কথারম্ভ
শ্রীকণ্ঠবাবু সেদিন তাঁর বৈঠকখানায় একা বসে গালে হাত দিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন ছিলেন, এমন সময়ে তাঁর বহুকালের অন্তরঙ্গ বন্ধু আনন্দগোপালবাবু হঠাৎ সেখানে এসে উপস্থিত হলেন। শ্রীকণ্ঠবাবু ঘরের ভিতর জুতার শব্দ শুনে চমকে উঠে সুমুখে আনন্দগোপালবাবুকে দেখে হাসিমুখে তাঁকে সম্বোধন করে বললেন, “কে, আনন্দগোপাল? কলকাতায় কবে এলে? আমি ভেবেছিলুম কে না কে। এসো বোসো— খবর কি?”
“ভালো। তোমার খবর কি?”
“ভালো।”
“আমি ভেবেছিলুম, তেমন ভালো নয়।”
“কিসের জন্য?”
“তোমার মুখ দেখে। গালে হাত দিয়ে কি ভাবছিলে?”
“কিছুই ভাবছিলুম না, শুধু অবাক হয়ে বসে ছিলুম।”
“কিসে অবাক হলে?”
“আমার ছেলেটার কথাবার্তা শুনে, তার ভবিষ্যৎ ভেবে।”
“কোন্ ছেলেটির?”
“যে ছেলেটা এবার বি. এল. পাস করেছে।”
“সে তো তোমার রত্ন ছেলে। দেহ-মনে ঠিক ফুলের মতো ফুটে উঠেছে। মনে আছে আমরা যখন কলেজে পড়তুম তখন একটা ল্যাটিন বুলি শিখি— Mens sana in corpore sano। সেকালে আমাদের ধারণা ছিল, একাধারে অন্তত এ দেশে ও-দুই গুণের সাক্ষাৎ পাওয়া অসম্ভব। কলেজে তোমার ছিল mens sana আর আমার corpore sano- তাই তো আমাদের দুজনের এত বন্ধুত্ব হল। তখন মনে হত, আমার দেহে যদি তোমার মন থাকত তা হলে পৃথিবীর কোনো নায়িকাই আমাকে দেখে স্থির থাকতে পারত না। এমন-কি, স্বয়ং ক্লিওপেট্রাও যদি আমাকে রাস্তায় দেখতে পেত তা হলে সেও তার প্রাসাদশিখর থেকে নক্ষত্রের মতো খসে এসে আমার বুকে সংলগ্ন হয়ে Star of India র মতো জ্বলজ্বল করত। কিন্তু আমার সেই যৌবনস্বপ্ন সাকার হয়েছে তোমার মধ্যমকুমার প্রফুল্লপ্রসূনে। তুমি যা সৃষ্টি করেছ তা একখানি মহাকাব্য; তোমার এ কুমার—নবকুমারসম্ভব। আমি মনে করতুম, এ যুগে ওরকম সৃষ্টি অসম্ভব।”
“দেখো আনন্দ, তোমার এ-সব রসিকতা আজ ভালো লাগছে না।”
“আমি যে-সব কথা বলছি, তার ভাষা ইষৎ রসিকতা-ঘেঁষা হলেও, আসলে সত্য কথা; প্রফুল্ল যে এক পদাঘাতে বিলেতি চামড়ার ফুটবল বিলেতি সাহেবদের মাথার উপর দিয়ে পাখির মতো উড়িয়ে দেয়, এ কথা কে না জানে। তারপর ইউনিভারসিটির ভেতর যতগুলি বেড়া আছে, সবগুলোই সে টপ্ টপ্ করে ডিঙিয়ে গেল। এগজামিনেশনের এতাদৃশ hurdle jump বাঙলার কটি ফুটবল-খেলিয়ে করতে পারে? শুধু তাই নয়, সে কবিতাও লেখে চমৎকার। সেদিন কল্লোল, কি কালিকলম, কি বেণু কি বীণা, এই রকম একটা কাগজে প্রফুল্লর লেখা ‘আকাঙ্ক্ষা-প্রসূন’ বলে একটি কবিতা পড়লুম।”
“তুমি ও-সব ছাইপাঁশও পড় নাকি?”
