কোনো-একটি সাহিত্যসভায় পড়া হবে বলে লিখিত
আপনাদের সেক্রেটারি মহাশয় আমাকে আপনাদের সুমুখে উপস্থিত হয়ে দু-চার কথা বলবার জন্যে বহুদিন ধরে অনুরোধ করে আসছেন। কতকটা অবসরের অভাবের দরুন, কতকটা আলস্যবশত সে অনুরোধ আমি এতদিন রক্ষা করতে পারি নি। তিনি যে বিষয়ে আমাকে বলতে অনুরোধ করেন, সে বিষয়ে ভালো করে কিছু বলবার জন্য আগে থেকে প্রস্তুত হওয়া দরকার, এবং তার জন্য কতকটা অবসরও চাই, কতকটা পরিশ্রমও চাই। রামমোহন রায় সম্বন্ধে যেমন-তেমন করে যা-হোক একটা প্রবন্ধ গড়ে তুলতে আমার নিতান্ত অপ্রবৃত্তি হয়। যে ব্যক্তিকে আমি এ যুগের অদ্বিতীয় মহাপুরুষ বলে মনে করি, তাঁকে মৎফরাক্কা রকম একটা সার্টিফিকেট দিতে উদ্যত হওয়াটা আমার মতে ধৃষ্টতার চরম সীমা।
শেষটা আপনাদের সেক্রেটারি মহাশয় যখন আমাকে কথোপকথনচ্ছলে এই মহাপুরুষের সঙ্গে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেবার অনুমতি দিলেন, তখন আমি তাঁর উপরোধ এড়িয়ে যাবার কোনো পথ দেখতে পেলুম না।
কিছুদিন পূর্বে প্রবাসী পত্রিকা এ যুগের বাংলাদেশের সবচাইতে বড়ো লোক কে, পাঠকদের কাছ থেকে এই প্রশ্নের জবাব চেয়েছিল। পাঠকদের ভোটে স্থির হয়ে গেল যে, সে ব্যক্তি রাজা রামমোহন রায়। দেশের লোক যে এ সত্য আবিষ্কার করেছে, এ দেখে আমি মহা খুশি হলুম। কিন্তু সেইসঙ্গে আমার মনে একটি প্রশ্নও জেগে উঠল। রামমোহন রায় যে বাংলার, শুধু বাংলার নয়, বর্তমান ভারতবর্ষের অদ্বিতীয় মহাপুরুষ, এ সত্য বাঙালি কি উপায়ে আবিষ্কার করলে? রামমোহন রায়ের লেখার সঙ্গে চাক্ষুষ পরিচয় আছে এমন লোক আমার পরিচিতের মধ্যে একান্ত বিরল, অথচ এঁদের মধ্যে অধিকাংশই হচ্ছেন যথোচিত সুশিক্ষিত এবং দস্তুরমত স্বদেশভক্ত। লোকসমাজে অনেকেরই বিশ্বাস যে, রামমোহন রায় বাংলা গদ্যের সৃষ্টি করেছেন। তিনি বাংলার সর্বপ্রথম গদ্যলেখক কি না, সে বিষয়ে সন্দেহ আছে; কিন্তু যে বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই তা এই যে, তিনি হচ্ছেন বাংলা গদ্যের প্রথম লেখকদের মধ্যে সর্বপ্রধান লেখক। অথচ তাঁর লেখার সঙ্গে বাংলা লেখকদেরও পরিচয় এত কম যে, তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ এ – কথা লিখতেও কুণ্ঠিত হন না যে, রামমোহন রায় ইংরেজি গদ্যের অনুকরণে বাংলা গদ্য রচনা করেছিলেন। এর পর যদি কেউ বলেন যে, শঙ্করের গদ্য হার্বার্ট স্পেন্সারের অনুকরণে রচিত হয়েছিল তাতে আশ্চর্য হবার কোনোই কারণ নেই।
২
এখন জিজ্ঞাস্য হচ্ছে, রামমোহন রায় এই অল্পকালের মধ্যেই ইতিহাসের বহির্ভূত হয়ে কিংবদন্তির অন্তর্ভূত হয়ে পড়লেন কেন। এ প্রশ্নের সহজ উত্তর এই যে, সাধারণত লোকের মনে এইরকম একটা ধারণা আছে যে, রামমোহন রায় বাঙালি জাতির একজন মহাপুরুষ নন, কিন্তু বাংলার একটি নব ধর্মসম্প্রদায়ের একজন মহাজন।
এ ভুল ধারণার জন্য দোষী কে? ব্রাহ্মসমাজ না হিন্দুসমাজ? এ প্রশ্নের উত্তর আজকের সভায় দিতে আমি প্রস্তুত নই, কেননা তা হলেই নানারূপ মতভেদের পরিচয় পাওয়া যাবে, নানারূপ তৰ্ক উঠবে এবং সে তর্ক শেষটা বাবিতণ্ডায় পরিণত হবে। ইংরেজদের ভদ্রসমাজে ধর্ম ও পলিটিক্সের আলোচনা নিষিদ্ধ, কেননা বহুকালের সঞ্চিত অভিজ্ঞতার ফলে প্রমাণ হয়েছে যে, এই দুই বিষয়ের আলোচনায় লোকে সচরাচর ধৈর্যের চাইতে বীর্য বেশির ভাগ প্রকাশ করে। ফলে বন্ধুবিচ্ছেদ জ্ঞাতিবিরোধ প্রভৃতি জন্মলাভ করে, এক কথায় হাত হাত সমাজের শান্তিভঙ্গ হয়। এ ক্ষেত্রে আমি রামমোহন রায়ের ধর্মমতের আলোচনায় যদি প্রবৃত্ত হই, তা হলে তাঁর সমসাময়িক সেই পুরোনো কলহের আবার সৃষ্টি করব। একশো বৎসর আগে রামমোহন রায়কে তাঁর বিপক্ষ দলের কাছ থেকে যে-সকল যুক্তিতর্ক শুনতে হত, আজকের দিনে আমাদেরও সেই-সব যুক্তিতর্ক শুনতে হবে। রামমোহন রায়ের রচিত পথ্যপ্রদান প্রভৃতি পড়ে দেখবেন, সে যুগের ধর্মসংস্থাপনকারীরা যে ভাবে যে ভাষায় তাঁর মতের প্রতিবাদ করেছিলেন, এ যুগেও সেই ভাব সেই ভাষায় নিত্য প্রকাশ পায়। এই একশো বৎসরের ভিতর মনোরাজ্যে আমরা বড়ো বেশিদূর এগোই নি। অতএব এ ক্ষেত্রে রামমোহন রায়ের ধর্মমত সম্বন্ধে নীরব থেকে তাঁর সামাজিক মতেরই যৎকিঞ্চিৎ পরিচয় দিতে চেষ্টা করব। তার থেকেই দেখতে পাবেন যে, তাঁর চাইতে বড়ো মন ও বড়ো প্রাণ নিয়ে এ যুগে ভারতবর্ষে অপর কোনো ব্যক্তি জন্মগ্রহণ করেন নি। মানুষমাত্রেরই জ্ঞানের আশ্রয় হচ্ছে দুটি বাইরের জিনিস; এক মানবসমাজ, আর-এক বিশ্ব। ইংরেজি দর্শনের ভাষায় যাকে cosmic consciousness এবং social consciousness বলে, মানুষমাত্রেরই মনে এ দুই consciousness অল্পবিস্তর আছে।
