“কি বললি? বড়োবাবু ডাকছেন?”
“না, তিনি ডেকেছেন।”
“তুই দেখছি হেঁয়ালিতে কথা বলছিস। ডাকছেন আর ডেকেছেন, এ দুয়ের ভিতর তফাতটা কি?”
“বড়োবাবু বাড়িতে নেই, তিনি ডাকবেন কি করে? তিনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবার সময় আমাকে বলে গেছেন আপনাকে একবার ডেকে দিতে।”
“বড়োবাবু আজ আফিসে যান নি?”
“আজ আফিসের ছুটি।”
“কিসের ছুটি?”
“ঈদ্-উল-ফিতরের।”
“তবে আমি এখন গিয়ে কার সঙ্গে দেখা করব, কার সঙ্গে কথা বলব?”
“বড়োবাবু একটি নতুন চীজ নিয়ে এসেছেন, আপনাকে তার হেফাজত করতে হবে।”
“এই মাসখানেক আগেই বড়োবাবু একটি বনমানুষ নিয়ে এসেছিলেন, তারও হেফাজত আমাকে করতে হয়েছিল। আমি তাকে দেদার দুধ ও কলা খাওয়ালুম। তার ফলে সে আমাশা হয়ে মারা গেল। মেজোবাবু বললেন, ‘বনমানুষটি তার স্ত্রীর অভাবে বিরহে প্রাণত্যাগ করলে।’ ছোটোবাবু বললেন, ‘এই হচ্ছে তোমাদের পূর্বপুরুষ।’ আমি তাকে দেখে কিন্তু কিছুতেই আমার প্রপিতামহ বলে চিনতে পারি নি। ছোটোবাবু বললেন, “ডারুইন পড় নি তো চিনবে কি করে?” ছোটোবাবু সে বনমানুষের প্রকাণ্ড চওড়া মুখ নানা যন্ত্রপাতি দিয়ে মাপতে আরম্ভ করেছিলেন। সে মারা গেলে তিনি কেঁদেই ফেললেন। এবার আবার বড়োবাবু কি নিয়ে এলেন-মৎস্যনারী? তা যদি হয় তো একটা প্রকাণ্ড জালায় জল ভরে তাকে ডুবিয়ে রাখলেই হবে।”
“না, না, মৎস্যনারী নয়।”
“তবে কি বৈদ্যনাথের পাঁচ-পেয়ে গোরু? তা হলে গোয়ালে তাকে বেঁধে খোল- বিছালি দিয়ে একটা জাব দিলেই হবে।”
“তাও নয়। আপনি কিছুতেই আন্দাজ করতে পারবেন না। একবার এসেই দেখুন-না।”
একটু পরে হল-ঘরে গিয়ে দেখি একটি পরম সুন্দর সন্ন্যাসী দাঁড়িয়ে রয়েছেন। ছ ফুট লম্বা, গৌরবর্ণ, বিশাল চোখ, খাঁড়ার মতো নাক, আর শরীর অতি বলিষ্ঠ। আমি ঘরে ঢুকেই বললুম, “গোড় লাগি মহারাজ।”
“আমি বাঙালি। বাঙলাতেই কথা বলুন।”
“আমাকে হুকুম করুন এখন কি করতে হবে।”
“এ ঘরের প্রতি দেওয়ালে একটা করে বিরাট আয়না টাঙানো আছে। এ ঘর লোককে দেখাবার জন্য, বাস করবার জন্যে নয়। যদি কোনো ছোটো ঘর থাকে তো সেখানে আমার আস্তানা গাড়ো।”
আমি তাঁকে পাশের এক ছোটো ঘরে নিয়ে গিয়ে একটি গালচের উপর বসতে দিলুম। তার পর তাঁকে জিজ্ঞেস করলুম, “আপনি কতদিন সন্ন্যাস অবলম্বন করেছেন?”
“পূর্বাশ্রমের কথা আমাদের বলতে নেই। যেদিন বিরজা হোম করে সন্ন্যাসে দীক্ষিত হয়েছি, সেইদিনই পূর্বজীবন পুড়িয়ে ছাই করে ফেলেছি। কবে সন্ন্যাস অবলম্বন করেছি সে কথা বললেই আপনি জিজ্ঞাসা করবেন, তার পূর্বে আমি কি ছিলুম, কি করতুম। আপনার দেখছি আমার গার্হস্থ্য জীবন সম্বন্ধেই কৌতূহল বেশি। একটা সিগারেট দিন।”
“আপনি সিগারেট খান?”
