শ্রীমান চিরকিশোর, কল্যাণীয়েষু-
আর পাঁচ জনের দেখাদেখি আমিও অতঃপর গল্প লিখতে শুরু করেছি, কেননা গল্প না লিখলে আজকাল সাহিত্য-সমাজে কোনোরূপ প্রতিষ্ঠা লাভ করা যায় না। ইতিপূর্বে যে লিখি নি তার কারণ, লেখবার এমন কোনো বিষয় দেখতে পাই নি যা পূর্ব-লেখকরা দখল করে না নিয়েছেন। শেষটা আবিষ্কার করলুম, বাঙলার গল্প-সাহিত্যে আদর্শপুরুষের সাক্ষাৎ লাভ করা বড়োই দুর্লভ, যা দুর্লভ তাই সুলভ করবার উদ্দেশ্যেই আমার এ গল্প লেখা। আমার হাতের প্রথম গল্পটি তোমাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি, যদি তোমার মতে সেটি উৎরে থাকে তা হলে পরে ঐ বিষয়ে একটি বড়ো গল্প লিখব। ক্রমে সাহস বেড়ে গেলে অবশেষে এই একই বিষয়ে, চাই কি একটি মহাকাব্যও লিখতে পারি। একটা কথা বলে রাখি, মানুষে যাকে সুন্দর বলে এ গল্পের ভিতর তার নাম-গন্ধও নেই—যদি কিছু থাকে তো আছে শিব। আর সত্য?—গল্পের ভিতর ও বস্তু সেই খোঁজে যে ইতিহাস ও উপন্যাসের ভেদ জানে না। তোমার দৃষ্টির জন্য এই সঙ্গে গল্পটির জাবেদা নকল পাঠাচ্ছি।
গল্প
প্রথম অঙ্ক
স্বভাব
বাঙলা দেশের একটি পাড়াগেঁয়ে-শহরে দুকড়ি দত্তের সহধর্মিনী যখন যমজ পুত্ৰ প্রসব করলেন, তখন দত্তজা মহাশয় ঈষৎ মনঃক্ষুণ্ণ হলেন। এ দুই ছেলে বড়ো হলে যে কত বড়ো লোক হবে, সে কথা জানলে তাঁর আনন্দের অবশ্য আর সীমা থাকত না। কিন্তু কি করে তিনি তা জানবেন? এই কলিকালে কারো জন্মদিনে তো কোনো দৈববাণী হয় না, অতএব বলা বাহুল্য তাদের জন্মদিনেও হয় নি ।
তবে ছেলে-দুটির বিষয়বুদ্ধি যে নৈসর্গিক এবং অসাধারণ, তার পরিচয় সেইদিনই পাওয়া গেল। তারা ভূমিষ্ঠ হতে-না-হতেই তাদের জননীকে আধাআধি ভাগ-বাটোয়ারা করে নিলে। একটি দখল করে নিলে তাঁর দক্ষিণ অঙ্গ, আর-একটি দখল করে নিলে তাঁর বাম অঙ্গ, এবং এই সুবন্দোবস্তের ফলে মাতৃদুগ্ধ তারা সমান অংশে পান করতে লাগল। মাতৃদুগ্ধ পান করবার প্রবৃত্তি ও শক্তির নামই যদি হয় মাতৃভক্তি, তা হলে স্বীকার করতেই হবে যে এই ভ্রাতৃযুগলের তুল্য মাতৃভক্ত শিশু ভারতবর্ষে আর কখনো জন্মায় নি। ফলে, তারা দুধ না ছাড়তেই তাদের মাতা দেহ ছাড়লেন—ক্ষয়রোগে।
এখানে একটি কথার উল্লেখ করে রাখা আবশ্যক। এরা দু ভাই এমনি পিঠপিঠ জন্মেছিল যে, এদের মধ্যে কে বড়ো আর কে ছোটো তা কেউ স্থির করতে পারলেন না। এইটেই রয়ে গেল এদের জীবনের আসল রহস্য, অতএব এ গল্পেরও আসল রহস্য। সে যাই হোক, কার্যত দুই ভাই শুধু একবর্ণ একাকার নয়, একক্ষণজন্মা বলে প্ৰসিদ্ধ হল।
শুভদিনে শুভক্ষণে তাদের অন্নপ্রাশন হল, এবং দত্তজা তাদের নাম রাখলেন—রাম ও শ্যাম। পৃথিবীতে যমজের উপযুক্ত এত খাসা খাসা জোড়া নাম থাকতে— যেমন নকুল-সহদেব, হরি-হর, কানাই-বলাই প্রভৃতি—রাম-শ্যামই যে দত্ত মহাশয়ের কেন বেশি পছন্দ হল তা বলা কঠিন। লোকে বলে, দত্তজা পুত্রদ্বয়ের আকৃতি নয়, বর্ণের উপরেই দৃষ্টি রেখে এই নামকরণ করেছিলেন। এই যমজের দেহের যে বর্ণ ছিল তার ভদ্র নাম অবশ্য শ্যাম। সে যাই হোক এটা নিশ্চিত যে, তাঁর পুত্রদ্বয় যে একদিন তাদের নাম সার্থক করবে, এ কথা তিনি স্বপ্নেও ভাবেন নি। এতে তাঁর দোষ দেওয়া যায় না। কারণ রাম-শ্যামের নামকরণের সময় আকাশ থেকে তো আর পুষ্পবৃষ্টি হয় নি!
