১. ক্লার্কওয়েল সাহেবের স্কুল

অনুবর্তন – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

উৎসর্গ
আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের
করকমলে

.

ওয়েলেসলি স্ট্রীটের আর পিটার লেনের মোড়ে ক্লার্কওয়েল সাহেবের স্কুল-বাড়িটা বেশ সরগরম হইয়া উঠিয়াছে। বেলা দশটা। ছাত্রের দল ইতিমধ্যে আসিতে শুরু করিয়াছে, বড়লোকের ছেলেরা মোটরে, মধ্যবিত্ত ও গরিব গৃহস্থের বাড়ির ছেলেরা পদব্রজে। স্কুলের পুরনো চাকর মথুরাপ্রসাদ ছেঁড়া ও মলিন খাকির চাপকান পরিয়া তৈরি, চাপকানের হাতের কাছটাতে রাঙা সুতায় একটা ফুটবলের শিল্ডের মত নকশার মধ্যে ইংরেজি ‘এম’ ও ‘আই’ অক্ষর দুইটি জড়াপট্টি খাইয়া শোভা পাইতেছে; কারণ স্কুলের নাম মডার্ন ইনস্টিটিউশন, যদিও হেডমাস্টার ক্লার্কওয়েল সাহেবের ব্যক্তিগত চিঠির উপরে ছাপানো আছে ‘‘ক্লার্কওয়েল’স মডার্ন ইনস্টিটিউশন’’, আসলে সেটা ভুল; কারণ স্কুলটি সাহেবের নিজের নয়, অনেক দিনের পুরনো স্কুল, কমিটির হাতে আছে, ক্লার্কওয়েল সাহেব আজ পনেরো বছর এখানকার বেতনভোগী হেডমাস্টার মাত্র।

এই স্কুল-বাড়ির দোতলার পিছন দিকের তিনটি ঘর হেডমাস্টারের থাকিবার জন্য নির্দিষ্ট আছে—ঘরের সামনেই ক্লাসরুম, কাজেই পর্দা ফেলা। ক্লার্কওয়েলের বয়স প্রায় ষাটের কাছাকাছি, মাথার চুল সাদা, মোটাসোটা, সর্বদা ফিটফাট হইয়া থাকেন, টাইটা এদিক ওদিক নড়িবার জো নাই, শার্টের সামনেটা নিখুঁত ইস্ত্রি করা, চকচকে কলার, ভালো কাটছাঁটের কোট, পেন্টালুনের পা দুটিতে চমৎকার ভাঁজ, যাহাকে বলে ‘নাইফ-এজ-ক্রিজ’—ছুরির ফলার মত সরু খাঁজ। সাহেব অবিবাহিত, কেউ কেউ বলে সাহেবের স্ত্রী আছে, কিন্তু সে সাহেবের কাছে থাকে না। তবে এখানে মিস সিবসন নামে একজন তরুণী ফিরিঙ্গি মেম সাহেবের সঙ্গেই থাকে, কেউ বলে সাহেবের শালি, কেউ বলে কী রকম বোন, কেউ বলে আর কিছু—মিস সিবসনও স্কুলের টিচার, নীচের ক্লাসে ইংরেজি পড়ায় ও উচ্চারণ শেখায়।

মিস সিবসনের নামে এ স্কুলে নীচের ক্লাসের দিকে ছোট ছোট ছেলের বেশ ভিড়। আশপাশের অবস্থাপন্ন গৃহস্থেরা মেমসাহেবের কাছে পড়িতে পাইবে ও নিখুঁত ইংরেজি উচ্চারণ শিখিতে পাইবে, এই লোভে ছেলেদের এই স্কুলে ভর্তি করে। বেলা দশটা বাজিতে না বাজিতে ছোট ছোট ছেলেরা স্কুলের সামনের কম্পাউন্ডে ছুটাছুটি করিতেছে, মারামারি করিতেছে, হৈ-চৈ, চীৎকার লাফালাফি দাপাদাপি জুড়িয়া দিয়াছে।

হঠাৎ দোতলার জানালাপথে ক্লার্কওয়েল সাহেবের মুখখানা বাহির হইল ও বিষম বাজখাঁই চিৎকার শোনা গেল : ও, ইউ মথুরা, স্টপ দি নয়েজ—বাবালোগকো চুপ করনে বোলো—

মুহূর্তে সব চুপ।

ছেলেরা মুখ উঁচু করিয়া হেডমাস্টারকে দেখিয়া লইল, এবং এ ওর মুখের দিকে চাহিয়া যে যাহার মার্বেল পকেটের মধ্যে পুরিয়া ফেলিল ও উদ্যত ঘুঁষি নামাইল।

—মথুরা—এই মথুরা—

পুনরায় হেডমাস্টারের গম্ভীর আওয়াজ।

নীচের ছোট্ট কুঠুরির মধ্যে বসিয়া চাপকান-পরিহিত বৃদ্ধ মথুরা তামাক খাইতেছিল, সে তাড়াতাড়ি হুঁকা রাখিয়া বাহির হইয়া আসিয়া উপরের দিকে চাহিল।

—পহেলা ঘণ্টি মারো, সওয়া দশ হো গিয়া—

দিকবিদিক প্রতিধ্বনিত করিয়া দীর্ঘসময়ব্যাপী স্কুল বসিবার প্রথম ঘণ্টা বাজিয়া চলিল—থামিতে আর চায় না। অনেক ছোট ছোট ছেলের মন বিষণ্ণ হইয়া উঠিল—এই এখন স্কুল বসিবার ঘণ্টা পড়িতেছে, কলির সবে শুরু। এযাত্রা কি আর ছুটির ঘণ্টা বাজিবার সম্ভাবনা আছে? মোটে সওয়া দশ, আর কোথায় সেই সাড়ে তিন। সাড়ে তিনটাতে নীচের ছোট ছেলেদের ক্লাসের ছুটি।

ক্লার্কওয়েল তাড়াতাড়ি টেবিলে বসিয়া এক প্লেট সরু চালের ভাত, দুইটি কাঁচা টোমাটো, একটা বড় কাঁচকলা-সিদ্ধ, কিছু কাঁচা লেটুস শাক ও কপির পাতা কুচানো, একফালি নারিকেল ও দুইখানা মুরগির ঠ্যাং-সিদ্দ খাওয়া শেষ করিয়া হাঁকিলেন, কেবলরাম!

বাবুর্চি কেবলরাম হিন্দু। সাহেবের কাছে অনেক দিন আছে, সেও কায়দাদুরস্তভাবে সাদা উর্দি পরিয়া, মাথায় সাদা পাগড়ি বাঁধিয়া তৈরি—সাহেবের বাবুর্চিগিরি করে এবং স্কুলের সময়ে রেজিস্ট্রি-খাতাপত্র এ-ক্লাস হইতে ও-ক্লাসে বহিয়া লইয়া যায়,  জল তোলে, ছেলেদের জল দেয়—এজন্য স্কুল হইতেই সে বেতন পাইয়া থাকে, সাহেবের খানা পাকাইবার জন্য সে কেবল সাহেবের কাছে খোরাকি পায় মাত্র।

কেবলরাম শশব্যস্ত হইয়া বলিল, হুজুর!

—মেমসাহেব কাঁহা?

—এখনও আসতেছেন না কেন, অনেকক্ষণ তো গেছেন! আলেন বলে হুজুর, ধর্মতলায় ওষুধ আনতি গেছেন।

কেবলরামের বাড়ি যশোর ও খুলনার সীমানায়।

—মেমসাহেবকো খানা টেবিলমে রাখ দো। আউর তুম চলা যাও ইউনিভার্সিটি, পিওন বুককা অন্দর দো লেফাফা হ্যায়—

—হুজুর, ইউনিভার্সিটি এখনো খোলে নি, এগারো বাজলি তবে বাবুরা আসবেন—মেমসাহেবের খানা দিয়ে তবে গেলি চলবে না হুজুর?

—বহুৎ আচ্ছা, চা দো।

সকালে ভাত খাওয়ার পর চা-পান ক্লার্কওয়েলের বহুদিনের অভ্যাস।

এই সময় উঁচু গোড়ালির জুতা খট খট করিতে করিতে মিস সিবসন ঘরে ঢুকিল। কৃশাঙ্গী, লম্বা, মুখে পুরু করিয়া পাউডার, ঠোঁটে লিপস্টিক ঘষা, হাতে হ্যান্ডব্যাগ ঝোলানো। বয়স কম হইলেও গালে ইতিমধ্যে মেছেতা পড়িতেছে। মুখ ফিরাইয়া চোখ ঘুরাইয়া বলিল, ডিয়ারি, ইউ হ্যাড ফিনিশড অলরেডি?

—ইয়েস, ডু ইউ গবল আপ কুইকলি, ফার্স্ট বেল ইজ গন, ইউ আর রাদার লেট ফর মিল!

সরু গলায় গানের সুরে কথা বলিয়া মেমসাহেব পাশের ঘরে ঢুকিল।

ক্লার্কওয়েল উঠিয়া দাঁড়াইলেন, স্কুলের পোশাক পরিয়াই তিনি খানার টেবিলে বসিয়াছিলেন, বাহিরে চাহিয়া পর্দার ফাঁক দিয়া দেখিবার চেষ্টা করিলেন, ক্লাসরুমে ছেলে আসিয়াছে কিনা। ঢং ঢং করিয়া স্কুল বসিবার ঘণ্টা পড়িল। ক্লার্কওয়েল শশব্যস্ত হইয়া ঘরের বাহির হইয়া নীচের গাড়িবারান্দায় স্কুলের ছেলেদের সমবেত প্রার্থনায় যোগ দিতে নামিয়া গেলেন।

ক্লার্কওয়েল দোর্দণ্ডপ্রতাপ জাঁহাবাজ হেডমাস্টার। ছাত্র ও মাস্টারেরা সমানভাবে ভয়ে কাঁপে তাঁর দাপটে—পুরো অটোক্র্যাট, কথা বলিলে তার নড়চড় হইবার জো নাই, হুকুমের বিরুদ্ধে কমিটিতে আপিল নাই—কমিটির মেম্বাররা সবাই বাঙালি, সাহেবকে খাতির করিয়া চলা তাঁহাদের বহুদিনের অভ্যাস, স্কুলের মাস্টারদের ডিক্রি-ডিসমিসের একমাত্র মালিক তিনিই।

সুতরাং আশ্চর্য না যে, তাঁহার সিঁড়ি দিয়া দুপ দুপ করিয়া নামিবার সময় দুই-একজন মাস্টার, যাঁহারা হেডমাস্টারের অলক্ষে তাড়াতাড়ি হাজিরা-বই সই করিতে দোতলায় আপিসঘরে যাইতেছিলেন, তাঁহারা একটু সঙ্কুচিত সুরে ‘গুডমর্নিং স্যার’ বলিয়া এক পাশে রেলিং ঘেঁষিয়া দাঁড়াইয়া হেডমাস্টারকে নামিবার পথ বাধামুক্ত করিয়া দিলেন—যদিও তাহা সম্পূর্ণ অনাবশ্যক; কারণ চওড়া সিঁড়ি উভয় পক্ষের নামিবার ও উঠিবার পক্ষে যথেষ্ট প্রশস্ত। ইহা বিনয়ের একপ্রকার রূপ, প্রয়োজনের কার্য নহে।

ক্লাস বসিয়া গেল। ক্লার্কওয়েল হাজিরা-বই খুলিয়া দেখিয়া হাঁকিলেন, মিঃ আলম!

সফরুদ্দিন আলম এম-এ, স্কুলের অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টার। বয়স ত্রিশের মধ্যে, আইন পাশ করিয়া আজ বছর চার-পাঁচ মাস্টারি করিতেছে, ধূর্ত চোখ, চটপটে ধরনের চালচলন—লোক ভালো নয়। হেডমাস্টারের দক্ষিণ-হস্তস্বরূপ, মাস্টারেরা ভয় করিয়া চলে, ভালোবাসে না।

আলম বলিল, ইয়েস স্যার।

—আজ প্রেয়ারের সময় শ্রীশবাবু আর যদুবাবু অনুপস্থিত। ওদের ডাকাও।

—স্যার, যদুবাবু আর শ্রীশবাবুকে বলে বলে পারলাম না, রোজ লেট স্যার, আপনি একটু বলে দিন ওদের।

লাগাইতে-ভাঙাইতে আলমের জুড়ি নাই বলিয়া মাস্টারের দল তাহাকে বিশেষ সমীহ করিয়া চলে।

আলম মাস্টারদের ঘরে গিয়া সুমিষ্ট স্বরে বলিল, যদুবাবু, শ্রীশবাবু, হেডমাস্টার আপনাদের স্মরণ করেছেন। শরৎবাবু কোথায়?

যদুবাবু বয়সে প্রবীণ, চালচলন ক্ষিপ্রতাবর্জিত, রোগা, মাথার চুল কাঁচাপাকায় মিশানো। তিনি ধীরে ধীরে টানিয়া বলিলেন, কেন আমায় অসময়ে স্মরণ—

—আপনি প্রেয়ারের সময় কোথায় ছিলেন?

—আসতে দেরি হয়ে গিয়েছিল। কেন?

—হেডমাস্টার নোট করেচেন—

যদুবাবু উষ্মাসহকারে বলিলেন, ও, তবেই আমার সব হল! নোট করেচেন তো ভারিই করেচেন! গেরস্ত মানুষ, কাঁটা ধরে আসা সব সময় চলে না।

মিঃ আলম চুপ করিয়া রহিল।

টিফিনের পর যদুবাবুর পুনরায় ডাক পড়িল আপিসে। ক্লার্কওয়েল বলিলেন, ওয়েল যদুবাবু, আমার স্কুলে শুনলাম আপনার অসুবিধে হচ্ছে?

যদুবাবু আমতা আমতা করিয়া বলিলেন, কেন স্যার?

বুঝিলেন, আলমের কাছে ওবেলা যাহা বলিয়াছিলেন তাহা সাহেবের কানে উঠিয়াছে।

—আপনার রোজ লেট হচ্ছে স্কুলে, অথচ ঘরের কাজ ঠিকমত করতে পারছেন না শুনলাম!

—ঘরের কাজ? না স্যার, ঘরের কাজ ঠিক—তার জন্যে কি—

ক্লার্কওয়েল সাহেব বলিলেন, বসুন ওখানে। এখন কোনো ক্লাস আছে?

—আজ্ঞে, থার্ড ক্লাসে হিস্ট্রির ঘণ্টা।

—আচ্ছা, যাবেন এখন। আপনি আজ প্রেয়ারের সময় ছিলেন না, রোজই থাকেন না।

—আমি কেন স্যার, শ্রীশ থাকে না, হীরেনবাবু থাকে না, ক্ষেত্রবাবু থাকে না।

—আমি জানি কে কে থাকে না। আপনার বলার আবশ্যক নেই। আপনি ছিলেন না কেন? লেট করেন কেন রোজ?

—খেতে একটু দেরি হয়ে যায় স্যার।

—বেশ, মাই গেট ইজ ওপন। আপনার অসুবিধে হলে আপনি চলে যেতে পারেন।

যদুবাবু নিরুত্তর রহিলেন। সাহেবের আড়ালে যাহাই বলুন, সামনাসামনি কিছু বলিবার সাহস তাঁহার নাই। অন্তত এতদিন কেহ দেখে নাই।

—আচ্ছা, যান ক্লাসে। কাল থেকে আমার আপিসে এসে সই করবেন আগে।

যদুবাবু পরের ক্লাসের ঘণ্টা পড়িলে আপিসে আসিয়াই ক্ষেত্রবাবুকে সামনে দেখিতে পাইলেন। তখনও অন্য কোনো শিক্ষক আপিস-ঘরে আসেন নাই।

ক্ষেত্রবাবু সুর নিচু করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, তলব হয়েছিল কেন?

যদুবাবু বলিলেন, ওঃ, অত আস্তে কথা কিসের? বলব সোজা কথা, তার আবার অত ঢাক-ঢাক গুড়-গুড়—

হঠাৎ যদুবাবুকে বাকশক্তি রহিত হইতে দেখিয়া ক্ষেত্রবাবু সবিস্ময়ে পিছন ফিরিয়া চাহিতেই একেবারে অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টার মিঃ আলমের সহিত চোখাচোখি হইয়া গেল?

আলম বলিল, ক্ষেত্রবাবু, ফোর্থ ক্লাসে একজামিনের পড়া দেখিয়ে দিয়েছেন?

—আজ্ঞে হ্যাঁ।

—যদুবাবু?

—কাল দেব।

—কেন, আজই দিন না।

—কাল দিলে ক্ষতি কিছু নেই।

অল্পক্ষণ পরে হেডমাস্টারের আপিসে যদুবাবুর আবার ডাক পড়িল।

হেডমাস্টার বলিলেন, যদুবাবু, আপনি ফোর্থ ক্লাসে কী পড়ান?

—হিস্ট্রি স্যার।

—ওদের উইকলি পরীক্ষা হবে এই শনিবার, পড়া দেখিয়ে দিয়েছেন?

—না স্যার, কাল দেব।

—ওরা ক’দিন সময় পাবে তৈরি হতে, তা ভেবে দেখলেন না! ছেলেদের কাজ যদি না হয়, তেমন মাস্টার এ স্কুলে রাখাও যা না রাখাও তাই। মাই  ডোর ইজ ওপন—আপনার না পোষায়, আপনি চলে গেলে কেউ বাধা দেবে না।

যদুবাবু বিনীতভাবে জানাইলেন, তিনি এখনই ক্লাসে গিয়া পড়া বলিয়া দিতেছেন।

—তাই যান। পড়া দিয়ে এসে আমাকে রিপোর্ট করবেন।

—যে আজ্ঞে স্যার।

আপিসে আসিয়া যদুবাবু লম্ভঝম্প আরম্ভ করিলেন। অন্য কেহ সেখানে ছিল না, শুধু হেডপণ্ডিত ও ক্ষেত্রবাবু।

—ওই আলম, ওটা একেবারে অন্ত্যজ—লাগিয়েছে গিয়ে অমনি হেডমাস্টারের কাছে! কথা পড়তে না পড়তে লাগাবে—এমন করলে তো এ স্কুলে থাকা চলে না দেখছি! বললাম যে ফোর্থ ক্লাসের একজামিনের পড়া দিচ্ছি দেখিয়ে—তা না, অমনি লাগানো হয়েছে! এ রকম করলে কি মানুষ টেঁকে মশাই?

বলা বাহুল্য, যদুবাবু জানিতেন, অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টার এ ঘণ্টায় নীচের হলে অ্যাডিশনাল হিস্ট্রির ক্লাস লইতেছেন।

ক্ষেত্রবাবু নীরব সহানুভূতি জানাইয়া চুপ করিয়া থাকাই নিরাপদ মনে করিলেন। তিনি ছাপোষা মানুষ, আজ সতেরো বছর ত্রিশ টাকা বেতনে এই স্কুলে চাকরি করিতেছেন। বেলেঘাটা অঞ্চলে একটি মাত্র ঘর ভাড়া লইয়া আছেন, সকালে ও সন্ধ্যায় সামান্য একটু হ্যোমিওপ্যাথি করিয়া আর কিছু উপার্জন করেন। চাকুরিটুকু গেলে এ বাজারে পথে বসিতে হইবে।

হেডপণ্ডিত মশায় বৃদ্ধ লোক, তিনি ক্লার্কওয়েল সাহেবের পূর্ব হইতে এ স্কুলে আছেন—তিনি আর নারাণবাবু। অনেক মাস্টার আসিল, চলিয়া গেল, তিনি ঠিক আছেন। মেজাজ দেখাইতে গেলে চাকরি করা চলে না। তবে তিনি ইহাও জানেন, লম্ভঝম্প করা যদুবাবুর স্বভাব, শেষ পর্যন্ত কোনো দিক হইতেই কিছু দাঁড়াইবে না।

এই সময় নারাণবাবু ঘরে ঢুকিলেন। তিনিও বৃদ্ধ, এই স্কুলেরই একটি ঘরে থাকেন—নিজে রান্না করিয়া খান। আজ পঁয়ত্রিশ বছর এ স্কুলে আছেন এবং এইভাবেই আছেন। বৃদ্ধের নিকট কেহ কখনও তাঁহার কোনো আত্মীয়স্বজনকে আসিতে দেখে নাই। রোগা, বেঁটে চেহারার মানুষটি, পাকশিটে গড়ন, গায়ে আধময়লা পাঞ্জাবি, ততোধিক ময়লা ধুতি, পায়ে চটিজুতা।

নারাণবাবু পকেট হইতে একটি টিনের কৌটা বাহির করিয়া একটি বিড়ি ধরাইলেন।

ক্ষেত্রবাবু হাত বাড়াইয়া বলিলেন, দিন একটা, কাঠিটা ফেলবেন না।

নারাণবাবু বলিলেন, কী হয়েছে, আজ যদুবাবুকে হেডমাস্টার ডাকিয়েচে কেন?

