প্রমথ চৌধুরীর গল্পরীতি

মহাকাব্য মধুসূদনের পরে আর রচিত হলো না; তার কারণ জাতীয় জীবনের যে জাগরণ ও উন্মাদনার মধ্যে, যে প্রসার ও উন্মুক্ততার মধ্যে, যে অফুরন্ত আলো-হাওয়ার মধ্যে মহাকাব্য জন্ম নেয়—মধুসূদনের সময়ে তা আত্মপ্রকাশ করেই মিলিয়ে গেলো—মিলিয়ে গেলো স্বাদেশিকতার সঙ্কোচনমুখী ‘গাধার চামড়ার’ মধ্যে, জটিল হলো শতসমস্যার লূতাতন্তুজালে। জাতীয় জীবনের বিপুল বিস্তার হারিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে গেলো মহাকাব্য। কিন্তু ধীরে ধীরে ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার উদ্ভব হলো, দেখা দিলো মধ্যবিত্ত সমাজ—তারা যোগালো নতুন রাষ্ট্রনৈতিক চেতনা, আর যোগালো গল্পের খোরাক। তাই বাংলা ছোটগল্পের ইতিহাসে ছড়িয়ে আছে মধ্যবিত্তের হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, ভয়-ভাবনা, ধ্যান-ধারণা, শিক্ষা-দীক্ষার স্বাক্ষর।

কিন্তু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমাদের মধ্যবিত্ত সমাজ বড়ো বেশি সঙ্কীর্ণ, তা গল্পের উপকরণ কতকাল যোগাবে, তার বিষয়-বৈচিত্র্য বা কতখানি আনবে, এই নিয়ে প্রশ্নের অন্ত নেই। কিন্তু প্রমথ চৌধুরীর গল্পের দিকে তাকিয়ে অবাক হতে হয়—আমাদের জীবনের মধ্যে এত বৈচিত্র্যও আছে। সঙ্গে সঙ্গে আরও মনে হয়, লেখকের দৃষ্টি প্রসারের  কথা, তাঁর তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণশীলতার কথা। বিষয় যেখানে সামান্য ও সঙ্কীর্ণ, সেখানে ফেনিয়ে ফাঁপিয়ে তাকে বিস্তার দেওয়া যায়, ভাবালুতার বাষ্পে তাকে বেলুনের মতো বড়ো করে তোলা যায়। কিন্তু প্রমথ চৌধুরীর কাছে ভাবালুতা ছিলো বিষের মতো পরিত্যাজ্য, তাই ভাবালুতার সহযোগ বিষয়-বৈচিত্র্য সম্পাদন তিনি করেন নি, তা করতে তিনি পারেন না। দ্বিতীয়তঃ, বিষয়ের সম্বল যেখানে কম, সেখানে পুনরাবৃত্তি করে সৃষ্টিপ্রাচুর্য দেখানো যেতে পারে। কিন্তু আমরা জানি, বীরবল গতানুগতিকতার, একঘেয়েমির ঘোর শত্রু—নতুনের, অভিনবের পরম মিত্র। ফলে পুনরাবৃত্তির পথে বিষয়ের বিচিত্র সম্প্রসারণ তাঁর অভিপ্রেত হতে পারে না। তবে প্রতি গল্পে এমন বস্তুস্বাতন্ত্র্য তিনি কোথা থেকে আনলেন, জানলেন কেমন করে?

তার উত্তরে বলা যায়, প্রমথ চৌধুরীর প্রতিভা ছিলো অনন্যসাধারণ, মেধা ছিলো ক্ষুরধার, বুদ্ধি ছিলো অন্তর্ভেদী, দৃষ্টি ছিলো সুদূরপ্রসারী। তা নিয়ে তিনি আমাদেরকে সঙ্কীর্ণ সমাজের সর্বত্র প্রদক্ষিণ করেছেন; তার আনাচে-কানাচে, অলিতে-গলিতে, আড়ালে-আবডালে, উপরে-নিচে, ভেতরে-বাইরে ঘুরেছেন, দেখেছেন, দেখেছেন, বিশ্লেষণ করেছেন। কখনও কখনও মধ্যবিত্ত জীবনের সূত্র ধরে বা সূত্র টেনে পাড়ি দিয়েছেন অভিজাত সমাজে। ধূর্জটিপ্রসাদ বলেছেন—’চার-ইয়ারী কথার প্রত্যেক ইয়ারের কাহিনী, আহুতি ও অণুকথার প্রত্যেক গল্প, নীল-লোহিতের হরেক কিসসা একটি অন্যটি থেকে পৃথক। ঘটনার ক্ষেত্র কখনও বড় কখনও ছোট; সহরে, গ্রামে, মাঠে, ট্রেনে, ষ্টীমারে, বাংলা দেশে, প্রবাসে, বিদেশে; চরিত্র ভূত-পেত্নী, আসামী, নেশাখোর, ভবঘুরে, পানওয়ালী, বাইজী থেকে আমীন-আমলা, কেরাণী, মধ্যবিত্ত, অধ্যাপক, প্রজা, লাঠিয়াল, বিলেতফেরতা, ইংরেজ গোরা, জমিদার পর্যন্ত; রসও বহু প্রকারের-হাসি, ভয়, ঠাট্টা, করুণা, সাহস, হিংসা, নিষ্ঠা ও আভিজাত্যবোধের। এমন বিস্তারিত পটভূমিতে তাঁর লেখনী অনায়াসে বিচরণ করে। কলকেতে তামাক ভরা, ডালকুত্তাকে খাওয়ান, বাইজী বাড়ির হালচাল, লাঠিয়ালের বাবরী চুলের প্রসাধন, এই সব প্রক্রিয়া যেমন তাঁর করায়ত্ত, তেমনি ইঙ্গবঙ্গ সমাজের রীতি-নীতি, কালীবাড়ীর ধুমধাম, শিকার খেলা প্রভৃতি বড়মানুষী খেয়ালের বর্ণনায় তিনি সিদ্ধহস্ত। আদৎ কথা এই যে, প্ৰমথবাবু গল্পের বিষয়বোধে প্রবুদ্ধ’। এই বিষয়বোধ ও বিস্তৃতক্ষেত্রে অনায়াস মানস-বিচরণ-শক্তি সকলের থাকে না—দ্বিতীয়টি থাকলেও প্রথমটির অভাব সুস্পষ্ট, আর প্রথমটির অনস্তিত্বে দ্বিতীয়টি যে মূল্যহীন কল্পনার ফানুসই সৃষ্টি করে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বিষয়- চেতনা প্রমথ চৌধুরীর প্রখর ছিলো বলে তাঁর কোনো গল্পই ব্যর্থ নয়, বিশেষ বিশেষ আবহাওয়া ও আমেজে পরিপূর্ণ। এটা নিঃসন্দেহে বড়ো রকমের সার্থকতার পরিচায়ক।

