৪. স্কুলের সময় হইয়া গিয়াছে

যদুবাবু বাজার করিয়া বাসায় ফিরিলেন। স্কুলের সময় হইয়া গিয়াছে। স্ত্রীকে বলিলেন, মাছটা ভেজে দাও, ন’টা বেজে গিয়েছে—আজ একজামিন আরম্ভ হবে কিনা। ঠিক টাইমে না গেলে সাহেব বকাবকি করবে।

শীতকালের বেলা। বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হইবে বলিয়া যদুবাবু সকালে উঠিয়া বাসার অতি ক্ষুদ্র দাওয়াটাতে দাড়ি কামাইতে বসিয়াছিলেন। দাড়ি কামানো শেষ করিয়া বাজারে গিয়াছিলেন।

দৈর্ঘে্য সাত ফুট, প্রস্থে সাড়ে তিন ফুট ঘর—দাওয়ার এক পাশে রান্নাঘর। ঘরের  জানালা খুলিলে পিছনের বাড়ির ইঁট-বাহির-করা দেওয়াল চোখে পড়ে। ভাগ্যে শীতকাল, তাই রক্ষা—সারা গরমকাল ও বর্ষাকালের ভীষণ গুমটে অধিকাংশ দিন রাত্রে ঘুম হইত না, তাই সাড়ে আট টাকা ভাড়া।

ভাত খাইতে খাইতে যদুবাবু বলিলেন, বাসা বদলাব, এখানে মানুষ থাকে না, তার ওপর অবনীটা এ বাসার ঠিকানা জানে। ও যদি আবার এসে জোটে—

যদুবাবুর স্ত্রী বলিল, তা অবনী ঠাকুরপো তোমার স্কুলে যাবে, স্কুল তো চেনে। বাসা বদলালে কী হবে! কী বুদ্ধি!

—ওগো, না না। স্কুলে আমাদের যার-তার ঢোকবার জো নেই। দারোয়ানকে বলে রেখে দেব, হাঁকিয়ে দেবে। এ বাড়ির ভাড়াটাও বেশি।

—এর চেয়ে সস্তা আর খুঁজো না। টিকতে পারবে না সে বাসায়। এখানে আমি যে কষ্টে থাকি! তুমি বাইরে কাটিয়ে আস, তুমি কী জানবে?

— কলকাতার বাইরে ডায়মন্ডহারবার লাইনে গড়িয়া কি সোনারপুরে বাসা ভাড়া পাওয়া যায়—সস্তা, কিন্তু ট্রেনভাড়াতে মেরে দেবে।

স্কুলে যাইতে কিছু বিলম্ব হইয়া গিয়াছে। মিঃ আলম ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া বলিলেন, ক্লাসে পেপার দেওয়া হয় নি। এত দেরি করে এলেন প্রথম দিনটাতেই?

একটু পরেই হেডমাস্টারের টেবিলের সামনে গিয়া যদুবাবুকে দাঁড়াইতে হইল। সাহেব বলিলেন, যদুবাবু, বড়ই দুঃখের কথা—কাজে আপনার আর মন নেই দেখা যাচ্ছে।

—না স্যার, বাড়িতে অসুখ।

—ওসব ওজর এখানে চলবে না—মাই গেট ইজ ওপন—যদি আপনার না পোষায়—

—স্যার, এবার আমায় মাপ করুন—আর কখনও এমন হবে না।

ব্যাপার মিটিয়া গেল। যদুবাবু আসিয়া হলে পরীক্ষারত ছেলেদের খবরদারি আরম্ভ করিলেন।

—এই দেবু, পাশের ছেলের খাতার দিকে চেয়ে কী হচ্চে?

একটি ছেলে উঠিয়া বলিল, তিনের কোশ্চেনটা স্যার একটু মানে করে দেবেন?

—কই, দেখি কী কোশ্চেন! এ আর বুঝতে পারলে না? বুড়ো ধাড়ি ছেলে—তবে পড়াশুনোর দরকার কী?

—স্যার, এধারে ব্লটিংপেপার পাই নি—একখানা দিয়ে যাবেন!

হেডমাস্টার একবার আসিয়া চারিদিক ঘুরিয়া দেখিয়া গেলেন। গেম-টিচার পাশের ঘরে চেয়ারে বসিয়া একখানা নভেল পড়িতেছিল, হেডমাস্টারকে হলে ঢুকিতে দেখিয়া বইখানা টেবিলে রক্ষিত ছেলেদের বইয়ের সঙ্গে মিশাইয়া দিল। পিছরের বেঞ্চিতে দুইটি ছেলে পাশাপাশি বসিয়া বই দেখিয়া টুকিতেছিল, হেডমাস্টারকে পাশের হলে ঢুকিতে শুনিয়া বইখানা একজন ছেলে তাহার শার্টের তলায় পেটকোচঁড়ে বেমালুম গুঁজিয়া ফেলিল।

জিনিসটা এবার গেম-মাস্টারের চোখ এড়াইল না, কারণ তাহার দৃষ্টি আর নভেলের পাতায় নিবদ্ধ ছিল না, ধীরে ধীরে কাছে গিয়া ছেলেটির পিঠে হাত দিয়া গেম-টিচার কড়াসুরে হাঁকিল, কী ওখানে? দেখি বার কর—

ছেলেটির মুখ শুকাইয়া গিয়াছে। সে বলিল, কিছু না স্যার—

—দেখি কেমন কিছু না—

বলা বাহুল্য, বই নিছক জড়পদার্থ, যেখানে রাখ সেখানেই থাকে, টানিতেই বাহির হইয়া পড়িল, ছেলেটি বিষণ্ণমুখে দাঁড়াইয়া এদিক ওদিক চাহিতে লাগিল। তাহার অপকার্যের সাথী পাশের ছেলেটি তখন একমনে খাতার উপর ঝুঁকিয়া পড়িয়া নিতান্ত ভালোমানুষের মত লিখিয়া চলিয়াছে।

দণ্ডায়মান ছাত্রটি হঠাৎ তাহার দিকে দেখাইয়া বলিল, স্যার, ক্ষিতীশও তো এই বই দেখে লিখছিল!

ক্ষিতীশ বিস্মিত দৃষ্টিতে তাহার মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, আমি! আমি টুকছিলাম?

গেম-টিচার বইখানি ক্ষিতীশকে দেখাইয়া বলিলেন, এই বই দেখে তুমিও টুকছিলে?

ক্ষিতীশ অবাক হইয়া ফ্যালফ্যাল করিয়া বইখানির দিকে চাহিয়া রহিল, যেন জীবনে সে এই প্রথম সে-বইখানা দেখিল।

—আমি স্যার টুকব বই দেখে! আমি!

তাহার মুখের ক্ষুব্ধ, অপমানিত ও বিস্মিত ভাব দেখিয়া মনে হয়, যেন গেম-মাস্টার তাহাকে চুরি বা ডাকাতি কিংবা ততোধিক কোনো নীচ কার্যে অপরাধী স্থির করিয়াছেন!

সুতরাং সে বাঁচিয়া গেল। তাহার বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ নাই—এক আসামী ছাত্রের উক্তি ছাড়া গেম-মাস্টার কিছু দেখেন নাই। আসামী হেডমাস্টারের টেবিলের সম্মুখে নীত হইল, সেখানেও সে তাহার সঙ্গীর নাম করিতে ছাড়িল না।

হেডমাস্টার হাঁকিলেন, বি এ স্পোর্ট, আর ইউ নট অ্যাশেমড অফ নেমিং ওয়ান অফ ইওর ক্লাস-মেটস—কাম, হ্যাভ ইট—

সপাসপ বেতের শব্দে আশেপাশের ঘরের ও হলের ছাত্ররা ভীত ও চকিত দৃষ্টিতে হেডমাস্টারের আপিস-ঘরের দিকে চাহিল।

ঢং ঢং করিয়া ঘণ্টা পড়িল।

পাহারাদার শিক্ষকেরা হাঁকিলেন, ফিফটিন মিনিটস মোর—

একটি ছেলে ও-কোণে দাঁড়াইয়া বলিল, স্যার, আমাদের ক্লাসে দেরিতে কোশ্চেন দেওয়া হয়েচে—

যদুবাবুই এজন্য দায়ী। তিনি হাঁকিয়া বলিলেন, এক মিনিটও সময় বেশি দেওয়া হবে না—

কারণ তাহা হইলে আরও খানিকক্ষণ তাঁহাকে সে ক্লাসের ছেলেগুলিকে আগলাইয়া বসিয়া থাকিতে হয়। ছেলেরা কিন্তু অনেকেই আপত্তি জানাইল। মিঃ আলমের কাছে আপিল রুজু হইল অবশেষে। আপিলে ধার্য হইল, সেই ক্লাসের ছেলেরা আরও পনেরো মিনিট বেশি সময় পাইবে। যদুবাবুকে অপ্রসন্নমুখে আরও কিছুক্ষণ বসিয়া থাকিতে হইল।

কেরানি প্রত্যেক টিচারের কাছে স্লিপ পাঠাইয়া দিল,—মাহিনা আজ দেওয়া হইবে, যাইবার সময় যে যার মাহিনা লইয়া যাইবেন।

প্রায় সব টিচারই সারা মাস ধরিয়া কিছু কিছু লইয়া আসিয়াছেন—বিশেষ কিছু পাওনা কাহারও নাই। কাটাকাটি করিয়া কেহ বারো টাকা, কেহ পনেরো টাকা হাতে করিয়া বাড়ি ফিরিলেন। ইহার মধ্যে যদুবাবুর অভাব সর্বাপেক্ষা বেশি, তাঁহার পাওনা দাঁড়াইল পাঁচ টাকা কয়েক আনা।

ক্ষেত্রবাবু বলিলেন,  চা খাবেন নাকি যদুদা? চলুন।

যদুবাবু দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, আর চা! যা নিয়ে যাচ্ছি এ দিয়ে স্ত্রীর এক জোড়া কাপড় নিয়ে গেলেই ফুরিয়ে গেল।

দুইজনে  চায়ের দোকানে গিয়া ঢুকিলেন।

ক্ষেত্রবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, কী খাবেন যদুদা? আর এখন তো স্কুলের মধ্যে আপনিই বয়সে বড়, নারাণবাবু মারা যাওয়ার পরে।

—দেখতে দেখতে প্রায় দু’ বছর হয়ে গেল। দিন যাচ্চে, না, জল যাচ্চে। মনে হচ্চে সে দিন মারা গেলেন নারাণদা।

—হেডমাস্টারকে বলে নারাণবাবুর একটা ফোটো, কি অয়েলপেন্টিং—

—পাগল হয়েছ ভায়া, পুওর স্কুল, মাস্টারদের মাইনে তাই আজ পনেরো বছরের মধ্যে বাড়া তো দূরের কথা, ক্রমে কমেই যাচ্চে—তাও দু’ মাস খেটে এক মাসের মাইনে নিতে হয়। এ স্কুলে আবার অয়েলপেন্টিং ঝুলনো হবে নারাণবাবুর—পয়সা দিচ্চে কে?

দোকানের চাকর সামনে দুই পেয়ালা চা ও টোস্ট রাখিয়া গেল। যদুবাবু বলিলেন, না না, টোস্ট না, শুধু চা।

ক্ষেত্রবাবু বলিলেন, খান দাদা, আমি অর্ডার দিয়েচি, আমি পয়সা দেব ওর।

—তুমি খাওয়াচ্চ? বেশ বেশ, তা হলে একখানা কেকও অমনি—

দুইজনে চা খাইতে খাইতে গল্প করিতেছেন, এমন সময় খবরের কাগজের স্পেশাল লইয়া ফিরিওয়ালাকে ছুটিতে দেখা গেল—কী একটা মুখে চিৎকার করিয়া বলিতে বলিতে ছুটিতেছে। ক্ষেত্রবাবু বলিলেন, কী বলচে দাদা? কী বলচে?

দোকানি ইতিমধ্যে কখন বাহিরে গিয়াছিল। সে একখানা কাগজ আনিয়া টেবিলের উপর রাখিয়া বলিল, দেখুন না পড়ে বাবু—জাপান ইংরেজ আর মার্কিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করচে—

দুইজনেই একসঙ্গে বিস্ময়সূচক শব্দ করিয়া কাগজখানা উঠাইয়া লইলেন। যদুবাবুই চশমাখানা তাড়াতাড়ি বাহির করিয়া পড়িয়া বিস্ময়ের সঙ্গে বলিলেন, য়্যাঁ—এ কী! এই তো লেখা রয়েছে, জাপান অ্যাটাকস পার্ল হারবার—এ কী! গ্রেট ব্রিটেন আর মার্কিন—

যদুবাবু ‘গ্রেট ব্রিটেন’ কথাটা বেশ টানটোন দিয়া লম্বা করিয়া গালভরা ভাবে উচ্চারণ করিলেন।

—উঃ! গ্রেট ব্রিটেন আর ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকা!

ক্ষেত্রবাবু ‘ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকা’ কথাটা উচ্চারণ করিতে ঝাড়া এক মিনিট সময় লইলেন। দুইজনেই বেশ পুলকিত ও উত্তেজিত হইয়া উঠিলেন হঠাৎ। কেন, তাহার কোনো কারণ নাই। একঘেয়ে দৈনন্দিন জীবনের মধ্যে যেন বেশ একটা নূতনত্ব আসিয়া গেল—নারাণবাবুর মৃত্যুর কিছুদিন পরেই ইউরোপে যুদ্ধ বাধিয়াছে, এবং এতদিন, আজ প্রায় দুই বৎসর, চায়ের আসর নিত্যনূতন যুদ্ধের খবরে মশগুল হইয়া ছিল। কিন্তু আজ এ আবার এক নূতন ব্যাপারের অবতারণা হইল তাহার মধ্যে।

যদুবাবু বলিলেন, আরে চল চল, স্কুলে ফিরে যাই—এত বড় খবরটা দিয়ে যাই সকলকে—

—তা মন্দ নয়, চলুন যদুদা। ওহে, তোমার কাগজখানা একটু নিয়ে যাচ্চি। দিয়ে যাব এখন ফেরত।

যে স্কুলের বাড়ি ছুটির পরে কারাগারের মত মনে হয়, ইঁহারা মহা উৎসাহে কাগজখানা হাতে করিয়া সেই স্কুলে পুনরায় ঢুকিলেন। মিঃ আলম, শ্রীশবাবু, জ্যোতির্বিনোদ, হেডপণ্ডিত, রামেন্দুবাবু প্রভৃতির এ বেলা ডিউটি। তাঁহাদের মধ্যে সকলেই বিভিন্ন ঘরে পাহারাদি দিতেছেন—উৎসাহের আতিশয্যে উভয়ে কাগজখানা লইয়া গিয়া একেবারে হেডমাস্টারের টেবিলে ফেলিয়া দিলেন।

হেডমাস্টার বিস্মিত দৃষ্টিতে চাহিয়া বলিলেন, কী?

—দেখুন স্যার, জাপান হাওয়াই দ্বীপ আর পার্ল হারবার হঠাৎ আক্রমণ করেছে—মিটমাটের কথা হচ্ছিল—হঠাৎ—

হেডমাস্টার সে কথাটা বিশ্বাস করিতে পারিলেন না। বলিলেন, কই দেখি?

খবরটা বিদ্যুদ্বেগে স্কুলের সর্বত্র ছড়াইয়া গেল। ছেলেরা অনেকে টিচারদের নানারূপ প্রশ্ন করিতে লাগিল। স্কুলের অটুট শৃঙ্খলা ভঙ্গ হইয়া বিভিন্ন ঘরে ছেলেদের উত্তেজিত কণ্ঠের প্রশ্ন ও মধ্যে মধ্যে দুই-একজন শিক্ষকের কড়া সুরে হাঁকডাক শ্রুত হইতে লাগিল—এই! স্টপ দেয়ার! উইল ইউ? ইউ, রমেন, ডোন্ট বি টকিং—হু টকস দেয়ার? ইত্যাদি ইত্যাদি।

যদুবাবু ও ক্ষেত্রবাবু স্কুল হইতে বাহির হইলেন, কিন্তু চায়ের দোকানে কাগজ ফেরত দেওয়া হইল না, কারণ স্কুলের টিচারদের বূ্যহ ভেদ করিয়া কাগজখানা বাহির করিয়া আনা গেল না।

পড়াইতে গিয়া যদুবাবু আজ আর ছেলেকে ক্লাসের পড়া বলিয়া দিতে পারিলেন না। ছেলের বাবা ও কাকাকে জাপানের ও প্রশান্ত মহাসাগরের ম্যাপ দেখাইতে দেখাইতে সময় কাটিয়া গেল।

বাসায় ফিরিবার মুখে গলিতে বৃদ্ধ প্রতিবেশী মাখন চক্রবর্তী রোয়াকের উপর অন্যান্য উৎসাহী শ্রোতাদের মধ্যে বসিয়া আন্তর্জাতিক রাজনীতির গুহ্য তত্ব ব্যাখ্যা করিতেছেন, যদুবাবুকে দেখিয়া বলিলেন, কে? মাস্টার মশায়? কী ব্যাপার শুনলেন? খিদিরপুরে পাঁচশো জাপানী গুপ্তচর ধরা পড়েচে, জানেন তো?

—সে কী! কই, তা তো কিছু শুনি নি। না বোধ হয়—

চক্রবর্তী মশায় বিরক্তির সুরে বলিলেন, না কী করে জানলেন আপনি? সব পিঠমোড়া করে বেঁধে চালান দিয়েছে লালবাজারে! যারা দেখে এল, তারা বললে!

—কে দেখে এল?

—এই তো এখানে বসে বলছিল—ওই ওপাড়ার—কে যেন—কে হে? সুরেশ বলে গেল?

শেষ পর্যন্ত শোনা গেল, কথাটা কে বলিয়াছে, তাহার খবর কেহই দিতে পারে না।

যদুবাবু বাসায় আসিয়া স্ত্রীকে বলিলেন, শুনেছ, আজ জাপানের সঙ্গে ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের যুদ্ধ বেধেচে?

—সে কোথায় গো?

—বুঝিয়ে বলি তবে শোন—ম্যাপ বোঝ? দাঁড়াও, এঁকে দেখাচ্ছি।

—ওগো, আগে একটা কথা বলি শোন। অবনী ঠাকুরপো এসেচে আজ।

যদুবাবুর উৎসাহ ও উত্তেজনা এক মুহূর্তে নিবিয়া গেল। বলিলেন, অ্যাঁ! অবনী? কোথায় সে?

—আমায় বললে,  চা করে দাও বউদি। চা করে দিলাম, তারপর তোমার আসবার দেরি আছে শুনে সন্ধের সময় কোথায় বেরুল।

—তা তো বুঝলাম। শোবে কোথায় ও? বড্ড জ্বালালে দেখছি। এইটুকু তো ঘর—ওই বা থাকে কোথায়, তুমি-আমিই বা যাই কোথায়? রাঁধছ কী?

—কী রাঁধব, তুমি আজ বাজার করবে বললে এ বেলা। বাজার তো আনলে না, আমি ভাত নামিয়ে বসে আছি। দুটো আলু ছিল, ভাতে দিয়েছি, আর কিচ্ছু নেই।

—নেই তো আমি কী জানি? আমি কি কাউকে আসতে বলেচি এখানে?

—তা বললে কি হয়! আসতে বলো নি, তুমিও না, আমিও না—কিন্তু উপায় কী? নিয়ে এস কিছু।

যদুবাবু নিতান্ত অপ্রসন্নমুখে বাজার করিতে চলিলেন। তাঁহার মনে আর বিন্দুমাত্র উত্তেজনা ছিল না—এ কী দুর্দৈব! অবনী আবার কোথা হইতে আসিয়া জুটিল!

রাত্রি নয়টার পরে অবনী একগাল হাসিয়া হাজির হইল : এই যে দাদা, একটু পায়ের ধুলো—ভালো আছেন বেশ?

—হ্যাঁ, ভালো। তোমরা সব ভালো? বউমা, ছেলেপিলে? নন্তু ভালো? আমি শুনলাম তোমার বউদিদির মুখে যে তুমি এসেচ, শুনে আমি ভারি খুশি হলাম। বলি—বেশ, বেশ। কতদিন দেখাটা হয় নি—আছ তো দু-একদিন?

—তা দাদা, আমি তো আর পর ভাবি নে। এলাম একটা চাকরি-টাকরি দেখতে। সংসার আর চলে না। বলি—যাই, দাদার বাসা রয়েছে। নিজের বাড়িই। সেখানে থাকিগে, একটা হিল্লে না করে এবার আর হঠাৎ বাড়ি ফিরছি নে। কিছুদিন ধরে  কলকাতায় না থাকলে কিছু হয় না।

অবনীর মতলব শুনিয়া যদুবাবুর মুখের ভাব অনেকটা ফাঁসির আসামীর মত দেখাইল। তবুও ভদ্রতাসূচক কী একটা উত্তর দিতে গেলেন, কিন্তু গলা দিয়া ভালো সুর বাহির হইল না।

আহারাদির পর যদুবাবুর স্ত্রী বলিল, আমি বাড়িওলার পিসির সঙ্গে গিয়ে না হয় শুই, তুমি আর অবনী ঠাকুরপো—

যদুবাবু চোখ টিপিয়া বলিলেন, তুমি পাথুরে বোকা! কষ্ট করে শুতে হচ্ছে এটা অবনীকে দেখাতে হবে, নইলে ও আদৌ নড়বে না। কিছু না, এই এক ঘরেই সব শুতে হবে।

যদুবাবুর আশা টিকিল না। সেই ভাবে হাত-পা গুটাইয়া ছোট ঘরে শুইয়া অবনী তিন দিন দিব্য কাটাইয়া দিল। যাওয়ার নামগন্ধ করে না।

একদিন বলিল, দাদা চলুন, আজ বউদিদিকে নিয়ে সবসুদ্ধ টকি দেখে আসি। পয়সা রোজগার করে তো কেবল সঞ্চয় করছেন, কার জন্যে বলতে পারেন? ছেলে নেই, পুলে নেই—

যদুবাবু হাসিয়া বলিলেন, তা তোমার বউদিদিকে তুমি নিয়ে গিয়ে দেখাও না কেন?