যদুবাবু চড়াগলায় মেজাজ দেখানোর সুরে বলিতে আরম্ভ করিলেন, সেই কথাই তো বলচি। শুধু শুধু ওই অন্ত্যজটা আমায় ডেকে নিয়ে গিয়ে—

নারাণবাবু বলিলেন, আস্তে আস্তে—

যদুবাবু গলা আরও এক পর্দা চড়াইয়া বলিলেন, কেন, কিসের ভয়? যদু মুখুজ্জে ওসব গ্রাহ্যি করে না। অনেক আলম দেখে এসেছি, থার্ড ক্লাস এম-এ—তার আবার প্রতাপটা কিসের হ্যা? কেবল লাগানো-ভাঙানো সব সময়! অত লাগানোর ধার ধারে কে? উনি ভাবেন, সবাই ওঁকে ভয় করে চলবে। যে চলে সে চলুক, যদু মুখুজ্জে সে রকম বংশের—

বাহিরে বুট জুতার শব্দ শোনা গেল—মিঃ আলমের পায়ে বুট আছে সবাই জানে—যদুবাবু হঠাৎ থামিয়া গেলেন। ক্ষেত্রবাবু বলিয়া উঠিলেন, যাই, খড়িটা দিন নারাণবাবু দয়া করে, ক্লাস আছে।

নারাণবাবু বলিলেন, চল, আমিও যাই। ওরে কেবলরাম, ইন্ডিয়ার বড় ম্যাপখানা দে তো—

কিন্তু দেখা গেল, যে ঘরে ঢুকিল সে মিঃ আলম নয়, বইয়ের দোকানের একজন ক্যানভাসার—এক হাতে ব্যাগ ঝোলানো, অন্য হাতে কিছু নতুন স্কুল-পাঠ্য বই। ক্যানভাসারের সুপরিচিত মূর্তি। ক্যানভাসারের প্রশ্নের উত্তরে তাহাকে হেডমাস্টারের আপিস দেখাইয়া দিয়া যদুবাবু পুনরায় শুরু করিলেন, হ্যাঁ, আমি যা বলব এক কথা। কাউকে ভয় করে না এই যদু মুখুজ্জে। বলি বাবা, এ স্কুল গড়ে তুলেছে কে? ওই নারাণ বাঁড়ুজ্জে আর হেডপণ্ডিত। সাহেব এল তো কাল, উড়ে এসে জুড়ে বসেচে—আর ওই অন্ত্যজ—

মিঃ আলমের প্রবেশটা একটু অপ্রত্যাশিত ধরনে ঘটিল।

যদুবাবু হঠাৎ ঢোক গিলিয়া চুপ করিয়া গেলেন।

মিঃ আলমের ব্যবহার অত্যন্ত ভদ্র ও সংযত। মুখের উপর কেহ গালাগালি দিলেও মিঃ আলমের কথাবার্তা বা ব্যবহারে কখনও রাগ প্রকাশ পায় না। আলম বলিল, ক্ষেত্রবাবুর একটা দরখাস্ত দেখলাম হেডমাস্টারের টেবিলে, কাল আসবেন না। কী কাজ?

ক্ষেত্রবাবু বলিলেন, আজ্ঞে, কাল আমার ভাগ্নীর বিয়ে—

—তা একদিন কেন, দুদিন ছুটি নিন না। আমি সাহেবকে বলে দেব এখন।

ক্ষেত্রবাবু বিনয়ে গলিয়া গিয়া বলিলেন, যে আজ্ঞে। তাই দেবেন বলে। আমার সুবিধে হয় তা হলে—থ্যাঙ্কস।

—নো মেনশন।

ছুটির ঘণ্টা এইবার পড়িবে। শেষের ঘণ্টাটা কি কাটিতে চায়? ক্ষেত্রবাবু ও যদুবাবু তিনবার ঘড়ি দেখিতে পাঠাইলেন। চারিটা বাজিতে পনেরো মিনিট, আট মিনিট—এখনও চার মিনিট।

স্কুল-ঘরের নীচের তলায় একটা অন্ধকূপ ঘরে থার্ড পণ্ডিত জগদীশ ভটচাজ জ্যোতির্বিনোদ মশায় আছেন। বাড়ি পূর্ববঙ্গে, দশ বৎসর এই স্কুলে আছেন, কুড়ি টাকায় ঢুকিয়াছিলেন, এখনও তাই—গত দশ বৎসরে এক পয়সাও মাহিনা বাড়ে নাই। অবশ্য অনেক মাস্টারেরই বাড়ে নাই—হেডমাস্টার ও অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টার ছাড়া। হেডমাস্টারের মাহিনা গত চারি বৎসরের মধ্যে দুই শত টাকা হইতে দুই শত পঁচাত্তর এবং মিঃ আলমের মাহিনা ষাট হইতে পঁচাশি হইয়াছে।

ভুলিয়া যাইতেছিলাম, মিস সিবসনের মাহিনা গত দুই বৎসরে এক শত হইতে দেড় শত দাঁড়াইয়াছে।

উপরের তিনজনের মাহিনা বছর বছর বাড়িয়া চলিয়াছে, অথচ নীচের দিকের শিক্ষকগণের বেতনের অঙ্ক গত দশ পনেরো বিশ বৎসরেও দারুব্রহ্মবৎ অনড় ও অচল আছে কেন—এ প্রশ্ন উত্থাপন করিবার সাহস পর্যন্ত কোনো হতভাগ্য শিক্ষকের নাই। সে কথা থাক।

জগদীশ জ্যোতির্বিনোদ সিকসথ ক্লাসে বাংলা পড়াইতেছিলেন। তিনি শেষ ঘণ্টার দীর্ঘতায় অতিষ্ঠ হইয়া একটি ছেলেকে ঘড়ি দেখিতে পাঠাইলেন। আপিস-ঘরে ঘড়ি। সিঁড়ির মুখে দাঁড়াইয়া ঘাড় বাড়াইয়া চালাক ছেলেরা ঘড়ি দেখিয়া ফিরিয়া আসে, যাহাতে হেডমাস্টারের চোখে না পড়িতে হয়। কিন্তু ভাঙা পা খানায় পড়ে! জগদীশ জ্যোতির্বিনোদের প্রেরিত হতভাগ্য ছাত্রটি একেবারে হেডমাস্টারের সামনে পড়িয়া গেল—ঘড়ি দেখিতে চেষ্টা করিবার অবস্থায়।

ক্লার্কওয়েল ভীমগর্জনে হাঁকিলেন, হোয়াট ইউ আর ট্রাইং টু লুক অ্যাট? ইউ! কাম আপ!

ছোট ছেলেটি কাঁপিতে কাঁপিতে আপিস-ঘরে ঢুকিল। সেখানে মিঃ আলম বসিয়া ছিল। আলম জিজ্ঞাসা করিল, কী করছিলে নন্দ?

—ঘড়ি দেখছিলাম স্যার।

—কেন? ক্লাসে কেউ নেই?

—আজ্ঞে, থার্ড পণ্ডিতমশাই আছেন। তিনি ঘড়ি দেখতে পাঠিয়ে দিলেন।

আলম ও হেডমাস্টার পরস্পরের দিকে চাহিলেন।

—আচ্ছা, যাও তুমি।

মিঃ আলম বলিলেন, চলবে না স্যার। কতকগুলো টিচার আছে, একেবারে অকর্মণ্য, শুধু ঘড়ি দেখতে পাঠাবে ছেলেদের। কাজে মন নেই। এই থার্ড পণ্ডিত একজন, যদুবাবু, হীরেনবাবু, আর ওই হেডপণ্ডিত—

একটা নোটিস লিখে দিন মিঃ আলম, স্কুল-ছুটির পরে মাস্টারেরা সব আমার সঙ্গে দেখা না করে না যায়। ঘণ্টা দিতে বারণ করে দিন, নোটিস ঘুরে আসুক।

মিঃ আলম হাঁকিল, কেবলরাম, ঘণ্টা দিয়ো না।

একে ঘণ্টা কাটে না, তাহার উপর ক্লাসে ক্লাসে হেডমাস্টারের নোটিস গেল—ছুটির পর কোনো মাস্টার চলিয়া যাইতে পারিবেন না, হেডমাস্টার তাঁহাদের স্মরণ করিয়াছেন।

হেডমাস্টারের আপিস-ঘরে একে একে যদুবাবু, শরৎবাবু, নারাণবাবু প্রভৃতি আসিয়া জুটিলেন। জ্যোতির্বিনোদ মশায় সকলের শেষে কম্পিত দুরু-দুরু বক্ষে প্রবেশ করিলেন; কারণ তিনি সেই ছেলেটির মুখে শুনিয়াছেন সব কথা। তাঁহার জন্যই যে এই বিচার-সভার আয়োজন, তাহা তাঁহার বুঝিতে বাকি নাই।

হেডমাস্টার বলিলেন, ইজ এভরিবডি হিয়ার?

মিঃ আলম উত্তর দিলেন, ক্ষেত্রবাবু আর হেডপণ্ডিতকে দেখচি নে।

নারাণবাবু বলিলেন, ক্লাসে রয়েছেন, আসছেন।

কথা শেষ হইতেই তাঁহারাও ঢুকিলেন।

—এই যে আসুন, আপনাদের জন্যে সাহেব অপেক্ষা করছেন।

ক্লার্কওয়েল শিক্ষকদের সভায় অতি তুচ্ছ কথা বলিবার সময়ও জজসাহেবের মত গাম্ভীর্য ও আড়ম্বর প্রদর্শন করিয়া থাকেন, বাজেট সভায় বাজেট পেশ করিবার সময় অর্থসচিব যত না বাগ্মিতা দেখান তদপেক্ষা বাগ্মিতা দেখাইয়া থাকেন। তিনি বর্তমানে চেয়ার ছাড়িয়া উঠিয়া টাই ধরিয়া কখনও দক্ষিণে কখনও বামে হেলিয়া গম্ভীর সুরে আরম্ভ করিলেন, টিচার্স, আজ আপনাদের ডেকেচি কেন, এখনি বুঝবেন। আমরা এখানে কতকগুলি তরুণ আত্মার উন্নতির জন্যে দায়ী (বড় বড় কথা বলিতে ক্লার্কওয়েল সাহেব খুব ভালোবাসেন), আমরা শুধু মাইনে নিয়ে ছেলেদের ইংরেজি শেখাতে আসি নি, আমরা এসেছি দেশের ভবিষ্যৎ আশার স্থল বালকদের সত্যিকার মানুষ করে তুলতে। আমরা তাদের সময়নিষ্ঠা শেখাব, কর্তব্যনিষ্ঠা শেখাব—তবে তারা ভবিষ্যতে সুনাগরিক হয়ে দেশের বড় বড় কার্যভার হাতে নিয়ে নিজেদের জীবন-সার্থক করে তুলতে পারবে, সেই সঙ্গে দেশেরও শ্রীবৃদ্ধি হবে।

দুই-একজন শিক্ষক বলিলেন, ঠিক কথা, ঠিক কথা।

—এখন দেখুন, যদি আমরাই তাদের সময়নিষ্ঠা ও কর্তব্যানুরাগ না শিখিয়ে ফাঁকি দিতে শেখাই, যদি আমরা নিজেরা নিজেদের কর্তব্য-কাজে অবহেলা করি, তবে সে যে কত বড় অপরাধ তা ধারণা করবার ক্ষমতা আমাদের মধ্যে অনেকের নেই দেখা যাচ্ছে। শিক্ষকতা শুধু পেটের ভাতের জন্যে চাকরি করা নয়, শিক্ষকতা একটা গুরুতর দায়িত্ব—এই জ্ঞান যাদের না থাকে, তারা শিক্ষক এই মহৎ নামের উপযুক্ত নয়।

দুই-চারিজন শিক্ষক মুখ-চাওয়াচাওয়ি করিলেন।

—আমি জানি, এখানে এমন শিক্ষক আছেন, যাঁদের মন নেই তাঁদের কাজে। তাঁদের প্রতি আমার বলবার একটিমাত্র কথা আছে। মাই গেট ইজ ওপন—তাঁরা দিব্যি তার মধ্যে দিয়ে হেঁটে বেরিয়ে চলে যেতে পারেন, কেউ তাঁদের বাধা দেবে না।

হেডমাস্টার কটমট করিয়া যদুবাবু, থার্ডপণ্ডিত, ও হেডপণ্ডিতের দিকে চাহিলেন।

—আজকের ঘটনাই বলি। আপনাদের মধ্যে কোনো একজন শিক্ষক আজ আপিসে ঘড়ি দেখতে পাঠিয়েছিলেন একটি ছেলেকে। তিনি যে কতবড় গুরুতর অন্যায় করেছেন, তা তিনি বুঝতে পারছেন না। এতে প্রমাণ হল যে, কর্তব্য-কাজে তাঁর মন নেই, কখন ঘণ্টা শেষ হবে সেজন্য তাঁর মন উসখুস করছে—তাঁর দ্বারা সুচারুরূপে শিক্ষকদের কর্তব্য কখনই সম্পন্ন হতে পারে না। সুকুমারমতি বালকদের সামনে তিনি কী আদর্শ দাঁড় করাবেন? কাজে ফাঁকি দেবার আদর্শ, কর্তব্যে অবহেলার আদর্শ—কী বলেন আপনারা?

সকলেই মাথা এক পাশে হেলাইয়া বলিলেন, ঠিক কথা।

—এখন আমি আপনাদের একটা কথা জিজ্ঞাসা করি। সে শিক্ষকের প্রতি আর ভালো ব্যবহার করা চলে কি? তাঁর দ্বারা এ স্কুলের কাজ চলে কি? বলুন আপনারা? আমি মিঃ আলমকে এই প্রশ্ন করচি। মিঃ আলম একজন কর্তব্যপরায়ণ শিক্ষক বলে আমি জানি। আর একজন ভালো শিক্ষক আছেন—নারাণবাবু, তাঁর প্রতিও আমি এই প্রশ্ন করচি।

ক্ষেত্রবাবু, যদুবাবু ও থার্ড পণ্ডিত তিনজনেরই মুখ শুকাইল। তিনজনেই ঘড়ি দেখিতে পাঠাইয়াছিলেন, তিনজনের প্রত্যেকেই ভাবিলেন তাঁহার উদ্দেশেই হেডমাস্টারের এই বক্তৃতা। নারাণবাবু দাঁড়াইয়া উঠিয়া বলিলেন, একটা কথা আছে আমার স্যার।

—কী, বলুন?

—এবার তাঁকে ক্ষমা করুন, তিনি যেই হন, আমার নাম জানবার দরকার নেই, এবার তাঁকে ক্ষমা করুন। ওয়ার্নিং দিয়ে ছেড়ে দিন স্যার।

হেডমাস্টারের কণ্ঠস্বর ফাঁসির হুকুম দিবার প্রাক্কালে দায়রা-জজের মত গম্ভীর হইয়া উঠিল।

—না নারাণবাবু, তা হয় না। আমি নিজের কর্তব্য-কর্মে অবহেলা করতে পারব না— আমি এই ইনস্টিটিউশনের হেডমাস্টার, আমার ডিউটি একটা আছে তো? আমি চোখ বুজে থাকতে পারি নে। আমার কর্তব্য এখানে সুস্পষ্ট, হয়তো তা কঠোর, কিন্তু তা করতে হবে আমায়। আমি সেই টিচারকে সাসপেন্ড করলাম।

হঠাৎ যদুবাবু দাঁড়াইয়া উঠিয়া বলিলেন, স্যার, আমি ঘড়ি দেখতে কোনোদিন পাঠাই নি—আজ পাঠিয়েছিলাম, তার একটা কারণ ছিল স্যার, আমার স্ত্রী অসুস্থ, ডাক্তার আসবে চারটের পরেই—তাই—এবারটা আমায়—

তিনি এতক্ষণ বসিয়া বসিয়া এই কৈফিয়তটি তৈরি করিতেছিলেন। তাঁহার দৃঢ় বিশ্বাস, তাঁহারই উদ্দেশে হেডমাস্টার এতক্ষণ ধরিয়া বাক্যবাণ বর্ষণ করিলেন। বলা বাহুল্য, কৈফিয়তটির মধ্যে সত্যের বালাই ছিল না।

হেডমাস্টারের চোখ কৌতুকে নাচিয়া উঠিল। তাহার একটা কারণ, যদুবাবু কোনোদিনই বাগ্মী নহেন, বর্তমানে ভয় পাইয়া যে কথাগুলি বলিলেন, সেগুলির ইংরেজি বারো আনা ভুল। অথচ যদুবাবু ব্যাকরণ পড়ান ক্লাসে—ইংরেজির কী কী ভুল হইল, তিনি নিজেও তাহা বলিবার পরক্ষণেই বুঝিয়া লজ্জিত হইয়াছেন, কিন্তু বলিবার সময় কেমন হইয়া যায় সাহেবের সামনে।

হেডমাস্টার বলিলেন, আপনি প্রায়ই ও-রকম করে থাকেন কিনা সে সব এখানে বিচার্য বিষয় নয়। আপনার কর্তব্য-কর্মে অবহেলা একবারও আমি ক্ষমা করিতে পারি নে।

নারাণবাবু উঠিয়া বলিলেন, এবার আমাদের অনুরোধটা রাখুন স্যার।

—আচ্ছা, আমি একজনের সম্বন্ধে সে অনুরোধ মানলাম। কারণ, তাঁর বাড়িতে গুরুতর পারিবারিক কারণ আছে তিনি বলচেন। একজন শিক্ষক মিথ্যে কথা বলচেন, এ রকম ধরে নেওয়ার কোনো কারণ নেই। কিন্তু আমি থার্ড পণ্ডিতকে জিজ্ঞেস করি, তাঁর কী কারণ ছিল ঘন ঘন ঘড়ি দেখবার? তিনি স্কুলেই থাকেন। তাঁর কোনো তাড়াতাড়ি দেখি না। তাঁকে ক্ষমা করতে পারি না, তাঁকে আমি সাসপেন্ড করলাম।

থার্ড পণ্ডিত এবার দাঁড়াইয়া কাঁদো-কাঁদো সুরে বাংলায় বলিলেন, (তিনি ইংরেজি জানেন না, সাহেব, এবার আমায় ক্ষমা করুন, আমি এমন আর কখনও করব না।

ক্ষেত্রবাবু ভাবিলেন, খুব বাঁচিয়া গিয়াছি এ যাত্রা। আমিও যে ঘড়ি দেখিতে পাঠাই, সেটা কেহ জানে না।

হেডমাস্টার ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন, আমার হুকুম নড়ে না। ছেলেদের প্রতি কর্তব্যপালন আগে করতে হবে, তারপর ব্যক্তিগত দয়া-দাক্ষিণ্য। সামনের বুধবারে স্কুল কমিটির মিটিং আছে, সেখানে আমি আপনার কথা ওঠাব। কমিটির অনুমতি নিয়ে আপনার শাস্তির ব্যবস্থা হবে। আপনি কাল থেকে আর ক্লাসে যাবেন না। কত দিন আপনাকে সাসপেন্ড করা হবে, সেটা কমিটি ঠিক করবেন।

সভা ভঙ্গ হইল। হেডমাস্টার গট গট করিয়া আপিস ছাড়িয়া নিজের ঘরে গিয়া ঢুকিলেন। মাস্টারেরাও একে একে সরিয়া পড়িলেন—তাঁহারা যদি কিছু বলেন, ফুটপাথে গিয়া বলিবেন।

সন্ধ্যার সময় ক্লার্কওয়েল সাহেব মোটরে খয়রাগড়ের রাজকুমারকে পড়াইতে চলিয়া গেলেন ল্যান্সডাউন রোডে। মোটা টাকার টুইশানি, তাহারাই মোটর পাঠাইয়া লইয়া যায়। সাহেব বাহির হইয়া যাইবার পরে মিস সিবসন ঘরে বসিয়া সেলাই করিতেছে, এমন সময়  দরজার বাহিরে খুস-খুস শব্দ শুনিয়া বলিল, হু? কোন হ্যায়?

বিনম্র সঙ্কোচে পর্দা সরাইয়া থার্ড পণ্ডিত একটুখানি মুখ বাহির করিয়া উঁকি মারিয়া বলিলেন, আমি মেমসাহেব।

—ও, পাণ্ডিট! কাম ইন। হোয়াট’স হোয়াট?

থার্ড পণ্ডিত হাত জোড় করিয়া কাঁদো-কাঁদো সুরে বলিলেন, সাহেব আমাকে সাসপেন্ড করেচেন।

—বেগ ইওর পার্ডন?

থার্ড পণ্ডিত ‘সাসপেন্ড’ কথাটার উপর জোর দিয়া কথা বলিয়া নিজের দিকে আঙুল দিয়া দেখাইয়া বলিলেন—মি, হাম—

মিস সিবসন আসলি বিলাতি, নানা দুর্ভাগ্যের মধ্যে পড়িয়া ক্লার্কওয়েল সাহেবের স্কুলে চাকরি লইতে বাধ্য হইয়াছে। বুদ্ধিমতী মেয়ে, ব্যাপারটা বুঝিয়া হাসিয়া বলিল, ওয়েল—

—ইউ মাদার—আই সন—সাহেবকে বলুন মা—

—ইয়েস, আই প্রমিস টু—

—হ্যাঁ, মা, বুড়ো হয়েছি—ওল্ড ম্যান (থার্ড পণ্ডিত নিজের মাথার সাদা চুলে হাত দিয়া দেখাইলেন) না খেয়ে মরে যাব—(মুখের কাছে হাত লইয়া গিয়া খাওয়ার অভিনয় করিয়া হাত নাড়িয়া না-খাওয়ার অভিনয় করিলেন) ইট নট—

মেমসাহেব হাসিয়া বলিলেন, আই আন্ডারস্ট্যান্ড পাণ্ডিট।

—নমস্কার মাদার।

থার্ড পণ্ডিত চলিয়া আসিলেন।

.

যদুবাবু ছুটি হইলে মলঙ্গা লেনের বাসাটায় ফিরিয়া গেলেন। দশ টাকা মাসিক ভাড়ায় একখানি মাত্র ঘর দোতলায়—এক বাড়িতে আরও তিনটি পরিবারের সঙ্গে বাস। যদুবাবুর স্ত্রী দুইখানি রুটি ও একটু পেঁপের তরকারি আনিয়া সামনে ধরিলেন। যদুবাবু গোগ্রাসে সেগুলি গিলিয়া বলিলেন, আর একটু  জল

যদুবাবু নিঃসন্তান। ত্রিশ টাকা মাহিনায় ও দুই-একটি টুইশানির আয়ে স্বামী-স্ত্রীর কায়ক্লেশে চলিয়া যায়।

জল পান করিয়া যদুবাবু একটু সুস্থ হইয়া তামাক ধরাইলেন।

যদুবাবুর স্ত্রী একসময়ে রূপসী বলিয়া খ্যাত ছিল, এখন নানা দুঃখকষ্টে সে রূপের কিছুই প্রায় অবশিষ্ট নাই আর, প্রায় সকল বন্ধ্যা স্ত্রীলোকের মতই স্বামীর উপর তাহার টানটা বেশি। স্বামীর কাছে বসিয়া বলিল, তোমার বড় শালির বাড়ি থেকে চিঠি এসেছে, ছেলের অন্নপ্রাশন, যাবে নাকি?

