অশনি সংকেত – ৪

বৈশাখের মাঝামাঝি থেকে কতকগুলি আশ্চর্য পরিবর্তন লক্ষ করলে গঙ্গাচরণ বাজারের জিনিসপত্র কিনতে গিয়ে। প্রত্যেক জিনিসের দাম ক্রমশ চড়ে যাচ্ছে। কিন্তু তা যাক গে, সেদিন হাটে একটা ঘটনা দেখে শুধু গঙ্গাচরণ নয়, হাটের সব লোকই অবাক হয়ে গেল।

ঘটনাটা অতি সামান্য। ইয়াসিন বিশ্বাসের বড় গোলদারি দোকান। তাতে কেরোসিন তেল আনতে গিয়ে অনেকে শুধু হাতে ফিরে গেল। তেল নাকি নেই!

গঙ্গাচরণের বিশ্বাস হলো না কথাটা। সে নিজেও তেল নেবে। তেলের বোতল হাতে দোকানে গিয়ে দাঁড়াতেই ইয়াসিনের দাদা ইয়াকুব বললে—তেল নেই পণ্ডিত মশাই—

—নেই?

—আজ্ঞে না।

—তেল আনোনি?

—আজ্ঞে পাওয়া যাচ্ছে না।

—সে কি কথা? ক্রাসিন পাওয়া যাচ্চে না?

—আমাদের চালান আসে নি এবার একদম। শুনলাম নাকি মহকুমা হাকিমের কাছে দরখাস্ত করতে হবে চালান পাঠাবার আগে।

—কবে আসতে পারে?

—আজ্ঞে কিছু ঠিক নেই—

গঙ্গাচরণ বোতল হাতে বেরিয়ে আসচে, ইয়াকুব সুর নিচু করে বললে—বাবু, এই বেলা কিছু নুন আর কিছু চাল কিনে রাখুন—ও দুটো জিনিস যদি ঘরে থাকে, তা হলে কষ্টস্রেষ্ট করে আধপেটা খেয়েও চলবে!

—কেন, ও দুটো জিনিসও কি পাওয়া যাবে না নাকি?

—পণ্ডিত মশাই, সাবধানের মার নেই, আমরা হলাম ব্যবসাদার মানুষ, সব দিকে নজর রেখে চলতি হয় কিনা? কে জানে কি হয় মশাই!

গঙ্গাচরণ ভাবতে ভাবতে বাড়ী চলে এসে স্ত্রীকে বললে—আজ একটি আশ্চর্য কাণ্ড দেখলাম—

—কি গা?

—পয়সা হলেও জিনিস মেলে না এই প্রথম দেখলাম। কোনো দোকানেই নেই—আরও একটি কথা বললে দোকানদার। চালও কিনে রাখতে হবে নাকি!

অনঙ্গ-বৌ তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললে—দূর! রেখে দাও ওদের সব গাঁজাখুরি কথা। চাল পাওয়া যাবে না, নুন পাওয়া যাবে না, তবে দুনিয়া পৃথিমে লোকে বাঁচতে পারে ককখনো? কি খাবে এখন?

—যা দেবে!

অনঙ্গ টাটকা-ভাজা মুড়ি গাওয়া ঘিতে মেখে নিয়ে এসে দিলে—তার সঙ্গে শসা কুচোনো। বললে—একটু চিনি দেবো, ওর সঙ্গে মেখে খাবে?

—নাঃ, চিনি আমার ভালো লাগে না। হাবু কোথায়?

—বাড়ী নেই। বিশ্বেস মশায়ের নাতির সঙ্গে ওর খুব ভাব হয়েচে কিনা। ডেকে নিয়ে গেল এসে। বড় মানুষের নাতির সঙ্গে ভাব থাকা ভালো। সময়ে অসময়ে দুটো জিনিস চাইলেও পাওয়া যাবে। সেজন্যে আমিও যেতে বারণ করি নি।

—এসো দুটো মুড়ি খাও আমার সঙ্গে।

অনঙ্গ-বৌ সলজ্জ হেসে বললে—আহা, রস যে উথলে উঠচে! আজ বাদে কাল যে ছেলের বৌ ঘরে আনতে হবে, খেয়াল আছে?