এখন কথা হচ্ছে, বাংলার জীবন নিয়ে এই যে কথাকাহিনী রচনা, তাতে সমগ্রভাবে বাংলা ও বাঙালীর কোন রূপ ফুটে উঠেছে? উত্তরে বলা যেতে পারে—শক্ত শাক্ত রূপ। ‘বাঙালী মনের ক্ষুব্ধ বিপ্লবান্বিত কল্পনাপ্রবণতা এবং বাঙালী জীবনের নানা ডিগ্রি অনশন অপমানের দৈনিক ইতিবৃত্ত জেনেও তিনি বাংলার প্রাণকে অস্বীকার করেন নি। তাঁর গল্পে খাঁটি বাংলা মরে নি, নূতন শক্তিতে লড়ছে পুরোনো ডাঙায়, পুরোনো কলেজার আভিজাত্য বজায় রেখে। সেখানে আজও ঈশ্বর পাটনির দু-হাত লাঠিখেলা, লাঠি লকড়ি সড়কি ধরার জোর দ্রষ্টব্য। অনুকথা সপ্তক বইখানিতে বাঙালীর মর্যাদা আছে এবং রয়েছে শক্ত হাড়ের পরিচয়, যা দেখতে পাই তাঁর অন্য ছোট গল্পে, আহুতি জাতীয় সংগ্রহে। মাছের ঝোল, মিহি গান, বেতারের লড়াইয়ের বাজি নিয়ে মত্ত বাঙালী বাবুই সবখানি বাংলা নয়। ক-জন সাহিত্যিক দেখিয়েছেন সাবলীল, সংগ্রামী, সাত- আগুনে পোড়া মেজাজী বাঙলার মনকে? পল্লীর ঝিল্লিগান, করুণ খোড়ো ঘরে অভিমানিনী, কলাগাছের বেড়া, পচা পুকুর, সাংঘাতিক গ্রাম্য চক্রান্ত এবং দিবান্তে শেয়ালের কোরাস নিয়ে চিত্রিত হয়েছে বিশেষ একটি দৃষ্টির সংস্কার।’ অর্থাৎ নানা সমস্যার আঘাতে আঘাতে যে বাংলা মরণদশার মানস নিয়ে ভুগছে—সেই বাংলাকে অন্যান্য সাহিত্যসাধকদের মতো তিনি গল্পসাহিত্যে ফুটিয়ে তোলেন নি—তিনি তাতে বাংলার সজীব প্রাণের ধারা আবিষ্কার করতে চেয়েছেন, আবিষ্কার করতে পেরেছেন।

তার অনেক প্রমাণ দেওয়া যেতে পারে। ‘আহুতি’তে দেখি—সেই দিন দুপুর রাত্তিরে—যখন সকলে শুতে গিয়েছে—রত্নময়ী নিজের ঘরে আগুন লাগিয়ে দিলে।… ধনঞ্জয় ও রঙ্গিণী ঘর থেকে বেরিয়ে পালাবার চেষ্টা করছিল।… রত্নময়ীর আদেশে তারা (পাঠানপাড়ার প্রজা) ধনঞ্জয় ও রঙ্গিণীকে সড়কির মারে আপাদমস্তক ক্ষতবিক্ষত করে সেই জ্বলন্ত আগুনের ভেতর ফেলে দিলে। রত্নময়ী অমনি অট্টহাস্য করে উঠল। তারপর সেই পাঠানপাড়ার প্রজাদের মাথায় খুন চেপে গেল, তারা ধনঞ্জয়ের চাকর-দাসী, আমলা-ফয়লা, দ্বারবান, বরকন্দাজ যাকে সমুখে পেলে, তার উপরেই সড়কি ও তলোয়ার চালালে, রায়বংশের পৈতৃক ভিটার উপরে আগুনের ও নিচে রক্তের নদী বইতে লাগল’। এখানে শাক্ত সামন্ততান্ত্রিক বাংলার শক্ত হাড়ের পরিচয় বারেকের জন্যে ঝিলিক দিয়ে উঠেছে যেমন উঠেছে, ‘পূজার বলিতে’। সেখানে শক্তিরূপিণী মায়ের কণ্ঠে শুনি—’আমার পেটে হয়েছে শুধু শেয়ালকুকুর—যদি মানুষের গর্ভধারিণী হতুম, তা হলে আর তোমার চৌদ্দ পুরুষের পূজো বন্ধ হতো না।’ মায়ের এই হুঙ্কার ব্যর্থ হয় নি—বন্ধু এক কোপেই সাবাড় করেছে শত্রু এবং বন্ধু বন্ধুকে বাঁচাতে গিয়ে আন্দামান বরণ করেছে মায়ের যোগ্যপুত্র। আর সিতিকণ্ঠ সিংহ ঠাকুর (সহযাত্রী)? ‘যেমন লম্বা, তেমনিই চওড়া। চোখের আন্দাজে বুঝলুম যে, তাঁর বুকের বেড় অন্ততঃ ৪৮ ইঞ্চি হবে। অথচ তিনি স্থুল নন। এ শরীর যে কুস্তিগীর পালোয়ানের, সে বিষয়ে আমার মনে কোনো সন্দেহ রইল না। …তাঁর গায়ে ছিল গেরুয়া পাগড়ি ও পায়ে পেশোয়ারী চাপলি। তাঁকে দেখে আমি একটু ভ্যাবাচাকা খেলুম, কারণ পাঠান যে সাধু হয়, তা আমি জানতুম না; আর আমি ধরে নিয়েছিলুম যে, এ ব্যক্তি পাঠান না হয়ে যায় না। এঁর মুখে-চোখে একটা নির্ভীক বেপরোয়া ভাব ছিল—যা এ দেশের কি গৃহস্থ, কি সন্ন্যাসী, কারও মুখে সচরাচর দেখা যায় না।’ কিন্তু আসলে তিনি বাঙালী, জাতিতে ব্রাহ্মণ, পেশায় জমিদার। হতে পারে, এ যুগের গণতন্ত্রে দীক্ষিত মানুষের কাছে এরা আর আদর্শ মানুষ নন, কিন্তু প্রমথ চৌধুরীর দৃষ্টিতে এরা আদর্শ মানুষ না হতে পারেন, কিন্তু শক্ত মানুষ—শাক্ত মানুষ; আর ভূতে-পাওয়া কান্নায় নেতিয়ে-পড়া নির্জীব বাঙালীর চোখের সামনে এদের তুলে ধরবার দরকার আছে।

‘পথের পাঁচালী’ অপূর্ব বই—কিন্তু এতে বাংলার যে মূর্তি দেখি তা একটু করুণ, স্যাঁতসেঁতে, একটু বা morbid; এই করুণ প্যাটার্ণের বদলে প্রমথ চৌধুরী আঁকলেন ঈশ্বর পাটনিকে (‘মন্ত্রশক্তি’)—প্রয়োজনবোধে যার চোখে আগুন জ্বলেছে আর শরীরটা হয়েছে ইস্পাতের মতো। বীরবল দেখিয়ে দিলেন বাংলার সজীব প্রাণের ধারা এখনও শুকিয়ে যায় নি—নতুন সমাজ গঠনে এদের বাদ দিলে সমাজের হবে অনেক ক্ষতি, আর সাহিত্য যদি এদের বাদ দেয় তবে তা হয়ে পড়বে নির্জীব।