এ বিশ্বের অর্থ কি, এর সঙ্গে আমার সম্বন্ধ কি, সে সম্বন্ধ ইহজীবনের কি অনন্তকালের, এই শ্রেণীর প্রশ্নের মূল হচ্ছে কমিক কনশাসনেস; এবং সকল ধর্ম, সকল দর্শনের উদ্দেশ্য হচ্ছে এই- সব প্রশ্নের জবাব দেওয়া। অপরপক্ষে ইহজীবনে কি উপায়ে আমার অভ্যুদয় হবে, সমাজের সঙ্গে আমার সম্বন্ধ কি, তার প্রতি আমার কর্তব্যই বা কি, কিরূপ কর্ম সমাজের পক্ষে এবং সামাজিক ব্যক্তির পক্ষে মঙ্গলকর, এই শ্রেণীর প্রশ্নের মূল হচ্ছে সোশ্যাল কনশাসনেস; তাই পলিটিক্স আইন শিক্ষা প্রভৃতির উদ্দেশ্য হচ্ছে, সমাজের মঙ্গল সাধন করা।
নিত্য দেখতে পাই যে, এ দেশের লোকের মনে এদানিক এই ভুল বিশ্বাস জন্মলাভ করেছে, যে, ভারতবর্ষে পূরাকালে ছিল একমাত্র কমিক কনশাসনেস এবং ইউরোপে বর্তমানে আছে শুধু সোশ্যাল কনশাসনেস। আমাদের দেশের শাস্ত্র মুক্তকণ্ঠে এর প্রতিবাদ করছে। যাকে আমরা মোক্ষশাস্ত্র বলি, তা কমিক কনশাসনেস হতে উদ্ভূত, আর যাকে আমরা ধর্মশাস্ত্র রলি, তা সোশ্যাল কনশাসনেস হতে উদ্ভূত। জ্ঞানমার্গ ও কর্মমার্গ সেকালে ছিল ঠিক উলটো উলটো পথ। ব্রহ্মজিজ্ঞাসার সঙ্গে কর্মজিজ্ঞাসার যে কি প্রভেদ, তা যিনি বেদান্তের দু-পাতা উলটেছেন তিনিই জানেন। এ দুই যে বিভিন্ন শুধু তাই নয়, এ উভয়ের ভিতর স্পষ্ট বিরোধ ছিল। কর্ম যখন ক্রিয়াকলাপে পরিণত হয় তখন জ্ঞানকাণ্ড তার প্রতিবাদ করতে বাধ্য, আর ধর্ম যখন কর্মহীন জ্ঞানে পরিণত হয় তখন কর্মকাণ্ড তার প্রতিবাদ করতে বাধ্য হয়। জ্ঞানকর্মের সমন্বয় করবার জন্য ভারতবর্ষে যুগে যুগে বহু মহাপুরুষের আবির্ভাব হয়েছে, যাঁদের কাছে এ সত্য প্রত্যক্ষ ছিল যে, কর্মহীন জ্ঞান পঙ্গু, এবং জ্ঞানহীন কর্ম অন্ধ। রামমোহন রায় এঁদেরই বংশধর, এঁদের পাঁচজনেরই একজন।
৩
তিনি যে জ্ঞানকর্মের সমন্বয় করতে ব্রতী হয়েছিলেন তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ এই, সেকালে তাঁর বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ ছিল যে, তিনি গৃহী হয়েও ব্রহ্মজ্ঞানী হবার ভান করতেন, এক কথায় তিনি ছিলেন একজন ‘ভাক্তজ্ঞানী’।
এই ‘ভাক্ত’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে গৌণ, অপ্রধান ইত্যাদি। এই বিশেষণে বিশেষিত হতে রামমোহন রায় কখনোই আপত্তি করেন নি। তিনি মুক্ত কণ্ঠে বলেছেন যে, তিনি যে ব্রহ্মের স্বরূপ জানেন, এমন স্পর্ধা তিনি কখনোই রাখেন নি। তবে গৃহীর পক্ষে যে বাহ্যিক ক্রিয়াকলাপই একমাত্র সেব্য ধর্ম এবং গৃহস্থের পক্ষে যে ব্রহ্মনিষ্ঠ হওয়া অসম্ভব, এ কথা যেমন ন্যায়বিরুদ্ধ, তেমনি অশাস্ত্রীয়। এ কথার উত্তরে ধর্মসংস্থাপনাকাঙ্ক্ষীরা যোগবাশিষ্ঠের একটি বচন তাঁর গায়ে ছুঁড়ে মেরেছিলেন। সে বচনটি হচ্ছে এই—
সংসারবিষয়াসক্তং ব্রহ্মজ্ঞোহস্থীতিবাদিনম্।
কর্মব্রহ্মোভয়ভ্রষ্টং তং ত্যজেদন্ত্যজং যথা ॥
অর্থাৎ যে ব্যক্তি সংসারসুখে আসক্ত হইয়া, আমি ব্রহ্মজ্ঞানী ইহা কহে, সে কর্ম-ব্রহ্ম উভয় ভ্রষ্ট, অতএব অন্ত্যজের ন্যায় ত্যাজ্য হয়।
এ সম্বন্ধে রামমোহন রায় বলেন—
যোগবাশিষ্ঠে ভাক্তজ্ঞানীর বিষয়ে যাহা লিখিয়াছেন, তাহা যথার্থ বটে।
এ প্রসঙ্গ উত্থাপন করবার উদ্দেশ্য হচ্ছে, এই দেখিয়ে দেওয়া যে, কর্ম ও ব্রহ্মজ্ঞানের একসঙ্গে চর্চা করা যেতে পারে কি না, এইটিই ছিল সে যুগের আসল বিবাদস্থল। এ বিবাদ আমরা আজ করি নে, কেননা দেশসুদ্ধ লোক এখন গীতাপন্থী; এবং আপনারা সকলেই জানেন যে, লোকের ধারণা যে, গীতায় শুধু জ্ঞানকর্মের নয়, সেইসঙ্গে ভক্তিরও সমন্বয় করা হয়েছে। দেশসুদ্ধ লোক আজ যে পথের পথিক হয়েছে, সে পথের প্রদর্শক হচ্ছেন রামমোহন রায়। সুতরাং ধর্মমত সম্বন্ধেও তিনি হচ্ছেন এ যুগের সর্বপ্রথম এবং সর্বপ্রধান মহাজন। যে শাস্ত্রের বচনসকল আজ শিক্ষিত অশিক্ষিত সকল লোকের মুখে মুখে ফিরছে, রামমোহন রায়কে সেই বেদান্তশাস্ত্রের আবিষ্কর্তা বললেও অত্যুক্তি হয় না। আপনারা শুনে আশ্চর্য হয়ে যাবেন যে, সেকালে একদল পণ্ডিত তাঁর বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আনেন যে, উপনিষদ বলে সংস্কৃত ভাষায় কোনো শাস্ত্রই নেই, ঈশ কেন কঠ প্রভৃতি নাকি তিনি রচনা করেছিলেন। এ অভিযোগ এত লোকে সত্য বলে বিশ্বাস করেন যে, রামমোহন এই মিথ্যা অভিযোগের হাত থেকে নিষ্কৃতি লাভ করবার জন্য প্রকাশ্যে এই জবাব দিতে বাধ্য হয়েছিলেন যে, এই কলিকাতা শহরে শ্রীযুক্ত মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকারের বাড়িতে গেলেই সকলে দেখতে পাবেন যে, বেদান্তশাস্ত্রের সকল পুথিই তাঁর ঘরে মজুত আছে। বিশেষ করে মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকারের নাম উল্লেখ করবার কারণ এই যে, তিনি ছিলেন রামমোহন রায়ের বিপক্ষদলের সর্বাগ্রগণ্য পণ্ডিত।
