বিপিনের সংসার – ৭

সপ্তম পরিচ্ছেদ

বেলা পড়িলে বিপিন পলাশপুরে পৌঁছিল।

বাহিরের বৈঠকখানায় শ্যামহরি চাকর ঝাঁট দিতেছিল, বিপিন বলিল, বাবু কোথায় রে?

—রাণাঘাট গিয়েছেন আজ সকালবেলা। সন্ধের সময় আসবেন বলে গিয়েছেন। —রাণাঘাটে কেন?

—উকিলবাবু পত্তর দিয়েছেন, বলছিলেন গিন্নিমাকে–কি মামলার কথা আছে। আপনারকথাও হচ্ছিল।

—আমার কথা?

—হ্যাঁ, বাবু বলছিলেন, ধোপাখালির কাছারি থেকে আপনি টাকা নিয়ে এলি আপনাকে রাণাঘাট পাঠাবেন। টাকার বড় দরকার নাকি—

—বাড়িতে কে কে আছেন?

—গিন্নিমা আছেন, দিদিমণি আছেন। দিদিমণিকে নিতে আসবেন কিনা জামাইবাবু, তাইবাবু বলছিলেন আপনার নাম করে, আপনি এই সময় টাকা নিয়ে এসে পড়লে ভাল হয়, খরচপত্তর আছে।

—ও। তা এর মধ্যে আসবেন বুঝি?

—আজ্ঞে, পরশু বুধবারে তো শুনছিলাম আসবেন।

—বেশ বেশ, খুব ভাল কথা। জামাইবাবুর সঙ্গে দেখাটা হয়ে যাবে এখন এই সময় তাহলে। তুই যা দিকি বাড়ির মধ্যে। গিন্নিমাকে বলো, আমি এসেছি। আর আমার সঙ্গে টাকা রয়েছে কিনা—সেগুলো কি তাঁর হাতে দোব, না বাবু এলে বাবুকে দোব, জিজ্ঞেস করে আয়।

শ্যামহরি বাড়ির মধ্যে ঢুকিবার একটু পরেই স্থানীয় পুরোহিত বটুকনাথ ভট্টাচার্য আসিয়াহাজির হইলেন। তিনি বৈঠকখানায় উঁকি দিয়া বলিলেন, কে বসে? বিপিন? বাবু কোথায়?

বিপিন আশা করিতেছিল এই সময় অনাদিবাবু বাড়ি নাই, মানী তাহার আসিবার খবর শুনিয়া বৈঠকখানায় আসিতে পারে। কিন্তু মানীর পরিবর্তে বৃদ্ধ বটুক ভট্‌ট্চাজকে দেখিয়াবিপিনের সর্বশরীর জ্বলিয়া গেল।

মুখে বলিল, আসুন ভট্‌ট্চাজ মশাই, বাবু নেই, রাণাঘাটে গিয়েছেন মামলার তদারক করতে। কখন আসবেন ঠিক নেই, আজ বোধ হয় আসবেন না।

এই উত্তর শুনিয়া বুড়া চলিয়া যাইবে এই আশা করাই স্বাভাবিক, কিন্তু তাহা না গিয়া সে দিব্য জাঁকিয়া বসিয়া গেল। বিপিন প্রমাদ গনিল, বৃদ্ধ অত্যন্ত বকবক করে সে জানে, বকুনি পাইলে উঠিতে চায় না—মাটি করিল দেখিতেছি! বাহিরের ঘরে অন্য লোকের গলার আওয়াজপাইলে মানী সেখানে পা দিবে না। অনাদিবাবু বাড়ি নাই— এমন ঘটনা ক্বচিৎ ঘটে, সাধারণততিনি কোথাও বাহির হন না। মানীও চলিয়া যাইতেছে, এমন একটা সুবর্ণ সুযোগ যদি বাঘটিল তাহার সহিত নির্জনে দুইটা কথা বলিবার, তাহাও যাইতে বসিয়াছে! বটুক ভট্‌চাজবলিল, মামলা? কিসের মামলা?

বিপিন উদাস নিস্পৃহ সুরে বলিল, আজ্ঞে তা ঠিক বলতে পারছি না। শুনলাম, উকিল সুরেনবাবু চিঠি লিখেছিলেন!

—সুরেন উকিল? কোন্ সুরেন? সুরেন মুখুজ্জে?

—আজ্ঞে না, সুরেন তরফদার।

—কালী তরফদারের ছেলে? সুরেন আবার কি হে, ওকে আমরা পটলা বলে জানি।ছেলেবেলা থেকে ওদের বাড়িতে আমার যাতায়াত, অবিশ্যি আমি ক্রিয়াকর্ম কখনও করিনিওদের বাড়ি। শূদ্রযাজক হতে পারতাম যদি, তা হলে আজ এ দুর্দশা ঘটত না। কিন্তু আমার কর্তা মশায়ের নিষেধ আছে। তিনি মরবার সময় বলে গিয়েছিলেন, বটুক না খেয়ে কষ্ট যদি পাও সেও ভাল, কিন্তু নারায়ণ-শিলা-হাতে শুদ্দুরের বাড়ি কখনও ঢুকো না। আমাদের বংশে ও কাজ কখনও কেউ করেনি, বুঝলে?

বিপিন বলিল, হুঁ।

—তা সেই পটলা আজ উকিল হয়েছে, কালী তরফদার মারা যাওয়ার পর হাতে কিছু টাকাও আজকাল পেয়েছে শুনেছি। তা ছাড়া টাকা জমাতে কি করে হয়, তা ওরা জানে।হাড়কঞ্জুস ছিল সেই কালী তরফদার, তার ছেলে তো? ওদের আদি বাড়ি শান্তিপুর, তা জানো তো? ওর জ্যাঠামশায় এখনও শান্তিপুরের বাড়িতেই থাকে। জমিজমা আছে শান্তিপুরে। বেশ বড় বাড়ি, দোমহলা।

—ও।

—অনেকদিন আগে একবার শান্তিপুর গিয়েছি রাস দেখতে, ভারি যত্ন-আত্তি করলে আমাদের। শান্তিপুরের রাস দেখেছ কখনও? দেখবার মতো জিনিস; অত বড় মেলা এ দিগরেহয় না কোথাও।

—ও।

—এখানে তামাক-টামাক দেবার কেউ নেই? বল না একটু ডেকে! আর একটু চা যদিহয়, কাউকে বলে পাঠাও না! আমি এসেছি শুনলেই বউমা চা পাঠিয়ে দিবেন। তবে শোনো, একটা রাসের মেলার গল্প করি। সেবার হল কি জানো—ওই যে চাকরটা যাচ্ছে—ও শ্যামহরি, শোন একবার এদিকে বাবা, বাড়ির মধ্যে যা তো, বলগে, ভট্‌ট্চাজ্যি মশাই একটু চা খেতেচাইছেন, আর একবার এক কলকে তামাক দিয়ে যা তো বাবা! বিপিন চা খাবে কি? ও কি, উঠছ কোথায়? বসো,বসো!

—আজ্ঞে, আপনি বসে চা খান। আমি একটু তাগাদায় যাব ওপাড়ায়, বাবু বলেগিয়েছেন, কিছু টাকা পাওয়া যাবে, এখন না গেলে হবে না, সন্ধে হয়ে এল। আমি আসি।

বিপিন বাহির হইয়া পড়িল। বটুক ভট্চাজের সঙ্গে বসিয়া গল্প করা বর্তমানে তাহারমনের অবস্থায় সম্ভব নয়।

সব নষ্ট হইয়া গেল। অনাদিবাবু সন্ধ্যার পরই আসিয়া পড়িবেন। তাহাকে তাঁহার সঙ্গে বসিয়া মুখ বুজিয়া খাইতে হইবে; তাহার পর বৈঠকখানায় আসিয়া চুপচাপ শুইয়া পড়িতেহইবে। হয়তো সে সময়ে অনাদিবাবু গড়গড়া হাতে বাহিরে আসিয়া তাহাকে জমিদারী সংক্রান্তকিছু উপদেশ দিবেন, তাহাও শুনিতে হইবে। তারপর কাল সকালে আর সে কোন ছুতায়পলাশপুরে বসিয়া থাকিবে? তাহার তো আসার কথাই ছিল না, টাকা আনিবার ছুতায় সেআসিয়াছে। টাকা ইরশালে ধরা হইয়া গিয়াছে, তাহার কাজও শেষ হইয়াছে। যাও চলিয়াধোপাখালির কাছারি—মিটিয়া গেল।

বিপিন উদ্‌ভ্রান্তের মতো কিছুক্ষণ রাস্তায় রাস্তায় পায়চারি করিয়া বেড়াইল। সন্ধ্যার বেশি দেরি নাই, হয়তো এতক্ষণ অনাদিবাবু আসিয়া পড়িয়াছেন। আচ্ছা, সে একটু দেরি করিয়াই যাইবে।

সন্ধ্যার অন্ধকার ঘোর-ঘোর হইতে বিপিন ফিরিল। উঁকি মারিয়া দেখিল, বটুক ভট্‌ট্চাজ বৈঠকখানায় বসিয়া আছে কিনা। না, কেহই নাই। অনাদিবাবুও আসে নাই, কারণ উঠানে তাহাহইলে গরুরগাড়ি থাকিত। বাড়ির গরুরগাড়ি করিয়া গিয়াছেন, তাহাতেই ফিরিবেন।

