প্রগতিরহস্য

আজ যা পাঁচজনকে শোনাতে বসেছি তা একটা উড়ো গল্প নয়—আমাদের বর্তমান প্রগতির আংশিক ইতিহাস, অথবা দুটি ভদ্রলোকের আংশিক জীবনচরিত। এ দুই ব্যক্তির কেউ অবশ্য চিরস্মরণীয় নন। আমার স্মৃতিপটে এঁদের যে রূপ অঙ্কিত আছে, সেই ছবি ঈষৎ enlarge করে আপনাদের সুমুখে খাড়া করতে চাই; যদিচ তাঁরা কেউ সুদৃশ্য ছিলেন না।

আপনারা জিজ্ঞাসা করতে পারেন, এ কথা স্মরণ করিয়ে দেবার সার্থকতা কি।—আমার উত্তর হচ্ছে, আমাদের ভিতর কজন চিরস্মরণীয় হবেন? দু এক জনের বেশি নয়। তাই বলে আমরা যারা আছি, আমাদের মতামতের ও বিদ্যাবুদ্ধির কি কোনো মূল্য নেই? আমাদের মতো সাধারণ লোকের সঙ্গে অসাধারণ লোকের প্রধান তফাত এই যে, আমরা আছি, আর তাঁরা ছিলেন। যখন তাঁরা ছিলেন, তখন তাঁরা আমাদেরই মতো কাউকে হাসিয়েছেন, কাউকে কাঁদিয়েছেন, কাউকে ঘুসো দেখিয়েছেন, কারো কাছে জোড়হাত করেছেন। অর্থাৎ আমরা আজ যা করি, বছর পঞ্চাশ আগে তাঁরাও তাই করেছেন। আমরা কেউ কেউ সেকালের কথা শুনতে যে ভালোবাসি তার কারণ, একাল সেকালেরই পুনরুক্তি মাত্র। আমাদের প্রতিব্যক্তির যেমন একটু-আধটু বিশেষত্ব আছে, তাঁদেরও তেমনি ছিল। সেই বিশেষত্বই আমার মনে আছে, আর সেই কথা আপনাদের নিবেদন করতে চাই। কি সূত্রে এঁদের কথা আজ মনে পড়ে গেল, তা বলছি।

প্রগতি যে আমাদের হয়েছে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। প্রগতির মানে কি? কোনো বড়ো জিনিসের কোনো ছোটো অর্থ নেই— যা দু কথায় বোঝানো যায়; আর অনেক কথায় তার ব্যাখ্যা করতে গেলে, লোকে সে কথায় কর্ণপাত করবে না। প্রগতির প্রমাণ এই যে, আমি যদি বলি প্রগতি হয়নি, তবে লোকে বলবে—তুমি অন্ধ, আর না হয় তো তুমি সেকেলে কূপমণ্ডুক। দেখতে পাচ্ছ না যে, আমাদের কাব্যে ও চিত্রে,

নৃত্যে ও গীতে কি পর্যন্ত প্রগতি হয়েছে ও হচ্ছে? তুমি, প্রমথ চৌধুরী, দেখছ যে আমরা আজও পরাধীন ও পরবশ—কিন্তু ভুলে যাচ্ছ যে আমাদের পরাধীনতাই আমাদের সকল প্রগতির মূল, আর তুমিও ঐ প্রগতির জোয়ারে খড়কুটোর মতো ভেসে চলেছ।

আমি বলি—তথাস্তু। এখন জিজ্ঞাসা করি, দেশে প্রগতি আনলে কে? যদি বল ইংরেজ, তা হলে কথাটা ঠিক হবে না। ইংরেজ তো আমাদের প্রগতির পথ বন্ধ করে দিয়েছে ইণ্ডিয়া অ্যাটের বেড়া তুলে। এর পর আমাদের প্রগতির উল্টোরথ টানতে হবে।

তবে কি রামমোহন রায় এই প্রগতির রথ নূতন পথে চালিয়েছেন? অবশ্য এ পথ রামমোহন প্রথম আবিষ্কার করেন। তার পর বহু লোক এই রথের দড়ি টেনেছেন। এই শ্রেণীর দুটি লোকের কথা তোমাদের শোনাব; তার মধ্যে একজন ছিলেন প্রগতির নীরব কর্মী, আর-একজন নীরব ভাবুক।