“পড়তে বাধ্য হই। থাকি পাড়াগাঁয়ে; করি জমিদারি; হাতে কাজ নেই আছে সময়। সেই সময় কাটাবার জন্যে ছেলেরা যত বই কেনে কিন্তু পড়ে না, সে সবই আমি পড়ি, নচেৎ টাকাগুলো যে মাঠে মারা যায়। দেখো, এই সূত্রে আমি একটা জিনিস আবিষ্কার করেছি। এ যুগে ইংরেজিতে যারা বই লেখে তারা একজনও ইংরেজ নয়, সব নরওয়ে সুইডেন ফিল্যাণ্ড ও আইল্যাণ্ডের লোক–আর সবাই জাতে বদ্যি, তাদের সবারই উপাধি সেন। যথা—ইবসেন, হামসেন, বিয়র্নসেন ইত্যাদি। সে যাই হোক, তোমার ছেলেরা সে কবিতা পড়ে আমারও মনে আকাঙ্ক্ষার ফুল ফুটে উঠল। এ ফুলের স্পষ্ট কোনো রূপ নেই, আছে শুধু বর্ণ আর গন্ধ। আর সে গন্ধ এমনি নতুন যে, তা বুকের নাকে ঢুকলে নেশা হয়। সে গন্ধ ক্লোরোফরমের দাদা। ঘুম-পাড়ানি মাসিপিসির চাইতে তা নিদ্রাকর্ষক। ও কবিতা দু-চার ছত্র পড়তে-না-পড়তে যে ঘুমিয়ে না পড়ে সে মানুষ নয়, দেবতা। আর ‘সবুজ পত্রে’ প্রফুল্লর লেখা একটা ছোটো গল্পও পড়েছি। এ গল্প আগাগোড়া আর্ট। সে তো গল্প নয়, নায়ক-নায়িকার হৃৎপিণ্ড নিয়ে অপূর্ব পিংপং- খেলা। সে হৃৎপিণ্ড দুটি এক মুহূর্তের জন্যও পৃথিবী স্পর্শ করে নি, বরাবর শূন্যেই ঝুলে ছিল—সূর্য চন্দ্র যেমন আকাশে ঝুলে থাকে, পরস্পরের প্রেমের টানে। শেষটায় এ প্রেমের খেলার ফল হল draw.”
“দেখো আনন্দ, তোমার বয়েস হয়েছে, কিন্তু বাজে বকবার অভ্যাস আজও গেল না। বরং তোমার যত বয়েস বাড়ছে তত বেশি বাচাল হচ্ছ।”
“তোমার ছেলের প্রশংসা শুনলে তুমি খুশি হবে মনে করেই এত কথা বললুম। কোনো বাপ যে ছেলের গুণগান শুনে এলে যেতে পারে এ জ্ঞান আমার ছিল না। আমার ছেলে যখন হারমোনিয়মে প্যাঁ পোঁ শুরু করে, তখন যদি কেউ বলে, ‘কেয়া মীড়’ তা হলে তো আমি হাতে স্বর্গ পাই এই ভেবে যে, আমি তানসেনের বাবা।”
“তুমি যাকে প্রশংসা বলছ, তার বাঙলা নাম হচ্ছে ঠাট্টা। আর এ ঠাট্টার মানে হচ্ছে, প্রফুল্ল যে কি চীজ হয়েছে তা আমি বুঝি আর না বুঝি, তুমি ঠিক বুঝেছ। তোমার এ-সব রসিকতা আমার গায়ে বেশি করে বিঁধছে এই জন্যে যে, আমি সত্যিই ভেবে পাচ্ছি নে—প্রফুল্ল fool না genius!”