“গাঁজা আমি খাই নে। গাঁজার কল্কে অবশ্য সঙ্গে আছে। সিগারেটটি ধরিয়ে গাঁজার কল্কের ভিতর দিয়ে প্রাণপণে টানি।”
“মহারাজের সেবার কি ব্যবস্থা করব?”
“আমরা একাহারী। সূর্যাস্তের পর খানকতক আটার রুটি আর কিঞ্চিৎ অড়হরের ডাল হলেই আমার আহার হয়ে যাবে।”
“আর ঘি?”
“সে ঐ ডালের মধ্যেই দেবে। আর তা নইলে সেরখানেক দুধ। দিনের বেলা হয় আমি ঘরে বসে পূজাপাঠ করব, না হয় তো কলকাতা শহরটা ঘুরে ঘুরে দেখব।”
“আপনার শহর দেখবার শখ আছে?”
“মানুষে তার কাম ক্রোধ লোভ ও মোহ চরিতার্থ করবার জন্যে যে-সব বিরাট শহর তৈরি করেছে তা অবশ্য দ্রষ্টব্য।”
“দেশময় ঘুরে ঘুরে বেড়িয়ে ঘুরে বেড়ানোই আপনার অভ্যাস হয়ে গেছে।”
“আপনি কি চান যে আমি আসনসিদ্ধ যোগী হই? এক হিমালয়ের গুহা ছাড়া আর কোথাও আমরা আসনসিদ্ধ হই নে।”
“ইচ্ছে করলেই তো ভারতবর্ষের সমভূমিতেও তা হতে পারেন।”
“কি করে?”
“একটি আশ্রম করে।”
“আপনার দেখছি গৃহ এবং গার্হস্থ্য জীবন ছাড়া আর কিছুই পছন্দ হয় না।”
“কিরকম?”
“আশ্রম তো এক রকম গার্হস্থ্য জীবন। আর আমি আশ্রম করলে সেখানে আমার ভক্ত জুটবে কারা? আমি তো মানুষকে অতিমানুষ করবার কোনো উপায় জানি নে। এবং রাম-শ্যাম-যদুকে মুনিঋষি বানাবার বৃথা চেষ্টাও করি নে।”
“আমি বলছি আপনি আশ্রম করলে সেখানে শিষ্য ঢের জুটবে।”
“শিষ্য যে জুটবে তা জানি। আর শিষ্য যে-কজন জুটবে সে ঐ শিষ্যাদের টানেই। আশ্রম নামক গার্হস্থ্য জীবনে স্ত্রী-পুরুষের পরস্পর মিলন কড়া বিধি-নিষেধের দ্বারা শাসিত নয়। আমি কামিনীকাঞ্চন ত্যাগ করেছি। আশ্রমের আবশ্যকীয় কাঞ্চনের জন্য কোনো ভাবনা নেই। কিন্তু কামিনী-পরিবৃত হয়ে আমি থাকতে চাই নে।”
“এমন সময় সেজোবাবু ঘরে প্রবেশ করলেন। লম্বা ছিপছিপে ছোকরা, ছেলেবেলা থেকে স্পোর্টসের চর্চা করে শরীরের চামড়া সব দড়ি পাকিয়ে গেছে। দেখতে মোটেই সুদৃশ্য নয়। তিনি এসেই বললেন, “মহারাজ, আপনার শরীর এরকম চমৎকার হল কি করে?”
“যোগ অভ্যাস করে। এর জন্যে হঠযোগেরও চর্চা করা চাই?”
“আমাকে সে-সব শিখিয়ে দিতে পারেন?”
“মোটামুটি ভাবে পারি। ইংরেজিতে যাকে বলে ground exercise—যথা ডন, বৈঠক, কুচিমোড়া ভাঙা, শরীরকে আকাশে তুলে দুহাত মাটিতে রেখে হাঁটা ইত্যাদি। এ-সব আপনি অবশ্য করেছেন। এর আসল ব্যাপার হচ্ছে প্রাণায়াম করা, ইংরেজিতে যাকে বলে breathing exercise.”