অনেকদিন যাবৎ রাম-শ্যামের কি শরীরে কি অন্তরে মহাপুরুষসুলভ কোনোরূপ লক্ষণই দেখা যায় নি। তারা শৈশবে কারো ননী চুরি করে নি, বাল্যে কারো মন চুরি করে নি। তাদের বাল্যজীবন ছিল ঠিক সেই ধরনের জীবন, যেমন আর-পাঁচজনের ছেলের হয়ে থাকে। ছেলেও ছিল তারা নেহাত মাঝারি গোছের, কিন্তু তা সত্ত্বেও কৈশোরে পদার্পণ করতেন-না-করতে তারা স্কুলের ছেলেদের একদম দলপতি হয়ে উঠল। তাদের আত্মশক্তি যে কোন্ ক্ষেত্রে জয়যুক্ত হবে তার পূর্বাভাস এইখান থেকেই সকলের পাওয়া উচিত ছিল।
সকল বিষয়ে মাঝারি হয়েও তারা সকলের মাথা হল কি করে? এর অবশ্য নানা কারণ আছে, তার মধ্যে একটি হচ্ছে এই যে, তারা ছিল চৌকস। যে-সব ছেলেরা পড়ায় ফার্স্ট হত তারা খেলায় লাস্ট হত, আর যে-সব ছেলেরা খেলায় ফার্স্ট হত তারা পড়ায় লাস্ট হত। পাছে কোনো বিষয়ে লাস্ট হতে হয়, এই ভয়ে তারা কোনো বিষয়েই ফার্স্ট হয় নি। চৌকস হতে হলে যে মাঝারি হতে হয়, এ জ্ঞান তাদের ছিল; কেননা বয়েসের তুলনায় তারা ছিল যেমন সেয়ানা তদধিক হুঁশিয়ার।
কিন্তু সত্য কথা এই যে, তাদের শরীরে এমন একটি গুণ ছিল যা এ দেশে ছোটোদের কথা ছেড়ে দেও— বড়োদের দেহেও মেলা দুষ্কর। তারা ছিল বেজায় কৃতকর্মা ছেলে, ইংরেজি ভাষায় যাকে বলে energetic। স্কুলের যত ব্যাপারে তারা হত যুগপৎ অগ্রগামী ও অগ্রণী। চাঁদা, সে ফুটবলেরই হোক আর সরস্বতী পুজোরই হোক, তাদের তুল্য আর কেউ আদায় করতে পারত না। উকিল-মোক্তারদের কথা তো ছেড়েই দাও, জজ-ম্যাজিস্ট্রেটদের বাড়ি পর্যন্ত তারা চড়াও করত এবং কখনো শুধু-হাতে ফিরত না। তারা ছিল যেমনি ছটফটে তেমনি চট্পটে। একে তো তাদের মুখে খই ফুটত, তার উপর চোখ কোথায় রাঙাতে হবে ও কোথায় নামাতে হবে, তা তারা দিব্যি জানত। স্কুলের ছেলেদের যত রকম ক্লাব ছিল, এক ভাই হত তার সেক্রেটারি আর-এক ভাই হত তার ট্রেজারার। তার পর স্কুলের কর্তৃপক্ষদের কাছে যত প্রকার আবেদন-নিবেদন করা হত, রাম-শ্যাম ছিল সে-সবের যুগপৎ কর্তা ও বক্তা। উপরন্তু মাস্টারদের অভিনন্দন দিতেও তারা ছিল যেমন ওস্তাদ, তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতেও তারা ছিল তেমনি ওস্তাদ। এক কথায় সাবালক হবার বহু পূর্বে তারা দুজনে হয়ে উঠেছিল স্কুল-পলিটিক্সের দুটি অ-তৃতীয় নেতা। এই নেতৃত্বের বলে তারা স্কুলটিকে একেবারে ঝাঁকিয়ে জাগিয়ে চাগিয়ে তুলেছিল। যতদিন তারা দুভাই সেখানে ছিল ততদিন স্কুলটির জীবন ছিল—অর্থাৎ আজ নালিশ, কাল সালিশ, পরশু ধর্মঘট এই-সব নিয়েই স্কুলের কর্তৃপক্ষদের ব্যতিব্যস্ত হয়ে থাকতে হয়েছিল। ফলে কত ছেলে বেত খেলে, কত ছেলের নাম কাটা গেল, কিন্তু রাম-শ্যামের গায়ে যে কখনো আঁচড়টি পর্যন্ত লাগল না, সে তাদের ডিপ্লোমাসির গুণে। ডিপ্লোমাসি যে পলিটিক্সের দেহ, সে সত্য তারা নিজেই আবিষ্কার করেছিল।
তার পর পলিটিক্সের যা প্রাণ— অর্থাৎ পেট্রিয়টিজম, সে বিষয়েও আর কেউ ছিল না যে রাম-শ্যামের ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে পারে। স্ব-স্কুল সম্বন্ধে তাদের মমত্ববোধ এত অসাধারণ ছিল যে, আমি যদি জর্মান দার্শনিক হতুম তা হলে বলতুম যে সমগ্র স্কুলের ‘সমবেত আত্মা’ তাদের দেহে বিগ্রহবান হয়েছিল। প্রমাণ স্বরূপ উল্লেখ করা যেতে পারে যে, তাদের স্কুলের সঙ্গে অপর কোনো স্কুলের ছেলেদের ফুটবল ম্যাচ হলে রাম- শ্যাম তাতে যোগ দিত না বটে—কিন্তু সকলের আগে গিয়ে দাঁড়াত এবং প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সমান বাক্যবর্ষণ করত—কখনো স্বপক্ষকে উৎসাহিত করবার জন্য, কখনো বিপক্ষকে লাঞ্ছিত করবার জন্য। স্বপক্ষ জিতলে তারা ইংরেজিতে ‘ব্র্যাভো’ ‘হিপ হিপ হুরে’ বলে তারস্বরে চিৎকার করত। আর বিপক্ষদল জিতলে তারা প্রথমেই রেফারিকে জুয়াচোর বলে বসত; তাতে কেউ প্রতিবাদ করলে রাম-শ্যাম অমনি ‘my school, right or wrong’ বলে এমনি হুংকার ছাড়ত যে স্বদলবলের ভিতর সে হুংকারে যাদের স্কুল-পেট্রিয়টিজম প্রকুপিত হয়ে উঠত তাহা বেপরোয়া হয়ে বিপক্ষদলের সঙ্গে মারামারি করতে লেগে যেত। মারামারি বাধবামাত্র রাম-শ্যামের দেহ অবশ্য এক নিমেষে সেখান থেকে অন্তর্ধান হত, কিন্তু সেই যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের আত্মা বিরাজ করত। জান তো, আত্মার ধর্মই এই যে, তা যেখানে আছে সেখানে সর্বত্রই আছে, কিন্তু কোথায়ও তাকে ধরে-ছুঁয়ে পাবার জো নেই।
রাম-শ্যামের এই বাল্যলীলা থেকে বোধ হয় তুমি অনুমান করতে পেরেছ যে, এরা দু ভাই কলিযুগের যুগধর্মের—অর্থাৎ পলিটিক্সের— যুগল অবতার স্বরূপে এই ভূ- ভারতে অবতীর্ণ হয়েছিল।
দ্বিতীয় অঙ্ক
শিক্ষা