—হ্যাঁঃ, আমার পয়সাকড়ি যদি থাকবে—

অবনী একেবারে নাছোড়বান্দা। অতি কষ্টে যদুবাবু আপাতত তাহার হাত এড়াইলেন।

.

কয়েক দিন কাটিয়া গেল। যুদ্ধের খবর ক্রমশই ঘনীভূত। বৈকালে চায়ের মজলিশে ক্ষেত্রবাবু বলিলেন, শুনেছেন একটা কথা? রেঙ্গুনে নাকি কাল বোমা পড়েচে!

জ্যোতির্বিনোদ বলিলেন, বল কী ক্ষেত্র ভায়া?

—কাগজে এখনও বেরোয় নি, তবে এই রকম গুজব।

শ্রীশবাবু চায়ের পেয়ালা হাতে আড়ষ্ট হইয়া থাকিয়া বলিলেন, আমার ছোট ভগ্নীপতি যে থাকে সেখানে! তা হলে আজই একটা তার করে—

যদুবাবু ও জ্যোতির্বিনোদ দুইজনেই ব্যস্তভাবে বলিলেন, হ্যাঁ ভায়া, দাও—এখুনি একটা তার করা আবশ্যক।

—দাদা, আমার হাতে একেবারে কিছু নেই—কত লাগে রেঙ্গুনে তার করতে, তাও তো জানি নে।

ক্ষেত্রবাবু বলিলেন, তার জন্যে কী, আমরা সবাই মিলে দিচ্ছি কিছু কিছু। তার তুমি করে দাও ভায়া, দেখি, কার কাছে কী আছে!

যদুবাবু বিপন্নমুখে বলিলেন, আমার কাছে একেবারেই কিন্তু কিছু নেই—

—আচ্ছা, না থাকে না থাক। আমরা দেখছি—দেখি হে, বিনোদ ভায়া—

সকলের পকেট কুড়াইয়া সাড়ে তিন টাকা হইল। শ্রীশবাবু তাহাই লইয়া ডাকঘরে চলিয়া গেলেন।

যদুবাবু বলিলেন, তাই তো হে, এ হল কী? এমন তো কখনও ভাবিও নি!

ক্ষেত্রবাবু ও জ্যোতির্বিনোদ টুইশানিতে বাহির হইয়া গেলেন। গলির মোড়ে ইংরেজি  কাগজের সদ্য প্রকাশিত সংস্করণ লইয়া ফিরিওয়ালা ছুটিতেছে—ভারি খবর বাবু—ভারি কাণ্ড হয়ে গেল—

ক্ষেত্রবাবু পকেট হাতড়াইলেন, পয়সা আছে দুইটি মাত্র! তাহাই দিয়া কাগজ একখানা কিনিয়া দেখিলেন, কাগজে বিশেষ কিছুই খবর নাই। রেঙ্গুনের বোমার তো নামগন্ধও নাই তাহাতে, তবে জাপানী সৈন্য ব্রহ্মের দক্ষিণে টেনাসেরিম প্রদেশে অবতরণ করিয়াছে বটে।

মনটা ভালো নয়, পয়সার টানাটানি! পুনরায় চা এক পেয়ালা খাইলে অবসাদগ্রস্ত মন একটু চাঙ্গা হইত। কিন্তু তার উপায় নাই। এমন সময়ে রামেন্দুবাবুর সঙ্গে দেখা।

ক্ষেত্রবাবু বলিলেন, কী, আজ যে চায়ের মজলিশে ছিলেন না?

—না, সাহেবের সঙ্গে দরকার ছিল। এই তো স্কুল থেকে বেরুলাম।

—যুদ্ধের খবর দেখেছেন? খুব খারাপ!

—কী রকম?

—শুনলাম নাকি রেঙ্গুনে বোমা পড়েছে!

—তা আশ্চর্যি নয়! কিন্তু গুজব রটে নানারকম এ সময়ে—কাগজে কিছু লিখেছে এ বেলা?

যদুবাবুকে কাহার সহিত যাইতে দেখিয়া দুইজনেই ডাকিয়া বলিলেন, ওই যে, ও যদুদা, শুনে যান—

যদুবাবুর সঙ্গে অবনী। বাজার করিয়া অবনীকে দিয়া বাসায় পাঠাইয়া দিবেন বলিয়া যদুবাবু তাহাকে লইয়া বাহির হইয়াছেন।

—এটি কে যদুদা?

—এ—ইয়ে আমার খুড়তুতো—দেশ থেকে এসেছে—

—বেশ, বেশ। কার কাছে পয়সা আছে? রামেন্দুবাবু?

—আছে। কত?

—সবাই চা খাওয়া যাক। হবে?

—খুব হবে। চলুন সব।

যদুবাবু বলিলেন, রামেন্দু ভায়ার কাছে চার আনা পয়সা বেশি হতে পারে? বাজার করতে যাচ্ছি কিনা!

রামেন্দুবাবু সকলকে ভালো করিয়া চা ও টোস্ট খাওয়াইলেন। যদুবাবুকে জিজ্ঞাসা করিলেন, দাদা, আর কি খাবেন বলুন? কেক একখানা দেবে?

—না ভায়া, বরং একখানা মামলেট—

—ওহে বাবুকে একটা ডবল ডিমের মামলেট দিয়ে যাও।

চায়ের দোকান হইতে বাহির হইয়া সকলে যে যাহার টুইশানিতে বাহির হইলেন। যদুবাবু পথে যাইতে যাইতে হঠাৎ দেখিলেন, প্রজ্ঞাব্রত ওপারের ফুটপাথ দিয়া যাইতেছে। সে এবার ম্যাট্রিক দিয়া স্কুল হইতে বাহির হইয়া গিয়াছে, কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে। কয়েকটি সমবয়সী বন্ধুর সঙ্গে বোধ হয় মাঠের দিকে খেলা দেখিতে যাইতেছে।

যদুবাবু ডাকিলেন, প্রজ্ঞাব্রত, ও প্রজ্ঞাব্রত—

প্রজ্ঞাব্রত এদিকে চাহিয়া দেখিল, এবং কিঞ্চিৎ অপ্রসন্ন মুখে ও অনিচ্ছার সহিত এপারে আসিয়া বলিল, কী স্যার?

যদুবাবু সপ্রশংস দৃষ্টিতে চাহিয়া দেখিলেন, ছেলেটির কী সুন্দর উন্নত চেহারা, খেলোয়াড়ের মত সাবলীল দেহভঙ্গী, গায়ে সিল্কের হাফ-শার্ট, কাবুলি ধরনের পায়জামার মত করিয়া কাপড় পরা, পায়ে লাল, শুঁড়ওয়ালা চটি। স্কুলের নীচের ক্লাসের সে প্রজ্ঞাব্রত আর নাই।

—ভালো আছ বাবা?

—হ্যাঁ স্যার।

—যাচ্ছ কোথায়?

প্রজ্ঞাব্রত এমন ভাব দেখাইল যে, যেখানেই যাই না কেন, তোমার সে খোঁজে দরকার কী? মুখে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে উত্তর দিল, এই একটু ওদিকে—

—হ্যাঁ বাবা, একটা কথা বলব ভাবছিলাম। তোমাদের বাড়ি একবার যাব আজই ভাবছিলাম—তোমার বাবার সঙ্গে দেখা করতে। তোমার ভাই দেবব্রতকে আজকাল পড়াচ্চে কে?

—শিববাবু বলে এক ভদ্রলোক। আপিসে চাকরি করেন—আমাদের বাড়ির সামনের মেসে থাকেন—

—ক’টাকা দাও?

—দশ টাকা বোধ হয়—কী জানি, ও-সব খবর আমি ঠিক জানি নে।

—আমি বলছিলাম কি, আমায় টুইশানিটা করে দাও না কেন! স্কুলের মাস্টার ভিন্ন ছেলে পড়াতে পারে? আমি তোমাদের স্নেহ করি নিজের ছেলের মত, আমি যেমন পড়াব—এমনটি কারও দ্বারা হবে না, তা বলে দিচ্চি—

—কিন্তু এখন তো আমরা সব চলে যাচ্ছি কলকাতা থেকে।

যদুবাবু বিস্ময়ের সুরে বলিলেন, কলকাতা থেকে? কেন?

—শোনেন নি, জাপানীরা কবে এসে বোমা ফেলবে—এর পরে রাস্তাঘাট সব বন্ধ হয়ে যাবে হয়তো। আমরা বুধবারে বাড়িসুদ্ধু সব যাচ্ছি সিউড়ি, আমার দাদামশায়ের ওখানে। আমাদের পাড়ার অনেকে চলে যাচ্ছে।

—তাই নাকি?

প্রজ্ঞাব্রত ধীরভাবে বলিল, কেন, আপনি কাগজ দেখেন না? হাওড়া স্টেশনে গেলেই বুঝবেন, লোক অনেক চলে যাচ্ছে—আচ্ছা, আসি স্যার—

—আচ্ছা বাবা, বেঁচে থাক বাবা।

প্রজ্ঞাব্রত চলিয়া গিয়া যেন হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচিল। দেখ দেখি বিপদ। যাইতেছি বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াইতে, রাস্তার মাঝখানে ডাকিয়া অনর্থক সময় নষ্ট—কে এখন বুড়ামানুষের সঙ্গে বকিয়া মুখ ব্যথা করে! মানুষের একটা কাণ্ডজ্ঞান তো থাকা দরকার, এই কি ডাকিয়া গল্প করিবার সময় মশায়?

যদুবাবু কিন্তু অন্য রকম ভাবিতেছিলেন। প্রজ্ঞাব্রতের কথায় তিনি একটু অন্যমনস্ক হইয়া পড়িলেন।  কলিকাতা হইতে লোক পলাইতেছে জাপানী বিমানের ভয়ে? তবে কি জাপানী বিমান এত নিকটে আসিয়া পড়িল?

ছোট একটা টুইশানি ছিল। ভাবিতে ভাবিতে যদুবাবু ছাত্রের বাড়ি গিয়া উঠিলেন। দুইটি ছেলে, রিপন স্কুলে পড়ে—ইহাদের জ্যাঠামশায়ের সঙ্গে যদুবাবু একসময়ে কলেজে পড়িয়াছিলেন, সেই সুপারিশেই টুইশানি। যদুবাবু গিয়া দেখিলেন, বাহিরের ঘরে আলো জ্বালা হয় নাই। ডাকিলেন, ও হরে, নরে! ঘর অন্ধকার কেন?

হরেন নামক ছাত্রটি ছুটিয়া দরজার কাছে আসিয়া বলিল, স্যার?

—আলো জ্বালিস নি যে বড়?

—স্যার, আজ আর পড়ব না।

—কেন রে?

—আমাদের বাড়ির সবাই কাল সকালের গাড়িতেই দেশে চলে যাচ্ছে—মা, জেঠিমা, দুই দিদি—সবাই যাবে। জিনিসপত্র বাঁধাছাঁদা হচ্ছে, বড় ব্যস্ত সবাই। আজ আর—আপনি চলে যান স্যার!

অন্যদিন টুইশানির পড়া হইতে রেহাই পাইলে যদুবাবু স্বর্গ হাতে পাইতেন, কিন্তু আজ কথাটা তেমন ভালো লাগিল না। যদুবাবু বলিলেন, তোরাও যাবি নাকি?

—একজামিনের এখনও দু’ দিন বাকি আছে, একজামিন হয়ে গেলে আমরাও যাব।

—কোথায় যেন তোদের দেশ?

—গড়বেতা, মেদিনীপুর।

—আচ্ছা, চলি তা হলে।

আজ খুব সকাল। সবে সন্ধ্যা হইয়াছে। এ সময় বাড়ি ফেরা অভ্যাস নাই। বিশেষত এখনই সে কোটরে ফিরিতে ইচ্ছাও করে না। তার উপর অবনী রহিয়াছে, জ্বালাইয়া মারিবে।

ক্রীক লেনে এক বন্ধুর বাড়ি ছুটিছাটার দিন যদুবাবু সন্ধ্যাবেলা গিয়া চাটা-আসটা খান, গল্প-গুজব করেন। ভাবিতে ভাবিতে সেখানেই গিয়া পৌঁছিলেন।

বন্ধু বাহিরের ঘরে বসিয়া নিজের ছেলেদের পড়াইতেছেন। যদুবাবুকে দেখিয়া বলিলেন, এস ভায়া। বোস। আজ অসময়ে যে? ছেলে পড়াতে বেরোও নি?

—সেখান থেকেই আসছি।

—একটু  চা করতে বলে আয় তো তোর কাকাবাবুর জন্যে। আমার আবার বাড়ির সবাই কাল যাচ্ছে মধুপুর। সব ব্যস্ত রয়েছে। বাঁধা-ছাঁদা—

যদুবাবুর বুকের মধ্যে ছাঁত করিয়া উঠিল। বলিলেন, কেন? কেন?

—সবাই বলছে, জাপানীরা যে-কোন সময়ে নাকি এয়ার রেড করতে পারে, তাই মেয়েদের সরিয়ে দিচ্ছি।

যদুবাবুর মনে বড় ভয় হইল, জিজ্ঞাসা করিলেন, কে বললে?

—বললে কেউ না, কিন্তু গতিক সেই রকমই। এর পরে রাস্তাঘাট বন্ধ হয়ে যাবে।

—বলো কী!

—তাই তো সবাই বলচে। কলকাতা থেকে অনেকে যাচ্ছে চলে। হাওড়া স্টেশনে গিয়ে দেখগে লোকের ভিড়।

যদুবাবু আর সেখানে না দাঁড়াইয়া বাড়ি চলিয়া আসিলেন। বাসার দরজায় দেখিলেন, দুইখানি ঘোড়ার গাড়ি দাঁড়াইয়া। বাড়িওয়ালার বড় ছেলে ধরাধরি করিয়া বিছানার মোট ও ট্রাঙ্ক গাড়ির মাথায় উঠাইতেছে।

যদুবাবু বলিলেন, এসব কী হে যতীন, কোথায় যাচ্চ?

যতীন বাইশ-তেইশ বছরের ছোকরা, কলেজে পড়ে। বলিল, ও, আমরা দেশে যাচ্চি মাস্টার মশায়। সকলে বলছে, কলকাতাটা এ সময় সেফ নয়। তাই মা আর বউদিদিদের—

—তুমি, তোমার বাবা, এঁরাও নাকি?

—আমি পৌঁছে দিয়ে আবার আসব। কী জানেন, পুরুষমানুষ আমরা দৌড়েও এক দিকে না এক দিকে পালাতে পারব। হাই এক্সপ্লোসিভ বম্ব পড়লে এ বাড়িঘর কিছু কি থাকবে ভাবছেন? বোমার ঝাপটা লেগেই মানুষ দম ফেটে মারা যায়। সে সব অবস্থায়—

যদুবাবুর পা ঠক-ঠক করিয়া কাঁপিতে লাগিল। বলিলেন, বল কী?

—বলি তো তাই। গবর্মেন্ট বলছে, একখানা করে পেতলের চাকতিতে নামধাম লিখে প্রত্যেকে যেন পকেটে করে বেড়ায়। এয়ার রেডের পরে ওইখানা দেখে ডেড বডি সনাক্ত করা—

যদুবাবুর তালু শুকাইয়া গিয়াছে। এখনই যেন তাঁহার মাথায় জাপানী বোমা পড়-পড় হইয়াছে। বলিলেন, আচ্ছা যতীন, তোমরা তো ইয়ং ম্যান, পাঁচ জায়গায় বেড়াও। তোমার কি মনে হয়, বোমা শীগগির পড়তে পারে?

—এনি মোমেন্ট পড়তে পারে। আজ রাতেই পড়তে পারে। স্ট্রে রেড করার কি সময়-অসময় আছে?

—তাই তো!

যদুবাবু নিজের ঘরে ঢুকিতেই স্ত্রী তাড়াতাড়ি আগাইয়া আসিয়া ব্যস্তভাবে বলিলেন, হ্যাঁগা, হিম হয়ে তো বসে আছ—এদিকে ব্যাপার কী শোন নি? আজ রাত্রে নাকি জাপান বোমা ফেলবে  কলকাতায়! বাড়িওলারা সব পালাচ্চে—পাশের বাড়ির মটরের বউ আর মা চলে গিয়েছে দুপুরের গাড়িতে। আমি কাঠ হয়ে বসে আছি—তুমি কখন ফিরবে! কী হবে, হ্যাঁগা, সত্যি সত্যি আজ কিছু হবে নাকি?

যদুবাবু তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলিলেন, হ্যাঁঃ—ভারি—কোথায় কী তার ঠিক নেই!

ভাবিলেন, মেয়েদের সামনে সাহস দেখানোই উচিত—নতুবা মেয়েমানুষ হাউমাউ করিয়া উঠিবে।

—হ্যাঁগা, বাইরে আজ এত অন্ধকার কেন?

—আজ ব্ল্যাক-আউট একটু বেশি। রাস্তার অনেক গ্যাসই নিবিয়ে দিয়েছে।

—তবুও তুমি বলছ—কোনও ভয় নেই?

এমন সময় অবনী আসিয়া ডাকিল, দাদা ফিরেছেন?

—হ্যাঁ, এস।

—আচ্ছা দাদা, আজ রাস্তা এত অন্ধকার কেন?

—ও, আজ রাত দশটার পরে কমপ্লিট ব্ল্যাক-আউট। মানে, রাস্তার সব আলো নিবুনো থাকবে।

—কেন?

—তুমি কিছু শোন নি যুদ্ধের খবর?

—না, কী?

যদুবাবুর মাথায় একটা বুদ্ধি আসিয়া গেল। বলিলেন, শোন নি তুমি? জাপানীরা যে-কোনো সময়ে এয়ার রেড—মানে বোমা ফেলতে পারে। সব লোক পালাচ্চে। আজ বাড়িওয়ালারা চলে গেল। আমার ছাত্রেরা চলে গেল—সব পালাচ্চে। হয়তো আজ রাত্রেই ফেলতে পারে বোমা—কে জানে? এখন একটা কথা, তুমি তোমার বউদিদিকে কাল নিয়ে যাও দেশে। আমি তো এখানে আর রাখতে সাহস করি নে—

অবনী পাড়াগাঁয়ের ভীতু লোক। তাহার মুখ শুকাইয়া গেল। দাদার বাসায় স্ফূর্তি করিতে আসিয়া এ কী বিপদে পড়িয়া গেল সে! বলিল, হ্যাঁ দাদা, আজ কী দেখলেন? জাপান কি কাছাকাছি এল?

—তা কাছাকাছি বইকি। মোটের ওপর আজ রাতেই বোমা পড়া বিচিত্র নয়, জেনে রাখ।

—তাই তো!

—তুমি তা হলে কাল সকালেই তোমার বউদিদিকে নিয়ে যাও—

—তা—তা দেখি।—অবনী গুম খাইয়া গিয়া আপনমনে কী খানিকটা ভাবিল। কিছুক্ষণ পরে বলিল, হ্যাঁ দাদা, সত্যি সত্যি আজ রাতে কিছু হতে পারে?

—কথার কথা বলচি। হতে পারবে না কেন, খুব হতে পারে। বাধা কী? তুমি বোস, আমি দু ভাঁড় দই নিয়ে আসি।

যদুবাবুর স্ত্রী কী কাজে ঘরের মধ্যে ঢুকিয়া দেখিল, অবনী নিজের ছোট্ট টিনের সুটকেসটি খুলিয়া কাপড়চোপড় বাহিরে নামাইয়া আবার তুলিতেছে। তাহাকে দেখিয়া বলিল, বউদিদি, আমার গামছাখানা কোথায়?

আহারাদির পরে যদুবাবু অবনীর সঙ্গে পরামর্শ করিলেন। এখানে তিনি স্ত্রীকে আর রাখিতে চান না। কাল দুপুরে অবনী তাহাকে লইয়া যাক।

অবনী নিমরাজি হইল।

সকালে উঠিয়া ঘরের দোর খুলিয়া দালানে পা দিয়া যদুবাবু দেখিলেন, অবনীর বিছানাটা গুটানো আছে বটে, কিন্তু সে নাই। অবনীকে ডাকিয়া তুলিতে হয়—অত সকালে তো সে ওঠে না! কোথায় গেল?

অবনী আর দেখা দিল না। টিনের সুটকেসটি কখন সে রাত্রে মাথার কাছে রাখিয়াছিল, ভোরে উঠিয়া গিয়াছে কি রাতেই পলাইয়াছে, তাহারই বা ঠিক কী?

.

পরদিন স্কুলে শিক্ষকদের মধ্যে একটা উত্তেজনা ও চাঞ্চল্য দেখা গেল। ক্ষেত্রবাবুর বাসার আশেপাশে যাহারা ছিল, সকলেই নাকি কাল বাসা ছাড়িয়া পলাইয়াছে। ক্ষেত্রবাবু স্ত্রীকে লইয়া তেমন বাসায় কী করিয়া থাকেন! যদুবাবুর বিপদ আরও বেশি, তাঁহার যাইবার জায়গা নাই। জ্যোতির্বিনোদের বাড়ি হইতে টেলিগ্রাম আসিয়াছে—কলিকাতায় আর থাকিবার আবশ্যক নাই, এখনই চলিয়া এস, প্রাণ, বাঁচিলে অনেক চাকুরি মিলিবে। হেডমাস্টার মীটিং করিলেন—অভিভাবকেরা চিঠি লিখিতেছে, স্কুলের প্রমোশন তাড়াতাড়ি দেওয়া হউক, ছেলেরা সব বাহিরে যাইবে—এ অবস্থায় মাস্টারদের কাছে যে সমস্ত পরীক্ষার খাতা আছে, সেগুলি যত শীঘ্র হয় দেখিয়া ফেরত দেওয়া উচিত।

মিঃ আলম বলিলেন, অনেক ছেলে ট্রান্সফার চাইছে, কী করা যায়?

সাহেব বলিলেন, একে স্কুলে ছেলে নেই, এর উপর ট্রান্সফার নিলে স্কুল টিকবে না। তার চেয়েও বিপদ দেখছি, মাইনে তেমন আদায় হচ্ছে না। বড়দিনের ছুটির আগে মাইনে দেওয়া যাবে না।

যদুবাবু উদ্বিগ্নকণ্ঠে প্রশ্ন করিলেন, দেওয়া যাবে না স্যার?

