ সুখে আছে। কপালে যাহা ছিল, তাহা হইয়াছে।

সঙ্গীটি উপসংহারে বলিল, বামুন-বাড়ির বৌ, হর্তেলের মতো গায়ের রঙ-যেন ঠাকরুনের পিরতিমে!

দুর্গ-প্রতিমার মতো রূপসী একটি গৃহস্থবধূ ছেঁড়া কাপড় পরনে, শামুকপোতার বিলে হাঁটুজল ভাঙিয়া চুপড়ি হাতে গুগলি তুলিতেছে-কত কাল ছবিটা তাহার মনে ছিল!

সেদিন সে স্কুলে গিয়া দেখিল স্কুলসুদ্ধ লোক বেজায় সন্ত্রস্ত! মাস্টারেরা এদিক ওদিক ছুটািছুটি করিতেছেন। স্কুল-ঘর গাঁদা ফুলের মালা দিয়া সাজানো হইতেছে, তৃতীয় পণ্ডিত মহাশয় খামোখা একটি সুবৃহৎ সিঁড়ি-ভাঙা ভগ্নাংশ কষিয়া নিজের ক্লাসের বোর্ড পুরাইয়া রাখিয়াছেন। হঠাৎ আজ স্কুল-ঘরের বারান্দা ও কম্পাউন্ড এত সাফ করিয়া রাখা হইয়াছে যে, যাহারা বারোমাস এস্থানের সহিত পরিচিত, তাহদের বিস্মিত হইবার কথা। হেডমাস্টার ফণীবাবু খাতপত্র, অ্যাডমিশন বুক, শিক্ষকগণের হাজিরা বই লইয়া মহা ব্যস্ত। সেকেন্ড পণ্ডিতকে ডাকিয়া বলিলেন, ও অমূল্যবাবু, চৌঠে তারিখে খাতায় যে নাম সই করেন নি? আপনাকে বলে বলে আর পারা গেল না। দেরিতে এসেছিলেন তো খাতায় সই করে ক্লাসে গেলেই হত? সব মনে থাকে, এইটের বেলাতেই

অপু শুনিল একটার সময় ইন্সপেক্টর আসিবেন স্কুল দেখিতে। ইন্সপেক্টর আসিলে কি করিযা উঠিয়া দাঁড়াইয়া তাহাকে অভ্যর্থনা করিতে হইবে, তৃতীয় পণ্ডিত মহাশয় ক্লাসের ছেলেদের সে বিষয়ে তালিম দিতে লাগিলেন।

বারোটার কিছু পূর্বে একখানা ঘোড়ার গাড়ি আসিয়া স্কুলের সামনে থামিল। হেডমাস্টার তখনও ফাইল দূরস্ত শেষ করিয়া উঠিতে পারেন নাই বোধ হয়-তিনি এত সকালে ইন্সপেক্টর আসিয়া পড়াটা প্রত্যাশা করেন নাই, জানাল দিয়া উঁকি মারিয়া গাড়ি দেখিতে পাইয়াই উঠি-পড়ি অবস্থায় ছুটিলেন। তৃতীয় পণ্ডিত মহাশয় হঠাৎ তড়িৎ স্পষ্ট ভেকের মতো সজীব হইয়া উঠিয়া তারস্বরে ও মহা উৎসাহে। (অন্যদিন এই সময়টাই তিনি ক্লাসে বসিয়া মাধ্যাহিক নিদ্রাটুকু উপভোগ করিয়া থাকেন) দ্রব পদার্থকহাকে বলে তাহার কর্ণনা আরম্ভ করিলেন। পাশের ঘরে সেকেন্ড পণ্ডিত মহাশয়ের ইকোর শব্দ অদ্ভুত ক্ষিপ্ৰতার সহিত বন্ধ হইয়া গেল। সঙ্গে সঙ্গে তাহার উচ্চকণ্ঠ শোনা যাইতে লাগিল। শিক্ষক বলিলেন, মতি, তোমরা অবশ্যই কমললেবু দেখিয়াছ, পৃথিবীর আকারএই হরেন-কমললেবুর ন্যায় গোলাকার–