৪
রামমোহন রায় সম্বন্ধে আর-একটি লৌকিক ভুল ধারণা এই যে, তিনি ছিলেন ইংরেজি শিক্ষার একটি product, অর্থাৎ ইউরোপের কাব্য ইতিহাস দর্শন বিজ্ঞানের প্রভাবেই তাঁর মন তৈরি হয়েছিল, এক কথায় তিনি আমাদেরই জাত। আমার ধারণা যে অন্যরূপ সে কথা আমি পূর্বেই বলেছি। আমি আজ বছর তিনেক আগে এই মত প্রকাশ করি যে
আমি অতঃপর আপনাদের কাছে যা কিছু নিবেদন করব, তা সবই স্বমত সমর্থন করবার অভিপ্ৰায়ে।
তার পর তাঁর বাংলা ও ইংরেজি লেখার সঙ্গে যাঁর পরিচয় আছে তিনিই জানেন যে, পৌত্তলিকতার মতো খৃস্টানধর্মকেও তিনি সমান প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁর মতে ও-ধর্মও আসলে একটি পৌরাণিক ধর্ম, অতএব তাঁর মতো শংকরের শিষ্যের নিকট তা অগ্রাহ্য। রামমোহন রায়কে শংকরের শিষ্য বলায় আমি নিজের মত প্রকাশ করছি নে। গোস্বামীর সহিত বিচার (১৮১৮) পড়ে দেখবেন যে, তিনি মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেছেন যে, তিনি আচার্যের শিষ্য। আজকের দিনে এ শিষ্যত্ব অস্বীকার করাতেই আমরা সাহসের পরিচয় দিই; কিন্তু সেকালে এ কথা স্বীকার করায় তিনি অতিসাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন। বাংলাদেশে তখন বৈষ্ণবধর্মের প্রতিপত্তি সম্প্রদায়বিশেষের মধ্যে অপ্রতিহত ছিল। আর যাঁরা চৈতন্য-চরিতামৃত আলোচনা করেছেন তাঁরাই জানেন যে,
উক্ত ধর্মের প্রবর্তক স্বয়ং চৈতন্যদেব সার্বভৌমকে স্পষ্টাক্ষরে বলেছিলেন যে, তিনি বেদান্ত মানেন কিন্তু আচার্য মানেন না, অর্থাৎ তিনি উপনিষদ্ মানেন কিন্তু তার শাংকরভাষ্য মানেন না। সে যাই হোক, এ কথা নিঃসন্দেহ যে, ইউরোপের ধর্মমত রামমোহন রায়ের মনের উপর প্রভুত্ব করে নি।
তার পর ইউরোপের প্রাচীন কিংবা অর্বাচীন দর্শনের সঙ্গে যে তাঁর কোনোরূপ পরিচয় ছিল তার প্রমাণ তাঁর লেখা থেকে পাওয়া যায় না। অতএব আমাদের স্বীকার করতেই হবে যে, সে শাস্ত্রের সঙ্গে তাঁর পরিচয় থাকলেও তার শিক্ষা তাঁর মনের উপর দিয়ে অয়েলক্লথের উপর দিয়ে জল যেরকম গড়িয়ে যায়, সেই ভাবে গড়িয়ে গিয়েছিল, তাতে করে তাঁর মনকে ভেজাতে পারে নি।
অতএব আমি জোর করে বলতে পারি যে, রামমোহনের cosmic consciousness ছিল ষোলো-আনা ভারতবর্ষীয়। সত্য কথা বলতে গেলে তিনি এ যুগে বাংলাদেশে প্রাচীন আর্য মন নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। সে মনের পরিচয় আমি এখানে দু কথায় দিতে চাই। আপনারা সকলেই জানেন যে কান্টের দর্শন তিন ভাগে বিভক্ত : প্রথম pure reason, দ্বিতীয় practical reason, আর তৃতীয় aesthetic judgment। আমার বিশ্বাস, ভারতবর্ষীয় আর্যেরা যার বিশেষভাবে চর্চা করেছিলেন, সে হচ্ছে এক pure reason, আর-এক practical reason; এবং রামমোহনের অন্তরে এই দুই reasonই পূর্ণমাত্রায় প্রস্ফুটিত হয়ে উঠেছিল। তিনি অলংকারশাস্ত্রকে কখনো দর্শনশাস্ত্র বলে গ্রাহ্য করেন নি, রসতত্ত্বকে আত্মতত্ত্ব বলে ভুল করেন নি, অর্থাৎ মানুষের মনের aesthetic অংশের তাঁর কাছে বিশেষ কিছু মর্যাদা ছিল না। বেদান্তের ধর্ম spiritual, কিন্তু emotional নয়; মীমাংসার ধর্ম ethical, কিন্তু emotional নয়। অপরপক্ষে খৃস্টান বৈষ্ণব মুসলমান প্রভৃতির ধর্মে emotional অংশ অতি প্রবল এবং সকল দেশের সকল মূর্তিপূজার মূলে মানুষের সৌন্দর্যবোধ আছে।
কিছুদিন পূর্বে রামমোহন রায়ের একটি নাতিদীর্ঘ জীবনচরিত ইংরেজি ভাষায় বিলাতে প্রকাশিত হয়। গ্রন্থকার তাঁর নাম গোপন রেখেছেন। এ পুস্তকে তাঁর সম্বন্ধে অনেক নূতন কথা আছে। তার মধ্যে একটি কথা হচ্ছে এই যে, তিনি বিলাতে গিয়ে খৃস্টধর্মের প্রতি অনুকূল হয়েছিলেন, এবং, লেখকের বিশ্বাস, তিনি আরো কিছুদিন বেঁচে থাকলে সম্ভবত খৃস্টধর্ম অবলম্বন করতেন। এ কথা বিশ্বাস করা আমার পক্ষে অসম্ভব। তবে তিনি যে উক্ত ধর্মের সঙ্গে বিশেষ পরিচয়ের ফলে তার প্রতি অনুকূল হয়েছিলেন, এ কথা গ্রাহ্য করায় বাধা নেই। বাইবেলের যে অংশ, রামমোহনের ভাষায় বলতে হলে, ‘বড়াই বুড়ির কথায়’ পরিপূর্ণ, তিনি সেই অংশের উপরেই বরাবর তাঁর বিদ্রূপবাণ বর্ষণ করে এসেছিলেন; কিন্তু খৃস্টধর্মের যে অংশ spiritual এবং eth- ical সে অংশের প্রতি অনুকূল হওয়া ছাড়া উদারচেতা লোকের উপায়ান্তর নেই। আর রামমোহনের স্বভাবের আর যে দোষই থাকুক তিনি সংকীর্ণমনা ছিলেন না। ধর্ম সম্বন্ধে তাঁর অন্তরে যে গোঁড়ামির লেশমাত্র ছিল না, তিনি যে একটি নতুন সম্প্রদায় গড়তে চান নি, কিন্তু স্বজাতিকে সাম্প্রদায়িক মনোভাব থেকে মুক্তি দিতে চেয়েছিলেন, তার পরিচয় আদিব্রাহ্মসমাজের ট্রস্ট ডীডে পাবেন। পৃথিবীতে আমরা দু জাতীয় অতিমানুষের সাক্ষাৎ পাই, এক যাঁরা saviour অর্থাৎ অবতার হিসেবে গণ্য, আর-এক যাঁরা liberator হিসেবে গণ্য। রাজা রামমোহন রায় ছিলেন এই শেষোক্ত শ্রেণীর একজন মহাপুরুষ।