আমি ছেলেবেলায় একটা মফস্বলের শহরে বাস করতুম লেখাপড়া করবার জন্য। সেকালে উক্ত শহরে দুজন গণ্যমান্য মুখুজ্যে মশায় ছিলেন। একজনের ছিল অগাধ টাকা, আর-এক জনের ছিল অগাধ বিদ্যে—দুইই স্বোপার্জিত; কেননা উভয়েই ছিলেন দরিদ্র সন্তান, কিন্তু উভয়েই self-help এর মন্ত্র সাধন করে একজন হয়েছিলেন ধনী, অপরটি বিদ্বান।

কেনারাম মুখুজ্যে কোনো জমিদারের মেয়ে বিয়ে করে তাঁর শ্বশুরকুলের দত্ত মাসহারার টাকা বাঁচিয়ে, সে উদ্বৃত্ত টাকা সুদে খাটাতেন। আমি এ কথা জানতুম এই সূত্রে যে, আমাদের মতো লোকের অর্থাৎ যাদের আয়ের চাইতে ব্যয় বেশি তাদের দরকার হলেই তিনি তিন চার হাজার টাকা অপব্যয় করার জন্য ধার দিতেন শতকরা বারো টাকা সুদে।

সে শহরে আর-একটি ভদ্রলোক ছিলেন, যিনি জাতে সুবর্ণবণিক ও ধর্মে খ্রীস্টান। তাঁর স্ত্রী তাঁর ঘর আলো করে থাকত, আর তার নাম ছিল—’মাই ডিয়ার’। তাঁর কোনো ostensible means of livelihood ছিল না, অথচ টাকার কোনো অভাব ছিল না। ছোটো ছেলের কৌতূহলের অন্ত নেই—তাই আমি মাই ডিয়ারের স্বামীকে একদিন জিজ্ঞেস করি যে, শ্রীযুক্ত কেনারাম মুখুজ্যে এত টাকা করলেন কি করে?— তিনি বললেন যে, টাকা করা একটা আলাদা বিদ্যে। যে জানে, সে বিনে পয়সায় দেদার পয়সা করতে পারে। পরে শুনেছি, তিনি আগে গভর্নমেন্টের চাকরি করতেন, কিন্তু অফিসে self-help এর বিদ্যের এতটা বেপরোয়াভাবে চর্চা করেছিলেন যে সরকার তাঁকে কর্মচ্যুত করতে বাধ্য হন; জেলে দেন নি পাদরি সাহেবের খাতিরে। তিনি ছিলেন প্রগতির একটি উপসর্গ। কি হিসেবে, তা পরে বলব।

কেনারামবাবু বোধ হয় কখনো ইস্কুলে পড়েন নি। তিনি ইংরেজি জানতেন কি না, বলতে পারি না। যদিও জানতেন তো সে নামমাত্র। এ ধারণা আমার কোত্থেকে হল তা বলছি।

মুখুজ্যে-গৃহিণীর একটি ছোটোখাটো operation হবার কথা ছিল। ছুরি চালাবেন একটি লালমুখো গোরা ডাক্তার। Operation এর ফলাফল জানতে আমরা তাঁর বাড়ি উপস্থিত হয়ে দেখি মুখুজ্যে মশায় বারান্দায় পাগলের মতো ছুটোছুটি করছেন ও বলছেন ‘হরিবোল’, ‘হরিবোল’। আমরা এ কথা শুনে বুঝলুম যে, মুখুজ্যে-গিন্নির কর্ম সাবাড় হয়েছে।

তারপর তাঁর একটি আশ্রিত আত্মীয় বললেন যে, operation খুব ভালোয় ভালোয় হয়ে গিয়েছে। আমরা সেই কথা শুনে জিজ্ঞেস করলুম যে, মুখুজ্যে মশায় তবে ‘হরিবোল’ ‘হরিবোল’ এই মারাত্মক ধ্বনি করছেন কেন? তিনি হেসে বললেন, ইংরেজি বলছেন। কাটাকুটি ব্যাপারটা যে ‘horrible’-তাই বলতে চেষ্টা করছেন।

এর থেকেই তাঁর ইংরেজি বিদ্যের বহর বুঝতে পারবেন। তিনি যে আমাদের প্রগতিকে মনে মনে গ্রাহ্য করেছিলেন, সে ইংরেজি পড়ে নয়, লোকচরিত্র দেখে-শুনে। তাঁর মতামত এখন উল্লেখ করছি।

আমার যখন বয়েস বছর বারো তখন কেনারামবাবু আমাকে একদিন বলেন যে, “আমাদের এ দেশে উন্নতি কোন্ জিনিসে এনেছে জান?”

