বাংলার নবযুগ ও স্বামী বিবেকানন্দ; যুগবন্যার শেষে বাঙালী-জীবন ও বাঙালী সমাজ—প্রতিক্রিয়া; বিবেকানন্দ-চরিত্রে যুগধর্ম্মের অভিনব প্রকাশ।
“Each nation like each individual, has one theme in this life, which is its centre, the principal note round which every other note comes to form the harmony……If any one nation attempts to throw off national vitality, the direction which has become its own through the transmission of centuries, that nation dies……Every man has to make his own choice; so has every nation. We made our choice ages ago……and it is the faith in an Immortal Soul……I challenge anyone to give it up……How can you change your nature?”
“Never forget the glory of human nature! We are the greatest God that ever was or ever will be. Christs and Buddhas are but waves on the boundless ocean which “I am.”–Vivekananda.
উপরে যে কথা কয়টি উদ্ধৃত করিলাম-বাংলার নবযুগের, ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রায় অবসানকালে, একজন বাঙালীর মুখেই তাহা উচ্চারিত হইয়াছিল। এই বাণীর পশ্চাতে যে জ্ঞান-শক্তি ও পৌরুষের ঐকান্তিক প্রেরণা ছিল—যুগনায়ক বঙ্কিমচন্দ্র তাঁহার ‘অনুশীলন’-ধর্ম্মে মানবত্বের এই উপাদানকে উপযুক্ত মর্য্যাদা দান করিলেও, তাহার এমন একাধিপত্য মনুষ্য সাধারণের জীবনে সম্ভব বা সুফলপ্রসূ বলিয়া মনে করিতেন না। কিন্তু রহস্য এমনই যে, তাঁহার কথা শেষ হইতে না হইতে আকাশ হইতে দৃপ্ত দৈববাণীর মতই ওই বজ্ররব ধ্বনিত হইল। ১৮৯৩ খ্রীষ্টাব্দে, বঙ্কিমচন্দ্র যখন মৃত্যুশয্যায়, তখনই ভাগীরথীর তীর হইতে বহুদূরে, সাগরপারে—শৃণ্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রাঃ’-র সেই প্রাচীন ভঙ্গী ও ভাষায়, এক বাঙালীর কন্ঠে যে বাণী প্রথম পুনরুদ্গীত হইল, সে বাণী—আত্মার সর্ব্ববন্ধন মুক্তির স্বাধিকার ঘোষণার বাণী, তাহাতে প্রকৃতির সহিত বোঝাপড়া করার কোন চিন্তাই নাই। এ যেন সমতল পৃথ্বী ভেদ করিয়া সহসা এক পর্ব্বতচূড়ার অভ্যুদয় হইল; যে যজ্ঞানল এতদিন ধিকি ধিকি জ্বলিতেছিল তাহারই এক শিখা যেন আচম্বিতে আকাশ স্পর্শ করিল। বাংলার নবযুগের এই শেষ ও অভিনব বাণীর পরিচয় দিতে বসিয়াছি বটে, কিন্তু ইহা তো শুধুই বাণী নয়, প্রতিভার দিব্যশক্তিও নয়; একদা এক দিব্য আবেশে কবি যাহা কামনা করিয়াছিলেন—
শঙ্খের মতন তুলি’ একটি ফুৎকার হানি’
দাও হৃদয়ের মুখে।
—ইহাও মহাপ্রাণ-নিঃশ্বসিত হৃদয়-শঙ্খের সেই ফুৎকার। সে প্রাণ, সে পৌরুষ একটা আবির্ভাবের মত; সেই মহাজীবন হইতে পৃথক করিয়া বাণীর আলোচনা আদৌ সম্ভব নয়। ঐ মূর্তির দিকে চাহিলে যুগের কথা ভুলিয়া যাইতে হয়, সনাতনের সংজ্ঞাও লোপ পায়। আজ যে প্রয়োজনে আমি এই পুরুষের প্রসঙ্গে উপনীত হইয়াছি তাহার পক্ষে অতি ধীরভাবে আলোচনায় অগ্রসর হওয়াই সঙ্গত, কিন্তু ভয় হয়, এবার হয়তো আমাকে হার মানিতে হইবে। আমার ব্যক্তি সাধনায় যাঁহাদের প্রভাব সব চেয়ে বেশী তাঁহাদের কথা বলিতে আমার কন্ঠ কাঁপে নাই—আমার সাহিত্যগুরু সেই বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথের প্রসঙ্গে আমার বিদ্যা ও বুদ্ধি সর্ব্বদাই অতি সচেতন। কিন্তু প্রথম যৌবন হইতে আজ পর্য্যন্ত যখনই এই পুরুষের সম্মুখে দাঁড়াইয়াছি তখনই সকল অভিমান নিমেষে অন্তর্হিত হইয়াছে; কেবল একটি বিরাট পুরুষ—সত্তার মহিমা আমাকে আবৃত করিয়াছে——সাগর-সঙ্গমে নদীস্রোতের মত আমার প্রাণস্রোত ক্ষণেকের জন্য তাহাতে বিশ্রাম লাভ করিয়াছে। পরক্ষণে ইহাও মনে হইয়াছে, এবং সে বিশ্বাস আজিও তেমনই আছে, যে পুরাকালের কথা বলিতে পারি না—ইদানীন্তন কালে বাঙালী জাতির মধ্যে এত বড় পুরুষ আর জন্মে নাই। তাই যখনই দেশী ও বিদেশী সকল সাক্ষীর মুখে এই একই কথা শুনি—
It was impossible to imagine him in the second place, Where ever he went he was the first.
কিংবা—
His pre-eminent characteristic was kingliness, and nobody ever came near him either in India or in America, without paying homage to his majesty.
