ফরসা হয়ে গেল রাত। সঙ্গে সঙ্গে রাতের মোহ যেন খানিকটা কেটে গেল। মনে মনে ভাবলাম—যাই না কেন বাড়িতে। সুরবালার সঙ্গে দেখা করে আবার আসবো এখন।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত যাওয়া হল না, নিয়তির ফল বোধ হয় খণ্ডন করা দুঃসাধ্য। যদি যেতাম বাড়িতে মাঝির কথায়, তবে হয়তো ঘটনার স্রোত অন্য দিকে বইতো। কিন্তু আমি ডাক্তারি পাশ করেছিলাম বটে মেডিকেল কলেজ থেকে, তবুও আমি মূর্খ। ডাক্তারি শাস্ত্র ছাড়া অন্য কোনো শাস্ত্র আমি পড়ি নি, ভালো কথা কোনো দিন আমায় কেউ শোনায় নি, জীবনের জটিলতা ও গভীরতা সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই আমার। সরল ও অনভিজ্ঞ মন নিয়ে পাড়াগাঁয়ের নিরক্ষর রোগীদের হাত দেখে বেড়াই।
যাওয়া হলো না, কারণ গোবিন্দ দাঁ ও আবদুল হামিদ এসে প্রস্তাব করলে আজ একটা বনভোজনের আয়োজন করা যাক। আমি দেখলাম, যদি পিছিয়ে যাই তবে ওরা বলবে, ডাক্তার টাকা দিতে হবে বলে পিছিয়ে গেল। ওদের মঙ্গলগঞ্জ থেকে বছরে অনেক টাকা আমি উপার্জন করি, তার কিছু অংশ ন্যায্যত আমোদ-প্রমোদের জন্যে দাবি করতে পারে।
বললাম—কি করতে চাও? যা চাও দেবো।
আবদুল হামিদ বললে—ভালো একটা ফিস্টি।
গোবিন্দ দাঁ বললে—আপনার নৌকোটা নিয়ে চলুন মহানন্দ পাড়ার চরে। দুটো মুরগী যোগাড় করা হয়েচে, আরও দুটো নেবো। পোলাও, না ঘি-ভাত, না লুচি—যা-কিছু বলবেন আপনি।
আমি বললাম—আমি দাম দিয়ে দিচ্ছি জিনিসপত্তরের। তবে আমাকে জড়িও না।
দুজনেই সমস্বরে হৈ চৈ করে উঠল। তা কখনো নাকি হয় না। আমাকে বাদ দিয়ে তারা স্বর্গে যেতেও রাজী নয়।
গোবিন্দ দাঁ বললে—কেন, মুরগিতে আপত্তি? বলুন তো বাদ দিয়ে শেখহাটি থেকে উত্তম মণ্ডলের ভেড়া নিয়ে আসি! পনেরো সের মাংস হবে।
আমি বললাম—আমায় বাদ দাও।
—কেন বলুন?
খুব সামলে গেলাম এ সময়। মুখ দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল আর একটু হলে যে, আমার মন ভালো নয়। ভাগ্যিস সে কথা উচ্চারণ করি নি। ওরা তখুনি বুঝে নিত। ঘুঘু লোক সব। বললাম—শরীর খারাপ হয়েচে।
গোবিন্দ দাঁ তাচ্ছিল্যের সুরে বললে—দিন দিন, দশটা টাকা ফেলে দিন। শরীর খারাপ টারাপ কিছু নয়, আমরা দেখব এখন। মাছের চেষ্টায় যেতে হবে। তা হলে আপনার নৌকো ঠিক রইল কিন্তু!
—মাঝিকে বাড়ি পাঠাবো ভেবেছি। আমি যাচ্চি নে খবরটা দিতে হবে তো?
—কালও তো যান নি।
—যাই নি বলেই আজ আরও বেশি করে খবর পাঠানো দরকার।
গোবিন্দ দাঁ বললে—আমি সাইকেলে লোক পাঠাচ্চি এক্ষুনি।
সব ঠিকঠাক হল। ওদের রুচিমতো ওদের পিকনিক হবে, এতে আমার মতামতের কোনো স্থান নেই, মূল্যও নেই। কিন্তু আমি ঘোর আপত্তি জানালাম যখন বুঝতে পারলাম যে ওদের নিতান্ত ইচ্ছে, পান্নাকে নিয়ে যাবে আমার নৌকো করে পিকনিকের মাঠে। ওরাও নাছোড়বান্দা। আমি শেষে বললাম, ওরা নিয়ে যেতে চায় পান্নাকে খুব ভালো, আমি যাবো না সেখানে।
গোবিন্দ দাঁ বললে—কেন এতে আপত্তি করচেন ডাক্তারাবু?
—না। তোমরা পান্নাকে পিকনিক-সহচরী করতে চাও—ভালো, আমাকে বাদ দাও।
—সে কি হয় ডাক্তারবাবু? তবে পান্নাকে বাদ দেওয়া যাক, কি বল প্রেসিডেন্ট সাহেব?
প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ (নসরাপুর ইউনিয়ন বোর্ডের) একগাল অমায়িক হাসি হেসে বললে—না, ও পান্না-টান্নাকে বাদ দিতে পারি, কিন্তু ডাক্তারবাবুকে—কক্ষনো না।
আমি কৃতার্থ হই। যথারীতি ওদের স্থূলরুচি অনুযায়ী বনভোজন সম্পন্ন হয়। সন্ধ্যার আগে ওরা তাড়াতাড়ি ফিরলো আসরে যাবে বলে। আমি গেলুম ওদের সঙ্গে। সেই রাত্রে পান্না আবার আমার ডাক্তারখানায় এসে হাজির। আমি জানতাম ও ঠিক আসবে, মনে মনে ওর প্রতীক্ষা করি নি এ কথা বললে মিথ্যে কথা বলা হবে। আমার সমস্ত মনপ্রাণ ওর উপস্থিতি কামনা করেনি কি?
ও এসেই হাসিমুখে সহজ সুরে বললে—আসরে যাওয়া হয় নি যে বড়?
অদ্ভুতভাবে দুষ্টু মেয়ের মতো চোখ নাচিয়ে ও প্রশ্নটা করলে। এখন যেন ও আমাকে আর সমীহ করে না। আমার খুব কাছে যেন এসে গিয়েচে ও। যেন কতদিনের বন্ধুত্ব ওর সঙ্গে, কতকাল থেকে আমাকে চেনে। বললাম—বসো।
ও গালে হাত দিয়ে কৃত্রিম বিস্ময়ের সুরে বলল—ওমা, কি ভাগ্যি! আমাকে আবার বসতে বলা! কক্ষনো তো শুনি নি!
আমি হেসে বললাম—ক’দিন তোমার সঙ্গে আলাপ, পান্না? এর মধ্যে বসতে বলবার অবকাশই বা ক’বার ঘটলো?
—ভালো, ভালো। আবার নাম ধরেও ডাকা হলো! ওমা, কার মুখ দেখে না জানি আজ উঠেছিলুম, রোজ রোজ তার মুখই দেখব।
—মতলব কি এঁটে এসেচ বল দিকি?
পান্না হাসিমুখে ঘাড় একদিকে ঈষৎ হেলিয়ে আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে চেয়ে বললে—ভয়ে বলব, না নির্ভয়ে বলব?
—নির্ভয়ে বলো।
—ঠিক?
—ঠিক।
—আমার সঙ্গে কলকাতায় চলুন। আজই, এখুনি—
কথা শেষ করে ছুটে এসে আমার পায়ের কাছে পড়ে ফুলের মতো মুখ উঁচু করে আমার মুখের দিকে চেয়ে বললে—চলুন।
ওর চোখে মিনতি ও করুণ আবেদন।
অপূর্ব রূপে পান্না যেন ঝলমল করে উঠল সেই অপ্রত্যাশিত মুহূর্তে। পান্না যেন সুন্দরী মৎস্যনারী, অনেকদূরের অথৈ জলে টানচে আমাকে ওর কুহক দৃষ্টি।
সেই ভোররাত্রেই পান্নার সঙ্গে আমি কলকাতা রওনা হই।
পান্না ও আমি এক গাড়িতে।
ওর সে সহচরী কোথায় গেল তা আমি দেখি নি। তাকে ও তত গ্রাহ্য করে বলে মনেও হল না। তার বয়স বেশি, তাকে কেউ সুনজরে বড় একটা দেখে না।
গাড়িতে উঠে পান্না আমার সামনের বেঞ্চিতে বসল। হু হু করে গাড়ি চলেচে, গাছপালা, গরু, পাখি, ঝোপঝাপ সটসট করে বিপরীত দিকে চলে যাচ্চে, স্টেশনের পর স্টেশন যাচ্চে আসচে।
আমার কোনো দিকে নজর নেই।
আমি ওর মুখের দিকে চেয়ে আছি, বেশি কথা বলতে পাচ্ছি নে ওর সঙ্গে, কারণ গাড়িতে লোক উঠচে মাঝে মাঝে। এক একবার খুব ভিড় হয়ে যাচ্চে, এক একবার গাড়ি ফাঁকা হয়ে যাচ্চে। তখন পান্না আমার দিকে অনুরাগ-ভরা দৃষ্টি মেলে চাইচে।
মদের চেয়েও তার তীব্র নেশা।
এক স্টেশনে পান্না বললে—তাহলে?
ওর সেই বদমাইশ ধরনের চোখ নাচিয়ে কথাটা শেষ করে। আমি জানি, পান্না খুব বদমাইশ মেয়ে, আমি ওকে দেবী বলে ভুল করি নি মোটেই। দেবী হয় সুরবালাদের দল। দেবীদের প্রতি আমার কোনো মোহ নেই বর্তমানে। দেবীরা এমন চোখ নাচাতে পারে? এমন বদমাইশির হাসি হাসতে পারে? এমন ভালোমানুষকে টেনে নিয়ে ঘরের বার করতে পারে? এমন পাগল করে দিতে পারে রূপে ও লাবণ্যের লাস্যলীলায়?
