বর্তমান সভ্যতা বনাম বর্তমান যুদ্ধ

বর্তমান যুদ্ধের কার্যকারণ সম্বন্ধে ইউরোপে যদি কোনো বাজে কথা কিংবা অসংগত কথা বলা হয় তাতে আশ্চর্য হবার কোনো কারণ নেই, কেননা মানুষে যখন যুগপৎ ক্রুদ্ধ ও ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে, মনে যখন রাগ ও দ্বেষই প্রাধান্য লাভ করে তখন তার পক্ষে বাক্যের সংযম কতক পরিমাণে হারানো স্বাভাবিক।

ঘরে ডাকাত পড়লে তার সঙ্গে মিষ্ট এবং শিষ্ট আলাপ করা সম্ভবত দেবতার পক্ষে স্বাভাবিক, মানুষের পক্ষে নয়; এবং ইউরোপের লোক দেবতা নয়, মানুষ।

কিন্তু এই যুদ্ধে ব্যাপারটি আমাদের পক্ষে নিরপেক্ষভাবে বিচার করবার বিশেষ কোনো বাধা নেই। আমরা ও-জালে জড়িয়ে পড়ি নি; এখন পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে এ ব্যাপারের যা-কিছু যোগ আছে সে শুধু তারের–নাড়ির নয়।

ইউরোপে সুরাসুর মিলে যে ভবসমুদ্র মন্থন করেছেন তার ফলে অমৃতই উঠুক আর হলাহলই উঠক, তার ভাগ আমরাও পাব; কিন্তু সে ভবিষ্যতে। সে বস্তু পান করবার পূর্বেই আমাদের দৃষ্টিবিভ্রম হবার কোনো কারণ নেই। বরং এই অবসরে আমরা যদি ব্যাপারটি ঠিক ভাবে দেখতে ও বুঝতে শিখি তা হলে এর ভবিষ্যৎ ফলাফলের জন্য আমরা অনেকটা প্রস্তুত থাকব।

এই সমরানলে যে বর্তমান ইউরোপীয় সভ্যতার অগ্নিপরীক্ষা হয়ে যাবে সে কথা সত্য। কিন্তু বর্তমান ইউরোপীয় সভ্যতার অর্থ যে কি, সে বিষয়ে দেখতে পাই অনেকের তেমন স্পষ্ট ধারণা নেই। এমন-কি, কেউ কেউ এই উপলক্ষে ইউরোপীয় সভ্যতার প্রতি নিতান্ত অবজ্ঞা প্রকাশ করতে কুণ্ঠিত হচ্ছেন না।

আমার মতে ইউরোপের প্রতি অবজ্ঞার কথা আমাদের মুখে শোভা পায় না। এ অবশ্য রুচির কথা; সুতরাং এ ক্ষেত্রে মতভেদের যথেষ্ট অবসর আছে। মনোভাব প্রকাশ না করলেই যে, সে ভাব মন থেকে অন্তর্হিত হয়ে যায় তা অবশ্য নয়। অথচ এ কথাও সম্পূর্ণ সত্য যে, আমরা মুখে কি বলি, তার চাইতে আমরা মনে কি ভাবি তার মূল্য আমাদের কাছে ঢের বেশি; কেননা সত্যের জ্ঞান না হলে মানুষে সত্য কথা বলতে পারে না।

 

প্রথমত কি স্বদেশী, কি বিদেশী, কি নবীন, কি প্রাচীন কোনো সভ্যতাকেই এক কথায় উড়িয়ে দেওয়া চলে না।

একটি বিপুল মানবসমাজের পক্ষে কিংবা বিপক্ষে ওরকম এক-তরফা ডিক্রি দেওয়ার নাম বিচার নয়। বহু মানবে বহু দিন ধরে কায়মনোবাক্যে যে সভ্যতা গড়ে তুলেছে তার ভিতর যে মনুষ্যত্ব নেই, এ কথা বলতে শুধু তিনিই অধিকারী যিনি মানুষ নন। অপর পক্ষে চরম-সভ্যতা বলে কোনো পদার্থ মানুষে আজ পর্যন্ত সৃষ্টি করতে পারে নি এবং কখনো পারবে না। কেননা, পৃথিবী যেদিন স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠবে সেদিন মানুষের দেহমনের আর কোনো কার্য থাকবে না, কাজেই মানুষ তখন চিরনিদ্রা উপভোগ করতে বাধ্য হবে। অন্তত পৃথিবীতে এমন কোনো সত্যতা

আজ পর্যন্ত হয় নি যা একেবারে নির্গুণ কিংবা একেবারে নির্দোষ। কোনো একটি বিশেষ সভ্যতার বিচার করবার জন্য তার দোষগণের পরিচয় নেওয়া আবশ্যক, মনকে খাটানো দরকার। যখন আমরা আলস্যে অভিভূত হয়ে হাই তুল তখনই আমরা তুড়ি দিই, সুতরাং আমরা যখন তুড়ি দিয়ে কোনো জিনিস উড়িয়ে দিতে চাই তখন আমরা মানসিক আলস্য ব্যতীত অন্য কোনো গুণের পরিচয় দিই না। এ সত্য অবশ্য চিরপরিচিত; কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, পৃথিবীতে যা চিরপরিচিত তাই চির-উপেক্ষিত।

 

 

২.

