একথা বলিলে ভুল হইবে না যে, আধুনিক সাহিত্যেই বাঙ্গালী জাতির জীবনীশক্তি ও প্রাণশক্তির একটি সুগভীর পরিচয় ফুটিয়া উঠিয়াছে; কারণ, বাহিরের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় প্রচেষ্টার মধ্যে এ যুগের বাঙ্গালীর স্বরূপ এখনও তেমন সুস্পষ্ট হইয়া উঠে নাই—চরিত্র ও কর্ম্মবুদ্ধির অভাবে সেখানে সে বিশেষ সাফল্য লাভ করে নাই। সে-যুগে বাঙ্গালীর স্বাস্থ্য অটুট ছিল, নবতি বৎসর বয়সেও দেহ-মনের সামর্থ্য একেবারে লোপ পাইত না, পুত্র-পৌত্রাদিবহুল পরিবার তখনও চারিদিকে বিদ্যমান। এজন্য বিদেশী শিক্ষা ও সভ্যতার তীব্র মদিরাও বাঙ্গালীর মনের পক্ষে রসায়নের কাজ করিয়াছিল, প্রাচীন সমাজের সুদৃঢ় বন্ধনের মধ্যেও তাহার প্রাণে নবীনতার আবেগ নিষ্ফল হয় নাই। যে শক্তি এতদিন সুপ্ত ছিল, তাহা বাস্তবজীবনে বাধা পাইলেও ভাবনা, ধারণা ও ধ্যান-কল্পনার ক্ষেত্রে অতিশয় বলিষ্ঠভাবে আত্মপ্রকাশ করিয়াছিল। সংস্কারের মোহ ও মুক্তির আকাঙ্ক্ষা, আত্মদমনের শাস্ত্রবিধি ও ইতিহাস-বিজ্ঞানের পৌরুষ-পাঞ্চজন্য, তাহার হৃদয়ে যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করিয়াছিল, তাহাতে সে ভিতরে ভিতরে অতিশয় অধীর ও অশান্ত হইয়া উঠিতেছিল; বাহিরে যাহার সহিত সন্ধি করিতে না পারিয়া সে একটা ঘূর্ণীর মধ্যে ঘুরিতেছিল, অন্তরে সে তাহার সহিত আরও স্বাধীনভাবে বোঝাপড়া করিবার সাধনা করিয়াছিল। সেই সাধনার প্রাণময়তা, সেই সংগ্রামের উল্লাস, এবং আত্মচেতনার স্ফূর্ত্তি এই সাহিত্যের মধ্যে উদ্বেলিত হইয়াছে। এ যুগের সাধনায় যদি জাতির সেই বিশিষ্ট চেতনা জাগিয়া না থাকিত, সে যদি ভাবের বিশ্বাকাশে আপনার মনোরথকে ছাড়িয়া না দিয়া, প্রাণরশ্মির দ্বারা তাহাকে আপনার পথে–স্বজাতি ও স্বপ্নের নিয়তি নিৰ্দ্দিষ্ট রথবর্তে-চালাইবার শক্তি না পাইত, তবে সাহিত্যে প্রাণের সাড়া জাগিত না, ভাষা ফুটিত না, সাহিত্যের সৃষ্টির হইত না।
মাইকেল হইতে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত বাঙ্গালীর এই সাহিত্য-জীবনের ধারা, এবং গতি-প্রকৃতির নানা দিক আছে; সকল দিকগুলির সম্যক আলোচনা করিতে না পারিলে, বাঙ্গালীর এই যুগের সাধনা ও সিদ্ধির একটা সুস্পষ্ট ধারণা হইবে না। বহু প্রাচীন অতীতের ইতিহাস এখনও উদ্ধার হয় নাই, কাজেই কীৰ্ত্তি-পরম্পরার ভিতর দিয়া জাতির অদৃষ্টলিপি বুঝিয়া লইবার উপায় নাই। অতএব সদ্য-বিগত কালের যে একমাত্র কীর্ত্তির মধ্যে বাঙ্গালীর একটা পরিচয় ফুটিয়া উঠিয়াছে তাহাতেই আমাদের জাতীয় জীবনের একটা আভাস পাওয়া যাইবে! এজন্য এই সাহিত্যের উৎপত্তি, তাহার প্রধান প্রবৃত্তি, এবং বর্তমান পরিণতির কথা আর এক দিক দিয়া অনুধাবন করিবার প্রয়োজন আছে।
‘জাতীয়তা’ ও ‘সাহিত্য’ —আজকালকার কাচার বিলাসী, dilettante বাঙ্গালীর মতে –এই দুইটি শব্দ পরস্পর-বিরোধী। সাহিত্যে এখন বিশ্বজনীনতার নামে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের ধূয়া উঠিয়াছে। কিন্তু মনস্তত্ত্ব ও সাহিত্য-ধর্ম্মের দিক দিয়া এই ব্যক্তি—স্বাতন্ত্র্য কি অর্থে কতখানি সত্য, সে বিচারের ক্ষমতা বা প্রয়োজন কাহারও নাই। অথচ দেখা যাইতেছে ব্যক্তির খেয়াল-খুশি, বা Pseudo-Romantic ভাবতন্ত্রের তাণ্ডব-লীলা এ-যুগে সাহিত্য-সৃষ্টির পক্ষে ব্যর্থ হইয়াছে। আজকাল য়ুরোপীয় সাহিত্যে spirit-এর উপর matter জয়ী হইয়াছে; আধুনিক লেখকেরা যে স্বাধীন ভাব-কল্পনার দাবী করিয়া থাকেন, মূলে তাহা বাহিরের নিকটে অন্তরের পরাজয়, বস্তুর নিকটে আত্মসমর্পণ, সমাজের যুগ-প্রয়োজন স্বকীয় কল্পনার পক্ষচ্ছেদ। এই সকল লেখকেরা আত্মভ্রষ্ট, বস্তু-নিগৃহীত, সামাজিক সমস্যার অন্ধ তাড়নায় সনাতন ভাব-সত্য হইতে তিরস্কৃত। ইহারা স্বাধীন নয়, ইহাদের স্বাতন্ত্র্য একটা মোহ মাত্র; ইহারা জড়জীবী, চিৎ-শক্তিহীন, বর্তমানের আবিল ও বিক্ষুব্ধ জলস্রোতের ক্ষণ—বুদ্বুদ—ইহাদের রচনা শতাব্দী পরে যুগবিশেষের দাহচিহ্ন মসীরেখার মতই মিলাইয়া যাইবে।
ব্যক্তিতন্ত্র বা বস্তুতন্ত্র—ইহার কোনটাই খাঁটি সাহিত্যতন্ত্র নয়। সাহিত্য—সমালোচনায় যে সকল বাক্য বা formula ব্যবহার করা হয়, তাহার দ্বারা কাব্যসৃষ্টির প্রক্রিয়াটিকে ধরিবার চেষ্টা করা হয় মাত্র। সমালোচনা-শাস্ত্র এ পর্যন্ত এ সম্বন্ধে নানা তত্ত্ব উদ্ভাবন করিয়া হাঁপাইয়া উঠিয়াছে। আসলে যাহা সাহিত্য তাহা একই নিয়মে সৃষ্ট হইয়া থাকে, নিরবধি কাল ও বিপুলা পৃথ্বী তাহাকে একই রূপে চিনিয়া লয়; যাহা accidental তাহাই যদি essential হইয়া উঠে, তবে সে ভুল ভাঙ্গিতে বিলম্ব হয় না। সাহিত্যে ব্যক্তিও আছে, বস্তুও আছে; কিন্তু ব্যক্তিতন্ত্র বা বস্তুতন্ত্র নাই। যাহা তর্ক-বিচারের অতীত তাহা লইয়া আমরা যখন বিচার করিতে বসি, তখনই এইরূপ বৈলক্ষণ্য নির্দেশের প্রয়োজন হয়—কিন্তু যে-গুণে রচনা কাব্য হইয়া উঠে তাহার মূল রহস্য একই। তথাপি এইরূপ বিচারেও ক্ষতি নাই—যদি সেই বিচার-বিতর্কের সিদ্ধান্তগুলিকে একটা গন্ডির মধ্যে মানিয়া লওয়া হয়। কারণ, মনে রাখিতে হইবে, এই সকল সিদ্ধান্ত কাব্যসৃষ্টির রহস্য সম্বন্ধে আমাদের মনের কৌতূহল চরিতার্থ করে মাত্র—রসাস্বাদ বা রসের ধারণার ইতর বিশেষ করিতে পারে না। কাব্যরচনায় রসের উৎপত্তি কেমন করিয়া হয়, কবির প্রাণের কোন নিগূঢ় নিয়মের বশে কাব্যসৃষ্টি হয়, তাহা যেমন রসের ধারণা বা রসতত্ত্ব হইতে সিদ্ধান্ত করা যায় না, তেমনই কবির যে প্রাণধর্ম্ম কাব্যসৃষ্টি করে, সেই প্রাণধর্ম্মের লক্ষণগুলির উপরে রসতত্ত্বের প্রতিষ্ঠা হয় না। বিভিন্ন কবির বিভিন্ন emotions বিশ্লেষণ করিয়া আমরা কাব্যের উপাদান-উপকরণের বৈচিত্র্য দেখিয়া মুগ্ধ হই—কবিবিশেষের ব্যক্তিগত অনুভূতির প্রকারভেদ আমাদের ব্যক্তিগত রুচির অনুকূল অথবা প্রতিকূল হয়; কিন্তু emotions-এর ঐ প্রকারভেদ পর্যন্তই যদি কাব্যের স্বরূপ-নিৰ্দ্দেশ হয়, তবে তাহা রস পর্যন্ত আর পৌঁছাইবে না—কাব্য ঐখানেই ইতি। অতি-আধুনিক সাহিত্যের গতি-প্রকৃতি এবং তাহার সম্বন্ধে রসিকের রসোচ্ছ্বাস দেখিয়া মনে হয়, ইহারা কাব্যকে হারাইয়া, সোনা ফেলিয়া আঁচলে গিরা দিতেছে। কাব্যে তাহারা কবির খেয়াল-খুশি, অথবা জীবনের যে দিকটা জড়চেতনার দিক্—spirit যেখানে matter-এর দ্বারা অভিভূত—সেই বস্তু-পীড়িত চেতনাকে উৎকৃষ্ট কবি-প্রেরণা বলিয়া মনে করিতেছে। ক্ষণ-পরিচ্ছিন্ন তড়িৎ-স্পর্শের মত যাহা তাহাদের স্নায়ুকে মাত্র আঘাত করে তাহাই কাব্যরস। প্রকৃত জীবন-রহস্যের পরিবর্তে, পারিবারিক, সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় জীবন-যাত্রার যে সব জমা-খরচের হিসাব মানুষের জড়চেতনাকে বিক্ষুব্ধ করিয়া তুলিয়াছে—তজ্জনিত জন্তুণ উদগার, আর্তনাদ, প্রলাপ ও দুঃস্বপ্ন যে রচনায় যত অধিক প্রকট হইয়াছে তাহাই তত উৎকৃষ্ট কাব্য! এ অবস্থায় কাব্যসমালোচনা নিষ্ফল।