দেবীদের দোষ, মানুষকে এরা আকৃষ্ট করতে পারে না। শুধু দেবী নিয়ে কি ধুয়ে খাব? আমার গোটা প্রথম যৌবন সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গিয়েচে দেবীদের সংসর্গে। দূর থেকে ওদের নমস্কার করি।
পান্না যে প্রশ্ন করলে, তার উত্তর আমি দিলাম না।
আমি এখন ওর প্রশ্নের উত্তর দেবার অবস্থায় নেই। আমার মন যেন অসীম অনন্ত আকাশে নিরবলম্ব ভ্রমণে বেরিয়েচে। দুরন্ত সে পথ-যাত্রা। কিন্তু পান্না যে আগ্রহ জাগিয়েচে তা পরিতৃপ্ত করতে পারবে কি?
পান্নার মুখে আবার সেই দুষ্টুমিভরা হাসি। বললে—উত্তর দিলেন না যে?
আমি বললাম—পান্না, তুমি আমার সঙ্গে কতদূর যেতে পারবে?
ও হাসি-হাসি মুখে বললে—কেন?
—কলকাতায় গিয়েও কাজ নেই।
—সে কি কথা, কোথায় যাবো তবে?
—আমি যেখানে বলব।
—কলকাতায় যাবো না—তবে আমার বাসাবাড়ি, জিনিসপত্তর কি হবে? থাকবো কোথায় বলুন?
—ও সব ভাবনা যদি ভাববে তবে আমায় নিয়ে এলে কেন?
—আপনার কি ইচ্ছে বলুন।
—বলব পান্না? পারবে তা?
—হ্যাঁ, বলুন।
—আমার সঙ্গে নিরুদ্দেশ যাত্রায় ভাসতে পারবে?
পান্না ঘাড় একদিকে বেঁকিয়ে বললে—কোথায়?
—যেখানে খুশি। যেখানে কেউ থাকবে না, তুমি আর আমি শুধু থাকবো। যেখানে হয়, যত দূরে—
—হুঁ-উ-উ-উ—
—ঠিক?
—ঠিক।
বলেই ও আবার আগের মতো হাসি হাসলে।
ওর ওই হাসিই আমাকে এমন চঞ্চল, এমন ছন্নছাড়া করে তুলেচে। নিরীহ গ্রাম্য ডাক্তার থেকে আমি দুঃসাহসী হয়ে উঠেচি—ওই হাসির মাদকতায়। বললাম—সব ভাসিয়ে দিতে রাজী আছ আমার সঙ্গে বেরিয়ে?
—সব ভাসিয়ে দিতে রাজী আছি আপনার সঙ্গে।
বলেই ও খিল খিল করে হেসে উঠল।
গাড়িতে এই সময়টায় কেউ নেই। আমি ওর হাত দুটো নিজের হাতে নিয়ে বললাম—তাহলে কলকাতায় কেন?
—না, আপনি যেখানে বলেন—
—ভেবে দ্যাখো। সব ছাড়তে হবে কিন্তু। খেমটা নাচতে পারবে না। টাকাকড়ি রোজগার করতে পারবে না।
পান্না যদি তখন বলতো, ‘খাব কি’—তবে আমার নেশা কেটে যেতো, শূন্য থেকে আছাড় খেয়ে মাটিতে পড়ে যেতাম তখুনি। কিন্তু পান্নার মুখ দিয়ে সে কথা বেরুলো না। সে ঘাড় দুলিয়ে বললে—এবং বললে অতি অদ্ভুত কথা, অদ্ভুত সুরে; বললে—তুমি আর আমি একা থাকবো। যেখানে নিয়ে যেতে ইচ্ছে হয়—মুজরো করতে দাও করবো, না করতে দাও, তুমি যা করতে বলবে করবো—
আমি তখন নিষ্ঠুর হয়ে উঠেচি, প্রেমের ও মোহের নিষ্ঠুরতায়—ওর মুখে ‘তুমি’ সম্বোধনে। আমি বলি—যদি গাছতলায় রাখি? না খেতে দিই?
—মেরে ফেলো আমাকে। তোমার হাতে মেরো। টুঁ শব্দটি যদি করি তবে বোলো পান্না খারাপ মেয়ে ছিল।
—তোমার আত্মীয়-স্বজন?
—কেউ নেই আমার আত্মীয়য়স্বজন।
—তোমার মা নেই?
পান্না তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে ঠোঁট উলটে দুর্দান্ত বিদ্রোহের সুরে বললে—ভারী মা!
—বেশ চলো তবে। যা হয় হবে। আমি কিন্তু পয়সা নিয়ে বার হই নি, তা তুমি জানো?
—আবার ওই কথা?
বেলা তিনটের সময় ট্রেন শেয়ালদ’ পৌঁছুলে স্টেশন থেকে সোজা একখানা ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করে ভবানীপুর অঞ্চলের এক ক্ষুদ্র গলিতে পান্নার বাসায় গিয়ে ওঠা গেল।
রাত্রে আমার ভালো ঘুম হল না। আমি এমন জায়গায় কখনো রাত কাটাই নি। পল্লীটা খুব ভালো শ্রেণীর নয়, লোক যে না ঘুমিয়ে সারা রাত ধরে গানবাজনা করে, এও আমার জানা ছিল না। সকালে উঠে পান্নাকে বললাম—পান্না, আমি এখানে থাকবো না।
পান্না বিস্ময়ের সুরে বললে— কেন?
—এখানে মানুষ থাকে?
—চিরকাল তো এখানে কাটালুম।
—তুমি পারো, আমার কর্ম নয়।
—আমি কি করবো তুমিই বলো। আমার কি উপায় আছে?
আমি এ কথায় উত্তর দিলাম না। একটু পরে বেলা হলে এক প্রৌঢ়া ঘরে ঢুকে আমার দিকে দু-একবার চেয়ে দেখে আবার চলে গেল। পান্না কোথায় গেল তাও জানি নে, একাই অনেকক্ষণ বসে রইলাম।
বেলা ন’টার সময় প্রৌঢ়াটি আবার ঘরে ঢুকে আমায় বললে—আপনার বাড়ি কোথায়? এ প্রশ্ন আমার ভালো লাগলো না। বললাম—কেন?
—তাই শুধুচ্চি।
—যশোর জেলায়।
বুড়ী বসে পড়লো ঘরের মেজেতে। সে ঘরের মেজেতে সবটা গদি-তোশক পাতা, তার ওপরে ধবধবে চাদর বিছানো, এক কোণে দুটো রূপোর পরী, তাদের হাতে হুঁকো রাখবার খোল। দেওয়ালে দুটো ঢাকনি-পরানো সেতার কিংবা তানপুরো, ভালো বুঝি না। পাঁচ-ছ’খানা ছবি টাঙানো দেওয়ালে। এক কোণে চৌকি পাতা, তার ওপরে পুরু গদিপাতা বিছানা, ঝালর বসানো মশারি, বড় একটা কাঁসার পিকদান চৌকির তলায়। ঘরের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা থাকা সত্বেও মনে হয় সবটা মিলে অমার্জিত রুচির পরিচয় দিচ্চে, গৃহস্থবাড়ির শান্তশ্রী এখানে নেই।
বুড়ী বললে—তুমি ক’দিন থাকবে বাবা?
—কেন বলুন তো?
—পান্না তোমাদের দেশে গান করতে গিয়েছিল?
—হ্যাঁ।
—তাই যেন তুমি ওর সঙ্গে এসেচ পৌঁছে দিতে?
—তাই ধরুন আর কি।
—একটা কথা বলি। স্পষ্ট কথার কষ্ট নেই। এ ঘরে তুমি থাকতে পারবে না। ওকে রোজগার করতে হবে, ব্যবসা চালাতে হবে। ওর এখানে লোক যায় আসে, তারা পয়সা দেয়। তুমি ঘরে থাকলে তারা আসবে না। যা—বলো আমি স্পষ্ট কথা বলব বাপু! এতে তুমি রাগই করো, আর যাই করো! এসেচ দেশ থেকে ওকে পৌঁছে দিতে, বেশ। পৌঁছে দিয়েচ, এখন দু’-একদিন শহরে থাকো, দেখো শোনো, ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাও—আমি যা বুঝি। চিড়িয়াখানা দেখেচ? সুসায়েড দেখেচ? না দেখে থাকো, আজ দুপুরে গিয়ে দেখে এস—
এই সময় পান্না ঘরে ঢুকে বুড়ীর দিকে চেয়ে বললে—মাসী, ঘরে বসে কি বলচো ওঁকে?
বুড়ী ঝাঁঝের সঙ্গে বললে—কি আবার বলব? বলচি ভালো মানুষের ছেলে, কলকেতা শহরে এসেচ, শহর দেখে দু’দিন দেখাশুনো করে বাড়ি চলে যাও। পৌঁছে তো দিয়েচ, এখন দেখো শোনো দুদিন, খাও মাখো—আমি তো না বলচি নে বাপু। ও ছুঁড়ি যখনই বাইরে যায়, তখনই ওর পেছনে কেউ না কেউ—সেবার খুলনে গেল, সঙ্গে এল সেই পরেশবাবু। পোড়ারমুখো নড়তে আর চায় না। পনেরো দিন হয়ে গেল, তবু নড়ে না—বলে, পান্নার সঙ্গে আমার বিয়ে দাও মাসী—সে কি কেলেঙ্কারি! তবে পান্না তাকে মোটেই আমল দেয়নি, তাই সে টিকতে পারলো না—নইলে বাপু, তা অমন কত এল, কত গেল!
পান্না বললে—আঃ মাসী, কি বলচো বসে বসে? যাও—
বুড়ী হাত-পা নেড়ে বললে—যাবো না কি থাকতে এসেচি? তোমার ঘাড়ে বাসা বেঁধে বসেচি? এখন অল্প বয়েস, বয়েস-দোষ যে ভয়ানক জিনিস। হিত-কথা শুনবি তো এই মাসীর মুখেই শুনবি—বেচাল দেখলে রাশ কে আর টানতে যাবে, কার দায় পড়েচে?
