সাহিত্যসম্মিলন

গত সাহিত্যসম্মিলনে একটি নূতন সুরের পরিচয় পাওয়া গেছে—সে হচ্ছে সত্যের সুর। এ সুর যে বঙ্গ সাহিত্যে পূর্বে কখনো শোনা যায় নি, তা নয়। তবে নূতনত্বের মধ্যে এইটুকু যে, আর-পাঁচটি বিবাদী সংবাদী ও অনুবাদী সুরের মধ্যে এবারকার পালায় এইটিই ছিল স্থায়ী সুর। এবং সে সুর যে অতি সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছিল, তার কারণ তা কোমল নয়, তীব্র।

এবারকার ব্যাপারের কর্মকর্তারা নিমন্ত্রিত অভ্যাগত সাহিত্যিকদের প্রচলিত প্রথামত ‘আসুন বসুন’ বলে সম্ভাষণ করেন নি, ‘উঠুন চলুন’ বলে অভিভাষণ করেছেন। এঁরা সকলেই গলার আওয়াজ আধসুর চড়িয়ে মুক্তকণ্ঠে একবাক্যে বলেছেন যে, ‘এ দেশের সেকাল সত্যযুগ হতে পারে, কিন্তু একাল হচ্ছে মিথ্যার যুগ।’ এই দেশব্যাপী মিথ্যার হাত হতে কি করে উদ্ধার পাওয়া যায়, তারই সন্ধান বলে দেওয়াটাই ছিল সাহিত্যাচার্যদের মুখ্য উদ্দেশ্য।

মিথ্যার চর্চা লোকে দুভাবে করে—এক জেনে, আর-এক না জেনে। সত্য যে কি, তা জেনেও কেউ কেউ কথায় ও কাজে তা নিত্য উপেক্ষা করেন। এ রোগের ঔষধ কি, বলা কঠিন; অন্তত ওর কোনো টোটকা আমার জানা নেই। অপরপক্ষে, অনেকে কেবলমাত্র মানসিক জড়তাবশত ও- বস্তু যে কি তার সন্ধান জানেনও না, নেনও না। তাই সম্মিলনের মুখপাত্রেরা, যাদের মনের সর্বাঙ্গে আলস্য ধরেছে সেই শ্রেণীর লোকদের, উপদেশ দিয়েছেন—উত্তিষ্ঠত জাগ্রত’।

এঁরা আমাদের জাগিয়ে তুলতে চান সত্যের জ্ঞানে, আমাদের উঠে চলতে বলেন সত্যের অনুসন্ধানে। কারণ, যে সত্য চোখের সুমুখে রয়েছে সেটিকে দেখাও আমাদের পক্ষে যেমন কর্তব্য, যে সত্য লুকিয়ে আছে তাকে খুঁজে বার করাও আমাদের পক্ষে তেমনি কর্তব্য। কোনো জিনিস দেখতে হলে জাগা অর্থাৎ চোখ খোলা দরকার, আর কোনো জিনিস খুঁজতে হলে ওঠা এবং চলা দরকার। তাই এঁরা আমাদের ‘উত্তিষ্ঠত জাগ্রত’ এই মন্ত্রে দীক্ষিত করতে চান। তবে আমরা এ মন্ত্রে দীক্ষিত হতে রাজি হব কি না জানি নে; কেননা এ মন্ত্রের সাধনায় আমরা অভ্যস্ত নই।

লোকপ্রবাদ যে, পুরুতে যখন মন্তর পড়ে পাঁঠা তাতে কর্ণপাত করে না। পাঁঠা যে ও-সব কথা কানে তোলে না তার কারণ, উৎসর্গের মন্ত্র পড়া হয় ছাগকে বলি দেবার জন্য। কিন্তু এই সাহিত্যযজ্ঞের পুরোহিতেরা যে মন্ত্র পড়েছেন তা বলির মন্ত্র নয়, বোধনের মন্ত্র। সুতরাং তাতে কর্ণপাত করায় আমাদের বিশেষ আপত্তি হওয়া উচিত নয়। আমরা মানি আর না মানি, এঁরা যে- কথা বলেছেন তা যে মন দিয়ে শোনবার মতো কথা, এই বিশ্বাসে আমি সাহিত্যসম্মিলনের অভিভাষণচতুষ্টয়ের আলোচনা করতে প্রবৃত্ত হয়েছি।

পূজ্যপাদ শ্রীযুক্ত দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয় তাঁর অভিভাষণের উপসংহারে বলেছেন যে,

 

বিজ্ঞান যদি বৃদ্ধ ভারতমন্ত্রীর কথা শোনেন, তবে ভারতে ফিরিয়া আসুন।

এ কথা বলবার উদ্দেশ্য এই যে, তাঁর মতে ভারতবর্ষই হচ্ছে বিজ্ঞানের জন্মভূমি। কিন্তু পুরাকালে বালক-অবস্থাতেই বিজ্ঞান সমাজের প্রতি অভিমান করে দেশত্যাগী হয়ে ইউরোপে চলে যান। এবং সেখানে তদ্দেশবাসীর যত্নে লালিতপালিত হয়ে এখন যথেষ্টর চাইতেও বেশি হৃষ্টপুষ্ট হয়ে উঠেছেন। এমন-কি, ইউরোপবাসীরা এখন আর তাঁকে সামলে উঠতে পারছে না। এই কারণেই যিনি স্থলপথে বিলেত চলে গেছলেন তাঁকে আবার জলপথে দেশে ফিরে আসতে অনুরোধ করা হয়েছে। ঘরের ছেলে আবার ঘরে ফিরে এলে দেশের যে কোনো অকল্যাণ হবে, এ আশঙ্কা ঠাকুরমহাশয় করেন না। বরং তিনি এতে মঙ্গলেরই আশা করেন। কেন? তা তিনি স্পষ্ট করে ব্যাখ্যা করেন নি। তবে তিনি বিজ্ঞানের রূপগুণের যে শাস্ত্র-সংগত বর্ণনা করেছেন, তার থেকেই আমরা অনুমান করতে পারি যে কি কারণে বিজ্ঞানের আবার দেশে ফেরাটা দরকার।

