আট বৎসর পূর্বে ঘটিয়াছিল যে হত্যাকাণ্ড, তাহারই বিচার। নৃশংস হত্যাকাণ্ড। দীর্ঘ আট বৎসর পরে দায়রা আদালতে তাহারই বিচার হইতেছে। আগামী কাল নিহত কালীনাথের স্ত্রী ব্রজরানীর সাক্ষ্য গৃহীত হইবে।
ব্রজরানী সন্ধ্যার অন্ধকারে ঘরের মধ্যে ধ্যানস্তিমিতার মতো বসিয়াছিলঃ; হরদাসবাবু কোর্ট হইতে ফিরিয়া একেবারে সেই ঘরে প্রবেশ করিলেন—এই যে ব্রজ।
ব্রজ মুখে কোনো উত্তর দিল না, জিজ্ঞাসুদৃষ্টিতে দাদার মুখের দিকে চাহিল মাত্র। হরদাসবাবু বলিলেন, কাল তোর সাক্ষীর দিন। মনকে একটু শক্ত করে নে ভালো করে। আমি বরং কাল সকালে তোকে তোর প্রথম এজাহারটা ভালো করে শুনিয়ে দেব।
হরদাস আর কোনো কথা না বলিয়া চলিয়া গেলেন।
ভালো করিয়া শুনাইয়া দিবে! মনে করাইয়া দিবে! ব্রজরানী দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া এক বিচিত্র হাসি হাসিল। ঠোঁটের কোণে ক্ষীণ রেখায় পরিস্ফুট নিঃশব্দ হাসি, হাসির সঙ্গে সঙ্গে বড় বড় চোখ দুইটি স্তিমিত হইয়া আসিল; উত্তেজনাহীন স্থির হিমশীতল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, বিচিত্র সে হাসি!
ব্রজরানীর মনে বাটালির আঘাতে কাটিয়া গড়া পাথরের মূর্তির মতো সে ছবি অঙ্কিত হইয়া আছে, সে কি মুছিবার, না মুছিয়া যায়!
হতভাগ্য নিহত কালীনাথের বিধবা স্ত্রী ব্রজরানী।
উঃ! সে ভীষণ শব্দ! সে যেন মৃত্যুর হুঙ্কার ধ্বনি। বার বার। হাতটা প্রথম ভাঙিয়া গেল; তারপর আবার, তারপর আবার, বার বার রক্তাপ্লুত দেহে স্বামী তাহার লুটাইয়া পড়িল তাহার চোখের সম্মুখে।
ব্রজরানী সে মূর্তি স্মরণ করিয়া আতঙ্কে শিহরিয়া উঠিল, সভয়ে ঘর হইতে ছুটিয়া সে বাহির হইয়া নীচে নামিয়া গেল। স্বামীর সেই রক্তাক্ত মূর্তি আজও তাহাকে আতঙ্কিত করিয়া অস্থির করিয়া তোলে। প্রায় রাত্রেই স্বপ্নে সেই মূর্তি দেখিয়া সে চিৎকার করিয়া উঠে, তাহার মা তাহার পাশে শুইয়া গায়ে হাত দিয়া থাকেন, সেই অভয় স্পর্শ নিদ্রার মধ্যেও সে অনুভব করে। সে হাত কিছুক্ষণ সরিয়া গেলেই আতঙ্কে তাহার ঘুম ভাঙিয়া যায়।
ব্রজরানী ত্রস্ত পদক্ষেপে আসিয়া দাঁড়াইতেই মা প্রশ্ন করিলেন, কী রে? এমন করে—প্রশ্নের আধখানা বলিয়াই তিনি চুপ করিয়া গেলেন, তাঁহার নিজের মনই প্রশ্নের উত্তর দিয়াছে।
ওদিকের বারান্দায় এক ভ্রাতৃবধূ যেন শুনাইয়া শুনাইয়াই বলিল, বাপের জন্মে এমন ভয় দেখিনি কিন্তু। আজ আট বছর হয়ে গেল—
মা শাসন-কঠোর গম্ভীর কণ্ঠে বলিলেন, বউমা!
বধূ মুখ বিকৃত করিয়া একটা ভঙ্গি করিয়া নীরব ইঙ্গিতে বাকি মনোভাবটা প্রকাশ করিয়া তবে ছাড়িল। মা ব্রজরানীকে কাছে বসাইয়া তাহার রুক্ষ চুলের বোঝা লইয়া বসিলেন, পিঙ্গল রুক্ষ চুলে জটিলতার আর অন্ত নাই। স্বামীর মৃত্যুর পর ব্রজরানী আজও তেল ব্যবহার করে নাই।
ব্রজরানীর বড়ভাই হরদাসবাবু আসিয়া দাঁড়াইলেন—মা!
মা মুখ তুলিয়া হরদাসের দিকে চাহিলেনঃ; হরদাস বলিলেন, একটা কথা ছিল মা।
—কী বল?
—একটু উঠে এস।
—এইখানেই বল না।
একটু ইতস্তত করিয়া হরদাস বলিলেন, সেই ভালো। ব্রজরই শোনা দরকার বিশেষ করে। —আবার একটু ইতস্তত করিয়া বলিলেন, মানে—ব্রজরানীর ছোট মামাশ্বশুর আর ওঁদের বেয়াই এসেছেন দেখা করতে।
মামাশ্বশুর? ব্রজরানীর স্বামীহন্তার পিতা আর তাহার শ্বশুর? ব্রজরানীর মায়ের চোখ দুইটা যেন জ্বলিয়া উঠিল। ব্রজরানী চঞ্চল হইয়া মাথার কাপড়টা তুলিয়া দিল, যেন মামাশ্বশুর কাছেই কোথাও রহিয়াছেন। মা বলিলেন কেন? কী জন্যে? কী দরকার তাঁর? কেন তিনি বার বার আসেন? উত্তরোত্তর তাঁহার কণ্ঠস্বর উচ্চ হইয়া উঠিতেছিল।
হরদাস বলিলেন, বলবেন আর কী? সেই কথা—ক্ষমা। যা হয়েছে তার উপর হাত নেই। এখন ভিক্ষা, ক্ষমা—কোনো রকমে ক্ষমা—
—ক্ষমা? —মা কঠিন হাসি হাসিলেন। তারপর তিনি বলিলেন, তাঁকে বাইরে বিদেয় করে দেওয়াই তোমার উচিত ছিল বাবা।
—সে কি আর আমি বলি নি মা! —বলেছি—বার বার বলেছি; কিন্তু আমার হাতে ধরে ভদ্রলোক ছাড়েন না। শেষে পায়ে ধরতে উদ্যত।
—তাহলে তাঁকে বল গে, ব্রজ আমার আজ আট বৎসর তেল মাখে নি, এই দিনটির জন্যে। ক্ষমা কী করে করবে?
হরদাস নীরব হইয়া রহিলেন, আবার একটু ইতস্তত করিয়া বলিলেন, আর একটা কথা মা। আমাকে যেন ভুল বুঝো না। আমি তাঁর কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ বলতে। অনন্তর শ্বশুর বললেন, আমার মেয়ের প্রতি দয়া করতে হবে। যে ক্ষতি হয়ে গেছে, তার পূরণ আজ ভগবানও করতে পারেন না। তবে মানুষের দ্বারা যেটুকু সম্ভব, যতটুকু পারা যায়—ব্রজর ভবিষ্যৎ আছে, তার ছেলেকে মানুষ করতে হবে—
বাধা দিয়া মা বলিলেন, মানে—টাকা দিতে চান, এই তো?