তবে অন্যদিকটাকেও তিনি উপেক্ষা করেন নি, তাকে মিথ্যা বলেন নি—কিন্তু সেটাই যে সব নয়, সেটাই যে সাহিত্যের একমাত্র উপজীব্য নয়, এই হলো প্ৰমথ চৌধুরীর বক্তব্য। আমরা তাঁর গল্পে দেখেছি—সামাজিক গোঁড়ামির যুপকাষ্ঠে বলি দেওয়া শ্রীমতির নিশ্চল নিষ্প্রাণ নির্বিকার মুখ—শ্বেতপাথরের দেবীমূর্তি—আর কোথাও নয়, বিয়ের বাসরে, আর তা বিয়ে তো নয় যেন দুটি Statue-র বিয়ের অভিনয় (‘একটি সাদা গল্প’)। আর দেখেছি ঈর্ষাপরায়ণা রঙ্গিণীর রত্নময়ীর ছেলেটিকে যখ দেওয়ার ভুতুড়ে ছবি (‘আহুতি’), ঘোড়ার আস্তাবলে অস্থিচর্মসার মুমূর্ষু ঝোউন-লোউনের করুণ মূর্তি (‘ঝোট্টন লোউন’), যখ-দেখতে পাওয়া রমা ঠাকুরের অন্ধ বিশ্বাসের রূপ (‘যখ’), কোন্দলপরায়ণ বাঙালীর কলহের চিত্র (‘নীল-লোহিতের সৌরাষ্ট্রলীলা’)—এক কথায় রোগে জীর্ণ, লোভ আর ভয়ে জর্জরিত, বিভেদ-বিচ্ছেদ দুর্বল বাঙালীর মূর্তি আর পল্লী বাঙলার জঙ্গলাকীর্ণ শেওলা-ধরা, ধ্বংসোন্মুখ ছবি তিনি ফুটিয়েছেন নিপুণ রেখায়। সুতরাং সত্যসন্ধানী দৃষ্টি তাঁর ছিলো, তবে তা পরিচিত সত্যকে স্বীকার করে তৃপ্ত হয় নি, উপেক্ষিত সত্যকে আবিষ্কার করতেও চেয়েছে—চেয়েছে বাঙালীর অনির্বাণ প্রাণের আগুন খুঁজে বের করতে। এখানেই তো দেশের পুনরুজ্জীবনের পথ তিনি দেখিয়ে গেলেন।

আর এই প্রসঙ্গে তাঁর নির্বাচন-শক্তির কথাও উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রেম তাঁর ছোটগল্পের উপজীব্য নয়; সাধারণ মানুষ ও তাদের প্রচলিত সুখদুঃখের কাহিনী সেখানে শুনতে পাই না। আমরা জানি, ভূত-পেত্নী নায়ক-নায়িকা হয় ভূতের গল্পে, কিন্তু বাস্তব সংসারের গল্পে তাদের অবতারণা করে প্রমথ চৌধুরী প্রচলিত সংস্কার ভেঙে দিয়েছেন (‘ফার্স্ট ক্লাস ভূত’, ‘ভূতের গল্প’, ‘ফরমায়েসি গল্প’, ‘চার-ইয়ারী কথার’ শেষ কাহিনী); কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, তা হাস্যকর হয়ে ওঠে নি, বরং বিশেষ আবহাওয়া ও রস সৃষ্টি করতে পেরেছে। বিশেষ করে ‘ফরমায়েসি গল্পে’ তর্কে-বিতর্কে ধাক্কা খেতে খেতে দেবমন্দিরে ‘দুর্গেশনন্দিনীর’ তিলোত্তমা গড়ে উঠলো—তাকে নিয়ে পাঠকের মন বিভোর হতে না হতেই তা আবার তর্কে বিতর্কে ধাক্কা খেতে খেতে দমকা হাওয়ায় মন্দিরের দুয়ার খুলে ভূত হয়ে মিলিয়ে গেলো;—দেখে শুনে মনে হয়, মানুষের গল্প ও ভূতের গল্পের মধ্যে বিশেষ কোনো সীমারেখা নেই, সব একাকার হয়ে গিয়ে, মধুর রস ও অদ্ভুত রস মিলে গিয়ে গল্পটি বিশেভাবে স্বাদু ও উপভোগ্য হয়ে উঠেছে।

প্রমথ চৌধুরীর গল্পে নেশাখোরের সাক্ষাৎ ঘটে। রুদ্রপুরের পথে পাল্কীর বেহারারা জিরিয়ে নিতে গিয়ে এক মহা জটলা পাকিয়ে তুললো—কারণ কি, না ‘বড় তামুক সেবন’, সঙ্গে গঞ্জিকার ত্বরিতানন্দের আবির্ভাব (‘আহুতি’)। নেশাখোরের অভিনয় দেখা যায় বড়বাবুর চরিত্রে—ভদ্র মহিলাকে বে-ইজ্জত করার চার্জে জেলে যাওয়া নিশ্চিত বলে জানালেন যখন, তখন হঠাৎ করে মনে হলো—এ বিপদ থেকে উদ্ধার পাবার একমাত্র উপায় হচ্ছে মাতলামির ভান করা, ‘মদ না খেয়ে মাতলামির অভিনয় করা, যখন দেহের কলকব্জাগুলো সব ঠিক ভাবে গাঁথা থাকে, তখন দেহের বাঁকানো চোরানো দোমড়ানো কোঁকড়ানো, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোকে এক মুহূর্তে ছড়িয়ে দেওয়া অতিশয় কঠিন ও কষ্টকর ব্যাপার। কিন্তু হাজার কষ্টকর হলেও আত্মরক্ষার্থে, যতক্ষণ না তিনি পাহারাওয়ালা কর্তৃক ধৃত হন, ততক্ষণ বড়বাবুকে এই কঠিন পরিশ্রম স্বীকার করতে হয়েছিল (‘বড়বাবুর বড়দিন’)। এই তো গেলো দিশি মাতালের  কথা; সাহেব মাতালও বাদ যায় নি। ‘গাড়ীতে একটা বুড়ো সাহেব ছিল, সে রাত চারটে পর্যন্ত অর্থাৎ যতক্ষণ হোঁস ছিল, ততক্ষণ মদ চালালে। তার দেহের গড়নটা অদ্ভুত কোমর থেকে গলা পর্যন্ত ঠিক বোতলের মত। মদ খেয়েই তার শরীরটা বোতলের মত হয়েছে, কিংবা শরীরটা বোতলের মত বলে সে মদ খায়, এ সমস্যার মীমাংসা আমি করতে পারলুম না।… সে ভদ্রলোক পালায় পালায় হাসছিল ও কাঁদছিল। হাসছিল—বিড় বিড় করে কি বকে, আর কাঁদছিল—পরলোকগতা সহধর্মিণীর গুণকীর্তন করে। সে যাত্রা গাড়ীতে প্রথমেই মানব- জীবনের এই ট্রাজি-কমেডির পরিচয় লাভ করলুম (‘ছোটগল্প’)।