বলেই এসে স্বামীর পাশে বসে বাটি থেকে একমুঠো ঘি-মাখা মুড়ি তুলে নিয়ে মুখে ফেলে দিল। স্বামীর দিকে বিলোল কটাক্ষে চেয়ে বললে—মনে পড়ে, সেই ভাতছালায় বিলের ধারে একদিন তুমি আর আমি এক বাটি থেকে চিঁড়ের ফলার খেয়েছিলাম? হাবু তখন ছোট।

অনঙ্গ-বৌয়ের হাসি ও চোখের বিলোল দৃষ্টি প্রমাণ করিয়ে দিলে সে বিগত-যৌবনা নয়, পুরুষের মন এখনও হরণ করার শক্তি সে হারায় নি।

গঙ্গাচরণ স্ত্রীর দিকে চেয়ে রইল মুগ্ধ দৃষ্টিতে।

.

ফাল্গুন মাসের শেষে গঙ্গাচরণ একদিন পাঠশালায় ছুটি দিয়ে চলে আসছে, কামদেবপুরের দুর্গা পণ্ডিত পথে ওকে ধরে বললে—ভালো আছেন? সেদিন গিয়েছিলেন কামদেবপুর, আমি ছিলাম না, নমস্কার।

—নমস্কার। ভালো আছেন?

—একরকম চলে যাচ্ছে। আপনার সঙ্গেই দেখা করতে আসা।

—কেন বলুন?

—আমার তো আর ওখানে চলে না। পৌনে সাত টাকা মাইনেতে একেবারে অচল হল। চালের মণ হয়েচে দশ টাকা।

গঙ্গাচরণের বুকটার মধ্যে ধক করে উঠলো। অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে দুর্গা পণ্ডিতের দিকে চেয়ে সে বললে—কোথায় শুনলেন?

—আপনি জেনে আসুন রাধিকাপুরের বাজারে।

—সেদিন ছিল চার টাকা, হল ছ’টাকা, এখন অমনি দশ টাকা!

—মিথ্যে কথা বলি নি, খোঁজ নিয়ে দেখুন।

—মণে চার টাকা চড়ে গেল! বলেন কি?

—তার চেয়েও একটি কথা শোনলাম, তা আরও ভয়ানক। চাল নাকি এবার না কিনলে এরপরে বাজারে আর মিলবে না। শুনে তো পেটের মধ্যে হাত পা ঢুকে গেল মশাই।

গঙ্গাচরণের সঙ্গে দুর্গা পণ্ডিত ওর বাড়ী পর্যন্ত এল। গঙ্গাচরণের বাইরের ঘর নেই, উঠোনের ঘাসের ওপরে মাদুর পেতে দুর্গা পণ্ডিতের বসবার জায়গা করে দিলে। তামাক সেজে হাতে দিলে। বললে—ডাব কেটে দেবো? খাবেন?

—হ্যাঁ, সে তো আপনার হাতের মুঠোর মধ্যে! বেশ আছেন!

—আর কিছু খাবেন?

—না, না, থাক। বসুন আপনি।

একথা ওকথা হয়, দুর্গা পণ্ডিত কিন্তু ওঠবার নাম করে না।

গঙ্গাচরণ ভাবলে, কামদেবপুর এতটা পথ—যাবে কি করে? সন্দে তো হয়ে গেল।

আরও বেশ কিছুক্ষণ কাটলো। গঙ্গাচরণ কিছু বুঝতে পারচে না।

এখনও যায় না কেন? শীতের বেলা, কোনো কালে সূর্য অস্তে গিয়েচে।

হঠাৎ দুর্গা পণ্ডিত বললে—হ্যাঁ, ভালো কথা—এবেলা আমি দুটো খাবো কিন্তু এখানে।

—খাবেন? তাহলে বাড়ীর মধ্যে বলে আসি।

অনঙ্গ-বৌ রান্নাঘরে চাল ভাজছিল, স্বামীকে দেখে বললে—ওগো, তোমার সেই পণ্ডিত মশায়ের জন্যে দুটো চাল ভাজছি যে। তেল নুন মেখে তোমরা দুজনেই খাওগে—

—শোনো, পণ্ডিত মশাই রাত্তিরে এখানে খাবেন।

—তুমি বললে বুঝি?

