সেদিন স্টার-থিয়েটারে ‘আনন্দ-বিদায়ে’র অভিনয় শেষে দক্ষযজ্ঞের অভিনয়ে পরিণত হয়েছিল শুনে দুঃখিত এবং লজ্জিত হলুম। তার প্রথম কারণ এই যে, শ্রীযুক্ত দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের মত লোককে দর্শকমণ্ডলী লাঞ্ছিত করেছেন; এবং তার দ্বিতীয় কারণ এই যে, শ্রীযুক্ত দ্বিজেন্দ্রলাল রায় শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে প্রকাশ্যে লাঞ্ছনা দেবার উদ্দেশ্যেই রঙ্গমঞ্চে আনন্দ-বিদায়ের অবতারণা করেছিলেন।
দ্বিজেন্দ্রবাবু লিখেছেন যে, তিনি সকলরকম ‘মি’র বিপক্ষে। ন্যাকামি জ্যাঠামি ভণ্ডামি বোকামি প্রভৃতি যেসকল ‘মি’-ভাগান্ত পদার্থের তিনি উল্লেখ করেছেন, সেগুলির যে কোনো ভদ্রলোকেই পক্ষপাতী, এরূপ আমার বিশ্বাস নয়; অন্তত পক্ষপাতী হলেও সেকথা কেউ মুখে স্বীকার করবেন না। কিন্তু সমাজে থাকতে হলেই পাঁচটি ‘মি’ নিয়েই আমাদের ঘর করতে হয়, এবং সেই কারণেই সপরিচিত ‘মি’গুলি, সাহিত্যে না হোক, জীবনে আমাদের সকলেরই অনেকটা সওয়া আছে। কিন্তু যা আছে, তার উপর যদি একটা নতুন ‘মি’ এসে আমাদের ঘাড়ে চাপে, তাহলে সেটা নিতান্ত ভয়ের বিষয় হয়ে ওঠে। আমরা এতদিন নিরীহ প্রকৃতির লোক বলেই পরিচিত ছিলুম। কিছুদিন থেকে ষণ্ডামি নামে একটা নতুন ‘মি’ আমাদের সমাজে প্রবেশলাভ করেছে। এতদিন রাজনীতির রঙ্গভূমিতেই আমরা তার পরিচয় পেয়েছি। সরাটকনগ্রেসে সেই ‘মি’র তাণ্ডবনৃত্যের অভিনয় হয়েছিল। আমার বিশ্বাস ছিল যে, সুরাটে যে যবনিকাপতন হয়েছে, তা আর সহসা উঠবে না। কিন্তু এখন দেখতে পাচ্ছি যে, রাজনীতিতে প্রশ্রয় পেয়ে ষণ্ডামি ক্রমশ সমাজের অপরসকল দেশও অধিকার করে নিয়েছে। ষণ্ডামি-জিনিসটের আর যে ক্ষেত্রেই সার্থকতা থাক, সাহিত্যে নেই; কেননা, সাহিত্যে বাহুবলের কোনো স্থান নেই। স্টার-থিয়েটারের বক্স হতে শ্রীযুক্ত দ্বিজেন্দ্রলাল রায়কে গায়ের জোরে নামানো সহজ, কিন্তু তিনি বঙ্গসাহিত্যে যে উচ্চ-আসন লাভ করেছেন, বাহুবলে তাঁকে সেখান থেকে নামানো অসম্ভব। লেখকমাত্রেই নিন্দাপ্রশংসা সম্বন্ধে পরাধীন। সমালোচকদের চোখরাঙানি সহ্য করতে লেখকমাত্রেরই প্রস্তুত হওয়া আবশ্যক। কিন্তু সাহিত্যজগতের ঢিলটে মারলে যে জড়জগতের পাটকেলটা আমাদের খেতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। ওরকম একটা নিয়ম প্রচলিত হলে সাহিত্যরাজ্যে আমাদের বাস করা চলবে না। কারণ একথা সৰ্ববাদিসম্মত যে, বুদ্ধির জোর গায়ের জোরের কাছে বরাবরই হার মানে। এই কারণেই শ্রীযুক্ত দ্বিজেন্দ্রলাল রায় যেভাবে লাঞ্ছিত হয়েছিলেন, তার জন্য আমি বিশেষ দুঃখিত এবং লজ্জিত।
২.
