যতীন হঠাৎ দেখতে পেলে তার খাটের পাশে পুষ্প দাঁড়িয়ে তার দিকে চেয়ে মৃদু মৃদু হাসচে।…
পুষ্প! এক সময় পুষ্পের চেয়ে তার জীবনে প্রিয়তর কে ছিল?
দুজনে–
নৈহাটির ঘাটে
বসে পৈঠার পাটে
কত খেলেচি ফুল ভাসায়ে জলে–
সেই পুষ্প।
নৈহাটির ঘাট নয়–সাগঞ্জ-কেওটার বুড়োশিবতলার ঘাট। নৈহাটির আড়পারে। সেখানে ছেলেবেলায় তার মাসীমার জীবদ্দশায় সে কতবার গিয়েচে। এক এক সময় ছ’মাস আটমাস মাসীমার কাছেই সে থাকতো। মাসীমার ছেলেপুলে ছিল না, যতীন ছিল তার চক্ষের মণি। তারপর মাসীমা মারা গেলে, মেসোমশায় দ্বিতীয়বার দার পরিগ্রহ করলেন, সাগঞ্জ-কেওটাতে মাসীমার বাড়ীর দরজা চিরদিনের মত বন্ধ হয়ে গেল ওর কাছে।
বুড়োশিবতলায় পুরোনো মন্দিরের কাছে ছিল ওর মাসীমার বাড়ী আর রাস্তার ও-পাশেই ছিল পুষ্পদের বাড়ী। পুষ্পর বাবা শ্যামলাল মুখুয্যে বাঁশবেড়ে বাবুদের জমিদারিতে কি কাজ করতেন। পুষ্প ছিল ভারি সুন্দরী মেয়ে–তার হাসি–সে হাসি কেবল পুষ্পই হাসতে পারতো। দোষের মধ্যে পুষ্প ছিল অত্যন্ত গর্বিত মেয়ে। তার বিশ্বাস ছিল তার মত সুন্দরী মেয়ে এবং তার বাবার মত সম্রান্ত লোক গঙ্গার ওপারে কোথাও নেই।
ধীরে ধীরে পুষ্পের সঙ্গে ওর আলাপ হয়, ধীরে ধীরে সে আলাপ জমে। ও তখন তেরো বছরের ছেলে, পুষ্প তেরো বছরের মেয়ে। সমান বয়স হোলে কি হবে, বাচাল ও বুদ্ধিমতী পুষ্পের কাছে যতীন, ভেসে যেতো। পুষ্প চোখে-মুখে কথা কইতো, যতীন সপ্রশংস দৃষ্টিতে তার গর্বিত সুন্দর মুখের দিকে নীরবে চেয়ে রইত। মস্ত অশ্বত্থ গাছ যে পুরোনো ঘাটটায় ওপরে, যেটার নাম সেকালে ছিল বুড়োশিবতলার ঘাট, ওই ঘাটে কতদিন সে ও পুষ্প একা বসে গল্প করেচে, জগদ্ধাত্রী পূজোর ভাসানের দিন পাঁপরভাজা কিনে ঘাটের রানার ওপর বসে দুজনে ভাগ করে খেয়েচে। কেমন করে যে সেই রূপগৰ্ব্বিতা বালিকা তার মত সাদাসিধে ধরনের বালককে অত পচ্ছন্দ করেছিল, অত দিনরাত মিশতো, নিত্য তাদের বাড়ী না গেলে অনুযোগ করতো–এ সব কথা যতীন জানে না, সে সব বোঝবার বয়েস তখন ওর হয়নি।
দু-দশ দিন নয়, দেড় বছর দুবছর ধরে দুজনে কত খেলা করেছে, কত গল্প করেচে, কত ঝগড়া করেছে, পরস্পরের নামে পরস্পরের গুরুজনের কাছে কত লাগিয়েছে, আবার দুজনে পরস্পরে যেচে সেধে ভাব করেছে–সে কথা লিখতে গেলে একখানা ইতিহাসের বই হয়ে। পড়ে।