ইউরোপের বর্তমান সভ্যতার বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ এই যে, যে মনোভাবের উপর সে সভ্যতা প্রতিষ্ঠিত এই মহাসমর হচ্ছে তার স্বাভাবিক পরিণতি; কেননা এ যুগে ইউরোপ ধর্মপ্রাণ নয়, কর্মপ্রাণ। সে দেশে আজ আত্মার অপেক্ষা বিষয়ের, মনের অপেক্ষা ধনের মাহাত্ম ঢের বেশি। শিল্প-বাণিজ্যের পরিমাণ-অনুসারেই এ যুগে ইউরোপের জাতীয় শ্রেষ্ঠত্বের পরিমাপ করা হয় এবং সে দেশের লোকের বিশ্বাস যে, মানবের ভ্রাতৃভাব নয় ভ্রাতৃবিরোধই হচ্ছে ব্যক্তিগত ও সামাজিক অভ্যুদয়ের একমাত্র উপায়। অতএব এই যুদ্ধ হচ্ছে ইউরোপের আজ একশো বৎসরের কর্মফল।

এ অভিযোগের মূলে যে কতকটা সত্য আছে তা অস্বীকার করা যায় না; কিন্তু কতটা, তাই হচ্ছে বিচার্য।

আমরা মানবসভ্যতাকে সচরাচর দুই ভাগে বিভক্ত করি; প্রাচীন ও নবীন। কিন্তু পৃথিবীতে এমন-কোনো বর্তমান সভ্যতা নেই যা অনেক অংশে প্রাচীন নয়। যেমন আমাদের বর্তমান সভ্যতা কিংবা অসভ্যতা এক অংশে প্রাচীন হিন্দু, এবং আর-এক অংশে নব্য ইউরোপীয়, তেমনি ইউরোপের বর্তমান সভ্যতা আট-আনা নতুন হলেও আট-আনা পুরনো। সুতরাং এই যুদ্ধের জন্য ইউরোপের নবমনোভাবকে সম্পূর্ণ দায়ী করা যেতে পারে না, বরং তার পূর্বসংস্কারকেই এর জন্য দোষী করা অসংগত হবে না।

 

মানুষে-মানুষে কাটাকাটি-মারামারি করা যদি অসভ্যতার লক্ষণ হয় তা হলে বলতে হবে ইউরোপের বর্তমান যুগের অপেক্ষা মধ্যযুগ টের বেশি অসভ্য ছিল। সে যুগে যুদ্ধপার্বন বারো মাসে তেরো বার হত এবং সে কালের মতে ও-কার্যটি নিত্যকর্মের মধ্যে গণ্য ছিল। মধ্যযুগকে ইউরোপীয়েরা কৃষ্ণযুগ বলেন, কিন্তু আসলে সেটি রক্তযুগ। আমরা আমাদের বর্তমান মনোভাববশতই যুদ্ধকাৰ্যটি হেয় মনে করি, প্রাচীন মনোভাব থাকলে শ্রেয় মনে করতুম। ইউরোপের নবযুগ অবশ্য এক হিসাবে যন্ত্রযুগ, কিন্তু তাই বলে মধ্যযুগ যে মন্ত্রযুগ ছিল, তা নয়। যে হিসাবে মধ্যযুগ ধর্মপ্রাণ ছিল সে হিসাবে নবযুগ ধর্মপ্রাণ নয়। সে হিসাবটি যে কি, তা একটু পরীক্ষা করে দেখা আবশ্যক।

বৌদ্ধধর্মের মতো খৃস্টধর্মেরও ত্রিরত্ন আছে–সে হচ্ছে খৃস্ট ধর্ম ও সংঘ; এবং খৃস্টিয়ান মাত্রেই নামমাত্র এই তিনের শরণ গ্রহণ করেন। কিন্তু যুগভেদে এই তিনের মধ্যে এক-একটি রত্ন সর্বাপেক্ষা মহামূল্য হয়ে ওঠে।

প্রথম যুগে (Primitive Christianity) খৃস্টিয়ানের পক্ষে খৃস্টই ছিল শরণ্য। মধ্যযুগে খৃস্টের স্থান খৃস্টসংঘ অধিকার করেন এবং ইউরোপের মনোরাজ্যে একাধিপত্য স্থাপন করেন; সে সংঘ সে আধিপত্যের ভাগ খৃস্টকেও দেন নি, ধর্মকেও দেন নি। প্রায় একহাজার বৎসর ধরে খৃস্টসংঘ মানবের বুদ্ধি ও আত্মাকে সমান অভিভূত করে রেখেছিলেন। শুধু তাই নয়, সাংসারিক হিসাবেও এই সংঘ ইউরোপের রাজরাজেশ্বর হয়ে উঠেছিলেন। এই সংঘ মানুষের তনু মন ধনের উপর এই অসীম প্রভুত্ব অক্ষম রাখবার জন্য ধর্মের নামে কত যে অধর্মযুদ্ধের প্রবর্তন করেছেন তার প্রমাণ মধ্যযুগের ইতিহাসের পাতায় পাতায় পাওয়া যায়।

 