হেডমাস্টারের পিছনে পিছনে ইন্সপেক্টর স্কুল ঘরে ঢুকিলেন। বয়স চল্লিশ-বিয়াল্লিশ বৎসর হইবে, বেঁটে, গৌরবর্ণ, সাটিন জিনের লম্বা কোট গায়ে, সিল্কের চাদর গলায়, পায়ে সাদা ক্যাম্বিশের জুতা, চোখে চশমা। গলার স্বর ভারী। প্রথমে তিনি অফিস-ঘরে ঢুকিয়া খাতপত্র অনেকক্ষণ ধরিয়া দেখার পরে বাহির হইয়া হেডমাস্টারের সঙ্গে ফাস্ট ক্লাসে গেলেন। অপুর বুক টিপ, টিপ করিতেছিল। এইবার তাঁহাদের ক্লাসে আসিবার পালা। তৃতীয় পণ্ডিত মহাশয় গলার সুর আর এক গ্রাম চড়াইলেন।

ইন্সপেক্টর ঘরে ঢুকিয়া বোর্ডের দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, এরা কি ভগ্নাংশ ধরেছে? তৃতীয় পণ্ডিত মহাশয়ের মুখ আত্মপ্রসাদে উজ্জ্বল দেখাইল; বলিলেন, আজ্ঞে হ্যাঁ, দু-ব্লাসে আমি অঙ্ক কাবাই কি না। ও ক্লাসেই অনেকটা এগিয়ে দিই-সরল ভগ্নাংশটা শেষ করে ফেলি

ইন্সপেক্টর এক এক করিয়া বাঙলা রিডিং পড়িতে বলিলেন। পড়িতে উঠিয়াই অপুর গলা কাঁপিতে লাগিল। শেষের দিকে তাহার পড়া বেশ ভালো হইতেছে বলিয়া তাহার নিজেরই কানে ঠেকিল। পরিষ্কার সতেজ বাঁশির মতো গলা। রিনারিনে মিষ্টি।

–বেশ, বেশ রিডিং। কি নাম তোমার?

তিনি আরও কয়েকটি প্রশ্ন করিলেন। তারপর সবগুলি ক্লাস একে একে ঘুরিয়া আসিয়া জলের ঘরে ডাব সন্দেশ খাইলেন। তৃতীয় পণ্ডিত মহাশয় অপুকে বলিলেন, তুই হাতে করে এই ছুটির দরখাস্তখানা নিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে থাক, তোকে খুব পছন্দ করেছেন, যেমন বাইরে আসবেন, অমনি দরখাস্তখানা হাতে দিবি—দু-দিন ছুটি চাইবি-তোর কথায় হয়ে যাবে-এগিয়ে যা।

ইন্সপেক্টর চলিয়া গেলেন। তঁহার গাড়ি কিছুদূর যাইতে না যাইতে ছেলেরা সমস্বরে কলরব করিতে করিতে স্কুল হইতে বাহির হইয়া পড়িল। হেডমাস্টার ফণীবাবু অপুকে বলিলেন, ইন্সপেক্টর বাবু খুব সন্তুষ্ট হয়ে গিয়েছেন তোমার ওপর। বোর্ডের একজামিন দেওয়াব তোমাকে দিয়ে-তৈরি হও, বুঝলে?

বোর্ডের পরীক্ষা দিতে মনোনীত হওয়ার জন্য যত না হউক, ইন্সপেক্টরের পরিদর্শনের জন্য দুদিন স্কুল বন্ধ থাকিবার আনন্দে উৎফুল্প হইয়া সে বাড়ির দিকে রওনা হইল। অন্যদিনের চেয়ে দেরি হইয়া গিয়াছে। অর্ধেক পথ চলিয়া আসিয়া পথের ধারে একটা সাঁকোর উপর বসিয়া মায়ের দেওয়া খাবারের পুঁটুলি খুলিয়া বুটি, নারিকেলকোরা ও গুড় বাহির করিল। এইখানটাতে বসিয়া রোজ সে স্কুল হইতে ফিরিবার পথে খাবার খায়। রাস্তার বাঁকের মুখে সাঁকোটা, হঠাৎ কোনো দিক হইতে দেখা যায় না, একটা বড়ো তুতি-গাছের ডালপালা নত হইয়া ছায়া ও আশ্রয় দুই-ই জোগাইতেছে। সাঁকোর নিচে আমরুল শাকের বনের ধারে একটু একটু জল বাধিয়াছে, মুখ বাড়াইলেই জলে ছায়া পড়ে। অপুর কেমন একটা অস্পষ্ট ভিত্তিহীন ধারণা আছে যে, জলটা মাছে ভর্তি, তাই সে একটু একটু বুটির টুকরা উপর হইতে ফেলিয়া দিয়া মুখ বাড়াইয়া দেখে মাছে ঠোকরাইতেছে কি না।

