কপালকুণ্ডলা

‘কপালকুণ্ডলা’ বঙ্কিমচন্দ্রের দ্বিতীয় উপন্যাস, ১৮৬৫ সালে প্রকাশিত হয়—তখন তাঁহার বয়স ২৭ বৎসর। প্রথম উপন্যাস ‘দুর্গেশনন্দিনী’ বাংলা সাহিত্যে যুগান্তর আনিয়াছিল ঐ উপন্যাস বিলাতী রোমান্সের আদর্শে রচিত হইলেও, ভাবে ভঙ্গিতে ও ভাষায় উহা খাঁটি দেশীয় পাত্রে এক নূতন রস পরিবেষণ করিয়াছিল। উহার ঐতিহাসিক আবহাওয়া-যুক্ত কাহিনী, নারী ও পুরুষ-চরিত্রের পৃথক মহত্ত্ব, আদর্শ-চরিত্র-সৃষ্টিতে স্বভাবের অনুবর্তিতা, এবং অতি গভীর গুরুগম্ভীর কাব্যরসের সহিত হাস্যরস প্রভৃতির জন্য এক অভিনব গদ্য-কাব্যের কবিরূপে বঙ্কিমচন্দ্র সহসা খ্যাতিলাভ করিলেন; পরবর্তী উপন্যাসগুলিতে তাঁহার সেই খ্যাতি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাইয়াছিল।

কিন্তু এই দ্বিতীয় উপন্যাসের ভাব-জগৎ আরও বিশেষ অর্থে রোমান্টিক, বা মুক্ত—স্বাধীন কবিকল্পনার বিশিষ্ট রসে সমুজ্জ্বল। এখানে তিনি নরনারীর সাধারণ ভাগ্য বা চরিত্রকেই উচ্চ কল্পনায় মণ্ডিত করিয়া একটি চিত্তাকর্ষক কাহিনী রচনা করিতেছেন না, ইহার ভাব-বস্তু উপন্যাসের প্রয়োজনকেও ছাড়াইয়া গভীরতর রসসৃষ্টির প্রয়াস পাইয়াছে। যে বিরাট প্রাকৃতিক শক্তি মানুষের জীবনকে অলক্ষ্যে বেষ্টন করিয়া তাহার শুভাশুভ নির্দ্ধারণ করিতেছে, তাহারই রহস্যগম্ভীর মহিমা, ভাষার অত্যধিক গাম্ভীর্য্যে এবং ভাবের ততোধিক লিরিক-মূর্ছনায়, ইহাকে হিব্রু-কাব্যের রস-সাদৃশ্য দান করিয়াছে। এইজন্য ‘কপালকুণ্ডলা’ বঙ্কিমচন্দ্রের অপর সকল উপন্যাস হইতে স্বতন্ত্র। এইজন্যই, ‘কপালকুণ্ডলা’র সমালোচনায় একজন পূর্ব্বসূরি, প্রতিভাবান কবি ও সমালোচক, এমন অপূর্ব্ব মন্তব্য করিয়াছিলেন—

“কপালকুণ্ডলা প্রতিভার আনন্দ-স্ফূর্ত্তি। কবি আপনাকে চিনিয়াছেন, আপন হৃদয়ের প্রতিভা-মূর্ত্তির পরিচয় পাইয়াছেন, কিন্তু সে তখনও বন্য, অসামাজিক, সামুদ্রিক।…. নবীনচন্দ্রের যেমন ‘পলাশীর যুদ্ধ’, তেমনই বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কপালকুণ্ডলা’—উভয়ের কোন অর্থ নাই, purpose নাই। তবু সুন্দর, অদৃষ্টপূর্ব্ব, একক সৌন্দর্য্য!  কপালকুণ্ডলা tale নহে, উপন্যাস নহে, উহা গদ্যরীতির কাব্যনাটক, গ্রীক নাটক।” (শশাঙ্কমোহন সেন)

 

—অর্থাৎ, ‘কপালকুণ্ডলা’র নিজস্ব বৈশিষ্ট্য—কবি তাহাকে যে রূপ দিয়াছিলেন তাহার সেই রূপ—পূর্ণ প্রস্ফুটিত হইয়াছে, ইহাই তাহার দোষের কারণ! অতএব ইহা যে একখানি উচ্চাঙ্গের কাব্য, লেখক প্রকারান্তরে তাহাই স্বীকার করিয়াছেন; তিনি তাহার রূপ-রসে মুগ্ধ হইয়াও, অতিমাত্রায় তত্ত্বপিপাসু ও অর্থসন্ধানী বলিয়া, ‘পলাশীর যুদ্ধ’ ও ‘কপালকুণ্ডলা’কে (তাহাদের কল্পনার রোমান্টিক প্রবৃত্তির জন্য) শ্রদ্ধা করিতে সঙ্কোচ বোধ করিয়াছেন। শেকসপীয়ারের অমর নাটকগুলিকেও সমসাময়িক বিদ্বজ্জন, এবং পরে অষ্টাদশ শতাব্দীর ইংরেজ সাহিত্যিক সমাজও এই চক্ষে দেখিতেন। কিন্তু লেখক স্পষ্টই নিন্দাচ্ছলে স্তুতি করিয়াছেন— ‘কপালকুণ্ডলা’র সৌন্দর্য্যে তিনি মুগ্ধ ও বিস্মিত, কিন্তু তাহার মূলে তিনি কোন তত্ত্ব আবিষ্কার করিতে পারেন নাই বলিয়া, তাহার প্রতি বিমূখ হইয়াছেন—আর কোন কারণে নহে। তথাপি সমালোচকের ঐ শেষ মন্তব্যটি অতিশয় যথার্থ ও মূল্যবান—এমন উক্তি সেকালের কোন সমালোচক করিতে পারিতেন না। আমি এই মন্তব্যগুলি উদ্ধৃত করিয়াছি, তাহার কারণ, আমার আলোচনায় ঐ মন্তব্য-নিহিত প্রশ্নগুলির মীমাংসা-উক্তির প্রতিবাদ ও সমর্থন, দুইই পাওয়া যাইবে।

“কপালকুণ্ডলা tale নহে, উপন্যাস নহে, উহা গদ্যরীতির কাব্য-নাটক, গ্রীক নাটক”—এই উক্তি অধিকাংশে সত্য। ইহাতে আখ্যান-রচনার কৃতিত্ব আছে—খাঁটি উপন্যাসের নৈপুণ্য নাই; চরিত্রসৃষ্টিতে উৎকৃষ্ট রোমান্টিক কল্পনা আছে; ঘটনা-সংস্থান নাটকীয় লক্ষণযুক্ত। নাটকীয় লক্ষণ ইহার গঠনেও পরিস্ফুট হইয়াছে। প্রথমতঃ, ইহার কলেবর অতিশয় ক্ষুদ্র; দ্বিতীয়তঃ, ইহাকে স্পষ্ট চারিটি অঙ্কের মত চারিটি খণ্ডে বিভক্ত করা হইয়াছে (এই রীতি বঙ্কিমচন্দ্রের অন্যান্য উপন্যাসেও লক্ষণীয়), পরিচ্ছেদগুলি যেন এক একটি গর্ভাঙ্ক। কাহিনী-সংক্ষেপের দ্বারা ইহাতে ঘটনার দ্রুতগতি রক্ষা করা হইয়াছে, এমন কি, পরিচ্ছেদগুলির নামেও সেই দ্রুত পট-পরিবর্তনের ইঙ্গিত আছে—সবগুলিতেই অধিকরণের সপ্তমী-বিভক্তি যুক্ত করা হইয়াছে, যথা—”সাগরসঙ্গমে”, “স্তূপ-শিখরে”, “পান্থ-নিবাসে” ইত্যাদি। নাটক-হিসাবে ইহার বৈশিষ্ট্য এই যে, ইহাতে গ্রীক নাটকের মত (যথা, এস্কাইলাসের) ঘটনা-কাহিনী (plot, action) অপেক্ষা ঘটনা—সংস্থানের (situation) চমকই অধিক—একটা বজ্রবিদ্যুৎগর্ভ ভাবমণ্ডল ও তাহারই ক্রমান্বয় বিষ্ণুরণ; শেষে নিজেরই অনিবার্য্য বেগে একটা বিষম পরিণামে তাহার শান্তি বা সমাপ্তি লাভ। ইহার আখ্যান-বস্তু সামান্য, ঐ নাটকীয় রচনাভঙ্গি সেই সামান্যকে অতিশায়িত করিয়াছে। অতএব, উপন্যাস হইলেও এই রচনা একটি সম্পূর্ণ নূতন ছাঁদের গদ্যকাব্যই বটে।

 

উহার ওই কাহিনীর অন্তরালে একটি বিশেষ ভাব-বস্তু আছে, সেই ভাব-বস্তুই উহার কাব্য-প্রেরণা হইয়াছে, একথা পূর্ব্বে বলিয়াছি। এক্ষণে সেই ভাব-বস্তু কি, তাহারই একটু সবিস্তার আলোচনা করিব। উপন্যাস পাঠ করিয়া একটা যে তত্ত্ব সকলেরই বোধগম্য হইবে তাহা এই যে, উহাতে মানুষের উপরে প্রকৃতি ও সমাজ এই দুইয়ের বিপরীত প্রভাব বিশেষ করিয়া বর্ণিত হইয়াছে; কপালকুণ্ডলা আর কিছু নয়, একান্তভাবে প্রকৃতিপালিত এক মানব-কন্যা— সমুদ্র, আকাশ ও নির্জ্জন বনভূমির যে উদার উদাস প্রকৃতি, সে যেন তাহারই একটি সাকার বিগ্রহ। এই আরণ্য লতাটির মূলোৎপাটন করিয়া তাহাকে সমাজের উদ্যানে, গৃহবাটিকার প্রাঙ্গণতলে রোপণ করার ফলে একটা বিষম অনর্থ ঘটিয়াছে। এটুকু বুঝিতে বিলম্ব হয় না। কিন্তু ঐ ভাববস্তুর মূল আরও গভীর; উহার সহিত বহু তত্ত্ব জড়িত আছে—এই উপন্যাসে সেই তত্ত্বটি একটি বিচিত্র রস-রূপ ধারণ করিয়াছে।

কথিত আছে, এই উপন্যাস-রচনার পূর্ব্বে বঙ্কিমচন্দ্র আপনার মনে মনে একটি প্রশ্নের সমাধান চিন্তা করিতেছিলেন। সে প্রশ্ন এই। মনুষ্যসমাজ হইতে দূরে, প্রকৃতির নিঃসঙ্গ প্রতিবেশের মধ্যে, একটি মানবদুহিতা যদি আবাল্য জীবন যাপন করে, তবে তাহার স্বভাব বা চরিত্র কিরূপ হওয়া সম্ভব? এই প্রশ্নের মূলে রহিয়াছে য়ুরোপীয় ভাব-চিন্তার প্রভাব। নব্য ইংরেজী-শিক্ষায় শিক্ষিত, যুবক বঙ্কিমের প্রাণ তখন য়ুরোপীয় কাব্যরসে টলমল করিতেছে; একদিকে তথাকার রিনেস্যান্স (Renaissance), ফরাসী—বিপ্লব প্রভৃতির ভাবধারা, অপরদিকে ঊনবিংশ শতাব্দীর ইংরেজী সাহিত্যে রোমান্টিক ভাববিপ্লব (Romantic Revolt), ও তাহার অন্তর্নিহিত প্রকৃতিবাদ (Nature-cult, Return to Nature) তাঁহাকে উৎকণ্ঠিত করিয়াছে। এই প্রশ্নও যে ইংরেজ কবি ওয়ার্ডস্—ওয়ার্থের (Wordsworth) নব-প্রকৃতিবাদ হইতেই সাক্ষাৎভাবে তাঁহার চিত্তে সংক্রামিত হইয়াছিল, এ অনুমান অসঙ্গত নহে, যদিও তদপেক্ষা মৌলিক তত্ত্বচিন্তার সহিত তাঁহার পরিচয় থাকাও সম্ভব। কিন্তু সেইকালে কাপালিক-সম্প্রদায়ের এক বামাচারী তান্ত্রিকের সহিত নাকি তাঁহার সাক্ষাৎ হইয়াছিল—হওয়াটাও যেমন বিচিত্র নয়, তেমনই, ঐ একটি ঘটনাই দৈবের মত তাঁহার চিন্তা ও ভাবধারাকে এমন পথে প্রবর্তিত করিল যে, য়ুরোপীয় প্রকৃতিবাদ অতিক্রম করিয়া তাহা হিন্দুচিন্তার অগম-গহনে, যেন অজ্ঞাতসারেই প্রবেশ করিল—সেই প্রকৃতিরও অন্তরালে এক বিরাট দুয়ে শক্তির আভাস পাইল। তথাপি, য়ুরোপীয় কাব্য ও নব্য ভাব-চিন্তার সেই রোমান্টিক প্রকৃতি-প্রেম এ কাব্যের একটি প্রধান প্রেরণা হইয়াছে—ইহার কাব্যরসের প্রধান উপাদান হইয়াছে সেই প্রকৃতিপ্রেমের রূপবিহ্বলতা। কিন্তু এই কাব্যের অন্তরঙ্গরূপে যে প্রাকৃতিক শক্তির ভাবনা আছে তাহা সেই রূপ-রসের প্রকৃতি নয়—সকল রস, সকল হৃদয়-সংবেদনাকে স্তম্ভিত ও তুচ্ছ করিয়া, সেই প্রকৃতিরও অন্তরালে একটা বিরাট সত্তা—একরূপ Natura Naturans, একটা মূলা—প্রকৃতি— দণ্ডায়মান রহিয়াছে। সেই প্রকৃতিকে—ভারতীয় তন্ত্র বা শক্তিসাধনার সেই তত্ত্বকে—বঙ্কিমচন্দ্র যেন অজ্ঞানে, গূঢ়তর কবিপ্রেরণা ও প্রচ্ছন্ন হিন্দুসংস্কারের বশে—একটা ভাববস্তুরূপে প্রত্যক্ষ করিয়াছিলেন। ঐ কাপালিক অতিশয় গৌণ ও তির্যকভাবে তাঁহার মনে সেই তত্ত্বটির আভাস দিয়া থাকিবে। তাই কপালকুণ্ডলা-চরিত্রের একাংশে প্রকৃতি-প্রভাবের সেই ওয়ার্ডসওয়ার্থীয় লক্ষণ থাকিলেও, একটি বিপরীত লক্ষণই সমধিক প্রাধান্য লাভ করিয়াছে। সে ঐ অপর প্রকৃতির প্রভাব সে প্রকৃতি বাহ্যপ্রকৃতির একটি কল্পিত আদর্শ-রূপ নয়, সে প্রকৃতি মনুষ্যজীবনেরই একটা উদারতর পটভূমিকা নয়-মনুষ্যহৃদয়ের সহিত তাহার কোন প্রত্যক্ষ সহযোগিতা নাই। ইহার সহিত তন্ত্র-তত্ত্বের সাদৃশ্য আছে; কিন্তু ইহা খাঁটি তন্ত্রতত্ত্বও নহে, সেই তন্ত্রতত্ত্বের একটা ভাবময় অনুবেদন মাত্র ইহাতে আছে। বঙ্কিমচন্দ্র, সম্ভবতঃ—এ সময়ে ত’ নহেই, পরেও—তন্ত্রের আলোচনা বিশেষভাবে করেন নাই, বরং সজ্ঞানে, সেকালের শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মত, তিনিও তন্ত্রের প্রতি অশ্রদ্ধার ভাব পোষণ করিতেন, ঐ কাপালিক-চরিত্রই তাহার প্রকৃষ্ট প্রমাণ।

 

অতএব বেশ বুঝিতে পারা যায় যে, মনের সেই প্রশ্নই তাঁহাকে সজ্ঞানে এই কাব্যরচনায় প্রেরিত করিলেও, কাব্যসৃষ্টিকালে তিনি অন্যবিধ ভাবনার বশবর্তী হইয়াছিলেন। তাঁহার প্রকৃতি-প্রেম—সেই অতি গভীর রোমান্টিক প্রবৃত্তি—এই কাব্যে যতই উচ্ছ্বসিত হইয়া থাকুক, সেই প্রকৃতির রূপে মুগ্ধ হইয়া তিনি যেমনই একটু ভিতরে দৃষ্টি করিলেন, অমনি এমন একটা তত্ত্বের সম্মুখীন হইলেন, যাহার তুলনায় আর সকলই তুচ্ছ হইয়া যায়,—মানুষের জীবন, তাহার কামনা-বাসনা, তাহার যত কিছু আত্মাভিমান, সকলই নিরর্থক ও হাস্যকর হইয়া পড়ে। সেই তত্ত্বই একটা ভাববস্তুর আকারে এই উপন্যাসের আদি-প্রেরণা হইয়াছে, তাহাকে বুঝিতে হইলে ঐ  কপালকুণ্ডলা—চরিত্রটিকে সর্ব্বাগ্রে বুঝিয়া লওয়া আবশ্যক।

