সেকালে ভারতবর্ষ ছিল মীমাংসার যুগ, একালে হয়েছে সমস্যার। এ কথা যে সত্য, এতগুলো কমিশনই তার প্রমাণ। এই আজকের দিনে পাঁচ-পাঁচটা কমিশনের প্রসাদে পাঁচ-পাঁচটা সমস্যা রাজদরবারে টাঙানো রয়েছে; যথা : ১ চাকরির সমস্যা, ২ স্বরাজের সমস্যা, ৩ অরাজকতার সমস্যা, ৪ শিল্পের সমস্যা, ৫ শিক্ষার সমস্যা; তার উপর আবার এসে জুটেছে বিয়ের সমস্যা।
এর পর জন্ম মৃত্যু বাদে দুনিয়ার আর কোন সমস্যা বাকি রইল? ও-দুটির যে কোনো সমস্যা নেই, তার কারণ ও-দুটিই হচ্ছে রহস্য। তবে এ দেশে জন্মটা বড়ো রহস্য না মৃত্যুটা বড়ো, এ বিষয়ে একটা তর্ক অবশ্য উঠতে পারে। কিন্তু ওঠে না এইজন্য যে, তার মীমাংসাও স্পষ্ট। আমাদের পক্ষে ও-দুইই সমান।
এ যুগ সমস্যার যুগ, বিশেষ করে এই কারণে যে, এ যুগে অধিকারীভেদ নেই। জীবন, তা সে ব্যক্তিগতই হোক আর জাতিগতই থোক, চিরকালই একটা সমস্যা; কিন্তু সেকালে এ সমস্যা নিয়ে মাথা কাত দু-চার জন; আর একালে কোনো বিষয়ে একটা সমস্যা উঠলে আমরা সকলে মিলে তার মীমাংসা করতে বাধ্য। যেকালে সকলের সকল বিষয়ে মত দেবার অধিকার আছে, সেকালে কোনো বিষয়েই কারো চুপ করে থাকবার অধিকার নেই। যদি বল, যার নিজের একটা মত গড়বার সামর্থ্য নেই, এক কথায় যার মত বলে কোনো পদার্থই নেই, সে সে-পদার্থ দান করে কি করে। তার উত্তর, মনের ঘরে যার শূন্য আছে, সে শুন্যই দিতে পারে; শুধু যে দিতে পারে তাই নয়, দেশের ও দশের মঙ্গলের জন্য তার পক্ষে তা দেওয়া একান্ত কর্তব্য। একের পিছনে শুন্য বসালে তা যে দশগুণ বেড়ে যায়, এ কথা কে না জানে। সুতরাং যার হোক একটা মতের পিছনে আমরা যদি ক্রমান্বয়ে শনা বসিয়ে যাই, তা হলে সঙ্গে সঙ্গে তার দশগুণ করে মূল্য বেড়ে যাবে।
সত্য কথা বলতে গেলে, রাজনৈতিকপ্রমুখ বিষয়ে অধিকাংশ লোকের পক্ষে কোনোরূপ মত না থাকাটাই শ্রেয়। সকলেরই যদি একটা-না-একটা স্বমত থাকে, তা হলে নানা মতের সৃষ্টি হয়; অপর পক্ষে অধিকাংশ লোক মতশূন্য হলে যা সৃষ্টি হয়, তার নাম লোকমত। আর, এ কথা বলা বাহুল্য যে, একালে লোকমতই হচ্ছে একমাত্র কেজো মত, কেননা ও-মতের অভাবে হয় কোনো বিলই পাস হয় না, নয় সকল বিলই পাস হয়।
এর কারণও খুঁজে বার করতে হবে না। নানা মত পরস্পরের সঙ্গে কাটাকাটি গিয়ে বাকি থাকে শুধু শন্য, আর শনন্য শন্যে যোগ দিলে দাঁড়ায় গিয়ে বিরাট একে। এই সত্যই যে সার সত্য, তার প্রমাণ দার্শনিক এবং বৈজ্ঞানিক, দরকম অদ্বৈতবাদের মধ্যে সমান পাওয়া যায়।
২.
