শ্রীযুক্ত সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভারতী পত্রিকাতে প্রকাশিত বাল্যকথা, ঢাকা রিভিউ ও সম্মিলনএর মতে অপ্রকাশিত থাকাই উচিত ছিল। লেখক যে কথা বলেছেন এবং যে ধরণে বলেছেন, দুয়ের কোনোটিই সম্পাদক মহাশয়ের মতে ‘সুযোগ্য লেখক এবং সুপ্রসিদ্ধ মাসিকের উপযোগী নয়’। শ্রীযুক্ত সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা সম্বন্ধে ভালোমন্দ কোনো কথাই আমার মুখে শোভা পায় না। তার কারণ এ স্থলে উল্লেখ করবার কোনো প্রয়োজন নেই, কেননা তা শুধু ‘ঘরওয়ালা ধরণে’র নয়, একেবারে পুরোপুরি ঘরাও কথা। আমি যদি প্রকাশ্যে সে লেখার নিন্দা করি, তা হলে আমার কুটুম্বসমাজ সে কার্যের প্রশংসা করবে না; অপরপক্ষে যদি প্রশংসা করি, তা হলে সাহিত্যসমাজ নিশ্চয়ই তার নিন্দা করবে। তবে ঢাকা রিভিউএর সম্পাদক মহাশয় উক্ত লেখকের ভাষা সম্বন্ধে যে মত প্রকাশ করেছেন, সে সম্বন্ধে আমার কিছু বক্তব্য আছে।
প্রথমত, সম্পাদক মহাশয় বলেছেন যে, সে ‘রচনার নমুনা যেপ্রকারের ঘরওয়ালা ধরণের, ভাষাও তদ্রূপ’। ভাষা যদি বক্তব্য বিষয়ের অনুরূপ হয়, তা হলে অলংকারশাস্ত্রের মতে সেটা যে দোষ বলে গণ্য, এ জ্ঞান আমাদের পূর্বে ছিল না। আত্মজীবনী লেখবার উদ্দেশ্যই হচ্ছে ঘরের কথা পরকে বলা। ঘরাও ভাষাই ঘরাও কথার বিশেষ উপযোগী মনে করেই লেখক, লোকে যেভাবে গল্প বলে, সেই ভাবেই তাঁর ‘বাল্যকথা’ বলেছেন। স্বর্গীয় কালী সিংহ যে হুতোম প্যাঁচার নক্শার ভাষায় তাঁর মহাভারত লেখেন নি, এবং মহাভারতের ভাষায় যে হুতোম প্যাঁচার নক্শা লেখেন নি, তাতে তিনি কাণ্ডজ্ঞানহীনতার পরিচয় দেন নি। সে যাই হোক, শ্রীযুক্ত সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পক্ষ হয়ে কোনোরূপ ওকালতি করা আমার অভিপ্রায় নয়, কারণ এ বিষয়ে বাংলার সাহিত্য-আদালতে তাঁর কোনোরূপ জবাবদিহি করবার দরকারই নেই। আমি এবং ঢাকা রিভিউএর সম্পাদক যেকালে, পূর্ববঙ্গের নয় কিন্তু পূর্বজন্মের ভাষায় বাক্যালাপ করতুম, সেই দূর অতীত কালেই ঠাকুর মহাশয় ‘সুযোগ্য লেখক’ বলে বাংলাদেশে খ্যাতি এবং প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন।
যে ধরনের লেখা ঢাকা রিভিউএর নিতান্ত অপছন্দ, সেই ধরনের লেখারই আমি পক্ষপাতী। আমাদের বাঙালি জাতির একটা বদনাম আছে যে, আমাদের কাজে ও কথায় মিল নেই। এ অপবাদ কতদূর সত্য তা আমি বলতে পারি নে। তবে এ কথা নিশ্চিত যে, আমাদের কথায় ও লেখায় যত অধিক অমিল হয়, তত আমরা সেটি অহংকারের এবং গৌরবের বিষয় বলে মনে করি। বাঙালি লেখকদের কৃপায় বাংলা ভাষায় চক্ষুকর্ণের বিবাদ ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। সেই বিবাদ ভঞ্জন করবার চেষ্টাটা আমি উচিত কার্য বলে মনে করি। সেই কারণেই এ দেশে বিদ্যাদিগ্গজের ‘স্থূলহস্তাবলেপ’ হতে মাতৃভাষাকে উদ্ধার করবার জন্য আমরা সাহিত্যকে সেই মুক্তপথ অবলম্বন করতে বলি, যে পথের দিকে আমাদের সিদ্ধাঙ্গনারা উৎসুক নেত্রে. চেয়ে আছে। ঢাকা রিভিউএর সমালোচনা অবলম্বন করে আমার নিজের মত সমর্থন করাই এ প্রবন্ধের উদ্দেশ্য।
অভিযোগ
সম্পাদক মহাশয়ের কথা হচ্ছে এই,
মুদ্রিত সাহিত্যে আমরা ‘করতুম’ ‘শোনাচ্ছিলুম’ ‘ডাকতুম’ ‘মেশবার’ (‘খেনু’ ‘গেনু’ই বা বাদ যায় কেন?) প্রভৃতি প্রাদেশিক শব্দ ব্যবহারের পক্ষপাতী নহি। অন্য ভাষাভাষী বাঙালির অপরিজ্ঞাত ‘ভাষা প্রয়োগে সাহিত্যিক সংকীর্ণতা প্রকাশ পায় বলিয়া আমাদের বিশ্বাস।
উপরোক্ত পদটি যদি সাধুভাষার নমুনা হয়, এবং ঐরূপ লেখাতে যদি ‘সাহিত্যিক্’ উদারতা প্রকাশ পায়, তা হলে লেখায় সাধুতা এবং উদারতা আমরা যে কেন বর্জন করতে চাই, তা ভাষাজ্ঞ এবং রসজ্ঞ পাঠকেরা সহজেই উপলব্ধি করতে পারবেন। এরূপ ভাষা সাধুও নয়, শুদ্ধও নয়, শুধু ‘যা-খুশি-তা’ ভাষা। কোনো লেখকবিশেষের লেখা নিয়ে তার দোষ দেখিয়ে দেওয়া আমার উদ্দেশ্য নয়। আমার বিশ্বাস, ওরূপ করাতে সাহিত্যের কোনো লাভ নেই। মশা মেরে ম্যালেরিয়া দূর করবার চেষ্টা বৃথা, কারণ সে কাজের আর অন্ত নেই। সাহিত্যক্ষেত্রে কতকটা আলো এবং হাওয়া এনে দেওয়াই সে স্থানকে স্বাস্থ্যকর করবার প্রকৃষ্ট উপায়। তা সত্ত্বেও ঢাকা রিভিউ হতে সংগৃহীত উপরোক্ত পদটি অনায়াসলব্ধ পদ নিয়ে অযত্নসুলভ বাক্যরচনার এমন খাঁটি নমুনা যে, তার রচনাপদ্ধতির দোষ বাঙালি পাঠকদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবার লোভ আমি সংবরণ করতে পারছি নে। শুনতে পাই, কোনো-একটি ভদ্রলোক তিন অক্ষরের একটি পদ বানান করতে চারটি ভুল করেছিলেন। ‘ঔষধ’ এই পদটি তাঁর হাতে ‘অউসদ’ এই রূপ ধারণ করেছিল। সম্পাদক মহাশয়ও একটি বাক্য রচনায় অন্তত পাঁচ-ছটি ভুল করেছেন—