জমিদার চরিত্রও প্রমথ চৌধুরী টেনে এনেছেন তাঁর গল্পে। সিতিকণ্ঠ সিংহ ঠাকুর—বাংলার জমিদার ছেলেদের মধ্যে বোধ হয়, বোধ হয় কেন, নিশ্চয়ই সর্বশ্রেষ্ঠ (‘সহযাত্রী’); রুদ্রপুরের রায়বাবুরা, বিশেষ করে উগ্রনারায়ণ—তার মতো সাহসী পুরুষ রায়বংশে কখনও জন্মগ্রহণ করে নি (‘আহুতি’); মকদমপুরের জমিদার রায় মহাশয়—তার বৈঠকখানায় তাকে ঘিরে থাকতো ইয়ারবক্সীর দল (‘ফরমায়েসি গল্প’); দেনার দায়ে বিক্রী-হয়ে-যাওয়া জমিদারির অধিকারি—তার দর্প আপন সন্তানকে আন্দামান পাঠাতে দ্বিধা করে নি (‘পূজার বলি’) ইত্যাদি কত জমিদার চরিত্রই না আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে—এই ক্ষয়িষ্ণু সামন্ততান্ত্রিক সমাজের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও শক্তিমাহাত্ম্য প্রমথ চৌধুরীকে আকর্ষণ করেছিলো, সন্দেহ নেই।

আর আছে আসামী ও চোর। কুলদাবাবু ও ছনুর বাবার মর্মস্পর্শী চিত্র পেয়েছি ‘জুড়িদৃশ্যে’–তারা দুইজনেই আন্দামানফেরত; খুন যে করে নি, খুনের দায়ে তার আন্দামান-বাসের কাহিনী শুনেছি ‘পূজার বলিতে’। এদেরই পিঠ পিঠ আসে প্রবঞ্চকের কথা। এ-দলের পাণ্ডা ধনঞ্জয় সরকার—ইংরেজের আইনের সাহায্যে এবং সেই আইন বাঁচিয়ে, কি করে অর্থোপার্জন করতে হয়, তার অন্ধি-সন্ধি ফিকির-ফন্দি সব তার নখদর্পণে ছিলো—রায়বাবুদের মুহুরী থেকে সে হলো মোক্তার, তারপর রুদ্রপুরের জমিদার (‘আহুতি’)। প্রমথ চৌধুরীর চরিত্র-নির্বাচনের তালিকা থেকে বাইজীও বাদ পড়ে নি—আমরা নির্জন নীরব নিঝুম রাত্রির পটভূমিতে ঝাড়লণ্ঠনের আলোতে দেখছি সকল সুন্দরীর সংক্ষিপ্ত সার বাইজীকে (‘নীল-লোহিতের সৌরাষ্ট্রলীলা’), ‘অবনীভূষণের সাধনা ও সিদ্ধিতে’ দেখেছি বারবনিতাকে। বিলেত-ফেরত চরিত্রের প্রকৃষ্ট উদাহরণ চার-ইয়ার—তাদের  চতুরঙ্গ প্রেমের কাহিনীতে দিশি আল-বোলার গন্ধ ছড়িয়ে নেই, ছড়িয়ে আছে বিলিতি চুরুটের গন্ধ—এরা যেন, অনেক সমালোচকের মতানুসারে, বিলেত-ফেরত প্রমথ চৌধুরীর প্রতিচ্ছায়া। ভবঘুরে সীতাপতি রায়কে দেখেছি বীরবলের মৃত্যুর চার বছর আগে লেখা একটি গল্পে (‘সীতাপতি রায়’), দেখেছি মন্দ-ভাগ্য কেরাণী প্রাণবন্ধু দাসকে (‘অদৃষ্ট’), মুন্সেফ শ্যামলালকে (‘একটি সাদা গল্প’), মজলিশী ঘোষাল আর নীল-লোহিতকে, উজ্জ্বল-নীলমণির ভক্ত নীলমণি গোস্বামীকে (‘ফরমায়েসি গল্প’), সেটেলমেন্ট অফিসার দে সাহেব ও অধ্যাপক কিশোরীরঞ্জনকে (‘ছোটগল্প’), বন্দুকপ্রিয় অভিজাত পল্টনী সাহেবকে (‘সহযাত্রী’), পত্রিকা-সম্পাদক শ্যাম ও রাজনীতিজ্ঞ (‘রাম ও শ্যাম’)। সুতরাং চরিত্র-নির্বাচনে প্রমথ চৌধুরী নিঃসন্দেহে মৌলিকতা ও বৈচিত্র্যের পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর লক্ষ্য শুধু মধুর রস নয়—বিচিত্ৰ রকমের রস; তাই কেবল রোমান্টিক চরিত্র নির্বাচন করেন নি তিনি।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই সব চরিত্র কতখানি জীবন্ত। প্রমথ চৌধুরীর সমসাময়িক কথাশিল্পী শরৎচন্দ্রের চরিত্রগুলি জীবন্ত ও প্রাণবন্ত, একথা অনেকেই মনে করেন। শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের জীবনালেখ্যের সঙ্গে প্রমথ চৌধুরীর গল্পের জীবনালেখ্যের তুলনামূলক বিচার করলে একটা পার্থক্য সহজেই ধরা পড়ে। শরৎ-সাহিত্য হৃদয়াবেগ সুস্পষ্ট ও প্রচুর—সেই হৃদয়রসই যেন চরিত্রগুলির জীবনের আলবালে, তাদের মর্মমূলে অমৃত সিঞ্চন করেছে। সে নির্মল স্নেহস্নিগ্ধ আলোকপাত প্রতি প্রভাতে সূর্যমুখীর শিরায় শিরায় শিহরণ আনে, পুলক জাগায়, প্রাণচেতনা যোগায়, প্রকাশের মন্ত্র ছড়ায়— শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের চরিত্রমিছিলে সেই আলোকপাতই দেখতে পাই। বুদ্ধিবাদীদের প্রত্যাশা তাতে সম্পূর্ণ মেটে না বটে, তবু সাধারণ বাঙালি পাঠক বলেন— এইতো জীবন। অন্যদিকে প্রমথ চৌধুরীর গল্প-সাহিত্য পড়ে তারা বলেন, —কী যেন পেলাম না, ঠিক যেন জীবনকে দেখলাম না। কেন এই অভাববোধ? কোন জিনিসের অনস্তিত্ব এই ধরনের মন্তব্যের কারণ? এর উত্তরে সাধারণ বাঙালি পাঠক নিজেই বলেন— যে হৃদয় আমাদের জীবনের অনেকখানি, সেই হৃদয়ের কোনো প্রকাশ নেই বীরবলী গল্পে। তাই আমাদের মতো জীবন তাতে নেই। এই বহুপ্রচলিত কথাগুলিকে একটু যাচাই করে দেখা দরকার।

লেখকমাত্রই গল্পের কথাবস্তু ও জীবন-উপাদান দুভাবে সংগ্রহ করেন— হয় জীবনের বই পড়ে, নয় কাগজের বই পড়ে। টমাস হার্ডি জীবনকে জেনেছিলেন জীবনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে মোকাবিলা করে—তাঁর জীবনানুভূতি বাস্তব ও অব্যবহিত— ওয়েসেক্সের (ডরসেটসায়ার) মাটি ও সেই মাটির মানুষের সঙ্গে অন্তরঙ্গ যোগাযোগ থেকে উদ্ভুত। আর এই জীবনকে তিনি পেয়েছিলেন প্রাথমিক চিত্তবৃত্তিতে (elementary passions), মস্তিস্কের মধ্যে নয়। এইতো গেল গ্রামের মানুষের জীবনের কথা। মার্কিন সাহিত্যিক ও. হেনরী নিজের বিচিত্র জীবনে বহু নাগরিক মানুষের সান্নিধ্যে এসেছেন, তাদের জেনেছেন। তাই তো বলা হয় : “the amazing keenness of his observation provided for his stories backgrounds taken straight from life’ আর সে জানার কাজে শুধু তাঁর বুদ্ধিধর্মই কাজ করে নি, কাজ করেছে হৃদয়ধর্মও। ‘The Romance of Busy Broker’ গল্পে নিউইয়র্ক শহরের এক ব্যস্তবাগীশ দালাল প্রেমলীলার উপসংহারে যখন নিজের বিয়ের কথাই ভুলে গেল তখন তার স্ত্রীর চোখ বেয়ে জল গড়াতে লাগলো;— এই চোখের জলের মধ্যে কি লেখক নিজের চোখের জলও মিশিয়ে দেন নি?

