[একটি পারিবারিক সমিতিতে পঠিত]
হে সমিতির কুমার ও কুমারী-গণ, তোমাদের সমিতির কর্ণধার ভারতবর্ষের জিয়োগ্রাফির সঙ্গে তোমাদের দু কথায় পরিচয় করিয়ে দেবার ভার আমার উপর ন্যস্ত করেছেন। জিয়োগ্রাফি বিজ্ঞানের অন্তর্ভুত, সাহিত্যের নয়; আর এ কথা সবাই জানে যে, আমি সাহিত্যিক হলেও হতে পারি, কিন্তু বৈজ্ঞানিক নই। তবে যে আমি এ অনুরোধ রক্ষা করবার জন্য উদ্যত হয়েছি, তার কারণ অনধিকারচর্চা করবার কু অভ্যাস ও দুঃসাহস দুই আমার আছে।
কিন্তু প্রথমেই এক মুশকিলে পড়েছি। সকল বিজ্ঞানের মতো জিয়োগ্রাফিরও একটা বিশেষ পরিভাষা আছে। সে পরিভাষা মূলত ইংরেজি। এ বিষয়ে বাংলা ভাষায় যে পরিভাষা আছে, তা হয় সংস্কৃত নয় ইংরেজির অনুবাদ। সে-সব সংস্কৃত কথার অর্থ বুঝতে হলে তাদের আবার মনে মনে ইংরেজি ভাষায় উলটে অনুবাদ করে নিতে হয়। একটি উদাহরণ দিই। অন্তরীপ ও cape, এ দুটি কথাই বাঙালির কাছে সমান অপরিচিত। এ দুয়ের মধ্যে সম্ভবত কেপ শব্দটিই তোমরা স্কুলঘরে বেশি বার শুনেছ, অতএব তোমাদের কাছে বেশি পরিচিত। অপর পক্ষে উত্তমাশা অন্তরীপ বললে আমরা ভাবতে বসে যাই, জিনিসটা কি। আর ততক্ষণ চিন্তার দায় থেকে অব্যাহতি পাই নে, যতক্ষণ না কেউ বলে দেয় যে, ও হচ্ছে কেপ অব গুড হোপ-এর বাংলা নাম। আর শঙ্গ-অন্তরীপ (কেপ হর্ন) শুনলে তো আমরা অগাধ জলে পড়ি। আর সে জলে পড়লে আর উদ্ধার নেই, কারণ সে জল বরফ জল।
আমাদের পরিভাষার দশা যখন এরূপ মারাত্মক, তখন আমি যতদূর সম্ভব পরিভাষা পরিত্যাগ করে আমার কথা ভাষায় বলতে চেষ্টা করব। যেখানে অগত্যা পরিভাষা ব্যবহার করতে বাধ্য হব, সেখানে ইংরেজি শব্দই ব্যবহার করব। এ প্রস্তাব শুনে আমার হাতে বাংলা ভাষার জাত মারা যাবে ভেবে তোমরা ভীত হোয়ো না। ইংরেজি বিজ্ঞানের পরিভাষাও ইংরেজি নয়, গ্রীক। আর গ্রীক সভ্যতার বয়েস আড়াই হাজার বৎসর। সুতরাং তার পাশে অমাদের ভাষার আভিজাত্য একেবারে নষ্ট হবে না। ভারতবর্ষের সভ্যতার সঙ্গে গ্রীক, সভ্যতার আর-কোনো বিষয়ে মিল থাকুক, বয়েসে মিল আছে।
ভূমণ্ডল
প্রথমেই আমি তোমাদের কাছে পৃথিবী নামক গোলকটির কিঞ্চিৎ পরিচয় দেব। এ গোলকটি ক্ষিতি আর অপ-মাটি আর জল—এই দুই ভূতে গড়া! আর এ গোলকের বহিঃপষ্ঠের চার ভাগের তিন ভাগ হচ্ছে জল, আর এক ভাগ স্থল।
আমরা অবশ্য পৃথিবী বলতে প্রধানত মাটিই বুঝি। তার প্রমাণ আমরা একে ভূমণ্ডল বলি। এর কারণ আমরা ভূচর জীব, অর্থাৎ মাটির উপর বাস করি। জলচর জীবদের যদি শুধু জল-পিপাসা নয়, সেইসঙ্গে জ্ঞান-পিপাসা থাকত ও সেইসঙ্গে তাদের জ্ঞান তরল ভাষায় ব্যক্ত করবার ক্ষমতা থাকত, তা হলে তারা জিয়োগ্রাফি না রচনা করে রচনা করত হাইড্রোগ্রাফি। আর তারা কবিতা লিখত ‘আমার জন্মজলের’ উপর। আর আমরা যাকে বলি মধুর রস, তার নাম তারা দিত লবণ রস। এর থেকেই দেখতে পাচ্ছ যে, আমাদের কল্পনা আশা আকাঙক্ষা কতটা মাটিগত, অর্থাৎ আমরা মনে-প্রাণে কতটা জিয়োগ্রাফির অধীন।
পৃথিবীর ভাগ
এখন শোনো, মাটি কিন্তু একলন্ত ভাবে নেই, খণ্ড খণ্ড ভাবে আছে। প্রাচীন শাস্ত্রকাররা বলেন যে, মেদিনী সপ্তদ্বীপ আকারে ব্যক্ত হয়েছে।
এই দ্বীপ শব্দটার অর্থ তোমরা সবাই জান। যার চারি দিকে জল আর মাঝখানে থল, তাকেই আমরা বলি দ্বীপ। এ হিসাবে আজকের দিনে পৃথিবীতে সাতটি নয়, অসংখ্য দ্বীপ আছে। সমুদ্রের মধ্যে থেকে অসংখ্য ছোটোবড়ো দ্বীপ মাথা তুলে রয়েছে।
সুতরাং এ স্থলে সপ্তদ্বীপ অর্থে সাতটি মহাদ্বীপ বুঝতে হবে। এই মহাদ্বীপকে আমরা একালে মহাদেশ বলি। আজকের দিনে আমরা পৃথিবীকে চারটি মহাদেশে ভাগ করি, যথা : ইউরোপ এশিয়া আফ্রিকা ও আমেরিকা; অস্ট্রেলিয়াকে আমরা আজও মহাদ্বীপ বলেই জানি, মহাদেশ বলে মানি নে।
মহাদেশ বলতে যদি মহাদ্বীপ বোঝায়, তা হলে পৃথিবীতে চারটি নয় তিনটি মাত্র মহাদ্বীপ আছে : প্রথম ইউরেশিয়া, দ্বিতীয় আফ্রিকা, তৃতীয় আমেরিকা। শ্লোবের প্রতি একবার দৃষ্টিপাত করলেই দেখতে পাবে যে, গোটা ইউরোপ ও গোটা এশিয়ার ভিতর কোথাও জলের ব্যবধান নেই। এ দুই দেশের জমি একলপ্ত। আর এই আদি মহাদেশটি হচ্ছে একটি প্রকাণ্ড দ্বীপ। এর উত্তরে আকীটক সী, দক্ষিণে ইন্ডিয়ান ওশন, পশ্চিমে অ্যাটলান্টিক ও পূর্বে প্যাসিফিক ওশন; আর আফ্রিকার উত্তরে ও পশ্চিমে অ্যাটলান্টিক এবং দক্ষিণে ও পূর্বে ইন্ডিয়ান ওশন। আর আমেরিকার পশ্চিমে প্যাসিফিক, পূর্বে অ্যাটলান্টিক, উত্তরে উত্তর-আর্কটিক ও দক্ষিণে দক্ষিণ-আর্কটিক সাগর। ইউরেশিয়ার সঙ্গে অপর দুটি মহাদেশের গড়নেরও একটা স্পষ্ট প্রভেদ আছে। ইউরেশিয়ার বিস্তার পব হতে পশ্চিমে, অপর দুটির উত্তর হতে দক্ষিণে। অর্থাৎ ইউরেশিয়া লম্বার চাইতে চওড়ায় বেশি। আফ্রিকা ও আমেরিকা চওড়ার চাইতে লম্বায় বেশি। এই আকারভেদ এক দেশের সঙ্গে অপর দেশের অনেক প্রভেদ ঘটিয়েছে।
তোমরা সবাই জান যে ইউরেশিয়া ও আফ্রিকাকে আমরা প্রাচীন পৃথিবী বলি ও আমেরিকাকে নবীন। এর প্রধান কারণ প্রাচীন পৃথিবীর লোক পাঁচশো বৎসর পূর্বে আমেরিকার অস্তিত্বের কথা জানত না। অতএব, এ নাম শুধু লৌকিক, বৈজ্ঞানিক হিসেবে ঠিক নয়। তা ছাড়া, অনেক বিষয়ে এই নতুন পৃথিবী প্রাচীন পৃথিবীর ঠিক উলটো। বিলাতে (গ্রীনউইচ) যখন দিনপর, আমেরিকায় (নিউ অরলিনস) তখন রাতদুপুর। কেন এরকম হয়, সে কথা আর আজ বলব না; কারণ তা বোঝাতে হলে আমাকে মাটি থেকে আকাশে উঠতে হবে। এ ব্যাপারের ব্যাখ্যার ভিতর শুধু পৃথিবী নয়, সচন্দ্রকেও টেনে আনতে হবে। কেননা জিয়োগ্রাফি কতক হিসেবে অ্যাস,ট্রনমির অন্তর্ভূত। আর অ্যাসষ্ট্রনমি তোমরাও জান না, আমিও জানি নে।
উত্তরখণ্ড দক্ষিণখণ্ড
আর-একটি কথা শোনো। আমাদের শাস্ত্রকারদের মতে এই বিশ্ব আদিতে ছিল ব্ৰহ্মাণ্ড নামে একটি অণ্ড। পরে ভগবান সেই অণ্ডকে দ্বিখণ্ড করে তার ঊর্ধ্বখণ্ড দিয়ে স্বর্গ ও অধঃখণ্ড দিয়ে পৃথিবী রচনা করেন, আর এ দুয়ের মধ্যে আকাশ সৃষ্টি করেন। কিন্তু একালে আমরা পৃথিবীকে আধখানা ডিমের সঙ্গে তুলনা করি নে; আমরা বলি পৃথিবীর চেহারা ঠিক একটি কমলালেবুর মততা।
