নীল-লোহিতের আদিপ্রেম

কি কুক্ষণেই নীল-লোহিতের হামবড়ামির গল্প পাঁচজনের কাছে বলেছিলুম। তার পর থেকেই যাঁর সঙ্গে দেখা হয় তিনিই আমার মুখে নীল-লোহিতের আর-একটি গল্প শুনতে চান। সে গল্প বলা যে কত কঠিন তা নীল-লোহিতের admirerরা একবারও ভাবেন না। প্রথমত নীল-লোহিতের গল্প শুনেছি বহুকাল পূর্বে, এখন তা উদ্ধার করতে স্মৃতিশক্তির উপর বেজায় জবরদস্তি করতে হয়। কারণ নীল-লোহিতের বাজে কথা সব পলিটিক্স বা ধর্মের লাখ কথার এক কথা নয়, যা শোনাবামাত্র মনে গেঁথে যায় আর কাঁটার মতো বিঁধে থাকে। সুতরাং আমার বন্ধুবরের রূপকথার জন্য স্মৃতির ভাণ্ডারে হাতড়ে বেড়ানোর চাইতে গল্প নিজে বানিয়ে বলা ঢের সহজ। তবে গল্প যদি আমি বানিয়ে বলি তা হলে তাতে কেউ কর্ণপাত করবেন না। কারণ সে গল্পের ভিতর বীররসও থাকবে না, মধুররসও থাকবে না। এর কারণ আমি বাঙালি। আমরা অবশ্য মরি, কিন্তু সে মৃত্যু ঘটে যুদ্ধক্ষেত্রে নয়, রোগশয্যায়; আর আমরাও ভালোবাসায় পড়ি, কিন্তু সে শুধু নিজের স্ত্রীর সঙ্গে, সঙ্গদোষে বা গুণে। পরিণয় হচ্ছে আমাদের বাধ্যতামূলক প্রণয়শিক্ষার সনাতন ইস্কুল। আর সে স্ত্রীও আমাদের সংগ্রহ করতে হয় না, গুরুজনেরা সংগ্রহ করে দেন—কিঞ্চিৎ দক্ষিণাসমেত। অপরপক্ষে নীল-লোহিত ছিলেন বীররস ও আদিরসের অবতার। নীল-লোহিতের আত্মকাহিনী আগাগোড়া অলীক হলেও, তাঁর সকল কাহিনীর ভিতর একটা জিনিস ফুটে উঠত— সে হচ্ছে তাঁর মুক্ত আত্মা। আজ তাঁর একটা ছোট্টগল্প মনে পড়ছে, সেইটে আপনাদের কাছে বলতে চেষ্টা করব। আশা করি এর পর নীল-লোহিতের আর কোনো গল্প আপনারা শুনতে চাইবেন না। আজগুবি কথারও একটা সীমা আছে।

সেদিন আমাদের সভায় আমাদের বন্ধু উদীয়মান কবি শ্রীভূষণ মন খুলে বক্তৃতা করছিলেন, আর আমরা পাঁচজনে নীরবে তাঁর বক্তৃতা শুনছিলুম। সে বক্তৃতার বিষয় ছিল অবশ্য প্রেম। শ্রীভূষণ বহু ইংরেজ কবির কাব্য থেকে দেদার কোটেশানের সাহায্যে প্রমাণ করছিলেন যে, প্রেম বস্তুটি হচ্ছে মূলহীন ফুলের বিনিসুতোর মালা। শ্রীভূষণের ভাষার ভিতর এতটা প্রাণ ছিল যে, প্রেমনামক আকাশকুসুমের অশরীরী গন্ধে আমরা ঈষৎ মাতোয়ারা হয়ে উঠেছিলুম। একমাত্র মেডিকেল কলেজের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র অনিলচন্দ্রের মুখ দেখে মনে হল যে, শ্রীভূষণের কবিত্ব তাঁর অসহ্য হয়ে উঠেছে। শ্রীভূষণ থামবামাত্রই অনিল বলে উঠলেন যে, মানুষে যাকে প্রেম বলে সে বস্তুটি একটি শারীরিক বিকার ছাড়া আর কিছুই নয়; আর তা যে নয়, তা অনুবীক্ষণের সাহায্যে সকলকেই দেখিয়ে দেওয়া যায়। ওর বীজ আমাদের দেহের glandএর মধ্যে প্রচ্ছন্ন থাকে। আর সেইজন্যই লোকের মনে কৈশোরেই প্রেম জন্মায়, তার পূর্বে নয়; কারণ বালকের দেহে প্রেমের বাহন glandএর সাক্ষাৎ পাওয়া যায় না। নীল-লোহিত শ্রীভূষণের কথা শুনে বিরক্ত হচ্ছিলেন, কিন্তু অনিলের কথা শুনে একেবারে চটে উঠে বললেন, “তোমাদের শাস্ত্রে বলে নাকি যে, ছোটো ছেলে প্রেমিক হত পারে না? অথচ আমি যখন প্রথম প্রেমে পড়ি, তখন আমার বয়স কত জান? সবে পাঁচ বৎসর।”

