শরৎচন্দ্র সম্বন্ধে একটা কথা আমাদের মধ্যে এখনও অনেকের মনে হয়-বাংলা কথাসাহিত্যে তাঁহার আবির্ভাবটা যেন একটু আকস্মিক। এক বিষয়ে যে আকস্মিক তাহাতে সন্দেহ নাই, সে বিষয়ে তিনি অনন্যসাধারণ। একান্ত নিভৃত-নির্জ্জনে তাঁহার সাধনা শেষ করিয়া তিনি একেবারে তাঁহার পূর্ণসিদ্ধির ফলটি আমাদের হাতে তুলিয়া দিলেন। সে যে কত বড় বিস্ময় তাহা, যাঁহারা সেদিনের লোক, তাঁহারা আজও স্মরণ করিবেন। কিন্তু আর একটা বিস্ময়ের কারণ আজও বিদ্যমান। এ কথা অস্বীকার করিবার উপায় নাই যে, তাঁহার উপন্যাসগুলিতে যে দিকটি যেমন করিয়া ফুটিয়া উঠিয়াছে, তাহাতে ভাব ও চিন্তার যে বৈশিষ্ট্য আছে—বাঙ্গালীর পক্ষে যে কঠোর আত্ম-জিজ্ঞাসার তাগিদ আছে, তাহাতে আমাদের হৃদয় যেমন উন্মুখ হইয়া উঠে, মন তেমনি সঙ্কুচিত হয়; আমাদের চিরদিনের সংস্কারে আঘাত লাগে, নিরুদ্বেগ আত্মাপ্রসাদের হানি হয়। যাঁহারা রসিক, তাঁহারা ইহাতে বিচলিত হন না, তাঁহারা সেটুকু পরম আগ্রহে, দ্বিধাশূন্যমনে উপভোগ করেন, বাস্তবের দিকটা অনায়াসে অতিক্রম করিয়া যান। কিন্তু যাঁহাদের সংস্কার প্রবল হইয়া রহিয়াছে, সেই সংসার—প্রবীণ জনমণ্ডলী শরৎচন্দ্রের উপন্যাসগুলি পড়িয়া যতটা অভিভূত হন, ঠিক ততটাই লেখকের প্রতি আক্রোশ প্রকাশ করেন। বাংলা কথা সাহিত্যে এতদিন যে-ধরনের ভাব-কল্পনা ও আদর্শের চর্চ্চা হইয়া আসিতেছিল, এ যেন তাহার বিপরীত। এই বিপ্লবের কি প্রয়োজন ছিল? জীবনের বাস্তব দিকটা লইয়া এমন নাড়াচাড়া করিবার তাহাকে আবার এমন রসোজ্জ্বল করিয়া তুলিবার এই দুৰ্ম্মতি কেন? শরৎচন্দ্রের প্রতিভার এই মৌলিক প্রবৃত্তি এখনও সন্দেহ ও সংশয়ের হেতু হইয়া রহিয়াছে। আমাদের জীবনের জীর্ণভিত্তির তলদেশে, অন্ধকার গহ্বরে, যে সকল প্রেতমূৰ্ত্তি পিপাসার্ত হইয়া একবিন্দু জল প্রার্থনা করিতেছিল, শরৎচন্দ্র তাহাদের সেই রুদ্ধ আৰ্ত্তনাদ আমাদের কর্ণগোচর করিয়া দিয়াছেন, আমরা ইহার জন্য প্রস্তুত ছিলম না, তাই একটা বিভীষিকার সৃষ্টি হইয়াছে। বঙ্কিমচন্দ্রের পর রবীন্দ্রনাথকে আমরা এখন কতকটা বুঝিতে পারিতেছি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের অব্যবহিত পরেই শরৎচন্দ্রের আবির্ভাব যেন একটু অতর্কিত ও অপ্রত্যাশিত—আমাদের সাহিত্যের ধারাটি যেন একটা ভিন্নমুখে প্রবাহিত হইতে চলিয়াছে। এই আপাত-বৈষম্যের মূলে কোনও সত্য আছে কি না, আমাদের সাহিত্যের ভাবধারার ক্রমবিকাশে শরৎচন্দ্রের অভ্যুদয় স্বাভাবিক কিনা, তাহারই কিঞ্চিৎ আলোচনা করিব।