গাড়ি উঠানে না দেখিয়া বিপিন যে খুব আশ্বস্ত হইল, তাহা নয়। আসেন নাই বটে, কিন্তুআসিলেন বলিয়া। আর বেশি দেরি হইবার কথা নয়, দুই ক্রোশ পথ গরুরগাড়ি আসিতে।

বিপিন বৈঠকখানায় ঢুকিয়া গায়ের জামাটা খুলিবার আগে একটুখানি বিশ্রাম করিতেছে, এমন সময় অন্দরের দিকের দরজায় আসিয়া দাঁড়াইল মানী।

বিপিনের সারা দেহে যেন বিদ্যুতের মতো কি একটা খেলিয়া গেল। সে কিছু বলিবার পূর্বেই মানী বলিল, আচ্ছা, কি কাণ্ড বল তো বিপিনদা? এলে সেই ধোপাখালি থেকেতেতে-পুড়ে—শ্যামহরি চাকর গিয়ে বললে—চা করে নিয়ে আসছি, এসে দেখি ভট্‌ট্চাজজ্যাঠামশাই বসে আছেন, তুমি নেই! ভট্‌ট্চাজ জ্যাঠামশাই বললেন, কোথায় তাগাদায় বেরুলেএইমাত্র। তারপর দু’বার এসে খুঁজে গেলাম—কোথায় কে? এলে—চা খাও, জিরোও, তারপরতাগাদায় গেলে হত না কি? প্রজারা পালিয়ে যাচ্ছে না তো!

বিপিনের মাথার মধ্যে সব কেমন গোলমাল হইয়া গিয়াছিল মানীকে দেখিয়া, আমতা আমতা করিয়া বলিল, না, সে জন্যে নয়—তা বেশ ভাল–মেসোমশাই কি রাণাঘাটে—

মানী বলিল, দাঁড়াও, আগে তোমার চা আর খাবার আনি।

মানী কথাটা ভাল করিয়া শেষ না করিয়াই চলিয়া যাইতে উদ্যত হইল। বিপিন দাঁড়াইয়া বলিয়া উঠিল, মানী, শোন শোন, যাসনি, দুটো কথা বলি আগে দাঁড়া।

মানী বলিল, দাঁড়াচ্ছি, চা-টা আনি আগে।কতক্ষণ লাগবে! স্টোভ ধরাব আর করব।আগে যে চা করেছিলুম, তা তো জুড়িয়ে জল হয়ে গেল!

আবার সে চলিয়া যায়। এদিকে অনাদিবাবুও আসিয়া পড়িলেন বলিয়া। হঠাৎ বিপিন বেদনাপূর্ণ আকুল মিনতির সুরে বলিল, মানী, চা আমি খাব না। তুই যাসনি, একবার আমারকথা শোন। তুই চা আনতে যাসনি।

মানী বিস্মিত হইয়া বিপিনের মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, কেন বিপিনদা? চা খাবে নাকেন? কি হয়েছে তোমার? অমন করছ কেন?

বিপিন লজ্জায় অভিভূত হইয়া পড়িল, সত্যই তাহার কণ্ঠস্বরটা তাহার নিজের কানেইস্বাভাবিক শোনায় নাই! কিন্তু সে কি করিবে? মেয়েমানুষ কি কথা শোনে? চা আনিবার ঝোঁকযখন করিয়াছে, তখন চা সে আনিবেই। ধোপাখালি হইতে পথ হাঁটিয়া বিপিন এখানে চা খাইতেআসিয়াছিল?

নিজেকে খানিকটা সংযত করিয়া লইয়া বলিল, মানী যাসনি।

মানী চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল।

—অনেকদিন তোকে দেখিনি, কথাও বলিনি, এলি আর চলে যাবি চা করতে? চা কি এতভাল জিনিস যে, না খেলে দিন যাবে না? আমি যেতে দেব না তোকে। এখানে দাঁড়িয়ে থাক।

মানী শান্তসুরে মৃদু হাসিমুখে বলিল, বিপিনদা, মেয়েমানুষের একটা কর্তব্য আছে। তুমিতেতে-পুড়ে এসেছ রাস্তা হেঁটে, আর আমি তোমার মুখে একটু জল দেবার ব্যবস্থা না করে সঙের মতো তোমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকব—এ হয় না। তুমি একটু বসো,আমি আগে চা আনি, খেয়ে যত খুশি গল্প করো। আমি পালিয়ে যাচ্ছি না। আমারও কি ইচ্ছে নয় তোমার সঙ্গে দুটো কথা কইবার?

মিনিট পনেরো—প্রত্যেক মিনিট এক-একটি দীর্ঘ ঘণ্টা-কাটিয়া গেল। মানীর তবুও দেখা নাই।

অনাদিবাবু কি আসিলেন? বাহিরে গরুরগাড়ির শব্দ হইল না? না, কিছু নয়। অন্যগরুরগাড়ি রাস্তা দিয়া যাইতেছে।

প্রায় পঁচিশ মিনিট পরে মানী আসিল। একটা থালায় খানকতক পরোটা, একটু আলুচচ্চড়ি, একটু গুড়। বিপিনের সামনে থালা রাখিয়া বলিল, ততক্ষণ খাও, আমি চা আনি। কতক্ষণলাগল, এই তো গিয়ে ময়দা মেখে বেলে ভেজে নিয়ে এলুম! চায়ের জল ফুটছে, এখুনি আনছিকরে। সব ক’খানা কিন্তু খাবে, নইলে রাগ করব, আস্তে আস্তে খাও।

বিপিনের সত্যই অত্যন্ত ক্ষুধা পাইয়াছিল। পরোটা ক’খানা সে গোগ্রাসে খাইতে লাগিল। অনাদিবাবু বুঝি আসিলেন? গরুরগাড়ির শব্দ না?

চা করিতে এত সময় লাগে? কত যুগ ধরিয়া মানী কেটলিতে চায়ের জলফুটাইতেছে—যুগ-যুগান্তর ধরিয়া চায়ের জল ফুটিতেছে!

মানী আসিল। এক পেয়ালা চা এক হাতে, অন্যহাতে একটি ছোট খাগড়াই কাঁসাররেকাবে পান।

—কই, দেখি কেমন সব খেয়েছ? বেশ লক্ষ্মী ছেলে! এই নাও চা, এই নাও পান।

বিপিন হাসিয়া বলিল, ভারী খিদে পেয়েছিল, সত্যি বলছি। আঃ, চা-টুকুযে কি চমৎকারলাগছে!

মানী বলিল, মুখ দেখে বুঝতে পারি বিপিনদা। তোমার যে অনেকক্ষণ খাওয়া হয়নি, তা যদি তোমার মুখ দেখে বুঝতে না পারলুম, তবে আবার মেয়েমানুষ কি?

—দাঁড়িয়ে কেন, বসো এই চেয়ারখানায়। ভাল কথা, মেশোমশাই তো এখনও এলেন না?

—বাবা বলে গিয়েছিলেন কাজ সারতে পারলে আজ আসবেন, নয়তো কাল আসবেন।বোধ হয় আজ এলেন না, এলে এতক্ষণ আসতেন।

ওঃ এত কথা মানীর পেটে ছিল! মানী জানিত যে বাবা আজ ফিরিবেন না, তাই সে নিশ্চিন্ত মনে চা ও খাবার করিতে গিয়াছিল! আর মূর্খ সে ছটফট করিয়া মরিতেছে!

সে বলিল, মানী, তুই অমন ভাবে চিঠি আর আমায় পাঠাসনে। পাড়াগা জায়গার ভাব তুমি জানো না, থাক কলকাতায়, যদি কেউ দেখে ফেলে বা জানতে পারে, তাতে নানা রকমকথা ওঠাবে। তোমার সুনাম বজায় থাকে এটা আমি চাই। কেউ কোনো কথা তোমাকে এইনিয়ে বললে আমি তা সহ্য করতে পারব না মানী

মানী বলিল, আমাদের চাকরের হাতে দিয়েছিলুম, সে নিজে চিঠি পড়তে পারে না। তারকাছ থেকে নিয়েই বা কে পড়বে পরের চিঠি, আর তাতে ছিলই বা কি?

তুমি আমায় আসতে বলছ এ কথাও আছে। যদি কেউ সে চিঠি দেখত, ওর অনেকরকম মানে বার করত। দরকার কি সে গোলমালের মধ্যে গিয়ে?

মানী চুপ করিয়া শুনিল, তারপর গম্ভীর মুখে বলিল, শোনো বিপিনদা, আমিও একটা কথাবলি। যদি কেউ সে চিঠি দেখত, তার কি মানে বার করত আমি জানি। তারা বলত, আমিতোমায় দেখতে চেয়েছি, তোমায় নিশ্চয়ই ভালবাসি তবে, এই তো?