অনিল বললেন, “কি! পাঁচ বৎসর?”

নীল-লোহিত উত্তর করলেন, “তুমি যদি আমার বিলেতিদস্তুর জীবনচরিত লিখতে চাও তা হলে বলি— তখন আমার বয়েস পাঁচ বৎসর, পাঁচ মাস, পাঁচ দিন। যদি জানতে চাও যে আমি ঠিক বয়েস জানলুম কি করে? জানলুম এইজন্যে যে, যেদিন আমি প্রেমে পড়ি সেইদিন আমি মাকে নিয়ে আমার জন্মতিথি কবে, জিজ্ঞাসা করি। তিনি আমার ঠিকুজির সঙ্গে পাঁজিপুঁথি মিলিয়ে, আঁক কষে আমার ঠিক বয়েস বলে দিলেন।”

নীল-লোহিতের এ কথা শুনে আমরা সকলে চুপ করে থাকাই সংগত মনে করলুম। শুধু শ্রীভূষণ বললে যে, চণ্ডীদাস লিখেছেন—

জনম অবধি পীরিতি বেয়াধি অন্তরে রহিল মোর,
থাকিয়া থাকিয়া জাগিয়া ওঠে, জ্বালার নাহিক ওর।

চণ্ডীদাসের উক্তি যে সত্য—নীল-লোহিত তার প্রমাণ। নীল-লোহিত প্রতিবাদ করে বললেন যে, চণ্ডীদাসের কথা সত্য হত, যদি তিনি ঐ ব্যাধি শব্দটা ব্যবহার না করতেন। অনিল পাছে ঐ ব্যাধি নিয়ে একটা তর্ক বাধায়, এই ভয়ে আমি প্রস্তাব করলুম যে, প্রেম জিনিসটে ব্যাধি কি না, তা নিয়ে পরে তর্ক করা যাবে; এমন নীল-লোহিতের আদিপ্রেমের উপাখ্যান শোনা যাক।

অমনি নীল-লোহিত তাঁর বর্ণনা শুরু করলেন।

নীল-লোহিত এই বলে তাঁর গল্পের সূত্রপাত করলেন যে, এ গল্প তোমাদের বলতুম না, কারণ প্রেম যে কি বস্তু তা যারা মর্মে মর্মে অনুভব করেছে তারা পাঁচজনের কাছে প্রেমের ব্যাখ্যান করে না; করে তারাই, যারা প্রেমের শুধু নাম শুনেছে, কিন্তু রূপ দেখে নি—যথা আধ্যাত্মিক কবিরা আর দেহতাত্ত্বিক বৈজ্ঞানিকেরা। এ কথা যে সত্য, তার প্রমাণ তোমরা হাতে হাতেই পেলে। কবি শ্রীভূষণ প্রেমকে এত উঁচুতে ঠেলে তুললেন যে দূরবীক্ষণের সাহায্যেও তার সাক্ষাৎ মেলে না; আর বৈজ্ঞানিক অনিলচন্দ্র তাকে এত নিচুতে নামালেন যে চোখে অনুবীক্ষণের চশমা এঁটেও তার সন্ধান পাওয়া যায় না। আজ তোমাদের কাছে যে আমার প্রেমের হাতেখড়ির কথা বলছি, সে শুধু এই কবি ও বৈজ্ঞানিকের মুখ বন্ধ করবার জন্য। এখন ব্যাপার কি ঘটেছিল শোনো।

