অবনীভূষণের সাধনা ও সিদ্ধি

কলেজে আমার সহপাঠীদের মধ্যে অবনীভূষণ রায় ছিলেন আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু; অর্থাৎ আমি ছিলেম তাঁর একান্ত অনুরক্ত ভক্ত। প্রথম-যৌবনে পাঁচজনের মধ্যে একজন সমবয়স্ক যুবক যে কেন আমাদের অত্যন্ত প্রিয় হয়ে ওঠে, তা বলা কঠিন। কারণ অনুরাগ কিম্বা ভক্তির ভিতর একটা অজানা জিনিস আছে। আমরা সে অনুরাগ বা ভক্তির যখন কারণ নির্দেশ করতে চাই, তখন আমরা সেই-সব কথাই ব্যক্ত করি যা আর- পাঁচজনের কাছে প্রত্যক্ষ। কিন্তু আমার বিশ্বাস—অন্তত অনুরাগের মূলে এমন-একটা অনির্দিষ্ট কারণ থাকে, যা ঠিক ধরাছোঁয়ার বস্তু নয়; অতএব তা অপরকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া যায় না; অবশ্য অবনীভূষণের শরীরে এমন কটি স্পষ্ট গুণ ছিল, যা কারো চোখ এড়িয়ে যেত না। প্রথমত, অবনীভূষণ ছিলেন অতিশয় প্রিয়দর্শন, উপরন্তু তিনি ছিলেন অতিশয় ভদ্র। বনেদি ঘরের ছেলের দেহে ও চরিত্রে যে-সব গুণের সদ্ভাব আমরা কল্পনা করি, অবনীভূষণের দেহে ও মনে সে গুণই পূর্ণমাত্রায় ছিল। তাঁর তুল্য ধীর ও অমায়িক যুবক আমাদের মধ্যে আর দ্বিতীয় ছিল না। আর ধনীর সন্তানের চরিত্রে যে-সব ছার গুণের নিত্য সাক্ষাৎ পাওয়া যায়—যথা মূর্খোচিত দাম্ভিকতা সর্বজ্ঞতা অনবস্থচিত্ততা, স্বেচ্ছাচারিতা প্রভৃতি— সে-সবের লেশমাত্রও তাঁকে স্পর্শ করে নি, যদিচ অবনী ছিলেন একাধারে বনেদি বংশের ও বড়োমানুষের ছেলে—রায়নগরের বড়ো জমিদার লক্ষ্মীকান্ত রায়ের একমাত্র সন্তান; সেকালে কলেজে আমরা প্রায় সকলেই ছিলাম রোমান্টিক প্রকৃতির যুবক। একমাত্র অবনীভূষণের মনে romanticismএর ছাপ কখনো পড়ে নি, ছোপও ধরে নি। স্ত্রীজাতি সম্বন্ধে তাঁর কোনোরূপ কৌতূহল, কোনোরূপ মায়া ছিল না; এমন-কি, কোনো মনগড়া সুন্দরীর সঙ্গে তিনি একদিনের জন্যও লভে পড়েন নি। কিসে দেশের অসংখ্য নিরক্ষর নিঃসহায় রোগক্লিষ্ট লোকদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের বিধান করা যায়, এই ছিল তাঁর প্রধান এবং একমাত্র ভাবনা। অতএব এ ভাবনায় যে তিনি সিদ্ধিলাভ করবেন, তা নিঃসন্দেহ।

 

এই-সব কারণে আমি আন্দাজ করেছিলুম যে অবনীভূষণ একদিন বাঙলার জমিদারদের মুখোজ্জ্বল করবেন। অবনীর একটি প্রধান গুণ ছিল তাঁর একাগ্রতা। উপরন্তু ইচ্ছা কার্যে পরিণত করবারও তাঁর যথেষ্ট সুযোগ ছিল। আমাদের পাঁচজনের মতো তাঁর পেটে কিঞ্চিৎ বিদ্যা ছিল, পরোপকার করবার বাসনা ছিল, তার উপর তাঁর ছিল অর্থসামর্থ্য—যা আমাদের পাঁচজনের ছিল না। আর তাঁর পারিবারিক সঞ্চিত অর্থ তিনি যে আমোদ-আহ্লাদে অপব্যয় করবেন না— সে বিষয়ে তাঁর বন্ধুবান্ধবরা নিশ্চিন্ত ছিলেন।

অবশ্য আমরা অনেকেই নানারূপ শুভসংকল্প নিয়ে কলেজ থেকে বেরোই, কিন্তু জীবনে সে সংকল্প কার্যে পরিণত করতে পারি নে। সামাজিক জীবনকে আমাদের মনোমত পরিবর্তন করা যে আমাদের পক্ষে অসাধ্য না হোক দুঃসাধ্য –দুদিনেই তা বুঝতে পারি বলে আমাদের কর্মজীবনকে সামাজিক জীবনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতেই ব্রতী হই। আর যিনি যতটা খাপ খাওয়াতে কৃতকার্য হন, তিনিই ততটা কৃতিত্ব লাভ করেন। দুঃখের বিষয় অবনীভূষণ সামাজিক জীবনের স্রোত উজান বহাতে পারেন নি— শুধু তাই নয়, নিজের জীবনকে অদ্ভুত ট্রাজেডিতে পরিণত করেছিলেন। কি কারণে সেই কথাটা আজ বলব।