“আপনি আমাকে প্রাণায়াম শেখাতে পারেন?”
“তার জন্যে একটু সময় লাগবে। আমি এ বাড়িতে কদিন থাকব তা জানি নে। যদি কিছুদিন থাকি তো শেষরাত্তিরে আমার কাছে আসবেন, আমি ইড়া-পিঙ্গলাকে আত্মবশ করতে আপনাকে শেখাব, যদি না আপনি দু-চার দিনের মধ্যেই রক্তবমি করতে আরম্ভ করেন। যৌগিক প্রাণায়াম সকলের সহ্য হয় না। বিশেষত যারা মদ্যপান করে তাদের তো নয়ই। আশা করি আপনি করেন না।
“আমি করি কালেভদ্রে, কোনো ম্যাচ জেতবার পর।”
“তা হলে দেখছি আপনাকে নিয়ে খাটতে হবে। প্রথমত, পেটের নাড়ি ধোয়াবার কায়দা আপনাকে শেখাতে হবে।”
সন্ন্যাসীঠাকুরের এই-সব প্রক্রিয়ার কথা শুনে সেজোবাবুর মুখ চুন হয়ে গেল। তিনি বললেন, “একটু ভেবে পরে বলব।”
সেজোবাবু চলে যাবার পরেই একটি অতি খর্বাকৃতি যুবক ঘরে এলেন। তাঁর মাথাটা প্রকাণ্ড, চোখ দুটিও তাই এবং নাকটি খাঁদা। আমি বললুম, “ঠাকুরমশায়, ইনি হচ্ছেন হিদেরাম মাস্টার। লোকে ভুল করে একে হাঁদারাম বলে, তাই আমরা এঁর নাম দিয়েছি খুদিরাম। ইনি ছোটোবাবুর মাস্টার।”
“উপাধি কি?”
“জানি নে।”
“ব্রাহ্মণ?”
“ব্রাহ্মণ না হলেও ইনি বামন।”
সন্ন্যাসীঠাকুর এ কথা শুনে ঈষৎহাস্য কারলেন। কারণ মাস্টারমশায় উঁচুতে বোধ হয় তাঁর কোমর পর্যন্ত হবেন। তার পর বললেন, “ছোটোবাবুকে ইনি কী পড়ান?”
“কি করে ভারত-উদ্ধার করতে হবে তারই সব উপদেশ দেন।—যাকে কালিদাস বলেছেন, ‘প্রাংশুলভ্য ফলে লোভাদুদ্বাহুরিব বামনঃ।”
“এঁর শিক্ষকতায় ছোটোবাবু বোধ হয় ভারত-উদ্ধারের পথে অনেকটা এগিয়েছে।”
“সে-সব কথা এঁর মুখেই শুনতে পাবেন।”
এরপর খুদিরাম মাস্টার বললেন, “আপনি তো অনেক কৃচ্ছ্রসাধন করেছেন।”
গেরস্তের চাইতে কিছু বেশি নয়। জীবনধারণ করাটাই কৃচ্ছ্রসাধন। এই দেখো- না, এ বাড়ির বাবুদের অতুল ঈশ্বর্য। তা হলেও বড়োবাবু আজ ছুটির দিনেও পাট কিনতে বেরিয়েছেন। আর হপ্তার বাকি কটা দিন তিনি একটা উঁচু টুলে বসে, একটা উঁচু ডেস্কের উপর উপুড় হয়ে প’ড়ে দশটা-পাঁচটা হিসেব লেখেন। শরীরের আরামভক্ত হলে এ কাজ কি করা যায়?”
“আপনি তো সংসার ত্যাগ করেছেন, আপনার স্ত্রীপুত্র কেউ নেই। তা হলেও বৃথা ঘুরে বেড়িয়ে জীবন কাটান কেন?”
“আপনি আমাকে কি করতে বলেন?”
“আপনারাই হচ্ছেন ভারত-উদ্ধার করবার উপযুক্ত লোক।”
“ভারত-উদ্ধারের অর্থ কি?”