“এ বড়ো কঠিন সমস্যা। Genius এর সঙ্গে fool এর একটা মস্ত মিল আছে; উভয়েই born, not made। এ উভয়ের প্রভেদ ধরা বড়ো শক্ত। তাই সাহিত্য- সমালোচকেরা নিত্য genius কে fool বলে ভুল করে, আর fool কে genius বলে।”
“Genius এর সঙ্গে insanityর সম্বন্ধ কি সে মহাসমস্যা নিয়ে মাথা বকাচ্ছিলুম না।”
“তবে কিসের ভাবনা ভাবছিল? দেখো, লোকে যাকে বলে ভাবনা, সেটা হচ্ছে আসলে ভাষার অভাব। Freud প্রমাণ করে দিয়েছেন যে, repressed speech থেকেই মানুষের মনে যে রোগ জন্মায় তারই নাম চিন্তা। মন খুলে সব কথা বলে ফেলো—তা হলেই ভাবনার হাত থেকে অব্যাহতি পাবে।”
“আমি ভাবছিলুম, আমার পুত্ররত্ন যা বললেন তা শুধু তাঁরই মুখের কথা, না, এ যুগের যুবক মাত্রেরই মনের কথা।”
“প্রফুল্ল কি বললে শোনা যাক; তা হলেই বুঝতে পারব, তা Vox dei কি vox populi.”
“ব্যাপার কি হয়েছে বলছি, শোনো। আজ সকালে গীতা পড়ছিলুম; একটা জায়গায় খটকা লাগল, তাই প্রফুল্লকে ডেকে পাঠালুম শ্লোকটার ঠিক মানে বুঝিয়ে দিতে।”
“গীতার অনেক কথায় মনে খটকা লাগে, কিন্তু সে-সব কথার তত্ত্ব অপরের মুখে শুনে বোঝবার জো নেই; অপরের কাজ দেখে হৃদয়ঙ্গম করতে হয়। যেমন আমি গীতার একটা বচনের হদিস পেয়েছি রায় ধর্মদাস ঘোষ বাহাদুরের জীবন পর্যালোচনা করে।”
“সে ভদ্রলোকটি কে?
“তিনি, যিনি পাটের ভিতর-বাজারে ফকা খেলে ধনকুবের হয়েছেন।”তিনি কি একজন গীতাপন্থী?”
“যা বলছি তা শুনলেই বুঝতে পারবে।”
“কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন—এ বচনটা আমার বরাবরই রসিকতা বলে মনে হত। কুলিগিরি করব, কিন্তু মজুরি পাব না—আমাদের ইংরেজি-শিক্ষিত মন এ কথায় সায় দেয় না; বরং আমরা চাই, মজুরি কড়ায়-গণ্ডায় বুঝে নেব, কিন্তু বসতে পেলে দাঁড়াব না, শুতে পেলে বসব না। কিন্তু ঘোষ বাহাদুর এই হিসেবে চলেছেন যে, অহর্নিশি দৌড়াদৌড়ি করে পয়সা কামাব, অথচ তার এক পয়সাও খরচ করব না; অর্থাৎ টাকা করবার তাঁর অধিকার আছে—মা ফলেষু কদাচন।”
“তোমার রসিকতা দেখছি আজ বে-পরোয়া হয়ে উঠেছে।”
“রসিকতা আমি করছি, না, তুমি করছ? তুমি ফিলজফিতে এম.এ. আর প্রফুল্ল বটানিতে। গীতা তুমি বুঝতে পার না, আর প্রফুল্ল শুধু বুঝবে না— উপরন্তু বোঝাবে! লোকে যে বলে—মোগল পাঠান হদ্দ হল ফার্সি পড়ে তাঁতি—সে কথাটা রসিকতা, না, আর-কিছু?”