আর কাগজের বই পড়ে জীবনকে পাওয়ার চেষ্টার উদাহরণও দুষ্প্রাপ্য নয়। ওয়েলসের উপন্যাসে বা শ’এর নাটকে যে চরিত্রের সঙ্গে পরিচিত হই, তা কি সোজাসুজি জীবন থেকে নেওয়া? তাঁরা সংসারে নর-নারী দেখেছেন নিশ্চয় কিন্তু তার চেয়ে বেশি দেখেছেন পুঁথির জগতে। শুধু তাই নয়, লাইব্রেরির পরিবেশে তাঁরা জীবন অধ্যয়ন করেছেন— সেই অধ্যয়ন ও চিন্তার ফলে জীবনের যে abstraction লাভ করেছেন তারই ভিত্তিতে করেছেন নতুন জীবন-নির্মাণ। আর তাঁদের চরিত্রসৃষ্টিতে হৃদয়ানুভূতির ছাপ কতখানি আছে? বার্নার্ড শ’ সম্বন্ধে বলা হয়েছে : ‘Bernard Shaw’s characters bear the mark of the conscious will which has given them birth; few among them stir us with human sympathy….. Their very feelings when brought into play, seem dry and merely cerebral’. সুতরাং শরৎচন্দ্র-হার্ডিও. হেনরীর ক্ষেত্রে যেমন এক ধরনের চরিত্রসৃষ্টি দেখলাম, তেমনি আরেক ধরনের চরিত্র সৃষ্টি দেখলাম শ-ওয়েলসের ক্ষেত্রে।

প্রমথ চৌধুরী এ সমস্ত জানতেন। তবে তাঁর ধারণা : ‘জীবনগ্রন্থ থেকে কথা-বস্তু সংগ্রহ করা এক হিসেবে অতি সহজ। কেননা, এ গ্রন্থ সকলের সুমুখেই পড়ে রয়েছে। এ গ্রন্থ পড়বার জন্য কারও পক্ষে কোনও রূপ ব্যাকরণ কি অভিধান মুখস্থ করার প্রয়োজন নেই, কোনও রূপ শাস্ত্রমার্গে ক্লেশ করবার প্রয়োজন নেই। কিন্তু আর এক হিসেবে, এই বই পড়া অতি কঠিন। আমাদের অধিকাংশ লোকের এ পুস্তকের শুধু মলাটের সঙ্গে পরিচয় আছে। সে মলাট আমরা খুলতে ভয় পাই— কেননা, আমরা জানিনে যে জীবনের সামাজিক আবরণ উদ্ধাটিত করলে তার ভিতর থেকে সাপ ব্যাঙ কি বেরিয়ে পড়বে। অপর পক্ষে কাগজের বই থেকে কথা-বস্তু সংগ্রহ করা অপেক্ষাকৃত সহজ এবং এক হিসেবে মামুলি। বড় বড় লেখকদেরই উদাহরণ দেওয়া যাক। তাঁরা অনেকেই ও-বস্তু বই থেকেই সংগ্রহ করেছেন। কালিদাস শকুন্তলার কথা-বস্তু নিয়েছেন মহাভারত থেকে, ভবভূতি উত্তররাম-চরিতের কথা-বস্তু নিয়েছেন রামায়ণ থেকে।’ এই কারণে কাগজের বই থেকে জীবন-উপাদান সংগ্রহ করতে প্রমথ চৌধুরী দ্বিধা করেন নি। লেখাপড়া যাঁর পেশা নেশা কাজ আর খেলা তাঁর পক্ষে এটাই সুবিধাজনক পন্থা। অবশ্য সংসারের জীবনও ছায়া ফেলেছে তাঁর মনের মধ্যে। এই যে মালমশলা সংগৃহীত হলো তাকে তিনি আত্মসাৎ করেছেন নিজের প্রতিভা দিয়ে, পরের জিনিস নিজের মনের উত্তাপ দিয়ে গালিয়ে নিয়ে আপন করে নিয়েছেন। তারপর গল্প-সাহিত্যে যে চরিত্রগুলি সৃষ্টি হল, তা প্রমথ চৌধুরীর স্বকৃত বলেই গণ্য।

কিন্তু যে পরিমাণ হৃদয়াবেগ ও সহানুভূতি হার্ডি-ও হেনরী-শরৎচন্দ্রের চরিত্র সৃষ্টির মধ্যে লক্ষণীয়, তা বীরবলের চরিত্র সৃষ্টির মধ্যে নেই। তার অর্থ এই নয় যে, তাতে লেখকের প্রাথমিক সহানুভূতিটুকু পর্যন্ত নেই। আমাদের অধিকাংশ সাহিত্যে যে হৃদয়বোধের প্রকাশ তাতে ভাবালুতার আবিলতা থাকে প্রচুর এবং হৃদয়বোধের প্রয়োগেও অসংযম ও মাত্রাতিরেক দেখা যায়। কিন্তু প্রমথ চৌধুরীর গল্পে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সহানুভূতি আছে, আছে হৃদয়বোধের প্রকাশ—কিন্তু তার প্রয়োগ সর্বত্রই শুদ্ধ ও সংযত—বুদ্ধির দ্বারা তাকে শোধন করে পরিমিত পরিমাণে প্রয়োগ করাই তাঁর ধর্ম।