আমি ভূমিষ্ঠ হয়েছিলুম একটি পাড়াগেঁয়ে শহরে। পাড়াগেঁয়ে শহর কাকে বলে জান? সেই লোকালয়— যা শহরও নয়, পাড়াগাঁও নয়। ও হচ্ছে একরকম কাঁঠালের আমসত্ত্ব। একটি পাড়াগেঁয়ে শহর দেখলেই বোঝা যায় যে, তা একটা পুরানো শহরের ভগ্নাবশেষও নয়; তার অতীতও নেই, ভবিষ্যৎও নেই। যদি ফৌজদারী ও দেওয়ানী আদালত, থানা ও জেলখানা, বিদ্যালয় ও অবিদ্যালয় থাকলেই একটা মান্ধাতার আমলের পল্লিগ্রাম শহর হয়ে ওঠে তো আমার জন্মস্থানও শহর ছিল। কারণ সেখানে জজও ছিল, ম্যাজিস্ট্রেটও ছিল, দারোগাও ছিল, স্কুলমাস্টারও ছিল। আর স্কুল ছিল দুজাতের—অর্থাৎ মেয়েদের আর ছেলেদের। কোটি যে কি, তা দেখলেই চেনা যেত। ছেলেদের স্কুল ছিল কোঠাবাড়ি, আর মেয়েদের চালাঘর। এর কারণও স্পষ্ট। ছেলেদের পড়ানো হত জজ ম্যাজিস্ট্রেট উকিল দারোগা বানাবার জন্য; আর মেয়েদের পড়ানো হত কেন, তা মা-গঙ্গাই জানেন। অবশ্য এ প্রভেদ এখন ততটা চোখে পড়ে না, কারণ একালে ছেলেরা হয়ে পড়েছে সব মেয়েলি, আর মেয়েরা পুরুষালি।

আমার বয়েস পাঁচ বৎসর হতেই আমাকে একটি বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেওয়া হল। বিদ্যালয়টি ছিল আমাদের বাড়ির কাছে; ভিতরে শুধু একটি মাঠের ব্যবধান ছিল। এ বিদ্যালয়ের শুধু একটিমাত্র ক্লাস ছিল, কারণ একটি বড়ো আটচালার একটিমাত্র ঘরে স্কুল বসত। মাথার উপর ছিল খড়ের চাল, আর চারপাশে দরমার বেড়া। আর ছাত্রীরা বসত সব ছেঁড়া মাদুরের উপর। মাস্টার কি মাস্টারনী কেউ ছিল কি না মনে পড়ে না। তবে এইটুকু মনে আছে যে আমরা সকলে খুব মন দিয়ে লেখাপড়া করতুম; কিন্তু কি যে সেখানে পড়েছি, তার বিন্দু-বিসর্গও মনে নেই। সম্ভবত সেখানে পড়ার চাইতে লেখাটাই বেশি হত। আমি অবশ্য এ স্কুল ছেড়ে ছেলেদের স্কুলে যাবার জন্য ব্যস্ত হয়েছিলুম, কারণ ছেলেদের স্কুলে গেলে পাঁচজন ছেলের সঙ্গে মারামারি করা যায়, পাঞ্জা করা যায়; কিন্তু এ স্কুলে পরস্পর পরস্পরকে শুধু চিমটি কাটত। আমাকে বালিকা বিদ্যালয় থেকে তুলে নিয়ে ছেলেদের স্কুলে ভর্তি করে দেবার কথাবার্তা সব ঠিক হয়ে গিয়েছিল। এমন সময় এমন-একটি ঘটনা ঘটল যার ফলে কেউ আমাকে আর সে স্কুল ছাড়াতে পারলেন না। আমাদের স্কুলে পুরানো ছাত্রী নিত্য ছেড়ে যেত, আর নূতন ছাত্রী নিত্য ভর্তি হত। আমার বয়েস যখন পাঁচ বৎসর, পাঁচ মাস, পাঁচ দিন ঠিক সেইদিন একটি নূতন ছাত্রী আমাদের স্কুলে এল, যাকে দেখবামাত্রই আমি তার প্রেমে পড়ে গেলুম। এর মূলে ছিল— আলংকারিকেরা যাকে বলে পূর্ববাসনা।