জ্যা-মুক্ত শরের মতো মুহূর্তে ব্রজরানী উঠিয়া দাঁড়াইল, তাহার চোখ দিয়া যেন আগুন বাহির হইয়া গেল, সে দৃঢ়কণ্ঠে বলিল, না।
তারপর দৃঢ়পদক্ষেপে সে স্থান ত্যাগ করিয়া চলিয়া গেল।
অনন্ত মামাতো ভাই, কালীনাথ তাহার পিতৃষ্বসাপুত্র। কালীনাথ বয়সে কিছু বড়। কিন্তু যৌবনের একটা কোঠায় বিশ-ত্রিশের ব্যবধান বন্ধুত্বের সেতুবন্ধনে স্বচ্ছন্দে বাঁধা যায়, এ তো বৎসর-চারেকের ব্যবধান। সেই সেতুবন্ধনে অনন্ত এবং কালীনাথ পরস্পর প্রীতিবদ্ধ হইয়া একান্ত ঘনিষ্ঠভাবে মিলিত হইয়াছিল। ভোর না হইতেই অনন্ত আসিয়া ডাকিল, কালীদা! বাপস, কী ঘুম তোমার! তাঁহার কাঁধে এক বন্দুক, পকেটে বোঝাই কার্তুজ।
কালীনাথ উঠিয়া দরজা খুলিয়া দিবামাত্র সে উনানের ধারে উনান জ্বালিতে বসিয়া যাইত। কালীনাথ তখন অবিবাহিত, সংসারে বাপ-মা ভাই-ভগ্নী কেহ নাই, বাড়িটা দুইটি তরুণের খেয়াল ও খুশিমতো চলিবার একটি কল্পরাজ্য হইয়া উঠিয়াছিল। কালীনাথ মুখ-হাত ধুইতে ধুইতে অনন্ত চা তৈয়ারি করিয়া দুইটি পেয়ালায় পরিবেশন করিয়া ফেলিত, তারপর গতরাত্রের উদ্বৃত্ত পাখির মাংস সহযোগে প্রাতরাশ সারিয়া গ্রাম-গ্রামান্তরেরজঙ্গল অভিমুখে রওনা হইত। গ্রাম পার হইয়াই কালীনাথ পকেট হইতে ছোট কল্কে, সিগারেট মিকশ্চার, আরও দুই-একটা সরঞ্জাম বাহির করিয়া বসিত। অনন্ত তৃষ্ণার্তের মতো বলিত, হ্যাঁ, দাও, নইলে জমছে না। চোখের টিপ, বুঝছ কি না—ও না হলে ঠিক আসে না।
অনন্ত নিতান্তই অল্পশিক্ষিত, মূর্খ বলিলেও চলে। কালীনাথ শিক্ষিত, বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ-উপাধিকারী; কিন্তু আশ্চর্যের কথা, সেও ঐ নেশায় আসক্ত। শুধু আসক্তই নয়, এ বিষয়ে অনন্তের গুরু সে-ই। তাহাদের দুইজনের মিলনের সেতুবন্ধনে এই বস্তুটিই ছিল কাঠামো।
একটা অস্বাভাবিক উত্তেজনায় উত্তেজিত হইয়া অনন্ত রিপীটারটা খুলিয়া একেবারে ছয়টা কার্তুজ ভর্তি করিয়া বলিত, বাস। চল এইবার। হাত কিন্তু আমার নিশপিশ করছে, কী মারি বল তো?
—দে, একটা মানুষই মেরে দে।
—বেশ, দাঁড়াও তুমি, এখানে মানুষের মধ্যে তুমি। —অনন্ত বন্দুকটা তুলিয়া ধরিত। কালীনাথ সভয়ে সরিয়া গিয়া বলিত—এই, এই অনু, ওসব ভালো নয় কিন্তু। বাবা! ও হল যমদ্বার, চাবি টিপলেই দোর খুলে যাবে।
অনু হি-হি করিয়া হাসিয়া বন্দুকটা ফিরাইয়া লইতঃ; কালীনাথ একটা গ্রামান্তরযাত্রী কুকুরকে অথবা আকাশচারী কোনো পাখিকে দেখাইয়া দিত—ওই মার না, মারবার জানোয়ারের আবার অভাব!—অনন্ত মুহূর্তে বন্দুকটা তুলিয়া ধরিত। প্রান্তরের অনভ্যস্ত আবেষ্টনীর মধ্যে অপরিচিত দুইজন মানুষের হাতে লাঠির মতো অস্ত্রটাকে দেখিয়া ভীত কুকুরটার লেজ আপনি নত হইয়া আসিত, ভীত মৃদু শব্দ করিয়া সে ছুটিয়া পলাইত, কিন্তু অনন্তর লক্ষ্য অব্যর্থ। গতিশীল জীবটা কোনো-না-কোনো অঙ্গে আহত হইয়া আর্তনাদ করিয়া লুটাইয়া পড়িত, কখনও মরিত, কখনও মারিত না। না মরিলে কালীনাথ বলিত—দে, আমাকে দে তো বন্দুকটা, বড় জানোয়ার—হাতের টিপ করে নিই।
কিছু দূরে দাঁড়াইয়া গুলির পর গুলি ছুঁড়িয়া সেটাকে সে বধ করিয়া হাসিয়া বলিত—একেই বলে কুকুর মারা, অ্যাঁ!
—চুপ।
—কী?
—মাথার উপর পাখার শব্দ শুনছ! হরিয়ালের পাখার শব্দ। বসে পড়, গুঁড়ি মেরে বসে পড়।
তারপর বন্দুকের শব্দে, পাখির ভয়ার্ত কলরবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্রামগুলি চকিতে আলোড়িত হইয়া উঠিত। পিছনে জুটিত ছেলের দল, তাহারা হত্যার আনন্দ উপভোগ করিত, আর সংগ্রহ করিত কার্তুজের খালি খোল।
একসঙ্গেই দুইটি বিবাহের উদ্যোগ হইয়াছিল। ব্রজরানীর পিতার বংশ, চাকুরের বংশ—দুই পুরুষ সরকারী চাকরি করিয়া বিত্তশালী হইয়া উঠিয়াছেন। তাঁহারা খুঁজিতেছিলেন—প্রতিষ্ঠিতনামা ধনীর ঘরের ছেলে। ওদিকে কলিকাতায় নিকটবর্তী এক প্রাচীন জমিদার-বাড়ি আধুনিক-আলোকপ্রাপ্ত হইয়া খুঁজিতেছিলেন—বিদ্যাগৌরবে গৌরবান্বিত একটি সম্ভ্রান্ত ঘরের পাত্র। সন্ধানী ঘটক দুই বিভিন্ন স্থান হইতে এই দুই সম্বন্ধ আনিয়া হাজির করিল। একপক্ষের জন্য অনন্ত ও অন্যপক্ষের জন্য কালীনাথকে সে খুঁজিয়া বাহির করিল। অনন্ত খুশি হইয়া বলিল—দাদা, তোমার পাত্রী দেখতে যাব আমি, আর আমার পাত্রী দেখতে যাবে তুমি।
কালীনাথ অনন্তর পিঠে চাপড় মারিয়া বলিল, একসেলেন্ট আইডিয়া! বহুত আচ্ছা ব্রাদার আমার রে!