কলেজের যুগটা পার হলেই আমরা পাঁচজনে নানাস্থানে নানাদেশে ছড়িয়ে পড়ি; কর্মজীবনই আমাদের পরস্পরকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এম. এ. পাস করবার পর অবনীভূষণ স্বস্থানে ফিরে গেলেন, আর আমি গেলুম পশ্চিমের এক শহরে স্কুলমাস্টারি করতে। বছর-তিনেক তাঁর সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হয় নি, তাঁর কাছে কোনো চিঠিপত্র ও পাই নি। তার পর একদিন হঠাৎ তাঁর কাছ থেকে আদেশ পেলুম রায়নগরে গিয়ে তাঁর সঙ্গে একবার দেখা করতে। তাঁর সংকল্পিত ডিসপেন্‌সারি ও স্কুলঘর তৈরি হয়ে গিয়েছে; বাকি আছে শুধু উপযুক্ত মাস্টার ও ডাক্তার সংগ্রহ করা। ইতিমধ্যে অবনীভূষণকে একরকম ভুলেই গিয়েছিলুম। তাঁর এই চিঠি পেয়ে সেকালের সব কথা আবার মনে পড়ে গেল, এবং এ ক্ষেত্রে তাঁর সব কীর্তি দেখবার জন্য আমার মনে অত্যন্ত কৌতূহল জন্মাল। ফলে আমি পুজোর ছুটিতে রায়নগরে গেলুম। স্কুল চালানো সম্বন্ধে তাঁকে দুটো একটা পরামর্শ দেবার মতলবও আমার ছিল।

গিয়ে দেখে, অবনীভূষণ সেই কলেজের ছোকরাই আছেন। তিনি এ যাবৎ বিবাহ করেন নি, কারণ তিনি দেশের জনসাধারণের শিক্ষা ও চিকিৎসার সুব্যবস্থা না করে বিবাহ করবেন না প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। ইতিমধ্যে স্কুল ও ডিপেন্‌সারির বাড়ি দুটি তৈরি হয়ে গিয়েছিল। সে দুটি তো পাড়াগেঁয়ে স্কুল ও ডাক্তারখানা নয়-রাজপ্রাসাদ। দেখলুম দেশবিদেশ থেকে সব কারিগর আনিয়ে এই অট্টালিকা দুটিকে অলংকৃত করা হয়েছে। আমি ব্যাপার দেখে একটু আশ্চর্য হয়ে গেলুম লক্ষ্য করে অবনীভূষণ বললেন— ছেলেবেলা থেকে beautyর মধ্যে বর্ধিত না হলে লোক যথার্থ সুশিক্ষিত হয় না।

তাঁকে সৌন্দর্যের উপাসক হতে শিখিয়েছেন তাঁর নতুন friend, philosopher and guide প্যারীলাল। এ ভদ্রলোক রায়পরিবারের একটি পুরোনো আমলার ছেলে, অবনীভূষণের জ্ঞাতি সম্পর্কে অগ্রজ। গ্রামেই বাড়ি, কিন্তু থাকেন বেশির ভাগ বিদেশে, এবং মধ্যে মধ্যে আবির্ভূত হন। শুনলুম ইনি বি. এ. পাস করে নানাস্থানে নানারকম কাজ করেছেন। প্রথমে জয়পুরে স্কুলমাস্টারি, তার পরে কাশীতে কবিরাজি, তার পরে আউধে কোনো তালুকদারের মোসাহেবি। তার পর বহুকাল ধরে করেছেন তীর্থভ্রমণ অর্থাৎ দেশপর্যটন। যখন যে কাজ করেছেন, তাতেই তিনি সুখ্যাতি লাভ করেছেন; কিন্তু কোনো কাজেই বেশিদিন লিপ্ত থাকতে পারেন নি। বছরে একবার পেশা পরিবর্তন না করলে তাঁর মনের শান্তি থাকত না। আসল কথা এই যে, লোকটা ছিলেন জন্ম- ভবঘুরে ও লক্ষ্মীছাড়া। তবে তিনি যে অসাধারণ বুদ্ধিমান, সে বিষয়ে আর সন্দেহ নেই। তাঁর মুখেচোখে যেন বুদ্ধির বিদ্যুৎ খেলত। তার উপর তাঁর ছিল নানাবিদ্যায় সহজ অধিকার। ইংরেজি তিনি ভালোই জানতেন, আর সংস্কৃতে তিনি ছিলেন সুপণ্ডিত। তার উপর তিনি ছিলেন অতি সদালাপী। আর্ট বল, সংগীত বল, হিন্দুশাস্ত্র বল— সব বিষয়েই তিনি চমৎকার কথা বলতেন। আর্ট ও ধর্মই ছিল তাঁর কথোপকথনের প্রধান বিষয়—অর্থাৎ সেই দুই বিষয়, আমাদের স্কুলকলেজে যা আমাদের ভুলিয়ে দিয়েছে। আর তিনি ছিলেন চমৎকার সেতারী। সেতার নাকি তিনি অপরকে শোনাবার জন্য নয়, নিজে শোনবার জন্যই বাজাতেন। তিনি সেতার শিক্ষা করেছিলেন জনৈক সন্ন্যাসীর কাছে, আর তাঁর শুরু নাকি সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে, পরের মনোরঞ্জনার্থ বাজালে কেউ আর সংগীতসাধনা করতে পারে না; কারণ তখন সে পেশাদার ওস্তাদ হয়ে পড়ে। অপরপক্ষে কর্মজীবনের প্রতি প্যারীলালের ছিল অগাধ অবজ্ঞা। এরকম লোকের বশীভূত হলে কেউই আর কর্মজীবনে কৃতী হতে পারে না। আর অবনীভূষণকে তিনি যে জাদু করেছিলেন, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। এ-সব দেখেশুনে আমার ভয় হল যে, অবনীভূষণের সামাজিক হিতসাধনের খেয়াল হয়তো বেশিদিন থাকবে না। কেননা আর-পাঁচজনের কাছে শুনলুম, প্যারীলাল অত্যন্ত অসামাজিক প্রকৃতির লোক— একেবারে বেপরোয়া। প্যারীলাল যে philosopher তা নিঃসন্দেহ, অবনীর friendও হতে পারেন, কিন্তু guide হিসাবে সর্বনেশে। কেননা তিনি ছিলেন, genius বিগড়ে গেলে যা হয়, তাই।