ঠাকুরমহাশয় বলেছেন যে,

বৈদান্তিক আচার্যেরা বলেন সত্য তিনপ্রকার : ১. পারমার্থিক সত্য=তত্ত্বজ্ঞান=পরাবিদ্যা, ২. ব্যাবহারিক সত্য=বিজ্ঞান=অপরাবিদ্যা, ৩. প্রাতিভাসিক সত্য=ভ্রমজ্ঞান=অবিদ্যা।

 

বিজ্ঞান বলতে একালে আমরা যা বুঝি সে বিষয়ে বেদান্তের পরিভাষায় সম্যক্ আলোচনা করা কঠিন। কারণ জ্ঞানের এই ত্রিবিধ জাতিভেদ আধুনিক দার্শনিকেরা স্বীকার করেন না। নব্যমতে জ্ঞান এক, শুধু ভ্রমই বহুবিধ। তবুও আমার বিশ্বাস যে, বেদান্তের পরিভাষা অবলম্বন করেও জ্ঞানের রাজ্যে বিজ্ঞানের স্থান কোথায় এবং কতখানি তা দেখানো যেতে পারে। সুতরাং আমি এ প্রবন্ধে উক্ত পরিভাষাই ব্যবহার করব।

ঠাকুরমহাশয় পূর্বোক্ত তিন সত্যের নিম্নলিখিতরূপ ব্যাখ্যা করেছেন—

বিজ্ঞান ব্যষ্টিজ্ঞান বা শাখাজ্ঞান; তত্ত্বজ্ঞান সমষ্টিজ্ঞান বা মোট জ্ঞান। পারমার্থিক সত্য মোট জ্ঞানের মোট সত্য; ব্যাবহারিক সত্য বিভিন্ন জ্ঞানের বিভিন্ন সত্য।

অর্থাৎ যে জ্ঞানের দ্বারা এক অখণ্ডসত্য লাভ করা যায়, সেই হচ্ছে তত্ত্বজ্ঞান; আর যার দ্বারা বহু খণ্ডসত্যের জ্ঞান লাভ করা যায়, সেই হচ্ছে বিজ্ঞান। এক কথায়, তত্ত্বজ্ঞানের উদ্দেশ্য হচ্ছে পুরুষকে জানা; বিজ্ঞানের উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রকৃতিকে চেনা। বিজ্ঞানের নামে অনেকে ভয় পান এই মনে করে যে তা তত্ত্বজ্ঞানের বিরোধী; এবং তত্ত্বজ্ঞান যেহেতু ভারতবর্ষের প্রাণ, অতএব সেটিকে নিরাপদে রাখবার জন্য এঁদের মতে বিজ্ঞানকে পরিহার করা কর্তব্য। এরূপ কথা অবশ্য বেদ- বেদান্তে নেই; বরং উপনিষদ্ধারেরা বলেছেন যে, অপরাবিদ্যা আয়ত্ত করতে না পারলে পরাবিদ্যায় কারো অধিকার জন্মায় না। উপরোক্ত মতটি যে সম্পূর্ণ সত্য, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কেননা, বিজ্ঞানের চর্চা ত্যাগ করলে বহু সম্বন্ধে আমাদের ভ্রমজ্ঞান হওয়া অবশ্যম্ভাবী, কারণ বিজ্ঞান হচ্ছে পরীক্ষিত জ্ঞান; বৈজ্ঞানিকেরা সত্যের টাকা না বাজিয়ে নেন না। বহু খণ্ডসত্যের উপর যদি এক মোটসত্যের প্রতিষ্ঠা না করা যায়, তা হলে বহু খণ্ডমিথ্যার উপর সে সত্যের যে প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে, এরূপ মিছা আশা শুধু পাগলে করতে পারে।

 

আসল কথা এই যে, দর্শনে আমরা ব্যষ্টি ও সমষ্টি এই দুইটি ভাবকে পৃথক করে নিলেও এ বিশ্ব ব্যস্তসমস্ত। তাই সমষ্টির জ্ঞানের ভিতর ব্যষ্টির জ্ঞান প্রচ্ছন্ন থাকে, এবং ব্যষ্টির জ্ঞান সমষ্টির জ্ঞানের অপেক্ষা রাখে। কেননা বস্তুত ও-দুই একসঙ্গে জড়ানো। তত্ত্বজ্ঞানে ও বিজ্ঞানে প্রভেদ এই যে, সমষ্টিজ্ঞান পরাবিদ্যায় এক ভাবে পাওয়া যায়, আর অপরাবিদ্যায় আর-এক ভাবে পাওয়া যায়। পরাবিদ্যার সমষ্টিজ্ঞান হচ্ছে মূলত একত্বের জ্ঞান। অপরপক্ষে বহুকে যোগ দিয়ে যে সমষ্টি পাওয়া যায়, তারই জ্ঞান হচ্ছে বিজ্ঞানানুমোদিত সমষ্টিজ্ঞান। তত্ত্বজ্ঞানী এক জেনে সব জানতে চান, আর বৈজ্ঞানিক সবকে একত্র করে জানতে চান। এ দুয়ের ভিতর পার্থক্য আছে কিন্তু বিরোধ নেই। সুতরাং বিজ্ঞানের চর্চায় পারমার্থিক সত্যের নাশের ভয় নেই, ভয় আছে শুধু মিথ্যাজ্ঞানের উচ্ছেদের। যাঁরা মিথ্যাকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চান তাঁরাই শুধু বিজ্ঞানকে ডরান।

পূর্বে বলা হয়েছে যে, প্রাতিভাসিক সত্য হচ্ছে ভ্রমজ্ঞান। এ কথা শুনে লোকের এই ধোঁকা লাগতে পারে যে, কি করে একই জ্ঞান যুগপৎ সত্য ও ভ্রম হতে পারে। প্রাতিভাসিক সত্য যে এক হিসাবে সত্য আর-এক হিসাবে মিথ্যা, এর স্পষ্ট প্রমাণ আছে। সম্মিলনের সভাপতিমহাশয় যে- দুটি উদাহরণ দিয়েছেন, তারই সাহায্যে প্রাতিভাসিক সত্যের স্বরূপ নির্ণয় করতে চেষ্টা করব।

সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘুরছে, এটি হচ্ছে প্রাতিভাসিক সত্য; আর পৃথিবী যে সূর্যের চারদিকে ঘুরছে, এটি হচ্ছে, বৈজ্ঞানিক সত্য। পৃথিবী চ্যাপটা, এটি হচ্ছে প্রাতিভাসিক সত্য; আর পৃথিবী গোলাকার, এটি হচ্ছে বৈজ্ঞানিক সত্য। পৃথিবী চ্যাপটা ও সূর্যের যে উদয়াস্ত হয়, এ দুটিই হচ্ছে প্রত্যক্ষ সত্য, অর্থাৎ আমাদের চোখের পক্ষে ও আমাদের চলাফেরার পক্ষে সম্পূর্ণ সত্য। যতখানি জমি বাংলাদেশে চোখে দেখা যায় তা যে সমতল, এর চাইতে খাঁটি সত্য আর নেই। সুতরাং পৃথিবীর যে খণ্ডদেশ আমাদের কাছে প্রত্যক্ষ, তা চ্যাপটা, গোলাকার নয়। সমগ্র পৃথিবীটি গোলাকার, কিন্তু সমগ্র পৃথিবীটি প্রত্যক্ষ নয়। আমরা যখন প্রত্যক্ষের সীমা লঙ্ঘন করে অপ্রত্যক্ষের বিষয় প্রত্যক্ষজ্ঞানের সাহায্যে জানতে চাই, তখনই আমরা ভ্রমে পড়ি। কারণ বৈজ্ঞানিক জ্ঞান হচ্ছে সমষ্টির জ্ঞান, অসংখ্য খণ্ড খণ্ড প্রত্যক্ষজ্ঞানের যোগাযোগ করে সে জ্ঞান পাওয়া যায়। অসংখ্য চ্যাপটা খণ্ডকে ঠিক দিলে তা গোল হয়ে ওঠে। এক মুহূর্তে একদেশদর্শিতাই হচ্ছে প্রত্যক্ষজ্ঞানের ধর্ম, সুতরাং কোনো একটি বিশেষ প্রত্যক্ষজ্ঞানের উপর নির্ভয়ে বৈজ্ঞানিক সত্যকে দাঁড় করানো যায় না।

ইন্দ্রিয় বাহ্যবস্তুর যে পরিচয় দেয়, সাধারণত মানুষে তাই নিয়েই সন্তুষ্ট থাকে, কারণ তাতেই তার কাজ চলে যায়; কিন্তু বৈজ্ঞানিক ব্রহ্মাণ্ডকে একটি প্রকাণ্ড সমষ্টি হিসেবে দেখতে চায়; বিশ্বে একটা নিয়ম আছে এই বিশ্বাসে, সে সেই নিয়মের সন্ধানে ফেরে। বস্তুসকলকে পৃথকভাবে না দেখে যুক্তভাবে দেখতে গিয়ে বিজ্ঞান দেখতে পায় যে, প্রাতিভাসিক সত্য সমগ্র সত্য নয়। পৃথিবী যে চ্যাপটা ও সূর্য যে পৃথিবীর চারদিকে ঘুরছে, প্রত্যক্ষজ্ঞানের হিসেবে এ দুটি হচ্ছে সম্পূর্ণ পৃথক এবং সম্পর্করহিত সত্য। কিন্তু বিজ্ঞানের কাছে এ দুটি হচ্ছে এক সত্যের দুইটি বিভিন্ন রূপ। পৃথিবী নামক মৃৎপিণ্ডটি যে কারণে সূর্যের চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে, সেই কারণেই সেটি তাল পাকিয়ে গেছে। ত্রিকোণ বা চতুষ্কোণ কিংবা চ্যাপটা হলে ওভাবে ঘোরা তার পক্ষে অসাধ্য হত। সুতরাং প্রত্যক্ষজ্ঞানের সঙ্গে বিজ্ঞানের কোনো বিরোধ নেই, কারণ এ উভয়ের অধিকার স্বতন্ত্র। বিজ্ঞানের সাহায্যে আমরা জানতে চাই বস্তুজগতের সামান্য গুণ, আর প্রত্যক্ষজ্ঞানের সাহায্যে আমরা দেখতে চাই বস্তুর বিশেষ রূপ। অতএব বিজ্ঞানের চর্চা করলে আমাদের তত্ত্বজ্ঞান মারা যাবে না অর্থাৎ আমাদের ধর্ম নষ্ট হবে না; এবং আমাদের বাহ্যজ্ঞানও নষ্ট হবে না অর্থাৎ কাব্য-শিল্পও মারা যাবে না। যা তত্ত্বজ্ঞানও নয়, বিজ্ঞানও নয়, প্রত্যক্ষজ্ঞানও নয়, তাই হচ্ছে যথার্থ মিথ্যা; এবং তারই চর্চা করে আমরা ধর্ম সমাজ কাব্য শিল্প, এক কথায় সমগ্র মানবজীবন, সমূলে ধ্বংস করতে বসেছি।