সাঁকোর নিচের জলে হাত মুখ ধুইতে নামিতে গিয়া হঠাৎ তাহার চোখ পড়িল একজন ঝাঁকড়া-চুল কালোমতো লোক রাস্তার ধারের মাঠে নামিয়া লতা-কাঠি কুড়াইতেছে। অপু কৌতূহলী হইয়া চাহিয়া রহিল। লোকটা খুব লম্বা নয়, বেঁটে ধরনের, শক্ত হাত পা, পিঠে একগাছা বড়ো ধনুক, একটা বড়ো বেঁচেকা, মাথার চুল লম্বা লম্বা, গলায় রাঙা সবুজ হিংলাজের মালা। সে অত্যন্ত কৌতূহলী হইয়া ডাকিয়া বলিল, ওখানে কি খুঁজচো? পরে লোকটির সঙ্গে তাহার আলাপ হইল। সে জাতিতে সাঁওতাল, অনেক দূরে কোথায় দুমকা জেলা আছে, সেখানে বাড়ি। অনেক দিন বর্ধমানে ছিল, বাঁকা বাঁকা বাংলা বলে, পায়ে হ্যাঁটিয়া সেখান হইতে আসিতেছে। গন্তব্য স্থান অনিৰ্দেশ্যএরূপে যতদূর যাওয়া যায় যাইবে, সঙ্গে তীর ধনুক আছে, পথের ধারে বনে মাঠে যাহা শিকার মেলে-তাহাই খায়। সম্প্রতি একটা কি পাখি মারিয়াছে, মাঠের কোন ক্ষেত হইতে গোটকয়েক বড়ো বড়ো বেগুনও তুলিয়াছে-তোহ্যাঁই পুড়াইয়া খাইবার জোগাড়ে শুকনো লতা-কাঠি কুড়াইতেছে। অপু বলিল, কি পাখি দেখি? লোকটা ঝোলা হইতে বাহির করিয়া দেখাইল একটা বড়ো হড়িয়াল ঘুঘু। সত্যিকারের তীর ধনুক-যাহাতে সত্যিকারের শিকার সম্ভব হয়-অপু কখনও দেখে নাই। বলিল, দেখি একগাছা তীর তোমার? পরে হাতে লইয়া দেখিল, মুখে শক্ত লোহার ফলা, পিছনে বুনোেপাখির পালক বাঁধা-অদ্ভুত কৌতূহলপ্রদ ও মুগ্ধকর জিনিস!

–আচ্ছা এতে পাখি মারে, আর কি মরে?

লোকটা উত্তর দিল, সবই মারা যায়-খরগোশ, শিয়াল, বেজি, এমন কি বাঘ পর্যন্ত। তবে বাঘ মারিবার সময় তীরের ফলায় অন্য একটা লতার রস মাখাইয়া লইতে হয় …তাহার পর সে তুঁতগাছতলায় শুকনা পাতা লতার আগুন জ্বলিল। অপুর পা আর সেখান হইতে নড়িতে চাহিল না-মুগ্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া দেখিতে লাগিল, লোকটা পাখিটার পালক ছাড়াইয়া আগুনে ঝলসাইতে ছিল, বেগুনগুলাও পুড়াইতে দিল।

বেলা অত্যন্ত পড়িলে অপু বাড়ি রওনা হইল। আহার শেষ করিয়া লোকটা তখন তাহার বেঁচেক ও তীর ধনুক লইয়া রওনা হইয়াছে। এ রকম মানুষ সে তো কখনও দেখে নাই। বাঃযেদিকে দুই চোখ যায় সেদিকে যাওয়া-পথে পথে তীর ধনুক দিয়া শিকার করা, বনের লতাপাতা কুড়াইয়া গাছতলায় দিনের শেষে বেগুন পুড়াইয়া খাওয়া! গোটা আষ্টেক বড়ো বড়ো বেগুন সামান্য একটু নুনের ছিটা দিয়া গ্রাসের পর গ্রাস তুলিয়া কি করিয়াই নিমেষের মধ্যে সাবাড়া করিয়া ফেলিল।…