“দেখো, আমরা যেকালে কলেজে পড়তুম, সেকালে গীতার রেওয়াজ ছিল না। আমরা বিলেতি দর্শন পড়েই মানুষ হয়েছি, তাই তার অনেক কথায় খটকা লাগে। আর গীতা আজকাল সবাই পড়ছে; সাহেবরা পড়ছে, বাঙালি সাহেবরা পড়ছে, মেয়েরা পড়ছে, মাড়োয়ারিরা পড়ছে। ও-দর্শন এখন হাওয়ায় ভাসছে। এর থেকে অনুমান করেছিলুম যে, আমার ছেলে ও-দর্শনের ভিতর আমার চাইতে বেশি প্রবেশ করেছে—বিশেষত সে যখন গীতার বিষয় মিটিংয়ে বক্তৃতা করে।”
“কি বললে! প্রফুল্ল বাবাজি কি আবার ধর্মপ্রচার শুরু করেছে না কি? আমি তো জানি সে এম. এ. বি. এল, তার উপরে সে sportsman, কবি, গল্পলেখক, পলিটিশিয়ান। উপরন্তু সে যে আবার বুদ্ধদেব ও যীশুখৃস্টের ব্যবসা ধরেছে, তা তো জানতুম না। আজকালকার ছেলেরা কি চৌকোস, আর তাদের কি wide culture! এরা প্রতিজনে একাধারে খেলায় ইংরেজ, পড়ায় জর্মান, বুদ্ধিতে ফরাসী, প্রেমে ইটালিয়ান, পলিটিক্সে রাশিয়ান। ইংরেজরা আমাদের স্বরাজ দিলে, তা নেবে কে—এই ভাবনায় আমার রাত্রিতে ঘুম হত না। এখন সে দুশ্চিন্তা গেল। আজ থেকে ঘুমিয়ে বাঁচব।”
কথা-মধ্য
“দেখো স্বরাজ আমার নিদ্রার ব্যাঘাত করে না বরং আমি ঘুমিয়ে পড়লেই স্বরাজ আমার কাছে আসে। কিন্তু প্রফুল্লর কথা ভেবে বোধ হয় আমার insomnia হবে। সে তোমার চাইতেও অদ্ভুত কথা বলে।”
“এটা অবশ্য ভয়ের কথা।”
“তুমি বল অদ্ভুত বাজে কথা, প্রফুল্ল বলে অদ্ভুত কাজের কথা।”
“তার কথা তবে শোনবার মতন।”
“তুমি তো কারো কথা শুনবে না, শুধু নিজে বকবে।”
“তুমি তোমাদের পরস্পরের কথোপকথন রিপোর্ট কর, আমি তা নীরবে শুনে যাব— যেমন নীরবে আমি খবরের কাগজের রিপোর্ট পড়ি।”
-আমি যখন তাকে শ্লোকটার অর্থ আমাকে বুঝিয়ে দিতে বললেম, তখন সে অম্লান বদনে বললে, ‘আমি গীতার এক বর্ণও পড়ি নি।” আমি জিজ্ঞেস করলুম, “তা হলে তুমি সেদিন মিটিংয়ে গীতা সম্বন্ধে অমন চমৎকার বক্তৃতা করলে কি করে—যার রিপোর্ট আমি কাগজে পড়লুম।’ প্রফুল্ল উত্তর করলে, ‘গীতার প্রতি আমার অগাধ ভক্তি আছে বলে।’ ‘যার বিন্দুবিসর্গ জান না, তার উপর তোমার অগাধ ভক্তি!’ সে উত্তর করলে, ‘ভক্তি জিনিসটা অজানার প্রতিই হয়।’
‘কিরকম?’
‘আপনি দেশের যত লোককে বড়োলোক বলে ভক্তি করেন, আপনি কি তাঁদের সবাইকে জানেন? আমি জানি আপনি তাঁদের কখনো চোখে দেখেন নি।’
‘হাঁ, তা ঠিক; কিন্তু আমি তাঁদের বিষয় খবরের কাগজে পড়েছি, লোকের মুখে শুনেছি।’
‘আমিও গীতার বিষয় কাগজে পড়েছি ও লোকের মুখে শুনেছি।’
‘তা হলে তোমার বক্তৃতা শুনে ও কাগজে তার রিপোর্ট পড়ে আর-পাঁচজন অজ্ঞ লোকের গীতার উপরে ভক্তি বাড়বে?’
‘অবশ্য। সেই উদ্দেশ্যেই তো বক্তৃতা করা।’
‘লোকের মনে ভক্তির এরকম মূলহীন ফুল ফোটাবার সার্থকতা কি?’
‘ও হচ্ছে nation-bulding এর একটা পরীক্ষোত্তীর্ণ উপায়।’
‘কি হেসেবে?”
‘General Bernhardi বলেছেন যে, জর্মানীর গত যুদ্ধের মূলে ছিল জর্মান ন্যাশনালাজিম, আর সে ন্যাশনালাজিমের মূলে আছে কাণ্ট ও গেটে। আপনি কি বলতে চান কাণ্ট ও গেটের সঙ্গে বার্হার্ডির বিশেষ পরিচয় ছিল?”