বিপিন অবাক হইয়া মানীর মুখের দিকে চাহিল। মানী এমন কথা মুখ ফুটিয়া কোনোদিন বলে নাই। কোনো মেয়ে কখনও বলে না। ‘তোমাকে ভালবাসি’ অতি সংক্ষিপ্ত, অতি সামান্য কয়েকটি কথা, কিন্তু এই কথা কয়টির কি অদ্ভুত শক্তি, বিশেষত যখন সে মেয়েটির মুখ হইতে এ কথা বাহির হয়, যাহাকে মনে মনে ভাল লাগে। প্রণয়পাত্রীর মুখে এই স্পষ্ট সহজ উক্তিটি শুনিবার আশ্চর্য ও দুর্লভ অভিজ্ঞতা বিপিনের জীবনে এই প্ৰথম হইল।

মানীর উপরে সঙ্গে সঙ্গে একট অদ্ভুত ধরনের স্নেহ ও মায়া হইল। এতদিন যেন সেটামনের কোণেই প্রচ্ছন্ন ছিল, কিন্তু বাহিরে ফুটিয়া প্রকাশ পায় নাই। ওগো কল্যাণী, এই অদ্ভুতঅভিজ্ঞতা তোমারই দান, বিপিন সেজন্য চিরদিন তোমার কাছে কৃতজ্ঞ থাকিবে।

মানী বলিল, বিপিনদা, কথা বললে না যে? ভাবছ বোধ হয় মানীটা বড্ড বেহায়া হয়েউঠেছে দেখছি, না?

বিপিন তখনও চুপ করিয়া রহিল। সে অন্য কথা ভাবিতেছিল, মানীর বিবাহিত জীবন কিখুব সুখের নয়? স্বামীকে কি তাহার মনে ধরে নাই?

খুব সম্ভব। বেচারি মানী! অনাদিবাবু বড় ঘরে বিবাহ দিতে গিয়া মানীর ভাল লাগানা-লাগার দিকে আদৌ লক্ষ করেন নাই, মেয়েকে ভাসাইয়া দিয়াছেন হয়তো ধনীর সহিতকুটুম্বিতার লোভে।

মানী মৃদু হাসিমুখে বলিল, রাগ করলে বিপিনদা?

বিপিন বলিল, রাগের কথা কি হয়েছে যে রাগ করব? কিন্তু আমি ভাবছি মানী, তোরমতো মেয়ে আমার ওপর—ইয়ে—একটুও স্নেহ দেখাতে পারে, এর মানে কি? আমার কোন্কথা তোর কাছে না বলেছি! কি চরিত্রের মানুষ আমি ছিলাম, তুই তো সব জানিস। সেহীনচরিত্রের লোককে তোর মতো একটা শিক্ষিতা ভদ্র মেয়ে যে এতটুকু ভাল চোখে দেখতেপারে, সেইটেই আমার কাছে বড় আশ্চর্য মনে হয়!

মানী বলিল, থাক ও কথা বিপিনদা।

বিপিনের যেন ঝোঁক চাপিয়া গিয়াছিল, আপনমনে বলিয়াই চলিল, না মানী, আমার মনে হয়, আমার সব কথা তুই জানিসনে। কি করেই বা জানবি, ছেলেবেলার পর আর তো দেখাহয়নি! তোকে সব কথা বলি— শুনেও যদি মনে হয়, আমি তোর স্নেহের উপযুক্ত, তবে স্নেহ করিস, ধন্য হয়ে যাব। আর যদি—

মানী বলিল, আমি শুনতে চাইছি বিপিনদা?

—না, তোকে শুনতে হবে। তুমি আমাকে ভারী সাধুপুরুষ ভেবে রেখেছ, সেটা আমিবরদাস্ত করতে পারব না। রাণাঘাটে বা বনগাঁয়ে এমন কোনো কুস্থান নেই, যেখানে আমিযাতায়াত করিনি। মদ খেয়ে বাবার বিষয় উড়িয়েছি, স্ত্রীর গায়ের গহনা বন্ধক দিয়ে অন্যমেয়েমানুষের আবদার রেখেছি। যখন সব গেল, মদ জোটেনি, তাড়ি খেয়েছি, হয়তো চুরি পর্যন্ত করতাম, কিন্তু নিতান্ত ভদ্রবংশের রক্ত ছিল বলেই হোক বা যাই হোক, শেষ পর্যন্ত করা হয়নি! তাও অন্য কিছু চুরি নয়, একখানা শাড়ি। শামকুড় পোস্ট-আপিসের বারান্দায় শাড়িখানা শুকুতে দেওয়া ছিল, বোধ হয় পোস্টমাস্টারের স্ত্রীর। আমার হাতে পয়সা নেই, শাড়িখানানতুন আর বেশ ভাল, একজনকে দিতে হবে। সে চেয়েছিল, কিন্তু কিনে দেবার ক্ষমতা নেই।চুরি করবার জন্যে অনেকক্ষণ ধরে ঘুরলাম, পাড়াগাঁয়ের ব্রাঞ্চ পোস্ট-আপিস, পোস্টমাস্টারআপিস বন্ধ করে ছেলে পড়াতে গিয়েছে। কেউ কোনো দিকে নেই। একবার গিয়ে এক দিকেরগেরো খুললাম—

মানী চুপ করিয়া শুনিতেছিল, এইবার অধীরভাবে বলিয়া উঠিল, তুমি চুপ করবে, নাআমি এখান থেকে চলে যাব?

—না শোন, ঠিক সেই সময় একটা ছোট মেয়ে সেখানে এসে দাঁড়াল। সামনেই একটা বাঁধানো পুকুরঘাট। মেয়েটাকে দেখে আমি ডাকঘরের রোয়াক থেকে নেমে বাঁধাঘাটে গিয়েবসলাম। মেয়েটা চলে গেল, আমি আবার গিয়ে উঠলাম রোয়াকে। এবারে কাপড় নেবই এইরকম ইচ্ছে। হঠাৎ মনে হল, ছিঃ, আমি না বিনোদ চাটুজ্জের ছেলে? আমার বাবা কতগরিব-দুঃখী লোককে কাপড় বিলিয়েছেন আর আমি কিনা একখানা অপরের পরনের কাপড় চুরি করছি! তখন যেন ঘাড় থেকে ভূত নেমে গেল, ঠিক সেই সময় বাড়ির মধ্যে থেকে একটাছেলে বার হয়ে এসে বললে, কাকে চান? বললাম, খাম কিনতে এসেছি। খাম পাব? ছেলেটা বললে, না, ডাকঘর বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তখন চলে এলাম সেখান থেকে।

মানী বলিল, বেশ করেছিলে, খুব বাহাদুরি করেছিলে। নিজে আর নিজের গুণ ব্যাখ্যায় দরকার নেই, থাক। আমার দেওয়া বইগুলো পড়েছিলে?

—ওই যে বললাম, সব পড়া হয়নি। ‘দত্তা’খানা পড়েছি, বেশ চমৎকার লেগেছে।

—’শ্রীকান্ত’ পড়োনি?

—সময় পাইনি। সেখানা আনিওনি সঙ্গে, এর পর পড়ব বলে রেখে এসেছি কাছারিতে। ‘দত্তা’খানা ফেরত এনেছি।

—তোমার কাছে সবই রেখে দাও না, মাঝে মাঝে পোড়ো। একলাটি থাক কাছারিতে আমার সঙ্গে আরও যে সব বই আছে, যাবার সময় তোমার কাছে রেখে যাব। তুমি সেখানেপোড়ো বসে। আচ্ছা, বল তো বিজয়া কে?

অনলাইনে বেস্টসেলিং বই কিনুন

বিপিন হাসিয়া বলিল, ও! এক্‌জামিন করা হচ্ছে বুঝি? মাস্টারনী এলেন আমার।

মানী কৃত্রিম রাগের সুরে অথচ ঈষৎ লাজুক ভাবে বলিল, আবার! উত্তর দাও আমারকথার!

—বিজয়া তোমার মতো একটি জমিদারের মেয়ে।

—তারপর?

—তারপর আবার কি? নরেনের সঙ্গে তার ভালবাসা হল। —কথাটা বলিয়াই বিপিনের মনে হইল, মানী পাছে কি ভাবে, কথাটা বলা উচিত হয় নাই, মানীও তো জমিদারের মেয়ে! ‘তোমার মত’ কথাটা না বলিলেই চলিত। কিন্তু মানীর মুখ দেখিয়া বোঝা গেল না। সে বেশসহজ ভাবেই বলিল, মনে হচ্ছে, পড়েছ। ভাল, পড়লে মানুষ হয়ে যাবে। এইবার রবি ঠাকুরের ‘চয়নিকা’ বলে কবিতার বই আছে, সেখান থেকে কবিতা মুখস্থ করো। খুব ভাল ভাল কবিতা।

বিপিন খিলখিল করিয়া হাসিয়া বলিল, কবিতা আবার মুখস্থও করতে হবে। উঃ, তুইহাসালি মানী! পাঠশালায় ইস্কুলে যা কখনও হল না, উঃ, এই বুড়ো বয়সে বলে কি না, হি-হিবলে কি না—

—হ্যাঁ, মুখস্থ করতে হবে। আমার হুকুম। শুনতে বাধ্য তুমি। মানুষ বলে যদি পরিচয় দিতে চাও তবে তা দরকার। যা বলি তাই শোনো, হাসিখুশি তুলে রাখ এখন—

কিন্তু অত্যন্ত কৌতুকের প্রাবল্যে বিপিনের হাসি তখনও থামিতে চায় না। মানী মাস্টারনীসাজিয়া তাহাকে কবিতা মুখস্থ করাইতেছে—এই ছবিটা তাহার কাছে এতই আমোদজনক মনেহইল যে সে হাসির বেগ তখনও থামাইতেই পারিল না।

এবার মানীও হাসিয়া ফেলিল। বলিল, বড্ড হাসির কথাটা কি যে হল তা তো বুঝিনে।আমার কথাগুলো কানে গেল, না গেল না?

—খুব গিয়েছে। আচ্ছা, তোর কবিতা মুখস্থ আছে?

