জয়দেব

একখানি সাহিত্যগ্রন্থকে দুইরকম ভাবে আলোচনা করা যায় : প্রথমত, কাব্য স্বরূপে; দ্বিতীয়ত, ঐতিহাসিক তত্ত্ব আবিষ্কারের উপায় স্বরূপে।

প্রথমোক্ত প্রথা অবলম্বন করিলে আমরা কেবলমাত্র তাহার দেশকাল-নিরপেক্ষ কাব্য হিসাবে দোষগুণবিচারে সমর্থ হই।

দ্বিতীয় প্রথা অবলম্বন করিলে আমরা তাহা যে নির্দিষ্ট সময়ে যে দেশে রচিত হইয়াছিল সেই দেশের তৎসাময়িক অবস্থাসকলের আলোচনাদ্বারা তাহার তদ্দেশীয় অন্যান্য কাব্যসকলের সহিত কি সম্বন্ধ এবং তাহার দোষ ও গুণ কোন্ কোন্ বিশেষ কারণপ্রসূত, এই-সকল বিষয়ে জ্ঞানলাভ করিতে পারি।

কাব্যের দোষগুণবিচার করাই সমালোচনার মুখ্য উদ্দেশ্য। ঐতিহাসিক প্রথায় আলোচনা উক্ত বিচারের সহায়তাসাধন করে মাত্র। কিন্তু এই উভয় পদ্ধতির মিলিত সাহায্যেই যথার্থ সমালোচনা করা যায়।

দুঃখের সহিত স্বীকার করিতে বাধ্য হইতেছি যে, সংস্কৃত সাহিত্যে তাদৃশ ব্যুৎপত্তি না থাকায় শ্রীমদ্‌ভাগবতাদি গ্রন্থের সহিত জয়দেব-রচিত  গীতগোবিন্দের কি সম্বন্ধ তাহা আমার নিকট অবিদিত; এবং ভারতবর্ষের পুরাবৃত্ত সম্বন্ধেও আমার পরিমিত জ্ঞান, জয়দেবের সময়ে, অর্থাৎ বঙ্গীয় রাজা লক্ষ্মণসেনের সময়ে, বঙ্গদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থাদির সম্যক্ নির্ধারণের পক্ষে যথেষ্ট নহে। সুতরাং উপস্থিত প্রবন্ধে আমাকে জয়দেবের গ্রন্থ কেবলমাত্র কাব্য হিসাবে বিচার করিয়াই ক্ষান্ত থাকিতে হইবে। আর-একটি কথা, শুনিতে পাই গীতগোবিন্দের নাকি একটি আধ্যাত্মিক অর্থ আছে; জীবাত্মার সহিত পরমাত্মার নিগূঢ় মিলনের বিষয়ই নাকি রাধাকৃষ্ণের প্রেমবর্ণনাচ্ছলে বর্ণিত হইয়াছে। আমি যতদূর বুঝিতে পারিয়াছি তাহাতে এ কাব্যে আধ্যাত্মিকতার কোনো পরিচয় নাই। জয়দেব তাঁহার কাব্যে যে-সকল শব্দ ব্যবহার করিয়াছেন তাহার সহজ ও প্রচলিত অর্থ অনুসারে যতটা বুঝা যায় তাহাই বুঝিয়াছি, কোনো নিগূঢ় অর্থ উদ্ভাবনও করিতে পারি নাই। আমার কাছে কৃষ্ণ ও রাধাকে আমাদেরই মতো রক্তমাংসে-গঠিত মানুষ বলিয়া বোধ হইয়াছে এবং তাঁহাদের প্রেমকেও স্ত্রীপুরুষঘটিত সাধারণ মানবপ্রেম বলিয়াই বুঝিয়াছি। যদি যথার্থই একটি সুগভীর আধ্যাত্মিক ভাব কাব্যখানির প্রাণস্বরূপ হয় তাহা হইলে আমি উপস্থিত প্রবন্ধে যাহা বলিয়াছি তাহা একান্ত অর্থশূন্য। সূচনাস্বরূপ এই অসম্পূর্ণতার কথা উল্লেখমাত্র করিয়া আমি আসল বিষয়ের আলোচনায় প্রবৃত্ত হইতেছি।

রাধাকৃষ্ণের প্রণয়মূলক দুই-চারিটি ঘটনা লইয়া জয়দেব  গীতগোবিন্দ রচনা করিয়াছেন।

একদিন কৃষ্ণ গোপিনীগণ সমভিব্যাহারে যমুনাতীরে বসন্তবিহার করিতেছিলেন, এমন সময় রাধা বেশভূষা করিয়া কৃষ্ণের উদ্দেশে তথায় আসিয়া উক্ত ব্যাপার দেখিয়া ক্রোধভরে ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া তথা হইতে চলিয়া গেলেন। কৃষ্ণও একান্ত অপ্রতিভ হইয়া মৌনভাব ধারণ করিয়া রহিলেন এবং রাধাকে গমন হইতে নিবৃত্ত করিতে চেষ্টামাত্র করিতেও সাহসী হইলেন না। কিন্তু, রাধা চলিয়া গেলেন দেখিয়া তিনি গোপবধূদিগকে পরিত্যাগ করিয়া কোনো-এক নিভৃত কুঞ্জবনে আশ্রয় লইয়া মনোদুঃখে রাধার কথা ভাবিতে লাগিলেন। এদিকে রাধা স্বস্থানে ফিরিয়া আসিয়া কৃষ্ণ-কৃত পূর্ববিহারস্মরণে অত্যন্ত উদ্দীপ্ত হইয়া কৃষ্ণকে আনয়নার্থ তাঁহার নিকট সখী প্রেরণ করিলেন। কৃষ্ণ সখীকে বলিলেন, ‘আমি যাইতে পারিব না, তাহাকে আসিতে বলো।’ তার পর সখীর রাধার নিকট প্রত্যাগমন এবং কৃষ্ণের প্রার্থনানুযায়ী রাধাকে কৃষ্ণের নিকট পাঠাইবার চেষ্টা। কিন্তু রাধা ইচ্ছা থাকিলেও বিরহজনিত শারীরিক ক্লান্তি হেতু স্থান পরিত্যাগ করিতে অসমর্থ। সখী অগত্যা আবার কৃষ্ণের নিকট ফিরিয়া আসিলেন। কৃষ্ণ এবার রাধার সকাশে স্বয়ং যাইতে রাজি। সখী ছুটিয়া আসিয়া রাধাকে সুসংবাদ জানাইলে রাধা বাসকসজ্জা হইয়াঁ কৃষ্ণের আগমন প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন। কিন্তু কৃষ্ণ কথা রাখিতে পারিলেন না। কাজেই রাধা ঠাহরাইলেন যে, কৃষ্ণ অন্য-কোনো রমণীর সাক্ষাৎ পাইয়া তাহার সহিত জমিয়া গিয়াছেন। উক্ত রমণীর সহিত কৃষ্ণ কিরূপ ব্যবহার করিতেছেন, সেই-সকল কথা রাধা কল্পনায় অনুভব করিয়া সেই ভাগ্যবতীর তুলনায় নিজেকে অত্যন্ত হতভাগিনী মনে করিয়া বিলাপ করিতে লাগিলেন। রাত্রি এইরূপেই কাটিয়া গেল। প্রত্যুষে কৃষ্ণ অন্য রমণীর ভোগচিহ্নসকল শরীরে ধারণ করিয়া রাধার সমক্ষে উপস্থিত হইলেন। রাধা কৃষ্ণকে কিরূপ ভাষায় সম্ভাষণ করিলেন তাহা বোধ হয় আর বলিবার আবশ্যক নাই। কৃষ্ণ নিজের দোষক্ষালনের কোনোরূপ চেষ্টা করিলেন না, কারণ সে চেষ্টা নিষ্ফল। অধরের কজ্জল, কপোলের সিন্দূর, বক্ষঃস্থ যাবক-রঞ্জিত পদচিহ্ন—এ-সকল কোথা হইতে আসিল। তাহার নাহয় একটি বাজে কারণ নির্দেশ করা যাইতে পারে, কিন্তু পরিধানের নীল শাটী সম্বন্ধে তো আর কোনোরূপ মিথ্যা কৈফিয়ত খাটে না। রাধা কথা শেষ করিয়া দুর্জয় মান করিয়া বসিলেন, কিন্তু কৃষ্ণের কাছে কি মান টিকে? তিনি মনোমত কথায় রাধার প্রীতিসাধন করিলেন, রাধা কৃষ্ণের উপরে যে আড়ি করিয়াছিলেন তাহা ভাবে পরিণত হইল। এই তো গেল প্রভাতসময়ের ঘটনা। যোগেযাগে দিনটিও কাটিয়া গেল। দিনান্তে অভিসারিকা রাধা কৃষ্ণের নিকট উপস্থিত হইলেন, উভয়ের মিলন হইল। মিলনান্তর সম্ভোগ, সম্ভোগান্তর কৃষ্ণ কর্তৃক রাধার বেশবিন্যাসের সঙ্গে সঙ্গেই গ্রন্থের সমাপ্তি।

