সূত্রপাত
এ গল্প আমার ঘোষালের মুখে শোনা। এ কথা আগে থাকতেই বলে রাখা ভালো। নইলে লোকে হয়তো ভাববে যে এ গল্প আমিই বানিয়েছি। কারণ ঘোষালের গল্পের যা প্রধান গুণ, স্ফূর্তি—এ গল্পের মধ্যে তার লেশমাত্র নেই। এ গল্প বৈঠকী গল্প নয়, অর্থাৎ রায়মশায়ের বৈঠকখানায় বলা নয়—আমার ঘরে বসে নিরিবিলি একমাত্র আমাকে বলা। কোন্ অবস্থায় –বলছি।
আমি একদিন জনকতক বন্ধুকে আমার বাড়িতে চায়ের নিমন্ত্রণ করি; আমার বন্ধুরা সকলেই সুশিক্ষিত ও গানবাজনার জহুরী। তাঁরা যে গাইয়ে-বাজিয়ে ছিলেন তা অবশ্য নয়; কিন্তু সকলেই সংগীতশাস্ত্রে বিশেষজ্ঞ। এর থেকে মনে ভাববেন না যে, তাঁরা সংস্কৃতভাষায় লিখিত সংগীতশাস্ত্রের সঙ্গে পরিচিত। তাঁরা তাঁদের শাস্ত্রজ্ঞান লাভ করেছেন সেই-সব নিরক্ষর মুসলমান ওস্তাদের কাছ থেকে, যাঁরা সকলেই মিঞা তানসেনের বংশধর, আর এ বিদ্যে যাঁদের খানদানী।
আমি এ চা-পার্টিতে যোগ দিতে ঘোষালকে নিমন্ত্রণ করেছিলুম—উদ্দেশ্য, বন্ধুবান্ধবকে ঘোষালের গান শোনানো। সেদিন সংগীতশাস্ত্রেরই চর্চা হল। ঘোষাল ‘শরীর ভালো নেই’ অজুহাতে গান গাইতে মোটেই রাজি হল না। ঘোষালের এই বেদস্তুর ব্যবহারে আমি একটু আশ্চর্য হয়ে গেলুম। বন্ধুবান্ধবরা চলে গেলে পর ঘোষাল বললে, “আমি গান-বাজনার সায়েন্স জানি নে। জানি শুধু আর্ট। আর আমার বিশ্বাস এ ক্ষেত্রে সায়েন্স আর্ট থেকে বেরিয়েছে—আর্ট সায়েন্স থেকে বেরোয় নি। হার্মোনিয়মের অতিরিক্ত ধ্বনি আছে, অর্থাৎ অতিকোমল অতিতীক্ষ্ণ সুরও অবশ্য আছে। কিন্তু যা গানের প্রাণ, তা হচ্ছে অতীন্দ্রিয় সুর—আর এই অতীন্দ্রিয় সুরের সন্ধান যিনি জানেন তিনিই যথার্থ আর্টিস্ট। এই কারণেই আর্ট যে কী বস্তু, তা বুঝিয়ে বলা যায় না। আর্টের অভিধানও নেই, ব্যাকরণও নেই। সেকেলে শাস্ত্রীরা গড়তেন ব্যাকরণ—অর্থাৎ বিধি – নিষেধের ফর্দ। আর একেলে শাস্ত্রীরা লেখেন আর্টের অভিধান—অর্থাৎ ব্যাখ্যা।”
কথারম্ভ
আমি বললুম, “ঘোষাল, তোমার মতামত দার্শনিক হতে পারে, কিন্তু অবোধ্য। অনেক মাথা ঘামিয়ে বুঝতে হয়।”
ঘোষাল বললে, “আমার যা মনে হল, তাই বললুম। আমার কথা ঝুঁটো কি সাচ্চা সে বিচার আপনারা করবেন। আমি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে যে-সত্যের সাক্ষাৎ পেয়েছি, তাই শুধু বলতে পারি ও বলি।
“এখন সংগীতবিদ্যা সম্বন্ধে আমার অভিজ্ঞতার কথা শুনুন। এ বিষয়ে আমার পটুতা একরকম অশিক্ষিতপটুত্ব। আমি ছেলেবেলা থেকেই গান গাইতুম, কেননা গেয়ে আমি আনন্দ পেতুম; আর শ্রোতারাও শুনে আনন্দিত হতেন। সেকালে আমি কোনোরূপ শিক্ষার ধার ধারতুম না। এ বিষয়ে আমি ছিলুম শ্রুতিধর। একটি গান শোনবামাত্র তমুহূর্তে পাঁচজনকে তা শোনাতে পারতুম। এরই নাম বোধ হয় প্রাক্তন সংস্কার। পৃথিবীতে যে-বস্তু আনন্দঘন— তা স্বপ্রকাশ। ভাষায় এর ব্যাখ্যা করা যায় না। সংগীতের একমাত্র ভাষা হচ্ছে সুর—কথা নয়।
“তার পর আমি যখন প্রব্রজ্যা গ্রহণ করি, তখন কাশীতে একটি বৃদ্ধ পূজারী ব্রাহ্মণের কাছে গান শিক্ষা করি— আমার কণ্ঠস্বরকে আত্মবশে আনবার জন্য। বৃদ্ধ আজীবন শুধু পূজাপাঠ ও সংগীতচর্চাই করেছিলেন। গানের অন্তরে যে কী দিব্যভাব আছে, তার প্রথম পরিচয় পাই এই বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের প্রসাদে।
“তার পর আমি এ বিদ্যা শিক্ষা করি স্বয়ং সরস্বতীর কাছে।”
আমি বললুম, “ঘোষাল, কথা আজ তুমি বেপরোয়া ভাবে বলছ।”
তিনি উত্তর করলেন, “সত্য কারো পরোয়া করে না। আমার আসল শিক্ষাগুরু হচ্ছেন একটি আলোকসামান্য রমণী; আর তাঁর নাম হচ্ছে-বীণাবাই। তিনি বাইজি ছিলেন না। যে অর্থে মীরাবাই বাই, তিনিও সেই অর্থে বাই। তিনি ছিলেন শাপভ্রষ্টা দেবী সরস্বতী। কোথায় ও কি সূত্রে তাঁর সাক্ষাৎ লাভ করি, তা যতদূর সম্ভব সংক্ষেপে বলছি।”
সুরপুর
আমি এ দেশে ও দেশে ঘুরে শেষটায় বুন্দেলখণ্ডের একটি ছোটো রাজার ছোটো রাজধানী—সুরপুরে গিয়ে উপস্থিত হই। আমি একে ব্রাহ্মণ, তার উপর ‘গাবইয়া’ তাই দুদিনেই রাজাবাহাদুরের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠলুম। বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের কাছে শেখা জয়দেবের একটি গান—’ধীর-সমীরে যমুনাতীরে বসতি বনে বনমালী’ আমি রাজাবাহাদুরকে শোনাই। তা শুনে তিনি মহা খুশি হলেন ও তাঁর সভাগায়ক রামকুমার মিশ্রের কাছে গান শিখতে আমাকে আদেশ করলেন। অবশ্য আমার খোরপোষের ব্যবস্থা তিনিই করে দেবেন বললেন।