১. সাহিত্যের পূর্বে ‘মুদ্রিত’ এই বিশেষণটি জুড়ে দেবার সার্থকতা কি? অমুদ্রিত সাহিত্য জিনিসটি কি? ওর অর্থ কি সেই লেখা, যা এখন হস্তাক্ষরেই আবদ্ধ হয়ে আছে, এবং ছাপা হয় নি? তাই যদি হয়, তা হলে সম্পাদক মহাশয়ের বক্তব্য কি এই যে, ছাপা হবার পূর্বে লেখায় যে ভাষা চলে, ছাপা হবার পরে আর তা চলে না? আমাদের ধারণা, মুদ্রিত লেখামাত্রই এক সময়ে অমুদ্রিত অবস্থায় থাকে, এবং মুদ্রাযন্ত্রের ভিতর দিয়ে তা রূপান্তরিত হয়ে আসে না। বরং কোনোরূপ রূপান্তরিত হলেই আমরা আপত্তি করে থাকি, এবং যে ব্যক্তির সাহায্যে তা হয়, তাকে আমরা মুদ্রাকরের শয়তান বলে অভিহিত করি। এইরূপ বিশেষণের প্রয়োগ শুধু অযথা নয়, একেবারেই অনর্থক।
২. ‘ডাকতুম’ ‘করতুম’ প্রভৃতির ‘তুম’ এই অন্তভাগ প্রাদেশিক শব্দ নয়, কিন্তু বিভক্তি। এ স্থলে ‘শব্দ’ এই বিশেষ্যটি ভুল অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। কারণ সম্পাদক মহাশয় বোধ হয় এ কথা বলতে চান না যে, ‘ডাকা’ ‘করা’ ‘শোনা’ প্রভৃতি ক্রিয়া শব্দের অর্থ কলিকাতা প্রদেশের লোক ছাড়া আর কেউ জানেন না। এ কথা নির্ভয়ে বলা চলে যে, ‘ডাকা’ ‘করা’ ‘শোনা’ প্ৰভৃতি শব্দ, ‘অন্য ভাষাভাষী’ বাঙালির নিকট অপরিজ্ঞাত হলেও বঙ্গ-ভাষাভাষী বাঙালি মাত্রেরই নিকট বিশেষ সুপরিচিত। সম্পাদক মহাশয়ের আপত্তি যখন ঐ বিভক্তি সম্বন্ধে, তখন শব্দের পরিবর্তে ‘বিভক্তি’ এই শব্দটিই ব্যবহার করা উচিত ছিল।
৩. ‘সাহিত্যিক্’ এই বিশেষণটি বাংলা কিংবা সংস্কৃত কোনো ভাষাতেই পূর্বে ছিল না, এবং আমার বিশ্বাস, উক্ত দুই ভাষার কোনটির ব্যাকরণ অনুসারে ‘সাহিত্য’ এই বিশেষ্য শব্দটি ‘সাহিত্যিক’-রূপ বিশেষণে পরিণত হতে পারে না। বাংলার নব্য ‘সাহিত্যিক’দের বিশ্বাস যে, বিশেষ্যের উপর অত্যাচার করলেই তা বিশেষণ হয়ে ওঠে। এইরূপ বিশেষণের সৃষ্টি আমার মতে অদ্ভুত সৃষ্টি। এই পদ্ধতিতে সাহিত্য রচিত হয় না, literature শুধু literatural হয়ে ওঠে।
৪. ‘ভাষাভাষী’ এই সমাসটি এতই অপূর্ব যে, ও কথা শুনে হাসাহাসি করা ছাড়া আর কিছু করা চলে না।
৫. ‘আমরা’ শব্দটি পদের পূর্বভাগে না থেকে শেষভাগে আসা উচিত ছিল। তা না হলে পদের অন্বয় ঠিক হয় না। ‘করতুম’এর পূর্বে নয়, ‘ব্যবহার’ এবং ‘পক্ষপাতী’ এই দুই শব্দের মধ্যে এর যথার্থ স্থান।
অযথা এবং অনর্থক বিশেষণের প্রয়োগ, ভুল অর্থে বিশেষ্যের প্রয়োগ, অদ্ভুত বিশেষণ এবং সমাসের সৃষ্টি, ‘উলটোপালটা’ রকম রচনার পদ্ধতি প্রভৃতি বর্জনীয় দোষ আজকালকার মুদ্রিত সাহিত্যের পত্রে পত্রে ছত্রে ছত্রে দেখা যায়। সাধুভাষার আবরণে যে-সকল দোষ, শুধু অন্যমনস্ক পাঠকদের নয়, অন্যমনস্ক লেখকদেরও চোখে পড়ে না।
মুদ্রিত সাহিত্য বলে কোনো জিনিস না থাকলেও মুদ্রিত ভাষা বলে যে একটা নতুন ভাষার সৃষ্টি হয়েছে, তা অস্বীকার করবার জো নেই। লেখার ভাষা শুধু মুখের ভাষার প্রতিনিধি মাত্র। অনিত্য শব্দকে নিত্য করবার ইচ্ছে থেকেই অক্ষরের সৃষ্টি। অক্ষর-সৃষ্টির পূর্বযুগে মানুষের মনে করে রাখবার মতো বাক্যরাশি কণ্ঠস্থ করতে করতেই প্রাণ যেত। যে অক্ষর আমরা প্রথমে হাতে লিখি, তাই পরে ছাপানো হয়। সুতরাং ছাপার অক্ষরে উঠলেই যে কোনো কথার মর্যাদা বাড়ে, তা নয়। কিন্তু দেখতে পাই অনেকের বিশ্বাস তার উলটো। আজকাল ছাপার অক্ষরে যা বেরোয় তাই সাহিত্য বলে গণ্য হয়। এবং সেই একই কারণে মুদ্রিত ভাষা সাধুভাষা বলে সম্মান লাভ করে। গ্রামোফোনের উদরস্থ হয়ে সংগীতের মাহাত্ম্য শুধু এ দেশেই বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। আসলে সে ভাষার ঠিক নাম হচ্ছে বাবু-বাংলা। যে গুণে ইংলিশ বাবু-ইংলিশ হয়ে ওঠে, সেই গুণেই বঙ্গভাষা বাবু- বাংলা হয়ে উঠেছে। সে ভাষা আলাপের ভাষা নয়, শুধু প্রলাপের