আমি চলে আসবার পর অবনীভূষণের স্কুল ও ডাক্তারখানা খোলা হল এবং ভালোভাবেই চলতে লাগল প্যারীলালের তত্ত্বাবধানে। অবনীভূষণের বিশ্বাস ছিল যে, তাঁর বন্ধুর শিক্ষা ও চিকিৎসা সম্বন্ধে ঢের নতুন নতুন idea আছে, যা তিনি ইতিপূর্বে ছাত্রদের ও রোগীদের উপকারার্থে পরের স্কুল-কলেজে ডাক্তারখানায় প্রয়োগ করবার সুযোগ পান নি। তিনি ডাক্তার ও মাস্টারদের শিক্ষার ভার নিজের হাতে নিলেন। প্যারীলাল ডাক্তারদের শিক্ষাশাস্ত্র সম্বন্ধে ও মাস্টারদের চিকিৎসাশাস্ত্র সম্বন্ধে উপদেশ দিতে শুরু করলেন, কারণ তাঁর মতে দেহ বাদ দিয়ে মানুষের মন গড়া যায় না, আর মন বাদ দিয়েও তার দেহ গড়া যায় না। এ-সব উপদেশ, কি ডাক্তারবাবুদের কি মাস্টারবাবুদের কারো বিরক্তিকর হয় নি, কেননা তাঁর মুখের কথা ছিল একরকম বশীকরণ মন্ত্র। বুদ্ধির এরকম বিচিত্র এবং অদ্ভুত খেলা তাঁরা পূর্বে আর কখনো দেখেন নি।

বছরখানেক না যেতেই অবনীভূষণ বিবাহ করলেন। অবনীভূষণের স্ত্রী ছিলেন যেমন সুন্দরী, তেমনি ভালো মেয়ে। বিবাহের পরেই অবনীভূষণের জীবনের কেন্দ্র হয়ে উঠল তাঁর স্ত্রী। পৃথিবীতে স্ত্রীজাতি যে একরকম অপূর্ব জীব, এবং তাদের ভিতর যে একটা বিশ্বজোড়া রহস্য আছে—অবনীভূষণ তাঁর স্ত্রীর সংসর্গে এসে এই সত্যটি প্রথমে আবিষ্কার করলেন। ক্রমে তিনি তাকে মনে মনে একটি দেবতা করে তুললেন। এই প্রতিমার নিত্যপূজা উপাসনা ধ্যানধারণাই হল তাঁর জীবনের নিত্যকর্ম। বলা বাহুল্য, তাঁর স্কুল ও ডাক্তারখানার ভার তিনি সম্পূর্ণ ডাক্তার ও মাস্টারদের হাতে ন্যস্ত করলেন; এবং তিনি তাঁর স্ত্রীর শিক্ষা ও রূপের অনুশীলনেই তাঁর সকল মনপ্রাণ নিয়োজিত করলেন। লোকে বলতে আরম্ভ করলে যে, তিনি ঘোর স্ত্রৈণ হয়ে পড়েছেন; কারণ তিনি কারো সঙ্গে আর মেলামেশা করতেন না। যে লোক শৈশবে মাতৃপিতৃহীন হয়েছিলেন এবং জন্মাবধি একমাত্র চাকরবাকর আমলাফয়লা মাস্টার ও ডাক্তারের হাতে লালিতপালিত হয়েছেন, তাঁর অন্তরে একটি রক্তমাংসের মানুষের রক্তমাংসের ভালোবাসার বুভুক্ষা প্রচণ্ডভাবে দেখা দিল। এ তো হবারই কথা। তাঁর একমাত্র বন্ধু প্যারীলাল ইতিমধ্যেই অন্তর্ধান হয়েছিলেন। বোধ হয় আবার কোনো নূতন বিদ্যা শিখতে কোনো নূতন গুরুর সন্ধানে তিনি বেরিয়ে পড়েছিলেন।

অবনীভূষণের দেহ ও মনে তাঁর স্ত্রীর প্রতি আসক্তি একটা দমকা জ্বরের মতো এসে পড়েছিল। বছরখানেক পর সে জ্বর আস্তে আস্তে ছাড়তে আরম্ভ করলে। তাঁর দুকূল-ছাপানো প্রেমের জোয়ারে যখন ভাঁটা ধরতে আরম্ভ করলে, তখন প্যারীলালের একটা পুরোনো কথা তাঁর মনে পড়ে গেল। প্যারীলাল একদিন তাঁকে বলেছিলেন যে, “নিত্যপূজা হচ্ছে ধর্মমনোভাবের প্রধান শত্রু। কারণ নিত্যপূজাটা ক্রমে একটা শারীরিক অভ্যাসের মধ্যে দাঁড়িয়ে যায়, আর তখন মন ধর্ম থেকে অলক্ষিত সরে যায়, আর লোকে ঐ অভ্যাসটাকেই ধর্ম বলে ভুল করে।” অবনীভূষণ কথাটাকে প্রথমে রসিকতা বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন আবিষ্কার করলেন যে, প্যারীলালের কথাটা সম্পূর্ণ সত্য। তাঁর মনে হল যে, তাঁর স্ত্রী-দেবতার পূজা-ব্যাপারটা ক্রমে প্রেমের একটা মন্ত্রপড়া ও ঘণ্টানাড়ার ব্যাপারে পরিণত হচ্ছে, আর তিনি তাঁর আসল কর্তব্যগুলি উপেক্ষা করছেন। স্কুল ও হাসপাতালের উন্নতিকল্পে তিনি শুধু টাকা দিচ্ছেন, দিচ্ছেন না। আর টাকা যে দিচ্ছেন, সে শুধু অনায়াসে তা দিতে পারেন বলে। আর এ অর্থও তাঁর স্বোপার্জিত নয়—উত্তরাধিকারসূত্রে পূর্বপুরুষের নিকট প্রাপ্ত। প্যারীলাল তাঁকে বলে গিয়েছিলেন, “দেখো যেন এর কর্তব্য থেকে কখনো ভ্রষ্ট হোয়ো না। প্যারীলাল স্কুল প্রতিষ্ঠা করবার প্রস্তাব শুনে প্রথমে হেসে বলেছিলেন যে, “অবনীভূষণ, তুমি যা করতে চাও সে বস্তু কী, জান? লাঙল ঠেলবার যন্ত্রকে কলম ঠেলবার যন্ত্রে পরিণত করবার কারখানা। কিন্তু এ কারখানা খুলতে তুমি যখন কৃতসংকল্প হয়েছ, তখন তাই করাই তোমার কর্তব্য। কর্তব্য পালন করার ভিতর কোনো সুখ নেই। কিন্তু সুখ নেই বলেই কর্তব্যসাধন হচ্ছে নিজের ক্ষুদ্র অহং-এর বন্ধন থেকে লৌকিক মুক্তির সহজ উপায়। কারণ মানুষের লৌকিক কর্তব্যগুলি তার মনের সীমা নির্দিষ্ট করে দেয়; সে সীমা অতিক্রম করলেই মানুষের মন অসীমের মধ্যে দিশেহারা হয়ে পড়ে, আর তখন তার কর্মজীবন ব্যর্থ হয়।”