দেখা যাইতেছে, এ কাব্যের মুখ্য বর্ণিত বিষয় রাধাকৃষ্ণের রূপ; তাঁহাদের পরস্পরের বিরহে পরস্পরের দুঃখপ্রকাশ; মিলিত হইলে পরস্পরে কথোপকথন অর্থাৎ কেবলমাত্র রাধাকৃষ্ণের দেহের বর্ণনা ও তাঁহাদের মনোগত প্রেমভাবের বর্ণনা। এ ছাড়া আনুষঙ্গিকরূপে যমুনাতীর কুঞ্জবন বসন্তকাল রাধার সখী ও অন্যান্য গোপিনীগণের কথাও বলা হইয়াছে। গ্রন্থারম্ভে গ্রন্থকারের আত্মপরিচয় ও ঈশ্বরের বন্দনা বাদ দিলে দেখা যায়, রাধা ও কৃষ্ণের কেলি ব্যতীত স্বর্গমর্ত- পাতালের অন্য কোনো বিষয়, কোনোরূপ ধর্মনৈতিক কিংবা নৈতিক মতামত ইত্যাদি কিছুই গীতগোবিন্দে স্থান লাভ করে নাই। জয়দেবের মস্তিষ্কপ্রসূত কোনো চিন্তা ইহাতে সন্নিবেশিত হয় নাই। ইহা আমার নিকট অত্যন্ত সুখের বিষয় বলিয়া মনে হইতেছে, কারণ কবির ক্ষমতার পরিসর যত সংক্ষিপ্ত হয় ও তাঁহার কল্পনা যত সংকীর্ণ পরিধির মধ্যে বদ্ধ থাকে, ক্ষুদ্রশক্তিসম্পন্ন সমালোচকের পক্ষে সমালোচনা করাটা ততই সহজসাধ্য হইয়া উঠে। আমি এখন জয়দেবে যাহা নাই তাহার কথা ছাড়িয়া দিয়া তাহাতে যাহা আছে তাহার বিষয়ই আলোচনা করিব। জয়দেবের কবিত্বশক্তির পরিমাণ সম্বন্ধে মন্তব্য প্রকাশ করিবার পূর্বে আমি তাঁহার বর্ণিত প্রেম কিরূপ ও তাঁহার বর্ণিত স্ত্রীপুরুষের রূপই বা কিরূপ, তাহাই যথার্থরূপে নিরূপণ করিতে চেষ্টা পাইতেছি।

মনের ভাবের প্রকাশ কথায় ও কার্যে। সাধারণ গোপিনীগণ, রাধা ও কৃষ্ণ, ইহারা প্রেম শব্দের অর্থে কি বুঝেন তাহা তাঁহাদের কথায় ও কার্যে বিশেষরূপে বুঝা যায়। গোপিনীগণ কৃষ্ণের কামোদ্দীপ্ত মুখের উপরে সতৃষ্ণনয়নে চাহিয়া কানে-কানে কথা কহিবার ছলে তাঁহার মুখচুম্বন করিয়া, পীনপয়োধরভারভরে তাঁহাকে আলিঙ্গন করিয়া, ‘কেলিকলাকুতুকেন’ কুঞ্জবনে প্রবেশের নিমিত্ত তাঁহার পরিহিত দুকুল ধরিয়া আকর্ষণ করিয়া তাঁহার প্রতি স্বীয় প্রেমের পরিচয় দিয়াছেন

রাধা কৃষ্ণের বিরহে কাতর হইয়া সখীকে বলিলেন—

সখি হে কেশিমথনমুদারম্
রময় ময়া সহ মুদনমনোরথভাবিতয়া সবিকারম্।

তাহার পর কৃষ্ণের সহিত মিলন হইলে কৃষ্ণ কি করিবেন এবং তাঁহার অবস্থা কিরূপ হইবে, রাধা সে বিষয়ে সখীকে একটি দীর্ঘ বক্তৃতা করিলেন। সে বক্তৃতাটি ইচ্ছা সত্ত্বেও এ সভায় আপনাদিগকে পড়িয়া শুনাইতে পারিলাম না। নিজেরা পড়িয়া দেখিলেই তাহাতে রাধা বিরহ ও মিলন কিভাবে দেখেন তাহা অতি স্পষ্টই বুঝিতে পারিবেন।

সখী কৃষ্ণের নিকট রাধার বিরহ-অবস্থা জানাইয়া বলিতেছেন, রাধা

ব্রতমিব তব পরিরম্ভসুখায় করোতি কুসুমশয়নীয়ম্।

আরো নানা কথা বলিলেন, ফলে দাঁড়াইল রাধার অবস্থা অতি শোচনীয়; তিনি অতিশয় উৎকট ব্যাধিগ্রস্ত, রক্ষা পাওয়া ভার; রোগের কারণ কৃষ্ণের বিরহ। রোগ অতি কঠিন হইলেও কৃষ্ণের দ্বারা অতি সহজেই তাহার প্রশমন হইতে পারে। সখী কৃষ্ণকে বলিলেন, এ রোগ

ত্বদঙ্গসঙ্গামৃতমাত্রসাধ্যাম্।

আর কৃষ্ণ?—তিনিও কথা এবং ব্যবহারে তাঁহার মনোভাব নিঃসন্দেহরূপে বুঝাইয়া দিয়াছেন। তিনি কেবলমাত্র চুম্বন আলিঙ্গন রমণ ইত্যাদির দ্বারা গোপিনীগণের প্রতি তাঁহার অন্তরের ভালোবাসা প্রকাশ করেন। সখীদ্বারা রাধাকে বলিয়া পাঠান যে, যাও শ্রীমতীকে গিয়া বলো—

ভূয়স্ত্রৎকুচকুম্ভনির্ভরপরীরম্ভামৃতং বাঞ্ছতি।

কৃষ্ণ রাধার দুর্জয় মান ভঞ্জনার্থ যে-সকল চাটুবচন প্রয়োগ করেন তাহাতেও ঐ একটি ভাবই ফুটিয়া উঠিয়াছে। রাধাকৃষ্ণ ইত্যাদি সকলেই যে-ভাবে মত্ত সে-ভাবের নাম সংস্কৃতে ঠিক প্রেম নহে। জয়দেব-বর্ণিত প্রেমের উৎপত্তি দেহজ আকাঙ্ক্ষা হইতে, তাহার পরিণতি দেহের মিলনে, তাহার উদ্দেশ্য দেহের ভোগজনিত সুখলাভ; তাঁহার নিকট বিরহের অর্থ প্রণয়ী-প্রণয়িনীর দেহের বিচ্ছেদজনিত শারীরিক কষ্ট।

গীতগোবিন্দে আসল ধরিতে গেলে প্রেমের কথা নাই, কেবলমাত্র কামের বিষয়ই আলোচিত হইয়াছে। হৃদয়ের সহিত জয়দেবের সম্পর্ক নাই, শরীর লইয়াই তাঁহার কারবার। যে রমণীর মনে প্রেম নাই, যাহার হৃদয় নাই, কেবলমাত্র দেহ আছে—তাহার স্ত্রীসুলভ লজ্জা নম্রতা ইত্যাদি মানসিক সৌন্দর্যের বিশেষ অভাব থাকিবার কথা; রাধিকাপ্রমুখ গোপযুবতীদিগের এই নির্লজ্জতার পরিচয় তাঁহাদের ব্যবহারে ও কথোপকথনে যথেষ্ট পরিমাণে লাভ করা যায়। রাধা কৃষ্ণের সহিত মিলিত হইলে ‘স্মরশরপরবশাকুত’ প্রিয়মুখ দেখিয়া নির্লজ্জভাবে উচ্চহাস্য করিয়া উঠেন।