যে ভাববস্তু এই উপন্যাসের মেরুদণ্ডস্বরূপ—তাহার নিম্নপ্রান্তে আছে ঐ কাপালিক, কিন্তু আর সকলকে গৌণ করিয়া তাহার উর্দ্ধপ্রান্তে বিরাজ করিতেছে এই উপন্যাসের প্রধানা নায়িকা—কপালকুণ্ডলা। নরনারী-চরিত্রে প্রকৃতি-প্রভাবের যে মনস্তত্ত্বঘটিত মতবাদ বঙ্কিমচন্দ্রের কল্পনাকে প্ররোচিত করিয়াছিল, তাহা ঐ কপালকুণ্ডলা-চরিত্রে ব্যর্থ হইয়াছে। এই চরিত্রসৃষ্টিকালে বঙ্কিমচন্দ্র নিশ্চয় শেক্সপীয়ারের মিরাঙা—(Miranda)—চরিত্র স্মরণ করিয়াছিলেন। সেখানেও এক নির্জ্জন দ্বীপে পিতামাত্র সহচর হইয়া এক নারীশিশু বর্দ্ধিত হইয়াছে; তাহারও কোন সাক্ষাৎ সমাজ-সম্পর্ক নাই; একদিকে মুক্ত—প্রকৃতির প্রভাব, অপরদিকে তাহার ঐ স্নেহময় পিতার সঙ্গ—এবং সম্ভবতঃ রক্তের আভিজাত্যগুণে, মিরাঙা-চরিত্র যেরূপ বিকাশ লাভ করিয়াছে, সহজ বুদ্ধিতে তাহাই স্বাভাবিক বলিয়া মনে হয়। সেখানে প্রকৃতি-প্রভাবই অধিক বটে, তথাপি ঐ পিতার চরিত্রের প্রভাবও আছে, সে চরিত্রে সুকর্ষিত সামাজিক সংস্কারও বিদ্যমান। অতএব, মিরান্ডা, ঐ পিতার সংসর্গে, তাহার অজ্ঞাতসারে, মানবীয় শিক্ষা ও সামাজিক সংস্কার কতক পরিমাণে আত্মসাৎ করিয়াছে। তাহার পিতার মন্ত্রতন্ত্র-সাধনা ও ভূতপ্রেতের উপর আধিপত্য, তাহাকে একটা অতিপ্রাকৃত শক্তির বিষয়ে সচেতন ও অভ্যস্ত করিলেও, পিতার স্নেহ ও সহৃদয়তা সে সকলের প্রভাব হইতে তাহাকে মুক্ত রাখিয়াছে। অতএব যে নিয়মে মিরাঙার প্রকৃতি ঐরূপ হইয়াছে, সেই নিয়মেই কপালকুণ্ডলা-চরিত্র কিরূপ হওয়া সঙ্গত? প্রকৃতির প্রভাব যদি দুইয়ের পক্ষে সমানও হয়, প্রস্পেরো (Prospero ) ও কাপালিকের মধ্যে আকাশ-পাতাল প্রভেদ;  কপালকুণ্ডলার রক্তেও কোন বিশেষ বংশগত প্রভাবের অবকাশ নাই। বঙ্কিমচন্দ্র তাঁহার নায়িকাকে আরও মুক্ত ও অনাবৃত ভাবে প্রকৃতির মুখে স্থাপন করিয়াছেন, এবং সমাজকে আরও বেশি করিয়া দূরে রাখিবার জন্য একটি অতিশয় অসামাজিক, এমন কি, সাধারণ মনুষ্যস্বভাবের বিরুদ্ধাচারী, ঐ কাপালিকের সংসর্গে তাহাকে নিক্ষেপ করিয়াছেন। প্রকৃতি-প্রভাব এবং ঐ সংসর্গ, এই দুইয়ের মিলিত ফল, ঐ প্রকৃতিবাদের নিয়মে কি রূপ হইতে পারে? কাপালিকের সেই অতি নিষ্ঠুর আত্মসাধনা ও পৈশাচিক ক্রিয়াকলাপের সহিত আশৈশব পরিচয়ের ফলে কপালকুণ্ডলার চরিত্র তিনটি বিভিন্ন মুখে বিকাশ পাইতে পারিত; (১) সেও সেইরূপ নিষ্ঠুর হইয়া উঠিত; (২) সেই নিষ্ঠুরতার প্রতিক্রিয়া-স্বরূপ তাহার চিত্ত অতিশয় স্নেহ-কোমল, প্রেমপ্রবণ হইতে পারিত; (৩) তাহার হৃদয় অসাড় হইয়া যাইত, কোন বৃত্তিরই স্ফুরণ হইত না। ইহার কোনটাই হয় নাই। দুৰ্ব্বল হইলে তাহা অসাড় হইত সন্দেহ নাই; কিন্তু কবি এই নারীচরিত্রকে অতিশয় সুস্থ ও সবল রূপেই গ্রহণ করিয়াছেন। কপালকুণ্ডলা উদাসীন হইলেও নিষ্ঠুর নহে, বরং অপূর্ব্ব করুণাময়ী। ইহাতেই বঙ্কিমচন্দ্রের কবিদৃষ্টির প্রসার ও গভীরতা লক্ষ্য করিয়া চমৎকৃত হইতে হয়। গভীরতর দৃষ্টির প্রমাণ এই যে, তিনি কাপালিকের ঐ প্রভাবের উপরে তাহার নারী—প্রকৃতিকে জয়ী করিয়াছেন,—নারীর প্রকৃতিগত মহত্ত্বকে তান্ত্রিকের মতই স্বীকার করিয়াছেন। যে নিৰ্ম্মমতা কেবল ঔদাসীন্যই নয়, যাহা আত্মত্যাগের অসীম শক্তি এবং সর্ব্বস্বার্থশূন্যতার অপার করুণাও বটে, বঙ্কিমচন্দ্র তাহাকে, পুরুষ অপেক্ষা নারী—সুলভ বলিয়াই ধারণা করিয়াছেন, এবং সেই শক্তিকেই তিনি কপালকুণ্ডলা-চরিত্রে মূর্তিমতী করিয়া তুলিয়াছেন। কেবল সাগরের সীমাহীন তরঙ্গবিস্তার, আকাশ, অরণ্য ও নির্জ্জন বনভূমির মন্ত্রগুঞ্জরণই যথেষ্ট নয়—প্রকৃতির সেই প্রভাবও নানা কারণে মানবহৃদয়ের পক্ষে ব্যর্থ বিকৃত হইতে পারে; কেবল নারীই তাহার একটি বিশিষ্ট শক্তির বলে সেই প্রভাবকে হৃদয়ে গ্রহণ করিয়া তাহাকে আত্মসাৎ করিতে সক্ষম। কপালকুণ্ডলা নারী বলিয়াই, সে নিজে সেই মহাশক্তির প্রতীক; এইজন্য সে প্রকৃতির গভীরতর প্রভাবকেই স্বীকার করিয়া, ঐ কাপালিকের প্রভাবকে জয় করিয়াছে। এই যে চরিত্র-বিকাশ ইহা বিজ্ঞান বা মনস্তত্ত্ব, বা তাহারই অনুরূপ কোন প্রকৃতিবাদের নিয়মানুমোদিত নয়। এ চরিত্র moral নয়, un-moral; psychological নয়—mystical, spiritual। য়ুরোপীয় কাব্যে এইরূপ চরিত্রসৃষ্টি সম্ভব নয়—সেখানকার প্রকৃতি-প্রেরণাই অন্যরূপ।

 

নারী-রূপা ওই শক্তি বা প্রকৃতি সেই একই শক্তি—যাহাকে জয় করিয়া, আত্মবশ করিয়া, মূর্খ কাপালিক শক্তিমান হইতে চায়। এই কাপালিক-চরিত্র বঙ্কিমচন্দ্র নিজ প্রয়োজনমত গড়িয়া লইয়াছেন, তিনি সে চরিত্রের ভিতরে প্রবেশ করিয়া, কবিকল্পনা—সুলভ সহানুভূতিযোগে, তাহার অন্তরবাসী মানুষটাকে আবিষ্কার করেন নাই; শাইলকের (Shylock) প্রতি শেপীয়ারের যেটুকু সহানুভূতি আছে এই কাপালিকের প্রতি কবির সেটুকু পক্ষপাতও নাই; তার কারণ, তাহাকে তাঁহার পৃথক প্রয়োজন নাই, সে এই কাহিনীর একটা machinery বা অতিরিক্ত অথচ প্রয়োজনীয় অঙ্গ—সে ইহার ঘটনাধারাকে ধাক্কা দিবার বা সচল রাখিবার একটা উপায় মাত্র। আরও কারণ, বঙ্কিমচন্দ্র তন্ত্রতত্ত্ব বা তান্ত্রিক সাধনার প্রতি আদৌ শ্রদ্ধান্বিত ছিলেন না, সে কথা পূৰ্ব্বে বলিয়াছি। তথাপি শুধু কাহিনী বা ঘটনার প্রয়োজনই নয়, এই কাপালিক-চরিত্র বঙ্কিমচন্দ্রের সেই মূল ভাবকল্পনারও পুষ্টিসাধন করিয়াছে—কপালকুণ্ডলা-চরিত্রের উপরে তাহার গৌণ প্রভাব নানাদিক দিয়া সেই চরিত্রকে স্ফুটতর করিয়াছে। বঙ্কিমচন্দ্র তাহাকে একটা নিষ্ঠুর নির্মমতার মূর্তিরূপেই চিত্রিত করিয়াছেন বটে, তথাপি, প্রথম দিকে তাহার সেই নির্মমতার মধ্যেও এমন একটা আত্মস্থতা ও দৃঢ়তার আভাস আছে যে, বিতৃষ্ণা-সত্ত্বেও আমরা কেমন যেন একটু আকৃষ্ট হই, ভয়ের মধ্যেও একটু শ্রদ্ধা অনুভব করি—শক্তিমানের প্রতি দুর্ব্বল যেমন করে। কিন্তু পরে তাহার সেটুকু মহিমাও আর রহিল না, অতিশয় সাধারণ স্বার্থপর মানুষের মতই তাহার মধ্যে একটা দুর্বল, অসহায়, লোলুপ মূৰ্ত্তি দেখা দিল—হৃত-সম্পত্তি-পুনরুদ্ধারের জন্য সে অতি হীন উপায় অবলম্বন করিতেছে। ইহাতে মনে হয়, বঙ্কিমচন্দ্র ঐরূপ ব্যক্তির ঐরূপ সাধনার ঐরূপ পরিণামই যথার্থ বলিয়া স্থির করিয়াছেন। কিন্তু খাঁটি তান্ত্রিক সাধকের চরিত্র ঐরূপ নহে; সে চরিত্র আমাদের চক্ষে যতই ভ্রান্ত বা দুর্নীতি-কলুষিত হউক, তাহার একটা স্বতন্ত্র বিশ্বাস ও তত্ত্ব-নিষ্ঠা আছে—প্রকৃত সাধক যে, সে ঐরূপ দুর্ব্বল, মোহগ্রস্ত হয় না। ঐ কাপালিক শেষে যে অবস্থায়, যে উপায়ে, যাহা করিতে চাহিতেছে, তাহাতে সে আমাদের কৃপার পাত্র হইয়াছে। তান্ত্রিকের সাধনা সর্ব্বসংস্কারমুক্তির সাধনা —দেহ-মনের যতকিছু বন্ধন, যতকিছু অভিমান, যাহাকিছু আত্মাকে দুর্ব্বল করে, তাহাই উচ্ছেদ করিবার জন্য তান্ত্রিক ঐরূপ নির্ম্মমতার সাধন করে। কেবল জ্ঞানের দ্বারা, উচ্চ তত্ত্বচিন্তার দ্বারা, ভাব—সাধনার দ্বারা স্বভাব-সংশোধন করা বড়ই দুরূহ; কারণ, সেই সকল চেষ্টার মূলে স্বভাবের ক্রিয়াই থাকিবে; ভিতরে ভিতরে সেই স্বভাবই মানুষকে ভুলাইয়া, অতিশয় সূক্ষ্মভাবে প্রবঞ্চনা করিয়া, তাহার সাধনা ব্যর্থ করিয়া দেয়; তাই স্বভাবকেও নিহত করিতে হইবে। এইজন্যই যোগপন্থা ও তন্ত্রপন্থা—বৈদান্তিক সাধনা ও তান্ত্রিক সাধনায় এত প্রভেদ। বঙ্কিমচন্দ্রের এই কাপালিক কেবল সেই নির্মমতার একটা ভীষণ মূর্ত্তি মাত্র। তাহার ভবানী-ভক্তিও একটা অন্ধভক্তি বলিয়াই মনে হয়। তথাপি তাহার এই সাধন-মন্ত্রের দ্বারা সে তাহার পালিতা কন্যার সারা চৈতন্য আবিষ্ট করিয়াছে; সে যাহাকে একটা অসম্পূর্ণ জ্ঞান, এবং কতকগুলা অনুষ্ঠানের দ্বারা লাভ করিতে চায়—এখনও করে নাই, ঐ কন্যা তাহার নারীসুলভ অজ্ঞান-অনুভূতিতেই তাহাকে প্রাণে লাভ করিয়াছে, তন্ময় হইয়া গিয়াছে; সেই শক্তিকে—সেই দেবী-ভবানীকে সে বিশ্বময় দেখিতেছে, তাহার নিজের কোন স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বা ইচ্ছাশক্তি নাই। কাপালিকের সাধনার মূলে যে সত্য ছিল, তাহা কাপালিকের চরিত্রে নয়—ঐ অপর চরিত্রে প্রতিফলিত হইয়াছে; এইজন্য কাপালিক চরিত্রের যাহাকিছু নীচতা ও দুর্ব্বলতা তাহাই যেন  কপালকুণ্ডলা সংশোধন করিয়া লইয়াছে। কপালকুণ্ডলাও নিৰ্ম্মম বা মমতাহীন; কাপালিক যাহাতে সিদ্ধিলাভ করিতে পারে নাই, সে তাহাতে অনায়াসে সিদ্ধিলাভ করিয়াছে। কিন্তু সেই নির্মমতার বলেই সে অপূর্ব্ব করুণাময়ী, কাপালিকের প্রতিও তাহার করুণার অন্ত নাই। কাপালিক তাহাকে অজ্ঞান অবোধ মনে করে, এমন কি তাহার সাধনায় বিঘ্ন ঘটাইয়াছে বলিয়া তাহাকে হত্যা করিতে উদ্যত হইয়াছে; কিন্তু সেও জানে না—যে শক্তির সে আরাধনা করে সেই শক্তির সহিত তাহার ঐ কন্যা একাত্ম হইয়া গিয়াছে। কপালকুণ্ডলা-চরিত্রের সহিত কাপালিক-চরিত্রের যোগে, উপন্যাসের ভাববস্তুর যে পরিচয় পাওয়া যায়, তাহার সবিস্তার আলোচনা করিলাম।

 

পূর্ব্বে বলিয়াছি, ‘কপালকুণ্ডলা’ কাব্য হইলেও ইহার এক প্রকার নাটকীয় প্রকৃতিও লক্ষণীয়। ইহাও সত্য যে, ইহার ঘটনাধারা একটা নিদারুণ ব্যর্থতায় সমাপ্ত হইয়াছে। অতএব ইহাকে বিলাতী কাব্যশাস্ত্রের মতে ট্র্যাজেডি বলা যাইতে পারে। কিন্তু ভাল করিয়া ভিতরে দৃষ্টি রাখিলে ইহাকে ঠিক সেই আদর্শের ট্র্যাজেডি বলা যায় না। কারণ, ইহাতে—ভিতরে ও বাহিরে মানুষের জীবনগত কোন বৃহৎ সংঘর্ষ নাই, এই কাহিনীতে মানুষের জীবন বা চরিত্র বিশেষ মর্য্যাদালাভও করে নাই—একটা দুর্দ্ধর্য দুয়ে রহস্যময় শক্তির সম্মুখে মানুষ মুহূৰ্ত্তকালও দাঁড়াইতে পারে নাই। যাহাকে ‘human interest’ বলে তাহাও ইহাতে অল্প। ইহাকে প্রেমের ট্র্যাজেডিও বলা যায় না, কারণ, মতিবিবির প্রেমে সেইরূপ ট্র্যাজেডির আভাস থাকিলেও শেষ পর্যন্ত তাহা শোচনীয় না হইয়া অকিঞ্চিৎকর হইয়াছে, এবং নবকুমারের প্রেমও পৌরুষের অভাবে নিতান্তই কৃপার যোগ্য হইয়াছে। অতএব কপালকুণ্ডলা সেই বিলাতী আদর্শের খাঁটি ট্র্যাজেডি নয়।