“বর্তমান শাসনপদ্ধতি ধ্বংস করে দেশে নতুন রাজ্য স্থাপন করা।”
“আমরা যারা সংসার ত্যাগ করেছি, আমরা কে রাজা, কে প্রজা তা জানিও নে, জানতে চাইও নে। আমরা কারো প্রজা নই, সুতরাং, রাজা-রাজড়ার ধার ধারি নে। আমরা সম্পূর্ণ স্বাধীন।”
“আমরাও তো স্বাধীন হবার জন্যই চেষ্টা করছি।”
“আপনারা যা পাবার চেষ্টা করেছেন সে হচ্ছে বিলিতি স্বাধীনতা। এ দেশে আমরা স্বাধীনতা বলতে অন্য জিনিস বুঝি। দেখুন মশায়, মনে ভাববেন না যে আমি ভয়ে আপনার চেলা হতে অস্বীকৃত হচ্ছি। জেলকে আমরা ডরাই নে। আহার তো আমরা করি শুধু প্রাণধারণের জন্যে। সেরকম আহার জেলেও মেলে। একখানা ইঁট মাথায় দিয়ে শোওয়া, তাতেও আমরা অভ্যস্ত। আর গলায় ফাঁসি তো আমরা সকলে পরেই রয়েছি; কখন ফাঁসিটা কষে যাবে তা কেউ বলতে পারে না। মৃত্যু একটা accident। আপনাদের স্বাধীনতার ব্রত নিলে আমাকে আপনাদের অধীনতা স্বীকার করতে হবে। আমি আপনার শিষ্য হবার উপযুক্ত লোক নই।”
এরপর মাস্টারমশায় সন্ন্যাসীঠাকুরকে প্রণাম করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। পাঁচ মিনিট পর স্বয়ং ছোটোবাবু এসে হাজির হলেন। এসেই সন্ন্যাসীঠাকুরকে বললেন, “আপনি আছেন কিরকম? চেহারা দেখে তো মনে হচ্ছে কিছুই বদল হয় নি।”
“আপনি আমাকে চেনেন নাকি?”
“অবশ্য। আপনি তো আমাদের দলের একজন চাঁই।”
“আপনি ভুল করেছেন। আপনি যাকে দেখেছেন সে আমি নই, আমার দাদা।”
“আমি তো অন্ধ হই নি। আপনি আমাদের গুরুর ভাই হতে পারেন, কিন্তু দু ভাই তো দেখতে ঠিক এক রকম হয় না।”
“আমরা উভয়ে যমজ ভ্রাতা। আমাদের দু জনকে একই ব্যক্তি বলে বহুলোকে ভুল করে এবং তার জন্যে আমাকে বার বার বিপদে পড়তে হয়। দাদাও সন্ন্যাসী, কিন্তু তিনি হচ্ছেন পোলিটিকাল সন্ন্যাসী। এবং তাঁর কর্মের জন্যে আমাকে মধ্যে মধ্যে জেলে যেতে হয়।”
“এখান থেকেও হয়তো আবার আপনাকে জেলে যেতে হবে। পুলিসের গোয়েন্দারা এ বাড়ির উপর বারোমাস নজর রাখে মাস্টারমশায়ের কোন্ শিষ্য এখানে আসে যায় তাই দেখবার জন্যে।”
“আমি তো মাস্টারমশায়ের শিষ্য নই।”
“আপনি মাস্টারমশায়ের গুরু, অর্থাৎ আপনার দাদা।”
“পুলিস ধরে নিয়ে যায় তো তাদের সঙ্গে যাব। আমাকে সেখান থেকে উদ্ধার করবেন আপনার এ মাস্টারমশায়। কারণ উনি হচ্ছেন পুলিসের বর্ণচোরা গোয়েন্দা। ওঁর সঙ্গে পুলিসের খুব দহরম-মহরম। উনি ধরিয়ে দিতেও যেমন ওস্তাদ, ছাড়িয়ে নিতেও তেমনি।”
“আপনি ইতিমধ্যে বিবাহ করেছেন?”
“না।”
“তা হলে চটপট একটা করে ফেলুন। কারণ পুলিস জানে যে বিয়ে করলে অধিকাংশ লোকের বিপ্লবের নেশা ছুটে যায়।”
“আমি রাজি আছি। কিন্তু কোন্ বাপ-মা সন্ন্যাসীকে মেয়ে দেবে? আর কোন্ মেয়েই-বা আমাকে বিয়ে করতে রাজি হবে?”