এ কথা শুনে অনিলচন্দ্র আর স্থির থাকতে পারলেন না, নীল-লোহিতের কথায় বাধা দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন যে, তোমার মনের নতুন ভাবকে তুমি সেই মুহূর্তেই প্রেম বলে চিনতে পারলে? নীল-লোহিত বললে, “অবশ্য এ জাতীয় মনোভাব তো আর বই পড়ে শিখতে হয় না, ঠেকেই শিখতে হয়। প্রেমে পড়া আমার সহজ প্রবৃত্তি। এর পর আমি বছরে অন্তত দুবার করে প্রেমে পড়েছি, কিন্তু সে-সবই হচ্ছে আমার সেই আদিপ্রেমের reprint মাত্র। পূর্বের সঙ্গে পরের যা-কিছু প্রভেদ, সে শুধু ছোটোবড়ো typeএর। অনেকের বিশ্বাস যে, ছোটো ছেলের কোনো স্পষ্ট অনুভূতি নেই, আছে শুধু বয়স্ক লোকের। এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। আমার বয়েস যখন ছ বৎসর, তখন আমার একটি আত্মীয় মারা যান। সেদিন আমার চোখে পৃথিবীর যে নতুন চেহারা দেখা দিয়েছিল, তার পরে পরিবারে যত বার মৃত্যু ঘটেছে, প্রতিবারেই সেই চেহারা দেখেছি। মরে শুধু একজন লোক, আর সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবী যেন জনশূন্য হয়ে যায়, রোদ খাঁ খাঁ করে, আকাশের আলোর ভিতর একটা বিশ্রী ঔদাস্যের ভাব আসে, আর চার পাশের লোকজন সব ছায়ার মতো ঘুরে বেড়ায়। মৃত্যু ও প্রেম সম্বন্ধে ছেলে-বুড়োর কোনো অধিকারী-ভেদ নেই। কিন্তু মানুষে মানুষে ঢের প্রভেদ আছে। সকলেই মরে, কিন্তু সকলেই আর প্রেমে পড়ে না। তাই ডাক্তারের কথা যেমন সর্বলোকগ্রাহ্য, প্রেমিকের কথা তেমনি ডাক্তারি শাস্ত্রে অগ্রাহ্য।” এই বক্তৃতার পর অনিলচন্দ্র আর রা কাড়লেন না।

এর পর শ্রীভূষণ বললেন যে, তোমার প্রেমে পড়বার সঙ্গে সঙ্গে কি ভাবান্তর ঘটেছিল তার বর্ণনা কর তো তা হলেই বোঝা যাবে ব্যাপারখানা কি ঘটেছিল।

নীল-লোহিত বললেন, “তুমি যে-সব বিলেতি বচন শোনালে, তার সঙ্গে আমার কথা মিলবে না। ইংরেজরা প্রেমে পড়লে তাদের মনের অবস্থা কি হয় জানি নে, তবে তারা যা লেখে তার সঙ্গে সত্যের কোনো সম্বন্ধ নেই। আমার বিশ্বাস তারা প্রেম করে অনিলের শাস্ত্র-মতে, আর তা ব্যক্ত করে শ্রীভূষণের ভাষায়। আমার যা হয়েছিল, তা অবশ্য desire of the moth of the star নয়। কারণ আমিও moth নই, সেও star ছিল না। এক কথায়, প্রেমে পড়বামাত্র আমি যেন প্রথমে জেগে উঠলুম, তার আগে ঘুমিয়ে ছিলুম। সেইদিন প্রথম আবিষ্কার করলুম যে, তেলাকুচোর রঙ লাল। হঠাৎ দেখি পৃথিবী প্রাণে ভরপুর হয়ে উঠল, আকাশের রোদ চন্দ্রালোক হয়ে এল, চারি দিকের যত আলো সব হেসে উঠল, আর ঐ মেয়েটির চোখে আশ্রয় নিলে। কি সুন্দর সে আলো, আর তার অন্তরে কি গভীর অর্থ! তার চোখ দুটি প্রথমে কি যেন খুঁজে বেড়াচ্ছিল, তার পর আমার উপর যেই পড়া, সেই চঞ্চল চোখ একেবারে স্থির হয়ে গেল, আর তার পল্লব কিঞ্চিৎ নত হয়ে এল। আমি বুঝলুম যে সেও আমার প্রেমে পড়েছে। যেমন এক হাতে তালি বাজে না, তেমনি এক পক্ষেও প্রেম হয় না। আমি ভালোবাসলুম, কিন্তু সে বাসলে না—এমন যদি হয় তা হলে সে একটা হা-হুতাশের ব্যাপার হয়ে ওঠে, তাকেই ব্যাধি বলা যেতে পারে। আমাদের উভয়ের মনে যা জন্মাল সে হচ্ছে যথার্থ প্রেম—তাই উভয়ের মন একসঙ্গে নীরব আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে উঠল