‘না। তিনি যখন বলেছেন যে, গত যুদ্ধের জন্য দায়ী কাণ্ট এবং গেটে তখন যে তাঁর ও-দুটি ভদ্রলোকের সঙ্গে কোনোরূপ পরিচয় নেই, তা নিঃসন্দেহ।’
‘তা হলেও তিনি কান্টের দর্শনের ও গেটের কবিতার সারমর্ম বুঝেছিলেন। কাণ্টের সারকথা হচ্ছে agnosticism, আর গেটেরও তাই—গীতারও তাই।’
‘মানছি যে agnosticismই হচ্ছে nation-building এর ভিত। কিন্তু গীতার ধর্ম যে agnosticism, এ কথা তোমাকে কে বললে?’
‘এ যুগে যারা গীতা গুলে খেয়েছে, সেই-সব expert-রা এ বিষয়ে একমত যে, গীতার প্রথম অংশে আছে utilitarianism, শেষ অংশে agnosticism, আর তার মধ্যভাগ প্রক্ষিপ্ত।’
‘তোমার expert বন্ধুরা যে গীতা গুলে খেয়েছেন সে বিষয়ে আর সন্দেহ নেই। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যে একাধারে মিল্ এবং স্পেন্সর—এ একটা নূতন আবিষ্কার বটে। তোমার expert গুরুরা আর-একটি সত্য আবিষ্কার করতে ভুলে গিয়েছেন, সেটি হচ্ছে, যাঁর নাম বুদ্ধদেব তাঁর নামই বার্টাণ্ড রসেল। যাক ও-সব কথা। এখন দেখছি তোমাদের কালিদাসকেও প্রচার করতে হবে।’
‘অবশ্য। আমি আসছে হপ্তায় কালিদাস সম্বন্ধে একটি বক্তৃতা করব।’
‘কোথায়?’
‘Youngman’s Hindu Association এ।’
‘অনুমান করছি, গীতার সঙ্গে তোমার পরিচয় যদ্রূপ, শকুন্তলার সঙ্গেও তোমার পরিচয় তদ্রূপ।’
আগেই তো বলেছি যে, সংস্কৃত সাহিত্য আমরা জানি নে বলেই তার প্রতি আমাদের ভক্তি আছে, জানলে তার প্রতি আমাদের অভক্তি হত।’
“নিশ্চয়ই তাই হত। কারণ, তখন বুঝতে পারতে যে, মিল্ ও স্পেন্সর শ্রীকৃষ্ণের অবতার নন~ন চ পূর্ণো ন চাংশকঃ; এবং কিপলিং কালিদাসের প্রপৌত্র নন। এখন আমি জানতে চাই যে, পূর্বপুরুষের নামের দোহাই দিয়ে নতুন নেশান কি করে গড়বে; ও উপায়ে পুরোনোকেই আর টিকিয়ে রাখা দুষ্কর।
‘অর্থাৎ আমাদের নূতন সাহিত্য গড়তে হবে। এ জ্ঞান আমাদের সম্পূর্ণ আছে। আমরা নূতন সাহিত্যই গড়ছি।’
‘কি সাহিত্য তোমরা গড়ছ?’ ‘কাব্যসাহিত্য।’
‘বুঝেছি, তোমরা আগে নব-গেটে হয়ে পরে নব-কাণ্ট হবে। পারস্পর্যের ধারাই এই—আগে কালিদাস পরে শংকর। তবে আমার ভয় এই যে, জ্ঞানের প্রতি সম্পূর্ণ উদাসীন হয়ে বড়ো কবি কি হতে পারবে?’
‘দেখুন, জ্ঞান মানে তো যা অতীতে হয়ে গিয়েছে, তারই জ্ঞান। অতীতের দিকে পিঠ না ফেরালে আমরা ভবিষ্যৎ গড়তে পারব না।’
‘আচ্ছা, ধরে নেওয়া যাক যে, কাব্যের সঙ্গে সরস্বতীর মুখ-দেখাদেখি নেই। কিন্তু তোমরা তো পলিটিক্স জিনিসটাকেও ঠেলে তুলতে চাও? আর তুমি কি বলতে চাও যে, জ্ঞানশূন্য না হলে পলিটিশিয়ান হওয়া যায় না?’