“মেয়ে মাত্রই। কারণ আপনার মতো সুন্দর পুরুষ লাখে একটি মেলে না।”
“তা যেন হল। কিন্তু আমি তো আমার সন্ন্যাস ত্যাগ করব না। আমাকে বিয়ে করলে তাকেও সঙ্গে সঙ্গে সন্ন্যাসিনী হতে হবে। অর্থাৎ তাকে আমার ভৈরবী হতে হবে।”
“দেখি এরকম একটি মেয়ে জোগাড় করতে পারি কি না।”
“ইতিমধ্যে ছোটোবাবু সন্ন্যাসীঠাকুরের কানে কি বললেন তা আমি শুনতে পাই নি। তারপর ছোটোবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “কটা বেজেছে?”
“সাড়ে নটা হবে।”
“তবে এখন আমি যাই, দশটায় ফের আসব।”
“আমিও এই আধঘণ্টা ব্যাপারটা কিরকম হবে ভেবে দেখি।” পরে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে সন্ন্যাসীঠাকুর বললেন, “আর-একটা সিগারেট দিন তো।” আমি একটি সিগারেট দিলে তিনি সেটি ধরিয়ে বললেন, “ভাবনা হচ্ছে এই কারণে যে, আমার ভাই আবার আমার স্ত্রীকে কেড়ে না নেন। ও মেয়েটি তো আমাদের দুজনের প্রভেদ বুঝতে পারবে না। তিনি তাঁর দলের একটি কৃষ্ণবিষ্ণু হতে পারেন, যদি কৃষ্ণগিরিতে মত্ত হয়ে না থাকতেন।”
এর পরে সন্ন্যাসীঠাকুর সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে ধ্যানমগ্ন হয়ে গেলেন।
ঠিক দশটার সময় ছোটোবাবু মেজোবাবুকে সঙ্গে করে এসে উপস্থিত হলেন। মেজোবাবু বললেন, “আমি একটি বাইজিকে জানি, সে চমৎকার গান করে, আর অপূর্ব কথকী নাচ নাচে। কিন্তু সে মনস্থির করেছে যে সে আর মা-বোনের ব্যবসা করবে না; সন্ন্যাসিনী হবার দিকে তার ঝোঁক। আপনি চান তো আমি আপনাকে বিয়ে করতে তাকে রাজি করতে পারি।”
“আমার কোনো আপত্তি নেই, যদি সে স্বেচ্ছায় আমাকে বরণ করে। সে শুনছি চমৎকার গান করে। বোধ হয় টপ্পা ও ঠুংরি। আমার হাতে পড়লে তাকে ধ্রুপদ গাইতে শেখাব। আর সে যদি সত্যিই সন্ন্যাসিনী হয়, তা হলে তাকে প্রথমে এই ধ্রুপদটি শেখাব : বাওরে কি সঙ্গ সাথ, বাওরে সি ভই মৈ।”
“সন্ন্যাসীঠাকুর, আপনি কি গাইতেও পারেন?”
“আমি গাই আপনাদের সুমুখে নয়, স্বসম্প্রদায়ের কাছে। আর-একটি কথা। আপনি আমাকে বরপণ কি দেবেন?”
“আপনি বরপণও নেবেন?”
“যখন কামিনী নিচ্ছি, তখন কাঞ্চন-বা ছাড়ব কেন?”
এ কথায় মেজোবাবু একটু ইতস্তত করেছেন দেখে ছোটোবাবু, বললেন, “এঁকে অন্তত হাজার টাকা দিতে হবে।”
তারপর তিনি চাকরকে বললেন, “যা, মতিবাবুকে ডেকে নিয়ে আয়।”
মতি এ বাড়ির খাজাঞ্চি। তিনি ডাকবামাত্র এসে উপস্থিত হলেন। চোখ দেখেই বোঝা যায় যে লোকটি অতিশয় ধূর্ত, কিন্তু কথাবার্তায় তিনি অতিশয় বিনয়ী, খোসামুদে বললেও অত্যুক্তি হয় না। মতিবাবু আসতেই ছোটোবাবু তাঁকে বললেন, “যাও, মেজোবাবুর নামে হাজার টাকা খরচ লিখে আমার নামে জমা করো। পাঁচ টাকার নোটে হাজার টাকা তাড়া বেঁধে রাখো, আমি চাইলেই যেন পাই।” তারপর ছোটোবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “মেয়েটি এখন দেখবেন?”