এ যে একটু বক্রোক্তি, যদুবাবু সেটা বুঝিলেন। এটি যদুবাবুর স্ত্রীর বৈমাত্রেয় দিদি, সকলে বলে এই মেয়েটির রূপ দেখিয়া যদুবাবু নাকি একদিন মুগ্ধ হইয়াছিলেন, তাহাকে বিবাহ করিবার চেষ্টাও করিয়াছিলেন; কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঘটে নাই। যদুবাবুর স্ত্রী খোঁচা দিতে ছাড়ে না এখনও।

—তুমি যাও। এখন মুর্শিদাবাদ যাই সে সময় কই? ওরা নিতে আসবে?

—তা জানি নে। তারা এখন বড়লোক, যদিই ধরো গরিব কুটুম্বুর অত তোয়াজ না করে? চিঠি একখানা দিয়েছে, এই যথেষ্ট।

—তা হলে যাওয়া হবে না। ভাড়ার টাকা, তারপর ধর নকুতো কিছু একটা দিতে হবে— সে হয় না।

—আমার কাছে কিছু আছে—তবে তুমি যদি না যাও, আমি যাব না।

—আমি ছুটি পাব না। আলম ব্যাটা বড্ড লাগাচ্ছে আমার নামে সাহেবের কাছে। আজ তো এক কাণ্ডতে বেধে গিয়েছিলাম আর কি, অতি কষ্টে সামলেছি। আমার হবে না। তুমি বরং যাও।

এমন সময় বাহির হইতে নারাণবাবুর গলা শোনা গেল—ও যদু, আছ নাকি?

—আসুন, আসুন নারাণদা—

নারাণবাবু ঘরে ঢুকিয়া যদুবাবুর স্ত্রীর দিকে চাহিয়া বলিলেন, বউঠাকরুণ, একটু চা খাওয়াতে পার?

যদুবাবুর স্ত্রী ঘোমটার ফাঁকে যদুবাবুর দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে চাহিলেন—অর্থাৎ চা নাই, চিনি নাই, দুধ নাই। অর্থাৎ যদুবাবু বাড়িতে চা খান না।

যদুবাবু বলিলেন, বসুন নারাণদা, আমি একটু আসচি।

নারাণবাবু হাসিয়া বলিলেন, আসতে হবে না ভায়া, আমি সব এনেছি পকেটে, এই যে—আমি খাই কিনা, সব আমার মজুত আছে। তোমার এখানে আসব বলে পকেটে করে নিয়েই এলাম। এই নাও বউঠাকরুণ।

—তারপর দেখলেন তো কাণ্ডখানা?

—ও তো দেখেই আসছি। নতুন আর কী বল!

—আমায় কী রকম অপমানটা—

—আরে, তুমি যে ভায়া, গায়ে পেতে নিলে, ওটা আসলে থার্ড পণ্ডিতকে লক্ষ্য করে বলছিল সাহেব।

—না না, আপনি জানেন না, আমাকেও বলছিল ওই সঙ্গে।

—কিছু না, তোমার হয়েচে—ঠাকুরঘরে কে? না, আমি তো কলা খাই নি। তুমি কেন বলতে গেলে ও-কথা?

—যাক, তা নিয়ে তর্ক করে কোনো লাভ নেই। ও যেতে দিন।

চা-পান শেষ করিয়া দুইজনে উঠিলেন। টুইশানির সময় সমাগত।

.

যদুবাবু শাঁখারিটোলায় এক বাড়িতে টুইশানিতে গেলেন। নীচের তলায় অন্ধকার ঘর, তিনটি ছেলে একসঙ্গে পড়ে। ভীষণ গরম ঘরের মধ্যে, কেমন একটা ভ্যাপসা গন্ধ আসে পাশের সিউয়ার্ড ডিচ হইতে। দুইটি ঘণ্টা তাহাদের পড়া বলিয়া ক্লাসের টাস্ক লিখাইয়া দিতে রাত আটটা বাজিল। আর একটা টুইশানি নিকটেই, যদু শ্রীমানীর লেনে। সেখানে একটি ছেলে—ম্যাট্রিক ক্লাসে পড়ে, বেশ একটু নির্বোধ অথচ পড়াশুনায় মন খুব। এমন ধরনের ছেলেরাই প্রাইভেট টিউটরকে ভোগায় বেশি। এ ছেলেরা এই অঙ্ক কষাইয়া লয়, ওটার ভাবাংশ লিখাইয়া লয়—খাটাইয়া ফরমাশ দিয়া যদুবাবুকে রীতিমত বিরক্ত করিয়া তোলে প্রতি দিন। ক্লার্কওয়েল সাহেবকে ফাঁকি দেওয়া চলে, কিন্তু প্রাইভেট টুইশানির ছাত্র বা ছাত্রের অভিভাবকদের ফাঁকি দেওয়া বড়ই কঠিন।

রাত পৌনে দশটার সময় যদুবাবু উঠিবার উদ্যোগ করিতেছেন, এমন সময় ছেলেটি বলিল, একটু বাকি আছে স্যার। কাল ইংরেজি থেকে বাংলা রিট্রানস্লেশন (বারো আনা শিক্ষক ও ছাত্র এই ভুল কথাটি ব্যবহার করে) রয়েচে, বলে দিয়ে যান।

যদুবাবুর মাথা তখন ঘুরিতেছে। তিনি বলিলেন, আজ না হয় থাক।

—না স্যার। বকুনি খেতে হবে, বলে দিয়ে যান।

—কই, দেখি। এতটা? এ যে ঝাড়া আধ ঘণ্টা লাগবে! আচ্ছা, এস তাড়াতাড়ি। আমি বলে যাই, তুমি লিখে নাও।

নির্বোধ ছাত্রকে লিখাইয়া দিতেও প্রায় আধ ঘণ্টা লাগিয়া গেল। রাত সাড়ে দশটার সময় ক্লান্ত বিরক্ত যদুবাবু আসিয়া বাড়ি পৌঁছিলেন ও যা-হয় দুটি মুখে দিয়াই শয্যা আশ্রয় করিলেন।

.

পরদিন স্কুলে ক্লার্কওয়েল সাহেব জ্যোতির্বিনোদ মহাশয়কে ডাকাইয়া বলিলেন, পণ্ডিত, তুমি মেমসাহেবের কাছে কেন গিয়েছিলে? চাকরি তোমার বন্ধ আছে আমার হুকুমে, তা রদ হবে না।

জ্যোতির্বিনোদ ইংরেজি বোঝেন না, কিন্তু আন্দাজ করিয়া লইলেন, সাহেবকে মেমসাহেব কোনো কথা বলিয়া থাকিবে, তাহার ফলেই এই ডাক। তিনি হাত জোড় করিয়া বলিলেন, সাহেব মা-বাপ, আপনি না রাখলে কে রাখবে। আমি এমন কাজ আর কখনও করব না।

হেডমাস্টারের মুখে ঈষৎ হাসির আভাস দেখিয়া জ্যোতির্বিনোদের মনে আশ্বাস জাগিল। সাহস পাইয়া তিনি হেডমাস্টারের টেবিলের সামনে আগাইয়া গিয়া বলিলেন, এবার আমায় মাপ করুন,—ব্রাহ্মণ—আমার অন্ন—

হেডমাস্টার টেবিলের উপর কিল মারিয়া বলিলেন, ব্রাহ্মণ আমি মানি না। আমার কাছে হিন্দু-মুসলমান সমান।

জ্যোতির্বিনোদ চুপ করিয়া রহিলেন—ইংরেজি বুঝিয়াছিলেন বলিয়া নয়, টেবিলে কিল মারার দরুণ ভাবিলেন, সাহেব যে কারণেই হোক চটিয়াছেন।

হেডমাস্টার ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া বলিলেন, ওয়েল?

জ্যোতির্বিনোদ পুনরায় হাত জোড় করিয়া বলিলেন, আমায় মাপ করুন এবার।

—আচ্ছা, যাও এবার, ও-রকম আর না হয়, তা হলে মাপ হবে না।

জ্যোতির্বিনোদ সাহেবকে নমস্কার করিয়া আপিস হইতে নিষ্ক্রান্ত হইলেন।

কিন্তু ব্যাপারটা অত সহজে মিটিল না। স্কুল বসিবার পর মিঃ আলম শুনিয়া হেডমাস্টারকে বুঝাইলেন, এ রকম করিলে এ স্কুলে ডিসিপ্লিন রাখা যাইবে না—মাস্টাররা স্বভাবতই ফাঁকিবাজ, আরও ফাঁকি দিবে। অতএব সারকুলার বাহির করিয়া থার্ড পণ্ডিতকে মাপ করা হোক। কী জন্য সাসপেণ্ড করা হইয়াছিল, তাহার কারণ এবং ভবিষ্যতের জন্য সতর্কতা অবলম্বন করিবার উপদেশ লিপিবদ্ধ করা থাক সারকুলার-বহিতে। ইহাতে পণ্ডিত জব্দ হইয়া যাইবে।

হেডমাস্টারের কর্ণদ্বয় মিঃ আলমের জিম্মায় থাকিত, সুতরাং সেই মর্মেই সারকুলার বাহির হইয়া গেল। অন্যান্য শিক্ষকেরা জ্যোতির্বিনোদকে ভয় দেখাইল, চাকুরি এবার থাকিল বটে, তবে বেশি দিনের জন্য নয়, এই সারকুলার স্কুলের সেক্রেটারি বা কমিটির কোনো মেম্বারের চোখে পড়িলেই চাকুরি যাইবে।

.

ক্ষেত্রবাবু পড়াইতেছেন, হেডমাস্টার সেখানে গিয়া পিছনের বেঞ্চির একটা ছেলেকে হঠাৎ ডাক দিয়া বলিলেন, তুমি কী বুঝেছ বল?

সে কিছুই শোনে নাই, পাশের ছেলের সঙ্গে গল্পে মত্ত ছিল, তীক্ষ্ণদৃষ্টি ক্লার্কওয়েলের নজর এড়ানো সহজ কথা নয়।

হেডমাস্টার ক্ষেত্রবাবুর দিকে চাহিয়া বলিলেন, ডোন্ট সিট অন ইওর চেয়ার লাইক এ বাহাদুর—ছেলেরা কিছু শুনছে না। উঠে উঠে দেখুন, কে কী করচে না-করচে!

ক্ষেত্রবাবু ছেলেদের সামনে তিরস্কৃত হওয়ায় নিজেকে অপমানিত বিবেচনা করিলেন বটে, কিন্তু সাহেবের কাছে বিনীতকণ্ঠে অঙ্গীকার করিতে হইল যে, তিনি ভবিষ্যতে দাঁড়াইয়া ও ক্লাসে পায়চারি করিতে করিতে পড়াইবেন।

সাহেবের জের এখানেই মিটিবার কথা নয়। সেদিন স্কুল ছুটির পর টিচারদের মিটিং আহূত হইল। সাহেবের উপদেশবাণী বর্ষিত হইল। ছেলেদের স্বার্থ বজায় রাখিয়া যিনি টিকিতে পারিবেন, এ স্কুলে তাঁহারই শিক্ষকতা করা চলিবে; যাঁহার না পোষাইবে, তিনি চলিয়া যাইতে পারেন—স্কুলের গেট খোলা আছে।

বেলা সাড়ে পাঁচটায় হেডমাস্টারের সভা ভাঙিল। মাস্টারেরা বাহিরে আসিয়া নানা প্রকার মন্তব্য প্রকাশ করিলেন। যদুবাবু লম্ভঝম্প শুরু করিলেন।

—রোজ রোজ এই বাজে হাঙ্গামা আর সহ্য হয় না—সাড়ে পাঁচটা বেজে গেল—টিউশানিতে যাবার আগে আর বাসায় যাওয়া হবে না দেখছি, কবে যে আপদ কাটবে, নারায়ণের কাছে তুলসী দিই। আপনারা সব চুপ করে থাকেন, বলেনও না তো কোনো কথা! সবাই মিলে বললে কি সাহেবের বাবার সাধ্যি হয় এমন করবার?

অন্য দুই-একজন বলিলেন, তা আপনিও তো কিছু বললেন না যদুদা!

—আমি বলব কি এমনি বলব? আমি যেদিন বলব, সেদিন সাহেবকে ঠ্যালা বুঝিয়ে দেব, আর ঠ্যালা বুঝিয়ে দেব ওই অন্ত্যজটাকে—ও-ই কুপরামর্শ দেয়। আর সাহেবের মতে অমন আইডিয়াল টিচার আর হবে না! মারো খ্যাংরা!

ক্ষেত্রবাবু বলিলেন, সে তো বোঝাই যাচ্ছে, কিন্তু ওকে নড়ানো সোজা কথা নয়। সাহেব ওর প্রশংসায় পঞ্চমুখ, আর সবাই খারাপ, কেবল আলম ভালো—

হেডপণ্ডিত বৃদ্ধ লোক, স্মৃতিভ্রংশ ঘটায় অনেক সময় অনেকের নাম মনে করিতে পারেন না : আর ভালো ওই মেমসাহেব—কী ওর যেন নামটা?

—মিস সিবসন।

—হ্যাঁ, ও খুব ভালো—

মাস্টাররা বিভিন্ন দিকে ছড়াইয়া পড়িলেন। ক্ষেত্রবাবু, যদুবাবু, নারাণবাবু ও ফণীবাবু প্রতিদিন ছুটির পরে নিকটবর্তী ছোট চায়ের দোকানে চা খাইতেন। বহুদিনের যাতায়াতের ফলে পিটার লেনের মোড়ের এই চায়ের দোকানটির সঙ্গে তাঁহাদের অনেকের স্মৃতি জড়াইয়া গিয়াছে। নিকট দিয়া যাইবার সময় কেমন যেন মায়া হয়।

ক্ষেত্রবাবুর মনে পড়ে তাঁহার চার বছরের ছেলেটির কথা। সেবার একুশ দিন ভুগিয়া টাইফয়েড রোগে মারা গেল। কত কষ্টভোগ, কত চোখের  জল ফেলা, কত বিনিদ্র রজনী যাপন! এই চায়ের দোকানে বসিয়া সহকর্মীদের সঙ্গে কত পরামর্শ করিয়াছেন, আজ পেট ফাঁপিলে, কী করিতে হইবে; আজ কথা আড়ষ্ট হইয়া আসিতেছে, কী করিলে ভালো হয়! এই চায়ের দোকানের সামনে আসিলেই খোকার শেষের দিনগুলি চোখের সামনে ভাসিয়া উঠে।

নারাণবাবুর স্মৃতি স্কুলের সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট। আগের হেডমাস্টার ছিলেন অনুকূলবাবু। তিনি ছিলেন ঋষিকল্প পুরুষ। দুজনে মিলিয়া এই স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন—খুব বন্ধুত্ব ছিল দুজনের মধ্যে। অনুকূলবাবুর অনুরোধে নারাণ চাটুজ্জে রেলের চাকরি ছাড়িয়া আসিয়া এই স্কুলে শিক্ষাব্রত গ্রহণ করেন। এই স্কুলকে  কলিকাতার মধ্যে একটি নামজাদা স্কুল করিয়া তুলিতে হইবে, এই ছিল সঙ্কল্প। একদিন দুইদিন নয়, দীর্ঘ পনেরো-ষোলো বৎসর ধরিয়া সে কত পরামর্শ, কত আশা-নিরাশার দোলা, কত অর্থনাশের উদ্বেগ! একবার এমন সুদিনের উদয় হইল যে, নারাণবাবুদের স্কুল কলিকাতার মধ্যে প্রথম শ্রেণীর স্কুল হইয়া গেল বুঝি। হেয়ার-হিন্দুকে ডিঙাইয়া সেবার এই স্কুলের এক ছাত্র ইউনিভার্সিটিতে প্রথম স্থান অধিকার করিল। নারাণবাবু দেড় শত টাকা বেতনে সুপারিন্টেন্ডেন্ট নিযুক্ত হইবেন, সব ঠিকঠাক—এমন সময় অনুকূলবাবু মারা গেলেন। সব আশাভরসা ফুরাইল। একরাশ দেনা ছিল স্কুলের, পাওনাদারেরা নালিশ করিল। গবর্নমেন্ট-নিযুক্ত অডিটার আসিয়া রিপোর্ট করিল, স্কুলের রিজার্ভ ফান্ডের টাকা ভূতপূর্ব হেডমাস্টার তছরূপ করিয়াছেন। বাড়িওয়ালা ভাড়ার দায়ে আসবাবপত্র বেচিয়া লইল। নতুন ছাত্র ভর্তি হইবার আশা থাকিলে হয়তো এতটা ঘটিত না, কিন্তু ছাত্র আসিত অনুকূলবাবুর নামে, তিনিই চলিয়া গেলেন, স্কুলে আর রহিল কে? জানুয়ারি মাসে আশানুরূপ ছাত্রের আমদানি হইল না, কাজেই পাওনাদারদের উপায়ান্তর ছিল না।

হেডপণ্ডিত চা খান না, তবু মাস্টারদের সঙ্গে দোকানে বসিয়া গল্পগুজব করিয়া চা-পানের তৃপ্তি উপভোগ করেন আজ বহু বৎসর হইতে। বলিলেন, চলুন নারাণবাবু, চা খাবেন না? আসুন যদুবাবু, ক্ষেত্রবাবু—

মাস্টার মহাশয়দের এ দোকানে যথেষ্ট খাতির। নিকটবর্তী স্কুলের মাস্টার বলিয়াও বটে, অনেকদিনের খরিদ্দার বলিয়াও বটে। দোকানি বেঞ্চ হইতে অন্য খরিদ্দারদের সরাইয়া দেয়, মাস্টার মহাশয়দের চায়ের প্রকৃতি কিরূপ হইবে, সে সম্বন্ধে খুঁটিনাটি প্রশ্ন করে, দুই-একটি ব্যক্তিগত প্রশ্নও করে আত্মীয়তা করিবার জন্য। অনেক সময় কাছে পয়সা না থাকিলে ধারও দেয়।

যদুবাবু বলিলেন, আমাকে একটু কড়া করে চা দিয়ো আদা দিয়ে।

নারাণবাবু বলিলেন, আমার চায়েও একটু আদা দিয়ো তো।

সকলের সামনে চা আসিল। সঙ্গে সঙ্গে পাশে একখানি করিয়া টোস্ট দিয়া গেল চায়ের পিরিচে প্রত্যেককে। দোকানিকে বলিতে হয় না, সে জানে, ইঁহারা কী খাইবেন, আজিকার খরিদ্দার তো নন।

স্কুলের হাড়ভাঙা খাটুনির পরে এবং যে যাহার টুইশানিতে যাইবার পূর্বে এখানটিতে বসিয়া আধ ঘণ্টা ধরিয়া চা খাওয়া ও গল্পগুজব প্রত্যেকের পক্ষে বড় আরামদায়ক হয়। বস্তুত মনে হয় যে, সারাদিনের মধ্যে এই সময়টুকুই অত্যন্ত আনন্দের। যাঁহারা চারিটা বাজিবার পূর্বে ঘড়ি দেখিতে পাঠান, তাঁহারা নিজেদের অজ্ঞাতসারে এই সময়টুকুরই প্রতীক্ষা করেন। তবে স্কুলমাস্টার হিসাবে ইঁহাদের দৃষ্টি সংকীর্ণ, জীবনের পরিধি সুপ্রশস্ত নয়, সুতরাং কথাবার্তা প্রতিদিন একই খাতে বাহিয়া চলে। সাহেব আজ অমুক ঘণ্টায় অমুকের ক্লাসে গিয়া কী মন্তব্য করিল, অমুক ছেলেটা দিন-দিন খারাপ হইয়া যাইতেছে, অমুক অঙ্কটা এ ভাবে না করিয়া অন্য ভাবে কী করিয়া ব্ল্যাকবোর্ডে করা গেল, ইত্যাদি।

ক্ষেত্রবাবু বলিলেন, মাসটাতে ছুটিছাটা একেবারেই নেই, না নারাণবাবু?

—কই আর! সেই ছাব্বিশে কী একটা মুসলমানদের পর্ব আছে, তাও যে ছুটি দেবে কিনা—

—ঠিক দেবে। মিঃ আলম আদায় করে নেবে।

—নাঃ, এক-আধ দিন ছুটি না হলে আর চলে না।

যদুবাবু বলিলেন, ওহে, হাফ কাপ একটা দাও তো। আজ চা-টা বেশ লাগচে—

চার পয়সার বেশি খরচ করিবার সামর্থ্য কোনো মাস্টারেরই নাই চায়ের দোকানে। যদুবাবুর এই কথায় দুই-একজন বিস্মিত হইয়া তাঁহার মুখের দিকে চাহিলেন। নারাণবাবু বলিলেন, কী হে যদু, দমকা খরচ করে ফেললে যে!

—খাই একটু নারাণদা! আর ক’দিনই বা!

যদুবাবু একটু পেটুক ধরনের আছেন, এ কথা স্কুলের সবাই জানে। বাজারহাট ভালো করিয়া করিতে পারেন না পয়সার অভাবে, সামান্য বেতনে বাড়িভাড়া দিয়া থাকিতে হয়—কোথা হইতে ভালো বাজার করিবেন! তবে নিমন্ত্রণ-আমন্ত্রণ পাইলে সেখানে দুইজনের খাদ্য একা উদরস্থ করেন, স্কুলে ইহা লইয়া নিজেদের মধ্যে বেশ হাসিঠাট্টা চলে।

নারাণবাবু বয়সে সর্বাপেক্ষা প্রবীণ, প্রবীণত্বের দরুন অপেক্ষাকৃত বয়ঃকনিষ্ঠদের প্রতি স্বাভাবিক স্নেহ জন্মিয়াছে তাঁহার মনে। তিনি ভাবিলেন, আহা খাক, খেতে পায় না, এই তো স্কুলে সামান্য মাইনের চাকরি; ভালোবাসে খেতে, অথচ কী ছাই বা খায়! মুখে বলিলেন, খাও আর একখানা টোস্ট। আমি দাম দেব। ওহে, বাবুকে একখানা টোস্ট দাও—এখানে।

যদুবাবু হাসিয়া বলিলেন, নারাণদা আমাদের শিবতুল্য লোক। তা দাও আর একখানা, খেয়ে নিই।

খাওয়া শেষ করিয়া সকলে বিড়ি বাহির করিলেন। যে সময়ের কথা বলিতেছি, তখন দেশলাই পয়সায় দুইটা; তৎসত্বেও কেহ দেশলাই রাখেন না পকেটে, দোকানির নিকট হইতে চাহিয়া কাজ সারিলেন।

নারাণবাবু বলিলেন, চল যাই ছটা বাজে।

যদুবাবু বলিলেন, বাসায় আর যাওয়া হল না, এখন যাই গিয়ে শাঁকারিটোলা, ঢুকি ছাত্রের বাড়ি।

ক্ষেত্রবাবু বলিলেন, আমি যাব সেই ক্যানাল রোড, ইটিলি—আমার ছাত্রেরা আবার সেখানে উঠে গিয়েচে।

নারাণবাবুও ছেলে পড়ান, তবে বেশি দূরে নয়, নিকটেই প্রমথ সরকারের লেনে, সরকারদের বাড়িতেই। বাহিরের ঘরে বুড়া যোগীন সরকার বসিয়া আছেন, নারাণবাবুকে দেখিয়া বলিলেন, আসুন, মাস্টারমশায় আসুন। তামাক খান। বসুন।

—চুনি পান্না খেলে বাড়ি ফিরেচে?