অরক্ষণীয়া মেয়েকে নিয়ে শরৎচন্দ্র হৃদয়াবেগ উজাড় করে দিয়েছেন—সমান আবেগ নিয়ে আমাদের সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে ক্ষোভও প্রকাশ করেছেন। প্রমথ চৌধুরীও রচনা করেছেন অরক্ষণীয়া মেয়ের উপাখ্যান। শ্যামলালের শিক্ষিতা ও সুন্দরী মেয়ের (‘একটি সাদা গল্প’) বিয়ের নামে যখন স্ট্যাচুর বিয়ের অভিনয় হলো, তখন লেখক চোখের জলে বক্ষ ভাসান নি, উজাড় করে দেন নি হৃদয়াবেগের প্রাচুর্য। ‘বর কনেতে যে মন্ত্র পড়ছিল, তা প্রথমে আমার কানে ঢোকে নি, তারপর হঠাৎ কানে এল, ক্ষেত্রপতি (বৃদ্ধ বর) বলছেন, ‘যদস্তু হৃদয়ং মম তদস্তু হৃদয়ং তব।’ কেন?— তা যার কিছুমাত্র বোধশক্তি আছে তিনিই বুঝবেন। শেষ বাক্যটি যেন সোজা পাঠকের হৃদয়ে গিয়ে বেঁধে। অথচ গল্পটি কি না ‘একটি সাদা গল্প’। এর মধ্যে নাকি কোনো নীতিকথা বা ধর্মকথা নেই, নেই কোনো সামাজিক সমস্যা। শরৎচন্দ্র একদা বীরবলকে লিখেছিলেন—’এক একটা অত্যন্ত চাপা লোক যেমন তাঁর বড় দুঃখটাকেও বলবার সময় এমন একটা তাচ্ছিল্যের সুর দেয় যে হঠাৎ মনে হয় যেন সে আর কারও দুঃখটা গল্প করে যাচ্ছে। এর সঙ্গে তার নিজের যেন কোনো সম্পর্ক নেই। আপনিও বলেন ঠিক তেমনি করে। ইনিয়ে বিনিয়ে কাতরোক্তি কোথাও নেই— অথচ কত বড় না একটা ট্রাজেডি পাঠকের বুকে গিয়ে বাজে। আপনার লেখায় এই সহজ শান্ত রিফাইন্ড বলার ভঙ্গিটাই আমাকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করে।’ অথচ এই সহজ শান্ত রিফাইন্ড ভঙ্গিটার জন্যেই প্রমথ চৌধুরীর গল্পে প্রাথমিক সহানুভূতিও অলক্ষ্য বলে সাধারণ পাঠকের মনে হয়।

‘সহযাত্রী’ গল্পে সিতিকণ্ঠ সিংহ ঠাকুর লেখকের সমবেদনা বা সহানুভূতি থেকে বঞ্চিত হয় নি— তবে সেই সমবেদনা অতি প্রচ্ছন্ন ও সূক্ষ্ম, পাঠকের অনুভূতির কাছে প্রায় অনধিগম্য। তার সাধুবেশ, বন্দুকপ্রীতি ও ট্রেনে ট্রেনে খেয়ালী ভ্রমণের বর্ণনা প্রাধান্য লাভ করায় তার বিড়ম্বিত জীবনের বেদনা (স্ত্রীর গৃহত্যাগঘটিত) প্ৰায় চাপা পড়ে গেছে। সুরনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তার কাগজে অতুলানন্দের কবিতা বাজে জেনে ছেপেছেন, তার কারণ তা না করলে অতুলের মা লতিকার illusion ভেঙে যাবে। আর এই লতিকা কে?— যার সঙ্গে একদিন সুরনাথের বিয়ের সম্বন্ধ হয়েছিল এবং যে আজও সুরনাথের আদর্শে নিজের ছেলেকে অতিমানুষ করতে চায়। গল্পটিতে ‘psychology’র একটি বাঁকা রেখার’ বর্ণনা পড়তে পড়তে পাঠকের হৃদয়ে একটি সূক্ষ্ম অনুরণন কি জাগে না (‘সম্পাদক ও বন্ধু’)? ট্রাজেডির সূত্রপাতে’ প্রৌঢ় অধ্যাপকের কুমারী ছাত্রীর প্রতি অনুরাগের কাহিনী পরিহাসমূলক হয়েও হয় নি—গল্পস্রষ্টার প্রচ্ছন্ন সহানুভূতিই আড়াল দিয়ে অধ্যাপকের মোহাবেশকে বিদ্রূপের পঙ্ককুণ্ডে পতনের হাত থেকে রক্ষা করেছে। গল্প-বলিয়ে ঘোষাল। গল্প বলতে বলতে ডিগবাজি খেতে সে ওস্তাদ; তার মুরুব্বিতে জমিদার রায়মশায় ধমকে ওঠেন : ‘ঘোষাল, তোর গল্প বন্ধ কর, নইলে কত যে মিথ্যে  কথা বানিয়ে বলবি, তার আর আদি অন্ত নেই। আজ তোর ঘাড়ে রসিকতার নয়, মিথ্যে কথার ভূত চেপেছে, ঝাঁটা দিয়ে না ঝাড়লে তা নামবে না।’ তবু শেষ পর্যন্ত তার ভূত ঝাড়বার জন্যে ঝাঁটা পড়লো না (শুধু উজ্জ্বলনীলমণির একটু দাঁত-খিঁচুনি দেখা গেল) —যদিও ঘোষালের হাতে পড়ে প্রেমের গল্প ততক্ষণে ভূতের গল্পে পরিণত হয়েছে। এতেই মনে হয়, ঘোষাল যতই মিথ্যে বলিয়ে হোক—তার স্রষ্টার সহানুভূতি সে আদায় করেছে, তা না হলে ঝাঁটা এড়ানো তার পক্ষে সাধ্য ছিল না (‘ফরমায়েসি গল্প’)। আর নীল-লোহিত? মিথ্যা কথনের আর্টে তার জুড়ি মেলা ভার, একমাত্র ঘোষাল ছাড়া। সত্য-মিথ্যার ভেদজ্ঞান তার লোপ পেয়ে যেতো গল্প বলার সময়ে। তবে কি সে comic figure. গোপাল ভাঁড়? লেখকের মতে তা নয়, যদি তা হতো তবে নীল- লোহিতের গল্প বন্ধ করার পরবর্তী জীবনের বর্ণনায় তিনি লিখতেন না’ লোকে বলে যে তিনি সত্যবাদী হয়েছেন—কিন্তু আমার মতে তিনি মিথ্যার পঙ্কে আকন্ঠ নিমজ্জিত হয়েছেন। তাঁর স্বধর্ম হারিয়ে, যে জীবন তাঁর আত্মজীবন নয়, অতএব তাঁর পক্ষে সম্পূর্ণ মিথ্যা জীবন—সেই জীবনে তিনি আবদ্ধ হয়ে পড়েছেন। তাঁর আত্মীয়-স্বজনেরা এই ভেবেই খুশি যে, তিনি এতদিনে—মানুষ হয়েছেন, কিন্তু ঘটনা কি হয়েছে জানেন? নীল-লোহিতের ভিতর যে মানুষ ছিল, তার মৃত্যু হয়েছে—যা টিকে রয়েছে তা হচ্ছে সংসারের ঘানি ঘোরাবার একটি রক্তমাংসের যন্ত্র মাত্র।’ এই মন্তব্যের মধ্যে নীল- লোহিত সম্বন্ধে সূক্ষ্ম বেদনাবোধ কি ধ্বনিত হয় নি?