কিন্তু শ্ৰীযুক্ত দ্বিজেন্দ্রলাল রায় যে, এ যুগের সাহিত্যে আবার ‘কবির লড়াই’ ফিরে আনবার প্রয়াস পেয়েছেন, তার জন্য আমি আরও বেশি দুঃখিত। ও কাজ একবার আরম্ভ করলে শেষটা খেউড় ধরতেই হবে। দ্বিজেন্দ্রবাবু বোধ হয় একথা অস্বীকার করবেন না যে, সেটি নিতান্ত অবাঞ্ছনীয়।
এ পৃথিবীতে মানুষে আসলে খালি দুটি কার্যই করতে জানে; সে হচ্ছে হাসতে এবং কাঁদতে। আমরা সকলেই নিজে হাসতেও জানি, কাঁদতেও জানি; কিন্তু সকলেরই কিছু,আর অপরকে হাসাবার কিংবা কাঁদাবার শক্তি নেই। অবশ্য অপরকে চপেটাঘাত করে কাঁদানো কিংবা কাতুকুতু দিয়ে হাসানো আমাদের সবারই আয়ত্ত, কিন্তু সরস্বতীর বীণার সাহায্যে কেবল দুটিচারটি লোকই ঐ কার্য করতে পারেন। যাঁদের সে ভগবৎদত্ত ক্ষমতা আছে, তাঁদেরই আমরা কবি বলে মেনে নিই। বাদবাকি সব বাজে লেখক। কাব্যে, আমার মতে, শুধু তিনটিমাত্র রস আছে : করণ রস, হাস্যরস, আর হাসিকান্নামিশ্রিত মধুর রস। যে লেখায় এর একটি-না-একটি রস আছে, তাই কাব্য; বাদবাকি সব নীরস লেখা। দর্শন বিজ্ঞান ইত্যাদি যা খুশি তা হতে পারে, কিন্তু কাব্য নয়। বাংলাসাহিত্যে হাস্যরসে শ্রীযুক্ত দ্বিজেন্দ্রলাল রায় অদ্বিতীয়। তাঁর গানে হাস্যরস ভাবে কথায় সরে তালে লয়ে পঞ্চীকৃত হয়ে মতিমান হয়ে উঠেছে। হাসির গান তাঁর সঙ্গে জড়িতে গাইতে পারে, বঙ্গসাহিত্যের আসরে এমন গুণী আর-একটিও নেই। কান্নার মত হাসিরও নানাপ্রকার বিভিন্ন রূপে আছে, এবং দ্বিজেন্দ্রবাবুর মুখে হাসি নানা আকারেই প্রকাশ পেয়েছে। সাহিত্যে যে কেবল আমাদের মিষ্টি হাসিই হাসতে হবে, একথা আমি মানি নে। সুতরাং দ্বিজেন্দ্রবাবু যে বলেছেন যে, কাব্যে বিদ্রুপের হাসিরও ন্যায্য স্থান আছে, সেকথা সম্পূর্ণ সত্য। কিন্তু উপহাস জিনিসটের প্রাণই হচ্ছে হাসি। হাসি বাদ দিলে শুধু তার উপটুকু থাকে, কিন্তু তার রূপটকু থাকে না। হাসতে হলেই আমরা অল্পবিস্তর দন্তবিকাশ করতে বাধ্য হই। কিন্তু দন্তবিকাশ করলেই যে সে ব্যাপারটা হাসি হয়ে ওঠে তা নয়; দাঁতখিচুনি বলেও পৃথিবীতে একটা জিনিস আছে সে ক্রিয়াটি যে ঠিক হাসি নয়, বরং তার উলটো, জীবজগতে তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ আছে। সুতরাং উপহাস-জিনিসটে সাহিত্যে চললেও, কেবলমাত্র তার মুখভঙ্গিটি সাহিত্যে চলে না। কোনো জিনিস দেখে যদি আমাদের হাসি পায়, তাহলেই আমরা অপরকে হাসাতে পারি। কিন্তু কেবলমাত্র যদি রাগই হয়, তাহলে সে মনোভাবকে হাসির ছদ্মবেশ পরিয়ে প্রকাশ করলে দর্শকমণ্ডলীকে শুধু রাগাতেই পারি। দ্বিজেন্দ্রবাবু এইকথাটি মনে রাখলে লোককে হাসাতে গিয়ে রাগাতেন না।
৩.