রাম-শ্যাম ষোলো বৎসরও অতিক্রম করলেন, সেই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষাও উত্তীর্ণ হলেন, অবশ্য সেকেণ্ড ডিভিসনে। এতে আশ্চর্য হবার কিছুই নেই। যেমন তেমন করে হোক, হাতের পাঁচ রাখতে তাঁরা ছিলেন সিদ্ধহস্ত।
এর পর তাঁরা কলকাতায় পড়তে এলেন। এইখান থেকেই তাঁদের আসল পলিটিক্সের শিক্ষানবিসি শুরু হল। কলেজে ভর্তি হবামাত্র নিজের প্রতি তাঁদের ভক্তি যথোচিত বেড়ে গেল, এবং সেই সঙ্গে তাঁদের উচ্চ আশা সিমলাস্পর্ধী হয়ে উঠল I সহসা তাঁদের হুঁশ হল যে, স্কুল-কলেজের মোড়লী করা রূপ তুচ্ছ ব্যবসায়ের মজুরী তাঁদের মতো শক্তিশালী লোকের পোষায় না। তাই তাঁরা মনস্থির করলেন, তাঁরা হবেন দেশনায়ক; এবং পলিটিক্সের মহানাটকের অভিনয়ে যাতে সর্বাগ্রগণ্য হতে পারেন তার জন্য তাঁরা প্রস্তুত হতে লাগলেন।
মহানগরীর আবহাওয়া থেকে এ তথ্য তাঁরা দু দিনেই উদ্ধার করলেন যে, এ যুগে ধর্মবলও বল নয়, কর্মবলও বল নয়, একমাত্র বল হচ্ছে বুদ্ধিবল—ওরফে বাক্যবল। এ বল যে তাঁদের শরীরে আছে তার পরিচয় তাঁরা স্কুলেই পেয়েছিলেন। স্বাক্ষরিত অভিনন্দনপত্র এবং বেনামী দরখাস্ত লিখে, জিভের জোরে এক দিকে বড়োদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করে, আর-এক দিকে ছোটোদের কাছ থেকে ভয়ভক্তি আদায় করে তাঁরা বাক্যবলের কতকটা চর্চা ইতিপূর্বেই করেছিলেন, এবার তার সম্যক্ অনুশীলনে প্রবৃত্ত হলেন।
রাম-শ্যাম যেমন এ ধরাধামে প্রবেশ করা মাত্র তাঁদের জননীকে আপসে আধাআধি ভাগ করে নিয়ে নিশ্চিতমনে ভোগ-দখল করেছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করামাত্র তাঁরা তদ্রূপ আপসে মা-সরস্বতীকে আধাআধি ভাগ করে নিয়ে ভোগ-দখল করতে ব্রতী হলেন। বাণীর এ কালে দুটি অঙ্গ আছে, এক রসনা আর-এক লেখনী। রাম ধরলেন বক্তৃতার দিক, আর শ্যাম ধরলেন, লেখার দিক। এর কারণ, স্কুলে থাকতেই তাঁরা প্রমাণ পেয়েছিলেন যে, অভিনন্দন জবর হত রামের মুখে, আর অভিযোগ জবর হত শ্যামের কলমে।
বলা বাহুল্য, নৈসর্গিক প্রতিভার বলে অচিরে রাম হয়ে উঠলেন একজন মহাবক্তা আর শ্যাম হয়ে উঠলেন একজন মহালেখক। যা এক কথায় বলা যায় রাম তা অনায়াসে একশো কথায় বলতেন, আর যা এক ছত্রে লেখা যায় শ্যাম তা অনায়াসে একশো ছত্রে লিখতেন। রাম-শ্যামের বক্তব্য অবশ্য বেশি কিছু ছিল না। তার কারণ, যারা অহর্নিশি পরের ভাবনা ভাবে তারা নিজে কোনো কিছু ভাববার কোনো অবসরই পায় না। ফলে, অনেক কথা বলে কিছু না-বলার আর্টে তারা Gladstone এর সমকক্ষ হয়ে উঠলেন।
রামের মুখ ও শ্যামের কলম থেকে অজস্র কথা যে অনর্গল বেরোত তার আরো একটি কারণ ছিল। জ্ঞানের বালাই তো তাঁদের অন্তরে ছিলই না, তার উপরে যে ধর্ম শরীরে থাকলে মানুষের মুখে কথা বাধে, কলমের মুখে কথা আটকায়, সে ধর্ম অর্থাৎ সত্যমিথ্যার ভেদজ্ঞান— দুকড়ি দত্তের বংশধর যুগলের দেহে আদপেই ছিল না। এ জ্ঞানের অভাবটা যে পলিটিক্সে ও গল্প-সাহিত্যে কত বড়ো জিনিস সে কথা কি আর খুলে বলা দরকার?
যদি জিজ্ঞাসা কর যে তাঁরা এই অতুল বাক-শক্তির চর্চা কোথায় এবং কি সুযোগে করলেন, এক কথায়, কোথায় তাঁরা রিহার্সেল দিলেন— তার উত্তর, কলেজের ছাত্রদের কলকাতা শহরে যতরকম সভা-সমিতি আছে রাম তাতে অনবরত বক্তৃতা করতেন, এবং শ্যাম সে-সবের লেখালেখির কাজ দুবেলা করতেন, তার উপর নানা কাগজে নানা ছদ্মনামে নানা সত্যমিথ্যা পত্রও লিখতেন। সে-সকল অবশ্য ছাপাও হত। বিনে পয়সায় লেখা পেলে কোন কাগজ ছাড়ে!
পূর্বেই বলেছি, রাম-শ্যামের বক্তব্য বেশি কিছু ছিল না, কিন্তু যেটুকু ছিল তার মূল্য অসাধারণ। মানিকের খানিকও ভালো, এ কথা কে না জানে? একে তো তাঁদের ভাষা ছিল গালভরা ইংরেজি, তার উপর ভাব আবার বুকভরা পেট্রিয়টিক, এই মণিকাঞ্চনের যোগ দেখলে প্রবীণদেরই মাথার ঠিক থাকে না— নবীনদের কথা তো ছেড়েই দেও। তাঁদের সকল কথা সকল লেখার মূলসূত্র ছিল এক। তাঁরা এ কালের ইউরোপের সঙ্গে সে কালের ভারতের তুলনা করে দেখিয়ে দিতেন যে, এ কালের আর্থিক সভ্যতা সে কালের আধ্যাত্মিক সভ্যতার তুলনায় কত তুচ্ছ, কত হেয়। তাঁরা এই মহাসত্য প্রচার করতেন যে, অতীত ভারতই পতিত ভারতকে উদ্ধার করবে, অপর কোনো উপায় নেই। রামের মুখে এ কথা শুনে, শ্যামের লেখায় এ কথা পড়ে আমাদের সকলের চোখেই জল আসত, আর দু-চারজন উৎসাহী লোক ঘর ছেড়ে বনেও চলে গেল— অতীতের সন্ধানে। এর পর, রাম-শ্যামের পেট্রিয়টিজমের খ্যাতি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীর টপকে যে সমগ্র শহরে ছড়িয়ে পড়ল তাতে আর আশ্চর্য কি। —সে তো হবারই কথা।