প্রমথ চৌধুরী গল্পের চরিত্র সম্বন্ধে যেখানে স্নেহদৃষ্টি দেখিয়েছেন—সেখানেও সাধারণ বাঙালি পাঠক খুশি হয় নি। কারণ ‘আমরা বাঙালিরা স্নেহ বলতে তেল ঘি-ই বুঝি, তাই প্রমথবাবুর সংযত প্রয়োগকে নিছক বুদ্ধির না হয় আভিজাত্যের চিহ্ন ভাবি।’ তদুপরি অনেক ক্ষেত্রে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ, তর্ক-বিতর্ক ও অবান্তর প্রসঙ্গের তলায় চাপা পড়ে গিয়ে হৃদয়বোধের সংযত প্রয়োগও অস্পষ্ট ও প্রচ্ছন্ন প্রয়োগে পরিণত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ ‘ছোট গল্প’ ও ‘চার-ইয়ারী কথার’ শেষ গল্পটির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। ‘ছোট গল্পের’ মুখবন্ধে আছে ছোটগল্পের বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা, উপসংহারে আছে কথামুখের আলোচনার পুনরাবর্তন—ফলে মাঝখানে, প্রফেসর কিশোরীরঞ্জনের জীবনে পরস্ত্রী কিশোরীকে নিয়ে যে ট্রাজি-কমেডির আত্মপ্রকাশ, তার অন্তর্নিহিত কারুণ্য প্রায় চাপা পড়ে গেছে। ‘চার-ইয়ারী কথার’ শেষ গল্পে দাসীর গোপন প্রেমের আজীবন সাধনা, আমাদের হৃদয়কে স্পর্শ করে; কিন্তু তার পরেই পরলোকবাসিনীর টেলিফোন যোগে প্রণয়-নিবেদনের প্রয়াস সেই উৎসারিত হৃদয়াবেগকেই যেন বিদ্রূপ করতে থাকে। গল্প রচনার এই অভিনব কৌশল ও হৃদয়রসের সঙ্গে খানিকটা অম্ল- কষায় রস যুক্ত করার চেষ্টাই বীরবলী সাহিত্যকে হৃদয়ধর্ম বর্জিত বলে মনে করতে বাধ্য করে। আবার কোনো কোনো গল্পে হৃদয়বোধের সংযত প্রয়োগও নেই—সেগুলি নিতান্ত ই বিদ্রূপাত্মক, তাতে বুদ্ধি ও ব্যঙ্গের যে ছুরি-খেলা আছে, তাতে হৃদয়ের পক্ষ নেওয়া নিরাপদ নয়—যেমন ‘বড়োবাবুর বড়দিনে’। একটা চরিত্রকে কেমন করে বাঁদর করে তোলা যায়—তারই একটা ভাল আদর্শ পাই গল্পটিতে। এই গল্পে লেখকের হৃদয়ধর্মের প্রতি বিদ্রূপ যেন মারমুখী হয়ে উঠেছে। তবে প্রমথ চৌধুরীর হাতে বুদ্ধির খেলা ‘পাকা খেলোয়াড়ের ছুরি খেলা’ হয়েছে, ‘গুণ্ডার হাতের ছোরা খেলায়’ পরিণত হয় নি। কারণ তিনি ছিলেন নিপুণ আৰ্টিষ্ট।

অনেকে বলেন, প্রমথ চৌধুরীর গল্পে কোনো নিটোল কাহিনী নেই—অন্তত শরৎচন্দ্র, প্রভাত মুখোপাধ্যায় ও রবীন্দ্রনাথের গল্পে যে ধরনের কাহিনী মেলে তার অসদ্ভাব দেখতে পাওয়া যায় বীরবলের গল্পে। কিন্তু কথা হচ্ছে, গল্পের যথার্থ সংজ্ঞা কি? গল্পের অর্থ যদি হয় ‘সুনির্বাচিত ঘটনাশ্রিত জীবন-চিত্র’ তবে প্রমথ চৌধুরীর সব গল্প তা নয়; আর গল্প বলতে যদি ‘আলাপ-আলোচনাগত খণ্ড জীবনভাষ্যও’ বোঝায়— তবে প্রমথ চৌধুরীর সমগ্র কথাসাহিত্যকেই গল্প বলা যায়। বস্তুত, গল্পের সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা দেওয়া কঠিন—কারণ মোপাসাঁর রচনাকে যেমন গল্প বলা হয়, তেমনি এইচ. জি. ওয়েলসের রচনাকেও গল্প বলা হয়, অথচ দুইয়ের আকৃতি-প্রকৃতি এক নয়। রবীন্দ্রনাথ প্রমথ চৌধুরীকে লিখেছিলেন : ‘তোমার ছোট গল্প পড়ে চেকভের ছোট গল্প মনে পড়ল। যা মুখে এসেছে তাই বলে গেছ হালকা চালে। এতে আলবোলার ধোঁয়ার গন্ধ পাওয়া যায়। এরকম কিছুই না লিখতে সাহসের দরকার করে। দেশের লোক সাহিত্যে ভুরিভোজন ভালোবাসে—তারা ভাববে ফাঁকি দিয়েছে—কিম্বা ভাববে ঠাট্টা।’ অর্থাৎ ঘটনাশ্রিত কাহিনীর ভুরিভোজনের ব্যবস্থা বীরবলের গল্পে নেই, যেমন অধিকাংশ লেখকের গল্পে আছে। তাই প্রচলিত অর্থে, বীরবলের অনেক গল্পকে গল্প বলা যায় কি না সন্দেহ আছে, এবং সেই সন্দেহ প্রমথ চৌধুরীর নিজেরও ছিল। ‘নীল-লোহিতের আদিপ্রেমের’ উৎসর্গ-পত্রে তিনি নিজেই লিখেছেন—’পড়ে ফেলো, হয়ত মন্দ লাগবে না; যদিচ গল্প ক’টি পাঁচমিশালী, আর সব কটিকে গল্প বলা যায় কিনা, সেই বিষয়েও সন্দেহ আছে।’ তবে বীরবলের নিজের সংজ্ঞানুযায়ী তা ছোট অর্থাৎ পরিমিত পরিসরের এবং তা পড়তে এডগার এলেন পো’র নির্দিষ্ট একঘন্টা থেকে দু’ঘন্টার বেশি সময় লাগে না। ‘ছোটগল্প হওয়া উচিত একটি ফুলের মতো, বর্ণনা ও বক্তৃতার লতাপাতার তার ভিতর স্থান নেই’—প্রমথ চৌধুরীর গল্পের একটি চরিত্র স্বয়ং এই মত পোষণ করে। অথচ প্রমথ চৌধুরীর অনেক ছোটগল্পে অবাস্তব  কথা ও অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ের অন্ত নেই। এর একাধিক কারণ স্থানান্তরে উল্লেখ করা হয়েছে; আর একটি কারণ এখানে বিশ্লেষণ করা যাক। আমরা জানি, গল্প রচনার দুইটি স্টাইল আছে—এক, পূর্ব পরিকল্পনানুযায়ী রচনা—দুই, খেয়াল অনুসারে রচনা। প্রথম ক্ষেত্রে আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত সমগ্ৰ কাহিনী আগে ভেবে নিয়ে তারপর গল্প লিখতে বসতে হয়, আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রে কাহিনী আগে থেকে ভেবে নিয়ে গল্পকে আপন খেয়ালে চলতে দিতে হয়’। প্ৰথম রীতিতে গল্পের ঘটনা ও কাহিনীর রূপরেখা স্থির থাকে বলে অবাস্তব প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাওয়া যায়। দ্বিতীয় রীতিতে কাহিনী ও ঘটনার ছক আগে থেকে ঠিক থাকে না বলে গল্প সেখানে এগোয় পাত্র-পাত্রীদের তর্ক-বিতর্কে ধাক্কা খেতে খেতে, নানা বিচিত্র খাতে বাঁক নিতে নিতে—তারপর সেই খেয়ালী চলন সমাপ্ত হয় একটা পরিণতির আবর্তে। গল্পের এ অভিযাত্রায় স্বাধীনতা থাকে, অতর্কিত পরিবর্তন থাকে, থাকে আপন ইচ্ছায় চলার স্বচ্ছন্দ্য-আর তারই আশে-পাশে জমে ওঠে কত অবান্তর কথা, অনাবশ্যক বিষয়। অনেকে যেমন পথে চলতে চলতে এদিক সেদিক তাকায়, থমকে দাঁড়ায়, ঝগড়া বাঁধায়,–যেন সময়ের তাগিদ নেই, তেমনি চলে এই ধরনের গল্প… শেষ পর্যন্ত যদি ঘাটের বদলে আঘাটায় পৌঁছায় তবু যেন কুছ পরোয়া নেই। প্রমথ চৌধুরী এই দ্বিতীয় রীতিতে অনেক গল্প লিখেছেন—গল্পে মুক্ত স্বচ্ছন্দ বিহার আছে ‘ফরমায়েসি গল্পে’ নীল-লোহিতের সৌরাষ্ট্রলীলায়’, ‘নীল-লোহিতের স্বয়ম্বরে’ ‘ঘোষালের ‘হেঁয়ালীতে’। ধূর্জটিপ্রসাদের মতে, ‘এই সব ক্ষেত্রে ভাষার দক্ষতা ও গতির মোড় ফেরাবার বুদ্ধিটাই মুখ্য এবং এই বুদ্ধি প্রমথ চৌধুরীর ছিলো বলেই তিনি এই ধরনের গল্প লিখতে বেশি ভালোবাসতেন। নির্বাচন শক্তির ওপর সম্পূর্ণ দখল না থাকলে অনিয়ন্ত্রিত ঘটনার সমাবেশ ও অসাধারণ ঘটনার সৃষ্টি অসম্ভব। পাকা ওস্তাদ রাগভ্রষ্টের আশঙ্কা জাগিয়ে রাগরূপ কেবল বজায় রাখেন না, ফুটিয়ে তোলেন। আর্টিষ্ট আত্মসমাহিত বলেই ক্ষণিক বিচ্যুতি তাঁর হস্তামলকবৎ।’ সুতরাং এই ধরনের গল্পে কেন অবান্তর প্রসঙ্গ আছে এবং সেগুলি রচনায় প্রমথ চৌধুরীর কৃতিত্ব কতখানি তা জানা গেল।