—না।

—নভেম্বর মাসের মাইনে হয় নি এখনও! আমরা কী করে চালাব স্যার, একটু বিবেচনা করুন। দু মাসের মাইনে যদি বাকি থাকে—

সাহেব হাসিয়া বলিলেন, আমায় বলা নিষ্ফল, আমি ঘর থেকে আপনাদের মাইনে দেব না তো! না পোষায় আপনার, চলে যাওয়াতে আমি বাধা দেব না—মাই গেট ইজ অলওয়েজ ওপন—

রামেন্দুবাবুকে সব মাস্টার মিলিয়া ধরিল। অন্তত নভেম্বর মাসের দরুন কিছু না দিলে চলে কিসে? যদুবাবু কাতরস্বরে জানাইলেন, তিনি সম্পূর্ণ নিরুপায়, এ বিপদকালে কোথায় গিয়া উঠিবেন ঠিক নাই, হাতে পয়সা নাই, টুইশানির মাহিনা আদায় হয় কি না-হয়, টুইশানি থাকিবে কিনা তাহারও স্থিরতা নাই—কারণ ছেলেরা অন্যত্র যাইতেছে। কতদিনে তাহারা আসিবে কে জানে? টুইশানি না থাকিলে একেবারেই অচল।

রামেন্দুবাবুকে সাহেব বলিলেন, অবস্থা কী রকম বলে মনে হয়?

—কিছুতেই বুঝতে পারছি না স্যার।

—এবার জানুয়ারি মাসে নতুন ছাত্র বেশি পরিমাণে ভর্তি না হলে স্কুল চলবে না। তারপর এই গোলমাল—

—ও কিছু না স্যার, জানুয়ারি মাসে সব ঠিক হয়ে যাবে।

—হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হচ্ছে। এ একটা হুজুগ, কী বল? ব্রিটিশ গবর্নমেন্টের রাজ্যে আবার বাইরের শত্রুর ভয়!

—হুজুগ বইকি স্যার। পিওর হুজুগ। ও কিছু না। একটা কথা—

—কী?

—মাস্টারদের মাইনে কিছু কিছু দিতেই হবে স্যার।

—কোথা থেকে দেব? মাইনে আদায় নেই। তবে নিতান্ত ধরেছে—দাও কিছু কিছু। আর একটা কথা, যে সব ছেলে ট্রান্সফারের দরখাস্ত করেচে, তাদের বাড়ি গিয়ে অভিভাবকদের অনুরোধ করতে হবে, তাদের যেন ছাড়িয়ে না নিয়ে যায়। ক্লাস এইটের একটা ছেলে—নাম সুধীর দত্ত, তার বাড়ি সন্ধ্যার পর একবার যেয়ো।

সন্ধ্যায় সুধীর দত্তের বাড়ি রামেন্দুবাবু অভিভাবকদের ধরিতে যাইয়া বেশ দুই কথা শুনিলেন। ছেলেটি এবার প্রমোশন পায় নাই। ছেলের অভিভাবক চটিয়া খুন, ছেলে তিনি ও-স্কুলে আর রাখিতে চান না। তিনি স্কুল ঠিক করিয়া ফেলিয়াছেন—অনুরোধ বৃথা।

রামেন্দুবাবু বলিলেন, কেন, কী অসুবিধে হল এ স্কুলে বলুন! আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি, তা দূর করে দেওয়া হবে।

—পড়াশুনো কিছু হয় না মশাই আপনাদের স্কুলে। ওদের ক্লাসে যদুবাবু বলে একজন মাস্টার পড়ান, একেবারে ফাঁকিবাজ। কিছু করান না ক্লাসে।

—আপনি ও-রকম নাম করে বলবেন না। ছেলেদের মুখে শুনে বিচার করা সব সময়ে ঠিক নয়। এবার আমি বলছি, ওর পড়াশুনো আমি নিজে দেখব।

—তা ওরা তো কাল যাচ্ছে নবদ্বীপে। ওর মাসির বাড়ি। কবে আসবে ঠিক নেই। হ্যাঁ মাস্টারবাবু, এ হাঙ্গামা কতদিন চলবে বলতে পারেন?

—বেশি দিন চলবে বলে মনে হয় না।

—সুধীরকে জানুয়ারি মাসে ক্লাসে উঠিয়ে দেন যদি, তবে ট্রান্সফার এবার না হয় থাক।

—তাই হবে। ওকে ক্লাস নাইনে উঠিয়ে দেওয়া যাবে।

রামেন্দুবাবু হৃষ্টমনে ফিরিতেছিলেন; কারণ কর্তব্য নিখুঁতভাবে সম্পাদন করিবার একটা আনন্দ আছে। পথের ধারে একস্থানে দেখিলেন অনেকগুলি লোক জটলা করিয়া উঁচু মুখে কী দেখিতেছে। রামেন্দুবাবু গিয়া বলিলেন, কী হয়েছে মশায়?

একজন আকাশের দিকে আঙুল দিয়া দেখাইয়া বলিল, দেখুন তো স্যার, ওই একখানা এরোপ্লেন—ওখানা যেন কী রকমের না?

রামেন্দুবাবু কিছু দেখিতে পাইলেন না। বলিলেন, কই মশায়, কিছু তো—

দুই-তিনজন অধীরভাবে বলিল, আঃ, দেখতে পেলেন না? এই ইদিকে সরে আসুন—ওই—ওই—

তবুও রামেন্দুবাবু দেখিতে পাইলেন না, একটা নক্ষত্র তো ওটা!

সবাই বলিয়া উঠিল, ওই মশায়, ওই। নক্ষত্র দেখছেন তো একটা? ওই! ও নক্ষত্র নয়—জাপানী বিমান।

রামেন্দুবাবু সাহসে ভর করিয়া বলিলেন, কিন্তু নক্ষত্র তো আরও অনেক—

লোকগুলি রামেন্দুবাবুর মূঢ়তা দেখিয়া দস্তুরমত বিরক্ত হইল। একজন বলিল, আচ্ছা, এটা কি নক্ষত্র? নীল মত আলো দেখলেন না? চোখের জোর থাকা চাই। ও হল সেই, বুঝলেন? চুপি চুপি দেখতে এসেছে—

আর একজন চিন্তিত মুখে বলিল, তাই তো, এ যে ভয়ানক কাণ্ড হল দেখছি!

পূর্বের লোকটি বলিল,  কলকাতায় থাকা আর সেফ নয় জানবেন আদৌ।

সবাই তাহাতে সায় দিয়া বলিল, সে তো আমরা জানি। যে-কোন সময়—এনি মোমেন্ট বোমা পড়তে পারে।

রামেন্দুবাবু সে স্থান হইতে সরিয়া পড়িলেন।

পরদিন স্কুলে মাস্টারদের মধ্যে যথেষ্ট ভয় ও চাঞ্চল্য দেখা গেল। যে যে পাড়ায় থাকেন, সেই সেই পাড়া প্রায় খালি হইতে চলিয়াছে, মাস্টারদের মধ্যে অনেকের যাইবার স্থান নাই।

যদুবাবু  চায়ের মজলিশে বলিতেছিলেন, সবাই তো যাচ্ছে, আমি যে কোথায় যাই!

ক্ষেত্রবাবু বলিলেন, আমারও তাই দাদা। আমার গ্রামে বাড়িঘর সারানো নেই—কতকাল যাই নি। সেখানে গিয়ে ওঠা যাবে না।

—তবুও তোমার তো আস্তানা আছে ভায়া, আমার যে তাও নেই। চিরকাল বাসায় থেকে বাড়িঘর সব গিয়েছে। এখন যাই কোথায়?

জ্যোতির্বিনোদ বলিলেন, আমার বাড়ি থেকে টেলিগ্রাম এসেছে, চিঠির পর চিঠি আসছে—বাড়ি যাবার জন্যে। বাড়ি থেকে লিখছে, চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে এস।

হেডপণ্ডিত বলিলেন, কাল শেয়ালদা ইস্টিশানে কী ভিড় গিয়েছে হে! গাড়িতে উঠতে পারি নে—বুড়ো মানুষ, কত কষ্টে যে ঠেলে-ঠুলে উঠলাম!

—স্কুল বন্ধ হলে যে বাঁচি। সাহেবকে সবাই মিলে বলা যাক, স্কুল বন্ধ করবার জন্যে।

সারারাত্রি ধরিয়া গাড়িঘোড়ার শব্দ শুনিয়া যদুবাবু বিশেষ ‘নার্ভাস’ হইয়া উঠিয়াছিলেন। পাড়াসুদ্ধ লোক বিছানা-বোঁচকা বাঁধিয়া হয় হাওড়া, নয় শেয়ালদহ স্টেশনে ছুটিতেছে। কে বলিতেছিল, ঘোড়ার গাড়ির ভাড়া অসম্ভব ধরনে বৃদ্ধি পাইতেছে।

জ্যোতির্বিনোদ বলিলেন, কোনো ভয় নেই দাদা। বোঁচকা মাথায় নিয়ে ঠেলে উঠব ইস্টিশানে—আমরা বাঙাল মানুষ, কিছু মানি নে।

ক্ষেত্রবাবু বলিলেন, আসসিংড়িই চলে যাই ভাবছি, ভাঙা ঘরে গিয়ে আপাতত উঠি। এখানে থাকলে এর পরে আর বেরুতে পারব না।

যদুবাবু সভয়ে বলিলেন, তাই তো, কী যে করি উপায়!

—কালই সাহেবকে গিয়ে আগে ধরা যাক, স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হোক।

ক্ষেত্রবাবু চায়ের দোকান হইতে বাহির হইয়া ধর্মতলার মোড়ে আসিলেন। দাঁড়াইয়া থাকিতে থাকিতে দুই-তিনখানি ঘোড়ার গাড়ি ছাদের উপর বিছানার মোট চাপাইয়া শেয়ালদহ স্টেশনের দিকে চলিয়া গেল। ক্ষেত্রবাবু চিন্তিত হইয়া পড়িলেন—আসসিংড়ি গ্রামে যাইবেন বটে, কিন্তু সেখানে বাড়িঘরের অবস্থা কী রকম আছে, তাহার ঠিক নাই। আজ পাঁচ-ছয় বছর পূর্বে নিভাননী বাঁচিয়া থাকিতে সেই একবার গিয়াছিলেন, তাহার পর আর যাওয়া ঘটে নাই। কোনো খবরও লওয়া হয় নাই, কারণ, এতদিন প্রয়োজন ছিল না।

একটিমাত্র টুইশানি অবশিষ্ট ছিল, সেখানে গিয়া দেখা গেল, আজ বৈকালে তাহারাও দেশে চলিয়া গিয়াছে। বাড়ির কর্তা আপিসে চাকরি করেন। বলিলেন, মাস্টার মশায়, আপনার এ মাসের মাইনেটা আর এখন দিতে পারছি নে—খরচপত্র অনেক হয়ে গেল কিনা। জানুয়ারি মাসে শোধ করব।

—আমায় না দিলে হবে না বোস মশায়, ফ্যামিলি আমাকে দেশে নিয়ে যেতে হবে—

—তা তো বুঝতে পারছি। কিন্তু এখন কিছু হবে না।

ক্ষেত্রবাবুর রাগ হইল। এখানে দুই মাসের কমে এক মাসের মাহিনা কোনোদিনই দেয় না—তাও আজ পাঁচ টাকা, কাল দুই টাকা। নিতান্ত নিরুপায় বলিয়াই লাগিয়া থাকা। কিন্তু এই বিপদের সময় এত অবিবেচনার কাজ করিতে দেখিলে মানুষের মনে মনুষ্যত্ব সম্বন্ধে সন্দেহ উপস্থিত হয়।

ক্ষেত্রবাবু বলিলেন, না বোস মশায়, এ সময় আমায় দিতেই হবে। দু’ মাস ধরে ছাত্র পড়ালাম, ছেলে ক্লাসে উঠল। এখন বলছেন, আমার মাইনে দেবেন না! তা হয় না—

বসু মহাশয়ও চটিয়া উঠিয়া বলিলেন, মশাই, এতকাল তো পড়িয়েচেন—মাইনে পান নি কখনও বলতে পারেন কি? যদি এ মাসটাতে ঠিক সময়ে না-ই দিতে পারি—

—ঠিক সময়ে কোনোদিনই দেন নি বোস মশায়, ভেবে দেখুন। তাগাদা না করলে কোনো মাসেই দেন নি!

—বেশ মশাই, না দিয়েছি তো না দিয়েছি! মাইনে পাবেন না এখন! আপনি যা পারেন করুন গিয়ে!

ক্ষেত্রবাবু ভদ্রস্বভাবের লোক, টুইশানির মাহিনা লইয়া একজন বৃদ্ধ ব্যক্তির সহিত ঝগড়া করিবার প্রবৃত্তি তাঁহার হইল না। কিছু না বলিয়া বাড়ির বাহির হইয়া আসিলেন। কলিকাতায় বাড়ি আছে, আপিসে মোটা চাকুরিও করেন শোনা যায়, অথচ এই তো সব বিচার! ছিঃ!

অন্যমনস্কভাবে গলির মোড়ে আসিতেই ব্ল্যাক আউটের কলিকাতায় কাহার সঙ্গে ঠোকাঠুকি হইল। ক্ষেত্রবাবু বলিয়া উঠিলেন, মাপ করবেন মশাই, দেখতে পাই নি—দুটো গ্যাসই নিবিয়েছে—

লোকটি বলিল, কে, ক্ষেত্রবাবু নাকি?

—ও, রাখালবাবু?

—আমিই। ভালোই হল, দেখা হল এভাবে। আপনাদের স্কুলে কাল যাব ভাবছিলাম—

—ভালো আছেন মিত্তির মশায়?

—আমাদের আবার ভালো-মন্দ! বই দিয়ে এসেছি পাঁচ-ছটা স্কুলে—এখন ধরায় যদি, তবে বুঝতে পারি। আপনাদের স্কুলে আমার সেই নব ব্যাকরণবোধখানা ধরানোর কী করলেন? চমৎকার বই। ক্লাস ফাইভ আর ফোরের উপযুক্ত বই। সন্ধি আর সমাস যেভাবে ওতে দেওয়া—বইয়ের লিস্ট হয়েচে আপনাদের?

—এখনও হয় নি।

—কেন, প্রমোশন হয় নি? তবে বইয়ের লিস্ট হয় নি কেমন কথা?

—না, প্রমোশন হবে বুধবার। শুক্রবার ছুটি হবে।

—আমার বইয়ের কী হল?

—হেডমাস্টারের কাছে দেওয়া হয়েছে—কী হয়, বলতে পারি নে!

—আমার যে এদিকে অচল ক্ষেত্রবাবু। এই অবস্থায় প্রায় দেড়শো টাকা ধার করে বই ছাপালাম। প্রেসের দেনা এখনও বাকি। দপ্তরীর দেনা তো আছেই। বাসাভাড়া তিন মাসের বাকি। বই যদি না চলে, তবে খেতে পাব না ক্ষেত্রবাবু। আপনারাই ভরসা।

—বুঝলাম সবই রাখালবাবু, কিন্তু এ তো আর আমার হাতে নয়। আমি যতদূর বলবার বলেচি।

কথার মধ্যে সত্যের কিছু অপলাপ ছিল। ক্ষেত্রবাবু বলেন নাই। রাখাল মিত্তিরের বই আজকাল অচল। তবুও হয়তো চলিত, কিন্তু বড় বড় প্রকাশকের সহিত প্রতিযোগিতা করিয়া বই চালানো রাখাল মিত্তিরের কর্ম নয়। তাহারা লাইব্রেরির জন্য বিনামূল্যে কিছু বই দেয়, প্রাইজের সময় বই কিনিলে মোটা কমিশন দেয়।

রাখাল মিত্তির ক্ষেত্রবাবুর পিছু ছাড়ে না। বলিল, আসুন না আমার ওখানে, একটু  চা খাবেন—

শেষ পর্যন্ত যাইতেই হইল—নাছোড়বান্দা রাখাল মিত্তিরের হাতে পড়িলে না গিয়া উপায় নাই। সেই ছোট একতলার কুঠুরি। এই অগ্রহায়ণ মাসেও যেন গরম কাটে না। একখানা নিচু কেওড়া কাঠের তক্তপোশের উপর মলিন বিছানা। কেরোসিন কাঠের একটা আলমারি ভর্তি বই। ঘরখানা অগোছালো, অপরিষ্কার, মেঝের উপরে পড়িয়া আছে দুইটা ছেঁড়া জামা ছেলেপুলেদের, এক বোতল আঠা, একটা আলকাতরা মাখানো মালসা।

ক্ষেত্রবাবু বলিলেন, কী বই রাখালবাবু, আলমারিতে!

—দেখবেন? এ সব বই—এই দেখুন—

রাখালবাবু সগর্বে বই নামাইয়া দেখাইতে লাগিলেন।

—এই দেখুন প্রকৃতিবোধ অভিধান। পুরনো বইয়ের দোকান থেকে তিন টাকায়—আর এই দেখুন মুগ্ধবোধ—মশাই, সংস্কৃত ব্যাকরণ না পড়লে কি ভাষার ওপর দখল দাঁড়ায়? সহর্ণেঘঃ থেকে আরম্ভ করে সব সূত্র তিনটি বছর ধরে মুখস্থ করে ভোঁতা হয়ে গিয়েছে, তাই আজ দু-এক পয়সা করে খাচ্চি। রাখাল মিত্তিরের ব্যাকরণের ভুল ধরে, এমন লোক তো দেখি নে। গোয়ালটুলি স্কুলের হেডপণ্ডিত সেদিন বললে—মিত্তির মশাই, আপনার ব্যাকরণ পড়লে ছেলেদের সন্ধি আর সমাস গুলে খাওয়া হয়ে গেল। পড়া চাই—পেটে বিদ্যে না থাকলে—

—আপনার বই ধরিয়েচে নাকি?

—না, হেডমাস্টার বললে, শশিপদ কাব্যতীর্থের ব্যাকরণ আর-বছর থেকে রয়েছে ক্লাসে। এ বছর যুদ্ধের বছরটা, বই বদলালে গার্জেনরা আপত্তি করবে—তাই এ বছর আর হল না। সামনের বছর থেকে নিশ্চয়ই দেবে।

একটি বারো-তেরো বছরের রোগা মেয়ে, একটা থালায় দুটি আংটাভাঙা পেয়ালা বসাইয়া চা আনিল। রাখালবাবু বলিলেন, ও পাঁচী! এটি আমার ভাগ্নী—আমার যে বোন এখানে থাকে, তার মেয়ে—প্রণাম কর মা, উনি ব্রাহ্মণ।

—আহা, থাক থাক। এস মা, হয়েছে—কল্যাণ হোক। বেশ মেয়েটি।

—অসুখে ভুগছে। বর্ধমানে দেশ, কেউ নেই। এবার এক জ্ঞাতি কাকা নিয়ে গিয়েছিল, ম্যালেরিয়ায় ধরেচে। যাও মা, দুটো পান নিয়ে এস তোমার মামীমার কাছ থেকে। চা মিষ্টি হয়েছে? চিনি নেই, আখের গুড় দিয়ে—

—না না, বেশ হয়েছে।

দুধচিনিবিহীন বিস্বাদ চা, তামাক-মাখা গুড়ের গন্ধ, এক চুমুক খাইয়া বাকিটুকু গলাধঃকরণ করিতে ক্ষেত্রবাবুর বিশেষ কসরৎ করিতে হইল।

রাখালবাবু বলিলেন, তা তো হল, কী হাঙ্গামা বলুন দিকি! পাড়া যে খালি হয়ে গেল অর্ধেক!

—আপনাদের এ পাড়াতেও?

—হ্যাঁ মশাই, আশেপাশে লোক নেই। সব পালাচ্ছে। পাশের বাড়ির ঘোষালেরা আজ সকালে সব পালাল—এখন ওরা বড়লোক, এই দিনকতক আগেও পুতুলের বিয়েতে হাজার টাকা খরচ করেছে। ফুলশয্যের তত্ব করেছিল, দশজন ঝি চাকর মাথায় করে নিয়ে গেল, মায় রুপোর দান-সামগ্রী, খাট  বিছানা এস্তোক! ওদের কথা বাদ দিন। এখন আমরা যাব কোথায়?

—সেই ভাবনা তো আমারও, ভাবছি তো। গরিব স্কুল-মাস্টার—

—গরিব তো বটেই, যাবার জায়গাও তো নেই।

—আপনার দেশে বাড়িঘর—

রাখালবাবু হাসিয়া বলিলেন, দেশই নেই, তার বাড়িঘর! দেশ ছিল ন’দে জেলায়, কাঁচড়াপাড়া নেমে যেতে হয়। ছেলেবেলায় বাবার সঙ্গে গিয়েছিলাম। সে সব কিছু নেই। বড় হয়ে আর যাই নি, এই কলকাতাতেই—

—আমারও তো তাই।

পাঁচী পান আনিয়া রাখিয়া গেল।

—অনেক পয়সা খরচ করে বই ছাপালাম, চার-পাঁচশো টাকা দেনা এখনও বাজারে। এই হাঙ্গামাতে যদি বই বিক্রি কমে যায়, তবে তো পথে বসতে হবে। আপনাদের ভরসাতেই—

—কিছুই বুঝছি নে, কী যে হবে!

—আমাদের এখানে কিছু হবে না, কী বলেন? যুদ্ধ ফিলিপাইনে আর হংকংয়ে, তার এখানে কী?

—সিঙ্গাপুর ডিঙিয়ে আসা অত সোজা নয়।

—তবে লোক পালাচ্চে কেন?

—প্যানিক—ভয়! প্যানিক একেই বলে। আচ্ছা উঠি, রাত হল মিত্তির মশাই।

—আর একটু বসবেন না? আচ্ছা তা হলে—হ্যাঁ, একটা কথা। আনা আষ্টেক পয়সা হবে?