দ্বিজেন্দ্রবাবু বলেছেন যে, নাটকাকারে প্যারডি কোনো ভাষাতেই নেই। যা কোনো দেশে কোনো ভাষাতেই ইতিপূর্বে রচিত হয় নি, তাই সৃষ্টি করতে গিয়ে তিনি একটি অদ্ভুত পদার্থের সৃষ্টি করেছেন। বিশ্বামিত্রের তপোবল আমাদের কারও নেই; সুতরাং বিশ্বামিত্রও যখন নূতন সৃষ্টি করতে গিয়ে অকৃতকার্য হয়েছিলেন, তখন আমরা যে হব, এ তো নিশ্চিত।
মানুষে মুখ ভ্যাংচালে দর্শকমাত্রই হেসে থাকে। কেন যে সে কাজ করে, তার বিচার অনাবশ্যক; কিন্তু ঘটনা হচ্ছে এই যে, ওরূপ মুখভঙ্গি দেখলে মানুষের হাসি পায়। প্যারডি হচ্ছে সাহিত্যে মুখ-ভ্যাংচানো। প্যারডি নিয়ে যে নাটক হয় না, তার কারণ দু ঘণ্টা ধরে লোকে একটানা মুখে ভেংচে যেতে পারে না; আর যদিও কেউ পারে তো, দর্শকের পক্ষে তা অসহ্য হয়ে ওঠে। হঠাৎ এক মুহূর্তের জন্য দেখা দেয় বলেই, এবং তার কোনো মানেমোন্দা নেই বলেই, মানুষের মুখ-ভ্যাংচানি দেখে হাসি পায়। সতরাং ভ্যাংচানির মধ্যে দর্শন বিজ্ঞান সনীতি সুরুচি প্রভৃতি ভীষণ জিনিস সব পুরে দিতে গেলে ব্যাপারটা মানুষের পক্ষে রুচিকর হয় না। ঐরূপ করাতে ভ্যাংচানির শুধু ধর্ম নষ্টই হয়। শিক্ষাপ্রদ ভ্যাংচানির সৃষ্টি করতে গিয়ে দ্বিজেন্দ্রবাবু রসজ্ঞানের পরিচয় দেন নি। যদি প্যারডির মধ্যে কোনোরূপ দর্শন থাকে তো সে দন্তের দর্শন।
৪.
দ্বিজেন্দ্রবাবু তাঁর ‘আনন্দ-বিদায়ে’র ভূমিকায় প্রকারান্তরে স্বীকারই করেছেন যে, লোকহাসানো নয়, লোকশিক্ষা দেওয়াই তাঁর মনোগত অভিপ্রায়; প্রহসন শুধু অছিলামাত্র। বেত হাতে গুরুমশাইগিরি করা, এ যুগের সাহিত্যে কোনো লোকের পক্ষেই শোভা পায় না। পরিত্রাণায় সাধূনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম। ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভাবামি যুগে যুগে।।—একথা শুধু অবতীর্ণ ভগবানের মুখেই সাজে, সামান্য মানবের মুখে সাজে না। লেখকেরা যদি নিজেদের এক-একটি ক্ষুদ্র অবতারস্বরূপ মনে করেন, কিংবা যদি তাঁরা সকলে কেষ্টবিষ্ট হয়ে ওঠেন, তাহলে পৃথিবীর সাধুদেরও পরিত্রাণ হবে না, এবং দুষ্টদেরও শাসন হবে না; লাভের মধ্যে লেখকেরা পরস্পর শুধু কলমের খোঁচাখুচি করবেন। দ্বিজেন্দ্রবাবুর ইচ্ছাও যে তাই হয়। এবং তিনি ঐরূপ খোঁচাখুঁচি হওয়াটা যে উচিত, তাই প্রমাণ করবার জন্যে বিলেতি নজির দেখিয়েছেন। তিনি বলেন যে, ওআর্ডসওআর্থকে ব্রাউনিং চাব্কেছিলেন, এবং ওআর্ডসওআর্থ বায়ুরন এবং শেলিকে চাব্কেছিলেন। বিলেতের কবিরা যে অহরহ পরস্পরকে চাবকা-চাবকি করে থাকেন, এ জ্ঞান আমার ছিল না।