কিন্তু আমরা গত যুগের বাংলা সাহিত্যের কথা বলিতেছি। সে সাহিত্য সম্বন্ধে আলোচনা করিতে হইলে খুব আধুনিক সাহিত্যনীতি অবলম্বন না করিলেও বোধ হয় চলিবে; আমরা সে সাহিত্যের কাব্যগুণ বিচার করিতেছি না। পূৰ্ব্বেই বলিয়াছি, এই সাহিত্যের ইতিহাসে আমরা বাঙ্গালীর হৃদয়-সংগ্রাম, তাহার ‘জাতীয়’ আত্মপ্রতিষ্ঠার একটা বিপুল প্রয়াস দেখিতে পাই। বাঙ্গালী যে তখনও বাঁচিয়াছিল— আত্মরক্ষা ও আত্মপ্রসার, জীব-ধর্ম্মের এই দুই শক্তির প্রমাণ তাহার এই সাহিত্যে ফুটিয়া উঠিয়াছে। এই প্রাণশক্তি ছিল বলিয়াই সে তাহার প্রাণের ভাষাকে এমন সুন্দর, সুদৃঢ় ও সুপরিপুষ্টরূপে ফুটাইয়া তুলিতে পারিয়াছিল। আজও পর্য্যন্ত আমরা সাহিত্যের নামে যে অনাচার করিতেছি তাহা এই ভাষারই বুকে; আজও পর্য্যন্ত আমরা গদ্যে ও পদ্যে যে বমন ও রোমন্থন করিতেছি তাহাও পিতৃপিতামহ-নির্ম্মিত এই সাহিত্যের শিলা-চত্বরের উপরেই। কারণ, কি ভাষা, কি সাহিত্য, কোন দিক দিয়াই আমরা সেই মন্দিরে একটি নূতন চূড়া তুলিতে পারি নাই বরং তার ভিৎ জখম করিতেছি।
গতযুগে এই সাহিত্য ও ভাষার সৃষ্টি সম্ভব হইয়াছিল কেমন করিয়া?—যেমন করিয়া সর্ব্বকালে ও সর্ব্বদেশে কোনো জাতির সাহিত্য গড়িয়া ওঠে। সাহিত্যের সৃষ্টিতত্ত্ব ও সাহিত্যের রসতত্ত্ব এক নয়। সাহিত্যের সৃষ্টি-মূলে জীবনধর্ম আছে, কিন্তু রসের আস্বাদনে ব্যক্তির ব্যক্তিগত বা জাতিগত চেতনা নির্ব্যক্তিক ও সাৰ্ব্বজনীন হইয়া ওঠে। এই জীবনধর্ম্ম অর্থে আধুনিক সাহিত্যের আত্মতন্ত্র বা বস্তুতন্ত্র নয়। ইহা আরও গভীর আরও ব্যাপক। কবিও প্রকৃতি পরবশ, কিন্তু কবির অহং এই প্রকৃতির অধীন হইয়াই, দেশ, কাল ও জাতির বিশিষ্ট সাধন-সংস্কারের প্রভাবে যাহা সৃষ্টি করে তাহাই সাহিত্য। কারণ, ভাব যতই বিশ্বজনীন হউক, কবির প্রাণের ছাঁচে ঢালা না হইলে তাহা রূপময় হইয়া উঠে না—এই প্রাণই কবিধর্ম্মের, তথা জীবনধর্ম্মের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা। যেখানে যাহা কিছু সাহিত্য সৃষ্টি হইয়াছে, তাহার রস যতই গভীর, উদার ও সার্ব্বজনীন হউক—যে রূপ হইতে সেই রসের উৎপত্তি হয় তাহা কবির প্রাণেরই রূপ; অর্থাৎ তাহাতে যে বর্ণ আছে তাহা ব্যক্তিবিশেষের হৃদয়-রক্তের আভা; এবং তাহাতে আলোছায়ার যে রেখাপাত আছে, তাহা ব্যক্তিবিশেষের আনন্দ-বেদনার অশ্রু-হাস্যে বিচিত্রিত। কবি যতই বস্তুতন্ত্র বা আত্মতন্ত্র হউন, তাঁহার এই প্রাণধৰ্ম্মই কাব্যসৃষ্টির আদি প্রেরণা। এই প্রাণের স্পন্দন একটা নির্ব্বিশেষ ভাবযন্ত্রের ক্রিয়া নয়; কবির জাতি ও বংশ, তাঁহার দেশ ও কাল এই প্রাণের প্রতিষ্ঠা করিয়াছে—ইহাকে পুষ্ট করিয়াছে। সাহিত্যের যে-রূপ রসের আধার—সেই রূপটি বৃন্তহীন পুষ্পসম বিশ্বাকাশে ফুটিয়া উঠে না, তাহার মূলে এই বিশেষের মৃত্তিকা-বন্ধন আছে, না থাকিলে কোন সাহিত্যেরই বৈশিষ্ট্য থাকিত না—সাহিত্য সাহিত্যই হইত না; কারণ তাহা হইলে ভাবের রূপসৃষ্টি অসম্ভব হইত। তাই, জগতের সাহিত্যে যে কাব্য সবচেয়ে নির্ব্যক্তিক, সেই শেক্সপীরীয় নাটকের প্রেরণামূলেও এলিজাবেথীয় যুগের ইংরাজ প্রাণ স্পন্দিত হইতেছে; তাই, গ্যেটে যে ভাষায় তাহার ফাউস্ট লিখিয়াছেন, সেই ভাষাই তাহার প্রাণ; সে ভাষার বাহিরে সে এতটুকু দাঁড়াইতে পারে না।
অতএব সাহিত্যের সঙ্গে জাতীয়তার সম্পর্ক কি, এবং এই জাতীয়তারই বা অর্থ কি, তাহা বুঝিতে কষ্ট হইবে না। মনে রাখিতে হইবে, আমি এখানে সাহিত্য—রসের লক্ষণ বিচার করিতেছি না। সাহিত্য-সৃষ্টির মূলে কোন্ শক্তির ক্রিয়া আছে, সাহিত্যের মধ্য দিয়া জাতির জীবন—তাহার জাতীয় আত্ম-প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা—কেমন করিয়া ফুটিয়া উঠে, তাহারই কথা বলিতেছি। এই সাহিত্যের দর্পণেই জাতি যে আপনাকে আপনার মধ্যে অবলোকন করে—তাহার আত্মসাক্ষাৎকার হয়। যাঁহারা সাহিত্যের রসই উপভোগ করেন তাঁহাদের নিকটে এ তথ্যের কোনও মূল্য নাই; ঋতুবিশেষে জল ও মাটির কোন অবস্থায় উদ্যানলতা পুষ্প প্রসব করে—সে সংবাদ তাঁহাদের নিষ্প্রয়োজন; তাঁহার কেবল সদ্য-চয়নিত পুষ্পগুচ্ছের রূপ ও সৌরভ উপভোগ করিতে পারিলেই সন্তুষ্ট। কিন্তু এই ফুল যখন ফুরাইয়া আসে, তখন শুধুই বিলাসীর-সঙ্কট উপস্থিত হয় না, জাতির প্রাণশক্তির অভাব ধরা পড়ে এবং সে যে কত বড় দুৰ্দ্দিন, তাহা জাতির জীবনেই যাহারা জীবিত—যাহারা বিশ্বপ্রেমিক নয়, অতি অধম ও সঙ্কীর্ণমনা স্বজাতি প্রেমিক—তাহারাই তাহা জানে।
আমাদিগের গত যুগের সাহিত্যে এই জাতীয়তা ও তদনুবিদ্ধ প্রাণধর্ম্মের প্রকাশ রহিয়াছে। পশ্চিমের আকস্মিক সংঘাতে, এই জাতির বহুকাল-লুপ্ত চেতনা চমকিত হইয়া উঠিল, যে মুহূর্ত্তে তাহার মানস-শরীরে এই বিদ্যুৎ-স্পর্শ সঞ্চারিত হইল, সেই মুহূর্ত্তে প্রতিক্রিয়া আরম্ভ হইল। হঠাৎ জাগরণে সে দিশাহারা হইয়াছিল। গুপ্তকবি ও রঙ্গলাল দিশাহারা হন নাই, কারণ তাঁহাদের সম্যক জাগরণ হয় নাই—একজন হাই তুলিয়া তুড়ি দিতেছিলেন, আর একজন জাগর-স্বপ্নের ক্ষণ—অবসরে এই রূঢ় আলোকের দ্বার রুদ্ধ করিয়া আপন গৃহকোণের স্তিমিত মৃৎপ্রদীপটি উস্কাইয়া দিবার চেষ্টা করিতেছিলেন।
কিন্তু জাগরণে বিলম্ব হয় নাই। পশ্চিমের প্রবল প্রভাব—শিক্ষা-দীক্ষা, রুচি ও আশা-বিশ্বাস—যাহাকে একেবারে জয় করিয়া লইয়াছিল, তাহার মধ্যেই বাঙ্গালীর বাঙ্গালীতম প্রাণ, সেই পাশ্চাত্ত্য প্রভাবের পীড়নেই ভিতরে ভিতরে গুমরিয়া উঠিল; তাহার অন্তরের অন্তস্তলে—সুগভীর মর্ম্মমূলে, তাহার জাগ্রত চেতনারও অন্তরালে যে হাহাকার জাগিয়াছিল, বাহিরে বিদ্রোহচ্ছলে সেই অসীম আকুতিই মহাকাব্যের গীতোচ্ছ্বাসে প্লাবিয়া উচ্ছ্বসিয়া উঠিয়াছে। মেঘনাদবধকাব্য বাঙ্গালী কি কখনও ভাল করিয়া পড়িয়াছে?—কেহ কি এখনও পড়ে? এই কাব্য-কাহিনীর ঘনঘটার ফাঁকে ফাঁকে কুললক্ষ্মী, মাতা ও বধূর বেশে, কবিচিত্ত মথিত করিয়া ক্রন্দন-রবে দিক্দেশ বিদীর্ণ করিতেছে। সেই আলুলায়িত-কুন্তলা রোদনোচ্ছ্বননেত্রা অপরূপ মমতাময়ী মূৰ্ত্তি প্রথম হইতে শেষ পর্য্যন্ত কবির চক্ষে বিরাজ করিয়াছে। বাঙ্গালীর কাব্যে সত্যকার সৌন্দর্য্য আর কি ফুটিতে পারে?-তাহার জীবনে আর আছে কি? সর্ব্বস্ব বিসর্জ্জন দিয়া, মনুষ্যত্ব হারাইয়া, নারীর যে প্রেম ও স্নেহের আত্মত্যাগ সে এখনও প্রাণে-প্রাণে অনুভব করে, এবং করে বলিয়াই এখনও একেবারে বিনষ্ট হয় নাই, সেই অনুভূতি মেঘনাদবধের কবির বাঙ্গালীত্ব অটুট রাখিয়াছে; বাঙ্গালীর গৃহ—সংসারের সেই পুণ্য-দীপ্তি—মধুসূদনের হৃদয়ে তাঁহার মায়ের সেই স্নেহ-ব্যাকুলতার অশান্ত স্মৃতি তাঁহাকে বিধর্ম্ম হইতে রক্ষা করিল। হোমার, ভার্জ্জিল, ট্যাসোর কাব্য—গৌরব বিফল হইল—বীর-বিক্রমের গাথা অশ্রুধারে ভাঙ্গিয়া পড়িল; মাতা ও বধূর ক্রন্দনরবে বিজয়ীর জয়োল্লাস ডুবিয়া গেল—বীরাঙ্গনার যুদ্ধযাত্রা বাঙ্গালীবধূর সহমরণ-যাত্রার করুণ দৃশ্যে, অদৃষ্টের পরম পরিহাসের মত নিদারুণ হইয়া উঠিল। স্বর্গ, নরক, পৃথিবী ও সমুদ্রতলব্যাপী এই আয়োজন, রাজসভার ঐশ্চর্য্য, রণসজ্জার আড়ম্বর, অস্ত্রের ঝঞ্ঝনা এবং অযুত যোধের সিংহনাদ সত্ত্বেও, আশোক-কাননে বন্দিনী নারী লক্ষ্মীর মূক-শোক-ঝঙ্কারে সমস্ত আকাশ ভরিয়া উঠিয়াছে; এবং শক্তিশেল-মূর্ছিত ভ্রাতার শ্মশান-শিয়রে রামের শোকোচ্ছ্বাস, অথবা সিন্ধুতীরে পুত্র ও পুত্রবধূর চিতাপার্শ্বে দন্ডায়মান রাবণের সেই মর্ম্মান্তক উক্তিকেও প্রতিহত করিয়া যে একটি অতি কোমল ক্ষীণ কণ্ঠের বাণী, লবণাম্বুগর্ভে নিৰ্ম্মল উৎস-বারির মত উৎসারিত হইয়াছে—
সুখের প্রদীপ, সখি, নিবাই লো সদা
প্রবেশি যে গৃহে, হায় অমঙ্গলারূপী
আমি। পোড়া ভাগ্যে এই লিখিলা বিধাতা!
নরোত্তম পতি মম, দেখ, বনবাসী!