ব্রজরানীকে দেখিয়া কালীনাথ মুগ্ধ হইয়া গেল। তারপর সে দুইখানি বেনামী পত্র লিখিয়া বসিল। ব্রজরানীর পিতাকে লিখিল, বড়লোকের ছেলে অনন্ত—তাহাতে সন্দেহ নাই, কিন্তু সে নেশাখোর দুর্দান্ত, গোঁয়ার। সকল রকম নেশাতেই সে অভ্যস্ত, তাহার উপর চরিত্রহীন।
আর তাহার যেখানে সম্বন্ধ চলিতেছিল, সেখানে লিখিল, কালীনাথ এম. এ. পাশ করিয়াছে সত্য, কিন্তু নিতান্ত হাঘরে বংশের ছেলে। তাঁহার পিতা সরকারী চাকরি করিয়া যাহা রাখিয়া গিয়াছেন, তাহা মধ্যবিত্ত ঘরের পক্ষেও অকিঞ্চিৎকর। আরও একটি কথা, ছেলেটি বড় হীন স্বভাবসম্পন্ন। হীনতাটা তাহাদের বংশানুক্রমিক। পাঠ্যজীবনে কয়েকবার সহপাঠীদের বই চুরি করিয়া সে ধরা পড়িয়াছে। জ্ঞাতার্থে জানাইলাম, যাহা ভালো বিবেচনা হয় করিবেন।
তারপর ঘটকের চেষ্টায় ঘটিল অন্যরূপ। সম্বন্ধ অদল-বদল হইয়া গেল। ঘটক বর্ণনা করিল, কালীনাথের অবস্থা বেশ ভালোই, অর্থাৎ সূর্য থাকিলে যেমন চন্দ্রকে দেখা যায় না তেমনই মাতুল বংশ বিদ্যমান থাকিতে ভাগিনেয় চোখে পড়ে না—অন্যথায় চন্দ্রই তমোনাশ করিতে পারিত। আর অনন্ত পাস না করিলেও লেখাপড়া বেশ ভালোই করিয়াছে, তাঁহাদের ডিগ্রীর প্রয়োজন নাই। প্রয়োজন বিদ্যার। অতঃপর বিদ্বান কাহাকে বলে, সে বিষয়ে বক্তৃতাও সে খানিকটা করিল। ফলে পাত্রী ও পাত্র পরিবর্তন করিয়া দুইটি বিবাহই হইয়া গেল।
মাটির নীচে অন্ধকার রাজ্যের অধিবাসী উই; মধ্যে মধ্যে আলোক কামনায় তাহাদের পক্ষোদগম হইলে আর রক্ষা থাকে না, তাহার পিচকারির মুখে জলের মতো গহ্বর পরিত্যাগ করিয়া বাহির হয়। পাখার শক্তি অপেক্ষা অহঙ্কারই হয় অধিক। অনন্তর শ্বশুরদের অনেকটা সেই অবস্থা। রক্ষণশীল জমিদার-বাড়ির সকলে অকস্মাৎ অবরোধ ঘুচাইয়া আলোকের নেশায় ঐ পতঙ্গগুলির মতোই ফরফর করিয়া উড়িতেছে।
ফুলশয্যার রাত্রেই বধূটি প্রশ্ন করিল, তোমার পড়ার ঘর বুঝি বাইরে?
অনন্ত প্রশ্নটা বেশ বুঝিতে পারিল না, বধূর মুখের দিকে চাহিয়া প্রশ্ন করিল, পড়ার ঘর?
বধূটি সলজ্জভাবে নিজেকে সংশোধন করিয়া লইয়া বলিল—তোমার লাইব্রেরীর কথা জিজ্ঞেস করছি আমি।
—লাইব্রেরী! —তারপর সোজাসুজি ঘাড় নাড়িয়া সে বলিয়া দিল, ওসব লাইব্রেরী-টাইব্রেরীর ধার-টার ধারি নে আমি। বছরে সরস্বতীর পুজো এক দিন—পাঁঠা কাটি, ফিষ্টি করি, ব্যস।
বধূ স্তম্ভিত হইয়া অনন্তর মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। তারপর সে যে সেই শুইল, আর সাড়াও দিল না, উঠিলও না। সাধ্যসাধনার মধ্যে অনন্ত আবিষ্কার করিল, সে কাঁদিতেছে।
—কাঁদছ কেন? হল কী? শুনছ?
বধূ নিরুত্তর। অনন্ত আবার প্রশ্ন করিল—কী হল বলবে না? লক্ষ্মী, শোন, কথার উত্তর দাও।
—ওগো, আমাকে আর জ্বালিয়ো না, তোমার পায়ে পড়ি।
কাতর কণ্ঠস্বরের মধ্যেও প্রচ্ছন্ন বিরক্তির সুর গোপন ছিল না। অনন্ত একটু আহত না হইয়া পারিল না। তবুও সে আবার প্রশ্ন করিল—কী হল সেইটে বল না?
—আমার মাথা ধরেছে। —এবার বেশ পরিস্ফুট বিরক্তির সহিতই বধূ জবাব দিয়া বসিল। অনন্তও অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া শয্যা ত্যাগ করিয়া উঠিয়া একটা সিগারেট ধরাইয়া জানালার ধারে দাঁড়াইল। নিস্তব্ধ রাত্রি। শুধু তাহাদের বাড়ির পাশের সারিবদ্ধ নারিকেল গাছগুলির কোনো একটির মাথায় বসিয়া একটা পেচক কর্কশ স্বরে ডাকিতেছে। অনন্ত বিরক্ত হইয়া সরিয়া আসিল। তারপর অকস্মাৎ তাহার খেয়াল হইল, কালীদাদা কী করিতেছে দেখিয়া আসিলে মন্দ হয় না!
কালীনাথের বিবাহও এই বাড়ি হইতেই অনুষ্ঠিত হইতেছিল। বিবাহের আচার-অনুষ্ঠান শেষ হইলে বর-বধূ আপনাদের বাড়িতে গিয়া সংসার পাতিবে। অনন্ত কালীনাথের ফুলশয্যাগৃহের দরজায় আসিয়াই শুনিল, ভিতরে স্বামী-স্ত্রীতে আলাপ চলিতেছে। সে কৌতুকপরবশ হইয়া কান পাতিল।
কালীনাথ বলিতেছে—তোমায় আমি রানী বলেই ডাকব। আমার হৃদয় রাজ্যের রানী তুমি।
—দূর, সে আমার লজ্জা করবে। তার চেয়ে সবাই যা বলে, তাই বলবে—ওগো।
—সে তো সকলের সামনে বলতেই হবে। কিন্তু তুমি আর আমি যেখানে শুধু, সেখানে বলব—রানী।
অনন্ত কালীনাথকে আর ডাকিল না, আপনার ঘরে আসিয়া আবার জানালার ধারে দাঁড়াইল। তাহার ভাগ্য! নতুবা এই মেয়ে তো তাহার স্কন্ধে পড়িবার কথা নয়!
নারিকেলগাছের মাথায় পেচকটা কর্কশ স্বরে আবার ডাকিয়া উঠিল। অকস্মাৎ অনন্তর সমস্ত ক্রোধ গিয়া পড়িল ঐ কর্কসকণ্ঠ নিশাচর পাখিটার উপর। সে ঘরের কোণ হইতে তাহার রিপীটারটা লইয়া স্থিরভাবে কিছুক্ষণ শব্দ লক্ষ্য করিয়া ঘোড়াটা টানিয়া দিল। আকস্মিক ভীষণ শব্দগর্জনে রাত্রিটা কাঁপিয়া উঠিলঃ; নারিকেলগাছের মাথাটায় একটা আলোড়ন বহিয়া গেল, কী একটা নীচে সশব্দে খসিয়াও পড়িল।
পিত্রালয়ে আসিয়া বধূটির পুঞ্জিত ক্ষোভ ফাটিয়া পড়িল। তাহার মুখ দেখিয়াই মা একটা আশঙ্কা করিয়াছিলেন। তিনি একান্তে ডাকিয়া মেয়েকে প্রশ্ন করিলেন—হ্যাঁরে, তোর মুখ এমন ভার কেন রে?