বঙ্কিমের আমল হইতে আজ পর্যন্ত আমাদের কথা-সাহিত্য ভাবপ্রধান : অর্থাৎ কল্পনা ও ব্যক্তিগত ভাবদৃষ্টির প্রসারই যেন সাহিত্যে বেশী। বঙ্কিমচন্দ্র খাঁটি আদর্শবাদী, তাঁহার উপন্যাসগুলিতে অতি সাধারণ জীবন-যাত্রার উপরেও একটি অবাস্তব-রমণীয় কল্পনার ছায়াপাত হইয়াছে। কতগুলি চরিত্র, ঘটনা ও অবস্থান (situation)-কে সেই কল্পনার উপযোগী করিয়া তার মধ্যে লেখক নিজের মনোমত আদর্শে সাহিত্যিক রসপিপাসা চরিতার্থ করিয়াছেন। এজন্য তাঁহার উপন্যাসের প্লট—রচনায় কৃতিত্বের পরিচয় আছে। বঙ্কিমের উপন্যাসগুলি ঠিক নভেল নয়—গদ্য রোমান্স, ভাষা, ভাব ও কল্পনার ঐশ্বর্য্যে পাঠককে স্বপ্নাতুর করিয়া তুলে। তাঁহার উপন্যাসগুলি পড়িবার সময়ে মনের রাশ একটু আলগা করিয়া রাখিতে হয়; কেবলমাত্র সেই রস উপভোগ করার জন্যই যদি সেগুলি পড়া যায় তবে তার ভিতরকার সেই গভীর সৌন্দর্য্যদৃষ্টি, Passion ও emotion-এর দ্বন্দ্ব এবং একটি অপ্রাকৃত কল্পনার মোহে মুগ্ধ না হইয়া থাকা যায় না। বঙ্কিমের এই idealism বাঙ্গালীর মনোহরণ করিয়াছিল; শেক্সপীয়ারের নাটক ও স্কটের রোমান্স পড়িয়া এককালে বাঙ্গালীর প্রাণে যে রসের ক্ষুধা জাগিয়াছিল তাহা বঙ্কিম কতকটা তৃপ্ত করিয়াছিলেন। সেকালের কাব্যগুলিতে এমন খাঁটি সাহিত্যরস ছিল না—কাব্য, নাটক ও উপন্যাস, এই ত্রিবিধ সাহিত্যের রস ঐ একজনই একপাত্রে পরিবেশন করিয়াছিলেন।
এই ধরণের রুচি ও রস পুরাতন হইয়া না আসিতেই—বরং, যখন পূর্ণ মাত্রায় বঙ্কিমের যুগই চলিয়াছে—সেই সময়ে আসিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁহার রচনায় প্রথম হইতেই ভাবকল্পনার একটা নূতন অভিব্যক্তি দেখা গেল। এখানে রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসগুলির উল্লেখ না করিয়া, বাংলা কথাসাহিত্যে যেগুলি তাঁহার প্রতিভার সর্ব্বাপেক্ষা সুন্দর ও মৌলিক সৃষ্টি, সেই ‘গল্পগুচ্ছে’র কথা মনে রাখিলেই হইবে। বঙ্কিমের ভাবুকতা যে বাস্তবকে পাশ কাটাইয়া রসের সন্ধান করিতেছিল, রবীন্দ্রনাথের idealism সেই বাস্তবকেই এক অপূৰ্ব্ব মহিমায় মণ্ডিত করিয়াছে। যে-কল্পনা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত বা subjective, সে-কল্পনার রঙে, যাহা অতিশয় সাধারণ ও সুপরিচিত, এমন কি তুচ্ছ ও ক্ষুদ্র—তাহাই অপূর্ব্ব-সুন্দর হইয়া উঠিয়াছে, বাস্তবের মধ্যেই লোকোত্তর-চমৎকারের বিস্ময়রস সঞ্চারিত হইয়াছে। বাস্তবের সেই অতি-পরিচয়ের আবরণখানি উন্মোচন করিয়া বস্তুর অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য্য আবিষ্কার করাই তাঁহার কল্পনার মূল প্রবৃত্তি। সে-কল্পনা বস্তুকে একেবারে রূপান্তরিত করে, অথচ মনে হয় সেইটিই যেন তার একমাত্র সত্যকার রূপ। যে-আনন্দে কবি এই অপূর্ব্ব রসসৃষ্টি করিয়াছেন, তার মূলে কোন্ প্রেরণা ছিল তাহা কবি নিজেই বলিয়াছেন—
মাথাটি করিয়া নীচু বসে’ বসে’ রচি কিছু
বহুযত্নে সারাদিন ধরে’,–
ইচ্ছা করে অবিরত আপনার মনোমত
গল্প লিখি একেকটি করে’।
ছোট প্রাণ, ছোট ব্যথা ছোট ছোট দুঃখকথা
নিতান্তই সহজ সরল,