বনবাসী, সুলক্ষ্মণে, দেবর সুমতি
লক্ষ্মণ! ত্যজিলা প্রাণ পুত্রশোকে, সখি,
শ্বশুর! অযোধ্যাপুরী আঁধার লো এবে,
শূন্য রাজসিংহাসন! মরিলা জটায়ু,
বিকট বিপক্ষপক্ষে ভীমভূজবলে,
রক্ষিতে দাসীর মান! হ্যাদে দেখ হেথা—,
মরিল বাসবজিৎ অভাগীর দোষে,
—কবির কাব্য-লক্ষ্মীও সেই বাণী-মন্ত্রে কবির কণ্ঠে স্বয়ম্বর-মালা অর্পণ করিয়াছেন। ইহাই হইল বাঙ্গালীর মহাকাব্য। আয়োজনের ত্রুটি ছিল না।, ছন্দ, ভাষা, ঘটনা-কাহিনী, হোমার-মিল্টনের ভঙ্গি, দান্তে-ভার্জিলের কল্পনা এবং সর্ব্বোপরি বিদেশী কাব্যের প্রাণবস্তু—এমন কি বাক্য-ঝঙ্কার পর্য্যন্ত আত্মসাৎ করিবার প্রতিভা—সবই ছিল; কিন্তু কবি, সত্যকার কবি বলিয়া, সৃষ্টিরহস্যের অমোঘ নিয়মের বশবর্তী হইয়া যাহা রচনা করিলেন—তাহা মহাকাব্যের আকারে বাঙ্গালী-জীবনের গীতিকাব্য। দূর দিগন্তের সাগরোর্ম্মি তাঁহাকে আহ্বান করিয়াছিল, তিনি তাহারই —অভিমুখে তাঁহার দেহ-মনের সকল শক্তি প্রয়োগ করিয়া কাব্য-তরণী চালনা করিয়াছিলেন। সমুদ্রবক্ষে তরণী ভাসিল; ছন্দে, ভাষায় ও বর্ণনা-চিত্রে নীলাম্বু—প্রসার ও জল-কল্লোল জাগিয়া উঠিল—কিন্তু কবি-কর্ণধারের মনশ্চক্ষু আধ-নিমীলিত কেন? সাগর-বক্ষে উত্তাল তরঙ্গরাজির মধ্যেও এ কার কুলু-কুলু ধ্বনি? –এ যে কপোতাক্ষ! তীরে, ভগ্ন শিবমন্দিরে, সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনাইয়া উঠিতেছে, জলে “নূতন গগন যেন, নব তারাবলী”, এবং গ্রাম হইতে সন্ধ্যারতির শঙ্খধ্বনি ভাসিয়া আসিতেছে! সমুদ্র গৰ্জ্জন করুক, ফেনিল জলরাশি তরণী-তটে আছাড়িয়া পড়ুক—তথাপি এ স্বপ্ন বড় মধুর! সমুদ্রতলে কপোতাক্ষের অন্তঃস্রোত তাঁহার কাব্য—তরণীর গতি নির্দ্দেশ করিল, সমুদ্রে পাড়ি দেওয়া আর হইল না। তরী যখন তীরে আসিয়া লাগিল, তখন দেখা গেল,—“সেই ঘাটে খেয়া দেয় ঈশ্বরী পাটুনী।”
* ***
এমনি করিয়া আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ভিৎ-পত্তন হইয়াছিল। বাহিরের প্রচন্ড সংঘাত ভিতরের প্রাণ-বস্তু আলোড়িত করিয়াছিল; এ আলোড়নের প্রয়োজন ছিল, এই সংঘাতেই তাহার প্রাণ জাগিয়াছিল। বাঙ্গালী হঠাৎ নূতন জগতে চক্ষুরুন্মীলন করিল, তাহার সমস্ত দেহ-মন-প্রাণে সাড়া জাগিল; এই প্রাণ ছিল বলিয়াই যে প্রবল প্রতিক্রিয়া উপস্থিত হইল তাহার ফলে এই নব-সাহিত্যের জন্ম হইয়াছিল। প্রথম দিশাহারা অবস্থায় যে একটা প্রবল আবেগ অনুভব করিয়াছিল; নব ভাব ও চিন্তার মন্থনে তাহার প্রাণের সেই অস্থিরতা সর্বত্র-সাহিত্যের আকারে সুপ্রকাশিত হয় নাই; প্রকাশের বেদনা ও ব্যাকুলতা আছে, কিন্তু ভাষা নাই, ছন্দ নাই; প্রাণে যাহা জাগিয়াছে তাহার অনুভূতি স্পষ্ট হইয়া উঠে নাই, অথবা সেই অনুভূতিকে চাপিয়া রাখিয়া ইংরেজী সাহিত্য, বিজ্ঞান ও ইতিহাসের ভাব ও চিন্তারাজি মনের মধ্যে গোল বাধাইতেছে। সে সকল ভাব ও চিন্তার আবেগমূলক অনুকরণে যে সকল কাব্য ও মহাকাব্য রচিত হইয়াছিল তাহাতে আমরা খাঁটি কাব্যসৃষ্টির পরিচয় পাই না বটে, কিন্তু বাঙ্গালী কেমন করিয়া এই নব ভাবের প্লাবনের মধ্যে আপনাকে ছাড়িয়া দিয়াও নিজের জাতি-কুল আঁকাড়ইয়া ধরিতেছে, আত্মপ্রতিষ্ঠ হইবার চেষ্টা করিতেছে—তাহার সম্যক পরিচয় পাই। হেমচন্দ্রের কাব্যে আমরা খাঁটি বাঙ্গালী প্রাণের পরিচয় পাই; কিন্তু সে প্রাণ বলিষ্ঠ হইলেও অলস, তাহা গভীরভাবে আন্দোলিত হয় নাই। যে বজ্রাগ্নির আলোকে মধুসূদনের জাগর-চৈতন্য স্তম্ভিত হইয়া, অন্তরের অন্তরে বাংলার কাব্যলক্ষ্মীর সঙ্গে সাক্ষাৎকার ঘটিয়াছিল-সে বজ্রাগ্নি হেমচন্দ্রের অতিশয় স্থূল, আত্মতৃপ্ত বাঙ্গালীয়ানা ভেদ করিতে পারে নাই। নবীনচন্দ্রের আবেগ ছিল, কিন্তু সে আবেগ অন্ধ; তিনি আদৌ আত্ম-সচেতন ছিলেন না, অতিশয় আত্মাভিমানী ছিলেন; তাই তাঁহার মনে ভাব ও কল্পনার যেমন অবাধ অধিকার ছিল, প্রবলতাও ছিল, তেমনি তাহা উপর দিয়াই বহিয়া যাইত—অন্তরের মধ্যে কাব্যসৃষ্টির গভীরতর প্রেরণা হইয়া উঠিবার অবসর পাইত না। তাই এক একটা idea তাঁহাকে পাইয়া বসিত মাত্র; ইংরেজী-শিক্ষার অভিমানই ছিল তাহার মূল, তাহার সহিত অতিশয় দেশী এবং অতি দুর্ব্বল ভাবাতিরেক যুক্ত হইয়া যে কাব্যগুলির জন্ম হইয়াছে, তাহাতে ইংরেজী ভাব ও দেশী ভাবপ্রবণতার একটি অদ্ভুত সংমিশ্রণ দেখিতে পাই—বাঙ্গালীর জাতি-ধর্ম্ম ও ইংরেজী-শিক্ষা উভয় উভয়কে বেড়িয়া ঘুরিয়া ঘুরিয়া কেমন ঘৃণার সৃষ্টি করিয়াছে তাহাই দেখিয়া কৌতুক অনুভব করি। সুরেন্দ্রনাথের প্রকৃতি স্বতন্ত্র; সে যুগের সেই দিশেহারা অবস্থার প্রথম দিকে এই একমাত্র কবি ইংরেজী ভাব ও চিন্তার ধারাকে ধীরভাবে আত্মসাৎ করিতে চাহিয়াছিলেন; নব বিজ্ঞান, দর্শন ও ইতিহাসের আলোকে নিজের অন্তরের ধারণা ও ভাবনাকে যাচাই করিয়া লইতে চাহিয়াছিলেন—ভাবাতিরেক বা কবি কল্পনাকে দমন করিয়া বাস্তব-প্রত্যক্ষের সঙ্গে বোঝাপড়া করিতে চাহিয়াছিলেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর ইংরেজী সাহিত্যে যে ভাবমার্গ ও যুক্তিপন্থার প্রসার হইয়াছিল তাহাই তাঁহাকে বিশেষ করিয়া প্রভাবান্বিত করিয়াছিল; তিনি কল্পনা অপেক্ষা বুদ্ধিবৃত্তি, কাব্য অপেক্ষা বৈজ্ঞানিক তথ্য জিজ্ঞাসার দিকে ঝুঁকিয়াছিলেন। বাস্তব ও প্রত্যক্ষ বস্তুনিচয়ের নূতন করিয়া মূল্য-নির্দ্ধারণের জন্য তিনি পাশ্চাত্য বিজ্ঞান ও দেশীয় চিন্তাপ্রণালীর সমন্বয় সাধন করিতে উৎসুক হইয়াছিলেন। এই সত্য-নির্ণয়ের আবেগ, যুক্তি-কল্পনার আনন্দ, মনুষ্য-সমাজের নূতনতর মহিমা —আবিষ্কারের উৎসাহ তাঁহাকে যে কাব্যরচনায় ব্রতী করিয়াছিল, তাহাতে সম্যক রসসৃষ্টি না হইলেও একটা নূতন ভাবদৃষ্টির পরিচয় আছে; তাঁহার কাব্যে নব নব চিন্তা ও ভাবনার যে সকল চকিত-চমক আছে তাহা সত্যই বিস্ময়কর। পরবর্ত্তী কবিগণের কাব্যে এইরূপ অনেক চিন্তাবস্তু কাব্যবস্তুতে পরিণত হইয়াছে—সুরেন্দ্রনাথ সেগুলিকে যেন চিন্তার আকারেই ছড়াইয়া গিয়াছেন। এ শক্তি ঠিক কবিশক্তি না হইলেও, ইহার মূলে কল্পনার আবেগ আছে; যে দৃষ্টান্ত ও উপমা সমুচ্চয়ের দ্বারা তিনি তাঁহার বক্তব্যকে সমীচীন করিয়া তুলিতে চান, তাহার মধ্যেই তাঁহার কবি শক্তির প্রমাণ আছে। তাঁহার রচনায় এই যুগের প্রধান প্রবৃত্তি নিখুঁতভাবে ধরা পড়িয়াছে। ভাবপ্রবণ বাঙ্গালীর প্রকৃতিতে পাশ্চাত্ত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের যে সাড়া জাগিয়াছিল—তাহার ফলে সে নূতন চিন্তাভিত্তির অন্বেষণ করিয়াছিল, আত্মপ্রতিষ্ঠ হইয়া আপনার প্রাণধর্ম্মের অনুযায়ী করিয়া যে পরস্ব গ্রহণের প্রয়োজন সে অনুভব করিয়াছিল—তাহাতে দেশী ও বিদেশী চিন্তার সমন্বয় সাধনে একটা সজ্ঞান চেষ্টাই স্বাভাবিক। এবং সে সমন্বয় সাধনে কতক পরিমাণে ভাবুকতারও প্রয়োজন—এই ভাবুকতাই সুরেন্দ্রনাথের কবিত্ব। সুরেন্দ্রনাথের মধ্যে সে-যুগের এই প্রধান প্রবৃত্তির প্রথম উন্মেষ দেখিতে পাই। তাঁহার কাব্যরচনা এই হিসাবে সার্থক হইয়াছে যে, তাঁহার ভাববস্তু তাঁহার কাব্য অপেক্ষা কম বা বেশী হয় নাই—তাঁহার কথা তিনি তাঁহার মত করিয়া বলিতে পারিয়াছেন। হেমচন্দ্রের মহাকাব্য-রচনার মত অক্ষমের প্রয়াস-বিড়ম্বনা তাহাতে নাই; তিনি নবীনচন্দ্রের মত মহাকাব্য-রচনার নামে ধর্ম্ম, রাজনীতি ও সমাজ-সংস্কারের বক্তৃতা অমিত্রাক্ষর ছন্দে লিপিবদ্ধ করেন নাই। তিনি তাঁহার প্রিয় কবি Pope-এর মত কবিতায় Essay on Woman লিখিয়াছেন, সে বিষয়ে তাঁহার কার্য্য ও অভিপ্রায়ের মধ্যে কোনও লুকাচুরী নাই, বরং এই গদ্যাত্মক কাব্যে কবির নির্ভীক সত্যবাদের উৎসাহ, ভাব চিন্তার অভাবনীয় চমক, ভাষার একটি নূতন ভঙ্গী এবং স্থানে স্থানে অপ্রত্যাশিত ছন্দ-ঝঙ্কার তাঁহার ‘মহিলা-কাব্য’খানিকে বাংলা কাব্যসাহিত্যে বেশ একটু স্বতন্ত্র আসনে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছে।