মুহূর্তে কন্যা জ্বলিয়া উঠিল অগ্নিস্পৃষ্ট বারুদের মতো—শেষকালে অশিক্ষিত মূর্খের হাতে আমাকে সঁপে দিলে তোমরা! একটা ফোর্থ ক্লাসের ছেলে যা লেখাপড়া জানে, ও তাও জানে না।
মা স্তম্ভিত হইয়া মেয়ের মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন। মেয়ে রুদ্ধ কণ্ঠে বলিল, সকাল থেকে ব্যাধের মতো পাখি মেরে মেরে বেড়ায়। গুণ্ডার মতো একে মারা, ওকে চাবকে শাসন করাই হল গৌরবের কাজ।
অনন্ত বাহিরে বেশ গম্ভীর ভাবেই বসিয়া ছিল, সহসা তাহার এক শ্যালক একখানা ইংরেজি বই আনিয়া বলিল, এই জায়গাটা বুঝিয়ে দিন না জামাইবাবু।
অনন্ত রহস্য-যবনিকার বহির্ভাগেই ছিলঃ; কিন্তু একটি ছোট শ্যালিকা আসিয়া একখানা ইংরেজি খবরের কাগজ ফেলিয়া দিয়া খিলখিল করিয়া হাসিয়া সে যবনিকা ছিন্ন করিয়া দিল। বলিল, পড়ুন জামাইবাবু।
মুহূর্তে সমস্ত বিষয়টা অনন্তর চোখের সম্মুখে আলোকিত পৃথিবীর মতো পরিস্ফুট হইয়া পড়িল। মাথার মধ্যে ক্রোধ জ্বলিয়া উঠিল আগুনের শিখার মতো! কিন্তু কোনো উপায় ছিল না, সে নীরবে মাথা নীচু করিয়া বসিয়া রহিল।
দিনে খাওয়া-দাওয়ার পর বিশ্রাম করিবার জন্য একটি ঘর দেখাইয়া দিয়া শাশুড়ী বলিলেন, একটা কথা বলছিলাম বাবা, মানে—তোমার শ্বশুরের ইচ্ছে, আমারও ইচ্ছে—তুমি এখন কলকাতায় থাক। আমার বড়ছেলে থাকে কলকাতায়, বাসাও রয়েছে—সেখানে থেকে পড়াশুনো কর।
অনন্তর ইচ্ছা হইল, সে দৃপ্ত হুঙ্কারে বলিয়া উঠে—না, না, না। কিন্তু তাহা সে পারিল না। চুপ করিয়া দৃষ্টি নত করিয়া বসিয়া রহিল। শাশুড়ী অনন্তর নীরবতায় সন্তুষ্ট হইয়াই চলিয়া গেলেন। ‘হ্যাঁ’ না বলিলেও বলাইতে বিশেষ বেগ পাইতে হইবে না।
অপরাহ্নে শ্বশুর তাহাকে ডাকিয়া বলিলেন, সেই কথাই লিখে দিলাম। তোমার বাবাকে। সেই ভালো, এত অল্পবয়সে চুপচাপ বসে থাকা ভালো নয়। An idle brain is the devil’s workshop—কলকাতায় থেকে পড়াশুনো কর।
অনন্ত কোনো কথা না বলিয়া সকলের অজ্ঞাতসারে বাড়ি হইতে বাহির হইয়া একেবারে স্টেশনে আসিয়া উপস্থিত হইল। তাহার জিনিসপত্র সব পড়িয়া রহিল। সে ট্রেনে চাপিয়া বসিল এবং বাড়ি ফিরিয়া যেন আক্রোশভরেই নেশা আরম্ভ করিল।
অকস্মাৎ একদিন অনন্তর পিতা ক্রোধে ফুলিতে ফুলিতে স্ত্রীকে বলিলেন, আমি অনন্তর বিয়ে দেব আবার। ছোটলোকের মেয়ে—মেয়ের বাপ হয়ে চিঠি লিখেছে দেখ না! আস্পর্ধা দেখ দেখি—লিখেছে, আমরা নাকি মূর্খ-ছেলের বিবাহ দেবার জন্যে কালীনাথের নামে অপবাদ দিয়ে বেনামী চিঠি দিয়েছি! তুমি চিঠি লিখে দাও বেয়ানকে, মেয়ে যদি না পাঠিয়ে দেয়, ছেলের বিয়ে দেব আমি। —চিঠিখানা স্ত্রীর হাতে দিয়া তিনি ক্রোধভরেই বাহির হইয়া গেলেন।
অনন্ত ছিল পাশের ঘরেই। সমস্তই সে শুনিয়াছিল, বাপ বাহির হইয়া যাইতেই সে মায়ের ঘরে ঢুকিয়া মায়ের হাত হইতে ছোঁ মারিয়া চিঠিখানা কাড়িয়া লইল।
নিতান্ত কটুভাষায় অভিযোগ করিয়া ঐ পত্রখানা লেখা। পরিশেষে লেখা—প্রণামস্বরূপ বেনামী পত্রখানাও এই সঙ্গে পাঠাইলাম। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এ পত্র আপনাদের ইঙ্গিতক্রমেই লেখা হইয়াছিল।
বেনামী পত্রখানা উল্টাইয়াই অনন্ত চমকিয়া উঠিল, এ কি! এ যে অত্যন্ত পরিচিত হাতের লেখা! এ যে, এ যে—। শ্বশুরের পত্রখানা মায়ের পায়ের কাছে ফেলিয়া দিয়া সে বেনামী পত্র হাতে করিয়া বাহির হইয়া গেল। একেবারে কালীনাথের বাড়ি আসিয়া ডাকিল, কালীদা!
—কে অনু? আয় আয়।
অনন্ত আসিতেই ব্রজরানী ঘোমটা টানিয়া উঠিয়া গেল। অনন্ত লক্ষ্য করিল, বাড়ির চারিদিকে একটি লক্ষ্মীশ্রী, সুপ্রসন্ন শৃঙ্খলা ও পরিচ্ছন্নতায় যেন উছলিয়া পড়িতেছে।
কালীনাথ বলিল, আর তুই আসিসই না!
—এলে খুশি হও কি না সত্যি বল দেখি?
হা-হা করিয়া হাসিয়া কালীনাথ সে কথার উত্তরটা আর দিলই না।
অনন্ত প্রশ্ন করিল, বউ খুব ভালো হয়েছে, না?
অকপট প্রসন্নমুখে কালীনাথ বলিল, রানীর গুণ একমুখে বলে শেষ করতে পারব না অনু। দেখছিস না ঘরদোরের অবস্থা। তুই ও বউকে এইবার নিয়ে আয়, বুঝলি?
অনন্ত চুপ করিয়া রহিল। কালীনাথ বলিল, তারপর হঠাৎ কী মনে করে এমন অসময়ে এলি বল তো?
অনন্ত বেনামী চিঠিখানা কালনাথের হাতে দিয়া বলিল, চিঠিখানা দেখাতে এসেছি তোমাকে। দেখাতে কেন, দিতেই এসেছি। চিঠিখানা তুমি রাখ, আমার শ্বশুর পাঠিয়েছেন বাবার কাছে।
কালীনাথের মুখ মুহূর্তে বিবর্ণ হইয়া গেল। অনন্ত আর অপেক্ষা করিল না, উঠিয়া বাহির হইয়া আসিল! কিন্তু দরজা হইতে বাহির হইবার মুখেই পিছন হইতে কে ডাকিল, ঠাকুরপো!