সেই কমলালেবুটিকে যদি ঠিক মাঝখানে কাট, তা হলে এই কাটা জায়গাটার নাম হবে ইকোয়েটর; তার উপরের আধখানার নাম হবে উত্তর হেমিসফিয়ার, আর নীচের অংশটির নাম হবে দক্ষিণ হেমিসফিয়ার। পৃথিবীর এই দুই খণ্ডের চরিত্র কোনো কোনো বিষয়ে ঠিক পরস্পরের বিপরীত। যথা উত্তরাখণ্ডে যখন গ্রীষ্মকাল, দক্ষিণাখণ্ডে তখন শীতকাল। তার পর এই দুই খণ্ডের গড়নেও ঢের প্রভেদ আছে। দক্ষিণাখণ্ডে যতখানি মাটি আছে, উত্তরাখণ্ডে প্রায় তার দ্বিগুণ আছে। এর থেকে অনুমান করতে পার যে, উত্তরাখণ্ডের জলবায়ুর সঙ্গে দক্ষিণাখণ্ডের জলবায়ুর বিশেষ প্রভেদ আছে। আর জলবায়ুর প্রভেদ থেকেই ভৌগোলিক হিসেবে এক দেশের সঙ্গে অপর দেশের প্রভেদ হয়। তোমরা সবাই জান যে, জল ও বায়, খির পদার্থ নয়-ও দুইই চঞ্চল, ও দুয়েরই স্রোত আছে। অপ ও মরতের স্রোতের মূল কারণ হচ্ছে সূর্যের তেজ; কিন্তু ক্ষিতি এই দুই স্রোতকে বাধা দিয়ে তাদের গতি ফিরিয়ে দিতে পারে। সুতরাং পৃথিবীর যে খণ্ডে বেশি পরিমাণ মাটি আছে, সে খণ্ডের জলবায়ুর গতি, যে খণ্ডে জল বেশি, সে দেশ হতে বিভিন্ন।
ইউরেশিয়া
এখন ইউরেশিয়ার বিশেষত্ব এই যে, এ মহাদেশটি সম্পূর্ণ পৃথিবীর উত্তরখণ্ডের অন্তর্ভূত। অপর পক্ষে আমেরিকা ও আফ্রিকার কতক অংশ উত্তরখণ্ডে ও কতক অংশ দক্ষিণখণ্ডে অবস্থিত। এর ফলে আমরা যাকে সভ্যতা বলি, সে বহু ত্যিপতেজমরদ,ব্যোমের কৃপায় ইউরেশিয়াতেই জন্মলাভ করেছে। আমেরিকা ও আফ্রিকা সভ্যতার জন্মভূমি নয়। ও দুই মহাদেশে যে সভ্যতার আমরা সাক্ষাৎ পাই, সে সভ্যতা ইউরেশিয়া হতে আমদানি। সমগ্র আমেরিকা ও আফ্রিকার উত্তরদক্ষিণ ভাগ তো ইউরোপের উপনিবেশ। আর পুরাকালে আফ্রিকার যে অংশে সভ্যতা প্রথম দেখা দেয়, সেই ইজিপ্ট উত্তরাখণ্ডের অন্তর্ভূত ও এশিয়ার সংলগ্ন। সুতরাং এ অনুমান করা অসংগত হবে না যে, সে সভ্যতার জন্মভূমি হচ্ছে এশিয়া, আর সেকালে ইজিপ্ট ছিল এশিয়ার একটি উপনিবেশ।
এর থেকে তোমরা বুঝতে পারবে যে, কোনো দেশের ইতিহাস বুঝতে হলে সে দেশের জিয়োগ্রাফিও আমাদের জানা চাই। এ যুগের মানুষ জিয়োগ্রাফির দশ অধীন না হলেও আদিতে যে বিশেষ অধীন ছিল, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ভারতবর্ষের ইতিহাস জানতে আমরা সবাই উৎসুক। সে ইতিহাস ভারতবর্ষের জমির উপরেই গড়ে উঠেছে, সেইজন্যই সেই জমির সঙ্গে তোমাদের পরিচয় করিয়ে দিতে আমি উদ্যত হয়েছি। এখন এই-ক’টি কথা তোমরা মনে রেখো যে, এ পৃথিবী সৌরমণ্ডলের অন্তর্ভূত ও তার সঙ্গে নানারূপ যোগসূত্রে আবদ্ধ। তার পর এই পৃথিবীর উত্তরাখণ্ডে ইউরেশিয়া অবস্থিত। আর এই মহাদেশের যে অংশকে আমরা এশিয়া বলি, ভারতবর্ষ তারই একটি ভূভাগ। আর এই ভূভাগের রূপগুণ বর্ণনা করাই এ প্রবন্ধের উদ্দেশ্য। প্রথমে সৌরমণ্ডল থেকে পৃথিবীকে ছাড়িয়ে নিয়ে, তার পর পৃথিবী থেকে তার উত্তরাখণ্ডকে ছাড়িয়ে নিয়ে, তার পর তার উত্তরাখণ্ড থেকে ইউরেশিয়াকে ছাড়িয়ে নিয়ে, তার পর ইউরেশিয়া থেকে এশিয়াকে পৃথক করে নিয়ে, তার পর এশিয়া থেকে অপরাপর দেশকে বাদ দিলে তবে আমরা ভারতবর্ষ পাই। এ দেশ অপরাপর দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন না হলেও বিভিন্ন। সুতরাং একে একটি স্বতন্ত্র দেশ হিসেবে ধরে নিয়ে তার বর্ণনা করা যায়। আমি পূর্বে বলেছি যে, বিদেশের সামান্য জ্ঞান না থাকলে স্বদেশেরও বিশেষ জ্ঞান লাভ করা যায় না। এ কথা সত্য। কিন্তু অপর পক্ষে এ কথাও সমান সত্য যে, স্বদেশের বিশেষ জ্ঞান না থাকলে বিদেশের সামান্য জ্ঞান লাভ করা কঠিন। ও ক্ষেত্রে আমরা নাম শিখি, কিন্তু দেশ চিনতে শিখি নে। এই কারণে আজকাল এক শ্রেণীর বৈজ্ঞানিক বলেন যে, প্রথমে বাড়ির জিয়োগ্রাফি শিখে, তার পর দেশের জিয়োগ্রাফি শেখাই কর্তব্য। কারণ ছোটোর জ্ঞান থেকেই মানুষকে বড়োর জ্ঞানে অগ্রসর হতে হয়, ঘর থেকেই বাইরে যেতে হয়। আমি যে এ প্রবন্ধে তার উলটো পদ্ধতি অবলম্বন করেছি, বড়ো থেকে ছোটোতে, বাইরে থেকে ঘরে আসছি, তার প্রথম কারণ আমি বৈজ্ঞানিক নই-সাহিত্যিক; আর তার দ্বিতীয় কারণ, আমি তোমাদের মনে এই সত্যটি বসিয়ে দিতে চাই যে, ভারতবর্ষ একটা সৃষ্টিছাড়া দেশ নয়।
এশিয়া
এশিয়া ব’লে ইউরোপ থেকে কোনো পথক, মহাদেশ নেই, এ কথা তোমাদের পূর্বেই বলেছি। কিন্তু বহুকাল থেকে মানুষ এই এক মহাদেশকে দুই মহাদেশ বলে আসছে। ভৌগোলিক হিসাবে না হোক, লৌকিক মতে এশিয়া একটি স্বতন্ত্র মহাদেশ বলে যখন গ্রাহ্য, তখন এ ভূভাগকে একটি পথক, মহাদেশ বলে মেনে নেওয়া যাক।
ভারতবর্ষ এই মহাদেশের অন্তর্ভূত, অতএব এশিয়ার চেহারাটা একনজর দেখে নেওয়া যাক।
এ যুগের জাপানের একজন বড়ো কলাবিদ ও সাহিত্যিক কাকুজো ওকাকুরা, তার The Ideals of the East নামক গ্রশের আদিতেই বলেছেন যে, Asia is one। এ কথাটা Eastএর ideal হতে পারে, কিন্তু বস্তুগত্যা সত্য নয়।
ভৌগোলিক হিসেবে এশিয়া চারটি উপমহাদেশে (সাব-কন্টিনেন্ট) বিভক্ত। কি হিসেবে এশিয়াকে চার ভাগে বিভক্ত করা হয়, তা এখন শোনো।
জগৎ সরিৎ সমুদ্ৰা শৈলাদ্যাত্মকম্
অর্থাৎ এ জগৎ নদী সমুদ্র ও পাহাড় দিয়ে গড়া। জগৎ সম্বন্ধে এ কথাটা যে কতদূর সত্য, তা বলতে পারি নে—তবে একেবারে যে বাজে নয়, তার প্রমাণ চন্দ্র উপগ্রহে পাহাড় আছে, মার্স গ্রহে নদী আছে এবং সম্ভবত অপর কোনো গ্রহে সমুদ্রও থাকতে পারে। সে যাই হোক, পৃথিবী সম্বন্ধে মেধাতিথির উক্তি যে সম্প সত্য সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
আর, এই তিন বস্তুই পৃথিবীকে নানাদেশে বিভক্ত করে রেখেছে।
সমুদ্রের ব্যবধানেই যে মহাদেশ হয়, তার কারণ সমুদ্র আগে ছিল অলঘ্য আর এখন হয়েছে দুর্লঙ্ঘ্য। শৈলমালা সমুদ্রের চাইতে কিছু, কম অঘ্য বা দল নয়। সুতরাং পর্বতের ব্যবধানও এক ভূভাগকে অপর ভূভাগ থেকে পৃথক করে রাখে।
কালিদাস বলেছেন যে–
অস্ত্যুত্তরস্যাং দিশি দেবতাত্মা হিমালয়ো নাম নগাধিরাজঃ।
পূর্বাপরৌ তোয়নিধী বগাহ্য স্থিতঃ পৃথিব্যা ইব মানদণ্ড।
ভারতবর্ষের উত্তরে স্থিত যে পর্বতশ্রেণীর স্বদেশী অংশকে আমরা হিমালয় বলি, তা অবশ্য এশিয়ার পূর্ব ও পশ্চিম সমুদ্রে অবগাহন করছে না। কিন্তু হিমালয় বলতে আমরা যদি সেই শৈলমালা বুঝি, যে পর্বতশ্রেণী সমগ্র এশিয়ার মেরুদণ্ড, আর যাকে এ যুগের ভৌগোলিকরা সেন্ট্রাল মাউনটেনস আখ্যা দিয়েছেনহলে আমরা কালিদাসের উক্তি সত্য বলে স্বীকার করতে বাধ্য। এ নগাধিরাজ সত্য সত্যই এশিয়ার পূর্ব ও পশ্চিম তোয়নিধিতে অবগাহন করে অবস্থিতি কমছে। পশ্চিমে ভূমধ্যসাগর ও পূর্বে প্রশান্ত মহাসাগর পর্যন্ত এ পর্বতশ্রেণী বিস্তৃত। আর পৃথিবী বলতে যদি আমরা শুধু প্রাচীন পৃথিবী বুঝি, তা হলে তো কালিদাসের উক্তি অক্ষরে অক্ষরে সত্য হয়। কারণ এশিয়ার এই সেন্ট্রাল মাউন, টেনস হচ্ছে প্রাচীন পৃথিবীর মিড-ওঅলড মাউনটেনএরই অংশ। তার পর এ সমগ্র পর্বতশ্রেণীকে হিমালয় বলা যেতে পারে; কেননা এ পর্বতের অধিকাংশই চিরহিমের আলয়।