সহস্র বিস্মৃতিরাশি প্রত্যহ যেতেছে ভাসি
তারি দু’চারিটি অশ্রুজল।
নাহি বর্ণনার ছটা, ঘটনার ঘনঘটা,
নাহি তত্ত্ব নাহি উপদেশ;
অন্তরে অতৃপ্তি র’বে সাঙ্গ করি মনে হবে
শেষ হয়ে হইল না শেষ।
জগতের শত শত অসমাপ্ত কথা যত,
অকালের বিচ্ছিন্ন মুকুল,
অজ্ঞাত জীবনগুলা অখ্যাত কীর্ত্তির ধুলা
কত ভাব, কত ভয় ভুল
সংসারের দশদিশি ঝরিতেছে অহর্নিশি
ঝর ঝর বরষার মত—
ক্ষণ-অশ্রু ক্ষণ—হাসি পড়িতেছে রাশি রাশি
শব্দ তার শুনি অবিরত।
সেই সব হেলা ফেলা, নিমেষের লীলাখেলা
চারিদিকে করি’ স্তূপাকার,
তাই দিয়ে করি সৃষ্টি একটি বিস্মৃতি-বৃষ্টি
জীবনের শ্রাবণ-নিশার।
মানুষের জীবনের যে দিকটি আড়ম্বরের দিক, কেবলমাত্র ঘটনার ঘনঘটায় যে দিকটি বড় হইয়া উঠে—মানব-ইতিহাসের শোভাযাত্রায় যে সব উন্নত উষ্ণীষ ও উদ্ধত ধ্বজা আমাদের মনে একটা অতিরিক্ত সম্ভ্রমের উদ্রেক করে—রবীন্দ্রনাথের কল্পনা সেদিকে আকৃষ্ট হয় নাই। তাঁহার কথা Wordsworth-এর মত—
The moving accident is not my trade,
To freeze the blood I have no ready arts,
‘Tis my delight-alone in summer shade
To pipe a simple song for thinking hearts.
রবীন্দ্রনাথও বলেন—
শুধু বাঁশিখানি হাতে দাও তুলি’
বাজাই বসিয়া প্রাণমন খুলি’
পুষ্পের মত সঙ্গীতগুলি
ফুটাই আকাশ ভালে।
অন্তরে হতে আহরি বচন
আনন্দ-লোক করি বিরচন,
গীতরসধারা করি সিঞ্চন
সংসার-ধুলিজালে
কেবল মানুষ হিসাবেই মানুষের যে চিরন্তন মহিমা, উত্তম ও অধম নির্ব্বিশেষে যে কাহিনী তাহার জীবনের সত্যকার ইতিহাস—সেই প্রতিদিনের হাসিকান্না, সুখ—দুঃখই ধরণীকে চিরশ্যামল করিয়া রাখিয়াছে, তাহারই যে গান—তাহাই শাশ্বত, তাহাই অমর। নতুবা-—
সে রণরঙ্গ হয়েছে নীরব,
সে চিতা-বহ্নি অতি-ভৈরব—
ভস্মও নাহি তার;
যে-ভুমি লইয়া এত হানাহানি,
সে আজি কাহার তাহাও না জানি,
কোথা ছিল রাজা, কোথা রাজধানী,
চিহ্ন নাহিক’ আর!
তবে আছে কি?
যুগে যুগে লোক গিয়েছে এসেছে,
দুখীরা কেঁদেছে, সুখীরা হেসেছে,
প্রেমিক যে জন ভাল সে বেসেছে
আজি আমাদেরি মত;
তারা গেছে, শুধু তাহাদের গান—
দু’হাতে ছড়ায়ে করে গেছে দান;
দেশে দেশে, তার নাহি পরিমাণ,
ভেসে ভেসে যায় কত!
শ্যামলা বিপুলা এ ধরার পানে
চেয়ে দেখি আমি মুগ্ধ নয়ানে;
সমস্ত প্রাণে কেন যে কে জানে
ভরে’ আসে আঁখিজল।
বহুমানবের প্রেম দিয়ে ঢাকা,
বহুদিবসের সুখে দুখে আঁকা,
লক্ষযুগের সঙ্গীতে মাখা
সুন্দর ধরাতল!
ইহাই হইল রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য-সৃষ্টির মূল প্রেরণা। একটু ভাবিয়া দেখিলেই বুঝা যাইবে, এই idealism কত বড়, কত দুরূহ! পৃথিবীর ধূলামাটিকে সোনা করিয়া তোলা, মানুষের সাধারণ সুখ-দুঃখ-আশা-আকাঙ্ক্ষাকে, বিশ্বসৃষ্টির যে রহস্য তাহারই অন্তর্ভুক্ত করিয়া দেখা ত সহজ idealism নয়!