—তখন আর এক অভিমানে আত্ম-সম্বিৎ ফিরিয়া পাই, সে অভিমান বাঙালীত্বের অভিমান। যে বেদান্তকে ভারতীয় সাধনা আত্মার উত্তুঙ্গ শিখরে বিশুদ্ধ জ্ঞানযোগের আশ্রয় করিয়াছিল, সেই বেদান্তের বাণীকে শুধু জ্ঞানে নয়-প্রেম ও কর্ম্মে মানুষের গভীরতম হৃদয়-সংবেদনায় এমন করিয়া প্রাণের ছন্দে স্পন্দিত করিতে একমাত্র বাঙালীই পারিয়াছে, আর কেহ পারে নাই—পারিত না। বৈষ্ণবের ভাব-কল্লোলিনী—বিধৌত পলিমাটি এবং শাক্তের হৃদয়াবেগ-বর্জ্জিত কঠিন সাধনার এই সুদৃঢ় তটভূমিতে—এই শ্যামলিমাবেষ্টিত শ্মশান-মৃত্তিকায় হিমালয়ের দেওদার কে রোপণ করিয়াছিল? জলমাটির গুণেই সেই দেওদার-শাখায় এমন সুস্বাদু পিপ্পল ফলিয়াছে! বাংলার নবযুগ সম্পর্কে বাঙালী-প্রতিভার সেই দিকটির পরিচয় লওয়াও যেমন আবশ্যক, তেমনই, সেই প্রতিভা যে শুধুই বাণী-প্রতিভা নয়, তাহাও বুঝি—তাই বাণীকে অতিক্রম করিয়া যে ব্যক্তির প্রকাশ ঘটিয়াছে, আমি সেই ব্যক্তিচরিত্রের বৃত্তটি ধরিয়া—বাণীর রূপ সাজাইবার চেষ্টা করিব।
* * * *
ঊনবিংশ শতাব্দীর সেই যুগ-বন্যার প্রধান ধারায়, বৃহত্তর তরঙ্গের ফাঁকে ফাঁকে, বহু জ্ঞানী ও সাধকের বিচিত্র প্রয়াস নানা রূপে প্রবাহিত হইয়াছে; সাহিত্য, সমাজ, শিক্ষা, ধর্ম্ম, এবং সর্ব্বশেষে রাষ্ট্রনীতি—এই সকল ক্ষেত্রেই অল্পাধিক উদ্যম—সত্য, সুন্দর ও মঙ্গলের সন্ধান শেষ পর্যন্ত একরূপ অব্যাহতই, ছিল। খন্ড খন্ড ভাবেও এ সকলের পরিচয় ঐতিহাসিকের পক্ষে কর্তব্য বটে, আমি কেবল তাহাদের অন্তর্গত প্রধান প্রবৃত্তি এবং তৎসম্পর্কিত কার্য্যকারণ তত্ত্বের একটা পরিচয় লিপিবদ্ধ করিতেছি। আমি এ পর্যন্ত ইংরেজী শিক্ষা ও তজ্জনিত সাহিত্যিক ভাবচিন্তার ভিতর দিয়া এই যুগের প্রধান প্রবৃত্তিকে অনুসরণ করিয়াছি; এবং তাহারই প্রসঙ্গে, এ জাতির জাতীয় সংস্কারে যে আধ্যাত্মিকতার বীজ নিহিত আছে—যাহা তাহার প্রতিভার মূলে স্বপ্ন-চেতনার মত অস্ফুট রহিয়াও শক্তি সঞ্চার করিয়াছে, তাহার কথাও বলিয়াছি। যুগাবতার বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতিভা দৃষ্টিতে নবযুগ-প্রবৃত্তির সহিত জাতির এই প্রাক্তন সংস্কারের দ্বন্দ্ব কি আকারে দেখা দিয়াছিল, এবং কোন্ মন্ত্রে তিনি তাহার নিরসন করিয়া নিশ্চিন্ত হইতে চাহিয়াছিলেন, তাহা সবিস্তারে বলিয়াছি। কিন্তু এ জাতির অস্থিমজ্জাগত সংস্কার সেই সমস্যাকে যে এত সহজে বিদায় করিবে না—সমস্যার মূল যে আরও গভীর, তাহার প্রমাণ ইতিপূর্ব্বেই পাওয়া যাইতেছিল, বঙ্কিমচন্দ্রের জীবৎ-কালেই আর এক ক্ষেত্রে এক আর আন্দোলন ক্রমেই প্রবলতর হইয়া উঠিতেছিল। নবজাগরণের অনতিকাল মধ্যেই, প্রথমে সমাজ-সংস্কারের প্রয়োজনে, এবং শেষে আধ্যাত্মিক কল্যাণ-পিপাসার বশে, এক গুরুতর ধর্ম্মান্দোলন শুরু হইয়াছিল—সে আন্দোলন শুধুই চিন্তার ক্ষেত্রে নয়, শুধুই সমাজ-চৈতন্যে নয়, ব্যক্তির স্বকীয় চৈতন্যে বিক্ষোভ সৃষ্টি করিতে লাগিল। ইহাই স্বাভাবিক। অতি দীর্ঘ নিদ্রার অবসানে এ জাতি এক নূতন জগতে চক্ষুরুন্মীলন করিল—সে জগৎ তাহার সেই প্রাক্তন পল্লীসমাজের জগৎ নয়; আকাশ যেন অনেক দূরে উঠিয়া গিয়াছে, এবং তাহারই দিদিগন্ত হইতে মানবেতিহাসের বিপুল ও বহুবিচিত্র ধারার কলরোল তাহার জ্ঞান-বুদ্ধিকে বিপর্যস্ত করিয়া দিতেছে—শুধুই কর্ণে কলগৰ্জ্জন নয়, সেই স্রোত তাহার বক্ষতটে প্রহত হইতেছে। সেই আঘাত সর্ব্বশেষে তাহার প্রাণধাতুকে স্পর্শ করিল, এবং প্রতিঘাতে তাহার স্বকীয় সংস্কার যেন ভিতরে ভিতরে প্রবলভাবে নাড়া পাইল। নবযুগের সংক্রমণ ও প্রভাব রামমোহনের চিন্তায় সর্বপ্রথম ধরা দিয়াছিল বটে, কিন্তু তাঁহার দৃষ্টি সম্মুখপ্রসারী হইলেও উপরের দিকেই নিবদ্ধ ছিল; নূতন