মতিলাল

‘চোত-পরব’ অর্থাৎ গাজনের সঙ বাহির হইয়াছিল। ঢাক-ঢোল বাজাইয়া শোভাযাত্রার মধ্যে বাবা বুড়োশিবের দোলা চলিয়া গেল, তাহার পিছনে পিছনে সঙের দল চলিতেছিল। একজন বাজিকর সাজিয়াছে, সঙ্গে একটা প্রকাণ্ড বড় ভালুক, একটা হনুমান; বাজিকরের বগলে একটা সাপের ঝাঁপি। এই বাজিকরের পিছনেই যত ছেলের ভিড়। কৌতুকের সীমা নাই, অথচ ভয়ও আছে, একটু দূরে দূরে কোলাহল করিতে করিতে তাহারা চলিয়াছে। ভালুকটা প্রকাণ্ড বড়—বোধহয় বুড়া—গায়ের রোঁয়াগুলো অনেকস্থলে উঠিয়া গিয়াছে, ছেলের পাল সেটাকে লক্ষ্য করিয়াই বাজিকরের অলক্ষ্যে ক্রমাগত ঢিল ছুঁড়িতেছিল। বুড়া ভালুকটা কয়েকবার এমনইভাবে আঘাত পাইয়া ফিরিয়া দাঁড়াইয়া গোঁ-গোঁ করিয়া উঠিল। সভয়-কৌতুকে ছেলের দল এদিকে-ওদিকে ছুটিয়া পলাইয়া গেল। ভালুকটা খিলখিল করিয়া হাসিয়া আবার বাজিকরের সঙ্গে চলিতে লাগিল।

ছেলেদের দলের অগ্রগামী পার্বতী তাহার পার্শ্বচর মদনকে বলিল, মানুষ রে, মানুষ—হাসছে। সেজেছে।

মদন বলিল, ধেৎ! নারায়ণবাবুদের কাছারীতে জ্বরে কাঁপছিল, দেখিস নি? ভালুক না হলে জ্বর আসে—কাঁপে? গাঁজা খেলে—

চোটা ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট শ্যামগোপালবাবুর বৈঠকখানাটা সম্মুখেই, সেখানে তখন শ্যামগোপালবাবু ইউনিয়ন বোর্ডের খাতাপত্র দেখিতেছিলেন। বাজিকরের হনুমানটা ‘উপ’ শব্দে লাফ দিয়া দাওয়ার উপর উঠিয়া বসিল, ভালুকটা প্রণাম করিয়া ধপ করিয়া সেইখানে পড়িয়া জ্বরে কাঁপিতে আরম্ভ করিল। হনুমানটা প্রেসিডেন্টবাবুকে দাঁত দেখাইয়া ঘন ঘন চোখ মিটমিট করিতে আরম্ভ করিল।

শ্যামবাবু অল্প একটু হাসিয়া বলিলেন, বেশ বেশ! ওবেলায় এসে পয়সা নিয়ে যাস।

 

বাজিকর জোড়হাত করিয়া বলিল, আজ্ঞে, এই বেলাতেই পেলে—

শ্যামবাবু বলিলেন, যা বেটা, দেখছিস না এখন সরকারি কাজ করছি?

বাজিকর আর কিছু বলিতে সাহস করিল না, সে প্রণাম করিয়া ফিরিল।

শ্যামবাবুর খোট্টা চাপরাসীটা পাশে দাঁড়াইয়াছিল, সে বলিল, আরে ভালকো তো বহুৎ লঢ়াই করে রে, দেখে তেরা কেমন ভালকো। —বলিতে বলিতে সে ধাঁ করিয়া ভালুকটাকে বেশ কায়দা করিয়া জাপটাইয়া ধরিল। অতর্কিত আক্রমণে ভালুকটা বেকায়দায় নিচে পড়িয়া গেল।

বাজিকর চটিয়া উঠিয়াছিল, সে বলিল, ই কী করেন তোমার সিংজী? বলেহার বেটা, বলেহার বেটা ভালুক রে!