এ প্রেমের কোনো ইতিহাস নেই; কেননা সেইদিন আর পরের দিন ছাড়া তার সঙ্গে আমার জীবনে আর কখনো দেখা হয় নি। কেন, তা পরে বলছি। তবে তার স্মৃতি আমার জীবনের বিচিত্র ইতিহাসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত হয়ে রয়েছে।

আমি এমন কোনো স্ত্রীলোকের সঙ্গে কখনো প্রেমে পড়ি নি যার মুখে আমি তার চেহারা দেখতে পাই নি। বর্ণ তার ছিল উজ্জ্বল শ্যাম, গড়ন ছিপছিপে, নাক তোলা, আর চোখ সাত রাজার ধন কালামানিকের মতো। আমি চিরজীবন তাকেই খুঁজে বেড়াচ্ছি, আর যখনই তার ঈষৎ পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত সংস্করণের সাক্ষাৎ পেয়েছি, তখনই আবার প্রেমে পড়েছি। এই কারণেই আমি বলেছি যে, আমার সব নতুন প্রেম আমার সেই আদিপ্রেমের reprint মাত্র। যখনই কোনো নতুন প্রেমে পড়েছি তখনই পৃথিবী একেবারে উল্টে-পাল্টে গিয়েছে, ডুমুরের ফুল ফুটেছে, অমাবস্যায় জ্যোৎস্না ফুটেছে, আকাশকুসুমের গন্ধ চারি দিকে ছড়িয়ে পড়েছে এবং আমার মনে হয়েছে যেন আমি হঠাৎ জেগে উঠেছি, আর তার আগে ঘুমিয়ে ছিলুম। এই আদিপ্রেমের কৃপায় কোনো ইংরেজ কিংবা জাপানি অথবা ইহুদি মেয়ের প্রেমে কখনো পড়ি নি। কারণ ইংরেজের রঙ উজ্জ্বল শ্যাম নয়, চুনের মতো সাদা; জাপানির নাক তোলা নয়, চাপা; আর ইহুদিদের নাক হাতির শুঁড়ের মতো লম্বা। এখন আমাদের কি কারণে বিচ্ছেদ ঘটল, তা শোনো।

তার পর নীল-লোহিত বললেন যে, পরের দিন বালিকা-বিদ্যালয় থেকে তাঁর ইংরেজি স্কুলে বদলি হবার কথা ছিল; কিন্তু তিনি বালিকা-বিদ্যালয়রূপ স্বর্গ হতে ভ্রষ্ট হতে কিছুতেই রাজি হলেন না। তাঁর মা নিলেন তাঁর পক্ষ, আর বিপক্ষ হলেন তাঁর বাবা। এ দুজনের মধ্যে অনেক বকাবকি হল; শেষটায় নীল-লোহিতের জেদই বজায় রইল। তার বাবা, ‘এটার ছেলে না হয়ে মেয়ে হয়ে জন্মানো উচিত ছিল’—এই কথা বলে মার সঙ্গে তর্কে ক্ষান্ত দিলেন। তর্কে বাবা কোথায় মার কাছে পেরে উঠবেন?