আবহাওয়ার উপযোগী একটা স্বাস্থ্যকর গৃহ নির্ম্মাণ করিবার পক্ষে ভিত্তি যতটুকু দৃঢ় হওয়া আবশ্যক, তাঁহার বিষয়-বুদ্ধি তাহার অতিরিক্ত ভাবনা করে নাই—ভূমিকম্প প্রভৃতির চিন্তাকে তিনি কখনও আমল দেন নাই। ধর্ম্মের ব্যাপারেও, কেবল সর্ব্বপ্রকার কুসংস্কারের গ্রন্থি একটিমাত্র আঘাতে ছেদন করিবার উদ্দেশ্যে, তিনি খ্রীষ্টান বা সেমিটিক ঈশবাদকেই বেদান্তসূত্র দ্বারা শোধন করিয়া একটি অতি সহজ অস্ত্র নির্ম্মাণ করিয়াছিলেন। রামমোহনের ধর্ম্ম যতই যুক্তিসিদ্ধ ও সুকল্পিত হউক, তাহা মূল অ-ভারতীয় আদর্শে অনুপ্রাণিত—তাহাতে এমন সঞ্জীবনী অধ্যাত্ম—প্রেরণা ছিল না, যাহার বলে মানুষ শেষ পর্য্যন্ত নিজের আত্মার উপরে আস্থা না হারাইয়া একটা মহাসঙ্কটে উদ্ধার পাইতে পারে। যে য়ুরোপীয় সমাজ ও রাষ্ট্রের আদর্শ ও যে ধৰ্ম্মনীতি একদা রামমোহনকে আশ্বস্ত করিয়াছিল, তাঁহার যুক্তিবাদের সহায় হইয়াছিল, সে আদর্শ ও নীতির পরিণামে শতাব্দী শেষে প্রকট হইয়া উঠিয়াছে। বরং রামমোহনের প্রতিভার অসাধারণত্ব ইহাই যে, তিনিই প্রথম ভারতীয় সাধনার গঙ্গোত্তরী ধারাকে ভিন্ন-পথগা করিবার প্রেরণা লাভ করিয়াছিলেন, তাহাতেই সাময়িক পঙ্কোদ্ধারের কাজ হইয়াছিল। সেই বুদ্ধির জাগরণই সে যুগের প্রথম লক্ষণ,—চৈতন্যস্ফুরণের আদি অবস্থা যে তাহাই। দ্বিতীয় অবস্থায় হৃদয় বা প্রাণের জাগরণ—বিদ্যাসাগরে ও মধুসূদনে, দুই দিক দিয়া তাহাই ঘটিয়াছিল। তৃতীয় অবস্থায় বুদ্ধি ও হৃদয় দুয়েরই সমান জাগরণ—সুস্থ মনুষ্যত্বের পূর্ণ বিকাশ, তাহার বিগ্রহ বঙ্কিমচন্দ্র। ইহারও পরে, শতাব্দীর শেষভাগে, জাতীয় জাগরণের প্রায় তৃতীয় বা চতুর্থ অবস্থায়, সেই সকলের সহিত আর এক যে-বস্তুর উন্মেষ হইল, অন্য নামের অভাবে তাহার নাম দিব ‘আত্মা’। মন, বুদ্ধি, হৃদয় ও প্রাণ—সকলই ইহার সেবায় পূর্ণভাব নিয়োজিত; এই আত্মার দৃষ্টিতে যুগসমস্যা এমন একটি আকার ধারণ করিল যে, তাহা যুগ-জাতি-দেশ অবলম্বনে সর্ব্বকাল ও সর্ব্বদেশের সমস্যা হইয়া দাঁড়াইল।
জীবনের প্রতি শ্রদ্ধা ও জীবন-জিজ্ঞাসা—ইহাতেই যুগপ্রবৃত্তির আরম্ভ, এবং সঙ্গে সঙ্গে প্রতিক্রিয়াও হইতে থাকে। প্রতিক্রিয়ার কারণ—বহুকাল—অর্জিত সংস্কার; এই সংস্কারই অন্ধসংস্কাররূপে জীবনকে গতিহীন করিয়াছিল। নবযুগ ও তাহার অনুষঙ্গী সেই পাশ্চাত্য প্রভাব, এই সুপ্ত সংস্কারের এতই বিরোধী যে, দেশের রক্ষণশীল সমাজ একটা অজ্ঞাত অস্পষ্ট ভয়ের বশীভূত হইয়া সেই প্রভাবের গতিরোধ করিতে চাহিল; কোথায় যে বিরোধ— ভিতরের কোন্ মূল গ্রন্থিতে টান পড়িতেছে তাহা বুঝিতে না পারিয়া, বিচার-বুদ্ধিকে দমন, এবং অবোধ চিত্তবৃত্তিকে প্রাণপণে আশ্রয় করিয়া, নির্জীব শাস্ত্র-বচনের মহিমা ঘোষণায় অধীর হইয়া উঠিল। অপর দিকেও উৎকন্ঠা কম ছিল না; প্রাণের প্রবল মুক্তি-কামনা—জীবনকে বিধিমতে ভোগ করিবার আকাঙ্ক্ষাও যেমন জাগিয়াছে, তেমনই ব্যক্তির আত্ম-চেতনা প্রখর হইয়া উঠিয়াছে; তাহার ফলে আধাত্মিক সত্য-মীমাংসাও নবযুগের আন্দোলনে একটা বিশিষ্ট স্থান অধিকার করিল; শেষের দিকে ইহাও একটা পৃথক খাতে বহিতে সুরু করিয়াছিল। রামমোহন-পন্থীরা এই আধ্যাত্মিক উৎকণ্ঠাকে বুদ্ধির শাসনে সংযত রাখিবার চেষ্টা করিলেও তাহা যে সফল হয় নাই, তাহার প্রমাণ, বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর মত পুরুষেরও অবশেষে সন্ন্যাস গ্রহণ। আবার নিছক যুক্তি-বিচার যে ভগবদ্ভক্তির অনুকূল নয়, সেই গভীরতর পিপাসা নিবৃত্তির জন্য জাগ্রত বুদ্ধিবৃত্তির উপরে এক প্রকার রস-চেতনাকে প্রাধান্য দিতেই হয়, সে যুগের ধর্মান্দোলনের সর্বপ্রথম ও শক্তিমান নেতা আচার্য্য কেশবচন্দ্রই তাহার প্রাণ। কিন্তু এ সকলের দ্বারা যুগ—সমস্যার কোনরূপ সমাধান হয় নাই; কেবল ইহাই প্রমাণ হয় যে, যুগধর্ম্মের প্রভাবে এ জাতির চেতনার উপরি-স্তরে যত তরঙ্গই উত্থিত হউক, তলদেশে একটা গভীরতর আকৃতি উত্তরোত্তর বাড়িয়া উঠিতেছিল; যুগ ও সনাতন, সৰ্ব্বমানবীয় চেতনা ও জাতীয় সংস্কার, এই দুইয়ের সংঘর্ষ ভিতরে ভিতরে বৃদ্ধি পাইতেছিল; ফলে একটা ঘোরতর আধ্যাত্মিক সংশয়-সঙ্কট আসন্ন হইয়া উঠিয়াছিল। যাহারা অতিশয় মেধাবী অথচ তীক্ষ্ণ অনুভূতিশীল—তাই জীবনের আদি-অন্ত সম্বন্ধে যাহারা কোন কাটা-ছাঁটা ধারণায় সন্তুষ্ট হইতে পারে নাই—তাহারা শেষ পৰ্য্যন্ত জীবন সম্বন্ধে নাস্তিক হইয়া পড়িতেছিল, সে কথা পূর্ব্বে বলিয়াছি।
বঙ্কিমের সঙ্গে সঙ্গে যুগের আদি-প্রবৃত্তি প্রায় নিঃশেষ হইয়া আসিয়াছিল। পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে যে নৈতিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক উদ্দীপ্তি ঘটিয়াছিল, এক্ষণে তাহা প্রশমিত হইয়া বাঙালীর জীবনযাত্রায় তথা চরিত্রে যে পরিণতির আভাস দেখা দিতেছিল, বঙ্কিমচন্দ্র তাহাই লক্ষ্য করিয়া অতিশয় বিচলিত হইয়াছিলেন, তাহারই নিবারণকল্পে তিনি তাঁহার প্রতিভার সকল শক্তি নিয়োজিত করিয়া জাতির জীবন-রক্ষার একটা পন্থা নির্ণয় করিয়াছিলেন। নব্যশিক্ষিত সমাজের দাসত্ব-প্রীতিও তিনি যেমন লক্ষ্য করিয়াছিলেন, তেমনিই তাহার চরিত্রে দারুণ স্বার্থসুখলোলুপতা ও তাহার কারণ দিব্য চক্ষে দেখিতে পাইয়াছিলেন, তাহার এই মনুষ্যত্ব-লোপ এবং অচিরকালের মধ্যে সর্ব্বপ্রকার অধঃপতনের সম্ভাবনা তাঁহাকে ব্যাকুল করিয়াছিল। তথাপি তাঁহার ভরসা ছিল শিক্ষিত বাঙালীর উপরেই; তাই উৎকৃষ্ট ভাব ও চিন্তারাজি অকাতরে ছড়াইয়া তিনি তাহাদের চিত্তশুদ্ধির প্রাণপণ প্রয়াস পাইয়াছিলেন। এই চিন্তারাজির মধ্যে দুইটি ছিল প্রধান—সাৰ্ব্বজনীন মনুষ্যপ্রীতি ও বিশেষভাবে দেশপ্রীতি, এবং সমাজের নেতৃত্বভার গ্রহণ করিবার জন্য আত্মানুশীলন, –দেহ, মন ও প্রাণের উৎকর্ষসাধন। ইহা যে আপামর সাধারণের জন্য নয়, তাহা তিনি জানিতেন, সে আদর্শ ও তাহার সাধনা কেবল শিক্ষিত—সমাজেরই আয়ত্ত। বৃহত্তর সমাজের দারুণ দুর্গতি ও অবনতির অবস্থা তাঁহার অজ্ঞাত ছিল না, সে সমস্যাও তাঁহার চিন্তায় অল্প স্থান অধিকার করে নাই। কিন্তু সে সকলের দায়িত্ব তিনি আধুনিক কালের ‘ব্রাহ্মণের ‘ উপরেই দিয়াছিলেন; এ বিষয়ে বঙ্কিমচন্দ্র যেমন আদর্শবাদী তেমনই aristocrat। তথাপি নবমানবধর্ম্ম-প্রচারক বঙ্কিম, দেশপ্রেম—মন্ত্রের ঋষি বঙ্কিম, এই aristocrat বঙ্কিম একদা যেমন ‘সাম্য’ নামক প্রবন্ধমালা রচনা করিয়াছিলেন, তেমনই তাঁহার সেই আদর্শবাদী ভাব-চিন্তার মধ্যেই এমন বীজ নিহিত ছিল, যাহা অতঃপর সেই আদর্শের উচ্চভূমি বিদীর্ণ করিয়া বাস্তবকেই আরও বিরাট আকারে সঙ্কট-সঙ্কুল করিয়া তুলিয়াছিল। বঙ্কিমচন্দ্রের পরেই বিবেকানন্দ; একের সহিত অপরের যুগগত পরম্পরতার যোগই শুধু নয়, ভাবগত যোগও নিশ্চয় ছিল-সে যোগ সাক্ষাৎ বা প্রত্যক্ষ যোগ না হইতে পারে, কিন্তু এতবড় বাণীবরপুত্রের সেই বহুপ্রচারিত বাণী বিবেকানন্দের মত পিপাসু যুবকের পানীয় হয় নাই, ইহা সম্ভব নয়; রামমোহন, কেশবচন্দ্রকে যেমন, বঙ্কিমচন্দ্রকেও তেমনই তিনি তাঁহার দিক দিয়া হজম করিয়াছিলেন, এবং বঙ্কিমের চিন্তাধারার প্রায় বিপরীত মুখে হইলেও, বঙ্কিম যেখানে শেষ করিয়াছিলেন ঠিক সেইখান হইতেই তাঁহার যাত্রা আরম্ভ হইয়াছে। ইহাও মনে হয়, বিবেকানন্দের গন্তব্য পর্য্যন্ত অগ্রসর হইতে বঙ্কিমচন্দ্রের আপত্তি ছিল না, বরং অতিশয় হৃষ্টচিত্তেই তিনি তাহাতে সম্মত হইতেন; কিন্তু পঙ্গুর পক্ষে সেরূপ গিরিলঙ্ঘন তিনি আদৌ সাধ্য বলিয়া