এই হিমালয়, ভাষান্তরে সেন্ট্রাল মাউনটেনসএর মতো বিরাট প্রাচীর পৃথিবীর আর কোনো মহাদেশকে দু ভাগে বিভক্ত করে নি। এ প্রাচীরের উত্তরদেশকে এশিয়ার উত্তরাপথ এবং দক্ষিণদেশকে দক্ষিণাপথ বলা যেতে পারে। এই প্রাচীর যে কত উঁচু তা তো তোমরা সবাই জান। এই ভারতবর্ষের উত্তরেই এর পাঁচটি শৃঙ্গ আছে, যার প্রতিটির উচ্চতা হচ্ছে পঁচিশ হাজার ফুটের চাইতেও বেশি। কাশ্মীরে নাংঘা পর্বত উঁচুতে ২৬,৬২১ ফুট, তিব্বতে নন্দাদেবী ২৫,৬৪৫, নেপালে ধবলগিরি ২৬,৭৯৯ ফুট, এভারেস্ট ২৯,০০২, কিনচিনজঙ্গা ২৮,১৪৬। এখন এ পর্বত প্রস্থে কত বড়ো তা শোনো।–
ভারতবর্ষের পশ্চিমে যে দেশ আছে, সে দেশকে আমরা ইরান বলি; আর উত্তরপশ্চিমে যে দেশ আছে, তাকে তুরান বলি। ইরান ও তুরানে এই পর্বত কোথাও চারশো মাইল, কোথাও আটশো মাইল চওড়া। এ মহাপর্বতের অনেক শাখাপ্রশাখা আছে। তাদের মিলনভূমি হচ্ছে পামির অধিত্যকা। এ অধিত্যকাও প্রায় চৌদ্দ হাজার ফুট উঁচু। এই পামিরের উত্তরে এ পর্বতের প্রস্থ হচ্ছে বারোশশা মাইল, এবং এর সঙ্গে এ পর্বতের নিদাংশ অর্থাৎ উপত্যকাগুলি যদি যোগ দেওয়া যায়, তা হলে এ ব্যবধানের প্রস্থ হয় দু হাজার মাইল—অর্থাৎ হিমালয় হতে কন্যাকুমারিকা যতদূর ততদূর। এর থেকে দেখতে পাচ্ছ যে, এশিয়ার উত্তরাপথ ও দক্ষিণাপথকে এক দেশ বলা কতদূর সংগত।।
এই কারণে এশিয়ার উত্তরাখণ্ডকে একটি উপমহাদেশ বলা হয় আর তার দক্ষিণাপথের পশ্চিম ভাগকে দ্বিতীয়, পূর্ব ভাগকে তৃতীয়, তার মধ্য ভাগকে চতুর্থ উপমহাদেশ বলা যায়।
এই মধ্যদেশই ভারতবর্ষ। ভূমধ্য পর্বত থেকে এই চারটি উপমহাদেশ ঢাল হয়ে সমুদ্রের দিকে নেমে এসেছে। ফলে উত্তর ভাগের সকল নদী উত্তরবাহিনী, ও তারা সব গিয়ে পড়ে আর্কটিক সমুদ্রে; পশ্চিম ভাগের জল গড়িয়ে পড়ে ভূমধ্যসাগরে, পর্ব ভাগের জল প্রশান্ত-মহাসাগরে ও মধ্যদেশের জল ভারত-মহাসাগরে। মধ্য এশিয়া পর্বতময়। আর এ পর্বত অর্ধেক এশিয়া জুড়ে বসে আছে। আর তার চার পাশের চার ভাগের প্রকৃতি ও চরিত্র সম্পূর্ণ বিভিন্ন। উত্তরদেশ অর্থাৎ সাইবিরিয়া সমতল ভূমি কিন্তু জলবায়ুর গুণে মানুষের বাসের পক্ষে অনুকল নয়। পশ্চিম একে পাহাড়ে, উপরন্তু নির্জলা দেশ। সে দেশের জমিতে ফসল একরকম হয় না বললেই চলে। ইরান-তুরানের অধিকাংশ লোক গৃহস্থ নয়, তারা অন্নের সন্ধানে তাঁবু ঘাড়ে করে দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়ায়। বাকি দুটি ভূভাগ, ভারতবর্ষ ও চীনদেশ, মানুষের বাসের পক্ষে সম্পূর্ণ উপযোগী। এ দুটি দেশ মুখ্যত সমতল ভূমি, আর সে ভূমি কর্ষণ করে অন্নবস্ত্র দুই লাভ করা যায়; অতএব এ দুই দেশের লোকই গহস্থ হয়েছে। আর শাস্ত্রে বলে, মানুষের সকল আশ্রম গার্হস্থ্যআশ্রমেরই বিকল্প মাত্র।
এশিয়াকে ত্যাগ করবার পূর্বে সে মহাদেশ সম্বন্ধে আর-একটি কথা বলছি, যা শুনে তোমরা একটু চমকে যাবে। এ মহাদেশের ম্যাপে একটি দেশ ভুলক্রমে ঢুকে পড়েছে, যেটি ভৌগোলিক হিসেবে এশিয়ার নয়, আফ্রিকার অঙ্গ। সে দেশের নাম আরবদেশ। এই আরবদেশ প্রকৃতপক্ষে আফ্রিকার সাহারা মরুভূমিরই একটি অংশ। তোমরা বোধ হয় জান যে, মরুভূমির একটি ধর্ম হচ্ছে পার্শ্ববর্তী দেশকে আক্রমণ করা। হাওয়ায় তার তপ্ত বালি উড়ে এসে পার্শ্ববর্তী দেশকে চাপা দেয়। তার স্পর্শে গাছপালা-তৃণপুষ্প সবই মারা যায়। মরুভূমির শুধু বালুকা নয়, তার বায়ুও সমান মারাত্মক। যে দেশের উপর দিয়ে সে বাতাস বয়ে যায়, সে দেশের রস-কষ একেবারে শুকিয়ে যায়। সাহারার এই নিজস্ব বাতাসের নাম ট্রেড উইন্ড্স। এবার গ্লোবের দিকে তাকিয়ে দেখলেই দেখতে পাবে যে, এই ট্রেড উইন্ড্স চলার পথটি হচ্ছে আগাগোড়া পোড়ামাটি।
সাহারা মরুভূমি আরবদেশের ভিতর দিয়ে এসে প্রথমে পারস্যের দক্ষিণ ভাগকে, তার পর আরো এগিয়ে ভারতবর্ষের সিন্ধুদেশকে আক্রমণ করে। ফলে, আরব থেকে সিন্ধুদেশ পর্যন্ত সমস্ত ভূভাগকে মরুভূমিতে পরিণত করেছে। এ আক্রমণে বাধা দিয়েছে রাজপুতানা। রাজপুতানার চিরগৌরব এই যে, এই রাজপুতানাই হিন্দুস্থানকে এই ক্রমবর্ধমান আফ্রিকার মরুভূমির কবল থেকে রক্ষা করেছে।
এই আরবদেশ যে ভুলক্রমে এশিয়ার ম্যাপে ঢুকে গেছে, তার কারণ কেবলমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী মানচিত্রকাররা লোহিত-সমুদ্রকে আফ্রিকা ও এশিয়ার মধ্যে পরিখা বলে ধরে নিয়েছিলেন। একটু তলিয়ে দেখলেই দেখা যায়, এ সমুদ্রও আসলে মরুভূমি। এর উপরে যেটুকু জল আছে, তা ভারত-মহাসাগরের দান।
ভারতবর্ষকে যদি এশিয়াখণ্ডের একটি উপমহাদেশ না বলে একটি স্বতন্ত্র মহাদেশ বলা যায়, তা হলেও কথাটা অসংগত হয় না।
ভারতবর্ষ মাপে ১৫,০০,০০০ বর্গমাইল। এক চীন ব্যতীত এত বড়ো দেশ এশিয়ায় আর কোথাও নেই। এশিয়ার রুশিয়া ম্যাপে দেখতে প্রকাণ্ড দেশ; কিন্তু এর দক্ষিণাংশে এত বড়ো বড়ো হ্রদ মরুভূমি তৃণকান্তার ও পর্বত আছে যে, সে অংশটিকে একটি দেশ বলা যায় না। কারণ সে ভূভাগ মানুষের বাসের অযোগ্য। আর এর উত্তরাংশের জমি সমতল হলেও আজও জমাট মাটি হয়ে ওঠে নি। এ দেশে গাছপালা অতি বিরল, যে দুটি-চারটি আছে তারা সব বামন। এরকম দেশ যে কৃষিকার্যের জন্য অনুপযোগী, সে কথা বলাই বাহুল্য। ফলে সাইবিরিয়া একরকম জনশূন্য বললেই হয়।
ভারতবর্ষ যে আকারে বিপুল, শুধু তাই নয়। এ দেশ এশিয়ার অপরাপর দেশ থেকে একরকম সম্পূর্ণ বিভিন্ন বললেও অত্যুক্তি হয় না।
এর উত্তরে হিমালয়ের গগনস্পর্শী প্রাচীর; আর তিন দিকে ভারত-মহাসাগরের অতলস্পর্শী পরিখা। তোমরা ভেব না যে আমি ভুল করছি। আরব-সাগর বঙ্গউপসাগর প্রতি নাম আমিও জানি; কিন্তু ও-সব সাগর-উপসাগর ভারত-মহাসাগরেরই অংশ মাত্র। ভারতবর্ষ তার উত্তরপশ্চিম ও উত্তরপূর্বে কোণে শুধু অপর দেশের সঙ্গে সংলগ্ন। তার উত্তরপশ্চিমে আফগানিস্থান, এবং উত্তরপূর্বে ব্রহ্মদেশ। কিন্তু এ দুই দিকেই আবার অতি দুর্গম পর্বতের ব্যবধান আছে। যে পর্বতশ্রেণী আফগানিস্থান ও বেলুচিস্তানকে হিন্দুখান থেকে পথক করে রেখেছে, সে পর্বতশ্রেণীর অবশ্য দুটি দয়োর আছে—খাইবার পাস ও বোলান পাস-যার ভিতর দিয়ে এ দুই দেশে মানুষে যাতায়াত করতে পারে। কিন্তু ব্রহ্মদেশে যাবার পথ আজও বঙ্গোপসাগরের জলপথ।
দেখতে পাচ্ছ স্বয়ং প্রকৃতিই ভারতবর্ষকে একটি স্বতন্ত্র মহাদেশ করে গড়েছেন।
এখন দেখা যাক, এই সমগ্র দেশটার আকার কিরকম। আমাদের পূর্বপুরুষেরা সমগ্র পৃথিবীকে ত্রিকোণ বলতেন। সম্ভবত পৃথিবী বলতে তাঁরা ভারতবর্ষ বুঝতেন। কেননা ভারতবর্ষ সত্যসত্যই ত্রিকোণ।