অনন্ত পিছন ফিরিয়া দেখিল, ব্রজরানী জলখাবারের থালা হাতে তাহাকে ডাকিতেছে। অনন্তর আর যাওয়া হইল না, সে ফিরিল—বউদির হাতের খাবার তো ফেলে যাওয়া হতে পারে না! কি বল কালীদা? বউদি আমার স্বর্গের দেবী—তার হাতের জিনিস, এ যে অমৃত!
কালীনাথ শুষ্ক হাসি হাসিয়া বলিল, নিশ্চয়।
নিতান্ত অপ্রত্যাশিতভাবেই অনন্তর স্ত্রী একদিন আসিয়া উপস্থিত হইল। অনন্তর পিতা চরম-পত্রই পাঠাইয়াছিলেন, সেই পত্রের ফলে আলোকপ্রাপ্ত হইয়াও বধূর পিতা আর থাকিতে পারিলেন না। তিনি স্বয়ং উদ্যোগী হইয়া মেয়েকে পাঠাইয়া দিলেন।
ফুটবল টীম লইয়া অনন্তর সেদিন ম্যাচ দেখিতে যাইবার কথা। সকালবেলাতেই বধূকে এমন অযাচিতভাবে আসিতে দেখিয়া মনটা তাহার উল্লাসে ভরিয়া উঠিল। সে স্থির করিল সে আজ আর যাইবে না। কিন্তু সে-ই টীমের সর্বশ্রেষ্ঠ হাফব্যাক, তাহার উপর সে-ই ক্যাপ্টেন। মনটা তাহার খুঁতখুঁত করিতে লাগিল। অবশেষে ভাবিয়া-চিন্তিয়া স্থির করিল, খেলা শেষ হওয়ার পরেই সে ট্যাক্সি করিয়া ফিরিয়া আসিবে—ত্রিশ মাইল রাস্তা বই তো নয়! ট্যাক্সি না পাওয়া গেলে বাইসিক্ল আছে। রাত্রির অন্ধকারকে সে ভয় করে না।
সে পুলকিত চিত্তে বাড়ির ভিতর আপনার শয়নকক্ষে গিয়া উঠিল। বধূটি পিছন ফিরিয়া কী যেন করিতেছিল, অনন্ত সন্তর্পিত পদক্ষেপে আসিয়া তাহাকে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করিল। চকিত হইয়াই মুখ তুলিয়া অনন্তকে দেখিয়া সে সবলে আপনাকে মুক্ত করিবার চেষ্টা করিয়া বলিল—ছাড়।
হাসিয়া অনন্ত বলিল, এত রাগ কেন?
—রাগ নয়, ছাড় তুমি।
—রীতিমতো রাগ! কিন্তু আমি তো আবার বিয়ে করব লিখি নি। বাবা লিখেছিলেন, বিয়ে দেব।
—ছাড়, বলছি—ছাড়। নইলে আমি চিৎকার করব বলছি।
অনন্ত স্ত্রীকে মুক্ত করিয়া দিয়া বলিল, কিন্তু তোমার এমন ব্যবহার কেন?
বধূ সে কথার কোনো উত্তর দিল না, ক্রুদ্ধ নেত্রে স্বামীর মুখের দিকেই শুধু চাহিয়া রহিল। অনন্ত আবার বলিল, ওই তো কালীদাদার বউ, তার ব্যবহার দেখে এস, স্বামীকে সে কত ভক্তি—
মুখের কথা কাড়িয়া লইয়া বধূ বলিয়া উঠিল, কার সঙ্গে নিজেকে তুমি তুলনা করছ? শিবে আর বাঁদরে! সে বিদ্বান—
অনন্ত আর দাঁড়াইল না; হনহন করিয়া বাহির হইয়া চলিয়া গেল। একেবারে আস্তাবলে গিয়া ডাকিল, নেত্য!
নিত্য সহিস কয়েকজন বন্ধুবান্ধব জুটাইয়া গোপনে চোলাই-করা মদ খাইতেছিল, অসহিষ্ণু অনন্ত একেবারে দরজা ঠেলিয়া খুলিয়া বলিল, হাণ্টার কই?
হাণ্টারগাছটা লইয়া চলিয়া যাইতে যাইতে সে আবার ফিরিল—দেখি রে!
নিত্য বুঝিতে না পারিয়া বলিল, আজ্ঞে?
—ওই বোতলটা। —বলিয়া নিজেই অগ্রসর হইয়া বোতলটা তুলিয়া লইয়া খানিকটা গিলিয়া ফেলিল। নির্জলা হলাহল বুকের মধ্যে অগ্নিশিখার মতো জ্বালা ধরাইয়া দিল—মাথার মধ্যে ক্রোধ হু হু করিয়া জ্বলিয়া উঠিল। সে আবার দ্রুতপদে অন্দরে প্রবেশ করিয়া স্ত্রীর সম্মুখে দাঁড়াইয়া বলিল, কী বলছিলে, বল এইবার।
সে মূর্তি দেখিয়া বধূটি স্তম্ভিত হইয়া গেল, পরক্ষণেই সুরার গন্ধে ক্ষোভে আত্মবিস্মৃত হইয়া বলিয়া উঠিল, তুমি মদ খাও? মাতাল তুমি?
—হ্যাঁ খাই; মদ খাই, গাঁজা খাই, সব খাই। তোমার বাপের পয়সায় খাই?
আত্মবিস্মৃতা বধূ বর্ধিততর ক্ষোভে বলিয়া ফেলিল, মাতাল, মুখ্যু, বেরোও—
কথা তাহার অসমাপ্তই থাকিয়া গেল, হাণ্টারের আঘাতে তীব্র যন্ত্রণায় অস্থির হইয়া সে চিৎকার করিয়া উঠিল। হাণ্টারের পাকানো কশাখানির তীক্ষ্ণ আঘাতে বাহুমূল হইতে সমস্ত হাতখানা দীর্ঘরেখায় কাটিয়া গিয়াছে। অনন্ত হাণ্টার হাতে করিয়াই তরতর করিয়া নামিয়া গেল।
ফুটবল টীম লইয়া যাত্রার পথে ক্ষুধা অনুভব করিয়া সে আসিয়া উঠিল কালীনাথের বাড়ি—কালীদা!
কালীনাথও বাহির হইতেছিল, সে বলিল—এই যে, আমি যে যাচ্ছিলাম তোর কাছে।
অনন্ত বলিল, সে সব পরে শুনব। বউদি কই? বউদি?
—তোমার বউদির হুকুমেই যাচ্ছিলাম; তার ব্রত আছে, তোমায় তার ব্রাহ্মণ করেছে।
—সে হবে। কিন্তু এখন কিছু খেতে দাও তো বউদি।
ব্রজরানী অদূরে আসিয়াই দাঁড়াইয়াছিল, সে বলিল—সে কী! আজ তোমার বউ এসেছে—
—আঃ বউদি, থাক না ও-কথা। এখন তুমি খেতে দেবে কিছু? বল, নয় তো অন্যত্র চেষ্টা দেখি। আমার সময় নেই, তোমার বাপের বাড়ির শহরে যাচ্ছি—ম্যাচ খেলতে।
ব্রজরানী ব্যস্ত হইয়া থালায় জলখাবার সাজাইয়া আনিয়া নামাইয়া দিল। কালীনাথ প্রশ্ন করিল—ফিরবি কবে? পরশু যে তোর বউদির ব্রত।
ক্ষুধার শান্তিতে প্রসন্নভাবেই অনন্ত বলিল—কাল সকালে। পরশুর জন্যে ভাবনা কী? —কিন্তু ব্রতটা কী?
লজ্জিত হইয়া ব্রজরানী নতমুখী হইয়া রহিল। উত্তর দিল কালীনাথ, অবৈধব্য-ব্রত; অর্থাৎ আমার আগে মরবার পাসপোর্টের ব্যবস্থা করছেন আর কী!