ওআর্ডসওআর্থ সম্বন্ধে ব্রাউনিং Lost Leader নামে যে একটি ক্ষুদ্র কবিতা রচনা করেন, সেটিকে কোনো হিসাবেই চাবুক বলা যায় না। কবিসমাজের সর্বমান্য এবং পূজ্য দলপতি দলত্যাগ করে অপর-দলভুক্ত হওয়াতে কবিসমাজ যে গভীর বেদনা অনুভব করেছিলেন, ঐ কবিতাতে ব্রাউনিং সেই দুঃখই প্রকাশ করেছেন। ওআর্ডসওআর্থ যে বায়ুরন এবং শেলিকে চাবকেছিলেন, একথা আমি জানতুম না। বায়ুরন অবশ্য তাঁর সমসাময়িক কবি এবং সমালোচকদের প্রতি দু হাতে ঘুঁষো চালিয়েছিলেন, কিন্তু সে আত্মরক্ষার্থ। অহিংসা পরমধর্ম হলেও আততায়ী-বধে পাপ নেই। দ্বিজেন্দ্রবাবু যে নজির দেখিয়েছেন, সেই নজিরের বলেই প্রমাণ করা যায় যে, চাবুক পদার্থটার বিলেতি কবিসমাজে চলন থাকলেও তার ব্যবহারে যে সাহিত্যের কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি হয়েছে, তা নয়। ওআর্ডসওআর্থ শেলি বায়ুরন প্রভৃতি কোনো কবিই কোনো প্রতিদ্বন্দীর তাড়নার ভয়ে নিজের পথ ছাড়েন নি, কিংবা সাহিত্যরাজ্যে পাশ কাটিয়ে যাবারও চেষ্টা করেন নি। কবিমাত্রেরই মত যে ‘স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরঃধর্মে ভয়াবহ’। চাবুকের ভয় কেবলমাত্র তারাই করে, যাদের ‘স্বধর্ম বলে জিনিসটা আদপেই নেই এবং সাহিত্যে পরমুখাপেক্ষী হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। এ শ্রেণীর লেখকেরা কি লেখেন আর না-লেখেন, তাতে সমাজের কিংবা সাহিত্যের বড়-কিছু আসে যায় না।
একথা আমি অস্বীকার করি নে যে, সাহিত্যে চাবুকের সার্থকতা আছে। হাসিতে রস এবং কষ দুইই আছে। এবং ঠিক মাত্রা-অনুসারে কষের খাদ দিতে পারলে হাস্যরসে জমাট বাঁধে। কিন্তু তাই বলে ‘কষে’র মাত্রা অধিক বাড়ানো উচিত নয় যে, তাতে হাসি জিনিসটা ক্রমে অন্তর্হিত হয়ে, যা খাঁটি মাল বাকি থাকে, তাতে শুধু ‘কশাঘাত’ করা চলে। সাহিত্যেও অপরের গায়ে নাইট্রিক অ্যাসিড ঢেলে দেওয়াটা বীরত্বের পরিচয় নয়। দ্বিজেন্দ্রবাবু ‘কষাঘাত’কে ‘কশাঘাত’ বলে ভুল করে ষত্ব-ণত্ব জ্ঞানের পরিচয় দেন নি। সাহিত্যে কোনো ব্যক্তিবিশেষের উপর চাবুক প্রয়োগ করাটা অনাচার। সমগ্র সমাজের পণ্ঠেই ওর প্রয়োগটা সনাতন প্রথা। মিথ্যা যখন সমাজে আশকারা পেয়ে সত্যের সিংহাসন অধিকার করে বসে, এবং রীতি যখন নীতি বলে সম্মান লাভ করে ও সমগ্র সমাজের উপর নিজের শাসন বিস্তার করে, তখনই বিদ্রূপের দিন আসে। পৃথিবীতে সব চাপা যায়, কিন্তু হাসি চাপা যায় না। ব্যক্তিবিশেষের প্রতি চাবুকের প্রয়োগ চলে না। কোনো লেখক যদি নিতান্ত অপদার্থ হয়, তাহলে তার উপর কশাঘাত করাটা কেবল নিষ্ঠুরতা; কেননা, গাধা পিটে ঘোড়া হয় না। অপরপক্ষে যদি কোনো লেখক সত্যসত্যই সরস্বতীর বরপুত্র হন, তাহলে তাঁর লেখার কোনো বিশেষ অংশ কিংবা ধরন মনোমত না হলেও, সেই বিশেষ ধরনের প্রতি যেরূপ বিদ্রূপ সংগত, সেরূপ বিদ্রূপকে আর যে নামেই অভিহিত কর, ‘চাবুক’ বলা চলে না। কারণ, ওরূপ ক্ষেত্রে কবির মর্যাদা রক্ষা না করে বিদ্রূপ করলে সমালোচকেরও আত্মমর্যাদা রক্ষিত হয় না। কোনো ফাঁক পেলেই কলি যেভাবে নলের দেহে প্রবেশ করেছিলেন, সমালোচকের পক্ষে সেইভাবে কবির দেহে প্রবেশ করা শোভনও নয়, সংগতও নয়।
৫.