এই সকল রচনা উৎকৃষ্ট সাহিত্য না হইলেও, যে প্রাণ-মনের নিগূঢ় আন্দোলনে সাহিত্যসৃষ্টি সম্ভব হয়, দুই বিভিন্ন সভ্যতার সংঘর্ষে জাতিবিশেষের সুপ্ত চেতনা মন্থিত হইয়া তাহার প্রাণভান্ডে অমৃত সঞ্চিত হইয়া ওঠে—সেই আন্দোলন—আলোড়নের প্রকৃষ্ট পরিচয় এই সকল রচনায় আছে। মাইকেল, বঙ্কিম, বিহারীলাল ও রবীন্দ্রনাথ–আধুনিক সাহিত্যের এই চারিটি স্তম্ভ যে ভিত্তিভূমির উপরে দাঁড়াইয়া বঙ্গভারতীর এই অভিনব মন্দির-চূড়া ধারণ করিয়া আছেন, তাহার তলদেশ কোথায় এবং কত গভীর,—নির্ণয় করিতে হইলে, এই সকল কবির কাব্যপ্রচেষ্টা সযত্নে পর্য্যালোচনা করা আবশ্যক। কোনো যুগের অন্তরতম প্রবৃত্তির সন্ধান করিতে হইলে কেবল উৎকৃষ্ট প্রতিভার প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করিলে চলিবে না; কারণ, প্রতিভার যে দিকটা আমাদিগকে মুগ্ধ করে সে তার আলৌকিক কীৰ্ত্তি—এই কীর্ত্তির অন্তরালে সে স্বাভাবিক নিয়ম রহিয়াছে তাহা সহজে আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় না। কিন্তু যাঁহারা সেরূপ প্রতিভাশালী নহেন তাঁহাদের প্রয়াস-প্রচেষ্টা আরও স্বচ্ছ, তাঁহাদের মধ্যে আমরা যুগধর্ম্মকে আরও স্পষ্ট উপলব্ধি করিতে পারি। মাইকেলের মেঘনাদবধ কাব্যে বাঙ্গালীর প্রাণ যুগধর্ম্মবশে কি নিগূঢ় স্পন্দনে স্পন্দিত হইয়াছে, সে চিন্তা আমরা করি না—তাঁহার কাব্যরসের উৎকর্ষ অপকর্ষ বিচার করি। বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস-কাব্যগুলির মধ্যে, পাশ্চাত্ত্য কাব্য-সাহিত্যের পূর্ণ রসস্রোত বাঙ্গালীর প্রাণে কেমন করিয়া সাহিত্য-সৃষ্টির প্রেরণা দান করিয়াছে, সেই সকল কাব্যে বাঙ্গালীর মনীষা ও কবি-প্রতিভা খাঁটি বিদেশী রস-রসিকতার আবেগে কি অপূৰ্ব্ব ভাব—জগৎ সৃষ্টি করিয়াছে—তাহা চিন্তা করিতে গেলে আমরা কেবল বিস্ময়-বিমুগ্ধ হইয়া থাকি; কোথায় কোন্ দিক দিয়া কবির প্রাণে সাড়া জাগিয়াছে, এবং আমরা পাঠকেরা, এই অতিশয় অপরিচিত ভাবলোকে প্রাণের কোন নবজাগরণে জাগিয়া উঠি, অথবা কোন্ স্বপ্নলোকে আমাদের চিরসুষুপ্ত কামনা লক্ষ্মীর সন্ধান পাই—এই বিদেশী সাহিত্যকলার মোহন মুকুরে আমাদেরই প্রাণের প্রতিবিম্ব কেমন করিয়া ফুটিয়া উঠিয়াছে, কেমন করিয়া তাহা সম্ভব হইল, এ চিন্তার অবকাশ থাকে না। কিন্তু একথা কখনও বিস্মৃত হইলে চলিবে না যে, এই সাহিত্যরস যতই উৎকৃষ্ট হউক, যদি তাহার ভাষা আমাদের হৃদয় স্পর্শ করিয়া থাকে, যদি তাহার ভাব—কল্পনায় কেবল আমাদের রুস-পিপাসা উদ্ভিক্ত না হইয়া তাহার সহিত আমাদের একটি মৰ্ম্মর্গত আত্মীয়তা উপলব্ধি করিয়া থাকি, তবেই তাহা আমাদের সাহিত্য হইয়াছে। বিদেশী ভাব-কল্পনা বিদেশী সাহিত্যেই আমরা উপভোগ করি; কিন্তু সেই ভাব-কল্পনাই যদি আমাদের মনের তৃপ্তি সাধন করিত, তবে কোনও পৃথক স্বকীয় সাহিত্যের প্রয়োজন হইত না–আমার ভাষায় তাহা অনুবাদ করিলেই আমার সাহিত্য হইত। এ যুগে সেই বিদেশী ভাব-কল্পনাকে যাঁহারা আত্মসাৎ করিয়াছিলেন—অর্থাৎ তাহা হইতে প্রেরণা লাভ করিয়া একটি স্বতন্ত্র স্বকীয় ভাব জগৎ সৃষ্টি করিয়া নিজ প্রাণের স্বাধীন স্ফূর্ত্তির বিকাশ করিয়াছিলেন—তাঁহারাই এ যুগের সাহিত্য-স্রষ্টা। এই সৃষ্টিশক্তিই তাঁহাদের দিব্যশক্তি। এইখানেই সাহিত্যের সহিত জাতীয়তার সম্বন্ধ। কবির আত্মা নির্বিশেষ মানবাত্মা নয়; যে রূপরসপিপাসা কবি-প্রকৃতির স্থায়ী লক্ষণ, যাহার বশে কবির ভাব রূপময় হইয়া উঠে, নিৰ্ব্বিশেষ বিশেষে পরিণত হয়—কবির সেই কবিধৰ্ম্ম একটাই বিশিষ্ট প্রাণমনের দ্বারা পরিচ্ছিন্ন-প্রাণের সেই ছাঁচটি আছে বলিয়াই ভাব রূপের আকারে আকারিত হয়; এই প্রাণ না থাকিলে সাহিত্যের প্রাণসৃষ্টি অসম্ভব—এই প্রাণের মূল জাতির বহুকাল-লব্ধ চেতনা, তাহার অতীত ও বর্ত্তমান, তাহার জাগ্রত ও মগ্ন চৈতন্যের মধ্যে প্রসারিত হইয়া আছে। মেঘনাদবধ কাব্যের মধ্যে আমরা কবির এই অন্তরতম অন্তরের পরিচয় পাইয়াছি। বঙ্কিমের কাব্যে চৈতন্য আরও পরিস্ফুট, তাই তাঁহার মধ্যে এই দেশী ও বিদেশী ভাবের সংঘর্ষ আরও গভীর, আরও বিপুল। বঙ্কিমের কাব্যসৃষ্টিতে আমরা যে প্রাণের আলোড়ন দেখিতে পাই, তাহাতে বাত্যাবিক্ষুব্ধ সমুদ্রের অধীর উচ্ছ্বাস, ফেনশীর্ষ তরঙ্গ-গহ্বরের অন্ধকার, এবং জলতলস্থ ভীষণা শান্তির আভাস পাই। সেকালে বাঙ্গালীর প্রাণে যে বিক্ষোভ উপস্থিত হইয়াছিল–বিক্ষুব্ধ জলরাশির উপরে সর্ব্বপ্রথম মেঘনাদবধের তরঙ্গচূড়া দেখা দিয়াছিল—সেই পাশ্চাত্যঝটিকার আন্দোলনে প্রমত্ত বাঙ্গালীর প্রাণসাগর যে তুঙ্গতম তরঙ্গে উদ্বেল হইয়া উঠিয়াছিল, তাহারই ফল-বিষবৃক্ষ, কৃষ্ণকান্তের উইল, সীতারাম, চন্দ্রশেখর, দেবী চৌধুরাণী ও আনন্দমঠ। কিন্তু এই তরঙ্গের স্রোত-নির্ণয় হইবে সুরেন্দ্রনাথ, হেমচন্দ্র ও নবীনচন্দ্রের কাব্যে।
তথাপি এই আলোড়নের সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিক্রিয়া আরম্ভ হইয়াছে। বিদেশী সংঘাতের প্রতিঘাতে যে সাহিত্যের জন্ম হইল, যে সাহিত্যের মূল-প্রেরণা ছিল নবাবিস্তৃত ভাব ও চিন্তার জগতে বাঙ্গালীর আত্মপ্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা; তাহার করনা, বাসনা ও পিপাসাকে উদ্বুদ্ধ করিয়া প্রত্যক্ষ-বাস্তবের সহিত দ্বন্দ্বকে আরো ঘনাইয়া তোলা—সহসা সে সাহিত্যের স্রোত উল্টা দিকে বহিল। এ দ্বন্দ্ব যেন তাহার বেশীক্ষণ সহ্য হইল না। প্রাণ হইতে মনে, ভাব হইতে ধ্যানে, সে বাস্তব-মুক্তির জন্য লালায়িত হইল। মাইকেল হইতে বঙ্কিম— অতি অল্পকাল, এক-পুরুষও নয়; বাঙ্গালীর নব জাগ্রত প্রাণ-চেতনা তখনও সুপরিস্ফুট হইয়া উঠে নাই, জাতির অতীত স্বপ্ন ও ভবিষ্যতের আশা তাহাকে চঞ্চল করিতেছে মাত্র—সেই কালেই সাহিত্য-প্রাঙ্গণের এককোণে ধ্যানাসনে বসিয়া কবি বিহারীলাল ‘সারদামঙ্গল’—গান আরম্ভ করিয়াছেন। সেকালে, সে সুরে কান পাতিবার অবসর কাহারও ছিল না; কেহ জানিত না যে, অতঃপর বাংলার কাব্যলক্ষ্মী দেশ-কাল বিস্মৃত হইয়া যে ধ্যানরসে নিমগ্ন হইবেন—সাহিত্যে জাতীয় জীবনের স্পন্দন স্তিমিত হইয়া ক্রমশঃ যে সূক্ষ্মতর রসবিলাস ও বিশ্বজনীন ভাবলোকের প্রতিষ্ঠা হইবে–এই ভাবোন্মত্ত, উদাসীন, আত্মহারা ব্রাহ্মণ-কবি তাহারই সূচনা করিতেছেন।
.
বাঙ্গালীর চরিত্রে ভারতীয় প্রকৃতি-সুলভ ধ্যানকল্পনার প্রভাব যে আছে, এবং থাকিবেই একথা বলা বাহুল্য। কিন্তু বাঙ্গালীর যে বৈশিষ্ট্যের কথা আমি পুনঃ পুনঃ নির্দ্দেশ করিতে চাই তাহাই বাঙ্গালীর বাঙ্গালীত্বের নিদান এবং তাহারই ফলে, এত অল্প সময়ের মধ্যে বাঙ্গালী একটা বিদেশী সাধনার সারবস্তু আত্মসাৎ করিয়া তাহার সাহিত্যে নবজন্মের পরিচয় দিয়াছে। আর কোনও ভারতীয় জাতি এমন করিয়া যুগযুগান্তরের অভ্যস্ত সংস্কার ভেদ করিয়া এত শীঘ্র এইরূপ একটি আধুনিক আদর্শকে বরণ করিয়া লইতে পারে নাই। মাইকেলের মহাকাব্যে যে বেদনা সঙ্গীতরূপে প্রকাশ পাইল, তাহা যেন—“ Music yearning like a good in pain”; তাহাতে নবজন্মের সেই প্রাণপণ প্রয়াস বা আত্ম-স্ফূর্ত্তির আবেগ রহিয়াছে। অমিত্রাক্ষর ছন্দের ধ্বনি-বিন্যাসের মধ্যেই প্রাণের যে লীলা, মুক্তিগতির যে আনন্দ, কাব্যবস্তুর নিঃসঙ্কোচ সঙ্কলনে কল্পনার যে চিন্তালেশহীন স্বাধীন বিচরণ লক্ষ্য করা যায়, তাহাতেই এই নবসাহিত্যের প্রাণ প্রতিষ্ঠা হইয়াছিল। এই আত্ম-স্ফূর্ত্তির কারণ—নিজ দেহ-সংস্কারের দ্বারাই বহির্জগতের সহিত আত্মীয়তা উপলব্ধি করিয়া মানুষ যে সহজ রস আস্বাদন করিতে চায়, বাঙ্গালীর প্রকৃতিতে সেই অ-ভারতীয় প্রবৃত্তি সুপ্ত আছে; ভারতীয় প্রভাবের বশে যে কল্পনা অন্তর্মুখ, সে কল্পনারই তলে তলে জীবন ও জগতের প্রতি তাহার এই মমতা অন্তঃশীলা হইয়া বহিতেছে। তাই বেদান্ত ও সন্ন্যাস বাঙ্গালীর যথার্থ ধর্ম হইতে পারে নাই। দেশের জলবায়ু, কর্ম্ম অপেক্ষা স্বপ্নের অনুকূল; ইহার উপর আর্য্যসাধনার অধ্যাত্মবাদ চিত্তকে অন্তর্মুখী করিয়া তোলে; তথাপি বাঙ্গালীর মজ্জাগত প্রাণধৰ্ম্মকে এই মনোধর্ম্ম একেবারে নির্মূল করিতে পারে নাই; এজন্য জীবন ও জগৎ সম্বন্ধে তাহার যে স্বাস্থ্যকর আসক্তি তাহা ভোগ হইতে উপভোগে পর্যবসিত হয়। কিন্তু পাশ্চাত্য সাহিত্যের শ্বেতভূজা বীণাপাণি বাঙ্গালীর চিত্ত-শতদলে যখন আসন পাতিলেন, তখন সহসা তার কল্পনায় এক মহোৎসব পড়িয়া গেল। সে সাহিত্যে জগৎ ও জীবন, প্রকৃতি ও মানব-হৃদয়, প্রত্যক্ষ পরিচয়ক্ষেত্রে পরস্পরকে যে মহিমায় মন্ডিত করিয়াছে—মানুষের দেহই যে অপূৰ্ব্ব ভঙ্গিমায় সূৰ্য্যালোকিত আকাশতলে ছায়া বিস্তার করিয়াছে, তাহাই বাঙ্গালীকে মুগ্ধ করিল, বহিঃপ্রকৃতির সংস্পর্শে আত্মপরিচয় সাধন করিতে সেও অধীর হইয়া উঠিল। মাইকেলের কাব্যপ্রেরণায় সর্ব্বাপেক্ষা প্রবল হইয়াছে বহির্বস্তুর বাহিরের রূপ। কেবলমাত্র বিচিত্র বস্তু সংগ্রহ করিয়া সেগুলিকে দূরে ধরিয়া অথবা নিকটে সাজাইয়া দর্শন ও স্পর্শনের আনন্দে তিনি বিভোর; ক্ষুদ্র ও বৃহৎ চিত্র—চিত্রণ এবং তক্ষণ-শিল্পীর মত মূর্তি-সুষমার সন্ধানে তাঁহার কল্পনার কি উল্লাস! উপমার পর উপমায় তিনি যে রূপ ফুটাইয়া তোলেন, তাহা ভাব বা চিন্তার চমক নহে—বাহিরের বস্তুবিন্যাসের সৌন্দর্য; বিষাদ-প্রতিমা বন্দিনী সীতার ললাটে সিন্দুরবিন্দু ‘গোধুলি ললাটে আহা তারারত্ন যথা’। তিনি বস্তুকে ভাবের দ্বারা, বা ভাবকে বস্তুর দ্বারা উজ্জ্বল করিয়া তোলেন না; একই বস্তুর সৌন্দর্য্য ফুটাইবার জন্য বহু বস্তুর উপমা সন্নিবেশ করেন, চিত্রকে চিত্রের দ্বারাই সুন্দর করিয়া তোলেন। আলো ও ছায়া এই দুইটি মাত্র বর্ণে মর্ম্মর-মূর্তি, যেমন প্রকাশ পায়, তাঁহার সৃষ্ট মানব-মানবীও তেমনি অতিশয় সরল ও সার্ব্বজনীন সুখ-দুঃখের ছায়ালোকসম্পাতে আমাদের হৃদয়-গোচর হয়। এই জন্য আকারে ও ভঙ্গিমায় মহাকবি মিল্টনকে অনুসরণ করিলেও মধুসূদন মানুষের সংসার বিস্মৃত হইয়া মহাকাব্যের অত্যুচ্ছ কাব্যলোকে, সীমাহীন দিগ্দেশে, তাঁহার কল্পনাকে প্রেরণ করিতে পারেন নাই। কিন্তু মানুষকে তিনি বড় করিয়া দেখিয়াছিলেন; পুরুষের পৌরুষ ও নারীর নারীত্ব তাঁহার হৃদয়ে যে মহিমাবোধ জাগ্রত করিয়াছিল তাহারই আবেগ মহাকাব্যের রূপ—ভঙ্গিমায় ব্যক্ত হইয়াছে! মাইকেলের কাব্য পড়িয়া মনে হয়, গীতি-প্রাণ বাঙ্গালী কবি যেন এক নূতন জগৎ আবিষ্কার করিয়াছেন; সেখানে হৃদয় সমুদ্রের বেলাবালুকায় ভঙ্গ-তরঙ্গের অলস ফেন-রেখা বুদ্বুদ মালায় মিলাইয়া যায়, কিন্তু সেই সঙ্গে দূরাগত জলোচ্ছ্বাস ও ভগ্নপোত-যাত্রীর আর্তনাদ নিভৃত নিকুঞ্জের বংশীরবকেই এক অপূর্বর বেদনায় প্রতিধ্বনিত করিয়া তোলে। কবিকল্পনার এই নূতন অভিযান নব্য সাহিত্যের গতি নির্দ্দেশ করিয়াছিল—মনের সূক্ষ্ম লীলা-বিলাস অগ্রাহ্য করিয়া মানুষকে দেহের রাজ্যে দাঁড় করাইয়া, তাহার স্বাভাবিক আকার, আয়তন ও রূপ-ভঙ্গিমা দুই চক্ষু ভরিয়া দেখিয়া লইবার আকাঙ্ক্ষা জাগিয়াছিল পাপ-পুণ্য নির্বিশেষে তাহার প্রাণের স্ফূর্ত্তি নিয়তির অমোঘ নিয়মে কেমন ভীষণ—মধুর হইয়া উঠে—বাঙ্গালী কবির চিত্তে তাহারই প্রেরণা জাগিয়াছিল।