—বাঃ! মেয়েদের এই ধারণাটা আমার ভারি ভালো লাগে কালীদা। —তারপর ব্রজরানীর মুখের দিকে চাহিয়া সে বলিল, বউদি, স্বর্গের দেবী তুমি।
লজ্জিতা ব্রজরানী প্রসঙ্গান্তর আনিয়া বলিল, আমার বাপের বাড়িতে গিয়ে কিন্তু তুমি যেন উঠ ঠাকুরপো। নইলে ঝগড়া হবে। আমারও উপকার হবে, ওঁদের খবর পাব। কদিন খবর পাইনি।
ম্যাচ জিতিয়াও অনন্তর মনটা ভালো ছিল না। প্রভাতের সেই তিক্ত স্মৃতি তাহার মনকে অহরহ পীড়া দিতেছিল। সে অবসন্ন ভাবেই ব্রজরানীর পিত্রালয়ের বাহিরের ঘরে নির্জীবের মতো শুইয়া ছিল। ব্রজরানীর অনুরোধমতো সে এইখানেই আতিথ্য স্বীকার করিয়াছে। দলের সকলে দারুণ আপত্তি করিয়াছিল—না, না, সে হবে না ভাই। জিতলাম ম্যাচ, সমস্ত রাত আজ হৈ-হৈ করব, ফুর্তি করব। তুমি ক্যাপ্টেন—তুমি না থাকলে চলে।
সবিনয়ে হাতজোড় করিয়া অনন্ত বলিয়াছিল, সে হয় না ভাই। আমি কথা দিয়ে এসেছি বউদিকে।
—বেশ। তবে একটু খেয়ে যাও।—তাহারা বোতল গ্লাস বাহির করিয়া বসিল। কিন্তু জিব কাটিয়া অনন্ত বলিল—ছি, তাই হয়?—কুটুম্বলোক!
বার বার অনন্তর চোখ ভরিয়া জল আসিতেছিল। মনটা যেন উদাস হইয়া গিয়াছে। ব্রজরানীর মা ঘরে প্রবেশ করিয়া বলিলেন, ব্রজ আমার ভালো আছে বাবা?
তাড়াতাড়ি অনন্ত উঠিয়া তাঁহাকে প্রণাম করিয়া বলিল—হ্যাঁ মাউই-মা, বউদি ভালোই আছে।
—ব্রজ আমার সুখ্যাতি নিয়েছে তো বাবা? তোমাদের যত্ন-আত্তি করে তো?
উচ্ছ্বসিত হইয়া অনন্ত বলিল, এ যুগে এমন মেয়ে হয় না মাউই-মা। সতী-সাবিত্রী বইয়ে পড়েছি—বউদির মধ্যে চোখে দেখলাম।
ব্রজরানীর মা পরম তৃপ্ত হইয়া বলিলেন, বেঁচে থাক বাবা, দীর্ঘায়ু হও। তোমরা নিজেরা ভালো, তাই সেই দৃষ্টান্তে ব্রজ আমার ভালো হতে পেরেছে।
অতঃপর বেয়াই-বেয়ানদের প্রণাম জানাইতে অনুরোধ করিয়া তিনি বিদায় লইলেন। কিছুক্ষণ পর আবার তিনি একটা বাটিতে দুধ লইয়া প্রবেশ করিয়া ডাকিলেন—বাবা!
অনন্তর মন তখন আপনার শ্বশুরবাড়ির সহিত এই বাড়িটার তুলনা করিতে ব্যস্ত ছিল, সে কোনো সাড়া দিল না। ভালো লাগিল না তাহার। ব্রজরানীর মা তাহার নিস্তব্ধতা দেখিয়া আপন মনেই বলিল, খেলাধুলো করে নিথরে ঘুমিয়ে পড়েছে বাবা।
তিনি আবার বাহির হইয়া গেলেন। বাড়ির ভিতরে হরদাস প্রশ্ন করিলেন, ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝি?
—হ্যাঁ, ক্লান্ত হয়ে ঘুমুচ্ছে, আর ডাকলাম না।
—ওঃ, খুব খেলেছে ছোকরা। ভালো খেলে। স্বাস্থ্যও ভালো—বেশ ছেলে।
মা বলিলেন, ভারি মিষ্টি কথা; ব্রজর কথা বলতে একেবারে পঞ্চমুখ। ভালো বংশের ছেলে। সেই চিঠিটা কিন্তু তাহলে কেউ হিংসে করে লিখেছিলে। মাতাল, নেশাখোর, চরিত্রহীন, গোঁয়ার। দেখে তো মনে হয় না। তুই হাসছিল যে?
—হাসছি।
—কেন, তাই তো জিজ্ঞেস করছি!
—সে চিঠিখানা কিন্তু কালীনাথের হাতের লেখা। কালীনাথের এখনকার চিঠির লেখার সঙ্গে সে চিঠি মিলিয়ে দেখেছি আমি। ব্রজকে ও দেখতে এসেছিল তো—খুব পছন্দ হওয়ায় এই কাণ্ড সে করেছিল।
—তা ব্রজর আমার তপস্যা ভালো। কালীনাথ আমার রূপে গুণে জামাইয়ের মতো জামাই। ব্রজ বলতে পাগল।
অনন্তর মাথার ভিতরটা ঝাঁ-ঝাঁ করিয়া উঠিল। শেষরাত্রে উত্তপ্ত মস্তিষ্কে সে স্থির করিল, সে পড়াশুনাই করিবে। জীবনে প্রশংসা, শান্তি—এ তাহার চাই। তাহার জন্য তপস্যার প্রয়োজন হয়, সে তপস্যাই করিবে। সর্বান্তঃকরণে সে কালীনাথকে মার্জনা করিল, ব্রজরানীকে বার বার মনে মনে আশীর্বাদ করিল—তুমি চিরসুখী হও, চিরায়ুষ্মতী হও।
বাড়িতে আসিয়াই কিন্তু তাহার সব গোলমাল হইয়া গেল। দারুণ ক্রোধে তাহার পিতা বলিলেন, তোর মুখ দেখতে চাই না আমি। তুই আমাদের বংশের কলঙ্ক। তোর থেকে এত বড় বাড়ির মান গেল, মর্যাদা গেল। তুই মরলি না কেন?
কালই অনন্তর বধূ যে লোকের সঙ্গে আসিয়াছিল, সেই লোকের সঙ্গেই পিত্রালয়ে চলিয়া গিয়াছে। অনুনয় উপরোধ সমস্ত উপেক্ষা করিয়া শেষ পর্যন্ত পুলিশের সাহায্য লইতে উদ্যত হইলে, এ-পক্ষ নীরবে পথ মুক্ত করিয়া সরিয়া দাঁড়াইতে বাধ্য হইয়াছিলেন। বধূটি যে কটুকথাগুলি বলিয়াছে, তাহার তীক্ষ্ণতায় মর্মাহত অনন্তর জননীর চোখের জল এখনও শুকায় নাই। অনন্তর সব গোলমাল হইয়া যাইতেছে। তবুও সে অত্যন্ত দৃঢ়তার সহিত বলিল, আমি চললাম।
—কোথায়?