তথাপি ইহাতে একটা ভিন্নতর ট্র্যাজেডির ইঙ্গিত আছে। ব্যক্তিবিশেষের জীবন বা চরিত্রঘটিত যে নিদারুণ পরিণাম, তাহাই মহিমান্বিত হয় নাই বটে,—ইহা ‘ওথেলো’ ‘ম্যাকবেথ’ ‘এ্যান্টনি’র ট্র্যাজেডি নয়; কিন্তু শেকসপীয়ার তাঁহার ‘হ্যামলেট’ এবং বিশেষ করিয়া ‘লীয়ারে’ যে ট্র্যাজেডি-রসের সৃষ্টি করিয়াছেন—সমগ্র মানবজীবন বা সৃষ্টির মূলে যে একটা নির্ঘুম বা অন্ধশক্তির লীলা, ও তাহারই কারণে মানুষের নিষ্ফল সংগ্রামের যে নিরাশ্বাস তাহাতে ঘনাইয়া উঠে—অথবা, ইংরেজ ঔপন্যাসিক টমাস হার্ডির (Thomas Hardy) উপন্যাসগুলিতে যে ধরণের ট্র্যাজেডি আমাদিগকে স্তম্ভিত করিয়া দেয়—’কপালকুণ্ডলা’র সহিত তাহার কিছু সাদৃশ্য আছে। তথাপি কপালকুণ্ডলা ঠিক সেইজাতীয় ট্র্যাজেডি নয়। কারণ বঙ্কিমচন্দ্র ইহাতে যে শক্তিকে জয়যুক্ত করিয়াছেন তাহার মহিমা এমনই যে, মানুষ তাহার তুলনায় আপন ক্ষুদ্রতা ও তুচ্ছতা স্বীকার করে—অভিভূত হইলেও হতাশ্বাস (demoralised) হয় না, পরাজিত হইলেও সে পরাজয়ে নিরাশ্বাস জাগিয়া থাকে না। উপন্যাসের শেষ পরিচ্ছেদের শেষ দৃশ্য স্মরণ করিলেও ইহা নিঃসংশয় হইয়া উঠিবে। সেখানে সেই শক্তিরই প্রতীক-রূপিণী মানবী—কপালকুণ্ডলা মানব-নবকুমারের প্রেম যে ভাবে প্রত্যাখ্যান করিল, এবং তাহার ফলে সেই হতভাগ্য পুরুষের জীবন-নাট্যে যে যবনিকা পড়িল, তাহা চিন্তা করিয়া পাঠকের হৃদয় যেমন মথিত হয়, তেমনই, সেই ভাবাকুলতার মধ্যেও একটি অনির্বচনীয় বৈরাগ্য বা শান্তরসের উদ্রেক হয়—ঠিক এই রস য়ুরোপীয় ট্র্যাজেডির রস নয়। আবার নবকুমার এই উপন্যাসের নায়ক হইলেও, নায়িকা কপালকুণ্ডলাই তাহার অসাধারণ চরিত্র মহিমায় উপন্যাসের আর সকল চরিত্রের মত, ঐ নায়ককেও এমন ম্লান করিয়া দিয়াছে যে, এই উপন্যাসের ট্র্যাজেডি মুখ্যতঃ তাহারই জীবনের ট্র্যাজেডি। কিন্তু তাহার সেই আত্ম—বিসর্জ্জন, আমাদের চক্ষে যেমনই হৌক, তাহার নিজের পক্ষে তাহাই একটা পরম সিদ্ধিলাভ—’a consummation devoutly to be wished’; অতএব দুঃখ করিবার কিছু নাই।

 

এই সকল কারণে, কপালকুণ্ডলা ট্র্যাজেডি হইলেও একটা নূতন রসের ট্র্যাজেডি—ইহার প্রেরণাই স্বতন্ত্র। আমি পুনরায় সংক্ষেপে তাহা বলিতেছি। খাঁটি য়ুরোপীয় ট্র্যাজেডির উপযুক্ত নায়ক-নায়িকা ইহাতে নাই; একমাত্র  কপালকুণ্ডলার চরিত্রই ট্র্যাজেডির উচ্চতম শিখরে আরোহণ করিবার উপযুক্ত বটে; কিন্তু সে চরিত্র সাধারণ মানব-চরিত্র নয়, তাই সে তাহার নিয়তিকে অনায়াসে, বিনা সংগ্রামে পরাস্ত করিয়াছে—তাহার পক্ষে কোন ট্র্যাজেডিই সম্ভব নয়। অপরগুলির মধ্যে কোথাও কঠিন প্রবৃত্তি-বিরোধ বা দুর্জ্জয় প্রবৃত্তি-বেগ নাই; মতিবিবির মধ্যে যাহা ছিল তাহা অৰ্দ্ধপথেই প্রায় নিরস্ত হইয়াছে, কপালকুণ্ডলার সহিত পুনরায় সাক্ষাতের পরে সে দ্বিধাগ্রস্ত ও নিরুদ্যম হইয়া পড়িয়াছে। যেন সেই এক শক্তিই আর সকলকে আচ্ছন্ন ও অভিভূত করিয়া ফেলে। সমুদ্রতীরের সেই মরু-ক্ষেত্র হইতে যে ঝড় প্রবাহিত হইয়াছে তাহার গতিরোধ করে এমন সাধ্য কাহারও নাই; সেই ঝড় অবাধে ও দ্রুতগতিতে সকল তুচ্ছ বাধা অপসারিত করিয়া আপন ধ্বংসকার্য্য সমাধা করিয়াছে—শেষে ভাঙন ধরা নদীর কূলে, অপর এক শ্মশানে সে তাহার প্রাপ্য বলি আদায় করিয়া লইয়াছে। সেই বলিও নবকুমার নয়— কপালকুণ্ডলা, অর্থাৎ তাহার বলি সে নিজেই। নবকুমার সামান্য মানুষ মাত্র—বড় ক্ষুদ্র; তাই অন্তিমকালে সে সেই মহাশক্তিরূপিণীর নিকটে উন্মাদের মত প্রেম ভিক্ষা করিল, পাইল কেবল করুণা— সুমহতী ক্ষমা। অতএব এই ট্র্যাজেডিতে মানুষের প্রতি কৃপা আছে, সেই কৃপার মধ্যেই করুণ-রস আছে। কিন্তু মানুষ যে কত ক্ষুদ্র—তাহার সমাজ, তাহার সংসার, তাহার সুখদুঃখ, সম্পদ-বিপদ, তাহার ন্যায়-অন্যায়, তাহার সদসৎ, তাহার চরিত্র-নীতির অভিমান, এবং প্রেমনামক তাহার সেই পিপাসার যতকিছু বিকার— সকলই যে কিরূপ মূঢ়তা, দুর্ব্বলতা ও স্বার্থপরতার নিদর্শন, এই কাব্যে তাহাই নিৰ্ম্মমভাবে প্রকটিত হইয়াছে। সেই ঝড়ের ঝাপটে যে নীড় ধ্বংস হইয়া গেল, তাহাও আকারে বা আয়তনে বড় নয়। কবির দৃষ্টি অন্যত্র নিবদ্ধ। ইংরেজীতে যাহাকে sublime বলে তাহারই রুদ্রকান্ত রূপের ধ্যানে কবি তন্ময় সেই Epic Sublimity-ই এ কাব্যের প্রধান রস। তাই, ইহাতে মানুষের বিদ্রোহী আত্মার মহিমা ঘোষণা নাই; তাহাকেও অতিক্রম করিয়া একটা বিরাট—বিশালের স্তুতি এই কাব্যের মূল প্রেরণা হইয়াছে। এ যেন অৰ্জ্জুনের বিশ্বরূপদর্শনের মতই—একটা ক্ষুদ্রতর পটভূমিকায়—আর এক প্রকার শক্তিরূপ-দর্শন। এ তুলনার উদ্দেশ্য আর কিছু নয়, ঐ তুলনা দ্বারা একটা বস্তু সহজেই হৃদয়ঙ্গম হইবে, তাহা এই যে,–এই কাব্যেও সেই এক ভারতীয় ভাবদৃষ্টির প্রেরণা রহিয়াছে; সে যে কি দৃষ্টি তাহা বুঝাইবার পক্ষে ঐ এক তুলনাই যথেষ্ট। অতএব বঙ্কিমচন্দ্রের কপালকুণ্ডলা—নাটক-রোমান্স-উপন্যাস—ট্র্যাজেডি—যে গুণযুক্ত হউক, তাহা যে একটি সম্পূর্ণ মৌলিক সৃষ্টি তাহাতে সন্দেহ নাই।

‘কপালকুণ্ডলা’র ভাব-বস্তু সম্বন্ধে কিছু বলিয়াছি, অতঃপর ইহার কাব্য-পরিচয় আরম্ভ করিলাম। ‘কপালকুণ্ডলা’র আখ্যান-বস্তু সংক্ষেপে এইরূপ।—

এখন হইতে প্রায় তিনশত বৎসর পূর্ব্বের ঘটনা। নবকুমার নামে সপ্তগ্রামবাসী এক গৃহস্থ যুবক গঙ্গা-সাগর-সঙ্গম হইতে দেশে ফিরিবার কালে ঘটনাচক্রে সমুদ্রতীরবর্তী এক নির্জ্জন বনভূমিতে সহযাত্রিগণ কর্তৃক পরিত্যক্ত হয়। ওই বনে এক কাপালিক বাস করিত, সে সেই নির্জ্জন স্থানে তাহার তান্ত্রিক সাধনার আসন করিয়াছিল। কিছুদূরে বনের অপর প্রান্তে একটি কালী মন্দির ছিল, সেই মন্দিরের অধিকারী ঐ বনের দ্বিতীয় অধিবাসী। আরও একজন ছিল ঐ কাপালিক এক কন্যাকে শৈশব হইতে পালন করিয়াছিল, তাহার নাম, কপালকুণ্ডলা।

 

নবকুমার প্রথমে সেই কাপালিকের দর্শনলাভ করে এবং তাহারই আশ্রয়ে একরাত্রি ও একদিন যাপন করে। তাহাকে দৈবপ্রেরিত মনে করিয়া কাপালিক তাহার ইষ্টদেবীর তর্পণার্থে নবকুমারকে বলি দিতে মনস্থ করিয়াছিল, আয়োজনও করিয়াছিল, কিন্তু সেই কন্যা কপালকুণ্ডলা ইতিমধ্যে নবকুমারকে দেখিয়া এবং পরে কাপালিকের অভিসন্ধি জানিতে পারিয়া তাহাকে সুকৌশলে উদ্ধার করে, এবং সেই দূরস্থ দেবীমন্দিরে তাহাকে লুকাইয়া রাখে। মন্দিরের অধিকারী সেই পূজারী বাহ্মণ এই কার্য্যে সহায়তা করিলেও, কপালকুণ্ডলার প্রতি কাপালিকের ভীষণ রোষ ও তাহার ফল কি হইবে স্মরণ করিয়া—উভয়ের বিবাহ দিয়া, নবকুমারের সঙ্গে কপালকুণ্ডলাকেও সেই স্থান হইতে চিরদিনের জন্য বিদায় করিয়া দিল— যাহাতে কাপালিক আর তাহার সন্ধান না পায়।

পথে এক চটিতে অবস্থান কালে নবকুমারের সহিত তাহার পূর্ব্ব-বিবাহিত ও বহুকাল-পরিত্যক্ত পত্নী পদ্মাবতীর সহিত হঠাৎ দেখা হইয়া গেল; সেও ঐ পথে যাত্রা করিয়া সন্ধ্যাকালে অতিশয় বিপন্ন অবস্থায় সেই একই চটিতে আশ্রয় লইয়াছিল। কিন্তু পদ্মাবতী এখন আর বাঙালী নহে; তাহার পিতা মুসলমান ধর্ম্ম গ্রহণ করিয়া আগ্রার ওমরাহ-সমাজে অতি উচ্চপদে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। পদ্মাবতীর এখন নাম হইয়াছে, লুৎফউন্নিসা; এখন সে পূর্ণবয়স্কা যুবতী; তাহার বেশভূষা, কথাবার্তা ও আদব—কায়দা অতিশয় সম্ভ্রান্ত মোগল-অন্তঃপুরিকার ন্যায়। তাই এতদিন পরে কেহ কাহাকেও চিনিতে পারিল না—বয়সের সহিত নবকুমারের চেহারার পরিবর্তন হইয়াছিল, রাত্রির অন্ধকার এবং অস্পষ্ট দীপালোকও একটা কারণ। লুৎফউন্নিসা একটা গুরুতর রাজনৈতিক অভিপ্রায়-সিদ্ধির জন্য উড়িষ্যায় গিয়াছিল, এখন এই পথে ফিরিতেছে। সঙ্গে লোকজন দাসদাসীও আছে। এইরূপ ভ্রমণকালে সে একটি ছদ্মনাম ব্যবহার করিয়া থাকে, সে নাম— মতিবিবি।

নবকুমার তাহাকে চিনিল না বটে, কিন্তু মতিবিবি তাহার নামধাম জিজ্ঞাসা করিয়া শীঘ্রই চিনিয়া ফেলিল, এবং সেই মুহূর্ত্তে অন্তরে একটা প্রবল বেদনা ও বাসনা অনুভব করিল। সে-ও আর বিবাহ করে নাই; আগ্রার বিলাস-ঐশ্বর্য্যে লালিত হইয়া সে এতদিন অতিশয় দুর্নীতিপূর্ণ ভোগসৰ্ব্বস্ব জীবন যাপন করিতেছিল। আজ তাহার বিবাহিত স্বামীকে দেখিয়া সে পুনরায় দাম্পত্য সুখভোগের জন্য আকুল হইয়া উঠিল; অথবা এইবার সে সত্যই প্রথম প্রেমে পড়িল। সপত্নী কপালকুণ্ডলাকে দেখিয়া যদিও সে তাহার রূপে ও স্বভাব-সৌন্দর্যে মুগ্ধ হইল, তথাপি আশা ছাড়িল না, কারণ সে নিজেও অসামান্য রূপবতী। ইহার কিছুদিন পরে সে আগ্রার ভোগবিলাস ত্যাগ করিয়া সপ্তগ্রামে আসিয়া একান্তে একটি সুসজ্জিত অট্টালিকায় বাস করিতে লাগিল, উদ্দেশ্য—নবকুমারকে তাহার রূপ ও ঐশ্বর্য্যের দ্বারা বশীভূত করিয়া নিজের সেই কামনা চরিতার্থ করিবে

 

এদিকে নবকুমার কপালকুণ্ডলাকে স্বগৃহে আনিয়া বড় সুখের আশায় নূতন করিয়া সংসার পাতিল। কিন্তু  কপালকুণ্ডলার প্রকৃতি এমনই যে, সে কিছুতেই সংসার বা সমাজের শাসন, এমন কি–স্নেহপ্রেমের বন্ধনও স্বীকার করিবে না। সে নিজের সুখেও সম্পূর্ণ উদাসীন, যদিও পরের প্রতি করুণাময়ী। নবকুমার যতই তাহার প্রতি প্রেম-বিহ্বল হয় সে ততই কঠিন হইয়া উঠে—সেই দুর্ব্বলতা তাহার কৃপা উদ্রেক করে মাত্র।

মতিবিবি সকল সংবাদই লইতেছিল। সে নানা ছলে নবকুমারকে নিজগৃহে আনিয়া বহুপ্রকারে তাহার প্রেমভিক্ষা করিল; নবকুমার প্রতিবার তাহা প্রত্যাখ্যান করিল। অবশেষে একদিন এইরূপ সাক্ষাৎকালে, উত্তেজিত ও অপমানিত মতিবিবির মুখে সে যখন শুনিল যে, সে তাহারই প্রথমা পত্নী পদ্মাবতী, তখন সে আরও ভীত ও চিন্তিত হইয়া সে স্থান ত্যাগ করিল, আর তথায় পদার্পণ করিল না।

মতিবিবি তাহাতেও হতাশ হইল না, বরং আরও কঠিন সংকল্প করিল। অতঃপর সে এক অভিসন্ধি করিয়া নবকুমারের গৃহসন্নিহিত নিবিড় অরণ্যে পুরুষবেশে বিচরণ করিতে আরম্ভ করিল; স্বাধীনপ্রকৃতি স্বেচ্ছাবিহারিণী সরলহৃদয়া কপালকুণ্ডলাকে ঐ বনে সে নিশ্চয় দেখিতে পাইবে, এবং ঐ পুরুষবেশেই তাহার সহিত এমনভাবে মিশিবে, যাহাতে তাহাদের সেই বন্ধুত্ব ক্রমে নবকুমারের চিত্তে ঘোরতর সন্দেহের উদ্রেক করে। এইরূপে কপালকুণ্ডলাকে স্বামীপ্রেম-বঞ্চিত করিতে পারিলেই সে অনায়াসে নবকুমারকে জয় করিতে পারিবে—ইহাই তাহার বিশ্বাস।

হঠাৎ দুইটা সুযোগ ঘটিল। বনমধ্যে প্রবেশ করিয়া সে সেই সমুদ্রতীরবাসী কাপালিকের দেখা পাইল।  কপালকুণ্ডলা কর্তৃক নবকুমারের উদ্ধারসাধনের পরে সেই রাত্রেই কাপালিক তাহাদের সন্ধানে একটা বালুস্তূপের শিখরে আরোহণ করিয়া চতুৰ্দ্দিকে দৃষ্টিপাত করিতেছিল; ঐ স্তূপের তলদেশ বর্ষার জলস্রোতে একদিকে ক্ষয় হইয়া গিয়াছিল, কাপালিক তাহা লক্ষ্য করে নাই, সেইক্ষণে সহসা স্তূপসহ ভূপতিত হইয়া তাহার দুইবাহু ভগ্ন হইয়া যায়। তথাপি সেই অবস্থাতেও বহু সন্ধানের পর এতদিনে সে নবকুমারের বাসস্থান আবিষ্কার করিয়াছে, ঐ বনের মধ্যেই সে পুনরায় তাহার আসন করিয়াছে; এবার সে কপালকুণ্ডলাকেই বলি দিবে,—এতদিন দেরী করিয়াছিল বলিয়াই দেবী তাহাকে ঐ শাস্তি দিয়াছেন, আর সে ভুল করিবে না। মতিবিবি এই কাপালিকের দ্বারা কিছু সাহায্য পাইবার আশা করিল—দুইজনে একটা ষড়যন্ত্র চলিল।