ভালুকটা নিজের অসতর্ক অবস্থা তখন অনেকটা সামলাইয়া লইয়াছে। চারিদিকে দর্শক জমিয়া গিয়াছিল। সম্মুখেই দাঁড়াইয়া পার্বতী আর মদন যুধ্যমান ভালুক ও চাপরাসীটার প্যাঁচ-কষাকষির সঙ্গে আপন আপন দেহ লইয়া আঁকিয়া বাঁকিয়া উঠিতেছিল, কখনও দাঁতে ঠোঁট কামড়াইয়া বলিতেছিল দে—দে—দে!

শুধু মদন আর পার্বতী নয়, ওরূপ ধারায় মুখভঙ্গি করিতেছিল আরও অনেকে, মায় শ্যামগোপালবাবু পর্যন্ত। ভালুকটা যখন চাপরাসীটাকে চিত করিয়া ফেলিয়া দিল, তখন তিনি ধনুকের মতো বাঁকিয়া দাঁড়াইয়া আছেন। দর্শকরা হাসিবার উপক্রম করিতেছিল, এমন সময় হনুমানটা চট করিয়া উঠিয়া পরাজিত চাপরাসীটার মুখের উপর বাঁ পায়ের একটা মৃদু লাথি মারিয়া দিয়া দর্শকদের একবার দাঁত দেখাইয়া দিল। দর্শকের মধ্যে হাসির একটা হাঁড়ি যেন সশব্দে ফাটিয়া পড়িল। পার্বতী পথের উত্তপ্ত ধূলার উপরেই একটা ডিগবাজি মারিয়া দিল।

 

চাপরাসীটা অপমানে চটিয়া উঠিয়াছিল, শ্যামবাবুও চটিয়াছিলেন; কিন্তু এতগুলি লোকের সহানুভূতির বিরুদ্ধে বিশেষ কিছু বলিতে সাহস করিলেন না। শুধু গম্ভীরভাবে প্রশ্ন করিলেন, হনুমান সেজেছে ওর নাম কীরে? কান ধর তো বেটার, এই চৌকিদার!

ভিড়ের মধ্য হইতে কে বলিয়া উঠিল, আসছে বারে ভোট দোব না কিন্তু।

অত্যন্ত রুষ্টকণ্ঠে শ্যামবাবু কহিলেন, কে?

বক্তা আসিয়া সম্মুখে জোড়হাতে দাঁড়াইয়া বলিলেন, প্রভু, আমি।

শ্যামবাবু ফিক করিয়া হাসিয়া ফেলিলেন, বক্তা তাঁহার এক আত্মীয় এবং বন্ধু—হবুকাকা।

শ্যামবাবু কহিলেন, এস এস, তামাক খাও খুড়ো।

হবুকাকা বলিলেন, যা যা সব, যা এখন।

সঙের দল চলিয়া গেল। সমস্ত গ্রামখানা ঘুরিয়া বাজিকর যখন শিবতলায় ফিরিল, তখন বেলা প্রায় চারিটা। দর্শকদলের বেশি কেহ আর তখন সঙ্গে ছিল না, শুধু পার্বতী তখনও পিছন ছাড়ে নাই। গাজনের পাণ্ডা হরিলাল পাত্র দাওয়ায় দাঁড়াইয়াছিল, বিরক্তিভরে সে বলিল, ওঃ, আমোদ তোদের আর শেষই হয় না। নে বাপু, নৈবিদ্যি নিয়ে যা।

সঙ্গে সঙ্গে হনুমান, ভালুক, বাজিকর এক এক গামছা খুলিয়া বসিল। হরিলাল সের খানেক করিয়া  চাল, কয়টা কলা ও সামান্য কয়েকখানা বাতাসা বিতরণ করিয়া দিয়া বলিল, এইবারে আমি খালাস বাবা।

 

পার্বতী আশ্চর্য হইয়া গিয়াছিল, সে আরও আশ্চর্য হইয়া গেল, যখন বাজিকর জানোয়ার দুইটাকে ছাড়িয়া দিয়া চলিয়া গেল। হনুমানটাও এক দিকে চলিয়া গেল, ভালকটাও পাশের গ্রামের পথ ধরিল। ভয়ে সে দূরত্ব একটু বাড়াইয়া দিয়া নাচিতে নাচিতে ভালুকটার পিছন ধরিল।

খানিকটা মাঠ পার হইয়াই ‘মৌলকিনী’ পুকুর, ভালুকটা পুকুরের ঘাটে নামিয়া বসিল, তারপর হাত পা মুখ ও দেহ হইতে একে একে খোলসগুলি ছাড়াইতে আরম্ভ করিল।

পার্বতীর আনন্দের সীমা-পরিসীমা ছিল না, —তাহার অনুমানই সত্য হইয়াছে। সে করতালি দিয়া বলিয়া উঠিল, মানুষই বটে, মানুষই বটে, ওরে বাবা রে!