৫
আজকের সভায় আমি বিশেষভাবে রামমোহন রায়ের social consciousnessএর পরিচয় দিতে প্রতিশ্রুত হয়েছি। তবে তাঁর ধর্মবুদ্ধির পরিচয় না দিলে তাঁর সম্বন্ধে আলোচনা অঙ্গহীন হয় বলে যতদূর সম্ভব সংক্ষেপে তাঁর দার্শনিক মনোভাবের পরিচয় দিতে বাধ্য হয়েছি। কারো ছবি আঁকতে বসে তাঁর মাথা বাদ দিয়ে দেহটি আঁকলে সে চিত্র যে পূর্ণাঙ্গ হয় না তা বলাই বাহুল্য।
রামমোহন রায় যখন যুবক তখন ইংরেজ এ দেশের একছত্র রাজা হয়ে বসেছেন। সমগ্র দেশ তখন ইংরেজের রাষ্ট্রনীতির অধীন হয়ে পড়েছে, আমাদের সমগ্র জীবনের উপর ইঙ্গ-সভ্যতার প্রভাব এসে পড়েছে। ইংরেজের শাসন ও ইংরেজি সভ্যতার প্রভাব যে আমাদের জাতীয় জীবনের মহা পরিবর্তন ঘটাবে, এ সত্য সর্বপ্রথমে রামমোহন রায়ের চোখেই ধরা পড়ে। এই অতুলশক্তিশালী নবসভ্যতার সংঘর্ষে ভারতবাসীদের অন্তত আত্মরক্ষার জন্যও সে সভ্যতার ধর্মকর্মের পরিচয় নেওয়াটা নিতান্ত আবশ্যক হয়ে পড়েছিল। এই যুগসন্ধির মুখে একমাত্র রামমোহন রায়ের অন্তরে সমগ্র ভারতবর্ষ তার আত্মজ্ঞান লাভ করেছিল। রামমোহন এই মহাসত্য আবিষ্কার করেন যে, এই নবসভ্যতার সাহায্যে ভারতবাসী, শুধু আত্মরক্ষা নয়, স্বজাতির আত্মোন্নতি করতে পারবে। তাই জাতীয় আত্মোন্নতির যে পথ তিনি ধরিয়ে দিয়ে গিয়েছেন, অদ্যাবধি আমরা সেই পথ ধরে চলেছি। ইতিমধ্যে আর কেউ কোনো পথ আবিষ্কার করেছেন বলে তো আমার জানা নেই। যাকে সময়ে সময়ে আমরা নূতন পথে যাত্রা বলি, সে রামমোহন রায়ের প্রদর্শিত মার্গে পিছু হটবার প্রয়াস ছাড়া আর কিছুই নয়।
৬
পৃথিবীতে যে-সকল লোককে আমরা মহাপুরুষ বলি, তাঁরা প্রত্যেকেই জাতীয় মন ও জাতীয় জীবনকে এমন একটা নতুন পথ ধরিয়ে দেন, যে পথ ধরে মানুষে মনে ও জীবনে অগ্রসর হয়। যে পথে অগ্রসর হয়ে অতীত ভারতবর্ষ বর্তমান ভারতবর্ষে এসে পৌঁছেছে সে পথের তিনিই হচ্ছেন সর্বপ্রথম দ্রষ্টা এবং প্রদর্শক। আমাদের জীবনে যে নবযুগ এসেছে তিনিই হচ্ছেন সে যুগের আবাহক।
ইংরেজের হাতে পড়ে আমাদের জীবনের ও মনের যে আমূল পরিবর্তন ঘটবে ভারত-সভ্যতা যে নবকলেবর ধারণ করবে, এ সত্য সর্বাগ্রে রাজা রামমোহন রায়ের চোখেই ধরা পড়ে। সে যুগে তিনি ছিলেন একমাত্র লোক, যাঁর অন্তরে ভারতের ভবিষ্যৎ “সাকার হয়ে উঠেছিল। তাঁর সমসাময়িক অপরাপর বাংলা লেখকের লেখা পড়লে দেখা যায় যে, এক রামমোহন রায় ব্যতীত অপর কোনো বাঙালির এ চৈতন্য হয় নি যে, নবাবের রাজ্য কোম্পানির হাতে পড়ায় শুধু রাজার বদল হল না, সেইসঙ্গে জাতীয় জীবনের মহা পরিবর্তনের সূত্রপাত হল। ইংরেজের সঙ্গে সঙ্গে দেশে এমন সব নবশক্তি এসে পড়ল যার সমবায়ে ও সংঘর্ষে ভারতবর্ষে একটি নূতন সমাজ ও নূতন সভ্যতা গঠিত হল। এবং সে-সকল শক্তি যে কি এবং তার ভিতর কোন্ কোন্ শক্তি আমাদের জাতিগঠনের সহায় হতে পারে, সে বিষয়ে তিনি সম্পূর্ণ সজ্ঞান ছিলেন। তাঁর দৃষ্টিকে দিব্যদৃষ্টি ছাড়া আর কিছু বলা চলে না, কেননা দেড়শো বৎসর ইংরেজের রাজ্যে বাস করে এবং প্রায় একশো বৎসর ইংরেজি শিক্ষা লাভ করেও আমাদের মধ্যে আজ খুব কম লোক আছেন, শাসনতন্ত্র সম্বন্ধে শিক্ষা সম্বন্ধে সমাজ সম্বন্ধে যাঁদের ধারণা রাজা রামমোহন রায়ের তুল্য স্পষ্ট। সম্যক্ জ্ঞানের অন্তরে কোনো দ্বিধা নেই, কোনো ইতস্তত নেই। সে জ্ঞান কিন্তু শুধু স্কুলকলেজে বই পড়ে লাভ করা যায় না, ভগবদ্দত্ত প্রতিভা ব্যতীত কেউ আর যথার্থ জ্ঞানের অধিকারী হতে পারেন না। আপনারা মনে রাখবেন যে, রাজা রামমোহন ইংরেজের স্কুলকলেজে কখনো পড়েন নি, এবং ইংরেজি শিক্ষার সম্বল নিয়ে মনের দেশে যাত্রা শুরু করেন নি। সংস্কৃত আরবি ও ফারসি, এই তিন ভাষায় ও শাস্ত্রে শিক্ষিত মন নিয়েই তিনি ইংরেজি সভ্যতার দোষগুণ বিচার করতে বসেন এবং তার কোনো অংশ তিনি প্রত্যাখ্যান করেন এবং তার কোনো কোনো শক্তিকে সঞ্জীবনী শক্তি হিসেবে অঙ্গীকার করেন।