এই সংঘের ধর্ম ও খৃস্টধর্ম এক বস্তু নয়। সুতরাং এই সংঘের দাসত্ব হতে মুক্তিলাভ করে ইউরোপের যে ধর্মজ্ঞান লুপ্ত হয়েছে এ কথা বলা চলে না। বরং পূর্বের অপেক্ষা বর্তমানে ইউরোপীয়দের যে ধর্মবুদ্ধি (conscience) অধিক জাগ্রত হয়ে উঠেছে তার প্রমাণ ইউরোপের সকল আইনকানুনে সকল সমাজব্যবস্থায় পাওয়া যায়।

মধ্যযুগের অন্ধ কারাগার আপনি ভেঙে পড়ে নি; মানবমনের একটির পর আর-একটি তিনটি প্রবল ধাক্কায় তার পাষাণপ্রাচীর বিদীর্ণ হয়েছে; সে তিন হচ্ছে ইতালির রেনেসাঁস, জর্মানির রিফরমেশন এবং ফ্রান্সের রেভলিউশন।

গ্রীস ও রোমের প্রাচীন সভ্যতার স্পর্শে ইতলি যেদিন নবজীবন লাভ করলে সেইদিন ইউরোপে নবসভ্যতার সূত্রপাত হল। এই প্রাচীন সাহিত্যের আবিষ্কারের সঙ্গে মানুষ নিজের শক্তি ও বাহিরের সৌন্দর্য আবিষ্কার করলে। মানুষ বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ডকে নিজের চোখ দিয়ে দেখতে এবং নিজের বুদ্ধি দিয়ে বুঝতে শিখলে। মানুষের পক্ষে তার এই নব-আবিস্কৃত অন্তর্নিহিত শক্তির চর্চাই তার প্রধান কর্তব্য হয়ে উঠল। যে প্রকৃতিকে ইউরোপীয়েরা হাজার বত্সর ধরে বিমাতা মনে করে আসছিল, তাকে তারা সেবাদাসীতে পরিণত করতে ব্যর্থ হয়ে উঠল। এই নবজীবন শিল্পে  বিজ্ঞানে কাব্যে ইতিহাসে বিকশিত হয়ে উঠল। এক কথায় নবজীবন লাভ করে মানুষের চোখ-কান ফুটল এবং হাত-পায়ের খিল খুলে গেল।

 

এর পরবর্তী যুগে জর্মানি বাইবেলের আবিষ্কারের সঙ্গে নিজের আত্মারও আবিষ্কার করলে; মানুষে এই সত্যের পরিচয় পেলে যে, ধর্মের মূল তার নিজের অন্তরে, ধর্মযাজকের মুখে নয়। খৃস্টের ধর্মের পরিচয় লাভ করে মানুষে খৃস্টসংঘের সংস্কারের জন্য উৎসুক হয়ে উঠল। জর্মানির এই নবসংস্কারের গুণে ইউরোপের মানবশক্তি আবার অন্তর্মুখী হল। মানুষ আত্মদর্শনের জন্য লালায়িত হয়ে উঠল।

এই রেনেসাঁসের ফলে ইউরোপে মানুষের কর্মবুদ্ধি এবং এই রিফরমেশনের ফলে তার ধর্মবুদ্ধি মুক্তিলাভ করলে; কিন্তু তার সামাজিক জীবনের বিশেষ কোনো পরিবর্তন ঘটল না।

তার পর ফ্রান্সের বিপ্লবের ফলে ইউরোপীয় মানব মধ্যযুগের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা থেকে মুক্তিলাভ করে জীবনেও স্বাধীনতা লাভ করলে। সুতরাং ইউরোপের নবযুগের সভ্যতায় মানুষ তার মনুষ্যত্ব ফিরে পেলে, হারাল না। যে মনোভাবের উপর এ সভ্যতা প্রতিষ্ঠিত তা শান্তির পক্ষে অনুকূল বই প্রতিকুল নয়। সামাজিক স্বাধীনতা যে সামাজিক মৈত্রীর প্রতিবন্ধক নয়, তার প্রমাণ এই ধেই পাওয়া যায়। আজ দেখা যাচ্ছে যে, ইউরোপের এক-একটি জাতি যেন এক-একটি ব্যক্তিস্বরূপ হয়ে উঠেছে; মধ্যযুগে এরূপ একজাতীয়তার ভাব মানুষের কল্পনারও অতীত ছিল।

 

৩.

আমি পূর্বে বলেছি যে, কোনো যুগের কোনো সভ্যতা একেবারে নির্দোষ কিংবা একেবারে নির্গুণ নয়। ইউরোপের মধ্যযুগের সপক্ষে যে কিছু বলবার নেই, তা নয়। অন্ধকারেরও একটা অটল সৌন্দর্য আছে এবং তার অন্তরেও গুপ্তশক্তি নিহিত থাকে। যে ফল দিনে ফোটে, রাত্রে তার জন্ম হয়—এ কথা আমরা সকলেই জানি। সুতরাং নবযুগে যে-সকল মনোভাব প্রস্ফুটিত হয়ে উঠেছে তার অনেক গলির বীজ মধ্যযুগে বপন করা হয়েছিল। কিন্তু নবযুগের আলোক না পেলে সে-সকল বীজ বড়োজোর অঙ্কুরিত হত, তার বেশি নয়।