এই তো গেল প্রেমের কথা, এখন শারীরিক সৌন্দর্যের কথা পাড়া যাউক। শারীরিক সৌন্দর্য তিনটি বিভিন্ন উপকরণে গঠিত

১. অঙ্গপ্রত্যঙ্গাদির গঠন বা আকৃতি

২. বর্ণ

৩. ভাব, অর্থাৎ আন্তরিক সৌন্দর্যের বাহ্যবিকাশ।

জয়দেবের নায়ক-নায়িকা যখন সর্বাংশে আন্তরিক সৌন্দর্যবঞ্চিত তখন অবশ্য তাহাদের শরীরে ভাবের সৌন্দর্যের দেখা পাওয়া অসম্ভব।

অঙ্গপ্রত্যঙ্গাদির গঠন এবং পরস্পরের সহিত পরস্পরের পরিমাণসামঞ্জস্য ও বর্ণ এ-সকল ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হইলেও দর্শনেন্দ্রিয়গ্রাহ্য বলিয়া ইহাতে কোনোরূপ ভোগের ভাব সংলিপ্ত নহে। যে সৌন্দর্য চোখে দেখা যায়, তাহার কেবল মানসিক উপভোগই সম্ভব; তাহা হইতে যে সুখ লাভ করা যায় তাহা কেবলমাত্র মানসিক আনন্দ; তাহাতে দেহের কোনোরূপ লাভলোকসান নাই। কিন্তু স্পর্শ করিয়া যে সুখ তাহা চৌদ্দ-আনা দৈহিক, সুতরাং জয়দেবের নিকট আমরা আকৃতি ও বর্ণের সৌন্দর্য অপেক্ষা শারীরিক কোমলতা ও স্পর্শযোগ্যতা ইত্যাদির অধিক বর্ণনা প্রত্যাশা করিতে পারি এবং জয়দেব এ বিষয়ে আমাদিগকে নিরাশ করেন না। মুখশ্রীর প্রধান উপকরণ ভাব, গঠন ও বর্ণের সৌন্দর্য। তাই জয়দেব মুখশ্রীবর্ণনা দুই কথায় করিয়াছেন, যে দুইটি কথা বলেন তাহা ও খানিকটা যেন না বলিলে নয় বলিয়া।

 গীতগোবিন্দের মুখ্য বিষয়টি কি, তাহা আমি যেরূপ বুঝিয়াছি তাহা আপনাদিগকে এতক্ষণ ধরিয়া বুঝাইতে চেষ্টা করিলাম, এখন আমি তাহার কাব্যাংশের দোষগুণের বিচারে প্রবৃত্ত হইতেছি।

কোনো-একটি বিশেষ রচনা কাব্য কি না, ও যদি কাব্য হয় তাহা হইলে কাব্যাংশে শ্রেষ্ঠ কিংবা নিকৃষ্ট এ-সকল বিষয়ে মন্তব্য প্রকাশ করিতে হইলে আগে কাব্য কাহাকে বলে সে বিষয়ে কতকটা পরিমাণে পরিষ্কাররূপ ধারণা থাকা আবশ্যক। আমরা প্রায় সকলেই সচরাচর কবিতা-বিষয়ে মতামত প্রকাশ করিয়া থাকি এবং আমাদের সকলেরই মনে কাব্য যে কি পদার্থ সে বিষয়ে একটা ধারণাও আছে, সেটি যে কি তাহা ঠিক প্রকাশ করিয়া বলা অত্যন্ত কঠিন। কোনো-একটি ক্ষুদ্র সংজ্ঞার ভিতর পৃথিবীর যাবতীয় কবিতাপুস্তক প্রবেশ করানো যায় না। দুই-চারি কথায় কোনো কাব্যের সমস্ত গুণের বর্ণনা করা অসম্ভব। কিন্তু সকল কাব্যের ভিতর যেটি সাধারণ অংশ তাহা নির্ণয় করিতে পারিলে তাহা যে কি, সে বিষয়ে একটি সংজ্ঞা দেওয়া যাইতে পারে। আমার বিবেচনায় আমাদের দেশে প্রচলিত ‘কাব্য রসাত্মক বাক্য’১ কাব্যের এই সংজ্ঞায়, সকল কাব্যের ভিতর যেটি সাধারণ অংশ অর্থাৎ যাহার অভাবে কোনো রচনা কাব্য হইতে পারে না, সেইটি অতি সুন্দরভাবে ব্যক্ত করা হইয়াছে। এই অল্পসংখ্যক কথা-কয়েকটির মধ্যে কি ভাব নিহিত আছে তাহা খুলিয়া বুঝাইয়া দিলে বোধ হয় আপনারাও আমার কথা কতক পরিমাণে গ্রাহ্য করিবেন।

[১. যেকালে এ প্রবন্ধ লেখা হয়, সেকালে সংস্কৃত অলংকারশাস্ত্রের কোনো গ্রন্থ আমি চোখে দেখি নি, এমন-কি, তাদের নাম পর্যন্ত শুনি নি, সেই কারণে উক্ত শাস্ত্রীয় বাক্যটি আমি আমাদের দেশে প্রচলিত বাক্য বলে উল্লেখ করতে বাধ্য হয়েছিলুম।—লেখক। ১৩২৭]

‘রসাত্মক বাক্য’—এই কথা কয়েকটির যথার্থ অর্থ বুঝিতে হইলে রস আত্মা ও বাক্য এই শব্দগুলির অর্থ জানা আবশ্যক। প্রথমত, ‘বাক্য’ এই শব্দ লইয়াই আরম্ভ করা যাউক; আমরা দেখিতে পাই বাক্যের দুইটি অংশ আছে। প্রথম, অর্থ; দ্বিতীয়, শব্দ। প্রথমাংশ মানসেন্দ্রিয়গ্রাহ্য; দ্বিতীয়াংশ শ্রবণেন্দ্রিয়গ্রাহ্য। যে শব্দ কানে শুনিয়া অন্তরে তাহার অর্থ গ্রহণ করি তাহাই বাক্য।

বাক্যের বিষয় মানুষের মনোভাব।

বাক্যের উদ্দেশ্য তাহা প্রকাশ করা এবং উক্ত উদ্দেশ্যসাধনের উপায় শব্দ। সুতরাং বাক্য রসাত্মক হইতে হইলে, প্রথমত, ভাব রসাত্মক হওয়া আবশ্যক; দ্বিতীয়ত, শব্দ রসাত্মক হওয়া আবশ্যক; তৃতীয়ত, এরূপভাবে প্রকাশ করা কর্তব্য যাহাতে রসাত্মক ভাব রসাত্মক শব্দের সহিত সম্পূর্ণরূপে মিশ্রিত হইতে পারে।

শব্দের রস কি? অবশ্য শ্রুতিমধুরতা; যেমন সংগীতে একটি সুর আর-একটি সুরের সহিত মিশ্রিত হইয়া অধিকতর শ্রুতিমধুর হয়, সেইরূপ একটি শব্দ আর-একটি শব্দের সংস্পর্শে অধিকতর শ্রুতিমধুর হয়। কানে শুনিতে ভালো লাগিবার জন্য শব্দবিন্যাসের পারিপাট্য হইতে ছন্দের উৎপত্তি। ভাষা ছন্দোবদ্ধ হইলে যত শুনিতে ভালো লাগে, ছন্দব্যতিরেকে ততদূর মিষ্ট লাগে না। সুতরাং কবির ভাষা ছন্দোযুক্ত। পদ্যে দুইটি উপকরণ বিদ্যমান—প্রথম rhyme, দ্বিতীয় rhythm। এই দুইটির মধ্যে দ্বিতীয়টিই ছন্দের প্রাণস্বরূপ; rhyme না থাকিলেও ছন্দ হয় কিন্তু rhythm না থাকিলে চলে না; rhyme ও rhythm উভয়েই সমভাবে বর্তমান থাকিলেই ছন্দ যথেষ্ট পরিমাণে পূর্ণাবয়ব হয়। সুতরাং যে কবির রচনায় rhyme এবং rhythm যত বহুল- পরিমাণে থাকিবে ততই তাঁহার শব্দের রস বেশি হইবে।