দ্বিতীয় সুযোগ এই যে, ঠিক ঐ সময়ে কপালকুণ্ডলা তাহার ননদিনী শ্যামাসুন্দরীর দুঃখমোচনের জন্য—স্বামীসহবাসবঞ্চিতা কুলীন-কন্যার পতি বশীকরণ-কার্য্যে সহায়তা করিবার জন্য—রাত্রিকালে বন হইতে একটি লতা-মূল সংগ্রহ করিতে বাহির হইয়াছিল। বনে মতিবিবির সহিত সাক্ষাৎ হইলে সে তাহার মুখে কাপালিকের পুনরাবির্ভাব ও তাহার কারণ অবগত হইল, তাহাতে তাহার পূর্ব্বজীবনের সেই সংস্কার এবং কাপালিকের প্রতি তাহার সেই পূর্ব্ব-মনোভাব আবার জাগ্রত হইল। প্রথম দিন সে সব কথা শুনিবার অবসর পায় নাই, লতা-মূলও সংগ্রহ করিতে পারে নাই, তাই পরদিন সে মতিবিবির পুরুষ-নামে স্বাক্ষরিত একখানি ক্ষুদ্রলিপি পাইয়া পুনরায় রাত্রিকালে বনে বাহির হইল; নবকুমার দেখিতে পাইয়া তাহাকে নিষেধ করিল, সে তাহাতে অসন্তুষ্ট হইয়া তাহার নিষেধ মানিল না। ইহার পর নবকুমার সেই লিপিখানিও কুড়াইয়া পাইল, লিপি পাঠ করিয়া তাহার মনে দারুণ সন্দেহ জন্মিল—হৃদয়ে বড় আঘাত লাগিল। কাপালিক পূর্বরাত্রে কপালকুণ্ডলার অজ্ঞাতসারে তাহার অনুসরণ করিয়া বনপথে নবকুমারের গৃহে প্রবেশ ও নির্গমনের দ্বারপথ দেখিয়া গিয়াছিল; আজ সে ঐ সময়ে গৃহের নিকটে থাকিয়া সকলই লক্ষ্য করিতেছিল। কপালকুণ্ডলার বহির্গমন, নবকুমারের সেই আকস্মিক দুরবস্থা ও তাহার কারণ, সকলই তাহার কার্য্যসিদ্ধির বড় অনুকূল হইল। সেই সময়ে সহসা নবকুমারের গৃহপ্রাঙ্গণে আবির্ভূত হইয়া সে তাহাকে যেমন বিস্মিত করিল, তেমনই, পুরুষবেশী মতিবিবির অবৈধ প্রণয় উল্লেখ করিয়া তাহার সন্দেহ আরও বৃদ্ধি করিল; শেষে নবকুমারকে নিঃসংশয় করিবার জন্য সে তাহাকে সঙ্গে লইয়া বনে প্রবেশ করিল, এবং কিছুদূর গিয়া একস্থানে সেই পুরুষের সহিত আলাপ-রতা কপালকুণ্ডলাকে দেখাইয়া দিল। ইহার পর নবকুমারের বুদ্ধিলোপ হইল, সেই অবস্থায় কাপালিক তাহাকে মদ্যপান করাইল, এবং তদ্বারা নবকুমারকে সম্পূর্ণ বশীভূত করিয়া, কপালকুণ্ডলাকে ধরিয়া বলি দিবার জন্য পূজার স্থানে লইয়া যাইতে তাহাকে সম্মত করিল।

এদিকে কপালকুণ্ডলা মতিবিবির মুখে কাপালিক সম্বন্ধে সকল কথা শুনিয়া অতিশয় বিচলিতচিত্তে সেই অন্ধকার বনপথ ধরিয়া গৃহে প্রত্যাবর্তন করিতেছিল। সহসা পশ্চাৎ‍ হইতে অতি গম্ভীর কণ্ঠে কে তাহাকে ডাকিল, সেই স্বরে চমকিত হইয়া কপালকুণ্ডলা ফিরিয়া দাঁড়াইল, এবং তৎক্ষণাৎ কাপালিককে চিনিতে পারিয়া তাহার হস্তে আত্মসমর্পণ করিল। কাপালিক তাহাকে গঙ্গাতীরবর্তী শ্মশানে লইয়া গিয়া বলির পূর্ব্বে স্নান করাইয়া আনিবার জন্য নবকুমারকে আদেশ করিল। মদিরার প্রভাবে নবকুমার তখন অপ্রকৃতিস্থ, সে তাহাকে লইয়া যে উচ্চ পাড়ের উপরে দাঁড়াইল-তাহা একটা ভাঙ্গনের ধার, নীচে খরস্রোত বহিতেছে। সেইকালেও  কপালকুণ্ডলার ধীর প্রশান্ত মূর্ত্তি দেখিয়া সহসা নবকুমারের নেশা ছুটিয়া গেল, সে আকুলভাবে কপালকুণ্ডলাকে তাহার সেই হৃদয়বিদারক সন্দেহ দূর করিতে বলিল। কপালকুণ্ডলা সেই সন্দেহ দূর করিল, কিন্তু আর গৃহে ফিরিতে চাহিল না। তাহাতে নবকুমার আরও ব্যাকুল হইয়া যেমনই তাহার দিকে অগ্রসর হইল, অমনিই কপালকুণ্ডলার পদতলস্থ সেই ভূমিখণ্ড ভাঙ্গিয়া—তাহাকেও লইয়া নদীগর্ভে পড়িয়া গেল; নবকুমারও সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপাইয়া পড়িল। কেহই আর উঠিল না।

এই আখ্যানে ঘটনার বাহুল্য নাই; ঘটনার ধারাও জটিল নয়, তাহার কারণ, ইহা যে-সমাজ ও গৃহ-সংসারের কাহিনী, তাহার জীবনযাত্রা অতিশয় সহজ ও সরল। অতি-স্থির প্রবাহহীন জলতলে লোষ্ট্রক্ষেপের মত দুই একটা উৎপাত মাত্র আছে, তাহাতে সেই জলরাশি বিক্ষুব্ধ হইয়া আবার আপনার খাতে পূর্ব্ববৎ বহিয়া চলে। লেখক এই জীবনযাত্রার পশ্চাতে একটা ঐতিহাসিক পটভূমিকা যুক্ত করিয়াছেন বটে—কিন্তু ইহার মূল কাহিনীটি পারিবারিক, অতিশয় সাধারণ জীবনের কাহিনী। ইহার যাহা—কিছু অভাবনীয়তা বা কাহিনীসুলভ চিত্ত-চমৎকার তাহার কারণ হইয়াছে দুইটি চরিত্র—একটি অসাধারণ, অপরটি অস্বাভাবিক। ইহার ঘটনাধারাও অবিচ্ছিন্ন নয়, এবং তাহাতেও চরিত্রগুলি সাক্ষাৎভাবে সংশ্লিষ্ট নয়; অর্থাৎ পাত্রপাত্রী নিজ নিজ স্বভাব বা প্রবৃত্তির বশে যে কৰ্ম্মজালে জড়াইয়া পড়ে, ঐ ঘটনাজাল সেইরূপ একটা কৰ্ম্মবন্ধ নহে—ঘটনাগুলি দৈবের মত বাহির হইতেই ঘটে, এবং তাহার সংঘাতে চরিত্রগুলি যেন অভিভূত হইয়া তাহাদের গূঢ়তর প্রবৃত্তি প্রকাশ করিয়া ফেলে।

এইজন্য উপন্যাস হিসাবে  কপালকুণ্ডলা বিশেষ নৈপুণ্য দাবী করিতে পারে না। মাত্র একটি কালানুক্রম-সূত্রে কতকগুলি ঘটনা গ্রথিত হইয়াছে, এবং তন্মধ্যে এমন কয়েকটি সংস্থিতির (situation) সৃষ্টি হইয়াছে, যাহাতে ঐ রোমান্টিক কাব্যকল্পনা একপ্রকার নাটকীয় রস-রূপ পরিগ্রহ করিয়াছে। নাটক হিসাবে দেখিলে ইহার ঘটনাচক্র (plot বা action) যে চারিটি খণ্ডে বা অঙ্কে নিঃশেষ হইয়াছে, তাহার প্রথমটিতেই নাটকের Crisis বা নায়ক-ভাগ্যের সেই সঙ্কট-মুহূৰ্ত্ত দেখা দিয়াছে—যাহাকে তাহার জীবনের একটা গুরুতর সন্ধিক্ষণ বলা যাইতে পারে। নবকুমারের সহিত কপালকুণ্ডলার বিবাহই সেই Crisis; তাহাতে নায়ক জয়লাভ করিয়া যেন সৌভাগ্যের পথে পদার্পণ করিল; কিন্তু তাহার পরেই ভিন্নমুখে অবতরণ, এবং Catastrophe বা পূর্ণ-পতনের সূচনা।

উপন্যাসের দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ডে সেই Catastrophe (পতন)-র বীজ দেখা দিয়াছে ও দ্রুত অঙ্কুরিত হইয়াছে। মধ্যে গতি-নিবারণের একটু সম্ভাবনা জাগিয়াছিল— হয়ত নবকুমার বাঁচিয়া গেল, কারণ মতিবিবি তখনও একটা অতিশয় উচ্চাশা পোষণ করিতেছিল; কিন্তু শীঘ্র তাহা ধূলিসাৎ হওয়ায়, এই ক্ষণরুদ্ধ পতন-বেগ শেষ খণ্ডে দুর্ব্বার হইয়া উঠিয়াছে। Crisis ও Catastrophe-র মধ্যে ঐ যে গতিবেগের একটু বিশ্রাম এবং তজ্জনিত একটা আশা বা সংশয়ের অবকাশ, উহাও একটা নাটকীয় কৌশল; এই উপন্যাসেও গ্রন্থকার সেই কৌশল করিয়াছেন—আগ্রার রাজ-অন্তঃপুরের ষড়যন্ত্র এবং মেহেরুন্নিসাকেও এই জন্য অবশ্যক হইয়াছে। অতএব ‘কপালকুণ্ডলা’র ঐ নাটকীয় প্রকৃতিই লক্ষণীয়—”কপালকুণ্ডলা tale নহে, উহা গদ্যরীতির কাব্য-নাটক, গ্রীক নাটক”–এ উক্তি যথার্থ। আখ্যানের জটিলতা থাকিলে উহা গ্রীক নাটক হইতে পারিত না। তথাপি নাটক হিসাবেও ইহার গঠনে একটু অসামান্যতা আছে, কারণ ইহাও লক্ষ্য করিতে হইবে যে, প্রথম অঙ্কেই ইহার Crisis শেষ হইয়াছে—বাকি সমগ্র ঘটনাধারা একটা বিলম্বিত Catastrophe মাত্র।

এইবার ইহার অন্তর্গত চরিত্রগুলির কথা। কাপালিকের চরিত্র স্বাভাবিক বা সামাজিক মানব-চরিত্র নয়, তাহা আমরা দেখিয়াছি। সে একপ্রকার সাধনায় সিদ্ধিলাভ করিবার আশায় সকল মনুষ্য-সুলভ সংস্কার বিসর্জ্জন দিয়াছে; তাহার যে ইষ্ট-দেবতা—তন্ত্রে তাহার বহুতর নাম আছে; সেই মহাশক্তিকে আরাধনায় তুষ্ট করিয়া সেও মহাশক্তিমান হইতে চায়। কিন্তু শেষ পর্য্যন্ত সে একটা বিকৃতমস্তিষ্ক নরপিশাচমাত্রে পর্যবসিত হইয়াছে। তাহার ঐ সংস্কৃত ভাষায় কথোপকথন এবং দুই একটি তত্ত্বকথার মত বচন শুনিয়া, এবং তাহার অসীম দেহবল ও নিষ্ঠুর মনোবল দেখিয়া প্রথমে যেমন ভয় ও বিস্ময় জাগে, পরে তাহার দুরবস্থা দর্শনে তেমনই ঘৃণা ও অশ্রদ্ধার উদ্রেক হয়। একটা অমানুষিক সংকল্প-সিদ্ধির জন্য তাহার যে একাগ্রতা, তাহাও যেন একটা ‘fixed idea’ বা একপ্রকার মানসিক ব্যাধির মত। গ্রন্থকার এ চরিত্রে মনুষ্যপ্রকৃতির বিকৃতিই বিশেষভাবে চিত্রিত করিয়াছেন; এ চরিত্র স্বাভাবিকও নয়, আবার স্বভাবকে অতিক্রম করার যে মহত্ত্ব তাহাও ইহাতে নাই।

কপালকুণ্ডলা-চরিত্রে অসাধারণত্ব আছে, তাহার কারণ পূর্ব্বে ব্যাখ্যা করিয়াছি। তথাপি, গ্রন্থকার তাহার সেই অনমনীয়, অতিমানবীয় প্রকৃতির মধ্যেও যতদূর সম্ভব রক্তমাংসের বাস্তবতা রক্ষা করিয়াছেন। প্রথমতঃ, নারী-প্রকৃতিসুলভ দুর্ব্বলতা হইতে সে সম্পূর্ণ মুক্ত নয়; পালক-পিতার প্রতি কন্যার মত স্নেহভক্তিও তাহার আছে। দ্বিতীয়তঃ, তাহারও একপ্রকার ধর্মবিশ্বাস ও তজ্জনিত মিথ্যা ভয় (superstition ) আছে—বিল্বপত্রের ঘটনা ও তাহার মনে সেই ঘটনার প্রভাবই তাহার প্রমাণ। তৃতীয়তঃ, শ্যামাসুন্দরীর দুঃখে সে যে দুঃখ অনুভব করে, তাহাও একটা সহজ নারীসুলভ সহানুভূতি। এইজন্য যদিও তাহার চরিত্রের আর সকল লক্ষণ—অতিরিক্ত সরলতা, ঘোরতর স্বার্থশূন্যতা ও চিত্তের দুর্দমনীয় স্বাধীনতা স্পৃহা –এ সকলই তাহাকে কবি—কল্পিত একটি মানসী (Ideal) প্রতিমা করিয়া তুলিয়াছে, তথাপি ঐ অপর লক্ষণগুলি সেই আদর্শকে সম্পূর্ণ অবাস্তব হইতে দেয় নাই। কিন্তু এই সকলের অন্তরালে যে একটা গুণ অপরগুলিকে অতিক্রম করিয়া বিদ্যমান রহিয়াছে—তাহার সেই কঠোর অনাসক্তি বা ঔদাসীন্য—তাহাই এই উপন্যাসের ট্র্যাজেডির কারণ হইয়াছে; সেই ঔদাসীন্যের কঠিন বেষ্টনী অতিশয় দুর্ভেদ্য বলিয়াই তাহার সহিত কোন মানুষের কোনরূপ সম্পর্ক স্থাপিত হইতে পারিল না, সেই পাষাণ প্রাচীরে প্রহত হইয়া নবকুমারও চূর্ণ হইয়া গেল।

আখ্যানভাগে আর যে দুইটি প্রধান চরিত্র আছে তাহাদের একটি—এই উপন্যাসের নায়ক নবকুমার, আর একটি ইহার অন্যতম নায়িকা—মতিবিবি।  কপালকুণ্ডলার মূল ভাব-বস্তু ও তাহার গভীরতর কাব্যরসের কথা ছাড়িয়া দিলে এই দুইটি চরিত্রই ইহার উপন্যাস-ধর্ম্ম বজায় রখিয়াছে। নবকুমার চরিত্র লইয়াই উপন্যাসের আরম্ভ, এবং আরম্ভেই লেখক তাহাকে নায়কোচিত গুণসম্পন্ন করিয়া আমাদের চিত্ত আকর্ষণ করিয়াছেন। তাহার বুদ্ধি ও বিচারশক্তি একজন সুস্থ ও সবলচিত্ত যুবকের মত; তাহার স্বভাবে যে সৎকর্ম্ম-প্রবৃত্তি আছে তাহাও পৌরুষের লক্ষণ। সে অতিশয় স্পষ্টভাষী, তাহার চিত্তও উদার ধর্ম্মশাস্ত্রের আদেশ সে অন্ধভাবে পালন করে না, তাহার মর্ম্ম গ্রহণ করিয়া থাকে। তীর্থদর্শনের ছলে সে সমুদ্র ও সমুদ্রতীরের প্রাকৃতিক শোভা দর্শন করিতে আসিয়াছে—সে ভাবুক ও কাব্যরস-রসিক। লেখক প্রথম দুই পরিচ্ছেদেই নবকুমারের চরিত্র-পরিচয় প্রায় সম্পূর্ণ করিয়াছেন। পরবর্তী ঘটনাগুলিতে, বিশেষতঃ কপালকুণ্ডলাকে বিবাহ করিয়া তাহার উদ্ধারসাধন, এবং পরে পথিমধ্যে মতিবিবির সহিত প্রথম সাক্ষাতে তাহার কর্তব্যবোধ, স্ত্রীজনের প্রতি শিষ্ট ব্যবহার, তীক্ষ্ণ আত্মমর্যাদাজ্ঞান ও সংযমের যে পরিচয় পাওয়া যায়, তাহাতে, ইংরেজীতে যাহাকে আদর্শ gentleman বলে সে তাহাই। পুরুষ-চরিত্রের এই আদর্শ আমাদের সাহিত্যে অতিশয় আধুনিক— বঙ্কিমচন্দ্রের নিজস্ব রুচির পরিচায়ক। মতিবিবির গৃহে তাহাকে প্রত্যাখ্যান করার দৃশ্যে এই চরিত্রে যে দৃঢ়তা যুক্ত করা হইয়াছে, তাহাতেও একটু আধুনিকতার ছাপ আছে।

কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, নবকুমার-চরিত্রের এই সর্ব্বাঙ্গীণ বলিষ্ঠতার পরিচয় আমরা কাহিনীর প্রথমভাগেই পাই। শেষের দিকে তাহার সেই পুরুষোচিত উদারতা ও সুস্থ বিচারবুদ্ধির অভাবই লক্ষ্য করি। এইরূপ পরিণাম ট্র্যাজেডির নায়কের পক্ষেও ঘটিয়া থাকে; অধঃপতনের কারণও সেই চরিত্রের মধ্যে নিহিত থাকে। পুরুষ যতই মহৎ হৌক, তাহার মনুষ্যসুলভ দুর্ব্বলতা থাকিবেই—কোন না কোন রন্ধ্রে শনি প্রবেশ করিয়া তাহার সেই মহত্ত্বকে নিষ্ফল করিয়া দেয়। কপালকুণ্ডলাকে বিবাহ করার পর তাহার জীবনে যে নূতন একটি অবস্থার সূত্রপাত হইল—কপালকুণ্ডলার প্রতি তাহার সেই আকস্মিক ও অতিপ্রবল অনুরাগই তাহার চরিত্রের মূল ভিত্তি শিথিল করিয়া দিল। লেখক তাহার হৃদয়কে এই প্রেমের দ্বারা বিস্ফারিত করিতে চাহিয়াছেন—এ চরিত্রের পক্ষে তাহাই স্বাভাবিক বটে; প্রেম এমন পুরুষকে আরও নিঃস্বার্থ আরও শক্তিমান করিবে। কিন্তু নবকুমারের প্রেম স্বাস্থ্য না হইয়া একটা ব্যাধিতে পরিণত হইল—একটা অস্বাভাবিক ক্ষুধার মত, রিপুর মত তাহাকে আত্মভ্রষ্ট করিল। সর্ব্বশেষে সে নিজেও তাহা বুঝিয়াছে—প্রেমের পরিবর্তে রূপমোহকেই তাহার দুরবস্থার কারণ বলিয়া আত্মগ্লানি প্রকাশ করিয়াছে (উপন্যাসের শেষ খণ্ডের শেষ পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য)। এইরূপ হইবার কারণ কি? লেখক সে বিষয়ে সম্পূর্ণ নিরুত্তর। এ চরিত্রের এইরূপ পরিবর্ত্তন সহসা অসঙ্গত বলিয়া মনে হইতে পারে। কিন্তু একটু ভিতরে দৃষ্টিপাত করিলেই ইহার কারণ অতিশয় স্পষ্ট হইয়া উঠিবে। বঙ্কিমচন্দ্রের কবিদৃষ্টি অভ্রান্তই আছে; তাঁহার সৃষ্টি-কল্পনা সৃষ্টিই করে এবং সে কল্পনা অব্যর্থ বলিয়া তিনি নিজে এই সকল গভীরতর কারণ সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হইয়া থাকেন। নবকুমারের এই অস্বাভাবিক চরিত্রভ্রংশ একটা অস্বাভাবিক কারণেই ঘটিয়াছে—সে কারণ  কপালকুণ্ডলা, সে-ই সকল অস্বাভাবিকতার নিদান। কিন্তু ইহার একটা স্বাভাবিক কারণও নির্দ্দেশ করা যায়। নবকুমারের সেই প্রথম বিবাহের পরিণাম এমনই লজ্জাজনক ও দুঃখকর হইয়াছিল—তাহার মত পুরুষের হৃদয়ে, তথা আত্মসম্মানে, এমন আঘাত লাগিয়াছিল যে, তাহার ফলে সে আর বিবাহ করে নাই; ইহা সেকালের পক্ষে একটু অসাধারণ। সম্ভবতঃ নারীর সহিত ঐ সম্পর্ক সে অতঃপর ভয় ও সন্দেহের চক্ষে দেখিত। কপালকুণ্ডলার প্রতি তাহার যে আকর্ষণ তাহার মধ্যেও এই সংস্কার জাগ্রত ছিল; তাহার অন্তরের অন্তরে যেন একটা ভয় ছিল যে, নারী-সংস্পর্শ তাহার পক্ষে কল্যাণকর হইবে না। পরে বিবাহবিমুখ নবকুমার কপালকুণ্ডলার অসাধারণ রূপ ও অদ্ভুত চরিত্রে আকৃষ্ট হইয়া, এবং—তাহার প্রতি কৃতজ্ঞতার বশেও—বিবাহ করিল; তখন এতদিনের নিরুদ্ধ, অথচ সুস্থ ও স্বাভাবিক যৌনপিপাসা যেন প্রকৃতির প্রতিশোধের মত তাহাকে আক্রমণ ও অভিভূত করিল। তথাপি তাহার প্রথমা পত্নীর সেই স্মৃতি, সেই দাহচিহ্ন সে ভুলিতে পারে নাই; ফলে, সে এই স্ত্রীর সম্বন্ধেও সন্দেহকাতর হইয়া ওঠে। বাহিরেও যেমন সেই পদ্মাবতী তাহাকে এখনও অনুসরণ করিতেছে, ভিতরেও সেই পত্নীর স্মৃতি তাহার প্রেমকে পঙ্গু করিয়া তাহার চরিত্রের এমন অবনতি ঘটাইয়াছে।

মতিবিবি-চরিত্র লেখক নিজেই এমন সবিস্তারে ও গাঢ় বর্ণে চিত্রিত করিয়াছেন এবং নিজেই তাহার যে ব্যাখ্যা করিয়াছেন, তাহার পর সে বিষয়ে অধিক কিছু বলিবার নাই বটে, তথাপি এই চরিত্র উপন্যাসের এক ভাগে এমন রসসৃষ্টি করিয়াছে যে, পাঠকের দিক দিয়া ওই চরিত্রের কাব্য-সৌন্দর্য্য বিচার করিবার পৃথক প্রয়োজন আছে। এই চরিত্রসৃষ্টিতে নারীপ্রকৃতি সম্বন্ধে বঙ্কিমচন্দ্রের গভীর কবিদৃষ্টির পরিচয় পাওয়া যায়। কপালকুণ্ডলা-চরিত্রে তাঁহার দৃষ্টি একটা ভাববস্তু বা তত্ত্বরসে নিবদ্ধ ছিল, এখানে তাহা মুক্তিলাভ করিয়াছে—সেখানে যাহার অবকাশ ছিল না, এখানে তাহার পূর্ণ অবকাশ মিলিয়াছে। কাহিনীর দিক দিয়া দেখিতে পাই, যে মুহূর্তে মতিবিবির আবির্ভাব হইয়াছে সেই মুহূর্ত্তেই উপন্যাসের আখ্যান-গ্রন্থি দৃঢ়তর হইয়াছে; নবকুমার ও  কপালকুণ্ডলার বিবাহিত জীবনের ঠিক প্রবেশপথে সেই পথের অন্তও দেখা দিয়াছে। মতিবিবি যেন নবকুমারের প্রাক্তন কর্ম্মের দুশ্ছেদ্য বন্ধন—সেই কৰ্ম্মশৃঙ্খলই এই উপন্যাসের ঘটনাকে প্রসারিত ও নিয়ন্ত্রিত করিয়াছে। জীবনে এমনই করিয়া গ্রন্থি পড়ে এবং গ্রন্থিমোচন হয়; যেন তাহার আদ্যন্ত একটা অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের কর্ম্মধারায় সুবিন্যস্ত ও সুনিয়ন্ত্রিত হইয়া আছে। জীবনের আলেখ্যরচনায় যে কবি এই তত্ত্বটি আমাদের দৃষ্টিগোচর করেন— আদ্য, মধ্য ও অন্তকে এমনই একটা নিয়মাধীন দেখাইতে পারেন, তিনিই জীবনের শ্রেষ্ঠ চিত্রকর; ঐ প্লট বা আদ্যন্তযুক্ত কাহিনীনিৰ্ম্মাণই সেইরূপ সৃষ্টি-প্রতিভার প্রধান কৃতিত্ব।

আবার, এই চরিত্রই উপন্যাসের রসবস্তুকেও নানাভাবে সমৃদ্ধ করিয়াছে। প্রকৃতি ও পল্লীসমাজের যে মূল বর্ণ-ভূমিকায় এই আখ্যান চিত্রিত হইয়াছে, তাহার উপরে একটি বিপরীত বর্ণের অত্যুজ্জ্বল ছটা উদ্ভাসিত করিয়াছে এই মতিবিবির আবির্ভাব। উহার দ্বারা মোগলযুগের সভ্যতা ও সংস্কৃতি, বিলাস ও ঐশ্বর্য্য, বৈদগ্ধ্য ও শিষ্টাচার যেমন ঐ পল্লী-প্রতিবেশের মধ্যে আরও প্রেক্ষণীয় হইয়াছে, তেমনই মতিবিবি-চরিত্রে নারীপ্রকৃতির যে আরেক রূপ—তাহার সেই দুরন্ত ভোগ-পিপাসা—তাহাও কপালকুণ্ডলা—চরিত্রের অতিশয় বিপরীত হইয়া, এই কাব্যের ভাববস্তুকে অতিশয় পরিস্ফুট করিয়াছে। আগ্রার রাজ-পরিবারের সঙ্গে সপ্তগ্রামের এক বাঙালী গৃহস্থ পরিবারের যোগস্থাপন সহজ বা স্বাভাবিক নয়—কবি সেই দুঃসাহস করিয়াছেন; যোগটা একটু কষ্ট-কল্পিত হইলেও, ইহার দ্বারা উপন্যাসের পটভূমিকাও যেমন বিস্তার লাভ করিয়াছে, তেমনই তদ্বারা রোমান্সের ইতিহাস রসও যুক্ত হইয়াছে।

 

মতিবিবি চিরন্তন নারী, পুরুষের ভোগ-সহচরী, তাহার সুখদুঃখবিধায়িনী, বাসনাকামনাময়ী, মোহিনী, নায়িকারূপিণী নারী! নারীর এই মূর্ত্তিই শ্রেষ্ঠ কবিগণের কল্পনাকে যেমন উদ্বুদ্ধ, তেমনই মূর্ছিত করিয়াছে। এই নারী প্রকৃতির নিয়মে সর্ব্বদেশে ও সর্ব্বসমাজে মুকুলিত হয়, কিন্তু সর্ব্বদা প্রস্ফুটিত হইতে পারে না। কবিগণ কাব্যে, নাটকে সেই অস্ফুট বা অর্দ্ধস্ফুট মুকুলের পূর্ণস্ফুট রূপটিকে কল্পনাচক্ষে নিরীক্ষণ করিয়া আমাদেরও চক্ষের অতি সম্মুখে স্থাপন করেন। যে কয়টি গুণ এইরূপ নারীচরিত্রের বৈশিষ্ট্য তাহার প্রায় সবই মতিবিবির চরিত্রে আছে—কামনা উদ্রেককারী (voluptuous) রূপ, প্রখর বুদ্ধি, সাহস বা প্রগল্ভতা, সুনিপুণ রসিকতা-শক্তি। কিন্তু এ সকল সত্ত্বেও মতিবিবির চরিত্র বড়, অর্থাৎ মহনীয় নয়; কবি নিজেই বলিয়াছেন, তাহার সকলই আছে, নাই কেবল—নারীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ সেই হৃদয় বা প্রেম; তৎপরিবর্তে আছে এক দুৰ্দ্দমনীয় ভোগলালসা। কিন্তু তাই বলিয়া মতিবিবি একজন সাধারণ নারীও নয়। সত্য বটে, ঐ সকল গুণ একজন উচ্চশ্রেণীর গণিকারও থাকিতে পারে, তথাপি মতিবিবি সেইরূপ সাধারণী নারীও নয়, নয় বলিয়াই সে এই উপন্যাসের খণ্ড-আকাশে সচন্দ্রতারকা বিভাবরীর মত উদয় হইয়াছে; শেষে অগ্নিময়ী উল্কার মত নিজে দগ্ধ হইয়া অতি তীব্র ও অশুভ আলোকচ্ছটা বিকীর্ণ করিয়াছে। তাহার সেই প্রবল ভোগাসক্তির মধ্যেও দুইটি বিরোধী চরিত্র-লক্ষণ ছিল—একটি তাহার অত্যুগ্র আত্মাভিমান, আরেকটি তাহার স্বাভাবিক ঔদার্য্য। এই দুইটিই তাহার ভোগ-জীবনের বাধা হইয়া শেষে তাহার সর্ব্বনাশ ঘটাইয়াছে। প্রথমটির জন্য সে আগ্রার বিলাসজীবন ত্যাগ করিয়াছিল, অথচ নবকুমারকে বশ করিবার মত নম্রতা, বিনয় ও সহিষ্ণুতা তাহার ছিল না। দ্বিতীয়টির জন্য সে কাপালিকের সহিত ষড়যন্ত্রে সম্যক সম্মত হইতে পারে নাই; সেই দ্বিধা তাহার উদ্দেশ্যসিদ্ধির কতখানি অন্তরায় হইয়াছিল তাহা ভাবিয়া দেখিবার বিষয়; সে কপালকুণ্ডলার প্রাণ বাঁচাইতে গিয়া এমন কাজ করিল যাহাতে অবস্থা আরো দারুণ হইয়া উঠিল—শেষে সব গেল। এইজন্য মতিবিবির চরিত্রসৃষ্টিতে বঙ্কিমচন্দ্রকে নারীচরিত্রের জটিলতর গ্রন্থি-মোচন করিতে হইয়াছে; কপালকুণ্ডলায় যেমন প্রকৃতি-ধ্যানমূলক ভাবকল্পনার কবিত্বই অধিক, এই চরিত্রে তেমনই নারীচরিত্রের রহস্যগভীর তলদেশে কবিকল্পনার স্বচ্ছন্দ প্রবেশ আছে।

এই উপন্যাসে কয়েকটি অপ্রধান চরিত্রও আছে; যথা-ভবানী মন্দিরের অধিকারী, মতিবিবির বাঁদী পেষমণ, মেহেরুন্নিসা ও শ্যামাসুন্দরী। এ সকলের মধ্যে মেহেরুন্নিসা—চরিত্রের সহিত এই উপন্যাসের ঘটনাগত সম্পর্ক নাই, গ্রন্থকার একটি সুযোগ সৃষ্টি দ্বারা উপন্যাসমধ্যে এই ইতিহাসপ্রসিদ্ধা নারীর একটি স্থান করিয়া লইয়াছেন, তাহাতে এ কাহিনীর শোভাবৃদ্ধি হইয়াছে। এ চরিত্র সম্বন্ধে গ্রন্থকারের মন্তব্যই যথেষ্ট। বাঁদী পেষমণ যেন মতিবিবিরূপ হীরকখণ্ডটিকে বসাইবার একটি রূপার আংটি; আংটিটি অতি সামান্য বটে, কিন্তু এই সাধারণ সামান্যা নারীর সাংসারিক বুদ্ধি ও তাহার অবস্থা-অনুযায়ী আশা-আকাঙ্ক্ষা মতিবিবির আভিজাত্য ও উচ্চাভিলাষকে তুলনায় অতিশয় লক্ষ্যগোচর করিয়াছে। যাহাকে ক্ষুদ্র মনে হইতেছে তাহারও মূল্য কম নহে; এই উপন্যাসের কল্পনামণ্ডলটি সুসম্পন্ন করিবার জন্য এই সকল খণ্ড-চরিত্র যথাস্থান অধিকার করিয়া শিল্পীর শিল্প-কৌশলের সাক্ষ্য দিতেছে। পেষমণের সহিত মতিবিবির কথোপকথন যদি বাদ দেওয়া যায়, তবে মতিবিবির কাহিনী অঙ্গহীন হইয়া পড়ে। শ্যামাসুন্দরীও ঠিক এইরূপ চরিত্র, কপালকুণ্ডলা-চরিত্রকে তুলনায় উজ্জ্বলতর করিবার জন্য ইহার বিশেষ প্রয়োজন ছিল—এই দুইটিকে একত্র স্থাপন করিয়া লেখক, সমাজ—সংসার ও প্রকৃতি এই দুইয়ের দ্বন্দ্ব অতিশয় পরিস্ফুট করিয়া তুলিয়াছেন—শ্যামাসুন্দরীর পাশে না দেখিলে আমরা কপালকুণ্ডলাকে উত্তমরূপে চিনিতে পারিতাম না। আরও দুই কারণে শ্যামাসুন্দরীর চরিত্র উল্লেখযোগ্য; প্রথমতঃ, বঙ্কিমচন্দ্র এই একটি মাত্র চরিত্রের দ্বারা এই উপন্যাসে একটু বাস্তব আবহাওয়ার সৃষ্টি করিয়াছেন; এমন সরলহৃদয় স্নেহকাতর খাঁটি বাঙালী নারী এ সমাজে এখনও সর্ব্বত্র সুলভ; দ্বিতীয়তঃ, শ্যামাসুন্দরীর সেই স্ত্রীজনসুলভ কুসংস্কার, সেকালের পক্ষে যেমন আরও স্বাভাবিক হইয়াছে, তেমনই, উহার ফলে উপন্যাসের ঘটনাধারা একটা অপ্রত্যাশিত গতিবেগ লাভ করিয়াছে, সে পক্ষে এই চরিত্র বড় কাজে লাগিয়াছে। অধিকারী-চরিত্রটিও এই কাহিনীর পক্ষে বড় প্রয়োজনীয় হইয়াছে;  কপালকুণ্ডলার জীবনের গতি সেই ফিরাইয়া দিয়াছে; কপালকুণ্ডলার চরিত্রের উপরেও তাহার প্রভাব অল্প নহে। সংসারত্যাগী ঐ পুরুষটির মধ্যে যে হৃদয়মাধুৰ্য্য প্রকাশ পাইয়াছে তাহা যেমন মুগ্ধ করে, তেমনই সে চরিত্রের নিরভিমান নম্রতা, সামাজিক শিষ্টতা ও ব্যবহার-জ্ঞান প্রভৃতি সদ্গুণে উহা আমাদের চিত্তে একটি গভীর রেখাপাত করে। কপালকুণ্ডলাকে বিদায় দেওয়ার কালে কণ্ব—কর্তৃক শকুন্তলা-বিদায়ের অনুরূপ দৃশ্য মনে পড়ে। অতএব এই অপ্রধান চরিত্রগুলিও বঙ্কিমচন্দ্রের কবিপ্রতিভার প্রকৃষ্ট নিদর্শন।