শব্দ শুনিয়া ভালুক তাহার দিকে চাহিয়া পরমানন্দে দাঁত বাহির করিয়া হাসিতেছিল। কিন্তু সে কী ভীষণ মূর্তি! হাঁড়ির মতো প্রকাণ্ড মাথা, মাথায় ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল, আলকাতরার মতো কালো রঙ, নাকটা থ্যাবড়া, চোখ দুইটা আমড়ার আঁটির মতো গোল এবং মোটা, দুই গালের থলথলে মাংস খানিকটা করিয়া চোয়ালের নীচে ঝুলিয়া পড়িয়াছে, মুখগহ্বরের পরিধি আকর্ণ-বিস্তৃত। সেই মুখগহ্বর মেলিয়া বড় বড় দাঁত বাহির করিয়া সে হাসিতেছিল, দেখিয়া পার্বতী সভয়ে ছুটিয়া পলাইল। ভালুক তাড়াতাড়ি উঠিয়া দাঁড়াইয়া ডাকিল, ও খোকাবাবু, ও খোকাবাবু!

পার্বতী একবার দাঁড়াইয়া ফিরিয়া চাহিল। ভয় অপেক্ষা বিস্ময়ের মাত্রা তাহার অনেক গুণ অধিক হইয়া উঠিয়াছিল। এত লম্বা এত মোটা আর এত কালো লোক সে কখনও দেখে নাই। সমস্ত গা বাহিয়া কালো আঠার মতো কী ঝরিতেছে! বুকও গুরগুর করিতেছিল, ভালুক, না ভূত? না, তাহার চেয়েও বেশি মেলে গয়লাদের কাদামাখা মহিষগুলোর সঙ্গে। লোকটা একখানা বাতাসা হাতে তুলিয়া তখনও তেমনই হাসিতে হাসিতে ডাকিতেছিল, পেসাদ, পেসাদ, শিবের পেসাদ।

 

পার্বতী সভয়ে তাহাকে লক্ষ্য করিতেছিল, ভালুকের কথা শুনিয়া সে দুই পা পিছাইয়া গেল। ভালুক এবার কয় পা তাহার দিকে আগাইয়া আসিল, আরও খানিকটা বেশি হাসিয়া বলিল, ভয় কী খোকাবাবু, এস।

পার্বতী নিমেষের মধ্যে পিছন ফিরিয়া ছুটিল এবং পথপার্শ্বের জঙ্গলের আড়ালে অদৃশ্য হইয়া গেল। ভালুক হাসিতে হাসিতে ঘাটে ফিরিয়া নৈবেদ্যের পুঁটুলিটা খুলিয়া বসিল।

সবসুদ্ধ গামছাটা  জলে ভিজাইয়া লইয়া চাল কলা ও বাতাসায় মাখিয়া প্রকাণ্ড বড় বড় গ্রাসে অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে শেষ করিয়া ফেলিল। উচ্ছিষ্টলোভী কয়টা কাক দূরে বসিয়াছিল, শূন্য গামছাখানা সে বার কয়েক তাহাদের দিকে সজোরে ঝাড়িয়া দিয়া বলিল, ওই লে, ওই লে। —তারপর গামছাখানা জলে কাচিয়া লইয়া ভালুকের পোশাক ঘাড়ে ফেলিয়া সে পথ ধরিল। ডোমপাড়ায় পৌঁছিয়া একটা বাড়িতে ঢুকিয়া ডাকিল, ভোবন, আজ যে মজা, বুঝলি কিনা!