যে ভাব মনে সুন্দর ভাবের উদ্রেক করে, আমাদের হৃদয় বিশুদ্ধ আনন্দে পরিপুত করে তাহাই রসাত্মক ভাব। যেমন ফুল, সুগঠিত প্রস্তরমূর্তি, পূর্ণিমারজনী ইত্যাদি আমাদের দেখিতে ভালো লাগে, কিন্তু কেন লাগে তাহার কোনো কারণ নির্দেশ করা যায় না, সেইরূপ মানবমনের প্রেম ভক্তি স্নেহ, সৌন্দর্যের আকাঙ্ক্ষা, আকাঙ্ক্ষাজনিত বিষাদ, জগতের আদি অন্ত উদ্দেশ্য ইত্যাদি রহস্যপূর্ণ বিষয়ের চিন্তাজনিত মনের আবেগ, বিস্ময়াদি ভাবসকল সহজেই আমাদের ভালো লাগে; কিন্তু কেন যে ভালো লাগে তাহার কোনো কারণ নির্দেশ করা যায় না। উক্তপ্রকার রসাত্মক ভাবসকলই কাব্যের মুখ্য বিষয়। এই-সকল ভাবের ভিতর যে মাধুর্য আছে তাহাই প্রকাশ করা এবং আমাদের মনে এই-সকল ভাব উদ্রেক করিয়া আনন্দ প্রদান করাই কবিতার উদ্দেশ্য এবং যে কবি সেই উদ্দেশ্যসাধনে কৃতকার্য হয়েন তিনিই যথার্থ শ্রেষ্ঠ কবি। যদিও সুন্দর ভাব লইয়াই কবির কারবার, তথাপি পৃথিবীর কোনো সুন্দর জিনিস একেবারে তাঁহার আয়ত্তের বহির্ভূত নয়। কি বাহ্যিক, কি মানসিক যতপ্রকার সৌন্দর্য আছে সকলেরই ভিতর একটা বিশেষ মিল আছে। চিত্রকরের মুখ্য উদ্দেশ্য অবশ্য দর্শনেন্দ্রিয়গ্রাহ্য সৌন্দর্য সৃষ্টি দ্বারা লোকের মানসিক তৃপ্তি সাধন, কিন্তু তিনি তাঁহার চিত্রে বাহ্যিক সৌন্দর্যের ভিতর দিয়া ভাবের সৌন্দর্য ফুটাইয়া তুলিতে পারেন; কবির পক্ষেও ঠিক সেইরূপ। ভাবের সৌন্দর্য প্রকাশ করাই তাঁহার উদ্দেশ্য হইলেও তিনি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সৌন্দর্যের বর্ণনাতেও ক্ষান্ত নহেন, বরং যে কবি নিজের রচনায় রূপজ ভাবজ নৈতিক ইত্যাদি নানাবিধ সৌন্দর্যের একত্র মিলন করিতে পারেন তিনিই তত উচ্চদরের কবি বলিয়া গণ্য হয়েন। কিন্তু যেমন একটি চিত্রকরের পক্ষে চিত্রে ভাবের সৌন্দর্য প্রকটিত করিতে হইলে প্রথমত, চিত্রটিকে সুন্দর করিয়া আঁকিতে হইবে, দ্বিতীয়ত, যাহাতে তাহার ভাব পরিষ্কাররূপে ব্যক্ত হয় সেইরূপ করিয়া আঁকিতে হইবে; কবির পক্ষেও ঠিক সেইরূপ কোনো- একটি বিষয় কাব্যভুক্ত করিতে হইলে প্রথমে তাহাকে ভাবের সৌন্দর্যের সহিত লিপ্ত করিতে হইবে, দ্বিতীয়ত, তাহাকে সুন্দর ভাষায় ব্যক্ত করিতে হইবে।

আমি ভাষা ও ভাব পৃথক করিয়া আলোচনা করিয়াছি, কিন্তু বাস্তবিক কবির নিকট ভাষা ও ভাবের ভিতর কোনো প্রভেদ নাই। কবিতার ভাষা ও ভাব পরস্পরের উপর পরস্পর সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করে। ভাব মন্দ হইলে কবিতার ভাষা কখনোই সুন্দর হইতে পারে না, এবং ভাষা কদর্য হইলে ভাবও সম্পূর্ণরূপে কবিত্বপূর্ণ হইতে পারে না। কবিতার ভাষা ভাবের দেহস্বরূপ, কিছুতেই তাহা ভাব হইতে পৃথক করিতে পারা যায় না। একটি ভাব দুইপ্রকার ভাষায় ব্যক্ত হইলে অর্থ সম্বন্ধে অনেকটা বিভিন্ন হইয়া যায়। নিবিড় অন্ধকারকে কালিদাস বলিতেছেন ‘সূচিভেদ্যস্তমস্’, জয়দেব বলিতেছেন ‘অনল্পতিমির’। এ দুয়ের মধ্যে কতটা প্রভেদ আপনারাই বুঝিতে পারিতেছেন।

যে অন্তর্নিহিত শক্তি দ্বারা কবিতায় ভাব ও ভাষার সম্পূর্ণ একীকরণ সম্পন্ন হয় তাহাই কবিতার আত্মা। এই আত্মা আমাদের আত্মার ন্যায় রহস্যজড়িত। যেমন বৈজ্ঞানিকগণ মানবদেহ খণ্ডখণ্ড করিয়াও তাহার ভিতরকার আত্মাকে খুঁজিয়া পান না, সেইরূপ সমালোচকেরাও একখানি কাব্যের বিভিন্ন উপাদানসকল পরস্পর হইতে বিশ্লিষ্ট করিলেও তাহাদের অন্তরস্থ আত্মাকে ধরিতে পারেন না। যাঁহারা ভাবের সহিত ভাষা যুক্ত করিয়া কবিতাকে সজীব করিয়া তুলিতে পারেন তাঁহাদেরই কবিতার আত্মা আছে। কিন্তু যথার্থ কবিত্বশক্তিবিবর্জিত কোনো ব্যক্তি যদি বহুল পরিশ্রম দ্বারা বিশেষরূপে পাণ্ডিত্যের পরিচায়ক ভাব-সকলকে পরিপাটি ছন্দ ও ভাষা-যুক্ত করেন তাহা হইলেও তাঁহার রচনা কাব্যশ্রেণীভুক্ত নয়। সৃষ্টি ও নির্মাণে যে প্রভেদ, কবিতা ও তাহার অনুকরণে রচিত প্রাণশূন্য ছন্দোবন্ধের সমষ্টিতে সেই প্রভেদ।

পূর্বে যাহা বলিলাম তাহা সংক্ষেপে বলিতে গেলে দাঁড়ায় এই যে, যে রচনায় রসাত্মক ভাব সম্পূর্ণরূপ অনুরূপ ভাষায় প্রকাশিত তাহাকেই আমি কাব্য বলিয়া মানি। এখন দেখা যাউক কাব্য- বিষয়ে আমার মত অনুসারে বিচার করিলে জয়দেবের কাব্যজগতে স্থান কোথায়।

জয়দেব অধিকাংশ কবিদিগের অপেক্ষা কাব্যের বিষয়নির্বাচনে নিজের নিকৃষ্ট রুচির পরিচয় দিয়াছেন; প্রেমের পরিবর্তে শৃঙ্গাররসকে কবিতার বর্ণিত বিষয়স্বরূপ স্থির করিয়াছেন, সেজন্য আমরা কখনো তাঁহাকে কালিদাসাদি কবিগণের সহিত সমশ্রেণীভুক্ত করিতে পারি না। আমি আপাতত জয়দেব বিষয়টি কাব্যাকারে গঠিত করিয়া কিরূপ ক্ষমতার পরিচয় দিয়াছেন, সেই সম্বন্ধে আমার যাহা বক্তব্য আছে তাহাই বলিতেছি।