মাসীমার মৃত্যুর পরে কেওটার পথ বন্ধ হোল। বছরখানেকের মধ্যে পুষ্পও বসন্ত হয়ে মারা গেল। দেশে থাকতে পুষ্পর মৃত্যুসংবাদ মেসোমশায়ের চিঠিতে সে জেনেছিল। তারপর তেরো বছর কেটে যাওয়ার পরে ছাব্বিশ বছর বয়সে যতীন বিবাহ করে। বাল্যের তেরো বছর–বহুদিন। পুষ্প তখন ক্ষীণ স্মৃতিতে পর্যবসিত হয়েছে। তারপর আশালতার সঙ্গে নবীন অনুরাগের রঙীন দিনগুলিতে পুষ্প একেবারে চাপা পড়ে গেল। কিন্তু চাপা পড়ে যাওয়া আর ভুলে যাওয়া এক জিনিস নয়। মানুষের মনের মন্দিরে অনেক কক্ষ, এক এক কক্ষে এক এক প্রিয় অতিথির বাস। সে কক্ষ সেই অতিথির হাসিকান্নার সৌরভে ভরা, আর কেউ সেখানে ঢুকতে পারে না। প্রেমের এ অতিথিশালা বড় অদ্ভুত, অতিথি যখন দূরে থাকে তখনও যে কক্ষ সে একবার অধিকার করেছে সে তারই এবং তারই চিরকাল। আর কেউ সে কক্ষে কোনো দিন কোনো কালে ঢুকতে পারে না। সে যদি আর ফিরেও না আসে কখনো, চিরদিনের জন্যই চলে যায় এবং জানিয়ে দিয়েও যায় যে সে ইহজীবনের মতই চলে যাচ্ছে–তখন তার সকল স্মৃতির সৌরভ সুদ্ধ সে ঘরের কবাট বন্ধ করে দেওয়া হয়–তারই নাম লেখা থাকে সে দোরের বাইরে। তার নামেই উৎসর্গীকৃত সে ঘর আর-কারো অধিকার থাকে না দখল করবার।
পুষ্পের ঘরের কবাট বন্ধ ছিল–চাবি দেওয়া, বাইরে ছিল পুষ্পের নাম লেখা। হয়তো চাবিতে মরচে পড়েছিল, হয়তো কবাটের গায়ে ধুলো মাকড়সার জাল জমেছিল, হয়তো এ ঘরের সামনে অনেক দিন। কেউ আসে নি, কিন্তু সে ঘর দখল করে কার সাধ্য? আশালতা সে ঘরে ঢোকে নি–আশালতার ঘর আলাদা।
সেই পুষ্প।
যতীন অবাক দৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে রইল। প্রথমেই যে কথাটা ওর মনে উঠলো সেটা এই যে, পুষ্পের সঙ্গে শেষবার দেখা হওয়ার পরে যে বহু বছর কেটে গিয়েচে তেরো বছর পরে সে বিয়ে করে। আশাকে, বিয়ে করেচেও আজ দশ বছর–এই দীর্ঘ, দীর্ঘ তেইশ বছর। পরে কেওটার বুড়োশিবতলার ঘাটের সেই রূপসী মেয়ে বালিকা পুষ্প কোথা থেকে এল? যে বয়সে তারা দুজনে
নৈহাটির ঘাটে
বসে পৈঠার পাটে
খেলা করেছিল ফুল ভাসাবে জলে–!
বুড়োশিবতলার ঘাটের প্রাচীন সোপানশ্রেণীর ওপরে বাঁকাভাবে অস্তসূর্যের আলো এসে পড়েচেঘাটের রানায় শেওলা জমেছে, ঠিক ওপারে হালিসহরে শ্যামাসুন্দরী ঘাটের মন্দিরেও পড়েচে রাঙা আলো, কিন্তু সেটা পড়েছে পশ্চিমদিক থেকে সোজাভাবে গিয়ে, এখনও সেই প্রাচীন পাখীর দল ডাকচে বড় অশত্থাগাছটার ডালে ডালে, সাদা পাল তুলে ইলিশ মাছ ধরা পুরোনো জেলেডিঙির সারি চলেছে ত্রিবেণীর দিকে..যতীন বসে পুষ্পের সঙ্গে গত বারোয়ারীতে যাত্রায় দেখা কি একটা পালার গল্প করচে..তেইশ বছর পরেও পুষ্প এখনও সেই রকমটি দেখতে রয়েচে কেমন করে?
কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে হোল–পুষ্প তো নেই। সে তো বহুঁকাল মরে গিয়েছে। ব্যাপার কি, সে স্বপ্ন দেখছে না কি? পুষ্প কিন্তু এগিয়ে এসে হাসিমুখে বল্লে–অবাক হয়ে চেয়ে দেখছো কি? চিনতে পেরেচো? বল তো আমি কে?