৭
জনরব এই যে, রাজা রামমোহন রায় ব্রাহ্মধর্মের প্রবর্তন করে দেশের লোককে খৃস্টধর্মের আক্রমণ হতে রক্ষা করেছেন; সে আক্রমণের বিরুদ্ধে তিনি যে লেখনী ধারণ করেছিলেন সে বিষয়ে কোনোই সন্দেহ নাই। আমি নিম্নে তাঁর একটি লেখা থেকে কতক অংশ উদ্ধৃত করে দিচ্ছি, তার থেকে আপনারা রামমোহন রায়ের মনের ও সেইসঙ্গে তাঁর বাংলা রচনার কিঞ্চিৎ পরিচয় পাবেন,
শতার্দ্ধ বৎসর হইতে অধিককাল এদেশে ইংরেজের অধিকার হইয়াছে তাহাতে প্রথম ত্রিশ বৎসরে তাঁহাদের বাক্যের ও ব্যবহারের দ্বারা ইহা সর্ব্বত্র বিখ্যাত ছিল যে তাঁহাদের নিয়ম এই যে কাহারো ধর্ম্মের সহিত বিপক্ষতাচরণ করেন না ও আপনার আপনার ধর্ম্ম সকলে করুক ইহাই তাঁহাদের যথার্থ বাসনা পরে পরে অধিকারের ও বলের আধিক্য পরমেশ্বর ক্রমে ক্রমে করিতেছেন। কিন্তু ইদানীন্তন বিশ বৎসর হইল কতক ব্যক্তি ইংরেজ যাঁহারা মিসনরি নামে বিখ্যাত হিন্দু ও মোছলমানকে ব্যক্তরূপে তাঁহাদের ধৰ্ম্ম হইতে প্রচ্যুত করিয়া খ্রিষ্টান করিবার যত্ন নানা প্রকারে করিতেছেন। প্রথম প্রকার এই যে নানাবিধ ক্ষুদ্র ও বৃহৎ পুস্তকসকল রচনা ও ছাপা করিয়া যথেষ্ট প্রদান করেন যাহা হিন্দুর ও মোছলমানের ধর্ম্মের নিন্দা ও হিন্দুর দেবতার ও ঋষির জুগুপ্সা ও কুৎসাতে পরিপূর্ণ হয়, দ্বিতীয় প্রকার এই যে লোকের দ্বারের নিকট অথবা রাজপথে দাঁড়াইয়া আপনার ধর্ম্মের ঔৎকর্ষ ও অন্যের ধর্মের অপকৃষ্টতাসূচক উপদেশ করেন, তৃতীয় প্রকার এই যে কোনো নীচলোক ধনাশায় কিম্বা অন্য কোনো কারণে খ্রিষ্টান হয় তাহাদিগ্যে কৰ্ম্ম দেন ও প্রতিপালন করেন যাহাতে তাহা দেখিয়া অন্যের ঔৎসুক্য জন্মে। যদ্যপিও যিশুখ্রিষ্টের শিষ্যেরা স্বধর্ম্ম সংস্থাপনের নিমিত্ত নানা দেশে আপন ধর্ম্মের ঔৎকর্য্যের উপদেশ করিয়াছেন কিন্তু ইহা জানা কর্তব্য যে সে সকল দেশ তাঁহাদের অধিকারে ছিল না সেই রূপ মিসনরিরা ইংরেজের অনধিকারের রাজ্যে যেমন তুরকি ও পারসিয়া প্রভৃতি দেশে যাহা ইংলণ্ডের নিকট হয় এরূপ ধর্ম উপদেশ ও পুস্তক প্রদান যদি করেন তবে ধর্ম্মার্থে নির্ভয় ও আপন আচার্য্যের যথার্থ অনুগামীরূপে প্রসিদ্ধ হইতে পারেন কিন্তু বাঙ্গালাদেশে যেখানে ইংরেজের সম্পূর্ণ অধিকার ও ইংরেজের নাম মাত্রে লোক ভীত হয় তথায় এরূপ দুর্ব্বল ও দীন ও ভয়ার্ত্ত প্রজার উপর ও তাহাদের ধর্ম্মের উপর দৌরাত্ম্য করা কি ধর্ম্মত কি লোকত প্রশংসনীয় হয় না, যেহেতু বিজ্ঞ ও ধার্মিক ব্যক্তিরা দুর্ব্বলের মনঃপীড়াতে সর্ব্বদা সঙ্কুচিত হয়েন তাহাতে যদি সেই দুৰ্ব্বল তাঁহাদের অধীন হয় তবে তাহার মৰ্ম্মান্তিক কোনোমতে অন্তঃকরণেও করেন না। এই তিরস্কারের ভাগী আমরা প্রায় নয় শত বৎসর অবধি হইয়াছি ও তাহার কারণ আমাদের অতিশয় শিষ্টতা ও হিংসা ত্যাগকে ধর্ম্ম জানা ও আমাদের জাতিভেদ যাহা সর্ব্ব প্রকারে অনৈক্যতার মূল হয়। লোকের স্বভাবসিদ্ধ প্রায় এই যে যখন এক দেশীয় লোক অন্য দেশকে আক্রমণ করে সেই প্রবলের ধর্ম্ম যদ্যপিও হাস্যাস্পদ স্বরূপ হয় তথাপি ঐ দুর্ব্বল দেশীয়ের ধর্ম ও ব্যবহারের উপহাস ও তুচ্ছতা করিয়া থাকে[১]…
[১. ব্রাহ্মণসেবধি (১৮২১)।]
যুক্তিযুক্ত ও সত্যমূলক হলে বিদ্রূপ যথেষ্ট ভদ্র হয়েও যে কতদূর সাংঘাতিক হতে পারে, উপরোক্ত বাক্য ক’টি তার একটি চমৎকার উদাহরণ। এই শ্রেণীর মারাত্মক বিদ্রূপে রামমোহন রায় সিদ্ধহস্ত। বিপক্ষের সঙ্গে তর্কযুদ্ধে শিষ্টতা তিনি কখনো ত্যাগ করেন নি; কিন্তু ‘হিংসা ত্যাগকে ধর্ম জানা’ তাঁর স্বভাব ও শিক্ষা দুইয়েরই বিরুদ্ধে ছিল। প্রসিদ্ধ জর্মান কবি হাইরিখ হাইনে (Heinrich Heine) বলে গিয়েছিলেন যে, তাঁর গোরের উপর যেন এই ক’টি কথা লেখা থাকে যে, ‘He was a brav : soldier in the war of liberation of humanity’–এ খ্যাতি রামমোহন রায় অনায়াসে আত্মসাৎ করতে পারেন। মানুষের মুক্তির জন্য তিনি জীবনের সকল ক্ষেত্রেই যুদ্ধ করতে প্রস্তুত ছিলেন। জৈন বৌদ্ধ প্রভৃতি অহিংসামূলক ধর্ম তাঁর মনের উপর কখনো প্রভুত্ব করে নি, তিনি ছিলেন বেদপন্থী ব্রাহ্মণ, অর্থাৎ রাজসিকতার মাহাত্ম্য তাঁর নিকট অবিদিত ছিল না। তামসিকতা যে অনেক স্থলে সাত্ত্বিকতার ছদ্মবেশ ধারণ করে, এ সত্যও তাঁর সম্পূর্ণ জানা ছিল। আমরা, এ যুগের বাঙালি লেখকেরা, তাঁর কাছ থেকে একটি মহাশিক্ষা লাভ করতে পারি। তর্কক্ষেত্রে সৌজন্য রক্ষা ক’রে কী ক’রে প্রতিপক্ষকে পরাভূত করা যায়, তার সন্ধান আমরা রামমোহন রায়ের লেখার ভিতর পাব, অবশ্য যদি আমরা সাহিত্যে একমাত্র বৈধ-হিংসার চর্চা করতে প্রস্তুত থাকি। যা অসত্য, যা অন্যায়, যা অবৈধ, তার পক্ষে যিনি লেখনী ধারণ করবেন তাঁর গুরু রামমোহন রায় কখনোই হতে পারেন না। কেননা তাঁর শাস্ত্রশাসিত মন অধর্মযুদ্ধের একান্ত প্রতিকূল। এখন প্রশ্ন হচ্ছে যে, এ ক্ষেত্রে রামমোহন রায় কিসের বিরুদ্ধে অসি ধারণ করেছিলেন। খৃস্টধর্মের বিরুদ্ধে নয়, কেননা কোনো ধর্মমতের প্রতি তাঁর বিদ্বেষ ছিল না। তাঁর নিজের কথা এই—