চাবুক ব্যবহার করবার আর-একটি বিশেষ দোষ আছে। ও কাজ করতে করতে মানুষের খন চড়ে যায়। দ্বিজেন্দ্রবাবরও তাই হয়েছে। তিনি একমাত্র ‘চাবুকে’ সন্তুষ্ট না থেকে, ক্রমে ‘ঝাঁটিকা’ ‘চাঁটিকা’ প্রভৃতি পদার্থেরও প্রয়োগ করবার চেষ্টা করেছেন। আমি বাংলায় অনাবশ্যক ‘ইকা’প্রত্যয়ের বিরোধী। সুতরাং আমি নির্ভয়ে দ্বিজেন্দ্রবাবকে এই প্রশ্ন করতে পারি যে, ‘চাঁটিকা’র ‘ইকা’ বাদ দিয়ে যা অবশিষ্ট থাকে, সে-জিনিসটে মারাতে কি কোনো লেখকের পদমর্যাদা বৃদ্ধি পায়? ‘ঝাঁটা’ সম্বন্ধে আমার বক্তব্য এই যে, সম্মার্জনীর উদ্দেশ্য ধুলোঝাড়া, গায়ের ঝালঝাড়া নয়। বিলেতিসরস্বতী মাঝেমাঝে রণচণ্ডী মতি ধারণ করলেও বঙ্গসরস্বতীর পক্ষে ঝাঁটা উঁচিয়ে রঙ্গভূমিতে অবতীর্ণ হওয়াটা যে নিতান্ত অবাঞ্ছনীয়, একথা বোধ হয় কেউ অস্বীকার করবেন না।
৬.
শ্ৰীযুক্ত দ্বিজেন্দ্রলাল রায় নিজে মার-মতি ধারণ করবার যে কারণ দেখিয়েছেন, আমার কাছে সেটি সবচেয়ে অদ্ভুত লাগল। দ্বিজেন্দ্রবাবর মতে, যদি কোনো কবি কোনো কাব্যকে সাহিত্যের পক্ষে অমঙ্গলকর বিবেচনা করেন, তাহা হইলে সেরূপ কাব্যকে সাহিত্যক্ষেত্র হইতে চাবকাইয়া দেওয়া তাঁহার কর্তব্য।
এককথায়, সাহিত্যের মঙ্গলের জন্য নৈতিক চাবুক মারাই দ্বিজেন্দ্রবাবুর অভিপ্রায়। পৃথিবীতে অনেক লোকের ধারণা যে কাউকে ধর্মাচরণ শেখাতে হলে মৃত্যুর মত তার চুল চেপে ধরাটাই তার সর্বশ্রেষ্ঠ উপায়, এবং সেইজন্য কর্তব্য। স্কুলে জেলখানায় ঐ সমাজের মঙ্গলের জন্যই বেত মারবার নিয়ম প্রচলিত ছিল। কিন্তু আজকাল অনেকেরই এ জ্ঞান জন্মেছে যে, ও পদ্ধতিতে সমাজের কোনো মঙ্গলই সাধিত হয় না; লাভের মধ্যে শুধু যে বেত মারে এবং যাকে মারা হয়, উভয়েই তার ফলে মনুষ্যত্ব হারিয়ে পশুত্ব লাভ করে। অপরের উপর অত্যাচার করবার জন্য শারীরিক বলের প্রয়োগটা যে বর্বরতা, একথা সকলেই মানেন; কিন্তু একই উদ্দেশ্যে নৈতিক বলের প্রয়োগটাও যে বর্বরতামাত্র, এ সত্য আজও সকলের মনে বসে যায় নি। কঠিন শাস্তি দেবার প্রবৃত্তিটি আসলে রূপান্তরে প্রতিহিংসাপ্রবত্তি। ও জিনিসটিকে সমাজের মঙ্গলজনক মনে করা শুধু নিজের মনভোলানো মাত্র। নীতিরও একটা বোকামি গোঁড়ামি এবং গণ্ডামি আছে। নিত্যই দেখতে পাওয়া যায়, একরকম প্রকৃতির লোকের হাতে নীতি-পদার্থটা পরের উপর অত্যাচার করবার একটা অমাত্র। ধর্ম এবং