ভাষা। লেখার যা সর্বপ্রথম এবং সর্বপ্রধান গুণ—প্রসাদগুণ—সে গুণে বাবু-বাংলা একেবারেই বঞ্চিত। বিদ্যের মতো, ভাষা ও কেবলমাত্র পুঁথিগত হয়ে উঠলে তার ঊর্ধ্বগতি হয় কি না বলতে পারি নে, কিন্তু সদ্গতি যে হয় না সে বিষয়ে আর সন্দেহ নেই। আসলে এই মুদ্রিত ভাষায় মৃত্যুর প্রায় সকল লক্ষণই স্পষ্ট। শুধু আমাদের মাতৃভাষার নাড়িজ্ঞান লুপ্ত হয়ে রয়েছে বলে আমরা নব্যবঙ্গ সাহিত্যের প্রাণ আছে কি নেই তার ঠাওর করে উঠতে পারি নে। মুখের ভাষা যে জীবন্ত ভাষা, এ বিষয়ে দু মত নেই। একমাত্র সেই ভাষা অবলম্বন করেই আমরা সাহিত্যকে সজীব করে তুলতে পারব। যেমন একটি প্রদীপ থেকে অপর-একটি প্রদীপ ধরাতে হলে পরস্পরের স্পর্শ ব্যতিরেকে সে উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয় না, তেমনি লেখার ভাষাতেও প্রাণ সঞ্চার করতে হলে মুখের ভাষার সম্পর্ক ব্যতীত অন্য কোনো উপায়ে সে উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয় না; আমি সংস্কৃত শব্দের ব্যবহারের বিরোধী নই, শুধু ন্যূন অর্থে, অধিক অর্থে কিংবা অনর্থে বাক্যপ্রয়োগের বিরোধী। আয়ুর্বেদ-মতে ওরূপ বাক্যপ্রয়োগ একটা রোগবিশেষ, এবং চরকসংহিতায় ও-রোগের নাম বাক্যদোষ। পাছে কেউ মনে করেন যে, আমি এই কথাটা নিয়ে একটু বাড়াবাড়ি করছি, সেই কারণে এক শত বৎসর পূর্বে ‘অভিনব যুবক সাহেবজাতের শিক্ষার্থে’ মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকার যে উপদেশ লিপিবদ্ধ করে গেছেন, সেটি এখানে উদ্ধৃত করে দিচ্ছি—
শাস্ত্রে বাক্যকে গো শব্দে যে কহিয়াছেন তাহার কারণ এই ভাষা যদি সম্যরূপে প্রয়োগ করা যায় তবে স্বয়ং কামদুঘা ধেনু হন, যদি দুষ্টরূপে প্রয়োগ করা যায় তবে সেই দুষ্টভাষা সন্নিষ্ঠগোত্ব ধর্মকে স্বপ্রয়োগকর্তাকে অর্পণ করিয়া স্ববক্তাকে গোরূপে পণ্ডিতেরদের নিকটে বিখ্যাত করেন।…আর বাক্য কহা বড় কঠিন, সকলহইতে কহা যায় না কেননা কেহ বাক্যেতে হাতি পায়, কেহ বা বাক্যেতে হাতির পায়। অতএব বাক্যেতে অত্যল্প দোষও কোনপ্রকারে উপেক্ষণীয় নহে, কেননা যদ্যপি অতিবড় সুন্দরও শরীর হয় তথাপি যৎকিঞ্চিৎ এক শ্বিত্র রোগ দোষেতে নিন্দনীয় হয়।১
[১. প্রবোধচন্দ্রিকা।]
বিদ্যালংকার মহাশয়ের মতে ‘বাক্য কহা বড় কঠিন’। কহার চাইতে ে যে অনেক বেশি কঠিন, এ সত্য বোধ হয় ‘অভিনব যুবক’ বঙ্গলেখক ছাড়া আর কেউ অস্বীকার করবেন না। Art এবং artlessnessএর মধ্যে আসমান-জমীন ব্যবধান আছে, লিখিত এবং কথিত ভাষার মধ্যেও সেই ব্যবধান থাকা আবশ্যক। কিন্তু সে পার্থক্য ভাষাগত নয়, স্টাইলগত। লিখিত ভাষার কথাগুলি শুদ্ধ, সুনির্বাচিত এবং সুবিন্যস্ত হওয়া চাই, এবং রচনা সংক্ষিপ্ত ও সংহত হওয়া চাই। লেখায় কথা ওলটানো চলে না, বদলানো চলে না, পুনরুক্তি চলে না, এবং এলোমেলো ভাবে সাজানো চলে না। ঢাকা রিভিউএর সম্পাদক মহাশয়ের মতে যে ভাষা প্রশস্ত, সে ভাষায় মুখের ভাষার যা-যা দোষ সে-সব পূর্ণমাত্রায় দেখা দেয়, কেবলমাত্র আলাপের ভাষার যে-সকল গুণ আছে—অর্থাৎ সরলতা, গতি ও প্রাণ—সেই গুণগুলিই তাতে নেই। কোনো দরিদ্র লোকের যদি কোনো ধনী লোকের সহিত দূরসম্পর্কও থাকে, তা হলে প্রায়ই দেখতে পাওয়া যায় যে, সে গরিব বেচারা সেই দূরসম্পর্ককে অতি ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তাতে পরিণত করতে চেষ্টা করে। কিন্তু সে চেষ্টার ফল কিরূপ হয়ে থাকে তা তো সকলেরই নিকট প্রত্যক্ষ। আমরা পাঁচজনে মিলে আমাদের মাতৃভাষার বংশমর্যাদা বাড়াবার জন্যই সংস্কৃত ভাষার আশ্রয় গ্রহণ করতে উৎসুক হয়েছি। তার ফলে শুধু আমাদের ভাষায় স্বীয় মর্যাদা রক্ষা হচ্ছে না। সাধুভাষার লেখকদের তাই, দেখতে পাওয়া যায় যে, পদে পদে বিপদ ঘটে থাকে। আমার বিশ্বাস যে, আমরা যদি সংস্কৃত ভাষার দ্বারস্থ না হয়ে ঘরের ভাষার উপরই নির্ভর করি, তা হলে আমাদের লেখার চাল স্বচ্ছন্দ হবে, এবং আমাদের ঘরের লোকের সঙ্গে মনোভাবের আদান-প্রদানটাও সহজ হয়ে আসবে। যদি আমাদের বক্তব্য কথা কিছু থাকে, তা হলে নিজের ভাষাতে তা যত স্পষ্ট করে বলা যায়, কোনো কৃত্রিম ভাষাতে তত স্পষ্ট করে বলা যাবে না।
বাংলা ভাষার বিশেষত্ব