কপালকুণ্ডলা যে কিরূপ উপন্যাস তাহা পূর্ব্বে সবিস্তারে বলা হইয়াছে। তথাপি ইহা যে খাঁটি রোমান্সধর্মী তাহাতে সন্দেহ নাই। রোমান্স-জাতীয় পদ্য বা গদ্যকাব্যে যে ধরণর রসসৃষ্টি করিতে হয়, তাহার পক্ষে দূর কাল ও অপরিচিত প্রতিবেশ বড়ই অনুকূল; এইজন্য ইহা কখনও বর্তমানের কাহিনী হইতে পারে না; বরং সে কাহিনীর স্থানকাল যতই অনির্দেশ্য হয় ততই সেই রস গভীর হইয়া উঠে। প্রাচীন আখ্যান—আখ্যায়িকার এই রসই ছিল মুখ্য। কিন্তু নব্য রোমান্স-কাব্য সেই কল্পনাকে একটা বিশিষ্ট দেশ-কালের ছাপ দিয়া যাহা সচরাচর ঘটে না তাহাকে একটু বাস্তবের রূপ দিয়া, পাঠকচিত্তকে অধিকতর আকৃষ্ট করে; যাহা কল্পনামাত্র তাহারও সম্ভাব্যতা বড়ই উপাদেয় মনে হয়। আখ্যান রচনায় এইরূপ ঐতিহাসিকতার মাত্রা ও প্রকারভেদ আছে। ঐতিহাসিক চরিত্র ও ঘটনাকে কাহিনীর সহিত যুক্ত করিয়া সাধারণ মানুষের জীবনকাহিনীকেই গৌরবদান করা হয়। রবীন্দ্রনাথ এ সম্বন্ধে যে মন্তব্য করিয়াছেন তাহা এ প্রসঙ্গে অতিশয় মূল্যবান; তিনি লিখিয়াছেন—

“যাহা স্বভাবতই আমাদের হইতে দূরস্থ, যাহা আমাদের অভিজ্ঞতায় বহিবৰ্ত্তী তাহাকে কোন একটা ছুতায় খানিকটা প্রকৃত ঘটনার সহিত বাঁধিয়া দিতে পারিলে পাঠকের প্রত্যয় উৎপাদন লেখকের পক্ষে সহজ হয়। রসের সৃজনটাই উদ্দেশ্য, অতএব সেজন্য ঐতিহাসিক উপকরণ যে পরিমাণে যতটুকু সাহায্য করে সে পরিমাণে ততটুকু লইতে কবি কুণ্ঠিত হন না।

ইতিহাসের সংস্রবে উপন্যাসে একটা বিশেষ রস সঞ্চার করে; ইতিহাসের সেই রসটুকুর প্রতি ঔপন্যাসিকের লোভ, তাহার সত্যের প্রতি তাঁহার কোন খাতির নাই। [ ‘ঐতিহাসিক উপন্যাস’–সাহিত্য ]

‘কপালকুণ্ডলা’কে কি অর্থে ঐতিহাসিক উপন্যাস বলা যাইতে পারে? ইহাতে কোন বৃহৎ ঐতিহাসিক পটবিস্তার নাই, নায়ক-নায়িকার কেহই ইতিহাসপ্রসিদ্ধ ব্যক্তি নহে। তথাপি ইহাতেও ইতিহাস—রস আছে। ইহার কাহিনী বর্তমানের নহে, তাহাতে মোগলযুগের আবহাওয়া রহিয়াছে; সংসার ও সমাজ-চিত্রে প্রাক্-আধুনিক যুগের ছাপ রহিয়াছে। রবীন্দ্রনাথ ইহাকেই কাব্যের ইতিহাস -রস বলিয়াছেন, ইহার অধিক না বলিলেও চলে।

য়ুরোপীয় সাহিত্যে ঐতিহাসিক উপন্যাসের যে নানা রূপ ও ভঙ্গি দেখা দিয়াছে, তাহার কলা-কৌশলেরও অন্ত নাই; এখানে সে আলোচনা অবান্তর। ‘কপালকুণ্ডলা’ সম্বন্ধে কেবল ইহাই বলা সঙ্গত হইবে যে, ইহা কোন বিশেষ আদর্শের ঐতিহাসিক উপন্যাস না হইলেও, একরূপ ইতিহাস-রস যখন ইহার কাব্যরসকে সমৃদ্ধ করিয়াছে তখন এক অর্থে ইহাও ‘ঐতিহাসিক উপন্যাস’ বা ইতিহাসগন্ধী রোমান্স। বঙ্কিমচন্দ্রের অপর কয়েকখানি উপন্যাসে ইতিহাসের সংস্রব কিছু অধিক থাকিলেও, সেগুলিও ঠিক এই অর্থে ঐতিহাসিক উপন্যাস— সেখানেও, ইতিহাসের সত্য নয়, ঐ ইতিহাস—রস সঞ্চারিত করাই কবির একমাত্র উদ্দেশ্য।

‘কপালকুণ্ডলা’র ভাববস্তু সম্বন্ধে আর একটি প্রশ্ন উঠিতে পারে—এই কাব্যে এক প্রকার অদৃষ্ট বা অখণ্ডনীয় নিয়তির ক্রিয়া যেন অতিশয় প্রকট হইয়া উঠিয়াছে। ঐ কাহিনীর মূলে যে মহাশক্তির লীলা আছে বলিয়াছি, অথবা যে শক্তির মহিমাই এ কাব্যের কল্পনা-বস্তু হইয়াছে, তাহাকেই যদি ‘অদৃষ্ট’ বা সৰ্ব্বজয়ী নিয়তি বলা হয়, তবে ‘কপালকুণ্ডলা’র অদৃষ্টবাদকে একটু ভিন্ন বা বিশেষ অর্থে গ্রহণ করিতে হইবে। কপালকুণ্ডলার কাহিনীতে, তাহার ঘটনাধারার গতি ও প্রকৃতিতে, আমরা যেন একটা দুর্ব্বার ও প্রচ্ছন্ন শক্তির লীলা লক্ষ্য করি বটে, কিন্তু একমাত্র কপালকুণ্ডলার চিত্তে ও চরিত্রে সেই শক্তির সজ্ঞানতা এবং ভবিতব্যের দৃঢ়মূল দেখিতে পাই; নতুবা এই উপন্যাসে যাহা কিছু ঘটিয়াছে তাহা মানব-প্রকৃতির বা বহিঃপ্রকৃতির নৈসর্গিক নিয়মেই ঘটিয়াছে, ইহার দৈবসংঘটনকে সাধারণ অর্থে দৈবই বলা যায়, অদৃষ্টমূলক বলা যায় না। ‘বিষবৃক্ষ’ উপন্যাসেও কুন্দনন্দিনীর স্বপ্ন ও সেই চরিত্রে তাহার প্রভাব, এই প্রসঙ্গে তুলনীয়।  কপালকুণ্ডলার ঐরূপ ভয়ের কারণও মনস্তত্ত্বের দ্বারাই ব্যাখ্যা করা যাইতে পারে। অতএব প্রকৃতির নিয়মকেই যদি ‘নিয়তি’ বা ‘অদৃষ্ট’ বলা যায়, তবে ‘কপালকুণ্ডলা’য় অদৃষ্টবাদের সমর্থন আছে। কপালকুণ্ডলার ঐ যে ভবিতব্যে বিশ্বাস, উহাও তাহার চরিত্রের একটি লক্ষণ। কপালকুণ্ডলা সেই অদৃষ্টকে কি চক্ষে দেখে? তাহাকে সে ভবানীর ইচ্ছা বলিয়াই, অতিশয় নিশ্চিন্ত, নির্বিকারভাবে, এমন কি আনন্দের সহিত বরণ করিয়া লয়। বনপথে প্রত্যাবর্তনকালে সে আকাশে যে ভৈরবী—মূৰ্ত্তি দেখিতেছে (চতুর্থ খণ্ড, অষ্টম পরিচ্ছেদ), তাহার সেই ভীষণ সঙ্কেতও সৰ্ব্বসংশয় দূর করিয়া তাহাকে যেন আশ্বস্ত করিল। তাহার নিকটে সেই অদৃষ্ট বা ভবিতব্য আর কিছু নয়—সেও যেন এক মহাশক্তির মঙ্গলময় বিধান, তাহাতে সৃষ্টির সত্যই আছে; ঐ ভবিতব্যের অব্যর্থতা একটা অন্ধ নিষ্ঠুর কিছু নয়, উহাতেই গূঢ়তর ও মহত্তর কল্যাণ নিহিত আছে। অতএব কপালকুণ্ডলার ঐ ‘অদৃষ্ট’ সাধারণ মানবীয় সংস্কারের ‘অদৃষ্ট’ নয়—উহা সেই দুর্জ্ঞেয় রহস্যময় শক্তিরই লীলা। এ কাব্যের ভাবনা-কল্পনা যেমন সৰ্ব্বাংশেই মৌলিক, তেমনই ইহার প্রত্যেকটি সমস্যা সেই এক ভাববস্তুর অনুগত; এই ‘অদৃষ্ট’ও সেই ভাববস্তুর একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ—অথবা তাহারই আর এক রূপ। এই ভাববস্তুকেই একজন বিদেশী সমালোচক আখ্যা দিয়াছেন— “a mystic form of Eastern thought”; বস্তুতঃ কপালকুণ্ডলার কবিকে সেই ভারতীয় তত্ত্ববাদের একটা গূঢ়-গভীর প্রেরণাই আবিষ্ট করিয়াছে; ‘mystic thought’ অর্থে—চৈতন্য-গহনের অপরোক্ষ অনুভূতি; এইজন্যই ইহার রস-রূপ সুনির্দেশ্য নয়—ইহা অতিমাত্রায় রোমান্টিক হইয়াছে। আমি উক্ত সমালোচকের সম্পূর্ণ উক্তিটিই এখানে উদ্ধৃত করিয়া দিলাম, তাহাতে বাঙালী পাঠক পাঠিকা বুঝিতে পারিবেন, এ কাব্য একজন বিদেশী সাহিত্যবিদকেও কিরূপ মুগ্ধ ও বিস্মিত করিয়াছে; এই উদ্ধৃতির জন্য আমি বঙ্গীয়—সাহিত্য-পরিষৎ-সংস্করণের নিকট ঋণী। উক্তিটি এই—

“The force that moves the whole with emotion, and gives to it its subtle spell, is the mystic form of Eastern thought that clearly shows the new forms that lie ready for inspiring a new school of fiction with fresh life. Outside the Marriage de Loti there is nothing comparable to the  Kapalkundala in the history of Western fiction.” [R. W. Fraser: Literary History of India ] লেখক বলিয়াছেন ‘The force that moves’ ইত্যাদি—কপালকুণ্ডলার অদৃষ্টবাদ সেই এক শক্তিরই তত্ত্ববাদ—যে শক্তি অদৃষ্ট হইতেও বড়, মানুষের চিন্তা মানুষের ভাষা যাহাকে স্পর্শ করিতেও পারে না। ইহাকে শোপেনহাউয়ের (Schopenhauer) বা হার্ডির ‘Will’ বলা যাইতে পারিত, কারণ এই শক্তির অদৃশ্য আকর্ষণে উপন্যাসের পাত্রপাত্রীগণ যেন সম্পূর্ণ অবশে একটা নিশ্চিত পরিণামের দিকে ছুটিয়াছে বলিয়া মনে হয়; যেন একটা দুর্নিবার fatalism সমগ্র জীবনের উপরে ছায়া বিস্তার করিয়াছে। কিন্তু তখনই স্মরণ হয় যে, ঐ শক্তির মহিমা এমনই যে, তাহার সম্মুখে মানুষের মঙ্গল-অমঙ্গলের কোন অর্থই নাই, তাহার এই নির্ম্মমতাও বন্দনীয়—সেই শক্তিকে বরণ করিয়া তাহার সমকক্ষ বা তাহার সহিত একাত্ম হইতে পারাই মানব-জীবনের নিঃশ্রেয়স।

শেকসপীয়ারের ট্র্যাজেডিগুলিতেও যে নিয়তির লীলা আছে বলিয়া মনে হয়, একজন মনীষী আধুনিক সমালোচকের মতে, তাহা একটা ভ্রান্ত ধারণা। তিনি বলিয়াছেন, উহা একটা ‘blank necessity’ নয়—একটা ‘moral necessity’; অর্থাৎ উহার দ্বারা সৃষ্টিমূলে একটা ‘শিব’ বা ‘মঙ্গল’-এর আধিপত্যই সূচিত হয়। কপালকুণ্ডলার কল্পনামূলে যে অদৃষ্ট বা নিয়তির আভাস আছে তাহা এইরূপ মানবীয় সংস্কারের মঙ্গল-অমঙ্গল —বোধকে তৃপ্ত করে না। উক্ত সমালোচক যে বলিয়াছেন—

But the name ‘fate’ may be intended to imply something more-to imply that this order is a blank necessity totally regardless alike of human weal and of the difference between good and evil, or right and wrong. [ A. C. Bradley : Shakespearean Tragedy, p.30. 1

—এখানে যেন সেই ‘fate’-এর লক্ষণই সমধিক পরিস্ফুট হইয়া উঠিয়াছে। অতএব পাশ্চাত্ত্য সমালোচক ইহাকে শেকসপীরীয় ট্র্যাজেডির লক্ষণ বলিবেন না; বড় জোর উহার ঐ নিয়তিকে একটা গূঢ়তর তত্ত্ববাদের (mysticism) অন্তর্ভুক্ত বলিয়া মনে করিবেন। পূর্ব্বোদ্ধৃত আর এক ইংরেজ সমালোচকের মন্তব্য তাহারই সাক্ষ্য দিতেছে। ইহার কারণ, আমি পূর্ব্বে নির্দ্দেশ করিয়াছি—য়ুরোপীয় জীবনদর্শনে morality বা ন্যায়-অন্যায়ের সংস্কার এমনই বদ্ধমূল যে, সর্ব্বসংস্কারমুক্তির সেই ভারতীয় সাধনা ও তদনুগত বিরাট বা ভূমার উপলব্ধি— যাহা কেবল অনুভবযোগ্য, প্রকাশযোগ্য নহে—তাহাই তথাকার ভাষায় ঐ এক mystic নামে সকল জিজ্ঞাসার বহির্ভূত হইয়া থাকে; আমিও পূর্ব্বে ঐ শব্দটি ব্যবহার করিয়াছি, কিন্তু ঠিক ঐ অর্থে নহে। যাহা moral নহে তাহাই দুৰ্ব্বোধ্য ও ভীতিজনক, তাহাই অবস্থা বা ঘটনা-বিশেষে অন্ধ—নিয়তির রূপ ধারণ করে। কিন্তু ‘কপালকুণ্ডলা’র কবি এই শক্তিকে ভিন্নরূপে ভাবনা করিয়াছেন, সেইজন্যই  কপালকুণ্ডলার চরিত্র ঐরূপ হইয়াছে এবং নবকুমার ও মতিবিবি কেহই পৃথক্ চরিত্র-মহিমা লাভ করে নাই—করিলে moral necessity-র প্রশ্ন উঠিতে পারিত, সে প্রশ্ন এখানে যেন অবান্তর। ‘কপালকুণ্ডলা’য় যে শক্তির লীলা আছে তাহা ঐরূপ নিয়তি নয়, তাহা ‘অদৃষ্ট’ বটে, কিন্তু তাহা একটা পরম সত্যের মত অন্তর-গভীরে ‘দৃষ্ট’ হইয়া থাকে; তখন তাহাকে স্বীকার করিয়া, অন্তরে বরণ করিয়া, সাভয় ও সংশয়ের পারে যাওয়া যায়। যতক্ষণ ইহা ‘অদৃষ্ট’ থাকে ততক্ষণই ভয়—মানুষের হৃদয়-দৌর্বল্যই তাহার কারণ। ‘কপালকুণ্ডলা’য় সেই শক্তির যেন একটা ঝলক আকস্মিক বজ্রদীপ্তির মত ফুটিয়া উঠিয়াছে, দুর্ব্বল মানুষ তাহা সহ্য করিতে পারিল না, কিন্তু তাই বলিয়া তাহা অন্ধ-নিয়তি নহে।

তথাপি, যদি এই কাহিনীর কোন অংশে অদৃষ্টবাদের ইঙ্গিত থাকে, তবে তাহা নবকুমারের জীবনে অন্যভাবে আছে, তাহাও ঠিক অদৃষ্টবাদ নয়, হিন্দুর কৰ্ম্মফলবাদ। নবকুমার পূর্ব্বে যে একবার বিবাহ করিয়াছিল তাহারই দুর্লঙ্ঘ্য কৰ্ম্মফল তাহাকে নির্মমভাবে অনুসরণ করিয়াছে; পদ্মাবতীর সহিত সেই বিচ্ছেদে নিশ্চয় এমন একটা কিছু ছিল, যাহার জন্য স্বামী-স্ত্রী উভয়েই দায়ী (তৃতীয় খণ্ড, ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য), তাহাতেই যে বিষপাত্র প্রস্তুত হইয়াছিল উভয়কেই তাহা পান করিতে হইয়াছে। আমার মনে হয়, কাহিনীর অন্তর্গত এই তত্ত্বটি অনেকের দৃষ্টি এড়াইয়া গিয়াছে, কিন্তু ইহাই একহিসাবে সমগ্র আখ্যানটিকে একটি গভীরতর জীবন-সত্যের মহিমায় মণ্ডিত করিয়াছে।