নীতির নামে মানুষকে মানুষে যত কষ্ট দিয়েছে, যত গহিত কার্য করেছে, এমন বোধ হয় আর কিছুরই সাহায্যে করে নি। আশা করি দ্বিজেন্দ্রবাবু সে শ্রেণীর লোক নন, যাঁদের মতে সুনীতির নামে সাত খুন মাপ হয়। ইতিহাসে এর ধারাবাহিক প্রমাণ আছে যে, নীতির বোকামি গোঁড়ামি এবং গুণ্ডামির অত্যাচার সাহিত্যকে পুরোমাত্রায় সহ্য করতে হয়েছে। কারণ, সাহিত্য সকল দেশে সকল যুগেই বোকামি গোঁড়ামি এবং গুণ্ডামির বিপক্ষ এবং প্রবল শত্র।
নীতির, অর্থাৎ যুগবিশেষে প্রচলিত রীতির, ধর্মই হচ্ছে মানুষকে বাঁধা; কিন্তু সাহিত্যের ধর্ম হচ্ছে মানুষকে মুক্তি দেওয়া। কাজেই পরস্পরের সঙ্গে দা-কুমড়োর সম্পর্ক। ধর্ম এবং নীতির দোহাই দিয়েই মুসলমানেরা আলেকজান্ড্রিয়ার লাইব্রেরি ভস্মসাৎ করেছিল।
এ যুগে অবশ্য নীতিবীরদের বাহুবলের এক্তিয়ার হতে আমরা বেরিয়ে গেছি, কিন্তু সুনীতির গোয়েন্দারা আজও সাহিত্যকে চোখে-চোখে রাখেন, এবং কারও লেখায় কোনো ছিদ্র পেলেই সমাজের কাছে লেখককে ধরিয়ে দিতে উৎসুক হন। কাব্যামৃতরসাস্বাদ করা এক, কাব্যের ছিদ্রান্বেষণ করা আর। শ্রীকৃষ্ণের বাঁশি কবিতার রূপকমাত্র। কারণ, সে বাঁশির ধর্মই এই যে, তা ‘মনের আকুতি বেকত করিতে কত না সন্ধান জানে’। ছিদ্রান্বেষী নীতি ধর্মীদের হাত পড়লে সে বাঁশির ফটোগুলো যে তাঁরা বাজিয়ে দিতে চেষ্টা করবেন, তাতে আর সন্দেহ কি। একশ্রেণীর লোক চিরকালই এই চেষ্টা করে অকৃতকার্য হয়েছেন; কারণ, সে ছিদ্র স্বয়ং ভগবানের হাতে-করা বিঁধ, তাকে নিরেট করে দেবার ক্ষমতা মানুষের হাতে নেই। ‘মি’-জিনিসটিই খারাপ, কিন্তু আমাদের শাস্ত্রমতে, মানুষের পক্ষে সবচাইতে সর্বনেশে ‘মি’ হচ্ছে ‘আমি’। কারণ, ও পদার্থটির আধিক্য থাকলে আমাদের বিদ্যাবৃদ্ধি কাণ্ডজ্ঞান সবই লুপ্ত হয়ে আসে। অন্যান্য সকল ‘মি’ ঐ ‘আমি’কে আশ্রয় করেই থাকে। কিন্তু ‘আমি’ এত অব্যক্তভাবে আমাদের সমস্ত মনটায় ব্যাপ্ত হয়ে পড়ে যে, আমরা নিজেও বুঝতে পারি নে যে, তারই তাড়নায় আমরা পরের উপর কুব্যবহার করতে উদ্যত হই, সমাজ কিংবা সাহিত্য কারও মঙ্গলের জন্য নয়। এইকথাটা স্পষ্ট বুঝতে পারলে আমরা পরের উপর নৈতিক চাবুক প্রয়োগ করতে কুণ্ঠিত হই। এই কারণেই, যদি একজন কবি অপর-একজন সমসাময়িক কবির সমালোচক হয়ে দাঁড়ান, তাহলে তাঁর নিকট কবি এবং কাব্যের ভেদবুদ্ধিটি নষ্ট হওয়া অতি সহজ।
৭.