কিন্তু মধুসূদনের যে আবেগ একটা ‘great technique’ ও ‘prodigious art’-এর প্রেরণায় মানুষের জীবনকে কেবল মাত্র একটা বিশালতর পট-ভূমিকার উপরে সন্নিবেশিত করিয়া তাহার প্রাণের স্ফুর্ত্তি ও দেহের মুক্তগতি অঙ্কিত করিয়াই চরিতার্থ হইয়াছিল, মনুষ্যজীবনের রহস্য-চিন্তার সেই আবেগ পরিপূর্ণ আকারে প্রকাশ পাইল বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস-কাব্যে। গীতিকাব্যের নিছক ভাবুকতায় এবং স্বল্প পরিসরে যে প্রেরণা স্ফূর্ত্তি পাইতে পারে না—ভাব জগৎ হইতে বাহিরে আনিয়া মূর্তি-জগতের চাক্ষুষ আলো-অন্ধকারে হৃদয়-মণির দেহ-বিচ্ছুরিত রশ্মিচ্ছটা প্রতিফলিত করিবার জন্য যে নূতন আকারে কাব্যসৃষ্টির প্রয়োজন—মহাকাব্য বা কাহিনী-কাব্যে তাহার experiment শেষ হইবার পূর্ব্বেই, সেই প্রয়োজন সাধন করিবার জন্য, আধুনিক বাংলা সাহিত্যে অবতারকল্প প্রতিভার অভ্যুদয় হইল। বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসের বাংলা গদ্যচ্ছন্দ সহসা যে বাণী-রূপ ধারণ করিল, তাহাতে দেহেরই রূপ-রাগ প্রাণের মূর্ছনায় স্পন্দিত হইয়া উঠিল। বঙ্কিমচন্দ্রের পূর্ব্বে বা পরে আর কোনও বাঙ্গালী কবি এমন করিয়া ‘দেহের রহস্যে বাঁধা অদ্ভুত জীবনের’ গাথা গান করেন নাই; প্রকৃতির প্ররোচনায় মানুষের আত্মা এমন করিয়া দেহের দুয়ারে লুটাপুটি খায় নাই; মনুষ্য-হৃদয়ের চিরন্তন আকুতি কবি-কল্পনায় মন্ডিত হইয়া দেহ-ধর্ম্মের তাড়নায় এমন সুদুর্লভ দুর্ভাগ্য-মহিমা লাভ করে নাই। য়ুরোপের কাব্যলক্ষ্মী তথাকার সাহিত্যে মানুষের যে পরিচয়টিকে যুগযুগান্তর ধরিয়া দেহ—চেতনার মধ্য দিয়াই অনির্ব্বচনীয় করিয়া তুলিয়াছেন—সে সাহিত্যের সেই গভীরতম প্রেরণা এমন করিয়া আর কোনও বাঙ্গালী কবিকে আবিষ্ট করে নাই। বঙ্কিমচন্দ্রের কাব্যে কামনার সেই সোমযাগ যে বেদীর উপরে অনুষ্ঠিত হইয়াছে তাহা মনুষ্য—জীবনের রোমান্স; যে উপকরণ-সমষ্টির দ্বারা তিনি এই বেদী নির্ম্মাণ করিয়াছেন, বাঙ্গালীর জীবনেতিহাসে তাহা নিত্য-প্রত্যক্ষ নয় বলিয়া যাঁহারা এই কাব্য অতিমাত্রায় কাল্পনিক বলিয়া মনে করেন, তাঁহাদের চক্ষে মানুষের জীবনই অতিশয় ক্ষুদ্র; বঙ্কিমের কল্পনায় মানব-ভাগ্য ও মানব-চরিত্রের যে রহস্য সন্ধান আছে তাহা যদি কাহারও পক্ষে বাস্তবাতিরিক্ত হয়, তবে তাঁহার মতে হিমালয় অপেক্ষা উই-ঢিবি সত্য, এবং পদ্ম অপেক্ষা ঝিঙাফুল অধিকতর বাস্তব।
কিন্তু বর্তমান প্রসঙ্গে সে বিচার নিষ্প্রয়োজন। আধুনিক সাহিত্যে বাঙ্গালীর নবজন্মের কথা বলিতেছিলাম। মানুষের দেহমন্দিরে যে দেবতা রহিয়াছেন তাঁহার প্রতি যে গোপন শ্রদ্ধা বাঙ্গালীর অস্থিমজ্জাগত, জগৎ ও মানব-জীবন সম্বন্ধে তাহার সেই ঔৎসুক্য এই নব-সাহিত্যের জন্ম হেতু। যে কামনার নাম সৃষ্টি-কল্পনা, রূপ—রস-গন্ধ-শব্দ-স্পর্শের যে মোহিনী মানুষের প্রাণে ‘প্রেম’ নামক মহাপিপাসার উদ্রেক করে, যাহার বশে মানুষ আপনাকে স্বতন্ত্র না ভাবিয়া, এই জগৎ-রহস্যের সঙ্গে আপনাকে একটি অপূর্ব্ব রস-চেতনায় যুক্ত করিয়া নিজেরই স্বরূপ উপলব্ধি করিয়া কৃতার্থ হয়—বাঙ্গালী চরিত্রের সেই সুপ্ত প্রবৃত্তি যুরোপীয় সাহিত্য হইতে প্রেরণা পাইয়া জাগিয়া উঠিয়াছিল। আধ্যাত্মিকতার প্রাণহীন জড়-সংস্কার হইতে মুক্ত হইয়া, জীবন ও জগৎ সম্বন্ধে একটা তুচ্ছ ধারণা বা ঔদাসীন্য ত্যাগ করিয়া, বহিঃ-প্রকৃতির সহিত আত্মীয়তা স্থাপনের যে আকাঙ্ক্ষা, তাহারই নিদর্শন—বিষবৃক্ষ ও মেঘনাদবধ। মেঘনাদবধের কবি নাটক রচনা করিতে চাহিয়াছিলেন; কিন্তু নাটকীয় চরিত্র-সৃষ্টিতে কবির যে আত্মবিলোপ সর্ববস্তুর মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট হইবার যে কল্পনা-শক্তি—যাহার বলে করিব আত্মচেতনার (সে যত গভীর হউক) সঙ্কীর্ণ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া প্ৰকৃত মুক্তির অধিকারী হল—মধুসূদনের সে শক্তি ছিল না; তাই তাঁহার কাব্যে যখন মেঘনাদের জিহ্বাগ্রে সরস্বতী বিরাজ করেন, তখন লক্ষ্মণ কথা খুঁজিয়া পায় না। কবি-হৃদয়ের লিরিক্-পক্ষপাত স্পষ্ট হইয়া উঠে। তথাপি মধুসূদন সাহিত্যের এই মন্ত্রে সিদ্ধিলাভ না করিলেও, মানুষের প্রতি মানুষ হিসাবেই তাঁহার যে শ্রদ্ধা, মানুষের বাসনা-কামনা, পাপ-পুণ্য, পৌরুষ ও দুর্ববলতার প্রতি তাঁহার যে শাস্ত্র—সংস্কার-মুক্ত সহজ সহানুভূতি, তাহাই এ যুগের কবিকল্পনাকে মুক্তিলাভের দুঃসাহসে দীক্ষিত করিয়াছে। অপরাপর প্রতিভাহীন কবি এই মন্ত্রে দীক্ষিত হইয়া, মহাকাব্য বা কাহিনী-কাব্য রচনার আগ্রহ থাকিলেও, ইতোনষ্টস্ততোভ্রষ্ট হইয়া গীতিকাব্য বা কাহিনী কোনটাই আয়ত্ত করিতে পারেন নাই। তার কারণ, এ কাব্যের উৎকৃষ্ট আর্ট বা technique তখনও বাংলা কাব্যে সুপ্রতিষ্ঠিত হয় নাই, প্রাচীন গীতি—কাব্যের কল্পনা ও রচনাভঙ্গীই তখনও ভাষাকে আচ্ছন্ন করিয়া আছে। বঙ্কিমের প্রতিভা এ সমস্যার সমাধান করিল—এ কাব্যের ছন্দ হইল গদ্য, ইহার আকার হইল উপন্যাস। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্রের সঙ্গে সঙ্গেই এ কল্পনার পূর্ণবিকাশ ও অবসান ঘটিয়াছে—বঙ্কিমের সেই নাটকীয় প্রতিভা ও সৃষ্টিশক্তি, কল্পনার সেই ঐশ্চর্য্য আর কাহারও মধ্যে প্রকাশ পায় নাই।
তথাপি উপন্যাস ও গল্পসাহিত্যে এই ধারা কতকটা ভিন্নমুখী হইলেও আজও একেবারে লুপ্ত হয় নাই; বাস্তব-প্রীতি বা মানুষের দেহ-জীবনের রহস্য-বোধ উৎকৃষ্ট কল্পনাশক্তির অভাবে অতিশয় সঙ্কীর্ণ ক্ষেত্রে প্রবাহিত হইলেও তাহা আজ বাংলা গদ্যে বাস্তবেরই বিচিত্র ভঙ্গী বিশ্লেষণ করিতেছে। কিন্তু বাংলাকাব্যে এই বহির্মুখী কল্পনা আর আমল পাইল না। পঞ্চেন্দ্রিয়ের পঞ্চপ্রদীপ জ্বালাইয়া তাহারই আলোকে মূর্তিপূজার যে আনন্দ, বাহিরের বিপুল জনস্রোতের কলকোলাহলে মিশিয়া মিলিত কণ্ঠস্বরে যে অপূর্বর উন্মাদনা—বাংলাকাব্যে তাহার প্রতিষ্ঠা হইল না। মানুষ হইয়া মানুষের ভিড়ে আসিয়া দাঁড়াইবার সেই উৎসাহ যেমন বাঙ্গালীর পক্ষেই সম্ভব, তেমনি বৃন্দাবন-স্বপ্নও বাঙ্গালীরই; এই দুই প্রবৃত্তির বিরুদ্ধ ধারায় বাঙ্গালী আত্মহারা। তাই নব-সাহিত্যের যে প্রেরণার কথা আমরা এতক্ষণ আলোচনা করিয়াছি, যে প্রেরণার বশে বাংলা সাহিত্যে বাঙ্গালীর নব-জন্ম হইয়াছিল বলিয়া মনে করি, এবং যাহার সম্যক স্ফূর্ত্তি ঘটিলে সাহিত্যে ও তথা জীবনে আমরা একটা নূতন অধ্যায় আরম্ভ করিতে পারিতাম, সেই প্রেরণা সহসা আর এক পথে প্রবাহিত হইল। বাঙ্গালীর কাব্য-কল্পনা প্রাণের অন্তস্তল হইতে সরস্বতীর ধ্যানমূর্তি আবিষ্কার করিল তাহাতে বাস্তবজীবন ও বর্হিজগৎকে আত্মসাৎ করিবার এক অভিনব ভাবসাধনার পদ্ধতি প্রবর্ত্তিত হইল—বাহিরের সহিত ঘনিষ্ঠ পরিচয়ের প্রয়োজন আর রহিল না; কাব্য জীবন হইতে পৃথক হইয়া পড়িল। আমি কবি বিহারীলাল ও তাঁহার “সারদামঙ্গলে”র কথা বলিতেছি।
বিহারীলালের গীতিকল্পনায় আত্মভাবসাধনার যে ভঙ্গীটি ফুটিয়া উঠিয়াছে, তাহা এতই নূতন যে,• আমাদের দেশীয় গীতিকাব্যের ইতিহাসে কবিমানসের এতখানি স্বাতন্ত্র্য—কাব্যসাধনাকেই আধ্যাত্মিক সংশয়-মুক্তিকর উপায়রূপে বরণ করার এই আদর্শ—ইতিপূর্বের আর লক্ষিত হয় না। বৈষ্ণব কবির কাব্যসাধনায় একটা ভাব—গভীর আধ্যাত্মিক প্রেরণায় পরিচয় আছে—শুধু রসসৃষ্টিই নয়, প্রাণের গভীরতর পিপাসার নিবৃত্তির সাধনা আছে। তথাপি বৈষ্ণব কবির কল্পনায় এরূপ ব্যক্তি—স্বাতন্ত্র্য নাই, সে কল্পনা একটা বিশিষ্ট ভাব-সাধনার পদ্ধতিকে, একটা সঙ্কীর্ণ সাধন—তন্ত্রকে আশ্রয় করিয়াছে—সে সাধনার মন্ত্র কবির নিজ কবিদৃষ্টির ফল নহে। বিহারীলালের ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্য সম্পূর্ণ আধুনিক। সমগ্র জগৎ ও জীবনকে সম্পূর্ণ স্বাধীন স্বকীয় কল্পনার অধীন করিয়া, আত্ম-প্রত্যয়ের আনন্দে আশ্বস্ত হওয়ার যে গীতি—প্রেরণা, তাহারই নাম কবির ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্য। বিহারীলালের কল্পনায় এই ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্য ও আত্ম-প্রত্যয়ের আনন্দ, বাংলা কাব্যে সর্বপ্রথম ফুটিয়া উঠিয়াছে। ইহা এতই অপ্রত্যাশিত যে, সহসা ইহার উৎপত্তি নির্ণয় করা যায় না। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইংরেজী গীতিকাব্যে কবির এই ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য প্রকট হইয়াছিল; এবং Wordsworh ও Shelley-র কল্পনা হইতে বিহারীলালের কল্পনা যতই ভিন্ন হউক, উহা যে মূলে সমগোত্র সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। অতএব বিহারীলালের কাব্য সাধনায় ইংরাজী কাব্যের প্রভাব অনুমান করা অসঙ্গত নয়। তথাপি এ সম্বন্ধে বিবেচনা করিবার আছে। প্রথমতঃ ইংরেজী সাহিত্যে বা ভাষায় বিহারীলাল ততদূর ব্যুৎপন্ন ছিলেন বলিয়া মনে হয় না, যাহাতে ইংরাজ রোমান্টিক কবিগণের সঙ্গে তাঁহার খুব গভীর পরিচয় সম্ভব। তিনি বায়রণের কাব্য পড়িয়াছিলেন, তাঁহার নিজের কবিতায় বায়রণের ভাবানুবাদ আছে; এরূপ ইংরেজী জ্ঞান বা ভাবগ্রাহিতা খুব বিস্ময়কর নহে। কিন্তু শেলী অথবা ওয়ার্ডসওয়ার্থের ভাব-কল্পনা অনুবাদ বা অনুকরণের বস্তু নয়; সেখানে কাব্যের আত্মাকে যেন আত্মসাৎ করিতে হয়, সে কাব্যে এবং সে ভাষায় বিহারীলালের ততখানি প্রবেশ ছিল কিনা সন্দেহ। দ্বিতীয়তঃ, শেলী, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, বিহারীলাল প্রভৃতির গীতি-কবিতার বিশেষত্বই এই যে, শুধু তাহার ভাববস্তুই মৌলিক নয়, ভাবনার ভঙ্গীও মৌলিক; তাহা না হইলে তাঁহাদের ব্যক্তি—স্বাতন্ত্র্য এমন ফুটিয়া উঠিত না। এ স্বাতন্ত্র্য যেন জন্মগত, কোনও বহির্গত প্রভাবের ফল নয়। তাই বিহারীলালের কোনও কোনও শ্লোকে শেলীর কবিতাবিশেষের ছায়া লক্ষ্য করিলেও এরূপ ভাব-সাদৃশ্য অনুকরণাত্মক হইতে পারে না। অতএব এইরূপ প্রভাবকেই বিহারীলালের কাব্য-প্রেরণার কারণ বলিয়া মনে করিলে ভুল হইবে। তথাপি, বিহারীলাল এই সকল কবিদের সঙ্গে যে একেবারে অপরিচিত ছিলেন এমন না হইতে পারে; হয়তো ইংরেজী কাব্যে কবি-মানসের এই নূতন অভিব্যক্তির কথা তিনি তদানীন্তন পণ্ডিত-সমাজে আলোচনা-প্রসঙ্গে জানিতে পারিয়াছিলেন, এবং তাহাতে নিজের সাধনা সম্বন্ধে আশ্বাস ও উৎসাহ বোধ করিয়াছিলেন,—আচাৰ্য্য কৃষ্ণকমলের মত বন্ধুর সংসর্গ যাঁহার জীবনে ঘটিয়াছিল, তাঁহার সম্বন্ধে এরূপ অনুমান মিথ্যা না হইতেও পারে।
তবে কি বাংলাকাব্যে বিহারীলালের অভ্যুদয় নিতান্তই আকস্মিক? তিনি কি সে যুগের কেহ নন?-সাহিত্যের ইতিহাসে এরূপ ঘটনা কুত্রাপি ঘটে না, আমাদের সাহিত্যেও ঘটে নাই; বিহারীলাল এই যুগের কবি, এবং প্রতিভাহিসাবে তিনি যেমন বঙ্কিম ও মধুসূদনের সমকক্ষ, তেমনি, তাঁহার কাব্যপ্রেরণা সম্পূর্ণ বিপরীত হইলেও একই অবস্থার ফল। সে যুগের সাহিত্যে জগৎ ও জীবন সম্বন্ধে বাঙ্গালীর প্রতিভা যে নূতন সমস্যার সম্মুখীন হইয়াছিল, মধুসূদন, বঙ্কিম প্রভৃতি তাহাকে বাহিরের দিক হইতে বরণ করিয়া কল্পনাকে বহির্মুখী করিয়া যুরোপীয় আদর্শে রসসৃষ্টি করিতে চাহিয়াছিলেন—অন্তরকে বাহিরের নিয়মাধীন করিয়া সর্ববদ্বন্দ্ব ও সংশয়কে কাব্যরসে পরিণত করিতে চাহিয়াছিলেন। বিহারীলাল এই দ্বন্দ্ব স্বীকার করেন নাই—এইখানেই তাঁহার ভারতীয় সংস্কার জয়ী হইয়াছে; কিন্তু তিনিও এ যুগের প্রভাব অস্বীকার করিতে পারেন নাই। অর্থাৎ বহির্জগৎ সম্বন্ধে যে সচেতনতা এ যুগে অবশ্যম্ভাবী হইয়াছিল, পূৰ্ব্বতন কোনও যুগে যদি তাহা ঘটিত, তবে ভারতীয় কবি কাব্য—সাধনার যে পন্থা অবলম্বন করিতেন ও যে-মন্ত্রে সিদ্ধিলাভ করিতেন, বিহারীলাল তাহাই করিয়াছিলেন। তিনি বহির্জগৎকে কতকটা আড়ালে রাখিয়া প্রাণের মধ্যে একটা আদর্শ ভাবজগৎ সৃষ্টি করিয়া সকল সংশয়ের সমাধান করিয়া লইয়াছিলেন। প্রীতি ও সৌন্দর্য্য-লুব্ধ কবি-প্রাণ ধ্যানযোগে বিশ্বসৃষ্টির মধ্যে এমন একটা সত্তার সন্ধান পাইয়াছিলেন, যাহার ভাবনায় জীব-ধর্ম্মের গভীরতম প্রবৃত্তিও বাস্তব জগতের কঠোর কর্কশতার উপরে একটি কোমল প্রলেপ বুলাইয়া শান্ত আনন্দ-রসে পরিতৃপ্তি হইতে পারে। এ সাধনা ভারতীয় প্রকৃতির অনুবন্ধী—সকল রসের উপরে শান্ত—রসের প্রতিষ্ঠাই ভারতীয় কবির কবি-ধর্ম্ম। মানুষের বাস্তব জীবনের প্রত্যক্ষ কঠোর নিয়তি, বাসনা-কামনার স্বর্গ-নরকব্যাপী আলোড়ন, সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কীর্তি ট্র্যাজেডির অনুভাবনা, ভারতীয় কবির কল্পনাকে বিপথগামী করিতে পারে নাই কিন্তু বিহারীলালের কাব্যসাধনায় এই মন্ত্রের প্রভাব থাকিলেও তাহা স্বতন্ত্র, তাঁহার কবিপ্রকৃতি অন্যদিকে সম্পূর্ণ আধুনিক। আলঙ্কারিক পন্ডিতগণ কাব্যরসকে ব্রহ্ম স্বাদ-সহোদর বলিয়া ঘোষণা করিলেও—কাব্যকে চতুৰ্ব্বর্গফলপ্রদ বলিয়া স্বীকার করিলেও-কবির কাব্যসাধনাকে আধ্যাত্মিক সাধনা বলিয়া মনে করিতেন না। কারণ এই রসসৃষ্টিতে কাব্যের যে কলা-কৌশল নির্ধারিত হইয়াছিল, সেই কলা-কৌশলের নিপুণ প্রয়োগই কবিপ্রতিভার মুখ্য কীৰ্ত্তি—রস যেন তাহার গৌণ পরিণাম; কবি যেন একটি আদর্শ স্থির রাখিয়া কাব্যের উপকরণগুলি প্রয়োজন মত ব্যবহার করিতেন; একটা বাঁধা নিয়মের অনুবর্ত্তী হইয়া নিজ মানস বা প্রাণের প্রেরণাকে দমন করিয়া রাখিতেন। এজন্য কাব্যসাধনায় কবি মানসের কোন স্বাধীন বিকাশের সম্ভাবনা ছিল না। আধুনিক কালে আমরা কাব্যের মধ্যে কবি-মানসের যে আধ্যাত্মিক পরিচয় পাই—মানুষের স্বাভাবিক বোধশক্তি জগতের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কের ফলে যে পূর্ণ-চেতনা লাভ করে—কবি কী যাহাকে ‘soul-making’ বলিয়াছেন, এই সকল কাব্যে তাহার নিদর্শন নাই। কাব্য বাস্তব জগতের রূপরসোদ্ধৃত হইলেও তাহার লক্ষ্য যখন সেই ‘রস’-যাহা ব্রহ্মাস্বাদের মত, তখন বস্তুজগতের সঙ্গে কাব্যের ঘনিষ্ঠ যোগ থাকিবার প্রয়োজন কি? -কলা-কৌশলে সেই অবস্থা ঘটাইতে পারিলেই যথেষ্ট। অতএব বাহিরের সঙ্গে অন্তরের কোনও বোঝাপড়া অনাবশ্যক —সে সমস্যা জ্ঞান-যোগী দার্শনিকের অধিকারভুক্ত। এজন্য কবির পক্ষে একটা স্বাধীন ভাবসাধনার প্রয়োজন কখনও অনুভূত হয় নাই। আধুনিক বাঙ্গালী কবি বিহারীলাল এই বহিঃসৃষ্টির প্রভাবকে অন্তরে অনুভব করিয়াছেন, এবং তাহাকে নিজস্ব ভাবসাধনার মন্ত্রে জয় করিয়া লইয়াছেন। এই ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যের মূলে যে subjectivity আছে তাহা ভারতীয় সাধন-রীতির অনুকূল; কিন্তু তাহা যে কবিধর্ম্মকে আশ্রয় করিয়াছে তাহা সম্পূর্ণ নূতন; কারণ, এই ভাবসাধনার মূলে আছে মর্ত্যমাধুরীলুব্ধ কবিপ্রাণ, তাহা ভারতীয় অধ্যাত্মবাদের বিরোধী। কবিকল্পনার উপরে বহিঃপ্রকৃতির এই প্রভাব–যেমন ভাবেই হোক, মর্ত্যজীবনের মাধুরী পান করিবার এই আকাঙ্ক্ষা—যে ধরণের আধ্যাত্মিকতায় মন্ডিত হইয়াছে তাহাই বাংলা গীতিকাব্যে আধুনিকতার লক্ষণ। ইংরাজ রোমান্টিক কবিগণের মতই—প্রকৃতি ও মানব-হৃদয়কে একত্রে গাঁথিয়া একটা বৃহত্তর আদর্শের অনুপ্রাণনা, মানুষের মনোবৃত্তি ও দেহ-বৃত্তিকে একই তত্ত্বের অধীন করিয়া সত্যকে সুন্দর ও সুন্দরকে সত্য বলিয়া উপলব্ধি করিবার এই চেষ্টা,—মানুষের প্রাণে যে প্রেম ও সৌন্দর্য্যের পিপাসা রহিয়াছে, বহিঃপ্রকৃতির মধ্যে তাহার উৎসরূপিণী এক চিন্ময়ী সত্তার কল্পনা—বাঙ্গালী কবিকেও এত শীঘ্র অভিভূত করিয়াছে, ইহাই বিস্ময়কর। কিন্তু তদপেক্ষা বিস্ময়কর তাঁহার কল্পনার মৌলিকতা। তাঁহার ‘সারদা’, Wordsworth—এর প্রকৃতিসর্ববস্ব বিশ্বচেতনাও নয়, Shelley-র রূপাতীত রূপময়ী, প্রেম-সৌন্দর্য্যের অপরা আদর্শ-লক্ষ্মী, বিশ্বাতীত বিশ্বাত্মাও নয়, তাঁহার ‘সারদা’ মানুষের স্বাভাবিক প্রীতি প্রেমের প্রবাহরূপিণী, বিশ্বব্যাপ্ত সৌন্দর্য্য ও মানবীয় প্রেমের সমন্বয়রূপিণী, বহিরন্তর-বিহারিণী, বিশ্ববিকাশিনী “দেবী যোগেশ্বরী”; তিনি প্রত্যক্ষে বিরাজমান, সবভূতে অধিষ্ঠান, অর্থাৎ “তুমিই বিশ্বের আলো (শুধু নয়), তুমি বিশ্বরূপিণী”—
তুমি বিশ্বময়ী কান্তি, দীপ্তি অনুপমা,
কবির যোগীর ধ্যান
ভোলা প্রেমিকের প্রাণ—
মানব-মনের তুমি উদার সুষমা।
—’যোগীর ধ্যান’ ও ‘প্রেমিকের প্রাণ’,—তাঁহার ‘সারদা’য় এই দুয়ের কোনও বিরোধ নাই, কারণ প্রেম ও সৌন্দর্য্য-পিপাসা তাঁহার নিকট অভিন্ন।
বাস্তব-প্রীতি বা প্রত্যক্ষের প্রতি প্রাণের আকর্ষণ যাহার নাই, তাহার সৌন্দর্য্য—পিপাসাও নাই। সৌন্দর্য্য রূপাতীত বা বাস্তবাতীত নয়, এজন্য প্রেয়সী ও রূপসীর মধ্যে ভাবগত অসামঞ্জস্য নাই। যোগীর ধ্যানে যে সৌন্দর্য্যের প্রেরণা রহিয়াছে, প্রকৃত প্রেমের প্রেরণাও তাই। বিহারীলাল বিশ্বপ্রকৃতি ও মানব-হৃদয়ের যোগসূত্ররূপিণী এই ‘যোগেশ্বরী’ সারদার কল্পনা করিয়াছেন; ইহাতে কাব্যের সহিত জীবনের একটা নিগূঢ় সম্পর্কের কথা—সকল উৎকৃষ্ট কাব্য-প্রেরণার মর্ম্মকথা প্রকাশিত হইয়াছে। কবি কীসের সেই “Principle of Beauty in all things” বিহারীলালও কতকটা উপলব্ধি করিয়াছিলেন। মনে হয়, কবি-প্রেরণার পরম তত্ত্বটিকে তিনি যেমন করিয়া প্রাণের মধ্যে পাইয়াছেন, তেমন করিয়া Wordsworth বা Shelley ও পান নাই। কবি কীট্স যাহার সজ্ঞান চেতনায় অভিভূত হইয়াছিলেন, Shakespeare অজ্ঞানে তাহারই বশবর্তী হইয়া কাব্যসৃষ্টির আনন্দে কবিজীবনের পরম সিদ্ধি লাভ করিয়াছিলেন। বিহারীলালের ভারতীয় প্রকৃতি ধ্যানরসে পরিতৃপ্ত হইয়া নিজ অন্তরের উপলব্ধিকেই কবিপ্রাণের নিশ্চিন্ত মুক্তি মনে করিয়া কেবল মন্ত্র জপ করিয়াই ক্ষান্ত হইয়াছে।
.