…নিন্দা ও তিরস্কারের দ্বারা অথবা লোভ প্রদর্শন দ্বারা ধর্ম সংস্থাপন করা যুক্তি ও বিচারসহ হয় না তবে বিচারবলে হিন্দুর ধর্মের মিথ্যাত্ব ও আপন ধর্মের উৎকৃষ্টত্ব ইহা স্থাপন করেন সুতরাং ইচ্ছাপূর্ব্বক অনেকেই তাঁহাদের ধর্ম্ম গ্রহণ করিবেক অথবা স্থাপন করিতে অসমর্থ হয়েন এরূপ বৃথা ক্লেশ করা ও ক্লেশ দেওয়া হইতে ক্ষমাপন্ন হইবেন, ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের ক্ষুদ্র গৃহে নিবাস ও শাকাদি ভোজন ও ভিক্ষোপজীবিকা দেখিয়া তুচ্ছ করিয়া বিচার হইতে যেন নিবৃত্ত না হয়েন যেহেতু সত্য ও ধর্ম্ম সর্ব্বদা ঐশ্বর্য্য ও অধিকারকে ও উচ্চ পদবী ও বৃহৎ অট্টালিকাকে আশ্রয় করিয়া থাকেন এমত নিয়ম নহে।[১]….
[১ . ব্রাহ্মণসেবধি (১৮২১)।]
অতএব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে যে, তিনি এ দেশে খৃস্টধর্মের প্রচারের পদ্ধতির বিরুদ্ধে লেখনী ধারণ করেছিলেন। কেননা উক্ত উপায়ে লোকের ধর্মমতের পরিবর্তন ঘটানো সকল দেশেই উপদ্রববিশেষ এবং প্রবল রাজার জাতের পক্ষে দুর্বল-প্রজার জাতের উপর এরূপ ব্যবহার নিতান্ত অত্যাচার। রামমোহন রায় সেই অত্যাচারের বিরুদ্ধেই নির্ভীক প্রতিবাদ করেছিলেন। যে যুগে ইংরেজের নামমাত্রে লোকে ভীত হত, সে যুগে ইংরেজের বিরুদ্ধে এই তীব্র প্রতিবাদ করায় তিনি যে অসাধারণ সাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন, সে সাহস সকল দেশে সকল যুগেই দুর্লভ।
৮
আজকের দিনে যে মনোভাবকে আমরা জাতীয় আত্মমর্যাদাজ্ঞান বলি, রামমোহন রায়ের এই ক’টি কথায় তার প্রথম পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর সমসাময়িক অপর কোনো ব্যক্তির মনে এ মনোভাবের যে লেশমাত্র ছিল, তার কোনো নিদর্শন নেই। কিন্তু যেটা বিশেষ করে আমাদের চোখে পড়ে সে হচ্ছে এই যে, এর মধ্যে মিছা আত্মশ্লাঘার নামগন্ধও নেই, অপরপক্ষে যথেষ্ট পরিমাণে আত্মগ্লানিও আছে। সে যুগের বাঙালি যে দুর্বল ভয়ার্ত ও দীন ছিল সে কথা তিনি মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেছেন, এবং কিসে স্বজাতির দুর্বলতা ভীরুতা ও দীনতা দূর করা যায় সেই ছিল তাঁর একমাত্র ভাবনা, আর তাঁর জাতীয় উন্নতি সাধনের সকল চেষ্টার একমাত্র লক্ষ্য ছিল স্বজাতিকে মনে ও জীবনে শক্তিশালী ও ঐশ্বর্যবান্ করে তোলা। এই কথাটি মনে রাখলে তাঁর সকল কথা সকল কার্যের প্রকৃত অর্থ আমরা বুঝতে পারি। তারপর স্বজাতিকে তিনি উন্নতির যে পথ দেখিয়ে দিয়েছিলেন সে পথ সুপথ কি কুপথ তার বিচার করতে হলে রামমোহন রায় কোন্ সত্যের উপর তাঁর মতামতের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তার সন্ধান নেওয়া আবশ্যক।
পৃথিবীতে যে-সকল লোকের মতামতের কোনো মূল্য আছে তাঁদের সকল মতামতের মধ্যে একটা সংগতি একটা ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ আছে, কেননা তাঁদের নানা বিষয়ে নানা জাতীয় মতের মূলে আছে একটি বিশেষ মানসপ্রকৃতি। রাজা রামমোহন রায় কি আধ্যাত্মিক, কি সাংসারিক, যে-কোনো বিষয়ে মত প্রকাশ করেছেন সে-সকলের ভিতর দিয়ে তাঁর অসামান্য স্বাধীনতাপ্রিয়তা সদর্পে ফুটে বেরিয়েছে। তিনি যে বেদান্তের এত ভক্ত তার কারণ, ও-শাস্ত্র হচ্ছে মোক্ষশাস্ত্র। যে জ্ঞানের লক্ষ্য মুক্তি, ফল মুক্তি, সেই জ্ঞানকে আয়ত্ত করবার উপদেশ তিনি চিরজীবন স্বজাতিকে দিয়েছেন। এ মুক্তি কিসের হাত থেকে মুক্তি? এর দার্শনিক উত্তর হচ্ছে, অবিদ্যার হাত থেকে। এই অবিদ্যা বস্তু যে কি, সে বিষয়ে তর্কের আর শেষ নেই; ফলে অদ্যাবধি কেউ এ বিষয়ে একটা স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেন নি। অবিদ্যার মেটাফিজিক্যাল রহস্য ভেদ করবার বৃথা চেষ্টা না করেও সহজ বুদ্ধির সাহায্যে বোঝা যায়—বেদান্তের প্রতিপাদ্য মোক্ষ হচ্ছে ব্রহ্মবিষয়ক লৌকিক ধর্মের সংকীর্ণ ধারণা হতে মনের মুক্তি।
আপনারা সকলেই জানেন যে, বেদান্তশাস্ত্র নেতিমূলক। বেদান্তের ‘নেতি নেতি’র সার্থকতা সাধারণ লোকের ব্রহ্মবিষয়ক সকল অলীক ধারণার নিরাস করায়। এ বিষয়ে শংকরের মত তাঁর মুখ থেকেই শোনা যাক। বেদান্তের চতুর্থ সূত্রের ভাষ্যের দুটি বাক্য এখানে উদ্ধৃত করে দিচ্ছি—