এইবার কপালকুণ্ডলার কয়েকটি বিশিষ্ট কাব্য-লক্ষণ বা কলা-কৌশলের কথা বলিব :—

১। রোমান্টিক কল্পনার কতকগুলি উপাদান এই উপন্যাসের কাব্যগুণ বৃদ্ধি করিয়াছে, যথা—নির্জ্জন অরণ্য ও সমুদ্রতীর; অপরিচিত দেশ, দুর্গম পথ, দস্যুভয়; আভিজাত্যের ঐশ্চর্য্য, অতীতের মায়া; অতিশয় সরল, অনাড়ম্বর জীবনযাত্রা। কিন্তু ইহার প্রধান রোমান্টিক কাব্যরস হইয়াছে সেই বস্তু, ইংরেজীতে যাহাকে বলে grotesque ও bizarre; একটা দুয়ে-ভীষণ অনৈসর্গিক ভাবের ঘটনা ও চরিত্রসৃষ্টিতে, ঐ তান্ত্রিক কাপালিক ও তাহার ক্রিয়াকলাপে, সেই রস সর্বত্র সঞ্চারিত হইয়াছে। ইহাও লক্ষণীয় যে, এই কাহিনীর আরম্ভ হইয়াছে যেরূপ ভীষণ-গম্ভীর প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে শেষও হইয়াছে প্রায় অনুরূপ প্রতিবেশে।

২। ইহার রোমান্টিক ভাবমণ্ডল, তথা নাটকীয় অবস্থাসঙ্কটকে ঘনীভূত করিয়াছে আর একটি কল্পনা-কৌশল—একটা দুর্লঙ্ঘ্য নিয়তি বা ভবিতব্যের অবতারণা; ইহাও ট্র্যাজেডি-রসকে পুষ্ট করিবার একটি প্রকৃষ্ট কৌশল, ইহাও একপ্রকার দুর্জ্ঞেয়তার রহস্য—রসে পাঠকের চিত্ত অভিভূত করে। শেক্‌সপীয়ার তাঁহার বড় নাটকগুলিতে প্রায় সৰ্ব্বত্র এইরূপ কৌশল অবলম্বন করিয়াছেন—কোথাও দৈবজ্ঞের ভবিষ্যৎ-বাণী, কোথাও নায়ক বা নায়িকার চিত্তে অজ্ঞাত বিপদের আশঙ্কা, কোথাও স্বপ্নদর্শন, কোথাও বা প্রেতমূৰ্ত্তি বা ডাইনী প্রভৃতির আবির্ভাব। ‘কপালকুণ্ডলা’র কবিও সেইরূপ কলা-কৌশলের সুযোগ লইয়াছেন। উহার মূলে কোন বিশ্বাস বা মতবাদের প্রতিষ্ঠা নাই (পূর্ব্বে দ্রষ্টব্য)।

৩। এ কাব্যের কল্পনামুখে কয়েকটি দ্বন্দ্ব (contrast 3 antithesis) প্রচ্ছন্নভাবে বিদ্যমান রহিয়াছে; একাধারে একপ্রকার দ্বন্দ্বের ব্যঞ্জনা ইহার ভাবৈশ্বর্য্য বৃদ্ধি করিয়াছে। প্রথমতঃ, প্রকৃতি ও সমাজ—এই দুইয়ের মূলগত বিরোধ এই উপন্যাসে নানারূপে প্ৰকাশ পাইয়াছে, শুধুই প্রতিকূল নয়—অনুকূল সম্বন্ধের আভাসও আছে। কাপালিক—চরিত্রে মানবপ্রকৃতির বিকার যেমন তাহার লাঞ্ছনার কারণ হইয়াছে, তেমনই কপালকুণ্ডলায় সেই প্রকৃতি স্বাভাবিক মানবিকতাকে লঙ্ঘন করিয়াই, সমাজ-ধর্ম্মের উপরে আধ্যাত্মিক প্রকৃতি-ধর্ম্মের জয় ঘোষণা করিয়াছে। এখানে প্রকৃতি ও সমাজের মুখোমুখি বিরোধ।  কপালকুণ্ডলা ও কাপালিক এবং কপালকুণ্ডলা ও নবকুমারের মধ্যে লেখক আর একটি বিরোধ বা বৈসাদৃশ্যের স্পষ্ট ইঙ্গিত করিয়াছেন—তাহা নারী ও পুরুষের প্রকৃতিগত পার্থক্য। আরও কয়েকটি দ্বন্দ্বের আভাস ইহাতে আছে; যেমন মতিবিবি ও কপালকুণ্ডলা যেন দুই সম্পূর্ণ বিপরীতের—একটি ত্যাগ ও অপরটি ভোগের—প্রতীক। এতদ্ভিন্ন, দৈব ও পুরুষকার, বুদ্ধি ও কুসংস্কার প্রভৃতি নানা বিপরীত—বোধের উপকরণ ইহাতে আছে। প্রেমেরও দুই বিপরীত রূপ ইহাতে স্থান পাইয়াছে—একটি সমাজবিরুদ্ধ, স্বাভাবিক বা প্রকৃতিসঙ্গত; অপরটি সামাজিক-সংস্কার-শাধিত; কবি ইহার কোনটিকে ক্ষুদ্র করেন নাই বলিয়া এই দ্বন্দ্ব অতিশয় গভীর ও উজ্জ্বল হইয়া উঠিয়াছে। প্রকৃতিরও দুই মূর্ত্তির দুইরূপ প্রেরণা এই কাব্যের বৈচিত্র্য সম্পাদন করিয়াছে—একদিকে তাহার রোমান্টিক ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য প্রত্যক্ষরূপ, অপ্রদিকে ভারতীয় প্রকৃতিতত্ত্বের অধ্যাত্ম-রস।

৪। কাব্যকলার দিক দিয়া অভিনব সৌন্দৰ্য্যসৃষ্টির মূলেও রহিয়াছে ঐ দ্বন্দ্ব বা contrast। ঐ দ্বন্দ্ব ভাবগত হইলেও, কাব্যের রূপ-কলায় তাহাদের কয়েকটি বড় কাজে লাগিয়াছে। পান্থনিবাসে মতিবিবির আকস্মিক সমাগমে তাহার সেই ঐশ্বর্য্য ও অবস্থার জাঁকজমক দরিদ্র-দম্পতির চিত্রটিকে অধিকতর উজ্জ্বল করিয়াছে। অতিশয় অনাড়ম্বর পল্লীজীবন-কাহিনীর মধ্যে আগ্রা-দিল্লীর অন্তঃপুর, ও আমীর ওমরাহের বাদশাহী বিবরণ অতিশয় চমকপ্রদ হইয়াছে। চরিত্র-চিত্রণেও মতিবিবি ও মেহেরউন্নিসা এবং কপালকুণ্ডলা ও শ্যামাসুন্দরী যেন দুই বিভিন্ন জগতের অধিবাসী—এজন্য তুলনায় তাহাদের মূর্তিগুলি অতিশয় চিত্তাকর্ষক হইয়াছে।

৫। উপন্যাসের প্রতি পরিচ্ছেদের শিরোদেশে যে একটি করিয়া কবি-বচন উদ্ধৃত হইয়াছে, এ কাব্যের রসপুষ্টির পক্ষে তাহার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করিতে হইবে। এই কলা-কৌশলটি বঙ্কিমচন্দ্র স্কটের (Sir Walter Scott) উপন্যাস হইতে গ্রহণ করিয়া থাকিবেন। উহার দ্বারা প্রত্যেক পরিচ্ছেদের ঘটনা যেন একটি বিশেষ গুরুত্ব লাভ করিয়াছে—যেন এইরূপ ঘটনা একটা শাশ্বত নিয়মেই ঘটিয়া থাকে, অন্যত্রও এমনই ঘটিয়াছে। বঙ্কিমচন্দ্র তাঁহার আর কোন উপন্যাসে এই কৌশল অবলম্বন করেন নাই, তাহাতে মনে হয়, তিনি ঐ কৌশলটিকে একমাত্র এই কাব্যের বড়ই উপযোগী মনে করিয়াছিলেন। উহাও এই কাব্যের রোমান্স-রসকে গাঢ়তর করিয়াছে। এই উদ্ধৃত বচনগুলি যেমন সংক্ষিপ্ত তেমনই সুপ্ৰযুক্ত হইয়াছে, তাহাদের প্রাসঙ্গিক ভাব-সাদৃশ্য দেখিয়া বিস্মিত হইতে হয়।

৬। কিন্তু এই কাব্যের সর্ব্বাধিক কাব্যগুণ—তাহার দৃপ্ত কবিত্ব, কল্পনার দিব্যস্ফূর্ত্তি। প্রথম হইতেই সে কল্পনা একমুখে ও সমান গরিমায় অগ্রসর হইয়াছে; কাব্যে যাহা ক্রমে ছড়াইয়া পড়িয়াছে, সেই ভাব-সৌন্দর্য্যের আবেশ কবি-চিত্তকে যেন সহসা একটা জ্যোতিঃ-দর্শনের মত চমকিত করিয়াছে। এইজন্য এ কাব্যের unity of inspiration এমন লক্ষণীয়। যে-সৌন্দর্য্য এবং যে-ভাববস্তুকে কেন্দ্র করিয়া এই কাহিনী আরব্ধ ও সমাপ্ত হইয়াছে, কবি প্রথমেই তাঁহার সেই অবাস্তব-রমণীয় মানসী-প্রতিমাকে যেরূপ অপ্রত্যাশিতভাবে এবং পরিপূর্ণ মহিমায় আমাদের সম্মুখে আবির্ভূত করিয়াছেন, তাহাতেই সমগ্র কাব্যখানির রসরূপ মুহূর্ত্তে উদ্ভাসিত হইয়া উঠিয়াছে।  কপালকুণ্ডলার সেই যে প্রথম আবির্ভাব, তাহাতেই তাহার আদি ও শেষ পরিচয় রহিয়াছে—গ্রন্থের শেষ দৃশ্যে আমরা সেই অপার্থিব মনোহর কাব্যকুসুমটিকে তাহার সেই এক স্বভাবের বশেই ঝরিয়া পড়িতে দেখি। অতএব, কপালকুণ্ডলার ঐ প্রথম আবির্ভাব-দৃশ্যটি কেবল কবি-কৌশলই নয়, উহা কবিশক্তির অতি তীক্ষ্ণ, একাগ্র, একমুখী কল্পনার নিদর্শনও বটে। ইহাও মনে রাখিতে হইবে যে, সেই আবির্ভাব-দৃশ্যের যে বর্ণনা, সেই প্রতিমা ও তাহার পট-ভূমিকা, এবং তৎসহ জড়প্রকৃতি ও মানব-চৈতন্যের যে সুর-সঙ্গতি কবির দিব্য ভাবাবেশের পরিচয় দিতেছে তাহা শুধুই এই কাব্যের নয়, জগতের শ্রেষ্ঠ কাব্যের গৌরবস্থল। বঙ্কিমচন্দ্রের কবিশক্তির আরও দুইটি অত্যুৎকৃষ্ট নিদর্শন এই উপন্যাসে আছে—একটি, দ্বিতীয় খণ্ডের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের শেষ দৃশ্যে (“প্রদীপ নিবিয়া গেল”); আর একটি, “আমি পদ্মাবতী” এই উক্তির স্থান, কাল ও পাত্র-যোজনায় (তৃতীয় খণ্ড, ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ); উভয় ক্ষেত্রেই নাটকীয় কল্পনা ও কাব্য-কল্পনার চূড়ান্ত মিলন ঘটিয়াছে।

৭। এ কাব্যের আর একটি বিশিষ্ট লক্ষণ—ইহার অন্তর্নিহিত প্রকৃতি-প্রেম; এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য-প্রীতির নিদর্শন প্রায় সর্বত্র পাওয়া যাইবে। এমন কথাও বলা যাইতে পারে যে, লেখকের সেই প্রকৃতি-প্রেমই, গভীরতর তত্ত্বের আকারে মানব—জীবন-ব্যাপারকেও গৌণ করিয়া তুলিয়াছে। আমাদের দেশীয় সাহিত্যে, ইহার পূর্ব্বে এই ধরণের প্রকৃতি-প্রেম কোথাও লক্ষিত হয় না। বঙ্কিমচন্দ্র যে ইংরেজী কাব্য—সাহিত্যের—বিশেষ করিয়া ঊনবিংশ শতাব্দীর সেই রোমান্টিক কাব্য-মন্ত্র—অতি গভীরভাবে আত্মসাৎ করিয়াছিলেন—এই উপন্যাসের শুধু ভাব-কল্পনায় নয়, প্রাকৃতিক চিত্রাঙ্কনেও তাহার প্রচুর প্রমাণ আছে। ইহাতে প্রাকৃতিক দৃশ্যের যে বর্ণনাগুলি আছে তাহা হইতেই ঐ রোমান্টিক প্রকৃতি-প্রেমের লক্ষণ বুঝিতে পারা যাইবে। প্রাচীন কবিগণ যে প্রকৃতি-বর্ণনা করিতেন তাহা বিশেষ (particular) না হইয়া সামান্য (general) সৌন্দর্য্যের চিত্র হইত; নব্য কবিগণের প্রকৃতি-প্রেম আরও গভীর ও বাস্তব বলিয়া, তাঁহারা প্রকৃতি-রূপসীর প্রতি অঙ্গের বিচিত্র বিশিষ্ট শোভা মুগ্ধ-দৃষ্টিতে আবিষ্কার ও উপভোগ করেন—প্রিয়তমার গণ্ডে তিল-চিহ্নের মত, সামান্য সৌন্দর্য্যের পরিবর্তে বিশেষ সৌন্দর্য্যে আকৃষ্ট হন। এজন্য প্রাকৃতিক দৃশ্যবর্ণনার বিষয়ে রোমান্টিক কবিগণকে এক অর্থে Realist বা বস্তুনিষ্ঠ বলিতে হইবে। একজন বড় ইংরেজ সমালোচক ইহার নাম দিয়াছেন—’Sentiment of Reality’, কারণ এইরূপ রোমান্টিক প্রকৃতি-বর্ণনায়— “We find shape and identity perceived with a magical precision and delicacy, the mind fastening as it were with a peculiar intensity of vision upon any counterpart in the visible world of what it has imagined with delight.”

‘কপালকুণ্ডলা’র কাব্যলক্ষণ-বিচারে এই গুণটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য এই জন্য যে, প্রাকৃতিক বা ইন্দ্রিয়গাহ্য রূপের এই প্রকার রস-সংবেদনা ইতিপূর্ব্বে বাংলা কাব্যসাহিত্যে এত বড় স্থান অধিকার করে নাই। এই প্রসঙ্গে, বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসে—প্রথম দিকের রচনাগুলিতে এবং এই কাব্যে-নায়িকার রূপবর্ণনারীতিও উল্লেখযোগ্য।

৮। উপন্যাস-রচনায় বঙ্কিমচন্দ্রের নিজস্ব দুই একটি রীতিও অনুধাবনযোগ্য। কাহিনীর কথন (narration)-এর মধ্যে তিনি নিজেই উপযাচক হইয়া স্থলবিশেষের ব্যাখ্যা করেন : কোথাও পাত্রপাত্রীর মনোগত দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, কোথাও বা ঘটনার সম্ভাব্যতা নিজেই পাঠকচিত্রে সুস্পষ্ট করিয়া তোলেন। নাট্যকাব্যের তুলনায় উপন্যাস-লেখকের সে বিষয়ে যথেষ্ট স্বাধীনতা থাকিলেও, এইজাতীয় উপন্যাসে, লেখক কাহিনী হইতে যতদূর সম্ভব নির্লিপ্ত থাকিলেই ভাল হয়; পাঠককে যেটুকু সাহায্য করিবার প্রয়োজন তাহার অধিক যেন না হয়। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্র, শুধু সেইটুকু সাহায্যই নয়—পাঠকের গুরুগিরিও করিয়া থাকেন। তথাপি এই ব্যাখ্যা ও বক্তৃতাগুলি অধিকাংশ ক্ষেত্রে কাহিনীর গৌরব বৃদ্ধি করিয়াছে; গ্রীক নাটকের কোরাস (Chorus) এবং রোমান্টিক নাটকের ‘স্বগতোক্তি’ যে কাজ করিয়া থাকে, বঙ্কিমচন্দ্র উহার দ্বারা সে কাজও কতকটা করাইয়াছেন।

৯। এই উপন্যাসে কাহিনীর জগৎ নিত্য-পরিচিত জগৎ হইতে যতই ঊর্দ্ধে অবস্থিত হউক, যেন সেই কারণেই, বঙ্কিমচন্দ্র বাস্তব-জগতের দৃঢ়ভূমি কিছুতেই ত্যাগ করিবেন না, তাই ক্ষুদ্র হইলেও এমন কয়েকটি চরিত্র, এবং ফাঁকে ফাঁকে এমন দুই একটি ঘটনা সন্নিবিষ্ট করিয়াছেন, যাহাতে আমাদের বাস্তব চেতনা বা কাণ্ডজ্ঞানও (common sense) জাগরূক থাকে; আবার সেই সকল হইতেই তিনি যে হাস্যরসের সৃষ্টি করেন তাহাই কোথাও বা উৎকৃষ্ট হিউমার (humour ), কোথাও বা বাস্তব-জীবনের সুনিপুণ ভাষ্যরূপে (criticism of life), আমাদের চিত্তের ভাব-সাম্য রক্ষা করে। ইহাও উৎকৃষ্ট কবিশক্তির লক্ষণ।