বুড়ী গজ গজ করতে করতে উঠে চলে গেল।
আমি পান্নাকে অনেকক্ষণ দেখি নি। অনুযোগের সুরে বললাম—আমি বাড়ি চলে যাব আজ, ঠিক বলচি—
—কেন? কেন? ওই বুড়ীর কথায়! তুমি—
—সে জন্যে না। তুমি এতক্ষণ কোথায় ছিলে?
—এই!
পান্না মুখে কাপড় দিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠল।
আমি রাগের সঙ্গে বললাম—হাসচো যে বড়?
ও বললে—তোমার কথা শুনলে না হেসে থাকা যায় না। তুমি ঠিক ছেলেমানুষের মতো। আমি এমন মানুষ যদি কখনো দেখেচি!
বলেই হাত দুটো অসহায় হাস্যের ভঙ্গিতে ওপরের দিকে ছুঁড়ে ফেলবার মতো তুলে আবার হাসতে লাগলো।
ওর সেই অপূর্ব ভঙ্গি হাত ছোঁড়ার, সারা দেহের ঝলমলে লাবণ্য, মুখের হাসি আমাকে সব ভুলিয়ে দিলে। ও আমার কাছে এসে আমার হাত ধরে বললে—তুমি চলে গেলেই হল! মাইরি! পায়ে মাথা কুটবো না?
আমাকে ও চা দিয়ে গেল। বললে—খাবে কিছু?
সুরবালার কথা মনে পড়লো। সুরবালা এমন বলতো না, খাবার নিয়ে এসে রাখতো সামনে। আমি জানি এদের সঙ্গে সুরবালাদের তফাৎ কত। না জেনে বোকার মতো আসি নি। সুরবালা সুরবালা, পান্না পান্না—এ নিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে বাক্যবিন্যাস করে কোনো লাভ নেই। পান্না খাবার নিয়ে এল। চারখানা তেলেভাজা নিমকি, একমুঠো ঘুগনিদানা, দুখানা পাঁপড় ভাজা। এই প্রথম ওর হাতের জিনিস আমাকে খেতে হবে। মন প্রথমটা বিদ্রাহ করে উঠেছিল—কিন্তু তার পরেই শান্ত হয়ে এল। কেন খাব না ওর হাতে?
একটা কথা আমার মনে খচখচ করে বাজছিল। পান্নার ঘরে লোক আসে রাত্রে, বুড়ী বলছিল। যতবার এই কথাটা মনে ভাবি, ততবার যেন আমার মনে কি কাঁটার মতো বাজে।
বললাম কথাটা পান্নাকে।
পান্না বললে—কি করতে বলো আমায়?
—এ সব ছেড়ে দাও।
হয় পান্না খুব চালাক মেয়ে, নয় আমার অদৃষ্টলিপি—আবার পান্না বললে—যা তুমি বলবে—
সে বললে না, ‘খাব কি’ ‘চলবে কিসে’ প্রভৃতি নিতান্ত রোমান্স-বর্জিত বস্তুতান্ত্রিক কথা। কেন বললে না কতবার ভেবেছি। বললেই আমার নেশা তখুনি সেই মুহূর্তেই ছুটে যেতো। কিন্তু পান্না তা বললে না। প্রতিমার মাটির তৈরী পা ও আমাকে দেখতে দিলে না।
দু-দুবার এরকম হল। অদৃষ্টলিপি ছাড়া আর কি!
আমি বললাম—চলো আমরা—
কিন্তু মাথা তখন ঘুরছে। কোনো সাংসারিক প্ল্যান আঁটবার মতো মনের অবস্থা তখন আমার নয়। ওই পর্যন্ত বলে চুপ করলাম। পান্না হেসে বললে—খুব হয়েচে, এখন নাইবে চলো।
—চলো। কোথায়?
—কলতলায়।
—ওখানে বড্ড নোংরা। তা ছাড়া এ বাড়িতে চারিদিকে দেখচি শুধু মেয়েছেলের ভিড়। ওদের মধ্যে বসে নাইবো কি করে?
—ঘরে জল তুলে দিই—?
—তার চেয়ে চলো কালীঘাটের গঙ্গায় দুজনে নেয়ে আসি।
পান্নাও রাজী হল। দুজনে নাইতে বেরুবো, এমন সময়ে সেই বুড়ী মাসী এসে হাজির হল। কড়াসুরে আমায় বললে—বলি ওগো ভালোমানুষের ছেলে, একটা কথা তোমায় শুধাই বাপু—
আমি ওর রকম-সকম দেখে ঘাবড়ে গিয়ে বললাম—বলুন।
—তুমি বাপু ওকে টুইয়ে কোথায় নিয়ে বের করচো?
—ও নাইতে যাচ্ছে আমার সঙ্গে।
—ও! আমার ভারি নবাবের নাতি রে। পান্না তোমার ঘরের বৌ নাকি যে, যা বলবে তাই করতে হবে তাকে? ওর কেউ নেই? অত দরদ যদি থাকে পান্নার ওপর, তবে মাসে ষাট টাকা করে দিয়ে ওকে বাঁধা রাখো। ওর গহনা দেও, সব ভার নাও—তবে ও তোমার সঙ্গে যেখানে খুশি যাবে। ফেলো কড়ি মাখো তেল, তুমি কি আমার পর?
আমি চুপ করে রইলাম। পান্না সেখানে উপস্থিত ছিল না, সাবানের বাক্স আনতে ঘরের মধ্যে গিয়েছিল। বুড়ী ওর অনুপস্থিতির এ সুযোগটুকু ছাড়লে না। আবার বললে—তুমি এয়েচ ভালোমানুষের ছেলে পান্নাকে পৌঁছে দিতে, মফঃস্বলের লোক—বেশ, যেমন এয়েচ, দুদিন থাকো, খাও মাখো, কলকাতার পাঁচটা জায়গা দেখে বেড়াও, বেড়িয়ে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাও। পান্নাকে নিয়ে টানা-হেঁচড়া করবার দরকার কি তোমার? তুমি গেঁয়ো নোক, শহরের রাত কি, তুমি তা জানো না! তোমার ভালোর জন্যই বলচি বাছা—
বুড়ীর সে কথা যদি তখন আমি শুনতাম!
যাক সে কথা।
পান্নাকে আর আমি পীড়াপীড়ি করি নি নাইতে যাবার জন্যে। ওকে কিছু না বলে আমি নিজেই নাইতে গেলাম একা। ফিরে আসতে পান্না বললে—এ কি রকম হল?
—কেন?
—একা নাইতে গেলে?
—আমি গেঁয়ো লোক। কলকাতা দেখতে এসেচি, দেখে ফিরে যাই। দরকার কি আমার রাজকন্যের খোঁজে!
—আমি কি রাজকন্যে নাকি?
—তারও বাড়া।
— কেন?
—সে সব কথায় দরকার নেই। আমি আজই বাড়ি চলে যাবো।
—ইশ! মাইরি? পায়ে মাথা কুটবো না? কি হয়েচে বলো—সত্যি বলবে!
আমি বুড়ীর কথা কিছু বলা উচিত বিবেচনা করলাম না। হয়তো তুমুল ঝগড়া আর অশান্তি হবে এ নিয়ে। না, এ বাড়িতে আমার থাকা সম্ভব হবে না আর। একদিনও না। নিজের মন তৈরি করে ফেললাম, কিন্তু পান্নাকে সে কথা কিছু বলি নি। বিকেলের দিকে বেড়াতে যাবার নাম করে বেরিয়ে সোজা শেয়ালদ’তে গিয়ে টিকিট কাটবো।
খাওয়ার সময় পান্না নিজের হাতে পরিবেশন করে খাওয়ালে। আগের রাত্রে আমি নিজেই দোকান থেকে লুচি ও মিষ্টি কিনে এনে খেয়েছিলাম। আজ ও বললে—আমি নিজে মাংস রান্না করচি তোমার জন্যে, বলো খাবে? এমন সুরে অনুরোধ করলে, ওর কথা এড়াতে পারলাম না। বড় এক বাটি মাংস ও নিজের হাতে আমার পাতের কাছে বসিয়ে দিলে, সামনে বসে যত্ন করে খাওয়াতে লাগলো বাড়ির মেয়েদের মতো। কিন্তু একটা কাজ ও হঠাৎ করে বসল, আমার মাংসের বাটি থেকে একটু মাংস তুলে নিয়ে মুখে দিয়ে তখন বলচে—খাব একটু তোমার এ থেকে?
তারপর হেসে বললে—দেখচি কেমন হয়েচে!
আমার সমস্ত শরীর যেন সঙ্কুচিত হয়ে উঠল, এত কালের সংস্কার যাবে কোথায়? আমি বললাম—ও এঁটো হাত যেন দিও না বাটিতে। ছিঃ—
পান্না দুষ্টুমির হাসি হেসে হাত খানিকটা বাটির দিকে বাড়িয়ে বললে—দিলাম হাত, ঠিক দেবা—দিচ্ছি কিন্তু—
পরে নিজেই হাত গুটিয়ে নিয়ে বললে—না না, তাই কখনো করি? হয়তো তোমার খাওয়া হবে না—খাও, তুমি খাও—
আমি জানি কোনো মার্জিতরুচি ভদ্রমহিলা অতিথিকে খাওয়াতে বসে তার সঙ্গে এমন ধরনের ব্যবহার করতো না—কিন্তু পান্না যে শ্রেণীর মেয়ে, তার কাছে এ ব্যবহার পেয়ে আমি আশ্চর্য হই নি মোটেই।
পান্না বললে—মাংস কেমন হয়েচে?
—বেশ হয়েচে।
—আমায় নিয়ে যাও এখান থেকে।
—কোথায়?