মানুষে যতক্ষণ জ্যামিতির কোনো মূর্তির সঙ্গে কোনো দেশকে মেলাতে না পারে, ততক্ষণ তার মনস্তুষ্টি হয় না; যদিও জ্যামিতির কোনো আকারের সঙ্গে কোনো দেশই হবহ, মিলে যায় না। পৃথিবীকে আমরা বলি গোলাকার। কথাটা মোটামুটি সত্য। কিন্তু জ্যামিতির বৃত্তের উত্তরদক্ষিণ চাপা নয়। ইউক্লিডের তৃতীয় অধ্যায়ে কমলালেবুর কোনো স্থান নেই। এই কথাটা মনে রাখলে, মহাভারতে ভারতবর্ষকে যে একটি সমভুজ ত্রিকোণ দেশ বলা হয়েছে, সে উক্তিকে গ্রাহ্য করে নিতে আমাদের কোনো আপত্তি হওয়া উচিত নয়।
পৃথিবীতে এমন কোনোই দেশ নেই, যা সম্পূর্ণ একাকার। ভারতবর্ষও একাকার নয়। অর্থাৎ ভারতবর্ষকেও নানা খণ্ডে বিভক্ত করা যায়। এখানে একটি কথা বলে রাখি। রাজ্যের ভাগের সঙ্গে ভৌগোলিক ভাগের বিশেষ কোনো সম্বন্ধ নেই। অর্ধেক পৃথিবী আজ ব্রিটিশরাজের অধীন; কিন্তু তাই বলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ক্যানেডা অস্ট্রেলিয়া ও ভারতবর্ষকে পাগল ছাড়া আর-কেউ এক দেশ বলবে না। আমি যে ভাগের কথা বলছি, সে ভৌগোলিক ভাগ।
আমাদের শাস্ত্রে ভারতবর্ষকে নানা ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। পুরাণকারদের মতে ভারতবর্ষ নবখণ্ড। বরাহমিহির প্রতি গণিতশাস্ত্রীরা পৌরাণিকদের সঙ্গে একমত, যদিচ এ দুয়ের বর্ণিত নবখণ্ডের মিল নেই। মহাভারতের মতে এ দেশ চার খণ্ডে বিভক্ত। চারিটি equilateral triangleএর সমষ্টি হচ্ছে ভারতবর্ষ নামক বড়ো cquilateral triangle। জ্যামিতির হিসেব থেকে যদিও এ বর্ণনা সত্যের কাছ ঘেঁষে যায়, কিন্তু ভৌগোলিক হিসেব থেকে অনেক দূরে থাকে। সে যাই হোক, সংস্কৃত সাহিত্যে আর-একরকম ভাগের উল্লেখ আছে। ভারতবর্ষ মোটামুটি দু ভাগে বিভক্ত। একটি ভাগের নাম উত্তরাপথ, অপরটির দক্ষিণাপথ। এই লৌকিক ভাগটিই প্রকৃতপক্ষে বৈজ্ঞানিক। উত্তরাপথ ভৌগোলিক হিসেবে দক্ষিণাপথ থেকে বিচ্ছিন্ন ও বিভিন্ন।
হিমালয় যেমন সমস্ত এশিয়ার মেরুদণ্ড, বিন্ধ্যপর্বত তেমনি ভারতবর্ষের মেরুদণ্ড। এ খলে আমি সাতপরা ও আরাবলি পর্বতকে বিধ্য নামে অভিহিত করছি। উত্তরে হিমালয় ও দক্ষিণে বিন্ধ্যপর্বতের মধ্যের দেশকে উত্তরাপথ বলা যায়, আর দক্ষিণে বিন্ধ্যপর্বত থেকে ভারত-মহাসাগরের মধ্যবর্তী দেশকে দক্ষিণাপথ বলা যায়। কিন্তু তোমরা ম্যাপের প্রতি দৃষ্টিপাত করলেই দেখতে পাবে, আরাবলি পর্বতের পশ্চিমে ও রাজমহলের পূর্বেও অনেকখানি জমি পড়ে রয়েছে। এই পশ্চিম অংশের নাম পাঞ্জাব ও সিন্ধুদেশ, আর পর্ব অংশের নাম বঙ্গদেশ ও আসাম। এ দুটিকেও উত্তরাপথের অন্তর্ভূত করে নিতে হবে।
উত্তরাপথ
প্রথম জিনিস যা চোখে পড়ে সে হচ্ছে এই যে, এই বিস্তৃত ভূভাগের ভিতর কোনোরূপ পাহাড়পবত নেই, সমস্ত উত্তরাপথ সমতলভূমি। এর ভিতর এক জায়গায় শুধু একটু অপেক্ষাকৃত উঁচু জমি আছে। পাঞ্জাব ও হিন্দুস্থানের মিলনস্থল হচ্ছে সেই উচ্চভাগ। উত্তরাপথের এই জায়গাটার গড়ন কাছিমের পিঠের মতো। ফলে এ স্থানের পশ্চিমের যত নদী সব পশ্চিমবাহিনী ও পূর্বের যত নদী সব পূর্ববাহিনী।
এই পশ্চিম ভাগের নদী পাঁচটির নাম ঝিলম চেনাব রাবি বিয়াস ও সৎলেজ। এ পাঁচটিরও জন্মভূমি হচ্ছে হিমালয়, আর এ পাঁচটিই পথিমধ্যে এ-ওর সঙ্গে মিলিত হয়ে শেষটা ভারতবর্ষের সবচাইতে পশ্চিমের নদী সিন্ধুনদের সঙ্গে মিশে সমুদ্রে গিয়ে পড়েছে। তোমরা বোধ হয় জান যে, পাহাড় থেকে নদী যে মাটি কেটে নিয়ে আসে, সেই মাটি দিয়েই সমতলভূমি তৈরি হয়। এই পঞ্চনদের কৃপায় পঞ্চনদ-দেশ ওরফে পাঞ্জাব তৈরি হয়েছে। আর এই দেশটাকে ইণ্ডাস ভ্যালি বলা হয়। কারণ সিন্ধুই হচ্ছে এই পঞ্চনদের ভিতর মহানদ।
উত্তরাপথের পূর্ব ভাগের প্রধান নদীগুলির নাম যমুনা গঙ্গা গোমতী গোগরা গণ্ডক ও কুশি। এ-সকল নদীরই উৎপত্তি হিমালয়ে, আর এদের মধ্যে সর্বপ্রধান হচ্ছে গঙ্গা। অপর পাঁচটি একে একে গঙ্গায় মিশে গিয়েছে। সিন্ধুনদের সঙ্গে গঙ্গার একটি বিশেষ প্রভেদ আছে। সিন্ধুনদ তার আগাগোড়া জল হিমালয়ের কাছ থেকে পায়। গঙ্গা কিন্তু কিছু জল বিন্ধ্যপর্বতের কাছ থেকেও পায়। চম্বাল ও শোণ এই দুই নদীরই জন্মভূমি হচ্ছে বিন্ধ্যপর্বত। আর এই দুই নদীই উত্তরবাহিনী হয়ে এসে গঙ্গায় পড়েছে। সংস্কৃত ভাষায় জলের আর-এক নাম জীবন। গঙ্গাই হচ্ছে উত্তরাপথের জীবন। ও দেশের বুকের ভিতর দিয়ে গগা যদি রক্তের মতো বয়ে না যেত, তা হলে উত্তরাপথের প্রাণবিয়োগ হত। এই গাঙ্গেয় দেশই হচ্ছে প্রকৃত হিন্দুস্থান।
আরাবলি পর্বতের পশ্চিমে ও দক্ষিণে হচ্ছে মরভূমি। সিন্ধুনদ দক্ষিণাংশে এই মরভূমির ভিতর দিয়ে বয়ে সমুদ্রে গিয়ে পড়েছে। এই সিন্ধুনদীর দু পাশের দেশের নাম সিন্ধুদেশ।
বিন্ধ্যপর্বতের একরকম গা ঘেঁষে পূর্বে অনেক দূর এসে গগা রাজমহলের কাছে পর্বতের বাধা হতে অব্যাহতি লাভ করে দক্ষিণবাহিনী হয়ে সমুদ্রের অভিমুখে যাত্রা করেছেন। তার পর দক্ষিণে অনেক দূর এসে গোয়ালন্দের নিকট ব্ৰহ্মপুত্রের সহিত মিলিত হয়েছেন। এই ব্রহ্মপুত্রেরও জন্মস্থান হিমালয়। ব্রহ্মপুত্র লখনউয়ের উত্তরে হিমালয় থেকে বেরিয়ে পূর্বমুখে বহুদূর পর্যন্ত হিমালয়ের ভিতর দিয়েই প্রবাহিত হয়ে ভুটানের পূর্বে এসে দক্ষিণবাহিনী হয়ে গঙ্গার সঙ্গে মিশে গেছেন। তার পর এই মিলিত গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র আরো দক্ষিণে এসে মেঘনার সঙ্গে মিলিত হয়ে সমুদ্রে এসে পড়লেন। মেঘনার জন্মভূমি হচ্ছে গারো-লসাই পর্বত। এই তিন নদীতে মিলে বাংলাদেশ গড়েছে।
উত্তরাপথের পশ্চিমদেশ সিন্ধুদেশ যেমন শুখনো, তার পূর্বদেশ বাংলা তেমনি ভিজে। সিন্ধুদেশের সক্কর নামক স্থানের মতো গরম জায়গা পৃথিবীতে আর দ্বিতীয় নেই। তার পাশে রোড়ী নামক স্থানে গত বারো বৎসরে মোটে ছ পশলা বৃষ্টি হয়েছে। অপর পক্ষে বাংলার মতো ভিজে দেশও ভারতবর্ষে আর দ্বিতীয় নেই।
দক্ষিণাপথ
এখন দক্ষিণাপথে যাওয়া যাক।
এ ভূভাগ সম্বন্ধে প্রথম বক্তব্য হচ্ছে এই যে, এটি উত্তরাপথ থেকে একরকম বিচ্ছিন্ন।
অগস্ত্যমুনি বিন্ধ্যপর্বতের মাথা নিচু করে দিয়েছিলেন, কিন্তু সে মাথাকে ভূলণ্ঠিত করতে পারেন নি। ফলে এই দুই ভাগের ভিতর যাতায়াতের সুগম পথ নেই। উত্তরাপথ থেকে প্রবাহিত হয়ে দক্ষিণ সমুদ্রে গিয়ে পড়ছে এমন কোনো নদী নেই, সুতরাং এ দুই দেশের ভিতর জলপথ নেই। গঙ্গানদী বিন্ধ্যপর্বতকে প্রদক্ষিণ করে ও সিন্ধুনদ সে পর্বতকে বাঁয়ে ফেলে রেখে তার পর সমুদ্রে এসে পড়েছে।