জয়দেবের কবিতাসকল প্রকৃতির শোভা, রাধাকৃষ্ণের রূপ এবং তাঁহাদের বিরহমিলন ইত্যাদি অবস্থার বর্ণনায় পূর্ণ; সুতরাং তাঁহার বর্ণনাবিষয়ে কৃতকার্যতা অনুসারে তাঁহার কবিত্বশক্তির স্বরূপ নির্ধারিত হইবে। কবিরা দুইরূপ প্রণালীতে বর্ণনা করিয়া থাকেন—প্রথম, স্পষ্ট এবং সহজ ভাবে, দ্বিতীয়, বর্ণিত বিষয় ইঙ্গিতে বুঝাইয়া দেন। উভয় উপায়ই প্রকৃষ্ট, এবং শ্রেষ্ঠ কবিরা উভয় প্রণালী অনুসারেই বর্ণনা করিয়া থাকেন। জয়দেব কেবলমাত্র প্রথমোক্ত প্রথা অবলম্বন করিয়াছেন। বর্ণনার পারিপাট্য ও সৌন্দর্য উপমাদি অলংকারসকলের প্রয়োগ দ্বারা বিশেষরূপে সাধিত হয়। এ জগতের সকল পদার্থের মধ্যেই একটা মিল আছে। আমাদের সময়ে সময়ে কোনো-একটি পদার্থ কিংবা ঘটনা দেখিয়া মনে হয় যেন আর অন্য-একটি কি জিনিসে এইরূপ ভাব দেখিয়াছিলাম। পৃথক পৃথক পদার্থের ভিতরকার এই সাদৃশ্যের তুলনা হইতে উপমাদির উৎপত্তি।

উপমাদির দ্বারা দুইটি কার্য সিদ্ধ হয় : ১. ইহার দ্বারা একটি অস্পষ্ট ভাবকে স্পষ্ট করা যায়, ২. ইহার দ্বারা ভাবের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা যায়। ইহা ব্যতীত কোনো দুইটি ভাব বা পদার্থের ভিতর আমার অলক্ষিত কোনোরূপ মিল কেহ দেখাইয়া দিলে মনে বিশেষ আনন্দ লাভ করা যায়। কবিতায় যে-সকল উপমা ব্যবহৃত হয় তাহার মুখ্য উদ্দেশ্য কোনো-একটি ভাবের উপমার সাহায্যে সৌন্দর্যবৃদ্ধি, এবং কেবলমাত্র উপমার যাথার্থ্য দ্বারা মনের তুষ্টিসাধন, সুতরাং জয়দেবের বর্ণনার যাথার্থ্য এবং সৌন্দর্য অনেকটা তাঁহার উপমাদি অলংকার প্রয়োগের শক্তিসাপেক্ষ 1

জয়দেবের বিরহাদি বর্ণনা নেহাত একঘেয়ে। তাঁহার বিরহীবিরহিণীদিগের নিকট যে বস্তু মনের সহজ অবস্থায় ভালো লাগিবার কথা তাহাই শুধু খারাপ লাগে। জয়দেব বিরহের ভাবের অন্য-কোনো অংশ ধরিতে পারেন নাই। কালিদাসের মেঘদূত-কাব্যে যক্ষস্ত্রীর যে বিরহাবস্থা বর্ণিত হইয়াছে তাহার সহিত তুলনা করিয়া দেখিলে জয়দেবের বর্ণনায় বৈচিত্র্যের অভাব এবং বিরহাবস্থার মধ্যে যে মধুর সৌন্দর্য আছে তাহার সম্পূর্ণ উল্লেখের অভাব—এই দুইটি ত্রুটি আমাদের নিকট স্পষ্টই প্রতীয়মান হয়।

জয়দেবের অভিসারবর্ণনায় কেবলমাত্র বেশভূষার বর্ণনাই দেখিতে পাই। তাহাতে অভিসারিকার মনের আবেগ, প্রেমের নিমিত্ত অবলা রমণীগণ কিরূপে নানারূপ বিপদকে তুচ্ছ জ্ঞান করে, এ-সকল বিষয়ে তিনি একটি কথাও বলেন নাই। এ বর্ণনাও নেহাত একঘেয়ে। তাঁহার বসন্তবর্ণনার প্রধান দোষ তাহাতে একটিও সম্পূর্ণ নূতন কথা দেখিতে পাই না। পূর্ববর্তী কবিরা যে-সকল বসন্তবর্ণনা লিখিয়াছিলেন তাহা হইতেই তাঁহার বসন্তবর্ণনার উপকরণ সংগৃহীত হইয়াছে। নূতনত্বের কথা ছাড়িয়া দিলেও তাহাতে আরো অনেক দোষ বাহির হইয়া পড়ে। তাঁহার সমস্ত বর্ণনাটিতে সমগ্র বসন্তের ভাব ফুটিয়া উঠে না। তিনি এ কথা ও কথা বলেন, কিন্তু তাহার ভিতর হইতে একটা কোনো বিশেষ ভাব খুব স্পষ্টরূপে দেখা যায় না। কালিদাস অনেক স্থলে বসন্তবর্ণনা করিয়াছেন, তাহার অনেক স্থলেই তিনি একটিমাত্র শ্লোকে হয় বসন্তের সমগ্রভাব প্রকাশ করিয়াছেন, নয় একটিমাত্র চিত্রে সমস্ত বসন্ত আবদ্ধ করিয়াছেন—

দ্রুমাঃ সপুষ্পাঃ সলিলং সপদ্মং
স্ত্রিমঃ সকামাঃ পবনঃ সুগন্ধিঃ ॥
সুখাঃ প্রদোষা দিবসাশ্চ রম্যাঃ
সর্বং প্রিয়ে চারুতরং বসন্তে ॥

জয়দেব বসন্তবর্ণনায় অনেকগুলি বিষয় বর্ণনা করিয়াছেন, কিন্তু বর্ণিত বিষয়গুলির মধ্যে খুব-একটা ভাবের মিল নাই। তিনি একটি শ্লোকের প্রথম চরণে বলিতেছেন যে ‘বসন্তে বিরহীগণ বিলাপ করিতেছেন’; সেই শ্লোকের আর-একটি চরণে ‘অলিকুল কর্তৃক বকুলকলাপ অধিকারে’র কথা উল্লেখ করিয়াছেন। এ দুয়ের ভিতর যে কি স্বাভাবিক মিল তাহা আমি বুঝিতে পারি না। তাঁহার উদ্দেশ্য, বসন্তে যে মদন-রাজার অধিকার বিস্তৃত হইয়াছে তাহাই বর্ণনা করা। কিন্তু কেবলমাত্র কোনো ফুলকে মদন-রাজার নখ এবং অন্য অপর আর-একটিকে বিরহীদিগের হৃদয়বিদারণের অস্ত্রস্বরূপ বলিলেই সে উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয় না। যথার্থ মদনবিকারের ভাব কিসে ফুটিয়া উঠে তাহা আমি কালিদাসের একটিমাত্র শ্লোক উদ্‌ধৃত করিয়া দেখাইতেছি—

মধু দ্বিরেফঃ কুসুমৈকপালে
পপৌ প্রিয়াং স্বামনুবর্তমানঃ
শৃঙ্গেণ চ স্পর্শনিমীলিতাক্ষী
মৃগীমকণ্ডূয়ত কৃষ্ণসারঃ ॥

উক্ত শ্লোকে কালিদাস মদনের নখ দূরে যাউক তাঁহার নাম পর্যন্ত উল্লেখ করেন নাই, তথাপি প্রেমরসমত্ততার কি চমৎকার চিত্র আঁকিয়াছেন। সমগ্র ভাবের কথা ছাড়িয়া দিলেও জয়দেব এমন একটিমাত্রও শ্লোক রচনা করিতে পারেন নাই যাহাতে কোনো-একটি পদার্থের সজীব চিত্র আমাদের চোখের সম্মুখে ধরিয়া দেওয়া হইয়াছে। প্রকৃতি বর্ণনাতেও যেরূপ স্ত্রীপুরুষের রূপবর্ণনাতেও তিনি ঠিক সেইরূপ অক্ষমতার পরিচয় দিয়াছেন। কালিদাস

আবর্জিতা কিঞ্চিদিব স্তনাভ্যাং
বাসো বসানা তরুণার্করাগম্।
পর্যাপ্তপুষ্পস্তবকাবনম্রা
সঞ্চারিণী পল্লবিনী লতেব ॥