বিজ্ঞান শুধু একপ্রকার বিশেষজ্ঞানের নাম নয়; একটি বিশেষ প্রণালী অবলম্বন করে যে জ্ঞান লাভ করা যায়, আসলে তারই নাম হচ্ছে বিজ্ঞান। আমরা বিজ্ঞানকে যতই কেন সাধাসাধি করি-নে, সে কখনোই এ দেশে ফিরে আসবে না, যদি না আমরা তার সাধনা করি। সুতরাং সেই সাধনপদ্ধতিটি আমাদের জানা দরকার। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিটি যে কি, সে সম্বন্ধে আমি দুই-একটি কথা বলতে চাই। বিজ্ঞানের উদ্দেশ্য থেকেই তার উপায়েরও পরিচয় পাওয়া যাবে। তত্ত্বজ্ঞানের জিজ্ঞাস্য বিষয় হচ্ছে ‘এক সত্য’, অথচ প্রত্যক্ষজ্ঞানের বহুর অস্তিত্ব তত্ত্বজ্ঞানীরাও অস্বীকার করতে পারেন না। তাই বৈদান্তিকেরা বলেন, যা পূর্বে এক ছিল তাই এখন বহুতে পরিণত হয়েছে। সাংখ্যের মতে সৃষ্টি একটি বিকার মাত্র, কেননা ত্রিগুণের সাম্যাবস্থাই প্রকৃতির সুস্থ অবস্থা। সৃষ্টিকে বিকার হিসেবে দেখা আশ্চর্য নয়, কেননা আপাতসুলভ জ্ঞানে এ বিশ্ব একটি ভাঙাচোরা, ছাড়ানো ও ছড়ানো ব্যাপার। বিজ্ঞানের উদ্দেশ্য হচ্ছে, এই অসংখ্য পৃথক্ পৃথক্ বস্তুর পরস্পরের সম্বন্ধ নির্ণয় করা, জড়জগতের ভগ্নাংশগুলিকে যোগ দিয়ে একটি মন দিয়ে ধরবার-ছোঁবার মতো সমষ্টি গড়ে তোলা। এই ভগ্নাংশগুলিকে পরস্পরের সঙ্গে যোগ করতে হলে আঁকজোখ চাই। সুতরাং দুইয়ে দুইয়ে চার করার নামই হচ্ছে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি। দুইয়ে দুইয়ে পাঁচ আর-যে-দেশেই হোক, বিজ্ঞানের রাজ্যে হয় না। বিজ্ঞানের কারবার শুধু বস্তুর সংখ্যা নিয়ে নয়, পরিমাণ নিয়েও। সুতরাং বিজ্ঞানে মাপজোখও করা চাই। বিনা মাপে বিনা আঁকে যে সত্য পাওয়া যায় তা বৈজ্ঞানিক সত্য নয়। বিজ্ঞানের যা-কিছু মর্যাদা গৌরব ও মূল্য, তা সবই এই পদ্ধতির দরুন। আমাদের কাছে কোনো বৈজ্ঞানিক সত্যের বিশেষ কিছু মূল্য নেই, যদি আমরা কি উপায়ে সেটি পাওয়া গেছে তা না জানি। পৃথিবী কমলালেবুর মতো, এটি হচ্ছে বৈজ্ঞানিক সত্য। কিন্তু কি মাপজোখের কি যুক্তির সাহায্যে এই সত্য নির্ণীত হয়েছে, সেটি না জানলে ও-সত্য আমাদের মনের হাতে কমলালেবু নয়, ছেলের হাতে মোয়া; অর্থাৎ তা আমাদের এতই কম করায়ত্ত যে, যে-খুশি-সেই কেড়ে নিতে পারে। বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্তসকলের ক্রমান্বয় ভুল বেরচ্ছে, আবার তা সংশোধন করা হচ্ছে। কিন্তু সে ভুলের আবিষ্কার ও সংশোধন ঐ একই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সাহায্যে সাধিত হচ্ছে।

 

ঐতিহাসিক শাখার নেতা শ্রীযুক্ত অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় মহাশয় ঐতিহাসিক সত্য নির্ণয় করবার পদ্ধতিটি যে কি, তারই বিস্তৃত ব্যাখ্যা করেছেন; কারণ ইতিহাস ঠিক বিজ্ঞান না হলেও একটি উপবিজ্ঞানের মধ্যে গণ্য। এ ক্ষেত্রে মৈত্রেয়মহাশয়ের মতে ঐতিহাসিকদের প্রধান কর্তব্য হচ্ছে অনুসন্ধান করে অতীতের দলিল সংগ্রহ করা। সে দলিল নানা দেশে নানা স্থানে ছড়ানো আছে। সুতরাং সেই-সব হারামণির অন্বেষণের জন্য ঐতিহাসিকদের দেশদেশান্তরে ঘুরতে হবে। শুধু তাই নয়। ঐতিহাসিক তত্ত্ব সকল সময়ে মাটির উপর পড়ে-পাওয়া যায় না। ও হচ্ছে বেশির ভাগ কষ্ট করে উদ্ধার করবার জিনিস। কারণ অতীত প্রত্যক্ষ নয়, বর্তমানে তা ঢাকা পড়ে থাকে। ঐতিহাসিক তত্ত্ব আবিষ্কার করবার অর্থ হচ্ছে অ-দৃষ্টকে দৃষ্ট করা, তার জন্য চাই পুরুষকার। তাই মৈত্রেয়মহাশয় কেবলমাত্র ভক্তিভরে অতীতের নাম কীর্তন না করে তার সাক্ষাৎকার লাভ করবার পরামর্শ আমাদের দিয়েছেন। তাঁর পরামর্শমত কাজ করতে হলে আমাদের করতাল ভেঙে কোদাল গড়াতে হবে। ভূগর্ভে ও কালগর্ভে যে-সকল ঐতিহাসিক রত্ন নিহিত আছে আগে তা খুঁড়ে বার করতে হবে, পরে তার কাটাই-ছাঁটাই করে সাহিত্যসমাজে প্রচলন করতে হবে। এ কথা অবশ্যস্বীকার্য যে, আগে আসে খনিকার, তার পরে মণিকার। মৈত্রেয়মহাশয় তাই ঐতিহাসিকদের কলম ছাড়িয়ে খন্তা ধরাতে চান। তাঁর বিশ্বাস যে, ঐতিহাসিকদের হাতের খন্তা নিয়ত ব্যবহারে ক্ষয়ে গিয়ে ক্রমশ কলমের আকার ধারণ করবে, এবং সেই কলমে ইতিহাস লিখতে হবে। ইতিহাসের আবিষ্কর্তা ও রচয়িতার মধ্যে যে অধিকারভেদ আছে, মৈত্রেয়মহাশয় বোধ হয় সেটি মানেন না। অথচ এ কথা সত্য যে একজনের পক্ষে কলম ছেড়ে খন্তা ধরা যত কঠিন, আর- একজনের পক্ষে খন্তা ছেড়ে কলম ধরা তার চাইতে কিছু কম কঠিন নয়।