পকেটে যাহা কিছু খুচরা ছিল, তক্তপোশের উপর রাখিয়া ক্ষেত্রবাবু বাহিরের মুক্ত বাতাসে আসিয়া হাঁপ ছাড়িয়া যেন বাঁচিলেন।

‘স্পেশাল টেলিগ্রাফ’ কাগজ বাহির হইয়াছে, কাগজওয়ালা ফুটপাথ ধরিয়া ছুটিতেছে। ক্ষেত্রবাবু একজনের হাত হইতে  কাগজ লইয়া দেখিলেন—হংকং অবরুদ্ধ!…চীনসমুদ্রে ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ ধ্বংস!

ক্ষেত্রবাবু কেমন অন্যমনস্ক হইয়া পড়িলেন।

.

পরদিন স্কুলে হেডমাস্টার সব মাস্টারকে আপিসে ডাকিলেন। জরুরী মীটিং।

হেডমাস্টার এ বছরের পরীক্ষার লম্বা রিপোর্ট লিখিয়াছেন, সকলকে পড়িয়া শোনাইলেন। প্রত্যেক শিক্ষকের নিকট হইতে রিপোর্ট লওয়া হয়, পরীক্ষার কাগজ দেখার পরে। সেই সব রিপোর্টের উপর ভিত্তি করিয়া হেডমাস্টার নিজে রিপোর্ট লিখিয়া অভিভাবকদের মধ্যে ছাপাইয়া বিলি করেন। তাঁহার ধারণা, ইহাতে স্কুলে ছেলে বাড়িবে।

রিপোর্ট পড়িয়া সকলের মুখের দিকে চাহিয়া বলিলেন, কী রকম হয়েছে?

সকলেই বলিলেন, চমৎকার রিপোর্ট হইয়াছে, এমনধারা হয় না।

—থার্ড ক্লাসের ইংরিজি নিতেন কে?

যদুবাবু বলিলেন, আমি স্যার।

—ভীষণ খারাপ ফল এবার আপনার সাবজেক্টে। আপনি লিখিত কৈফিয়ত দেবেন—

—যে আজ্ঞে স্যার।

—ক্লাস সেভেনের ইতিহাস কে নেয়?

শ্রীশবাবু বলিলেন, আমি স্যার।

—সকলের চেয়ে ভালো ছেলে মোটে ষাট পেয়েছে।

—স্যার, প্রশ্ন বড় কঠিন হয়েছিল—সিলেবাস ছাড়া প্রশ্ন হলে কী করে ছেলেরা—

—না, এমন কিছু কঠিন নয়। প্রশ্নপত্র সব আমি আর মিঃ আলম দেখে দিয়েছি। কমিটিতে এ কথা আমায় রিপোর্ট করতে হবে। লিখিত কৈফিয়ত দেবেন। আর এবার বাড়ি বাড়ি গিয়ে একটু ক্যানভাস করা দরকার হবে ছুটির পরে। নইলে ছেলে হবে না।

ক্ষেত্রবাবু উঠিয়া ভয়ে ভয়ে বলিলেন, কিন্তু স্যার, এদিকে শহর যে খালি হয়ে গেল—

সাহেব তাচ্ছিল্যের সুরে বলিলেন, কে বললে?

যদুবাবু ও শ্রীশবাবু দাঁড়াইয়া বলিলেন, সেই রকমই দেখা যাচ্ছে স্যার। ক্ষেত্রবাবু ঠিক বলেছেন।

গেম মাস্টার বিনোদবাবু বলিলেন, আমাদের পাড়াতে তো আর লোক নেই।

জগদীশ জ্যোতির্বিনোদ বলিলেন, আমি এক জায়গায় ছেলে পড়াই, তারা চলে গিয়েছে। তাদের পাড়া খালি।

সাহেব মিঃ আলমের দিকে চাহিয়া বলিলেন, কী মিঃ আলম, আপনি কি দেখেছেন? এই রকম হয়েছে নাকি?

মিঃ আলম উঠিয়া ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন, না স্যার, এখানে ওখানে দু-একটা বাড়ি খালি হয়েছে বটে—কিছুই নয়।

ক্ষেত্রবাবু প্রতিবাদের সুরে বলিলেন, কিছু না কী রকম মিঃ আলম! হাওড়া স্টেশনে নাকি বেজায় ভিড় হচ্চে—কুলি আর ঘোড়ার গাড়ির দর বেজায় বেড়েছে—

—ওসব গুজব। কই, আমি তো রোজ বেড়াই, কিছু দেখি নি।

এমন সময় রামেন্দুবাবু বাহির হইতে একখানা খবরের কাগজ লইয়া ঘরে ঢুকিয়া সাহেবের টেবিলে রাখিয়া বলিলেন, দেখুন স্যার, হংকং যায়-যায়—জাপীনারা সিঙ্গাপুরে দূর-পাল্লার কামানের গোলা ছুঁড়েচে।

হেডমাস্টারের কড়া ডিসিপ্লিনের নিগড় বুঝি টুটিল। ক্ষেত্রবাবু ও শ্রীশবাবু টেবিলের উপর ঝুঁকিয়া পড়িয়া খবরের কাগজ পড়িতে গেলেন। সমবেত শিক্ষকদের মধ্যে একটা গুঞ্জনধ্বনি উত্থিত হইল।

—তাই তো!

—তাই তো!

—দেখ না ভায়া কাগজটা!

—সিঙ্গাপুর বিপন্ন!

—ব্যাপার কি?

সাহেব কাগজ হাতে তুলিয়া পড়িয়া ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন, বাজে গুজব! সিঙ্গাপুর পৃথিবীর মধ্যে সর্বাপেক্ষা দুর্ভেদ্য!

মিঃ আলম বলিলেন, বাজে গুজব—হেঁঃ—

সাহেব তাচ্ছিল্যের সঙ্গে কাগজখানা একদিকে সরাইয়া বলিলেন, যাক এসব। তা হলে বাড়ি বাড়ি ক্যানভাসিংয়ের জন্যে কে কে রাজি আছেন বলুন? সকলের সাহায্যই আমি চাই। যদুবাবু? ক্ষেত্রবাবু? মিঃ আলম?

ইঁহারা সকলেই দাঁড়াইয়া উঠিয়া সম্মতি জ্ঞাপন করিলেন।

ক্লার্কওয়েল সাহেবের স্কুলে ডিসিপ্লিন পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হইল। জাপানী বোমার হুজুগে পড়িয়া সে কঠোর ডিসিপ্লিনের ভিত্তি সামান্য একটু নড়িয়া উঠিয়াছিল মাত্র—তাহাও অতি অল্পক্ষণের জন্যে।

হেডপণ্ডিত বলিলেন, স্যার, ছুটি কদিন হচ্চে?

সাহেব গম্ভীরস্বরে বলিলেন, পাণ্ডিট, ছুটি বেশি দিন দিতে চাই না। দোসরা জানুয়ারি খুলবে। কিন্তু তার আগে ক্যানভাসিং করবার জনে চার-পাঁচজন টিচারকে এখানে থাকতে হবে। আমি তাদের নামে সারকুলার করব।

ক্ষেত্রবাবু বলিলেন, আমাদের মাইনেটা স্যার—

—স্কুল খুললে দেওয়া হবে।

যদুবাবু মুখ কাঁচুমাচু করিয়া বলিলেন, কিছু না দিলে, স্যার, আমরা দাঁড়াই কোথায়? হাতে কিছু নেই—

—যার না পোষাবে, তিনি চলে যেতে পারেন—মাই গেট—

যদুবাবু শিক্ষক কর্তৃক তিরস্কৃত স্কুলের ছাত্রের মত ঘাড় নিচু করিয়া পুনরায় আসনে বসিয়া পড়িলেন।

হেডমাস্টার বলিলেন, আমি ছুটির কদিন মিঃ আলম, রামেন্দুবাবু আর ক্ষেত্রবাবুকে চাই। তাঁরা রোজ আসবেন আপিসে। নতুন বছরের রুটিনে অনেক অদলবদল করতে হবে। সিলেবাস তৈরি করতে হবে প্রত্যেক ক্লাসের। আপনারা তিনজন আমাকে সাহায্য করবেন। যদুবাবু?

যদুবাবু আবার দাঁড়াইয়া উঠিলেন।

—আপনিও আসবেন। আপনাকে ক্লাস-টাস্কের একটা চার্ট করতে হবে গ্রীষ্মের ছুটি পর্যন্ত।

যদুবাবুর মুখ শুকাইয়া গেল। আমতা আমতা করিয়া বলিলেন, আমি স্যার, আমার শালির, মানে—বিয়ে—দেশে যেতে হবে সেখানে। আমিই সব দেখাশুনো করব—

হঠাৎ মনে পড়িল পৌষ মাসে বিবাহ হয় না হিন্দুর, এ কথা সাহেব না জানিলেও অন্যান্য মাস্টারেরা সবাই জানে, হয়তো আলমও জানে। আলম সাহেবকে বলিয়া দিতেও পারে। তাই তাড়াতাড়ি সামলাইয়া লইয়া বলিলেন, বিয়ে এই সামনের বুধবারে, কিন্তু ছুটিতে আমার না গেলে—

—ইয়েস, ইয়েস, আই আণ্ডারস্ট্যাণ্ড।

সভা ভঙ্গ হইল। সাহেবের ঘর হইতে বাহির হইয়া যদুবাবু রামেন্দুবাবুকে পাকড়াও করিলেন।

—ও রামেন্দুবাবু, আমায় গোটাদশেক টাকা দিতে বলুন সাহেবকে। করে দিতেই হবে। না হলে মারা যাব। হাতে কিচ্ছু নেই। টুইশানির ছেলে পালিয়েচে। কোথায় পয়সা পাই বলুন তো?

.

ক্ষেত্রবাবু বাড়ি ফিরিতেই অনিলা ব্যস্তসমস্ত হইয়া বলিল, এসেছ? শোন, সব পালাচ্ছে, পাড়া ফাঁকা হয়ে গেল যে? সোমবার থেকে নাকি হাওড়ার পুল খুলে দেবে, রেলগাড়ি বন্ধ করে দেবে?

—কে বললে?

—কে বললে আবার—সবাই বলছে। তোমার ছুটির কদিন দেরি? এর পর যাওয়া যাবে না কোথাও—ঘোড়ার গাড়ির ভাড়া নাকি দশ টাকা করে হয়েছে—বোমা নাকি শীগগির পড়বে। সিঙ্গাপুর ব্লকেড করেছে, দেখেচ তো?

ক্ষেত্রবাবুর ভয় হইয়া গেল। তাই তো, ঘোড়ার গাড়ির ভাড়া চড়িয়া গেলে কী করিয়া  কলিকাতা ত্যাগ করিবেন? বলিলেন, কিন্তু কোথায় যাওয়া যায় বল তো? জায়গা তো দেখছি এক আসসিংড়ি। কতকাল সেখানে যাই নি। নিভা বেঁচে থাকতে একবার গরমের ছুটিতে সেখানে গিয়েছিলাম। বাড়িঘর এতদিনে ইটের স্তূপ হয়েছে পড়ে থেকে। বেজায় জঙ্গল সে গাঁয়ে।

—চল, গয়া যাই।

—পয়সা? অত টাকা কোথায়? স্কুলে এক পয়সা দিলে না।

—আমার বাক্সে পাঁচ-ছটা টাকা আছে। আর কিছু ধার কর।

—কে দেবে ধার? সে বাজার নয়।

—কিন্তু যা হয় কর তাড়াতাড়ি। এর পর আর  কলকাতা থেকে বেরুনো যাবে না সবাই বলচে।

—রান্না হয়ে থাকে, দাও। আমি একবার যদুদার বাসা থেকে আসি। দেখে আসি, কী করছে ওরা!

.

যদুবাবু বাসায় পা দিতেই তাঁহার স্ত্রী বলিল, ওগো, কী হবে গো? সবাই চলে যাচ্ছে, কী করবে কর! কোনদিন ঝুপ করে বোমা পড়বে, তখন—

—দাঁড়াও, একটু স্থির হতে দাও। চা কর, আগে খাই। তারপর সব শুনছি।

চা করিয়া যদুবাবুর গৃহিণী কাঁসার গ্লাসে আঁচল জড়াইয়া লইয়া আসিল।

যদুবাবু বলিলেন, কেন, পেয়ালা?

—সে ও-বেলা ধুতে গিয়ে হাত থেকে পড়ে গুঁড়ো হয়ে গেল।

যদুবাবু রাগিয়া উঠিলেন, তা ভাঙবে বইকি, তোমাদের তো ভেবে খেতে হয় না। জিনিসপত্র নষ্ট করলেই হল—লাগে টাকা, দেবে গৌরী সেন! একটা পেয়ালার দাম কত আজকালকার বাজারে, তার খোঁজ রাখ?

এমন সময় বাহিরে ক্ষেত্রবাবুর গলা শোনা গেল : ও যদুদা, বাসায় আছেন নাকি?

যদুবাবু তাড়াতাড়ি চা-সুদ্ধ কাঁসার গ্লাসটা স্ত্রীর হাতে দিয়া বলিলেন, এটা নিয়ে যাও—নিয়ে যাও। দেখে ফেলবে, বলবে কী? গলার সুর বাড়াইয়া বলিলেন, এস ক্ষেত্র ভায়া—এস এস—

—কী হচ্চে?

—এই সবে এলাম ভাই। সবে মিনিট দশেক। তারপর কী মনে করে? বোস এইটেতে।

—বউদিদি কোথায়? ও বউদিদি, বলি, একটু চা-টা না হয় করেই খাওয়ান—

যদুবাবু হাসিয়া বলিলেন, চা খাবে কি ভাই, পেয়ালা ভেঙে বসে আছে তোমার বউদিদি—কাঁসার গেলাসে চা খাচ্ছিলাম, তা তোমাকে কি আর তাতে—

—খুব দেওয়া যাবে। তাতেই দিন না বউদিদি।

—দাও তা হলে, ওগো, ওই চা-ই দিয়ে যাও—ক্ষেত্র ভায়া আমাদের ঘরের লোক।

চা আসিল। চা খাইতে খাইতে ক্ষেত্রবাবু বলিলেন, তা তো হল। এখন কী উপায় করা যাবে বলুন দিকি? কলকাতার যা অবস্থা! লোক সব পালাচ্চে—

—হেডমাস্টার তা বুঝবেন না। তাঁর মতে কোনো বিপদের কারণ নেই। আবার বাড়ি বাড়ি ঘুরে ক্যানভাসিং করতে হবে ছেলের জন্যে! ছেলে কোথায়? কলকাতা শহর তো ফাঁকা হয়ে গেল!

—তা কি আর সাহেবকে বোঝানো যাবে দাদা? কাল থেকে ক্যানভাসিংয়ে না বেরুলে সাহেব রাগ করবে। আপনারও তো ডিউটি আছে।

—তাই তো, কী করা যায় ভাবচি! মুশকিল আসলে কী হয়েছে জান ভায়া, হাতে নেই পয়সা। রামেন্দু ভায়াকে ধরেছি, সাহেবকে বলে গোটাদশেক টাকা আমায় না দেওয়ালে চলবে না।

—কোথায় যাবেন ভাবচেন?

—কোথায় যে যাই!—হাতে পয়সা নেই, দেশঘর নেই। তোমার তবুও তো দেশে বাড়িঘর আছে, আমার যাবার স্থান নেই। এক আছে জ্ঞাতি-ভাইয়ের বাড়ি, বেড়াবাড়ি বলে গ্রাম, তা সেখানে তারা যে রকম ব্যবহার করেচে—পরের বাড়ি, কোনো জোর তো সেখানে খাটে না! তুমি কোথায় যাবে ভাবচ?

—আমারও সেই একই অবস্থা। আসসিংড়িতে—মানে আমাদের দেশে—কতকাল যাই নি। বাড়িঘর এতদিনে ভূমিসাৎ—নয়তো একগলা জঙ্গল, সাপ-ব্যাঙের আড্ডা হয়ে আছে। মেয়েছেলে নিয়ে সেখানে গিয়ে দাঁড়াই কী করে? আমার স্ত্রী বলছিল, গয়াতে—শ্বশুরবাড়ি—

—সেই সব চেয়ে ভালো আমার মতে। তাই কেন যাও না?

—পয়সা? পয়সা কোথায়? স্কুলে খাটব দু’ মাস পরে এক মাসের মাইনে নেব—এই তো অবস্থা। জানেন তো সবই।

—আচ্ছা, তোমার কী মনে হয় ভায়া? জাপানীরা কি এতদূর আসবে? সিঙ্গাপুর নিতে পারবে?

—কী করে বলব? তবে আমার এক জানাশোনা গবর্মেন্ট অফিসার বলছিল, সিঙ্গাপুর হঠাৎ নিতে পারবে না। ওখানে যুদ্ধ হবে দারুণ, এবং সে যুদ্ধ কিছুকাল চলবে।

—তবে কলকাতাতে বোমা ফেলতে পারে, কী বল?

—ফেলতে পারে। সাহেব যাই বলুক, কলকাতা খুব সেফ হবে না।

—স্কুলটাতে দু’ দিন বেশি ছুটির কথা বলে দেখলে হয় না?

—সাহেবকে তা বলা যাবে না। সাহেব ভিজবে না।

ক্ষেত্রবাবু আর কিছুক্ষণ কথাবার্তা কহিয়া বিদায় লইলেন। ব্ল্যাক-আউটের  কলিকাতা, ঘুটঘুটে অন্ধকার—কাল হইতে আলো আরও কমাইয়া দিয়াছে। মোড়ের কাছে এক জায়গায় ঘোড়ার গাড়ির আড্ডা। ক্ষেত্রবাবুর কৌতূহল হইল, গাড়ির ভাড়া কেমন হাঁকে একবার দেখিবেন।

রাস্তা পার হইতে ভয় করে। অন্ধকারের মধ্যে দূরে বা নিকটে বহু আলো তাঁহার দিকে আসিতেছে—ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে বোঝা যায় না, কত বেগে সেগুলি এদিকে আসিতেছে। ক্ষেত্রবাবু সন্তর্পণে রাস্তা পার হইয়া গাড়ির আড্ডার কাছে গিয়া বলিলেন, ওরে গাড়োয়ান, ভাড়া যাবি?

একখানা গাড়ির ছাদে একটা লোক শুইয়া ছিল। উঠিয়া বলিল, কাঁহা যানে হোগা বাবুজি?

—হাওড়া ইস্টিশানে।

—আভি যাইয়েগা?

—হ্যাঁ, এখুনি।

—ক’ আদমী আছে?

—তিন-চারজন আছে—মালপত্তর। কত ভাড়া নিবি?

—এক বাত বোলেগা বাবুজি? চার রূপেয়া!

—কত?

—চার রূপেয়া বাবুজি। কাল ইসসে আউর বাঢ়েগা বাবুজি। কাল পান-ছ রূপেয়া হোগা। দিন দিন বাঢ়তে যাতা হ্যায়—যাবেন আপনি? সওয়ারি কোথা থেকে যাবে?

ক্ষেত্রবাবু কী একটা অজুহাত দেখাইয়া সেখান হইতে সরিয়া পড়িলেন। তাঁহার হাত-পা যেন অবশ হইয়া আসিতেছে—সম্মুখে যেন ঘোর বিপদ ঘনাইয়া আসিতেছে, প্রলয় অথবা মৃত্যু, স্ত্রীপুত্র লইয়া এই ব্ল্যাক-আউটের ঘুটঘুটে অন্ধকারাচ্ছন্ন কলিকাতা শহরে তিনি বোতলের ছিপি আঁটা অবস্থায় বুঝি মারা পড়িলেন। ঘোড়ার গাড়ির ভাড়া দিনে দিনে যদি অসম্ভব অঙ্কের দিকে ছোটে, তবে তাঁর মত গরিব স্কুল-মাস্টার তো নিরুপায়!

মোড়ের মাথায় বিষ্ণু ভটচাজের সঙ্গে অন্ধকারে প্রায় মাথা ঠুকিয়া গেল। পরস্পরকে চিনিয়া পরস্পর ক্ষমা প্রার্থনা করিলেন। বিষ্ণু হাওড়ার রেলওয়ে মালগুদামে কাজ করে, বলিল, ওঃ, জানেন ক্ষেত্রদা, কী কাণ্ড আজ হাওড়া স্টেশনে! প্রত্যেক ট্রেন ছাড়ছে, লোকে লোকারণ্য। লোক গাড়িতে উঠতে পারছে না—দশ টাকা, পনেরো টাকা করে কুলিরা নিচ্ছে। আবার শুনচি, হাওড়া ব্রিজ দিয়ে গাড়ি-ঘোড়া যাওয়া বন্ধ করে দেবে। এত ভিড় যে, স্ট্র্যান্ড রোড একেবারে জ্যাম—ই. আই. আর.-এর গাড়িতে ওঠবার উপায় নেই।

—তুমি এখনও আছ যে?

—আমি আর কোথায় যাব? ফ্যামিলি পাঠিয়ে দিয়েছি বীরভূম—মামাশ্বশুর-বাড়ি।

.

ক্ষেত্রবাবু বাসায় ঢুকিলেন। অনিলা বলিল, কী হল গো? যদুবাবু কী বললে?

—বলবে আর কী! সব একই অবস্থা। সেও ভাবছে কোথায় যাবে—জায়গা নেই—

—গয়া যাবে?

—যাব কি, ই. আই. আর-এর গাড়িতে নাকি যাওয়ার উপায় নেই!

—তবে কী করবে? স্কুল তো এখনও বন্ধ হল না!