উপরে যে-সব সমস্যার ফদ দেওয়া গেছে, তার উপর সম্প্রতি আর-একটি সমস্যা এসে জটেছে, যার বিশেষত্ব হচ্ছে এই যে, তার কোনো মীমাংসা নেই অথচ অনেক তর্ক আছে।
সমস্যাটা হচ্ছে এই যে, ভারতবর্ষ সভ্য কি না। দেখতে পাচ্ছেন সমস্যাটা কত ঘোরতর, কত গুরতর। এ সমস্যা অবশ্য রাজনৈতিকও নয়, সামাজিকও নয়, কিন্তু সকলপ্রকার রাজনৈতিক এবং সামাজিক সমস্যা ওরই অন্তর্ভূত।
যদি জিজ্ঞাসা করেন, যার মীমাংসা নেই, এমন সমস্যা ওঠে কেন। তার উত্তর একজনে এর পর্বমীমাংসা করে দিয়েছেন বলেই আর পাঁচজনে তার উত্তরমীমাংসা করতে বদ্ধপরিকর হয়েছে। ফলে, ব্যাপারটা দাঁড়িয়েছে একটা বিষম তর্কে।
উইলিয়ম আর্চার নামক জনৈক ধনধর ইংরেজি লেখক এবং প্রবীণ ভাবক, ভারতের নানা দেশ পর্যটন করে অবশেষে উপনীত হয়েছেন এই সিদ্ধান্তে যে, ভারতবাসীরা হচ্ছে অসভ্য জাতিদের মধ্যে সবচাইতে সভ্য এবং সভ্য জাতিদের মধ্যে সবচাইতে অসভ্য।
অমনি আমরা অস্থির হয়ে উঠেছি।
এ কথায় কিন্তু বিচলিত হবার কোনো কারণ আমি দেখতে পাই নে। উইলিয়ম আচারের মত যদি সত্য বলেই ধরে নেওয়া যায়, তাতেই বা ক্ষতি কি। আমরা যদি সভ্যতার মধ্যপথ অবলম্বন করে থাকি, তা হলে তো আমরা আরিস্টটলের মতে ঠিক পথই ধরেছি, বৌদ্ধ মতেও তাই। আর সেকেলে দর্শন যদি বাতিল হয়ে গিয়ে থাকে, তা হলে বলি হেগেলের মতেও দাঁড়ায় এই যে, সভ্যতা (thesis) + অসভ্যতা (antithesis) = সভ্যাসভ্যতা (synthesis); অর্থাৎ আমাদের সভ্যাসভ্যতাটা হচ্ছে synthetic civilization। অতএব সর্বশ্রেষ্ঠ। বেশি অসভ্য হওয়া যে ভালো নয়, সে তো পুরানো সত্য; আর বেশি সভ্য হওয়াও যে মারাত্মক, এই নতুন সত্য তো ইউরোপে হাতে-হাতে প্রমাণ হয়ে গেল। এক দিকে সভ্যতা আর-এক দিকে অসভ্যতা, এই দুই চাপের ভিতর পড়াটা অবশ্য সুখের অবস্থা নয়; কিন্তু আমাদের বর্তমান অবস্থা যে সুখের অবস্থা, এমন কথা আর যেই বলক, আমরা তো কখনো বলি নে।
আর-এক কথা, কি সভ্যতা কি অসভ্যতা এ দুয়ের কোনোটিরই ভিতর মানুষের শান্তি নেই–না দেহের না মনের। যারা নিজেদের অসভ্য বলে জানে, তারা সভ্য হবার জন্য লালায়িত হয়; আর যারা নিজেদের সভ্য বলে জানে, তারা স্বাভাবিক হবার জন্য লালায়িত হয়। পুরাকালে ভারতবর্ষ যখন অতিসভ্য হল, তখন ভারতবাসী সভ্যতার শিকলি কেটে বনে যাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠল; এবং একই অবস্থায় একই কারণে গ্রীকরা হল ফিলজফর আর রোমানরা খান। তার পর যখন নব রোমক-খস্টান-সভ্যতা পুরোপুরি গড়ে উঠল, তখন রসো সকলকে পরামর্শ দিলেন আবার প্রকৃতির কাছে ফিরে যেতে— অমনি দেশসদ্ধ লোক মেতে উঠল। অপর পক্ষে যাদের জ্ঞান তারা