‘লৌকিক মুক্তি’র অর্থ কি জিজ্ঞাসা করায় প্যারীলাল বলেছিলেন যে, “এ যুগে যুগধর্ম অনুসারে সবিকার সমাজব্রহ্মে লীন হওয়াই পরম পুরুষার্থ—নির্বিকার পরব্রহ্মে নয়।”

প্যারীলালের কথাটা কতটা সত্য আর কতটা রসিকতা তা না বুঝলেও স্ত্রৈণ হওয়াটাই যে পরম পুরুষার্থ নয়, এ কথাটা অবনীভূষণ হৃদয়ঙ্গম করলেন, এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত স্কুল ও ডাক্তারখানার উন্নতিসাধন করাই যে তাঁর মুখ্য কর্তব্য, সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ হলেন।

এর পর অবনীভূষণ আবার তাঁর স্কুল ও ডাক্তারখানার মাজাঘসার কাজে পুরোদমে লেগে গেলেন। নূতনত্বের মধ্যে এই হল যে, তিনি তাঁর স্ত্রীকে যে-সব বিষয় শিক্ষা দিতেন, সেই-সব বিষয়ে স্কুলে শিক্ষকতা করতে আরম্ভ করলেন। কিন্তু কিছুদিনে আবার আবিষ্কার করলেন যে, এ কর্তব্যপালনে তাঁর সুখও নেই, সন্তোষও নেই, সম্ভবত সার্থকতাও নেই। তাঁর স্ত্রী যেরকম একাগ্রমনে তাঁর কাছে পাঁচরকম লেখাপড়া শিখতেন, স্কুলের ছাত্রদের মধ্যে একজনেরও সে মন নেই, সে আগ্রহ নেই। ক্রমে তাঁর জ্ঞান হল যে, তিনিও যেমন শিক্ষাদান করা শুধু একটা অপ্রিয় কর্তব্য হিসেবে ধরে নিয়েছেন, ছেলেরা শিক্ষালাভটাও তেমনি একটি অপ্রিয় কর্তব্য হিসেবে গ্রাহ্য করে নিয়েছে। তাদের শিক্ষা সম্বন্ধে কোনো মনের টান নেই। ফলে তাঁর পক্ষে শিক্ষাদান করাটাও যেমন নিরানন্দ ব্যাপার, ছেলেদের পক্ষে শিক্ষালাভ করাটাও তেমনি নিরানন্দ ব্যাপার, এবং সেইসঙ্গে তাঁর মনে হল যে, প্যারীলাল যে শিক্ষকতার পেশা ছেড়ে দিয়েছেন, তার কারণ বোধ হয় তিনি যেদিন বুঝলেন ও-জাতীয় শিক্ষার ভিতর কোনো আনন্দ নেই— না মাস্টারদের না ছাত্রদের, সেদিন থেকে এ ব্যাপারের দিকে পিঠ ফিরিয়েছেন। ছাত্রদের মনে যদি তাঁর স্ত্রীর মতো শিক্ষালাভের জন্য আকুলতা থাকত তা হলে শিক্ষা দেবার একটা সার্থকতা থাকত। এর থেকে তাঁর মনে হল যে, শিক্ষা যথার্থ নিতে পারে মেয়েরা, আর দিতে পারে পুরুষে। এর পর তিনি নিশ্চয়ই একটি Girls’ School প্রতিষ্ঠা করতেন, যদি না তাঁর মনে পড়ে যেত যে, প্যারীলাল বলেছিলেন, সব মেয়ে তাঁর স্ত্রীর প্রকৃতির নয়—অনেকে বরং তার উল্টো প্রকৃতির।

অবনীভূষণ ক্রমে এ বিষয়ে নিঃসন্দেহ হলেন যে, স্কুলমাস্টারি করার ভিতর অপরের কোনো সার্থকতা থাকতে পারে, কিন্তু তাঁর নেই। সুতরাং স্কুল তাঁর সমানভাবেই চলতে লাগল, শুধু তিনি শিক্ষকতা থেকে অবসর নিলেন। এ কাজ তিনি অনায়াসেই করতে পারলেন, কারণ তিনি ছিলেন তাঁর স্কুলের একটি অবৈতনিক এবং উপরি মাস্টার।