পরদিন সকালবেলায় নীল-লোহিত যথাসময়ে স্কুলে গিয়ে হাজির হলেন। গিয়ে দেখেন যে, মেয়েটি আগেই এসে যথাস্থানে একটি মাদুরের উপরে যোগাসনে বসে আছে, আর তার কালো কালো চোখ দুটি কি যেন খুঁজছে; তাঁকে দেখবামাত্রই সে চোখ নিবাতনিষ্কম্প প্রদীপের মতো হয়ে গেল।

নীল-লোহিত অমনি তাঁর স্লেট নিয়ে বড়ো বড়ো অক্ষরে ক খ লিখতে বসে গেলেন। তাঁর সঙ্গে মেয়েটির যা-কিছু কথাবার্তা হল সে শুধু চোখে চোখে, মুখের ভাষায় নয়। চোখের আলাপ যখন খুব জমে উঠেছে তখন হঠাৎ একটা বন্দুকের বেজায় আওয়াজ হল। অমনি ছাত্রীরা সব চমকে উঠে ভয়ে হাঁউমাউ করতে আরম্ভ করলে, আর সেই মেয়েটি নীল-লোহিতের দিকে সকাতরে চেয়ে রইল। সে চাহনির ভাবটা এই যে, গুলির হাত থেকে আমাকে যদি কেউ রক্ষা করতে পারে তো সে তুমি। এই সময়ে নীল-লোহিতের চোখে পড়ল যে, দরমার বেড়া ফুটো করে একটা গোলাপী রঙের গুলি সোজা মেয়েটির দিকে ছুটে আসছে।

নীল-লোহিত আর তিলমাত্র দ্বিধা না করে বাঁ হাত দিয়ে স্লেটখানি মেয়েটির মুখের সুমুখে ধরলেন আর গুলিটি স্লেট ভেদ করে বেরবামাত্র ডান হাত দিয়ে সেটি চেপে ধরলেন। তখন সে গুলির তেজ কমে এসেছে, তাই সেটি নীল-লোহিতের মুঠোর মধ্যে রয়ে গেল।

ইতিমধ্যে বেড়ায় আগুন ধরে গিয়েছে, মেয়েরা সব ডুকরে কাঁদতে আরম্ভ করেছে, আর বাইরে লোকে লোকারণ্য হয়ে গিয়েছে। এমন সময়ে নীল-লোহিতের বাবা একটা দোনালা বন্দুক হাতে করে স্কুলে এসে উপস্থিত। তিনি এসেই প্রথমে আগুন নেবাবার ব্যবস্থা করলেন, এবং পরে ব্যাপার কি হয়েছিল তা গৃহস্বামীকে বললেন। নীল- লোহিতের বাবার অভ্যাস ছিল বাড়ির সুমুখে পুকুরে একটা ছিপি-আঁটা বোতল ভাসিয়ে দিয়ে সেই বোতলকে গুলি মারা—চোখের নিশানা ও হাতের তাক ঠিক রাখবার জন্য। সেদিন গুলিটে বোতলের গা থেকে ঠিকরে বেঁকে বিপথে চলে এসেছে। অবশ্য পথিমধ্যে তার তেজ অনেকটা মরে গিয়েছিল, তবুও নীল-লোহিত যদি সেটিকে না আটকাত তা হলে গুলিটি অন্তত ঐ মেয়েটির কপালে চিরদিনের জন্য একটি আধুলি- প্রমাণ হোমের ফোঁটা পরিয়ে যেত।

তার পর তিনি নীল-লোহিতের পিঠ চাপড়ে বললেন যে, ‘তুমি ছেলে বটে, বাপকো বেটা।’

মেয়েটি অমনি তার কচি হাত দুখানি জোড় করে নীল-লোহিতকে ভক্তিভরে প্রণাম করলে। এর পর তার বাবা তাকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি চলে গেলেন।

এই ঘটনার পরে গৃহস্বামী তাঁর আটচালায় বালিকা-বিদ্যালয় বসবার অনুমতি আর দিলেন না। ফলে সেইদিনই বিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেল।

আমরা সকলে নীল-লোহিতের আদিপ্রেমের কাহিনী শুনে না হোক, আদিবীরত্বের কাহিনী শুনে অবাক হয়ে গেলুম।

এখন আপনারা বিচার করুন, এ গল্পের কোনো মানে-মোদ্দা আছে কি না।

ফাল্গুন ১৩৩৯


© 2024 পুরনো বই