কেবলমাত্র পড়ে-পাওয়া-চোদ্দ-আনা-গোছ সংস্কৃত শব্দ বর্জন করলেই যে আমাদের মোক্ষলাভ হবে, তা নয়। আমরা লেখায় স্বদেশী ভাষাকে যেরূপ বয়কট করে আসছি, সেই বয়কটও আমাদের ছাড়তে হবে। বহুসংখ্যক বাংলা শব্দকে ইতর বলে সাহিত্য হতে বহিষ্করণের কোনোই বৈধ কারণ নেই। মৌখিক ভাষার মধ্যেই সাধু এবং ইতর, উভয়প্রকারেরই শব্দ আছে। যে শব্দ ইতর বলে আমরা মুখে আনতে সংকুচিত হই, তা আমরা কলমের মুখ দিয়েও বার করতে পারি নে। কিন্তু যে-সকল কথা আমরা ভদ্রসমাজে নিত্য ব্যবহার করি, যা, কোনো হিসেবেই ইতর বলে গণ্য নয়, সেই-সকল বাক্যকে সাহিত্য থেকে বহির্ভূত করে রাখায় ক্ষতি শুধু সাহিত্যের। কেন যে পদ-বিশেষ ইতরশ্রেণীভুক্ত হয়, সে আলোচনার স্থান এ প্রবন্ধে নেই। তবে এ কথা নির্ভয়ে বলা যেতে পারে যে, ভদ্র এবং ইতরের প্রভেদ আমাদের সমাজে এবং সাহিত্যে যেরূপ প্রচলিত, পৃথিবীর অন্য কোনো সভ্যদেশে সেরূপ নয়। আমরা সমাজের যেমন অধিকাংশ লোককে শূদ্র করে রেখে দিয়েছি, ভাষারাজ্যেও আমরা সাধুতার দোহাই দিয়ে তারই অনুরূপ জাতিভেদ সৃষ্টি করবার চেষ্টা করছি, এবং অসংখ্য নির্দোষ বাংলা কথাকে শূদ্রশ্রেণীভুক্ত করে তাদের সংস্কৃত শব্দের সঙ্গে এক পঙ্ক্তিতে বসতে দিতে আপত্তি করছি। সমাজে এবং সাহিত্যে আমরা একই সংকীর্ণ মনোভাবের পরিচয় দিই। বাংলা কথা সাহিত্যে অস্পৃশ্য করে রাখাটা শুধু লেখাতে ‘বামনাই’ করা। আজকাল দেখতে পাই অনেকেরই চৈতন্য হয়েছে যে, আমাদেরই মতো রক্তমাংসে গঠিত মানুষকে সমাজে পতিত করে রাখবার একমাত্র ফল, সমাজকে দুর্বল এবং প্রাণহীন করা। আশা করি, শীঘ্রই আমাদের সাহিত্য-ব্রাহ্মণদের এ জ্ঞান জন্মাবে যে, অসংখ্য প্রাণবন্ত বাংলা শব্দকে পতিত করে রাখবার দরুন, আমাদের সাহিত্য দিন দিন শক্তিহীন এবং প্রাণহীন হয়ে পড়ছে। একালের ম্রিয়মাণ লেখার সঙ্গে তুলনা করে দেখলেই স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, আলালের ঘরের দুলাল এবং হুতোম প্যাঁচার নক্শার ভাষাতে কত অধিক ওজঃধাতু আছে। আমরা যে বাংলা শব্দমাত্রকেই জাতে তুলে নিতে চাচ্ছি, তাতে আমাদের ‘সাহিত্যিক সংকীর্ণতা’ প্রকাশ পায় না, যদি কিছু প্রকাশ পায় তো উদারতা
আর-একটি কথা। অন্যান্য জীবের মতো ভাষারও একটা আকৃতি ও একটা গঠন আছে। বৈজ্ঞানিকদের মতে, জীবে জীবে প্রভেদ ঐ গঠনের পার্থক্যেরই উপর নির্ভর করে, আকৃতির উপর নয়। পাখা থাকা সত্ত্বেও আরশোলা যে পোকা, পাখি নয়, এ জ্ঞান আমাদের দেশের নিরক্ষর লোকেরও আছে। এমন-কি, কবিরাও বিহঙ্গকে পতঙ্গের প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহার করেন না। অন্যান্য জীবের মতো ভাষার বিশেষত্বও তার গঠন আশ্রয় করে থাকে, কিন্তু তা তার দেহাকৃতির উপর প্রতিষ্ঠিত নয়। ভাষার দেহের পরিচয় অভিধানে, এবং তার গঠনের পরিচয় ব্যাকরণে। সুতরাং বাংলায় এবং সংস্কৃতে আকৃতিগত মিল থাকলেও জাতিগত কোনোরূপ মিল নাই। প্রথমটি হচ্ছে analytic, দ্বিতীয়টি inflectional ভাষা। সুতরাং বাংলাকে সংস্কৃতের অনুরূপ করে গড়ে তুলতে চেষ্টা করে আমরা যে বঙ্গভাষার জাতি নষ্ট করি, শুধু তাই নয়, তার প্রাণ বধ করবার উপক্রম করি। এই কথাটি সপ্রমাণ করতে হলে এ বিষয়ে একটি বিস্তৃত প্রবন্ধ লিখতে হয়, সুতরাং এ স্থলে আমি শুধু কথাটার উল্লেখ মাত্র করে ক্ষান্ত হলুম।
বিজ্ঞান ছেড়ে দিয়ে সহজ জ্ঞানেতেই জানা যায়, উক্ত দুই ভাষার চালের পার্থক্য ঢের। সংস্কৃতের হচ্ছে ‘করিরাজবিনিন্দিত মন্দগতি’, কিন্তু বাংলা, গুণী লেখকের হাতে পড়লে, দুকি কদম ছাতক সব চালেই চলে। শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যৌবনকালে লিখিত এবং সদ্যপ্রকাশিত ছিন্নপত্র পড়লে সকলেই দেখতে পাবেন যে, সাহস ক’রে একবার রাশ আলগা দিতে পারলে নিপুণ এবং শক্তিমান্ লেখকের হাতে বাংলা গদ্য কি বিচিত্র ভঙ্গিতে ও কি বিদ্যুদ্বেগে চলতে পারে। আমরা ‘সাহিত্যিক্’ ভাবে কথা কই নে ব’লে আমাদের মুখের কথায় বাংলা ভাষার সেই সহজ ভঙ্গিটি রক্ষিত হয়। কিন্তু লিখতে বসলেই আমরা তার এমন-একটা কৃত্রিম গড়ন দেবার চেষ্টা পাই, যাতে তার চলৎশক্তি রহিত হয়ে আসে। ভাষার এই আড়ষ্ট ভাবটাই সাধুতার একটা লক্ষণ বলে পরিচিত। তাই বাংলা সাহিত্যে সাধারণ লেখকের গদ্য গদাই-লশকরি ভাবে চলে, এবং কুলেখকদের হাতের লেখা একটা জড়পদার্থের স্তূপমাত্র হয়ে থাকে। এই জড়তার বন্ধন থেকে মুক্ত হবার একমাত্র উপায় হচ্ছে, লেখাতেও মৌখিক ভাষার সহজ ভঙ্গিটি রক্ষা করা। কিন্তু যেই আমরা সে কাজ করি অমনি আমাদের বিরুদ্ধে সাধুভাষার কলের জল ঘোলা করে দেবার এবং বাংলা সাহিত্যের বাড়া-ভাতে ‘প্রাদেশিক শব্দে’র ছাই ঢেলে দেবার অভিযোগ উপস্থিত হয়।