 

মাস কয়েক কাটিয়া গেল। সকালবেলা স্কুলের ভাত চাহিতে গিয়া অপু দেখিল রান্না চড়ানো হয় নাই। সর্বজয়া বলিল, আজ যে কুলুইচণ্ডী পুজো-আজি স্কুলে যাবি কি করে?…ওরা বলে গিয়েচে ওদের পুজোটা সেরে দেওয়ার জন্যে-পুজোবারে কি আর স্কুলে যেতে পারবি? বড় দেরি হয়ে যাবে।

-হ্যাঁ, তাই বইকি? আমি পুজো করতে গিয়ে স্কুল কামাই করি আর কি? আমি ওসব পারবো না, পুজোঁটুজো আমি আর করবো কি করে, রোজই তো পুজো লেগে থাকবে। আর আমি বুঝি রোজ রোজ-তুমি ভাত নিয়ে এসো আমি ওসব শুনছিনে-।

-লক্ষ্মী বাবা আমার। আচ্ছা, আজকের দিনটা পুজোটা সেরে নে। ওরা বলে গিয়েছে ওপাড়াসুদ্ধ পুজো হবে।  চাল পাওয়া যাবে এক ধামার কম নয়, মানিক আমার, কথা শোনো, শুনতে হয়।

অপু কোন মতেই শুনিল না। অবশেষে না খাইয়াই স্কুলে চলিয়া গেল। সর্বজয়া ভাবে নাই যে, ছেলে সত্যসত্যই তাহার কথা ঠেলিয়া না খাইয়া স্কুলে চলিয়া যাইবে। যখন সত্যই বুঝিতে পারিল, তখন তাহার চোখের জল আর বাধা মানিল না। ইহা সে আশা করে নাই।

অপু স্কুলে পৌঁছিতেই হেডমাস্টার ফণীবাবু তাহাকে নিজের ঘরে ডাক দিলেন। ফণীবাবুর ঘরেই স্থানীয় ব্রাঞ্চ পোস্ট-অফিস, ফণীবাবুই পোস্ট-মাস্টার। তিনি তখন ডাকঘরের কাজ করিতেছিলেন। বলিলেন, এসো অপূর্ব, তোমার নম্বর দেখবো? ইন্সপেক্টর অফিস থেকে পাঠিয়ে দিয়েচে-বোর্ডের এগজামিনে তুমি জেলার মধ্যে প্রথম হয়েচ–পাঁচ টাকার একটা স্কলারশিপ পাবে। যদি আরও পড়ো’তবে। পড়বে তো?

এই সময়ে তৃতীয় পণ্ডিত মহাশয় ঘরে ঢুকিলেন। ফণীবাবু বলিলেন, ওকে সে কথা এখন বললাম পণ্ডিতমশাই! জিজ্ঞাসা করচি, আরও পড়বে তো? তৃতীয় পণ্ডিত বলিলেন, পড়বে না, বাঃ! হীরের টুকরো ছেলে, স্কুলের নাম রেখেছে। ওরা যদি না পড়ে তো পড়বে কে, কেষ্ট তেলির বেটা গোবর্ধন? কিছু না, আপনি ইন্সপেক্টর অফিসে লিখে দিন যে, ও হাই স্কুলে পড়বে। ওর আবার জিজ্ঞেসটা কি?-ওঃ, সোজা পরিশ্রম করিচি মশাই ওকে ভগ্নাংশটা শেখাতে?