অসভ্য, তারা যে সভ্য হবার জন্য আঁকুবাঁকু করে তার প্রমাণ কি আর উদাহরণের অপেক্ষা রাখে। অতএব এ কথা নিয়ে বলা যায় যে, শান্তি যদি কোথাও থাকে তো সভ্যতা আর অসভ্যতার মিলনক্ষেত্রে; কেননা ও-ক্ষেত্রে অসভ্যতা সভ্যতার এবং সভ্যতা অসভ্যতার তেজ বিলকু ও বেমালুম মেরে দেয়। সুতরাং একাধারে সভ্য এবং অসভ্য হওয়াটাই বুদ্ধিমান জাতের কাজ; আর আমাদের মাথায় যে মগজ নেই, এমন কথা উইলিয়ম আর্চারও বলেন না।
আমার এ-সব কথা যতই যুক্তিযুক্ত হোক-না কেন, আমার মত কেউ গ্রাহ্য করবেন। কেননা এক দল প্রমাণ করতে যেমন ব্যস্ত যে আমরা অতি-সভ্য, আর-এক দল প্রমাণ করতে তেমনি ব্যস্ত যে আমরা অতি-অসভ্য। সুতরাং এ দুই দলকে কেউ ঠেকাতে পারবে না; তাঁরা তর্ক করবেনই, শুধু উইলিয়ম আচারের সঙ্গে নয়, পরস্পরের সঙ্গেও।
এ উভয়কেই আমি বলি, খিরো ভব। আমরা যে অসভ্য, এ প্রমাণ করবারই বা সার্থকতা কি। আর আমরা যে সভ্য, এ প্রমাণ করবারই বা সার্থকতা কি। কেউ যদি প্রমাণ করে দেয় যে আমরা অসভ্য, তা হলেই কি আমাদের অস্তিত্ব লোপ পাবে, না, আমাদের জীবনের সকল সমস্যা উড়ে যাবে? তা অবশ্য কখনোই হবে না, উপরন্তু আর-একটা সমস্যা বাড়বে, সে হচ্ছে সভ্য হবার মহাসমস্যা।
অপর পক্ষে আমরা যদি প্রমাণ করে দিই যে আমরা সভ্য, তা হলেই কি আমাদের অস্তিত্ব সম্পূর্ণ হয়ে উঠবে, না, আমাদের জীবনের সকল সমস্যার চড়ান্ত মীমাংসা হয়ে যাবে? তা অবশ্য কখনোই হবে না। কেননা নিজের সার্টিফিকেট নিজের কোনো কাজে লাগে না, ব্যক্তির পক্ষেও নয় জাতির পক্ষেও নয়। তা ছাড়া নিজের দরখাস্তের বলে, এ ক্ষেত্রে পরের কাছ থেকে ভালো সার্টিফিকেট আমরা কিছুতেই আদায় করতে পারব না। সভ্যতা সম্বন্ধে প্রতি জাত নিজেকে সোহহং মনে করে, কিন্তু অপর কোনো জাতকে তত্ত্বমসি বলতে প্রস্তুত নয়। তবে প্রাচীন সভ্যতার সম্বন্ধে এ কথা অবশ্য খাটে না। প্রাচীন গ্রীক ও রোমান সভ্যতার সুখ্যাতি যে ইউরোপের মুখে আর ধরে না, এ কথা কে না জানে। তার কারণ এই যে, যে সভ্যতা মরে ভূত হয়ে গেছে, উঁচুগলায় তার গুণগান করবার ভিতর কোনো বিপদ নেই; কেননা কোনো জ্যান্ত সভ্যতার উপর ও-সব মরা সভ্যতার কোনো দাবি নেই। প্রাচীন ও মত সভ্যতা কোনো বতমান সভ্যতার কাছ থেকে কিছু আদায় করতে পারে না, কিন্তু বর্তমান সভ্যতা তার কাছ থেকে ঢের আদায় করে, এবং তার নন খায় বলেই তার গুণে গায়। ভারতবর্ষের সভ্যতা গ্রীস-রোমের সভ্যতার মতো প্রাচীন হলেও প্ৰশস্য নয়; কেননা তা মত নয়, জীবিত। এ সভ্যতার অমার্জনীয় অপরাধ এই যে, তা আজও বেচে আছে, এবং বহুকাল বেচে আছে বলে আরো বহুকাল বেচে থাকতে চায়; তাই তার দাবির আর অন্ত নেই। এ সভ্যতার সপক্ষে ইউরোপের সাটিফিকেট বার করা অসম্ভব। আর যদিই বা করা যায়, তাতেই বা কি লাভ? আমাদের জাতীয় সমস্যার আশ মীমাংসা ততটা নির্ভর করবে না আমাদের প্রাচীন সভ্যতা কিংবা অসভ্যতার উপর যতটা নির্ভর করবে ইউরোপের বর্তমান সভ্যতা কিবা অসভ্যতার উপর।