তার পর এ দুয়ের ভিতর কোনো স্থলপথও নেই। এক রেলের গাড়ি ছাড়া আর কোনোরকম গাড়ি-গোরুর ঘোড়ার কি উটের-বিন্ধ্যপর্বতের এক পাশ থেকে অপর পাশে যেতে পারে না।
মানুষে পায়ে হেঁটে যখন হিমালয় পার হয়ে যায়, তখন বিন্ধ্যপর্বত অবশ্য তার চলাচলের পথ বন্ধ করতে পারে নি। মানুষের অগম্য স্থান ভূ-ভারতে নেই, কিন্তু দুর্গম স্থান আছে। এই বিন্ধ্য অতিক্রম করবার পথ সেকালে অত্যন্ত দুর্গম ছিল। রামচন্দ্র পায়ে হেঁটে বিন্ধ্যপর্বত পার হয়ে দক্ষিণাপথে গিয়েছিলেন, কিন্তু ফিরতি বেলায় তিনি বিমানে চড়ে লঙ্কা থেকে অযোধ্যায় প্রত্যাগমন করাই বেশি আরামজনক অতএব সুযুক্তির কাজ মনে করেছিলেন।
সেকালে বিন্ধ্যপর্বত প্রদক্ষিণ করে আসবারও বিশেষ অসুবিধা ছিল। আরাবলি পর্বতের পশ্চিম দিয়ে আসতে হলে মরুভূমি অতিক্রম করে আসতে হত। অপর পক্ষে রাজমহলের পূর্ব দিয়ে বাংলায় এসে সমুদ্রের ধার দিয়ে মাদ্রাজ পৌঁছতে অনেক দিন নয়, অনেক বছর লাগত। এক, রাজা ও সন্ন্যাসী ছাড়া ওরকম দেশভ্রমণ বোধ হয় সেকালে অপর কেউ করত না। সমগ্র ভারতবর্ষকে এ ভাবে প্রদক্ষিণ করতেন রাজা দিগ্ বিজয়ে বহির্গত হয়ে, আর সন্ন্যাসী তীর্থভ্রমণে।
এই বিন্ধ্যপর্বতের ভিতর একটি ফাঁক আছে–খাণ্ডেয়া নামক স্থানে। এলাহাবাদ থেকে বম্বে যাবার রেলপথ এই খাণ্ডোয়ার ফাঁক দিয়েই যায়। এবং সেকালে এই দুয়োর দিয়েই বোধ হয় উত্তরাপথের লোক দক্ষিণাপথে প্রবেশ করত। ভারতবর্ষের মধ্যে দক্ষিণাপথ হচ্ছে একটি বড়ো কৌটোর মধ্যে আর-একটি ছোটো কৌটো।
দক্ষিণাপথ উত্তরাপথ থেকে শুধু বিচ্ছিন্ন নয়, বিভিন্ন আকৃতিতেও, প্রকৃতিতেও।
উত্তরাপথকে একটি চতুর্ভুজ হিসেবে ধরা যায়, কিন্তু দক্ষিণাপথ হচ্ছে একটি স্পষ্ট ত্রিভুজ। একটি উলটো পিরামিড, যার base হচ্ছে বিধ্য, আর apex কুমারিকা অন্তরীপ। এর উভয় পাশই পাহাড় দিয়ে বাঁধানো। পশ্চিম দিকের পর্বতের নাম পশ্চিমঘাট, পর্ব দিকের পর্বঘাট। এই দুই পর্বত এসে মিলিত হয়েছে, কুমারিকা অন্তরীপের একটু উত্তরে। এর দক্ষিণে যে জায়গাটুকু আছে, তার পূর্বে আর পাহাড় নেই, কিন্তু পশ্চিমে আছে কারডামম হিলস।
উত্তরাপথ হচ্ছে সমতলভূমি কিন্তু দক্ষিণাপথ মালভূমি। অর্থাৎ ইরান দেশের মতো এ দেশও হচ্ছে পর্বতের উপত্যকা; শুধু ইরানের উপত্যকা হচ্ছে প্রায় তিন হাজার ফুট উঁচু, ও দক্ষিণাপথের হাজার ফিট। সুতরাং এ পিরামিডকে পাথরেগড়া বলা যেতে পারে। এ ভূভাগে সমতলভূমি আছে শুধু পশ্চিমঘাটের পশ্চিমে ও সমুদ্রের উপকূলে, যে দেশকে আমরা মালাবার দেশ বলি; ও পর্বসমুদ্রের উপকূলে, যে দেশকে আমরা করমণ্ডল বলি। দক্ষিণাপথের অন্তরেও কিছু কিছু সমতলভূমি আছে, তার পরিচয় পরে দেব।
এই মালাবার দেশটি অতি সংকীর্ণ, করমণ্ডল অপেক্ষাকৃত প্রশস্ত। যদি একটি বিমানে চড়ে দূর থেকে দেখা যায় তো দেখা যাবে যে, দক্ষিণাপথের পশ্চিম পাড় বেজায় মাথা উঁচু করে রয়েছে, পশ্চিমঘাট যেন সমুদ্র থেকে ঝাঁপিয়ে উঠেছে আর করমণ্ডল একেবারে সমুদ্রের সঙ্গে বেমালুম মিশে গেছে। এ অংশের তালীবন যেন সমুদ্র থেকেই উদভূত হয়েছে। কালিদাস যে বলেছেন–
দূরাদয়শ্চক্রনিভস্য তন্বী তমালতালীবনরাজিনীলা।
আভাতি বেলা লবণাম্বুরাশেঃ ধারানিবন্ধেব কলঙ্করেখা ৷৷
সে বেলা হচ্ছে করমণ্ডল কোস্ট্।
দক্ষিণাপথের উত্তরে দুটি অপর নদী আছে, নর্মদা ও তাপ্তি। নর্মদা বিন্ধ্যপর্বতের উপত্যকার ভিতর দিয়ে, ও তাপ্তি সাতপরা-পর্বতের দক্ষিণ পাদদেশ ঘেঁষে পশ্চিমবাহিনী হয়ে গালফ অব ক্যাম্বেতে পড়ছে।
এ দুই নদী মানুষের বিশেষ কোনো কাজে লাগে না। এ নদী দুটি মানুষের যাতায়াতের জলপথ নয়। তার পর এদের পলিতে কোনো সমতল দেশ গড়ে ওঠে নি। এরা দুটিতে মিলে সাগরসংগমের মুখে খালি একটুখানি মাটি তৈরি করেছে।
এ দেশের দক্ষিণের নদী-ক’টি সবই পূর্ববাহিনী। প্রথম গোদাবরী, দ্বিতীয় কৃষ্ণা, তৃতীয় কাবেরী। এই তিনটি নদীরই জন্মভূমি হচ্ছে পশ্চিমঘাট, আর এ তিনটিই এসে পড়ছে বঙ্গ-উপসাগরে।
এই তিনটি নদীর উভয় কূলে অল্পস্বল্প সমভূমি আছে, যেখানে ফসল জন্মায়। এই তিনটি নদীর হাতে করমণ্ডল দেশ গড়ে উঠেছে। দক্ষিণাপথের ভিতর থেকে মালাবার ও কোন যাবার কোনো পথ থাকত না, যদি না পশ্চিমঘাটের ভিতর তিনটি ফাঁক থাকত—উত্তরে থালঘাট ও বোরঘাট, দক্ষিণে পালঘাট। এইখানেই কোইম্বাটোর নামক শহর। এই কোইম্বাটোরের দুয়োরই দক্ষিণাপথের অন্তরের সঙ্গে তার পশ্চিম উপকূলের যোগরক্ষা করেছে। দক্ষিণাপথ ও বাংলার ভিতর আর দুটি দেশ আছে—উত্তরে সেন্ট্রাল প্রভিনসেস ও দক্ষিণে উড়িষ্যা।
সেন্ট্রাল প্রভিনসেস পাহাড় ও জঙ্গলে ভরা। উড়িষ্যার অনেকটাই সমভূমি। মহানদী এই সমভূমি গড়েছে। এ দুটি দেশ সম্ভবত কখনোই দক্ষিণাভুক্ত হয় নি বলে একে উত্তরাপথের ভিতর টেনে আনা যায়। আজকাল আমরা যাকে বথে প্রেসিডেন্সি ও ম্যাড্রাস প্রেসিডেন্সি বলি, সে দুই এই দক্ষিণাপথেরই অন্তর্ভূত। শাধ, সিদেশটি ববের গভর্নরের অধীন হলেও দক্ষিণাপথের অন্তর্ভূত নয়।
ভারতবর্ষের উত্তরে হিমালয়ের উপরে চারিটি দেশ আছে, যেগলি ভারতবর্ষের অন্তর্ভূত। পশ্চিমে কাশ্মীর, তার পূর্বে নেপাল, তার পূর্বে সিকিম ও পূর্বপ্রান্তে ভুটান।
কাশ্মীরের লোকের ভাষা সংস্কৃতের অপভ্রংশ, নেপালের গুর্খাদেরও তাই; অপর পক্ষে সিকিম-ভুটানের ভাষা চীনবংশীয়। এই নেপালেই পশ্চিম ও দক্ষিণ থেকে আগত আর্যজাতি এবং পূর্ব ও উত্তর থেকে আগত চীনজাতি মিলেমিশে একজাতি হয়ে গিয়েছে। এ দেশে শুধু দুই জাতির নয়, দুই সভ্যতারও মিলন ঘটেছে। তাই নেপালে বৌদ্ধধর্ম ও হিন্দুধর্ম পাশাপাশি বাস করছে। কাশ্মীরে অবশ্য হিন্দুধর্ম ও মুসলমানধর্ম পাশাপাশি বাস করছে, কিন্তু এই দুই ধর্ম পরস্পরের অশ্য। ফলে উভয় ধর্মই নিজের স্বাতন্ত্র্য সম্পর্ক রক্ষা করে চলেছে। অপর পক্ষে নেপালের বৌদ্ধধর্মকে হিন্দুধর্মের বিকার অথবা নেপালের হিন্দুধর্মকে বৌদ্ধধর্মের বিকার বললেও অত্যুক্তি হয় না। সিকিম-ভুটানের সংস্রব আসলে বাংলাদেশের সঙ্গে। শুনতে পাই, বাংলার লোকের দেহে চীনের রক্ত আছে। সেইসঙ্গে বাঙালির মনেও কিঞ্চিৎ চৈনিক ধর্ম আছে কি না বলতে পারি নে।