—না, উনিই বলছেন। আমি কিছু বলি নি।

—অন্য কিছু নয়, কি দিয়ে ভাত দিই পাতে? একটু দুধ যা ছিল ওবেলা তুমি আর হাবু খেয়েছ।

দুর্গা পণ্ডিতের কথাবার্তা শুনে গঙ্গাচরণের মনে হল সে খুব ভয় পেয়েছে। এমন একটা অবস্থা আসবে সে কখনো কল্পনাও করতে পারে না। ওর ভয়ের ছোঁয়াচ এসে গঙ্গাচরণের মনেও পৌঁছায়। বাইরে ঘোড়ানিম গাছটার তলায় অন্ধকার রাত্রে বসবার জন্যে হাবু একটা বাঁশের মাচা করেছিল। দুই পণ্ডিত সেই মাচার ওপর একটি মাদুর বিছিয়ে দিব্যি ফুরফুরে ফাল্গুনে হাওয়ায় বসে তামাক ধরিয়ে কথাবার্তা বলছিল। হাবু এসে বললে—বাবা, নিয়ে এসো ওঁকে, খাওয়ার জায়গা হয়েছে—

মুগের ডাল, আলুভাতে, পেঁপের ডালনা ও বড়াভাজা। অনঙ্গ-বৌ রাঁধতে পারে খুব ভালো। দুর্গা পণ্ডিতের মনে হল এমন সুস্বাদু অন্নব্যঞ্জন অনেক দিন খায় নি। হাবু বললে—মা জিজ্ঞেস করছে আপনাকে কি আর দুখানা বড়াভাজা দেবে?

গঙ্গাচরণও ওই সঙ্গে খেতে বসেচে। বললে—হ্যাঁ হ্যাঁ, নিয়ে আয় না। জিজ্ঞেস করাকরি কি?

অনঙ্গ-বৌ আড়ালে থেকে হাবুর হাতে পাঠিয়ে দিলে একটা রেকাবিতে কিছু পেঁপের ডালনা, ক’খানা বড়াভাজা।

গঙ্গাচরণ বললে—ওগো, তুমি ওঁর সামনে বেরোও, উনি তোমার ধনপতি কাকার বয়েসী। আপনার বয়েস আমার চেয়ে বেশী হবে, কি বলেন?

দুর্গা পণ্ডিত বললেন—অনেক বেশী। বৌমাকে আসতে বলুন না? একটা কাঁচা ঝাল নিয়ে আসুন।

একটু পরে অনঙ্গ-বৌ লজ্জা-কুণ্ঠা-জড়িত সুঠাম সুগৌর কাঁচের চুড়ি-পরা হাতে গোটা-দুই কাঁচালঙ্কা এনে দুর্গা পণ্ডিতের পাতে ফেলে দিতেই দুর্গা পণ্ডিত ওর দিকে মুখ তুলে চেয়ে বললে—মা যে আমার লক্ষ্মী পিরতিমে। আমার এক ভাইঝির বয়িসী বটে। কোনো লজ্জা নেই আমার সামনে বৌমা—একটু সরষের তেল আছে? দাও তো মা—

হাবু বললে—মা বলচে, দুধ নেই। একটু তেঁতুল গুড় মেখে ভাত ক’টা খাবেন?

—হাঁ হাঁ, খুব। দুধ কোথায় পাবো? বাড়ীতেই কি রোজ দুধ খাই নাকি?

দুর্গা পণ্ডিত এই বয়সেও কিন্তু বেশ খেতে পারে। মোটা আউশ চালের রাঙা রাঙা ভাত শুধু তেঁতুল গুড় মেখেই যা খেলে, গঙ্গাচরণের তা দু’বেলার আহার। অনঙ্গ-বৌ কিন্তু খুব খুশি হল দুর্গা পণ্ডিতের খাওয়া দেখে। যে মানুষ খেতে পারে, তাকে নাকি খাইয়ে সুখ। নিজের জন্যে রাখা বড়াভাজাগুলো সে সব দিয়ে দিলে অতিথির পাতে।

গঙ্গাচরণ মনে মনে ভাবলে পৌনে সাত টাকায় বেচারী নিশ্চয়ই আধ পেটা খেয়ে থাকে—

রাত দশটার বেশী নয়। একটু ঠাণ্ডা রাতটা। আবার এসে দুজনে বসলো নিমগাছের তলায় বাঁশের মাচায়। হাবু তামাক সেজে এনে দিলে।

দুর্গা পণ্ডিত বললে—এখন কি করি আমায় একটা পরামর্শ দাও তো ভায়া। যে রকম শুনছি—

গঙ্গাচরণ চিন্তিত সুরে বললে—তাই তো! আমারও তো কেমন কেমন মনে হচ্ছে। কেরাসিন তেল বাজারে আর পাওয়া যাচ্ছে না, আবার কাল থেকে শুনছি দেশলাইও নাকি নেই।

—সে মরুক গে, যাক কেরোসিন তেল। অন্ধকারে থাকবো। কিন্তু খাবো কি? চাল নাকি মোটেই মিলবে না। দামও চড়বে!