দ্বিজেন্দ্রবাবু শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা হতে দুর্নীতির যে প্রমাণ সংগ্রহ করেছেন, তা হাস্যরসাত্মক না হোক, হাস্যকর বটে। ‘কেন যামিনী না যেতে জাগালে না’–একথাটা ভারতবাসীর পক্ষে যে অপ্রীতিকর, তা আমি স্বীকার করতে বাধ্য; কেননা, যামিনী গেলেও আমরা জাগবার বিপক্ষে। আমরা শুধু রাতে নয়, অষ্টপ্রহর ঘুমতে চাই। সুতরাং যদি কেউ অন্ধকারের মধ্যেই চোখ খোলবার পক্ষপাতী হন, তাহলে তাঁর উপর বিরক্ত হওয়া আমাদের পক্ষে স্বাভাবিক। সে যাই হোক, ও গানটিতে বঙ্গসাহিত্যের যে কি অমঙ্গল ঘটেছে, তা আমি বুঝতে পারলাম না। এদেশের কাব্যরাজ্যে অভিসার বহুকাল হতে প্রচলিত আছে। রাধিকার নামে বেনামি করলে ও কবিতাটি সম্বন্ধে দ্বিজেন্দ্রবাবুর বোধ হয় আর-কোনো আপত্তি থাকত না। আমরা যে নাম-জিনিসটির এতটা অধীন হয়ে পড়েছি, সেটা আমাদের পক্ষে মোটেই শ্লাঘার বিষয় নয়। আর যদি দ্বিজেন্দ্রবাবুর মতে ও গানটি ভদ্রসমাজে অশ্রাব্য হয়, তাহলে সেটির প্যারডি করে তিনি কি তাকে এতই সুশ্রাব্য করে তুলেছেন যে, সেটি রঙ্গালয়ে চীৎকার করে না গাইলে আর সমাজ উদ্ধার হয় না? দ্বিজেন্দ্রবাবু যেমন বিলেতি নজিরের বলে চাবকা-চাবকি বঙ্গসাহিত্যে প্রচলিত করতে চেয়েছেন, তেমনি তিনি আমাদের সাহিত্যে বিলেতি puritanismএর ভূত নামাতে চান। ভারতবর্ষীয় সাহিত্যের অনেক ত্রুটি আছে, কিন্তু puritanism-নামক ন্যাকামি এবং গোঁড়ামি হতে এদেশীয় সাহিত্য চিরকালই মুক্ত ছিল। দ্বিজেন্দ্রবাবুর মত যদি আমাদের গ্রাহ্য করতে হয়, তাহলে অশ্বঘোষের ‘বুদ্ধচরিত’ থেকে শুরু করে জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’ পর্যন্ত অন্তত হাজার বৎসরের সংস্কৃতকাব্যসকল আমাদের অগ্রাহ্য করতে হবে; একখানিও টিকবে না। তারপর বিদ্যাপতি চণ্ডীদাস থেকে আরম্ভ করে ভারতচন্দ্র পর্যন্ত সকল কবির সকল গ্রন্থই আমাদের অস্পৃশ্য হয়ে উঠবে; একখানিও বাদ যাবে না। যাঁরা রবীন্দ্রবাবুর সরস্বতীর গাত্রে কোথায় কি তিল আছে তাই খুঁজে বেড়ান, তাঁরা যে ভারতবর্ষের পূর্বকবিদের সরস্বতীকে কি করে তুষারগৌরীরূপে দেখেন, তা আমার পক্ষে একেবারেই দুর্বোধ্য। শেষ কথা, puritanismএর হিসেব থেকে স্বয়ং দ্বিজেন্দ্রবাবুও কিছু কম অপরাধী নন। তার প্রমাণ তো হাতে-হাতেই রয়েছে। ‘আনন্দ-বিদায়’ moral text-book বলে গ্রাহ্য হবে, এ আশা যদি তিনি করে থাকেন, তাহলে সে আশা সফল হবে না।
মাঘ ১৩১৯