“যদি এখানে এসে থাকে তো এখনি দেখিয়ে দিন।”
ছোটোবাবু মেজোবাবুকে বললেন, “তুমি নীচে গিয়ে রতনকে ডেকে নিয়ে এসো।” পাঁচ মিনিটের মধ্যে রতন এল। মেয়েটি দেখতে পরমাসুন্দরী। সন্ন্যাসী-ঠাকুর তার সঙ্গে ফিফিস্ করে কি কথাবার্তা কইলেন; তার পর মেজো-বাবুকে বললেন, “ও আমাকে বিবাহ করতে রাজি। এমন স্ত্রী তো হঠাৎ পাওয়া যায় না। কথকী নাচে ওস্তাদ— সে তো ছোকরার নাচ, আধা-জিমন্যাস্টিক্। আমার সঙ্গে দেশ-পর্যটন করতে হলে আমার সহধর্মিণীর কখনো কখনো কসরৎও করতে হবে। বেলা পাঁচটায় আমি বিবাহ করব, সে কথা স্থির হয়েছে।”
মেজোবাবু বললেন, “পাঁচটার সময় কি লগ্ন আছে?”
“আমাদের বিয়েতে আবার লগ্ন কি? আপনাদের কোনো পুরুতও ডাকতে হবে না। আমি বিবাহ করব, আমিই পৌরোহিত্য করব। রতন, ঠিক পাঁচটার সময় এখানে এসে হাজির হোয়ো। আমি এই ঘণ্টা তিন-চার শরীরের শুশ্রূষা করব।”
বড়োবাবু বেলা বারোটার সময় বাড়ি ফিরে এসে জিজ্ঞেস করলেন, “সন্ন্যাসীঠাকুর কোথায়?”
“তিনি এখন ঘরের দুয়োর দিয়ে হঠযোগ অভ্যাস করছেন।”
তার পর আমরা তাঁকে বেলা পাঁচটার সময় সন্ন্যাসীঠাকুরের অদ্ভুত বিবাহের আদ্যোপান্ত সব কথা বললুম। তিনি একটু হেসে বললেন, “উনি যে একটি চীজ তা আমি দেখেই বুঝেছিলুম। সেই জন্যেই তো তাঁকে বাড়ি নিয়ে এলুম।”
“যা হোক, এটি বনমানুষ নয়!”
“এই মানুষ বনে গেলেই বনমানুষ হয়।” বলে বড়োবাবু স্নানাহার করতে গেলেন। বলে গেলেন, তিনি এই বিবাহে যথাসময়ে উপস্থিত থাকবেন।
ঠিক পাঁচটার সময় বিবাহ-সভায় আমরা সকলেই উপস্থিত হলুম।—মায় রতন, মতিবাবু ও খুদিরাম মাস্টার। সন্ন্যাসীঠাকুর এসে রতনের কানে কি মন্ত্র দিলেন। তার পর বললেন, “আমাদের বিবাহ তো হয়ে গেল।” রতন বললে, “গুরুজি মেরা বেয়াদপি মাপ কিজিয়ে। মৈ একঠো গীত বাৎলায়গা। মেজলাবাবু, আপ তানপুরা ছোড়িয়ে।”
মেজবাবু আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “হরিদা, হারমোনিয়ামে সংগত কীজিয়ে। রতন কোমল রেখাব সুর করে একটি গান গাইবে।” রতন বললে, “একঠো তবলচি হোনেসে আচ্ছা হোতো।”
ছোটোবাবু বললেন, “মাস্টারমশায় চমৎকার তবলা বাজান।” খুদিরাম মাস্টার একটি তাঁবার বাঁয়া কোলে করে তবলাতে চাঁটি মারলেন। তারপরে রতন এই গানটি ধরলে : মোরি নয়ি লগন লাগি রে পিয়া তুম সন মোরা সুন্দর সনেহ লাগি ঘড়ি পল ছন দিন। কি চমৎকার তার গলা—যেমন ভরাট তেমনি মিষ্টি! আমি হারমোনিয়াম মন্দ বাজাই নে। আর খুদিরাম মাস্টার বায়াতবলায় ওস্তাদ। দুহাতেই বোল সমান ওঠে। যখন গান-বাজনা খুব জমেছে তখন দরওয়ান এসে বড়োবাবুকে বললে যে, নীচে পুলিসের সব লোক এসেছে। ছোটোবাবু বললেন, “ও লোককো উপর আনে দেও।”