মনে করিতেন না, এমন অসীম সাহসের যোদ্ধৃ-মনোভাব তাঁহার ছিল না। বঙ্কিম ছিলেন ভাবুক ও চিন্তাশীল, প্রাকৃতিক নিয়তি-নিয়মের অনুবর্ত্তী ক্রমবিকাশবাদী। বিবেকানন্দ আত্মার—স্ব-শক্তিতে আস্থাবান, তিনি প্রকৃতির ধমক মানিতেন না। উভয়ের দৃষ্টিভঙ্গী যতই বিপরীত হউক, মূল সমস্যা উভয়ের নিকটেই এক; আবার তত্ত্বের দিক দিয়া যেমনই হউক, ভাব-প্রেরণায় উভয়ের সগোত্রতা এত অধিক যে, এককালে বাঙালী যে উভয়কে একই মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিল, তাহাতে আশ্চর্য্য হইবার কিছুই নাই। মনুষ্যত্বের উদ্ধার-সাধন যেমন উভয়েরই ছিল একমাত্র ব্রত, তেমনই প্রেম ও পৌরুষ, এই দুই ছিল উভয়ের সাধন-মন্ত্র; এবং উভয়েরই মতে, সেই প্রেম ও পৌরুষের মুখ্য সাধনক্ষেত্র ছিল স্বদেশ ও স্বজাতি-সমাজ। কিন্তু বিবেকানন্দেই যে যুগের জাগরণ প্রায় সমাপ্ত হইয়াছে। সে জাগরণের এইরূপ ক্রমনির্দেশ করা যায় :–প্রথম মনুষ্য-জীবনের গৌরববোধ; দ্বিতীয়, জীবন-জিজ্ঞাসা, মনুষ্যত্বের আদর্শ সন্ধান, ও জীবনের মাহাত্ম্য—ঘোষণা; তৃতীয়, জীবনের মহিমাই মানুষের মহিমা নয়; জীবন-সাধনার কোন স্বতন্ত্র আদর্শ নাই; মানুষই মানুষের আদর্শ, মানবাত্মার মহিমাই সকল মহিমার মূল; জ্ঞানে প্রেমে ও কর্ম্মে বন্ধনমুক্ত আত্মার সেই স্বরাজ প্রতিষ্ঠাই মনুষ্যজীবনের নিঃশ্রেয়স। এবার এই বাণীর কিছু পরিচয় দিব, কিন্তু বাণী ও ব্যক্তির পরিচয় একই—বরং ব্যক্তি আগে, বাণী পরে।
.
তখন ঊনবিংশ শতাব্দী প্রায় শেষ পাদে আসিয়া পৌঁছিয়াছে; ইংরেজশাসন ও ইংরেজী শিক্ষার ফলে বাঙালী তখন বড় মোহকর স্বপ্ন দেখিতেছে, সে স্বপ্ন সফল হইতেও যেন আর বিলম্ব নাই; বাঙালী তখন রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা স্বপ্ন দেখিতেও আরম্ভ করিয়াছে! এদিকে সরকারী চাকুরীর মাহাত্ম্য এক নূতনতর কৌলীন্যের প্রতিষ্ঠা করিয়াছে, জীবনযাত্রায় পরিবর্তন সুরু হইয়াছে। কলিকাতা শহর এক নূতন নাগরিক সভ্যতার কেন্দ্রস্থল হইয়াছে; অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত বাঙালী যেখানে যেটুকু সংস্কৃতি অর্জন করিয়াছিল এই নগরী তাহারও সবটুকু আকর্ষণ করিতেছে; বাঙালীর চিত্তভূমির—তাহার হৃদয় ও মস্তিষ্কের—সবটুকু শক্তি তাহার একাধিকারে বৰ্ত্তিয়াছে। শিক্ষা, সমাজ ও ধর্ম্মসম্পর্কিত, এমন কি, নূতন সাহিত্যের জন্মঘটিত যত কিছু আন্দোলন, এই শহরেই সব হইয়া গিয়াছে। প্রাচীনের হিসাবনিকাশ প্রায় শেষ করিয়া বাঙালী তখন নূতনের সঙ্গেও একটা আপোষ করিয়া লইয়াছে, সম্মুখে যেন বাঁধা পথ; সে পথ যেমন উন্মুক্ত, তেমনই নিঃসঙ্কট। দাসত্বের অন্ন সুলভও বটে, রুচিকরও বটে; নিজের উপরে অথবা ভগবানের উপরে যে বিশ্বাস তাহা ইরেজের উপরে স্থাপন করিয়া বাঙালী একরূপ নিশ্চিন্ত হইয়াছে।
কিন্তু আসলে এই স্বপ্ন-বিলাস ও সুখের আশ্বাস—নিরুপায়ের আত্মপ্রবঞ্চনা মাত্র তলে তলে একটা ক্লান্তি আসিয়াছে, সংশয়ও দেখা দিয়াছে—পশ্চিম এ জাতির মস্তিষ্কে হানা দিয়াছে—তাহার জীবনকে দুর্ব্বল করিয়াছে। একদিন যাহার নূতনত্বে সে অধীর হইয়াছিল—সেই নূতনকে লইয়া লোফালুফি করিয়া, তাহাকে বাজাইয়া এবং চতুৰ্দ্দিকে ছুঁড়িয়া ছড়াইয়া সে সকলকে অস্থির করিয়া তুলিয়াছিল, এক্ষণে সেই নূতনের উন্মাদনাশেষে তাহার দেহে-মনে একটা বেদনা জাগিতে লাগিল। বঙ্কিমচন্দ্রই সৰ্ব্বপ্রথম সেই বেদনা সজ্ঞানে অনুভব করিয়াছিলেন। সেই যুগের যত কিছু আশা-আকাঙ্ক্ষা, ভয়-ভরসাকে তিনিই একটি প্রকৃষ্ট বাণীরূপ দিয়াছিলেন বটে— যুগনায়করূপে জাতীয়-জাগরণের প্রধান পুরোহিতরূপে তিনিই দাঁড়াইয়াছিলেন— তথাপি, এই বেদনা তাঁহাকে বিহ্বল করিয়াছিল, জাতির সেই হীন