—যেখানে তোমার খুশি—
পরে বাঁকা ভুরুর নিচে আড়-চাউনি দিয়ে আমার দিকে চেয়ে বলল—আমি তোমার, যেখানে নিয়ে যাবে—
সে চাউনি আমাকে কাণ্ডজ্ঞান ভুলিয়ে দিলে, আমি এঁটো হাতেই ওর পুষ্পপেলব হাতখানা চেপে ধরতে গেলাম, আর ঠিক সেই সময়েই সেই বুড়ী সেখানে এসে পড়লো। আমার দিকে কটমট চোখে চেয়ে দেখলে, কিছু বললে না মুখে। কি জানি কি বুঝলে!
আমি লজ্জিত ও অপ্রতিভ হয়ে ভাতের থালার দিকে চাইলাম। কোনো রকমে দু’চার দলা খেয়ে উঠে পড়ি তখুনি।
.
কাউকে কিছু না বলে সেই যে বেরিয়ে পড়লাম, একেবারে সোজা শেয়ালদ’ স্টেশনে এসে গাড়ি চেপে বসে দেশে রওনা।
সুরবালা আমায় দেখে অবাক হয়ে আমার দিকে চাইলে। তারপর বললে—কোথায় ছিলে?
—কলকাতায় গিয়েছিলাম, সেখান থেকে আসচি।
—তা আমিও ভেবেছি। সবাই তো ভেবে-চিন্তে অস্থির, আমি ভাবলাম ঠিক কোনো দরকারী কাজ পড়েচে, কলকাতায় টলকাতায় হঠাৎ যেতে হয়েচে। একটা খবর দিয়েও তো যেতে হয়। এমন তো কখনো করো নি?
—এমন অবস্থাও তো এর আগে কক্ষনো হয় নি। সবাই ভালো আছে?
—তা আছে। নাও, তুমি গা হাত ধুয়ে নাও, চা করে নিয়ে আসি। খাওয়া হয়েচে?
একটু পরে সুরবালা চা করে নিয়ে এল। বললে—বাবাঃ, এমন কখনো করে? ভেবেচিন্তে অস্থির হতে হয়েচে। সনাতনবাবু তো দু’বেলা হাঁটাহাঁটি করচেন। নৌকোর মাঝি ফিরে এসে বললে— বাবু শেষ রাত্তিরে কোথায় চলে গেলেন হঠাৎ—আমাকে কিছু বলে তো যান নি—সনাতনদা আবার যাবেন বলছিলেন মঙ্গলগঞ্জে খোঁজ নিতে। যান নি বোধ হয়—
সনাতনদা ভাগ্যিস মঙ্গলগঞ্জে যায় নি! সেখানে গেলেই সব বলে দিত গোবিন্দ দাঁ বা আবদুল হামিদ। এখনও ওরা অবিশ্যি জানে না, আমি বাড়ি চলে এসেছিলাম না কলকাতায় গিয়েছিলাম। সনাতনদা অনুসন্ধান করতে গেলেই ওরা বুঝতে পারতো আমি পান্নার সঙ্গেই চলে গিয়েছি।
একজন লোককে পাঠিয়ে দিলাম সনাতনদা’র বাড়িতে খবর দিতে যে আমি ফিরে এসেছি।
সুরবালার মুখ দেখে বুঝলাম ওর মনে কোনো সন্দেহ জাগে নি। ওর মন তো আমি জানি, সরলা শান্ত স্বভাবের মেয়ে। অতশত ও কিছু বোঝে না। ও আমাকে খাওয়াতে মাখাতেই ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
তবুও আমার মুখের দিকে চেয়ে চেয়ে ও যেন কি দেখলে।
আমি বললাম—কি দেখচো?
—তোমার শরীর ভালো আছে তো?
—কেন?
—তোমার মুখ যেন শুকিয়ে গিয়েছে—কেমন যেন দেখাচ্চে—
হেসে উড়িয়ে দেবার ভঙ্গিতে বললাম—ও, এই!
সুরবালা উদ্বেগের সুরে বললে—না সত্যি, তোমার মুখে যেন—
—ও কিছু না। একটু ঘুমুই—
—একটু ওষুধ খাও না কিছু? তুমি তো বোঝ—
—কিছু না। মশারিটা ফেলে দিয়ে যাও, ঘুমুই একটু—
.
সকালে সনাতনদা এসে হাজির হল। বললে—একি হে? তুমি হঠাৎ কোথাও কিছু নয়, কোথায় চলে গেলো? বৌমা কেঁদেকেটে অস্থির!
বললাম—কলকাতায় গিয়েছিলাম।
—কেন, হঠাৎ?
—বিশেষ কারণ ছিল।
—সে আমি বুঝতে পেরেছি। নইলে তোমার মতো লোক হঠাৎ অমনি না বলা-কওয়া, কলকাতা চলে যাবে? তা কি কারণটা ছিল—
—সে একটা অন্য ব্যাপার।
সনাতনদা আর বেশি পীড়াপীড়ি করলে না। আমার মুশকিল আমি মিথ্যে কথা বড় একটা বলি নে, বলতে মুখে বাধে—বিশেষ কাজে হয়তো বলতে হয় কিন্তু পারতপক্ষে না বলারই চেষ্টা করি। অন্য কথা পাড়লাম তাড়াতাড়ি। সনাতনদা দু’তিনবার চেষ্টা করলে কলকাতা যাবার কারণটা জানবার। আমি প্রতিবারই কথা চাপা দিলাম। সনাতনদা বললে—মঙ্গলগঞ্জে যাবে নাকি?
—যাবো বৈকি। রুগী রয়েচে।
—আমিও চলো যাই—
—তুমি যাবে?
—চলো বেড়িয়ে আসি—
সর্বনাশ! বলে কি সনাতনদা? মঙ্গলগঞ্জে গেলেই ও সব জানতে পারবে হয়তো। ওর স্বভাবই একে-ওকে জিজ্ঞেস করা। গোবিন্দ দাঁ সব বলে দেবে। কিন্তু আমার এখনও সন্দেহ হয়, গোবিন্দ দাঁ বা মঙ্গলগঞ্জের কেউ এখনো হয়তো জানে না আমি কোথায় গিয়েছিলাম।
সনাতনদা বললে—কবে যাবে?
—দেখি কালই যাবো হয়তো।
সনাতনদা চলে গেল। আমি তখনই সাইকেল চেপে মঙ্গলগঞ্জে যাবার জন্যে তৈরি হলাম। আগে সেখানে গিয়ে আমায় জানতে হবে। নয়তো সনাতনদাকে হঠাৎ নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না।
সুরবালাকে বলতেই সে ব্যস্তভাবে বললে—না গো না, এখন যেও না—
—আমার বিশেষ দরকার আছে। মঙ্গলগঞ্জে যেতেই হবে।
—খেয়ে যাও।
—না, এসে খাব।
সাইকেলে যেতে তিন চার মাইল ঘুর হয়। রাস্তায় এই বর্ষাকালে জল কাদা, তবুও যেতেই হবে।
বেলা সাড়ে দশটার সময় মঙ্গলগঞ্জের ডিসপেনসারির দোর খুলতেই চাকরটা এসে জুটলো। বলেলে—বাবু, পরশু এলেন না? আপনি গিয়েলেন কনে?
— কেন?
—আপনার সেই মাঝি নৌকো নিয়ে ফিরি গেল।
—তোর সে খোঁজে কি দরকার? যা নিজের কাজ দেখগে—
একটু পরে গোবিন্দ দাঁ এল কার মুখে খবর পেয়ে। ব্যস্তভাবে বললে—ডাক্তার, ব্যাপার কি? কোথায় ছিলেন?
—কেন?
—সেদিন গেলেন কোথায়? মাঝি আমাকে জিজ্ঞেস করলে। শেষে নৌকো নিয়ে গেল। এখন আসা হচ্চে কোথা থেকে?
—বাড়ি থেকেই আসচি। সেদিন একটু বিশেষ দরকারে অন্যত্র গিয়েছিলাম।
—তবুও ভালো। আমরা তো ভেবেচিন্তে অস্থির।
গোবিন্দ দাঁ সন্দেহ করে নি। হাঁপ ছেড়ে বাঁচা গেল। গোবিন্দ দাঁ-ই সব চেয়ে ধূর্ত ব্যক্তি, সন্দেহ যদি করতে পারে, তবে ওই করতে পারতো। ও যখন সন্দেহ করে নি, তখন আর কারো কাছ থেকে কোনো ভয় নেই। আমি ভয়ানক কাজে ব্যস্ত আছি দেখাবার জন্যে আলমারি খুলে এ শিশি ও শিশি নাড়তে লাগলাম। গোবিন্দ দাঁ একটু পরে চলে গেল।
ও যেমন চলে গেল আমি একা বসে রইলুম ডিসপেনসারি ঘরে। অমনি মনে হল পান্না ঠিক ওই দোরটি ধরে সেদিন দাঁড়িয়ে ছিল। আমার মনে হল একা এখানে এসে আমি ভুল করেছি। পান্নার অদৃশ্য উপস্থিতিতে এ ঘরের বাতাস ভরে আছে—হঠাৎ তার সেই অদ্ভুত ধরনের দুষ্টুমির হাসিটি ফুটে উঠল আমার সামনে। মন বড় চঞ্চল হয়ে উঠল।
সে কি সাধারণ চঞ্চলতা?
অমন যে আবার হয় তা জানতাম না।
পান্না এখানে ছিল, সে গেল কোথায়? সেই পান্না, অদ্ভুত ভঙ্গি, অদ্ভুত দুষ্টুমির হাসি নিয়ে! তাকে আমার এখুনি দরকার। না পেলে চলবে না, আমার জীবনে অনেকখানি জায়গা যেন ফাঁকা হয়ে গিয়েছে, সে শূন্যতা যাকে দিয়ে পুরতে পারে সে এখানে নেই—কতদূর চলে গিয়েছে! আর কি তাকে পাবো?