মিশ্রজি ও অঞ্চলের সর্বপ্রধান গাইয়ে। তিনি করেন যোগ-অভ্যাস আর সংগীতচর্চা। গুরুজি ছিলেন অতি সদাশয় ও মহাপ্রাণ ব্যক্তি। রাজাবাহাদুরের অভিপ্রায়- অনুসারে তিনি আমাকে শিষ্য করতে স্বীকৃত হলেন, এবং আমাকে তাঁর কাছে যেতে অনুরোধ করলেন। আমি তাঁর কাছে উপস্থিত হবামাত্র তিনি বললেন, “প্রথমে তুমি আমার পালিত কন্যা বীণাবাইয়ের কাছে কিছুদিন শিক্ষা করো, তার পর আমি তোমাকে হাতে নেব। বীণাবাই শেষ রাত্তিরে উঠে জপতপ করেন, তার পর বীণা অভ্যাস করেন। সুতরাং প্রতিদিন প্রত্যুষে আমার বাড়িতে হাজির হোয়ো। আমি এ কয় বৎসর ধরে তাঁকে নিজে শিক্ষা দিয়েছি এখন তিনি আমার তুল্য গাইয়ে হয়ে উঠেছেন। সত্য কথা বলতে গেলে, আমার চাইতে তাঁর গলা ঢের বেশি নাজুক ও সুরেলা। সে কণ্ঠ ভগবদ্দত্ত, সাধনালব্ধ নয়। সংগীতশাস্ত্রে তিনি এখন পারদর্শী। সেইজন্য তাঁর গান শাস্ত্রশাসিত নয়। যার ঐশ্বর্য আছে, সে কখনো বিধি-নিষেধের দাস হতে পারে না। এ কথা স্বয়ং শুকদেব বলে গিয়েছেন ভাগবতে। অন্যকে শেখানো তাঁর কাজ নয়, কিন্তু আমার অনুরোধ তিনি রক্ষা করবেন।”
দেবীদর্শন
তার পরদিন আমি প্রত্যুষে রামকুমারের দ্বারস্থ হলুম। একটি দাসী এসে আমাকে তাঁর সংগীতশালায় নিয়ে গেল। সেখানে গিয়ে দেখি, যিনি একটি রাঙ্কব আসনে উপবিষ্ট আছেন, তিনি স্বয়ং সরস্বতী; তন্বী, গৌরী, বিগাঢ়-যৌবনা শ্বেতবসনা। আর তাঁর কোলে একটি বীণা। এ সরস্বতী পাথরে কোঁদা নয়, রক্তমাংসে গড়া। আমার মনে হল এ রমণী বাঙালি। কেননা তাঁর মুখেচোখে ‘নিমক’ ছিল; সংস্কৃতি যাকে বলে লাবণ্য। কোনো বৈষ্ণব কবি এঁর সাক্ষাৎ পেলে বলতেন, ‘ঢল ঢল কাঁচা অঙ্গের লাবণি অবনী বহিয়া যায়’; যে কথা কোনো হিন্দুস্থানী সুন্দরীর সম্বন্ধে বলা যায় না। আমাকে দেখে তিনি প্রথমে একটু অসোয়াস্তি বোধ করতে লাগলেন; যেন কোনো পূর্বস্মৃতি তাঁর মনকে বিচলিত করেছে। মুহূর্তে সে ভাবটা কাটিয়ে নিয়ে তিনি আমাকে হিন্দী ভাষায় প্রশ্ন করলেন, “আপনি ব্ৰাহ্মণ? “
আমি বললুম, “আমি ব্রাহ্মণবংশে জন্মগ্রহণ করেছি।”
এ কথা শুনে তিনি আমাকে নমস্কার করলেন। তার পর বললেন, “আপনি একটি গান করুন, সে গান শুনে আমি বুঝব আপনি সংগীতপ্রাণ কি না।”
আমি একটি তম্বুরা নিয়ে ‘নৈয়া ঝাঁঝরি’ বলে একটি আশাবরীর গান গাইলুম। এ গান আমার পূজারী ঠাকুরের কাছে শেখা। আমি গানটি সেদিন পুরো দরদ দিয়ে গেয়েছিলুম। একে বসন্তকাল, তার উপর উষার আলোক-আর সুমুখে ঐ দিব্যমূর্তি। তাই মনের যত আনন্দ, যত আক্ষেপ আমার কণ্ঠে রূপধারণ করেছিল। মনে হল, আমার গান শুনে তিনিও আনন্দিত হলেন।
তিনি বললেন “আমি গুরুজির আদেশ পালন করব। এর অর্থ এই নয় যে, আমি আপনাকে শিক্ষা দেব। আপনি নিজ চেষ্টায় শিক্ষিত হবেন।”
আমি প্রশ্ন করলুম, “এর অর্থ কি?”
তিনি উত্তর করলেন, “আপনাকে সংগীতসাধনা করতে হবে। একের সাধনায় অপরে সিদ্ধ হতে পারে না। প্রত্যেককেই নিজে সাধনা করতে হয়। আমি শুধু আপনার কানে সংগীতের মন্ত্র দেব। সে মন্ত্রের সাধন আপনাকেই করতে হবে। দেখুন—হাত যন্ত্র বাজায় না, বাজায় প্রাণ; গলা গান গায় না, গায় মন। আর প্রাণকে উদ্বুদ্ধ করা ও মনকে প্রবুদ্ধ করারই নাম সাধনা।”
পরিচয়
পরমুহূর্তেই দেবী মানবী হয়ে উঠলেন, এবং অসংকুচিত চিত্তে আমাকে বললেন,
“আপনি তো বাঙালি?”
“হ্যাঁ।”
“বয়েস?”
“পঁচিশ।”
“শিক্ষিত?”
“ইংরাজি শিক্ষিত।”
“সংস্কৃত?”
“কালিদাসের কবিতা আমাকে অলকায় নিয়ে যায়।”
“এখানে কিজন্য এসেছেন?—বেড়াতে?”
“না। পথই এখন আমার দেশ। আর পথ-চলাই একমাত্র ধর্ম।”
“তার অর্থ?”
“আমি দেশত্যাগ করেছি।”
“স্ত্রীপুত্র সব ফেলে এসেছেন?”
“আমি অবিবাহিত।”
“তা হলেও স্বদেশ-স্বজনের মায়া কাটালেন কি করে?”
“স্বেচ্ছায় কাটাই নি, কাটাতে বাধ্য হয়েছি।”
“কেন?”
“একটি নূতন মায়ার টানে পুরানো মায়ার সব বন্ধন ছিঁড়ে গিয়েছে।”
“সংগীতের মায়া?”