রাম-শ্যাম দেশের অতীত সম্বন্ধে যতই বলা-কওয়া করুন না কেন, নিজেদের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে কিন্তু সম্পূর্ণ সতর্ক ছিলেন। দেশের ভবিষ্যতের উপায় যাই হোক নিজের ভবিষ্যৎ যে বর্তমানের সাহায্যেই গড়ে তুলতে হয়, এ জ্ঞান তাঁরা ভুলেও হারান নি। পাস না করলে যে পয়সা রোজগার করা যায় না, আর বাক্যের পিছনে অর্থ না থাকলে তার যে কোনো বলই থাকে না— এ পাকা কথাটা তাঁরা ভালোরকমই জানতেন। তাই তাঁরা যথাসময়ে বিএ এবং বিএল পাস করলেন, দুইই অবশ্য সেকেণ্ড ডিভিসনে। ফাস্ট ডিভিসনে পাস করলে লোকে বলত খুব মুখস্থ করেছে, আর থার্ড ডিভিসনে পাস করলে বলত ভালো মুখস্থ করতে পারে নি। এই দুই অপবাদ এড়াবার জন্যই তারা সেকেণ্ড ডিভিসনে স্থান নিয়ে সুবুদ্ধির পরিচয় দিলেন। মুখস্থ অবশ্য তাঁরা ঢের করেছিলেন, সে কিন্তু সেই সব বড়ো ইংরেজি কথা— যা বক্তৃতার আর লেখার কাজে লাগে।
সংসারের বিচিত্র কর্মক্ষেত্রের তারা যে কোন ক্ষেত্র দখল করবেন সে বিষয়ে তাঁরা একদম মনস্থির করে ফেললেন। রাম ঠিক করলেন, তিনি হবেন একজন বড়ো উকিল, আর শ্যাম ঠিক করলেন তিনি হবেন একজন বড়ো এডিটার। এর থেকে তুমি যেন মনে কোরো না যে তাঁরা পলিটিক্সের দিকে পিঠ ফেরাবার বন্দোবস্ত করলেন। রাম-শ্যাম অত কাঁচা অত বে-হিসেবী ছেলে ছিলেন না। তাঁরা বেশ জানতেন যে, পেট্রিয়টিজমের সাহায্যে তাঁরা ব্যবসায়ে উন্নতিলাভ করবেন, আর একবার ব্যবসায় উন্নতি লাভ করতে পারলে দেশের লোক ধরে নিয়ে গিয়ে তাঁদের পলিটিক্সের নেতা করে দেবে।
এইখানে একটি কথা বলে রাখি। আকৃতি-প্রকৃতিতে রামের সঙ্গে শ্যামের পনেরো আনা তিন পাই মিল থাকলেও এক পাই গরমিল ছিল, সে গরমিল একবৃন্তে দুটি ফুলের মধ্যে চিরদিনই থেকে যায়।
প্রথমত রামের ছিল মোটার ধাত, আর শ্যামের রোগার ধাত। দ্বিতীয়ত, রামের কণ্ঠস্বর ছিল ভেরীর মতো আর শ্যামের তুরীর মতো, জোর অবশ্য দুয়েরই সমান ছিল, কিন্তু একটা খাদের দিকে, আর একটা জিলের দিকে।
কালিদাস বলে গেছেন যে, বড়োলোকের প্রজ্ঞা তাদের আকারের সদৃশ্য হয়। এ ক্ষেত্রেও দেখা গেল যে কবির কথা মিথ্যে নয়। দুজনের মধ্যে রাম ছিলেন অপেক্ষাকৃত সুস্থ, আর শ্যাম অপেক্ষাকৃত ব্যস্ত। রাম ছিলেন বেশি দরবারী, আর শ্যাম ছিলেন বেশি তকরারী। রামের কৃতিত্ব ছিল হিকমতে, শ্যামের হুজ্জুতে। রাম সিদ্ধহস্ত ছিলেন দল পাকাতে, আর শ্যাম দল ভাঙাতে। এক কথায় দলাদলি ছিল রামের পেশা, আর শ্যামের নেশা। রামের motto ছিল আগে ভেদ তার পরে সাম, আর শ্যামের motto ছিল আগে ভেদ তার পরে বিগ্রহ; কেননা রাম চাইতেন লোকে তাঁকে ভক্তি করুক, আর শ্যাম চাইতেন লোকে তাঁকে ভয় করুক। তাঁদের চরিত্রের প্রভেদটা একটি ব্যাপার থেকেই স্পষ্ট দেখানো যায়। আগেই বলেছি যে, স্কুলকলেজে যতপ্রকার সভাসমিতি ছিল, এই ভ্রাতৃযুগল সে-সবের সেক্রেটারি ট্রেজারারের পদ অধিকার করে বসতেন। কিন্তু রাম বরাবর ট্রেজারারই হতেন, আর শ্যাম সেক্রেটারি।
এ হেন চরিত্র, এ হেন বুদ্ধি নিয়ে রাম ও শ্যাম যখন সংসারের রঙ্গমঞ্চে অবতীর্ণ হলেন তখন সকলেই বুঝল যে, তাঁরা জীবনে একটা বড়ো খেলা খেলবেন।
তৃতীয় অঙ্ক
পেট্রিয়টিজম
যিনি মহাপুরুষ-চরিতের চর্চা করেছেন তিনিই জানেন যে, তাঁদের জীবনের একটা ভাগ তাঁরা অজ্ঞাতবাসে কাটান। সে সময় তাঁরা কোথায় ছিলেন কি করেছেন সে খবর কেউ জানে না। কলেজ ছাড়বার পর রাম-শ্যাম দশ বৎসরের জন্য লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে গিয়েছিলেন। এ কয় বৎসর তাঁরা যে কোথায় ছিলেন, এবং কি করেছেন, সে খবর কেউ জানে না।
তার পর স্বদেশী যুগে তাঁদের পুনরাবির্ভাব হল। বন্দে মাতরম-এর ডাক শুনে তাঁদের সুপ্ত মাতৃভক্তি আবার ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল, তাঁরা আর স্থির থাকতে পারলেন না; অমনি অজ্ঞাতবাস ছেড়ে প্রকাশ্য মাতৃসেবায় লেগে গেলেন। যে অগাধ মাতৃভক্তি শৈশবে তাঁদের গর্ভধারিণীর হৃদয়ের উপর ন্যস্ত ছিল, পূর্ণযৌবনে তা তাঁদের জন্মভূমির পৃষ্ঠে গিয়ে ভর করলে। লোকে ধন্য ধন্য করতে লাগল।
বাতাসের স্পর্শে জল যেমন নেচে ওঠে, আগুনের স্পর্শে খড় যেমন জলে ওঠে, রামের রসনা আর শ্যামের লেখনীর স্পর্শে আমাদের হৃদয় তেমনি উদবেলিত আন্দোলিত হয়ে উঠল, আমাদের উৎসাহ তেমনি সংধুক্ষিত প্রজ্বলিত হয়ে উঠল I
এবার তাঁরা ধরলেন এক নতুন সুর। ভারতবর্ষের আধ্যাত্মিক অতীতকে টেঁকে গুঁজে ভারতবর্ষের আর্থিক ভবিষ্যতের তাঁরা ব্যাখ্যান শুরু করলেন। তাঁদের বাক্যবলে সে ভবিষ্যৎ অন্নবস্ত্রে ধনরত্নে পরিপূর্ণ হয়ে উঠল। এ ছবি দেখে সকলেরই মুখে জল এল। যারা পূর্বে বনে চলে গিয়েছিল তারা আবার ঘরে ফিরে এল।
রাম যখন স্পষ্ট করে বললেন যে, ‘আমি দেশের চিনি খাব’, আর শ্যাম যখন স্পষ্ট করে লিখলেন যে, ‘আমি বিদেশের নুন খাব না’— তখন আর কারো বুঝতে বাকি থাকল না যে অতঃপর রামের মুখ দিয়ে শুধু মধুক্ষরণ হবে, আর শ্যামের কলম শুধু দেশের গুণ গাইবে, অর্থাৎ তাঁরা দুজনে একমনে এ কালের যুগধর্ম প্রচার করবেন; অমনি আমাদের মনে তাঁদের প্রতি ভক্তি উথলে উঠল।