ইউরোপের নবসভ্যতার আলোক সুর্যের আলো নয় যে, তা কেউ নেবাতে পারে না। এ আলো প্রদীপের আলো, আকাশ থেকে পড়ে নি, মানুষে নিজহাতে রচনা করেছে; সুতরাং ইউরোপের নিশাচররা এ আলো নেবাবার বহু চেষ্টা করেছে। মধ্যযুগের সঙ্গে পদে-পদে লড়াই করে নবযুগকে অগ্রসর হতে হয়েছে। রিফমেশনকে আত্মরক্ষার জন্য প্রায় দেড়শো বছর অবিরাম যুদ্ধ করতে হয়েছে। ফরাসিবিপ্লব আত্মরক্ষার জন্য যে যুদ্ধ করতে বাধ্য হয়, তা ইউরোপময় ব্যাপ্ত হয়ে পড়েছিল। স্বাধীনতা সাম্য ও মৈত্রী’র মন্ত্রে দীক্ষিত নেপোলিয়ন সমগ্র ইউরোপকে প্রায় নিঃক্ষত্রিয় করেছিলেন। স্বাধীনতার অবতার পরের স্বাধীনতা অপহরণ করা, মৈত্রীর অবতার পরের শত্রুতা করা এবং সাম্যের অবতার যে ইউরোপের একেশ্বর হওয়া তাঁর জীবনের ব্রত করে তুলেছিলেন, এ কথা মনে করলে মানবসভ্যতা সঙ্গে হতাশ হয়ে পড়তে হয়। কিন্তু আমরা আজ একশো বছর পরে নেপোলিয়নের এই বিরাট দস্যুতার বিচার করে দেখতে পাই যে, তার সুফল হয়েছে এই যে, ফরাসি রাজনৈতিক ব্যবস্থা সমগ্র ইউরোপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে; আর তার কুফল হয়েছে এই যে, সেইসঙ্গে নেপোলিয়নের মিলিটারিজমও সর্বত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

 

অতীতের সঙ্গে বর্তমানের প্রবল সংঘর্ষে যে অমৃত ও হলাহল উত্থিত হয়েছে, ইউরোপের সকল জাতির দেহ ও মনে তার অল্পবিস্তর প্রভাব স্পষ্ট লক্ষিত হয়।

বর্তমান যুগের সর্বপ্রধান সমস্যাই এই যে, কি উপায়ে সভ্যসমাজের দেহ এই বিষমুক্ত করা যেতে পারে।

.

৪.

এ সমস্যা অতি গুরুতর সমস্যা। কেননা, এক পক্ষে যেমন ইউরোপের সভ্যজাতিদের মনে যুদ্ধ করবার প্রবৃত্তি কমে এসেছে, অপর পক্ষে তাদের জীবনে পরস্পর যুদ্ধ করবার নূতন কারণেরও সৃষ্টি হয়েছে। এই কারণে ইউরোপের মুখে শান্তিবচন এবং হাতে অস্ত্র।

সকলেই জানেন যে, শিল্প ও বাণিজ্যই হচ্ছে ইউরোপীয় সভ্যতার প্রধান আশ্রয়স্থল। শিল্পবাণিজ্যের সাহায্যে অন্নবস্ত্রের সংস্থান করার অর্থ হচ্ছে নিজের পরিশ্রমে জীবিকা অর্জন করা; আর যুদ্ধের দ্বারা অর্থ সংগ্রহ করার অর্থ হচ্ছে পরের পরিশ্রমের ফল উপভোগ করা। এ দুটি মনোভাব সম্পূর্ণ বিপরীত। এই কারণেই সকল দেশে সকল যুগেই দেখা যায় যে, ক্ষত্রিয় বৈশ্যকে অবজ্ঞা করে এবং বৈশ্য ক্ষত্রিয়কে ভয় করে। যে জাতির অধিকাংশ লোক শিল্পবাণিজ্যে ব্যাপৃত, সে জাতির যুদ্ধে প্রবৃত্ত না থাকাই স্বাভাবিক।

 

তার পর, শিল্পবাণিজ্যের পক্ষে যুদ্ধের ন্যায় ক্ষতিকর ব্যাপার আর নেই। যুদ্ধ যে মানুষের সকল কাজকর্ম সকল বেচাকেনা একদিনেই বন্ধ করে দেয়, তার প্রমাণ তো আজ হাতে-হাতেই পাওয়া যাচ্ছে। সুতরাং, যুদ্ধ জিনিসটি ইউরোপীয়দের স্বার্থের বিরোধী। আর-এক কথা, হার্বাট স্পেনসর প্রমুখ দার্শনিকেরা আশা করেছিলেন যে, বর্তমান ইউরোপের বৈশ্যসভ্যতা পৃথিবীতে চিরশান্তি স্থাপন করবে। তাঁদের বিশ্বাস ছিল যে, বাণিজ্যের যোগ পৃথিবীর সকল জাতির সখ্যসূত্রে পরিণত হবে। এই অন্নবস্ত্রেরে অবাধ আদানপ্রদানের ফলে প্রতি জাতির কাছেই বসুধা কুটুম্ব হয়ে উঠবে। এই কারণে এই শ্রেণীর দার্শনিকদের মতে ক্ষত্রিয়যুগের অপেক্ষা বৈশ্যযুগের সভ্যতা মানব-ইতিহাসের উন্নত স্তরের সভ্যতা। হার্বার্ট স্পেনসরের এই আশা যে কবিকল্পনা ব্যতীত আর কিছুই নয়, তার প্রমাণ আজ পাওয়া যাচ্ছে। আজ দেখা যাচ্ছে যে, আগে যেমন রাজ্য নিয়ে রাজায়-রাজায় লড়াই করত, আজ তেমনি বাণিজ্য নিয়ে জাতিতে-জাতিতে লড়াই করছে এবং এ লড়াই অতি ভীষণ এবং অতি নিষ্ঠুর। কারণ আগে মানুষ হাতে যুদ্ধ করত, এখন কলে যুদ্ধ করে। এই কারণেই বর্তমান যুদ্ধ নিতান্ত অমানুষী ব্যাপার, কেননা বাহুবলের ভিতর মনুষ্যত্ব আছে কিন্তু যন্ত্রবলের ভিতর নেই। কিন্তু এ সত্ত্বেও এ কথা সত্য যে, বৈশ্যসভ্যতা যুদ্ধের অনুকূল নয়, কেননা যুধ বৈশ্যধর্মের প্রকৃতিবিরুদ্ধ।