“না। সংগীতপ্রীতি আমার জন্মসুলভ। কিন্তু সংগীতের মায়া কাউকেও উদ্ভ্রান্ত করে না, উন্মার্গগামী করে না।”
এ কথা শুনে তাঁর মুখের উপর কিসের যেন ছায়া ঘনিয়ে এল। তিনি যুগপৎ গম্ভীর ও অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন। তাঁর মুখের ও মনের সে মেঘ কেটে যেতে মিনিট-পাঁচেক লাগল। তার পর তিনি বাঙলায় এই কটি কথা যেন আপন মনে বলে গেলেন—স্বর সংযত ও আত্মবশ, আর মুখশ্রীও নির্বিকার।
বীণাবাইয়ের স্বগতোক্তি
আমিও বাঙালি। ব্রাহ্মণকন্যা এবং শিক্ষিতা। ইংরেজি ও সংস্কৃত উভয় ভাষার সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। আপনাকে আর কোনো প্রশ্ন করব না। আমার কৌতূহল অদম্য নয়। তা ছাড়া জানি, আপনি সে-সব প্রশ্নের উত্তর দেবেন না। আমার কোথায় বাড়ি, আমি কোন্ বৃন্তচ্যুত, সে-সব বিষয়ে আপনিও আশা করি কোনো কথা জিজ্ঞাসা করবেন না। আপনারও নিশ্চয় বৃথা কৌতূহল নেই। এক বিষয়ে আমাদের উভয়ের মিল আছে। আপনাকে ও আমাকে দুজনকেই ‘নইয়া ঝাঁঝরি’তে অর্থাৎ ফুটো নৌকাতে ভবসাগর পাড়ি দিতে হবে। এ যাত্রায় আমাদের একমাত্র সম্বল শুধু সংগীত, আর কাণ্ডারী—’অবাঙ্ মনসোগোচর’ কেউ।
যদিচ আমি আপনার চাইতে বছর-চারেকের ছোটো, তবুও এখন থেকে আপনাকে তুমি বলে সম্বোধন করব। কেননা আপনি আমার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছেন। আমি তোমাকে আমার সংগীতসাধনার সতীর্থ করব। তাতেই হবে তোমার সংগীতশিক্ষা। আর-এক কথা, অপরের সুমুখে আমার সঙ্গে বাঙলায় কখনো কথা কোয়ো না। আর তুমি আমাকে ‘বীণাবাই’ বোলো না। কারণ, ‘বাই” শব্দটা এ দেশে সম্মানসূচক, কিন্তু বাঙালির মুখে জুগুপ্সিত। তাই তুমি আমাকে ‘বীণা বেন’ বোলো। বোধ হয় জান, ‘বেন’ বোহিনের অপভ্রংশ।— না, না, তোমার কাছে আমি ‘বীণা বেন’ও নই—আমি বীণা সেন। এ নামের সার্থকতা এই যে, আমি তানসেনের স্বজাত।
এই কথা বলেই তিনি একটু বক্রহাসি হাসলেন। আমি বুঝলুম, তিনি যথার্থই বাঙালির মেয়ে—প্রকৃতিসরলা ও বুদ্ধিমতী। আর তাঁর আলাপ, নর্মালাপ–অৰ্থাৎ লীলা- চতুর ও সবিভ্রম।
সুরপুর ত্যাগ
তার পর বছরখানেক ধরে বীণাবাই আমার কানে সংগীতমন্ত্র দিলেন— অর্থাৎ তাঁর সংগীতসাধনায় আমাকে দোসর করে নিলেন। আমি হলুম সংগীতসাধক আর তিনি উত্তরসাধিকা। কোনো একটা রাগ তিনি প্রথমে বীণে আলাপ করতেন, পরে কণ্ঠে। আর আমি যথাসাধ্য তাঁর অনুসরণ করতুম। এ শিক্ষা একরকম প্রদীপ থেকে প্রদীপ ধরিয়ে নেওয়া। আমি পূর্বে বলেছি এরকম অপূর্ব গান আমি জীবনে কখনো শুনি নি। আপনি মৃচ্ছকটিক নিশ্চয়ই পড়েছেন। চারুদত্ত ভাব রেভিলের গান শুনে যা বলেছিলেন বীণাবাইয়ের গান সম্বন্ধে তাই বলা যায়—
তং তস্য স্বরসংক্রমং মৃদুগিরঃ শিষ্টঃ চ তন্ত্রীস্বনং
বর্ণানামপি মূর্ছনান্তরগতং তারং বিরামে মৃদুম্।
হেলাসংযমিতং পুনশ্চ ললিতং রাগ দ্বিরুচ্চারিত
যৎ সত্যং বিরতেহপি গীতসময়ে গচ্ছামি শৃণ্বন্নিব।।
সে বৎসরটা ছবি ও গানের লোকে দিবাস্বপ্নের মতো আমার কেটে গেল— কেননা বীণাবাই ছিলেন একাধারে চিত্র ও সংগীত।
তারপর গুরুজি একদিন অকস্মাৎ ইহলোক ত্যাগ করলেন। লোকে বললে, যোগীর যা হল, তা ইচ্ছামৃত্যু; আমরা যাকে বলি sudden heart failure। গুরুজি তাঁর সর্বস্ব বীণাবাইকে দিয়ে গিয়েছিলেন। বীণা বিষয়সম্পত্তি সব গুরুজির ভাই হরিকুমার মিশ্রকে প্রত্যার্পণ করলেন; শুধু রাজকোষে তাঁর নিজের টাকা মজুত ছিল, তাই নিতে রাজি হলেন—গুরুজির ইচ্ছামত কাশীতে একটি সরস্বতীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করবার অভিপ্রায়ে। তিনি আমাকে বললেন, “তোমাকেও আমাদের সঙ্গে যেতে হবে; আমি তোমার উপরে সম্পূর্ণ নির্ভর করি; আর জানই তো কারো না কারো উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করাই হচ্ছে স্ত্রীধর্ম। আমি অবশ্য তাঁর সহযাত্রী হতে স্বীকৃত হলুম। কেননা তাঁর প্রতি আমার ছিল পরাপ্রীতি—নামান্তরে ভক্তি।
কাশীবাস
কাশীতে আমাদের সঙ্গী ছিলেন বসন্তরাও মৃদঙ্গী, হরিকুমারজি (কাকাবাবু), হিম্মত সিং ও ত্রিবেণী সিং-সুরপুরের রাজবাড়ির দুজন বিশ্বস্ত রক্ষী—ও বীণার সেই বুন্দেলখণ্ডী দাসীটি।
সেখানে গিয়ে দেখা গেল যে, একটি সরস্বতীর মূর্তি গড়তে ও মন্দির তৈরি করতে যে টাকা লাগবে বীণাবাইয়ের তা নেই। তখন কাকাবাবু প্রস্তাব করলেন যে, তিনি ও বীণাবাই দুজনে সংগীত-রসিকদের গানবাজনা শুনিয়ে নাজাই টাকা রোজগার করবেন। হরিকুমারজি ছিলেন একজন অসাধারণ ওস্তাদ। তাঁর যন্ত্র রুদ্রবীণা নয়—ক্ষুদ্র সেতার। তিনি করেছিলেন—গানের নয়—গতের সাধনা এবং এ বিষয়ে তাঁর ছিল অসাধারণ কৃতিত্ব। গুরুজি বলতেন—ভাইসাহেব সংগীতের প্রাণের সন্ধান করেন নি, কিন্তু তার বহিরঙ্গ সম্পূর্ণ আয়ত্ত করেছেন। তাই তাঁর সংগীতে শক্তি আছে, শ্ৰী নেই; তান আছে, প্রাণ নেই। যাদৃশী ভাবনা যস্য সিদ্ধির্ভবতি তাদৃশী। ওস্তাদমহলে তাঁর পায়ে সকলেই নিজের মাথার পাগড়ি রেখে দিত।