ভাষামাত্রেরই তার আকৃতি ও গঠনের মতো একটা বিশিষ্ট প্রকৃতি আছে, এবং প্রকৃতিস্থ থাকার উপরই তার শক্তি এবং সৌন্দর্য নির্ভর করে। বঙ্গভাষার সেই প্রকৃতির বিশেষ জ্ঞানের অভাববশতই আমরা সে ভাষাকে সংস্কৃত করতে গিয়ে বিকৃত করে ফেলি। তা ছাড়া প্রতি ভাষারই একটি স্বতন্ত্র সুর আছে। এমন অনেক সংস্কৃত শব্দ আছে যা বাংলার সুরে মেলে না এবং শোনবামাত্র কানে খট্ করে লাগে। যার সুরজ্ঞান নেই তাকে কোনোরূপ তর্কবিতর্ক দ্বারা সে জ্ঞান দেওয়া যায় না। ‘সাহিত্যিক্’ এই শব্দটি ব্যাকরণসিদ্ধ হলেও যে বাঙালির কানে নিতান্ত বেসুরো লাগে, এ কথা যার ভাষার জ্ঞান আছে তাকে বোঝানো অনাবশ্যক, আর যার নেই তাকে বোঝানো অসম্ভব।
এই বিকৃত এবং অশ্রাব্য ‘সাহিত্যিক্ ভাষার’ বন্ধন থেকে সাহিত্যকে মুক্ত করবার প্রস্তাব করলেই যে সকলে মারমুখো হয়ে ওঠেন, তার একমাত্র কারণ এই যে, উক্ত ভাষা ইংরেজি-শিক্ষিত বাঙালির স্বাভাবিক ঢিলেমি, মানসিক আলস্য এবং পল্লবগ্রাহিতার অনুকূল। মুক্তির নাম শোনবামাত্রই আমাদের অভ্যস্ত মনোভাবসকল বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। রাজা রামমোহন রায়ের মতে, সাধুসমাজের লোকেরা যে ভাষা কহেন এবং শুনেন, সেই ভাষাই সাধুভাষা। কিন্তু আজকালকার মতে, যে ভাষা সাধুসমাজের লোকেরা কহেনও না শুনেনও না, কিন্তু লিখেন এবং পড়েন, সেই ভাষা সাধুভাষা। সুতরাং ভালো হোক মন্দ হোক, যে ভাষায় লেখাপড়া করা লোকের অভ্যাস হয়ে গেছে, সেই অভ্যাসবশতই সেই ভাষায় লেখাপড়া করা লোকের পক্ষে অতি সহজ। কিন্তু যা করা সোজা তাই যে করা উচিত, এরূপ আমার বিশ্বাস নয়। সাধু বাংলা পরিত্যাগ করে বাংলা ভাষায় লিখতে পরামর্শ দিয়ে আমি পরিশ্রমকাতর লেখকদের অভ্যস্ত আরামের ব্যাঘাত করতে উদ্যত হয়েছি, সুতরাং এ কার্যের জন্য আমি যে তাঁদের বিরাগভাজন হব তা বেশ জানি। ‘নব্য সাহিত্যিক’দের বোলতার চাকে আমি যে ঢিল মারতে সাহস করেছি তার কারণ, আমি জানি তাদের আর যাই থাক্ হুল নেই। বড়োজোর আমাকে শুধু লেখকদের ভনভনানি সহ্য করতে হবে। সে যাই হোক, ঢাকা রিভিউএর সম্পাদক যে আপত্তি উত্থাপন করেছেন, তার একটা বিচার হওয়া আবশ্যক। আমি ভাষাতত্ত্ববিদ্ নই, তবুও আমার মাতৃভাষার সঙ্গে যেটুকু পরিচয় আছে, তার থেকেই আমার এইটুকু জ্ঞান জন্মেছে যে, মুখের কথা লেখায় স্থান পেলে সাহিত্যের ভাষা
প্রাদেশিক কিংবা গ্রাম্য হয়ে উঠবে না। বাংলা ভাষার কাঠামো বজায় না রাখতে পারলে আমাদের লেখার যে উন্নতি হবে না, এ কথা নিশ্চিত। কিন্তু সেই কাঠামো বজায় রাখতে গেলে ভাষারাজ্যে বঙ্গভঙ্গ হবার কোনো সম্ভাবনা আছে কি না, সে বিষয়ে একটু আলোচনা দরকার। আমি তর্কটা উত্থাপন করে দিচ্ছি, তার সিদ্ধান্তের ভার যাঁরা বঙ্গভাষার অস্থিবিদ্যায় পারদর্শী তাঁদের হস্তে ন্যস্ত থাকল।
ভাষায় প্রাদেশিকতা
প্রাদেশিক ভাষা, অর্থাৎ dialect, এই নাম শুনলেই আমাদের ভীত হবার কোনো কারণ নেই। সম্ভবত এক সংস্কৃত ব্যতীত গ্রীক ল্যাটিন প্রভৃতি মৃত ভাষাসকল এক সময়ে লোকের মুখের ভাষা ছিল। এবং সেই সেই ভাষার সাহিত্য সেই যুগের লেখকেরা ‘যদ্ভুতং তল্লিখিতং’ এই উপায়েই গড়ে তুলেছেন। গ্রীকসাহিত্য ইউরোপীয় পণ্ডিতদের মতে ইহজগতের সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্য। কিন্তু এ অপূর্ব সাহিত্য কোনোরূপ সাধুভাষায় লেখা হয় নি, ডায়ালেটেই লেখা হয়েছে। গ্রীকসাহিত্য একটি নয়, তিনটি ডায়ালেটে লেখা। এইটেই প্রকৃষ্ট প্রমাণ যে, মুখের ভাষায় বড়ো সাহিত্য গড়া চলে। আধুনিক ইউরোপীয় সাহিত্যও মৌখিক ভাষার অনুসারেই লেখা হয়ে থাকে, ‘মুদ্রিত সাহিত্যে’র ভাষায় লেখা হয় না। পৃথিবীতে এমন কোনো দেশ নেই যেখানকার উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিমের লোকেরা ঠিক সমভাবেই কথা বলে। ইংলণ্ড ফ্রান্স ইতালি প্রভৃতি দেশেও ডায়ালেটের