“আমি বললুম, “না।

তিনি বললেন, “ব্রাণ্ডি। ব্রাণ্ডি না খেলে মুরগি খাওয়া যায় না, আর মুরগির পিঠপিঠ আসে আর-সব প্রগতি। ব্রাণ্ডি পান করলে নেশা হয়, অর্থাৎ কাণ্ডজ্ঞান লুপ্ত হয়। তখন মুরগি নির্ভয়ে খাওয়া যায়। আর সেই সঙ্গে হিন্দু-মুসলমানের জাতিভেদ থাকে না। মুরগি খেতে হলেই মুসলমানের হাতে খেতে হয়। তার পরেই স্ত্রী-শিক্ষার প্রয়োজন হয়। কেননা অশিক্ষিত স্ত্রীলোকেরা ওরূপ পান-ভোজনে মহা আপত্তি করে; শিক্ষিত হলে করে না। আর স্ত্রী-শিক্ষার পিঠপিঠ আসে স্ত্রী-স্বাধীনতা। তারা লেখাপড়া শিখবে অথচ অন্দরমহলে আটক থাকবে—এ হতেই পারে না। এর থেকেই দেখতে পাচ্ছ, প্রগতির মূল হচ্ছে ব্রাণ্ডি, ইংরেজি শিক্ষা নয়। ইংরেজি শেখা শক্ত, কিন্তু ব্রাণ্ডি গেলা খুব সহজ। এ বিষয়ে অশিক্ষিত-পটুত্ব কি লোকের দেখ নি?—এই কারণে আমি ব্রাণ্ডি- খোরদের উৎসাহ দিই। ঐ নেশার পথই হচ্ছে যথার্থ প্রগতির পথ; যদিও আমি নিজে মদও খাই নে, মাংসও খাই নে।”

খ্রীস্টান ভদ্রলোকটি এঁর সাহায্য করতেন, কারণ তাঁর ওখানে গেলেই তিনি চায়ের সঙ্গে মুরগির ডিম অর্থাৎ প্রগতির ডিম সকলকেই খাওয়াতেন।

পূর্বে বলেছি, মুখুজ্যে মহাশয়দ্বয়ের ছবি আঁকবার যোগ্য নয়। এঁদের কেউই রূপে শ্রীকৃষ্ণ বা মহাদেব ছিলেন না। দুজনেই রঙ ও রূপে ছিলের আমাদের মতোই সাধারণ বাঙালি। শুধু বাঞ্ছারামবাবুর কোনো অঙ্গ ছিল অসাধারণ সংকুচিত, কোনো অঙ্গ আবার তেমনি প্রসারিত। তাঁর চোখ দুটি ছিল অযথা সংকুচিত, আর নাসিকা বেজায় প্রসারিত। আর তাঁর চুল ছিল ঊর্ধ্বমুখী। সে চুলের ভিতর চিরুনি-ব্রুসের প্রবেশ নিষেধ, আর গুম্ফ ঐ একই উপাদানে গঠিত। আর তাঁর উদরের আয়তন ছিল অসাধারণ প্রবৃদ্ধ। লোকে বলত তাঁর পেটের ভিতর একখানা গোটা Webster’s Dictionary বাসা বেঁধেছে। এ রসিকতার অর্থ—তিনি নাকি A থেকে Z পর্যন্ত সমস্ত ইংরেজি শব্দ উদরস্থ করেছেন। এক কথায়, তাঁর চেহারা ছিল ঈষৎ ভীতিপ্রদ।

কিন্তু আমরা ছেলের দল তাঁকে ভয় করতুম না, করতেন আমাদের মাস্টারমশায়রা। কেননা তিনি ছিলেন সেকালের একজন জবরদস্ত স্কুল-ইনস্পেক্টার তিনি পরীক্ষা করতেন আমাদের, কিন্তু আমাদের ভুলভ্রান্তির জন্য শাস্তি দিতেন মাস্টারমশায়দের। কাউকে করতেন বরখাস্ত, কাউকে করতেন জরিমানা। কারণ তাঁর কথা ছিল—ছেলেরা যদি ভুল ইংরেজি লেখে তো জাতির প্রগতি হবে কোত্থেকে?—প্রগতি অর্থে তিনি বুঝতেন—ইংরেজি ভাষার ষত্ব-ণত্বের জ্ঞান। তাঁর তুল্য ইংরেজি যে ইংরেজরাও জানে না, এই ছিল লোকমত।