—বন্ধ হলে কী হবে? আমার ছুটির মধ্যে ডিউটি পড়েছে—আমার যাবার জো নেই—

অনিলা স্বামীর হাত ধরিয়া মিনতির সুরে বলিল, ওগো, আমার মুখের দিকে চেয়ে তুমি চাকরি ছেড়ে দাও। এই বোমার হিড়িকে তোমাকে এখানে ফেলে রেখে আমার কোথাও গিয়ে শান্তি হবে না। ছেলেমেয়েদের মুখের দিকে চাইতে হবে, লক্ষ্মীটি, শুধু তোমার-আমার কথা ভাবলে হবে না।

ক্ষেত্রবাবুর মনে হইল, তাঁহার মাথার উপর ভীষণ বিপদ সমাগত। স্ত্রীর গলার সুরে, নিজের মুখের কোথায় যেন কোনো মহা ট্র্যাজেডির ইঙ্গিত দিতেছে, সে ট্র্যাজেডির বেড়াজাল এড়াইয়া কোথাও পলাইবার পথ নাই।

সারারাত্রি বড় রাস্তা দিয়া ঘড়-ঘড় করিয়া ঘোড়ারগাড়ি আর ঠুনঠুন করিয়া রিকশা ছুটিতেছে—ক্ষেত্রবাবু বিনিদ্র চক্ষে সারারাত্রি ধরিয়া শুনিয়াই চলিলেন। অনিলা ঘুমাইয়া পড়িয়াছে, ছেলেমেয়েরা ঘুমাইতেছে, সম্মুখে কী বিপদ, ইহাদের সে সম্বন্ধে কোনো ধারণাই নাই। কী করিয়া উদ্যত জাপানী বোমার হাত হইতে ইহাদের বাঁচাইবেন? বাঁচাইতে পারিবেন কি শেষ পর্যন্ত? হাতে টাকাপয়সা কোথায়?

সারারাত্রি ক্ষেত্রবাবু  বিছানায় এপাশ ওপাশ করিলেন।

.

পরদিন স্কুলের প্রমোশন। সাহেব খুব সকালে উঠিয়া—অভিভাবকদের পড়িয়া শোনাইবার জন্য যে রিপোর্ট লিখিয়াছেন, তাহা আর-একবার পড়িয়া দেখিতে বসিলেন। আজ ছেলেদের প্রমোশনের পর অভিভাবকদের সভায় এই রিপোর্ট পড়া হইবে—প্রতি বৎসর হইয়া থাকে, অভিভাবকদের নিমন্ত্রণ করা হয়, এবারেও হইয়াছে।

‘‘বড়ই আনন্দের কথা, সপ্তম শ্রেণীর ইংরেজি পরীক্ষার ফল এবার যথেষ্ট আশাপ্রদ; যদিও ক্লাসের সর্বোচ্চ নম্বর শত-করা বাহান্ন, তবুও এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, প্রত্যেক উত্তরের খাতা আমাকে যথেষ্ট সন্তোষ দান করিয়াছে। ক্লাসের ছেলেদের মধ্যে হরিচরণ এবার গ্রামারে বিশেষ উন্নতি করিয়াছে, যদিও ক্রিয়াপদের যথার্থ প্রয়োগ এখনও সে  শিক্ষা করে নাই। গ্রামার-শিক্ষার ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক এজন্য যত্ন লইতেছেন। শ্রীমান নবীনচন্দ্র গুঁই ইংরাজি আর্টিকলের ব্যবহারে বালকসুলভ ভ্রম প্রদর্শন করা সত্বেও তাহার গ্রামারের জ্ঞান উন্নতির পথে অগ্রসর হইতেছে। নবম শ্রেণীর অঙ্কের ফল এ বৎসর আশাতীত ভালো। শ্রীমান গোপাল বন্দ্যোপাধ্যায় নব্বই নম্বর পাইয়া অঙ্কে ক্লাসের সর্বোচ্চ স্থান অধিকার করিয়াছে। আমি এই বালকের গত বৎসরের অঙ্ক পরীক্ষার ফলের দিকে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করিতেছি—বিগত বৎসরের ষান্মাসিক ও বার্ষিক পরীক্ষায় শ্রীমান গোপাল বীজগণিত ও জ্যামিতিতে যথাক্রমে আটচল্লিশ ও বত্রিশ নম্বর মাত্র পায়—একবৎসরের মধ্যে সেই বালকের এই উন্নতি শুধু যে কেবল অঙ্কশিক্ষকের কৃতিত্বের পরিচায়ক তাহা নহে, বালকের নিজের অধ্যবসায় ও আগ্রহেরও নিদর্শন বটে। আমি এজন্য তাহাকে একটি স্বাক্ষরিত প্রশংসাপত্র দিব স্থির করিলাম। শ্রীমান লালগোপাল ধর ইতিহাসে এ বৎসর…’’ ইত্যাদি।

অভিভাবকদের কাছে এই ধরনের রিপোর্ট পাঠ কোনো স্কুলেই হয় না—কিন্তু সাহেবের বিশ্বাস, ইহাতে অভিভাবকেরা সন্তুষ্ট থাকে, স্কুলের ছাত্রসংখ্যা বাড়ে। এই ধরনের রিপোর্ট পাঠ নাকি ক্লার্কওয়েল সাহেবের স্কুলের একটি বৈশিষ্ট্য। কৃতী বালকদিগকে স্বাক্ষরিত প্রশংসাপত্র দান আর একটি বৈশিষ্ট্য; যদিও ছেলেরা আড়ালে বলাবলি করে, রৌপ্যপদক দিতে অর্থব্যয় আছে, প্রশংসাপত্র দিতে খরচ শুধু কাগজের।

মাস্টারেরা বেলা নয়টার মধ্যে আসিয়া গেল। কাল সারকুলার দেওয়া হইয়াছিল—বিভিন্ন মাস্টারের বিভিন্ন কাজ। কেহ প্রমোশন-প্রাপ্ত ছেলেদের নাম, ক্লাস ও সারি তালিকা করিতেছে, কেহ ভালো ছাত্রদের পরীক্ষার খাতাগুলি আলাদা করিয়া রাখিতেছে, কেহ নতুন ক্লাসের বইয়ের লিস্টগুলি তৈয়ারি করিতেছে। দুইজনে মিলিয়া একখানা বিজ্ঞাপন লিথো করিতেছে [এই স্কুলে আধুনিকতম শিক্ষাবিজ্ঞান অনুমোদিত পদ্ধতিতে ছেলেদের শিক্ষা দেওয়া হয়, হেডমাস্টার মিঃ জি. বি. ক্লার্কওয়েল এম. এ. (লিডস) বি. এড. (লন্ডন) এল. টি. (কর্ক) এস. সি. এস. (অমুক) স্বয়ং নবম ও দশম শ্রেণীতে ইংরাজি পড়ান এবং শিশু-শ্রেণীতে কথ্য ইংরেজি শিক্ষা দেন। আমরা স্পর্ধার সহিত বলিতে পারি—]।

বিজ্ঞাপন ছাপাইবার পয়সা নাই—তাই লিথো করা। অভিভাবকদের হাতে বিলি করা হইবে। হেডমাস্টারের নানা ফাইফরমাশ খাটিতে খাটিতে মাস্টারেরা হিমশিম খাইয়া গেল।

বেলা দশটা বাজিল। এ কয়দিন ছেলেরা তেমন নাই—কারণ পরীক্ষার পর একরকম ছুটিই ছিল। আজ প্রমোশনের দিন, অন্য অন্য বছর বেলা সাড়ে নয়টার সময় হইতে ছেলেদের ভিড় হয়—এবার জনপ্রাণীর দেখা নাই। বেলা এগারোটা বাজিল, কেহই নাই। সাড়ে এগারোটার সময় ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ জন মাত্র ছাত্র আসিল—তিনশো সাড়ে তিনশো ছেলের মধ্যে। দুইজন মাত্র অভিভাবক দেখা দিলেন প্রায় বারোটার সময়। আর কেহই আসিল না। হেডমাস্টার রীতিমত নিরাশ হইলেন—কত কষ্ট করিয়া লেখা রিপোর্ট কাহার সামনে পাঠ করিবেন? তবুও তিনি ছাড়িবার পাত্র নহেন, নিজের ঘর হইতে গাউন ঝুলাইয়া ও স্লেটের মত দেখিতে হ্যাট মাথায় দিয়া সাজিয়া-গুজিয়া মাস্টারদের লইয়া ক্লাসে ক্লাসে প্রমোশন দিতে গেলেন।

মিঃ আলম বলিলেন, স্যার, নীচের তলায় কোনো ক্লাসে ছেলে নেই—ছোট ছোট ছেলেদের ক্লাস একেবারে ফাঁকা। সেখানে কি যেতে হবে?

সাহেব হাইকোর্টের জজের মত গম্ভীর সুরে বলিলেন, নিয়ম যা, তার একটুকু ব্যতিক্রম হবার জো নেই আমার স্কুলে। শূন্য ক্লাসের সামনেই প্রমোশনের লিস্ট পড়া হবে।

সুতরাং উপরের ক্লাসের প্রমোশন লিস্ট পড়া শেষ করিয়া হেডমাস্টার দলবল লইয়া নীচেকার শূন্য ক্লাসগুলিতে অবতীর্ণ হইলেন।

হেডমাস্টার ডাকিলেন, রমেন্দ্র বোস প্রোমোটেড টু নেকসট হাইয়ার ক্লাস, অমুক প্রোমোটেড টু নেকসট হাইয়ার ক্লাস, ইত্যাদি।

ফাঁকা হাওয়া এ-জানালায় ও-জানালায় হা-হা করিতেছে। কড়িকাঠে টিকটিকি টিকটিক করিয়া উঠিল; হাসি পাইলেও কোনো মাস্টারের হাসিবার জো নাই। শ্রীশবাবু গেম-মাস্টার বিনোদবাবুর পাঁজরায় আঙুলের গুঁতা মারিলেন। যদুবাবু ক্ষেত্রবাবুকে চিমটি কাটিলেন।

উপরে আসিয়া রিপোর্ট পড়িবার সময় দেখা গেল, সেই দুইজন অভিভাবক আপিসে বসিয়া আছে। তাহারা সাহেবের বার্ষিক প্রোগ্রেস রিপোর্ট শুনিতে আসে নাই, আসিয়াছে তাহাদের ছেলেদের ট্রান্সফার সার্টিফিকেট লইতে।

সাহেবের ইঙ্গিতে মিঃ আলম তাহাদের আড়ালে লইয়া গিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, আপনারা এ স্কুল থেকে নিয়ে যেতে চাচ্ছেন কেন? ওদের এ বছরের ফল বেশ ভালোই। হেডমাস্টারের রিপোর্টটা শুনুন না—

একজন বলিল, রিপোর্ট শুনে কী করব মশাই, আমাদের ফ্যামিলি সব এখান থেকে চলে গিয়েছে কাটোয়ায়, আজ আট-দশ দিন হল সেখানে এখন সবাই থাকবে। এখানে বাড়ি চাবিবন্ধ, ছেলে থাকবে কার কাছে? সেখানেই ভর্তি করে দেব।

অন্য লোকটি বলিল, আমাদের দেশ মশাই বর্ধমানে। আমাদের দোকান ছিল, উঠিয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছি। দেশের স্কুলে ভর্তি করব। আপনি সাহেবকে বলুন, ট্রান্সফার আজই দিতে হবে। আমাদের পাড়ায় লোক নেই, থাকব কী ভরসায়?

—রিপোর্টটা শুনুন না!

—না মশাই, মন ভালো না। ওসব শোনবার সময় নেই। আমার ব্যবস্থাটা করে দিন তাড়াতাড়ি।

মিঃ আলম ফিরিয়া আসিলে সাহেব জিজ্ঞাসা করিলেন, কী হল?

—স্যার, ওরা শোনে না। ট্রান্সফার না নিয়ে ছাড়বে না মনে হচ্ছে।

—ছেলে এল না কেন আজ?

রামেন্দুবাবু বলিলেন, ছেলে কোথায় যে আসবে স্যার? সব ভেগেছে!

নমো-নমো করিয়া মীটিং শেষ হইল। রিপোর্ট পাঠ হইল স্কুলের মাস্টারদের সামনে। মীটিং-অন্তে হেডমাস্টারের নানারকম সারকুলার বাহির হইল—দোসরা জানুয়ারি স্কুল খুলিবে। হেডমাস্টারের নিকট মাস্টারেরা বিদায় লইলেন। অতি সাধের লিথো-করা-বিজ্ঞাপন কাহাদের মধ্যে বিলি করা হইবে? স্কুলের বোর্ডে খানকতক আঠা দিয়া জুড়িয়া দেওয়া হইল।

চায়ের দোকানে যদুবাবু আর শ্রীশবাবু হাসিয়া বাঁচেন না।

ক্ষেত্রবাবু বলিলেন, সাহেবের কী কাণ্ড! কোনো ত্রুটি হবার জো নেই!

যদুবাবু বলিলেন, নাঃ, হেসে আর বাঁচি নে—হাসতে হাসতে পেট ফুলে উঠল। হাসতেও পারি নে সাহেবের সামনে—

এই সময় জ্যোতির্বিনোদ একটা পুঁটুলি হাতে ঘরে ঢুকিয়া বলিলেন, আজ শেষ দিনটা, একটু ভালো করে খাওয়া-দাওয়া করা যাক যদুদা।

ক্ষেত্রবাবু বলিলেন, হাতে পোঁটলা কিসের হে?

—আজ বাড়ি যাচ্চি রাত্রের গাড়িতে।

—এ কদিনের জন্যে?

—না দাদা, বাড়ি থেকে চিঠি এসেছে। যাই চলে, যা হয় হবে। এখন  কলকাতা আসা বোধ হয় হবে না।

—সাহেব কি ছুটি দেবে?

—না হয় চাকরি ছেড়ে দেব। দেশে ঘর আছে, ভিক্ষে করে খাব। বামুনের ছেলে, তাতে লজ্জা নেই।

যদুবাবুর বুকের ভিতরটা ছ্যাঁত করিয়া উঠিল। এই জ্যোতির্বিনোদের মত সামান্য দরের লোকে যদি চাকরি ছাড়িয়া দিবার মত মরীয়া হইয়া উঠিতে পারে, তবে বিপদ কত বেশি।

কে একজন বলিল, ক্ষেত্রদার হোমিওপ্যাথিটা যা হোক চলছিল—

—আর হোমিওপ্যাথি ভায়া! পাড়ায় নেই লোক, ডাক্তারি করতাম একটু-আধটু অবসরমত, তাও গেল—পাড়া খালি।

যদুবাবু হঠাৎ যেন শীতকালেও ঘামিয়া উঠিতে লাগিলেন। শ্রীশবাবু, শরৎবাবু, গেম মাস্টার বিনোদবাবু, হেডপণ্ডিত, সবাই আজ উপস্থিত। বড়দিনের ছুটি হইয়া যাইতেছে—তাহার উপর এই গোলমাল। কী হইবে কে জানে? একটু ভালো করিয়া খাওয়া-দাওয়া করিয়া লওয়া যাক। ইঁহাদের ভালো খাওয়ার দৌড়—চার পয়সা হইতে ছয় পয়সা বা আট পয়সা। একখানা টোস্টের জায়গায় দুইখানা টোস্ট। তাহাই সকলে আমোদ করিয়া খাইলেন। ইঁহারা অল্পেই সন্তুষ্ট, অভাবের মধ্যে সারা জীবন এবং যৌবনের অংশ অতিবাহিত করিয়া সংযম ও মিতব্যয়ে অভ্যস্ত হইয়া উঠিয়াছেন।

ইঁহাদের মধ্যে জগদীশ জ্যোতির্বিনোদ অমিতব্যয়িতার প্রথম উদাহরণ দেখাইয়া বলিল, ওহে দোকানদার, যদুবাবুকে আরও একখানা কেক দাও, শ্রীশবাবুকে একখানা টোস্ট দাও, বিনোদকে—

যদুবাবু একগাল হাসিয়া বলিলেন, আমাদের জ্যোতির্বিনোদের হার্টটা যাই বল বেশ ভালো!

—আর দাদা, হার্ট! এবার কলকাতা থেকে চলে যাচ্ছি। বোধ হয় এই শেষ দেখা—চাকরি আর করব না—

—কেন, কেন?

—বাড়ির সকলে বলছে, প্রাণ বাঁচলে অনেক চাকরি মিলবে—চলে এস বাড়ি।

যদুবাবু কথাটা এই কিছুক্ষণ আগেই একবার শুনিয়াছেন ইঁহার মুখ হইতে, তবুও আর একবার জিজ্ঞাসা করিয়া শুনিয়া বিপদের গুরুত্বটা ভালো করিয়া যেন বুঝিতে চাহিলেন। ক্ষেত্রবাবুকে বলিলেন, তারপর ক্ষেত্র ভায়া, ব্যাপার কী দাঁড়াল বল তো? সত্যি কি কলকাতা ছেড়ে যেতে হবে?

ক্ষেত্রবাবুও ঠিক এই কথাই ভাবিতেছেন। চা খাইতে খাইতে এই মাত্র ভাবিতেছিলেন, আসসিংড়ি যাওয়া ভালো, না গয়ার দিকে—শ্বশুরবাড়িতে? যদুবাবুর কথায় যেন একটু বিস্মিত হইলেন। ভয়ানক বিপদ নিশ্চয় সম্মুখে, নতুবা যদুদার মনেও ঠিক একই সময়ে সেই একই কথা উঠিল কেন? বলিলেন, তা যেতে হবে বইকি। সবাই যখন পালাল—

গেম-মাস্টার বলিলেন, আমার এক বন্ধুর বাড়িতে রেডিও আছে। টোকিও থেকে নাকি বলেছে, সাতাশ তারিখে কলকাতায় নিশ্চয়ই বোমা ফেলবে—

যদুবাবু সভয়ে বলিয়া উঠিলেন, য়্যাঁ!

ক্ষেত্রবাবুর নিজের স্নায়ুসমূহের উপর কর্তৃত্ব আরও দৃঢ়তর। তিনি বলিলেন, কোন সাতাশে? এই সাতাশে?

—এই সামনের সাতাশে দাদা। আজ হল সতেরো।

যদুবাবুর সামনে এইবার দোকানি জ্যোতির্বিনোদের অর্ডারি সেই কেকখানা দিয়া গেল। যদুবাবুর তখন আর কেক খাইবার রুচি নাই—অন্য সময়ে হইলে পরের দেওয়া চার পয়সা দামের ভালো কেকখানা কী তৃপ্তির সঙ্গেই একটু একটু করিয়া ভাঙিয়া ভাঙিয়া চায়ের সঙ্গে খাইয়া শেষ করিতে অন্তত দশ-পনেরো মিনিট ব্যয় করিতেন—পাছে তাড়াতাড়ি ফুরাইয়া যায়! আজ কিন্তু যদুবাবুর মনে হইল, তিনি মিউনিসিপ্যালিটির জবাইখানার মধ্যে বসিয়া আছেন, চারিধারে গরুর বদলে মানুষের কাটা হাত, পা, ঘিলু-বার হওয়া শূন্যগর্ভ নরমুণ্ড, চাপ চাপ রক্ত, থেঁতলানো ধড়, ছটকিয়া পড়া দন্তপাটি—শবের উপরে শব, রক্তমাখা চুলের বোঝা, উগ্র কর্ডাইটের গন্ধ, মৃত্যু, আর্তনাদ!

যদুবাবু নিজের অজানিতে শিহরিয়া উঠিলেন।

কোথায় যাইবেন তিনি? যাইবার কোনো জায়গা নাই। বেড়াবাড়ি গিয়া উঠিবেন অবনীকে খোশামোদ করিয়া, হাতে পায়ে ধরিয়া? এ বিপদসঙ্কুল স্থানে মরণের ফাঁদের মধ্যে নিশ্চেষ্ট হইয়া বসিয়া থাকার চেয়ে তাও যে ভালো। ভাগ্যে আজ রামেন্দুবাবুকে ধরিয়া-কহিয়া গোটাকতক টাকা সাহেবের নিকট হইতে আদায় করিয়া লইয়াছেন!

সম্মুখের টেবিলস্থ পাত্রের দিকে চাহিয়া দেখিলেন, ইতিমধ্যে কখন কেকখানা খাইয়া ফেলিয়াছেন অন্যমনস্ক অবস্থায়। টেবিল হইতে উঠিয়া বলিলেন, তোমরা তা হলে বোস, আমি আসি—

জ্যোতির্বিনোদ বলিল, আরে বসুন বসুন যদুবাবু, আর এক পেয়ালা  চা দেবে? আর একখানা কেক?

—আরে, না হে না। আমার সময় নেই সত্যি। একটা জরুরী কাজ আছে, আমি চলি—

অপরের চা ও খাবার যদুবাবু বোধ হয় জীবনে এই সর্বপ্রথম প্রত্যাখ্যান করিলেন।

.

বেলা সাড়ে পাঁচটা। শীতের বেলা, সন্ধ্যার বেশি দেরি নাই। ব্ল্যাকআউটের কলিকাতায় বেশি ঘোরাঘুরি করা চলিবে না, তবুও যদুবাবু শ্যামবাজারে তাঁহার এক জানাশোনা লোকের আড়তে গিয়া কিছু টাকা ধারের চেষ্টা একবার দেখিলেন। যদি  কলিকাতা ছাড়িয়া যাইতে হয়, বেশ কিছু রেস্ত থাকা দরকার হাতে।

টালার পুলের পাশ দিয়া গলিটা নামিয়া গেল। যদুবাবু দুরুদুরু বক্ষে আড়তের নিকটবর্তী হইলেন, কী জানি কী ঘটে! কত টাকা চাহিবেন? দশ, না ত্রিশ? পাওয়া যাইবে কি এ বাজারে? বিশেষত এস্থলে আলাপ-পরিচয় তেমন ঘনিষ্ঠ নয়। লোকটি তাঁহার শালার সহপাঠী, শালার সঙ্গে কয়েকবার ইতিপূর্বে এখানে আসিয়াছেন—একসময়ে যাতায়াত ছিল, এখন কমিয়া গিয়াছে।

আড়তের টিনের চালা নজরে পড়িতেই যদুবাবুর বুকের মধ্যে কেমন করিয়া উঠিল, জিভ শুকাইয়া আসিল।

পথের ধারে খালের জলে একটা হাঁড়ি-বোঝাই ভড় হইতে লোকজন হাঁড়ি নামাইতেছিল। যদুবাবু লক্ষ করিলেন, অনেকগুলি মাটির তোলোহাঁড়ি ডাঙায় সাজাইয়া এক পাশে রাখিয়া দিয়াছে। একপাশে স্তূপাকার কলিকা। লুঙ্গি-পরা একজন মাঝি আরও কলিকা নামাইতেছে।

যদুবাবু ভাবিলেন, এ হাঁড়িতে আর কি কেউ ভাত রেঁধে খাবে? কলকাতা শহর তো ফাঁকা—এত কল্কেতেই বা তামাক খাবে কে?