এই কল্পনার সঙ্গে দেশের লোকের এখনও ভাল করিয়া পরিচয় হয় নাই। ইহার প্রভাব আকস্মিক হইতে পারে না—রবীন্দ্রনাথের ভাব-কল্পনা আমাদের মনকে আচ্ছন্ন করিয়াছে খুব ধীরে। বঙ্কিমের কল্পনা সূৰ্য্যাস্ত-শেষ বর্ণ-গরিমার মত আমাদের মনের আকাশে যে সৌন্দর্য্য-রাগের আয়োজন করিয়াছিল তাহারি অন্তরালে শুক্ল-সন্ধ্যার অস্ফুট চন্দ্রালোকের মত রবীন্দ্রনাথের কল্পনা অলক্ষিতে আমাদের মনকে অধিকার করিয়াছে। এ আলোক যে কখন কেমন করিয়া গাঢ় হইতে গাঢ়তর হইয়া উঠিল, কখন যে সে আলোকে পথের উপর আমাদের ছায়া গভীর হইয়া উঠিল—তাহা আমরা জানিতেই পারি নাই। এ রূপের মধ্যে কোন উদ্বেগ নাই, কোন উত্তেজনা নাই, নিশীথ-রাত্রের দিগন্তপ্লাবী জ্যোৎস্নার সঙ্গে ইহার যেন কোথাও কোন বিরোধ নাই, সকল কর্কশতা ও রূঢ়তা একটি গভীরতর চেতনার আশ্বাসে যেন লুপ্ত হইয়া যায়। বাস্তবের মধ্যে যেখানে যেটুকু সৌন্দর্য্য রহিয়াছে সেইটুকু সত্য, অথবা তাহার যতটুকু সত্য ততটুকুই সুন্দর—বাকিটুকু মিথ্যা, মিথ্যা, বলিয়াই দুঃখকর। এই ভাবদৃষ্টি, এই আনন্দবাদ, এই সত্য-সন্ধান বাংলাসাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের সর্ব্বাপেক্ষা বড় দান। কিন্তু ইহা ত সকলের পক্ষে সহজ নয়। যে—কল্পনায়, ছোট-বড় সুন্দর-কুৎসিত সুখ-দুঃখ—সবই একটা নিগূঢ় ঐক্য-বোধের আনন্দে সমান হইয়া দেখা দেয়, তাহাকে আত্মসাৎ করা একটা বিশেষ culture বা সাধনার অপেক্ষা রাখে। তবু এই কল্পনার যাদুশক্তিকে সজ্ঞানে স্বীকার না করিলেও, অনেকের প্রাণে একটা নূতনতর স্বপ্নের আবেশ লাগিয়াছে। মানুষের সম্বন্ধে কোন কিছুই উপেক্ষার যোগ্য নয়, সত্যকার জগৎকে অস্বীকার করিয়া বৈরাগ্য-সাধন বা কোন অপ্রাকৃত কল্পনার আশ্রয় নেওয়া যে ঠিক নয়—এমনই একটা ভাব মানুষের মনে ক্রমশঃ স্থান পাইতেছে। রবীন্দ্রনাথের দূরারোহিণী কল্পনার ঊর্দ্ধ শাখায় যে ফুল গুচ্ছে গুচ্ছে ফুটিয়া উঠিল তার সবটুকু শোভা সকলের চোখে ধরিল না বটে, কিন্তু সেই ফুলের বীজ নিম্নভূমিতে একটি নূতন রূপে অঙ্কুরিত হইল। শরৎচন্দ্রের সুনিভৃত সাধনার পরিচয় আগে কেহ পায় নাই; তাই হঠাৎ যখন দেখা গেল, একেবারে পথের ধারেই লতাগুল্মের বেড়াগুলি এক নূতন ধরণের ফুলে ভরিয়া উঠিয়াছে, তার বর্ণ ও গন্ধ যেমন চমকপ্রদ তেমনই অতি সহজে প্রাণ-মন অভিভূত করে—তখন আর বিস্ময়ের সীমা রহিল না। এ যেন ভাব—কল্পনার বস্তু নয়, একেবারে প্রত্যক্ষ বাস্তব; এ যেন চিরদিনের দেখা জিনিস, অথচ এমন করিয়া কখনও দেখি নাই। রবীন্দ্রনাথের প্রতিভা যখন সাহিত্য গগনের শেষ সীমা পর্যন্ত উদ্ভাসিত করিয়াছে, তখনই সেই রবীন্দ্রালোকিত মহাদেশের এক প্রান্তে একটা নূতন আলো বিচ্ছুরিত হইল, নিথর নিবিড় জ্যোৎস্নাকাশের এক কোণে বিদ্যুৎ-শিহরণ আরম্ভ হইল।