 

সে যাই হোক, মৈত্রেয়মহাশয় আমাদের আর-একটি বিশেষ আবশ্যকীয় কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। সে হচ্ছে এই যে, ত্যাগ স্বীকার না করতে পারলে কোনোরূপ সাধনা করা যায় না। কেননা, ত্যাগের অভ্যাস থেকেই সংযমের শিক্ষা লাভ করা যায়। ইতিহাসের বৈজ্ঞানিক সাধনা করতে হলে আমাদের অসংখ্য মানসিক-আলস্যপ্রসূত বিশ্বাস ত্যাগ করতে হবে। আমাদের পুরাণের মায়া, কিংবদন্তীর মোহ কাটাতে হবে।

শুধু রূপকথা নয়, সেইসঙ্গে কথার মোহও আমাদের ত্যাগ করতে হবে; অর্থাৎ যথার্থ ইতিহাস রচনা করতে হলে সে রচনায় ‘শব্দের লালিত্য, বর্ণনার মাধুর্য, ভাষার চাতুর্য’ পরিহার করতে হবে। এক কথায় শ্রীহর্ষচরিত আর কাদম্বরীর ভাষায় লেখা চলবে না। এ কথা অবশ্য অক্ষরে অক্ষরে সত্য। কিন্তু কি কারণে অক্ষয়বাবু অপরকে যে-উপদেশ দিয়েছেন নিজে সে-উপদেশ অনুসরণ করেন নি তা ঠিক বুঝতে পারলুম না। কারণ তাঁর অভিভাষণের ভাষা যে ‘অক্ষর-ডম্বর’, এ কথা টাউন হলে সশরীরে উপস্থিত থাকলে স্বয়ং বাণভট্টও স্বীকার করতেন। সম্ভবত অক্ষয়বাবুর মতে ইতিহাসের আখ্যান হচ্ছে বিজ্ঞান, আর বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ব্যাখ্যান হচ্ছে কাব্য

যে লোভ অক্ষয়বাবু সংবরণ করতে পারেন নি, শ্রীযুক্ত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় তা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেছেন। শাস্ত্রীমহাশয় আগাগোড়া অশাস্ত্রীয় ভাষা ব্যবহার করায় তাঁর অভিভাষণ এতই জলের মতো সহজ হয়েছে যে, তা এক নিশ্বাসে নিঃশেষ করা যায়। এ শ্রেণীর লেখা যে বহতা নদীর জলের মতোই স্বচ্ছ ও ঠাণ্ডা হওয়া উচিত, সে বিষয়ে কোনোই সন্দেহ নেই। জলের মতো ভাষার বিশেষ গুণ এই যে, তা জ্ঞানপিপাসুদের তৃষ্ণা সহজেই নিবারণ করে। বর্ণ-গন্ধ চাই শুধু কাব্যের ভাষায়, কেননা তা হয় অমৃত নয় সুরা।

 

আমি বহুকাল হতে এই কথা বলে আসছি যে, বাংলা সাহিত্য বাংলা ভাষাতেই রচিত হওয়া উচিত। কিন্তু এই সহজ কথাটি অনেকের কাছে এতই দুর্বোধ ঠেকে যে, তাঁরা এরূপ আজগুবি কথা শুনে বিরক্ত হন। এঁদের মতে বাংলা হচ্ছে আমাদের আটপৌরে ভাষা, তাতে সাহিত্যের ভদ্রতা রক্ষা হয় না। সুতরাং সাহিত্যের জন্য সাধুভাষা নামক একটি পোশাকি ভাষা তৈরি করা চাই। পোশাক যখন চাইই, তখন তা যত ভারী আর যত জমকালো হয় ততই ভালো। তাই সাহিত্যিকরা সংস্কৃত ভাষার চোরা-জরিতে কিংখাব বুনতে এতই ব্যগ্র ও এতই ব্যস্ত যে, সে জরি সাচ্চা কি ঝুটা, তা দিয়ে তাঁরা কিংখাব দূরে থাক্ দোসুতিও বুনতে পারেন কি না, পারলেও সে বুনানিতে ঐ জরি খাপ খায় কি না, এ-সব বিচার করবার তাঁদের সময় নেই। সুতরাং বাংলা লিখতে বললে তাঁরা মনে করেন যে, আমরা তাঁদের কাব্যের বস্ত্রহরণ করতে উদ্যত হয়েছি। কিন্তু আমরা যে ওরূপ কোনো গর্হিত আচরণ করতে চাই নে, তার প্রমাণ, ভাষা ভাবের লজ্জা নিবারণ করবার জিনিস নয়। ভাষা বস্ত্র নয়, ভাবের দেহ; আলংকারিকদের ভাষায় যাকে বলে ‘কাব্যশরীর’। বাঙালির ভাষা বাঙালি চৈতন্যের অধিষ্ঠান। বাঙালির আত্মাকে সংস্কৃত ভাষার দেহে কেউ প্রবেশ করিয়ে দিলে ব্যাড়ীর আত্মা নন্দ-ভূপতির দেহে প্রবেশ করে যেরূপ দুর্দশাগ্রস্ত হয়েছিল সেইরূপ হবারই সম্ভাবনা। দরিদ্র ব্রাহ্মণের আত্মা রাজার দেহে প্রবেশ করায় তার যে কি পর্যন্ত দুর্গতি হয়েছিল তার বিস্তৃত ইতিহাস কথাসরিৎসাগরে দেখতে পাবেন। বাঙালির স্কুলে পড়ানো আত্মা কেন যে নিজের দেহপিঞ্জর হতে নিষ্ক্রমণ করে পরের পিঞ্জরে প্রবেশলাভ করবার জন্য ছটফট করছে, তার কারণ শাস্ত্রীমহাশয়ই নির্দেশ করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন—