এই একটিমাত্র শ্লোকে সমগ্র উমাকে কত সুন্দরভাবে বর্ণনা করিয়াছেন। জয়দেব এইরূপ দুই-চার কথায় একটি স্ত্রী কিংবা পুরুষের সমগ্র চিত্র বর্ণনা করিতে একান্ত অপারগ। তাঁহার বিশ্বাস পদ্মের ন্যায় মুখ, তিলফুলের ন্যায় নাসিকা, ইন্দীবরের ন্যায় নয়ন এবং বান্ধুলির ন্যায় অধর—এই- সকলের একটি সমষ্টি করিলেই সুন্দরীর মুখ নির্মাণ করা যায়। উক্ত বিশ্বাসে ভর করিয়া সুন্দর-কবি বিদ্যাকে একটি পদ্মের সহিত তিলফুল নীলোৎপল বান্ধুলিপুষ্প এবং কুন্দকলিকা ইত্যাদি অতি কৌশলসহকারে সংযোজনা করিয়া যে অপূর্ব মূর্তি নির্মাণ করিয়া উপহারস্বরূপ পাঠাইয়াছিলেন তাহা অবশ্য জয়দেবের নিকট তিলোত্তমার মুখ বলিয়া গণ্য হইতে পারিত। উক্তপ্রকার বিশ্বাসের উপর আমার কোনোই আক্রোশ নাই, যিনি ইচ্ছা করেন অনায়াসে তিনি ঐ-সকল ফুল জোড়াতাড়া দিয়া যখন-তখন মনের সুখে সুন্দরীর রূপবর্ণনা করিয়া কবিতা লিখিতে পারেন। কেবল এইটিমাত্র মনে রাখিলেই আমি সন্তুষ্ট থাকিব যে, পদ্ধতি অনুসারে চলিলে মাথামুণ্ড কিছুই বর্ণনা করা যায় না।

তার পর জয়দেবের উপমার বিষয় কিছু বলিতে ইচ্ছা করি। প্রথমত আমরা দেখিতে পাই ে জয়দেবের উপমাসকল প্রায়ই নেহাত পড়ে-পাওয়া-গোছের। জয়দেবের পূর্বে-সেই-সকল উপম শতসহস্রবার সংস্কৃতকবিগণ কর্তৃক ব্যবহৃত হইয়াছে। জয়দেব কাব্যজগতের বিস্তৃত ক্ষেত্র হইে তাহা কুড়াইয়া লইয়াছেন মাত্র। কাব্যজগতে না বলিয়া পরের দ্রব্য গ্রহণ করার প্রথাটা বিশেষরূ প্রচলিত আছে এবং কোনো কবি যদ্যপি উক্ত উপায়ে উপার্জিত দ্রব্যের সমুচিত সদ্ব্যবহার করিতে পারেন তাহা হইলে তাঁহাকে লোকে কিছু-একটা বিশেষ দোষও দেয় না। নেহাত পরের দ্রব্য বলিয় চেনা গেলেই আমরা রাগ করি এবং কবির উদ্দেশে কটুকাটব্যও ব্যবহার করি; কিন্তু যদি তাহার একটুমাত্রও রূপের পরিবর্তন দেখিতে পাই তাহা হইলেই ঠাণ্ডা থাকি। জয়দেব অনেক স্থলেই পরের উপমাদি লইয়া তাহার একটু-আধটু বদলাইয়া নিজের বলিয়া চালাইবার চেষ্টা পাইয়াছেন তাঁহার এ বিষয়ে হাত বড়ো মন্দ সাফাই নহে; আবার অনেক স্থলে যেমনটি পাইয়াছেন অবিকল তেমনটি রাখিয়াছেন। এইরূপ উপমাদি পড়িয়া রাগ করি আর না করি, খুব যে খুশি হই তাহ নহে। যে কথা হাজারবার শুনিয়াছি তাহা আর কার শুনিতে ভালো লাগে। আমার তো পদ্মের মতো মুখ ইত্যাদি কথা শুনিলেই মনটা একটু অন্যমনস্ক হয় এবং ঐরূপ উপমা বেশিক্ষণ পড়িতে হইলেই হাই উঠিতে আরম্ভ হয়, কারণ ও-সব পুরানো কথায় মনে কোনো নির্দিষ্ট ভাব বা চিত্র আসে না। শুনিবামাত্রই মনে হয় ও-সব তো অনেকদিনই শুনিয়াছি, আবার অনর্থক ও কথা কেন? ভরসা করি, আপনারা সকলেই আমার সহিত এ বিষয়ে একমত।

কিন্তু জয়দেব যে কেবলমাত্র প্রচলিত উপমাদি ব্যবহার করিয়াছেন এমন নহে তাঁহার পরিকল্পিত দু-চারিটি নূতন উপমাও গীতগোবিন্দে দেখিতে পাওয়া যায়। তাহার মধ্যে যেগুলি আমার নিকট বিশেষরূপে জয়দেবীয় বলিয়া বোধ হইয়াছে আপনাদের জ্ঞাতার্থে তাহারই দুই- একটি এখানে উদ্ধৃত করিতেছি। জয়দেব ঈশ্বরের নরহরিরূপ সম্বন্ধে বর্ণনায় বলিতেছেন—

তব করকমলবরে নখসম্ভূতশৃঙ্গম্
দলিতহিরণ্যকশিপুতনুভূঙ্গম্।

ইহার দোষ—প্রথমত, কমলের নখাঘাত ও তৎকর্তৃক ভ্রমরের বিনাশ নেহাত অস্বাভাবিক; দ্বিতীয়ত, নরসিংহের করযুগলকে কমলের সহিত তুলনা করায় এবং হিরণ্যকশিপুকে ভৃঙ্গের সহিত তুলনা করায় উভয়ের ভিতর বৈরিতার বিরোধীভাবের পরিচয় দেওয়া হয় নাই; তৃতীয়ত, দুর্দান্ত দৈত্যের সহিত কৃষ্ণ নরহরিরূপ গ্রহণ করিয়া তাঁহাকে বধার্থ স্বীয় বীরত্বের পরিচায়ক যে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন তাহাকে কমল ও ভ্রমরের যুদ্ধস্বরূপ বলায় ভাবের যাথার্থ্য এবং সৌন্দর্য কতটা পরিমাণে বজায় থাকিল আপনারাই বিবেচনা করিবেন।

বলরামকে উল্লেখ করিয়া জয়দেব বলিতেছেন–

বহসি বপুষি বিশদে বসনং জলদাভম্
হলহতিভীতিমিলিত মুনাভম্।

হলতাড়নার ভয়ে যমুনা ডাঙায় উঠিয়া বলরামের দেহে বসনরূপে সংলগ্ন হইয়াছেন, এরূপ অযথা কথা বলায় যদি কিছু সৌন্দর্য বৃদ্ধি পাইত তাহা হইলেও নাহয় উপমাটি সহ্য করা যাইত; তাহার বিবেচনায় জয়দেব বলরামকে জলে নামাইলে যমুনাকে আর জলছাড়া করিবার আবশ্যক হইত না। কৃষ্ণের মুখ কিরূপ, না—

তরলদৃগঞ্চলবলনমনোহরবদনজনিতরতিরাগম ফুটকমলোদরখেলিতখঞ্জনযুগমিব শরদি তড়াগম্।

কৃষ্ণের নয়নশোভিত বদন দেখিয়া মনে হইল যেন পদ্মের ভিতর খঞ্জনযুগল খেলা করিয়া বেড়াইতেছে। কমলের ভিতর খঞ্জনযুগলের বিহার আমিও দেখি নাই, জয়দেবও দেখেন নাই এবং আমার বিশ্বাস ওরূপ কার্য খঞ্জনেরা কখনো করে না। এ উপমাটি আমার নিকট যেমন অপ্রাকৃত তেমনি অর্থশূন্য বলিয়া মনে হইতেছে।