পান্নার অদৃশ্য আবির্ভাব আমাকে মাতাল করে তুলেচে। ওই চেয়ারটাতে সেদিন সে বসেছিল। এখান থেকে ডিসপেনসারি উঠিয়ে দিতে হবে।
পকেট খুঁজে দেখি মোটে দুটো টাকা। বিষ্ণু সাধুখাঁর দোকান পাশেই। তাকে ডাকিয়ে বললাম—দশটা টাকা দিতে পারবে?
—ডাক্তারবাবু, প্রাতঃপ্রণাম। কোথায় ছিলেন?
—বাড়ি থেকে আসচি। টাকা ক’টা দাও তো?
—নিয়ে যান।
তার দোকানের ছোকরা চাকর মাদার এসে একখানা নোট আমার হাতে দিয়ে গেল। আমি সাইকেলখানা ডিসপেনসারির মধ্যে চাবি দিয়ে রেখে স্টেশনে চলে এলাম। আড়াই ক্রোশ রাস্তা হাঁটতে হল সেজন্যে।
.
পান্না আমায় দেখে অবাক। সে নিজের ঘরের সামনে চুপ করে একখানা চেয়ারে বসে আছে—কিন্তু সাজগোজ তেমন নেই। মাথার চুলও বাঁধা নয়।
আমি হেসে বললাম—ও পান্না—
—তুমি।
—কেন? ভূত দেখলে নাকি?
—তুমি কেমন করে এলে তাই ভাবছি!
—কেন আসবো না?
—সত্যি তুমি আমার এখানে এসেচ?
পান্না যে আমাকে দেখে খুব খুশি হয়েচে সেটা তার মুখ দেখেই আমি বুঝতে পারলাম। ওর এ আনন্দ কৃত্রিম নয়। পান্না আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে খাটের ওপর বসিয়ে একখানা হাতপাখা এনে বাতাস করতে লাগলো। ওর এ যত্ন ও আগ্রহ যে নিছক ব্যবসাদারি নয় এটুকু বুঝবার মতো বুদ্ধি ভগবান আমাকে দিয়েচেন। আমি ওর মুখের দিকে চেয়ে দেখলাম বেশ একটু তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে। সে মুখে ব্যবসাদারির ধাঁচও নেই। আমি বিদেশ থেকে ফিরলে সুরবালার মুখ এমনি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, কিন্তু সুরবালার এ লাবণ্যভরা চঞ্চলতা, এত প্রাণের প্রাচুর্য নেই। এমন সুন্দর অঙ্গভঙ্গি করে সে হাঁটতে পারে না, এমন বিদ্যুতের মতো কটাক্ষ তার নেই, এমন দুষ্টুমির হাসি তার মুখে ফোটে না।
পান্না বললে—দেশে গিয়েছিলে?
—হ্যাঁ।
—তবে এলে যে আবার?
—তোমায় দেখতে।
—সত্যি বলো না!
—বিশ্বাস করো। আজ মঙ্গলগঞ্জ থেকে সোজা তোমার এখানে আসচি।
—কেন? বলো, বলতেই হবে।
—বলব না।
—বলতেই হবে, লক্ষ্মীটি!
—তোমার জন্যে মন কেমন করে উঠল। তুমি সেদিন দোর ধরে দাঁড়িয়েছিলে, সে জায়গাটা দেখেই মন বড় অস্থির হল, তাই ছুটে এলাম।
—খুব ভালো করেচ। জানো, আমি মরে যাচ্ছিলাম তোমার সঙ্গে দেখা করবার জন্যে। তুমি যেদিন চলে গেলে, সেদিন থেকে—
—কেন মিথ্যে কথাগুলো বলো? ছিঃ!
পান্না খাড়া হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ঘাড় বেঁকিয়ে বললে—কি? আমি তোমার পায়ে মাথা কুটে মরবো দেখো তবে—আমি মিথ্যে কথা বলচি?
আমি সুখের সমুদ্রে ডুবে গেলাম। কি আনন্দ! সে আনন্দের কথা মুখে বলে বোঝানো যাবে না। এই সুন্দরী লাবণ্যময়ী চঞ্চলা ষোড়শী আমার মতো মধ্যবয়স্ক লোককে ভালোবাসে! এ আমার এত বড় গর্ব, আনন্দের কথা, ইচ্ছে হয় এখুনি ছুটে বাইরে চলে গিয়ে দু’পারের দুই পথের প্রত্যেক লোককে ধরে ধরে চীৎকার করে বলি—ওগো শোনো—পান্না আমাকে ভালোবাসে, আমার জন্যে সে ভাবে।…ভালোবাসা! জীবনে কখনো আস্বাদও করি নি। জানি নে ও জিনিসের রূপ কি। এবার যেন ভালোবাসা কাকে বলে বুঝেচি। ভালোবাসা পেতে হয় এরকম সুন্দরী ষোড়শীর কাছ থেকে, যার মুখের হাসিতে, চোখের কোণের বিদ্যুৎকটাক্ষে ত্রিভুবন জয় হয়ে যায়!
কেন, আমি আজ তেরো বছর হল বিয়ে করেছি। সুরবালা কখনো ষোড়শী ছিল না? সে আমাকে ভালোবাসে না? মেয়েদের ভালোবাসা কখনো কি পাই নি? সে কথার জবাব কি দেবো আমি নিজেই খুঁজে পাই না। কে বলে সুরবালা আমায় ভালোবাসে না? কিন্তু সে এ জিনিস নয়। তাতে নেশা লাগে না মনে। সে জিনিসটা বড্ড শান্ত, স্থির, সংযত, তার মধ্যে নতুন আশা করবার কিছু নেই—নতুন করে দেখবার কিছু নেই—ও কি বলবে আমি তা জানি, বলতেই তাকে হবে, সে আমার বাড়ি থাকে, খায়, পরে। ভালো মিষ্টি কথা তাকে বলতে হবে। তার মিষ্টি কথা আমার দেহেমনে অপ্রত্যাশিতের পুলক জাগায় না। সুরবালা কোনোকালেই এ রকম সজীব, প্রাণচঞ্চলা, সুন্দরী, ষোড়শী ছিল না—তার চোখে বিদ্যুৎ ছিল না।
পান্নার হাত ধরে বসিয়ে দিয়ে বললাম—বসো, ছেলেমানুষি কোরো না—
—তা হলে বললে কেন অমন কথা?
—ঠাট্টা করছিলাম। তোমার মুখে কথাটা আবার শুনতে চাচ্ছিলাম—
—চা করি?
—তোমার ইচ্ছে—
—কি খাবে বলো?
—আমি কি জানি?
—আচ্ছা বোসো। লক্ষ্মী হয়ে বোসো, ভালো হয়ে বোসো, পা তুলে বোসো, পা ধুয়ে জল দিয়ে মুছিয়ে দেবো, সাত রাজার-ধন-এক-মানিক বসো!
—যাও—
আমি বসে একটা সিগারেট ধরিয়েচি, এমন সময় পান্নার মাসী সেই বুড়ী এসে আমার দিকে কটমট করে চাইলে। আমি একটু বিব্রত হয়ে পড়লাম। যেন প্রাইভেট টিউটর ছাত্রকে দিয়ে বাজারের দোকানে সিগারেট কিনতে পাঠিয়ে ছাত্রের অভিভাবকের সামনে পড়ে গিয়েচে।
বুড়ী আরও কাছে এসে বললে—সেই তুমি না? সেদিন চলে গেলে?
গলা ভিজিয়ে বলি—হ্যাঁ।
—তা আবার এলে আজ?
—একটু কাজ আছে—
—কি কাজ?
—কলকাতার কাজ। এই হাটবাজারের—
—তোমার দোকান-টোকান আছে নাকি?
—হ্যাঁ, ওষুধের দোকান—
—ওষুধ কিনতে এসেচ, তা এখানে কেন?
—পান্নার সঙ্গে দেখা করতে।
—কোথায় গেল সে ছুঁড়ী? দেখা হয়েচে?
—হ্যাঁ।
—তোমরা সবাই মিলে ও ছুঁড়ীর পেছনে পেছনে অমন ঘুরচো কেন বলো তো? তোমাদের পাড়াগাঁ অঞ্চলে মেয়েকে পাঠালেই এই কাণ্ড গা! জ্বলে পুড়ে মনু বাপু তোমাদের জ্বালায়। আবার তুমি এসে জুটলে কি আক্কেলে?
আমি এ কথার কি জবাব দেবো ভাবচি, এমন সময় বুড়ী বললে—তোমাকে সেবার ভালো কথা বন্নু বাছা তা তোমার কানে গেল না। তুমি বাপু কি রকম ভদ্দর নোক? বয়েস দেখে মনে হয় নিতান্ত তুমি কচি খোকাটি তো নও—এখানে এলেই পয়সা খরচ করতে হয়, বলি জানো সে কথা? বলি এনেচ কত টাকা সঙ্গে করে? ফতুর হয়ে যাবে বলে দিচ্চি। শহুরে বাবুদের সঙ্গে টেক্কা দিয়ে টাকা খরচ করতে গিয়ে একেবারে ফতুর হয়ে যাবে, এখনো ভালোয় ভালোয় বাড়ি চলে যাও—
—যাবোই তো। থাকতে আসি নি।
—সে কথা ভালো। তবে এত ঘন ঘন এখানে না-ই বা এলে বাপু! ও ছুঁড়ীকেও তো বাইরে যেতে হবে, তোমার সঙ্গে জোড়-পায়রা হয়ে বসে থাকলে তো ওর চলবে না।
এমন সময় পান্না খাবারের রেকাব ও চায়ের পেয়ালা হাতে ঘরে ঢুকে বললে—কি মাসী, কি বলচো ওঁকে? যাও এখন ঘর থেকে—
বৃদ্ধা আমার দিক থেকে ওর দিকে ফিরে বললে—দ্যাখ পানু, বাড়াবাড়ি কোনো বিষয়ে ভালো না। দু’জনকেই হিতকথা শোনাচ্চি বাপু,—কষ্ট পেতে, আমার কি, তোরা দুজনেই পাবি—
পান্না ব্যঙ্গের সুরে বললে—তুমি এখন যাবে একটু এ ঘর থেকে? ওঁকে এখন বোকো না। সমস্ত রাত ওঁর খাওয়া হয় নি, জানো?