 

আমার বিশ্বাস, বাঙালি একটি আত্মবিস্মৃত জাতি। বিষ্ণু যখন রামরূপে অবতীর্ণ হইয়াছিলেন তখন কোনো ঋষির শাপে তিনি আত্মবিস্মৃত ছিলেন।

আমরাও তেমনি বাঙালি জাতির অজ্ঞান অবতার, সম্ভবত গুরু-পুরোহিতের শাপে। মুক্তির জন্য আমাদের এই শাপমুক্ত হতে হবে, অর্থাৎ জাতিস্মর হতে হবে। কেননা, সত্যলাভের জন্য যেমন বাহ্যজ্ঞান চাই, তেমনি আত্মজ্ঞানও চাই। এই জাতিস্মরতা লাভ করবার একমাত্র উপায় হচ্ছে ইতিহাস। একমাত্র ইতিহাসই জাতির পূর্বজন্মের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এই জাতীয় পূর্বজন্মের জ্ঞান হারিয়েই আমরা নিজের ভাষার মনের ও চরিত্রের জ্ঞান হারিয়েছি।

শাস্ত্রীমহাশয়ের মোদ্দা কথা হচ্ছে এই যে, এক ‘আর্য’ শব্দের উপর জীবন প্রতিষ্ঠা করতে গেলে বাঙালির ইহকাল পরকাল দুইই নষ্ট হবে, কেননা আমরা মোক্ষমুলারের আবিষ্কৃত খাঁটি আর্য নই। আমরা একটি মিশ্রজাতি। প্রথমত দ্রবিড় ও মোঙ্গলের মিশ্রণে বাঙালি জাতি গঠিত হয়। তার পর সেই জাতির দেহে মনে ও সমাজে কতক পরিমাণ আর্যত্ব আরোপিত হয়েছে। কিন্তু তাই বলে আমরা একেবারে আর্যমিশ্র হয়ে উঠি নি। শাস্ত্রীমহাশয়ের মতে আর্যসভ্যতা আবর্তে আবর্তে বাংলায় এসে পৌঁচেছে। তিনি বলেন-

 

এই-সকল আবর্ত ঘুরিতে ঘুরিতে যখন বাংলায় আসিয়া উপনীত হয়, তখন দেখা যায় আর্যের মাত্রা বড়ই কম, দেশীর মাত্রা অনেক বেশি।

.

এ সত্য আমি নিরাপত্তিকে স্বীকার করি, যদিচ সম্ভবত আমি এই ক্রমাগত আর্য-আবর্তের একটি ক্ষুদ্র বুদবুদ, কেননা আমি ব্ৰাহ্মণ।

বাংলা ভাষা আর্য ভাষা নয়, উক্ত ভাষার একটি স্বতন্ত্র শাখা—এক কথায় একটি নবশাখ ভাষা। বাঙালি জাতিও আর্য জাতি নয়, একটি নবশাখ জাতি। আজকাল শিক্ষিত সম্প্রদায়ের প্রধান চেষ্টা হয়েছে আমাদের মন ও ভাষার মধ্যে থেকে তার দেশী খাদটুকু বাদ দিয়ে তার আর্য সোনাটুকু বার করে নেওয়া। প্রথমত ওরূপ খাদ বাদ দেওয়া সম্ভব নয়, দ্বিতীয়ত সম্ভব হলেও বড়ো বেশি যে সোনা মিলবে তাও নয়। কিন্তু আসল প্রশ্ন হচ্ছে, দেশী অংশটুকু বাদ দেবার এত প্রাণপণ চেষ্টা কেন। ও তো খাদ নয়, ঐ তো হচ্ছে বাঙালি জাতির মূলধাতু। এবং সে ধাতু যে অবজ্ঞা কিংবা উপেক্ষা করবার জিনিস নয়, তা যিনিই বাঙালির প্রাচীন ইতিহাসের সন্ধান রাখেন তিনিই মানেন। কাঁঠাল আম নয় বলে দুঃখ করবারও কারণ নেই, এবং কাঁঠালের ডালে আমের কলম বসাবার চেষ্টা করবারও দরকার নেই। আমরা এই বাংলার গায়ে হয় ইংরেজি নয় সংস্কৃতের কলম বসিয়ে সাহিত্যে ও জীবনে শুধু কাঁঠালের আমসত্ত্ব তৈরি করবার বৃথা চেষ্টা করছি।

 

শাস্ত্রীমহাশয় বলেছেন যে, বাঙালি জাতির প্রাচীন সিদ্ধাচার্যেরা সব সহজিয়া মতের প্রবর্তক ও প্রচারক ছিলেন। আমরা আত্মজ্ঞানশূন্য বলে যা আমাদের কাছে সহজ তাই বর্জন করি; আমরা সাধুভাষায় সাহিত্য লিখি, আর জীবনে হয় সাহেবিয়ানা নয় আর্যামি করি। জাতীয় আত্মজ্ঞান লাভ করতে পারলে আমরা আবার সহজ, অর্থাৎ natural, হতে পারব। মনের এই সহজসাধন অতি কঠিন ব্যাপার, কেননা আমাদের সকল শিক্ষাদীক্ষা হচ্ছে কৃত্রিমতার সহায় ও সম্পদ।

সাহিত্যশাখার সভাপতি শ্রীযুক্ত যাদবেশ্বর তর্করত্ন মহাশয়ও আমাদের বলেছেন যে—

আলস্যের প্রশ্রয় দিলে হইবে না। নিদ্রিত সমাজকে জাগাইতে হইবে। শয্যাশয়ান সমাজের সুখসুপ্তি ভাঙাইতে হইবে।