যুগধর্মের প্রচারে যাতে কোনোরূপ ব্যাঘাত না ঘটে, তার জন্য দেশের লোক চাঁদা করে টাকা তুলে শ্যামের জন্য একখানি ইংরেজি কাগজ বার করে দিলেন, সে কাগজের নাম হল Nationalist। শ্যামের হাতে পড়ে সেখানি হয়ে উঠল একখানি চাবুক। শ্যাম সজোরে তা আকাশের উপর চালাতে লাগলেন, তার পটপটানির আওয়াজে আকাশ বাতাস ভরে গেল। সেই রণবাদ্য শুনে আমাদের বুকের পাটা দশগুণ বেড়ে গেল।
কথায় বলে, দিন যেতে জানে, ক্ষণ যেতে জানে না। শ্যামের ভাগ্যে ঘটলও তাই। এই চাবুক দৈবাৎ একদিন একটি বড়োসাহেবের গায়ে লেগে গেল। তিনি তৎক্ষণাৎ শ্যামের বিরুদ্ধে মানহানির নালিশ করলেন। দেশময় হৈ হৈ রৈ রৈ পড়ে গেল।
যথাসময়ে ফৌজদারী আদালতে শ্যামের বিচার হল; এবং এই সূত্রে রাম তাঁর অসাধারণ আইনের জ্ঞান ও অসামান্য ওকালতিবুদ্ধি দেখাবার একটি অপূর্ব সুযোগ পেলেন। রামের জেরার জোরে, বাহাজের বলে, আইনের হিকমতে মামলা মাঝপথেই ফেঁসে গেল। রাম নিম্ন আদালতে আইনের যে-সব কূটতর্ক তুলেছিলেন সে তর্ক এখানে তুললে তুমি ভেবড়ে যাবে, কেননা তার মর্ম তুমি বুঝতে পারবে না; বেচারা ম্যাজিস্ট্রেটও তার নাগাল পায় নি। তবে এ ক্ষেত্রে তিনি কিরকম বুদ্ধি খেলিয়েছিলেন তার একটা পরিচয় দিই। রাম এই আপত্তি তুললেন যে, ইংরেজের ইংরেজির যা মানে শ্যামের ইংরেজির সে মানে করলে আসামীর উপর সম্পূর্ণ অবিচার করা হবে। কেননা শ্যাম যে ভাষা লেখেন সে তাঁর নিজস্ব ভাষা, এক কথায় সে হচ্ছে শ্যামের স্বকৃত ভঙ্গ-ইংরেজি! বাঙলা খুব ভালো না জানলে সে ইংরেজির যথার্থ অর্থ হৃদয়ঙ্গম করা যায় না। ফরিয়াদির সাহেব-কৌসুলি এ আপত্তির আর কোনো উত্তর দিতে পারলেন না, কেননা তিনি এ কথা অস্বীকার করতে পারলেন না যে, শ্যামের ইংরেজি ইংল্যাণ্ডের ইংরেজি নয়। শ্যাম খালাস হলেন। লোকে রাম-শ্যামের জয়জয়কার করতে লাগল।
শ্যাম যেদিন খালাস পেলেন বাঙলার সেদিন হল— ইংরেজরা যাকে বলে— একটি ‘লাল হরফের দিন’। লোকের অমন আনন্দ অমন উল্লাস সেদিনের পূর্বে আর কখনো দেখা যায় নি।
এমন-কি, এই ফচকে কলকাতা শহরের লোকরাও সেদিন যে কাণ্ড করেছিল তা এতই বিরাট যে বীরবলী ভাষায় তার বর্ণনা করা অসাধ্য, তার জন্য চাই ‘মেঘনাদবধ’ এর কলম। রাম-শ্যামকে একটি ফিটানে চড়িয়ে হাজার হাজার লোকে বড়ো রাস্তা দিয়ে সেই ফিটান যখন টেনে নিয়ে যেতে লাগল তখন পথঘাট সব লোকে লোকারণ্য হয়ে গেল, এত লোক বোধ হয় জগন্নাথের রথযাত্রাতেও একত্র হয় না। লোকে বললে, রাম- শ্যাম কৃষ্ণার্জুন। তারপর এই যুগলমূর্তি দেখবার জন্য জনতার মধ্যে এমনি ঠেলাঠেলি মারামারি লেগে গেল যে কত লোকের যে হাত-পা ভাঙলে তার আর ঠিকঠিকানা নেই।
আমি ভিড় দেখলে ভড়কাই— ওর ভিতর পড়লে বেহুঁশ হয়ে যাবার ভয়ে এবং সেই চড়কের সঙ দেখা ছাড়া অপর কোনো শোভাযাত্রা দেখতে কখনো ঘর থেকে বার হই নে। কিন্তু সেদিন উৎসাহের চোটে আমিও ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েছিলুম। চোরবাগানের মোড়ে গিয়ে যখন দেখলুম যে, চিৎপুরের দুধার থেকে রাম-শ্যামের মাথায় পুষ্পবৃষ্টি হচ্ছে তখন আমার চোখে জল এসেছিল। আর কোনো গুণের না হোক পেট্রিয়টিজমের সম্মান যে বাঙালি করতে জানে সেদিন তার চূড়ান্ত প্রমাণ হয়ে গেল।
এইখান থেকেই দেশ আবার মোড় ফিরলে; অর্থাৎ এই ঘটনার অব্যবহিত পরেই স্বদেশী আন্দোলন উপরের চাপে বসে গেল। কত ছা-পাষা লোকের চাকরি গেল, কত ছেলের স্কুল থেকে নাম কাটা গেল, কত যুবক রাজদণ্ডে দণ্ডিত হল, বাদবাকি আমরা সব একদম দমে গেলুম। রাম-শ্যামের গায়ে কিন্তু আঁচড়টি পর্যন্ত লাগল না। অনেক কথা বলে কিছু না বলার আর্টের যে কি গুণ, এবার তার পরিচয় পাওয়া গেল। তাঁরা অবশ্য দমেও গেলেন না। এ দুই ভাই এই হাঙ্গামার ভিতর থেকে শুধু যে অক্ষত শরীরে বেরিয়ে এলেন তাই নয়, তাঁদের মনেরও কোনো জায়গায় আঘাত লাগল না; কেননা স্বদেশীর সকল কথাই দিবারাত্র তাঁদের মুখের উপরই ছিল, তার একটি কথাও তাঁদের বুকের ভিতর প্রবেশ করবার ফুরসৎ পায় নি।
রামের ওকালতির সনন্দ আর শ্যামের খবরের কাগজ দুইই অবশ্য তাঁদের হাতেই রয়ে গেল। তার পর দেশ যখন জুড়োল, তখন রামের ওকালতির পশার ও শ্যামের কাগজের প্রসার শুক্লপক্ষের চন্দ্রের মতো দিনের পর দিন আপনা হতেই বেড়ে যেতে লাগল। শেক্সপীয়র বলেছেন যে, মানুষমাত্রেরই জীবনে এমন একটা জোয়ার আসে যার ঝুঁটি চেপে ধরতে পারলে তার কাঁধে চড়ে যেখানে প্রাণ চায় সেখানেই যাওয়া যায়। যে স্বদেশীয় জোয়ারে আমরা সকলেই হাবুডুবু খেলুম এবং অনেকে একেবারে ডুবে গেল, রাম-শ্যাম তার কাঁধে চড়ে একজন বড়ো উকিল আর একজন বড়ো এডিটার হতে চললেন।