 

৫.

ইংলণ্ড এবং ফ্রান্স যে আত্মরক্ষা ব্যতীত অপর কোনো কারণে যুদ্ধ করাটা অকর্তব্য মনে করে সে বিষয়ে সন্দেহ করবার কোনো বৈধ কারণ নেই। ইউরোপের নবযুগের নবসভ্যতার যথার্থ উত্তরাধিকারী হচ্ছে এই দুটি দেশ। ইংরেজ ও ফরারি উভয়েই ক্ষত্রিয়যুগ উত্তীর্ণ হয়ে বৈশ্যযুগে এসে উপস্থিত হয়েছেন। সুতরাং এদের দেহে রণসজ্জা থাকলেও মনে খাঁটি মিলিটারিজম নেই। অপর পক্ষে জর্মানি হচ্ছে যুদ্ধপ্রাণ; মিলিটারিজম জর্মানির যুগপৎ ধর্ম ও কর্ম। বর্তমান জর্মানির এরূপ মনোভাবের জন্য দায়ী জর্মানির পূর্বইতিহাস।

প্রায় আটশত বৎসর ধরে ইউরোপে জর্মানজাতির কোনোরূপ প্রভুত্ব ছিল না, তার কারণ জর্মানরা এই দীর্ঘকালের ভিতর একটি জর্মানরাজ্য কিংবা একটি জর্মানজাতি গড়ে তুলতে পারে নি। যে কালে ইংলণ্ড ফ্রান্স প্রভৃতি দেশ স্বাতন্ত্র্য এবং স্বরাজ্য লাভ করেছিল, সে কালে জর্মানি শত শত পরস্পরবিরোধী খন্ডরাজ্যে বিভক্ত ছিল। এ কতকটা জর্মানির কপালের দোষে, কতকটা তার বুদ্ধির দোষে। জর্মানি সমগ্র ইউরোপের সম্রাট হবার দুরাশা হৃদয়ে পোষণ করত বলে স্বদেশেও একরাট হতে পারে নি।

 

কোনো কোনো বৌদ্ধদেশে দুটি করে রাজা থাকেন; একজন প্রকৃতিপুঞ্জের আত্মার প্রভু, আর-এক জন দেহের। মধ্যযুগের প্রথম ভাগে সমগ্র ইউরোপীয় মানবকে এইরূপ দুই ছত্রের অধীন করবার চেষ্টা করা হয়েছিল। পোপ ইউরোপের ধর্মরাজের পদ এবং জর্মানরাজ দেবরাজের পদ অধিকার করে বসেছিলেন। ইউরোপ একটি মহাদেশ এবং ইউরোপীয়েরা নানা বিভিন্ন জাতীয়, সুতরাং ঐহিক কিংবা পারত্রিক কোনো বিষয়ে একজাতি হওয়া যে তাদের পক্ষে অসম্ভব, এ কথা পোপও স্বীকার করেন নি, জর্মান-সম্রাটও স্বীকার করেন নি। জর্মানজাতি যে ইউরোপের অন্যান্য জাতি হতে মনে ও চরিত্রে পধক, এ সত্য উপেক্ষা করবার ফলে জর্মানি ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ল। স্বদেশ এবং জাতির উপর কোনোরূপ একাধিপত্য না থাকলেও জর্মান-সম্রাট তাঁর সম্রাট-পদবী এবং সাম্রাজ্যের আশা ত্যাগ করতে পারলেন না, এবং স্বজাতিকে নিয়ে একটি স্বরাজ্য গঠন করবার চেষ্টামাত্রও করলেন না। এই কারণে জর্মানজাতির পূর্বে কোনোরূপ রাষ্ট্রশক্তি ছিল না। অথচ জর্মানজাতির ভিতর কি দেহের কি বুদ্ধির কি চরিত্রের কোনোরূপ বলের যে অভাব ছিল না—জর্মান কাব্যে দর্শনে শিপে সংগীতে ধর্মে ও কর্মে তার প্রকৃষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। ফলে জর্মানির মহাপরিষেরা লৌকিকরাজ্যের আশা ত্যাগ করে চিন্তারাজ্য অধিকার করাই নিজেদের কর্তব্য বলে মেনে নিলেন। সম্ভবত জর্মানজাতির ইতিহাস অদ্যাবধি ঐ একই পথ অনুসরণ করে চলত, যদি নেপোলিয়ন জর্মানজাতিকে আকাশ থেকে টেনে মাটিতে ফেলে পদদলিত না করতেন। ১৮০৬ খৃস্টাব্দে জেনার যুদ্ধে পরাজিত এবং লাঞ্ছিত হবার পর জর্মান মাত্রেরই এ জ্ঞান জন্মাল যে, জর্মানির খণ্ডরাজ্য-সকলকে একত্র করে একটি যুক্তরাজ্যে পরিণত না করতে পারলে জর্মানজাতির পক্ষে অস্তিত্ব রক্ষা করা অসম্ভব হয়ে পড়বে।