—দাম আরও চড়বে? দশ টাকা হয়েছে, আরও?

—একজন ভালো লোক বলছিল সেদিন। এই বেলা কিছু কিনে রাখতি পারলে ভালো হত, কিন্তু পৌনে সাত টাকা মাইনেতে রোজকার চাল কেনাই কঠিন হয়ে পড়েছে! আমাদের স্কুলের সেক্রেটারি হল ও গাঁয়ের রতিকান্ত ঘোষ। গোলাপালা আছে বাড়ীতে। ধানচাল মজুদ আছে। সেদিন বললাম আমায় একমণ চাল দিন, মাইনে থেকে কেটে নেবেন। তা আধমণ দিতে রাজী হয়েছে।

—আপনার কত চাল লাগে রোজ?

—তা সকালবেলা উঠলি একপালি করে চালির খরচ! খেতে দুবেলায় আট-ন’টি প্রাণী। কি করে চালাই বলো তো ভায়া? ও আধমণ চালে আমার ক’দিন?

গঙ্গাচরণ মনে মনে বললে তার ওপর খাওয়ার যা বহর! অমন যদি সকলের হয় বাড়ীতে, তবে রতিকান্ত ঘোষের বাবাও চাল যুগিয়ে পারবে না—

দুর্গা পণ্ডিত কিছুতেই ঘুমুতে যায় না। মাঝে পড়ে গঙ্গাচরণেরও ঘুম হয় না। অতিথিকে ফেলে রেখে সে একা শুতে যায় কি করে? তার নিজেরও যে ভয় একেবারে না হয়েচে তা নয়।

দুর্গা পণ্ডিত বললে—একটা বিহিত পরামর্শ দাও তো ভায়া। ওখানে একা একা থাকি, যত সব অজ মুখ্যুদের মধ্যিখানে। আমরা কি পারি? আমার চাই একটু সৎসঙ্গ, বিদ্যে পেটে আছে এমন লোকের সঙ্গ। নয়তো প্রাণ যে হাঁপিয়ে ওঠে—না কি বল?

—ঠিক ঠিক।

তাই ভাবলাম যদি পরামর্শ করতে হয় তবে ভায়ার ওখানে যাই। বাজে লোকের সঙ্গে পরামর্শ করে কি হবে? তুমি যা বুদ্ধি দিতে পারবে, চাষাভুষো লোকের কাছ থেকে সে পরামর্শ পাবো না।

যুদ্ধের খবর কি?

—জাপানীরা সিঙ্গাপুর নিয়ে নিয়েচে?

—শুধু সিঙ্গাপুর কেন, ব্রহ্মদেশও নিয়ে নিয়েচে। জানো না সে খবর?

—না—ইয়ে—শুনি নি তো? ব্রহ্মদেশ? সে তো—

—যেখান থেকে রেঙ্গুন চাল আসে রে ভায়া। ওই যে সস্তা, মোটা মোটা আলো চাল, সিদ্ধও আছে, তবে আমি আতপ চালটাই খাই।

এ আবার এক নতুন খবর বটে। বিশ্বাস মশায়ের চণ্ডীমণ্ডপে বসে গল্প করবার একটা জিনিস পাওয়া গেল বটে। উঃ, এ খবরটা সে এত দিন জানে না? কেউ তো বলেও নি। জানেই বা কে এ অজ চাষা-গাঁয়ে? তবে গঙ্গাচরণের কাছে সবটাই ধোঁয়া ধোঁয়া। রেঙ্গুন বা ব্রহ্মদেশ ঠিক কোনো দিকে তা সে জানে না। পুব বা দক্ষিণ দিকে কোনো জায়গায়? অনেক দূর?

.