তবে পূর্ব পরিকল্পনানুয়ায়ী লিখিত গল্পেও অবান্তর প্রসঙ্গ অনুপস্থিত নয়। ‘প্রমথবাবুর অনেক গল্পে দেখি যিনি বলবেন (অর্থাৎ গল্পের কথক) তাঁকে নিয়ে স্বতন্ত্র গল্পের সূচনা, সেইখানে আবহাওয়ার সৃষ্টি এবং অনেক সময়ে ঘটনারও গ্রন্থি বাঁধা’। যেমন ‘আহুতিতে’, ‘ফার্স্ট ক্লাশ ভূতে’। ‘বড়বাবুর বড়দিন’, ‘একটি সাদা গল্প’, ‘সহযাত্রী’, ‘পূজার বলি’, ‘মন্ত্রশক্তি’, ‘মেরি ক্রিসমাস’, ‘চার-ইয়ারী কথা’, আগে-ভাবা পরে-লেখা গল্প, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

ভূমিকা

আমার এই নিভৃত কক্ষের মধ্যে সংবাদ এসে পৌঁছল যে প্রমথর জয়ন্তী উৎসবের উদ্যোগ চলেছে— দেশের যশস্বীরা তাতে যোগ দিয়েছেন। প্রমথ চৌধুরীর এই জয়ন্তী অনুষ্ঠানের কর্তৃত্বপদ নেবার অধিকার স্বভাবতই আমারই ছিল। যখন তিনি সাহিত্যক্ষেত্রে অপরিচিত ছিলেন তাঁর পরিচয় আমার কাছে ছিল সমুজ্জ্বল। যখন থেকে তিনি সাহিত্যপথে যাত্রা আরম্ভ করেছেন আমি পেয়েছি তাঁর সাহচর্য এবং উপলব্ধি করেছি তাঁর বুদ্ধিপ্রদীপ্ত প্রতিভা। আমি যখন সাময়িকপত্র চালনায় ক্লান্ত এবং বীতরাগ, তখন প্রমথর আহ্বানমাত্রে ‘সবুজপত্র’ বাহকতায় আমি তাঁর পার্শ্বে এসে দাঁড়িয়েছিলুম। প্রমথনাথ এই পত্রকে যে একটি বিশিষ্টতা দিয়েছিলেন তাতে আমার তখনকার রচনাগুলি সাহিত্য-সাধনায় একটি নূতন পথে প্রবেশ করতে পেরেছিল। প্রচলিত অন্য কোনো পরিপ্রেক্ষণীর মধ্যে তা সম্ভবপর হতে পারত না। সবুজপত্রে সাহিত্যের এই একটি নূতন ভূমিকা রচনা প্রমথর প্রধান কৃতিত্ব। আমি তাঁর কাছে ঋণ স্বীকার করতে কখনও কুণ্ঠিত হই নি।

প্রমথর গল্পগুলিকে একত্র বার করা হচ্ছে এতে আমি বিশেষ আনন্দিত, কেননা গল্পসাহিত্যে তিনি ঐশ্বর্য দান করেছেন। অভিজ্ঞতা বৈচিত্র্যে মিলেছে তাঁর অভিজাত মনের অনন্যতা, গাঁথা হয়েছে উজ্জ্বল ভাষার শিল্পে। বাংলাদেশে তাঁর গল্প সমাদর পেয়েছে, এই সংগ্রহ প্রতিষ্ঠার কাজে সহায়তা করবে।

অনেকদিন পর্যন্ত আমাদের দেশ তাঁর সৃষ্টিশক্তিকে যথোচিত গৌরব দেয় নি সেজন্য আমি বিস্ময় বোধ করেছি।

আজ ক্রমশ যখন দেশের দৃষ্টির সম্মুখে তাঁর কীর্তির অবরোধ উন্মোচিত হল তখন আমি নিস্তেজ এবং জরার অন্তরালে তাঁর সঙ্গ থেকে দূরে পড়ে গেছি। তাই তাঁর সম্মাননা-সভায় দুর্বল স্বাস্থ্যের জন্য যথাযোগ্য আসন গ্রহণ করতে পারলেম না। বাহির থেকে তার কোনো প্রয়োজন নেই অন্তরেই অভিনন্দনের আসন প্রসারিত করে রাখলুম দলপুষ্টির জন্য নয় আমার মালা এতকাল একাকী তাঁর কাছে সর্বলোকের অগোচরে অর্পিত হয়েছে আজও একাকীই হবে। আজ বিরলেই না হয় তাঁকে আশীর্বাদ করে বন্ধুকৃত্য সমাপন করে যাব।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
[১৯৪১]


© 2024 পুরনো বই