এই আমার উপমা তিনটি উদ্ধৃত করার উদ্দেশ্য কেবল জয়দেবকে নিন্দা করা নহে; আমি এই-সকল উদাহরণ হইতে জয়দেব কি জন্য এবং কি উপায়ে উপমা প্রয়োগ করিতেন তাহাই দেখাইব। এরূপ উপমা পড়িয়া আপনাদের কি মনে হয় না যে, জয়দেব কেবল উপমাপ্ৰয়োগ করাটা কবিতায় আবশ্যক বিবেচনায় উক্ত কার্য করিতেছেন, বাস্তবিক উপমায় কবিতার সৌন্দর্য বাড়িল কি না এবং কোনো বিশেষ ভাব পরিষ্কাররূপে তাহার সাহায্যে ব্যক্ত করা গেল কি না এ- সব কথা জয়দেবের মনেও আসে নাই। উপমা আপনা হইতেই তাঁহার কাছে আসে না, তিনি জোর করিয়া তাহাকে টানিয়া আনেন অর্থাৎ তাঁহার উপমায় স্বাভাবিকতা কিছুমাত্র নাই। তাহা কেবলমাত্র কৃত্রিমতায় পরিপূর্ণ। প্রমাণ, কবিরা প্রায়ই সুন্দর করযুগলকে কমলের সহিত তুলনা করেন, তাই জয়দেব নরসিংহের করযুগলকে কমলস্বরূপ বলিয়া বসিলেন এবং তাহাকে কমল বলায় হিরণ্যকশিপুকে তাঁহাকে বাধ্য হইয়া ভৃঙ্গ বলিতে হইল। ভাবের সৌন্দর্য বজায় থাকিল কি না সে কথা ভাবিয়া আর কি করিবেন? একটি ভুলের জন্য বাধ্য হইয়া আর-একটি অন্যায় কাজ করিতে হইল। আবার দেখুন, কবিরা মুখকে পদ্মের সহিত এবং নয়নযুগলকে খঞ্জনের সহিত তুলনা করেন, ইহা জয়দেবের নিকট অবিদিত ছিল না, কিন্তু নয়নশোভিত বদনকে কবিরা কি বলেন তাহা তাঁহার জানা ছিল না। কাজেই কি করেন, তিনি উপমাস্বরূপ পদ্মের সহিত মনে মনে খঞ্জনের যোগ করিয়া ফেলিলেন, অগত্যা খঞ্জনকেই কমলোদরে প্রবেশ করাইয়া দিতে হইল। ল্যাঠা চুকিয়া গেল, জয়দেব হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিলেন। কবিতা হইল কি না সে কথা আপনারা ভাবুন।

আমি ক্রমে ক্রমে প্রমাণ করিয়াছি যে, জয়দেব যখন কোনো বিষয়ের সাধারণ ভাব অথবা তাহার সর্বাবয়বের প্রত্যক্ষরূপ সহজভাবে কিংবা অলংকারাদির সাহায্যে উত্তমরূপ বর্ণনা করিতে অসমর্থ তখন তাঁহাকে এ বিষয়েও বড়ো কবি বলিয়া গণ্য করা যায় না।

এখন আমি জয়দেবের ভাষা সম্বন্ধে আমার যাহা বক্তব্য আছে তাহা বলিয়াই আমার প্রবন্ধ শেষ করিব। জয়দেবের ভাষা যে অতি সুললিত এবং শ্রুতিমধুর ইহা তো সর্ববাদিসম্মত। এমন-কি, যাঁহারা সংস্কৃত ভাষায় অনভিজ্ঞ তাঁহারাও এ কথা স্বীকার করিয়া থাকেন। বরং শেষোক্ত ব্যক্তিদিগকেই উক্ত বিষয়ে জয়দেবের প্রচুর পরিমাণে প্রশংসা করিতে দেখা যায়। আমি পূর্বে বলিয়াছি যে, কবিতার ভাষার সৌন্দর্য হইতে ভাবের সৌন্দর্য পৃথক করা যায় না। ভাবের অনুরূপ ভাষা প্রয়োগেই যথার্থ কবিত্বশক্তির পরিচয়। যাহাদের মস্তিষ্কে ভাব ও ভাষা একত্রে গঠিত হয় না তাহারা লোকের মনোযোগ আকর্ষণ করিবার জন্য হয় ভাব-বিষয়ে পাণ্ডিত্য নয় ভাষা-বিষয়ে ছন্দনির্মাণের কৌশল, এই দুইয়ের একটির সাহায্য লইতে বাধ্য হয়। জয়দেব আমার বিবেচনায় যথার্থ উচ্চ-অঙ্গের কবিতা রচনার অক্ষমতাবশত লোকসাধারণের চটক লাগাইবার অভিপ্রায়ে শেষোক্ত উপায় অবলম্বন করিয়াছেন। তাঁহার রচনায় কিছু অতিরিক্ত মাত্রায় কথার কারিগরি দেখা যায়। মনে কোনো-একটি বিশেষ ভাবের উদয় হইলে যে-কথাটি স্বভাবতই মুখাগ্রে আসিয়া উপস্থিত হয়, জয়দের সেটিকে চাপিয়া রাখেন। তাহার পরিবর্তে শব্দ-শাস্ত্র খুঁজিয়া ভাবপ্রকাশবিষয়ে অপেক্ষাকৃত অনেকাংশে অনুপযোগী আর-একটি কথা আনিয়া হাজির করেন। কালিদাসাদি যথার্থ শ্রেষ্ঠ কবিদের রচনাপ্রণালী স্বতন্ত্র। তাঁহারা স্বভাবতই যে কথাটি মুখে আসে সেইটি ব্যবহার করেন; তবে তাঁহাদের ভাবের সহিত আমাদের ভাবের অনেক পার্থক্য, সুতরাং যেরূপ শব্দ প্রয়োগ করা তাঁহাদের পক্ষে সহজ, সাধারণ লোকের পক্ষে তাহা একান্তই দুঃসাধ্য। আপনার আমার ও জয়দেবের সহিত তাঁহাদের এইটুকুমাত্র তফাত। জয়দেবের ভাষার প্রধান দোষ—সুস্পষ্ট rhythmএর অভাব। তাঁহার ব্যবহৃত শব্দসকল একটি প্রায় সম্পূর্ণরূপে অন্য আর- একটির ন্যায়। অতিরিক্ত মাত্রায় অকারান্ত শব্দের ব্যবহারে শব্দসকলের হ্রস্বদীর্ঘাদি প্রভেদ যথেষ্ট পরিমাণে না থাকায়, সুতরাং তাহাদের উচ্চারণের বৈচিত্র্য-অভাবে, জয়দেবের ভাষায় গাম্ভীর্যের একান্ত অভাব ঘটিয়াছে! কিন্তু বাক্যের যে অংশ কেবলমাত্র শ্রবণেন্দ্রিয়গ্রাহ্য তাহাও গাম্ভীর্যব্যতিরেকে সম্পূর্ণরূপে মধুর হইতে পারে না। অন্যান্য বিষয়ের ন্যায় ভাষা সম্বন্ধেও গাম্ভীর্যযুক্ত মাধুর্য গাম্ভীর্যবিরহিত মাধুর্য অপেক্ষা বহুল পরিমাণে শ্রেষ্ঠ এবং শ্রীসম্পন্ন।  গীতগোবিন্দের সহিত মেঘদূতের তুলনা করিলেই দেখা যায় গাম্ভীর্য-গুণবিশিষ্ট হইয়াও শেষোক্ত কাব্যের ভাষা পূর্বোক্ত কাব্যের ভাষা হইতে কত উৎকৃষ্ট।

সমভাবে উচ্চারিত অকারান্ত শব্দের একত্রে বহুল বিন্যাসের আর-একটি দোষ আছে, তাহাতে পাঠকমাত্রেরই পক্ষে রচনার অর্থ গ্রহণ করা কিঞ্চিৎ কঠিন হইয়া উঠে। বিভিন্ন বিভিন্ন শব্দসকল পরস্পর হইতে বিশেষরূপে স্বতন্ত্র না হইলে পাঠকালীন তাহাদের প্রত্যেকের উপর নজর পড়ে না। একটি শ্লোকের অন্তর্ভূত শব্দসকলের আকৃতিগত স্বাতন্ত্র্য যত সুস্পষ্ট তাহার অর্থও সেই পরিমাণে চট্ করিয়া বুঝা যায়। শব্দসকলের বৈচিত্র্য বজায় রাখিয়া তাহাদের ভিতর সামঞ্জস্য সৃষ্টি করিয়া যিনি রচনাকে শ্রুতিমধুর করিতে পারেন তিনিই যথার্থ ভাষার রাজা। জয়দেব তাঁহার রচনায় শব্দসকলের হ্রস্বদীর্ঘাদি প্রভেদজনিত বন্ধুরতা ভাঙিয়া মাজিয়া-ঘষিয়া এমন মসৃণ করিয়াছেন যে তাহা পড়িতে গেলে তাহার উপর দিয়া রসনা ও মন দুইই পিছলাইয়া যায়। প্রত্যেক শব্দটির উপর মন বসাইতে না পারিলে সমস্ত রচনার অর্থের উপরেও অমনোযোগ আপনা হইতেই আসিয়া পড়ে।