আত্ম-সন্তোষ ও হৃদয়দৌৰ্ব্বল্য দর্শনে তাঁহার লজ্জা ও ক্ষোভের অবধি ছিল না। ইংরেজীশিক্ষার পদ্ধতি-দোষে তাহার সুফল অপেক্ষা কুফল বৃদ্ধি পাইল, সে শিক্ষার একমাত্র তপঃফল হইল চাকুরি-লাভ— সরস্বতীর কমলবনে কমলবিলাসী বাঙালী চাকুরি-মধু—পানে বিভোর হইয়া উঠিল। বাঙালীর নিজস্ব সমাজ-জীবনও নষ্ট হইতে চলিল; পল্লীর প্রতিবেশে, মাঠে, বাটে, প্রান্তরে সেই সরল উন্মুক্ত জীবন যাপন করিয়া সে যেটুকু প্রাণশক্তি বজায় রাখিয়াছিল তাহা ক্রমেই হ্রাস পাইতে লাগিল; কলিকাতা শহরের বদ্ধ বায়ুতে নূতন নাগরিক সুখোপকরণ তাহার সেই স্বাস্থ্য নাশ করিয়া অহিফেনসুলভ জড়তা বৃদ্ধি করিল—প্রাণ যেন হাঁপাইয়া উঠিতে লাগিল; কিন্তু নেশার ঘোরে, নূতনত্বের মোহে, সেই অস্বাভাবিক অবস্থা ক্রমে অভ্যস্ত হইয়া আসিল; পল্লীসমাজের বন্ধন যেমন দুঃসহ, পল্লীবাসও তেমনই অসুখকর হইয়া উঠিল। বাস্তব জীবনে দাসত্বপ্রীতি যতই বাড়িতে লাগিল—মনে ততই স্বাতন্ত্র্য—অভিমান জাগিয়া উঠিল; ইংরেজের চাকুরি ও ইংরেজের আইন সেই স্বাতন্ত্র্যের পোষকতা করিল; ইংরেজী বিদ্যার অভিমানও মনের সঙ্কোচ ঘুচাইল। এক দিকে চাকুরি-গৌরব, আর এক দিকে Mill, Bentham, Spencer; এক দিকে দাশুরায়ের পাঁচালী, আর এক দিকে Shakespeare, Milton, Byron; এক দিকে মাহেশের রথ, বাগানবাড়ির আমোদ, অপর দিকে ব্রাহ্ম-মন্দিরের উপসনা; সে যেন এক অপূৰ্ব্ব প্রহসন! এই দুইয়ের রস যে সমভাবে উপভোগ করিতে পারে, সে ‘হুতোম পেঁচার নকশা’ লিখিয়া প্রবল হাস্যবেগ প্রশমিত করে। এই জীবনই সেকালের চতুৰ্ব্বর্গকামী বাঙালীসন্তানের আদর্শ হইয়া উঠিয়াছিল।
কিন্তু মধ্যবিত্ত সমাজ তখনও একেবারে মরে নাই—এই সমাজই ক্ষতবিক্ষত হইয়াও জাতির মেরুদণ্ডস্বরূপ এ পর্যন্ত সমাজের স্থিতি রক্ষা করিয়াছে; আবার এই সমাজই সর্ব্বপ্রকার বিদ্রোহের বীজ ধারণ ও পালন করিয়াছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশে, ইংরেজীশিক্ষার, সুফলস্বরূপ, যতকিছু আন্দোলন ঘটিয়াছে তাহার প্রায় সকলগুলিতে শক্তিসঞ্চার করিয়াছে—এই শ্রেণীর মানুষ; শুধুই বিদ্রোহের মন্ত্র-রচনা নয়, তাহার আগুনে ঝাঁপ দিয়াছে ইহারাই। উৎকৃষ্ট প্রতিভারও জন্ম হইয়াছে ইহাদের মধ্যে, কেবল দুইজন এই শ্রেণীভুক্ত নহেন—রামমোহন ও রবীন্দ্রনাথ। ইহার কারণ আছে; বাঙালীর জাতীয় চরিত্রের যে একটি মহৎ গুণ—তাহা এই শ্রেণীর জীবনেই সম্ভব। তখনকার একান্নবর্তী পরিবারে জীবিকা অর্জ্জনের ভার প্রায় একজনের উপরেই থাকিত, অথবা পৈতৃক জমিজমার দ্বারাই তাহা এক প্রকার নির্ব্বাহ হইত, তাহাতে এক দিকে যেমন আলস্য প্রশ্রয় পাইত, তেমনই স্বল্পসুখসন্তুষ্ট, দায়িত্ববন্ধনমুক্ত, ভাবুক ও চিন্তাপ্রবণ বাঙালীর ভাবচর্চ্চার বড় অবকাশ হইত। যে বিলাসব্যসনে অভ্যস্ত নয়, অথচ জাতিস্বভাবসুলভ চিন্তা ও কল্পনাশক্তির অধিকারী—কোন একটি ভাব-সত্যের প্রতিষ্ঠায় তাহার পক্ষে সর্ব্বস্বত্যাগ আদৌ দুষ্কর নয়, ইহার প্রমাণ বাংলা দেশের ধর্ম্ম, সমাজ ও শেষে রাষ্ট্রীয় আন্দোলনের ইতিহাসে প্রচুর পাওয়া যাইবে। সেকালের কলিকাতার সেই সমাজে, সেই নব্য জীবনযাত্রার অবসাদকর আবহাওয়ায়, রুদ্ধ আলোক ও বদ্ধ বায়ুর সেই শ্বাসকৃচ্ছ্রতার মধ্যে, স্বধর্ম্ম ও পরধর্ম্মের সংঘর্ষে জাতির সেই মানস-বৈকল্যের অবস্থায়, আত্মক্ষয়কারী দারুণ দাসত্ব-ব্যাধি যখন সংক্রামক হইয়া উঠিয়াছে, তখন কলিকাতারই এক মধ্যবিত্ত পরিবারে সেই শ্রুতি-প্রসিদ্ধ নাচিকেত-অগ্নির একটি শিখা সকলের অগোচরে জ্বলিতে আরম্ভ করিল; এবারে শুধু জীবনের আরাধনাই নয়, মৃত্যুর বদ্ধমুষ্টি হইতে অমৃত—ভান্ড উদ্ধার করিবার দুর্দমনীয় আকাঙ্ক্ষা জাগিল।