—শ্বশুরবাড়ি।
মা আর্তস্বরে বলিলেন, না না।
—ভয় নেই মা। আমি শ্বশুরের পায়ে ধরে ক্ষমা চাইব।
সে বাহির হইয়া চলিয়া গেল, সেই বস্ত্রে, সেই অভুক্ত অবস্থায়। মা পিছন পিছন আসিয়াও পিছন-ডাকার অমঙ্গল ভয়ে আর ডাকিতে পারিলেন না।
শ্বশুরবাড়িতে আসিয়াই সে সত্য-সত্যই শ্বশুরের পা দুইটা জড়াইয়া ধরিল। শ্বশুর মুহূর্তে পা দুইটা টানিয়া লইয়া দ্রুতগতিতে স্থান ত্যাগ করিয়া চলিয়া গেলেন। অনন্ত স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। অকস্মাৎ তীব্র যাতনায় অস্থির হইয়া লাফ দিয়া ঘুরিয়া দাঁড়াইয়া দেখিল, হাণ্টার উদ্যত করিয়া রক্তচক্ষু শ্বশুর। অনন্ত এবার স্থির হইয়া দাঁড়াইল, হাণ্টারের আস্ফালিত রজ্জুশিখা বার বার তাহার দেহখানাকে জর্জরিত করিয়া দিল। জামা ছিঁড়িয়া সর্বাঙ্গ রক্তাক্ত হইয়া উঠিল।
—বেরোও আমার বাড়ি থেকে—বেরোও।
অনন্ত স্তব্ধ হইয়াই দাঁড়াইয়া রহিল।
হাতের হাণ্টারগাছটা ফেলিয়া দিয়া গৃহকর্তা হাঁকিলেন, দারোয়ান! নিকাল দো ইসকো। —তিনি স্থান ত্যাগ করিয়া চলিয়া গেলেন।
দারোয়ান আসিতে অনন্ত দ্রুতপদে বাড়ি হইতে বাহির হইয়া চলিয়া গেল।
মাথার মধ্যে তাহার আগুন জ্বলিয়া উঠিল—সমস্ত সঙ্কল্প ভাসিয়া গেল। সে স্থির করিল, বাড়ি হইতে রিভলভারটা লইয়া, ফিরিয়া ঐ দাম্ভিক জানোয়ারটাকে হত্যা করিবে, তারপর সে নিজে আত্মহত্যা করিবে। বাড়ির স্টেশনে নামিয়া দেখিল, তাহাদের লোকজন পালকি লইয়া অপেক্ষা করিতেছে। বধূ লইয়াই সে ফিরিবে, এমন প্রত্যাশাই সকলে করিতেছে। বাড়ির সরকার অগ্রসর হইয়া আসিয়া বলিল, বউমা—
—আসেন নি।
—এ কী ছোটবাবু! সর্বাঙ্গে—!—সরকার শিহরিয়া উঠিল।
অনন্ত দ্রুত স্টেশন ত্যাগ করিয়া মাঠের রাস্তায় নামিয়া পড়িল।
সকলের অলক্ষিতে একটা অব্যবহার্য সিঁড়ি দিয়া সে উপরে আসিয়া উঠিল। রিভলভারটা কোথায়? মুহূর্তে অব্যবস্থিত চিত্তে তাহার খেয়াল হইল, শ্বশুরকে হত্যা করিয়া কী হইবে? কন্যার বৈধব্যের যাতনা ভোগ করিবে কে! বার বার তাহার মন বলিল, সেই ভালো। সে আপনার পরম প্রিয় রিপীটারটা তুলিয়া লইল। খুলিয়া দেখিল, কয়টা কার্তুজ ভরাই আছে।
ঘরে—এই ঘরে? না, একবার কোনোক্রমে ব্যর্থ হইলে তখন আর উপায় থাকিবে না। কোনো নির্জন প্রান্তরে। আত্মহত্যার সঙ্কল্প লইয়া রিপীটারটা হাতে করিয়াই অলক্ষিতে সে আবার বাহির হইয়া পড়িল। বিহ্বলের মতো কোনদিকে কোনপথে সে চলিয়াছিল—খেয়াল ছিল না।
—অনু! অনু!
কালীনাথের বাড়ির জানালায় অনন্তর প্রতীক্ষায় ব্রতচারিণী ব্রজরানী দাঁড়াইয়া ছিল। কালীনাথ জল খাইতে বসিয়াছে, জল খাইয়াই অনন্তকে সে ডাকিয়া আনিবে। ওপাশে ব্রতের আয়োজন সাজানো। ব্রজরানীর চোখে পড়িল, অনন্ত বন্দুক-হাতে চলিয়াছে। সে বলিল, অনু ঠাকুরপো পথ দিয়ে যাচ্ছে।
কালীনাথ ডাকিল—অনু! অনু!
কে? কালীনাথ? অনন্তর মস্তিষ্কের অগ্নিশিখার উপর যেন ঘৃতাহুতি পড়িয়া গেল; সহস্র শিখায় লেলিহান হইয়া সে জ্বলিয়া উঠিল। কালীনাথ! তাহার জীবনের কুগ্রহ—তাহার সুখে পরম সুখী কালীনাথ! কালীনাথ! কালীনাথ—তাহার জীবনের সাথী কালীনাথ! একা সে কোথায় যাইবে!
অনন্ত বাড়ির মুক্ত দ্বারপথে প্রবেশ করিয়া বলিল—এই যে!
হা-হা করিয়া হাসিয়া কালীনাথ বলিল, এসেই বন্দুক হাতে?
—কুকুর-মারা মনে পড়ে? তেমনই করে মারব তোমাকে।
সঙ্গে সঙ্গে বন্দুকটা সে তুলিয়া ধরিল। ব্রজরানী আর্তস্বরে চিৎকার করিয়া উঠিল; কালীনাথ বন্দুকের নলটা চাপিয়া ধরিয়া অন্যদিকে ফিরাইবার চেষ্টা করিয়া চিৎকার করিয়া উঠিল—অনু, ক্ষমা—ক্ষমা—
ভীষণ গর্জনে মৃত্যু তখন হুঙ্কার দিয়াছে। কালীনাথের যে হাতখানি নলটা চাপিয়া ধরিয়াছিল সেটা ভাঙিয়া গেল। ব্রজরানী কালীনাথকে সবলে আকর্ষণ করিয়া চীৎকার করিল—ঠাকুরপো!
আবার বন্দুকটা গর্জিয়া উঠিল, কালীনাথ পড়িয়া গেল, কিন্তু তখনও সে জীবিত। আবার। কালীনাথের রক্তাপ্লুত দেহ নিস্পন্দ নিথর।
অনন্ত দ্রুত বাহির হইয়া গ্রাম পার হইয়া প্রান্তরে পড়িল, তারপর এক স্থানে দাঁড়াইয়া বন্দুকের নলটা মুখে পুরিয়া পা দিয়া ঘোড়াটা টানিয়া দিল। খট করিয়া একটা আওয়াজই হইল শুধু। এ কী! বন্দুকটা তুলিয়া কার্তুজের ঘর খুলিয়া অনন্ত দেখিল, শূন্য। নাই, আর নাই। তিনটি কার্তুজই ছিল, ফুরাইয়া গিয়াছে! যাক, দড়ি তো আছে। কাপড় ছিঁড়িয়া দড়ি তো সহজেই হইবে।
পরক্ষণেই আতঙ্কে শিহরিয়া উঠিয়া বন্দুকটা ফেলিয়া দিয়া সভয়ে সে ছুটিতে আরম্ভ করিল। মৃত্যুর ভয়ঙ্কর মূর্তি—ঐ যে রক্তাক্ত বিকৃতমূর্তি কালীনাথ ভাঙা হাতে ফাঁসির দড়ি লইয়া তাহার দিকে ছুটিয়া আসিতেছে।
প্রাণপণে সে ছুটিল।
ধরা পড়িল সে দশদিন পরে বাংলার বাহিরে একটা দুর্গম পার্বত্য প্রদেশে। সে তখন ঘোর উন্মাদ। আট বৎসর পাগলা গারদে থাকার পর প্রকৃতিস্থ হইয়াছে, দায়রা-আদালতে সেই বিচার হইতেছে। কাল ব্রজরানীর সাক্ষ্য দিবার দিন।
আজ আট বৎসর ব্রজরানী অশৌচ পালন করিয়া আসিতেছে। তৈলহীন স্নান, আপন হাতে হবিষ্যান্ন আহার, মৃত্তিকায় শয়ন করিয়া সে এই দিনটির প্রতীক্ষা করিয়া আছে।
হরদাসকে মা বলিলেন, বুঝলাম সব বাবা। এই রাত্রি তিন প্রহর হয়ে গেল; একে একে অনন্তর মা বউ সকলে এলেন। কিন্তু উপায় কই? সে তো কথা শুনলে না। দেখে আয়, চোখ বুজে বসে আছে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে, মধ্যে মধ্যে ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ছে; চোখ খুলে সে তাকালে না পর্যন্ত। নইলে যা হবে হোক, ছেলেটার তো একটা ভবিষ্যৎ হত!