ঠিক হল—তাঁরা কারো বাড়ি গাইতে বাজাতে যাবে না। লোকে তাঁদের যথেষ্ট দক্ষিণা দিয়ে তাঁদের বাড়ি এসে বীণার গান ও ভাইসাহেবের সেতার শুনে যাবে। বীণাবাই হপ্তায় একদিন, শুধু রবিবারে, দর্শন দেবেন। কিন্তু এ ব্যবসা খুলতে হবে কাশীতে নয়-কলকাতায়; কেননা বাঙালিরা সংগীতের জন্য মেহনত করে না, কিন্তু পয়সা খরচ করে। বসন্তরাও কলকাতায় গিয়ে একটি সরু গলির ভিতর একটি পুরোনো প্রাসাদ ভাড়া নিলেন, যার সংলগ্ন কতকগুলো একতলা ছোটো ছোটো কামরা ছিল; বোধ হয় সেকেলে কোনো ধনী ব্যক্তির আমলাদের থাকবার ঘর। আমরা সদলবলে সেই বাড়িতে এসে আড্ডা গাড়লুম ও ব্যবসা খুললুম। পয়সা তো দেদার আসতে লাগল। শ্রোতারা হল দু’দল—অর্থাৎ যারা সংগীতের স’ও জানে না, অথচ সংগীতের মুরুব্বি; আর অপর দল—যারা সেতার পিড়িং পিড়িং করতে পারে আর শাস্ত্রের বুলি আওড়ায়। মুরুব্বিরা মুগ্ধ হত বীণার গান শুনে না হোক, ছবি দেখে; আর গুণধররা অবাক হত সেতারীর তরল অঙ্গুলির বিচিত্র লীলা দেখে। তিনি যার সাধনা করেছিলেন—সে সেতারের হঠযোগ
বীণার যাত্রাভঙ্গ
মাসখানেক পরে একদিন রবিবার সন্ধেয় আমরা পধারীর দল আসরে বসে আছি, আর বীণাদেবী আমাদের মধ্যে নিবাত-নিষ্কম্প প্রদীপের মতো বিরাজ করছেন। একটু দূরে জনকতক গুণী ও ধনী শ্রোতা বসে আছেন। বসন্তরাও তখন মৃদঙ্গে মেঘ ডাকাচ্ছেন, হাতের কলকব্জা সব খেলিয়ে নেবার জন্য। এমন সময় হিম্মত সিং নীচে থেকে উপরে এসে বললে- পাশের বাড়িতে একটি বাবুর ভারি অসুখ, তিনি বলে পাঠিয়েছেন যে মেহেরবানি করে গান-বাজনা যদি বন্ধ করেন তা হলে তিনি একটু ঘুমোতে পারেন। এ কথা শুনে শ্রোতাদের ভিতর থেকে একজন স্থূলকায় ঘোর কৃষ্ণবর্ণ ধনী বলে উঠলেন—”তিনি মরুন আর বাঁচুন, আমাদের আনন্দোৎসব চলবে।” এই নিষ্ঠুর কথা শুনে বীণাদেবী আগুন হয়ে উঠলেন ও আমাকে হুকুম করলেন—”ঘোষাল, তুমারা পাগড়ি উতারো আওর নিচু যাকে পুছকে আও—বাঙালি লোক কেয়া মাঙতা। বাঙলা বোলনেকো তুমারা আদত হ্যায়।” আমি তখনই আমার পাগড়ি বসন্তরাওয়ের হাতে দিয়ে নীচে নেমে গেলুম; আর পাঁচ মিনিটের মধ্যে ফিরে এলুম। বীণাদেবী হুকুম করলেন, “বাঙলামে বোলো, সবকোই সমঝেগা।” আমি বললুম, “প্রার্থনা ভদ্রলোক আপনাকে জানাবেন, কেননা আপনি স্ত্রীলোক— আমাদের উপর তাঁর ভরসা নেই। এই পাশের একতলা বাড়ির ভাড়াটেবাবু নাকি সাংঘাতিক ব্যারামে ভুগছেন। উপরে গান – বাজনা নীচের রোগীর কানে অসহ্য গোলমালের মতো ঠেকছে।”
এ কথা শুনে বীণাদেবী বললেন, “ঘোষাল, তুমি সামনের ফটক দিয়ে যাও, আমি পাশের সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছি।” সেই আমলাবাবুটির সঙ্গে আমিও সেখানে উপস্থিত হলুম, পিঠপিঠ অন্য সিঁড়ি দিয়ে বীণাদেবীও নেমে এলেন। তার পর যা ঘটল, সে অদ্ভুত কাণ্ড; তা গল্পে মধ্যে মধ্যে হয়, জীবনে নিত্য হয় না। কারণ কথার অঘটনঘটনপটীয়সী শক্তি অসীম।
নটবরের নিবেদন
বীণাদেবীকে দেখবামাত্র সেই আমলাবাবুটি “কে, দিদিমণি!” বলে তাঁকে সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত করে তাঁর পায়ের ধুলো নিয়ে কপালে ঠেকালেন ।
বীণাও গদ্গদ কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন, “নটবর চট্টরাজ, কার অসুখ?”
“বড়োবাবুর।”
“কি, দাদার?”
“আজ্ঞে তাঁরই।”
“রোগ কি?”
“ডাক্তাররা তো বলেন, এ রোগে লোক আজ আছে কাল নেই।”
“এখানে কেন এসেছ? বড়োবাবুর চিকিৎসার জন্য? সঙ্গে কে আছে?”
“পুরোনো চাকরবাকর, আমি আর বড়ো-বৌঠাকরুন।”
“বৌঠান কোথায়?”
“এই পাশের ঘরে আছেন।”
বীণা এ কথা শুনে আমাকে বললেন, “ঘোষাল, উপরে যাও ও কাকাবাবুকে বলো শ্রোতা-বাবুদের সব বিদায় করে দিতে—আর তাদের টাকাকড়ি সব ফিরিয়ে দিতে। তুমি যাবে আর আসবে।” আমার মনে হল তিনি দুরন্ত চিত্তচাঞ্চল্য সামলে নেবার জন্য মুহূর্তের জন্য আমাকে সরিয়ে দিলেন। আমি তাঁর আদেশ হরিকুমারজিকে জানিয়ে সেই সরু সিঁড়ি দিয়ে আবার নেমে এলুম। দেখি বীণাদেবী যেখানে ছিলেন সেখানেই দাঁড়িয়ে আছেন চিত্র-পুত্তলিকার মতো। মনে হল—দুঃখে ও লজ্জায় তিনি অভিভূত হয়ে পড়েছেন। আমি আসবামাত্র তিনি বললেন, “চলো বড়োবৌয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আসি— আমার একা যেতে সাহস হচ্ছে না। ভালো কথা, ব্যাপার দেখে ও শুনে তোমার কি মনে হচ্ছে?