যদি কেউ বলেন যে, ইউরোপের খাতিরে নয়, সত্যের খাতিরে আমরা প্রমাণ করতে চাই যে, ভারতবর্ষ সভ্যতার উত্তরে আমার বক্তব্য এই যে, ও চেষ্টায় উলটো উৎপত্তি হবারই সম্ভাবনা বেশি। মানুষ যেমন মুখের জোরে নিজেকে অপরের চাইতে বেশি ভদ্র প্রমাণ করতে গিয়ে শুধু অভদ্রতারই পরিচয় দেয়, জাতিও তেমনি নিজেকে অপরের চাইতে বেশি সভ্য প্রমাণ করতে গিয়ে শুধু অসভ্যতারই পরিচয় দেয়। এর প্রথম কারণ, সভ্যতা প্রমাণ করতে হয় হাতে-কলমে, কাগজে-কলমে নয়; কেননা ও-বস্তু আত্মপ্রতিষ্ঠিত হয় যুক্তির বলে নয়, কর্মের ফলে। এর দ্বিতীয় কারণ, মানুষ সভ্য হলেও মানুষই থাকে; সভ্য মানবেরও সত্তার মূলে রয়েছে আদিম মানব। সুতরাং মানুষ যখন অবিবাসী লোকের সম্মুখে নিজেকে সভ্যমানব বলে খাড়া করতে যায়, তখন প্রায়ই দেখা যায় যে, ও-ক্ষেত্রে যাকে খাড়া করা হয় সে হচ্ছে আদিম মানব; কেননা এরকম কাজ মানুষে এক রাগের মাথায় ছাড়া আর-কোনো অবস্থায় করে না। প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিতা থাকলে মানুষে যে এ কাজ করে না, তার কারণ ও-কাজ করা হয় অনাবশ্যক, নয় নিরর্থক। সভ্যতা বলে যদি মানবসমাজে কোনোএক বস্তু থাকে, তা হলে সভ্যসমাজ মাত্রেই তার সঙ্গে পরিচিত। যা প্রত্যক্ষ, তার অস্তিত্ব প্রমাণ অনাবশ্যক। আর অসভ্যের কাছে তার অস্তিত্ব প্রমাণ করতে যাওয়া বিড়ম্বনা, কেননা কোনো প্রমাণ-প্রয়োগের দ্বারা অসভ্যের কাছে সভ্যতাকে প্রত্যক্ষ করে তোলা যাবে না।
মতান্তরে সভ্যতা এক বস্তু নয়, কিন্তু দেশভেদে ও কালভেদে সভ্যতা হরেক রকমের হয়ে থাকে। সভ্যতার ভিতরও বিশিষ্টতা আছে, এবং সভ্যতায় আর সভ্যতায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে পার্থক্য এত বেশি যে, তাদের মিলন কস্মিনকালেও হবে না। এ মতের চরম বাণী হচ্ছে কিপলিঙের এই কথা
The East is East and the West is West, and never the twain shall meet. এ কথা দেশে-বিদেশে অনেকে বেদবাক্য বলে গ্রাহ্য করেছেন, কিন্তু আমার কাছে বরাবর তা নিরর্থক প্রলাপ বলেই মনে হয়েছে, কেননা ও-কথার অর্থ আমি কখনো বুঝতে পারি নি। সম্প্রতি বটিশ সভ্যতার একটি অগ্রগণ্য মুখপত্রে তার ব্যাখ্যা দেখে নিশ্চিন্ত হলুম। SPECTATOR লিখেছেন, কিপলিঙের ও-কথার সাদা অর্থ হচ্ছে।
Black is black and white is white.