ইহার আগে আর একজন মাত্র কথাশিল্পী রবীন্দ্রনাথের পার্শ্বে একটি ক্ষুদ্র জ্যোতিষ্কের মত দীপ্তি পাইতেছিলেন। শ্রীযুক্ত প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের গুল্পগুলিতে একটি হাস্যোজ্জ্বল অথচ শিশির-স্নিগ্ধ-বাস্তব-কল্পনা ফুটিয়া উঠিয়াছিল। সে কল্পনায় সুপরিচিত দৈনন্দিন জীবনের আলোক-চিত্র সংগ্রহ করা হইতেছিল’। তার প্রকাশভঙ্গি যেমন অনবদ্য, তার ভাবদৃষ্টিও তেমনই সহজ ও সরল, সে যেন কোথাও বাধে না। জীবনকে একটা নূতন দিক হইতে দেখিবার প্রয়াস তাহাতে নাই, কোন অন্ধকার গহ্বর বা কুটিল পথ-রেখার আবিষ্কার তাহার মধ্যে নাই; কেবল একটি সহজ সরল আত্মীয়তার আনন্দে ও সহৃদয় কৌতুক-হাস্যে সেগুলি সমুজ্জ্বল। সাধারণের মধ্যে, রবীন্দ্রনাথের ‘গল্পগুচ্ছ’ হইতেও এগুলির প্রচার যেন একটু বেশী হইয়াছিল। প্রভাতকুমারের জনপ্রিয়তার মূলে ছিল তাঁহার কল্পনার সহজ রসিকতা; আর একটা কারণ, সে চিত্রগুলি সমাজ ও পরিবারের সঙ্কীর্ণ ফ্রেমে বাঁধা। রবীন্দ্রনাথের কল্পনায় বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে মানব-জীবনের যে সূক্ষ্ম অন্তরতার যোগ আছে—যে বিপুলতর রহস্যের ছায়ায় সকল ক্ষুদ্রতা একটা অসীমতা লাভ করিয়াছে, প্রভাতকুমারের কল্পনায় তাহার কিছুই নাই। তাই, সেগুলি খাঁটি গল্প হিসাবেই মুগ্ধ করে, কাহারও গভীরতর চেতনা স্পর্শ করে না। কথাসাহিত্যের যখন এই অবস্থা, যখন একদিকে রবীন্দ্রনাথের সূক্ষ্ম কল্পনা মনোহরণ করিতে পারিতেছিল না, অথচ তাহারি প্রভাবে ভিতরে ভিতরে একটা উৎকণ্ঠা জাগিয়াছে—অন্যদিকে প্রভাতকুমারের মত শিল্পী, ক্ষণিকের আনন্দ বিতরণ করিলেও সেই উৎকণ্ঠার তৃপ্তি-সাধনে অক্ষম, তখন এমন একজন শিল্পীর আবির্ভাব হইল যিনি এই নিগূঢ় উৎকণ্ঠাকেই যেন বাঙ্ময়ী করিয়া তুলিলেন। যে সামাজিক ও পারিবারিক বিধি-ব্যবস্থার বশে, বাঙ্গালীর জীবনে আত্মত্যাগের মহিমা ও স্বার্থরক্ষার দৈন্য, এই দুয়েরই বেদনা করুণ হইয়া উঠিয়াছে—যে-ট্র্যাজেডি কোন অতি-মানুষ নাটকীয় ট্র্যাজেডি হইতে কিছুমাত্র কম নয়, তাহাকেই তিনি সাহিত্যের আকারে সুপ্রকাশিত করিলেন। তিনি জীবনকে খুব বিস্তৃত করিয়া দেখেন নাই, কিন্তু যেটুকু দেখিয়াছেন গভীর করিয়া দেখিয়াছেন—সে গভীরতা ততটা কল্পনার নয়, যতটা অনুভূতির। এই সহানুভূতি যেখানে যতটুকু পৌঁছিতে পারিয়াছে ততটুকুই তাঁহার কল্পনার প্রসার। সমাজ যে-পাপে জর্জরিত হইয়াও তাহাকে স্বীকার করে না-আত্মঘাতীর সেই ব্যথাকে শরৎচন্দ্র তাঁহার হৃদয়ের রঙে রঞ্জিত করিয়াছেন। তিনি যাহা দেখিয়াছেন বিনা-সঙ্কোচে তাহার সবটুকুই প্রকাশ করিয়াছেন; সবটুকু প্রকাশ না করিলে যে সে ব্যথার পরিমাপ করা যাইবে না। অসহায় শক্তিহীন সমাজের এই ব্যথাকেই তিনি বড় করিয়া দেখিয়াছেন, তাহাদেরই মত অসহায়ভাবে তিনি নিজেও সেই ব্যথা ভোগ করিয়াছেন। এ বিষয়ে তিনি অনেক চিন্তা অনেক ভাবনা করিয়াছেন বটে, কিন্তু কোথাও বিচার করিতে বসেন নাই। তিনি দুঃখের কোন দার্শনিক মীমাংসা করিতে চাহেন নাই, তার বাস্তব রূপটি ধ্যান করিয়াছেন; চোখে দেখা এবং গভীর করিয়া অনুভব করা—ইহাই হইল তাঁহার কল্পনার উৎস।