—আছেই তো, চয়নিকা’র আদ্ধেক কবিতা মুখস্থ আছে।

—সত্যি? একটা বল না?

—এখন কবিতা বলবার সময় নয়। আর বললেই বা তুমি বুঝবে কি করে হয়েছে কিনা? তুমি তো জানোঢেঁকি, কি করে ধরবে?

—তাতেই তো তোর সুবিধে, যা খুশি বলবি, ধরবার লোক নেই।

মানী মুখে কাপড় দিয়া খিলখিল করিয়া হাসিয়া বলিল, ওমা কি দুষ্টবুদ্ধি!

—তা বল একটা শুনি।

—শুনবে? তবে শোনো। দাঁড়াও, কেউ আসছে কিনা দেখে আসি, আবার বাইরের ঘরে দাঁড়িয়ে কবিতা বলছি শুনলে কে কি মনে করবে!

একটু পরে ফিরিয়া আসিয়া মানী স্কুলের ছাত্রীর মতো কবিতা আবৃত্তির ভঙ্গিতে দাঁড়াইয়াশুরু করিল—

‘অত চুপিচুপি কেন কথা কও, ওগো মরণ হে মোর মরণ!”

বিপিন হাসিয়া গড়াইয়া পড়ে আর কি! মানীর কি চোখমুখের ভাব, কি হাত-পা নাড়ারকায়দা! যেন থিয়েটারের অ্যাটো করিতেছে। অথচ হাসিবার জো নাই, মুখ বুজিয়া বসিয়াথাকিতে হইবে শান্ত ছেলেটির মতো। এমন বিপদেও মানুষ পড়ে। মানীটা চিরদিনই একটু ছিটগ্রস্ত!

কিন্তু খানিকটা পরে মানীর আবৃত্তি বিপিনের বড় অদ্ভুত লাগিতে লাগিল।—

‘যবে বিবাহে চলিলা বিলোচন, ও গো মরণ হে মোর মরণ!’

এই জায়গাটাতে যখন মানী আসিয়া পৌঁছিয়াছে, তখন বিপিনের হাসিবার প্রবৃত্তি আরনাই, সে তখন আগ্রহের সঙ্গে মানীর মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। বাঃ, বেশ লাগিতেছে তো পদ্যটা! মানী কি চমৎকার বলিতেছে! অল্পক্ষণের জন্য মানী বদলাইয় গিয়াছে, তাহার চোখেমুখে অন্য এক রকমের ভাব। কবিতা যে এমনভাবে বলা যাইতে পারে, তাহা সে জানিত না, কখনও শোনে নাই।

—বাঃ, বেশ, খাসা! চমৎকার বলতে পারিস তো?

মানী যেন একটু হাঁপাইতেছে। নিশ্বাস ঘন ঘন পড়িতেছে, বড় কষ্ট হয় পদ্য আবৃত্তিকরিতে, বিশেষত অমনি হাত-পা নাড়িয়া। ভারী সুন্দর দেখাইতেছে মানীকে। মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমিয়াছে, একটু রাঙা হইয়াছে মুখ, বুক ঈষৎ উঠিতেছে নামিতেছে। এ যেন মানীর অন্য রূপ, এ রূপে কখনও সে মানীকে দেখে নাই।

–নেবু খাবে বিপিনদা?

-–কি নেবু?

—কমলানেবু, সেদিন কলকাতা থেকে এক টুকরি এসেছে। দাঁড়াও, নিয়ে আসি।

—যাসনি মানী, তুই চলে গেলে আমার নেবু ভাল লাগবে না।

মানী যাইতে উদ্যত হইয়াছিল, ফিরিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, বাজে কথা বোলো না বিপিনদা!বিপিন হতবুদ্ধি হইয়া বলিল, বাজে কথা কি বললাম?

—বাজে কথা ছাড়া কি! যাক, দাঁড়াও, লেবু আনি।

মানী একটু পরে দুইটি বড় বড় কমলালেবু ছাড়াইয়া একটা চায়ের পিরিচে আনিয়া যখন হাজির করিল, বিপিনের তখন লেবু খাইবার প্রবৃত্তি আদৌ নাই, অভিমানে তাহার মন বিমুখ হইয়া উঠিয়াছে।

সে শুষ্ককণ্ঠে বলিল, নেবু আমি খাব না নিয়ে যা।

—কি, রাগ হল অমনিই? তোমার তো পান থেকে চুন খসবার জো নেই, হল কি?

—না না, কিছু হয়নি, তুই যা। মিটে গেল গণ্ডগোল।

—কেন, কি হয়েছে বল না?

—আমার সব কথা বাজে। আমার কথা তোর কি শুনতে ভাল লাগে! আমি যখন বাজে লোক তখন তো বাজে কথা বলবই। তবে ডেকে এনে অপমান করা কেন?

মানী কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিল। পরে গম্ভীর সুরে বলিল, দেখ বিপিনদা, আমি যা ভেবে বলেছি, তা যদি তুমি বুঝতে পারতে, তবে এমন কথা ভাবতে না বা বলতেও না। তোমারকথাকে কেন বাজে কথা বলেছি, তা বুঝবার মতো সূক্ষ্ম বুদ্ধি তোমার ঘটে থাকলে কথায় কথায় অত রাগও আসত না।

বিপিন চুপ করিয়া থাকিবার পাত্র নয়, বলিল, জানিস তো আমার মোটা বুদ্ধি, তবেআর—

মানী পূর্ববৎ গম্ভীর সুরে বলিল, তোমার সঙ্গে কথা-কাটাকাটি করবার সময় নেই এখনআমার, তুমি বসো। কমলালেবু এই রইল, খাও তো খেও, না খাও রেখে দিয়ো, শ্যামহরি এসেনিয়ে যাবে, আমি চললুম।

কথা শেষ করিয়া মানী এক মুহূর্তও দাঁড়াইল না।

বিপিন কিছুক্ষণ গুম হইয়া বসিয়া রহিল। কিছুক্ষণ পূর্বের তাহার মনের সে আনন্দ আর নাই, জগৎটা যেন এক মুহূর্তে বিস্বাদ হইয়া গেল। মানী এমন ধরনের কথা কখনও তাহাকে বলেনাই। মেয়েমানুষ সবাই সমান, যেমন মানী তেমনই মনোরমা। মিছামিছি মনোরমার প্রতি মনেমনে সে অবিচার করিয়াছে। মানীও রাগি কম নয়, এখন দেখা যাইতেছে। স্বরূপ কি আর দুই-একদিনে প্রকাশ হয়, ক্রমে ক্রমে প্রকাশ হয়। যাক ওসব কথায় দরকার নাই। সেআজই—এখনই ধোপাখালি কাছারিতে ফিরিবে। কত রাত আর হইয়াছে। সাতটা হয়তো।দুইঘণ্টা জোর হাঁটিলে রাত নয়টার মধ্যে খুব কাছারি পৌঁছানো যাইবে। কমলালেবু খাওয়ারদরকার নাই আর।

কিন্তু একটা মুশকিল হইয়াছে এই, অনাদিবাবু এখনও রাণাঘাট হইতে ফিরিলেন না।সঙ্গে যে টাকা আছে, তাহা ইরশাল না করিয়া কি ভাবে যাওয়া যায়? সে আসিয়া কেন চলিয়াগেল হঠাৎ, না খাইয়া রাত্রিবেলাতেই চলিয়া গেল, একথা যদি অনাদিবাবু জিজ্ঞাসা করেন, তখন সে কি জবাব দিবে? তাঁহার মেয়ের সঙ্গে ঝগড়া করিয়া চলিয়া আসিয়াছে— একথা বলিতে পারিবে না!

বিপিন ঠিক করিল, আর একটু অপেক্ষা করিয়া সে দেখিবে অনাদিবাবু আসেন কিনা।দেখিয়া যাওয়াই ভাল। বাড়ির মধ্যে মানীর মায়ের কাছে টাকা দেওয়া চলে না, তিনি জিজ্ঞাসাকরিবেন এত রাত্রে সে না খাইয়া কেন কাছারি ফিরিবে? যাইতে দিবেন না, পীড়াপীড়িকরিবেন। সব দিকেই বিপদ।

মানী কেন ও কথা বলিল? বড় হেঁয়ালি ধরনের কথাবার্তা বলে আজকাল। কি গূঢ় অর্থ জানি উহার মধ্যে নিহিত আছে! আছে থাকুক, গূঢ় অর্থ মাথায় থাকুক, সে এখন চলিয়া যাইতে পারিলে বাঁচে।

কিন্তু অনেকক্ষণ অপেক্ষা করিয়াও অনাদিবাবু আসিলেন না। রাত নয়টা বাজিয়া গেল, পল্লীগ্রামে ইহারই মধ্যে খাওয়া-দাওয়া চুকিয়া যায়। একবার শ্যামহরি চাকর আসিয়া বলিল, মাবলে পাঠালেন আপনি একা খেয়ে নেবেন, না বাবু এলে খাবেন?

বিপিন বলিল, বলগে বাবু এলে খাব এখন একসঙ্গে। কিন্তু রাত দশটা বাজিয়া গেল, তখনও অনাদিবাবুর দেখা নাই। অগত্যা সে বাড়ির মধ্যে একাই খাইতে গেল।

মানীর মা পরিবেশন করিতেছিলেন, মানী সেখানে নাই। বিপিনের মন ভাল ছিল না, সেঅন্যমনস্কভাবে তাড়াতাড়ি খাইতে লাগিল। যেন খাওয়া শেষ করিতে পারিলে বাঁচে।

মানীর মা বলিলেন, বিপিন, টাকাকড়ি কিছু এনেছ নাকি?