‘ভোবন’ অর্থাৎ ভুবনমোহিনী ঘরের ভিতর হইতে বাহির হইয়া আসিয়া বলিল, জ্বালাস না আমাকে আর, আপন জ্বালাতে বলে মলাম আমি! ভাতের হাঁড়িটা নামা দেখি।

ভুবনমোহিনী ওই লোকটির যেন ছায়া বা দর্পণের মধ্যের নারীরূপিণী প্রতিবিম্ব। অমনই কালো, অমনই দৈর্ঘ্যে, অমনই পরিধিতে। মাথার সম্মুখেই সিঁথি জুড়িয়া একটা টাক, প্রকাণ্ড বড় মুখের মধ্যে অতি ক্ষুদ্র দুইটা চোখ, লম্বা নাক, তাহার উপর উপরের ঠোঁটের এক পাশের খানিকটা মাংস নাই, সে দিক দিয়া দুইটি দাঁত নিচের ঠোঁটের উপর চাপিয়া বসিয়া আছে।

ভালুকের পোশাকটা ঘাড় হইতে ফেলিয়া পুরুষটি ভাতের হাঁড়ি নামাইতে চলিল।

 

ভুবন বলিল, আমার মাথা বলে খসে গেল? ওষুধ নাই, পত্তর নাই, আর বাঁচব না আমি।—ও মা!

পুরুষটি কোনো উত্তর দিল না, কোথা হইতে একটা পোড়া বিড়ি বাহির করিয়া উনানের আগুনে সেটাকে ধরাইতে বসিল। ভুবন তাহার কাছে আসিয়া বসিল, তু ঘরে বসে থাকবি কেনে, বল? একা মেয়েমানুষ আমি কত রোজগার করব?

ভালুক নিজের কনুইটা দেখিতে দেখিতে বলিল, তাই বলি, জ্বলছে কেনে? মাস ছেড়ে গিয়েছে দলকাছাড়া হয়ে।

তারপর ভুবনের দিকে চাহিয়া বলিল, বাবুদের ওই খোট্টা চাপরাসী বেটা আচমকা আমাকে চেপে ধরে কায়দা করে ফেলিয়েছিল আর টুকচে হলে।

ভুবন বলিল, ত্যাল লাগা খানিক।—বলিয়াই সে মাটির উপর শুইয়া পড়িল, আঃ, গা-গতর যেন ঢিঁকিতে কুটছে!—বাবা!

ভালুকের কথা তখনও শেষ হয় নাই, সে বলিতেছিল, তেমনই দিয়েছি বেটাকে ঠিক করে। আমাকে পারবে কেনে বেটা, আমার ক্ষ্যামতায় আর—

মুখের কথা কাড়িয়া ভুবন বলিল, তাই তো বলছি, ওই ক্ষ্যামতায় খাটলে যে রোজকার হয়! আচ্ছা, কেন খাটিস না, বল দেখি?

ভালুক বলিল, উ গাঁয়ে একটি কী সুন্দর ফুটফুটে ছেলে, বুঝলি ভোবন—

ভুবন ভুলিল না, সে বাধা দিয়া বলিল, তোর ভাত আমি যোগাতে পারি? খাটুনিকে এত ভয় কীসের তোর?

—ভয় আবার কী?

—তবে?

নিজের বিশাল দেহের দিকে চাহিয়া ভালুক কহিল, খাটতে গেলে গতর দেখে সব। বলে, গতর দেখ আর খাটছে দেখ। খুঁড়ে খুঁড়ে আমার গতর কমে গেল। উঁহু, উ সব হবে না। দত্ত-কাকা বলেছে, কলকাতার যাত্রার দলে ঢুকিয়ে দেবে আমাকে।

এ কথা ভুবনের বহুবার শোনা কথা। বহু কাণ্ড এই লইয়া হইয়া গিয়াছে; ভুবন চুপ করিল। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ যেন তাহার কী মনে পড়িয়া গেল, সে উঠিয়া বসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, সঙ সাজলি, তার পয়সা কই, লৈবিদ্যি কই?

ভালুক বলিল, পয়সা এখনও ভাগা হয় নাই।

—লৈবিদ্যি? বলি, লৈবিদ্যি কী হল?