তখন একেবারে আড়তের সামনে তিনি পৌঁছিয়া গিয়াছেন।

সামনেই একজন ভদ্রলোক বসিয়া আছেন, বছর পঞ্চাশেক বয়স, মাথায় টাক, রঙ খুব গৌরবর্ণ, গায়ে হাত-কাটা বেনিয়ান। লোকটি গুড়গুড়িতে তামাক খাইতেছিলেন।

যদুবাবু পৈঠা দিয়া উঠিতে উঠিতে হাত তুলিয়া নমস্কার করিয়া বলিলেন, এই যে সীতানাথবাবু, ভালো আছেন?

—এই যে যদুবাবু আসুন—বসুন। তারপর কোথা থেকে? রামনাথ কোথায়?

রামনাথ যদুবাবুর শ্যালক, আজ বছর কয়েক যদুবাবু তাহার কোনো খবর জানেন না; সেও ভগ্নীপতির খবরাখবর রাখে না। কিন্তু সে কথা এস্থলে বলা ঠিক হইবে না। যাহার সুবাদে আড়তের মালিকের সঙ্গে পরিচয়, সে-ই যদি খোঁজখবর না রাখে, তবে ইহার নিকটও যদুবাবুকে কিঞ্চিৎ খেলো হইতে হয় বইকি। সুতরাং তিনি বলিলেন, রামু সেইখানেই আছে। মধ্যে আসবে লিখেছিল, ছুটি পাচ্ছে না—

—সেই জব্বলপুরেই আছে? আছে ভালো?

—হ্যাঁ, তা ভালো আছে।

—আপনাদের স্কুল ছুটি হয়ে যায় নি? আপনি এখনও স্কুলে আছেন তো?

—আছি বইকি! নয়তো কী আর করব বলুন? আপনাদের মতন তো ব্যবসা-বাণিজ্য শিখি নি।

আড়তের মালিক হাসিয়া বলিলেন, আপনাদের তো ভালো, বিছানা-বাক্স বাঁধলেন, কলকাতা থেকে পালালেন, আমাদের কী হয় বলুন তো? গুদামভরা মাল নিয়ে এখন যাই কোথায়? বোমা পড়ে, এখানেই যা হয় হোক। বসুন, চা খাবেন? ওরে, দু পেয়ালা চা করতে বল ঠাকুরকে।

চা খাইয়া এ-কথা ও-কথার পরে যদুবাবু আসল কথাটি উত্থাপন করিবার পূর্বে যথেষ্ট সাহস সঞ্চয় করিয়া লইলেন। তাহার পর শুষ্কমুখে বার-দুই-তিন ঢোঁক গিলিয়া বলিলেন, আপনার কাছে এসেছিলাম সীতানাথবাবু, হাতে বিশেষ কিছু নেই, একেবারেই খালি। কলকাতার বাইরে যেতে হলে কিছু হাতে রাখা দরকার। গোটা কুড়ি টাকা যদি আমাকে ধার দেন এসময় তবে বড়ই উপকার করা হয়, আমি অবিশ্যি যত সত্বর হয়, আপনার ধার শোধ করব, জানুয়ারি মাসের মাইনে থেকে—

চাহিবার ভাষা অবশ্য ইহাই। আড়তদার সীতানাথবাবু স্কুল-মাস্টার নহেন, লোক চরাইয়া খান। টাকা ধার লইলে কেহ স্বেচ্ছায় শোধ দিয়া যায় বাড়ি বহিয়া, ইহা বিশ্বাস করেন না। যদুবাবুর সঙ্গে তেমন ঘনিষ্ঠতাও তাঁহার নাই, এ অবস্থায় যদুবাবু একেবারে কুড়ি টাকা ধার চাওয়াতে কিঞ্চিৎ বিস্মিতও হইয়াছিলেন। বেশ অমায়িকভাবে হাসিয়া, কথার সঙ্গে কিছুমাত্র ডালপালা না জুড়িয়া যথেষ্ট ভদ্রতা ও বিনয়ের সহিত বলিলেন, টাকা হবে না। এ সময় নয়—

যদুবাবু আর কোনো কথা বলিতে পারিলেন না। সীতানাথবাবুর গলার সুরে হৃদ্যতা বা আত্মীয়তার লেশমাত্র নাই। চাঁচাছোলা কেতাদুরস্ত ভাবের ভদ্রতার সুর। শুনিলে ভয় হয়, দ্বিতীয়বার আর যাচ্ঞা করা চলে না। তবুও প্রাণের দায় বড় দায়—কাল সকালে তিনি কলিকাতা হইতে নিষ্ক্রান্ত হইবেনই, যেদিকে দুই চোখ যায়, এখানে লজ্জা করিলে চলিবে না। সুতরাং আবার বলিলেন, তা দেখুন সীতানাথবাবু, একটু দেখুন। হয়ে যাবে এখন। আমার বড্ড দরকার।  কলকাতা থেকে চলে যাবার উপায় নেই, আমাকে একটু সাহায্য করুন—

—হবে না। পারব না। মাপ করুন—

সীতানাথবাবু হাতজোড় করিলেন এমন ভঙ্গিতে, যেন তিনি বিশেষ কোনো অপরাধ করিয়া ফেলিয়াছেন যদুবাবুর কাছে।

তবুও যদুবাবু আবার বলিলেন, তবে না হয় আমায় পনেরোটা কি দশটা টাকা দিন—যা পারেন—আমি যে বড় টানাটানিতে পড়েছি কিনা—জানুয়ারি মাসের মাইনে পেলেই—

সীতানাথবাবু কী ভাবিয়া বলিলেন, পাঁচটা টাকা নিয়ে যান, এসেছেন যখন! ও গোপাল, ক্যাশ থেকে পাঁচটা টাকা দাও তো!

ওদিকে একজন বৃদ্ধ লোক বসিয়া খাতাপত্র লিখিতেছিল, সে বলিল, খাতায় কী লিখব বাবু?

—আমার নিজ নামে হাওলাতে লিখে রাখ। এই নিন—আসুন।

যদুবাবু নমস্কার করিয়া সীতানাথবাবুর আড়ত হইতে নিষ্ক্রান্ত হইলেন। শ্যামবাজারের মোড় পর্যন্ত আর আসিতে পারেন না, রাস্তা পার হইতে পারেন না, ঘুটঘুটে অন্ধকার। ওখানা কী আসে—রিকশা, না মোটর?

আলো চলিয়া আসিতেছে—অন্ধকারের মধ্যে কত জোরে আসিতেছে বোঝা যায় না, ঘাড়ে পড়িবে নাকি?

বাড়ি আসিলেন তখন দশটা রাত্রি।

যদুবাবুর স্ত্রী বলিল, এলে? আমি ভেবে মরি, এত রাত পর্যন্ত এই অন্ধকারে—

—শোন, বিছানা-বাক্স গুছিয়ে নাও—কাল সকালের ট্রেনেই বেরুতে হবে, আর নয় এখানে—

যদুবাবুর স্ত্রী শিহরিয়া উঠিয়া বলিল, ওগো, তুমি মাপ কর। সেখানে আমি যাব না।

যদুবাবু মুখ খিঁচাইয়া বলিলেন, তবে মর গে যাও—যাবে কোথায়! দাঁড়াবার জায়গা আছে কোথায় জিগ্যেস করি? এখানে মর বোমা খেয়ে!

—তা সেও ভালো। অবনী ঠাকুরপোর বউ আর মায়ের খিটিং খিটিং দাঁতের বাদ্যি আমার সহ্য হবে না। তার চেয়ে মরি বোমা খেয়েই মরি।

—তবে মর, যা হয় কর। আমি কিচ্ছু জানি নে—

—তুমি যাও না নিজে। রেখে যাও আমায় এখানে—

আহারাদি করিয়া যদুবাবু মাথায় হাত দিয়া ভাবিতে লাগিলেন। বেড়াবাড়ি যদি না যাওয়া যায়, তবে কোথায় গিয়া উঠিবেন? দিদির বাড়ি? হুগলী জেলার যে পল্লীগ্রামে তাঁহার দিদির বাড়ি, ভগ্নীপতির মৃত্যুর পরে বহুদিন কেন, বহুকাল সেখানে যাওয়া হয় নাই। বাড়িঘরের কী আছে না আছে, তিনি জানেনও না। সেইখানেই অগত্যা যাইতে হয়। মোটের উপর যেখানে হয়, কাল সকালেই পলাইতে হয়। ভাবিবার সময় নাই।

একবার কী একটা শব্দ হইল, যদুবাবু চমকিয়া দাঁড়াইয়া উঠিলেন। এরোপ্লেনের শব্দ, সাইরেন বাজিল নাকি?

পোঁ—ও—ও—ও—

ক্রমশ শব্দটা মাথার উপর আসিতেছে। যদুবাবুর প্লীহা চমকাইয়া গেল। জাপানী প্লেন যে নয়, তাহা কে বলিল? যদুবাবুর স্ত্রী বলিল, এই দেখ একখানা উড়োজাহাজ আলো জ্বালিয়া মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে!

যদুবাবু তাড়াতাড়ি বলিলেন, চুপ চুপ, হ্যারিকেনটা ঘরের মধ্যে নিয়ে যাও—ঘরের মধ্যে নিয়ে যাও—বোমা! বোমা! জাপানী বোমা!

আবার সেই রক্তাক্ত জবাইখানার দৃশ্য তাঁহার চক্ষুর সম্মুখে স্পষ্ট হইয়া উঠিল—রক্ত, চুল, অস্থি, মাংস। স্ত্রীকে বলিলেন, বেঁধে নাও, বিছানা-টিছানা বেঁধে ফেল—কটা বেজেছে দেখ তো, ওখানেই যাব ঠিক করলাম, মঙ্গলাদের দেশে।

আজ রাতটা কি কোনো রকমে কাটিবে না?

সকাল হইতে না হইতে যদুবাবু ঘোড়ার গাড়ির আড্ডায় গাড়ি ভাড়া করিতে গেলেন। হাওড়া স্টেশনে যাইতে কেহ হাঁকিল তিন টাকা, কেহ হাঁকিল সাড়ে তিন টাকা। একজন বলিল, হাওড়ার পুল বন্ধ হয়ে গিয়েছে বাবু, কোনো গাড়ি যেতে দিচ্ছে না—

যদুবাবু চমকিয়া উঠিয়া বলিলেন, কে বললে?

—হামরা সব জানি বাবু।

দুইখানা রিকশা ঠুন ঠুন করিয়া যাইতেছিল। তাহাদের থামাইয়া, বারো আনায় রিকশা ঠিক করিয়া তাহাদের বাসার সামনে আনিলেন। তখনও ভালো করিয়া ভোর হয় নাই। যদি হাওড়ার পুল বন্ধ থাকে, বালি ব্রিজ হইয়া রিকশা ঘুরাইয়া লইবেন—যত টাকা লাগে!  কলিকাতা হইতে বাহির হইতেই হইবে। এ মৃত্যুর ফাঁদ হইতে বাহির হইতে পারিবেন না কি কোনো রকমে? জাপানী বোমা—

জিনিসপত্র রিকশায় বোঝাই দিয়া মলঙ্গা লেন হইতে সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউতে পড়িয়া বউবাজার দিয়া হাওড়ার পুলের দিকে চলিলেন। একটু একটু ফরসা হইয়াছে। পুল নির্বিঘ্নে পার হইয়া গেল, অত ভোরেও দলে দলে ছ্যাকরা গাড়ি, মোটর, রিকশা, ঠ্যালাগাড়ি, মোটমাথায় মুটে, পথচারীর দল চলিয়াছে পুল বাহিয়া। যদুবাবু নিজের চোখকে বিশ্বাস করিতে পারিলেন না, তবে কি পুল পার হইতে পারিয়াছেন সত্যই? বোধ হয় এ-যাত্রা তবে রক্ষা পাইয়া গেলেন!

স্টেশন লোকে লোকারণ্য অত সকালেও। বউ-ঝি, ছেলে-মেয়ে, লটবহর, মুটে,  বিছানা, ধামা, ট্রাঙ্ক, গুড়ের ভাঁড়, তেলের টিন, ছাতালাঠির বান্ডিল, চ্যাঁ-ভ্যাঁ, হৈ-চৈ। টিকিট কাটিতে গিয়া দেখিলেন, টিকিটের জানালা খোলে নাই। অথচ সেখানে সার বাঁধিয়া লোক দাঁড়াইয়া। গেটে ঢুকিবার উপায় নাই, পিষিয়া তালগোল পাকাইয়া কোনো রকমে প্ল্যাটফর্মে ঢুকিলেন। গাড়ির দরজায় চাবি—লোকজন জানালা দিয়া লাফাইয়া ডিঙাইয়া কামরার মধ্যে ঢুকিতেছে। যদুবাবু এক ভদ্রলোককে বলিলেন, মশায়, একটু দয়া করে যদি সাহায্য করেন মেয়েদের।

যদুবাবুর স্ত্রী বসিবার জায়গা পাইলেন, কিন্তু তিনি নিজে অতি কষ্টে দাঁড়াইবার স্থানটুকু পাইলেন। এই সময় যদুবাবুর স্ত্রী বলিলেন, ওগো, সেই ছোট বালতিটা? সেটা সেই টিকিট ঘরের সামনে—সেখানেই পড়ে আছে—

সর্বনাশ! যদুবাবু অমনি ছুটিলেন। আছে, ঠিক আছে। বালতিটা কেহই লয় নাই। ভিড়ের মধ্যে জিনিসপত্র চুরি যায় না। কাছে কাছে সর্বদাই লোক। সকলেই ভাবে, তাহার মধ্যে কাহারও জিনিস।

গেটে পুনরায় ঢুকিবার সময় বেজায় ভিড়। সারি সারি মুটে মোটঘাট মাথায় দাঁড়াইয়া, পিছনে বউ-ঝি, ছেলে-মেয়ে, পুরুষ। গেট আবার বন্ধ করিয়া দিয়াছে। একটু পরে কেন যে হঠাৎ গেট খুলিল, তাহা কেহ বলিতে পারে না। নরনারীর দল ধীর মন্থর গতিতে গেটের দিকে অগ্রসর হইতে লাগিল। একটি অল্পবয়সী বধূ দুই হাতে দুইটি ভারী পোঁটলা ঝুলাইয়া ভিড়ে পিষিয়া যাইতেছে। যদুবাবুর মনে সেবা-প্রবৃত্তি জাগিল। আহা, কতটুকু মেয়ে, এই ভিড় সহ্য করা কি ওদের কাজ? যদুবাবু গিয়া বলিলেন, মা, আপনার পুঁটুলিটা দিন আমার হাতে—

বউটিকে সামনে দিয়া হাত দিয়া প্রায় বেড়িয়া ভিড়ের সংস্পর্শে হইতে বাঁচাইয়া, তাহাকে গেট পার করিয়া দিলেন। বউটির সঙ্গে উনিশ-কুড়ি বছরের ছোকরা, তাহার দুই হাতে দুইটি ভারী ট্রাঙ্ক। সে যদুবাবুকে বলিল, স্যার, আপনি কোন গাড়িতে যাবেন? শেওড়াফুলি? তা হলে এক গাড়িতেই—

যদুবাবু বধূটিকে অনেক কষ্টে স্ত্রীর পাশে একটু জায়গা করিয়া বসাইয়া দিলেন। ট্রেন ছাড়িল।

পুনর্জন্ম।

যদুবাবু হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচিলেন। জাপানী বোমার পাল্লা হুগলী জেলা পর্যন্ত পৌঁছিবে না।

.

ক্ষেত্রবাবু শেষ পর্যন্ত আসসিংড়ি গ্রামে যাওয়াই স্থির করিলেন। প্রায় আজ দশ বছর পরে যাওয়া। বহু কষ্টে ভিড়, অসুবিধা, অতিরিক্ত খরচ, ধাক্কাধুক্কি সহ্য করিয়া গ্রামে আসিয়া পৌঁছিলেন সন্ধ্যার কিছু আগে। গিয়া দেখিলেন, পৈতৃক বাড়ির পশ্চিম দিকের কুঠুরিতে গ্রামের এক গরিব গৃহস্থ আশ্রয় লইয়াছে, তাহারা জাতিতে কৈবর্ত। তাহারা মনের আনন্দে গাছের ডাব ইঁচড় ইত্যাদি খাইতেছে, বাঁশঝাড়ের বাঁশ কাটাইতেছে। উঠানে প্রকাণ্ড তরিতরকারির ক্ষেত করিয়াছে। কোনকালে কেহ আসিয়া এ-সব কাজের কৈফিয়ত চাহিবে, তাহারা কোনোদিনও ভাবে নাই। হঠাৎ সন্ধ্যাবেলা বাড়ির মালিকের আকস্মিক আবির্ভাবে তাহারা সন্ত্রস্ত তটস্থ হইয়া পড়িল।

ক্ষেত্রবাবু বলিলেন, কে হে! ও, পাঁচু না? তোমরাই আছ?

পাঁচু হাত কচলাইয়া বলিল, আজ্ঞে আমরাই। বাড়িঘর সেবার পড়ে গেল ঝড়ে, তা বলি বাবুর বাড়ি পড়ে রয়েছে, তাই আমরা—

—আছ, ভালোই। বাপের ভিটেতে সন্ধে পড়ছে। তা ওদিকে অত জঙ্গল করে রেখেছ কেন? নিজেরাই থাক, একটু ভালো করে রাখলে পার। ওদিকের ঘরগুলো ভালো আছে?

—না বাবু। ওই একখানা ঘর ভালো ছিল, আমরাই থাকি। ওদিকের ঘরের ছাদ দিয়ে জল পড়ে।

—যাই হোক, এখন রাত্তিরটা থাকার ব্যবস্থা কী করা যায়?

—ওদিকের ঘর দুটো পরিষ্কার করে দিই বাবুকে। এখন আসুন।

সেই ভাঙা ঘরের স্যাঁতসেতে মেঝেতে জিনিসপত্র স্ত্রীপুত্র লইয়া ক্ষেত্রবাবু সেই সন্ধ্যা হইতে অধিষ্ঠিত হইলেন। অনিলার আদৌ ইচ্ছা ছিল না এখানে আসিবার। শুধু টাকাপয়সার অভাবে গ্রামে আসিতে বাধ্য হইতে হইয়াছে।

অনিলা বলে, সাপখোপ কামড়াবে নাকি! মেঝের ওপর শোয়া—তোমার এখানে তক্তপোশ নেই?

—ছিল—সবই। আজ দশ বছর আসি নি, লোকে চুরিই করুক বা উইয়েই খাক—

.

পাঁচ-ছয় দিন কাটিয়া গেল।

গ্রামে আসিয়া নূতন জীবন শুরু হইয়াছে ক্ষেত্রবাবুর। সকালে উঠিয়া জেলেপাড়া হইতে মাছ সংগ্রহ করিয়া আনেন, বন-বাগান হইতে এঁচড় ডুমুর পাড়িয়া আনেন, কয়লা পাওয়া যায় না—সুতরাং কাঠ কুড়াইয়া আনেন। সকালে সাড়ে নয়টায় খাওয়ার পরিবর্তে বেলা বারোটায় খান।

অনিলা বলে, প্রাণ গেল বাপু, একটু কথা বলি কার সঙ্গে, এমন লোক খুঁজে মেলা দুর্ঘট!

—কেন, কাকাদের বাড়ি যাও, দত্তদের বাড়ি যাও—

—কী যাব, কেউ কথা বলতে পারে না। শুধু গেঁয়ো কথা—কী রাঁধলে ভাই? কতক্ষণ রান্নার কথা বলা যায় বল তো? এর চেয়ে ডিহিরি গেলে খুব ভালো হত। শুনলে না আমার কথা!

শীঘ্রই কিন্তু এ অভাব দূর হইল।

গ্রামের একটা বাড়িতে  কলিকাতা হইতে একঘর গৃহস্থ আসিল। ক্ষেত্রবাবুর মত তাহারাও এই গ্রামের বাসিন্দা, কলিকাতায় বাড়ি আছে, বড়বাজারে মশলার ব্যবসা করিয়া বেশ সঙ্গতিপন্ন অবস্থা। তাহারা সঙ্গে করিয়া আনিয়াছে আরও দুই ঘর বোমা-ভীত-পরিবার। শেষোক্ত দলের একটি পরিবারের থাকিবার স্থান নাই, পূর্বোক্ত গৃহস্থের প্রাচীন ঠাকুরদালানে দরমার বেড়া দিয়া আবরু সৃষ্টি করিয়া এক ঘর সেখানে রহিল। অপর পরিবারের জন্য গ্রামে ঘর খুঁজিয়া মিলিল না। সকলেই গরিব, কোঠাবাড়ি বেশি নাই—যাহা দুই-একখানা আছে, তাহাতে মালিকদের নিজেদেরই কুলায় না।

ক্ষেত্রবাবুর কাছে লোক আসিয়া বলিল, আপনার একখানা ঘর ভাড়া দেবেন?

ক্ষেত্রবাবু অবাক হইলেন। গ্রামের ভাঙা কুঠুরি কেহ ভাড়া লইবে, একথা কে কবে শুনিয়াছে? ভরসা করিয়া বলিলেন, তা দিতে পারি—

—কী নেবেন?

ক্ষেত্রবাবু ভাবিয়া বলিলেন, তিন টাকা।

লোকটি এই গ্রামেরই লোক। বলিল, তিন টাকা কেন? পনেরো টাকা হাঁকুন না, তাই দেবে।

ক্ষেত্রবাবু বিস্মিত হইয়া বলিলেন, পনেরো টাকা বাড়িভাড়া কে দেবে? এই ভাঙা বাড়ির একখানা ঘরের ভাড়া তিন টাকা, তা-ই বেশি। পাগল!

—আপনি জানেন না, ওরা টাকার আণ্ডিল, কারে না পড়লে কি করতে এসেছে এই পাড়াগাঁয়ে? ঠিক দেবে, নইলে বাড়ি পাচ্ছে কোথায়?