 

অসংখ্য দার্শনিক  বৈজ্ঞানিক ঐতিহাসিক অধ্যাপক প্রভৃতি চিরজীবন প্রাণপণে চেষ্টা করেও এ ব্রত উদযাপন করতে পারেন নি; কিন্তু আজ প্রায় পঞ্চাশ বৎসর পূর্বে বিসমার্ক দুটি যুদ্ধের সাহায্যে জর্মানজাতির প্রাণের আশা ফলে পরিণত করেছিলেন। বিসমার্ক অস্ট্রিয়াকে পরাভূত করে উত্তর-জর্মানির এবং ফ্রান্সকে পরাভূত করে দক্ষিণ-জর্মানির যোগসাধন করেন। বিসমার্ক বলতেন যে, রক্ত ও লৌহের রসান দিয়ে তিনি ভাঙা জর্মানিকে জোড়া দিয়েছেন। সুতরাং যুদ্ধের দ্বারা যে রাজ্যের সৃষ্টি হয়েছে, যুদ্ধের দ্বারাই তার রক্ষা এবং সুখের দ্বারাই তার উন্নতি সাধন করতে হবে–এই হচ্ছে নবজর্মানির দৃঢ়ধারণা।

যুদ্ধকার্য অপ্রিয় হলেও আত্মরক্ষার্থ যে তা করা কর্তব্য এ বিষয়ে ইংরেজ ফরাসি প্রভৃতি ইউরোপের অগ্রগণ্য জাতির মধ্যে কোনো মতভেদ নেই। জর্মানদের সঙ্গে আর-সকলের প্রভেদ এইখানে যে, জর্মানির কর্তৃপক্ষদের মতে জাতীয় উন্নতির পথ পরিষ্কার করবারও একমাত্র উপায় হচ্ছে তরবারি।

জর্মানির যোদ্ধাদলের মুখপাত্র জেনারেল বেয়ারনহার্ডি অতি স্পষ্টাক্ষরে দুনিয়ার লোককে জর্মান রাষ্ট্রনীতির মূলকথা জানিয়ে দিয়েছেন। সে কথা এই—

জর্মানজাতি গত ত্রিশ-চল্লিশ বৎসরের মধ্যে শিল্পবাণিজ্যে যে অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছে তার থেকেই প্রমাণ হয় যে, কি বাহুবলে, কি বুদ্ধিবলে সে জাতির সমকক্ষ দ্বিতীয় জাতি পৃথিবীতে নেই। জর্মানির শ্রীবৃধি তার বাণিজ্যবিস্তারের উপর নির্ভর করে। যদিচ ভবের হাটে কেনাবেচার জন্য জর্মানজাতিই হচ্ছে জ্যেষ্ঠ অধিকারী তবুও এ ক্ষেত্রে সকলের শেষে উপস্থিত হওয়ার দরুন সে আজ সর্বকনিষ্ঠ, কেননা পৃথিবীর সকল হাটবাজার আজ অপরের সম্পত্তি। পরের হাটে কেনাবেচা করার অর্থ পরভাগ্যোপজীবী হওয়া; সুতরাং এ পৃথিবীতে আত্মপ্রতিষ্ঠা করবার জন্য জর্মানি অপরের সম্পত্তি জোর করে কেড়ে নিতে বাধ্য। যুদ্ধ ব্যতীত অপর কোনো উপায়ে জর্মানির পক্ষে তার জাতীয় স্বার্থসাধন করা অসম্ভব। অতএব মিলিটারিজম হচ্ছে নবজর্মানির একমাত্র ধর্ম।

জেনারেল বেয়ারনহার্ডি যে স্পষ্টবাদী সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। দস্যুতাকে ধর্ম বলে প্রচার করতে লোকে সহজেই কুণ্ঠিত হয়। ওরূপ মনোভাব প্রকাশ করতে হলে অপর দেশের লোকে অনেক বড়ো বড়ো নীতির কথায় তাকে চাপা দেয়।

কিন্তু জর্মান-রাজমন্ত্রী কিংবা জর্মান-রাজসেনাপতির পক্ষে এ বিষয়ে কোনোরূপ কপটতা করবার প্রয়োজন নেই। জর্মানির রাজগুরুপুরোহিতেরা যে নবশাস্ত্র রচনা করেছেন, জর্মানির রাজ-পুরুষদের রাজনীতি সেই শাস্ত্রসংগত।