দেশের পণ্ডিতলোক-সব আজকাল বেদের পুনরুদ্ধারের জন্য ভারতবর্ষের উত্তরপশ্চিম দেশে মহা খোঁড়াখুঁড়ি আরম্ভ করেছেন। বেদ উদ্ধারের পর আমাদের পণ্ডিতরা যদি তন্ত্রের সন্ধানে বেরোন, তা হলে, আমার বিশ্বাস, তাঁদের উত্তরপশ্চিম দেশকে গজভুক্ত কপিখবৎ ত্যাগ করে ভারতবর্ষের উত্তরপূর্বে আসতে হবে। তখন রিসার্চ ওঅক-এর পীঠস্থান হবে প্রথমে ভূটান, পরে সিকিম। তন্ত্রশাস্ত্রের পথি খললেই পাতায় পাতায় মহাচীনের সাক্ষালাভ ঘটে। সে যাই হোক, ভারতবর্ষের পশ্চিমে ইরান ও উত্তরে তুরানের মতো তার পূর্বে মহাচীনকেও পুরাতত্ত্ববিৎ ভাষাতত্ত্ববিং ও নতত্ত্ববিত্রা উপেক্ষা করতে পারেন না। সম্প্রতি অবগত হয়েছি যে, পণ্ডিতরা আজকাল Tarim দেশ নিয়েই উঠে-পড়ে লেগেছেন। Tarim অবশ্য চীন সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুত তুর্কস্থানে। সুতরাং আশা করা যায় যে, তাঁরা খোটান থেকে ভুটানে অচিরে নেবে পড়বেন।
ভারতবর্ষের প্রকৃতি
এতক্ষণে তোমরা ভারতবর্ষ নামক মহাদেশ, আর তার অন্তর্ভুত খণ্ড দেশগুলির আকৃতির মোটামুটি পরিচয় পেলে। এখন, তার প্রকৃতির পরিচয় সংক্ষেপে দেওয়া যাক।
প্রথমত ভারতবর্ষ হচ্ছে গ্রীষ্মপ্রধান দেশ। তবে উত্তরাপথের সঙ্গে দক্ষিণপথের এ বিষয়েও একটু প্রভেদ আছে। তোমরা বোধ হয় লোবে লক্ষ্য করেছ যে পিপের গায়ে লোহার পঞ্জার বাঁধনের মতো কতকগুলি কালো কালো রেখা এই গোলকটির দেহ বেষ্টন করে আছে। এই রেখাগুলির ভিতর দুটি রেখায় একটু বিশেষত্ব আছে। সে দুটি একটানা নয়, কাটা কাটা। এ উভয়ের মধ্যে ইকোয়েটরর উত্তরে যে রেখাঁটি আছে, সেটির নাম ট্রীপক অব ক্যানসার; আর ইকোয়েটরএর দক্ষিণে যেটি আছে, তার নাম ট্রপিক অব ক্যাপ্রিকর্ন।
সূর্যের সঙ্গে পৃথিবীর কি যোগাযোগ আছে, তাই দেখাবার জন্য এ দুটি রেখা আঁকা হয়েছে। এই রেখাঙ্কিত জায়গাতেই সূর্যের কিরণ পৃথিবীর উপর ঠিক খাড়া হয়ে পড়ে, অপর সব স্থানে তেরচা ভাবে। এই ট্রপিক অব ক্যানসারের উত্তরদেশ শীতের দেশ, আর ট্রপিক অব ক্যাপ্রিকর্নের দক্ষিণদেশও শীতের দেশ।
আর এই রেখাদ্বয়ের মধ্যের দেশ সব দারুণ গরম দেশ। ভারতবর্ষের উত্তরাপথ, প্রায় সমস্তটাই ট্রপিক অব ক্যানসারের উত্তরে, ও দক্ষিণাপথ আগাগোড়া তার দক্ষিণে। ফলে দক্ষিণাপথে শীতঋতু বলে কোনো ঋতু নেই। জনৈক ইংরেজ বলেছেন যে, দক্ষিণাপথ হচ্ছে Nine months hot and three months hotter। কথাটা কিপলিঙের মুখ থেকে বেরোলেও মিথ্যে নয়। উত্তরাপথে কিন্তু শীতগ্রীষ্ম দুই বেশি। দক্ষিণাপথে গ্রীষ্মকালে গরম যে উত্তরাপথের মতো অসহ্য হয় না, তার কারণ দক্ষিণাপথ উত্তরাপথের চাইতে প্রথমত উঁচু, দ্বিতীয়ত তার তিন দিক সমুদ্রে ঘেরা।
মাটি
তার পর ভারতবর্ষের এ দুই ভূভাগের মাটিও এক জাতের নয়, এবং তাদের গণাগণও পথক। মানুষের পৃথিবীর সঙ্গে কারবার প্রধানত মাটি নিয়ে। গাছপালা তৃণ শস্য সব মাটিতেই জন্মায়। এবং অনেক পণ্ডিতের মতে সব জীবজন্তুর ন্যায় মানুষের আদিমাতা হচ্ছে ভূমি। এ মতে যাঁরা বিশ্বাস করেন, তাঁরা কোন জমিতে কে জন্মেছে তার থেকেই মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব ও নিকৃষ্টত্ব নির্ণয় করেন।
এ সত্ত্বেও আমাদের জানা উচিত যে, মাটি হচ্ছে পৃথিবীর চামড়া মাত্র। ও চামড়ার নীচে পাথর আছে, যে পাথর থেকে কিছুই জন্মায় না।–জীবজন্তুও নয়, গাছপালাও নয়। মা-বসুন্ধরা আসলে পাষাণী।
এই মাটিও পাথরের বিকার মাত্র। অর্থাৎ পাথরকে ভেঙে মাটি তৈরি করতে হয়। পাথরকে চূর্ণ করা হচ্ছে জল আর বাতাসের কাজ।
নদনদী পাহাড় থেকে বেরোয়, পাহাড় ভেঙে। আর তারা যে চূর্ণপাষাণ বয়ে নিয়ে আসে, তাই দিয়ে যে মাটি গড়ে, সেই মাটিকে আমরা পলিমাটি বলি। সেই মাটিই প্রধানত গাছপালার জন্মভূমি। আর সমগ্র উত্তরাপথ প্রায় এই মাটিতেই তৈরি।
আমরা ভারতবর্ষকে উপদ্বীপ, পেনিনসুলা বলি; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ভারতবর্ষের ত্রিকোণ দক্ষিণাংশই একটি উপদ্বীপ। এ অংশ অতি পুরাকালে একটি দ্বীপ মাত্র ছিল। হিমালয় ও বিন্ধ্যপর্বতের মধ্যের দেশ তখন জলমগ্ন ছিল। তার পর সেই জলমগ্ন দেশ যখন হিমালয়ের নদনদীর কৃপায় উত্তরাপথ হয়ে উঠল, তখন তার দক্ষিণ দ্বীপ উত্তরাপথের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ভারতবর্ষ নামক মহাদেশ সৃষ্টি করল। দক্ষিণাপথ উত্তরাপথের চাইতে ঢের প্রাচীন দেশ। তোমরা যখন জিয়োলজি পড়বে, তখন এ দেশের বয়সের গাছপাথরের অথবা গাছপাথরের বয়সের হিসেব পাবে।
দক্ষিণাপথের বেশির ভাগ মাটি নদনদীর দান নয়। আগ্নেয়গিরি হতে যে গলা পাথরের (লাভা) উদগম হয়েছে, তাই চুর্ণ হয়ে হয়েছে দক্ষিণাপথের মাটি। উত্তরাপথ বরুণদেবতার সৃষ্টি, দক্ষিণাপথ অগ্নিদেবতার। এ দুই মাটি এক জাতেরও নয়, এ দুয়ের ধর্মও এক নয়।
এ দুই দেশের জলবায়ুও বিভিন্ন। মেঘ আসে সমুদ্র থেকে, আর পবনদেবই মেঘকে উড়িয়ে নিয়ে আসেন। সুতরাং কোন দেশে কত বৃষ্টি হয় তা নির্ভর করে কোন দেশে কোন দিক থেকে কি বাতাস বয়, তার উপর। তোমাদের পূর্বে বলেছি যে, সিন্ধুদেশ হচ্ছে অনাবৃষ্টির ও আসাম অতিবৃষ্টির দেশ। এর মধ্যবর্তী দেশ অল্পবন্টির দেশ। অপর পক্ষে দক্ষিণাপথের পশ্চিম উপকূল অতিবৃষ্টির দেশ, ও তার পূর্বে অংশই অনাবৃষ্টির দেশ।
যে বায়ুকে আমরা মনসুন নামে আখ্যাত করি, তার চলবার পথ হচ্ছে ভারতবর্ষের দক্ষিণপশ্চিম কোণ থেকে উত্তরপূর্বে কোণে। এ বাতাস মালাবার দেশকে জলে ভাসিয়ে দেয়। আবার বাংলায় ঢোকার পর এর গতি হয় দক্ষিণপূর্ব থেকে উত্তরপশ্চিমে। এই বাতাস বাংলা ও আসামের গায়ে প্রচুর জল ঢেলে দিয়ে তার পর উত্তরাপথের অন্তরে গিয়ে প্রবেশ করে। গ্রীষ্মঋতুর অবসানেই এ দেশে বর্ষাঋতু দেখা দেয়। মনসুন কিন্তু পঞ্চনদ পর্যন্ত ঠেলে উঠতে পারে না। এজন্য বাংলায় যখন বৃষ্টি হয়, পাঞ্জাব তখন শুখনো। পাঞ্জাবে শীতকালই বর্ষাকাল।
ভারতবর্ষের লোক শতকরা নব্বই জন হচ্ছে কৃষিজীবী। এই কারণে ভারতবর্ষ নাগরিক দেশ নয়, গ্রাম্য দেশ। এ দেশে সাত লক্ষ পঞ্চাশ হাজার গ্রাম আছে, আর পঁচাত্তরটি নগর নেই। নগরেও একরকম সভ্যতার সৃষ্টি হয়, যেমন হয়েছিল পুরাকালে গ্রীসের আথেন্স ও ইতালির রোম নগরীতে। আর সেই সভ্যতাই কতক অংশে বর্তমান ইউরোপের মনের উপর প্রভুত্ব করছে। এই শহরে মনোভাব থেকে নিষ্কৃতি না পেলে মানুষের মন ভারতবর্ষ ও চীনদেশের সভ্যতার প্রতি অনুকূল হয় না। এই কারণেই ইউরোপের সাধারণ লোক ও বর্তমান ভারতবর্ষের অসাধারণ লোকে–অর্থাৎ যারা শিক্ষা-দীক্ষার প্রভাবে বিলেতের সাধারণ লোকের শামিল হয়ে গিয়েছে, তারা ভারতবর্ষের সভ্যতাকে অসভ্যতা মনে করে।