ক্ষেত্রবাবু হাজার হোক স্কুল-মাস্টার, অত ব্যবসাবুদ্ধি মাথায় খেলিলে আজ সতেরো-আঠারো বছর ক্লার্কওয়েল সাহেবের স্কুলে পঁয়ত্রিশ টাকা বেতনে মাস্টারি করিবেন কেন? তিনি স্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করিতে গেলেন। অনিলা বলিল, সে কী গো, ওই ঘর আবার ভাড়া! ওর আছে কী যে ভাড়া দেবে? তারা বিপদে পড়ে এসেছে, ওই ভাঙা দুটো ঘরে থাকতে চাইছে, এতেই বোঝ। এমনি থাকতে দাও, কথা বলবার মানুষ পাওয়া যাচ্ছে এক ঘর, এই না কত!

ক্ষেত্রবাবু ক্ষীণ সুরে বলিলেন, তিনটে টাকা দিতে চাচ্ছে—আর বাড়াচ্ছি নে অবিশ্যি। দিক তিনটে টাকা—নিই।

—নাও গে যাও, কিন্তু আর এক পয়সা বেশি বোল না।

পরদিন ক্ষেত্রবাবুর ভাঙা ঘরে ভাড়াটেরা আসিয়া গেল—একটি বধূ, তিন ছেলেমেয়ে, প্রৌঢ়া ননদ। শোনা গেল, বধূটির স্বামী কাজ করে ইছাপুরে বন্দুকের কারখানায়। ছুটি পাইলেই একবার আসিয়া দেখিয়া যাইবে। অনিলা বধূটির সঙ্গে খুব ভাব করিয়া ফেলিল, তার নাম কুসুমকুমারী, বাপের বাড়ি বাগবাজার—বৃন্দাবন মল্লিকের গলি। কলিকাতা ছাড়িয়া বাহিরে আসা এই প্রথম, বিশেষ করিয়া আসসিংড়ির মত অজ পল্লীগ্রামে। প্রত্যেক কাজেই অসুবিধা, না আছে দেওয়াল টিপিলেই আলো, কল টিপিলেই জল, না আছে ভালো রাস্তাঘাট, না আছে একটা টকি-বায়স্কোপ।

তবুও দিন যায় কায়ক্লেশে। মেয়েছেলে, কেহ নিজের বাপেরবাড়ি শ্বশুরবাড়িকে অপর মেয়ের কাছে ছোট হইতে দিতে চায় না। কুসুম বাগবাজারের গল্প করে তো অনিলা ডিহিরি-অন-সোনের গল্পে তাহাকে ছাড়াইয়া যাইতে চায়।

শীত কাটিয়া বসন্ত পড়িল। ক্ষেত্রবাবুর মনে পড়িল, আমের বউলের গন্ধ কতদিন এমন পান নাই, বাঁশবন, মাঠে ঘেঁটুফুল ফোটার দৃশ্য কতকাল দেখেন নাই। বহুদিন পূর্বের বিস্মৃত শৈশবকালের স্মৃতি অতীত মাধুর্যে মণ্ডিত হইয়া শৈশবের মাতাপিতার কত হাসি ও কথার টুকরা ভুলিয়া-যাওয়া স্নেহস্বর লইয়া মনের মধ্যে উঁকি মারে।

.

হাতের পয়সা ফুরাইয়া গেল। অনিলা পিতৃগৃহ হইতে আসিবার সময় লুকাইয়া সামান্য কিছু অর্থ আনিয়াছিল, তাহা দিয়াই এতদিন চলিল, নতুবা ক্ষেত্রবাবু স্কুল হইতে বিশেষ কিছু আনেন নাই। ক্লার্কওয়েল সাহেবের স্কুল আর খোলে নাই, আঠারোই ডিসেম্বরের পরে কলিকাতার কোনো স্কুলই খুলে নাই—ক্ষেত্রবাবু স্কুল হইতে পত্র পাইয়া জানিয়াছেন, খবরের কাগজেও দেখিয়াছেন।

স্কুল কি উঠিয়া গেল! হেডমাস্টারের নামে দুই-তিনখানা পত্র দিয়াও উত্তর না পাওয়াতে বৈশাখ মাসের প্রথমে ক্ষেত্রবাবু নিজেই কলিকাতা গেলেন। সে কলিকাতা আর নাই, রাস্তা দিয়া কত কম লোকজন চলিতেছে, তেল বন্ধ হওয়ার দরুন মোটরগাড়ির সংখ্যা বহু কমিয়া গিয়াছে, রাত আটটার পর ঘুটঘুটে অন্ধকার!

পিটার লেনের মোড়ে ক্লার্কওয়েল সাহেবের স্কুল-বাড়িটার আর সে শ্রীছাঁদ নাই। গেট ভিতর হইতে ভেজানো ছিল। ঢুকিয়া ক্ষেত্রবাবু ডাকিলেন, ও মথুরা—মথুরা!

নীচের তলার ঘর হইতে কেবলরাম বাহির হইয়া আসিল। ক্ষেত্রবাবুকে দেখিয়া তাড়াতাড়ি দুই হাত জোড় করিয়া মাথা নিচু করিয়া বলিল, কেমন আছেন বাবু?

ক্ষেত্রবাবু বলিলেন, ও কেবলরাম, সাহেব কোথায়?

কেবলরাম হতাশার সুরে দুই হাত তুলিয়া বলিল, তিনি  কলকাতায় নেই। নাগপুরে গেছেন। আমার মাইনে চুকিয়ে দিয়ে গেলেন যাবার সময়।

—স্কুল!

—উঠে গিয়েছে বাবু।

—তবে তোকে মাইনে দিচ্ছে কে এখানে?

—হেডমাস্টার বললেন, তুই এখানে থাক। চিঠিপত্র এলে তাঁর নামে পাঠাতে বলে দিয়েছেন। যদি এর পরে স্কুল চলে—কিন্তু তা চলবে না বাবু, বাড়িওলার পাঁচ মাসের ভাড়া বাকি, শুনছি নাকি নোটিশ দিয়েছে।

—ছেলেপিলে কেউ আসে না?

—কে আসবে বাবু, কে আছে কলকাতায়? ওই পাশের গলির কেষ্ট আসে, আর আসে শিবরাম—ওই কুণ্ডু লেনের বাবুদের বাড়ির সেই দুষ্টু ছেলেটা। ওরা এসে খোঁজ নেয়, কবে স্কুল খুলবে। আমি বলি—যাও ছেলেরা, স্কুল যদি খোলে, খবর পাবে।

—মাস্টারেরা?

—কেবল হেডপণ্ডিত এসেছিলেন সাহেবের ঠিকানা নিতে। আর শ্রীশবাবু এসেছিলেন টাকার কী হল জানতে। আর কেউ আসে না। শ্রীশবাবু ঢাকায় চাকরি পেয়েছেন, জ্যোতির্বিনোদ মশাই দেশেরই স্কুলে চাকরি নিয়েছেন।

—নাগপুরে সাহেব কী করছেন জান? তাঁর ঠিকানা কী?

—তিনি কী করছেন তা জানি নে। ঠিকানা নিয়ে যান, আমার কাছে সেদিনও চিঠি দিয়েছেন।

ক্ষেত্রবাবু ঠিকানা লইয়া বিষণ্ণ মনে স্কুল হইতে বাহির হইলেন। আজ সতেরো বৎসরের কত সুখ-দুঃখের লীলাভূমি, কত ছেলে এই দীর্ঘ সতেরো বছরে আসিয়াছে গিয়াছে, কত অস্পষ্ট কাঁচা উৎসুক মুখ মনে পড়ে এখানকার মাটিতে আসিয়া দাঁড়াইলে। মুখই মনে পড়ে, মুখের অধিকারীর নাম মনে পড়ে না। ক্লার্কওয়েল সাহেব, যদুবাবু, জ্যোতির্বিনোদ, মিঃ আলম—আজ সকলের সঙ্গেই আর একবার দেখা করিতে ইচ্ছা হয়; কিন্তু কে কোথায় আজ ছত্রভঙ্গ হইয়া গিয়াছে।

পুরনো  চায়ের দোকানটিতে ঢুকিয়া ক্ষেত্রবাবু বলিলেন, ওহে, চা দাও এক পেয়ালা।

দোকানী দেখিয়া ছুটিয়া আসিল : মাস্টারবাবু যে! আসুন, আসুন। ভালো সব?

—ভালো। তোমাদের সব ভালো?

—আর কী করে ভালো হবে বাবু! আপনারা সব চলে গেলেন, তিন-তিনটে স্কুল আছে, সব বন্ধ। বিক্রি-সিক্রি নেই, দোকান চলে কী করে বলুন?

ক্ষেত্রবাবু বসিয়া বসিয়া আপনমনে চা খাইতে লাগিলেন। কোথায় গেল সে পুরনো দিন! ওইখানটাতে বসিত জ্যোতির্বিনোদ, এখানটাতে রামেন্দুবাবু, ক্ষেত্রবাবু পাশে সব সময়েই বসিত যদুদা, আর ওই হাতলহীন চেয়ারটা ছিল নারাণদার (আহা বেচারি! ভালোই হইয়াছে স্বর্গে গিয়াছে, স্কুলের এ দুর্দশায় বেচারির প্রাণে বড়ই কষ্ট হইত।) বাঁধা-ধরা আসন। এখানে বসিয়া দুঃখের মধ্যেও কত আনন্দ, কত মজলিশ করা গিয়াছে। গত দশ-বারো চৌদ্দ বছর। আজ কেউ নাই কোনো দিকে। সব ছত্রভঙ্গ।

স্কুল আর বসিবে না। কলিকাতার সব স্কুল যদিও দুই পাঁচ মাস পরে খোলে, তাঁহাদের স্কুল আর বসিবে না। বসিতে পারে না—আর্থিক অবস্থা খারাপ। বাড়িওয়ালা আর মাসখানেক দেখিয়া ‘টু লেট’ ঝুলাইয়া দিবে। মাস্টারেরা পেটের ধান্ধায় যে যেখানে পারিয়াছে, চাকুরিতে ঢুকিয়া পড়িয়াছে, নয়তো তাঁর মত সুদূর পল্লীগ্রামে আত্মগোপন করিয়াছে।

ক্লার্কওয়েল সাহেবের মত একনিষ্ঠ শিক্ষাব্রতীর আজ কী দুরবস্থা, তাহার খবর কে রাখে?

—ক’ পয়সা?

—মাস্টারবাবু, আপনাদের খেয়েই মানুষ। এতদিন পরে পায়ের ধুলো দিলেন—এক পেয়ালা চা খেয়েছেন, ওর আর কী দাম নেব? না মাস্টারবাবু, মাপ করবেন।

—আচ্ছা, আমাদের স্কুলের আর কোনো মাস্টার যদি এখানে চা খেতে আসে, তবে আমার কথা বোল তাকে, কেমন তো? মনে থাকবে? আমার নাম ক্ষেত্রবাবু। বোল—আমি তাদের কথা ভুলি নি, কেমন তো?

চায়ের দোকান হইতে বাহির হইয়া দুই-একটি টুইশানির ছাত্রদের বাড়ি গেলেন। বাড়ি তালাবন্ধ। মেয়েছেলে নাই, ভাবে মনে হইল। পুরুষেরা যদি বা থাকে, কর্মস্থল হইতে সকাল সকাল ফিরিবার তাগিদ নাই। ক্ষেত্রবাবু অন্যমনস্কভাবে পথ চলিতে লাগিলেন। ধর্মতলার কাছাকাছি আসিলে একটি তরুণ যুবক আসিয়া খপ করিয়া তাঁহার পায়ের উপর পড়িয়া ধূলা লইয়া প্রণাম করিয়া হাসিমুখে বলিল, স্যার, ভালো আছেন? চিনতে পারেন?

—হ্যাঁ, রাজেন দেখচি যে! তা আর চিনতে পারব না? তুই কাদের সঙ্গে যেন পাস করিস, কোন বছর?

—বছর পাঁচ হয়ে গেল স্যার। মনে রেখেছেন, এই যথেষ্ট। আমি শিবুদের ব্যাচে পাস করি। শিবুকে মনে আছে? শিবনাথ ভটচাজ্জি—ক্ষীরোদ ডাক্তারের ছেলে।

ক্ষেত্রবাবু ভালো মনে করিতে পারিলেন না; কিন্তু বলিলেন, হ্যাঁ, মনে পড়েছে। কী করচিস?

—এ. আর. পি.-তে ঢুকেছি স্যার। বেকার বসেছিলাম আজ অনেক দিন। এবার—

—বেশ, বেশ। আচ্ছা, চলি।

সন্ধ্যার দেরি নাই। আবার সেই ব্ল্যাক-আউটের কলিকাতা। আর কলিকাতায় থাকিয়া লাভ নাই। রাত সাড়ে আটটায় গাড়ি আছে শিয়ালদহে। ছেলেদের জন্য কিছু সস্তার বিস্কুট ও লেবেঞ্চুস কিনিয়া সন্ধ্যার পূর্বেই ক্ষেত্রবাবু স্টেশনে আসিয়া জমিলেন।

.

যদুবাবু আজ মাস দুই শয্যাগত।

হাওড়া জেলার যে পল্লীগ্রামে তিনি গিয়াছিলেন, সেখানে গিয়া দেখিলেন, ভগ্নীপতির ঘরবাড়ির অবস্থা যা, তাহাতে সেখানে মানুষের বাস করা চলে না। তবুও থাকিতে হইল, কী করিবেন—অভাব। কিন্তু মাসখানেক পরে যদুবাবুর ম্যালেরিয়া ধরিল। অর্থের অভাব, তদুপরি থাকিবার কষ্ট—এ গ্রামে আত্মীয়বন্ধু কেহ নাই, হাতেও নাই পয়সা।

গ্রামের নাম কমলাপুর, তারকেশ্বর লাইন হইয়া যাইতে হয়—শেওড়াফুলি হইতে পাঁচ-ছয় ক্রোশ দূরে। গ্রামের ভদ্রলোকেরা সকলেই ডেলি-প্যাসেঞ্জার, সকালে কেহ আটটা চল্লিশ, কেহ নয়টা দশের ট্রেন ধরিয়া কলিকাতায় ছোটে, আবার ঝাড়নে বাজারহাট বাঁধিয়া বাড়ি ফেরে। যেটুকু গল্পগুজব করে—হয় আপিস, নয়তো ফুটবল, আজকাল অবশ্য যুদ্ধের গল্প।

পাশেই অবিনাশ বাঁড়ুজ্জের বাড়ি।  কলিকাতা হইতে রাত নয়টার সময় প্রৌঢ় ভদ্রলোক বাড়ি ফিরিলে যদুবাবু উদ্বেগের সুরে জিজ্ঞাসা করেন, আজ যুদ্ধের খবর কী অবিনাশবাবু?

অবিনাশবাবু যুদ্ধের আলোচনা করিতে বসেন। তোজো বা ওয়াভেল বা চার্চিল যাহা না ভাবিয়াছেন, অবিনাশবাবু তাহা ভাবিয়া বুঝিয়া বিজ্ঞ হইয়া বসিয়া আছেন। সিঙ্গাপুর বা ব্রহ্মদেশ কী করিলে রক্ষা পাইতে পারিত, ব্রিটিশের কী ভুল হইল, কোন পথ ধরিয়া কী ভাবে যুদ্ধ করিলে আপার বর্মা এখনও রক্ষা হয়—এসব কথা অবিনাশবাবু খুব ভালোই জানেন। কলিকাতায় দিন পনেরোর মধ্যে বোমা পড়িবে, এ বিষয়ে তিনি নিঃসন্দেহ। বোমারু বিমানের আক্রমণের চিত্র তাঁহার মত কেহ আঁকিতে পারে না।

শুনিয়া শুনিয়া যদুবাবুর কী হইয়াছে, আজকাল তিনি যেন সর্বদাই সশঙ্ক।

একদিন রাত্রে আহার করিতে বসিয়া হঠাৎ উৎকর্ণ হইয়া শুনিলেন, এরোপ্লেনের শব্দের মত একটা শব্দ না?

স্ত্রীকে বলিলেন, দাঁড়াও, ও কিসের শব্দ গো?

—কই?

—ওই যে শোন না—আলো সরাও, আলো ঘরে নিয়ে যাও, ঘরে নিয়ে যাও। জাপানী প্লেন হতে পারে—

—তোমার হল কী? ও তো গুবরে পোকা উড়ছে  জানালার বাইরে।

—না না, গুবরে পোকা কে বললে? দেখে এস আগে—দুধ দিতে হবে না, আগে দেখে এস—

যদুবাবুর স্ত্রী ঝাঁটার আগায় পোকাটাকে উঠানে ফেলিয়া দিয়া বলিল, জাপানী এরোপ্লেন ঝাঁট দিয়ে তফাত করে রেখে এলাম গো। এখন নিশ্চিন্দি হয়ে বসে দুধ দিয়ে ভাত দুটি খাও। এক চাকলা আম দিই!

সংসারের বড় কষ্ট, অথচ ভয়ে যদুবাবু কলিকাতায় গিয়া স্কুলে প্রভিডেন্ট ফণ্ডের টাকার খোঁজখবর করিতে পারেন না। স্কুলে চিঠি লিখিয়াও জবাব পাইলেন না। ম্যালিরিয়াপ্রধান স্থান, শরীরের মধ্যে অসুখ ঢুকিল—প্রায়ই অসুখে ভোগেন। অথচ ঔষধ নাই, পথ্য নাই। থাকিবারও খুব কষ্ট।

যদুবাবু বলেন, এর চেয়ে বেড়াবাড়ি ছিল ভালো।

যদুবাবুর স্ত্রী বলে, সেখানেও যে সুখ তা নয়, তবে তুমি সঙ্গে থাকলে আমি বনেও থাকতে পারি। সেবার তুমি আমায় ফেলে রেখে এলে একা—কী করে থাকি বল তো?

যদুবাবু বলেন, তুমি অবনীর দিদিকে একখানা চিঠি লেখো। আম-কাঁঠালের সময় আসছে, চল যাই। কতকাল বেড়াবাড়ি বাস করি নি। আসল কথা কী জান, কলকাতা ছাড়া কোনো জায়গায় মন টেঁকে না। কথা বলবার মানুষ নেই—আমার যে সব বন্ধু ছিল কলকাতায়, তাদের কেউ পোস্ট-মাস্টার, কেউ মার্চেন্ট অফিসের বড় কেরানি, দু’শো টাকার কম মাইনে নয়। স্কুল-মাস্টারকে সবাই খাতির করত। শিক্ষিত লোক শিক্ষিত লোকের মর্ম বোঝে।

—কেন, ওই অবিনাশবাবু—উনিও তো ভালো চাকরি করেন!

—ওই অবিনাশটা? আরে রামোঃ, রেল-আপিসে কাজ করে, সেকালের এন্ট্রাস পাস—ওর দরের লোকের সঙ্গে কি আমাদের বনে? ওই দেখ না কেন, দুটো ছেলে রয়েচে, আমি তার বাড়ির পাশে একজন কলকাতার বড় স্কুলের মাস্টার, পড়া না কেন টুইশানি? দে না দশটা টাকা মাসে? এমন পাবি কোথায় তোদের এই পাড়াগাঁয়ে? পেটে বিদ্যে থাকলে তবে তো! রেল-আপিসের কেরানি আর কত ভালো হবে!

অবনীর দিদিকে চিঠি লেখা হইল, কিন্তু কোনো উত্তর পাওয়া গেল না। ইতিমধ্যে যদুবাবু একদিন হঠাৎ জ্বর হইয়া অজ্ঞান হইয়া পড়িলেন। যদুবাবুর স্ত্রী গিয়া অবিনাশবাবুর স্ত্রীর কাছে কাঁদিয়া পড়িলেন। অবিনাশবাবু তখন অফিস হইতে ফেরেন নাই, তাঁহার চাকর পাঠাইয়া পাশের গ্রামের ভূষণ ডাক্তারকে ডাকাইয়া আনিলেন। ভূষণ ডাক্তার আসিয়া রোগী দেখিয়া বলিলেন, মাথায় হঠাৎ রক্ত উঠিয়া এমন হইয়াছে। খুব সাবধানে থাকা দরকার। চিকিৎসাপত্র করিয়া কথঞ্চিৎ সুস্থ করিতে যদুবাবুর স্ত্রীকে শেষ সম্বল হাতের রুলি বিক্রয় করিতে হইল।

এই সময় হঠাৎ একদিন অবনী আসিয়া হাজির। সে একটা পুঁটলি হইতে গোটাকয়েক কমলালেবু ও পোয়াটাক মিছরি যদুবাবুর বিছানার এক পাশে রাখিয়া একগাল হাসিয়া বলিল, নিতে এসেছি দাদা, চলুন। বউদিদি দিদিকে পত্র লিখেছিলেন আপনার অসুখের খবর দিয়ে। দিদি বললেন—যাও ওদের গিয়ে এখানে নিয়ে এস।

যদুবাবু মিনতির সুরে বলিলেন, তাই নিয়ে চল ভায়া, এখানে আমার মন টেঁকে না।

—বউদিদি কই?

—বোধ হয় ঘাটে গিয়েছে। বোস, আসছে এখুনি।

অবনীকে দেখিয়া যদুবাবু যেন হাতে স্বর্গ পাইলেন। নির্বান্ধব স্থানে তবুও একজন দেশের লোক, জ্ঞাতির সান্নিধ্যলাভ কম কথা নয়!