বুড়ী বললে—বেশ তো, আমি কি বন্নু খেয়ো না, মেখো না, খাও দাও, তারপর সরে পড়ো—
—তুমি এবার সরে পড়ো দিকি মাসী দেখি—
বুড়ী গজ গজ করতে করতে চলে গেল। পান্না আমার সামনে এসে রেকাব নামাল, তাতে একটুখানি হালুয়া ছাড়া অন্য কিছু নেই। এই অবস্থায় সুরবালা কত কি খাওয়াতো। পান্নার মতো মেয়েরা সেদিক থেকে বড্ড আনাড়ি, খাওয়াতে জানে না। আমার খাওয়ার সময়ে পান্না নিজেই বললে—বুড়ী বড় খিটখিট করে, না? চলো আজ দু’জনে কালীঘাট ঘুরে আসি, কি কোথাও দেখে আসি—
আমি আকাশের চাঁদ হাতে পেলাম যেন। ব্যগ্রভাবে বলি—যাবে তুমি? কখন যাবে? উনি বকবেন না? যেতে দেবেন তোমাকে?
পান্না হেসে লুটিয়ে পড়ে বললে—আহা, কথার কি ছিরি! ওই জন্যেই তো—হি-হি-হি—যাবে তুমি? কখন যাবে? হি-হি-হি—
এই তো অনুপমা পান্না, অদ্বিতীয়া পান্না, হাস্যলাস্যময়ী আসল পান্না, হাজারো মেয়ের ভিড়ের মধ্যে থেকে যাকে বেছে নেওয়া যায়। এমন একটি মেয়ের চোখে তো পড়ি নি কোনোদিন। মন খুশিতে ভরে উঠল, যার দেখা পেয়েচি, যে আমাকে ভালোবেসেচে, পথেঘাটে দেখা মেলে না তার।
.
না, পান্না যে আমাকে ভালোবাসে, এ সম্বন্ধে আমি তত নিশ্চিত ছিলাম না। ওর ভালোবাসা আমাকে জয় করে নিতে হবে এই আমার বড় উদ্দেশ্য জীবনের। এখন যেটুকু ভালোবাসে, ওটা সাময়িক মোহ হয় তো। ওটা কেটে যাবার আগে আমি ওকে এমন ভালোবাসাবো যে আর সমস্ত কিছু বিস্বাদ হয়ে যাবে ওর কাছে। এই আমার সাধনা, এই সাধনায় আমায় সিদ্ধিলাভ করতে হবে। আমাকে পাগল করে দিতে হবে—আমার জন্যে পাগল করে দিতে হবে।
পান্নাকে দেখবার জন্যে ওদের বাড়িতে ঘন ঘন যাতায়াত করবার সাহস আমার হল না। ওর মাসীর মুখের দিকে চাইলে আমার সাহস চলে যেত।
একদিন পান্নাকে বললাম—চলো আমার সঙ্গে।
পান্না হেসে বললে—কোথায় যাবো?
—যে রাজ্যে মাসী পিসীরা নেই।
পান্না খিলখিল করে হেসে উঠে বললে—কোথায়? নদীর ওপারে?
তারপর অপূর্ব ভঙ্গিতে ঘার দুলিয়ে দুলিয়ে বলতে লাগলো—বালি-উত্তরপাড়া? কোন্নগর-হুগলী?
—না।
—তবে?
—আমি যেখানে ভালো বুঝবো। যাবে?
—নিশ্চয়ই।
—এখনি?
—এখুনি।
পান্নাকে আমি খুব ভালোভাবে চিনি নে বটে কিন্তু আমি মানুষ চিনি। ওর চোখের দিকে চেয়ে বুঝলাম পান্না মিথ্যে কথা বলচে না। ও আমার সঙ্গে যেতে রাজী আছে, যেখানে ওকে নিয়ে যাবো। শুধু এইটুকু জানা বোধ হয় আমার দরকার ছিল। যে-ই বুঝলাম ও আমার সঙ্গে যতদূর নিয়ে যাবো যেতে পারে, তখনই আমি একটা অদ্ভুত আনন্দ মনের মধ্যে অনুভব করলাম। সে আনন্দ একটা নেশার মতো আমাকে পেয়ে বসল। সে নেশা আমাকে ঘরে থাকতে দিলে না—সোজা এসে বড় রাস্তার ওপর পড়লাম। সেখান থেকে ট্রামে গড়ের মাঠে এসে একটা গাছের তলায় বেঞ্চিতে নির্জনে বসলাম।
হাতে কত টাকা আছে? কুড়ি পঁচিশের বেশি নয়। এই টাকা নিয়ে কতদূর যেতে পারি দু’জনে? কাশী হয় তো! ফিরতে পারবো না। ফিরবার দরকারও নেই। আর আসবো না। সব ভুলে যাবো, ঘরবাড়ি, সুরবালা, ছেলেমেয়ে। ওসবে আমার কোনো তৃপ্তি নেই। সত্যিকার আনন্দ কখনো পাই নি। এবার নতুন ভাবে জীবনযাত্রা আরম্ভ করবো পান্নাকে নিয়ে।
আজ রাত্রেই যাবো।
মাতালের মতো টলতে টলতে বড় রাস্তায় এসে ট্রাম ধরলাম। এমন সময় পেছন থেকে কে বলে উঠল—কি রে, শোন শোন—
ট্রাম থেকে নেমে পড়লাম। পেছনদিকে চেয়ে দেখি আমার মেডিকেল কলেজের সহপাঠী করালী। অনেকদিন দেখা হয় নি, দেখে আনন্দ হল। ওর সঙ্গে পুরনো কথাবার্তায় অনেকটা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এলাম। করালী ডায়মণ্ডহারবারের কাছে কি একটা গ্রামে প্র্যাকটিস করচে। আমায় বললে, চল একটু চা খাই কোনো দোকানে।
—বেশ, চলো।
আমার চা খাবার বিশেষ কোনো ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু আমার প্রয়োজন ছিল স্বাভাবিক কথাবার্তার মধ্যে দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা। আমি বুঝতে পেরেছিলাম, স্বাভাবিক অবস্থায় আমি আদৌ নেই। করালী গ্রাম্য প্র্যাকটিসের অনেক গল্প করলে। দু’একটা শক্ত কেসের কথা বললে। আমি একমনে বসে শুনছিলাম। করালীকে বললাম—অমনি একটা নিরিবিলি গ্রামের ঠিকানা আমায় দিতে পারিস?
—কেন রে?
—আমি প্র্যাকটিস করবো তোর মতো।
—কেন, তুই তো গ্রামেই বসেছিলি—তাই না? চাকরি নিয়েচিস নাকি?
—জায়গাটা বদলাবো।
—বদলাবি বটে কিন্তু একটা কথা বলি। ডায়মণ্ডহারবার অঞ্চলে ম্যালেরিয়া নেই, গ্রামে বেশি পয়সা হবে না।
—যা হয়।
—আমি দেখব খোঁজ করে। তোর ঠিকানাটা দে আমাকে।
—তোর ঠিকানাটা দে, আমি বরং তোকে আগে চিঠি দেবো।
করালী বিদায় নিয়ে চলে গেল।
আমি পান্নার বাড়িতেই চললাম সোজা। ওর ঘরের বাইরে একটা কাঠের বেঞ্চি আছে, বেঞ্চিটার ঠিক ওপরেই দেওয়ালে একটা পুরনো সস্তা খেলো ক্লকঘড়ি। ঘরের মধ্যে ঢোকবার সাহস আমার কুলালো না, ঘড়ির নীচে বেঞ্চিখানাতে বসে পড়লাম।
অনেকক্ষণ পরে পান্নাই প্রথম এল ওদিকের একটা ঘর থেকে।
আমায় দেখে অবাক হয়ে বললে—এ কি!
বললাম—চুপ, চুপ।
আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললাম—কোথায়?
পান্না হেসে বললে—কে? মাসী? হরিসংকীর্তন না কথকতা কি হচ্ছে গলির মোড়ে, তাই শুনতে গিয়েচে। বুড়ীর দল সবাই গিয়েচে। তাই মলিনাদের ঘরে একটু মজা করে চা আর সাড়ে বত্রিশ ভাজার মজলিশ করছিলাম। আনবো আপনার জন্যে? দাঁড়ান—
আমি ব্যস্তভাবে বললাম—শোনো শোনো, থাক ওসব। কথা আছে তোমার সঙ্গে—
পান্না যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকে আবার যেতে যেতে বললে—বসুন ঠাণ্ডা হয়ে। বুড়ীরা নিচ্চিন্দে হয়ে বেরিয়েচে—রাত ন’টার এদিকে ফিরবে না। চা আর ভাজা খেয়ে কথা হবে এখন বসে বসে।
—বেশ, আমি এত রাত্রে যাব কোথায়?
—এখানে থাকবেন।
—সে সাহস আমার নেই।
পান্না ধমক দিয়ে বললে—আপনি না পুরুষমানুষ? ভয় কিসের? আমি আছি, সে ব্যবস্থা করবো।
—তুমি থাকলে তবু ভরসা পাই।
—বসুন—আসচি—
একটু পরেই পান্না চা আর বাদামভাজা নিয়ে ফিরলো। বললে—চলুন ঘরে।
—না, আমি ঘরে যাব না। এখানেই বসো।
পান্না হঠাৎ এসে খপ করে আমার হাত ধরে বললে—তা হবে না, আসুন।
আমি কৃত্রিম রাগের সুরে বললাম—তুমি আমার হাত ধরলে কেন?