বিহারীলালের কবিদৃষ্টি কাব্যসৃষ্টিতে সার্থক হয় নাই; তাঁহার কাব্য একরূপ তত্ত্বরসের (mysticism) আধার হইয়া আছে,–সে রসকে তিনি রূপ দিতে পারেন নাই, তিনি নিজে যাহা দেখিয়াছেন অপরকে তাহা দেখাইতে পারেন নাই। এ সম্বন্ধে একটু ভাবিয়া দেখিলে একটা কথা মনে হয়। বিহারীলালের এই মন্ত্র-দৃষ্টি যদি কাব্য সৃষ্টি করে, তবে সে কাব্য গীতিকাব্য হইতে পারে না; নাটকীয় রূপ-সৃষ্টি ভিন্ন আর কোনও উপায়ে ইহার পূর্ণ-প্রকাশ অসম্ভব। যে কল্পনা সর্ব্ববস্তুকে সুন্দর দেখে, যে সৌন্দর্য্যবোধের মূল বাস্তবপ্রীতি, সে কল্পনার পরিণাম বিশ্বাত্মীয়তা। অতএব তাহা যদি কাব্য-সৃষ্টির প্রেরণা” হয় তবে তাহা কোমল কঠোর সুন্দর—কুৎসিত, পাপ-পুণ্য, সুখ-দুঃখ—এক কথায় জগৎসৃষ্টির যত কিছু বৈচিত্র্যকে একটি সমান নির্দ্বন্দ্ব রস-চেতনার বলে কাব্যরূপে প্রতিফলিত করিয়াই চরিতার্থ হইতে পারে, লিরিকের আত্মভাবসর্ব্বস্বতা তাহার পক্ষে অসঙ্গত। এই জন্যই বিহারীলালের গীতি-কবিতাও সুস্পষ্ট আকার গ্রহণ করিতে পারে নাই। তাঁহার রচনায় যথার্থ কাব্যসৃষ্টির পরিবর্তে কাব্যরস-রসিকের একরূপ ভাবাবস্থার পরিচয় আছে। Keats এই ভাবকে রূপ দিবার—বহিরন্তরবিহারী এই সত্যসুন্দরকে কাব্যের সাহায্যে দৃষ্টিগোচর করাইবার জন্য আকুল হইয়াছিলেন; অসমাপ্ত কবিজীবনে তিনি কেবল ইন্দ্রিয়গোচরকে বাক্যগোচর করিতে পারিয়াছিলেন, নিজ প্রাণের আকুতিকেও অপরের হৃদয়গোচর করিতে পারিয়াছিলেন; তাই তাঁহার অসম্পূর্ণ কবিকল্পনাও কাব্যসৃষ্টি করিয়াছে। কিন্তু তিনিও বুঝিয়াছিলেন ব্যক্তি-নিরপেক্ষ (objective) রূপ—সৃষ্টি ব্যতিরেকে এ কল্পনা সার্থক হইতে পারে না। বিহারীলালের এ ভাবনা ছিল না, এ প্রেরণাই ছিল না; কেবল উৎকৃষ্ট ভাব-রসে নিমগ্ন হইয়া তিনি নিজ প্রাণের আনন্দ জ্ঞাপন করিয়াছেন—কাব্য প্রেরণার যে রহস্য সেই রহস্যেরই প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন; তাই তিনি প্রকৃত কবি না হইয়া mystic হইয়াই রহিলেন। একজন প্রসিদ্ধ কবি-সমালোচক যথার্থই বলিয়াছেন—
“The pure poet is not a mystic: contemplation of the mystery is no end in itself for him. He is a doer, a maker, a revealer, a creator.”
তথাপি বিহারীলালের কাব্যসাধনায় ভারতীয় প্রভাব বিশেষ ভাবে থাকিলেও, তাহার একটা লক্ষণ বিস্মৃত হইলে চলিবে না—বিহারীলালের কবি-প্রকৃতিতে উৎকৃষ্ট সৌন্দর্য্য-বোধ এবং অতিশয় বাস্তব হৃদয়বৃত্তি এক সঙ্গে চরিতার্থ হইয়াছে। ইহার কারণ, তাঁহার কাব্য সাধনায় বাঙ্গালীর বৈরাগ্যবিমুখ বাস্তবরস-পিপাসার সঙ্গে ভারতীয় ভাবনা যুক্ত হইয়াছে—এই দুইয়ের সম্মিলনেই এমন সত্যকার কবি-দৃষ্টি সম্ভব হইয়াছে। কিন্তু ইংরেজী সাহিত্যের প্রভাবে বঙ্কিমচন্দ্রের যে বাঙ্গালী-প্রতিভা বাস্তব-জীবনের কল্পনাগৌরবে কাব্যসৃষ্টি করিয়াছে, সেই বাঙ্গালী-প্রতিভাই ইংরেজী—প্রভাববর্জ্জিত হইয়া এবং ভারতীয় ধ্যান-প্রকৃতির বশবর্তী হইয়া কাব্যের স্রষ্টা না হইয়া মন্ত্রদ্রষ্টা হইয়াছে। এজন্য শেলী বা ওয়ার্ডসওয়ার্থের তুলনায় বিহারীলালের কবি-দৃষ্টি আরও সম্যক ও সুসম্পূর্ণ হইলেও, কাব্যসৃষ্টির বিষয়ে তাঁহাদের বহু নিম্নে রহিয়া গিয়াছে।
.
বিহারীলালের এই কবি-দৃষ্টি আর কাহাকেও অনুপ্রাণিত না করিলেও তাঁহার কাব্য-রচনার ভঙ্গী এবং তাহার অন্তর্গত ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যের আদর্শ পরবর্ত্তী কবিগণের উপরে প্রভাব বিস্তার করিয়াছে। ইতিমধ্যে ঊনবিংশ শতাব্দীর ইংরেজী কাব্য-সাহিত্য বাঙ্গালীর সুপরিচিত হইয়া উঠিল; তাহাতে ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যের যে ভাবোন্মাদমাধুরী অপূর্ব্ব সঙ্গীতে উৎসারিত হইয়াছে, গীতি-প্রাণ বাঙ্গালীর কল্পনা তাহাতে আত্মসমর্পণ করিল; বিহারীলাল যে আত্ম—ভাবসাধনার পথ নির্দ্দেশ করিয়াছিলেন তাহাতে এই বিদেশী গীতিকাব্যের আদর্শ সহজেই বাংলা কাব্যে প্রবেশ করিল। কিন্তু বিহারীলাল খাঁটি বাঙ্গালী-সুলভ প্রীতিকল্পনায়, বাহিরের সহিত অন্তরকে যুক্ত করিয়া একটি পরিপূর্ণ রসসাধনার যে ইঙ্গিত করিয়াছিলেন, সে ইঙ্গিত ব্যর্থ হইল; ইংরেজী কাব্যের প্রভাবে আত্মপ্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষাই এ কাব্যের মূল প্রেরণা হইয়া দাঁড়াইল। বিহারীলালের কাব্যে আত্মভাবনিমগ্নতার লক্ষণ থাকিলেও তাহাতে সজ্ঞান আত্মপ্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা নাই। কিন্তু সেই আত্মনিমগ্নতার মোহই বড়াল-কবির কাব্যে আত্মপ্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষারূপে ফুটিয়া উঠিয়াছে। তাই বিহারীলালের ‘সারদা’র একটি দিক—বিশ্বের অন্তঃপুরে তাঁহার সেই রহস্যময়ী মূর্ত্তি—শেলির কাব্যরসে অভিষিক্ত হইয়া বড়াল—কবির অবাস্তব রসপিপাসার ইন্ধন যোগাইয়াছে। ব্যক্তির এই আত্মপরায়ণ কল্পনা, এই সম্পূর্ণ অসামাজিক আত্মরতির কবিতা বাংলা সাহিত্যে নূতন—কাব্যকে জীবন হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া কবিকল্পনার হা-হুতাশ বাংলা সাহিত্যে এইখান হইতেই আরম্ভ হইয়াছে। দেবেন্দ্রনাথের কবিতায় এই আত্মরতি আর একরূপে ফুটিয়া উঠিয়াছে; তিনি সর্ববস্তুতে যে সৌন্দর্য্য দেখিতেছেন তাহা বস্তুগত নয়, বাস্তবই অবাস্তব—মনোহর হইয়া উঠিয়াছে, তাঁহার প্রীতির অফুরন্ত উৎসমুখে সর্ববস্তুই সুন্দর। এ বিষয়ে তিনিও বিহারীলালের কাব্যকল্পনার একাংশমাত্রের অধিকারী। বিহারীলাল তাঁহার ‘সারদা’কে যে ভোলা প্রেমিকের প্রাণ’ বলিয়াছেন, দেবেন্দ্রনাথের কাব্য তাহার উৎকৃষ্ট উদাহরণ বটে, কিন্তু কবির যোগীর ধ্যান’ তাহা নহে।
তথাপি দেবেন্দ্রনাথের উচ্ছ্বাস-প্রবণ কবি-প্রতিভায় বাংলা গীতি-কাব্যের যে একটি রূপ ফুটিয়া উঠিয়াছে, তাহাতেও যেন পলকের জন্য, অন্ধকের বিদ্যুৎ চমকের মত, বাঙ্গালীর সেই চিরকালের বাঙ্গালীত্ব শেষবার ধরা দিয়াছে। এ যুগের কবিগণের মধ্যে এই বাঙ্গালী-সুলভ প্রীতির আবেগ আমরা বিহারীলালের কাব্যে দেখিয়াছি; মধুসূদন পাশ্চাত্ত্য মহাকাব্যের আদর্শ গ্রহণ করিয়াও এই প্রীতির বশে abstractions লইয়া থাকিতে পারেন নাই। হেমচন্দ্র এই প্রীতির উচ্ছ্বাসে অসংখ্য কবিতা লিখিয়াছিলেন, কিন্তু প্রকৃত কবিশক্তির অভাবে তাঁহার প্রীতি ভাষায় ও ছন্দে কাব্যের অপূর্ব্বতা লাভ করে নাই। বিহারীলাল এই প্রীতিকেই অতি উচ্চ সৌন্দৰ্য—ধ্যানে নিয়োগ করিয়াছিলেন; সেই ধ্যানের সঙ্গে এই প্রীতির বিরোধ ছিল না বলিয়াই তিনি এমন সম্যক কবিদৃষ্টির অধিকারী হইয়াছিলেন। দেবেন্দ্রনাথের কবিতায় এই প্রীতি একটি নূতন ভঙ্গীতে ফুটিয়া উঠিয়াছে—আত্মভাবমূলক আবেগের তীব্রতায় এই প্রীতি যেন কবির হৃদয়-বাঁশরীর একমাত্র রন্ধ্রমুখে গীতোচ্ছ্বাসে বাজিয়া উঠিয়াছে। চিন্তালেশহীন নিছক emotion-এর এই আবেগ, এই ভাব-বিহ্বলতা বাংলা কবিতায় যে একটি সুর-যোজনা করিয়াছে, তাহা গীতিকাব্য হিসাবে অপূৰ্ব্ব; নিজে প্রাণের আহলাদকে উপুড় করিয়া ঢালিয়া নিঃশেষ করিয়া দেওয়ার এমন ভঙ্গী বাঙ্গালী কবি ভিন্ন অপর কাহারও পক্ষে সম্ভব হইত না। প্রীতি-সৌন্দর্য্যের এই মিলিত আবেগ দেবেন্দ্রনাথকে বিহারীলালের যতটা সমগোত্র করিয়াছে আর কাহাকেও তেমন করে নাই; মনে হয়, যে আবেগ বিহারীলালের ধ্যান-কল্পনায় গভীর হইয়া শান্তরসে পরিণত হইয়াছে, সেই আবেগেই দেবেন্দ্রনাথের সর্ব্বেন্দ্রিয় বিবশ করিয়াছে। বিহারীলাল ‘বিচিত্র এ মত্তদশা’কে ‘ভাবভরে যোগে বসা’ বলিয়াছেন—দেবেন্দ্রনাথের সে যোগসাধনা ছিল না; তাঁহার কল্পনা একমুখী, আত্মহারা, অপ্রকৃতিস্থ; তিনি ধ্যান-ধারণার ধার ধারিতেন না, ভাবকে ভাবিয়া দেখিবার অবসর তাঁহার ঘটিত না। সেজন্য, প্রবল হইলেও তাঁহার কল্পনা সঙ্কীর্ণ, তাঁহার সৃষ্টিশক্তি অসমান ও বিক্ষিপ্ত।
.