প্রভেদ যথেষ্ট আছে। অথচ ইংরেজি সাহিত্যের ভাষা, ইংরেজ জাতির মুখের ভাষারই অনুরূপ। এর থেকেই বোঝা যায় যে, পাঁচটি ডায়ালেটের মধ্যে কেবল একটিমাত্র সাহিত্যের সিংহাসন অধিকার করে। √ং তার কারণ হচ্ছে সেই ডায়ালেটের সহজ শ্রেষ্ঠত্ব। ইতালির ভাষায় এর প্রমাণ অতি স্পষ্ট। ইতালির সাহিত্যের ভাষার দুটি নাম আছে; এক lingua purgata অর্থাৎ শুদ্ধ ভাষা, আর-এক lingua Toscana অর্থাৎ টস্কানি প্রদেশের ভাষা। টস্কানির কথিত ভাষাই সমগ্র ইতালির অধিবাসীরা সাধুভাষা বলে গ্রাহ্য করে নিয়েছে। আমাদের দেশে প্রচলিত নানারূপ বুলির মধ্যেও যে একটি বিশেষ প্রদেশের ভাষা সাহিত্যের ভাষা হবে তাতে আর আশ্চর্যের বিষয় কি। ফলে হয়েছেও তাই।
চণ্ডীদাস থেকে আরম্ভ করে ভারতচন্দ্র পর্যন্ত লেখকেরা প্রায় একই ভাষায় লিখে গেছেন। অথচ সেকালের লেখকেরা একটি সাহিত্যপরিষদের প্রতিষ্ঠা করে পাঁচজনের ভোট নিয়ে সে ভাষা রচনা করেন নি, কোনো স্কুলপাঠ্য গ্রন্থাবলী থেকেও তাঁরা সাধুভাষা শিক্ষা করেন নি, বাংলা বই পড়ে তাঁরা বই লেখেন নি। তাঁরা যে ভাষাতে বাক্যালাপ করতেন সেই ভাষাতেই বই লিখতেন, এবং তাঁদের কলমের সাহায্যেই আমাদের সাহিত্যের ভাষা আপনাআপনি গড়ে উঠেছে।
আমরা উত্তরবঙ্গের লোক, যে প্রাদেশিক ভাষাকে দক্ষিণদেশী ভাষা বলে থাকি, বঙ্গ ভাষার সেই ডায়ালেই, সাহিত্যের স্থান অধিকার করেছে। বাংলাদেশের মানচিত্রে দক্ষিণদেশের নির্ভুল চৌহদ্দি নির্ণয় করে দেওয়া আমার সাধ্য নয়। তবে মোটামুটি এই পর্যন্ত বলা যেতে পারে যে, নদিয়া শান্তিপুর প্রভৃতি স্থানে, ভাগীরথীর উভয় কূলে এবং বর্তমান বর্ধমান ও বীরভূম জেলার পূর্ব ও দক্ষিণাংশে যে ডায়ালেট প্রচলিত ছিল, তাই কতক পরিমাণে সংস্কৃত শব্দের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে সাধুভাষার রূপ ধারণ করেছে। এর একমাত্র কারণ, বাংলাদেশের অপরাপর ডায়ালেট অপেক্ষা উক্ত ডায়ালেটের সহজ শ্রেষ্ঠত্ব।
উচ্চারণের কথা
ডায়ালেটের পরস্পরের মধ্যে ভেদ প্রধানত উচ্চারণ নিয়েই। যে ডায়ালেকটে শব্দের উচ্চারণ পরিষ্কাররূপে হয়, সে ডায়ালেট প্রথমত ঐ এক গুণেই অপর সকল ডায়ালেটএর অপেক্ষা পূর্ণাঙ্গ, এবং সেই কারণেই শ্রেষ্ঠ। ঢাকাই কথা এবং খাস-কলকাত্তাই কথা, অর্থাৎ সুতানুটির গ্রাম্যভাষা, দুয়েরই উচ্চারণ অনেকটা বিকৃত; সুতরাং ঢাকাই কিংবা খাস-কলকাত্তাই কথা পূর্বেও সাহিত্যে নিজেদের আধিপত্য স্থাপন করতে পারে নি এবং ভবিষ্যতেও পারবে না। পূর্ববঙ্গের মুখের কথা প্রায়ই বর্গের দ্বিতীয় ও চতুর্থ বর্ণ হীন, আবার শ্রীহট্ট অঞ্চলের ভাষা প্রথম ও তৃতীয় বর্ণ হীন। যাদের মুখের ‘ঘোড়া’ ও ‘গোরা’ একাকার হয়ে যায়, তাদের চেয়ে যাদের মুখ হতে শব্দ নিজ নিজ আকারেই বার হয়, তাদের ভাষা যে শ্রেষ্ঠ বলে গণ্য হবে, এ আর কিছু আশ্চর্যের বিষয় নয়। ‘রড়য়োরভেদ’, চন্দ্রবিন্দুবর্জন, স স্থানে হ-এর ব্যবহার, প্রভৃতি উচ্চারণের দোষে পূর্ববঙ্গের ভাষা পূর্ণ। স্বরবর্ণের ব্যবহারও উক্ত প্রদেশে একটু উলটোপালটা রকমের হয়ে থাকে। যাঁরা ‘করে’র পরিবর্তে ‘করিয়া’ লেখবার পক্ষপাতী, তাঁরা মুখে ‘কইরা’ বলেন। সুতরাং তাঁদের মুখের কথার অনুসারে যে লেখা চলে না তা অস্বীকার করবার জো নেই। অপরপক্ষে খাস- কলকাত্তাই বুলিও ভদ্রসমাজে প্রতিপত্তি লাভ করতে পারে নি এবং পারবে না। ও ভাষার কতকটা ঠোঁটকাটা ভাব আছে। ট্যাকা, ক্যাঠাল, ক্যাঙালি, নুচি, আঁব, বে, দোর, সকালা, বিকালা, পিচাশ (পিশাচ অর্থে), প্রভৃতি বিকৃত-উচ্চারিত শব্দও সাহিত্যে প্রমোশন পাবার উপযুক্ত নয়। পূর্ববঙ্গের লোকের মুখে স্বরবর্ণ ছড়িয়ে যায়, কলকাতার লোকের মুখে স্বরবর্ণ জড়িয়ে যায়। এমন কোনোই প্রাদেশিক ভাষা নেই যাতে অন্তত কতকগুলি কথাতেও কিছু-না-কিছু উচ্চারণের দোষ নেই। কম- বেশি নিয়েই আসল কথা। টস্কান ডায়ালেট সাধু ইতালীয় ভাষা বলে গ্রাহ্য হয়েছে, কিন্তু ফ্লোরেন্সে অদ্যাবধি ক-র স্থলে হ উচ্চারিত হয়, ‘seconda’ ‘sehonda’ আকারে দেখা দেয়। কিন্তু বহুগুণসন্নিপাতে একটি-আধটি দোষ উপেক্ষিত হয়ে থাকে। সকল দোষগুণ বিচার করে মোটের উপর দক্ষিণদেশী ভাষাই উচ্চারণ হিসেবে যে বঙ্গদেশে সর্বশ্রেষ্ঠ ডায়ালেট এ বিষয়ে আর কোনো সন্দেহ নেই।