পরদিন দুপুরবেলাতেও দুর্গা পণ্ডিত এখানেই আহার করলে। অনঙ্গ-বৌ তার জন্য দু’তিন রকমের তরকারি রান্না করলে। খেতে ভালোবাসে, ব্রাহ্মণ অতিথি। তাদের চেয়ে অনেক গরীব।

অনঙ্গ-বৌ হাবুকে সকালে উঠেই বলেচে—একটা মোচা নিয়ে আয় তো তোর সয়াদের বাগান থেকে।

স্ত্রীকে মোচা কুটতে দেখে গঙ্গাচরণ বললে—আজ যে অতিথি সৎকারের খুব বহর দেখচি—

—ভারি তো! একটু মোচার ঘণ্ট রাঁধবো, আর একটু সুক্তুনি—

—বেশ বেশ। অতিথির দোহাই দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে আমাদেরও হয়ে যাবে।

—হ্যাঁগো, পণ্ডিত মশাই বড় গরীব, না? দেখে বড় কষ্ট হয়। কি রকম কাপড় পরে এয়েচে, পায়ে জুতো নেই!

—তা অবস্থা ভালো হলে কি সাত টাকা মাইনেতে পড়ে থাকে পাঠশালায়? আজ ওকে একটু ভালো করে খাওয়াও।

—একটু দুধ যোগাড় করে দেবে?

—দেখি যদি নিবারণ ঘোষের বাড়ীতে মেলে। ওটা কাঁচকলার মোচা নয় তো, তা’হলে কিন্তু এত তেতো হবে যে মুখে দেওয়া যাবে না তরকারি।

—নাগো, এ কাঁটালি কলার মোচা। আমাকে তুমি আমার কাজ শেখাতে এসো না বলচি।

দুপুরবেলা দুর্গা পণ্ডিত খেতে এসে সপ্রশংস বিস্ময়ের দৃষ্টিতে পাতের দিকে চেয়ে বললে—এ যে রীতিমত ভোজের আয়োজন করেছেন দেখচি। আহা, বৌমা সাক্ষাৎ লক্ষ্মী। এত সব রেঁধেচেন বসে বসে? ওমা, কোথায় গেলে গো মা?

অনঙ্গ-বৌ ঘরে ঢুকে সকুণ্ঠিত সলজ্জভাবে মুখ নীচু করে রইল।

দুর্গা পণ্ডিত ভালো করে মোচার ঘণ্ট দিয়ে অনেকগুলো ভাত মেখে গোগ্রাসে খেতে খেতে বললে—সত্যি, এমন তৃপ্তির সঙ্গে কতকাল খাই নি।

গঙ্গাচরণের মনে হল পণ্ডিত কিছুমাত্র বাড়িয়ে বলচে না। ওর স্বরে কপট ভদ্রতা নেই। সত্যি কথাই বলচে ও, এমন কি অনেক দিন পরে ও যেন আজ পেট ভরে দুটি ভাত খেতে পেলে।

অনঙ্গ-বৌ বললে—ও হাবু, বল আর কি দেবো? মোচার ঘণ্ট আর একটু আনি?

পরিশেষে ঘন জ্বাল দেওয়া এক বাটি দুধ আর নতুন আখের গুড়। দুর্গা পণ্ডিত সত্যিই অভিভূত হয়ে পড়েচে, খাওয়ার সময় ওর চোখ দু’টো যেন কেমন ধরনের চকচক করচে। শীর্ণ চেহারা শুধু বোধ হয় না খেয়ে খেয়ে। অনঙ্গ-বৌয়ের মনে মমতা জন্মালো। তাদের যদি অবস্থা থাকতো দেবার, ইচ্ছে হয় রোজ এই অনাহার-শীর্ণ দরিদ্র পণ্ডিত মশাইয়ের পাতে এমনিতর নানা ব্যঞ্জন সাজিয়ে খেতে দেয়।

—আসি বৌমা, আপনাদের যত্নের কথা ভোলোবো না কখনো। বাড়ী গিয়ে মনে রাখবো।

—অনঙ্গ-বৌয়ের চোখ দু’টি অশ্রুসজল হয়ে উঠলো।

—যদি কখনো না খেয়ে বিপদে পড়ি, তুমি একটু ঠাঁই দিও অন্নপূর্ণা। বড্ড গরীব আমি।

দুর্গা পণ্ডিতের অপস্রিয়মাণ ক্ষীণদেহ আম-শিমুলের বনের ছায়ায় ছায়ায় দূর থেকে দূরান্তরে গিয়ে পড়লো অনঙ্গ-বৌয়ের স্নেহদৃষ্টির সম্মুখে।

.