জর্মান বৈজ্ঞানিকদের মতে ডারউইনের আবিষ্কৃত ইভলিউশনের নির্গলিতার্থ হচ্ছে—জোর যার মুলুক তার। প্রকৃতির নিয়ম লঙ্ঘন করলে মানুষে শুধু মৃত্যুমুখে পতিত হয়। জীবনটা যখন একটা মারামারি-কাটাকাটি ব্যাপার, তখন যে মারতে প্রস্তুত নয় তাকে মরতে প্রস্তুত হতে হবে—এই হচ্ছে বিধির নিয়ম। ইভলিউশনের এই ব্যাখ্যা, নীটশে-নামক একটি প্রতিভাশালী লেখক সমগ্র জর্মানজাতিকে গ্রাহ্য করিয়েছেন। নীটশের মতে দয়া মমতা পরদুঃখকাতরতা প্রতি মনোভাব মানসিক রোগ ব্যতীত আর কিছুই নয়, কেননা এ-সকল মনোভাবের প্রশ্রয় দেওয়াতে মানুষের প্রকৃতি দুর্বল হয়ে পড়ে; এবং দুর্বলতাই হচ্ছে পৃথিবীতে একমাত্র পাপ এবং সবলতাই একমাত্র পণ্য; শক্তিই হচ্ছে একাধারে সত্য শিব ও সুন্দর। ইউরোপীয় মানব যে এই সহজ সত্য ভুলে গেছল তার কারণ ইউরোপ খৃস্টধর্ম নামক রোগে জর্জরিত। খৃস্টধর্ম যে এশিয়ায় জন্মলাভ করেছে তার কারণ, এশিয়াবাসীরা দাসের জাতি, সুতরাং তাদের সকল ধর্মকর্ম দাসমনোভাবের উপর প্রতিষ্ঠিত। এই এশিয়ার ক্যানসার ইউরোপের দেহ হতে সমূলে উৎপাটিত করতে হলে অস্ত্রচিকিৎসা ব্যতীত উপায়ান্তর নাই। ইউরোপের নবযুগের সাম্য মৈত্রী প্রভৃতি মনোভাব ঐ প্রাচীন রোগের নূতন উপসর্গ মাত্র। সুতরাং ফরাসি ইংরেজ প্রভৃতি যে-সকল জাতির দেহে এই-সকল রোগের লক্ষণ দেখা যায়, তাদের উচ্ছেদ করা জর্মান ক্ষত্রিয়দের পক্ষে একান্ত কর্তব্য। নীটশের এই মত জর্মান জাতির মনে যে বসে গেছে, তার কারণ নীটশে কালি-কলমে লেখেন নি, তার প্রতি অক্ষর বাটালি দিয়ে খোদা।

জর্মান-পণ্ডিতদের মত, কেবলমাত্র জাতীয় স্বার্থের জন্য নয়, লোকহিতের জন্যও, জর্মানির পক্ষে দিগ্বিজয় করা আবশ্যক। জেনারেল বেয়ারনহার্ডি বলেন–

জর্মান লেবার এবং জর্মান আইডিয়লিজমের প্রচার ব্যতীত মানবজাতির উদ্ধার হবে না। সুতরাং যেমন তরবারির সাহায্যে পৃথিবীসুদ্ধ লোককে জর্মান মাল গ্রাহ্য করাতে হবে, তেমনি ঐ একই উপায়ে জর্মান-তত্ত্বকথাও গ্রাহ্য করাতে হবে। এই হচ্ছে জর্মানির বিধিনির্দিষ্ট কর্ম।

এ স্থলে জর্মান-আইডিয়ালিজমের অর্থ কাণ্ট প্রভৃতির দর্শন নয়; কেননা, বেয়ারনহার্ডি কাণ্ট প্রমুখ দার্শনিকদের অতি অবজ্ঞার চক্ষে দেখেন। বেয়ারনহার্ডির মতে এই-সকল বাহ্যজ্ঞানশুন্য বিষয়বুদ্ধিহীন দার্শনিকদের অমার্জনীয় অপরাধ এই যে, তারা বিশ্বমানবের কাছে শান্তির বারতা ঘোষণা করেছিলেন। জর্মানি আজ তাই তার নব-আইডিয়ালিজম, প্রচার করতে বদ্ধপরিকর হয়েছেন। আধ্যাত্মিক জগতের নব্যপীদের সার কথা এই যে, বৈশ্যসভ্যতায় মানুষের মনুষ্যত্ব নষ্ট করে। বৈশ্যযুগে মানুষ আরামপ্রিয় ও ভোগবিলাসী হয়ে পড়ে। মানুষ বিষয়প্রাণ হলে তার মনের শক্তি ও আত্মার শক্তি নষ্ট হয়ে যায়। বর্তমান ইউরোপীয় সভ্যতা যে আত্মার অপেক্ষা দেহকে প্রাধান্য দেয় তার বিশিষ্ট প্রমাণ এই যে, মানবজীবনকে যতদূর সম্ভব নিরাপদ করে তোলাই এ সভ্যতার লক্ষ্য। ভয় না থাকলে ভক্তি থাকে না, অথচ বর্তমান সভ্যতা জনসাধারণকে রাজভয় দস্য,ভয় ও মৃত্যুভয় এই ত্রিবিধ ভয় থেকে মুক্ত করেছে। অন্নবস্ত্রের সংস্থান করা অবশ্য জীবনধারণের জন্য আবশ্যক, কিন্তু অর্থকেই জীবনের সার পদার্থ করে তুললে মানুষ অন্তঃসারশূন্য হয়ে পড়ে। সুতরাং মানুষের মনুষ্যত্ব রক্ষা করবার জন্য সামাজিক জীবন আবার বিপদসংকুল করে তোলা দরকার। এ যুগে এক যুদ্ধ ব্যতীত অপর কোনো উপায়ে সে উদ্দেশ্য সাধিত হতে পারে না। অতএব ইউরোপীয় সমাজকে পুনর্বার ক্ষত্রিয় শাসনাধীন করা আবশ্যক; কেননা বৈশ্যবধি যুদ্ধের প্রতিকল। এবং ইউরোপের রাজনীতি ক্ষাত্রধর্মের উপর প্রতিষ্ঠিত করবার ক্ষমতা একমাত্র জর্মানির আছে; কেননা জর্মানির বৈশ্যশূদ্রের আজও কোনোরূপ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নেই। সুতরাং অর্ধরাজ্যের উচ্ছেদ করে পৃথিবীতে ধর্মরাজ্যের সংস্থাপন করবার ভার জর্মানির হাতে পড়েছে। এই কারণে যুদ্ধ করা জর্মানির পক্ষে সর্বপ্রথম কর্তব্য। জর্মানির নব-মিলিটারিজমের প্ররোচনাই এই যুদ্ধের সাক্ষাৎকারণ।