প্রথমটা অপু যেন ভালো করিয়া কথাটা বুঝিতে পারিল না। পরে যখন বুঝিল তখন তাঁহার মুখে কথা জোগাইল না। হেডমাস্টার একখানা কাগজ বাহির করিয়া তাহার সামনে ধরিয়া বলিলেন—এইখানে একটা নাম সই করে দাও তো। আমি কিন্তু লিখে দিলাম যে, তুমি হাই স্কুলে পড়বে। আজই ইন্সপেক্টর অফিসে পাঠিয়ে দেবো।

সকাল সকাল ছুটি লইয়া বাড়ি ফিরিবার পথে মায়ের করুণ মুখচ্ছবি বার বার তাহার মনে আসিতে লাগিল। পথের পাশে দুপুরের রৌদ্রভরা শ্যামল মাঠ, প্রাচীন তুঁত বটগাছের ছায়া, ঘন শালপত্রের অন্তরালে ঘুঘুর উদাস কণ্ঠ, সব যেন করুণ হইয়া উঠিল। তাহার মনে এই অপূর্ব করুণ ভাবটি বড়ো গভীর ছাপ রাখিয়া গিয়াছিল। আজিকার দুপুরটির কথা উত্তর জীবনে বড়ো মনে আসিত তাহার। কত-কতদিন পরে আবার এই শ্যামচ্ছায়াভিরা বীথি, বাল্যের অপরূপ জীবনানন্দ, ঘুঘুর ডাক, মায়ের মনের একদিনের দুঃখটি-অনস্তের মণিহারে গাঁথা দানাগুলির একটি, পশ্চিম দিগন্তে প্রতি সন্ধ্যায় ছিঁড়িয়া-পড়া, বহুবিস্মৃত মুক্তাবলীর মধ্যে কেমন করিয়া অক্ষয় হইয়া ছিল।

বাড়িতে তাহার মাও আজ সারাদিন খায় নাই। ভাত চাহিয়া না পাইয়া ছেলে না খাইয়াই চলিয়া গিয়াছে স্কুলে-সৰ্বজয়া কি করিয়া খাবারের কাছে বসে? কুলুইচণ্ডীর ফলার খাইয়া অপু বৈকালে বেড়াইতে গেল।

গ্রামের বাহিরে ধঞ্চেক্ষেতের ফসল কাটিয়া লওয়া হইয়াছে। চারি ধারে খোলা মাঠ পড়িয়া আছে। আবার সেই সব রঙিন কল্পনা; সে পরীক্ষায় বৃত্তি পাইয়াছে। তার স্বপ্নের অতীত! মোটে এক বছর পড়িয়াই বৃত্তি পাইল!…সুমুখের জীবনের কত ছবিই আবার মনে আসে। ওই মাঠের পারে রক্তআকাশটার মতো। রহস্যস্বপ্নভরা যে অজানা অকুল জীবন-মহাসমুদ্র.পুলকে সারাদেহ শিহরিয়া উঠে। মাকে এখনও সব কথা বলা হয় নাই। মায়ের মনের বেদনার রঙে যেন মাঠ, ঘাট, অস্তদিগন্তের মেঘমালা রাঙানো। গভীর ছায়াভরা সন্ধ্যায় মায়ের দুঃখভরা মনটার মতো ঘুলি-ঘুলি অন্ধকার।

দালানের পাশের ঘরে মিটি মিটি প্ৰদীপ জ্বলিতেছে। সর্বজয়া রান্নাঘরের দাওয়ায় ছেলেকে ওবেলার কুলুইচণ্ডী-ব্রতের চিড়ে-মুড়কির ফলার খাইতে দিল। নিকটে বসিয়া চাপাকলার খোসা ছাড়াইয়া দিতে দিতে বলিল, ওরা কত দুঃখু করলে আজ। সরকারবাড়ি থেকে বলে গেল তুই পুজো করবি-তারা খুঁজতে এলে আমি বললাম, সে স্কুলে চলে গিয়েছে। তখন তারা আবার ভৈরব চক্কত্তিকে ডেকে নিয়ে গিয়ে ওই অত বেলায়–তুই যদি যেতিস–

—আজি না গিয়ে ভালো করিচি মা। আজ হেডমাস্টার বলেচে। আমি এগজামিনে স্কলারশিপ পেইচি। বড়ো স্কুলে পড়লে মাসে পাঁচ টাকা করে পাবো। স্কুলে যেতেই হেডমাস্টার ডেকে বললে–

সর্বজয়ার মুখ বিবর্ণ হইয়া গেল। ছেলের মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, কোথায় পড়তে হবে?

–মহকুমার বড়ো স্কুলে।

–তা তুই কি বললি?