ভালুক ডাকিল, আয় আয় গোবরা, আয়।

গোবরা এক বিশালকায় কুকুর, এ পরিবারটির উপযুক্ত জীব। শুধু গোবরা নয়, গোবরগণেশ উহার নাম। খায় দায় ঘুমায়, চোর আসুক, ডাকাত আসুক—কোনো আপত্তি নাই তাহার, সে কাহাকেও কিছু বলে না।

ভুবন সরোষে বলিল, বলি, লৈবিদ্যি কী হল?

—খেয়ে দিয়েছি। যে ক্ষিদে, বাবাঃ!

ভুবন আবার শুইয়া পড়িয়া কাতরাইতে লাগিল। ভালুক ভাতের হাঁড়িটা নামাইয়া ফেলিয়া বলিল, আজ আর ক্ষিদে বেশি নাই। লৈবিদ্যি খেয়ে ক্ষিদে পড়ে গেল।

ভুবন বলিল, আমি টাকা দোব, তু গরু কেন এক জোড়া, ভাগে চাষ—

 

ভালুক মধ্যপথেই ভুবনকে বাধা দিয়া বলিল, ধেৎ! টাকা টাকা করেই মরবি তু। ছেলে নাই, পিলে নাই, দুটো পেট শুধুঃ; বেশ তো চলছে।

ভুবন বলিল, হা রে মুখপোড়া গাঁদা মোষ, বলি—খেটে খেটে যে আমার গতর পড়ে গেল!

ভালুক হি-হি করিয়া হাসিতে হাসিতে বলিল, তোর গতরের এক সরষেও কমে নি ভোবন। দাঁড়া, একখানা বড় আরশি এনে দোব তোকে। একটা টাকা দিস দেকি নি।

হাতের কাছেই পড়িয়া ছিল একটা শুকনা গাছের ডাল, ভুবন স্বামীকে লক্ষ্য করিয়া সজোরে সেটাকে ছুঁড়িয়া মারিল। ভালুক কিন্তু ভুবনের মতলব পূর্বেই বুঝিয়াছিল, সে একটু পাশে সরিয়া দাঁড়াইল। ডালটা বোঁ শব্দে ডাক ছাড়িয়া উঠানের পেয়ারাগাছে প্রতিহত হইল।

ভালুক হি-হি করিয়া হাসিতে হাসিতেই বলিল, ওইটো যদি লাগত ভোবন! শেষ তো তোকেই ত্যাল মালিশ করতে হত।

ভুবন বলিল, ওই ছিরিতে আর দাঁত বার করে হাসিস নে বাপু। আহা-হা!

ভালুক হা-হা করিয়া হাসিয়া ঘরখানা ভরাইয়া দিল।

ভুবনও না হাসিয়া পারিল না, সেও সলজ্জভাবে ফিক করিয়া হাসিয়া ফেলিল।

কথাটা পুরাতন দিনের কথা।

ভালুকের নাম মতিলাল, জাতিতে সে হাড়ী। এ গ্রামের বাসিন্দা তাহারা নয়; এখান হইতে ক্রোশ পাঁচেক দূরে তাহার পৈতৃক বাস। এ গ্রামে তাহার মাতুলালয়; নিঃসন্তান মাতুলের ভিটায় সে ভুবনকে লইয়া বৎসর-খানেক আসিয়া বাস করিতেছে।

ভুবন কিন্তু এই গ্রামের মেয়ে। তাহাদের সামাজিক রীতি অনুযায়ী ভুবনের পাঁচ বৎসর সময় প্রথম বিবাহ হয়। তখন তাহার ঠোঁটের পাশটা কাটা ছিল না।

 

বৎসর দশেক বয়সের সময় গাছে গাছে ঝাল্লু খেলিতে গিয়া ঠোঁট কাটিয়া দাঁত বাহির হইয়া গেল। তখন সে ছিল লম্বা, কিন্তু ছিপছিপে পাতলা। এগারো বৎসর বয়স হইতেই দেহে তার জোয়ার ধরিতে আরম্ভ হইল। তখন তাহার বয়স চৌদ্দ বৎসর। সেবার জামাইষষ্ঠীতে বাপ তাহার জামাই লইয়া আসিল। জামাইটি দেখিতে শুনিতে মন্দ নয়, সচরাচর নিম্নশ্রেণীর জোয়ান যেমন হইয়া থাকে তেমনি। শাশুড়ী জামাইকে পরমাদরে বসাইয়া পা ধুইতে এক ঘটি  জল নামাইয়া দিল। ভুবনের বাপ গিয়াছিল মাছের সন্ধানে। মাও তাড়াতাড়ি বাহির হইয়া গেল তেলের বোতল হাতে, —ভুবনের চুলটা বাঁধিয়া দিতে হইবে। ছেলেটি পা না ধুইয়াই এদিক-ওদিক চাহিতেছিল ভুবনের সন্ধানে। ঠিক এই সময়টিতে ভুবন আসিয়া বাড়ি ঢুকিল। কাঁখে এক প্রকাণ্ড বড় কলসী। গ্রাম হইতে মাইলখানেক দূরে ঝরনার জল আনিতে গিয়াছিল সে।