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন যে, ইউরোপীয় সভ্যতা জন্মলাভ করেছে শহরে ও সেইখানেই লালিত-পালিত হয়েছে; অপর পক্ষে ভারতবর্ষের সভ্যতা জন্মগ্রহণ করেছে বনে, অর্থাৎ ঋষির আশ্রমে, ও সেইখানেই লালিত-পালিত হয়েছে।
এ দেশ যদি ঋষিক্ষেত্র হয়, তার কারণ এ দেশ মূলে কৃষিক্ষেত্র। বন গ্রামেরই অপর পৃষ্ঠা। আশ্রম মাটির নয়, মনেরই কৃষিক্ষেত্র।
আজকাল অনেক ইংরেজশিক্ষিত সদাশয় লোক ভিলেজ অরগ্যানিজেশন করবার জন্য অতিশয় ব্যাকুল হয়ে পড়েছেন। কিন্তু মানুষ কৃষিকর্মের জন্য যুগ যুগ ধরে যে অরগ্যানিজেশন করেছে, তারই নাম কি ভিলেজ নয়? ভিলেজ জিনিসটে শুধু অরগ্যানাইজড নয়, কালবশে প্রতি গ্রাম এক-একটি অরগ্যানিজম হয়ে উঠেছে। অরগ্যানিজমকে অরগ্যানাইজ করবার প্রবৃত্তিটি যেমন উচ্চ, তেমনি নিরর্থক। অরগ্যানিজমও ব্যাধিগ্রস্ত হয়; যদি আমাদের দেশের গ্রামসমূহ তাই হয়ে থাকে, তা হলে তাদের ব্যাধিমুক্ত করবার জন্য চিকিৎসার প্রয়োজন। কিন্তু চিকিৎসার নাম অরগ্যানিজেশন নয়; অরগ্যানাইজ্ মানুষে করে শুধু কলকারখানা। যে ভূভাগকে ভগবান চাষের দেশ করে গড়েছেন, তাকে আমরা পাঁচজনে কলকারখানার দেশ তৈরি করতে পারব না, তা চাষার মুখের গ্রাস কেড়ে টাটা কোম্পানির লোহার কলের পেট যতই ভরাই নে কেন। ভারতবর্ষ কখনো বিলেত হবে না। মনে ভেবো না যে আমি ধান ভানতে শিবের গীত গাইতে শুরু করেছি। পুরাণকাররা বলেছেন যে, ভারতবর্ষ হচ্ছে আসলে কর্মভূমি, আর এ দেশ সেই কর্মের ভূমি যে কর্ম দেবদানবরা করতে পারেন না। এ কর্ম হচ্ছে কৃষিকর্ম। আর এইটিই হচ্ছে, ভারতবর্ষের জিয়োগ্রাফির গোঁড়ার কথা আর অন্তরের কথা। আর এই ভিত্তির উপরেই ভারতবাসীর মনপ্রাণ গড়ে উঠেছে। এ সত্য উপেক্ষা করলে সেকালের ধর্মশাস্ত্রেও অধিকার জন্মাবে না, একালের অর্থশাস্ত্রেও অধিকার জন্মাবে না। আর তখন তোমরা ধর্ম বলতে বুঝবে অর্থ, আর অর্থ বলতে বুঝবে ধর্ম; যেমন আজকালকার পলিটিশিয়ানরা বোঝেন।
উদ্ভিদ
মানুষের জীবন উদ্ভিদের জীবনের অধীন। উদ্ভিদের কাছ থেকে যে আমরা শুধু অন্ন পাই তাই নয়, বস্ত্রও পাই। ভারতবর্ষের বক্ষলতা তৃণশস্য আমাদের এই দুই জিনিসই জোগায়। উত্তরাপথ প্রধানত আমাদের দেয় অন্ন, আর দক্ষিণাপথ বস্ত্র।
উত্তরাপথের পশ্চিমাংশ রুটির দেশ, পূর্বাংশ ভাতের দেশ। প্রথমত ধান জন্মায় অতিবৃষ্টির দেশে, ও গম জন্মায় অল্পবৃষ্টি এমন-কি, অনাবৃষ্টির দেশে। তার পর ধানের জন্য চাই নরম মাটি, ও গমের জন্য শক্ত মাটি। বাংলার মাটিও নরম আর এখানে বৃষ্টিও হয় বেশি, তাই বাংলা হচ্ছে আসলে ধানের দেশ। পাঞ্জাবে বৃষ্টি কম ও মাটি শক্ত, তাই পাঞ্জাবের প্রধান ফসল হচ্ছে গম। সিন্ধুদেশেও আজকাল দেদার গম জন্মাচ্ছে। অনেক উদ্ভিদের মাথায়ও জল ঢালতে হয়, গোঁড়ায়ও জল দিতে হয়। বৃষ্টির জলে স্নান না করতে পেলে ধান বাঁচে না। কিন্তু খেজুর গাছের মাথায় এক ফোঁটাও জল দিতে হয় না। গোঁড়ায় রস পেলে ও গাছ তেড়ে বেড়ে ওঠে। এ কারণ সাহারা মরুভূমি ও আরবদেশই আসলে খেজুরের দেশ। ও দুই মরভূমির ভিতর যেখানে একটু জল আছে, সেইখানেই চমৎকার খেজুর জন্মায়। জানোয়ারের ভিতর যেমন উট, গাছের ভিতর তেমনি খেজুর-মরুভূমিরই জীব। গমের মাথায়ও বারিবর্ষণ করবার দরকার নেই। মরুভূমির ভিতর নালা কেটে যদি জল নিয়ে যাওয়া যায়, তা হলেই সেখানে গম জন্মায় ও প্রচুর পরিমাণে জন্মায়। শস্যের যে শুধু পিপাসা আছে তাই নয়, খিদেও আছে। মাটির ভিতর যে রাসায়নিক পদার্থ ওরফে সার থাকে, তাই হচ্ছে শস্যের প্রধান খাদ্য। যে দেশে বেশি বৃষ্টি হয়, সে দেশের মাটি থেকে অনেক সময়ে এই সার ধুয়ে যায়। মরভূমির অন্তরে কিন্তু এ সার সঞ্চিত থাকে। সেখানে অভাব শুধু জলের। তাই মরভূমির অন্তরে জল ঢোকাতে পারলেই যে-সব শস্যের শুধু গোঁড়ায় জল চাই সে-সব শস্য প্রভূত পরিমাণে জন্মায়। সিন্ধুনদ থেকে খাল কেটে জল নিয়ে গিয়ে সিন্ধুদেশকে এখন শস্যশ্যামলা করে তোলা হয়েছে।
দক্ষিণাপথের ভিতরকার মাটি আগ্নেয়গিরি থেকে উদগত পাথর-ভাঙা মাটি। এ মাটিতে খাবার জিনিস তেমন জন্মায় না। আর দক্ষিণাপথের অপর মাটিও অতি নিরেস মাটি, তাতে ধান জন্মায় না, গমও জন্মায় না; জন্মায় শুধু বাজরি আর জোয়ারি, আর তারই রুটি খেয়েই এ দেশের লোক জীবনধারণ করে। এ দু ভাগের দুটি অংশ কিন্তু খুব উর্বর, পশ্চিমে মালাবার ও পূর্বে করমণ্ডল উপকূল। মালাবার নারিকেল গাছের দেশ, আর করমণ্ডল তাল গাছের। তা ছাড়া এই দেশে শস্যও প্রচুর জন্মায়। তবুও দক্ষিণাপথ নিজের দেশেরই খোরাক জুগিয়ে উঠতে পারে না; দেশে-বিদেশে অন্ন বিতরণ করা তো তার পক্ষে অসম্ভব।
কিন্তু এই দক্ষিণাপথের আর-একটি সম্পদ আছে। আগ্নেয়গিরির পাথর-ভাঙা মাটিকে ব্ল্যাক কটন সয়েল বলা হয়, কারণ ও-মাটির রঙ কালো ও তাতে কার্পাস জন্মায়। এ দেশে এত কার্পাস জন্মায় যে দক্ষিণাপথ শুধু সমগ্র ভারতবর্ষকে নয়, দেশ-বিদেশকে তুলো জোগায়। বাংলা যেমন ধানের দেশ, পাঞ্জাব যেমন গমের দেশ, দক্ষিণাপথ তেমনি মুখ্যত তুলোর দেশ। এ দেশ শুধু কাপাসের দেশ নয়, শিমুলেরও দেশ। অতি গোদাবরীতীরে বিশাল শাল্মলীতর-এ কথাটা শুধু গল্পের কথা নয়। দক্ষিণাপথের তুল্য বিশাল শাল্মলীতর, পৃথিবীর অন্য দেশে বিরল।
এই থেকে দেখতে পাচ্ছ যে ভারতবর্ষ, কি অন্ন কি বস্তু, কিছুরই জন্য অপর কোনো দেশের মুখাপেক্ষী নয়। আজকাল কেউ কেউ বাংলাদেশে কাপাসের চাষ করতে চান। এ চেষ্টা দক্ষিণাপথে ধানের চাষ চালাবার অনুরূপ। এ ইচ্ছা অবশ্য অতি সদিচ্ছা, কিন্তু এ ইচ্ছা জিয়োগ্রাফির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। সমগ্র ভারতবর্ষকে ঢেলে সাজাবার মহৎ বাধা হচ্ছে ভারতবর্ষের প্রকৃতি।
ভারতবর্ষের ঐক্য
ভারতবর্ষের জিয়োগ্রাফির পরিচয় দিতে হলে বোধ হয় এক বৎসর কাল লাগে। আমি আমার বরাদ্দ এক ঘণ্টার ভিতর সে দেশের আকৃতি ও প্রকৃতির মোটামুটি পরিচয় দিতে চেষ্টা করেছি। তাতে তোমাদের তরুণ জ্ঞানপিপাসা কতদূর মিটেছে বলতে পারি নে। যদি না মিটে থাকে তো আমার বক্তব্য এই যে— যত্নে কৃতে যদি ন সিধ্যতি কোহত্র দোষঃ।
এখন এই কথাটি তোমাদের বলতে চাই যে, এই সমগ্র দেশটি একদেশ। পৃথিবীতে আর যে-সব দেশ একদেশ বলে গণ্য, সে-সব ছোটো ছোটো দেশ। এক মহাচীন ব্যতীত অপর কোথাও এত বড়ো দেশ একদেশ বলে গণ্য হয় নি।
প্রথমত, এদেশের চতুঃসীমা এ দেশকে যেমন পরিচ্ছিন্ন করেছে, অন্য কোনো দেশকে তেমন করে নি। চীনদেশে এর তুল্য স্বাভাবিক সীমানা নেই, তাই চীনেরা তাদের দেশ প্রাচীর দিয়ে ঘিরতে চেষ্টা করেছিল, পাশাপাশি অন্যান্য দেশ থেকে স্বদেশকে পৃথক করবার জন্য। এ চেষ্টা অবশ্য ব্যর্থ হয়েছে।