এ ব্যাখ্যা যে অতি বিশদ, সে বিষয়ে আর কোনো সন্দেহ নেই; কিন্তু সেইসঙ্গে এ বিষয়েও কোনো সন্দেহ নেই যে, প্লেটের বৃটিশ সভ্যতার পরিচয় দিতে গিয়ে শুধু বৃটিশ অসভ্যতারই পরিচয় দিয়েছেন। এর পর নিজের সভ্যতার বিশিষ্টতার ব্যাখ্যান করতে সকলেরই ভয় পাওয়া উচিত।
কোনো সভ্যতার বিশিষ্টতার প্রতি বিশেষ করে নজর দেওয়াতেও বিপদ আছে। ও অবস্থায় বিশিষ্টতাকেই সভ্যতা বলে মানুষের সহজে ভুল হয়। অপর সমাজের সঙ্গে নিজের সমাজ যে অংশে বিভিন্ন, সেই অংশকেই নিজের সভ্যতার প্রধান অঙ্গ বলে অহংকার করবার লোভ যায়। শুধু তাই নয়, তখন সেই অঙ্গকেই যেন-তেনপ্রকারেণ রক্ষা করবার জন্য মানুষ বদ্ধপরিকর হয়ে ওঠে; আর তার ফলে যদি সমাজের সকল অঙ্গ পঙ্গু হয়ে যায়, তাতেও সমাজ তার নিজের গোঁ ছাড়ে না। উদাহরণ স্বরূপ, এই প্যাটেল-বিলের বিপক্ষ দলের কথাই ধরা যাক-না। এরা বলেন, জাতিভেদ-প্রথা যখন হিন্দুসমাজ ছাড়া অপর কোনো সভ্যসমাজে নেই, তখন হিন্দুসভ্যতার ভিত্তিই হচ্ছে জাতিভেদ-প্রথা। অতএব হিন্দুসভ্যতার বিশিষ্টতা, অর্থাৎ জাতিভেদ-প্রথা, বজায় রাখতেই হবে, তার জন্য যদি হিন্দু,জাতি ধলাশায়ী হয়, তাতেও কোনো ক্ষতি নেই। এ কথা বলাও যা, আর স্পেক্টেটরের কথায় সায় দেওয়াও তাই। স্পেক্টেটরের এ মত শুধু একমাত্র বর্ণভেদের উপরই প্রতিষ্ঠিত। ওরকম ঢেরা-সই দেওয়াতে বর্ণ ধর্মজ্ঞানের পরিচয় দেওয়া যেতে পারে কিন্তু বর্ণজ্ঞানের পরিচয় দেওয়া হয় না, ধর্মজ্ঞানেরও নয়। জাতিভেদ-প্রথা হিন্দুসমাজের গোঁড়ার কথা হলেও হিন্দুসভ্যতার শেষ কথা নাও হতে পারে।
সভ্যতার অবশ্য নানা রূপ, বিশেষ্য ও বিশেষণ আছে; কিন্তু তার ক্রিয়া এক, এবং সে ক্রিয়া হচ্ছে মানবজীবনের মুখ্য ক্রিয়া, to be। এ কথায় অবশ্য তারা আপত্তি করবেন, যাঁদের বিশ্বাস মানবপ্রকৃতির মূল ধাতু হচ্ছে to have। কিন্তু এঁরা ভুলে যান যে, জীবনে কিছু পেতে হলে তার আগে কিছু হতে হয়। এক সভ্যতার সঙ্গে আর-এক সভ্যতার গড়নের পার্থক্য ঘটে শুধু বাহ্যবস্তুর আনকল্যে এবং প্রতিকলতায়। এ পার্থক্য প্রাচীনকালে যেমন স্থূল ছিল, বর্তমানে তেমনি সক্ষম হয়ে আসছে; তার প্রথম কারণ, একালে এক জাতির সঙ্গে আর-এক জাতির দেশের ও সেইসঙ্গে দেহের এবং মনেরও ব্যবধান কমে আসছে। আর তার দ্বিতীয় কারণ এই যে, বর্তমানে মানুষ বস্তুজগতের ততটা অধীন নয়, বস্তুজগৎ মানুষের যতটা অধীন। জাতিতে জাতিতে মনের ও ব্যবহারের পার্থক্য কমে আসছে বলে এ ভয় পাবার দরকার নেই