–আমি কিছু বলি নি। পাঁচটা করে টাকা মাসে মাসে দেবে, যদি না পড়ি তবে তো আর দেবে না। ওতে মাইনে ফ্রি করে নেবে। আর ওই পাঁচ টাকাতে বোর্ডিং-এ থাকবার খরচও কুলিয়ে যাবে।

সর্বজয়া আর কোন কথা বলিল না। কি কথা সে বলিবে? যুক্তি এতই অকাট্য যে, তাহার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করিবার কিছুই নাই। ছেলে স্কলারশিপ পাইয়াছে, শহরে পড়িতে যাইবে, ইহাতে মাবাপের ছেলেকে বাধা দিয়া বাড়ি বসাইয়া রাখিবার পদ্ধতি কোথায় চলিত আছে? এ যেন তাহার বিরুদ্ধে কোন দণ্ডী তার নির্মম অকাট্য দণ্ড উঠাইয়াছে তাহার দুর্বল হাতের সাধ্য নাই যে ঠেকাইয়া রাখে। ছেলেও ওইদিকে ঝুঁকিয়াছে! আজিকার দিনটিই যেন কার মুখ দেখিয়া উঠিয়াছিল সে। ভবিষ্যতের সহস্ৰ সুখস্বপ্ন কুয়াশার মতো অনন্তে বিলীন হইয়া যাইতেছে কেন আজকের দিনটিতে বিশেষ করিয়া?

 

মাসখানেক পরে বৃত্তি পাওয়ার খবর কাগজে পাওয়া গেল।

যাইবার পূর্বদিন বৈকালে সর্বজয়া ব্যস্তভাবে ছেলের জিনিসপত্র গুছাইয়া দিতে লাগিল। ছেলে কখনও একা বিদেশে বাহির হয় নাই, নিতান্ত আনাড়ী, ছেলে-মানুষ ছেলে। কত জিনিসের দরকার হইবে, কে থাকিবে তখন সেখানে যে মুখে মুখে সব অভাব জোগাইয়া ফিরিবে, সব জিনিস হাতে লাইয়া বসিয়া থাকিবো? খুঁটিনাটি-একখানা কাঁথা পাতিবার, একখানি গায়ের-একটি জল খাইবার গ্লাস, ঘরের তৈরি এক শিশি সরের ঘি, এক পুঁটুলি নারিকেল নাড়ু, অপু ফুলকটা একটা মাঝারি জামবাটিতে দুধ খাইতে ভালোবাসে-সেই বাটিটা, ছোট একটা বোতলে মাখিবার চৈ-মিশানো নারিকেল  তৈল, আরও কত কি। অপুর মাথার  বালিশের পুরানো ওয়াড় বদলাইয়া নূতন ওয়াড় পরাইয়া দিল। দধি-যাত্রার আবশ্যকীয় দই একটা ছোট পাথরবাটিতে পাতিয়া রাখিল। ছেলেকে কি করিয়া বিদেশে চলিতে হইবে সে বিষয়ে সহস্র উপদেশ দিয়াও তাহার মনে তৃপ্তি হইতেছিল না। ভাবিয়া দেখিয়া যেটি বাদ দিয়াছে মনে হয় সেটি তখনই আবার ডাকিয়া বলিয়া দিতেছিল।

—যদি কেউ মারে-টারে, কত দুন্টু ছেলে তো আচে, আমনি মাস্টারকে বলে দিবি-বুঝলি? রাত্তিরে ঘুমিয়ে পড়িসা নে যেন ভাত খাবার আগে! এ তো বাড়ি নয় যে কেউ তোকে ওঠাবেখেয়ে তবে ঘুমুদ্বি-নিয়তো তাদের বলবি, যা হয়েচে তাই দিয়ে ভাত দাও-বুঝলি তো?