সেদিন এক বিপদ।

রাধিকানগরের বাজারে পরদিন বহুলোকের সামনে পাঁচু কুণ্ডুর চালের দোকান লুঠ হল। দিনমানে এমন ধরণের ব্যাপার এ সব অঞ্চলে কখনো ঘটে নি। গঙ্গাচরণও সেখানে দাঁড়িয়ে। একটা বটতলায় বড় আটচালাওয়ালা দোকানটা। প্রথমে লোকে সবাই এলো চাল কিনতে, তারপর কিসে যে কি হল গঙ্গাচরণ জানে না, হঠাৎ দেখা গেল যে দোকানের চারিপাশে একটা হৈচৈ গোলমাল। মেলা লোক দোকানে ঢুকচে আর বেরুচ্চে। ধামা ও থলে হাতে বহুলোক মাঠ ভেঙে বাঁওড়ের ধারে-ধারের পথে পড়ে ছুটচে। সন্ধ্যার দেরি নেই বেশি, সূর্যদেব পাটে বসে-বসে। গাছের মগডালে রাঙা রোদ।

একজন কে বললে—উঃ, দোকানটা কি করেই লুঠ হচ্চে!

গঙ্গাচরণও গিয়েছিল চাল কিনতে। হাতে তার চটের থলে। কিন্তু দোকানে দোকানে ঘুরে সে দেখলে চালের বাজারে সাড়ে বারো টাকা দর। গত হাটবারেও ছিল দশ টাকা চার আনা, একটা হাটের মধ্যে মণে একেবারে ন’সিকে চড়ে যাবে এ তো স্বপ্নের অগোচর। চাল কিনবে কি না-কিনবে ভাবচে, এমন সময় বিষম হৈচৈ।

লোকের ভিড় ক্রমশ পাতলা হয়ে আসচে, সবাই ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটচে। কেউ চাল নিয়ে ছুটচে, কেউ শুধু হাতে। গঙ্গাচরণ বিমূঢ়ের মত দাঁড়িয়ে ভাবচে তখনও, চাল কিনবে কিনা—এমন সময় পেছন থেকে দু’জন লোক এসে ওর ঘাড়ের ওপর পড়লো, তার মধ্যে একজন ওকে জাপটে ধরলে জোর করে ওর চটের থলে সুদ্ধ। গঙ্গাচরণ চমকে উঠে বললে—কে? কে?

কর্কশ কণ্ঠে কে একজন অস্পষ্ট দিবালোকে বলে উঠলো—চাল নিয়ে পালাচ্চো শালা—হাতে-নাতে ধরেচি।

গঙ্গাচরণ ঝাঁকি মেরে উঠে বললে—কে চাল চুরি করেচে? লোক চেনো না?

লোক দু’জন ওর সামনে এসে ভালো করে মুখ দেখলে। গঙ্গাচরণ চিনলে ওদের, বন্যেবেড়ের দফাদার সাধুচরণ মণ্ডল এবং ঐ ইউনিয়নের জনৈক চৌকিদার। ওরা কিন্তু গঙ্গাচরণকে চেনে না।

চৌকিদার বললে—শালা, লোক সবাই ভালো। সকলকেই আমরা চিনি। চাল ফেললি ক’নে?

—আমার নাম গঙ্গাচরণ পণ্ডিত, নতুন গাঁয়ে আমার পাঠশালা। চাল কিনতে এসেছিলাম বাপু, ব্রাহ্মণকে যা তা বোলো না। আমায় সবাই চেনে এ দিগরে। ছেড়ে দাও—

সাধুচরণ দফাদার ওর সামনে এসে মুখ ভালো করে দেখে বললে—এ পুরানো দাগী চোর। এর নাম মনে পড়চে না, বাঁধো একে।

ঠিক সেই সময় নতুন গাঁয়ের তিনজন লোক এসে পড়াতে গঙ্গাচরণ দাগী চোর ও চুরির অভিযোগ থেকে নিস্তার পেলে। এমন হাঙ্গামে গঙ্গাচরণ পড়ে নি জীবনে।

.