যে, মানবজীবন বৈচিত্র্যহীন হয়ে পড়বে। জাতিতে জাতিতে প্রভেদ যেমন কমে আসছে, ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে প্রভেদ তেমনি বেড়ে চলেছে। এক কথায় বিশিষ্টতা এখন জাতিকে ত্যাগ করে ব্যক্তিকে আশ্রয় করেছে। আমার বিশ্বাস, ভবিষ্যতের মানবসভ্যতা এই ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের গুণে অপূর্ব বৈচিত্র্য লাভ করবে এবং এই বিচিত্রতাই হবে তার বিশিষ্টতা। অন্তত আমাদের সভ্যতার জন্যে সে ভাবনা নেই। ভারতবর্ষ যদি একদেশ হিসেবে ধরা যায়, তা হলে সে দেশের সভ্যতা যুগপৎ হরবোলা ও বহুরূপী হতে বাধ্য।
ভবিষ্যতে যা হবার সম্ভাবনা তা নাও হতে পারে; কিন্তু অতীতে যা হয়ে গেছে তা যে হয়ে গেছে তার আর সন্দেহ নেই। এবং প্রতি প্রাচীন সভ্যতার যে একটা বিশেষ রূপ ও বিশেষ ধর্ম আছে, সে কথাও অস্বীকার করা অসম্ভব। অথচ এ-সকল সভ্যতার সামাজিক ব্যবহার এবং মনোভাবের মিলও বড়ো কম নয়। পণ্ডিত ব্যক্তিদের মতে গ্রীক রোমান এবং হিন্দু সভ্যতার ভিতর ঠিক ততখানি মিল আছে গ্রীক লাটিন ও সংস্কৃত ভাষার ভিতর যতখানি মিল আছে; এবং সে মিল প্রথমত কম নয়, দ্বিতীয়ত তা ধাতুগত। যদিচ আমি পণ্ডিত নই, তবও এ মত গ্রাহ্য করতে আমি কিছুমাত্র কুণ্ঠিত নই। তার কারণ, আমার বিশ্বাস, সকল সভ্যতারই ধাতু এক, প্রত্যয় শুধু; আলাদা। সে যাই হোক, যে-ক’টি প্রাচীন সভ্যতার সঙ্গে আমার পরিচয় আছে, সে সবগুলিই, আমার মনে হয়, একজাতীয়, অর্থাৎ আমার কাছে তার প্রতিটি হচ্ছে এক-একখানি কাব্য। কাব্যে-কাব্যে যে প্রভেদ থাকে এদের পরস্পরের ভিতর সেই প্রভেদ মাত্র আছে। আমার মতে গ্রীক সভ্যতা হচ্ছে নাটক, রোমান সভ্যতা মহাকাব্য, ইহদি সভ্যতা লিরিক এবং অর্বাচীন যুগের ইতালীয় সভ্যতা সনেট; আর ভারতবর্ষের প্রাচীন সভ্যতা হচ্ছে রূপকথা। সভ্যতার সঙ্গে কাব্যের তুলনা দেওয়ায় যদি কেউ আপত্তি করেন, তা হলে বলি, ও তুলনা একটা খামখেয়ালির ব্যাপার নয়। আমরা প্রাচীন সভ্যতার যে-সব মতি গড়ি-হয় পুজা করবার জন্য, নয় মনের ঘর সাজাবার জন্য-অতীত শুধু তার উপাদান জোগায়, তাও আবার অতি স্বল্পমাত্রায়; সেই উপাদানকে আমাদের কল্পনাশক্তি গড়ন ও রূপ দেয়, এবং সেই রূপকে আমরা আমাদের হৃদয়রাগে রঞ্জিত করি। কাব্যরচনার পদ্ধতিও ঐ।
সত্য কথা এই যে, সভ্যতা হচ্ছে একটা আর্ট এবং সম্ভবত সবচাইতে বড়ো আর্ট। কেননা এ হচ্ছে জীবনকে বরপ করে তোলবার আর্ট, আর বাদবাকি যত-কিছু, শিল্পকলা আছে, সে সবই এই মহা আর্ট হতে উদ্ভূত এবং তার কর্তৃকই পরিপুষ্ট।