যতীন তখনও হাঁ করে চেয়েই আছে। বল্লে–খুব চিনেছি। কিন্তু তুই কোথা থেকে এলি পুষ্প? তুই তো কত কাল হোল–
পুষ্প খিল খিল করে হেসে উঠে বল্লে–মরে গিয়েচি, অর্থাৎ তোমার হাড় জুড়িয়েছিল–এই তো? কিন্তু তুমিও যে মরে গিয়েচ যতুদা? নইলে তোমার আমার দেখা হবে কেমন করে? তুমিও পৃথিবীর মায়া কাটিয়েচ অর্থাৎ পটল তুলেচ।
যতীনের হঠাৎ বড় ভয় হোল। এ সব কি ব্যাপার? তার জ্বর হয়েছিল খুব, সে কথা মনে আছে। তারপর মধ্যে কি হয়েছিল তার জানা নেই। বর্তমানে বোধ হয় তার জ্বরের ঘোর খুব বেড়েচে, জ্বরের ঘোরে আবোল-তাবল স্বপ্ন দেখচে। তবুও সে এতকাল পরে পুষ্পকে দেখতে পেয়ে ভারি খুশি হোল। স্বপ্নই বটে, বড় মধুর স্বপ্ন কিন্তু!
পুষ্প কিন্তু ওকে ভাববার অবকাশ দিলে না। বল্লে–পুরোনো দিনের মত দুষ্টুমি কোরো না যতুদা। এখন তুমি ছেলেমানুষটি নেই। এখানে। আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে, থাকতে পারচি না–এখন এসো আমার সঙ্গে।
সে হঠাৎ পাগল হয়ে গেল নাকি? সে তো কিছুই বুঝতে পারছে। যাবে কোথায় চলে সে? পুস্পই বা আসে কোথা থেকে? অথচ সে তো এই তার পুরোনো ঘরেই রয়েচে, ঐ তো চূণবালি খসা দেওয়াল, ঐ তো উঠোনের পেঁপে গাছটি, ঐ পৈতৃক আমলের গোলার ভাঙা সিঁড়ি।
পুষ্পকে সে বল্লে–তুই কি করে জানলি আমার অসুখ করেছে? প্রশ্ন করলে বটে, অথচ যতীন সঙ্গে সঙ্গে ভাবলে, আশ্চর্য্য! কাকে একথা জিজ্ঞেস করচি? পুষ্প, যে তেইশ বছর আগে মারা গিয়েছে, তাকে? অদ্ভুত স্বপ্ন তো! এমনধারা স্বপ্ন তো সত্যিই জীবনে কোনদিন। দেখি নি!
পুষ্প বল্লে–কি করে জানলুম? বেশ কথাটি বল্লে তো যতুদা! তোমার এই ঘরে তোমার কাছে আমি বসে নেই পরশু তোমার জ্বর। হওয়ার দিন থেকে? দিন রাতে অনবরতই তো তোমার শিয়রে বসে।
–বলিস কি পুষ্প! আমার শিয়রে তুই বসে আছিস দুদিন থেকে? পুষ্প, একটা কথা বল তো–আমি পাগল হয়ে যাই নি তো জ্বরের ঘোরে?
–সবাই ও-রকম কথা বলে যতুদা। প্রথম প্রথম যারা আসে, তাদের বারোআনা ওই কথাই বলে। তারা বুঝতে পারে না তাদের। কি হয়েচে। তুমিও জ্বালালে যতুদা।
কথা শেষ করে পুষ্প ওর হাত ধরে খাট থেকে নামিয়ে নিতেই যতীন বেশ সুস্থ ও হালকা অনুভব করলে নিজেকে। তারপর কি মনে করে খাটের দিকে একবার চাইতেই সে বিস্ময়ে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। খাটের ওপর তার মত একটা দেহ নিজ্জীর্ব অবস্থায় পড়ে। ঠিক তার মত চোখ মুখ–সবই তার মত।
পুস্প বল্লে–দাঁড়িও না যতুদা–এসো আমার সঙ্গে। কেমন, এখন। বোধ হয় বিশ্বাস হয়েছে? বুঝলে এখন?
পুষ্প তো ঘরের দরজা খুললে না? তবে তারা ঘরের বাইরে এসে দাঁড়ালো কী করে! এখনও রাত আছে। অন্ধকার রয়েছে, মাথার ওপরে অগণ্য তারা জ্বলচে, নবীন বাঁড়য্যের বাড়ীর দিকে একটা কুকুরে ঘেউ ঘেউ করছে। অথচ এই ঘন অন্ধকার রাত্রে সে চলেচে কোথায়? কার সঙ্গেই বা চলেচে? এখনও কি সে স্বপ্ন দেখছে?
পুষ্প বল্লে–এখন বিশ্বাস হোল যতুদা? দেওয়ালের মধ্যে দিয়ে বার হয়ে এলাম দেখলে না?
-–কি করে এলাম?