তদেব ব্রহ্ম ত্বং বিদ্ধি নেদং যদিদমুপাসতে।
অস্যার্থ : তুমি তাঁহাকেই ব্রহ্ম বলিয়া জান যিনি ইদন্তারূপে (এই, অমুক) অথবা অন্য কোনোপ্রকারে উপাসিত হন না।
ন হি শাস্ত্রমিদন্তয়া বিষয়ীভূতং ব্রহ্ম প্রতিপিপাদয়িষতি।
অস্যার্থ : বেদান্তশাস্ত্র তাঁহাকে ইদন্তারূপে (কোনোরূপ বিশেষণ দিয়া) প্রতিপাদন করিতে ইচ্ছুক নহে। শাস্ত্র এইমাত্র প্রতিপাদন করে যে, ব্রহ্মপদার্থ ইদং জ্ঞানের অবিষয়
বলা বাহুল্য ধর্মজ্ঞানের রাজ্যে, এহেন মুক্তির বারতা পৃথিবীর অপর কোনো দেশে অপর কোনো শাস্ত্রে পাওয়া যায় না। এ মত কিন্তু নাস্তিক মত নয়, এ মত শুধু সকলপ্রকার সংকীর্ণ আস্তিক মতের বিরোধী।
আধ্যাত্মিক স্বাধীনতা যেমন প্রাচীন ভারতবর্ষের আর্যসভ্যতার চরম বাণী, সামাজিক সভ্যতা তেমনি বর্তমান ইউরোপীয় আর্যসভ্যতার চরম বাণী। এ সত্য আজকের দিনে আমাদের সকলেরই নিকট প্রত্যক্ষ, কেননা এ যুগের ইউরোপীয় সভ্যতার মূলমন্ত্র যে কী তা ইংরেজি শিক্ষার প্রসাদে আমরা সবাই জানি। কিন্তু এ দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সৃষ্টির বহুপূর্বে, অর্থাৎ একশো বৎসর পূর্বে, একমাত্র রামমোহন রায়ের চোখে এ সত্য ধরা পড়ে। ইউরোপের ঐ মহামন্ত্রই যে আমাদের যথার্থ সঞ্জীবনী মন্ত্র হবে, এই বিশ্বাসই ছিল তাঁর সকল কথা সকল ব্যবহারের অটল ভিত্তি। তাই তিনি এক দিকে যেমন ইউরোপের পৌরাণিক ধর্ম অগ্রাহ্য করেছিলেন, অপর দিকে তিনি তেমনি ইউরোপের সামাজিক ধর্ম সোৎসাহে সানন্দে অঙ্গীকার করেছিলেন। এই লিবার্টির ধর্মকেই আত্মসাৎ করে ভারতবাসী যে আবার নবজীবন নবশক্তি লাভ করবে এই সত্য প্রচার করাই ছিল তাঁর জীবনের মহাব্রত।
৯
লিবার্টি শব্দটা আজকের দিনে এত অসংখ্য লোকের মুখে মুখে ফিরছে, এক কথায় এতটা বাজারে হয়ে উঠেছে যে, ভয় হয় যে, অধিকাংশ লোকের মুখে ওটা একটা বুলি ছাড়া আর কিছুই নয়। গীতার নিষ্কাম ধর্মের কথাটাকে আমরা যে একটা বুলিতে পরিণত করেছি, এ কথা তো আর সজ্ঞানে অস্বীকার করা চলে না। যে কথা মুখে আছে মনে নেই, যদিও বা মনে থাকে তো জীবনে নেই, তারই নাম না বুলি? অতএব এ স্থলে, বর্তমান ইউরোপ লিবার্টি শব্দের অর্থে কি বোঝে সে সম্বন্ধে বর্তমান ইতালির একজন অগ্রগণ্য লেখকের কথা এখানে বাংলায় অনুবাদ করে দিচ্ছি-
প্রাচীনকালে লিবার্টি শব্দের অর্থে লোকে বুঝত শুধু দেশের গভর্নমেন্টকে নিজের করায়ত্ত করা। বর্তমানে লোকে লিবার্টি বলতে শুধু রাজনৈতিক নয়, সেইসঙ্গে মানসিক ও নৈতিক স্বাধীনতার কথাও বোঝে, অর্থাৎ এ যুগে লিবার্টির অর্থ, চিন্তা করবার স্বাধীনতা, কথা বলবার স্বাধীনতা, লেখবার স্বাধীনতা, নানা লোক একত্র হয়ে দল বাঁধবার স্বাধীনতা, বিচার করবার স্বাধীনতা, নিজের মত গড়বার এবং সে মত প্রকাশ করবার, প্রচার করবার স্বাধীনতা। মানুষমাত্রেই এ-সকল ক্ষেত্রে সমান স্বাধীনতার স্বভাবতই অধিকারী, এ স্বাধীনতা, কোনো চার্চ (ধর্মসংঘ) কর্তৃকও দত্ত নয়, কোনো রাজশক্তি কর্তৃকও দত্ত নয়। এর উলটো মত হচ্ছে এই যে, হয় ধর্মসংঘ নয় রাজশক্তি সর্বশক্তিমান্, অতএব ব্যক্তির ব্যক্তিহিসেবে কোনোই স্বাধীনতা নেই। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য একটা জাতীয় সমূহের অন্তরে লীন হয়ে লুপ্ত হয়ে যায়, সে সমূহ রাজাই হোক আর রাজ্যই হোক, চার্চই হোক আর পোপই হোক।
লেখকের মতে, যে দেশে যে সমাজে ব্যক্তিমাত্রেই এই-সকল মানসিক নৈতিক ও আধ্যাত্মিক স্বাধীনতার অধিকারী নয়, সে দেশের লোকমাত্রেই দাস; সে দেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতা মিছা ও অর্থশূন্য। আমি ইচ্ছা করেই De Sanctisএর মত আপনাদের কাছে নিবেদন করছি, কেননা উক্ত লেখককে ইতালির রাজনৈতিক স্বাধীনতা উদ্ধারের জন্য আজীবন অশেষ অত্যাচার, বিশেষ শাস্তি ভোগ করতে হয়েছিল।
রাজা রামমোহন রায় লিবার্টি শব্দের এই নূতন অর্থই গ্রহণ করেছিলেন, এবং স্বজাতিকে মানসিক নৈতিক ও আধ্যাত্মিক দাসত্ব হতে মুক্তি দিতে বদ্ধপরিকর হয়েছিলেন। লিবার্টির নূতন ধারণার ভিতর একটি দার্শনিক তত্ত্ব নিহিত আছে, সে তত্ত্ব এই যে, স্বাধীনতার মধ্যেই ব্যক্তিমাত্রেরই জীবনীশক্তি স্ফূর্তি লাভ করে। এবং বহু লোকের মনে ও জীবনে এই শক্তি স্ফূর্ত হলেই জাতীয় জীবন যুগপৎ শক্তি ও উন্নতি লাভ করে। মানুষকে দাস রেখে মানবসমাজকে স্বাধীন করে তোলার যে কোনো অর্থ নেই এ জ্ঞান রামমোহন রায়ের ছিল, কেননা তিনি হেগেল প্রমুখ জর্মান দার্শনিকদের শিষ্য ছিলেন না।