—চুনি ফিরেচে, পান্নার দেখা নেই এখনও। হতচ্ছাড়া ছেলে মাঠে একবার গেলে তো কাণ্ডজ্ঞান থাকে না—বলই পিটছে, বলই পিটছে! দুটো নাতিই সমান। বসুন, তামাক খান, আসচে।

কিন্তু ছাত্রেরা না আসিলে চলে না। নারাণবাবুকে দুইটা টুইশানি সারিয়া আবার স্কুলে ফিরিতে হইবে, কিছুক্ষণ সাহেবের সঙ্গে বসিয়া মোসাহেবি গল্পও করিতে হইবে।

এমন সময়ে চুনি আসিয়া ডাকিল, মাস্টারমশায়, আসুন।

চুনি তেরো বছরের বালক, সিকসথ ক্লাসে পড়ে। নারাণবাবু নিঃসন্তান, বিপত্নীক—ছেলেটিকে বড় স্নেহ করেন। চুনি দেখিতেও খুব সুন্দর ছেলে, টকটকে ফরসা রঙ, লাবণ্যমাখা মুখখানি, তবে স্বভাব বিশেষ মধুর নয়। কথায় কথায় রাগ, স্নেহ-ভালোবাসার ধার ধারে না—কেহ স্নেহ করিলে বোঝেও না, সুতরাং প্রতিদানেরও ক্ষমতা নাই। বড়লোকের ছেলে, একটু গর্বিতও বটে।

চুনি নিজের পড়ার ঘরে আসিয়া বলিল, আজ একগাদা অঙ্ক দিয়েছেন ক্ষেত্রবাবু, আমায় সব বলে দিতে হবে।

—হবে, বার কর খাতা বই।

—আপনি কখন চলে যাবেন?

—কেন রে?

—আজ আধ ঘণ্টা বেশি থাকতে হবে স্যার।

—থাকব, থাকব। তোর যদি দরকার হয়, থাকব না কেন? তোর কথা ফেলতে পারি না—

—মাস্টার বাড়িতে রাখা ওই জন্যেই তো। এতগুলো করে টাকা মাইনে দিতে হয় আমাদের ফি মাসে শুধু প্রাইভেট মাস্টারদের—কাকা বলছিলেন আজ সকালে।

কথাটা নারাণবাবুর লাগিল। তিনি আত্মীয়তা করিতে গেলে কী হইবে, চুনি সে সব বোঝে না, উড়াইয়া দেয়—পয়সা দেখায়।

ধমক দিয়া বলিলেন, তোর সে কথায় থাকার দরকার কী চুনি? অমন কথা বলতে নেই টিচারকে ছিঃ!

চুনি অপ্রতিভ মুখে নিচু হইয়া খাতার পাতা উল্টাইতে লাগিল। সুন্দর মুখে বিজলির আলো পড়িয়া উহাকে দেববালকের মত লাবণ্য-ভরা অথচ মহিমময় দেখাইতেছে। ইহারা আসে কোথা হইতে, কোন স্বর্গ হইতে? কে ইহাদের মুখ গড়ায় চাঁদের সব সুষমা ছানিয়া ছাঁকিয়া নিঙড়াইয়া?

নারাণবাবু দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিলেন। কোথায় যেন পড়িয়াছিলেন, কোন কবির  লেখা একটি ছত্র—‘যৌবনেরে দাও রাজটিকা’—

সত্য কথা। যৌবন পার হইয়া গিয়াছে বহুদিন, আজ আটান্ন বছর বয়স—ষাটের দুই কম। ডাক তো আসিয়াছে, গেলেই হয়! কী করিলেন সারা জীবন? স্কুল-স্কুল করিয়া সব গেল। নিজের বলিতে কিছু নাই। আজ যদি চুনির মত একটা ছেলে—

‘যৌবনেরে দাও রাজটিকা’—সারা দুনিয়ার সমস্ত আশা-ভরসা আমোদ-আহ্লাদ আজ অপেক্ষমাণ বশ্যতার সঙ্গে এই বালকের সম্মুখে বিনম্রভাবে দাঁড়াইয়া, কত কর্মভার-বিপুল দিবসের সঙ্গীত বাজিবে উহার জীবনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে, কত অজানা অনুভূতির বিকাশ ও কর্মপ্রেরণা! চুনির সঙ্গে জীবনবিনিময় করা যায় না—এই তেরো বছরের বালকের সঙ্গে?

—স্যার, ছুটির ইংরিজি কী হবে? আজ আমাদের ছুটি—এর কী ট্রানস্লেশন করব স্যার?

—আজ আমাদের ছুটি, আজ আমাদের ছুটি—কিসের মধ্যে আছে দেখি? বেশ। কর। আজ—টু ডে, আমাদের—আওয়ার, ছুটি—হলি-ডে—

—টু ডে আওয়ার হলি-ডে?

—দূর, ক্রিয়া কই! ইংরিজিতে ভার্ব না দিলে সেন্টেন্স হয় কখনও? কতবার বলে দিয়েচি না?

এমন সময় ঘরে ঢুকিল পান্না—চুনির ছোট ভাই। তাহার বয়স এগারো কিন্তু চুনির চেয়েও সে দুষ্ট ও অবাধ্য, বাড়ির কাহারও কথা শোনে না, কেবল নারাণবাবুকে একটু ভয় করিয়া চলে; কারণ স্কুলে নারাণবাবুর হাতে বড় মার খায়। ইহাকে তিনি তত ভালোবাসেন না।

পান্না ঘরে ঢুকিয়া অপরাধীর দৃষ্টিতে মাস্টারের দিকে চাহিল, তারপর শেলফের কাছে গেল বই বাহির করিতে।

নারাণবাবু কড়া সুরে বলিলেন, কোথায় ছিলে?

—খেলছিলাম স্যার।

—কটা বেজেছে হুঁশ আছে?

পড়ার ঘরেই ঘড়ি আছে দেওয়ালে। পান্না সেদিকে চাহিয়া দেখিল, সাড়ে ছয়টা বাজিয়াছে। সুতরাং সে বলিল, সাড়ে ছ’টা স্যার।

—হুঁঃ, গাধা কোথাকার! সাড়ে ছ’টা, না সাড়ে সাতটা? বল কটা বেজেছে? ভালো করে দেখে বল!

—সাড়ে সাতটা।

—ঠিক হয়েচে। এই বল খেলে এলে! কাল পড়া না হলে তোমার কী করি দেখো।

চুনি বলিল, স্যার, আজ দুপুরে বেরিয়ে গিয়েচে, এই এল।

পান্না দাদার দিকে চাহিয়া বলিল, লাগানো হচ্ছে স্যারের কাছে? তোর ওস্তাদি আমি বার করে দেব বলচি।

—দে না দেখি? তোর বড় সাহস!

—এই মারলাম। কী করবি তুই?

নারাণবাবু বৃদ্ধ, দুই বলিষ্ঠ বালকের মধ্যে পড়িয়া যুদ্ধ তো থামাইতে পারিলেনই না, অধিকন্তু চশমাটি চূর্ণবিচুর্ণ হইবার সম্ভাবনা প্রবল হইয়া উঠিল।

দেখিতে দেখিতে পান্না ড্রয়ারের ভিতর হইতে টর্চলাইট বাহির করিয়া চুনির মাথায় এক ঘা বসাইয়া দিল। ফিনকি দিয়া রক্ত ছুটিল।

চুনি হাউমাউ করিয়া কাঁদিবার ছেলে নয়, সে চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল; নারাণবাবু হাঁ-হাঁ করিয়া আসিয়া পড়িতে না পড়িতে এই কাণ্ডটি ঘটিয়া গেল।

গোলমাল শুনিয়া চুনি-পান্নার মা, বিধবা পিসি ও দুই ভাই-বউ অন্তঃপুরের দিকের ঘরের দরজায় আসিয়া দাঁড়াইল। চুনিকে জিজ্ঞাসা করিয়া তাহার কোনো উত্তর না পাইয়া মাস্টারের উদ্দেশে নানাপ্রকার মন্তব্য প্রকাশ করিতে লাগিল—ও মা, মাস্টার তো বসে আছে, তার চোখের সামনে ছেলেটাকে একেবারে খুন করে ফেললে গো!

অন্য একটি বধূ মন্তব্য করিল, মাস্টারকে মানে না দিদি, ছেলেগুলো ভারি দুষ্টু।

চুনির মা বলিলেন, মাস্টার বসে বসে আফিম খেয়ে ঝিমোয়, তা ওকে মানবে কী করে?

নারাণবাবু মনে মনে ক্ষুব্ধ হইলেও মুখে বাড়ির স্ত্রীলোকদের উদ্দেশে কী বলিবেন? কে তাঁহাকে আফিম খাওয়াইয়াছে শুনিবার তাঁহার বড় কৌতূহল হইল।

চুনিকে লইয়া তাহার মা ও পিসিমা চলিয়া গেলে নারাণবাবু রাগের মাথায় পান্নাকে গোটা দুই চড় কষাইলেন, সে চুপ করিয়া রহিল। বাড়ির মধ্যে খুব একটা গোলমাল হইল কিছুক্ষণ ধরিয়া, তাহার পর ব্যান্ডেজ-বাঁধা মাথায় চুনি এক পেয়ালা চা-হাতে বাহিরের ঘরে আসিয়া হাজির হইল। সব মিটিয়া গেল, দুই ভাইয়ের সম্মিলিত উচ্চ কণ্ঠস্বরে নৈশ-গগন বিদীর্ণ হইতে লাগিল।

চুনির মুখের দিকে চাহিয়া নারাণবাবুর বড় মায়া হইল। অবোধ বালক! কেন মারামারি করে তাও জানে না, নিজের ভালোমন্দ নিজেরা বোঝে না। মিছামিছি সন্ধ্যার সময় মার খাইয়া মরিল!

স্নেহপূর্ণ কণ্ঠে বলিলেন, লেগেছে চুনি খুব?

চুনি বলিল, আধ ইঞ্চি ডিপ হয়ে কেটে গিয়েচে।

—ব্যান্ডেজ বাঁধলে কে?

—পিসিমা।

—উনি জানেন?

—চমৎকার জানেন। কেন, ভালো হয় নি?

নারাণবাবুর ইচ্ছা হইল, চুনিকে কোলে টানিয়া লইয়া আদর করেন, তাহাকে সান্ত্বনা দেন। কিন্তু লজ্জায় পারিলেন না। চুনি ঘ্যানঘেনে ধরনের ছেলে নয়; মার খাইয়া নালিশ করিতে জানে না। এই রকম ‘স্টোইক’ ধরনের ছেলে নারাণবাবু তার দীর্ঘ শিক্ষক-জীবনে যতগুলি দেখিয়াছেন, এক অঙ্গুলির পর্বগুলির মধ্যেই তাহাদের গণনার পরিসমাপ্তি ঘটে। চুনি সেই অতি অল্পসংখ্যক ছেলেদের একজন। চুনিকে এই জন্যই এত ভালো লাগে তাঁর!

এই সময় চুনির বাবা বাহির হইতে আসিয়া ঘরে ঢুকিয়া বলিলেন, মাস্টার যে! ও কী, ওর মাথায় কী?

নারাণবাবু সব কথা বলিলেন।

চুনির বাবার হৃদ্যতা কর্পূরের মত উবিয়া গেল। তিনি বিরক্তির সুরে বলিলেন, আপনি বসে থাকেন, আর প্রায়ই আপনার চোখের সামনে এ রকম কুরুক্ষেত্র কাণ্ড ঘটে, আপনি দেখেন না?

—আজ্ঞে, দেখব না কেন? সামান্য কথাবার্তা থেকে মারামারি। আমি এসে পড়ে ছাড়িয়ে দিই, তবে—

—আপনি একটু ভালো করে দেখাশুনো করবেন বলেই তো রাখা। নইলে গ্রাজুয়েট মাস্টার দশ টাকাতেও পাওয়া যায়। দু বেলা পড়াবে।

—আজ্ঞে, আমি দেখি। দেখি না, তা ভাববেন না।

—আমি সব সময় দেখতে পারি নে, নানা কাজে ঘুরি। কিন্তু আপনার দ্বারা দেখচি—আপনার বয়স হয়েছে।

এই সময় চুনি যদি তাহার বাবাকে বলিত—বাবা, স্যারের কোনো দোষ নেই, আমারই সব দোষ, তাহা হইলে নারাণবাবুর মনের মত কাজ হইত; নারাণবাবু এই ভাবিয়া সপ্তস্বর্গ প্রাপ্ত হইতেন যে, চুনি তাঁহার অগাধ স্নেহের প্রতিদান দিল।

কিন্তু যাহা আশা করা যায়, তাহা হয় না।

চুনি চুপ করিয়া রহিল। বাবাকে তাহারা দুই ভাই যমের মত ভয় করে।

চুনির বাবা বলিলেন, মাস্টার, বোস। আমি আসচি, চা খেয়েচ?

এইবার চুনি মুখ তুলিয়া বলিল, হ্যাঁ বাবা, আমি এনে দিয়েছি।

চুনির এ কথাটা নারাণবাবুর ভালো লাগিল না। চুনি এ কথা কেন বলিতেছে, নারাণবাবু তাহা বুঝিতে পারিলেন। পাছে তাহার বাবা গিয়া আর এক কাপ চা মাস্টারের জন্য পাঠাইয়া দেন, সে জন্য। কেন এক পেয়ালা চা বেশি দেওয়া হইবে মাস্টারকে?

নারাণবাবু বাসায় ফিরিলেন, তখন রাত নয়টা। নিজের ছোট ঘরটায় চাবি খুলিয়া রান্না চাপাইয়া দিলেন, তারপর যোগবাশিষ্ঠ রামায়ণখানা লইয়া পড়িতে বসিলেন। এই সময়টাই বেশ লাগে সারাদিনের খাটুনির পরে। আজ স্কুলের এই ঘরে নারাণবাবু আছেন উনিশ বছর। বহুকাল হইল তাঁহার পত্নী স্বর্গগমন করিয়াছেন, নারাণবাবু আর বিবাহ করেন নাই—পত্নীর স্মৃতির প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য যত না হোক, গরিব-স্কুল-মাস্টার-জীবনে খরচ চালাইতে পারিবেন না বলিয়াই বেশি।

উনিশ বৎসরের কত স্মৃতি এই ঘরের সঙ্গে জড়ানো।

যখন প্রথম এই স্কুলে অনুকূলবাবু তাঁহাকে লইয়া আসেন, তখন এই ঘরে আর একজন বৃদ্ধ মাস্টার ভুবনবাবু থাকিতেন। ভুবনবাবুর বাড়ি ছিল মুর্শিদাবাদ—ভদ্রলোক বিবাহ করেন নাই, সংসারে এক বিধবা ভগ্নী ছাড়া তাঁহার আর কেহ ছিল না। একদিন বিছানায় লোকটি মরিয়া পড়িয়া ছিল এই ঘরেই। স্কুলের খরচে ভুবনবাবুর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয়।

নারাণবাবু ভাবেন, তাঁহার অদৃষ্টেও তাহাই নাচিতেছে। তাঁহারও কেহ নাই, স্ত্রী নাই, পুত্র নাই, ভাই নাই, ভগ্নী নাই—এই ঘরটি আশ্রয় করিয়া আজ বহুদিন কাটাইয়া দিলেন। এখন এমন হইয়া গিয়াছে, এই ঘর ও এই স্কুলের বাহিরে তাঁহার যেন আর কোনো স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নাই। জীবনের একমাত্র কর্মক্ষেত্র এই স্কুল। স্কুলের বিভিন্ন ক্লাসে রুটিন অনুযায়ী কোনদিন কী পড়াইবেন, নারাণবাবু সকালে বসিয়া ঠিক করেন।

কাল থার্ড ক্লাসে ললিত ছেলেটা ইংরেজি গ্রামারের ‘দি’র ব্যবহার সম্বন্ধে অজ্ঞতা প্রকাশ করিয়াছে, নারাণবাবুর প্রাণে তাহাতে এমন একটা ধাক্কা লাগিয়াছে, সে বেদনা নিতান্ত বাস্তব। নারাণবাবু জানেন যে ‘দি’ ব্যবহার করিতে না পারিলে থার্ড ক্লাসের ছেলে হইয়া সে ইংরেজি ব্যাকরণ শিখিল কী? কাল নারাণবাবু তখনই নোট-বইতে লিখিয়া লইয়াছেন, ‘‘থার্ড ক্লাস ললিতমোহন কর, ডেফিনিট আর্টিকল ‘দি’।’’—এইটুকু মাত্র দেখিলেই তাঁহার মনে পড়িবে।

তাহার পর আজ সেই ললিতকে ঝাড়া আধ ঘণ্টা ধরিয়া জিনিসটা শিখাইয়া দিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই হইল না। ললিত কর ‘যে আঁধারে সে আঁধারে’ই রহিয়াছে। কী করা যায়? তাঁহার শিখাইবার প্রণালীর কোনো দোষ ঘটিতেছে নিশ্চয়। কী করিলে ললিত ছোঁড়াটা ‘দি’ ব্যবহার শিখিতে পারে?

নারাণবাবু হুঁকায় তামাক খাইতে খাইতে চিন্তা করিতেছিলেন, হঠাৎ তাঁহার মনে পড়িল সেভেনথ ক্লাসের পূর্ণ চক্রবর্তী, মাত্র নয় বছরের ছেলে, এত মিথ্যা কথাও বলে! কত দিন মারিয়াছেন, নিষেধ করিয়াছেন, হেডমাস্টারের আপিসে লইয়া যাইবার ভয় দেখাইয়াছেন; কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো ফল হয় নাই। ছেলেটার সম্বন্ধে কি অভিভাবকের নিকট একখানা চিঠি দিবেন? তাহাতেই বা কী সুফল ফলিবে? না হয় চিঠি পাইয়া ছেলের বাপ ছেলেকে ধরিয়া ঠ্যাঙাইলেন, তাহাতেই ছেলে ভালো হইয়া যাইবে বলিয়া তো মনে হয় না। কী করা যায়?

নারাণবাবুর সম্মুখে এই সব সমস্যা প্রতিদিন দুই-একটা থাকেই। মাঝে মাঝে এগুলি লইয়া তিনি ক্লার্কওয়েল সাহেবের সঙ্গে পরামর্শ করিতে যান।

সাহেব সন্ধ্যার সময় মোটরে ছেলে পড়াইতে বাহির হন, ফিরিবার অল্পক্ষণ পরেই রাত নয়টা কি সাড়ে নয়টার সময়ে নারাণবাবু সাহেবের দরজায় গিয়া কড়া নাড়িলেন।

—কে? কী, নারাণবাবু? ভেতরে এস।

—স্যার, আপনার খাওয়া হয়েছে?

—এই এখুনি খেতে বসব। এক পেয়ালা কফি খাবে?

—তা—তা—

—বাবুকে এক পেয়ালা কফি দাও। বোস। কী খবর?

—স্যার, আপনার কাছে এসেছিলাম একটা খুব জরুরী দরকার নিয়ে। একবার আপনার সঙ্গে পরামর্শ করব। ওই থার্ড ক্লাসের ললিত কর বলে ছেলেটা—‘দি’র ব্যবহার কিছু জানে না, এত দিন পরে আবিষ্কার করলাম। কাল কত চেষ্টাই করেছি, কিন্তু শেখানো গেল না। কী করা যায় বলুন তো?

ক্লার্কওয়েল সাহেব অত্যন্ত কর্তব্যপরায়ণ হেডমাস্টার। এসব বিষয়ে নারাণবাবু তাঁহার শিষ্য হইবার উপযুক্ত। ক্লার্কওয়েল খাওয়া-দাওয়া ভুলিয়া গেলেন। নিজের টেবিলে গিয়া ড্রয়ার টানিয়া একখানা খাতা বাহির করিয়া নারাণবাবুকে দেখাইয়া বলিলেন, আমারও একটা লিস্ট আছে এই দেখ, ফার্স্ট ক্লাসের কত ছেলে ও-জিনিসটার ব্যবহার ঠিকমত জানে না আজও। আরও কত নোট করেছি দেখ। তবে একটা প্রণালীতে আমি বড় উপকার পেয়েছি, তোমাকে সেটা—এই পড়।—বলিয়া ক্লার্কওয়েল নিজের নোট-বইখানা নারাণবাবুর হাতে দিলেন।

মিস সিবসন ওদিকের  দরজা দিয়া ঘরে ঢুকিয়া নারাণবাবুকে দেখিয়া বলিয়া উঠিল, ও নারাণবাবু! আমাদের সঙ্গে ডিনার খাবে? হাউ সুইট অফ ইউ!

নারাণবাবু বিনীতভাবে জানাইলেন, তিনি ডিনার খাইতে আসেন নাই।

ক্লার্কওয়েল মেমসাহেবের দিকে চাহিয়া বলিলেন, এই স্কুলে দুজন টিচার আছে, যারা টিচার নামের উপযুক্ত—নারাণবাবু আর মিঃ আলম। ইনি এসেছেন ললিতকে কী করে ‘দি’র ব্যবহার শেখানো যায়, তাই নিয়ে। আর ক’জন আছে আমাদের স্কুলের মধ্যে, যাঁরা এ সব নিয়ে মাথা ঘামান?