রবীন্দ্রনাথ যে-বাস্তবকে অন্তরের আলোকে উজ্জ্বল করিয়া তুলিয়াছেন, শরৎচন্দ্র সেই বাস্তবকেই বাহিরের দিক হইতে নিকটতর করিয়া দেখিয়াছেন। রবীন্দ্রনাথের কল্পনায় যে ক্ষুদ্র সুখ-দুঃখের পরিধি সীমাহীন হইয়া আনন্দঘন শান্তরসের উদ্বোধন করে, শরৎচন্দ্রের প্রত্যক্ষ অনুভূতি-মূলক কল্পনায় সুখ-দুঃখের সেই সীমারেখা কোথাও হারাইয়া যায় না—ব্যথার ব্যথাটুকু শেষ পর্যন্ত জাগিয়াই থাকে। এই অনুভূতির সঙ্গেই তাঁহার মানসবৃত্তি জাগিয়া উঠে, কিন্তু তাঁহার সেই চিন্তাগুলিকে কোথাও বস্তুনিরপেক্ষ abstract idea-র ভাবনা বলিয়া মনে হয় না। অমাবস্যার রাত্রে নির্জ্জন শ্মশানে বসিয়া শ্রীকান্তের সেই ধ্যান—’অন্ধকারের একটা রূপ আছে’—পড়িতে পড়িতে মনে হয়, এখানে শরৎচন্দ্র বুঝি নিজেকেও ছাড়াইয়া গিয়াছেন; কিন্তু তাহার মধ্যে নিছক ভাব-কল্পনা নাই—একটা অত্যন্ত বাস্তব অনুভূতির emotion আছে। রবীন্দ্রনাথের কল্পনা সৃষ্টির মর্ম্মস্থলে একটা অব্যভিচারী রসবস্তুর সন্ধান করিয়াছে—সে কল্পনা সকল বস্তুরই সেই এক রস-পরিণাম উপলব্ধি করিয়াছে! এই ভাব-কল্পনার প্রভাবে শরৎচন্দ্রের অনুভূতি কল্পনাও যেন একটু জোর পাইয়াছে, তাই নীলাম্বরের মত নিরক্ষর, গাঁজাখোর পল্লীসন্তানের মধ্যেও রসের উৎকৃষ্ট উপকরণ সন্ধান করিতে তাঁহার সাহসের অভাব হয় নাই।
রবীন্দ্রনাথের প্রভাব তাঁহার ভাষার মধ্যেও রহিয়াছে; তথাপি তাঁহার ষ্টাইল যেমন মৌলিক, তাঁহার কল্পনাও তেমনি নিজস্ব। এই জন্যই তাঁহাদের দুই জনের দুই বিভিন্ন কল্পনা-প্রকৃতি তুলনা করিয়া দেখিবার মত ঠিক একই ধরণের গল্প খুঁজিয়া পাওয়া শক্ত। তবু আমি যতটা সম্ভব চেষ্টা করিয়া দেখিব। শরৎচন্দ্রের ‘অরক্ষণীয়া’ গল্পের সেই মেয়েটির অবস্থা রবীন্দ্রনাথের ‘পোষ্টামাষ্টার’ গল্পের রতনের অবস্থার সঙ্গে যেন একটু মিলে। রতনের দুঃখ যেন সমস্ত আকাশে ব্যাপ্ত হইয়া গেল, তাহার মধ্যে মানবভাগ্যের চিরন্তন ট্রাজেডির ছায়া পড়িয়াছে— সে-দুঃখ যেন ভাবের শাশ্বত লোকে একটি পরম পরিসমাপ্তি লাভ করিয়াছে। ‘অরক্ষণীয়া’র মধ্যে সে রকমের ভাবুকতা নাই; তাহার মধ্যে যে দুঃখের বর্ণনা আছে, সে ঠিক সেই ব্যক্তি ও সেই অবস্থার মধ্যে কঠিন ও সুনির্দিষ্ট হইয়া জাগিয়া রহিল, কোনও একটি ভাবলোকে সমাপ্তি লাভ করিল না। এখানে কবিত্বহিসাবে রবীন্দ্রনাথের কল্পনাই উৎকৃষ্ট। কিন্তু শরৎচন্দ্রের এই সহানুভূতিই তাঁহাকে উৎকৃষ্ট সৃষ্টি-শক্তির অধিকারী করিয়াছে। ‘চন্দ্রনাথ’ উপন্যাসে সেই ‘কৈলাস-খুড়া’ ও ‘বিশু’র কথা বাংলা গল্প—সাহিত্যে অতুলনীয়। ঐ উপন্যাসখানির শেষের