চতুৰ্থ অঙ্ক
ইভলিউসান
অবতারের কথা হচ্ছে— ‘সম্ভাবামি যুগে যুগে’। মহাপুরুষদের লীলাও নিত্য-লীলা নয়। তাঁরা অনাবশ্যক দেখা দেন না, যখন দরকার বোঝেন তখনই আবার আবির্ভূত হন।
স্বদেশী আন্দোলন চাপা পড়বার ঠিক দশ বৎসর পরে রাম-শ্যাম রাজনীতির আসরে আবার সদর্পে অবতীর্ণ হলেন, কিন্তু সে এক নব মূর্তিতে, যুগল রূপে নয়—স্ব স্ব রূপে। তাঁদের উভয়েরই চেহারা আর সাজগোজ ইতিমধ্যে এতটা বদলে গিয়েছিল যে তাঁদের দুজনকে যমজ ভ্রাতা তো অনেক দূরের কথা, পরস্পরের ভ্রাতা বলেই চেনা গেল না।
রামের দেহটি হয়েছিল ঠিক ঢাকের মতো আর শ্যামের হয়েছিল তার কাঠির মতো। এর কারণ রামের হয়েছিল বহুমূত্র ভার শ্যামের শ্বাসরোগ
তাদের বেশভূষাও একদম বদলে গিয়েছিল। এবার দেখা গেল, রামের দাড়িগোঁফ দুইই কামানো, মাথার চুল কয়েদীদের ফ্যাসানে ছাঁটা, এবং পরনে ইংরেজি পোশাক, হঠাৎ দেখতে পাকা বিলেত-ফেরত বলে ভুল হয়। অপর পক্ষে শ্যামের দেখা গেল. দাড়ি গোঁফ চুল সবই অতি প্রবৃদ্ধ, পরনে থানধুতি, গায়ে আঙরাখা, পায়ে তালতলার চটি, হঠাৎ দেখতে ঘোর থিয়জফিস্ট বলে ভুল হয়।
এ হেন রূপান্তরের কারণ, ইতিমধ্যে রাম হয়ে উঠেছিলেন একজন বড়ো উকিল আর শ্যাম হয়ে উঠেছিলেন একজন বড়ো এডিটার! এই বড়ো হবার চেষ্টার ফলেই তাঁদের এতাদৃশ বদল হয়েছিল। রামের পশার যেমন বাড়তে লাগল, তিনি চালচলনে তেমনি সাহেবিয়ানার দিকে ঝুঁকতে লাগলেন; আর যত তিনি সেই দিকে ঝুঁকতে লাগলেন তত তাঁর পশার বাড়তে লাগল। অপরপক্ষে শ্যামের কাগজের প্রসার যেমন বাড়তে লাগল, তেমনি তিনি হিঁদুয়ানির দিকে ঝুঁকতে লাগলেন; আর যত হিদুয়ানির দিকে ঝুঁকতে লাগলেন তত তাঁর কাগজের প্রসার বাড়তে লাগল।
তাঁরা যে দুটি রোগ সংগ্রহ করেছিলেন সেও ঐ বড়ো হবার পথে। এ দেশে মস্তিষ্কের বেশি চর্চা করলে যে বহুমূত্র হয়, আর হৃদয়ের বেশি চর্চা করলে যে হাঁপানি হয় এ কথা কে না জানে।
বাইরের চেহারার সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের মনের চেহারাও ফিরে গিয়েছিল।
এই দশ বৎসরের মধ্যে রাম হয়ে উঠেছিলেন একজন রিফরমার, আর শ্যাম একজন নব্য-হিন্দু। সমাজ-সংস্কার ছাড়া রামের মুখে অপর কোনো কথা ছিল না আর বেদান্ত ছাড়া শ্যামের মুখে অপর কোনো কথা ছিল না। রাম বলতেন বাল্যবিবাহ বন্ধ না হলে দেশের কোনো উন্নতি হবে না, আর শ্যাম বলতেন ‘অথাতো ব্রহ্ম’ জিজ্ঞাসা না করলে দেশের কোনো উন্নতি হবে না। রাম বলতেন যে, দেশের লোক যদি শক্তিশালী হতে চায় তো তাদের Eugenics মেনে চলতে হবে, আর শ্যাম বলতেন, ওর জন্য ‘শাস্ত্রযোনীত্বাৎ’ মেনে চলতে হবে। রাম বলতেন জাতিভেদ তুলে দিতে হবে, শ্যাম বলতেন বর্ণাশ্রম ধর্ম ফিরিয়ে আনতে হবে। এক কথায় রাম দোহাই দিতেন পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের, আর শ্যাম প্রাচ্য দর্শনের। বলা বাহুল্য, রামের পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের জ্ঞান, আর শ্যামের প্রাচ্য-দর্শনের জ্ঞান, দুইই ছিল তুল্যমূল্য।
এর থেকে অবশ্য মনে কোরো না যে, আচারে বিচারে রাম-শ্যামের ভিতর কোনোরূপ প্রভেদ ছিল। যে কৌশলে কথা মুখে রাখলেও তা পেটে যায় না সে কৌশলে তাঁরা চিরাভ্যস্ত ছিলেন। রাম তাঁর মেয়েদের যথাসময়ে অর্থাৎ দশ বৎসর বয়সেই পাত্রস্থ করতেন— প্রধানত পাত্রের জাত ও কুল দেখে; আর নিত্য মুরগি না খেলে শ্যামের অম্বল হত, আর চায়ের বদলে Bovril না খেলে তিনি জোর কলমে লেখবার মতো বুকের জোর পেতেন না। সুরা অবশ্য দুজনেই পান করতেন, উভয়ে কিন্তু এ ক্ষেত্রে এক রসের রসিক ছিলেন না। রাম খেতেন হুইস্কি আর শ্যাম ব্রাণ্ডি।
রাম-শ্যামের কথার সঙ্গে কাজের এই গরমিলটা ইউরোপে অবশ্য দোষ বলে গণ্য হত— তার কারণ, ইউরোপের মোটা বুদ্ধি সত্যের সঙ্গে ব্যবহারিক সত্যের প্রভেদটা ধরতে পারে নি। রাম এ সত্য জানতেন যে, সত্য কাজে লাগে অপর লোকের; আর শ্যাম জানতেন যে, ও বস্তু কাজে লাগে পরলোকের। নিজের ইহলোকের জীবন সুখে যাপন করতে হলে যে ব্যবহারিক সত্য মেনে চলতে হয়, এ জ্ঞান রাম-শ্যাম দুজনেরই সমান ছিল।
পঞ্চম অঙ্ক
পলিটিক্স
এবার অবশ্য দুজনে দু দলের নায়ক হয়েই রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত হলেন। রাম হলেন দক্ষিণ মার্গের মহাজন ও শ্যাম বাম মার্গের। এর কারণ শৈশবে রাম লালিত-পালিত হয়েছিলেন মার ডান কোলে, আর শ্যাম তাঁর বাঁ কোলে।
দু দলে যুদ্ধের সূত্রপাত হল সেই দিন যেদিন তারে খবর এল যে, জর্মানরা চাই কি ভারতবর্ষের উপরেও চড়াও হতে পারে।
এই সংবাদ যেই পাওয়া অমনি রাম প্রাকাশ্য সভায় বজ্রগম্ভীরস্বরে ঘোষণা করলেন— ‘আমি যুদ্ধ করব’। দেশের বাতাস অমনি কেঁপে উঠল। শ্যাম তার ঠিক পরের দিনই নিজের কাগজে জ্বলন্ত অক্ষরে লিখলেন, ‘আমি যুদ্ধ করব না’। দেশের আকাশ অমনি চমকে উঠল।