তাঁর ইংরেজি-জ্ঞানের একটা নমুনা দিই। আমাদের শহরের গভর্নমেন্টের একটি বৃত্তিভোগী স্কুলের সেকেণ্ড ক্লাসের ছাত্রদের তিনি মুখে মুখে পরীক্ষা করছিলেন। সে সময়ে পড়ানো হচ্ছিল Psalm of Life নামক একটি কবিতা। ছেলেদের মুখে psalm, pasalamaয় রূপান্তরিত হয়েছিল। তিনি জিজ্ঞাসা করেন—এ উচ্চারণ তোমাদের কে শিখিয়েছে? ছেলেরা উত্তর করলে—মাস্টারমশায়। বহু ব্যঞ্জনবর্ণ পাশাপাশি থাকলে উহ্য স্বরবর্ণগুলি উচ্চারণের সময় জুড়ে দিতে হবে। সেইজন্য আমরা তিনটি অলিখিত ঠিক ঠিক জায়গায় বসিয়েছি। বাঞ্ছারামবাবু বললেন, তিনটি vowel না জুড়ে দুটি ব্যঞ্জনবর্ণ ছেঁটে দিতে পারতে, তা হলেই তো উচ্চারণ ঠিক হত। এটি মনে রেখো যে, ইংরেজরা লেখে এক, বলে আলাদা, এবং করেও আলাদা। এই হচ্ছে তাদের অভ্যুদয়ের কারণ

এর পর সেকেণ্ড-মাস্টারকে তিনি থার্ড-মাস্টার করে দিলেন। লোকে বলে, সেকেণ্ড-মাস্টার ব্রাহ্ম তাঁর এই শাস্তি হল। মাস্টারমশায় যে ঘোর ব্রাহ্ম ছিলেন সে বিষয়ে সন্দেহ নেই— কেননা তিনি তাঁর মেয়ের বিয়েতে শালগ্রামের বদলে একটি তামাকের ডেলা সাক্ষী রেখে বিবাহকার্য সম্পন্ন করেছিলেন। অপরপক্ষে বাঞ্ছারামবাবু ছিলেন একাধারে ঘোর নাস্তিক এবং হিন্দু। ব্রাহ্মদের তিনি দুচক্ষে দেখতে পারতেন না; কেননা তাঁরা হিন্দুয়ানীর বিরোধী ও ভগবানে বিশ্বাস করেন। ব্রাহ্মধর্ম হচ্ছে ইংরেজি না জানার ফল। তাঁর মতে এ ধর্ম হচ্ছে বৈষ্ণবধর্মের মাসতুতো ভাই।

যাঁরা মনে করেন যে, ইংরেজি না জানলে লোকে সভ্য হয় না, তাঁদের বলি যে, এ কথা যদি সত্য হয় তা হলে বাঞ্ছারামবাবু ছিলেন আমাদের প্রগতির একটি অগ্রদূত।

তিনি মরবার সময়ও ইংরেজি বলতে বলতে মরছেন। ইংরেজি শিক্ষার ফলে তিনি বহুমূত্র রোগে আক্রান্ত হন। ডাক্তাররা বললে যে, রোগের একমাত্র ঔষধ ব্রাপ্তি, ও পথ্য মুরগির মাংস। নিরামিষাশী বাঞ্ছারামবাবু এ ওষুধপত্র সেবনে কিছুতেই রাজি হলেন না। তিনি বললেন, “To be, or not to be, that is the question”। শেক্সপিয়ারের এ প্রশ্নের উত্তর তিনি নিজেই দিয়েছেন। তাঁর কথা হচ্ছে—”We are such stuff as dreams are made on, and our little life is rounded with a sleep.”

তারপর তাঁর যখন আসন্নকাল উপস্থিত হল, তখন তাঁর ইংরেজিনবিশ উকিল ডাক্তার বন্ধুরা সব বাড়িতে উপস্থিত হন। বড়ো ডাক্তারবাবু এসে দেখলেন, সকলের চোখ দিয়ে জল পড়ছে। তিনি রোগীর নাড়ী টিপে বললেন, “My eyeballs burn and throb, but have no tears”; এ কথা শুনে মুমূর্ষু রোগী বললেন, “Long Live Byron”।

এর পরেই তিনি চিরনিদ্রায় মগ্ন হলেন।

এখন আমরা যখন প্রগতির উল্টোরথ টানতে বাধ্য হব, তখন পূর্বপ্রগতির কোন্ ধারা বজায় থাকবে? কেনারামবাবুর অনুমত পানভোজন? না, বাঞ্ছারামবাবুর অভিমত ইংরেজি ভাষা?— যে ভাষার লেখার সঙ্গে বলা মেলে না, আর বলার সঙ্গে করা মেলে না।


© 2024 পুরনো বই