১০
রামমোহন রায় জানতেন যে, তাঁর স্বজাতি দুর্বল ভয়ার্ত ও দীন, এবং এরূপ হবার কারণ, সে জাতির নয়শো বছরের পূর্ব ইতিহাস এবং এই দুর্বল ভয়ার্ত ও দীন জাতির দুর্বলতা ভয় ও দৈন্য কি উপায়ে দূর করা যায়, এই ছিল তাঁর জীবনের প্রধান ভাবনা। সুতরাং তাঁকে এক দিকে যেমন গভর্নমেন্টের আইনকানুনের দিকে নজর রাখতে হয়েছিল, অপরদিকে বাঙালির মানসিক ও সামাজিক মুক্তির উপায়ও নির্ধারণ করতে হয়েছিল।
ইংরেজিতে যাকে বলে civil and religious liberty, তার অভাবে কোনো জাতি যে মানুষ হয়ে ওঠবার সুযোগ পায় না, এ সত্য তাঁর কাছে স্পষ্ট ছিল। এই কারণে স্বজাতির সিভিল ও রিলিজিয়াস লিবার্টির রক্ষাকল্পে তখনকার ইংলণ্ডের রাজা চতুর্থ জর্জকে তিনি যে একখানি খোলাচিঠি লেখেন, সে পত্রে তিনি এতদূর স্বাধীন মনের পরিচয় দিয়েছিলেন যে, বিখ্যাত ইংরেজ দার্শনিক বেন্থাম এ রচনাকে দ্বিতীয় Areopagitica স্বরূপে শিরোধার্য করেন। পৃথিবীর স্বাধীনতার ইতিহাসে এ পত্রখানি একখানি মহামূল্য দলিল। দুঃখের বিষয় এই যে, খুব কম বাঙালির এ দলিলখানির সঙ্গে পরিচয় আছে এবং এ কালের পলিটিশিয়ানদের মোটেই নেই। নেই যে, সেটি বড়োই আশ্চর্যের কথা, কেননা যে কংগ্রেস তাঁদের রাজনৈতিক ব্যবসার প্রধান সম্বল, সেই কংগ্রেসের মূল সূত্রগুলির স্থাপনা ১৮৩২ খৃস্টাব্দে রাজা রামমোহন রায়ই করেন। অদ্যাবধি আমরা শুধু তার টীকাভাষ্যই করছি।
আধ্যাত্মিক দাসবুদ্ধির মতো সামাজিক দাসবুদ্ধিরও মূলে আছে অবিদ্যা। আজকালের ভাষায় আমরা যাকে অজ্ঞতা বলি, শাস্ত্রের ভাষায় তাকে ব্যাবহারিক অবিদ্যা বলা যেতে পারে।
জাতীয় মনকে এই অবিদ্যার মোহ থেকে উদ্ধার করবার জন্য রামমোহন রায় এ দেশে ইউরোপীয় শিক্ষাকে আবাহন করে নিয়েছিলেন। যে জ্ঞান সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত নয় কিন্তু ছেরে প কল্পনামূলক, সে জ্ঞান মানুষকে মুক্তি দিতে পারে না। রামমোহন রায় আবিষ্কার করেন যে, ইউরোপীয়দের অন্তত দুটি শাস্ত্র আছে, সত্য যার ভিত্তি : এক বিজ্ঞান, আর-এক ইতিহাস। এই বিজ্ঞানের প্রসাদে এ বিশ্বের গঠন ও ক্রিয়ার যথার্থ জ্ঞান লাভ করা যায়, আর এই ইতিহাসের কাছ থেকে মানবসমাজের উত্থান-পতন-পরিবর্তনের যথার্থ জ্ঞান লাভ করা যায়; অন্তত এ দুইয়ের চর্চার ফলে মানুষের মন মানুষ সম্বন্ধে ও বিশ্ব সম্বন্ধে ‘বড়াই বুড়ির কথা’র প্রভুত্ব হতে নিষ্কৃতি লাভ করে। যে-কোনো ক্ষেত্রেই হোক-না কেন, অবিদ্যার হাত থেকে উদ্ধার পাওয়ার নাম মুক্তিলাভ করা এবং মুক্তপুরুষই যথার্থ শক্তিমান্ পুরুষ। কিন্তু যথার্থ মুক্তি সাধনাসাপেক্ষ। রামমোহন রায় দেশের লোককে এই সত্যমূলক ইউরোপীয় শাস্ত্রমার্গে সাধনা করতে শিখিয়ে গিয়েছিলেন। তারই ফলে বর্তমান ভারতবর্ষে বাঙালি জাতির স্থান সবার উপরে। কি সাহিত্যে, কি আর্টে, কি বিজ্ঞানে, কি রাজনীতির ক্ষেত্রে, বাঙালি যে আজ ভারতবর্ষের সর্বাগ্রগণ্য জাতি, বাঙালির চিন্তা, বাঙালির কর্ম আজ যে বাকি ভারতবর্ষের আদর্শ, বাঙালি যে এ যুগে মানসিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সমগ্র ভারতবর্ষের যুগপৎ শিক্ষা ও দীক্ষা গুরু, তার কারণ একটি বাঙালি মহাপুরুষের প্রদর্শিত মার্গে বাঙালির মন, বাঙালির জীবন আজ একশো বৎসর ধরে অগ্রসর হয়েছে। এক কথায় আমাদের জাতীয় প্রতিভা রামমোহন রায়ের মনে ও জীবনে সম্পূর্ণ সাকার হয়ে উঠেছিল।
সুতরাং রামমোহন রায়ের মনে বাঙালি জাতি ইচ্ছা করলে তার নিজের মনের ছবি দেখতে পারে। বাঙালি জাতির মনে যে-সকল শক্তি প্রচ্ছন্ন ও বিক্ষিপ্ত ছিল, রামমোহন রায়ের অন্তরে সেই সকল শক্তি সংহত ও প্রকট হয়ে উঠেছিল। এর প্রমাণ রামমোহন রায়ের মন ও প্রকৃতি যদি অবাঙালি হত তা হলে আমরা পুরুষানুক্রমে কখনোই শিক্ষায় ও জীবনে অজ্ঞাতসারে তাঁর পদানুসরণ করতুম না।
এ কথাটা আজ স্বজাতিকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া দরকার। কারণ বাঙালি যদি তার স্বধর্ম হারায় তাতে যে শুধু বাংলার ক্ষতি, তাই নয়, সমস্ত ভারতবর্ষেরও ক্ষতি। আমরা যদি আমাদের মনের প্রদীপ জোর করে নেবাতে চেষ্টা করি, তা হলে যে ধূমের সৃষ্টি হবে তাতে সমস্ত ভারতবর্ষের মনের রাজ্য অন্ধকার হয়ে যাবে। একদল আত্মহারা বাঙালি আজকের দিনে স্বধর্ম বর্জন করতে উদ্যত হয়েছেন বলে রামমোহন রায়ের আত্মাকে স্বজাতির সুমুখে খাড়া করা অবশ্যকর্তব্য বলে মনে করি।
আশ্বিন ১৩২৭