অতি অল্প বয়সেই এই তেজ—সর্ব্ববন্ধনমুক্তির সেই দুর্দমনীয় পিপাসা— বিবেকানন্দের জীবনে দেখা দিয়াছিল, ইহাকেই আমাদের অধ্যাত্মবিজ্ঞানের ভাষায় ‘শৈব তেজ’ বলে। অপরের উপদেশ নয়, পরের সাক্ষ্য নয়, কোন তর্ক-যুক্তির পুঁথিগত সিদ্ধান্ত নয়-পরোক্ষ আপ্তবাক্যে আশ্বাস নয়, নিজেরই জ্ঞান-বুদ্ধি ও অপরোক্ষ অনুভূতির সাহায্যে, জীবনের তথা মানবীয় সত্তার অর্থ সন্ধান করিতে হইবে, যদি কোন সত্য থাকে তাহা সাক্ষাৎকার করিতে হইবে—ইহাই ছিল সেই বালকের প্রাক্তন সংস্কার, সে সংস্কার বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দৃঢ়তর হইয়াছিল। সেকালের স্কুলে ও কলেজে অধ্যেতব্য যাহা কিছু ছিল তাহা যেন গন্ডুষে পান করিয়া, জ্ঞানপন্থী অধ্যাত্মবাদীদের সঙ্গ করিয়া, তাহাদের তত্ত্ববিচার শুনিয়া কিছুতেই পিপাসা মেটে না; বরং সংশয় বাড়িয়া যায়, আত্মা আরও বিদ্রোহী হইয়া উঠে। বিবেকানন্দ ছাত্রাবস্থাতেই যুক্তিপন্থী নব্য-সম্প্রদায়ে যোগ দিয়াছিলেন—সেও যেন অন্ধভক্তি ও গুরুবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা। দেশে তখন পাশ্চাত্য বিদ্যার মোহ কিছু কমিয়াছে, বন্যার সেই জলরাশির নিম্নে পঙ্ক দেখা দিয়াছে; মানবত্বের মহিমা-বোধ যতই টিকিয়া থাকুক, সেই ভাবের বাধা পাইতে আরম্ভ করিয়াছে; কারণ ইতিমধ্যেই পাশ্চাত্য জাতির সেই মানবতন্ত্র শাস্ত্রের সাধন পীঠে আর এক মন্ত্র মানবতাকে পরিহাস করিয়া জয়ী হইতে চলিয়াছে। মানবধর্ম্মকে প্রকৃতিধর্ম্মের সহিত বাঁধিয়া লওয়ার ফলে, যে বৈজ্ঞানিক বুদ্ধিধর্ম্ম উত্তরোত্তর প্রাধান্য লাভ করিতেছিল তাহাতে মানুষের আত্মা ক্রমেই জড়শক্তির বশীভূত হইতেছিল—প্রেম, ভক্তি, বিশ্বাস প্রভৃতি মনুষ্যজীবনের আত্মিক সম্পদ মানুষ তখন হারাইতে বসিয়াছে। কিন্তু তখনও সে ঘটনা আমাদের প্রত্যক্ষ হইয়া উঠে নাই—আত্মার স্বাতন্ত্র্য-মহিমা নয়, ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্যবোধের অনুকূল যে-যুক্তিবাদ তাহাই পরম উপাদেয় হইয়াছে; তাহার কারণ, জীবনের সঙ্গে সাক্ষাৎ পরিচয়ের সুযোগও ছিল না, প্রয়োজনও ছিল না। তাই সেই নূতন নাগরিক জীবনে সমাজবন্ধন ছিন্ন করিয়া ব্যক্তির যে আত্ম-প্রসাদ —পুঁথিগত যুক্তির বলে কুসংস্কার—মুক্তির যে দুঃসাহস-তাহাই পরম জ্ঞানের পরিচায়ক হইয়া উঠিয়াছিল। এক দিকে শাস্ত্র, গুরু ও ব্রাহ্মণে ভক্তি, এবং অপর দিকে মানস মুক্তির এই যুদ্ধ ঘোষণা—এই দুইয়ের মধ্যে যুবক বিবেকানন্দ যে শেষেরটির দিকেই আকৃষ্ট হইবেন, ইহাই স্বাভাবিক। সংস্কার-কৈঙ্কর্য্যের উচ্ছেদ—মনের মুক্তিই তো আত্মার উদ্ধারসাধনের প্রাথমিক উপায়, মনুষ্যত্বের যাহা সার সেই পৌরুষের (“পৌরুষং নৃষু”) ইহাই তো প্রথম পরীক্ষাস্থল, কোন জ্ঞান, কোন তত্ত্ব কোন গুরুবাক্যে প্রয়োজন নাই— আগে চাই নিজ আত্মার স্বাধীনতাবোধ, তাহার তুলনায় আর সকলই তুচ্ছ।
বিবেকানন্দ-চরিত্রের এই প্রধান লক্ষণ তখন হইতেই, অথবা আরও পূৰ্ব্ব হইতেই পরিস্ফুট হইয়া উঠিয়াছিল। সে চরিত্র যেন একটি শাণিত ইস্পাতফলক, তাহার ধার—ওই প্রখর মুক্তি-পিপাসা, সৰ্ব্ববন্ধন-অসহিষ্ণুতা। কিন্তু প্রথম জীবনের সেই দুর্দ্ধর্ষ আত্মস্বাতন্ত্র্য এবং আজন্ম-শাণিত সেই জ্ঞান-পিপাসার তীক্ষ্ণ তরবারিও শেষে বড় কাজে লাগিয়াছিল, তাহার অন্তরস্থ সেই অতি-কঠিন ইস্পাতের দ্বারাই যে নূতন অস্ত্র নিৰ্ম্মিত হইল তাহাতে মাটির উপরকার বনগুল্মলতাই নয়, তলদেশে শিকড়গুলা পৰ্য্যন্ত কাটিয়া ফেলিবার উপায় হইল; বঙ্কিমচন্দ্র মাটির উপরকার ব্যবস্থাই করিয়াছিলেন, ভিতর পর্য্যন্ত দৃষ্টি করা তখনই আবশ্যক বোধ করেন নাই; তিনি ছিলেন দ্বৈতাদ্বৈতবাদী, সমন্বয়পন্থী শক্তি সাধক, এমন উগ্র অদ্বৈতবাদকে তিনি ভয় করিতেন।
.