একটু পরে একটি C. I. D. ইনস্পেক্টরবাবু দুটি ফিরিঙ্গি সার্জেন্ট সঙ্গে করে পিস্তল হাতে ঘরের ভিতর প্রবেশ করলেন। ইনস্পেক্টরবাবু বললেন, “আমাকে মাপ করবেন, এই সন্ন্যাসীটিকে আমরা সঙ্গে নিয়ে যাব।”
সন্ন্যাসীঠাকুর বললেন, “তথাস্তু।”
রতন বললে, “আমি সঙ্গে যাব। আমি জেলও ভয় করি নে, ফাঁসিও ভয় করি নে।”
সন্ন্যাসীঠাকুর বললেন, “রতন, তোমাকে যেতে হবে না। আমি ঘণ্টা দুয়ের ভিতর না ফিরি তো তোমাকে যোগসূত্রে সব জানাব। যোগসূত্র এক রকম Spiritual wireless। আমার সেই যমজ ভ্রাতা হয়তো আবার কিছু দুষ্কর্ম করেছে, তাই পুলিস ভুল করে আমাকে নিয়ে টানাটানি করছে। এই প্রথম নয়, আমাকে আগেও তারা বহুবার এইরকম গ্রেপ্তার করেছে।’
মাস্টারমশায় বললেন, “আপনার কোনো ভয় নেই, আমি ঠিক আপনাকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসব।’
ছোটোবাবু বললেন, “আপনার বরপণের টাকাটা কি হল?”
“সে টাকাটা মাস্টারমশায়কে দিয়ে দেবেন, তার চমৎকার বাজানোর পুরস্কার স্বরূপ।”
তার পর সন্ন্যাসীঠাকুর আস্তে আস্তে পুলিসের সঙ্গে চলে গেলেন। যেতে যেতে বললেন, “আমার হাতে আপনারা হাতকা পরান, যাতে আমি ফিরিঙ্গি সার্জেন্টের হাতের পিস্তল কেড়ে নিয়ে আপনাদের উপর গুলি না চালাই। প্রাণভয়ে লোকে সবই করতে পারে।”
যখন সাতটা বাজল তখন রতন বল,ে “তিনি তো ফিরে এলেন না। তবে এখন আমি যাই।”
আর পাঁচ মিনিট পর খুদিরাম মাস্টার টেলিফোন করে বললে, “সন্ন্যাসী-ঠাকুরকে আমি খালাস করেছি। তারপর তিনি অদৃশ্য হয়েছেন তাঁর ভাইটিকে খুঁজে বার করতে। আমি তাঁকে বললুম যে, ‘আপনি তো পালালেন, এখন রতনের কি হবে?’ তিনি বললেন,”সে ভাবনা আপনাকে ভাবতে হবে না’।”
এতক্ষণ আপনাদের যে গল্প বললুম, তা সত্যিই ঘটেছিল, না, আমি দিবা-স্বপ্ন দেখেছিলুম তা হলপ করে বলতে পারি নে। এক-একবার মনে হয় এই যুদ্ধের দিনে এরকম ওলোট-পালোট ব্যাপার সবই ঘটতে পারে। সন্ন্যাসী-ঠাকুরও বিয়ে করতে পারেন, খুদিরাম মাস্টারও দাগী সন্ন্যাসীকে পুলিসের হাত থেকে ছাড়িয়ে নিতে পারেন, রতনও রাস্তায় কোনো জায়গায় তার সঙ্গে গিয়ে জুটতে পারে। আর এও হতে পারে যে, কিছুই ঘটে নি, আমার মাথার ভিতর সব গোলমাল হয়ে গেছে বলে ছুটির দিন বাড়ি বসেই দিবাস্বপ্ন দেখেছি।
চৈত্র ১৩৫০