এ যে শুধু কথার কথা নয়, তার প্রমাণ, কি করে সাহিত্যের সাহায্যে সমাজকে জাগিয়ে তুলতে পারা যায় তার পন্থা তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন। তাঁর মোট কথা এই যে, দর্শনবিজ্ঞানের চর্চা না করলে সাহিত্য শক্তিহীন ও শ্রীহীন হয়ে পড়ে। তর্করত্নমহাশয়ের মতে ‘সাহিত্য’ শব্দের অর্থ সাহচর্য। যদি কেউ জিজ্ঞাসা করেন, কিসের সাহচর্য? তার উত্তর, সকলপ্রকার জ্ঞানের সাহচর্য। কারণ অতিপ্রবৃদ্ধ অজ্ঞতার গর্ভে যে সাহিত্য জন্মগ্রহণ করে তা সুকুমার-সাহিত্য নয়, তা শুধু কুমার-সাহিত্য অর্থাৎ ছেলেমানষি লেখা। তিনি দেখিয়েছেন যে, কালিদাস প্রভৃতি বড়ো বড়ো সংস্কৃত কবিরা সে যুগের সর্বশাস্ত্রে সুপণ্ডিত ছিলেন। প্রমাণ শকুন্তলা অভিজ্ঞান, অবিজ্ঞান নয়। সংস্কৃত সাহিত্যের নানা যুক্ত শাস্ত্রের জ্ঞানের অভাববশত আমরা সংস্কৃত কাব্য আধো বুঝি, সংস্কৃত দর্শন ভুল বুঝি, পুরাণকে ইতিহাস বলে গণ্য করি, আর ধর্মশাস্ত্রকে বেদবাক্য বলে মান্য করি।

 

সে যাই হোক, পাণ্ডিত্য কস্মিনকালেও সাহিত্যের বিরোধী নয়। তার প্রমাণ, কালিদাস দান্তে মিল্টন গ্যেটে প্রভৃতি। তবে, পণ্ডিত অর্থে যদি বিদ্যার চিনির বলদ বোঝায় তা হলে সে স্বতন্ত্র কথা। জ্ঞানই হচ্ছে কাব্যের ভিত্তি, কারণ সত্যের উপরেই সাহিত্য প্রতিষ্ঠিত। তর্করত্ন মহাশয়ের বক্তব্য এই যে, ইংরেজি ভাষায় যাকে বলে ‘সিনথেটিক কালচার’ তাই হচ্ছে সাহিত্যের পরম সহায়। এ কথা সম্পূর্ণ সত্য। ইউরোপের দর্শন বিজ্ঞান ইতিহাস অর্থনীতি সমাজতত্ত্ব রাজনীতির সঙ্গে কতকটা পরিচয় না থাকলে কোনো বড়ো ইংরেজ কবি কিংবা নভেলিস্টের লেখা সম্পূর্ণ বোঝাও যায় না, তার রসও আস্বাদন করা যায় না। সাহিত্য হচ্ছে প্রবুদ্ধ চৈতন্যের বিকাশ; এবং চৈতন্যকে জাগিয়ে তুলতে হলে তার উপর আর-পাঁচজনের মনের আর-পাঁচরকমের জ্ঞানের ধাক্কা চাই। যাঁর মন সত্যের স্পর্শে সাড়া দেয় না, সে সত্য আধ্যাত্মিকই হোক আর আধিভৌতিকই হোক, তিনি কবি নন। সুতরাং দর্শন-বিজ্ঞানকে অস্পৃশ্য করে তোলায় কাব্যের পবিত্রতা রক্ষা হয় না। এই কারণেই তর্করত্নমহাশয় আমাদের দেশী-বিলাতি সকলপ্রকার দর্শন-বিজ্ঞান অনুবাদ করতে পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁর মতে আলস্যপ্রিয় বাঙালি-মনের পক্ষে বিজ্ঞানচর্চারূপ মানসিক ব্যায়াম হচ্ছে অত্যাবশ্যক। আমাদের অলস মনের আরামজনক বিশ্বাস-সকল বিজ্ঞানের অগ্নিপরীক্ষায় পরিশুদ্ধ না হলে সত্যের খাঁটি সোনাতে তা পরিণত হবে না; আর যা খাঁটি সোনা নয়, তার অলংকার ধারণ করলে কাব্যের দেহও কলঙ্কিত হয়।

এবারকার সাহিত্যসম্মিলনের ফলে যদি বিজ্ঞানের সঙ্গে সাহিত্যের মিলন হয়, তা হলে বঙ্গ সাহিত্যের দেহ ও কান্তি দুইই পুষ্ট হবে। সে মিলন যে কবে হবে তা জানি নে। কিন্তু সত্যের সঙ্গে আমাদের ভাবের ও ভাষার বিচ্ছেদটি যে বহু লোকের নিকট অসহ্য হয়ে উঠেছে এইটি হচ্ছে মহা আশার কথা। মিথ্যার প্রতি আগে বিরাগ না জন্মালে কেউ সত্যের উদ্দেশে তীর্থযাত্রা করেন না; কারণ সে পথে কষ্ট আছে। বিজ্ঞানের মন্দিরে, অর্থাৎ সত্যের মানমন্দিরে পৌঁছতে হলে আগাগোড়া সিঁড়ি ভাঙা চাই।

আমি বৈজ্ঞানিক নই, কাজেই প্রত্যক্ষ জ্ঞানই আমার মনের প্রধান সম্বল। সেই প্রত্যক্ষ জ্ঞানের সম্বন্ধে সাহিত্যাচার্যেরা কেউ দুটি ভালো কথা বলেন নি। তাই আমি তার সপক্ষে কিছু বলতে বাধ্য হচ্ছি। বিজ্ঞান প্রত্যক্ষ জ্ঞানের অতিরিক্ত হলেও ঐ মূলজ্ঞানের উপরেই প্রতিষ্ঠিত। বাহ্যবস্তুকে ইন্দ্রিয়গোচর করতে হলে ইন্দ্রিয়েরও একটা শিক্ষা চাই। অনেকে চোখ থাকতেও কানা, কান থাকতেও কালা, অথচ মুখ না থাকলেও মূক নন। এই শ্রেণীর লোকের বাচালতার গুণেই আজ বাংলা সাহিত্যের কোনো মর্যাদা নেই। কাব্যকে আবার সাহিত্যের শীর্ষস্থান অধিকার করতে হলে ইন্দ্রিয়কে আবার সজাগ করে তোলা চাই। চোখও বাহ্যবস্তু সম্বন্ধে আমাদের ঠকাতে পারে, যদি সে চোখ ঘুমে ঢোলে। অপরপক্ষে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকলেও যা স্পষ্ট তাও আমাদের কাছে ঝাপসা হয়ে যায়। চোখে আর মনে এক না করতে পারলে কোনো পদার্থ লক্ষ্য করা যায় না। ইন্দ্রিয় ও মনের এই একীকরণ সাধনা বিনা স্নিদ্ধ হয় না। যাঁরা কাব্য রচনা করবেন,