মেমসাহেব হাসিয়া বলিল, ইউ ডিজার্ভ এ স্লাইস অফ মাই হোম-মেড কেক নারাণবাবু, ইউ ডু। একটা কেকের খানিকটা কাটিয়া প্লেটে নারাণবাবুর সামনে রাখিয়া মেমসাহেব বলিল, ইট ইট অ্যান্ড প্রেজ ইট।

নারাণবাবু বিনয়ে বাঁকিয়া দুমড়াইয়া হাত কচলাইতে কচলাইতে বলিলেন, ধন্যবাদ ম্যাডাম, ধন্যবাদ। চমৎকার কেক! বাঃ, বেশ—

ক্লার্কওয়েল বলিলেন, আর কে কী রকম কাজ করে নারাণবাবু? টিচারদের মধ্যে—

নারাণবাবুর একটা গুণ, কাহারও নামে লাগানো-ভাঙানো অভ্যাস নাই তাঁহার। মিঃ আলম যে স্থলে অন্তত তিনজন টিচারকে ফাঁকিবাজ বলিয়া দেখাইত, সেখানে নারাণবাবু বলিলেন, কাজ সবাই করে প্রাণপণে, আর সবাই বেশ খাটে।

হেডমাস্টার হাসিয়া বলিলেন, ইউ আর অ্যান ওল্ড ম্যান নারাণবাবু। তুমি কারও দোষ দেখ না—ওই তোমার মস্ত দোষ। আমি জানি, কে কে আমার স্কুলে ফাঁকি দেয়। আমি জানি নে ভাব? নাম আমি করছি নে—নাম করা অনাবশ্যক—কারণ আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তাদের নাম তোমার কাছেও অজ্ঞাত নয়। আচ্ছা, যাও—

মেমসাহেব বলিল, ভালো কেক!

নারাণবাবু বলিলেন, চমৎকার কেক ম্যাডাম, অদ্ভুত কেক।

মেমসাহেব বলিল, আমার বাপের বাড়ি শ্রপশায়ারে, শুধু সেইখানে এই কেক তৈরি হয় তোমায় বলছি। তাও দুখানা গাঁয়ে—নরউড আর বার্কলে-সেন্ট-জন—পাশাপাশি গাঁ।  কলকাতার দোকানে যে কেক বিক্রি হয়, ও আমি খাই নে!

নারাণবাবু আর এক প্রস্থ বিনীত হাস্য বিস্তার করিয়া বিদায় লইলেন…আজ অনুকূলবাবু নাই, কিন্তু সাহেব ও মেম আসাতে নারাণবাবু খুশিই আছেন। স্কুলের কী করিয়া উন্নতি করা যায় সেদিকে সাহেবের সর্বদা চেষ্টা, তবে দোষও আছে। টাকাকড়ি সম্বন্ধে সাহেব তেমন সুবিধার লোক নয়। মাস্টারের মাহিনা দিতে বড় দেরি করে, নানা রকমে কষ্ট দেয়—তার একটা কারণ, স্কুলের ক্যাশ সাহেবের কাছে থাকে, সাহেবের বেজায় খরচের হাত—খরচ করিয়া ফেলে, অবশ্য স্কুলের বাবদই খরচ করে, শেষে মাস্টারদের মাহিনা দিতে পারে না সময়মত।

মোটের উপর কিন্তু সাহেব স্কুলের পক্ষে ভালোই। বড় কড়াপ্রকৃতির বটে, শিক্ষকদের বিষয়ে অনেক সময় অন্যায় অবিচার যথেষ্ট করিয়া থাকে, যমের মত ভয় করে সব মাস্টার; কিন্তু স্কুলের স্বার্থ ও ছেলেদের স্বার্থের দিকে নজর রাখিয়াই সে-সব করে সাহেব। নারাণবাবু তাই চান, স্কুলের উন্নতি লইয়াই কথা।

যদুবাবুর আজ মোটে বিশ্রামের অবকাশ নাই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরিয়া খাটুনি চলিতেছে, দুইজন শিক্ষক আসেন নাই, তাঁহাদের ঘণ্টাতেও খাটিতে হইতেছে। একটা ঘণ্টার শেষে মিনিট পনেরো সময় চুরি করিয়া যদুবাবু তেতলায় শিক্ষকদের বিশ্রামকক্ষে ঢুকিলেন, উদ্দেশ্য ধূমপান করা।

গিয়া দেখিলেন, হেডপণ্ডিত ও ক্ষেত্রবাবু বসিয়া আছেন। তেতলার এই ঘরটি বেশ ভালো, বড় বড় জানালা চারিদিকে, চওড়া ছাদ, ছাদে দাঁড়াইলে সেন্ট পলের চূড়া, জেনারেল পোস্ট আপিসের গম্বুজ, হাইকোর্টের চূড়া, ভিক্টোরিয়া হাউস প্রভৃতি তো দেখা যায়ই, বিশাল মহাসমুদ্রের মত কলিকাতা নগরী অসংখ্য ঘরবাড়ির ঢেউ তুলিয়া এই ক্ষুদ্র স্কুল-বাড়িকে যেন চারিধার হইতে ঘিরিয়াছে মনে হয়; নীচে ওয়েলেসলি স্ট্রীট দিয়া অগণিত জনস্রোত ও গাড়ি-ঘোড়ার ভিড়, ট্রামের ঘণ্টাধ্বনি, ফিরিওয়ালার হাঁক—বিচিত্র ও বৃহৎ জীবনযাত্রার রহস্যে সমগ্র শহর আপনাতে আপনি-হারা—থমথমে দুপুরে যদুবাবু মাঝে মাঝে বিড়ি খাইতে খাইতে শিক্ষকদের ঘরের জানালা দিয়া চাহিয়া দেখেন।

ক্ষেত্রবাবু বলিলেন, কী যদুদা, বিশ্রাম নাকি?

—না ভাই পরিশ্রম। একটা বিড়ি খেয়ে যাই।

—আমাকেও একটা দেবেন।

হেডপণ্ডিতের দিকে চাহিয়া যদুবাবু বলিলেন, কাল একটা ছুটি করিয়ে দাও না দাদা, সাহেবের কাছ থেকে। কাল ঘণ্টাকর্ণ পুজো—

হেডপণ্ডিত হাসিয়া বলিলেন, হ্যাঃ, ঘণ্টাকর্ণ পুজোর আবার ছুটি—তাই কখনও দেয়!

—কেন দেবে না? তুমি বুঝিয়ে বল, তুমিই তো ছুটির মালিক।

—না না, সে দেবে না।

—বলেই দেখ না দাদা। বল গিয়ে, হিন্দুর একটা মস্ত বড় পরব।

—ভালো, তোমাদের কথায় অনেক কিছুই বললুম। তোমরা শিখিয়ে দিলে যে, রামনবমী আর পুজো প্রায় সমান দরের পরব। রাস, দোল, ষষ্ঠীপুজো, মাকালপুজো—তোমরা কিছুই বাদ দিলে না। আবার ঘণ্টাকর্ণ পুজোর জন্যে ছুটি চাই,—কী বলে—

—যাও যাও, বলে এস, বললেই হয়।

ক্ষেত্রবাবু ছাদের এক ধারে চাহিয়া বলিয়া উঠিলেন, ওহে, খুকির বর কাল এসে গেচে!

যদুবাবু ও হেডপণ্ডিত একসঙ্গেই বলিয়া উঠিলেন, সত্যি? এসে গেচে?

—ওই দেখুন না, বসে আছে!

—যাক, বাঁচা গেল। আহা, মেয়েটা বড্ড কষ্ট পাচ্ছিল।

এই উঁচু তেতলার ছাদের ঘরে বসিয়া চারিপাশের অনেক বাড়ির জীবনযাত্রার সঙ্গে ইঁহাদের প্রত্যক্ষ পরিচয়। বাড়ির মালিকের নাম-ধাম পর্যন্ত জানা নাই—অথচ ক্ষেত্রবাবু জানেন, ওই হলদে রঙের তেতলা বাড়িটার বড় ছেলে গত কার্তিক মাসে মারা গেল। বেশ কোট-প্যান্ট পরিয়া কোথায় যেন চাকুরি করিত, বাড়ির গিন্নির আছাড়িবিছাড়ি মর্মভেদী কান্না। টিফিনের অবকাশে এখানে বসিয়া দেখিয়া ক্ষেত্রবাবুর ও জ্যোতির্বিনোদ মহাশয়ের চোখে  জল আসিয়াছিল।

এই যে খুকির বর আসিল, ইঁহারা জানেন, ষোল-সতেরো বছরের সুন্দরী কিশোরী, বাড়ির ওই জানালাটিতে আনমনে বসিয়া পথের দিকে চাহিয়া থাকিত, আপনমনে চোখের জল ফেলিত। জ্যোতির্বিনোদ মহাশয় এই ঘরেই থাকেন। তিনি বলেন, রাত্রে ছাদে মেয়েটি পায়চারি করিয়া বেড়াইত, এক-একবার কেহ কোনো দিকে নাই দেখিয়া ছাদে উপুড় হইয়া প্রণাম করিয়া কী যেন মনে মনে মানত করিত। মেয়েটি যে অসুখী, সকলেই বুঝিতেন।—মেয়েটি বিবাহিতা, অথচ আজ এক বৎসরের মধ্যে তাহার স্বামীকে দেখা যায় নাই—কাজেই আন্দাজ করিয়াছিলেন, স্বামীর অদর্শনই মেয়েটির মনোদুঃখের কারণ। কী জাত, কী নাম, তাহা কেহই জানেন না; অথচ এই অনাত্মীয়া, অজ্ঞাতকুলশীলা কিশোরীর দুঃখে প্রৌঢ় শিক্ষকদের মন সহানুভূতিতে ভরিয়া ছিল, যদিও অল্পবয়স্ক দুই-একজন শিক্ষক ইঁহাদের অসাক্ষাতে কিশোরীকে লক্ষ্য করিয়া এমন সব কথা বলিত, যাহা শোভনতার সীমা অতিক্রম করে।

মাঝে মাঝে জ্যোতির্বিনোদ মহাশয় বলিতেন, আহা, কাল রাত্রে খুকি বড্ড কেঁদেছে একা একা ছাদে! হেডপণ্ডিত বলিতেন, ভাই, বড় তো মুশকিল দেখছি! কী হয়েছে ওর বরের? কোথায় গেল?

কেহই কিছু জানেন না, অথচ মেয়েটির সুখদুঃখ তাঁহারা নিজের করিয়া লইয়াছেন। আজ ইঁহারা সত্যই খুশি—খুকির বর আসিয়াছে। বিশেষ করিয়া হেডপণ্ডিত ও ক্ষেত্রবাবু।

হেডপণ্ডিতের মেয়ে রাধারানি, প্রায় এই কিশোরীর সমবয়সী, আজ এক বৎসর হইল মারা গিয়াছে টাইফয়েড রোগে। মেয়েটির দিকে চাহিলেই নিজের মেয়ের কথা মনে পড়ে। বাপের অমন সেবা রাধারানির মত কেহ করিতে পারিত না। স্কুলের খাটুনির পরে বৈকালে বাড়ি ফিরিলে দেখিতেন, রাধা তাঁহার জন্য হাত-পা ধোয়ার জল ঠিক করিয়া রাখিয়াছে, হাত-পা ধোয়া হইলেই একটু জলখাবার আনিয়া দিবে, পাখা লইয়া বাতাস করিবে, কাছে বসিয়া কত গল্প করিবে—ঠিক যেন পাকা গিন্নি। তাহার একমাত্র দোষ ছিল, বায়োস্কোপ দেখিবার অত্যধিক নেশা। প্রায়ই বলিত, বাবা, আজ কিন্তু—

—না মা, এই সেদিন দেখলি, আজ আবার কী!

—তুমি বাবা জান না, কী সুন্দর ছবি হচ্ছে আমাদের এই চিত্রবাণীতে, সবাই দেখে এসে বলেছে বাবা।

—রোজ রোজ ছবি দেখতে গেলে চলে মা? ক’টাকা মাইনে পাই?

—তা হোক বাবা, মোটে তো ন আনা পয়সা!

—ন আনা ন আনা—দেড় টাকা। তোর গর্ভধারিণী যাবে না?

—মা কোথাও যেতে চায় না। তুমি আর আমি—

হেডপণ্ডিত ভাবিতেন, মেয়েটি তাঁহাকে ফতুর করিবে, বায়োস্কোপের খরচ কত যোগাইবেন তিনি এই সামান্য ত্রিশ টাকা বেতনের মাস্টারি করিয়া? উঃ, কী ভালোই বাসিত সে ছবি দেখিতে! ছবি দেখিলে পাগল হইয়া যাইত, বাড়ি ফিরিয়া তিন দিন ধরিয়া তাহার মুখে অন্য কথা থাকিত না, ছবির কথা ছাড়া।

কোথায় আজ চলিয়া গেল! আজকাল দুই-একখানা ভালো বাংলা ছবি হইতেছে, ছবিতে কথাও কহিতেছে—এসব দেখিতে পাইল না মেয়ে। বায়োস্কোপের খরচ হইতে তাঁহাকে একেবারে মুক্তি দিয়া গিয়াছে।

যদুবাবু বলিলেন, তা যাও এ বেলা দাদা,—ছুটিটার জন্যে। তুমি গিয়ে বললেই হয়ে যাবে।

ইহাদের অনুরোধে হেডপণ্ডিত ভয়ে ভয়ে গিয়া হেডমাস্টারের আপিসে ঢুকিয়া টেবিলের সামনে দাঁড়াইলেন।

ক্লার্কওয়েল সাহেব কী লিখিতেছিলেন, মুখ তুলিয়া বলিলেন, হোয়াট পাণ্ডিট! সিওরলি ইট ইজ নট এ হলিডে ইউ হ্যাভ কাম টু আস্ক ফর?

হেডপণ্ডিত বলিলেন, কাল ঘণ্টাকর্ণ পুজো স্যার।

সাহেব বলিলেন, হোয়াট ইজ দ্যাট? ঘণ্টা—

—ঘণ্টাকর্ণ! হিন্দুর এত বড় পর্ব আর নেই।

—ও ইউ নটি ফেলো, তুমি প্রত্যেক বারই বল এক কথা!

—না স্যার, পাঁজিতে লেখে—

—ওয়েল, আই আন্ডারস্ট্যান্ড ইট—হবে না। কী পুজো বললে, ওতে ছুটি হবে না।

হেডপণ্ডিত বুঝিলেন তাঁহার কাজ হইয়া গিয়াছে। সাহেব প্রত্যেক বারই ও-রকম বলেন, শেষ ঘণ্টায় দেখা যাইবে, স্কুলের চাকর সারকুলার-বই লইয়া ক্লাসে ক্লাসে ঘুরিতেছে।

হেডপণ্ডিত ফিরিয়া আসিলে মাস্টারেরা তাঁহাকে ঘিরিয়া দাঁড়াইল।

ক্ষেত্রবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, কী হল দাদা?

যদুবাবু বলিলেন, কার্যসিদ্ধি?

—দাঁড়াও দাঁড়াও, হাঁপ জিরিয়ে নিই। সাহেব বললে, হবে না।

—হবে না বলেছে তো? তা হলে ও হয়ে গিয়েচে। বাঁচা গেল দাদা, মলমাস যাচ্ছিল, তবুও ঘণ্টাকর্ণের দোহাই দিয়ে—

—এখনও অত হাসিখুশির কারণ নেই। যদি পাশের স্কুলে জিজ্ঞেস করতে পাঠায়, তবেই সব ফাঁক। আমি বলেছি, হিন্দুর অত বড় পর্ব আর নেই। এখন যদি অন্য স্কুলে জানতে পাঠায়?

ছোকরা উমাপদবাবু বলিলেন, যদি তারাও ঘণ্টাকর্ণ পুজোর ছুটি দেয়?

হেডপণ্ডিত হাসিয়া বলিলেন, ঘণ্টাকর্ণ পুজোর ছুটি কে দেবে, রামোঃ!

কিন্তু সাহেবের ধাত সবাই জানে। শেষ ঘণ্টা পর্যন্ত মাস্টারের দল দুরু দুরু বক্ষে অপেক্ষা করিবার পরে সকলেই দেখিল, স্কুলের চাকর ছুটির সারকুলার লইয়া ক্লাসে ক্লাসে দৌড়াদৌড়ি করিতেছে।

যদুবাবুর ক্লাস সিঁড়ির পাশেই। তিনি বলিলেন, কী রে, কী ওখানে?

চাকর একগাল হাসিয়া বলিল, কাল ছুটি আছে, সারকুলার বেরিয়েছে।

—সত্যি নাকি? দেখি, নিয়ে আয় এদিকে।

চোখকে বিশ্বাস করা শক্ত। কিন্তু সত্য বাহির হইয়াছে :

‘‘The School will remain closed to-morrow the 9th inst. for the great Hindu festival, Ghanta Karna Puja.’’

কিছুক্ষণ পরে ছুটির ঘণ্টা বাজিবার সঙ্গে সঙ্গে ছেলের দল মহাকলরব করিয়া বাহির হইয়া গেল।

.

যদুবাবুকে ডাকিয়া হেডমাস্টার বলিলেন, আপনি আর ক্ষেত্রবাবু ফোর্থ ক্লাসের ছেলেদের মিউজিয়ম আর জু’তে বেড়াতে নিয়ে যেতে পারবেন?

—খুব স্যার।

—দেখবেন, যেন ট্রাম থেকে পড়ে না যায়—একটু সাবধানে নিয়ে যাবেন। আর এই নিন টাকা, আনুষঙ্গিক খরচ আর ছেলেদের টিফিন। ছেলেদের বেশ করে বুঝিয়ে দেবেন। সব দেখাবেন।

যদুবাবু স্কুলের সামনের বারান্দাতে গিয়া দাঁড়াইলেন। ছেলেরা দুই সারিতে দাঁড়াইল হেডমাস্টারের বেতের ভয়ে। ড্রিল মাস্টারের আদেশ অনুযায়ী তাহারা মার্চ করিয়া চলিল। কিন্তু খুব বেশিক্ষণের জন্য নয়, রাস্তার মোড়ে আসিয়া তাহারা আবার দাঁড়াইয়া গেল।

যদুবাবু অনেক পিছনে ছিলেন, ছেলেদের সঙ্গে সমান তালে আসিবার বয়স তাঁহার নাই। ক্ষেত্রবাবু আর একটু আগাইয়া ছিলেন, তিনি দৌড়িয়া গিয়া বলিলেন, দাঁড়ালি কেন রে?

—আমরা ট্রামে যাব স্যার।

—ট্রামের পয়সা কাছে আছে সব?

দুই একজন বড় ছেলে সাহস সঞ্চয় করিয়া বলিল, স্কুল থেকে পয়সা দেয় নি স্যার?

—কই, না! আমার কাছে তো দেয় নি। যদুবাবুর কাছে আছে কিনা জানি না, দাঁড়াও দেখি।

ইতিমধ্যে যদুবাবু আসিয়া ইহাদের কাছে পৌঁছিলেন : কী ব্যাপার? দাঁড়িয়েচ কেন?

—আপনার কাছে ট্রামের ভাড়া দিয়েছেন হেডমাস্টার?

—হ্যাঁ। কিন্তু সে চৌরঙ্গীর মোড় থেকে—এখানে চড়লে পয়সায় কুলুবে না। আপনি ওদের নিয়ে যান, আমি আর হাঁটতে পারছি নে। ট্রামে যাই।

—তবে আমিও ট্রামে যাই। ওরা হেঁটে যাক।

সেই ব্যবস্থাই হইল। যদুবাবু ও ক্ষেত্রবাবু ট্রামে চৌরঙ্গীর মোড়ে আসিয়া ছেলেদের জন্য অপেক্ষা করিলেন। ক্ষেত্রবাবু বলিলেন, আমি কিন্তু কালীঘাট যাচ্ছি আমার বন্ধুর বাড়ি, আমি জু’তে যাব না।

ক্ষেত্রবাবু কালীঘাটের ট্রামে উঠিয়া পড়িলেন। যদুবাবু দলবল সমেত এদিকের গাড়িতে উঠিলেন। খিদিরপুরের ট্রাম হইতে নামিয়া ছেলেরা হৈ-হৈ করিয়া জু’র দিকে ছুটিল। যদুবাবু জু অনেকবার দেখিয়াছেন, তিনি কি ছেলেদের দলে মিশিয়া হৈ-হৈ করিবেন এখন? একটা গাছের তলায় বসিলেন, পড়িয়া দেখিলেন, গাছের নাম ‘পুত্রনজীর রক্সবাজি’—জীবপুত্রিকা বৃক্ষ। এই বৃক্ষের ফলের বীজ মৃতবৎসা নারীর গলায় পরাইয়া দিলে ছেলে হইয়া মরে না। তাঁহার স্ত্রীও মৃতবৎসা। এখন ফল লইয়া গেলে কেমন হয়? বয়স অনেক হইয়া গিয়াছে। বোধ হয় সুবিধা হইবে না। কী চমৎকার ওই ছেলেটা! প্রজ্ঞাব্রত! যেমন নাম, তেমনই দেখিতে। ছেলে যদি হইতে হয়, প্রজ্ঞাব্রতের মত।

একটি ছেলের দল সম্মুখ দিয়া যাইতেছিল, তাঁহাকে দেখিয়া বলিল, স্যার, আমাদের একটু দেখাবেন?

—কী দেখাব?

—স্যার, অনেক পাখি-জানোয়ারের নাম  লেখা আছে, বুঝতে পারছি নে। একটু আসুন না স্যার!

—হ্যাঁ, আমার এখন ওঠবার শক্তি নেই। তোরা নিজেরা গিয়ে দেখগে যা। প্রজ্ঞাব্রত কোথায় রে?