—বেশ করেচি, যাও!
—জান, ওসব আমি পছন্দ করি নে?
—আমি ভয়ও করি নে।
দু’জনে খুব হাসলাম—পান্না তুমি কি আমায় ভালোবাসো? সত্যি জবাব দাও?
পান্না ঘাড় দুলিয়ে বললে—না—
—না, হাসিঠাট্টা রাখো, সত্যি বলো।
—কখনই না।
—বেশ, আমি তবে এই রাত্তিরে চলে যাবো।
—সত্যি?
—যদি ভালো না বাসো, তবে আর মিথ্যে কেন খয়ে-বন্ধন—
পান্না খিলখিল করে হেসে উঠল মুখে আঁচল দিয়ে। ততক্ষণ সে আমার হাত ধরে ঘরের মধ্যে নিয়ে গিয়ে ফেলেচে!
আমি কিন্তু মন ঠিক করে রেখেছি। ফাঁকা কথায় ভুলবার নই আমি। কাল সকালে পান্না আমার সঙ্গে যেতে পারবে কিনা? যেখানে আমি নিয়ে যাবো? সে বিচারের ভার আমার উপর ছেড়ে দিতে পারবে কি ও? আমি জানতে চাই এখুনি।
পান্না সহজ ভাবে বললে—নাও ওগো গুরুঠাকুর, কাল সকালে যখন খুশি তুমি কৃপা করে আমায় উদ্ধার কোরো—এখন চা’টুকু আর ভাজা ক’টা ভালো মুখে খেয়ে নাও তো দেখি!
চা খাওয়া শেষ হয়ে গেল। আমি বললাম—এখন?
পান্না হেসে বললে—কি এখন?
—এখন কি করা যাবে?
—এখানে থাকতে হবে রাত্রে, আবার কি হবে?
আমারও তাই ইচ্ছে। পান্নাকে ছেড়ে যেতে এতটুকু ইচ্ছে নেই আমার। ওর মুখের সৌন্দর্য আমাকে এত মুগ্ধ করেচে যে ওর মুখের দিকে সর্বদা চেয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। কিছুক্ষণ না দেখলে মনে হয় পান্নার মুখ আমার মনে নেই, আদৌ মনে নেই। আর একবার কখন দেখা হবে? পান্নার মুখ ভুলে গেলাম? ওকে না দেখে থাকতে পারি নে। ওর মুখের নেশা মদের নেশার মতোই তীব্র আমার কাছে। বুঝচি মোহ আসচে, সর্বনাশ করচে আমার, অমানুষ করে দিচ্চে আমাকে। কিন্তু ছাড়বার সাধ্য নেই আমার। ছাড়বোই যদি, তবে আর মোহ বলেচে কেন?
মনে মনে ভাবলুম, পান্নার মাসী যে খাণ্ডার, এখানে আমাকে রাত্রে দেখতে পেলে যা খিটখিট করবে।
পান্নাকে বললাম, কিন্তু তোমার সেই মাসী? যিনি জন্মাতেই তাঁর মা জিবে মধু দিয়েছিলেন?
পান্না খিলখিল করে হেসে গড়িয়ে পড়লো। আমার মুখের দিকে হাসি-উপচে-পড়া ডাগর চোখে চেয়ে বললে, সে কি! আবার বলুন ত কি বল্লেন?
—তোমার সেই খাণ্ডার মাসী—
—হ্যাঁ, তারপর?
—যিনি জন্মাতেই তাঁর মা জিবে মধু দিয়েছিলেন!
—ওমা, কি কথার বাঁধুনি!
পান্না হেসে আবার গড়িয়ে পড়লো। কি সুন্দর, লাবণ্যময়ী দেখাচ্ছিল ওকে। হাত দু’টি নাড়ার কি অপূর্ব ভঙ্গি ওর। এ আমি ওর সঙ্গে আলাপ হয়ে পর্যন্ত দেখে আসচি। আমার আরও ভালো লাগলো ওর তীক্ষ্ণ বুদ্ধি দেখে। আমি ঠিক বলতে পারি, সুরবালা বুঝতে পারতো না আমার কথার শ্লেষটুকু, বুঝতে পারলেও তার রস গ্রহণের ক্ষমতা এত নয়, সে এমন উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতে পারতো না। পান্নাকে নতুন ভাবে দেখতে পেলুম সেদিন। আমি ভোঁতা মেয়ে ভালোবাসি নে, ভালোবাসি সেই মেয়েকে মনে মনে, যার ক্ষুরের মতো ধার বুদ্ধির, কথা পড়বামাত্র যে ধরতে পারে।
পান্না আমার কথা শুনে আমার দিকে আকৃষ্ট হয়ে পড়লো, ওর চোখের চাউনির ভাষা গেল বদলে। মেয়েদের এ অদ্ভুত খেলা দু’মিনিটের মধ্যে। তবে সব মেয়ের পক্ষে সম্ভব নয় এ খেলা, তাও জানি। সুরবালাদের মতো দেবীর দল পারে না।
পান্নাকে বললাম, খাব কি?
—কেন, আমাদের রান্না খাবেন না?
—না।
—তবে?
—হোটেল থেকে খেয়ে আসবো এখন।
.
সেরাত্রে মাসী আমার দিকেও এলো না। কেন কি জানি। হয়তো পান্না বারণ করে থাকবে। কেবল অনেক রাত্রে পান্না আর আমি যখন গল্প করচি, ওর মাসী বাইরে এসে আমাদের কথা শুনতে পেয়ে বললে—ওমা, ই কি অনাছিষ্টি কাণ্ড! এখনো তোমাদের চোখে ঘুম এলো না? রাত দুটো বেজেচে যে! পান্না চোখ টিপে আমায় চুপ করে থাকতে বললে—দিব্যি গদি-পাতা ধপধপে বিছানা, পান্না ওদিকে আমি এদিকে বালিশ ঠেস দিয়ে গল্প করচি। আমি ওকে যেন আজ নতুন দেখচি। একদণ্ড চোখের আড়াল করতে পারচি নে। কত প্রশ্ন, কত আলাপ পরস্পরে।
এমনি ভাবেই ভোর হয়ে গেল।
পান্না উঠে বললে—ফুলশয্যের বাসর শেষ হল। তুমি চা খাবে তো? মুখ ধুয়ে নাও—আমি চা করি।
—করো। আজ মনে আছে?
—হ্যাঁ, মনে আছে।
—কি বলো তো?
—আজ তুমি আমায় নিয়ে যাবে।
—চা খেয়ে আমি একটু বেরুবো, তুমি তৈরী হয়ে থাকবে।
—বেশ।
—মাসীকে কিছু বলো না যেন যাওয়ার কথা। বাইরে দেখে এসো তো—কেউ নেই, না আছে?
পান্না মুখ টিপে হেসে বললে—সে আগেই আমি দেখেচি। এখনো কেউ ওঠে নি। তুমি নিশ্চিন্দি থাকো।
চা খেয়ে আমি বাড়ির বার হয়ে একটা পার্কে গিয়ে বসলাম। সারারাত ঘুম হয় নি, ঘুমে চোখ ঢুলে পড়েচে, কিন্তু একটা অদ্ভুত আনন্দে মন পরিপূর্ণ। করালী ঠিকানা দিয়েচে, ওকে একটা চিঠি লিখি। ওর দেশেই গিয়ে একটা বাসা নিয়ে প্র্যাকটিস করবো।
আপাততঃ কলকাতায় একটা ছোটখাটো বাসা দেখে আসা দরকার।
পার্কের বেঞ্চিতে শুয়ে পড়ে একটু ঘুমিয়ে নিলাম। যখন জেগে উঠলাম তখন বেলা সাড়ে ন’টা। একটা নাপিতকে ডেকে দাড়ি কামিয়ে নিলাম। চায়ের দোকানে আর এক পেয়ালা চা খেলাম। এইবার অবসাদ একটু কেটেচে। তারপর বাসা খুঁজতে বেরুই।
কলকাতায় আমায় কেউ চেনে না। ডাক্তারি পড়বার সময়ে যে মেসে থাকতাম, সেটা কলেজ স্কোয়ার অঞ্চলে। সে মেসে আমাদের সময়কার এখন কেউ নেই—যে যার পাশ করে বেরিয়ে গিয়েচে আট দশ বছর আগে। তাহলেও এই অঞ্চলের অনেক মুদী, নাপিত, চায়ের দোকানী আমায় চেনে হয়তো। ও অঞ্চলেও গেলাম না বাসা খুঁজতে। এমন জায়গায় যেতে হবে যেখানে আমাকে কেউ চেনে না। কলকাতা শহর জনসমুদ্র বিশেষ, এখানে লুকিয়ে থাকলে কার সাধ্য খুঁজে বার করে? কে কাকে চেনে এখানে? অজ্ঞাতবাস করতে হলে এমন স্থান আর নেই।
বাসা ঠিক হয়ে গেল। নেবুতলার এক ক্ষুদ্র গলির মধ্যে বাসা। আপাততঃ থাকবার জন্যে, ডাক্তারি এখান থেকে চলবে না, বড় রাস্তার ধারে তার জন্যে ঘর নিতে হবে বা একটু ঠাণ্ডা হয়ে বসে কোনো একটা ডিসপেনসারিতে বসবার চেষ্টা করতে হবে। বাড়িটা ভালো, ছোট হলেও অন্য কোনো ভাড়াটে নেই এই একটা মস্ত সুবিধে। এই রকম বাড়িই আমি চেয়েছিলাম। ওপরে দুটি ঘর, দুটিই বেডরুম হিসেবে ব্যবহার করা যায়, আলো হাওয়া মন্দ নয়।
বাড়িওয়ালা একজন স্বর্ণকার, এই বাড়ি থেকে কিছুদূরে কেরানীবাগান লেনের মোড়ে তার সোনারুপোর দোকান।
বাড়ি আমার দেখা হয়ে গেলে সে আমায় জিজ্ঞেস করলে আমি কবে আসবো। আমি জানালুম আজই আসচি। চাবিটা কোথায় পাওয়া যাবে? সে ওর সোনারূপোর দোকান থেকে চাবিটা নিয়ে আসতে বললে।
এই বাড়িতে পান্না আর আমি নিভৃতে দু’জনে থাকবো!