তাঁদের পক্ষে বাহিরের ভিতরের সকল সত্যকে প্রত্যক্ষ করবার ক্ষমতা অর্জন করতে হবে। কারণ কাব্যে প্রত্যক্ষ ব্যতীত অপর কোনো সত্যের স্থান নেই। সুতরাং প্রত্যক্ষ জ্ঞানের উপর অবিশ্বাস এবং তার প্রতি অমনোযোগ হচ্ছে কাব্যে সকল সর্বনাশের মূল। প্রত্যক্ষ জ্ঞান অবশ্য নিজের সীমা লঙ্ঘন করলে মিথ্যা বিজ্ঞানে পরিণত হয়। বিজ্ঞানও তেমনি নিজের সীমা লঙ্ঘন করলে মিথ্যা তত্ত্বজ্ঞানে পরিণত হয়। তার কারণ, বিজ্ঞান কোনো পদার্থকে এক হিসেবে দেখতে পারে না। বিজ্ঞান যে সমষ্টি খোঁজে সে হচ্ছে সংখ্যার সমষ্টি। বিজ্ঞান চারকে এক করতে পারে না। বিজ্ঞান চারকে পাওয়ামাত্র হয় তাকে দুই দিয়ে ভাগ করে, নয় তার থেকে দুই বিয়োগ করে; পরে আবার হয় দুই দ্বিগুণে, নয় দুয়ে-দুয়ে চার করে। অর্থাৎ বিজ্ঞান যার উপর হস্তক্ষেপ করে তাকে আগে ভাঙে, পরে আবার জোড়াতাড়া দিয়ে গড়ে। উদাহরণস্বরূপ দেখানো যেতে পারে যে, বিজ্ঞানের হাতে জল হয় বাষ্প হয়ে উড়ে যায়, নয় বরফ হয়ে জমে থাকে; আর না হয় তো এক ভাগ অক্সিজেন আর দু ভাগ হাইড্রোজেনে বিভক্ত হয়ে পড়ে। তার পর বিজ্ঞান আবার সেই বাষ্পকে ঠাণ্ডা করে সেই বরফকে তাতিয়ে জল করে দেয়, এবং অক্সিজেনে-হাইড্রোজেনে পুনর্মিলন করে দেয়।

কিন্তু আমরা এক নজরে যা দেখতে পাই, তাই হচ্ছে প্রত্যক্ষ জ্ঞান। এ জ্ঞানও একের জ্ঞান, অতএব প্রত্যক্ষ জ্ঞান হচ্ছে তত্ত্বজ্ঞানের সবর্ণ।!

ঈশাবাস্যমিদং সর্বং যৎ কিঞ্চ জগত্যাং জগৎ

এ কথা তাঁরই কাছে সত্য, যাঁর কাছে এটি প্রত্যক্ষ সত্য। কেননা, কোনোরূপ আঁকের সাহায্যে কিংবা মাপের সাহায্যে ও-সত্য পাওয়া যায় না। একত্বের জ্ঞান কেবলমাত্র অনুভূতিসাপেক্ষ।

আমি পূর্বে বলেছি, প্রত্যক্ষ জ্ঞানের জন্য ইন্দ্রিয়গ্রামে মনঃসংযোগ করা চাই; সেই : মনঃসংযোগের জন্য আন্তরিক ইচ্ছা চাই, এবং সেই ইচ্ছার মূলে আন্তরিক অনুরাগ চাই; এবং এ অনুরাগ অহৈতুকী প্রীতি হওয়া চাই। কোনোরূপ স্বার্থ-সাধনের জন্য যে সত্য আমরা খুঁজি, তা কখনো সুন্দর হয়ে দেখা দেয় না। যে প্রীতির মূলে আমার সহজ প্রবৃত্তি নেই, তা কখনো অহৈতুকী হতে পারে না। সুতরাং সত্য যে সুন্দর, এই জ্ঞানলাভের উপায় হচ্ছে সহজসাধন, অর্থাৎ সর্বাপেক্ষা কঠিন সাধন। কারণ আত্মার উপর বিশ্বাস আমরা হারিয়েছি।

সে যাই হোক, বিজ্ঞানের অবিরোধে যে প্রত্যক্ষ জ্ঞানের চর্চা করা যায়, এ বিশ্বাস হারালে আমরা কাব্য-শিল্প সৃষ্টি করতে পারি নে। বিজ্ঞান হচ্ছে পূর্বসৃষ্ট পদার্থের জ্ঞান। নূতন সৃষ্টির হিসাব বিজ্ঞানের পাকা খাতায় পাওয়া যায় না। সৃষ্টির মূলে যে চিররহস্য আছে, তা কোনোরূপ বৈজ্ঞানিক যন্ত্রে ধরা পড়ে না। এই কারণে দেশের লোককে বিজ্ঞানের চর্চা করবার পরামর্শ দেওয়াটা সৎপরামর্শ, কেননা যা স্পষ্ট তাতে সর্বসাধারণের সমান অধিকার আছে। অপরপক্ষে কাব্যে শিল্পে অধিকারীভেদ আছে। সত্যের মূর্তিদর্শন সকলের ভাগ্যে ঘটে না।

জ্যৈষ্ঠ ১৩২১


© 2024 পুরনো বই