প্রসিদ্ধ এবং অপ্রসিদ্ধার্থক শব্দ
দ্বিতীয় কথা এই যে, প্রতি ডায়ালেটেই এমন গুটিকতক কথা আছে যা অন্য প্রদেশের লোকদের নিকট অপরিচিত। যে ডায়ালেটে এই শ্রেণীর কথা কম, এবং বাঙালি মাত্রেরই নিকট পরিচিত শব্দের ভাগ বেশি, সেই ডায়ালেক্টই লিখিত ভাষার পক্ষে বিশেষ উপযোগী। আমার বিশ্বাস, দক্ষিণদেশী ভাষায় ঐরূপ সর্বজনবিদিত কথাগুলিই সাধারণত মুখে মুখে প্রচলিত। উত্তরবঙ্গের ভাষার তুলনায় যে দক্ষিণবঙ্গের ভাষা বেশি প্রসিদ্ধার্থক, এ বিষয়ে আমি নিজে সাক্ষ্য দিতে পারি। উদাহরণস্বরূপ আমি দুই-চারটি শব্দের উল্লেখ করতে চাই। উত্তরবঙ্গে, অন্তত রাজশাহী এবং পাবনা অঞ্চলে, আমরা সকলেই পৈতা’ ‘চুপ করা’ ‘সকাল’ ‘শখ’ ‘কুল’ ‘পেয়ারা’ ‘তরকারী’ প্রভৃতি শব্দ নিত্য ব্যবহার করি নে, কিন্তু তার অর্থ বুঝি; অপরপক্ষে ‘নগুন’ ‘নক্করা’ ‘বিয়ান’ ‘হাউস’ ‘বোর’ ‘আম-সরি’ ‘আনাজ’ প্রভৃতি আমাদের চলতি কথাগুলির অর্থ দক্ষিণদেশ-বাসীদের নিকট একেবারেই দুর্বোধ্য। এই কারণেও দক্ষিণদেশের মুখের কথা লিখিত ভাষার পক্ষে বিশেষ উপযোগী। খাস-কলকাত্তাই ভাষাতেও অপরের নিকট দুর্বোধ্য অনেক কথা আছে, এবং তা ছাড়া মুখে মুখে অনেক ইতর কথারও প্রচলন আছে, যা লেখা চলে না। ইতর কথার উদাহরণ দেওয়াটা সুরুচিসংগত নয় বলে আমি খাস-কলকাত্তাই ভাষার ইতরতার বিশেষ পরিচয় এখানে দিতে পারলুম না। কলকাতার লোকের আটহাত আটপৌরে ধুতির মতো তাদের আটপৌরে ভাষাও বি- কচ্ছ, এবং সেই কারণেই তার সাহায্যে ভদ্রতা রক্ষা হয় না। স্ত্রীর প্রতি ম-কারাদি প্রয়োগ করা, যাদের জঙ্গল কেটে কলকাতায় বাস সেইসকল ভদ্রলোকেরই মুখে সাজে, বাঙালি ভদ্রলোকের মুখে সাজে না। এই কারণেই বাঙালে ভাষা কিংবা কলকাত্তাই ভাষা, এ উভয়ের কোনোটিই অরিকল লেখার ভাষা হতে পারে না। আমি যে-প্রাদেশিক ভাষাকে দক্ষিণদেশী ভাষা বলি, সেই ভাষাই সম্পূর্ণরূপে সাহিত্যের পক্ষে উপযোগী।
বিভক্তির কথা
আমি পূর্বে বলেছি যে, ঐ দক্ষিণদেশী ভাষাই তার আকার এবং বিভক্তি নিয়ে এখন সাধুভাষা বলে পরিচিত। অথচ আমি তার বন্ধন থেকে সাহিত্যকে কতকটা পরিমাণে মুক্ত করে এ যুগের মৌখিক ভাষার অনুরূপ করে নিয়ে আসবার পক্ষপাতী। এবং আমার মতে, খাস-কলকাত্তাই নয়, কিন্তু কলিকাতার ভদ্রসমাজের মুখের ভাষা অনুসরণ করেই আমাদের চলা কর্তব্য।
জীবনের ধর্মই হচ্ছে পরিবর্তন। জীবন্ত ভাষা চিরকাল এক রূপ ধারণ করে থাকে না, কালের সঙ্গে সঙ্গেই তার রূপান্তর হয়। চসারের ভাষায় আজকাল কোনো ইংরেজ লেখক কবিতা লেখেন না, শেক্সপীয়ারের ভাষাতেও লেখেন না। কালক্রমে মুখে মুখে ভাষার যে পরিবর্তন ঘটেছে তাই গ্রাহ্য করে নিয়ে তাঁরা সাহিত্যরচনা করেন। আমাদেরও তাই করা উচিত। ভাষার গঠনের বদলের জন্য বহু যুগ আবশ্যক, শব্দের আকৃতি ও রূপ নিত্যই বদলে আসছে। ভাষা একবার লিপিবদ্ধ হলে অক্ষরে শব্দের রূপ অনেকটা ধরে রাখে, তার পরিবর্তনের পথে বাধা দেয়, কিন্তু একেবারে বন্ধ করতে পারে না। আর, যে-সকল শব্দ লেখায় ব্যবহৃত হয় না, তাদের চেহারা মুখে মুখে চটপট বদলে যায়। আজকাল আমরা নিত্য যে ভাষা ব্যবহার করি, তা আমাদের প্রাচীন সাহিত্যের ভাষা হতে অনেক পৃথক্। প্রথমত, সংস্কৃত ভাষার অনেক শব্দ আজকাল বাংলায় ব্যবহৃত হয় যা পূর্বে হত না; দ্বিতীয়ত, অনেক শব্দ যা পূর্বে ব্যবহার হত তা এখন ব্যবহার হয় না; তৃতীয়ত, যে কথায় পূর্বে চলন ছিল তার আকার এবং বিভক্তি অনেকটা নতুন রূপ ধারণ করেছে। আমার মতে সাহিত্যের ভাষাকে সজীব করতে হলে তাকে এখনকার ভদ্রসমাজের প্রচলিত ভাষার অনুরূপ করা চাই। তার জন্য অনেক কথা যা পূর্বে প্রচলিত ছিল, কিন্তু সংস্কৃতের অত্যাচারে যা আজকাল আমাদের সাহিত্যের বহির্ভূত হয়ে পড়েছে, তা আবার লেখায় ফিরিয়ে আনতে হবে। তার পর মুখে মুখে প্রচলিত শব্দের আকারের এবং বিভক্তির যে পরিবর্তন ঘটেছে, সেটা মেনে নিয়ে তাদের বর্তমান আকারে ব্যবহার করাই শ্রেয়। ‘আসিতেছি’ শব্দের এই রূপটি সাধু, এবং ‘আসছি’ এই রূপটি অসাধু বলে গণ্য। শেষোক্ত আকারে এই কথাটি ব্যবহার করতে গেলেই আমাদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আনা হয় যে, আমরা বঙ্গসাহিত্যের মহাভারত অশুদ্ধ করে দিলুম। একটু মনোযোগ করে দেখলেই দেখা