“আমার মনে হচ্ছে—নীচে অন্ধকার, উপরে আলেয়ার আলো; নীচে রোগ-শোক, উপরে নাচ-গান। এরই নাম সুবিন্যস্ত সমাজ।”
বীণা এ কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। তারপর বললেন, “যাও নটবর, বৌঠানকে গিয়ে বলো যে, দোতলার ‘বিবিজি’ আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।”
বীণার স্বজন
ঘরে ঢুকতেই চোখে পড়ল, সুমুখে একটি শ্বেতপাথরের প্রতিমা দাঁড়িয়ে আছেন- প্রায় আমার মতো লম্বা; পরনে একখানি লালপেড়ে উজ্জ্বল গরদের শাড়ি, বীণাদেবীর ধাঁচেই সুমুখে কোঁচা ও বাঁ কাঁধে আঁচল দিয়ে পরা। এ মূর্তি জমাট অহংকারের মূর্তি; আর সে অহংকার যেমন দৃপ্ত তেমনি দীপ্ত। বীণাকে দেখে তিনি একটু চমকে উঠলেন। পরমুহূর্তে বীণা যখন তাঁকে প্রণাম করতে অগ্রসর হল, তখন তিনি বললেন, “আমাকে ছুঁয়ো না, কেননা ছুঁলে আবার স্নান করতে হবে।”
বীণা দু পা পিছু হটে বললে, “আমাকে চিনতে পারছ না?”
“না। কে তুমি?”
“বীণা।”
“কোন্ বীণা?”
“তোমার ননদ বীণা।”
“আমার তো কোনো ননদ নেই। সে বীণা মরে গিয়েছে।”
“আমি মুহূর্তের জন্য ভুলে গিয়েছিলুম যে, আমি এখন তোমার কাছে অস্পৃশ্য। বহুকালের অভ্যাসের দোষে প্রণাম করতে উদ্যত হয়েছিলুম। যাক এ-সব কথা। বাড়িতে কার অসুখ?”
“আমার স্বামীর।”
“কি অসুখ?”
“হার্ট ডিসিস।”
‘কেমন আছেন?”
“খানিকক্ষণ আগে বুকে ভয়ংকর ব্যথা ধরেছিল। এখন একটু ভালো। তবে ডাক্তাররা বলেন, angina বড়ো ‘ট্রেচারাস্’।”
“এখানে এসেছ বুঝি বড়োবাবুর চিকিৎসার জন্য?”
“লোকে বলে—শ্মশান পর্যন্ত চিকিৎসা।”
“এ গোয়ালে উঠেছ কেন?”
“চৌরঙ্গিতে বাড়ি ভাড়া করবার সামর্থ্য নেই বলে। এখন বড়োবাবু নিঃস্ব।”
“তোমরা নিঃস্ব! তোমাদের জমিদারি তো একটা খণ্ডরাজ্য।”
“তালুক-মুলুক সব বিক্রি হয়ে গিয়েছে।”
“কিসে?”
“দেনার দায়ে।”
“তোমাদের তো ঋণ ছিল না।”
“যা আগে ছিল না, এমন অনেক জিনিস ইতিমধ্যে হয়েছে।”
“যেমন তোমার ননদের মৃত্যু
“হাঁ; আর তার পিঠপিঠ ঋণ।”
“আমার মৃত্যুর সঙ্গে দাদার ঋণের কি সম্বন্ধ?”
“ভগ্নীর মৃত্যুর পরেই দাদা ঘোর বদান্য হয়ে উঠলেন। বাঙলার যত সদনুষ্ঠানে দু’হাতে দান করতে লাগলেন; আর তার জন্য ঋণ করতে শুরু করলেন। বাঙলায় তো সদনুষ্ঠানের অভাব নেই; আর এ শ্রাদ্ধের অগ্রদানীরও অভাব নেই।
“ঋণ কেন?”
“আমরা তো সা-মহাজনের বংশে জন্মাই নি। তহবিলে মজুত টাকা ছিল না বলে।”
“আচ্ছা বড়োবাবু তো নিঃস্ব হয়েছেন। ছোটোবাবু?”
“তিনি এখন জেলে।”
“খোকা জেলে!”
“ছোটোবাবুর কাছে রিভলবার ছিল বলে সরকার তাকে ইন্টার্ন করেছে; কিন্তু সে ভুল করে। কেননা ছোটোবাবু রিভলভার সংগ্রহ করেছিলেন মাস্টারমশায়ের দেখা পেলে তাঁকে গুলি করবে বলে।”
“তারও কোনো আবশ্যক ছিল না। মাস্টারমশায়কে তাঁর হিন্দুস্থানী চেলার দল অনেকদিন হল গুলি করেছে।”
“কেন, তাদের তিনি কী সর্বনাশ করেছিলেন?”
“কিছু করেন নি, কিন্তু সর্বনাশ করবেন এই ভয়ে।”
“এই ভয়ের কারণ কি?”
“তিনি নাকি আসলে পুলিসের গোয়েন্দা—এই সন্দেহের জন্য। বোধ হয় এ সন্দেহের মূল ভয়। তিনি অতিমানুষ না হলেও অমানুষ ছিলেন না।”
“রাখো রাখো—তাঁর হয়ে ওকালতি! এখন বুঝি ছোটোবাবুকে কে ধরিয়ে দিয়েছে। তিনি তো ছোটোবাবুর কানে বিপ্লবের মন্ত্র দিয়েছিলেন। তিনি আর কিছু না করুন, আমাদের পরিবারে সব দিক থেকেই বিপ্লব ঘটিয়েছেন।—তার পর বীণার কি হল?”
বীণার জেরা
“সে আজও বেঁচে আছে।”
“আর বাইজির ব্যবসা নিয়েছে।”
“হাঁ, তাই।”
“টাকার অভাবে?—তার তো যথেষ্ট টাকা নটবরের জিম্মায় আছে। একখানি পোস্টকার্ড লিখলে পত্রোত্তরে সে তা পেত। আমরা তো জান তার স্ত্রীধন ছোঁব না—মরে গেলেও নয়।”
“তার টাকার অভাব নেই।”
“তবে শখ?”
“ধরে নেও তাই।”
“বলিহারি যাই বীণার শখের! সুন্দরী যুবতী বিধবা ব্রাহ্মণকন্যার চমৎকার ব্যবসা! ধিক্ তার শিক্ষাদীক্ষায়!”
“বীণা বিধবা নয়।”
“এর অর্থ কি?”
“সেনমশায়ের সঙ্গে তার কখনো বিবাহ হয় নি।”
এ কথা শুনে বৌঠাকুরানী আমার প্রতি কটাক্ষ করে জিজ্ঞাসা করলেন, “ইনি কে?”
“আমার গুরু-ভ্রাতা।”
“কিসের গুরু?”
“সংগীতের। গুরুজির মৃত্যুর পর ইনি আমার স্বেচ্ছাসেবক হয়েছেন।”
“অজ্ঞাতকুলশীল?”
“না, ব্রাহ্মণসন্তান। আর শীল?—এঁর দেহমনে পশুত্বের লেশমাত্র নেই।”
এই কথা শুনে সেই ঋজুদেহ পাষাণ-প্রতিমা নুয়ে আমাকে নমস্কার করলেন। আমিও প্রতিনমস্কার করলুম। তার পর বৌঠান বীণাকে বললেন, “তুমি সধবাও নও, বিধবাও নও, পুনর্ভূও নও। তবে তুমি কি?”