সন্ধ্যার পর সে কুণ্ডুদের বাড়ি মনসার ভাসান শুনিতে গেল। অধিকারী নিজে বেহুলা সাজিয়া পায়ে ঘুঙুর বাঁধিয়া নাচে-কেশ গানের গলা। খানিকটা শুনিয়া তাহার ভালো লাগিল না। শুধু ছড়া কাটা ও নাচ সে পছন্দ করে না,-যুদ্ধ নাই, তলোয়ার খেলা নাই, যেন পানসে-পানসে।

তবুও আজিকার রাতটি বড়ো ভালো লাগিল তাহার। এই মনসা ভাসানোর আসর, এই নূতন জায়গা, এই অচেনা গ্ৰাম্য বালকের দল, ফিরিবার পথে তাঁহাদের পাড়ার বাঁকে প্রস্ফুটিত হেনা ফুলেব গন্ধ-ভরা নৈশ বাতাস জোনাকি-জুলা অন্ধকারে কেমন মায়াময় মনে হয়।.

রাত্রে সে আরও দু-একটা জিনিস সঙ্গে লইল। বাবার হাতের লেখা একখানা গানের খাতা, বাবার উদ্ভট শ্লোকের খাতাখানা বড়ো পেটরাটা হইতে বাহির করিয়া রাখিল-বড়ো বড়ো গোটা গোটা ছাঁদের হাতের লেখাটা বাবার কথা মনে আনিয়া দেয়। গানগুলির সঙ্গে বাবার গলার সুর এমনভাবে জড়াইয়া আছে যে, সেগুলি পড়িয়া গেলেই বাবাব সুর কানে বাজে। নিশ্চিন্দিপুরের কত ক্রীড়াক্কাস্ত শান্ত সন্ধ্যা, মেঘমেদুর বর্ষামধ্যাহ্ন, কত জ্যোৎস্না-ভরা রহস্যময়ী রাত্রি বিদেশ-বিভুই-এব সেই দুঃখ-মাখানো দিনগুলির সঙ্গে এই গানের সুরা যেন জড়াইয়া আছে–সেই দশাশ্বমেধ ঘাটের রানা, কাশীর পরিচিত সেই বাঙালি কথকঠাকুর।

সর্বজয়ার মনে একটা ক্ষীণ আশা ছিল যে, হয়তো ছেলে শেষ পর্যন্ত বিদেশে যাইবার মত করিবে না। কিন্তু তাহার অপু যে পিছনেব দিকে ফিরিয়াও চাহিতেছে না। সে যে এত খাটিয়া, একেওকে বলিয়া কহিয়া তাহার সাধ্যমতো যতটা কুলায়, ছেলেব ভবিষ্যৎ জীবনের অবলম্বন একটা খাড়া করিয়া দিয়াছিল–ছেলে তাহার পায়ে দলিয়া যাইতেছে–কি জানি কিসের টানে! কোথায়? তাহার মেহদুর্বল দৃষ্টি তাহাকে দেখিতে দিতেছিল না যে, ছেলের ডাক আসিয়াছে বাহিরের জগৎ হইতে। সে জগৎটা তাহার দাবি আদায় করিতে তো ছাড়িবে না-সাধ্য কি সর্বজয়ার যে চিরকাল ছেলেকে আঁচলে লুকাইয়া রাখে?

যাত্রার পূর্বে মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানের দধির ফোটা অপুর কপালে পরাইয়া দিতে দিতে বলিলবাড়ি আবার শিগগির শিগগির আসবি কিন্তু, তোদের ইতুপুজোর ছুটি দেবে তো?

-হ্যাঁ, ইস্কুলে বুঝি ইতুপুজোয় ছুটি হয়? তাতে আবার বড়ো ইস্কুল। সেই আবার আসবো গরমের ছুটিতে।

ছেলের অকল্যাণের আশঙ্কায় উচ্ছ্বসিত চোখের জল বহু কষ্ট সর্বজয়া চাপিয়া রাখিব।

অপু মায়ের পায়ের ধূলা লইয়া ভারী বোঁচকাটা পিঠে ঝুলাইয়া লইয়া বাড়ির বাহির হইয়া গেল।

মাঘ মাসের সকাল। কাল একটু একটু মেঘ ছিল, আজ মেঘ-ভাঙা রাঙা রোদ কুতুবাড়ির দোফলা আম গাছের মাথায় ঝলমল করিতেছে-বাড়ির সামনে বাঁশবনের তলায় চকচকে সবুজ পাতার আড়ালে বুনো আদার রঙিন ফুল যেন দূর ভবিষ্যতের রঙিন স্বপ্নের মতো সকালের বুকে।


© 2024 পুরনো বই