–ইটের দেওয়াল এখন তোমার আমার কাছে ধোঁয়ার মত। আমাদের এ শরীরে পৃথিবীর জড় পদার্থের স্পর্শ লাগবে না। আর একটা মজা তোমায় দেখাবো, পায়ে হেঁটে যেও না, মনে ভাবো যে। উড়ে যাচ্চি
যতীন মনে মনে তাই ভাবলে। অমনি সে দেখলে তার দেহ রবারের বেলুনের মত আকাশ দিয়ে উড়ে চলেচে। দুজনে চললো, পুষ্প আগে, যতীন তার পেছনে। কোথায় যাচ্চে, যতীন কিছুই জানে না।
সে অনেক কথা ভাবছিল যেতে যেতে। এত অদ্ভুত ঘটনা তার জীবনে আর কখনো হয়নি। স্বপ্নে কি এমন সব ব্যাপার ঘটে? স্বপ্ন যদি না হয়। তবে কি সে পাগল হয়ে গেল? তাই বা কেমন করে হয়, তবে পুষ্প আসে কোথা থেকে? কিম্বা সবটাই মনের ধাঁধা–hallucination?
–একেই বলে মৃত্যু?
এরই নাম যদি মৃত্যু হয় তবে লোকে এত ভয় করে কেন? কেউ তো কখনো তাকে বলেনি যে মৃত্যুর পরে মানুষ জীবিত থাকে–বরং তার মনে হচ্চে সে আরও বেশি জীবন্ত হয়েছে–বেঁচেই বরং রোগের যন্ত্রণায় দুর্বল হয়ে পড়েছিল।
হঠাৎ যতীন দেখলে যে সে এক নতুন দেশে এসেচে–দেশটা পৃথিবীর মতই। তার পায়ের তলায় নদী, গাছপালা, মাঠ, সবই আছে–কিন্তু তাদের সৌন্দর্য অনেক বেশি। আকাশের দিকে চেয়ে দেখলে, সূৰ্য্য দেখা যায় না–অথচ অন্ধকারও নেই–ভারি চমৎকার এক ধরনের। অপার্থিব মৃদু আলোকে সমগ্র দেশটা উদ্ভাসিত। গাছপালার পাতা ঘন সবুজ, নানাধরনের ফুল, সেগুলো যেন আলো দিয়ে তৈরী।
এক জায়গায় এসে পুষ্প থামলো।
একি! এ তো সেই পুরোনো দিনের কেওটা-সাগঞ্জের বুড়োশিবতলার ঘাট। ঐ গঙ্গা। ঐ সেই প্রাচীন অশ্বত্থ গাছটা। ঐ তো বুড়োশিবের ভাঙা মন্দিরটা। পৃথিবীতে মাঝে মাঝে গোধূলির সময় মেঘলা আকাশে যেমন একটা অদ্ভুত হলদে আলো হয়, ঠিক তেমনি একটা মৃদু, তাপহীন, চাপা আলো গাছপালায়, গঙ্গার জলে, বুড়োশিবের মন্দিরের চূড়োয়। ওকে ঘাটের সোপানে একা বসিয়ে পুষ্প কোথায় চলে গেল। যতীন চুপ করে বসে অদ্ভুত আলোকে রঙীন গঙ্গাবক্ষের দিকে চেয়ে রইল। বাল্যের শত সুখের, শত আনন্দস্মৃতির রঙ্গস্থল সেই পুরোনো জায়গা–ঐ তো ওপারে শ্যামাসুন্দরীর ঘাট, শ্যামাসুন্দরীর মন্দির। কিন্তু আশ্চৰ্য্য এই যে, কোনো দিকে আর কোনো লোকজন নেই। এতখানি সুবিস্তীর্ণ স্থান একেবারে নির্জন। কেউ কোথাও নেই সে ছাড়া!
এমন সময়ে অশ্বত্থ গাছের তলায় সেই প্রাচীন পথটা দিয়ে পুষ্পকে আসতে দেখা গেল। তার খোঁপায় কি একটা ফুলের মালা জড়ানো।
যতীন বল্লে–এ কোথায় আলি পুষ্প? বুড়োশিবতলার ঘাট না? এ কি সাগঞ্জ-কেওটা?
পুষ্প যে সত্যিই দেবী, যতীন তার দিকে চেয়ে সেটা এবার ভালভাবেই বুঝতে পারলে। এমন গাঢ়যৌবনা, শান্ত আনন্দময়ী মূৰ্ত্তি মানবীর হয় না–কি রূপই তার ফুটেছে। কি জ্যোতির্ময় মুখশ্রী! যতীন অবাক হয়ে ওর দিকে চেয়ে রইল।
পুষ্প বল্লে–না যতুদা–এ স্বর্গ। সকলের স্বর্গ তো এক নয়!…
তারপর মৃদু হেসে সলজ্জ সুরে ওর মুখের দিকে চেয়ে বল্লে–এ আমাদের স্বর্গ তোমার আর আমার স্বর্গ।