আর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর হাসপাতালের মোহও কেটে গেল। ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয়ের ফলে দুটি বিষয় সম্বন্ধে তার জ্ঞানলাভ হল—এক রোগ আর দ্বিতীয় মৃত্যু। মানুষের রোগযন্ত্রণা আর তার পর মৃত্যু তাঁর মনকে নিতান্ত অভিভূত করে ফেলল। বিশেষত তাঁর স্কুলের সবচেয়ে ভালো ছেলে শ্রীশংকর যখন বসন্তরোগে অশেষ যন্ত্ৰণা ভোগ করে অবশেষে মারা গেল, তখন তাঁর মন ঘোর বিষাদে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল। তাঁর মনে হল, তাঁর স্ত্রীও একদিন হয়তো ঐ ভাবে অকস্মাৎ মারা যেতে পারে। এ কথা মনে উদয় হবামাত্র তাঁর কাছে পৃথিবীটা একটা মহাশ্মশানে পরিণত হল, যার নীচে শুধু ছাই আর উপরে ধোঁয়া। পৃথিবীতে মৃত্যু আছে জেনেও মানুষে যে কি করে হেসে-খেলে কাজকর্ম করে বেড়ায়, এ ব্যাপারটা তাঁর কাছে বড়োই অদ্ভুত মনে হল। প্যারীলাল হয়তো তাঁর জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা থেকে এ সত্যের উপলব্ধি করেছিলেন। তাই প্যারীলালের মতে ভবযন্ত্রণা থেকে মুক্তির দুটিমাত্র উপায় আছে— এক আর্ট, আর-এক ধর্ম। কারণ এ দুটি বস্তুই মৃত্যুকে অতিক্রম করে, এবং মতকেও অমৃতলোকে পরিণত করে। এর পর অবনীভূষণ মনস্থির করলেন যে, তিনি ধর্মের শরণাপন্ন হবেন— যে ধর্মকে তিনি এতদিন উপেক্ষা করে আসছিলেন। অতএব তিনি আদ্যোপান্ত শ্ৰীমদ্ভাগবত পাঠ করবেন সংকল্প করলেন। এ শাস্ত্রের সন্ধানও তাঁকে প্যারীলাল দিয়েছিলেন। ভাগবত তাঁর লাইব্রেরিতেই ছিল, কিন্তু সে বই আর তাঁর পড়া হল না।

অনলাইনে বেস্টসেলিং বই কিনুন

এই সময় একটি এমন ঘটনা ঘটল যাতে করে অবনীভূষণ মনের ও জীবনের গতি নূতন পথে চলে গেল। এ নূতন পথ সর্বনাশের পথ।

রায়নগরের সন্নিকট কৃষ্ণপুরে জমিদার কামদাপ্রসাদের কন্যার বিবাহের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে অবনীভূষণ কৃষ্ণপুরে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। বাধ্য হয়েছিলেন বলছি এই কারণে যে, কামদাপ্রসাদের জীবনযাত্রা ছিল সেকেলে ধরনের। দেশের ও দশের জন্য নূতন কিছু করা কামদাপ্রসাদ একদিনের জন্যও নিজের কর্তব্য বলে মনে করেন নি। তাঁর জীবন ছিল পুরোমাত্রায় বিলাসীর জীবন। তিনি বারোমাস গাইয়ে বাজিয়ে মোসাহেব ও ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতের দ্বারা পরিবৃত থাকতেন—অর্থাৎ তাঁর জীবনের একমাত্র কাজ ছিল আমোদপ্রমোদের চর্চা। অথচ সামাজিক লোকের তিনি অতি প্রিয়পাত্র ছিলেন; কারণ তিনি প্রজাদের উপর কখনো অত্যাচার করেন নি, কাউকে কখনো রূঢ় কথা বলেন নি, গরিবদুঃখী গুরুপরোহিতকে যথেষ্ট দান করতেন; এবং কন্যাদায় মাতৃদায়- গ্রস্ত নিঃস্ব গৃহস্থদের মুক্তহস্তে সাহায্য করতেন। কামদাপ্রসাদের এই-সব হালচাল অবনীভূষণ মোটেই পছন্দ করতেন না। তদ্‌ব্যতীত এই বিলাসী জীবনকে ভয় করতেন। বিশেষত প্যারীলাল তাঁকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে, বিলাসিতার একটা বিষম নেশা আছে, এবং যে লোক এ জীবনে অভ্যস্ত নয় ও যার প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিত নয়, বিলাসের নেশা তাকে সহজেই পেয়ে বসে; যেমন যে লোক মদ্যপানে অভ্যস্ত নয়, এক গেলাসই তার মাথায় চড়ে যায়, আর তখন দ্বিতীয় গেলাসের পিপাসা তার অদম্য হয়ে ওঠে। এ সত্ত্বেও তিনি এ নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে বাধ্য হলেন, কেননা কামদাপ্রসাদ তাঁর স্বসম্প্রদায়ের লোক, উপরন্তু আত্মীয়।