যায় যে, ‘আসছি’ ‘আসিতেছি’র অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ আকার। আমাদের প্রাচীন সাহিত্যে যে ‘আসিতেছি’র ব্যবহার আছে তার কারণ, তখন লোকের মুখে কথাটি ঐ আকারেই ব্যবহৃত হত। আজও উত্তর এবং পূর্ববঙ্গে মুখে মুখে ঐ আকারই প্রচলিত। সমগ্র বাংলাদেশ ভাষা সম্বন্ধে পূর্বে যেখানে ছিল, উত্তর এবং পূর্ববঙ্গ আজও সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু দক্ষিণবঙ্গ অনেক এগিয়ে এসেছে। ‘আসিতেছি’তে আসিতে’ এবং ‘আছি’ এই দুটি ক্রিয়া গা-ঘেঁষাঘেঁষি করে রয়েছে, দুয়ে মিলে একটি ক্রিয়া হয়ে ওঠে নি। কিন্তু শব্দটির ‘আসছি’ এই আকারে ‘আছি’ এই ক্রিয়াটি লুপ্ত হয়ে ‘ছি’ এই বিভক্তিতে পরিণত হয়েছে। সুতরাং ‘আসছি’র অপেক্ষা ‘আসিতেছি’ কোনো হিসেবেই অধিক শুদ্ধ নয়, শুধু বেশি সেকেলে, বেশি ভারী এবং বেশি অচল আকার। সুতরাং ‘আসিতেছি’ পরিহার করে ‘আসছি’ ব্যবহার করতে আমরা যে পিছপাও হই নে, তার কারণ এ কার্য করাতে ভাষাজগতে পিছনো হয় না, বরং সর্বতোভাবে এগনোই হয়।
ঐ একই কারণে ‘করিয়া’ যে ‘ক’রে’ অপেক্ষা বেশি শুদ্ধ, তা নয় শুধু বেশি প্রাচীন। ও-দুয়ের একটিও সংস্কৃত ব্যাকরণের বিভক্তি নয়, দু-ই খাঁটি বাংলা বিভক্তি। প্রভেদ এই মাত্র যে, পূর্বে মুখের ভাষায় ‘করিয়া’র চলন ছিল, এখন ক’রে’র চলন হয়েছে। চণ্ডীদাস তাঁর সানুনাসিক বীরভূমী সুরে মুখে বলতেন ‘করিঞা’, তাই লিখেছেনও ‘করিঞা’। কৃত্তিবাস ভারতচন্দ্র প্রভৃতি নদিয়া জেলার গ্রন্থকারেরা মুখে বলতেন ‘করা’ ‘ধরা’, তাই তাঁরা লেখাতেও যেভাবে উচ্চারণ করতেন সেই উচ্চারণ অবিকল বজায় রাখবার জন্য ‘ধরিয়া’ ‘করিয়া’ আকারে লিখতেন। সম্ভবত কৃত্তিবাসের সময়ে অক্ষরে আকারে যুক্ত য-ফলা লেখবার সংকেত উদ্ভাবিত হয় নি বলেই সে যুগের লেখকেরা ঐ যুক্ত স্বরবর্ণের সন্ধিবিচ্ছেদ করে লিখেছেন। ভারতচন্দ্রের সময়ে সে সংকেত উদ্ভাবিত হয়েছিল, তাই তিনি যদিচ পূর্ববর্তী কবিদের লিখনপ্রণালী সাধারণত অনুসরণ করেছিলেন, তবুও নমুনা স্বরূপ কতকগুলি কবিতাতে ‘বাঁধ্যা’ ‘ছাঁদ্যা’ আকারেরও ব্যবহার করেছেন। অদ্যাবধি উত্তরবঙ্গে আমরা দক্ষিণবঙ্গের সেই পূর্বপ্রচলিত উচ্চারণভঙ্গিই মুখে মুখে রক্ষা করে আসছি। ‘ক’রে’র তুলনায় ‘করা’ শুধু শ্রুতিকটু নয়, দৃষ্টিকটুও বটে, কেননা ঐ আকারে শব্দটি মুখ থেকে বার করতে হলে মুখের কিঞ্চিৎ অধিক ব্যাদান করা দরকার। অথচ লিপিবদ্ধ বাক্যের এমনি একটি মোহিনী শক্তি আছে যে, মুখরোচক না হলেও তা আমাদের শিরোধার্য হয়ে ওঠে। ‘ইতাম’ ‘তেম’ এবং ‘তুম’-এর মধ্যে একই রকমের প্রভেদ আছে। তবে ‘উম’-রূপ বিভক্তিটি অদ্যাবধি কেবলমাত্র কলকাতা শহরে আবদ্ধ, সুতরাং সমগ্র বাংলাদেশে যে সেটি গ্রাহ্য হবে সে বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে, বিশেষত যখন ‘হালুম’ ‘হুলুম’ প্রভৃতি শব্দের সঙ্গে অপর এক জীবের ভাষার সাদৃশ্য আছে। এই এক ‘উম’ বাদ দিয়ে কলকাতার বাদবাকি উচ্চারণের ভঙ্গিটি যে কথিত বঙ্গভাষার উপর আধিপত্য লাভ করবে তার আর সন্দেহ নেই। আসলে হচ্ছেও তাই। আজকাল উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম সকল প্রদেশেরই বাঙালি ভদ্রলোকের মুখের ভাষা প্রায় একই রকম হয়ে এসেছে। প্রভেদ যা আছে সে শুধু টানটুনের। লিখিত ভাষার রূপ যেমন কথিত ভাষার অনুকরণ করে, তেমনি শিক্ষিত লোকদের মুখের ভাষাও লিখিত ভাষার অনুসরণ করে। এই কারণেই দক্ষিণদেশী ভাষা, যা কালক্রমে সাহিত্যের ভাষা হয়ে উঠেছে, নিজ প্রভাবে শিক্ষিতসমাজেরও মুখের ভাষার ঐক্য সাধন করছে। আমি পূর্বেই বলেছি যে, আমার বিশ্বাস, ভবিষ্যতে কলকাতার মৌখিক ভাষাই সাহিত্যের ভাষা হয়ে উঠবে। তার কারণ, কলকাতা রাজধানীতে বাংলাদেশের সকল প্রদেশের অসংখ্য শিক্ষিত ভদ্রলোক বাস করেন। ঐ একটি মাত্র শহরে সমগ্র বাংলাদেশ কেন্দ্রীভূত হয়েছে। এবং সকল প্রদেশের বাঙালি জাতির প্রতিনিধিরা একত্র হয়ে পরস্পরের কথার আদান-প্রদানে যে নব্যভাষা গড়ে তুলছেন, সে ভাষা সর্বাঙ্গীণ বঙ্গভাষা। সুতানুটি গ্রামের গ্রাম্যভাষা এখন কলকাতার অশিক্ষিত লোকদের মুখেই আবদ্ধ হয়ে রয়েছে। আধুনিক কলকাতার ভাষা বাঙালি জাতির ভাষা, আর খাস-কলকাত্তাই বুলি শুধু শহুরে cockney ভাষা।
পৌষ ১৩১৯