—আজ্ঞে হ্যাঁ মাসিমা, মেশোমশাই তো এলেন না রাণাঘাট থেকে, আমি কাল খুব ভোরে চলে যাব ধোপাখালি কাছারি। টাকা আপনি নিয়ে রাখুন। খেয়ে উঠে আপনাকে বুঝিয়ে দিচ্ছি।

—কাল সকালেই কাছারি যাবে কেন? কর্তার সঙ্গে দেখা করে যাবে না? তিনি বলেইগিয়েছিলেন, আজ যদি না আসেন, কাল নিশ্চয়ই আসবেন সকাল আটটার মধ্যে।

—আমার থাকা হবে না মাসিমা, কাজ আছে।

—কাল জামাই আসবেন মানীকে নিতে, এদিকে দেখ বাবা, মেয়ের কি হয়েছে সন্ধেরপর থেকে—ওপরে শুয়ে আছে, খায়নি দায়নি। ওর আবার কি যে হল! এদিকে কর্তা নেই বাড়ি, তুমি যাচ্ছ চলে, আমি আতান্তরে পড়ে যাব তা হলে।

বিপিন ভাতের গ্রাস হাতে তুলিয়াছিল, মুখে না দিয়া সেই অবস্থাতেই মানীর মায়েরমুখের দিকে চাহিয়া কথাটা শুনিতেছিল। কথা শেষ হইতে বলিল, কি হয়েছে মানীর?

কি হয়েছে কি জানি বাবা! দু’বার ওপরে গেলাম, বালিশে মুখ গুঁজে পড়ে আছে, উঠলও না। বললে, আমার শরীর ভাল না, রাত্তিরে খাব না কিছু। বললুম, একটু গরম দুধ খাবি? বললে তাও খাবে না। কি জানি বাবা, কিছুই বুঝলুম না। একালের ধাতের মেয়ে, ওদের কথাআদ্ধেক থাকে পেটে, আদ্ধেক মুখে, কি হয়েছে না হয় বল, তাও বলবে না।

বিপিন আহারাদি শেষ করিয়া বাহিরের ঘরে আসিয়া বসিল বটে, কিন্তু নিদ্রা যাইবারএতটুকু ইচ্ছা মনে জাগিল না। মানীর মনে নিশ্চয়ই সে কষ্ট দিয়াছে, মানীর অসুখবিসুখ কিছুইনয়, বাহিরের ঘর হইতে গিয়াই সে উপরের ঘরে শুইয়া পড়িয়াছে। কেন? কি বলিয়াছিল সেমানীকে? সে চলিয়া গেলে লেবু ভাল লাগিবে না—এই কথার মধ্যে প্রেমনিবেদনের গন্ধ পাইয়া কি মানী নিজেকে অপমানিতা মনে করিয়াছে? কিন্তু এ ধরনের কথা সে তো ইতিপূর্বে আরও কয়েকবার মানীকে বলিয়াছে, তাহাতে তো মানী চটে নাই!বিপিনের মন বলিল এ কারণ আসল কারণ নয়। অন্য কোনো ব্যাপার আছে ইহার মধ্যে। তা ছাড়া মানীর অত যত্নে দেওয়া লেবু সে খাইতে চাহে নাই, রাগের মাথায় অত্যন্ত রূঢ়ভাবে মানীর সঙ্গে কথাবার্তা বলিয়াছিল। ছিঃ, ছিঃ, কি অন্যায় সে করিয়া বসিয়াছে! মানীর মতোতাহার শুভাকাক্ষিণী জগতে খুব বেশি আছে কি?

রাত তিনটে পর্যন্ত বিপিনের ঘুম হইল না। মানীর সঙ্গে যদি এখনই একবার দেখা হইত!সত্যই, সে বড় আঘাত দিয়াছে মানীর মনে। মানীর নিকট ক্ষমা না চাহিয়া সে ধোপাখালিযাইতে পারিবে না। কে জানে হয়তো এই মানীর সঙ্গে শেষ দেখা! এ চাকুরি কবে আছে, কবেনাই। আজ সে অনাদিবাবুর নায়েব, কালই সে অন্যত্র চলিয়া যাইতে পারে। মানী হয়তোকতদিন এখন আর আসিবে না। অনুতাপের কাঁটা চিরদিনই ফুটিয়া থাকিবে বিপিনের মনে।

সকাল হইলে যে-কোনো ছুতায় মানীর সঙ্গে দেখা করিতেই হইবে। না হয়, দুপুরেআহারাদি করিয়া কাছারি রওনা হইলেই চলিবে এখন। মানীর মনের কষ্ট না মুছাইয়া সে এ স্থানত্যাগ করিবে না।

কিন্তু মানুষ ভাবে এক, হয় আর এক। শেষরাত্রের দিকে বিপিনের ঘুম আসিয়াছিল, কাহাদের ডাকাডাকি হাঁকাহাঁকিতে তাহার ঘুম ভাঙিয়া গেল। চোখ মুছিতে মুছিতে উঠানের দিকে চাহিয়াদেখিল, একখানা গরুরগাড়ি দাঁড়াইয়া আছে, গাড়োয়ান একটা হ্যারিকেন লণ্ঠন উঁচু করিয়াহাঁকডাক করিতেছে, অনাদিবাবু ছইয়ের ভিতর হইতে নামিতেছেন।

শ্যামহরি চাকরও বৈঠকখানায় শোয়, বিপিন তাহাকে জাগাইয়া তুলিল। অনাদিবাবুবিপিনকে দেখিয়া বলিলেন, এই যে বিপিন! তোমার কথাই ভাবছিলাম। বড্ড জরুরি কাজেরাণাঘাট যেতে হবে তোমাকে কাল সকালেই। আজ রাত্রেই তোমায় কাগজপত্র দিয়ে দিই, কাল বেলা আটটার মধ্যে উকিল-বাড়ি দাখিল করে দিতে হবে। ভাবছিলাম কাকে দিয়ে পাঠাই! তুমিএ সময়ে এসে পড়েছ, খুব ভাল হয়েছে। বসো,আমি আসছি ভেতর থেকে। সেখান থেকেবেরিয়েছি রাত দশটার পরে। নতুন গরু, চলতে পারে না পথে, এখন রাত তো প্রায়—আঃ, কিকষ্টই গিয়েছে সারারাত!

বাড়ির ভিতর হইতে তখনই ফিরিয়া অনাদিবাবু বিপিনকে কাগজপত্র বুঝাইয়া দিলেন।

বলিলেন, আমি গিয়ে শুয়ে পড়ি, তুমিও শোও। এখনও ঘণ্টা দুই রাত আছে। ভোরে উঠে চলেযেও। যদি উকিলবাবু ছেড়ে দেন, তবে কালই ওখানে খাওয়াদাওয়া করে বিকেল নাগাদ এখানেচলে এসো। কাল আবার আমার মেয়েকে নিতে জামাই আসছেন কলকাতা থেকে, পারো তো কিছুমিষ্টি এনো সাধুচরণ ময়রার দোকান থেকে। এই একটা টাকা নিয়ে যাও।

খুব ভোরে উঠিয়া বিপিন রাণাঘাট রওনা হইল। যাইবার সময় সারাপথ দেখিল, খুবভোরে উঠিয়া চাষারা জমি নিড়াইতেছে। এবার বৈশাখের প্রথমে বৃষ্টি হইয়া ফসল বুনিবার সুবিধা করিয়া দিয়াছিল, এখন বৃষ্টি আদৌ নাই, জমিতে জমিতে নিড়ানি দেওয়া চলিতেছে।হয়তো এবার জ্যৈষ্ঠের মাঝামাঝি বর্ষা নামিবে—এই ভয়ে চাষিরা শীঘ্র শীঘ্র ছাঁটার কাজ শেষকরিতে চায়। সারাপথ দুইধারে মাঠে ধান-পাটের ক্ষেতে চাষারা জমি নিড়াইতেছে।

ভোরের অতি সুন্দর মিষ্টি বাতাস। মাঠে ও পথের ধারে ছোট বড় গাছে সোঁদালি ফুলের ঝাড় ঝুলিতেছে, বিশেষ করিয়া কানসোনার মাঠে। রেলের ফটক পার হইয়া আবাদ তত নাই, ফাঁকা মাঠের মধ্যে চারিধারে শুধুই সোঁদালি ফুলের গাছ।

কলাধরপুরের বিশ্বাসদের বাড়ির চণ্ডীমণ্ডপে বিপিন একবার তামাক খাইবার জন্য বসিল।প্রতিবার রাণাঘাট হইতে যাতায়াতের পথে এইটা তাহার বিশ্রামের স্থান। বিশ্বাসদের বাড়িরসকলেই বিপিনকে চেনে। বিশ্বাসদের বড়কর্তা রমা বিশ্বাস চণ্ডীমণ্ডপের সামনে পাটের দড়ি পাকাইতে ব্যস্ত ছিলেন। বিপিনকে দেখিয়া বলিলেন, এই যে আসুন চাটুজ্জে মশায়, প্রণাম হই।আজ যে বড্ড সকালে রাণাঘাট চলেছেন, মোকদ্দমা আছে নাকি? উঠে বসুন ভাল হয়ে, একটু চাকরে দিক!