আধুনিক সাহিত্যে বাঙ্গালীর বৈশিষ্ট্যের আলোচনায় আমি যাহা বলিয়াছি তাহাতে এযুগের সাহিত্যসৃষ্টির মূল্য নির্দ্ধারণ করা আমার উদ্দেশ্য নয়, তথাপি কবিগণের মৌলিক প্রতিভা ও ব্যক্তিগত প্রেরণার যতটুকু আলোচনা প্রয়োজন তাহা করিয়াছি। এই আলোচনা হইতে বাঙ্গালীর কবি প্রতিভা তাহার জাতীয় প্রবৃত্তির দ্বারা কতখানি নিয়ন্ত্রিত হইয়াছে এবং এই সাহিত্যসৃষ্টিতে কি কারণে কোন্ দিকে তাহা কতখানি সফল বা নিষ্ফল হইয়াছে তাহা অনুমান করা দুরূহ হইবে না। বাঙ্গালীর স্বভাবে যে দুই প্রবল বিরুদ্ধ প্রবৃত্তির উল্লেখ করিয়াছি তাহাও বিশেষভাবে স্মরণযোগ্য, কারণ এই জন্যই এই সাহিত্যের ধারা একটা ঘূর্ণীর মধ্যে পড়িয়া শেষে বিমুখবাহিনী হইয়াছে। যাহা নূতন অথচ সত্য এবং সুন্দর, তাহার আদর্শ বিদেশী বা বিজাতীয় হইলেও, তাহাকে আত্মসাৎ করিবার যে উদার কল্পনাশক্তি বাঙ্গালী জাতির বিশেষত্ব, তাহারই প্রভাবে এই নবসাহিত্যের জন্ম হইয়াছিল। কিন্তু জাতির প্রাণে সাড়া না জাগিলে, কেবলমাত্র অনুকরণের দ্বারা সাহিত্য সৃষ্টি হয় না। তাই, যুরোপীয় সাহিত্যের অনুকরণে, এই নব সাহিত্যের কল্পনাভঙ্গী ও ভাব-প্রেরণায় জীবন ও জগৎ সম্বন্ধে যে কৌতূহল, মনুষ্যজীবনের বাস্তব-নিয়তির ভাবনায় যে অভিনব উন্মাদনা আমরা লক্ষ্য করি—কল্পনাকে ভিতর হইতে বাহিরে আনিয়া বাস্তব-ক্ষেত্রে প্রসারিত করিয়া ইতিহাস বিজ্ঞান সমাজ ও মনস্তত্ত্বের উপরে প্রতিষ্ঠিত করিবার যে সফল ও নিষ্ফল সাধনার পরিচয় পাই, তাহার কারণ অনুসন্ধান করিলে দেখা যায়, বাঙ্গালীর অন্তরে এই মর্ত্যজীবনের প্রতি একটি সত্যকার মমতা, দেহপ্রীতি বা বাস্তবরসবুভুক্ষা চিরদিন বিদ্যমান আছে। কিন্তু দেশের জল-বায়ু, ভারতীয় কালচারের প্রভাব, ও বাহিরের নানা অবস্থার গুণে, এই ভোগস্পৃহা জীবনের বাস্তব আশা আকাঙ্ক্ষায় সত্য হইয়া উঠে নাই, অলস ভাববিলাস বা আত্মরতিকেই সে এই ক্ষুধানিবৃত্তির উপায় করিয়া লইয়াছে। তাই সাহিত্যে ও জীবনে কোনও বৃহৎ কল্পনা বা কীৰ্ত্তি-কামনা তাহার নিশ্চিন্ত পল্লী-বাস-সুখ বিঘ্নিত করিতে পারে না। কিন্তু গত যুগের সেই বৈদেশিক ভাবপ্লাবনে সে সহসা জাগিয়া দেখিল, তাহার গ্রামপ্রান্তের সেই নিভৃত নদীটির কূল-রেখা দূরবিসর্পী মাঠ-বাট-প্রান্তর একাকার করিয়া দিগন্ত সীমায় মিশিয়াছে; এবং সেইখানে ঊষালোকে নানারাগরঞ্জিত মণিহর্ম্মের মত একটি মেঘস্তম্ভ যেন সেই জলের উপরই দাঁড়াইয়া ছায়া বিস্তার করিয়াছে। বাস্তব জগতে কল্পনার এই আচম্বিত বিস্তারে তাহার প্রাণে স্ফূর্ত্তি হইল; যে-মেঘ আকাশকে মেদুর করিয়া, গৃহকোণ অন্ধকার করিয়া, তাহার অন্তরের দীপশিখা উজ্জ্বল করিয়া তুলিত, সেই মেঘ আজ নবপ্রভাতের কিরণচ্ছটায় কি অপরূপ মায়াপুরী রচনা করিয়াছে। সেই দিগন্তবিস্তৃত জলরাশি পার হইয়া অসীম সম্পদ-শোভার রহস্যনিকেতন অধিকার করিবার জন্য মধুসূদন তাঁহার অমিত্রাক্ষর ছন্দে আহ্বান-সঙ্গীত গাহিলেন। এই কূলভাঙ্গা কল্পনা-স্রোত, এই মুক্তির আনন্দই বাংলাকাব্যে মধুসূদনের দান। কিন্তু মধুসূদন য়ুরোপীয় আদর্শে মানুষের মনুষ্যধর্ম্ম, পুরুষের পৌরুষকে জয়যুক্ত করিতে চাহিলেও, মনুষ্যজীবনের তলদেশ বা ভীমকান্ত শিখর-মহিমা অপলক নেত্রে নিরীক্ষণ করিবার সাহস বা ধৈর্য্য সঞ্চয় করিতে পারেন নাই; বাঙ্গালীসুলভ মমতা ও প্রীতিবিহ্বলতার বশে তিনি তাঁহার অন্তরের অন্তরে য়ুরোপীয় আদর্শকে পূর্ণ প্রতিষ্ঠিত করিতে পারেন নাই। বঙ্কিমচন্দ্রই সে প্রভাব পূর্ণরূপে হৃদয়ঙ্গম করিয়াছিলেন; তাঁহার কাব্যেই মানুষের সর্বাঙ্গীন মনুষ্যত্ব প্রকটিত হইয়াছে। কিন্তু অতঃপর বাংলা কাব্য-সাহিত্যে কল্পনার এ ধারা আমূল পরিবর্তিত হইয়াছে—জীবন-সমুদ্র মন্থন করিয়া বিষামৃত পানের সে আকাঙ্ক্ষা—দেহ, মন ও হৃদয় এই তিনেরই উদ্দীপনার সে পৌরুষ আর নাই। মনে হয়, যে প্রাণবহ্নি কেবল মাত্র কবি-প্রতিভা দ্বারা এক সাহিত্য হইতে আর এক সাহিত্যে জ্বালাইয়া লইয়া বাঙ্গালীর কল্পনা বহির্মুখী হইতে চাহিয়াছিল, তাহাতে গোড়া হইতেই একটা অভাব, একটা দুর্বলতা ছিল। বাঙ্গালীর মজ্জাগত গীতি-প্রবণতা বা আত্মভাববিহ্বলতাই শেষ পৰ্য্যন্ত জয়ী হইয়াছে—বাস্তব-জীবন-সাধনার সেই নূতন আবেগ সাহিত্যেও সফল হয় নাই। যে-প্রবৃত্তি আধুনিক সাহিত্যের প্রারম্ভকে একটি নবতন ভঙ্গীতে প্রকাশ করিয়াছিল তাহা যেন অৰ্দ্ধপথেই নিঃশেষ হইয়াছে। বাঙ্গালীর একমাত্র সম্বল ছিল সুলভ ভাবোচ্ছ্বাস ও সহজ প্রীতিরস-রসিকতা—তাহাই লইয়া সে মহাকাব্য ও কাহিনীর দিকে ঝুঁকিয়াছিল—তাহার ফল হইয়াছিল শক্তিহীন অনুকরণ ও ভাব—কল্পনার স্বেচ্ছাচার। ইহাই প্রতিক্রিয়া আনয়ন করিলেন বিহারীলাল। তিনি একেবারে বাহির হইতে অন্তরে আশ্রয় লইলেন এবং কাব্যসাধনার ধ্যানযোগে, উৎকৃষ্ট সৌন্দর্য্যবোধ ও বাঙ্গালীসুলভ সহজিয়া প্রীতির যোগসাধন প্রণালী নিৰ্দ্দেশ করিলেন। পাশ্চাত্ত্য সাহিত্যের যে নব অনুপ্রেরণা বাংলা কাব্যে প্রথম প্রথম একটা কোলাহলের সৃষ্টি করিলেও, কালে তাহা প্রাণমূলে রস সঞ্চার করিয়া শুধু সাহিত্যে নয়, বাঙ্গালীর জীবনেও প্রতিষ্ঠা পাইত–বিহারীলাল সেই অনুপ্রেরণাকে আদৌ অস্বীকার করিয়া—
‘হা ধিক! ফেরঙ্গ বেশে
এই বাল্মীকির দেশে
কে তোরা বেড়াস সব উল্কিমুখী আয়া!’
এবং
‘তপোবনে ধ্যানে থাকি এ নগর-কোলাহলে’
—বলিয়া, জীবনের সর্ব্বদায়িত্ব বিস্মৃত হইয়া তাঁহার সরস্বতীকে সম্বোধন করিয়া গাহিলেন—
‘তুমি লক্ষ্মী সরস্বতী,
আমি ব্রহ্মান্ডের পতি
হোক্ গে এ বসুমতি যার খুশী তার।’
ইহাতে সৰ্ব্বদ্বন্দ্বের মীমাংসা হইল, বাঙ্গালী যেন মুক্তি পাইল। আত্মভাব—নিমগ্ন বাঙ্গালী কবি কখনো অন্তরে কখনো বাহিরে স্বকীয় কল্পনা প্রসারিত করিয়া কাব্যে ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যের সাধনা আরম্ভ করিলেন। কিন্তু বিহারীলাল খাঁটি বাঙ্গালী ছিলেন, এই আত্মভাবনিমগ্নতার মধ্যেও তিনি একটি অপূর্ব্ব প্রীতিরসের সাধনা করিয়াছিলেন। এ প্রীতি শুধুই কাল্পনিক বিশ্বপ্রেম নয়, অথবা আর্টের সৌন্দর্য্য-লালসা নয়, এ রস জীবনের প্রত্যক্ষ বাস্তব হৃদয় সম্পর্কের রস। এই প্রীতি ও সৌন্দর্য্য-পিপাসা একাধারে মিলিত হইয়াই বিহারীলালের কাব্যে (আধুনিক বাংলাকাব্যের একমাত্র সত্যকার) mysticism সঞ্চার করিয়াছে। পূর্ব্বেই বলিয়াছি কবিজীবনের আদর্শহিসাবে বিহারীলালের বাঙ্গালীত্ব এই যে ভাবদৃষ্টির সন্ধান পাইয়াছিল— কাব্যমন্ত্ৰ ইহা অপেক্ষা বিশুদ্ধ হইতে পারে না। কিন্তু এ দৃষ্টিকে বিহারীলাল কবিকর্ম্মে পরিণত করিতে পারেন নাই, তাহার কারণও উল্লেখ করিয়াছি। অতএব ইহাও আশ্চৰ্য্য নয় যে, পরবর্ত্তী যে সকল কবি কাব্যসৃষ্টিতে অধিকতর সাফল্য লাভ করিয়াছেন, তাঁহারা কেহই এই যোগদৃষ্টির অধিকারী হন নাই, বা হইতে চান নাই। তাঁহারা বিহারীলালের নিকট হইতে কেবল ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যের মন্ত্রটি গ্রহণ করিয়াছিলেন; সে মন্ত্রের স্বতন্ত্র সাধনায় অতঃপর বাংলা কাব্য যে রূপ পরিগ্রহ করিয়াছে, তাহা কাব্য-সৌন্দর্য্যে এ যুগের সাহিত্যকে যে পরিমাণে বিশ্ব সাহিত্যের সমকক্ষ করিয়াছে, ঠিক সেই পরিমাণে তাহাতে বাঙ্গালীর জাতিধর্ম্ম তাহার ব্যক্তিধর্ম্মের নিকট পরাস্ত হইয়াছে; যে গীতি-কল্পনায় তাহা মন্ডিত হইয়াছে তাহার ছন্দ ও সুর অতিশয় মোহকর হইলেও সে সুরে প্রাণের সুর মিলাইতে হইলে বাঙ্গালীকে জাতিসংস্কার মুক্ত হইতে হয়—এমন কি জগৎ ও জীবন সম্বন্ধে প্রত্যক্ষ চেতনাও স্তম্ভিত করিতে হয়। রবীন্দ্রনাথের প্রতিভার সেই অনন্যসাধারণ ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্য বাংলাভাষা ও সাহিত্যের অসীম বৈচিত্র্য সাধন করিয়া অবশেষে ভাবের তুরীয়মার্গে বিচরণ করিয়া, বাঙ্গালীর সাহিত্যসাধনাকে জীবন-ধৰ্ম্ম হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া, যে অতীন্দ্রিয় ভাববিলাসের মোহে প্রাণহীন করিয়া তুলিয়াছে, এবং অতি-আধুনিক কালে তাহার যে প্রতিক্রিয়া, রসবোধের একান্ত অভাব অথবা কাব্য-বিদ্বেষরূপে অবশ্যম্ভাবী হইয়া উঠিয়াছে, তাহার বিস্তৃত আলোচনার জন্য স্বতন্ত্র প্রবন্ধের প্রয়োজন; এ প্রবন্ধ এইখানেই শেষ করিলাম।
শ্রাবণ, ১৩৩৬