এ কথা অবশ্য বৈজ্ঞানিকেরা এবং দার্শনিকেরা মানবেন না; কেননা বৈজ্ঞানিকের বিশ্বাস, সভ্যতা জন্মে মাটির গুণে; আর দার্শনিকের বিশ্বাস, ও-বস্তু পড়ে আকাশ থেকে। এদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, কাব্যের জন্মদাতা যেমন কবি, সভ্যতার জন্মদাতাও তেমনি মানুষ। এ বস্তুর তত্ত্ব বিজ্ঞান-দর্শন কখনো আবিষ্কার করতে পারবে না, কেননা ও হচ্ছে জীবনের একটি postulate, জ্ঞানের axiom নয়। অর্থাৎ মানুষের মন ছাড়া সভ্যতার অস্তিত্ব আর কোথাও নেই।
সে যাই হোক, এ ক্ষেত্রে ভারতবর্ষের সভ্যতার বিশিষ্টতা প্রমাণ করবার কোনোই প্রয়োজন নেই। উইলিয়ম আর্চার প্রতি সে বিশিষ্টতা সম্পূর্ণ মানেন; আমাদের উপর তাঁদের রাগ এই যে, আমরা আমাদের প্রাচীনতা ত্যাগ করে নবীন হবার চেষ্টা করছি। ফলে আমাদের সমাজ এখন হয়েছে প্রবীণ-নবীন ওরফে সভ্যাসভ্য। East এবং West যে ভারতবর্ষে meet করেছে, এই হচ্ছে আমাদের অপরাধ; কেননা এই মিলনের ফলে কতকগুলি দুরন্ত সমস্যা জন্মলাভ করেছে। কিন্তু তার জন্য দায়ী কি আমরা?
যদি বর্তমান ইউরোপীয় সভ্যতা অ্যান্টিকো-মডান হতে পারে, তো ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ সভ্যতা কেন যে অ্যান্টিকো-মডার্ন হতে পারবে না, তা আমার বুদ্ধির অগম্য। তবে এ ক্ষেত্রে ইউরোপের সঙ্গে ভারতবর্ষের একটু প্রভেদ আছে। ইউরোপ তার নবীন সভ্যতার গায়ে প্রাচীন সভ্যতার কলম বসিয়েছে, অপর পক্ষে ভারতবর্ষ তার প্রাচীন সভ্যতার গায়ে নবীন সভ্যতার কলম বসাচ্ছে। ফল কোনটায় ভালো ফলবে, সে কথা বলতে পারে শুধু বৃক্ষায়ুর্বেদীরা। তবে সহজ বুদ্ধিতে তো মনে হয় যে, নূতনের ঘাড়ে পুরাতনকে ভর করতে দেওয়ার চাইতে নূতনকে পুরাতনের কোলে স্থান দেওয়াই বেশি স্বাভাবিক।
সুতরাং আমরা সভ্য কি অসভ্য, সে বিষয়ে আমাদের মাথা বকাবার দরকার নেই, কেননা এখন আমাদের মীমাংসা করতে হবে অন্য সমস্যার। প্রথমে যে-ক’টি সমস্যার উল্লেখ করেছি, তার মধ্যে যে তিনটি বিল-আকার ধারণ করেছে তাদের সম্বন্ধেও বেশি কিছু ভাববার নেই, কেননা এ কথা নিশ্চিত যে, রাউলাট-বিল পাস হবে প্যাটেল-বিল হবে না, এবং রিফর্ম-বিল পাস হবে ও হবে না। যে দুটি বাকি থাকল, শিক্ষা ও শিল্প, সে দুটিই হচ্ছে এ যুগের আসল সমস্যা; কারণ এ দুটির মীমাংসার ভার অনেকটা আমাদের হাতে, এবং এ দুটির আমরা যদি সুমীমাংসা করতে পারি তা হলে আমরা সভ্য কি না, সে প্রশ্ন আর উঠবে না।
ফাগুন ১৩২৫