‘কোন্ জ্ঞান পলিটিক্সের কাজে লাগে?’
‘কিঞ্চিৎ হিস্টরির আর কিঞ্চিৎ ইকনমিকসের, অর্থাৎ ইংরেজরা যাকে বলে factsএর।
‘আমরা যখন নতুন হিস্টরি ও নতুন ইকনমিক্স গড়তে চাচ্ছি, তখন পুরোনো হিস্টরি ও পুরানো ইকনমিক্সের জ্ঞান আমাদের উন্নতির পথে শুধু বাধাস্বরূপ। আর facts এর জ্ঞান যে idealism এর প্রধান শত্রু, তা তো আপনি মানেন? আমরা এ ক্ষেত্রে করতে চাই শুধু idealism এর চর্চা—’
Idealism জিনিসটে যে মস্ত জিনিস, তা আমিও স্বীকার করি; কিন্তু শুধু ততক্ষণ— যতক্ষণ তা কথামাত্র থাকে। তাকে কাজে খাটাতে গেলেই তার মানে ধরা পড়ে।’
‘আচ্ছা, একটা কাজের কথাই বলা যাক। রামকে কাউন্সিলে পাঠাতে হবে কিম্বা শ্যামকে, হিস্টরির জ্ঞান তার কি সাহায্য করবে? যার মনে idealism আছে, সেই শুধু রামের বদলে শ্যামের জন্য খাটতে প্ৰস্তুত।’
‘এই ভোট জোগাড় করার ব্যাপারটার নাম idealism?’
‘অবশ্য। এ কাজ করবার জন্য আহার-নিদ্রা বাদ দিয়ে দৌড়াদৌড়ি করে শরীর ভাঙতে হয়; Vote for শ্যাম বলে চিৎকার করে গলা ভাঙতে হয়। আর যে কাজ করবার জন্য চাই মন্ত্রের সাধন কিম্বা শরীরপাতন, তারই নাম তো idealism।’
‘ধর্ম কাব্য পলিটিক্স সম্বন্ধে তোমার জ্ঞান যে সমান সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। এখন জিজ্ঞাসা করি, তোমার আইনের জ্ঞানও কি সমান?’
‘আপনি কি জিজ্ঞাসা করছেন বুঝতে পারছি নে।’
‘আমি জানতে চাই, আইন কিছু জান—কি জান না?”
‘আইনের কতকগুলো কথা জানি, তার বেশি কিছু জানি নে।’
‘তবে বি. এল. পাস করলে কি করে?’
‘নোট মুখস্থ করে। বই পড়লে ফেল হতুম।’
‘আইন কিছু না জেনে universityর পরীক্ষা তো পাস করলে; কিন্তু ঐ বিদ্যে নিয়ে আদালতের পরীক্ষা পাস করবে কি করে?’
‘আদালতে পরীক্ষা করবে কে?’
‘জজ-সাহেবরা।’
‘আপনি বলতে চান, যারা জজ হয়, তারা সবাই আইন জানে? একালে যার পেটে বিদ্যে আছে, সে তো জজ হতে পারে না। সুতরাং একেলে জজের কাছে প্র্যাকটিস্ করতে বিদ্যের দরকার নেই। পলিটিক্স ঠিক থাকলেই প্র্যাকটিস ঠিক হবে।’
‘কিরকম?’
‘জজিয়তি লাভ করবার জন্য চাই নরম পলিটিক্স, আর প্র্যাকটিস করবার জন্য গরম।’
‘আর যার পলিটিক্স নরমও নয় গরমও নয়, তার কি হবে?’
‘তার ইতোনষ্টস্ততোভ্ৰষ্টঃ।’
কথা-শেষ
শ্রীকণ্ঠবাবু অতঃপর বললেন যে, “এই-সব সদালাপের পর আমি প্রফুল্লকে বললুম, ‘এখন এসো’। এ কথা শুনে আনন্দগোপাল হেসে বললেন, “তার পরেই বুঝি তুমি দমে গেলে। আমি হলে তো উৎফুল্ল হয়ে উঠতুম।”
“কেন?”
“তোমার ছেলে genius।”
“কিসে বুঝলে?”