—অন্য দিকে গিয়েছে স্যার, দেখছি নে। যাই তবে স্যার।

যদুবাবু আপনমনে বসিয়া বসিয়া হিসাব করিলেন। সাহেব ছেলেদের টিফিনের জন্য পাঁচ টাকা দিয়েছে—ছেলে মোট ত্রিশ জন, ছেলে-পিছু দুই টুকরো রুটি আর একটু মাখন দিলে টাকা দেড়-দুই খরচ। বাকি টাকা পকেটস্থ করা যাইবে। নগদ আড়াই টাকা লাভ।

ফিরিবার পথে ছেলের দল অনেকে সরিয়া পড়িল এদিক ওদিক। কেহ গেল ময়দানে হকিখেলা দেখিতে, কেহ কাছাকাছি অঞ্চলে কোনো মাসি-পিসির বাড়ি গিয়া উঠিল। যদুবাবু মনে মনে হিসাব করিয়া দেখিলেন, দেড় টাকার মধ্যে বাকি ছেলেদের রুটি-মাখন ভালো করিয়াই চলিবে। নিউ মার্কেট হইতে নিজেই তিনখানা বড় রুটি ও কিছু মাখন কিনিলেন, মিউজিয়ম হইতে বাহির হইয়া মাঠে বসাইয়া ছেলেদের খাওয়াইয়া দিলেন।

ছেলেরা পাছে আবার ট্রামের পয়সা চাহিয়া বসে, এই ছিল যদুবাবুর ভয়। কিন্তু ছেলেরা বৈকালবেলা মুক্তির আনন্দে কে কোথায় চলিয়া গেল। ছেলেরা অত হিসাব বোঝে না, হেডমাস্টার ট্রামের পয়সা দিয়াছিলেন কিনা—সে কৈফিয়ত কেহ লইল না। যদুবাবু একা বাসার দিকে চলিতে চলিতে সতৃষ্ণ নয়নে ধর্মতলার মোড়ে গ্লোব রেস্টুরেন্টের দিকে চাহিলেন। চপ-কাটলেট ভাজার সুরুচি-ঘ্রাণ ফুটপাথের দক্ষিণ হাওয়াকে মাতাইয়াছে। পকেটে নগদ আড়াই টাকা উপরি পাওনা—বাড়ির একঘেয়ে সেই ডাঁটাচচ্চড়ি আর কুমড়োভাজা খাইতে খাইতে যৌবন চলিয়া গেল। যদি পেটে ভালো করিয়া না খাইলাম তবে চাকুরি করা কী জন্য? চক্ষু বুজিলে সব অন্ধকার! ছেলে নাই, পিলে নাই, কাহার জন্য খাটিয়া মরা!

রেস্টুরেন্টে ঢুকিয়া দুইখানা ফাউল কাটলেট, দুইখানা চপ, এক প্লেট কোর্মা, দুইখানা ঢাকাই পরোটা অর্ডার দিয়া যদুবাবু মহাখুশির সহিত আপনমনে উদরসাৎ করিতেছেন, এমন সময় ফুটপাথ দিয়া প্রজ্ঞাব্রতকে যাইতে দেখিয়া ডাকিলেন, ও প্রজ্ঞা, ওরে শোন শোন—

প্রজ্ঞাব্রত হকিখেলা দেখিয়া বাড়ি যাইতেছিল, উঁকি মারিয়া বলিল, স্যার, আপনি এখানে?

—শোন শোন, বোস। খাবি?

—না স্যার, আপনি খান।

—কেন, বোস না। আয়। এই বয়, দুখানা চপ আর দুখানা কাটলেট দাও তো!

প্রজ্ঞাব্রত দুই-একবার মৃদু প্রতিবাদ করিয়া খাইতে বসিল। যদুবাবু তাহাকে জোর করিয়া এটা-ওটা আরও খাওয়াইলেন। যাইবার সময়ে তাহাকে বলিলেন, একটা সিগারেট কিনে আন তো, এই নে পয়সা।

সিগারেট ধরানো হইলে দুইজনে কিছুক্ষণ ধর্মতলা ধরিয়া চলিলেন।

একটা গ্যাস-পোস্টের নীচে আসিয়া যদুবাবু বলিলেন, হ্যাঁরে, তুই চাঁদা দিয়েছিলি?

—কিসের স্যার?

—এই আজ জু’তে আসবার জন্যে?

—হ্যাঁ স্যার, চার আনা।

যদুবাবু একটা সিকি বাহির করিয়া প্রজ্ঞাব্রতের হাতে দিয়া বলিলেন, এই নে, নিয়ে যা—কাউকে বলিস নে—

প্রজ্ঞাব্রত বিস্মিত হইয়া বলিল, ও কী স্যার! জু দেখলাম, ট্রামে গেলাম, রুটি-মাখন খাওয়ালেন তখন—

—তুই নিয়ে যা না! তোর অত কথায় দরকার কী? কাউকে বলবি নে!

—না স্যার, আমি নেব না—

—নে বলচি, ফাজলামো করিস নে,—নিয়ে নে—

প্রজ্ঞাব্রত আর দ্বিরুক্তি না করিয়া হাত পাতিয়া সিকিটি লইল।

—আমার এই গলি স্যার, যাই আমি।

—চল না, আমায় একটু এগিয়ে দিবি। বেশ লাগে তোর সঙ্গে যেতে।

প্রজ্ঞাব্রত অনিচ্ছার সহিত আরও কিছু দূরে গিয়া ওয়েলিংটন স্ট্রীটের মোড়ে আসিয়া বলিল, যান স্যার, আমি আর যাব না—

পরদিন যদুবাবু হেডমাস্টারের কাছে আট টাকা দশ আনার এক বিল দাখিল করিয়া বিনীতভাবে জানাইলেন, দশ আনা বেশি খরচ হইয়া গিয়াছে—ট্রামভাড়া, ছেলেদের খাওয়ানো, আনুষঙ্গিক খরচ।

হেডমাস্টার বলিলেন, ওয়েল, এই নাও দশ আনা।

ছেলেরা কিন্তু ক্লাসে বলাবলি করিতে লাগিল, যদুবাবু তাহাদের কিছুই খাওয়ান নাই। হেডমাস্টার কত টাকা যদুবাবুর হাতে দিয়াছেন, কেহ কেহ তাহাও অনুসন্ধান করিবার চেষ্টা করিতে ছাড়িল না।

প্রজ্ঞাব্রত সকলকে বলিল, যদুবাবু গ্লোব রেস্টুরেন্টে বসিয়া মনের সাধে চপ-কাটলেট খাইতেছিলেন, সে পথ দিয়া যাইবার সময় দেখিয়াছে। তাহাকে যে খাওয়াইয়াছেন, সেকথা প্রকাশ করিল না।

যদুবাবু ফোর্থ ক্লাসে তৃতীয় ঘণ্টায় পড়াইতে গিয়া দেখিলেন, ব্ল্যাকবোর্ডে  লেখা আছে—গ্লোব রেস্টুরেন্ট, চপ এক আনা, মুরগির কাটলেট দশ পয়সা, জু হইতে ফিরিবার পথে সকলে খাইয়া যান!

যদুবাবু দেখিয়াও দেখিলেন না। টিফিনের ঘণ্টায় প্রজ্ঞাব্রতকে আড়ালে ডাকিয়া বলিলেন, ওসব কে লিখেছে বোর্ডে? তুই কিছু বলেছিস?

সে বলিল, না স্যার, আমি কাউকে বলি নি।

—আর কেউ দেখেছিল আমাকে, বললে কেউ?

—তাও স্যার আমি জানি না—

মিঃ আলমের চোখে লেখাটি পড়িল টিফিনের পরের ঘণ্টায়। মিঃ আলম কূটবুদ্ধিসম্পন্ন লোক, জিজ্ঞাসা করিল, এসব কী?

ছেলেরা পরস্পর গা-টেপাটেপি করিল। দুইজন বইয়ের আড়ালে মুখ লুকাইয়া হাসিল।

—কী, বল না! মনিটার?

—একজন লম্বা ছেলে উঠিয়া বলিল, কী স্যার?

—এ কে লিখেচে?

—দেখি নি স্যার।

—হুঁ। কাল তোরা জু’তে গিয়েছিলি কার সঙ্গে?

—যদুবাবু ও ক্ষেত্রবাবুর সঙ্গে গিয়েছিলাম। তবে ক্ষেত্রবাবু কালীঘাট চলে গেলেন, যদুবাবু ছিলেন।

মিঃ আলম জেরা করিয়া সংগ্রহ করিলেন, তাহারা কী খাইয়াছিল, কত দূর ট্রামে গিয়াছিল ইত্যাদি। হেডমাস্টারকে আসিয়া বলিলেন, কাল ক’টাকা দিয়েছিলেন স্যার যদুবাবুকে? ছেলেরা তো দু টুকরো রুটি আর মাখন খেয়েচে, যাবার সময় একবারই ট্রামে গিয়েছিল, আর এসেছিল মিউজিয়াম পর্যন্ত। আর কোনো খরচ হয় নি।

—তিন টাকা ট্রামভাড়া আর পাঁচ টাকা টিফিন—যদুবাবু আট টাকা দশ আনার বিল দিয়েচে।

—স্যার, আপনি অনুসন্ধানের ভার যদি আমার ওপর দেন, আমি প্রমাণ করব—যদুবাবু স্কুলের টাকা চুরি করেছেন। উনি নিজে ফেরবার পথে চপ-কাটলেট খেয়েচেন দোকানে বসে, ফোর্থ ক্লাসের প্রজ্ঞাব্রত দেখেচে। সে আপনার কাছে সব বলতে রাজি হয়েচে। ডেকে নিয়ে আসি তাকে যদি বলেন! যদুবাবু শিক্ষকের উপযুক্ত কাজ করেন নি, ছেলেদের খাওয়ান নি অথচ স্কুলে বাড়তি বিল দিয়েচেন—এ একটা গুরুতর অপরাধ। আমার ধারণা উনি এ রকম আরও কয়েক বার করেছেন—জু’তে ছেলেদের নিয়ে যাবার সময় তাই উনি সকলের আগে পা বাড়ান। ব্ল্যাকবোর্ডে ছেলেরা যা-তা লিখেচে ওঁর নামে।

হেডমাস্টার হাসিয়া বলিলেন, লেট গো মিঃ আলম! এ বিষয়ে আর কিছু উত্থাপন করবেন না। হাজার হলেও আমাদেরই একজন টিচার, সহকর্মী—ছেড়ে দিন ও-কথা। আই ডোন্ট গ্রাজ দি পুওর ফেলো ফর এ কাটলেট অর টু—

.

গ্রীষ্মের ছুটির আর দেরি নাই। অন্য সব স্কুলে মর্নিং-স্কুল আরম্ভ হইয়া গিয়াছে, কিন্তু এ স্কুলে হেডমাস্টারের কাছে বহু দরবার করা সত্বেও আজও মর্নিং-স্কুল হয় নাই। হেডমাস্টারের ধারণা, মর্নিং-স্কুল হইলে লেখাপড়া ভালো হয় না ছেলেদের। ক্লাসে ক্লাসে পাখা আছে, মর্নিং স্কুলের কী দরকার!

ডেপুটেশনের পর ডেপুটেশন, হেডমাস্টারের আপিসে গিয়া ব্যর্থকাম হইয়া ফিরিল। অবশেষে সকলে মিঃ আলমকে গিয়া ধরিল। হেডপণ্ডিত বলিলেন, যান মিঃ আলম, বুঝিয়ে বলুন একবারটি।

আলমের দ্বারা স্কুলের ক্ষতিজনক কোনো কার্য হওয়া সম্ভব নয়, তিনি জানাইলেন।

অবশেষে অন্য সব মাস্টার জোট পাকাইয়া হেডমাস্টারের আপিসে গেলেন। ক্লার্কওয়েল একগুঁয়ে প্রকৃতির মানুষ, যাহা ধরিয়াছেন তাহার নড়চড় হইবার জো নাই। কাহারও কথায় কর্ণপাতও করিলেন না। বরং ফল হইল, যেসব মাস্টার দরবার করিতে গিয়াছিলেন তাঁহাদের উপর নানারকম বেশি খাটুনির চাপ পড়িল।

ছুটির পর প্রায়ই স্কুল হইতে মাস্টারদের চলিয়া যাইবার উপায় থাকিত না। প্রশ্নপত্র লিথো করিতে হইবে, ক্লাসের ট্রানস্লেশন দেখিয়া ভুল-ভ্রান্তি শুদ্ধ করিয়া তাহা হেডমাস্টারের টেবিলে পেশ করিতে হইবে। হেডমাস্টার দেখিতেন, ঠিকমত খাতা দেখা হইয়াছে কিনা।

আজ হুকুম হইল, প্রত্যেক শিক্ষক প্রতি দিন প্রত্যেক ক্লাসে কী পড়াইবেন তাহা নোট করিবেন, সে নোট আবার সাহেবের কাছে দাখিল করিতে হইবে।

হেডমাস্টার বলিলেন, স্কুলে পাখা আছে, মর্নিং-স্কুল কী জন্যে? যে সব মাস্টারের না পোষাবে, তিনি চলে যেতে পারেন। মাই গেট ইজ ওপন—

গলদঘর্ম হইয়া মাস্টারেরা আর দিন-চারেক স্কুল করিলেন। তারপর একদিন অপ্রত্যাশিত ভাবে হঠাৎ সারকুলার বাহির হইল, কাল হইতেই মর্নিং-স্কুল। ক্লার্কওয়েলের সব কাজই ওই রকম—পরের কথায় বা বুদ্ধিতে তিনি কিছুই কাজ করিবেন না, নিজের খেয়ালমত চলিবেন।

মর্নিং-স্কুল বসিবে ছ’টায়। দূরে যেসব মাস্টার থাকেন, তাঁহারা শেষরাত্রে উঠিয়া রওনা না হইলে আর ছয়টায় আসিয়া হাজিরা দিতে পারেন না। তাহার উপর সাড়ে দশটায় ছুটির পর রোজ বেলা সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত শিক্ষকদের লইয়া পরামর্শ-সভা বসিবে।

সভার কার্য-প্রণালী নিম্নোক্ত রূপ :—

১। সেভেনথ ক্লাসে কী করিয়া হাতের  লেখার উন্নতি করা যাবে?

২। থার্ড ক্লাসে ছেলেরা শ্রুতিলিখনে কাঁচা—কী ভাবে তাহারা শ্রুতিলিখনে উন্নতি করিতে পারে?

৩। একজন টিচার কাল ক্লাসে বাজে গল্প করিয়াছিলেন—তাঁহার সম্বন্ধে কী ব্যবস্থা করা যায়?

হেডমাস্টার প্রথমে বলিলেন, আচ্ছা, সেভেনথ ক্লাসের হাতের  লেখা সম্বন্ধে কার কী মত?

ক্ষুৎ-পিপাসায় পীড়িত টিচারের দল মনে বিরক্তি চাপিয়া চাকুরির খাতিরে মুখে কৃত্রিম উৎসাহ ও গভীর চিন্তার ভাব আনিয়া একে একে আলোচনায় যোগ দিলেন।

কাহারও ফাঁকি দিবার উপায় নাই, কেহ চুপ করিয়া উদাসীন হইয়া বসিয়া থাকিবেন, তাহার জো কী? হেডমাস্টার অমনি বলিবেন, যদুবাবু, হোয়াই ইউ আর সাইলেন্ট?

সর্বশেষে মিঃ আলমের দিকে চাহিয়া হাসিমুখে সাহেব বলিলেন, নাউ অ্যাট লাস্ট লেট আস হিয়ার মিঃ আলম!

মিঃ আলম গম্ভীর মুখে উঠিলেন। যেন ‘প্রাইম মিনিস্টার’ কোনো গুরুতর বিল আলোচনা করিবার জন্য ট্রেজারি বেঞ্চ হইতে উঠিয়া দাঁড়াইলেন। মিঃ আলমের হাতে তিনপাতা লেখা কাগজ, সেভেনথ ক্লাসের হাতের লেখা ভালো করা সম্বন্ধে এক গুরুগম্ভীর নিবন্ধ। তাহার মধ্যে কত উদাহরণ, কত প্রস্তাব, কত মহাজন-বাণী উদ্ধৃত!

মিঃ আলম মাথা দুলাইয়া সতেজ উচ্চারণের সহিত গোটা নিবন্ধটা পড়িয়া গেলেন, ‘‘অন দি বেটারমেন্ট অফ হ্যান্ডরাইটিং অফ সেভেনথ ক্লাস বয়েজ’’—ঝাড়া দশ মিনিট লাগিল।

টিচারদের সভা চুপ। হেডমাস্টার বলিলেন, মিঃ আলম একজন আদর্শ শিক্ষক। এ কথা আমি কতদিন বলেছি। মানুষের মত মানুষ একজন। কারও কিছু বলবার আছে মিঃ আলমের প্রবন্ধ সম্বন্ধে? নারাণবাবু?

বৃদ্ধ নারায়ণবাবু একটা কী সংশোধন প্রস্তাব উত্থাপন করিলেন।

—ওয়েল, যদুবাবু?

যদুবাবু বিনীতভাবে জানাইলেন, তাঁহার কিছু বলিবার নাই। মিঃ আলমের প্রবন্ধের পর আর বলিবার কী থাকিত পারে!

—ওয়েল, ক্ষেত্রবাবু?

—না, স্যার, আমার কিছু বলবার নেই।

এক পর্ব শেষ হইল। বেলা সাড়ে এগারোটা বাজে, জ্যৈষ্ঠের রৌদ্রে রাস্তার পিচ গলিয়া গিয়াছে। অনেকে চিন্তা করিতেছেন, বাড়ি ফিরিয়া আর স্নানের জল পাওয়া যাইবে না। চৌবাচ্চায় দুই ইঞ্চি জলও থাকে না এত বেলায়। অথচ কিছু বলিবার জো নাই, সাহেব বলিবেন, মাই গেট ইজ ওপন—

ঠিক বারোটার সময় ‘টিচার্স মিটিং’ সাঙ্গ হইল।

বাহিরে পা দিয়াই যদুবাবু বলিলেন, ব্যাটা কী খোশামুদে! দেখলে তো একবার! আবার এক প্রবন্ধ লিখে এনেচে! কাজের আঁট কত!

ক্ষেত্রবাবু বলিলেন, একেবারে লর্ড বেকন—‘‘অন দি বেটারমেন্ট অফ হ্যান্ডরাইটিং অফ সেভেনথ ক্লাস বয়েজ।’’ হামবাগ কোথাকার!

যদুবাবু বলিলেন, আর এক খোশামুদে ওই নারাণবাবু। তোর কোনো কুলে কেউ নেই, সন্নিসি হয়ে যা! দরকার কী তোর খোশামুদির?

নীচের ক্লাসের একজন টিচার মেসে থাকিতেন। তিনি সামান্য মাহিনা পান, মুখ ফুটিয়া কিছুই বলিতে সাহস পান না। তিনি কতকটা আপন মনেই বলিলেন, কোনোদিন নাইতে পারি নে—আজ মর্নিং-স্কুল হয়ে পাঁচ দিন নাই নি।

যদুবাবু বলিলেন, এই বলে কে! কই, তুমি তো মুখ ফুটে কথাটা বলতে পারলে না ভায়া সাহেবকে!

—আপনারা সিনিয়র টিচার রয়েছেন, কিছু বলতে পারেন না। আমি চুনো-পুঁটি—আমার সাহস কী?

—ওই তো দোষ ভায়া। ওতেই তো পেয়ে বসে। প্রোটেস্ট করতে হয়—মেনে নিলেই বিপদ।

—আপনারা প্রোটেস্ট করুন গিয়ে দাদা, আমার দ্বারা সম্ভব নয়।

গ্রীষ্মের ছুটি পর্যন্ত প্রায়ই এই রকম চলিল। গ্রীষ্মের ছুটি আসিয়া পড়িবার দেরি নাই। ছেলেরা সেদিন গান গাহিবে, আবৃত্তি করিবে। দুই-একজন শিক্ষক তাহাদের তালিম দিবার ভার লইয়া স্কুলের কাজ হইতে অব্যাহতি পাইয়াছেন।

হঠাৎ শোনা গেল, গ্রীষ্মের বন্ধের পূর্বে মাস্টারদের মাহিনা দেওয়া হইবে না।

দুই মাসের বেতন এই সময়ে একসঙ্গে পাওয়ার কথা। মোটেই পয়সা দেওয়া হইবে না! শুনিয়া মাস্টারদের মুখ শুকাইয়া গেল। হেডমাস্টারের কাছে দরবার শুরু হইল। হেডমাস্টার বলিলেন, আমি বা মিস সিবসন এক পয়সা নেব না—কেউ কিছু নিচ্ছি না। মাইনে আদায় যা হয়েছিল, কর্পোরেশনের ট্যাক্স আর বাড়ি-ভাড়াতে গেল।

দুই-একজন শিক্ষক একটু ক্ষুব্ধ স্বরে বলিলেন, আমরা তবে খাব কি?

—আমি জানি না। আপনাদের না পোষায়, মাই গেট ইজ ওপন—

গ্রীষ্মের ছুটিতে প্রত্যেক মাস্টারের উপর দুই-তিনটে প্রবন্ধ আনিবার ভার পড়িল—ছাত্রদের প্রতি কর্তব্য, বিভিন্ন বিষয় পড়াইবার প্রণালী প্রভৃতি সম্বন্ধে। মাস্টারদের দল মুখে কিছু বলিতে পারিলেন না, মনে মনে কেহ চটিলেন, কেহ ক্ষুব্ধ হইলেন।

যদুবাবু বলিলেন, ওঃ, ভাত দেবার কেউ নয়, কিল মারবার গোসাই! মাইনের সঙ্গে খোঁজ নেই, প্রবন্ধ লিখে নিয়ে এস—দায় পড়েচে—

.