রাম-শ্যামের এই দৃঢ় সংকল্পের সংবাদ শুনে যুদ্ধের কর্তৃপক্ষেরা ভীত কিম্বা আশ্বস্ত হয়েছিলেন, অদ্যাবধি তার কোনো পাকা খবর পাওয়া যায় নি; সম্ভবত আগামী Peace Conference-এ সে কথা প্রকাশ পাবে।
কিন্তু এর প্রত্যক্ষ ফল হল এই যে, স্বদেশ রক্ষা আগে, না স্ব-রাজ্য লাভ আগে, এই নিয়ে দেশময় একটা মহাতর্ক বেধে গেল; এবং সঙ্গে সঙ্গে দেশের লোক দু ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। যারা রক্ষণশীল তারা হল রামপন্থী আর যারা অরক্ষণশীল তারা হল শ্যামপন্থী। রামের দল হল ওজনে ভারী আর শ্যামের দল হল সংখ্যায় বেশি। তার কারণ যারা মোটা তারা হল রামের চেলা, আর যারা রোগা তারা হল শ্যামের চেলা। বাঙলাদেশে মোটাদের চাইতে রোগারা যে দলে ঢের বেশি পুরু— সে কথা বলাই বেশি। এরপর দু দলে কুরুপাণ্ডবের যুদ্ধ যে বেধে যাবে সে কথা সকলেই টের পেলে। দেশের জন্য যারা কেয়ার করে, তারা মনমরা হয়ে গেল; যারা করে না, তারা তামাশা দেখবার জন্য উৎসুক হল; যারা ঘুমিয়ে আছে, তারা একবার জেগে উঠে আবার পাশ ফিরে শুলে; আর বিলেতি কাগজওয়ালারা মহানন্দে বলতে লাগল— ‘নারদ’ ‘নারদ’।
যুদ্ধের প্রস্তাবে যে যুদ্ধের সূত্রপাত হয়েছিল, রিফরমের প্রস্তাবে সে যুদ্ধ দস্তুরমত বেধে গেল।
রিফরমের প্রতি রাম হলেন দক্ষিণ আর শ্যাম হলেন বাম। এ দেশের মেয়েরা বাড়িতে ছেলে হলে যেরকম আনন্দে নৃত্য করে, রাম সেইরকম নৃত্য করতে লাগলেন; আর মেয়ে হলে তারা যেরকম হা-হুতাশ করে, শ্যাম সেই-রকম হা-হুতাশ করতে লাগলেন। রাম বললেন, ‘রিফরম গ্রাহ্য, কিন্তু তার বদল চাই।’ শ্যাম অমনি বলে উঠলেন,’রিফরম অগ্রাহ্য, কেননা তার বদল চাই।’
এই দুটি বাক্যের ভিতর এক syntax ছাড়া আর কি প্রভেদ আছে দেশের লোকে প্রথমে তা ঠাহর করতে পারেনি; তারা মনে করেছিল যে, একই কথা রাম বলছেন positive আকারে, আর শ্যাম বলছেন negative আকারে। তাদের সে ভুল তাঁরা দুদিনেই ভাঙিয়ে দিলেন।
রাম যখন বুঝিয়ে দিলেন যে, শ্যামের মত নেতি-মূলক, আর শ্যাম যখন বুঝিয়ে দিলেন যে, রামের মত ইতি-অন্ত, তখন আর কারো বুঝতে বাকি থাকল না যে, রিফরমার ও বৈদান্তিকে যা প্রভেদ এ উভয়ের মধ্যে ঠিক সেই প্রভেদ আছে; অর্থাৎ দক্ষিণ মার্গ হচ্ছে পাশ্চাত্য আর বাম মার্গ হচ্ছে প্রাচ্য।
এর পর দু দলে প্রকৃত লড়াই লাগল। রাম-শ্যাম উভয়েই কিন্তু একটু মুশকিলে পড়ে গেলেন। স্বদেশীযুগে একজন করতেন বক্তৃতা আর একজন লিখতেন কাগজ। কিন্তু স্বরাজের যুগে পরস্পরের ছাড়াছাড়ি হওয়ার দরুন প্রত্যেককেই অগত্যা যুগপৎ লেখক ও বক্তা হতে হল, অর্থাৎ দুজনেই আবার বাল্যজীবনে ফিরে গেলেন। শ্যাম বক্তৃতা শুরু করে দিলেন, আর রাম কাগজ বার করলেন। সে কাগজের নাম রাখা হল Rationalist.
বলা বাহুল্য Rationalist-এর সঙ্গে Nationalist-এর তুমুল বাকযুদ্ধ বেধে গেল। Rationalist খুলে দেখো তাতে Nationalist এর কেচ্ছা ছাড়া আর কিছু নেই, আর Nationalist খুলে দেখো তাতে Rationalist এর কেচ্ছা ছাড়া আর কিছু নেই।
নির্বিবাদী লোক বাঙলাতেও আছে, এবং নির্বিবাদী বলে তারা যে একেবারে নির্বোধ কিম্বা পাষণ্ড, তাও নয়। ব্যাপার দেখে শুনে এই নিরীহের দল তিতিবিরক্ত হয়ে উঠল।
কিন্তু বিরক্ত হয়ে ঘরে বসে থাকার ফল হচ্ছে শুধু ঘরের ভাত বেশি করে খাওয়া; এতে করে দেশের যে কোনো উপকার হয় না, সে জ্ঞান এই নিরক্ষর দলের ছিল। শেষটায় তারা রাম-শ্যামের ভিতর একটা আপস-মীমাংসা করে দেবার জন্য হরিকে তাঁদের কাছে দূত পাঠালেন। হরিকে পাঠাবার কারণ এই যে, তার তুল্য গো-বেচারা এ দেশে খুব কমই আছে, তার উপর সে ছিল রাম-শ্যামের চিরানুগত বন্ধু।
হরি প্রস্তাব করলে যে, দুজনে মিলে যদি Rational – nationalist কিম্বা National- rationalist হন তা হলে দু দিক রক্ষা পায়। এ প্রস্তাব অবশ্য উভয়েই বিনা বিচারে অগ্রাহ্য করলেন, কেননা দুজনেরই মতে rationalism এবং nationalism হচ্ছে দিনরাতের মতো ঠিক উল্টো উল্টো জিনিস; একটি যেমন সাদা আর একটি তেমনি কালো, যাবচ্চন্দ্রদিবাকর ও দুই কিছুতেই এক হতে পারে না। হরি মধ্যস্থতা করতে গিয়ে বেজায় অপদস্থ হলেন। রামের চেলারা তাঁকে বললেন কবি, আর শ্যামের চেলারা দার্শনিক। হরিক লাঞ্ছনা দেখে আর কেউ সাহস করে মিটমাট করতে অগ্রসর হল না।
দলাদলি থেকেই গেল; শুধু থেকে গেল না, ভয়ংকর বাড়তে লাগল। ঢাকে কাঠিতে যখন মারামারি বাধে তখন মানুষের কান কিরকম ঝালাপালা হয় তা তো জানই। দেশের লোক মনে মনে বললে, এখন থামলে বাঁচি। কিন্তু এই গোল থামা দূরে থাক ভারতবর্ষময় ছড়িয়ে পড়ল, এবং সেও কতকটা রাম-শ্যামের চালের গুণে।