বীণার আত্মকথা
বীণা উত্তর করলে, “বলছি। ঘোষাল, তুমিও শোনো।
তার পর ঈষৎ ইতস্তত করে বললেন, “আমি কুমারী।”
“কুমারী!”
“অনাঘ্রাত পুষ্প।”
“তুমি!”
“হাঁ, আমি। মাস্টারমশায়কে কখনো স্পর্শ করি নি, স্বপ্নেও নয়।” “অর্থাৎ তুমি কুলত্যাগ করেছ, কিন্তু জাত বাঁচিয়েছ?”
“ব্রাহ্মণত্বের অহংকার তোমার মতো আমারও আছে; কিন্তু জাতিধর্মে আমার ভক্তিও নেই, ভয়ও নেই।”
“তোমার কথা বিশ্বাস করি নে। তুমি বলতে চাও—তোমার দেহ রক্ত-মাংসে গঠিত নয়?”
“তুমি পাষাণে গড়া হতে পার, কিন্তু আমি শুধু রক্তমাংসে গড়া; জীবন্ত রক্তমাংসেরও রুচি-অরুচি আছে। প্রবৃত্তি যেন স্বাভাবিক অপ্রবৃত্তিও তেমনি স্বাভাবিক। প্রবৃত্তি অবশ্য দমন করা যায়, কিন্তু অপ্রবৃত্তি দমন করবার যদি কোনো সদুপায় থাকে তো আমার জানা নেই।”
এ কথা শোনবার পর বৌঠাকুরানী মুষড়ে গেলেন। তাঁর ভাবান্তর ঘটল; তাঁর মুখ থেকে তাচ্ছিল্যের বজ্র-লেপের মুখোশ যেন খসে পড়ল। তিনি বললেন, “বীণা, তোমার শরীর কেমন আছে?”
“ভালোই।”
“তোমারও না হার্ট একটু বিগড়েছিল?”
“সেটুকু বেগড়ানো এখনো আছে। মাঝে মাঝে palpitation এখনো হয়। ও বস্তু একবার বেগড়ালে মেরামত করা যায় না। এই খানিকক্ষণ আগে বুক বেজায় ধড়াস ধড়াস করছিল; এখন হৃৎপিণ্ডটা আর ততটা লাফাঝাঁপি করেছে না, তাই যাই দাদাকে দেখে আসি। ঘোষাল, তুমি উপরে যাও। আমার দলবলকে এখনই দেশে ফিরে যেতে বলো। আর কাকাবাবুকে বলো যে, তাঁর কাছে আমার যে টাকাকড়ি আছে, তা তাঁকেই দিলুম। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে বাড়ি খালি করা চাই।”
“আচ্ছা” বলে আমি উপরে গেলুম, আর বীণা তাঁর দাদার শোবার ঘরে গেলেন। বৌঠান কোনো বাধা দিলেন না।
দলবল বিদায়
আমি উপরে গিয়ে হরিকুমারজি ওরফে কাকাবাবুকে বীণার ইচ্ছা জানালুম। বীণা তাঁর সমস্ত টাকা হরিকুমারজিকে দান করেছেন শুনে তিনি অবাক হয়ে গেলেন—সে যে অনেক টাকা! তারপর তিনি একটু ভেবে বললেন, বাইজির ইচ্ছা পূর্ণ করব; ঐ টাকা দিয়ে আমি সুরসুরে সরস্বতীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করব। তার পর ঘণ্টাখানেকের মধ্যে তাদের সব জিনিসপত্র নিয়ে হাবড়া স্টেশনে তারা চলে গেল; রেখে গেল শুধু বীণার বীণা, আর তার সুসজ্জিত শোবার ঘরের জিনিসপত্র আমার জিম্মায়। তারপর আমাদের ঠিকা চাকরকে দিয়ে ঝাঁট দিয়ে ঘরদোর সব সাফ-সুরো করে রাখলুম। কারণ জানতুম বীণা দেবী ময়লা দুচক্ষে দেখতে পারেন না—এমন-কি, দেয়ালের কোণে এক টুকরো ঝুলও নয়।
ঠিক সাড়ে নটার সময় নটবর চট্টরাজ উপরে এসে জিজ্ঞাসা করলে, “ঘরদোর তো সব খালি ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন?” আমি বললুম, “চোখেই তো দেখতে পাচ্ছেন।” তিনি বললেন, “বড়োবাবুকে আমরা উপরে নিয়ে আসব। ডাক্তারবাবু তাঁকে নড়বার অনুমতি দিয়েছেন এবং এখনো হাজির আছেন।” আমি জিজ্ঞাসা করলুম, “বড়োবাবু এখন কিরকম আছেন?” নটবর বললে, “ডাক্তারবাবু বলেন, আজকে ফাঁড়া কেটে গেছে। আপনিও আসুন, আমাদের একটু সাহায্য করতে হবে।” আমি বললুম,”চলো।” নটবর বললে, “আমার কাছে দিদিমণির বিস্তর টাকা আছে। দিদিমণি সে টাকা আপনাকে দিতে বলেছেন।”
“আমাকে!”