ক্ষেত্রবাবু অনেক দিন পরে গ্রামের বাড়িতে আসিলেন, সঙ্গে স্ত্রী নিভাননী ও দুই-তিনটি ছেলে-মেয়ে।

আজ প্রায় ছয় বছর পৈতৃক ভিটাতে আসেন নাই। চারিধারে জঙ্গল, বাড়িঘরে গাছ গজাইয়াছে। জমিজমা, আম-কাঁঠালের বাগান যাহা আছে, বারোভূতে লুটিয়া খাইতেছে। গ্রামের নাম আসসিনংড়ি—কয়েক ঘর গোয়ালা ও ব্রাহ্মণ এ গ্রামে বেশ সমৃদ্ধিসম্পন্ন গৃহস্থ, ধান পুকুর জমিজমা যথেষ্ট তাহাদের। অন্য কোনো ভালো ব্রাহ্মণ গ্রামে নাই, কায়স্থ আছে কিছু, গোয়ালা জেলে ছুতার কর্মকার এবং ষাট-সত্তর ঘর মুসলমান—এই লইয়া গ্রাম।

গ্রামে জঙ্গল খুব, বড় বড় আম-কাঁঠালের বাগান। ক্ষেত্রবাবুর পৈতৃক বাড়ি কোঠা, বড় বড় চার-পাঁচখানা ঘর; কিন্তু মেরামতের অভাবে ছাদ দিয়া  জল পড়ে। বাড়ির উঠানে বড় বড় কাঁঠালগাছে অনেক কাঁঠাল ফলিয়াছে, নারিকেলগাছে ডাবের কাঁদি ঝুলিতেছে। বাড়ির সামনে পুকুর, সেখানে কর্তাদের আমলে বড় বড় মাছ জাল দিয়া ধরা হইত, আজ কিছু নাই। শরিক এক জ্যাঠতুতো ভাই এতদিন সব খাইতেছিল, আজ বছর দুই হইল সে উঠিয়া গিয়া শ্বশুরবাড়ি বাস করিতেছে।

সকালে উঠিয়া ক্ষেত্রবাবু গ্রামের প্রজাদের ডাকাইলেন। সকলে আসিয়া প্রণাম করিল এবং এতদিন পরে তিনি গ্রামে আসিয়াছেন ইহাতে যথেষ্ট আনন্দ প্রকাশ করিল।—বাপ-পিতামহের ভিটা ছাড়িয়া বাহিরে না গেলে কি অন্ন হয় না? বাবু এখানে থাকুন, তাহারা ধানের জমি করিয়া দিবে, চলিবার সব ব্যবস্থা করিয়া দিবে। ক্ষেত্রবাবুও ভাবিলেন, সাহেবের তাঁবে থাকিয়া দিনরাত্রি দাসত্ব করার চেয়ে এ কত ভালো। ‘টিচার্স মীটিং’ নাই, দুই ঘণ্টা করিয়া প্রতি দিন খাতা কারেক্ট করিবার হাঙ্গামা নাই, মিঃ আলমের ধূর্ত চক্ষুর চাহনিতে আর ভয় খাইতে হইবে না—এই তো কত চমৎকার! নাকে-মুখে গুঁজিয়া স্কুলে দৌড়িবার তাড়া থাকিবে না।

নিভাননী হাসিয়া বলিল, দুধ এখানকার কী চমৎকার গো! ইটিলিতে এমন দুধ কিন্তু দেয় না গোয়ালা!

ক্ষেত্রবাবু বলেন, কোত্থেকে সেখানকার গোয়ালারা ভালো দুধ দেবে? তা দিতে পারে কখনও?

দিনকতক ভালো দুধের পায়েস পিঠে খাওয়া হইল। বাড়িতে সত্যনারায়ণের সিন্নি দেওয়া হইল একদিন। ইতিমধ্যে আম-কাঁঠাল পাকিয়া উঠিল, ছেলে-মেয়েরা প্রাণ পুরিয়া আম খাইল।

গ্রামের দক্ষিণে জোলের মাঠ, অনেক খেজুর পাকিয়াছে গাছে গাছে, ক্ষেত্রবাবু ছেলেমেয়েদের হাত ধরিয়া মাঠে গিয়া খেজুর কুড়াইয়া বাল্যের আনন্দ আবার উপভোগ করেন—যখন এ গ্রাম ছাড়া আর কোথাও বৃহত্তর দুনিয়ায় স্থান ছিল না, এই গ্রামের আম আমড়া কুল বেল খাইয়া একদিন মানুষ হইয়া উঠিয়াছিলেন, যখন এ গ্রামের মাটি ছিল পৃথিবীর জীবনের একমাত্র নোঙর, ক্ষুদ্রের মধ্যেও সে পরিধি ছিল অসীম—সেসব দিনের কথা মনে হয়।

তারপর তিনি বি-এ পাস করিলেন, এখানে আর থাকা চলিল না, বিদেশে চাকুরি লইতে হইল। কর্তারাও সব পরলোকে চলিয়া গেলেন—গ্রামের সঙ্গে সংযোগ-সূত্র ছিন্ন হইল। সন্ধ্যায় শিয়ালের ডাকে পিতৃপুরুষের ভিটা মুখরিত হইতে লাগিল। মধ্যে বার-দুই এখানে আসিয়াছেন—সেও বছর পাঁচ-ছয় আগেকার কথা, আর আসা ঘটে নাই। পনেরো টাকা ভাড়ায়  কলিকাতার গলিতে একখানা ঘরভাড়া করিয়া থাকা, বারান্দায় ছোট্ট এতটুকু রান্নাঘর, ধোঁয়া দিলে বাড়িতে টেকা দায়। এমন দুধ টাটকা তরকারি চোখে দেখা যায় না। ক্ষেত্রবাবু দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া ভাবেন, কী হইলে আবার আসিয়া গ্রামে বাস করিতে পারেন! পুরনো দিনের সুখ আবার ফিরিয়া আসে যদি, ক্ষেত্রবাবু তাঁহার জীবনের অনেকখানিই যে-কোন দেবতাকে দানপত্র করিয়া দিতে রাজি আছেন। ক্ষেত্রবাবু গ্রামের প্রজাদের সঙ্গে পরামর্শ করিতে লাগিলেন, গ্রামে থাকিলে তাঁহার সংসার চলিবার বন্দোবস্ত হয় কিনা! সকলেই উৎসাহ দিল, ধানের জমি আছে—তাহাতে বছরের ভাতের টানাটানি হইবে না—ক্ষেত্রবাবু গ্রামেই থাকুন।

একদিন নিভাননী বলিল, আর কদিন ছুটি আছে তোমার গো?

ক্ষেত্রবাবু বলিলেন, কেন?

—না, তাই বলছি।

দিন উনিশ কাটিয়াছে সবে, এখনও প্রায় এক মাস। সত্য কথা যদি স্বীকার করিতে হয়, ছুটিটা একটু বেশিই হইয়া গিয়াছে, এতদিন ছুটি না দিলেও চলিত।

নিভাননীর দিন আর কাটে না। এখানে সে কথা বলিবার মানুষ খুঁজিয়া পায় না, ঘুরিয়া ফিরিয়া সেই ভড়-গিন্নি আর তাহার মেয়ে সরলা। আর আছে কয়েকটি গোয়ালার মেয়ে। কোনো আমোদ নাই, আহ্লাদ নাই—বন-জঙ্গলের মধ্যে আর দিন কাটিতে চায় না। তাহার উপর উনি নাকি এখানে থাকিবার ব্যবস্থা করিতেছেন! এখানে মানুষ বারোমাস থাকিলে পাগল, নয় তো ভূত হইয়া যায়। বাড়ির পিছনে বাঁশবনের নীচেই, মিনিট কয়েকের পথ দূরে শীর্ণকায় চূর্ণী নদী, টলটলে কাচের মত জল—রোজ এই বাগানের ভিতর দিয়া স্নানে যাইবার সময় নিভাননীর ভয় হয়। উঁচু উঁচু আমগাছে পরগাছা ঝুলিতেছে, কালপ্যাঁচার গম্ভীর স্বরে দিনদুপুরেও বুকের মধ্যে কেমন করে! স্নান করিতে নামিয়া কিন্তু মনে বেশ আনন্দ হয়, এত  জল এবং এমন কাকের চোখের মত জল কলিকাতায় কল্পনাও করা যায় না।

বাঁশের চ্যালা পুড়াইয়া উনানে রান্না—কয়লা নাই, বাড়িতে জল নাই, নিভাননীর এসব অভ্যাস নাই। কলিকাতার রান্নাঘরের মধ্যেই কলের জলের পাইপ। এখানে মানুষ থাকে না। সময় যেখানে কাটিতে চাহে না, সে জায়গা আর যাহাই হউক, ভদ্রলোকের বাসের উপযুক্ত নয়।

ছেলেমেয়েদেরও এ জায়গা ভালো লাগে না। বড় ছেলে পাঁচু কেবল বলে, মা, কলকাতায় কবে যাওয়া হবে?

তাহাদের বাড়ির সামনে ছোট্ট পার্কটাতে প্রতি বৈকালে টুনু হাবু রণজিৎ হীরু মঙ্গল সিং বলিয়া একটা শিখের ছেলে, সুরেশ ভানু কত ছেলে আসিয়া জোটে। পাঁচুর সঙ্গে উহাদের সকলের খুব ভাব। পার্কে দোলনা টাঙানো আছে, গড়াইয়া পড়িবার লোহার ডোঙা খাটানো আছে, রোজ রোজ সেখানে কত কী খেলা, কত আমোদ-আহ্লাদ!

রণজিতের বাড়ি কাছেই—প্রসাদ বড়াল লেনে। পাঁচুর সঙ্গে রণজিতের খুব বন্ধুত্ব—প্রায়ই তাহার বন্ধুর বাড়ি পাঁচু যাইত, রণজিতের মা খাইতে দিতেন, তারপরে রণজিতের বোন সুসি আর হিমির সঙ্গে তাহারা দুইজনে বসিয়া ক্যারম খেলিত। সুসির অদ্ভুত টিপ, সরু, সরু ফরসা আঙুল দিয়া স্ট্রাইকার ছটকাইয়া সামনের কাঠে রিবাউন্ড করাইয়া কেমন অদ্ভুত কৌশলে সে গুটি ফেলিত। পাঁচু সুসির গুণে মুগ্ধ। অমন অদ্ভুত মেয়ে সে যদি আর কোথাও দেখিয়া থাকে!

হারিয়া গেলে সুসি হাসিয়া বলে, পারলে না পাঁচু, এইবার লালখানা ফেলেও হেরে গেলে!

লাল ফেলিলে কী হইবে, পয়েন্ট হইল কই? বোর্ডে যখন সাতখানা গুটি মজুত, তখন ওদিকে সুসির হাতের গুণে স্ট্রাইকার অসম্ভব সম্ভব করিয়া তুলিতেছে পাঁচুর বিস্মিত ও মুগ্ধ দৃষ্টির সম্মুখে। দেখিতে দেখিতে বোর্ড ফাঁকা, প্রতিপক্ষ সব গুটি পকেটে ফেলিয়াছে।

কী মজার খেলা! কী মজার দিন!

এখানে ভালো লাগে না। কী আছে এখানে? কুমোরপাড়ার ছেলেদের সঙ্গে মিশিয়া গেঁয়ো খেলা যত সব! কথা সব বাঙালে ধরনের, এখানে আর কিছুদিন থাকিলে পাঁচু বাঙাল হইয়া উঠিবে।

নিভাননী বলে, আজ পঁচিশ দিন হল, না?

ক্ষেত্রবাবু হাসিয়া বলেন, দিন গুনছ নাকি?

—ভালো লাগছে না আর, সত্যি!

—তা বটে। আমারও তেমন ভালো লাগছে না—বসে বসে আর দিনে ঘুমিয়ে শরীর নষ্ট হল। একটা কথা বলবার লোক নেই, আছে ওই নন্দী মশায় আর জগহরি ঘোষ—ওরা ধান-চালের দর নিয়ে কথাবার্তা বলে কেবল, কাঁহাতক ওদের সঙ্গে বসে গল্প করি?

—আর কদিন আছে তোমার?

—তা এখনও আঠারো-উনিশ দিন—কি তারও বেশি।

নিভাননী বলিল, ছেলেমেয়েদেরও আর ভালো লাগচে না। কানু আমায় বলচে, মা, আমরা কলকাতা যাব কবে?

ক্ষেত্রবাবুও নিজের মনের ভাব দেখিয়া নিজেই অবাক হইলেন। যে ক্লার্কওয়েল সাহেবের স্কুলের নাম শুনিলে গায়ের মধ্যে জ্বালা ধরে, চাকুরির সময় যাহাকে কারাগার বলিয়া বোধ হইত, সেই স্কুলের কথা এখন যখন মনে হয় তখন যেন সে প্রশান্ত মহাসাগরের নারিকেল দ্বীপপুঞ্জ ঘেরা পাগো-পাগো দ্বীপ, চিরবসন্ত যেখানে বিরাজমান, পক্ষি-কাকলিতে যাহার শ্যাম তীরভূমি মুখর—ইংরেজি টকি-ছবিতে যা দেখিয়াছেন কতবার। সেই সিঁড়ির ঘর, তেতলার ছাদে মাস্টারদের সেই বিশ্রামকক্ষ, হেডমাস্টারের আপিসের ঘণ্টাধ্বনি, মথুরা চাকরের সারকুলার বই লইয়া ছুটাছুটি করিবার সেই সুপরিচিত দৃশ্য—এসব কল্পনার বিষয় হইয়া দাঁড়াইয়াছে। না, আর ভালো লাগে না, স্কুল খুলিলেই বাঁচা যায়!

.

নারাণবাবুর অবস্থা ইহা অপেক্ষাও খারাপ।

নারাণবাবু স্কুলের ঘরটিতে বারো মাস আছেন, কোথাও যাইবার স্থান নাই। সেই ঘর আশ্রয় করিয়া বহুদিন থাকিবার ফলে যখন টুইশানি সারিয়া নিজের ঘরটিতে ফেরেন, তখন সমস্ত মনপ্রাণ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিয়া উঠে, বাড়ি এসে বাঁচা গেল! কত কালের পিতৃ-পিতামহের বাসভূমি যেন সাহেবের বাথরুমের পূর্বদিকের সেই এক-জানলা এক-দরজা-ওয়ালা কুঠুরিটা।

এ ছুটিতে নারাণবাবু গিয়াছিলেন তাঁহার এক দূর-সম্পর্কের ভাগ্নীর বাড়ি বরিশালে। চিরকাল  কলিকাতায় কাটাইয়াছেন। বরিশালের পল্লীগ্রামে কিছুদিন থাকিয়াই তিনি হাঁপাইয়া উঠিলেন। গরিব স্কুল-মাস্টার হইলেও নাগরিক মনোবৃত্তি তাঁহার মজ্জাগত—সত্যিকার শহুরে মানুষ। এখানে সকালে উঠিয়া কেহ চা খায় না, লেখাপড়া-জানা মানুষ নাই। এক বাঙাল মোক্তার আছে, পঞ্চানন লাহিড়ী—বয়সে নারাণবাবুর সমান, গ্রামে সে-ই একমাত্র লেখাপড়া জানা লোক। হইলে হইবে কী, লোকটার কথাবার্তায় বরিশালের টান তিনি ক্ষমা করিতে প্রস্তুত ছিলেন—কিন্তু সে গোঁড়া বৈষ্ণব, ধর্মবাতিকগ্রস্ত বৈষ্ণব।

তাহার কাছে গিয়া বসিতে হয়, উপায় নাই। সন্ধ্যাবেলাটা কোথায় কাটানো যায় আর! অমনি সে আরম্ভ করিবে—গোপিনীদের ভাব সম্বন্ধে উদ্ধব দাস কী বলিতেছেন—এটা বলিয়া লই—

নারাণবাবুকে বাধ্য হইয়া বসিয়া শুনিতে হয়। তিনি ধার্মিক লোক নন, যোগবাশিষ্ঠ রামায়ণের দার্শনিক অংশ ছাড়া আর কিছু ভালো লাগে না তাঁর। লেসলি স্টিফেন এবং মিলের ছাত্র তিনি। পঞ্চানন মোক্তার কথা বলিতে বলিতে যখন দুই হাত তুলিয়া ‘আহা’ ‘আহা’ বলে, তখন নারাণবাবু ভাবেন, এই একটা নিতান্ত অজ-মূর্খের পাল্লায় পড়ে প্রাণটা গেল দেখচি!

মনে হয় শরৎ সান্যালের কথা। শরৎ সান্যাল অবসারপ্রাপ্ত ইঞ্জিনীয়ার, নারাণবাবুর বহুদিনের বন্ধু—পাশের গলিতে এক সময় বড় বাড়ি ছিল, ছেলেরা রেস খেলিয়া বাড়ি উড়াইয়া দিয়াছে, এখন দুর্গাচরণ ডাক্তার রোডে ছোট ভাড়াটে বাড়িতে বাস করেন, ছুটিছাটার দিনে সন্ধ্যার দিকে ধোপ-দোরস্ত পাঞ্জাবি গায়ে, ছড়ি হাতে প্রায়ই নারাণবাবুর ঘরে আসিয়া বসেন ও নানাবিধ উঁচু ধরনের কথাবার্তা বলেন।

উঁচু ধরনের কথা নারাণবাবু পছন্দ করেন, গোপীভাবের কথা নয়।

কংগ্রেসের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা, ওয়াশিংটন-চুক্তির ভিতরের রহস্য, আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলরের বক্তৃতা, শিক্ষাসমস্যা সংক্রান্ত কথা প্রভৃতি আলোচনাকেই নারাণবাবু উচ্চ বিষয় বলিয়া থাকেন। বিংশ শতাব্দীর শিক্ষিত লোকে রাসলীলার আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা লইয়া মাথা ঘামায় না।

পঞ্চাননবাবু নিজে ইংরেজি-শিক্ষিত নহেন, সেকালের ছাত্রবৃত্তি-পাস মোক্তার, সুতরাং ইংরেজি  শিক্ষার উপর হাড়ে চটা। পশ্চিম হইতে যাহা কিছু আসিয়াছে সব খারাপ, এ দেশে যাহা ছিল সব ভালো। কৃষ্ণদাস কবিরাজের (পঞ্চানন মোক্তার বলেন, কবিরাজ গোস্বামী) চৈতন্যচরিতামৃত তাঁহার মতে বাংলা সাহিত্যের শেষ ভালো গ্রন্থ।

পঞ্চানন মোক্তার গদগদ কণ্ঠে বলেন, কী সব ইংরেজি বলেন আপনারা বুঝি না! কিন্তু কবিরাজ গোস্বামীর পর আর বই হয় না, বাংলায় আর বই নাই, লেখা হয় নাই তার পরে—

এ রকম লোকের সঙ্গে লেসলি স্টিফেন ও মিলের ছাত্র নারায়ণবাবু কী তর্ক করিবেন?

জীবনে তিনি একজন খাঁটি দার্শনিক দেখিয়াছিলেন—অনুকূলবাবু। নিজের জন্য কখনও কিছু করেন নাই, স্কুল গড়িয়া তুলিবেন মনের মত করিয়া, ভালো শিক্ষা দিবেন তাঁহার স্কুলে, কলিকাতার মধ্যে একটি আদর্শ বিদ্যালয়ে পরিণত করিবেন স্কুলকে। ইহাকে কেন্দ্র করিয়াই তাঁহার যত কল্পনা, যত আলোচনা—কত বিনিদ্র রজনী যাপন করিয়াছেন স্কুলের ভবিষ্যৎ ভাবিয়া! অমন সাধুপুরুষ জন্মায় না।

এই সব তিলক-কণ্ঠিধারী গোপীভাবে বিভোর লোকের মেরুদণ্ডহীন ব্যক্তিত্বের তুলনায় অনুকূলবাবু একটা পুরা মানুষ। আর এই সাহেবটাও মন্দ নয়, অনুকূলবাবুর মত এও স্কুল বলিতে পাগল। স্কুলের স্বার্থ, ছাত্রদের স্বার্থ সবচেয়ে বড় ওর কাছে। তবে অনুকূলবাবু ছিলেন খাঁটি স্টোইক আর সাহেব এপিকিউরিয়ান—এই যা তফাত।

যা হোক, নারাণবাবুর ভালো লাগে না—পঞ্চানন মোক্তারকে না, বরিশালের এ পাড়াগাঁ না। পঞ্চানন ছাড়া গ্রামে আরও অনেক মানুষ আছে বটে, কিন্তু তাহাদের সঙ্গে নারাণবাবুর খাপ খায় না। নারাণবাবু ভাবেন, তাহারা ছেলেছোকরা, তাহাদের সঙ্গে কী মিশিবেন! তা ছাড়া যাচিয়া তিনি কাহারও সঙ্গে দেখা করিতে যাইবেন না। কলিকাতার লোক, একটু লাজুক ধরনেরও আছেন।

একদিন গ্রামের বাঁশবনে জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষে খুব বর্ষা নামিয়া বাঁশঝাড়ের রঙ কালো দেখাইতেছে। চারিদিক মেঘে ঘিরিয়াছে গ্রামখানিকে, টারাসাদের ঘন জঙ্গলে বৃষ্টির ধারার শব্দ। গ্রামে এক জায়গায় গান-বাজনার মজলিশ হইবে, খুব আগ্রহ লইয়া নারাণবাবু সেখানে গিয়া দেখিলেন—পঞ্চানন মোক্তার, দীনবন্ধু স্যাকরা গলায় ত্রিকণ্ঠি তুলসীর মালা ঝুলাইয়া মজলিশ জুড়িয়া বসিয়া। আরও অনেক উহাদের শিষ্য-প্রশিষ্য বসিয়া আছে। কিছুক্ষণ পরে কীর্তন শুরু হইল, নারাণবাবু চলিয়া আসিলেন—তাঁহার ভালো লাগে না।

.