গঙ্গাচরণের ফিরতে রাত হয়ে গেল সেদিন—অনঙ্গ-বৌ বসে আছে চালের আশায়। এত রাত কখনো হয় না হাট করতে যেয়ে। ব্যাপার কি?

বিনোদ কাপালীর বোন ভানু এসে বললে—কি করচো ঠাকরুণ দিদি?

—এসো ভানু। বোসো ভাই—

—দাদাঠাকুর ক’নে?

—রাধিকানগরের হাটে গিয়েচে, এখনো আসবার নামটি নেই।

—আজ নাকি খুব হ্যাংনামা হয়ে গিয়েছে হাটে। দাদা ফিরে এয়েচে, তাই বলছেল।

অনঙ্গ-বৌ উদ্বিগ্ন মুখে বললে—কি হ্যাংনামা রে ভানু? হয়েচে কি?

ভানু বললে—কি নাকি চালের দোকান লুঠ হয়েচে, অনেক লোককে পুলিসে ধরে নিয়ে গিয়েচে—এই সব।

অনঙ্গ-বৌ আশ্বস্ত হল, তার স্বামী লুঠের ব্যাপারে থাকবে না, সুতরাং পুলিসে ধরেও নিয়ে যায় নি, হয়তো ওই সব দেখতে দেরি করে ফেলেচে। তবুও সে হাবুকে ডেকে বললে—ও হেবো, একটু এগিয়ে দেখ না—হাট থেকে লোকজন ফিরে এলো। এত দেরি হচ্চে কেন?

এমন সময় শূন্য চালের থলে হাতে গঙ্গাচরণ বাড়ী ঢুকে বললে—ওঃ, কি বিপদেই আজ পড়ে গিয়েছিলাম! আমাকে কিনা ধরেচে চোর বলে!

অনঙ্গ বলে উঠলো—সে কি গো?

—হ্যাঁ, ওই বন্যেবেড়ের সাধুচরণ দফাদার আর দু ব্যাটা চৌকিদার।

—ওমা, তারপর?

—তারপর বাঁধে আর কি। শেষে এ গাঁয়ের লোকজন গিয়ে না পড়লে বেঁধে নিয়ে যেত।

—কি সব্বনাশ গা! মা সাত-ভেয়ে কালীর পুজো দেবো স পাঁচ আনা। মা রক্ষা করেচেন।

—যাক সে তো গেল এক বিপদ, ইদিকে যে তার চেয়েও বিপদ। চাল পেলাম না হাটে।

—তুমি ভেবো না, আমি রাতটা চালিয়ে দেবো এক রকমে। কাল দুপুরেও চালাবো। সারাদিনে চাল যোগাড় করে আনতে পারবে এখন খুবই।

বাইরে এসে তাড়াতাড়ি ভানুকে বললে—ভানু দিদি, আমায় এক পালি চাল ধার দিতে পারবে আজ রাতের মত? উনি হাটে গিয়ে হ্যাংনামাতে পড়ে গিয়েছিলেন, চাল কিনতি পারেন নি।

ভানু বললে—এখুনি পেঠিয়ে দিচ্চি ঠাকরুণ দিদি।

—না দিলে কিন্তু রাতে ভাত হবে না!

—ওমা, সে কি কথা ঠাকরুণ দিদি, নয়তো আমি নিজে নিয়ে আসচি।

ভানু চলে গেল বটে কিন্তু চাল নিয়ে এলো না। এই আসে এই আসে করে প্রায় ঘণ্টাখানেক কেটে গেল, তখনও ভানুর দেখা নেই। অনঙ্গ-বৌ আশ্চর্য হয়ে গেল, ব্যাপারটা কি? এই গ্রামে এসে পর্যন্ত যার কাছে যা মুখ ফুটে চেয়েচে সে, তক্ষুনি পরম খুশির সঙ্গে সে জিনিসটা এনে দিয়ে যেন কৃতার্থ হয়ে গিয়েচে। এই প্রথমবার অনঙ্গ-বৌকে সামান্য এক কাঠা চাল ধার চেয়ে বিফল হতে হল।

এদিকে বিপদের ওপর বিপদ, স্বামী হাট থেকে এসে কোথায় যেন বেরিয়ে গেলেন, বোধ হয় হাটের গল্প বলবার জন্যে বিশ্বাস মশায়ের বাড়ী, কি করেই বা তাঁকে সে জানায়? এসে খিদের ওপর ভাত খেতে পাবে না।

সাতপাঁচ ভাবচে, এমন সময় ভানু উঠোন থেকে ডাকলে—ও ঠাকরুণ দিদি?