এই বিবাহবাসরে বিখ্যাত বাইজি বেনজীরের মুখে একটি মহলারের ঠুংরি শুনে তিনি মুগ্ধ হয়ে গেলেন। তার গানের মৃদু টান ও সূক্ষ্ম তানগুলি তাঁর হৃদয়কে স্পর্শ করে তার একটি রুদ্ধ দ্বার খুলে দিলে, এবং সেইসঙ্গে একটি আনন্দময় জগৎ তাঁর মনের দেশে আবির্ভূত হল। তাঁর মনে হল যে, প্যারীলালের হাতে পড়লে সেতারের যে-সব অতিকোমল মিড় প্রাণকে স্পর্শ করত, বেনজীরের গলায় তদনুরূপ সূক্ষ্ম মিড় সব অধিষ্ঠান করেছে। প্যারীলাল বলতেন যে-সংগীতের স্থূলদেহ আমাদের শ্রবণেন্দ্রিয়কে স্পর্শ করে, আর তার সূক্ষ্মশরীরই আমাদের মর্ম স্পর্শ করে। তাই সংগীত যখন আমাদের কানের কাছে মুমূর্ষু হয়, তখন তা আমাদের প্রাণের কাছে জীবন্ত হয়ে ওঠে। কারণ পৃথিবীতে যা ব্যক্ত তা ইন্দ্রিয়ের বিষয়, যা অব্যক্ত তা মনের বিষয়, আর যা অর্ধব্যক্ত তা যুগপৎ ইন্দ্রিয় ও মনের অর্থাৎ প্রাণের বিষয়। অবনীভূষণ মনে মনে স্বীকার করলেন যে, প্যারীলালের কথা সত্য। কিন্তু প্যারীলালের সেতার তো তাঁর মনকে কখনো এ ভাবে স্পর্শ করে নি, কোনো নূতন আকাঙ্ক্ষা উদ্রেক করে নি। এর কারণ বোধ হয় স্ত্রীকণ্ঠের মধ্যে এমন কোনো রহস্য আছে যা তারের যন্ত্রে নেই। সব স্ত্রীলোক যে এক প্রকৃতির জীব নয়, এ কথা তিনি প্যারীলালের মুখে পূর্বেই শুনেছিলেন। এইবার স্পষ্ট অনুভব করলেন যে, স্ত্রীজাতির মোহিনীশক্তিও বিচিত্র এবং নানামুখী। বেনজীরও ছিল সুন্দরী, কিন্তু তার রূপকে ফুটিয়ে তুলেছে তার আর্ট। অবনীভূষণের বিশ্বাস হল যে, আর্ট হচ্ছে সেই বস্তু যা প্রকৃতির প্রচ্ছন্নরূপ প্রকাশ করে।

এর পর বেনজীরের সঙ্গে অবনীভূষণের কি কথাবার্তা হল জানি নে। কিন্তু এই কথোপকথনের ফলে বেনজীর বিবাহান্তে আর কলকাতায় ফিরে গেল না; রায়নগরে অবনীভূষণের Guest Houseএ এসে অধিষ্ঠিত হল। আর অবনীভূষণও নিত্য তার সংগীতসুধা পান করতে লাগলেন। ফলে বেনজীর তাঁর দ্বিতীয়পক্ষের স্ত্রী হয়ে উঠল। তাঁর স্ত্রী হল তাঁর ধর্মপত্নী, আর বেনজীর তাঁর রূপপত্নী।

১০

বেনজীর অবশ্য কুলবধূ ছিল না। সে ছ মাস পরেই চলে গেল। মজলিস, বহুশ্রোতা ও সমজদারের বাহবার অভাব অবনীভূষণের অর্থ পূরণ করতে পারল না; অবনীভূষণ তখন দ্বিতীয় সুধাপাত্রের জন্য পিপাসিত হয়ে উঠলেন; ফলে দ্বিতীয়ের পর তৃতীয়, তৃতীয়ের পর চতুর্থ ইত্যাদি ক্রমে তাঁর পাত্রের পর পাত্র আমদানি হতে লাগল। আমাদের মতে তিনি একেবারে অধঃপাতে গেলেন। শেষটায় তাঁর দশা এই হল যে, তিনি শ্যাম্পেনের সাধ ধেনোয় মেটাতে আরম্ভ করলেন।

কিন্তু দিনের পর দিন তিনি মনের শান্তিও হারাতে লাগলেন। স্ত্রীজাতির প্রতি আসক্তি তাঁর দেহমনের যে একটা বিশ্রী অভ্যাসে পরিণত হচ্ছে, সে বিষয়ে মনে আর কোনো সন্দেহ রইল না। কারণ অবনীভূষণ যতই অধঃপাতে যান-না কেন, তাঁর কাণ্ডজ্ঞান একেবারে লোপ পায় নি, এবং মনের সুপ্রবৃত্তিগুলি একেবারে নির্মূল হয় নি। তাঁর এই নূতন মত্ততা তাঁর সমস্ত মনকে অভিভূত করতে পারে নি। তাঁর স্ত্রীর প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ও অনুরাগ এই সময়ে বেড়েছিল বৈ কমে নি। কারণ, এ কথা তিনি জানতেন যে, তাঁর নবপ্রণয়িনীর দল কেহই শ্রদ্ধার পাত্রী নন, আর এদের কারো কাছ থেকে তিনি যথার্থ ভালোবাসা পান নি। অথচ তিনি এই-সব রক্তমাংসের পুতুলদের মায়া কাটাতে পারতেন না। তাঁর মন নিজের প্রতি ধিক্কারে ভরে উঠল। এ অবস্থায় তাঁর মনে হল যে যদি কেউ তাঁকে এ পঙ্ক থেকে উদ্ধার করতে পারেন তো সে প্যারীলাল। কিন্তু প্যারীলাল যে কোথায় কোন্ দেশে তার সন্ধান কেউ জানে না। অতঃপর তিনি প্যারীলালের শুভাগমনের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলেন

১১

এ দিকে অবনীভূষণের চরিত্রের যত অবনতি ঘটতে লাগল, তাঁর স্ত্রীর মনের চরিত্র তত তাঁর অন্তর্নিহিত সৌন্দর্যে ফুটে উঠতে লাগল; তাঁর স্বামীদেবতা অপদেবতায় পরিণত হওয়ায় তাঁর মন অবশ্য অত্যন্ত পীড়িত হল, কিন্তু এই পীড়াই তাঁর চরিত্রের সুপ্তশক্তিকে জাগিয়ে তুললে। অবনীভূষণের স্ত্রীপূজা তিনি কখনোই প্ৰফুল্লমনে গ্রাহ্য করতে পারেন নি। তিনি জানতেন তিনি মানুষ— দেবতা নন। এবং পরকে ভালোবাসা ও পরের জন্য আত্মোৎসর্গ করবার প্রবৃত্তিও মানবধর্ম। তিনি কোনোকালেই স্বামীর কাছ থেকে পূজা চান নি, স্বামীকেই পূজা করতে চেয়েছিলেন। তা ছাড়া স্বামীস্ত্রীতে কপোত- কপোতীর মতো মুখে মুখ দিয়ে বসে থাকাটা তাঁর কোনোকালেই মনোমত ছিল না। তিনি চাইতেন কাজ করতে, আর-পাঁচ জনের সেবা করতে। তাঁর স্বামীর এই স্ত্রীমোহটা তাঁর কাছে চিরদিনই বিপজ্জনক মনে হত। ধনীর সন্তানের বনিতাবিলাস তাঁর কাছে মনে হত তাদের কর্মহীনতার একটা বিশেষ প্রকাশমাত্র; আর এ বিলাস কাকে যে কোন্ বিপথে টেনে নিয়ে যাবে কে বলতে পারে? তবে অবনীভূষণ যে আর-পাঁচ জন ধনী ব্যক্তির জাত নন, এ বিশ্বাস তাঁর ছিল। সুতরাং আর-পাঁচ জন অপদার্থ লোকের কপালে যে দুর্দশা ঘটে, অবনীভূষণ যে সেরূপ দুর্দশাপন্ন হবেন, সে ভয় তাঁর ছিল না। তাই অবনীভূষণের চরিত্রবিকারের পরিচয় পেয়ে তিনি নিতান্ত কাতর হয়ে পড়লেন ও ধর্মকর্মে মনোনিবেশ করলেন। এর ফলে তাঁর মনে নূতন শক্তি, নূতন সৌন্দর্য জন্মলাভ করলে। তিনি ছিলেন মানবী, হয়ে উঠলেন দেবী। তখন তাঁর প্রশান্ত স্নিগ্ধ করুণ দৃষ্টি যার উপরে পড়ত তাকেই পবিত্র করে তুলত।

এ-সব কথা আমি অবনভূষণের মুখেই শুনেছি— কী অবস্থায় আর কী সূত্রে, তা পরে বলছি।

১২

অনেকদিন অবনীভূষণের কোনো খবর পাই নি, নিইও নি। ইতিমধ্যে আমি স্কুলমাস্টারি থেকে প্রফেসারি-পদে প্রমোশন পাই, আর ছেলে-পড়ানো ছাড়া অপর কোনো বিষয়ে মন দেবার অবসর ছিল না। হঠাৎ একদিন অবনীভূষণের কাছ থেকে আবার এই চিঠি পাই—

“আমি এখন নিতান্ত একা হয়ে পড়েছি। জানই তো আমি নিঃসন্তান, তা ছাড়া আমার স্ত্রীও ইহলোক ত্যাগ করেছেন। আমিও সংসার ত্যাগ করব মনে করেছি, কিন্তু তার পূর্বে বিষয়সম্পত্তির একটা সুব্যবস্থা করতে চাই যাতে আমার পৈতৃক ধনের আর- পাঁচ জনে সদ্বব্যবহার করতে পারে। এ বিষয়ে আমি তোমার পরামর্শ চাই। তুমি যদি একবার এখানে এসো তো বড়ো ভালো হয়।”

এ চিঠি পেয়ে আমি কদিনের ছুটি নিয়ে রায়নগর গেলুম। গিয়ে দেখি অবনীভূষণের চেহারা এতটা বদলে গিয়েছে যে তাঁকে দেখে আমাদের সেই কলেজি বন্ধু বলে আর চেনবার জো নেই। তাঁর শরীর অসম্ভব রকম শীর্ণ ও জীর্ণ হয়ে পড়েছে— আর তাঁর চোখে একটা আলেয়ার আলো থেকে থেকে জ্বলে উঠছে ও নিবে যাচ্ছে।

তিনি আমাকে দেখবামাত্রই তাঁর চরিত্রবিকারের ইতিহাস বললেন, যে ইতিহাস আমি পূর্বেই তোমাদের বলেছি। তার পর যখন তিনি অধোগতির চরম দশায় উপস্থিত হয়েছেন, তখন হঠাৎ একদিন প্যারীলাল এসে উপস্থিত হলেন। তিনি এসেই অবনীকে দেখে হেসে বললেন, “তুমি নাকি এখন রাজা প্রিয়ব্রতের মতন মনে মনে বলছ-

অহো অসাধ্বনুষ্ঠিতং যদভিনিবেশিতোহহমিন্দ্রিয়ৈরবিদ্যারচিতবিষমবিষয়ান্ধ–কূপে তদলমলমমূষ্যা বনিতায়া বিনোদমৃগং মাং ধিন্ধিগিতি গর্হয়াঞ্চকার!”