কীর্তন কেন তাঁহার ভালো লাগে না, ইহা লইয়া পঞ্চানন মোক্তারের সঙ্গে তর্ক করিয়া একদিন তিনি হার মানিয়াছেন। পঞ্চানন মোক্তার বলে, কীর্তন বাংলার নিজস্ব জিনিস, সঙ্গীতে বাংলার প্রধান দান—এমন মধুর রসের জিনিস যে উপভোগ করিতে না শিখিল, তার শ্রবণেন্দ্রিয়ই মিথ্যা।

নারাণবাবু বলেন, তিনি বোঝেন না, তাঁহার ভালো লাগে না—মিটিয়া গেল। যে ভালো অত তর্ক করিয়া বুঝাইতে হয়, তাহার মধ্যে তিনি নাই। ‘বাংলাদেশের দান, বাংলাদেশের দান’ বলিয়া চেঁচাইলে কী হইবে! বাংলাদেশ, বাংলাদেশ—তিনি নিজে নিজে, ইহার চেয়ে কথা আছে? মিটিয়া গেল।

সেদিন সেখান হইতে বাহির হইয়া পল্লীগ্রামের উপর বিতৃষ্ণা ধরিয়া গেল নারাণবাবুর। কী বিশ্রী জায়গা এ সব, বৃষ্টির পরে বাঁশবনের চেহারা দেখিলে মনে হয়, কোথায় যেন পড়িয়া আছেন। এমন জায়গায় কি মানুষ থাকে!  কলিকাতার ফুটপাথে কোথাও এতটুকু ধুলাকাদা নাই—কি বিশাল জনস্রোত ছুটিয়াছে নিজের নিজের কাজে, সুইচ টিপিলেই আলো, কল টিপিলেই জল। সন্ধ্যার সময় যখন চারিদিকে বাড়িতে আলো জ্বলিয়া ওঠে, ‘বঙ্গবাণী’ প্রেসে ফ্ল্যাট মেশিনের শব্দ হয়, ওয়েলেসলি স্ট্রীট দিয়া ঘণ্টা বাজাইয়া ট্রাম চলে, তখন এক অদ্ভুত রহস্যের ভাবে মন পূর্ণ হইয়া যায়; মনে হয়, চিরজীবন এ কর্মব্যস্ত জনস্রোতের মধ্যে কাটাইলেও ক্লান্তি আসে না, প্রাণ নবীন হয়, এতটুকু সময়ের জন্য অবসাদ আসে না মনে।

এখান হইতে চলিয়া যাইতেন, কিন্তু ভাগ্নী যাইতে দেয় না, জোর করিয়াও যাইতে মন সরে না।

.

জ্যোতির্বিনোদ মহাশয়ও বাড়ি গিয়া খুব শান্তিতে নাই। তাঁহার বাড়ি নোয়াখালি জেলায়। তিন বৎসরে এই একবার বাড়ি আসেন, বাড়িতে স্ত্রীপুত্র সবাই আছে। দুই-তিন ভাই, খুব বড় পরিবার—এমন কিছু বেশি মাহিনা পান না, যাহাতে স্ত্রীপুত্র লইয়া  কলিকাতায় থাকিতে পারেন। বাড়িতে আসিয়াই জ্যোতির্বিনোদ এবার এক মোকদ্দমায় পড়িয়া গেলেন, জমিজমা সংক্রান্ত শরিকি মোকদ্দমা। তাহার পর হইল বড় ছেলেটির টাইফয়েড, সে সতেরো দিন ভুগিয়া এবং পয়সা খরচ করাইয়া ঠেলিয়া উঠিল তো স্ত্রী পা পিছলাইয়া হাঁটু ভাঙিয়া শয্যাগত হইয়া পড়িল।

এই রকম নানা মুশকিলে জ্যোতির্বিনোদ অতিষ্ঠ হইয়া উঠিলেন। এদিকে কলিকাতায় থাকিলে লোকের হাত দেখিয়া, ঠিকুজি কুষ্টি তৈরি করিয়া কিছু কিছু উপার্জনও হয়। এখানে সে উপার্জন নাই, শুধু খরচ আর খরচ।

কলিকাতায় একরকম থাকেন ভালো, একা ঘরে একা থাকেন, কোনো গোলমাল নাই। সাহেবের দাপট সহ্য করিয়া থাকিতে পারিলে আর কোনো হাঙ্গামা নাই। নিজে যা-খুশি দুইটি রান্না করিলেন, অভাব অভিযোগ হইলে নারাণবাবুর কাছে টাকাটা সিকিটা ধার করিয়া দিন চলিয়া যায়। বাড়ির এত ঝঞ্ঝাট পোহাইতে হয় না। যে চিরকাল একা কাটাইয়া আসিয়াছে, তাহার পক্ষে এসব বড় বোঝা বলিয়া মনে হয়।

ছুটি ফুরাইলে যেন বাঁচা যায়।

.

যদুবাবু ছিলেন কলিকাতায়, একটা মাত্র টুইশানি সন্ধ্যার সময়—অন্য অন্য টুইশানির ছাত্র কলিকাতার বাহিরে গিয়াছে। দিবানিদ্রা হইতে উঠিয়া বেলা পাঁচটার সময় চা খাইয়া তিনি টুইশানিতে যান। সময় কাটাইবার ওই একমাত্র উপায়। পথে এক কবিরাজ-বন্ধুর ওখানে বসিয়া কিছুক্ষণ গল্প-গুজব করেন। স্কুল-মাস্টারদের জগৎ সংকীর্ণ, বৃহত্তর কলিকাতা শহরে চেনেন কেবল টুইশানির ছাত্র ও তাহাদের অভিভাবকদের, কিংবা স্কুল-কমিটির দু-একজন উকিল কিংবা ডাক্তারকে। তাঁহাদের বাড়িতেও মাঝে মাঝে যদুবাবু গিয়া থাকেন, কমিটির মেম্বারদের তোয়াজ করা ভালো—কী জানি, কখন কী ঘটে!

একঘেয়ে ভাবে সময় আর কাটিতে চায় না, দিবানিদ্রার অভ্যাস ক্রমশ পাকা হইয়া আসিতেছে। স্কুল-বাড়ির সামনে দিয়া আসিবার সময় চাহিয়া দেখেন সাহেবের ঘরে আলো জ্বলিতেছে কিনা। সাহেব দার্জিলিং বেড়াইতে গিয়াছে মেম সিবসনকে লইয়া—ছুটি ফুরাইবার আগের দিন বোধ হয় ফিরিবে।

অবশেষে দীর্ঘ গ্রীষ্মাবকাশ ফুরাইল। সব মাস্টার একত্র হইলেন।

যদুবাবু বলিলেন, এই যে জ্যোতির্বিনোদ মশায়, নমস্কার! বেশ ভালো ছিলেন? কবে এলেন?

হেডপণ্ডিত যদুবাবুর সঙ্গে কোলাকুলি করিয়া বলিলেন, ভালো যদু? এখানেই ছিলে?

সকলে মিলিয়া বৃদ্ধ নারাণবাবুর পায়ের ধুলা লইয়া প্রণাম করিলেন। নারাণবাবুর স্বাস্থ্য ভালো হইয়া গিয়াছে। যেখানে গিয়াছিলেন, সেখানে দুধ ঘি মাছ সস্তা, খাওয়া-দাওয়া এখানকার চেয়ে ভালো অনেক, এখানে হাত পুড়াইয়া ভাতে-ভাত রাঁধিয়া খাইয়া থাকিতে হয়। এ বয়সে সেবাযত্ন পাওয়া আবশ্যক—সকলে এসব কথা বলিয়া নারাণবাবুকে আপ্যায়িত করিল।

মাস্টারদের মধ্যে পরস্পর প্রীতি ও আত্মীয়তার বন্ধন স্পষ্ট হইয়া ফুটিয়াছে দীর্ঘদিন পরস্পর অদর্শনের পর—হিংসা বা মনোমালিন্যের চিহ্নও নাই। এমন কি মিঃ আলমকে দেখিয়াও যেন সকলে খুশি হইল।

হেডমাস্টার বলিলেন, ওয়েলকাম জেন্টলমেন। আশা করি, আপনারা সব ভালো ছিলেন। এবার হাফ-ইয়ারলি পরীক্ষা সামনে, সকলে তৈরি হোন, প্রশ্নপত্র তৈরি করুন। আজই সারকুলার বার হবে।

আলম নিজের দেশ হইতে হেডমাস্টারের জন্য প্রায় দুই ডজন মুরগির ডিম একটা টিনের কৌটা ভরিয়া আনিয়াছে। সিবসন ডিম পাইয়া খুব খুশি।

—ওঃ, মিঃ আলম, ইট ইজ সো গুড অফ ইউ! সাচ নাইস এগস অ্যান্ড সো ফ্রেশ!

কিন্তু পরক্ষণেই সাহেব ও মেম দুইজনকেই আশ্চর্য করিয়া মিঃ আলম কাগজ-জড়ানো কী একটা বাহির করিয়া টেবিলের উপর রাখিল।

মেম বলিল, কী ওটা?

সাহেব বলিয়া উঠিলেন, গুড হেভনস! সিওরলি দ্যাট ইজ নট এ শোলডার অফ মাটন?

মিঃ আলম মৃদু হাসিয়া বলিল, ইয়েস স্যার, ইট ইজ স্যার। এ লিটল শোলডার অফ মাটন—ফ্রম মাই হোম স্যার।

বিস্মিত ও আনন্দিত মিস সিবসন বলিল, থ্যাঙ্কস অ-ফুলি মিঃ আলম!

যদুবাবু টিচারদের ঘরে আড়ালে বলিলেন, ঢের ঢের খোশামুদে দেখেচি বাবা, কিন্তু এ দেখছি সকলের উপর টেক্কা দিলে—আবার বাড়ি থেকে বয়ে ভেড়ার দাপনা এনেচে!

ক্ষেত্রবাবু বলিলেন, বাড়ি থেকে না ছাই! আপনিও যেমন! ওর বাড়িতে একেবারে দলে দলে ভেড়া চরচে! ক্ষেপেছেন আপনি? ওসব চাল-দেখানো আমরা বুঝি নে? মিউনিসিপ্যাল মার্কেট থেকে কিনে এনেছে মশাই!

ছেলেরা ক্লাসে ক্লাসে প্রণাম করিল মাস্টারদের। আজ বেশি পড়াশুনা নাই, সকাল সকাল ছুটি হইয়া গেলে সকলে মিলিয়া পুরনো চায়ের দোকানে চা পান করিতে গেলেন। দোকানী তাঁহাদের দেখিয়া লাফাইয়া উঠিল : আসুন বাবুরা, আসুন—ভালো ছিলেন সব? আজ স্কুল খুলল বুঝি? ওরে, বাবুদের চা দে! আবার সেই পুরনো ঘরে বসিয়া বহুদিন পরে পুরনো সঙ্গীদের সঙ্গে চা-পান। সকলেরই খুব ভালো লাগে।

যদুবাবু বলেন, নারাণদা, গল্প করুন সে দেশের!

—আরে রামো, সে আবার দেশ! মোটে মন টেঁকে না। দুধ ঘি খেতে পেলেই কি হল! মানুষের মন নিয়ে হল ব্যাপার—মন যেখানে টেঁকে না, সে দেশ আবার দেশ!

ক্ষেত্রবাবু বলিলেন, যা বলেচেন দাদা! গেলাম পৈতৃক বাড়িতে, ভাবলাম, অনেক দিন পরে এলাম, বেশ থাকব। কিন্তু মশাই, দু দিন যেতে-না-যেতে দেখি আর সেখানে মন টিঁকচে না।

— কলকাতার মতন জায়গা আর কোথাও নেই রে ভাই।

—খুব সত্যি কথা।

—মানুষের মুখ যেখানে দেখা যায়, দুটো বন্ধুর সঙ্গে গল্প করে সুখ যেখানে, খাই না-খাই সেখানে পড়ে থাকি।

নারাণবাবু অনেকদিন পরে চুনিদের বাড়ি পড়াইতে গেলেন।

চুনিরা দেওঘর না কোথায় গিয়াছিল, বেশ মোটাসোটা হইয়া ফিরিয়াছে। অনেকদিন পরে চুনির সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়াতে নারাণবাবু বড় আনন্দ পাইলেন।

চুনি আসিয়া প্রণাম করিল। নারাণবাবু প্রথম দিনটা তাহাকে পড়াইলেন না, বরিশালে যে গ্রামে গিয়াছিলেন, সে গ্রামের গল্প করিলেন, পঞ্চানন মোক্তারের কথা বলিলেন। চুনি তাঁহার কাছে দেওঘরের গল্প করিল।

নারাণবাবু বলিলেন, পান্না কোথায় রে?

—সে স্যার, মাসিমার বাড়ি গিয়েছে কালীঘাটে, কাল আসবে। মাসিমার বড় ছেলের পৈতে কিনা!

—তুই যাস নি যে?

—স্যার, আজ প্রথম দিনটা—আপনি আসবেন, রাত্রে যাব।

উত্তর শুনিয়া নারাণবাবু আহ্লাদে আটখানা হইয়া গেলেন। নিজের ছেলেপিলে নাই, পরের ছেলেকে মানুষ করা, তাহাদের নিজের সন্তানের মত দেখিয়া অপত্যস্নেহের ক্ষুধা নিবারণ করা যাহাদের অদৃষ্টলিপি—তাহাদের এ-রকম উত্তরে খুশি হইবার কথা। চুনি বলিল, চা খাবেন স্যার? আনি—

নারাণবাবু ভাবেন—নিজের নাই, তাতে কী? আমার ছেলেমেয়ে এই ওয়েলেসলি অঞ্চলে সর্বত্র ছড়ানো—আমার ভাবনা কী? একটা করে টাকা যদি দেয় প্রত্যেকে, বুড়ো বয়সে আমার ভাবনা কী?

—স্যার, আজ পড়ব না।

—বেশ, গল্প শোন—এই বরিশালের গাঁয়ে—

—না স্যার, একটা ভূতের গল্প করুন।

—ভূত-টুত সব মিথ্যে। ওসব নিয়ে মাথা ঘামাস নে ছেলেবেলা থেকে।

—কিন্তু স্যার, কুণ্ডাতে একটা বাড়ি আছে—

—কোথায়?

—কুণ্ডা—দেওঘরের কাছে স্যার। সেখানে একটা বাড়িতে ভূতের উপদ্রব ব’লে কেউ ভাড়া নেয় না। সত্যি, আমরা জানি স্যার!

নারাণবাবু আর এক সমস্যায় পড়িলেন। মিথ্যা ভয় এক বালকের মন হইতে কী করিয়া তাড়ানো যায়? নানা কুসংস্কার বালকদের মনে শিকড় গাড়িবার সুযোগ পায় শুধু অভিভাবকদের দোষে। তিনি শিক্ষক, তাঁহার কর্তব্য, বালকদের মন হইতে সে সমস্ত কুসংস্কার উচ্ছেদ করা।

নারাণবাবু নিজের নোট-বইয়ে লিখিয়া লইলেন। সাহেবের সঙ্গে পরামর্শ করা আবশ্যক, এ বিষয়ে কী করা যায়।

চুনির মা আসিয়া  দরজার কাছে দাঁড়াইয়া বলিলেন, বলি ও দিদি, মাস্টারকে বল না—ছেলে যে মোটে বই হাতে করতে চায় না!

(দেওঘরে গিয়ে বেড়িয়ে আর খেলে বেড়াবে—তার কী করবেন উনি?)

নারাণবাবু বলিলেন, বউমা, চুনি ছেলেমানুষ, একদিনে দুদিনে ও স্বভাব ওর যাবে না। আমি ওকে বিশেষ স্নেহ করি, সেদিকে আমার যথেষ্ট নজর আছে, আপনি ভাববেন না।

চুনির মা বলিলেন, ও দিদি, বল যে, পরীক্ষা সামনে আসছে, চুনিকে দু বেলা পড়াতে হবে। এক মাস দেড় মাস তো বসিয়ে মাইনে দিয়েছি। এখন মাস্টার যেন দু-বেলা আসে।

নারাণবাবু মেয়েমানুষের কাছে কী প্রতিবাদ করিবেন? ন্যায্য পড়াইয়া এখানে মাহিনা আদায় করিতে গায়ের রক্ত জল হইয়া যায়, ছুটির মাস বসাইয়া কে তাঁহাকে মাহিনা দিল? ছুটির আগের মাসের মাহিনা এখনও বাকি!

মুখে বলিলেন, বউমা, সকালে আজকাল সময় বেশি পাওয়া যায় না। আমারও নিজের একটু কাজ আছে। আচ্ছা, তা বরং দেখব—

—দেখাদেখি চলবে না বলে দাও দিদি। আসতেই হবে—না পারেন, আমরা অন্য মাস্টার রাখব। ওই তো সেদিন পাশের মেসের ছেলে—তিনটে পাসের পড়া পড়ছে—বলছিল, আমায় দশ টাকা দেবেন, দু বেলা পড়াব।

এই সময় চুনি মাকে ধমক দিয়া বলিল, যাও না এখান থেকে, তোমায় আর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিকনেস কাটতে হবে না!

নারাণবাবু বলিলেন, ছিঃ মাকে অমন কথা বলতে আছে?

মনে মনে কিন্তু খুশি হইলেন।

চুনি বলিল, স্যার, আপনি মার কথা শুনবেন না। দু বেলা আপনি পড়ালেও আমি পড়ব না। আমার দু বেলা পড়তে ইচ্ছে করে না।

নারাণবাবুর আনন্দ অনেকখানি উবিয়া গেল। তাঁহার অসুবিধা দেখিয়া তাহা হইলে চুনি কথা বলে নাই, সে দেখিয়াছে নিজের সুবিধা! পাছে নারাণবাবু স্বীকার করিলে দুই বেলা পড়িতে হয়, তাই মাকে ধমক দিয়াছে হয়তো।

বাড়িতে ফিরিয়া দেখিলেন, তাঁহার এঞ্জিনীয়ার-বন্ধুটি তাঁহার জন্য অপেক্ষা করিতেছেন।

—কী নারাণবাবু, কবে ফিরলেন?

—আজ দিন-তিনেক। ভালো সব? বসুন, বসুন শরৎবাবু।

মনের মতন সঙ্গী পাইয়াছেন তিনি। উঃ, কোথায় বরিশালের অজ-পাড়াগাঁয়ের পঞ্চানন মোক্তার, আর কোথায় তাঁহার এই বন্ধু শরৎ সান্যাল!

দুইজনে যেমন একত্র হইয়াছেন, অমনি উঁচু বিষয়ের আলোচনা শুরু। এই জন্যই  কলিকাতা এত ভালো লাগে। এ সব লইয়া কথা বলিবার লোক কি বাংলাদেশের অজ-পাড়াগাঁয়ে মিলবে?

নারাণবাবুর বন্ধু বলিলেন, ভালো কথা দাদা, আপনাকে দেখাব বলে রেখে দিয়েছি!

—কী?

—‘রিডার্স ডাইজেস্ট’-এ একটা আর্টিকল বেরিয়েছে বর্তমান চায়নার ব্যাপার নিয়ে। কাল এনে দেখাব।

—আচ্ছা, কাল আসবেন। কিন্তু আমার ভবিষ্যদ্বাণী স্মরণে আছে তো ওয়াশিংটন-চুক্তি সম্বন্ধে?

—আপনার ও-কথা টেঁকে না। রামানন্দবাবুর মন্তব্য পড়ে দেখবেন এ মাসের ‘মডার্ন রিভিউ’-এ।

—আলবাত টেঁকে। আমি কারও কথা মানি নে।

এ কথা নারাণবাবু বলিলেন একটা খাঁটি ইনটেলেকচুয়াল আলোচনা জমাইয়া তুলিবার জন্য। তর্ক না হইলে আলোচনা জমে না।

কলিকাতা না হইলে এমন মনের খোরাক কোথায় জোটে?

দুই বন্ধুতে মিলিয়া মনের খেদ মিটাইয়া রাত এগারোটা পর্যন্ত ইনটেলেকচুয়াল আলোচনা চলিল। দুইজনেই সমান তার্কিক। কোনো কথারই মীমাংসা হইল না। তা না হউক, মীমাংসার জন্য কেহ তর্ক করে না, তর্কের খাতিরেই তর্ক করিতে হয়। আফিমের নেশার মত তর্কের নেশাও একবার পাইয়া বসিলে আর ছাড়িতে চায় না।

নারাণবাবু বলিলেন, আজ একটু যোগবাশিষ্ঠ পড়া হল না!

—তা বেশ তো, পড়ুন না। আরও রাত হোক।

অনেক রাত্রে নারাণবাবুর বন্ধু রায় বাহাদুর শরৎ সান্যাল বিদায় গ্রহণ করিলে নারাণবাবু রান্না চড়াইলেন। মনে এত আনন্দ, ও-বেলার বাসি পুঁটিমাছ-ভাজা ছিল, তাই দিয়া ঝোল চড়াইলেন, আর ভাত—আর কিছু না। মনের আনন্দই মানুষকে তাজা রাখে, খাইয়া মানুষ বাঁচে না শুধু।

খাওয়া শেষ হইলে সাহেবের ঘরের দিকে উঁকি মারিয়া দেখিলেন, সাহেবের টেবিলে আলো জ্বলিতেছে, অত রাত্রে সাহেব লেখাপড়া করিতেছেন নাকি? নারাণবাবুর ইচ্ছা হইল, ঘরে ঢুকিয়া দেখেন সাহেব কী পড়িতেছেন?

সাহেব বলিলেন, কাম ইন!

নারাণবাবু বিনীত হাস্যের সহিত ঘরে ঢুকিলেন।

—ইয়েস?

—না, এমনি দেখতে এলাম, আপনি কী পড়ছেন?

—আমি আপিসের কাজ করছিলাম। বোসো।

—স্যার,  কলকাতার মত জায়গা নেই।

—আমাদের মত লোক অন্য জায়গায় গিয়ে থাকতে পারে না। আমার এক ভাই চায়নাতে আছে—মিশনারি। ক্যান্টন থেকে নদীপথে যেতে হয়—অনেক দূর। আগে সে ব্রিটিশ গানবোটে মেডিক্যাল অফিসার ছিল, এখন মিশনারি হয়েছে। সে কিন্তু চীনদেশের একটা অজ-পাড়াগাঁয়ে মিশনে থাকে। আমি একবার গিয়েছিলাম সেখানে, গিয়ে আমার মন হাঁপিয়ে উঠল।

—আমিও স্যার বরিশালে গিয়েছিলাম ছুটিতে, আমার মন টেঁকে নি।

একটুখানি চুপ করিয়া থাকিয়া কহিলেন, স্কুলটাকে আরও ভালো করতে হবে স্যার।

—আমিও তাই ভাবছি। একটা বিজ্ঞাপন দেব কাগজে, আরও ছেলে হোক।

দুজনে বসিয়া স্কুলের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে অনেক কথাবার্তা হইল।

নারাণবাবু বিদায় লইয়া শয়নের জন্য গেলেন।


© 2024 পুরনো বই