—না না, চায়ের দরকার নেই। একটু তামাক খাই বরং।

—আরে, তামাক তো খাবেনই, চা একটু খান। অত সকালে তো চা খেয়ে বেরোননি? এখন সাতটা বাজে আমিও তো চা খাব। বসুন, চার ক্রোশ রাস্তা হেঁটেছেন এর মধ্যে, কষ্ট কম হয়েছে? একটু জিরোন I

মানীর সঙ্গে ফিরিয়া আজ দেখা হইবে কি? আর দেখা হওয়া সম্ভবও নয়। দেখা হইলেওকথাবার্তা তেমনভাবে হইবে না। জামাইবাবু আসিবেন, কর্তা বাড়ি রহিয়াছেন। তবুও একবার চেষ্টা করিয়া দেখিতে হইবে।

বিশ্বাস মহাশয় চা ও মুড়ি আনিয়া দিলেন। বিপিন খাইতে খাইতে বলিল, এবার পাট ক’বিঘে বুনলেন বিশ্বেস মশায়?

—তা ধরুন, প্রায় বারো-চোদ্দো বিঘে হবে। বুনলে কি হবে, খরচা পোষায় না, দশ টাকাকরে দুটো কিষান, তা বাদে জন-মজুর তো আছেই। পাটের দর তো উঠল না। ওই দেখুন।ছত্রিশ সালে পাটের দর ভাল পেয়ে উত্তরের পোতায় বড় ঘরখানা তুলতে গিয়েছিলাম, আদ্ধেক গাঁথুনি হয়ে দেখুন পড়ে আছে, আর দর পেলাম না, তা কি হবে?

—আপনার বড়ছেলে কোথায়?

—সে ওই বীজপুরের কারখানায় ত্রিশ টাকা মাইনেয় ঢুকেছে, রং-মিস্ত্রী। আমি বলি, ওকেন, বাড়িতে এসে ফলাও করে চাষ-বাস লাগা। মেসে খায়, একটু দুধ-ঘি পেটে যায় না, শরীর মাটি। ও মাসে বাড়ি এসেছিল, আমার স্ত্রী এক বোতল ঘরের গাওয়া ঘি সঙ্গে পাঠিয়ে দিলে আবার। ওই খাটুনি, দুধ ঘি না খেলে শরীর থাকে? উঠলেন? ফিরবার পথে পায়ের ধুলো দিয়ে যাবেন। না হয় এখানেই ফিরবার সময় দুটো স্বপাকে আহার করে যাবেন এখন।

—না না, আমি সেখানেই খাব। উকিলের কাজ মিটতে বেলা এগারোটা বাজবে। তারপরহয়তো একবার কোর্টেও যেতে হবে স্ট্যাম্পভেন্ডারের কাছে। ফিরতে তো তিনটের কম হবে না। আচ্ছা, আসি ।

—আজ্ঞে আসুন, প্রণাম হই।

রাণাঘাট কোর্টে বিপিনের স্বগ্রামের নিবারণ মুখুজ্জের সঙ্গে দেখা। নিবারণ মুখুজ্জেবিপিনকে দূর হইতে দেখিয়া কাছে আসিলেন, বিপিন প্রথমে তাহাকে দেখিতে পায় নাই।

—কে বিপিন?, কোর্টে কাজে এসেছিলে বুঝি?

—আজ্ঞে হ্যাঁ, কাকা। আপনি?

—আমিও এসেছিলাম একবার একটা কাগজের নকল নিতে। আমার আবার একটুব্রহ্মোত্তর জমি নদীয়ার এলাকায় পড়ে কিনা, সেজন্যে রাণাঘাট ছুটোছুটি করতে হল। হ্যাঁ, তোমার সঙ্গে একটা জরুরি কথা আছে বাবা। দেখা হল ভালই হল। একটু আড়ালের দিকে চলোযাই, গোপনীয় কথা।

বিপিন একটু কৌতূহলী হইয়া নিবারণ মুখুজ্জের সহিত লোকজন হইতে একটু দূরেগেল।

—বাবা, কথাটা খুব গুরুতর। তোমার বাড়ির সম্বন্ধেই কথা। তুমি থাক বারো মাস বিদেশে, নিশ্চয়ই তোমার কানে এখনও ওঠেনি। বড় গুরুতর কথা আর বড় দুঃখের কথা।

বিপিন আশঙ্কায় উদ্বেগে কাঠ হইয়া গেল। বাড়ির সম্বন্ধে কি গুরুতর, আর কি দুঃখের কথা! প্রথমেই তাহার মুখ দিয়া আপনা-আপনি বাহির হইয়া গেল—কাকাবাবু, বেঁচে আছে তো?

তাহার বুকের মধ্যে কেমন ধড়াস ধড়াস করিতেছে, জজের মুখে ফাঁসির হুকুম শুনিবারভঙ্গিতে সে আকুল ও শঙ্কিত দৃষ্টিতে নিবারণমুখুজ্জের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।

নিবারণ মুখুজ্জে বলিলেন, না না, সে সব কিছু নয়। ব্যাপারটা একটু অন্যরকম। বলেই ফেলি। এই গিয়ে তোমার বোনকে নিয়ে গায়ে কথা উঠেছে—মানে ওপাড়ার পটলের সঙ্গেসর্বদাই মেলামেশা করে আসছে তো অনেকদিন থেকেই—সম্প্রতি একদিন নাকি সন্ধেবেলাতোমাদের বাড়ির পেছনে বাগানে কাঁটালতলায় দুজনকে একসঙ্গে দেখা গিয়েছিল—যে দেখেছিল সে-ই বলেছে। এই নিয়ে গাঁয়ে খুব কথা চলছে। এইসময় তোমার একবার যাওয়া খুব দরকার বলে মনে করি।

বিপিন শুনিয়া অবাক হইয়া গেল—তাহার বোন অসঙ্গত কিছু করিতে পারে ইহা তাহারমাথায় আসে না। তাহাকে বিপিন নিতান্ত ছেলেমানুষ বলিয়া জানে—আচ্ছা, যদি পটলের সঙ্গে কথাই বলিয়া থাকে তাহাতে দোষ বা কি আছে?

পরক্ষণেই তাহার মনে হইল বাড়ি যাওয়াটা খুব দরকার বটে এসময়। পলাশপুরে এমন কোনো জরুরি দরকার নাই যে আজ না ফিরিলেই চলিবে না। বরং একবার বাড়ি ঘুরিয়া আসাযাক্

বৈকালের দিকে বিপিন গ্রামে পৌঁছিল। বাড়ি ঢুকিতেই প্রথমে মনোরমার সঙ্গে দেখা। স্বামীকেহঠাৎ এভাবে আসিতে দেখিয়া সে যেন একটু অবাক হইয়া গেল। বলিল—কখন এলে, কোন্ গাড়িতে? চিঠি তো দাওনি? ভাল আছ তো?

বিপিন পুঁটুলিটা স্ত্রীর হাতে দিয়া বলিল—ধরো এটা। মার জন্যে বাতাসা আছে, ভেঙ্গে নাযায় দেখো। নেবেঞ্চুস্ আছে, ছেলেপিলেদের ডেকে দাও। তোমরা কেমন আছ? বলাই কোথায়?

বলাই গিয়েছে মাছ ধরতে।

—কেমন আছে সে?

মনোরমা চুপ করিয়া রহিল।

—কেমন আছে বলাই?

—ভাল না। আমার কথা কেউ তো শোনে না, যা পাচ্ছে তা খাচ্চে, রোজ নদীর ধারেমাছ ধরতে গিয়ে জলের হাওয়ায় বসে থাকে জ্বর হয় রোজ রাত্তিরে—তার ওপর খায়-দায়।ওষুধবিষুধ কিছুই না।

—মুখ হাত পা কেমন আছে?

—বেজায় ফোলা। এলেই দেখে বুঝতে পারবে। আজ একটা কথা শুনেচ? -হ্যাঁ, নিবারণ কাকার মুখে শুনলাম রাণাঘাটে। কি ব্যাপার বলো তো?

—যা শুনেছ, সব সত্যি, আমার কথা ঠাকুরঝি একেবারে শোনে না—কতদিন বারণ করেছি। মাকেও বলে দিইছি, মা শুনেও শোনেন না। এখন গাঁয়ে ঢি-ঢি পড়ে গিয়েছে—এখন আমার কথা হয়তো তোমাদের ভাল লাগলেও লাগতে পারে। দাসী-বাঁদীর মতো এ বাড়িতে আছি বই তো নয়!

বিপিন বিরক্ত হইয়া বলিল–আঃ, যা জিজ্ঞেস করছি তার উত্তর দাও না আগে! তুমিনিজের চোখে কিছু দেখেছ?