হিমালয়ই হচ্ছে ভারতবর্ষের জিয়োগ্রাফির সবচেয়ে বড়ো জিনিস। পৃথিবীর আর-কোনো দেশের অত বড়ো প্রাচীর নেই। তার পর ঐ হিমালয়ই সত্যসত্য ভারতবর্ষের ভাগ্যবিধাতা ও জলবায়ুর নিয়ন্তা। হিমালয়ের জলই হচ্ছে উত্তরাপথের প্রাণ। আর হিমালয়ই সমগ্র ভারতবর্ষের বায়ুর চলাচল নিয়ন্ত্রিত করে। এর ফলে প্রায় সমগ্র ভারতবর্ষ এমন উর্বর, এমন মানুষের বাসোপযোগী দেশ হয়েছে। তার পর ভারতবর্ষের অন্তরে কোনো সমদ্র কিংবা হ্রদ নেই, আর তার মধ্যস্থ একমাত্র পর্বতশ্রেণী বিন্ধ্যশ্রেণী এত উচ্চ নয় যে, ভারতবর্ষের উত্তর-দক্ষিণকে একেবারে বিচ্ছিন্ন করে রাখতে পারে। তার পর এই একদেশ এত বৈচিত্র্যপূর্ণ যে, এক হিসেবে একে পৃথিবীর সংক্ষিপ্তসার বলা যেতে পারে।
ভারতবর্য মহাদেশটি অতি সুরক্ষিত দেশ। প্রকৃতি নিজ হাতেই এ দুর্গের পর্বতের প্রাকার ও সাগরের পরিখা গড়ে দিয়েছেন। তবে এ দেশ এশিয়ার অপরাপর দেশ হতে বিচ্ছিন্ন হলেও তাদের সঙ্গে একেবারে যোগাযোগশন্য নয়। পূর্বেই বলেছি যে, উত্তরাপথের পশ্চিমে দুটি প্রবেশদ্বার আছে—উত্তরে খাইবার পাস ও দক্ষিণে বোলান পাস। অতীতে এই দুই রন্ধ্র দিয়ে ইরানি তুরানি শক হূন যবন বাহ্লিক মোগল পাঠান প্রভৃতি জাতিরা এ দেশে প্রবেশ করেছে, কিন্তু সহজে নয়। খাইবার পাস দিয়ে ঢুকলে পাঞ্জাবের পঞ্চনদ পার হয়ে এসে গঙ্গাযমুনার দেশে পৌঁছতে হত, আর বোলান পাস দিয়ে এলে বিদেশীদের বুকে মরুভূমি ঠেকত।
ভারতবর্ষের অন্তরে প্রবেশ করবার আসল দ্বার হচ্ছে দিল্লি নামক শহর। কারণ সেখানে মরভূমি ও আরাবলি পর্বত শেষ হয়ে শস্যশ্যামল সমভূমি আরম্ভ হয়েছে। সেই মিলনস্থানেই মোগল-পাঠানরা দিল্লি নগর প্রতিষ্ঠিত করেছে। আর্যদের ইন্দ্রপ্রস্থ নগরও এইখানেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আর, দিল্লির উপকণ্ঠেই ভারতবর্ষের সর্ব প্রধান রণক্ষেত্র। কুরুক্ষেত্র থানেশ্বর পাণিপথ এ-সবই প্রায় এক জায়গায়। পুরাকালে দিল্লির গেট না ভেঙে কোনো বিদেশী জাতি ভারতবর্ষের ভিতর প্রবেশ করতে পারে নি। ফলে যে-সকল জাত ও-দ্বার খুলতে পারে নি তারা হয় দেশে ফিরে গিয়েছে, নয় সিন্ধু ও পঞ্চনদ-দেশ অধিকার করে বসেছে।
ভারতবর্ষের সমুদ্রকূলেও দু-চারটি ছাড়া আর প্রবেশদ্বার ছিল না, আর সে-কটি বন্দর দক্ষিণাপথের পশ্চিম উপকূলে; উত্তরে ভৃগুকচ্ছ ও সুরপারগ এবং দক্ষিণে কালিকট ও কোচিন।
এই-ক’টি দ্বার দিয়েই ইউরোপীয় জাতিরা জাহাজে করে সমুদ্র পার হয়ে এ দেশে প্রবেশ করেছে। পোর্তুগিজ ওলন্দাজ ইংরেজ ও ফরাসিরা এই পথ দিয়েই ভারতবর্ষে ঢুকেছে। ভারতবর্ষে প্রবেশ করবার স্থলপথ এখন বন্ধ। খাইবার পাস এবং বোলান পাস এই দুই দুয়োরই এখন দুর্গ দিয়ে সুরক্ষিত; কিন্তু জলপথ এখন পশ্চিম দক্ষিণ ও পূর্ব তিন দিকে খোলা। এখন ভারতবর্ষের সঙ্গে এশিয়ার যোগ ছিন্ন হয়েছে, তার পরিবর্তে নূতন যোগ স্থাপিত হয়েছে ইউরোপের সঙ্গে; সে যোগ অবশ্য দৈহিক নয়, মানসিক।
এই এক ঘণ্টা ধরে তোমাদের কাছে ভারতবর্ষের যে মোটামুটি বর্ণনা করলাম, সে বর্ণনার ভিতর থেকে তার একটা অঙ্গ বাদ পড়ে গেল। দেশের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক অতি ঘনিষ্ঠ। সুতরাং ভারতবাসীদের কথা বাদ দিয়ে ভারতবর্ষের জিয়োগ্রাফির বর্ণনা পূর্ণাঙ্গ হয় না। তবে-যে ভারতবর্ষের নানা দেশের নানা জাতীয় লোকের রূপগণের পরিচয় দিতে চেষ্টামাত্র করি নি, তার কারণ সে পরিচয় দেওয়া আমার পক্ষে অসাধ্য। অ্যানথ্রপলজি নামক বিজ্ঞান আমি জানি নে, আর সে বিজ্ঞানেরও এ বিষয়ে বিশেষ কোনো জ্ঞান নেই। অ্যানথ্রপলজি এ বিষয়ে সত্য খুঁজছে, কিন্তু আজও তার সাক্ষাৎ পায় নি। আজ এক অ্যানথ্রপলজিস্ট যা বলেন, কাল অপর অ্যানথ্রপলজিস্ট তার খণ্ডন করেন। সুতরাং ও-শাস্ত্রের মনগড়া কথা সব তোমাদের নিয়ে কোনো লাভ নেই; বরং সে-সব কথা শোনায় তোমাদের ক্ষতি আছে। বিজ্ঞানের নাম শুনলেই আমরা অজ্ঞান হই। অর্থাৎ ঐ নামে যে-সব কথা চলে, সে-সব কথাকে এ যুগে বেদবাক্য বলে মেনে নিই। আমাদের মতো বয়স্ক লোক দেরই যখন মনের চরিত্র এহেন, তখন তোমাদের পক্ষে এ-সব অনিশ্চিত বিজ্ঞানের সুনিশ্চিত কথা শোনায় ভয়ের কারণ আছে। তোমাদের মন স্বভাবতই বিশ্বাসপ্রবণ। বিজ্ঞানের কথা ছেড়ে দাও, খবরের কাগজের কথাতেও তোমরা বিশ্বাস কর। বুজরুক শব্দটার মানে শুনতে পাই জ্ঞানী। বুজরুক নামক জ্ঞান নিয়েই কাগজওয়ালাদের কারবার। আর নিত্য দেখতে পাই যে, সেই বুজরুকি কথা তোমাদের নরম মনে এমনই বসে যায় যে, সে কালির ছাপ অনেকের মনে চিরজীবন থেকে যায়। সুতরাং ভারতবর্ষের নৃতত্ত্ব অথবা জাতিতত্ত্ব নিয়ে তোমাদের সব মনকে ব্যস্ত করবার কোনো প্রয়োজন নেই।
ভারতবর্ষের সকল লোক যে এক জাতির নোক নয়, এ সত্য তো সকলের কাছেই প্রত্যক্ষ। এ দেশে বিভিন্ন প্রদেশের লোকের রূপের ও বর্ণের ভিতর কতটা স্পষ্ট প্রভেদ আছে তা সকলেরই চোখে পড়ে। এর থেকে অনুমান করা যেতে পারে যে, তাদের প্রকৃতিও বিভিন্ন। আমি পূর্বে তোমাদের বলেছি যে, পৃথিবীর জিয়োগ্রাফিকাল ভাগ ও পলিটিকাল ভাগ এক নয়। এ দেশের যে পলিটিকাল হিসেবে এক জাত হতে পারে, কিন্তু বৈজ্ঞানিক হিসেবে এক জাত নয়। জিয়োগ্রাফির ভাগের হিসেবে তাদের জাতেরও স্পষ্ট ভাগ আছে। পলিটিক্সের হিসেবে কাশ্মীরি পণ্ডিত অবশ্য তামিল নাইডুর সহোদর, কিন্তু জিয়োগ্রাফির হিসেবে এরা পরস্পরকে কিছুতেই দেশকা ভাই বলতে পারেন না। আজ আমি তোমাদের কাছে যতদূর সংক্ষেপে পারি ভারতবর্ষের বর্তমান জিয়োগ্রাফির বর্ণনা করলুম; বারান্তরে তোমাদের ভারতবর্ষের প্রাচীন জিয়োগ্রাফি ও প্রাচীন ভারতবর্ষের জিয়োগ্রাফির কথা শোনাব। পুরাকালেও স্বদেশের জিয়োগ্রাফি জানবার কৌতূহল লোকের ছিল, এবং এ বিষয়ে যেটকু জ্ঞান তারা সংগ্রহ করেছিলেন তা তাঁরা লিখে রেখে গিয়েছেন; আর তার থেকেই জানা যায় যে, কালক্রমে ভারতবর্ষের জিয়োগ্রাফির কিঞ্চিৎ পরিবর্তন ঘটেছে।
তোমাদের ভরসা দিচ্ছি যে, সে বর্ণনা এ বর্ণনার চেয়ে ঢের ছোটো হবে, আর আশা করি ঢের বেশি সরস হবে। যে-সব দেশের, যে-সব শহরে, যে-পাহাড়ে, যে-সব নদীর নাম আমরা রামায়ণ-মহারতে পড়ি, তারা কোথায় ছিল আর তাদের ভিতর কোনটি, স্বনামে না হোক, স্বরূপে বিরাজ করছে, সে-সব ক নেতে তোমাদের নিশ্চয়ই ভালো লাগবে। সেকালের ভারতের পরিচয় দিতে আমাকে কষ্ট করতে হবে, কিন্তু শুনতে তোমাদের কোনো কষ্ট হবে না।
মাঘ ১৩৩২