অনঙ্গ-বৌয়ের প্রাণ এল ফিরে। সে তাড়াতাড়ি বাইরে এসে বললে—বলি কি কাণ্ডখানা, হ্যাঁ রে ভানু!

ভানু দাওয়ায় উঠে এসে শুকনো মুখে বললে—ঠাকরুণ দিদি, আমি সেই থেকে চাল যোগাড় করবার জন্যে তিন-চার বাড়ী ঘুরে বেড়িয়েচি—

—কেন তোদের বাড়ী কি হল?

—নেই। হাটে পায় নি আজ।

—হাটে কেন? ক্ষেতের ধান?

—আ মোর কপাল! ক্ষেতের ধান আর কনে! ছ’টাকা মণ যেমন হল, অমনি কাকা সব ধান আড়তে নিয়ে গেল গাড়ী পুরে। বিক্রি করে নগদ টাকা ঘরে এনলে। ফি-জনে জুতো কেনলে, কাপড় কেনলে, কাকীমা ঘটি বাসন কেনলে, মাছ খালে, সন্দেশ খালে, মাংস খালে। নবাবী করে সে টাকাও উড়িয়ে ফেললে। এখন সে ধানও নেই, সে টাকাও নেই। ক’হাট কিনে খাতি হচ্ছে মোদেরও।

—অন্য বাড়ী যে ঘুরলি বললি?

—মোদের পাড়ায় কারো ঘরে ধান নেই ঠাকরুণ দিদি। সব কিনে খাওয়ার ওপর ভরসা।

ভানু আঁচলের গেরো খুলতে খুলতে বললে।

—ওতে কি রে?

—এক খুঁচি মোটা চাল ওই ক্ষুদে গয়লার নাত-বৌয়ের কাছ থেকে চেয়েচিন্তে—

—হ্যাঁ রে, তারা তো বড্ড গরীব। তুই আনলি, তাদের খাবার আছে তো? দাঁড়া—

—সে আমি না জেনে আনি নি দিদি ঠাকরুণ। ওরা লোকের ধান ভানে কিনা? আট কাঠা ধানে এক কাঠা ধান বানি পায়। বানির ধান ভেনে খোরাকি চালায়।

অনঙ্গ-বৌ একটু ভেবে বললে—আমার একটা উপকার করবি ভানু?

—কি?

—আচ্ছা সে পরে বলবো এখন। দে চাল ক’টা—

—এক খুঁচি চালি রাতটা হবে এখন তো? আর না হলিই বা কি করবা ঠাকরুণ দিদি? কত কষ্টে যে চাল ক’ডা যোগাড় ক’রে এনিচি তা আমিই জানি।

গঙ্গাচরণ ভাত খেতে বসলো অনেক রাতে। ডাল, ভাত আর পুঁইশাকের চচ্চড়ি। বাড়ীর উঠোনেই সুগৃহিণী অনঙ্গ-বৌ পুঁইমাচা তুলে দিয়েছে, লাউমাচা তুলেছে, কিছু ঢেঁড়স, কিছু নটেশাকের ক্ষেত করেছে। হাবু ও নিজে দুজনে মিলে জল দিয়েছে আগে আগে, তবে এই সব গাছ বেঁচে আজ তরকারি যোগাচ্ছে।

অনঙ্গ-বৌ বললে—আর দুটো ভাত মেখে নাও, ডাল দিয়ে পেট ভরে খাও—

—এ চাল দুটো ছিল বুঝি আগের দরুণ?

—হুঁ।

—কাল হবে?

—কাল হবে না। সকালে উঠেই চাল যোগাড় করো। রাতটা টেনেটুনে হয়ে গেল।

—সেই বিশ্বাস মশায়ের দরুণ ধানের চাল?

—হুঁ।

অঙ্গন-বৌ স্বামী-পুত্রকে পেটভরে খাইয়ে সে-রাতে এক ঘটি জল আর একটু গুড় খেয়ে উপোস করে রইলো।


© 2024 পুরনো বই