‘কপালকুণ্ডলা’র ভাষাও এই উপন্যাসের কল্পনা বা ভাবমণ্ডলের অতিশয় উপযোগী হইয়াছে—এ ভাষা এ কাব্যের নিজস্ব ভাষা, এজন্য উহাও কাব্যকলার দিক দিয়া সার্থক হইয়াছে। বাংলা গদ্যের অপরিণত রীতিকে এত বড় কাব্যের বাহন করিবার যে দুঃসাহস তিনি করিয়াছিলেন—শব্দ-যোজনা ও বাক্য-নির্মাণের বহু বিঘ্ন সত্ত্বেও, তাহা সম্পূর্ণ সফল হইয়াছে; অবাধ্য বাক্য-রীতিকেও বশীভূত করিয়া তিনি যে অপূৰ্ব্ব ষ্টাইল নির্ম্মাণ করিয়াছেন তাহাই প্রকৃত প্রতিভার নিদর্শন। ইতিপূর্ব্বে মধুসূদনও তাঁহার মহাকাব্যের উপযোগী ভাষা নিজেই সৃষ্টি করিয়া লইয়াছিলেন, তাহা যে অনবদ্য হইয়াছিল, সেও প্রতিভার গুণে; তথাপি তাঁহাকে গদ্যের জটিলতর বাক্য-রীতি আয়ত্ত করিতে হয় নাই। ‘কপালকুণ্ডলা’র ভাষায় সংস্কৃত বাকভঙ্গির যে প্রাধান্য দেখা যায় তাহাতে বঙ্কিমচন্দ্রের ব্যক্তিগত আদর্শ এবং কাব্যের প্রয়োজন, দুই-ই মিলিয়াছে। এই কাব্যের ভাষায় পারিপাট্যের অভাব সত্ত্বেও তাহা যে এমন রসোজ্জ্বল ও প্রকাশক্ষম হইয়াছে, ইহাতেই প্রমাণিত হয় যে, উৎকৃষ্ট কবিশক্তি বা সৃষ্টি-প্রতিভা যাঁহাদের আছে তাঁহাদের রচনায় ভাষার রীতিটাই বড় নয়, ষ্টাইলটাই বড়; এই ষ্টাইল যদি সত্যকার বড় ষ্টাইল হয়—অর্থাৎ তাহার মূলে যদি অতি উচ্চ ও অনন্যসুলভ কবিদৃষ্টির প্রেরণা থাকে, এবং ভাষা যদি তাহারই ছাঁচে ঢালা হয়—তবে সর্ব্বপ্রকার রীতিকে লঙ্ঘন করিয়াই ভাষা আপনাকে গৌরবান্বিত করে।

* * * *

‘কপালকুণ্ডলা’র কাব্য-পরিচয় শেষ করিলাম। সৰ্ব্বশেষে, এই উপলক্ষ্যে বঙ্কিমচন্দ্রের কবি-প্রতিভার সম্বন্ধে সাধারণভাবে কিছু বলা আবশ্যক। আমি ইতিপূর্ব্বে নানা প্রসঙ্গে এবং একাধিক প্রবন্ধে এ বিষয়ে কিছু আলোচনা করিয়াছি। আধুনিক বাংলা সাহিত্যে যে কয়টি উৎকৃষ্ট প্রতিভার উদয় হইয়াছে, তাহাদের মধ্যে বঙ্কিমচন্দ্র এক হিসাবে যে শীর্ষস্থানীয় এমন কথা বলিলে তাহা অত্যুক্তি হইবে না; তথাপি উপন্যাস-রচনায় বঙ্কিমচন্দ্র যে সৃষ্টিশক্তির পরিচয় দিয়াছেন তাহা বাংলা কাব্যসাহিত্যেও অতুলনীয় কেন, সে বিচার সংক্ষেপে করিবার নয়; আমি সেই সৃষ্টিশক্তির কয়েকটি লক্ষণমাত্র এখানে নির্দ্দেশ করিব। সেই প্রতিভা যে কত উচ্চ শ্রেণীর, তাহা এই একখানি ক্ষুদ্র উপন্যাসের কাব্য-পরিচয় হইতেই আশা করি সকলের উপলব্ধি হইবে। এই কাব্যেও কবিকল্পনা কত দূরান্তরে এবং কত বিভিন্ন দিকে বিচরণ করিয়াছে। এই সামান্য কাহিনীর ক্ষুদ্র পরিধির মধ্যেই জীবন ও জগতের কত তত্ত্ব, কত রহস্য উঁকি দিতেছে! একটি ক্ষুদ্র হীরকখণ্ডের মত ইহাকে একটু ঘুরাইলেই তাহা যেন শতমুখে শতরশ্মি বিকিরণ করে। সে রহস্যের অন্ত নাই, কারণ তাহা সৃষ্টিরহস্যের অঙ্গীভূত। যিনি এই কাব্য-সৌধের যত ভিতরে প্রবেশ করিবেন, তিনি ততই নূতন নূতন কক্ষ আবিষ্কার করিবেন, কত নূতন অনাবিষ্কৃত তলদেশ ও উচ্চশিখর তাঁহার বিস্ময় বৃদ্ধি করিবে। আমি যে দিক দিয়া যে আলোচনা করিয়াছি তাহাও সম্পূর্ণ নয়—আরও কত দিক আছে—সৌন্দর্য্যের কত অলক্ষ্য সঙ্কেত রসিকচিত্তকে পর্য্যৎসুক করিয়া তুলিবে। ইহাই শ্রেষ্ঠ কাব্য বা Great Art-এর লক্ষণ; তাই এইরূপ কাব্যেই সাহিত্য-সমালোচনার পূর্ণতম অবকাশ আছে।

বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসগুলির প্রধান কাব্যলক্ষণ কি? সে কাব্য সৃষ্টির মতই স্বয়ম্প্রকাশ; অর্থাৎ, কাব্যের অন্তরালে কবিকে আবিষ্কার করিয়া, পরে সেই কবি—চিত্তের আলোকে এ কাব্য পাঠ করিতে হয় না। বরং কবিকে ভুলিয়া গিয়া কাব্যকেই দেখিতে হয়; সে কাব্যের রস-রহস্য এমনই যে, কবিও তাহাতে হারাইয়া তলাইয়া গিয়াছেন; সে যেন আপন সত্যে আপনি প্রতিষ্ঠিত; আপন রহস্যে আপনি সম্পূর্ণ। তাই এমন কাব্যের রস-বিচারে, সমালোচকের নিজস্ব অনুভূতির নবতন স্পর্দ্ধা প্রচার করিবার সুযোগ নাই; কাব্যগত নব নব বস্তুরই আবিষ্কার করিতে হয়, এবং তাহা, কবি-মানসের নয়—জগৎ ও জীবনেরই গভীরতর ব্যাখ্যার রূপ ধারণ করে। জীবনেও যেমন, কাব্যেও তেমনই—সেই রহস্য আমাদের সাক্ষাৎ দৃষ্টিগোচর হয়। এই যে সৃষ্টিকৰ্ম্ম, ইহা লিরিক-কবির আয়ত্ত নহে। কাব্যের আদর্শভেদ ও রসিকের রুচিভেদ থাকিতে পারে এবং আছেও; কিন্তু আজিও শ্রেষ্ঠ সমালোচকের মতে শেকসপীয়ারই শ্রেষ্ঠ কবি। তিনি যথার্থ ‘সৃষ্টি’ করিয়াছেন, তাঁহার সৃষ্ট নর-নারী ভাগবতী সৃষ্টির মতই বাস্তবের সুগভীর রহস্যে রহস্যময়। ঐ সৃষ্টি-প্রতিভাই শ্রেষ্ঠ প্রতিভা। আমাদের সাহিত্যে এ পর্যন্ত বঙ্কিমচন্দ্রই কতক পরিমাণে সেই প্রতিভার অধিকারী; সেই জন্যই শেকসপীয়ারের নাটকগুলির রস-বিচারে সমালোচনা-কৰ্ম্ম যেরূপ গভীর ও দূর-প্রসারী হইবার অবকাশ পাইয়াছে, একমাত্র বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসেই বাংলা কাব্যসমালোচনা সেই অবকাশ পাইতে পারে।

এই যে সৃষ্টিধর্মী কল্পনা, ইহার মূলে আছে সমগ্র-দৃষ্টি, তাই—ইংরেজীতে যাহাকে analytical বলে সে প্রবৃত্তি ইহাতে নাই; চরিত্র, প্লট—সকলই একটি কেন্দ্রগত রহস্যে, এমনই অঙ্গাঙ্গীভাবে সুসম্বদ্ধ হইয়া সেই কল্পনায় ধরা দেয় যে, কবিকে যেন কোন চিন্তাই করিতে হয় না, যতকিছু কার্য্য-কারণ জিজ্ঞাসা, যতকিছু ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ সেই সৃষ্টিকর্ম্মের অন্তর্নিহিত (implicit) হইয়াই আছে। এইজন্য এরূপ কাব্যের নির্মাণ—কৌশল প্রাকৃতিক নির্ম্মাণ-কৌশলের মতই সমালোচকের বিস্ময় উৎপাদন করে। সেই কলা-কৌশল যতই ভেদ করা যায়, ততই মনে হয়, কবি যেন তাহা সজ্ঞানে, অতি সাবধানে প্রয়োগ করেন নাই—কল্পনার পূর্ণ আবেশে, উপন্যাসের চরিত্রগুলিও যেমন, তাহাদের ঘটনা-ধারাও তেমনই, আপনা-আপনি বিকাশ লাভ করিয়াছে; কবির নিজের কোন ভাবনা নাই। পরে পরীক্ষা করিলে দেখা যায়, কোথাও প্রকৃতি বা মানব—চরিত্রের গূঢ়তর নিয়ম লঙ্ঘিত হয় নাই; ঘটনার কার্য্য-কারণ এমনই অচ্ছেদ্য, এবং চরিত্রগুলির উপরে তাহার ক্রিয়া এমনই স্বাভাবিক—এবং সর্ব্বোপরি উপন্যাসের সকল অংশ ও উপকরণ এমনই একটা মূলসূত্রে অঙ্গাঙ্গীভাবে গ্রথিত যে, তাহাদের কোনটাকে অপর হইতে পৃথক করিয়া দেখা যায় না। ইহাকেই উৎকৃষ্ট সৃষ্টিকৰ্ম্ম বলে। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কপালকুণ্ডলা’তেও এইরূপ সৃষ্টিশক্তির লক্ষণ আছে।

বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসের আরও বিশিষ্ট লক্ষণ এই যে, তাহার চরিত্র-বিভাবনা (conception) এবং আখ্যানমুখে তাহার যে বিকাশ (growth বা development), এই উভয়ই নাটকীয় প্রেরণার অনুবর্তী; এইজন্য সেই চরিত্রগুলিকে, ঘটনায়, কার্য্যে এবং কথায় বুঝিয়া লইতে হয়—ভিতরের রহস্য বাহির হইতেই অনুমান করিতে হয়। এ কথা পূর্ব্বে বলিয়াছি। এরূপ কাব্যে কবির নিজেরই ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ যেমন আবশ্যক হয় না, তেমনই, সেরূপ ব্যাখ্যা বা মন্তব্য মূল-কাব্যের সৃষ্টি-ক্রিয়া ব্যাহত করিতে পারে না। ইহার ফলে, উপন্যাসগত মানব-মানবীকে আমরা বিধাতার সৃষ্টির মতই অতিশয় স্বপ্রতিষ্ঠ বলিয়া মনে করি—মানব-জীবনের যে রহস্য, সেই রহস্যই তাহাদিগকে রহস্যময় করিয়া তোলে, সমালোচনারও শেষ হয় না। কাব্য-রচনার এই ভঙ্গিকেই কবি-কল্পনার objectivity বা আত্মভাব নিরপেক্ষ বস্তুরস-পরায়ণতা বলে; ‘বস্তু’ অর্থে বহিঃসৃষ্টির যাহা-কিছু। ইহাই খাঁটি নাটকীয় কল্পনা; আমাদের সাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসগুলিতে এরূপ কল্পনার যতটুকু প্রসার দেখা যায়, তেমন আর কোথাও নয়। লিরিক বা subjective কবি-কল্পনা ইহার ঠিক বিপরীত; আমাদের সাহিত্যে এই কল্পনার প্রসারই সমধিক—আমাদের শ্রেষ্ঠ কাব্যসম্পদ লিরিক বা গীতিধর্মী। এইজন্যই বঙ্কিমচন্দ্রের কবি—প্রতিভা এ সাহিত্যের পক্ষে কিছু অসাধারণ।

‘কপালকুণ্ডলা’র আখ্যান-নির্মাণে বঙ্কিমচন্দ্রের সেই প্রতিভার একটি নিদর্শনমাত্র উল্লেখ করিয়া এই আলোচনা শেষ করিব। ঐরূপ কবিদৃষ্টি—ঐরূপ objective কল্পনা ব্যতিরেকে, কাহিনী, উপন্যাস, নাটক প্রভৃতির মত কাব্য-রচনায় সৃষ্টিরহস্যের উদ্ঘাটন হয় না। সেই কল্পনার সেই দৃষ্টিই জীবনের তুচ্ছতম ঘটনাকেও সমগ্রের সহিত সম্বন্ধ—বিশিষ্ট দেখে; আবার, প্রাকৃতিক শক্তির সহিত মনুষ্য-জীবনের যে যোগ অহরহ ঘটিয়া থাকে, তাহাও যে সেই জীবনের নিয়ন্তা—দৃষ্টিমাত্রে তাহা বুঝিতে পারে। তাই, বঙ্কিমচন্দ্র, ইংরেজীতে যাহাকে ‘chance’ বলে, সেই দৈব-সংঘটনাকে উপযুক্ত মৰ্য্যাদা দান করিয়াছেন। Chance আর কিছুই নহে—দুইটি ভিন্নমুখী কার্য্যকারণ-ধারা যখন কোন এক লগ্নে পরস্পর মিলিত হয়, তখন যাহা ঘটে, তাহাই Chance, বা সংঘটন। ‘কপালকুণ্ডলা’র প্রথম খণ্ডের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদেই এইরূপ একটি সংঘটনা—সেই অকস্মাৎ নদীতে জোয়ার আসাই—সমগ্র কাহিনীর ভিত-পত্তন করিয়াছে। এই ঘটনাটি না ঘটিলে,  কপালকুণ্ডলা ও নবকুমার উভয়ের জীবন সম্পূর্ণ ভিন্নপথে পরিণতি লাভ করিত, এবং হয়ত তাহাতে কিছুমাত্র রোমান্সের অবকাশ থাকিত না। ইহা চিন্তা করিলে বিস্ময় বোধ হইবে। কিন্তু ঐ ঘটনাটি যে আদৌ অস্বাভাবিক বা অবাস্তব নয়, এবং এইরূপ একটিমাত্র ঘটনাই যে মানুষের জীবনকে সম্পূর্ণ শাসিত করিয়া তাহার সুখ-দুঃখের নিয়ামক হইতে পারে—কবি বঙ্কিমের এই দৃষ্টি যে সেই সমগ্রদৃষ্টির বা জীবনরহস্য—বোধের অন্তর্ভুক্ত, এই কাহিনীর সমগ্র ঘটনাধারা তাহাই প্রমাণ করিতেছে। বঙ্কিমচন্দ্রের অপরাপর উপন্যাসেও এই chance, ক্ষুদ্র-বৃহৎ নানারূপে মানব ভাগ্যের তথা জীবন—কাহিনীর একটা বড় দিক অধিকার করিয়া আছে। অথচ ইহা অদৃষ্টবাদ নয়, ইহা যেন সৃষ্টির মূল নিয়মের সঙ্গেই মানব-জীবনের একটা স্বাভাবিক গ্রন্থি; ইহার কোন ব্যাখ্যা নাই, কোন কারণ-নির্দ্দেশ নাই; এইজন্যই ইহা জীবনকে এমন রহস্যময় করিয়া তোলে। মানব-জীবনের যিনি শ্রেষ্ঠ কাব্যকার সেই শেকসপীয়ারের মত, বঙ্কিমচন্দ্রও কেবল ইহাকে দেখিয়াছেন, মাত্র; তাহার রহস্য-রসে তিনিও যেমন অভিভূত হইয়াছেন, তাঁহার অপূর্ব্ব কবিপ্রতিভার বলে তেমনই আমাদিগকেও তাহা হৃদয়ঙ্গম করাইয়াছেন। জীবনের কেবল বাস্তব প্রত্যক্ষ পরিদৃশ্যমান রূপই নয়, তাহার উর্দ্ধতম শিখর ও নিম্নতম তলদেশ—লক্ষ্য ও অলক্ষ্য, বস্তুগত ও ভাবগত, যুক্তিগ্রাহ্য এবং যুক্তিরও অগ্রাহ্য—সর্ব্বাঙ্গীণ রূপটি, যে-কবি আমাদের যতখানি অনুভূতিগোচর করিতে পারেন তিনিই সেই হিসাবে তত বড় কবি; সেই কবির কাব্যই সুগভীর সৃষ্টি-সত্যে অনুপ্রাণিত। বঙ্কিমচন্দ্রের কল্পনায় সেই স্পর্শমণির স্পর্শ আছে, তাই তাঁহার কাব্যগুলিতে মানব-জীবন-কাহিনীর একটি অভিনব রস-সংবেদনা আমাদিগকে এমন উৎকণ্ঠিত করে।


© 2024 পুরনো বই