এই  বৈজ্ঞানিক এবং দার্শনিক মিলিটারিজম ইউরোপের বর্তমান সভ্যতার অনুবাদ নয়, প্রতিবাদ মাত্র। জর্মানির পরশ্রীকাতরতাই এর যথার্থ মূল, এবং এ মূল জর্মানির প্রাচীন ইতিহাস থেকে রস সঞ্চয় করেছে। জর্মানির বর্তমান উচ্চ আশার ভাষা নতুন হলেও তার ভাব পুরাতন। মধ্যযুগে জর্মানি একবার ইউরোপের সার্বভৌম চক্রবতীত্ব-পদ লাভ করবার চেষ্টা করে অকৃতকার্য হয়েছিল; আশা করি এবারেও হবে। জর্মানজাতির যথেষ্ট বাহুবল বুদ্ধিবল ও চরিত্রবল আছে, কিন্তু বিসমার্কের হাতে-গড়া জর্মান-সাম্রাজ্যের অন্তরে নৈতিক বল নেই; সুতরাং জর্মানির দিগ্বিজয়ের আশা দুরাশা মাত্র। এ যুদ্ধের ফলাফল যাই হোক, ইউরোপের বর্তমান সভ্যতাকে এর জন্য দায়ী করা যেতে পারে না; কারণ মিলিটারিজম সে সভ্যতার গৃহশত্রু।

ইউরোপের সকল জাতির দেহেই এই মিলিটারিজম অল্পবিস্তর স্থান লাভ করেছে; একমাত্র জর্মানি তা পূর্ণমাত্রায় অঙ্গীকার করেছে। যা অপর সকল জাতির অন্তরে বাষ্পাকারে বিরাজ করছে জর্মানিতে তা জমে বরফ হয়ে গেছে। সুতরাং এই সমরানলে বরফের এই কাঠিন্যের অগ্নিপরীক্ষা হয়ে যাবে। যদি এই অগ্নিতে মিলিটারিজম ভস্মসাৎ হয় তা হলে যে কেবল অপরজাতি-সকলের মঙ্গল হবে শুধু তাই নয়, জর্মানিও পরিবর্ধিত না হোক, সংশোধিত হবে। যে জাতি মানবাত্মার সঙ্গে ইউরোপের পরিচয় করিয়ে দিয়েছে, যে দেশে কাণ্ট হেগেল গ্যেটে শিলার বীঠোভেন মোজার্ট জন্মলাভ করেছে, সে জাতির কাছে ইউরোপীয় সভ্যতা চিরঋণী। এই মিলিটারিজমের মোহমুক্ত হলে সে জাতি আবার মানবসভ্যতার প্রবল সহায় হবে।

মিলিটারিজম হেয় বলে বর্তমান বৈশ্যসভ্যতাই যে শ্রেয় এ কথা আমি বলতে পারি নে। কোনো সভ্যতাই নিরাবিল ও নিষ্কলুষ নয়, বৈশ্যসভ্যতাও নয়। তবে কোনো বর্তমান সভ্যতার দোষগুণ বিচার করতে হলে তার অতীতের প্রতি যেরূপ দৃষ্টি রাখা চাই, তার ভবিষ্যতের প্রতিও তদ্রূপ দৃষ্টি রাখা চাই। বর্তমান যে, অতীত ও ভবিষ্যতের সন্ধিস্থলমাত্র এ কথা ভোলা উচিত নয়। বর্তমানের যে-সকল দোষ স্পষ্ট লক্ষিত হচ্ছে ভবিষ্যতে তার নিরাকরণ হবার আশা আছে কি না, এ সভ্যতা স্বীয় শক্তিতে স্বীয় রোগমুক্ত হতে পারবে কি না, এই হচ্ছে আসল জিজ্ঞাস্য। আমার বিশ্বাস, বর্তমান ইউরোপীয় সভ্যতার সে শক্তি আছে। সে যাই হোক, বৈশ্যসভ্যতার রোগ সারাবার বৈধ উপায় হচ্ছে মন্ত্রৌষধির প্রয়োগ–জর্মানির অস্ত্রচিকিৎসা নয়।

অগ্রহায়ণ ১৩২১


© 2024 পুরনো বই