—কত দিন। তোমাকে বললেই তুমি রেগে যাবে বলে কিছু বলিনি—মাকে বলে কিহবে—বলা না বলা দুই সমান।

—আচ্ছা থাক। বীণাকে একবার ডেকে দাও—আমি তাকে দু-একটা কথা বলি। তুমি এঘর থেকে যাও।

কিন্তু মনোরমা ঘর হইতে চলিয়া গেলেও বীণার আসিতে বিলম্ব হইতে লাগিল। এব্যাপার লইয়া সে কি বলিবে? বীণা তাহার ছোট বোন, কখনও তাহাকে সে রূঢ় কথা জীবনেবলে নাই—বিশেষ করিয়া বীণা বিধবা হইবার পরে বিপিন সাধ্যমতো চেষ্টা করে ছেলেমানুষ বীণাকে কি করিয়া একটুখানি সুখী করা যায়। বিপিন ভাবিতে লাগিল—বীণার দোষ কি? অল্পবয়সে বিধবা—ওর মনের কোন্ সাধই বা পুরেছে? পটলকে হয়তো ওর চোখে ভাল লেগেছে—সম্পূর্ণ সম্ভব। ছেলেবেলা থেকেই পটলের সঙ্গে ওর ভাব ছিল, আর কেউ নাজানুক, আমি জানি। যদি পটলের সঙ্গে দুটো কথা কয়ে ওর তৃপ্তি হয়—তা আমি বারণ করি বা কি ভাবে!…তবে বীণা ছেলেমানুষ, সংসারের কি-ই বা জানে! কত বিপদ আছে কত দিকে, সে কি তার খবর রাখে? না—আমার কাজ নয়। মনোরমাকে দিয়ে বলাতে হবে।

হঠাৎ তাহার মনে আসিল মানীর কথা।

সেও তো এই রকম ছেলেবেলার বন্ধুত্ব। মানী বিবাহিতা, তার স্বামী শিক্ষিত, মার্জিত, ভদ্র যুবক। তবে মানীকেন তাহার সহিত কথা বলিতে আসে? কেন তাহাকে দেখিবার জন্যমানীর এত আগ্রহ?

এসব কথার কোনো মীমাংসা নাই। মীমাংসা হয় না। এই যে সে আজ বাড়ি আসিয়াছে –সারা পথ সারা ট্রেনে কাহার কথা সে ভাবিয়াছে?

নিজের মনকে চোখ ঠারা চলে না। ছেলেমানুষ বীণাকে সে কি দোষ দিবে? তাহার বাবা কি করিয়াছিলেন?

যাক ওসব কথা। মনোরমাকে দিয়া বীণাকে বলাইতে হইবে। গ্রামে কোনো কুৎসা রটেবীণার নামে—তাহা কখনই হইতে দেওয়া চলিবে না। আবশ্যক হইলে বীণাকে এখান হইতেসরাইয়া ধোপাখালি কাছারিতে নিজের কাছে কিছুদিন না হয় রাখিবে।

এই সময় বীণা ঘরে ঢুকিয়া বলিল—ডাকছিলে দাদা?

বিপিন চোখ তুলিয়া বীণার দিকে চাহিল। অনেক দিন ভাল করিয়া সে বীণাকে দেখে নাই।বীণার মুখশ্রী আজকাল এত সুন্দর হইয়া উঠিয়াছে! কি সুন্দর দেখিতে হইয়াছে বীণা! চোখ দুটি যেমন ডাগর, তেমনি স্নিগ্ধ। মুখখানি এখনও ছেলেমানুষের মতোই। এ চোখে ও মুখে কোনোপাপ থাকিতে পারে?

বিপিন বলিল—বলাই কোথায়?

—ছোড়দা মাছ ধরতে গিয়েছে।

—তোর শরীর ভাল আছে তো?

—হ্যাঁ। তুমি হঠাৎ চলে এলে যে?

—এমনি। রাণাঘাটে এসেছিলাম কাজে—ভাবলুম একবার বাড়ি ঘুরে যাই। হ্যাঁ, মাকোথায়?

—মা বড়ির ডাল ধুতে গিয়েছেনপুকুরের ঘাটে। ডেকে আনব?

—থাক এখন ডাকার দরকার নেই, তোর সঙ্গে একটা কথা ছিল।

—কি বল না?

—তুই পটলের সঙ্গে বেশি মেলামেশা করিসনে। গাঁয়ে ওতে পাঁচরকম কথাউঠছে—আমরা গরিব লোক, আমাদের পক্ষে সেটা ভাল নয়।

বিপিন কথাটা মরীয়া হইয়া বলিয়াই ফেলিল। সঙ্গে সঙ্গে ইহাও লক্ষ্য না করিয়া পারিলনা, পটলের কথা বলিতেই বীণার চোখমুখের ভাব যেন কেমন হইয়া গেল—যে ভাব সেবীণার মুখে-চোখে কখনও দেখে নাই।

মনোরমার কথা তাহা হইলে মিথ্যা নয়—নির্ধারণ মুখুজ্জেও বাজে কথা বলেন নাই! পূর্বে হইলে হয়তো বিপিন বীণার এ পরিবর্তন লক্ষ্য করিত না—কিন্তু গত কয়েক মাসেরব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ফলে বিপিন এসব লক্ষণ বুঝিতে পারে এখন।

বীণা কিন্তু অতি অল্প সময়ের মধ্যেই নিজেকে যেন সামলাইয়া লইয়া সহজ ভাবেইবলিল—যা বলো দাদা, পটলদা আসে, কথাবার্তা বলে—তাই বলি। না হয় আর বলব না।

বিপিন বুঝিল ইহা মিথ্যা আশ্বাস। বীণা ছলনা করিতেছে—পটলের সঙ্গে তাহার কিছুই নাই, ইহা সে দেখাইতে চায়—আর একটা খারাপ লক্ষণ, ছেলেমানুষ বীণা ভাবিয়াছে ইহাতেইদাদার চোখে ধূলা দেওয়া যাইবে—যাইতও যদি মানীর সঙ্গে পলাশপুরের বাড়িতে তাহার দেখা নাহইত!

ইহা ঠিকই যে বীণা মিথ্যা কথা বলিতেছে। পটলের সঙ্গে কথাবার্তা সে বন্ধ করিবে না।লুকাইয়া দেখা করিবার চেষ্টা করিবে। বিপিন বুঝিল, সে বীণা আর নাই, তাহার ছোট বোনসরলা ছেলেমানুষ বীণা এ নয়, এ প্রেমমুগ্ধা তরুণী নারী, প্রেমিকের সহিত মিশিবার সুবিধাখুঁজিতে সব রকম ছলনা এ অবলম্বন করিবে। সহোদরা বটে, কিন্তু বীণাকে আর বিশ্বাস নাই।বীণা দূরে সরিয়া গিয়াছে।

বিপিন তবুও হাল ছাড়িল না। বীণাকে কাছে বসাইয়া তাহাদের বংশের পূর্ব-গৌরবসবিস্তারে বর্ণনা করিল। গ্রাম্য কুৎসা যে ভয়ানক জিনিস, তাহাতে একটি গৃহস্থের ভবিষ্যৎ কি ভাবে নষ্ট হইয়া যাইতে পারে, দু-একটা কাল্পনিক দৃষ্টান্ত দিয়া তাহা বুঝাইবার চেষ্টা করিল।বীণা খানিকক্ষণ মন দিয়া শুনিল—কিন্তু ক্রমশ সে যেন অধীর হইয়া পড়িতেছে, দু-একবার উঠিবার চেষ্টা করিয়াও সে সাহস পাইতেছে না—দাদার সম্মুখ হইতে চলিয়া যাইতে পারিলেযেন বাঁচে, এরূপ ভাব তাহার চোখে মুখে ফুটিয়া উঠিয়াছে।

 

এই সময়ে বলাই আসিয়া পড়াতে বিপিনের বক্তৃতা আপনা-আপনিই বন্ধ হইয়া গেল। বলাই ঘরে ঢুকিয়া বলিল—দাদা কখন এলে? মাছ ধরে এনেছি দেখবে এসমস্ত একটা শোল মাছআর দুটো ছোট ছোট বান—

বিপিন বলাইয়ের চেহারা দেখিয়া চমকিয়া উঠিল। মুখ আরও ফুলিয়াছে, শরীরে রক্তনাই—পায়ের পাতা বেরিবেরি রোগীর মতো দেখিতে, চোখের কোণ সাদা। অথচ এই চেহারালইয়া বলাই দিব্য মনের আনন্দে মাছ ধরিয়া বেড়াইতেছে, খাওয়া-দাওয়া করিতেছে।

ভগবান এ কি করিলেন? চারিদিক হইতে তাহার জীবনে বিপদ ঘনাইয়া আসিতেছে, তাহা বুঝিতে বাকি নাই। বলাই বাঁচিবে না—নেফ্রাইটিসের রোগীর শেষ অবস্থা তাহার চেহারায় পরিস্ফুট—অথচ সে সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত আছে তাহার ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে।

বিপিন বলাইকে কিছু বলিল না। বলিয়া কোনো ফল নাই—যেমন বীণাকে বলিয়া কোনোফল নাই। কেহই তাহার কথা শুনিবে না। সে চাকুরি করিতে বাহির হইলেই উহারা যাহা খুশিতাহাই করিবে। এ জগতে কেহ কাহারও কথা শোনে না—সবাই স্বার্থপর, যাহার যাহা ভাললাগে সে তাহাই করে, অন্য কারও মুখের দিকে চাহিবার অবসর তখন তাহাদের বড় একটা থাকে না। সে নিজে সারাজীবন তাহাই করিয়া আসিয়াছে—এখনও করিতেছে—অপরের দোষ দিয়া লাভ কি?

দুপুরের পর সে নিজের ঘরে বিশ্রাম করিতেছে, মনোরমা ঘরে ঢুকিয়া বলিল—ঘুমুলে নাকি?

—না ঘুমুইনি, বসো।

মনোরমা বিছানার এক কোণে বিপিনের মাথার কাছে বসিল। একটু ইতস্তত করিয়া বলিল—বীণাকে বল্লে কিছু নাকি?