দিকে এই যে চিত্রটি ফুটিয়া উঠিয়াছে, তাহাতে মূল কাহিনী ম্লান হইয়া গিয়াছে। একি শুধু বাস্তবের তীব্র অনুভূতি? কত বড় রস-কল্পনার প্রমাণ ঐ চিত্রটি! ইহার সঙ্গে এক দিক দিয়া রবীন্দ্রনাথের ‘কাবুলিওয়ালা’ গল্পটির তুলনা করা যায়। ‘কাবুলিওয়ালা’র ব্যথা বিশ্বজনীন হইয়া এক অপূর্ব্ব রসের সৃষ্টি করিয়াছে বটে, তবু মনে হয় শরৎচন্দ্রের করুণরস যেন আরো গভীর, আরো উজ্জ্বল। রবীন্দ্রনাথের সত্যাশ্রয়ী ভাবকল্পনা বাঙ্গালীকে রসের ঊর্দ্ধলোকে বিচরণ করিবার অধিকার দিয়াছে। এই সত্যকে তিনি পৃথিবীর ধূলামাটির উপরেই প্রতিষ্ঠিত করিয়াছেন, সীমাকে অসীমের সঙ্গে বাঁধিয়া দিয়াছেন। শরৎচন্দ্র এই ধরণী ও ধরণীর ধূলামাটিকে তেমন করিয়া দেখেন নাই—তিনি বিশ্ব বা প্রকৃতি, কাহাকেও ভক্তি করিবার অবকাশ পান নাই। তাঁহার নিজের সমাজে তিনি যে জীবন প্রত্যক্ষ করিয়াছেন, তাহাকেই গভীর বর্ণে চিত্রিত করিয়াছেন, আর কিছুর ভাবনা তিনি করেন নাই। তিনি রবীন্দ্রনাথের মানবতাটুকুই গ্রহণ করিয়াছেন, বিশ্ব-মানবতা বা বিশ্ব-প্রাণতার দিক দিয়াও তিনি যান নাই।
কিন্তু তাই বলিয়া শরৎচন্দ্র বস্তু-তান্ত্রিক বা Realist নহেন। তিনিও একজন বড় দরের Idealist। অতি নিম্নশ্রেণীর জীবনযাত্রা, এমন কি সমাজ-বহির্ভূত জীবনকে তিনি তাঁহার কল্পনায় স্থান দিয়াছেন, অথবা অনেক বাস্তব দুঃখের চিত্র আঁকিয়াছেন বলিয়াই তিনি Realist নহেন। বরং তাঁহার হৃদয়ের আবেগ এতই বেশী যে, কোন কিছুকেই তিনি ঠিক তাহার মত করিয়া দেখিতে পারেন নাই—অনেক বড় করিয়া দেখিয়াছেন। মানুষের দুঃখ তিনি যতটুকু দেখিয়াছেন, তদপেক্ষা বেশী উপলব্ধি করিয়াছেন; এই উপলব্ধি করার মধ্যে যে শক্তি আছে, সেইটাই তাঁহার কবিশক্তি। যিনি প্রকৃত Realist, তিনি প্রত্যক্ষ বাস্তবকে ঠিক ঠিক প্রকাশ করেন, এজন্য তাঁহার রচনায় সুন্দরের অপেক্ষা কুৎসিতের দিকটা, ভাব অপেক্ষা অভাবের দিকটা, আত্মা অপেক্ষা অনাত্মার দিকটাই বেশী করিয়া ফুটিয়া উঠে—তাহার মধ্যে লেখকের নিজের কোন অভিপ্রায় বা ভাবের উচ্ছ্বাস থাকে না। এইটি মনে রাখিলেই শরৎচন্দ্রকে কেহ Realist বলিবেন না।
প্রমাণস্বরূপ শরৎচন্দ্রের নারী চরিত্রগুলিই ধরা যাক। শরৎচন্দ্রের যত কিছু নিন্দা—প্রশংসা এইগুলিকে লইয়া। এই নারী চরিত্রই বাংলার বড় বড় ঔপন্যাসিকের একটি শক্তি-পরীক্ষার স্থল। বাংলা উপন্যাসে নারী-চরিত্রগুলিই যা একটু বৈচিত্র্যময়, পুরুষ—চরিত্রগুলা নাকি তেমন কিছু নয়। রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসগুলি সম্বন্ধেও টম্সন্ সাহেবও এই কথাই বলিয়াছেন। কথাটা একেবারে মিথ্যা নয়। আমাদের দেশে নারীর মধ্যেই একটু শক্তির পরিচয় আছে, তাই গল্পে-উপন্যাসে নারী-চরিত্রের একটু বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ে। তবু বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথ এই উভয়ের মধ্যে, এবিষয়ে বরং বঙ্কিমের কল্পনাই একটু বাস্তব-ঘেঁসা; রবীন্দ্রনাথের নারী-চরিত্র সর্ব্বত্রই একটা আদর্শ-কল্পনায় অনুরঞ্জিত, তাহাদের সম্বন্ধে তাঁহারই কথায় বলা যাইতে পারে—’অর্দ্ধেক মানবী তুমি, অর্দ্ধেক কল্পনা’। আমাদের সমাজে, নারীর যে শক্তির কথা বলিয়াছি, শরৎচন্দ্র ঠিক সেইটির সন্ধান পাইয়াছেন, তাই তাঁহার কল্পনাও বাস্তবের অনুকূল হইয়াছে। তিনি আমাদের মেয়েদের মধ্যে সেই একটা মহিমা লক্ষ্য করিয়াছেন— দুঃখ সহ্য করিবার অসাধারণ শক্তি। ‘অন্নদাদিদি’কে দেখিয়া নারীচরিত্র সম্বন্ধে তিনি যে এক বিষয়ে নিসংশয় হন—সেটা উপন্যাস নয়, খুব সত্য কথা। কিন্তু একথা ত শুধু আমাদের দেশের মেয়েদের সম্বন্ধেই খাটে না, নারীমাত্রেরই প্রকৃতিতে এই passive শক্তি নিহিত রহিয়াছে। নারীবিদ্বেষী Schopenhauer ও বলিয়াছেন,—’She pays the debt of life not by what she does, but by what she suffers’,। নারী-জীবনের এই নিয়তি শরৎচন্দ্রকে বিশেষ করিয়া অভিভূত করিয়াছে; তাহার কারণ, আমাদের সমাজে নারীর এই নিয়তি সৰ্ব্বত্র জাজ্জ্বল্যমান। যে সমাজে পুরুষের পৌরুষ প্রায় নির্ব্বাপিত, ভীরু দুর্ব্বল স্বার্থপর পুরুষের সংখ্যাই বেশী, সেখানে নারীকেই যে পুরুষের সকল অত্যাচার, সকল পাপের বোঝা বহিতে হয়। এই সমাজের অন্ধতম গহ্বরে শরৎচন্দ্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়াছেন—সেখানে নারীর সেই ক্রুশবিদ্ধ অবস্থা তাঁহার প্রাণে অপরিসীম সহানুভূতির উদ্রেক করিয়াছে, তাই তিনি Son of man-এর পরিবর্ত্তে Daughter of Woman-এর মহিমা এমন করিয়া কীৰ্ত্তন করিয়াছেন। আমার মনে হয়, যে অপূর্ব্ব ভাবুকতা ও lyric sentiment শরৎচন্দ্রের উপন্যাসগুলিতে একটি গীতি-মূর্ছনার সৃষ্টি করিয়াছে, নারী-জীবনের এই দুঃখ-কল্পনাতেই তার জন্ম, ইহা ইহতেই তাঁহার কল্পনা গভীর ও ব্যাপক হইয়া উঠিয়াছে। কিন্তু নারী-চরিত্রের এই একটি দিক তিনি বিশেষ করিয়া দেখিয়াছেন বলিয়া, এবং সেইটিকেই কেন্দ্র করিয়া তাঁহার অধিকাংশ উপন্যাস গঠিত বলিয়া, তাঁহার কল্পনার মন্ডলটি কিছু সংকীর্ণ। প্রত্যক্ষ বাস্তব-অনুভূতির দ্বারাই তাঁহার কল্পনা নিয়ন্ত্রিত হইয়াছে বলিয়া তাঁহার দৃষ্টি যেমন গভীর সৃষ্টি-শক্তি তেমন প্রচুর নহে। বাস্তব-অনুভূতি ও subjective কল্পনা, এই দুয়ের পূর্ণ মিলনেই ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের প্রথম খন্ডে তাঁহার শক্তির এমন সার্থক বিকাশ দেখিতে পাই। এই উপন্যাসখানির গঠনে ও পরিকল্পনায় অতিশয় স্বাধীন আত্মপ্রকাশের সুযোগ ঘটিয়াছে, বাস্তব-অনুভূতি-স্বকীয় কল্পনার বিরোধ এখানে নাই : তাই এই উপন্যাসে শরৎচন্দ্রের Idealism এমন অপূৰ্ব্ব কাব্যসৃষ্টি করিয়াছে।
আশ্বিন, ১৩৪৫