পান্নাকে এত নিকটে, এত নির্জনে পাবো? ওকে নিয়ে এক বাসায় থাকতে পাবো? এত সৌভাগ্য কি বিশ্বাস করা যায়?
আনন্দে কিসের একটা ঢেউ আমার গলা পর্যন্ত উঠে আসতে লাগলো। আজই দিনের কোনো এক সময়ে পান্না ও আমি এই ঘরে সংসার পেতে বাস করবো। এই ক্ষুদ্র দোতলা বাড়িটা—বাইরে থেকে যেটা দেখলে ঘোর অভক্তি হয়—সে সৌভাগ্য বহন করবে এই বাড়িটাই।
না, হয়তো কিছুই হবে না। পান্না আসবে না, পান্নার মাসী পথ আটকাবে—ওকে আসতেই বাধা দেবে।
বাড়িওয়ালা আমার দেরি দেখে নিচে থেকে ডাকাডাকি করতে লাগলো। সে কি জানবে আমার মনের ভাব?
বাড়ি দেখে যখন বেরুলাম তখন বেলা একটা। খিদে পেয়েচে খুবই, কিন্তু আনন্দে মন পরিপূর্ণ, খাওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই।
বৌবাজারের মোড়ের একটা শিখ-হোটেল থেকে দু’খানা মোটা রুটি আর কলাইয়ের ডাল, বড় এক গ্লাস চা পান করি। চা জিনিসটা আমার সর্বদাই চাই। অন্ন আহার না করলেও আমার কোনো কষ্ট হয় না, যদি চা পাই। ঠিক করলাম বাসাতে পান্নাকে এনে আজই ওবেলা সর্বাগ্রে আমার চায়ের সরঞ্জাম কিনে আনতে হবে। পান্না চা করতে জানে না ভালো, ওকে শিখিয়ে নিতে হবে চা করতে।
বেলা তিনটের পর পান্নাদের বাসাতে গিয়ে পৌঁছুলাম। পান্না অঘোরে ঘুমুচ্চে, কাল রাত্রি-জাগরণের ফলে। পান্নার মাসীও ঘুমুচ্চে ভিন্ন ঘরে। পান্নাকে আমি ঘুম থেকে উঠিয়ে বললাম—সব তৈরি। বাসা দেখে এসেচি। কখন যাবে?
পান্না ঘুমজড়িত চোখে বললে—কোথায়?
—বেশ! মনে নেই? উঠে চোখে জল দাও।
—খেয়েচ?
—না খেয়ে এসেচি?
—আমি তোমার জন্যে লুচি ভেজে রেখেচি কিন্তু। আমাদের এখানে লুচি খেতে দোষ কি?
—দোষের কথা নয়। তুমি চল আমার সঙ্গে। সেখানে তুমি ভাত রেঁধে দিলেও খাব।
—ইস! মাইরি! আমার কি ভাগ্যি।
—আমি গাড়ি নিয়ে আসি?
—বোসো। চোখে জল দিয়ে আসি—
—তোমার মাসী ঘুমুচ্চে—এই সবচেয়ে ভালো সময়।
—বোসো। আসচি।
একটু পরে পান্না সত্যিই সেজেগুজে এল।
বললে—কোনো জিনিস নেই আমার, একটা পেঁটরা আছে কেবল। সেটা নিলুম আর এই কাপড়ের বোঁচকাটা।
আমি বললাম—চলো ওই নিয়ে। বাসে উঠবো, আর দেরি করো না।
—দেওয়ালে দু’খানা পিকচার আছে, আমার নিজের পয়সায় কেনা, খুলে নিই—
পান্না ঠকাঠক শব্দ করে পেরেক তুলতে লাগলো দেখে আমার ভয় হল। বললাম—আঃ, কি করো? ওসব থাকগে। তোমার মাসী জেগে কুরুক্ষেত্র বাধাবে এখুনি!
পান্না হেসে বললে—সে পথ বন্ধ। আমি বলেই রেখেচি মুজরো করতে যেতে হবে আমাকে আজ। নীলি সঙ্গে যাবে। নীলি সেই মেয়েটি গো, আমার সঙ্গে যে গিয়েছিল মঙ্গলগঞ্জ।
.
একটু পরে আমরা দু’জনে রাস্তায় বার হই।
নেবুতলার বাসার সামনে রিকশা দাঁড় করিয়ে কেরানীবাগান লেনের স্বর্ণকারের দোকানে চাবি আনতে গেলাম। বাড়িওয়ালা একগাল হেসে বললে—এসেচেন? কিন্তু—
—কিন্তু কি?
—চাবি নিয়ে আসিগে। দাঁড়ান একটু।
—আমি আমার স্ত্রীকে যে রিকশাতে বসিয়ে রেখে এসেছি। ওই বাড়ির সামনে।
—আপনি মাঠাকরুণের কাছে চলে যান। আমি চাবি নিয়ে যাচ্ছি—
পান্না নাকি মাঠাকরুণ! মনে মনে হাসতে হাসতে এলাম।
আমার ইচ্ছে নয় যে বাড়িওয়ালা পান্নাকে দেখে। পান্নার সিঁথিতে সিঁদুর নেই, হঠাৎ মনে পড়লো। পান্নাকে বললাম—তাড়াতাড়ি ঘোমটা দাও। বাড়িওয়ালা আসচে।
খিলখিলিয়ে হেসে উঠেই পান্না হঠাৎ চুপ করে ঘোমটা টেনে দিল। অভিনয় করতে দেখলুম ও বেশ পটু। যতক্ষণ বাড়িওয়ালা আমাদের সঙ্গে রইল বা ওপরে নিচের ঘরদোর দেখাতে লাগলো, ততক্ষণ পান্না এমন হাবভাব দেখাতে লাগলো যেন সত্যিই ও নিতান্ত লজ্জাশীলা একটি গ্রাম্যবধূ।
বাড়িওয়ালা বললে—একটা অসুবিধা দেখচি যে—
—কি?
—আপনি আপিসে বেরিয়ে যাবেন। মাঠাকরুণ একা থাকবেন—
—তা একরকম হয়ে যাবে।
—আমার মেয়ে আছে, না হয় সে মাঝে মাঝে এসে থাকবে।
—তা হবে।
বাড়িওয়ালা তো চলে গেল।
সঙ্গে সঙ্গে পান্না ঘোমটা খুলে বললে—বাবাঃ, এমন বিপদেও—দম বন্ধ হয়ে মরেছিলুম আর একটু হলে আর কি!
তারপর বললে—বাসা তো করলে দিব্যিটি। কিন্তু এত বড় বাড়ি নিলে কেন? একটা ঘর হলে আমাদের চলে যেত। এত বড় বাড়ি সাজাবে কি দিয়ে? না আছে একটা মাদুর বসবার, না একখানা কড়া, না একটা জল রাখবার বালতি!
—সব হবে ক্রমে ক্রমে।
—না হলে আমার কি? আমি মেজেতেই শুতে পারি!
একটি মাত্র পেঁটরা সঙ্গে এসেচে। তার মধ্যে সম্ভবতঃ পান্নার কাপড়-চোপড়। পেতে বসবার পর্যন্ত একটা কিছু নেই। তাও ভাগ্যে বাড়িওয়ালা ঘরগুলো ধুয়ে রেখেছিল, নতুবা ঘর ঝাঁট দেবার ঝাঁটার অভাবে ধূলিশয্যা আশ্রয় করতে হত। পান্না বললে—চা একটু খাবে না? সকাল বেলা চা খাও নি তো।
কথাটা আমার ভালো লাগলো, ও যদি বলতো, চা একটু খাব তা হলে ভালো লাগতো না। ও যে আমার সুখ-সুবিধে দেখচে, গৃহিণী হয়ে পড়েচে এর মধ্যেই, এটা ওর নারীত্বের স্বপক্ষে অনেক কিছু বললে। সত্যিকার নারী।
আমি বললাম—দোকান থেকে আমি—
—তাও তো পাত্র নেই, পেয়ালা নেই, চা খাবে কিসে?
—নারকোলের খোলায়।
দু’জনেই হেসে উঠলুম একসঙ্গে। উচ্চরবে মন খুলে এমন হাসি নি অনেকদিন। পান্না বেশ মেয়ে, সঙ্গিনী হিসাবে আনন্দ দান করতে পারবে প্রতি মুহূর্তে। সুরবালার মতো দেবী সেজে থাকবে না।
সকাল ন’টা। রান্নার কি ব্যাপার হবে ওকে জিজ্ঞেস করলাম। দু’জনে আবার পরামর্শ করতে বসি। অমন সাজানো ঘর-সংসার ছেড়ে এসে রিক্ততার আনন্দ নতুন লাগচে। এখানে আমাকে নতুন করে সব করতে হবে। কিছু নেই আমার এখানে।
পান্না বললে—কাছে হোটেল নেই?
—তা বোধ হয় আছে।
—দুথালা ভাত নিয়ে এসো আমাদের জন্যে, এবেলা কিছুরই যোগাড় নেই, ওবেলা যা হয় হবে।
—থালা দেবে?
—তুমি খেয়ে এসো, আমার জন্যে নিয়ে এসো শালপাতা কি কলার পাতা কিনে।
—সে বেশ মজা হবে, কি বলো?
—খুব ভালো লাগবে। তুমি নাইবে, তোমার কাপড় আছে?
—কিছু না। শুধু-হাতে বাড়ি থেকে বেরিয়েচি। কাপড় কোথায়?
—আমার শাড়ি পোরো একখানা। নেয়ে নাও। কলের জল চলে যাবে।