তাঁর কথা শুনে অবনী অবাক হয়ে গেল দেখে তিনি বললেন, “ভাগবতে পড় নি যে, পরম লোক-হিতৈষী প্রিয়ব্রত রাজা প্রজার অশেষ হিতসাধন করে শেষটায় বনিতার বিনোদ-মৃগ হয়ে নিজেকে এই বলে ধিক্কার দিয়েছিলেন। তার পর ভগবদ্‌ভক্তির প্রসাদে এই বনিতাবিলাসরোগ-মুক্ত হয়েছিলেন। তোমার মনে যখন ধিক্কার জন্মেছে, তখন তুমিও এ রোগ থেকে মুক্ত হবে; তবে ভগবদ্‌ভক্তির কৃপায় নয়, কারণ তোমার মতো লোকের মনে ভগবদ্‌ভক্তি উদ্রেক করা অতি কঠিন। তোমার পক্ষে যা প্রয়োজন, সে হচ্ছে তান্ত্রিক সাধনমার্গ। যে প্রবৃত্তি তোমাকে এ পথে নিয়ে গিয়েছে, সে প্রবৃত্তির চরম সার্থকতা লাভ করলেই তুমি এ রোগ থেকে মুক্ত হবে। এ বিশ্বের অন্তরে একটি নায়িকা আছেন, এ বিশ্ব যাঁর স্থূলদেহ; আর পৃথিবীর নায়িকামাত্রই তাঁর অংশাবতার। তাঁর দর্শনলাভ করলেই তোমার রূপপিপাসা সম্পূর্ণ চরিতার্থ হবে। এ-সব হয়তো তুমি বিশ্বাস করছ না, কারণ, এ দর্শনস্পর্শন জাগ্রত চৈতন্যের অধিকারবহির্ভূত। কিন্তু এ কথা তো মান যে, মানুষের অন্তরে একটি অধঃচৈতন্য আছে? তেমনি তার অন্তরে একটি ঊর্ধ্বচৈতন্যও আছে। আমরা যাকে আর্ট ও ধর্ম বলি, তা এই ঊর্ধ্বচৈতন্যগোচর। রক্তমাংসের সম্পর্ক অধঃচৈতন্যের সঙ্গে ও রূপের সম্পর্ক ঊর্ধ্বচৈতন্যের সঙ্গে। আর দেশকালের অতীত এই নায়িকার ঊর্ধ্বচৈতন্যেই দর্শনলাভ ঘটে; আর এ সাধনমার্গে তুমি নায়িকাসিদ্ধ হবে। আমি যে এ সিদ্ধিলাভ করি নি, তার কারণ এক পক্ষ ধরে কঠোর ব্রহ্মচর্য আমি পালন করতে পারি নি। আমার বিক্ষিপ্তচিত্ততা আমার সকল সাধনা ব্যর্থ করেছে। তাই আমি সংসারে অনাসক্ত, কিন্তু কোন্ অপার্থিব বস্তুর প্রতি আসক্ত, তা ঠিক জানি নে।”

প্যারীলালের কথায় অবনীভূষণ কী সাধনপদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন, তা আর আমাকে বললেন না। তাঁর কথার ভাবে বুঝলুম যে, কোনোরূপ বীভৎস প্রক্রিয়া তাঁকে করতে হয় নি, যা করতে হয়েছিল তা আগাগোড়া মানসিক প্রক্রিয়াই। শুধু এই পর্যন্ত বললেন যে, মাসাবধি কাল কোনো স্ত্রীলোকের মুখদর্শন তাঁর পক্ষে নিষিদ্ধ ছিল। এ সাধনায় সিদ্ধিলাভ করলেই নাকি সাধকের নখদর্পণে সেই দেশকালের অতীত নায়িকার মূর্তি স্পষ্ট ফুটে ওঠে।

অবনীভূষণ একাগ্রমনে এ সাধনা করেছিলেন। এমন-কি, তাঁর স্ত্রী কঠিন হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও, তিনি তাঁর ব্রতভঙ্গ করেন নি। যেদিন তাঁর স্ত্রীর মৃত্যু হল, সেইদিনই তিনি সিদ্ধিলাভ করলেন। স্ত্রীর মুখাগ্নি করে এসে তিনি নখের বস্ত্রাবরণ মুক্ত করে দেখেন যে, নখদর্পণে তাঁর স্ত্রীর অপরূপ সুন্দর ও করুণ দিব্যমূর্তি ফুটে উঠেছে।

এ ছবি নাকি ধুলেও যায় না, অথচ অপর কেউই তা দেখতে পায় না, এক স্বয়ং সাধক ব্যতীত।

এ-সব কথা শুনে মনে হল যে, অবনীভূষণ বনিতাবিলাসরোগ-মুক্ত হয়ে উন্মাদ হয়েছেন, আর সেইসঙ্গে প্রমাণ পেলুম যে, প্যারীলাল শুধু বশীকরণের নয়, মারণ- উচাটনেরও মন্ত্র জানেন; কারণ, অবনীভূষণের উন্মাদ আর স্ত্রীর অকালমৃত্যু, দুই-ই প্যারীলালের মন্ত্রতন্ত্রের ফল।

এরপর অবনীভূষণকে কোনোরূপ সাংসারিক উপদেশ দেওয়া বৃথা জেনে আমি বললুম, “তোমার ধনসম্পত্তি তুমি তোমার মন্ত্রদাতা গুরুর হাতেই সমর্পণ করো, তিনি তার সদ্‌ব্যবহার করবেন।” উত্তরে অবনী বললেন, “এ প্রস্তাব আমি প্যারীলালের কাছে করেছিলুম; তিনি তা শোনবামাত্রই প্রত্যাখ্যান করলেন এই বলে যে, ‘ডান হাতে যদি কাঞ্চন ধরি তো বাঁ হাতে আবার কামিনী এসে পড়বে, আর এ উভয় সীমার মধ্যে আবদ্ধ হয়ে পড়ার চাইতে অসীমের মধ্যে দিশেহারা হওয়া শতগুণে ভালো, কিন্তু শ্রেয় নয়।’

অবনীভূষণের এ কথা শুনে আমি অবাক হয়ে গেলুম; কারণ বুঝলুম যে, প্যারীলালের মুখের কথা শুধু paradox নয়, লোকটা স্বয়ং একটি জীবন্ত paradox!

ফাল্গুন ১৩৩৯


© 2024 পুরনো বই