—বলেছি।

—ও কি বল্লে?

—বল্লে পটলের সঙ্গে আর কথা বলবে না।

—একটা কথা বলি শোনো। এরকম করলে হবে না কিছু। বীণা ঠাকুরঝি যাই বলুক, পটলের সঙ্গে দেখা না করে পারবে না। তুমি বাড়ি থেকে বেরুতে যা দেরি। তার চেয়ে এককাজ করো, পটলকে একবার বলে যাও কথাটা। ওকে ভয় দেখাও, বাড়ি আসতে বারণ করেযাও—তাতে কাজ হবে। বুঝলে আমার কথা?

বিপিন মনে মনে মনোরমার বুদ্ধির প্রশংসা না করিয়া পারিল না। মেয়েমানুষের মন সে অনেক বেশি বোঝে তাহার নিজের চেয়ে।

মনোরমা আবার বলিল—না হয় পাড়ার পাঁচজনকে ডেকে তাদের সামনে পটলকে দু’কথা বল। এ বাড়ি আসতে মানা করে দাও। তাতে দু’কাজই হবে। গাঁয়ের লোক জানুক তুমি বাড়িএসে দুজনকেই শাসন করে দিয়েছ—পটলেরও একটা ভয় আর লজ্জা হবে—সে হঠাৎ এবাড়িতে আসতে পারবে না।

—কিন্তু তাতে একটা বিপদ আছে। গাঁয়ের লোকের কথা আমিই বা অনর্থকগায়ে মেখেনিতে যাই কেন? তাতে উল্টো উৎপত্তি হবে না?

—কিছু উল্টো উৎপত্তি হবে না। বেশ, ভয় দেখিয়ে না হয়, মিষ্টি কথায় বুঝিয়ে বলোপটলকে—যখন এরকম একটা কথা উঠেছে—তখন ভাই আমাদের বাড়ি আর তোমারযাওয়া-আসাটা ভাল দেখায় না—এই ভাবে বলো।

—তাই তবে করি। এদিকে আর একটা কথা বলি শোনো। বলাইয়ের অবস্থা ভাল নয়। আজ দেখে বুঝলাম, ও আর বেশি দিন নয়।

—বলো কি গো? অমন বলতে নেই।

—আর বলতে নেই! মনোরমা, সামনে আমার অনেক বিপদ আসছে আমি বুঝতেপেরেছি। এই বীণার ব্যাপার, বলাইয়ের চেহারা—এ সব দেখে তোমারই বা কি মনে হয়? আমার এখন পলাশপুরে যাওয়া হয় না। …

সেই রাত্রেই বিপিনের আশঙ্কা বাস্তবে পরিণত হইল। শেষরাত্রি হইতে বলাই হঠাত্যন্ত্রণায় অস্থির হইয়া পড়িল, মাঝে মাঝে চিৎকার করে, মাঝে মাঝে ছুটিয়া বাহির হইতে যায়। প্রতিবেশীরা অনেকে দেখিতে আসিলেন—নানারকম টোটকা ওষুধের ব্যবস্থা করিলেন— কিছুতেই কিছু হইল না। যত বেলা বাড়িতে লাগিল, বলাই-এর মুখের বুলিই হইল—জ্বলে গেল, জ্বলে গেল!…যন্ত্রণায় বলাই যেন পাগলের মতো হইয়া উঠিল, মুখে যাহা আসে বকে, হাত-পা ছোঁড়ে, আর কেবলই ছুটিয়া বাহির হইতে যায়।’

তিন দিন তিন রাত্রি একই ভাবে কাটিল। কত রকম তেল-পড়া, জল-পড়া, ঝাড়ফুঁক যেযাহা বলে তাহাই করা হইল। কিছুতেই কিছু হইল না। চতুর্থ দিন সকাল আটটার সময় হইতেবলাইয়ের অবস্থা ক্রমশ খারাপ হইয়া আসিতে লাগিল।

বিপিন স্ত্রীকে ডাকিয়া বলিল—কি করছ?

মনোরমার চক্ষু রাত জাগিয়া লাল, চোখের নীচে কালি পড়িয়াছে—বৃদ্ধা শাশুড়ি. রাত জাগিতে পারেন না— বিপিনও আয়েসী লোক, রাত একটা পর্যন্ত কায়ক্লেশে জাগিয়াথাকে—তারপর গিয়া শুইয়া পড়ে। মনোরমা সারারাত জাগিয়া থাকে রোগীর পাশে আর থাকে বীণা।

মনোরমা বলিল—গোয়ালে আজ চারদিন ঝাঁট পড়েনি, গোয়ালটা একটু ঝাঁট দিচ্ছি।

বিপিন বলিল—গোয়াল-ঝাঁট থাকুক। সকাল সকাল নেয়ে এসে দুটো যা হয় রেঁধেছেলেপিলেদের খাইয়ে- দাইয়ে নাও—বীণাকে আর মাকে খাইয়ে দাও। বলাইয়ের অবস্থা দেখেবুঝতে পারছ না?

মনোরমা স্বামীর মুখের দিকে চাহিয়া থাকিয়া বলিল, কেন গো—ঠাকুরপোর অবস্থাখারাপ?

তা দেখে বুঝতে পারছ না? আজই হয়ে যাবে। আর দেরি নেই। শীগির করে ঘাটেযাও।

মনোরমা নিঃশব্দে কাঁদিতে লাগিল। বিপিন বলিল—কেঁদে কি হবে, এখন যা করবারআছে করে ফেল। মায়ের সামনে কেঁদো না, ঘাটে যাও চলে।

মনোরমার একটা অভ্যাস সংসারের মধ্যে যে যে আছে তাহাদের সকলকেই সে ভালবাসে, স্নেহ করে—মা, বীণা ঠাকুরঝি, ঠাকুরপো—সকলেরই সুখসুবিধা দেখা তাহার চিরকালের অভ্যাস। এই সাজানো সংসারের মধ্য হইতে বলাই ঠাকুরপো চলিয়া গেলেসংসারের কতখানি চলিয়া যাইবে!..সে চিন্তা মনোরমার পক্ষে অসহ্য।

বিপিন ভাইয়ের সামনে গিয়া বসিল। বীণাকে বলিল—যা বীণা, ঘাটে যা—আমি আছিবসে। মাকে নিয়ে যা।

সত্যি, এতটুকু মেয়ে বীণা কয়দিন কি অক্লান্ত পরিশ্রম করিতেছে, সমানে রাত জাগিতেছে মা ও উহার বউদিদির সঙ্গে। দেবীর মতো সেবা করিতেছে ভাইয়ের, অথচ কি অভাগিনী! জীবনে সে কখনও যাহা পায় নাই—অথচ যার জন্য তার বালিকা-মন বুভুক্ষু, অপরের নিকট হইতে তারই এককণা পাইবার নিমিত্ত অভাগিনীর কি ব্যর্থ আগ্রহ! নিজেকেদিয়া বিপিন বোঝে এ নিদারুণ বুভুক্ষা।

সকলে আহারাদি শেষ করিয়া লইয়া বলাইয়ের কাছে বসিল। বলাইয়ের গত দুই দিনকোনো জ্ঞান ছিল না—যন্ত্রণায় চিৎকার করে মাঝে মাঝে কিন্তু মানুষ চিনিতে পারে না। বিপিনের মা খুব শক্ত মেয়ে—তিনি সবই বুঝিয়াছিলেন, অথচ এ পর্যন্ত তাহার চোখে জল পড়ে নাই—বরং বীণা ও মনোরমা কাঁদিলে তিনি কালও বুঝাইয়াছেন। আজ কিন্তু দুপুরের পর হইতেতিনি অনবরত কাঁদিতেছেন। বীণা ডোবার ধারে বাসন লইয়া গিয়াছিল।

ডোবার ওপারের ঘাটে রায়-বউ ও নিবারণ মুখুজ্জের বড় মেয়ে নলিনী কথাবলিতেছিল। নলিনী হাত-পা নাড়িয়া বলিতেছে—তা হবে না ওরকম? বাড়িতে বিধবা মেয়েরওই রকম অনাচার ভগবান সহ্যি করেন? জলজ্যান্ত ভাইটা ধড়ফড় করে মরল চোখের সামনে!এখনও চন্দ্র-সূর্য আছেন—অনাচার ঢুকলে সে সংসারে মঙ্গল হয় কখনও?

বীণা জলে নামিতে পারিল না—জলের ধারে কাঠের মতো দাঁড়াইয়া রহিল।

উহারা বীণাকে দেখিতে পায় নাই—বীণা কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া থাকিয়া বাসন লইয়া চলিয়া আসিল—চোখের জল সামলাইতে পারিল না ফিরিবার সময়। পটলদা’র সঙ্গে কথা বলাঅনাচার! এ ছাড়া আর কি অনাচার সে করিয়াছে? ভগবান তো সব জানেন। তাহারই পাপেছোড়দা মরিতে বসিয়াছে—একথা যদি সত্য হয়—সে পিতল-কাঁসা-হাতে শপথ করিয়াবলিতেছে, আর কোনো দিন সে পটলদার মুখ দেখিবে না। ভগবান ছোড়দাকে বাঁচাইয়া দিন।

কিন্তু ভগবান তাহার অনুরোধ রাখিলেন না। বৈকাল পাঁচটার সময় বলাই মারা গেল।


© 2024 পুরনো বই