অবনী ইহাদের সঙ্গে করিয়া বেড়াবাড়ি আনিয়া ফেলিল। যে ঘরে পূর্বে যদুবাবুর স্ত্রীর স্থান হইয়াছিল, সেই ঘরখানাতেই এবারও যদুবাবুরা আসিয়া উঠিলেন। ঘরখানা সেই রকমই আছে, বরং আরও খারাপ, আরও স্যাঁতসেঁতে। দেওয়ালে নোনা লাগার ছোপ আরও পরিস্ফুট হইয়াছে।

গ্রামে ডাক্তার নাই, আশপাশের ষোলখানা গ্রামের মধ্যে কুত্রাপি ডাক্তার নাই, দুই-একজন হাতুড়ে বদ্যি ছাড়া। তাহাদেরই একজন আসিয়া যদুবাবুকে দেখিল। পুরাতন জ্বরে ভাত খাওয়ার পরামর্শ দিল। বলিল, নাতি-খাতি সেরে যাবে অখন, ও গরম হয়েছে, গরমের দরুন অসুখডা সারচে না।

রুলি বিক্রয়ের টাকা ফুরাইয়া আসিতেছে দেখিয়া যদুবাবুর স্ত্রী স্বামীকে বলিল, হ্যাঁগো, কাল তো ওরা বলছিল—এক মণ চাল কিনতে হবে, অবনীর হাতে এখন টাকা নেই, তা তোমার ইয়েকে একবার বল। আমি তোমাকে আর কী বলব, সব বিদ্যে তো জানি। এক মণ চালের দাম দিতে গেলে তোমার ওষুধপথ্যির পয়সা থাকে না। অথচ ওদের হাঁড়িতে খাওয়াদাওয়া, না দিলেও তো মান থাকে না। কী করি?

যদুবাবু বিরক্তির সুরে বলিলেন, তোমাদের কেবল পয়সা আর পয়সা, একটা লোক শুষছে  বিছানায়—জানি নে ও-সব, যাও এখান থেকে—

যদুবাবুর স্ত্রীর আর কোনো গহনাপত্র নাই, স্বামী বিশেষ কিছু দেন নাই, বরং বাপের বাড়ি হইতে আনীত যাহা কিছু ধূলাগুঁড়ো ছিল, তাহাও স্বামী ফুঁকিয়া দিয়াছেন অনেকদিন পূর্বে।

এখন উপায়? ভাবিয়া-চিন্তিয়া বিবাহের সময় শ্বশুরের দেওয়া বেনারসী শাড়িখানা লুকাইয়া গ্রামের মধ্যে অবস্থাপন্ন রায়বাড়ির গিন্নির কাছে লইয়া গেল।

রায়বাড়ির গিন্নি বলিলেন, এস এস ভাই। কবে এলে? শুনলাম নাকি ঠাকুরপোর বড্ড অসুখ?

যদুবাবুর স্ত্রী কাঁদিয়া বলিল, সেই জন্যেই আসা।  কলকাতার স্কুল উঠে গিয়েছে, হাতে এক পয়সা নেই, অথচ ওঁর অসুখ। আমার এই ফুলশয্যের বেনারসীখানা বিক্রি করে দিন। নইলে উপায় নেই। এই দেখুন ভালো কাপড়, এখনও নষ্ট হয় নি—এক জায়গায় কেবল একটু পোকায় কেটেচে—

রায়গিন্নির অবস্থা ভালো। দুই ছেলে চাকুরি করে, জমিজমাও আছে। বাড়ির কর্তা আগে কোর্টের নাজির ছিলেন—সেকালের নাজির, দুই পয়সা উপার্জন করিয়াছিলেন। একটি মেয়ে বিধবা, বাপের বাড়ি থাকে, কিন্তু তাহার শ্বশুরবাড়ির অবস্থা ভালোই—স্ত্রীধন হিসাবে কিছু কোম্পানির কাগজও আছে।

রায়গিন্নি বলিলেন, ফুলশয্যের বেনারসী কেন বিক্রি করবে ভাই? দু-পাঁচ টাকা দরকার থাকে, নিয়ে যাও। আবার যখন তোমার হাতে আসবে দিয়ে যেয়ো।

যদুবাবুর স্ত্রী বলিল, না, আপনি একেবারে বিক্রি করিয়েই দিন। ধার করলে একদিন শোধ দিতে হবে, তখন কোথায় পাব?

স্ত্রীর মুখে এ কথা শুনিয়া যদুবাবু চটিয়া গেলেন। বলিলেন, ধার দিতে চাচ্ছিল, নিলেই হত। কাপড়খানা থাকত, টাকাও চার-পাঁচটা আসত। কাপড়খানা ঘুচিয়ে দিয়ে এলে? এমন পাথুরে বোকা নিয়ে কি সংসার করা চলে?

যদুবাবুর স্ত্রী কোনো প্রতিবাদ করিল না। অবুঝ স্বামী, রোগ হইয়া আরও অবুঝ হইয়া গিয়াছে। তাহাকে মিষ্টি কথায় ভুলাইয়া রাখিতে হইবে, ছেলেমানুষকে যেমন লোকে ভোলোয়। টাকাকড়ির বিষয়ে মানুষের সঙ্গে সোজাসুজি ব্যবহার ভালো। ফাঁকি দিয়া, ঠকাইয়া কতদিন চলে? স্বামীকে সে কথা বোঝানো শক্ত।

এদিকে অবনীদের ধারণা, যদুবাবু প্রভিডেন্ট ফন্ডের মোটা টাকা আনিয়াছেন সঙ্গে। স্বামী স্ত্রী লইয়া সংসার, এতদিন কলিকাতায় চাকরি করিয়াও দুই-পাঁচ হাজার বা ব্যাঙ্কে কোন না জমাইয়া থাকিবেন? বাইরের লোকের সামনে অবনী বলে, দাদার হাতে পয়সা আছে। গভীর জলের মাছ, এ কি আর তুমি আমি?

যদুবাবুকে বলে, দাদা, টাকা ব্যাঙ্কে রাখা ভালো না, যে বাজার!

যদুবাবু বলেন, তা তো বটেই।

—তা আপনি যদি রেখে এসে থাকেন ব্যাঙ্কে, একদিন না হয় আমিই যাই—চেক লিখে দিন, টাকাটা উঠিয়ে আনি।

যদুবাবু ভাঙেন তবু মচকান না। ব্যাঙ্কের ত্রিসীমানা দিয়া যে তিনি কস্মিনকালে হাঁটেন নাই, অবনীকে এই সোজা কথাটা বলিলেই হাঙ্গামা চুকিয়া যায়; কিন্তু তা তিনি বলিলেন না। এমন ভাবে কথা বলিলেন, যাহাতে অবনীর দৃঢ় বিশ্বাস জন্মিল, দাদার অনেক টাকা কলিকাতার ব্যাঙ্কে মজুত।

সেই দিন হইতে উহাদের দিক হইতে নানা ধরনের তাগিদ আসিতে লাগিল। আজ অবনীর মেয়ে উমার কাপড় নাই, কাল কাছারির খাজনা না দিলে মান থাকে না, পরশু অবনীর নিজের জুতা এমন ছিঁড়িয়াছে যে একজোড়া নতুন জুতা ভিন্ন ভদ্রসমাজে সে মুখ দেখাইতে পারিতেছে না। তা ছাড়া সংসারের বাজার-খরচের প্রায় সমুদায় ভার পড়িল যদুবাবুদের অর্থাৎ যদুবাবুর স্ত্রীর উপর। ফলে বেনারসী শাড়ি বিক্রির পঁচিশ টাকা, দিন-কুড়ির মধ্যেই কয়েক আনা পয়সায় আসিয়া দাঁড়াইল।

যদুবাবুর স্ত্রী জানে, স্বামীর কাছে কিছু চাওয়া ভুল। তোরঙ্গের তলার একটা সিঁদুরের কৌটার মধ্যে বহুকালের দুল ভাঙা, নথের টুকরা, এক কুচি চুড়ির গুঁড়া, দুই-চারিটা সিঁদুরমাখানো লক্ষ্মীর টাকা ইত্যাদি ছিল, সব গৃহিণীই এগুলি লুকাইয়া কুড়াইয়া রাখিয়া দেন, যদুবাবুর স্ত্রীও তাহা করিয়াছিল। কতকালের স্মৃতি-জড়ানো এই অতিপ্রিয় দ্রব্যগুলির দিকে চাহিয়া তাহার চোখে জল আসিল। শেষ সম্বল সোনার কুচি—লোকে কথায় বলে। সত্যিই সেই শেষ সম্বলটুকুও কি হাতছাড়া করিতে হইবে, অবস্থা এত মন্দ হইয়া আসিয়াছে?

অবনী একদিন যদুবাবুর কাছে ভূমিকা ফাঁদিয়া বলিল, দাদা একটা কথা বলি। এ মাসে আমায় কিছু টাকা দিন। একটা গরু বিক্রি আছে আদাড়ী জেলেনীর, বাইশ টাকা দাম চায়—এবেলা এক সের ওবেলা এক সের দুধ দিচ্ছে। আপনার অসুখের জন্যে দুধের তো দরকার। গরুটা কিনে রাখি, সব হাঙ্গামা মিটে যায়।

যদুবাবু স্বভাবসিদ্ধভাবে উত্তর দিলেন, তা—তা বেশ। মন্দ কী? হ্যাঁ, সে ভালোই।

অবনী উৎসাহ পাইয়া বলিল, কবে দিচ্ছেন টাকাটা? আজ না হয় পাঁচটা টাকা দিন, বায়না করে আসি। হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে—

আসলে সেদিন আড়ংঘাটার বাজারে অবনীর পাঁচ টাকা ধার শোধ দেওয়া ওয়াদা ছিল, কুণ্ডুদের দোকানে অনেক দিনের দেনা, নতুবা তাহারা নালিশ রুজু করিবে বলিয়া শাসাইয়াছে।

যদুবাবু বলিলেন, তা এখন তো হয় না। তোমার বউদিদির কাছে চাবি। সে ঘাটে গিয়াছে।

যদুবাবুর উপর হইতে চাপ গিয়া পড়িল এবার তাঁহার বেচারি স্ত্রীর উপর। বউদিদি কেন দিবেন না, দাদা যখন বলিয়া দিয়াছেন? আসল কথা, দাদা তো কঞ্জুস আছেনই, বউদিদি হাড়-কঞ্জুস। হাত দিয়া জল গলে না।

.

করট ও ফিঙে পাখি গ্রীষ্মের দীর্ঘ দিন ধরিয়া বাঁশঝাড়ে ডাকে, প্রস্ফুটিত তুঁতপুষ্পের ঘন সুবাসে যদুবাবুর  জানালার বাহিরের বাতাস ভরপুর, রোগগ্রস্ত যদুবাবু নিজের  বিছানায় বালিশে ঠেসান দিয়া বসিয়া বসিয়া শোনেন। সামনের নারিকেল গাছের গায়ে একটা গিরগিটি, যখনই যদুবাবু চাহিয়া দেখেন, সেই গিরগিটি ওই গাছের গায়ে একই জায়গায়। দেখিয়া দেখিয়া রুগ্ন উদভ্রান্ত যদুবাবুর মনে হয়, ওই গিরগিটি তাঁহার এই বর্তমান শয্যাশায়ী অবস্থার প্রতীক। ওটাও যেমন নারিকেল গাছের গায়ে অচল অনড়, তিনিও তেমনিই এই আলোআনন্দহীন কক্ষে, পুরনো ভাঙা কোঠার কেমন একপ্রকার নোনা-ধরা গন্ধের মধ্যে শয্যাগত, উত্থানশক্তিরহিত।

কবে শরীর সারিবে কে জানে? যেদিন ওই গিরগিটিটা ওখান হইতে সরিয়া যাইবে?

অবনীর বড় ছেলে কালীকে ডাকিয়া বলিলেন, এই শোন ওই গিরগিটিটাকে ওখান থেকে তাড়াতে পারবি?

বালক অবাক হইয়া তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, কেন জ্যাঠামশাই?

—দে না, দরকার আছে।

—একটা কঞ্চি নিয়ে আসি জ্যাঠামশায়। খোঁচা দিয়ে তাড়াই। আপনি উঠবেন না, শুয়ে শুয়ে দেখুন।

তাড়ানো হইল বটে, কিন্তু আবার পরদিন সকালে উঠিয়া যদুবাবু সভয়ে চাহিয়া দেখিলেন, গিরগিটিটা আবার সেই নারিকেলগাছের গায়ে স্বস্থানে জাঁকিয়া বসিয়া আছে। যদুবাবু হতাশ হইয়া বালিশের গায়ে ঠেস দিয়া দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিলেন।

.

অসুখ সারে না। দিন দিন দুর্বল হইয়া আসিতেছে দেহ, পাড়াগাঁয়ের হাতুড়ে ডাক্তারের ওষুধে ফল হয় না। জ্যৈষ্ঠ মাস গিয়া আষাঢ় মাস পড়িল। বর্ষার জলের সঙ্গে সঙ্গে হু-হু করিয়া মশককুল দেখা দিল, ফুটা ছাদ দিয়া জল পড়িতে লাগিল রোগীর বিছানায়, এক-এক দিন রাত্রে বিছানা গুটাইয়া ঘরের কোণে জড়সড় হইয়া স্বামী-স্ত্রীতে রাত কাটাইতে হয়।

যদুবাবুর স্ত্রী বলে, কপালে এতও ছিল!

যদুবাবু চটিয়া বলেন, তুমি ও-রকম নাকে কেঁদো না বলে দিচ্ছি। কথায় বলে, পুরুষের দশ দশা। রেখেছিলাম তো কলকাতায় বাসা করে এতাবৎকাল। জাপানীদের তো আমি ডেকে আনি নি। পড়ে গিয়েছি বিপদে, তা এখন কী করি বল? সুদিন আসে, কলকাতায় গিয়ে উঠব আবার—তা বলে নাকে কেঁদে কী হবে?

যদুবাবুর স্ত্রী বলিল, আমার জন্যে কিছু বলিনি, তোমার জন্যেই বলি। তোমার কি এত কষ্ট করা অভ্যেস আছে কখনও? চিরকাল টুইশানি করে এসেছ, শীতকালে গরমজল করে দিয়েছি হাত-পা ধুতে, তোমার ঠাণ্ডা সহ্যি হয় না। কোনো কালে—

—আচ্ছা থাক থাক, তার জন্যে নাকে কেঁদে কী হবে? আবার হবে সব—কেবল ওই অবনীটার জ্বালায়—

কিন্তু লক্ষণ ক্রমশ খারাপ দেখা দিল। আষাঢ় মাস পড়িবার সঙ্গে সঙ্গেই যদুবাবু যেন আরও দুর্বল হইয়া পড়িলেন। জ্বর রোজ আসে, কোনোদিন ছাড়ে, কোনোদিন ছাড়ে না।

.

সেদিন জগন্নাথের স্নানযাত্রা। সকালের দিকে বৃষ্টি হইয়া দুপুরের পর বৃষ্টিধৌত সুনীল আকাশে ঝলমলে সোনালী রোদ উঠিল। আতাগাছটাতে, ফুটন্ত ফুলে ভরা আকন্দগাছটাতে, বাঁশঝাড়ের মাথায় অদ্ভুত রঙের রোদ মাখানো। আতাফুলের কুঁড়ির মৃদু সুবাস শৈশবের কথা স্মরণ করাইয়া দেয়।

অবনীর মেয়ে টুনি বলিতেছে, মা, আমি পঞ্চুমীর পালুনি করে পান্তাভাত খেতে পারব না কিন্তু বলে দিচ্ছি, চিঁড়ে খাব।

যদুবাবুর মনে পড়িল, তাঁহার মা যদুবাবুর বাল্যদিনে মনসার পালুনি করিয়া পাতে যে চিঁড়ার ফলার রাখিয়া উঠিতেন, তাহা খাইবার জন্য তাঁহাদের দুই ভাইবোনের কাড়াকাড়ি পড়িয়া যাইত। কোথায় সে বাল্যকালের মা, কোথায় বা সেই ছোট বোন মঙ্গলা। চল্লিশ বছরের ঘন কুয়াশায় তাহাদের মুখ মনের দর্পণে আজ অস্পষ্ট।

তারপর কতকাল গ্রামছাড়া। ১৯০০ সালের পর আর গ্রামে এভাবে বাস করা হয় নাই। সেই সালেই যদুবাবু এন্ট্রাস পাস করেন বোয়ালমারি হাই স্কুল হইতে। দাড়িওয়ালা বৃদ্ধ রামকিঙ্কর বসু ছিলেন হেডমাস্টার। কেমন পাণ্ডিত্য, তেমনই বেতের বহর ছিল তাঁহার। রামকিঙ্কর বোসের বেত খাইয়া অনেক ডেপুটি মুন্সেফ পয়দা হইয়া গিয়াছে সেকালে।

যদুবাবুকে বলিয়াছেন—যদু, তুমি বড় ফাঁকিবাজ, টেস্ট পরীক্ষায় টুকে পাস করলে, চিরকালই পরের টুকে পাস করলে, জীবনের পরীক্ষায় যেন এরকম ফাঁকি দিয়ো না, বড্ড ফাঁকে পড়ে যাবে।

বেলা পড়িয়া আসিয়াছে। কী সুন্দর অপরাহ্নের নীল আকাশ! কী সুন্দর সোনার রঙের সূর্যালোক! ছোট গোয়ালে-লতার ঝোপে একজোড়া বনটিয়া আসিয়া বসিল। ছেলেবেলায় যদুবাবু পাখি বড় ভালোবাসিতেন। পদা বুনো নামে তাঁহাদের এক পৈতৃক প্রজা ছিল, তাহার সঙ্গে মিশিয়া ফাঁদ পাতিয়া জলচর পক্ষী ধরিতেন—সরাল, পানকৌড়ি, বক, শামকুড়—কতকাল এসব দেখেন নাই! গানের তাল কবে কাটিয়াছিল, স্মরণ নাই। বর্তমানের সঙ্গে অতীতের অনতিক্রমণীয় ব্যবধান।

যেন তাঁহার নবদৃষ্টি জাগ্রত হইয়াছে এই রোগশয্যায়। টুইশানির ছুটাছুটি নাই, সারাদিন ঠেসান দিয়া বাহিরের দিকে চাহিয়া থাকা। কতকাল এত দীর্ঘ অবকাশ ভোগ করেন নাই। ভগবানের কথা কখনও ভাবেন নাই, আজ মনে হইল—তিনি আছেন। না থাকিলে এই সুন্দর রোদ, বনটিয়া, তাঁহার মনের এই অকারণ আনন্দ, শত অভাবের মধ্যেও মায়ের স্নেহময়ী স্মৃতির বাস্তবতা কোথা হইতে আসিল? ভগবান না থাকিলে ওই অনাথা নিঃসম্বল বিধবাকে কে দেখিবে? তাঁহার দিন ফুরাইয়াছে তিনি জানেন।

জীবন কি ফাঁকি দিয়া কাটাইলেন!

সুদীর্ঘ জীবনের বহু কথা আজ যেন মনে পড়িতেছে, গত ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বৎসরের কর্মজীবনের ইতিহাস—না, ফাঁকি কেন দিবেন? ফাঁকি দেন নাই। নারাণদা সাধুপুরুষ ছিলেন—স্বর্গে চলিয়া গিয়াছেন—নারাণদা বলিতেন, জীবনকে সার্থক করিতে হইলে তাহাকে মানুষের কোনো না কোনো কাজে, সমাজের কোনো না কোনো উপকারে লাগানো চাই।

তিনিও জীবনকে বৃথা যাইতে দেন নাই। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে কত ছাত্র লেখাপড়া শিখিয়া তাঁহার হাতে মানুষ হইয়াছে। হয় নাই কি? নিশ্চয়ই হইয়াছে। সেই সব ছেলেই সাক্ষী আজ, পরকালের মৃত্যুপারের দেশের বড় দরবারে তাহারা সে সাক্ষ্য দিবে একদিন, যদুবাবু আশা করেন।

দুই-একটা অন্যায় কাজ, দুই-একটা—চুরি ঠিক বলা যায় না—চুরি নয়, তবে হাঁ, একটু- আধটু খারাপ কাজ যে না করিয়াছেন এমন নয়। তিনি তাহা স্বীকারই করিতেছেন। ভগবান গরিব মানুষের অপরাধ ক্ষমা করিবেন।

বেলা গেল…

গিরগিটিটা নারিকেলগাছের গুঁড়িতে ঠায় বসিয়া আছে…

ভগবান দয়াময়, গরিবের অপরাধ ক্ষমা করিবেন।

যদুবাবুর স্ত্রী এক বাটি বার্লি লইয়া ঘরে ঢুকিয়া বলিল, নেবু দিয়ে বার্লি দেব, না মিছরি দেব? পরে থামিয়া বলিল, আজ গুনে দেখলাম, এগারোখানা আমসত্ব হয়েছে, বুঝলে?  কলকাতার বাসায় নিয়ে যাব হাঙ্গামা মিটে গেলে। তুমি দুধ দিয়ে খেতে ভালোবাস বলে আমসত্ব দিলাম মরে-কুটে—সেরে ওঠো তুমি।

স্ত্রীকে হঠাৎ বিস্মিত করিয়া দিয়া তিনি তাহাকে পুরনো আমলের আদরের সুরে অনেক দিন পরে বলিলেন  বিছানায় এসে কাছে একটুখানি বোস না! এস—

* * * *

ক্লার্কওয়েল সাহেবের স্কুল দিন-পাঁচ-ছয় খুলিয়াছে। দুই-তিনজন ব্যতীত অন্য সব শিক্ষক আসিয়াছেন। আসেন নাই কেবল জ্যোতির্বিনোদ আর শ্রীশবাবু। তাঁহারা দেশের স্কুলে চাকুরি পাইয়াছেন। ছেলেরাও বেশি নাই, এ-ক্লাসে পাঁচজন ও-ক্লাসে দশজন। অনেকে বলিতেছে— স্কুল টিকিবে না।

আর আসেন নাই যদুবাবু। সাহেবের সারকুলার-বই লইয়া কেবলরাম ক্লাসে ক্লাসে ফিরিতেছে—স্কুলের সুযোগ্য প্রবীণ শিক্ষক যদুগোপাল মুখুজ্জের পরলোকগমনে স্কুল দুই দিন বন্ধ রহিল। মুখোপাধ্যায় মহাশয় একাদিক্রমে উনিশ বৎসর এই স্কুলে শিক্ষকতা করিয়া ছাত্র ও শিক্ষক সকলেরই শ্রদ্ধা অর্জন করিয়াছিলেন। তাঁহার মৃত্যুতে স্কুলের যে অপরিসীম ক্ষতি হইল…ইত্যাদি ইত্যাদি।


© 2024 পুরনো বই