“তার মতামত শুনে।”
“এ-সব মতামতের ভিতর কি পেলে?”
“প্রথমত নূতনত্ব, দ্বিতীয়ত বিশ্বাস।”
“বিশ্বাস! কিসের উপর?”
“নিজের উপর।”
“নিজের উপর অগাধ এবং অটল বিশ্বাস তো প্রতি fool এরই আছে।”
“কিন্তু সে বিশ্বাস শুধু একের এবং সে এক হচ্ছে স্বয়ং fool, কিন্তু যার আত্মবিশ্বাসের নীচে জনগণ ঢেরা-সই দেয় সেই তো superman।”
“তবে তুমি ভাব যে প্রফুল্লর মতামত শুধু একা তার নয়, যুবকমাত্রেরই?”
“বহুর মনে যা অস্পষ্টভাবে থাকে, তাই যার মনে স্পষ্ট আকার ধারণ করে সেই তো যুগধর্মের অবতার। জ্ঞান ভক্তির বিরোধী—এই তো পুরোনো কথা। আর, তা যে কর্মেরও প্রতিবন্ধক, এই হচ্ছে নবযুগবাণী। এ বাণীর জোর প্রচারক হবে তোমার মধ্যম-কুমার।”
“কি কর্ম এরা করতে চায়?”
“একসঙ্গে সরস্বতী ও ইলেকশানের বেগার খাটতে।”
“তাতে দেশের কি লাভ?”
“কোনো লোকসান নেই।”
“মূর্খতার চর্চায় কোনো লোকসান নেই?”
“যেমন তোমার-আমার মতো পাণ্ডিত্যের চর্চায় দেশের কোনো উপকারও হয় নি, তেমন এদের তার অ-চর্চায় কোনো অপকার হবে না।
“তা হলে দেশের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে তুমি নিশ্চন্ত?”
“দেখো, তোমার-আমার ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে কোনো কথা বলবার অধিকার নেই। তুমি-আমি যথাসাধ্য যথাশক্তি জ্ঞানের চর্চা করেছি, অর্থাৎ বই পড়েছি। আর প্রফুল্ল তো বলেই দিয়েছে যে জ্ঞান মানে হচ্ছে অতীতের জ্ঞান। অতএব আমাদের মুখে শোভা পায় শুধু অতীতের কথা।”
“তুমি দেখছি প্রফুল্লর একজন শিষ্য হয়ে উঠলে!”
“তার কারণ আমি মডার্ন।”
“এর অর্থ?”
“আমি অতীতেরও ধার ধারি নে, ভবিষ্যতেরও তোয়াক্কা রাখি নে। মনোজগতে দিন আনি, দিন খাই—অর্থাৎ যা পেটে পুরি; আমার পেটে সব যায়—প্রফুল্লরও কথা, গীতারও কথা।”
“তুমি দেখছি একজন মুক্তপুরুষ। শাস্ত্রে বলে, যে ব্যক্তি পরলোকে স্বৰ্গ চায় না, সেই মুক্ত। তুমি দেখছি ইহলোকেও স্বর্গরাজ্য চাও না। অতএব পুরো মুক্ত।”
“দেখো শ্রীকণ্ঠ, ভবিষ্যতের আলোচনা করতে করতে কলকেটা নিজের ধোঁয়া নিয়ে ফুঁকেই নির্বাণপ্রাপ্ত হল। অতএব ভবিষ্যতের কথা এখন মুলতবি থাক। বর্তমানে আর- এক ছিলেম তামাক ডাকো।”
এ কথা শুনে শ্রীকণ্ঠ বাবু ব্যস্ত-সমস্ত হয়ে চাকরকে শিগগির তামাক দিতে বললেন। চাকরও ব্যস্ত-সমস্ত হয়ে শিগগির কলকে বদলাতে গিয়ে সেটা উল্টে ফেললে, অমনি ফরাসে আগুন ধরে গেল। ধূম যে না-বলা কওয়া অগ্নিতে পরিণত হবে, এ কথা কেউ ভাবে নি। তাই দুই বন্ধুকে ব্যস্ত-সমস্ত হয়ে গাত্রোত্থান করলে, আর তাঁদের আলোচনা বন্ধ হল।
শ্রাবণ ১৩৩৪