বলিতে ভুলিয়াছি কালীনাথের মৃত্যুর সময় ব্রজরানী ছিল অন্তঃসত্বা। একটি পুত্র সে এই দুর্ভাগ্যের মধ্যেও পাইয়াছে।
হরদাসবাবু নিজে গিয়া ডাকিলেন, ব্রজ!
চোখ না খুলিয়াই সে উত্তর দিল, না।
—কথাটাই শোন।
—না।
মা আসিয়া বলিলেন, এইবার একটু ঘুমিয়ে নে ব্রজ।
শিহরিয়া উঠিয়া ব্রজ বলিল, না।
ঘুমাইলেই সে মূর্তি ব্রজর সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইবে।
মা বলিলেন—আমি গায়ে হাত দিয়ে থাকব রে।
—না।
আদালত লোকে লোকারণ্য হইয়া গিয়াছে। ব্রজরানীর সাক্ষ্য শুনিবার জন্য আজ লোক যেন ভাঙিয়া পড়িয়াছে। ব্রজরানী কঠিন দৃঢ় পদক্ষেপে আসিয়া সাক্ষীর কাঠগড়ায় উঠিল।
সম্মুখের কাঠগড়াতেই একটি লোক—শুভ্রকেশ, শীর্ণ, ন্যুব্জদেহ, স্তিমিত বিহ্বল দৃষ্টি, হাতজোড় করিয়া দাঁড়াইয়া রহিয়াছে। সে বিহ্বল দৃষ্টিতে ব্রজরানীর দিকে চাহিয়া সপ্রশ্ন ভঙ্গিতে যেন নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করিতে লাগিল। উত্তর যেন অতি পরিচিত স্থানে, অতি নিকটে রহিয়াছে, তবু সে খুঁজিয়া পাইতেছে না।
ব্রজরানী স্তম্ভিত হইয়া খুঁজিতেছিল, কোথায় সে দৃপ্ত দাম্ভিক বলশালী যুবা? কই, সে কোথায়? এ কি সেই মানুষ? না না, এ সে নয়, হইতে পারে না। তাহার অন্তরের মধ্যে একটা প্রবল আবেগ আসিয়া অকস্মাৎ তাহাকে আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিল। সে থরথর করিয়া কাঁপিতেছিল। চোখ দুইটি জলে পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল।
অকস্মাৎ ঐ জীর্ণ শীর্ণ হতভাগ্য যেন স্মৃতিকে খুঁজিয়া পাইল, সে পরম মুগ্ধ দৃষ্টিতে গভীর শ্রদ্ধায় তাহার দিকে চাহিয়া বার বার ঘাড় নাড়িয়া যেন নিজেকেই সমর্থন করিয়া বলিল—দেবী, দেবী। স্বর্গের দেবী! তুমি বউদি!
ব্রজরানীর চোখ দিয়া ঝরঝর করিয়া জল ঝরিয়া পড়িল। করুণায় মমতায় সে যেন দেবীই হইয়া উঠিয়াছে।
সরকারী উকিল ব্রজরানীকে সান্ত্বনা দিয়া বলিলেন, কেঁদে কী করবেন মা, এখন বিচার প্রার্থনা করুন। সুবিচার যাতে হয়, তাতে সাহায্য করুন।
পৃথিবীর দীনতা—পুঞ্জীভূত হীনতায় জীর্ণ, ঘৃণাহত ঐ হতভাগ্য, হায় রে, গলায় দড়ি বাঁধিয়া তাহাকে ঝুলাইয়া দিবে! এ কী বিচার! এ কাহার বিরুদ্ধে বিচার। ব্রজরানীর সমস্ত যেন গোলমাল হইয়া গেল। সরকারী উকিল প্রশ্ন আরম্ভ করিলেন। ওদিকে জনতার মধ্যে হইতে অস্ফুট গুঞ্জনে উচ্চারিত দুই-চারিটি কথা ভাসিয়া আসিতেছিল।
—ফাঁসি নয়, বন্দুকের গুলি দিয়ে মারুক ওকে।
ব্রজরানীর চোখে আবার জল দেখা দিল। সে চারিদিকে চাহিয়া দেখিল, সমস্ত লোক নিষ্করুণ নেত্রে আক্রোশভরে চাহিয়া আছে ঐ হতভাগ্যের দিকে। গম্ভীরমুখে জজ সাহেব ইংরেজিতে কী মন্তব্য করিলেন, অর্থ না বুঝিলেও ব্রজরানী সে শব্দের কাঠিন্য অনুভব করিল।
আদালতের পিয়ন বার বার হাঁকিতেছিল—চুপ—চুপ—আস্তে।
—এই লোকটিকে দেখুন। অনেক পরিবর্তন হয়েছে অবশ্য। এই অনন্ত কি আপনার স্বামীকে খুন করেছে?—সরকারী উকিল প্রশ্ন করিলেন।
ব্রজরানীর অন্তরাত্মা তারস্বরে প্রতিবাদ করিয়া উঠিল, তাহারই প্রতিধ্বনি জনতা স্তম্ভিত হইয়া শুনিল—না।
তারপর সংক্ষিপ্ত কয়েকটি কথা।
ব্রজরানী ফিরিল যেন স্বপ্নাচ্ছন্নের মতো—হৃদয়ে একটা প্রগাঢ় প্রশান্তি—হৃদয়-মন যেন কত লঘু হইয়া গিয়াছে। সঙ্গে ছিলেন হরদাসবাবু। তিনি তাঁহাকে বলিলেন, তোর মামাশ্বশুরের সঙ্গে একবার দেখা কর ব্রজ। যা দিতে চেয়েছিলেন—চেয়ে নে। ভবিষ্যতে—
ব্রজ বলিল, না।
বাড়িতে ব্যাপারটার সমালোচনার আর অন্ত ছিল না। ব্রজর মা পর্যন্ত কন্যার বুদ্ধিহীনতার সমালোচনা করিতেছিলেন। তিনি বলিলেন, তুমিই একবার যাও হরদাস, ওর নাম করে। সে গেল কোথায়?
সন্ধ্যার অন্ধকারে ব্রজরানী ক্লান্ত হইয়া ঘরের মধ্যে ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল। মা আসিয়া দেখিয়া বিরক্ত হইয়া বলিলেন, আবার এখুনি স্বপ্ন দেখে চেঁচিয়ে একটা কাণ্ড করে বসবে! ব্রজ—ও ব্রজ! চল নীচে শুবি, এখানে একা তোর আবার ভয় করবে।
ব্রজ নিদ্রারক্ত চোখ মেলিয়া বলিল, না।
সে আবার নিশ্চিন্ত নিদ্রায় নয়ন নিমীলিত করিল।