গীতগোবিন্দে কথার বড়ো-একটা কিছু অর্থ নাই বলিয়া জয়দেব যে চাতুরী করিয়া যাহাতে পাঠকের মন ভাবের দিকে আকৃষ্ট না হইতে পারে, সেই অভিপ্রায়ে উক্ত প্রকার শ্লোক রচনা করিয়াছেন এমন বোধ হয় না। কিন্তু ফলে তাহাই দাঁড়াইয়াছে।

এতক্ষণ পর্যন্ত আমি শুধু জয়দেবের কবিতার দোষ দেখাইয়া আসিয়াছি। তিনি যে উৎকৃষ্ট কবিদিগের সহিত সমশ্রেণীতে আসন গ্রহণ করিতে পারেন না তাহাই দেখানো আমার উদ্দেশ্য। যাঁহার কাব্যের বিষয় প্রেমের তামসিক ভাব, মানবদেহের সৌন্দর্য যাঁহার দৃষ্টিতে ততটা পড়ে না, যিনি মানবদেহকে কেবল ভোগের বিষয় বলিয়াই মনে করেন, প্রকৃতির সৌন্দর্যের সহিত যাঁহার সাক্ষাৎপরিচয় নাই, যিনি বর্ণনা করিতে হইলেই শোনা কথা আওড়ান, যাঁহার ভাষায় কবিত্ব অপেক্ষা চাতুরী অধিক—এক কথায়, যাঁহার কাব্যে স্বাভাবিকতা, অপেক্ষা কৃত্রিমতাই প্রাধান্য লাভ করিয়াছে, তাঁহাকে আমি উৎকৃষ্ট কবি বলিতে প্রস্তুত নহি। ভরসা করি এ বিষয়ে আপনারাও আমার সহিত একমত। কিন্তু এ-সকল কথা সত্য হইলেও জয়দেবকে যে, অনেকে বড়ো কবি বলিয়া মনে করেন সে কথাও তো অস্বীকার করিবার জো নাই। জয়দেব সম্বন্ধে এই সাধারণ মত কি কি কারণ- প্রসূত তাহা আমি কতকটা নির্ণয় করিতে চেষ্টা করিয়াছি। নিম্নে সেগুলি উল্লেখ করিতেছি।

প্রথমত, শৃঙ্গাররসের বর্ণনায় জয়দেব যখন তাঁহার সমস্ত ক্ষমতা প্রস্ফুটিত করিয়া তুলেন তখন তাঁহার কবিতা বিশেষরূপে স্বাভাবিক হইয়া উঠে—তখন তিনি কোনোরূপ অপ্রাকৃত কিংবা অযথার্থ কথা বলেন না। যে বিষয়ে যাহার প্রত্যক্ষ জ্ঞান আছে তাহার বর্ণনায় সে অবশ্য বিলক্ষণ নিপুণ। সুরতসুখালসজনিত দেহের অবস্থা তিনি কত জাজ্জ্বল্যমান করিয়া আঁকিতে পারেন। মনের ভাবের কথা নাই বলিলেন, রোমাঞ্চ শীৎকার ইত্যাদি একান্ত শারীরিক ভাবসকলের বর্ণনায় তো তিনি কাহারো অপেক্ষা কম নন। আর তাঁহার ভাষায় গাম্ভীর্য ইত্যাদি গুণ নাই বটে কিন্তু তাহা শৃঙ্গাররসের বর্ণনার পক্ষে বিশেষ উপযোগী। যুবতীদিগের দেহের ন্যায় তাঁহার শব্দগুলিও কুসুমসুকুমার। যখন রূপসীদিগের কবরী শিথিল হইয়া যাইতেছে, নীবিবন্ধন খসিয়া পড়িতেছে, যখন সকল অঙ্গপ্রত্যঙ্গাদির বন্ধন শ্লথ হইয়া আসিতেছে তখন আর ভাষার বাঁধুনি কি করিয়া প্রত্যাশা করা যায়? রাধার দেহের ন্যায় গীতগোবিন্দের ভাষা ‘নিঃসহনিপতিতা লতা’স্বরূপ। তাই শৃঙ্গাররসবর্ণনকালে তাহার ভাষা ভাবের অনুরূপ। তিনি শৃঙ্গাররসের কবি। কিন্তু যে রসেরই হউন না, কবি তো বটে। এবং কবির যথার্থ রচনা যে জাতিরই হউক, লোকের ভালো লাগিবেই লাগিবে, সুতরাং জয়দেবের কাব্য সাধারণের একেবারেই অনাদরের সামগ্রী নহে।

দ্বিতীয়ত, সাধারণের সংস্কৃত ভাষায় অজ্ঞতা আর-একটি কারণ। সংস্কৃত না জানার দরুন ভাষার লালিত্য হইতে লোকে ধরিয়া নেয় ভাবেরও অবশ্য সৌন্দর্য আছেই আছে।

তৃতীয়ত, রাধাকৃষ্ণের প্রেম জয়দেবের কাব্যের বিষয় বলিয়া সাধারণের নিকট জয়দেবের কাব্য এত উপাদেয়। এ সংসারে ফুল জ্যোৎস্না মলয়পবন কোকিলের কুহুস্বর আমাদের সকলেরই ভালো লাগে, চিরদিন লোকের ভালো লাগিয়াছে এবং চিরদিন ভালো লাগিবে। কিন্তু কতকগুলি জিনিস আছে যাহার যথার্থ একটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য না থাকিলেও অভ্যাস ও সংস্কার-বশত আমাদের ভালো লাগে। যমুনার জল, তমালের বন,  বৃন্দাবন, মথুরা, শ্রীকৃষ্ণের বাঁশি—এ-সকলের মধুরতা পূর্ণিমারজনী দক্ষিণপবনের ন্যায় আমাদের নিকট পুরাতন হয় না। যিনিই এ-সকলের কথা বলেন, তাঁহার কথাই আমাদের শুনিতে ইচ্ছা যায়। আমরা অনেকেই বৃন্দাবন, যমুনার জল এ- সকল কিছুই দেখি নাই, বাঁশির স্বরও কখনো শুনি নাই—তবে তাহাদের কথা এত প্রাণ স্পর্শ করে কেন? কারণ ঐ এক-একটি কথা হৃদয়ে কত সুন্দর কত মধুর স্মৃতি জাগাইয়া তুলে। আমরা যমুনার জল দেখি নাই বটে, কিন্তু তাহার সম্বন্ধে এত সুন্দর কবিতা পড়িয়াছি যে, যমুনার সমস্ত সৌন্দর্য আমাদের হৃদয়ে লিপ্ত হইয়া গিয়াছে; তাই রাধাকৃষ্ণের প্রণয়সম্পৰ্কীয় সকল বস্তুকেই প্রকৃতির চিরস্থায়ী সুন্দর অংশসকলের মধ্যে ভুক্ত করিয়া ফেলি। সুতরাং জয়দেব যখন সেই যমুনা, সেই বাঁশি, সেই রাধা, সেই কৃষ্ণ ও সেই  বৃন্দাবনের কথা বলেন তখন তাহার পরিবর্তে তাঁহা অপেক্ষা শতগুণে শ্রেষ্ঠ বৈষ্ণবকবিরা আমাদের মনে ঐ-সকলের যে সুন্দর মূর্তি অঙ্কিত করিয়াছেন তাহারই দিকে আমাদের দৃষ্টি পড়ে। আমরা আসল কারণ না বিচার করিয়া মনে করি, জয়দেবের কবিতা পড়িয়াই আমরা মোহিত হইতেছি। তাঁহার পরবর্তী কবিসকলের গুণ আমরা ভুলক্রমে জয়দেবে আরোপ করি। চণ্ডীদাসাদি বৈষ্ণবকবিগণ রাধাকৃষ্ণের প্রেম কাব্যের বিষয় না করিলে জয়দেব আমাদের যতটা ভালো লাগে তাহা অপেক্ষা অনেক কম ভালো লাগিত, অন্তত আমার কাছে।

জ্যৈষ্ঠ ১২৯৭


© 2024 পুরনো বই