“হাঁ, আপনাকে। বড়োবাবুর চিকিৎসার খরচ চালাতে। খরচ আমিই দেব, ও তার হিসাব রাখব। টাকাকড়ির ঝক্কি দিদিমণি আর পোয়াতে পারবেন না। তা ছাড়া পৈতৃক ধন ভাইয়ের জন্য ব্যয় হবে—এ তো হবারই কথা। বিশেষত বড়োবাবু দেবতুল্য লোক। বড়োমানুষের ঘরে এমন পুণ্যের শরীর দেখা যায় না। আর দিদিমণির তিনি তো শুধু ভাই নন—উপরন্তু শিক্ষাগুরু। ওঁরা দুজনে অভিন্নহৃদয়।”
আমরা পাঁচজনে ধরাধরি করে খাটসুদ্ধ বড়োবাবুকে উপরে নিয়ে এলুম, গঙ্গা- যাত্রীর মতো। বড়োবাবুকে এই প্রথমে দেখলুম। অতি সুপুরুষ। মুখে রোগের চিহ্নমাত্র নেই, আছে শুধু আভিজাত্যের ছাপ। তাঁর সঙ্গে এলেন ডাক্তারবাবু, আর বীণা দেবী; বৌঠানও এলেন—যদিচ তিনি প্রথমে একটু ইতস্তত করেছিলেন।
চাকরবাকর প্রথমেই চলে গিয়েছিল; শেষে ডাক্তারবাবুও ‘আর ভয় নেই’ বলে বিদায় হলেন। একটা টিপায়ের উপর দুটো ওষুধের শিশি রেখে গেলেন— একটি বড়োবাবুর জন্য, অপরটি বীণা দেবীর জন্য। দুটিই heart-tonic, কিন্তু এক ওষুধ নয়।
বীণা বললেন, “আমার ওষুধটা আমার ঘরে রেখে এসো; পাছে ভুল করে একের ওষুধ অন্যকে খাওয়ানো হয়। আজ আমাদের মাথার ঠিক নেই। আর আমার বীণাটা নিয়ে এসো। আজ আমাদের শিবরাত্রি, তোমারও। সমস্ত রাত্রি উপবাস ও জাগরণ।” আমি ওষুধটা রেখে বীণাটি নিয়ে এলুম। বীণা বললেন, “দাদা, তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি বীণার মৃদু গুঞ্জনে।” তারপর বৌঠানকে জিজ্ঞাসা করলেন, “কি রাগ আলাপ করব?” তিনি উত্তর করলেন, “ঝিমন্ত পরজ।” বীণা একটু হেসে বললে, “তুমি তো গান-বাজনায় আমার সর্বপ্রথম শিক্ষয়িত্রী; মন দিয়ে শোনো তালের হম্বিদিঘ্যি ও সুরের ষত্বণত্বের জ্ঞান আমার হয়েছে কি না। এ বিষয়ে spelling mistakes তো তোমার কান এড়িয়ে যাবে না।”
তারপর বীণা বীণার পরজ আলাপ করলেন—অতি মৃদুস্বরে, অতি বিলম্বিত লয়ে। এমন বাজনা আমি জীবনে আর কখনো শুনি নি। বীণার অন্তরে যে এত কাতরতা, এত বৈরাগ্য থাকতে পারে তা আমি কখনো ভাবি নি। আধ ঘণ্টার মধ্যেই বড়োবাবু ঘুমিয়ে পড়লেন।
বৌঠান বললেন, “বাণী, তোমার সাধনা সার্থক!” বীণা বললেন, “বৌঠান, তুমি দাদাকে পাহারা দেও। আমি ভিতরে যাচ্ছি ঘোষালের সঙ্গে একটা হিসেব-কিতে করতে। ঘোষাল হচ্ছে আমার নটবর—অর্থাৎ খাজাঞ্চী।”
বীণার ফিলজফি
ভিতর-বাড়ির বারান্দায় যাবামাত্র বীণা বললেন, “মনে আছে, আজ আমাদের শিবরাত্রি—অর্থাৎ নির্জলা উপবাস ও নিমিষে জাগরণ। সমস্ত রাত্রি জোড়াসন হয়ে বসে থাকতে পারব না, পিঠ ধরে আসবে। তুমি খানিকক্ষণ আগে বলেছিলে যে সমাজের একতলায় অন্ধকার আর দোতলায় আলেয়ার আলো। কথাটা খুব ঠিক। তবে একতলা মনে করে দোতলা স্বর্গ, আর দোতলা ভাবে একতলা নরক। দুটোই সমান illusion । আমি কিন্তু দোতলার জীব। তাই আমার চাই আলো আর বাতাস, আর চাই পিঠে আশ্রয়, বুকে আঁচল আর মুখে সাধুভাষা অর্থাৎ সাধুর ভাষা। আরো অনেক জিনিস চাই, যার ফর্দ দিতে গেলে রাত কেটে যাবে। জানি এ-সবই কৃত্রিম। তাতে কি যায় আসে—আমাদের জীবন, সমাজ ও সভ্যতা সবই কি কৃত্রিম নয়?—সে যাই হোক, আমার ঘর থেকে দুখানা cushion chair নিয়ে এসো।
আমি একখানির পর আর একখানি গদি-মোড়া চেয়ার নিয়ে এলুম, যাতে বসে আরাম আছে। তারপর বীণা বললেন, “চুপ করে কি জাগা যায়? বিশেষত মন যখন অশান্ত। ভালো কথা—বিলেতি দেহতত্ত্ব আর মনস্তত্ত্ব নিশ্চয়ই জান। Palpitation হয় বুকের দোষে না বুকের ভিতরে যে মন লুকোনো আছে, সেটি বিগড়ে গেলে? তুমি বলবে—ও দুই কারণেই। সেই ঠিক কথা। দেহ ও মন তো পরস্পর নিঃসম্পর্কিত নয়। আর ঐ দুয়ে মিলে তো তুমিও মানুষ, আমিও মানুষ। এই স্পষ্ট কথাটি ভুললেই আমরা হয় অধ্যাত্মিক, নয় দেহাত্মিক, নয় দেহাত্মবাদী হয়ে উঠি। আমি অবশ্য দেহাত্মবাদী নই। মনের সঙ্গে দেহের পার্থক্য আমি জানি। কিন্তু ঠিক কোথায় দেহ শেষ হয় আর মন আরম্ভ হয়, তা জানি নে।”
বীণার খেয়াল
এর পরেই বীণা কথার মোড় ফিরিয়ে নিয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “বৌঠানকে কিরকম দেখলে?”
“স্বয়ং সিংহবাহিনী।”
“সে তো স্পষ্ট। সুন্দরী?”
“সে তো স্পষ্ট। ইংরেজিতে যাকে বলে queenly beauty। সেই রঙ, সেই কপাল, সেই নাক, সেই ঠোঁট, সেই চিবুক, সেই স্থির দৃষ্টি। এ তো আগাগোড়া দৃঢ়তা ও প্রভুত্বের স্বপ্রকাশ রূপ।”
“আর সেই সঙ্গে দাসীত্বের। সিঁথির সিঁদুর কি তোমার নজরে পড়ে নি? ও কিসের নিদর্শন? দাসীত্বের; সেই দাসীত্বের—যা স্ত্রীলোকে স্বেচ্ছায় বরণ করে।”
আমি এ কথার প্রতিবাদ করতে উদ্যত হলে তিনি বাধা দিয়ে বললেন, “তোমার কথা শুনতে আমি আসি নি, এসেছি আমার কথা তোমাকে শোনাতে। স্বামী অবশ্য দেবতা। সেই স্বামী যিনি হৃদয়ের গর্ভমন্দিরে স্বপ্রতিষ্ঠিত, আর যাঁর দেবদাসী হওয়া স্ত্রীধর্ম। দাসী কেউ কাউকে করতে পারে না। আমরা কখনো কখনো স্বেচ্ছাদাসী হই। যাক ও-সব কথা। ঐ সিঁথের সিঁদুর আমার চোখে বড়ো সুন্দর লাগে আর পরতে বড়ো লোভ হয়—অর্থাৎ এখন হচ্ছে। যাও আমার ঘরে, আয়নার টেবিলের ডানধারের দেরাজে সিঁদুরের কৌটো আছে—নিয়ে এসো; একবার পরে দেখব আমাকে কত সুন্দর দেখায়।”
আমি চেয়ার ছেড়ে উঠবামাত্র বীণা বললেন, “ক্ষেপেছ। আমি সিঁথের সিঁদুর পরব? আমি যে চিরকুমারী, যেমন তুমি চিরকুমার।—তুমি সিগারেট খাও?”