এতদিনে রাম-শ্যামের এ জ্ঞান জন্মেছিল যে, বাঙলাতে কোনো বাঙালিকে বড়ো লোক বলে মানে না, যতক্ষণ না সে মরে। অতএব পরস্পরের সঙ্গে পলিটিক্সের লড়াই নিরাপদে লড়তে হলে উভয়ের পক্ষেই এই একটি বিদেশী শিখণ্ডী সুমুখে খাড়া করা দরকার। কেননা বাঙালির বিশ্বাস — মানুষের মতো মানুষ দেশে নেই, আছে শুধু বিদেশে।
রাম তাই মুরুব্বি পাকড়ালেন বোম্বাইয়ের চোরজি ক্রোড়জি কলওয়ালাকে। Rationalist অমনি লিখলে— ‘কলওয়ালার মতো অত বড়ো মাথা ভারতবর্ষে আর কারো নেই।’
অপরপক্ষে শ্যাম মুরুব্বি পাকড়ালেন মাদ্রাজের কৃষ্ণমূর্তি গৌরীপাদং আইন আচারিয়ারকে। Nationalist অমনি লিখলে— ‘আইন আচারিয়ারের মতো অত বড় বুক ভারতবর্ষে আর কারো নেই।’
এর জবাবে Rationalist লিখলে— “অব্রাহ্মণের যে ছায়া মাড়ায় না, সেই হল শ্যামের মতে ডিমোক্রাটের সর্দার!’ পাল্টা জবাবে Nationalist লিখলে— ‘কলের কুলির রক্ত চুষে যে জোঁকের মতো মোটা ও লাল হয়েছে, সেই হল রামের মতে ডিমোক্রাটের সর্দার!’ বেচারা কলওয়ালা— বেচারা আইন আচারিয়ার! দুজনেই সমান গাল খেতে লাগল।
যে-সব বাঙালি দলাদলির বাইরে ছিল, তারা এ ক্ষেত্রে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ল; কেননা বাঙলার নেতাদ্বয় স্বজাতিকে বুঝিয়ে দিলেন যে, বাঙালির মাথাও নেই, বুকও নেই; যে কজনের কাছে তারা হয় এ দলে নয় ও দলে ভর্তি হয়েছে। এ কথার পর আমাদের আর মুখ থাকল না। লজ্জায় আমরা অধোবদন হয়ে গেলুম।
কিন্তু সব দেশেই এমন দু-চারজন অবুঝ লোক থাকে যারা কোনো জিনিস সহজে বোঝে না। তারা ধরে নিলে যে, মেড়া লড়ে খোঁটার জোরে, সুতরাং তারা সেই খোঁটার অনুসন্ধানে বেরোল, এবং দুদিনেই তার খোঁজ পেলে।
রাম ও শ্যাম দুজনেই তাদের কানে কানে বললেন যে, তাঁদের পিছনে আছে—বিলেত। রামের বিশ্বাস তিনি হাতিয়েছেন বিলেতের capital, আর শ্যামের বিশ্বাস তিনি হাত করেছেন বিলেতের labour; এই ভরসায় দু পক্ষেরই বড়োরা মনে করলে যে তারা নির্ঘাত মন্ত্রী হবে। এর পর দু দলের কি আর মিল হয়? যা হতে পারে সে হচ্ছে একদম ছাড়াছাড়ি, এবং হলও তাই।
রাম স্বদলবলে দ্বারিকায় গিয়ে এক মহাসভা করলেন, আর শ্যাম রামেশ্বরে গিয়ে আর এক মহাসভা করলেন। ফলে, এক দিকে মোটাভাই চোটাভাই বাটলিওয়ালা কাথলিওয়ালাদের আনন্দে বাকরোধ হয়ে গেল, অন্যদিকে বেঙ্কট কেঙ্কট জম্বলিঙ্গম্ কোটীলিঙ্গমদেরও উৎসাহে দশা ধরল।
রামের চেলারা বললেন, ‘আমরা ভারতবর্ষে রামরাজ্যের প্রতিষ্ঠা করব,’ শ্যামের চেলারা সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘আমরা ভারতবর্ষে ধর্মরাজ্যের সংস্থাপন করব।’ Nationalist বিপক্ষের উপরে এই বলে চাপান দিলে যে, ‘তোমরা যা প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছ তার নাম রামরাজ্য নয়, তোমাদের আরাম-রাজ্য।’ Rationalist অমনি উতোর গাইলে— ‘তোমরা যার স্থাপনা করতে চাচ্ছ— তার নাম ধর্মরাজ্য নয়— তোমাদের শর্ম-রাজ্য।’
লাভের মধ্যে দাঁড়াল এই যে, বাঙলায় রিফরমের কথাটা চাপা পড়ে গেল, তার পরিবর্তে রাম বড়ো না শ্যাম বড়ো, এইটে হয়ে উঠল আসল মীমাংসার বিষয়। ছেলেবেলায় রাম-শ্যামের জীবনের যেটা ছিল রহস্য, সেইটে হয়ে উঠল এখন সমস্যা।
এ সমস্যার মীমাংসা আজ করা কিন্তু অসম্ভব, কেননা ‘স্বরাজ’ এখন রাজা হরিশ্চন্দ্রের মতো আকাশে ঝুলছে; অতঃপর তা উড়ে স্বর্গে যাবে কি ঝরে মর্তে পড়বে, সে কথা রামও বলতে পারেন না, শ্যামও বলতে পারেন না। হরি বলে, ও এখন অনেকদিন ঐ মাথার উপরেই ঝুলবে। কিন্তু ধরো যদি যে, রিফরম স্কিমটি যেমন আছে ঠিক তেমনি এ দেশে ভূমিষ্ঠ হয়, তা হলেই যে এ সমস্যার মীমাংসা হবে তাই-বা কি করে বলা যায়? হয়তো তখন দেখা যাবে যে, রাম হয়েছেন বাঙলার Finance Minister, আর শ্যাম হয়েছেন তার Chief Secretary! তা হলে?
তবে এ কথা নির্ভয়ে বলা যায় যে, ভারতমাতা রাম-শ্যামের টানাটানিতে নিশ্চয়ই খাড়া হয়ে উঠবেন, যদি ইতিমধ্যে কোনো দুর্ঘটনা না ঘটে; এবং তা ঘটবার সম্ভাবনা যে নেই, সে কথা চোখের মাথা না খেলে বলবার জো নেই। মা এখন ইনফ্লুয়েঞ্জা নামক মারাত্মক ক্ষয়রোগে যেরকম আক্রান্ত হয়েছেন, তাতে করে তাঁর পক্ষে হঠাৎকারে রাম- শ্যামের হাত এড়িয়ে চলে যাবার আটক কি?
“আমার কথা ফুরল, নটে গাছটি মুড়ল।”
—বীরবল।
পুনশ্চ
এ গল্প পড়ে আমার গৃহিনী বললেন, “কই গল্প তো শেষ হল না?”
আমি কাষ্ঠ হাসি হেসে উত্তর করলুম, “এ গল্পের মজাই তো এই যে, এর শেষ নেই। এ গল্প এ দেশে কবে যে শুরু হয়েছে তা কারো স্মরণ নেই, আর কখনো যে শেষ হবে তারও কোনো আশা নেই। এ গল্প যদি কখনো শেষ হত, তা হলে ভারতবর্ষের ইতিহাস এ পৃথিবীর সব চাইতে বড়ো ট্রাজেডি হত না।”
কার্তিক অগ্রহায়ণ ১৩২৫