বিবেকানন্দের চরিত্র ও জীবন-কথা বলিতেছিলাম। তাঁহার প্রথম যৌবনের সেই অদম্য জ্ঞান-পিপাসা ও স্বাতন্ত্র্য-স্পৃহার কথা বলিয়াছি; এ চরিত্রের তাহাই বটে, কিন্তু তাহাই সব নয়। সে চরিত্রের যে দিকটি অসাধারণ, যাহা মহামনীষিগণকে মুগ্ধ ও বিস্মিত করিয়াছে, সেই দিকটির কথা এইবার বলিব। ভগবান বুদ্ধের প্রসঙ্গমাত্রে তাঁহার নিজের সেই অপূর্ব্ব ভাবাবেশের কথা স্মরণ হয়, এবং তাহাতেই অনুমান করা যায়, বিবেকানন্দ কি কারণে আজীবন বুদ্ধকে এত ভক্তি করিতেন। সন্ন্যাসগ্রহণের পূর্ব্বেও যেমন তিনি বুদ্ধগয়ায় গিয়া বোধিবৃক্ষমূলে উপবেশন করিয়া রোমাঞ্চকলেবর হইয়াছিলেন, তেমনই জীবনের সর্ব্বশেষ তীর্থযাত্রা করিয়াছিলেন সারনাথে। তিনি এমন কথাও বলিতেন যে, অতি অল্প বয়সে ভাবাবেশে তিনি বুদ্ধের সাক্ষাৎ-দর্শনলাভ করিয়াছিলেন। ইহা আশ্চর্য্য নয়, বুদ্ধের সঙ্গে তাঁহার আত্মার সগোত্রতা ছিল তিনিও অতীত ও অনাগত বুদ্ধগণের বংশে জন্মিয়াছিলেন; বুদ্ধের মতই তিনি যত বড় সন্ন্যাসী, তত বড় প্রেমিক। যে-পুরুষ কোন বন্ধন মানিবে না, দেহের বন্ধনও যাহার কাছে দুর্বিষহ, কৈবল্য-মুক্তির পরমানন্দ ভিন্ন আর কিছুতেই যাহার রুচি ছিল না সেই সৰ্ব্বত্যাগী সন্ন্যাসী দেশকে ও দেশের মানুষকে যেরূপে ভালবাসিয়াছিলেন, তেমন ভালবাসা বোধ হয় আর কেহই বাসে নাই। ইহার কারণ যাহাই হউক, সেই প্রেমের অপূর্ব্ব আবেগ তাঁহার ব্যক্তিগত মুক্তিপিপাসাকেও দমন করিয়া, দেশের মুক্তি কামনা হইতেই, জগতের হিতার্থে তাঁহাকে ব্যাকুল করিয়াছিল। এই প্রেম একটা আধ্যাত্মিক রসাবেশ নয়, ইহাতে এক বিশাল হৃদয়ের অসীম দুঃখবোধ ছিল; এ প্রেম খাঁটি মানবীয় প্রেম। বিবেকানন্দের ত্যাগ-বৈরাগ্য এতই বিশুদ্ধ ও এমনই মজ্জাগত যে তাহার সহিত এই ধরণের প্রবল হৃদয়-সংবেদনা স্বভাববিরুদ্ধ বলিয়াই মনে হয়। যে একদিন এক মুহূর্ত্তের আত্মার স্বরূপ-মহিমার কথা ভুলে নাই—সেই আত্মার লেশমাত্র অজ্ঞান—মোহ, বন্ধন বা দুর্ব্বলতা যে সহ্য করিতে পারে না, সর্ব্বপ্রকার হৃদয়াবেগকে যে মাত্রাস্পর্শ-জনিত ভাবালুতা (“over flow of the senses”) বলিয়া ধিকৃত করে, তাহার সেই জ্ঞানাগ্নি-শুষ্ক আঁখিপল্লবে এমন অশ্রুধারা উদগত হয় কেমন করিয়া?
এ রহস্য দূরবগাহ; হয়তো মানব-মাহাত্ম্যের এই অভিনব রূপে এ যুগের শেষ ও সর্ব্বশ্রেষ্ঠ দান,—Humanism-এর অন্তর্গত যে গভীরতম তত্ত্ব, তাহারই চরম ও পরম প্রকাশ। আমাদের ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে ইহার যে কারণই নির্দ্দেশ করি না কেন, ইহার এই রূপকে—বুদ্ধির দ্বারা নয়, একরূপ মিষ্টিক চেতনার দ্বারাই—উপলব্ধি করা সম্ভব। কারণ, দেহ ও আত্মা, জীবন ও মহাজীবন, দ্বৈত ও অদ্বৈত এখানে এমন একটা নির্দ্বন্দ্বতার ইঙ্গিত করিতেছে,—“বাচো যতে নিবর্ত্তন্তে অপ্রাপ্য মনসা সহ”। এখানে জ্ঞান যেন প্রেমের দুঃখানলে দগ্ধ হইয়া আরও স্নিগ্ধ ও উজ্জ্বল হইয়া উঠিয়াছে—নিদাঘ-দিনের দাহশেষে তারকাখচিত আকাশ যেমন আরও উজ্জ্বল, আরও সৌম্য-গম্ভীর হইয়া উঠে। মহাযোগী মহাদেবের কন্ঠে সেই যে গরল-নীলিমা, তাহার জ্বালা-বোধ কি কম? সেই গভীর জ্বালাকে নিঃশেষে পান করিয়াই তিনি ব্যোমকেশ হইয়াছেন; তাই তাঁহার ললাটনেত্রের সেই জ্ঞান-বহ্নিও শশিকলার স্নিগ্ধকিরণে করুণ হইয়া উঠে। তথাপি বিবেকানন্দ মহাদেব নন–মানুষ।
বালক বিবেকানন্দের সেই দুর্দ্ধর্ষ জ্ঞানাভিমানের ঊর্দ্ধফণা কোন্ মন্ত্রৌষধির বলে রুদ্ধবীর্য্য হইয়াছিল তাহা আমরা জানি। কিন্তু এই প্রেমের অঙ্কুর তাঁহার নিজের চরিত্রেই আজন্ম নিহিত ছিল—কেবল বিকাশের অপেক্ষা মাত্র। আমি বিবেকানন্দ—চরিত্রের যে উদ্ধত স্বাতন্ত্র্য স্পৃহার কথা বলিয়াছি, তাহা ব্যক্তির ক্ষুদ্র ব্যক্তিত্বাভিমান নয়—তাহা পরের তুলনায় নিজের শ্রেষ্ঠত্ব জ্ঞান নয়, সেই মর্য্যাদা-বোধ ব্যক্তির নয়—আত্মার। আত্মারই সেই মর্য্যাদা-বোধ তাঁহাকে এত বড় প্রেমিক করিয়া তুলিয়াছিল।