“খাই।”
“ঐ আয়নার উপর এক টিন 555 আছে, নিয়ে এসো। আমি তোমার জন্য কিনে আনিয়েছি চট্টরাজকে দিয়ে। আমি বকে যাব আর তুমি নীরবে সিগারেট ফুঁকবে।”
বীণার প্রলাপ
আমি সিগারেটের টিন ঘর থেকে এনে পাশে রাখলুম। বীণা বললেন-
“আমি আজ প্রলাপ বকব, আর জানই তো প্রলাপের কোনো syntax নেই। সুতরাং আমার বকুনি হবে সাজানো কথা নয়—এলোমেলো কথা। সে বকুনি শুনে পাছে তুমি ঘুমিয়ে পড় সেই ভয়ে তোমার হাতে সিগারেট দিয়েছি। এ জ্বলন্ত সিগারেট হাতে ধরে ঘুমিয়ে পড়তে পারবে না, অগ্নিকাণ্ড হবার ভয়ে।—এখন আমার প্রলাপ শোনো। আমার জীবন বিশৃঙ্খল কেন জান? আমি কখনো কারো দাসী হতে পারি নি—অর্থাৎ কাউকেও ভালোবাসতে পারি নি। দাদাকে আমি অবশ্য প্রাণের চাইতেও ভালোবাসি—তাঁর সঙ্গে আমি অভিন্নহৃদয়। কিন্তু এ ভালোবাসা নৈসর্গিক ও অশরীরী। এ হচ্ছে এক বৃন্তে দুটি ফুলের সৌহার্দ্য, যে সৌহার্দ্যের বন্ধন ফুলে ফুলে নয়, উভয় স্কুলের সঙ্গে একই মূলের।
“আর মাস্টারমশায়?—তিনি শিখেছিলেন শুধু উচাটনের মন্ত্র, তা ছাড়া আর কিছু নয়। হিপনটিজমের ঘোর কদিন থাকে? তাঁর নীরস স্বভাবের ছোঁয়াচ লেগে আমি পাষাণ হয়ে গিয়েছিলুম। তার পর একটি পথ-চলতি লোকের সুকুমার স্পর্শেই অহল্যা আবার মানবী হয়ে উঠল। আমার শুষ্ক হৃদয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে ফুল ফুটল। কেবলমাত্র যূথী জাতি মল্লিকা মালতী নয়, অর্থাৎ যে-সব কুসুম পূজায় লাগে শুধু তাই নয়, সেই সঙ্গে নববসন্তের অগ্নিবর্ণ কিংশুক, হৃদয়ের অন্তঃপুরে আযৌবন অবরুদ্ধ নবজীবনের সদ্যমুক্ত কামনার জবাকুসুম। এখন উপমার ও সংস্কৃতের আব্রু খুলে ফেলে বলি, আমি তাকে প্রথম ভালোবাসি ও প্রথম থেকেই।
“এই বাঙলা কথাটা মুখে আনতে অপ্রবৃত্তি হয়। কেননা ওর চাইতে সস্তা কথাও আর নেই। অথচ ওর চাইতে দামী কথাও আর নেই। সস্তা তার কাছে, যে ও-কথার অর্থ জানে না; আর যে জানে, তার কাছে অমূল্য। সে ব্যক্তি পরম সুন্দর—দেহে ও মনে। আর তার অন্তরে পশুর অন্ত্রতন্ত্র নেই, আছে শুধু জাদুকরী বীণার তার। এ কথা আজ বলছি কেন জান?—এই পারিবারিক বিভ্রাটের বিপ্লবের প্রচণ্ড ধাক্কায় আমি আজ জেগে উঠেছি, নিজেকে চিনতে পেরেছি। আজ আত্মগোপন করা হবে বৃথা মিথ্যাচার।”
বীণার মুক্তি
এর পরে বীণা বললেন, “যাও ঘোষাল, আমার বীণাটি নিয়ে এসো—আর ওষুধের শিশিটাও। এখন আমার বুকের ভিতর হৃদয়টা তাণ্ডবনৃত্য করছে। যদি বীণার বশীকরণ মন্ত্রে নৃত্যকে বশীভূত করতে না পারি তা হলে ওষুধ খেয়ে হৃদয়টা সায়েস্তা করব।”
আমি বীণার ঘর থেকে ওষুধ ও বীণা দুই নিয়ে এলুম।
আমি ফিরে আসবা মাত্র “শ্বসিত কম্পিত পীনঘনস্তনী” বীণা নিজের হৃদয়কে “শান্ত হ পাপ” এই আদেশ করে আমাকে বললেন, “তোমার মুখে একটি কথা শুনতে চাই; তার পর বীণা বাজাব, তারপর ওষুধ গলাধঃকরণ করব। এখন আমার জিজ্ঞাস্য এই—যার মায়ায় তুমি উদ্ভ্রান্ত ও উন্মার্গগামী হয়েছিলে, সে মায়াবিনী কি তোমাকে আমার চাইতেও বেশি মুগ্ধ করেছিল?—না, তা হতেই পারে না। আমার মোহিনী শক্তি আর কেউ না জানুক, তুমি তো জান।
“এখন বীণাটা দেও। তোমাকে এই শেষ রাত্তিরে একটি আশাবরী শোনাব, যা আমার বীণার মুখে কখনো শোন নি।”
এই বলে তিনি বীণাটি বুকে তুলে নিয়ে ‘নৈয়া ঝাঁঝরি’ বীণার মুখ দিয়ে আমাকে শোনালেন। এ বাজনা শুনে রাধা কৃষ্ণের বাঁশি সম্বন্ধে যা বলেছিলেন, তাই আমার মনে পড়ল—”মনের আকুতি বেকত করিতে কত না সন্ধান জানে।”
বাজানো শেষ হলে বীণা বললেন, “এই গানটি তোমার মুখে প্রথম শুনি, আর বীণার মুখে এই শেষ শুনলে। হৃদয়ের এই উদ্দাম তোলপাড় ওষুধে আর থামবে না; আর যখন থামবে, একেবারেই থামবে। এই হচ্ছে আমার Premonition। তুমি আমার পাণিগ্রহণ করে, I mean হাত ধরে, আমাকে সুমুখের চৌকাঠটা পার করে দেও।”
আমি তার হাত ধরে শোবার ঘরের চৌকাঠটি পার করে দিলুম। বীণা ঘরে ঢুকেই বললে, “যতগুলো বাতি আছে সব জেলে দাও—আমার বড়ো ভয় করছে।”
সব বাতি জ্বেলে আমি জিজ্ঞেস করলুম, “কিসের ভয়?”
বীণা বললে, “মৃত্যুভয়।”
তার পর যেমন শোওয়া অমনি “বীণা হি নামা সমুদ্রোত্থিতং রত্নম্’ অকূল সাগরে নিমগ্ন হল। ‘অন্তর্হিতা যদি ভবেদ্বনিতেতি মন্যে।” আর আমি জীবন নামক “নৈয়া ঝাঁঝারি’তে ভেসে বেড়াচ্ছি; যাদের ধন আছে মন নেই, সেই-সব দোতলায় জীবদের মোসাহেবি করছি; যারা আমোদ ও আনন্দের প্রভেদ জানে না সেই-সব সমজদারদের মজলিসী গান শোনাচ্ছি, আর নিত্যনতুন সত্যমিথ্যা গল্প বানিয়ে বলছি।”
আমি জিজ্ঞাসা করলুম, “এ গল্প সত্য, না মিথ্যা?”
ঘোষাল বললে, “এক সঙ্গে দুই।”
“তার অর্থ?”
“তার অর্থ—গল্প সায়েন্স নয়, আর্ট।”
আষাঢ় ১৩৪৪