বাড়ি ঢুকিয়াই সে স্বামীকে প্রশ্ন করিল, কে বটিস রে তু, কোথা বাড়ি?

বাপের ফিরিবার কথা ছিল সন্ধ্যায়, কিন্তু ঘটনাচক্রে তাহারা দ্বিপ্রহরের পূর্বেই আসিয়া পড়িয়াছে। ভুবনের স্বামী অবাক হইয়া বিপুলকায়া ভুবনের কুৎসিত মুখের দিকে চাহিয়াছিল।

ভুবন আবার প্রশ্ন করিল, রা কাড়িস না কেনে রে ছোঁড়া, কোথা বাড়ি তোর?

তেলের বোতল হাতে মা ঘরে ঢুকিয়া বলিল, মাথায় কাপড় দে হারামজাদী, জামাই রয়েছে।

দারুণ লজ্জায় সহাস্যে পুরু জিবটা এতখানি বাহির করিয়া ভুবন দুমদুম শব্দে দ্রুতপদে ঘরে ঢুকিয়া পড়িল। মাও তাহার পিছন পিছন ঘরে ঢুকিয়া বলিল, বস, চুল বেঁধে দি তোর আগে। ও বাবা কানাই, হাত মুখ ধোও বাবা, শ্বশুর তোমার আইচে বলে।

 

অল্প কিছুক্ষণ পর ভুবনের বাপ মাছ হাতে বাড়ি ঢুকিয়া বলিল, কই, কোথা গেলি গো? কানাই কোথা গেল?

শাশুড়ী বাহিরে আসিয়া বলিল, এই হেতাই তো—কানাই, অ বাবা!

কেহ কোথাও ছিল না,  জলের ঘটিটা পর্যন্ত তেমনই পূর্ণ অবস্থায় সেইখানে পড়িয়া আছে। ধূলা পায়েই কানাই পলাইয়াছে।

সে আর আসে নাই, আবার সে বিবাহ করিয়াছে।

তাহার পর কত সম্বন্ধ যে ভুবনের বাপ করিল তাহার হিসাব নাই। কিন্তু ভুবনকে দেখিয়া সকলেই একরূপ পলাইয়া গেল।

ভুবনকে দেখিলেই পাড়ার ছেলেরা ফিক করিয়া হাসিত। ভুবন সে ব্যঙ্গহাসির জ্বালায় জ্বলিয়া উঠিত। একদিন সে ক্রোধে আপনার কপালে নোড়ার ঘা মারিয়া রক্তে মুখ ভাসাইয়া ফেলিল।

মামার অসুখের সংবাদ পাইয়া মতিলাল সেদিন এই গ্রামে আসিয়াছিল। তখন তাহার তিনটি বিবাহ হইয়া গিয়াছে, কিন্তু গৃহ গৃহিণীশূন্য। গ্রামে ঢুকিবার পথেই ভুবনের সহিত তাহার দেখা হইয়া গেল। তাহার রূপের কারুকার্য দেখিয়া মতিলাল না হাসিয়া থাকিতে পারিল না।

ভুবন ঘৃণার সহিত বলিল, ওই ছরিতে আর দাঁত বার করে হাসিস নে বাপু। আহা-হা!

মতিলাল হি-হি করিয়া হাসিয়া উঠিল।

তাহার কয়েক দিন পরই ভুবনের সহিত মতিলালের বিবাহ হইয়া গেল। মতিলাল ভুবনকে লইয়া ধূমধামের সহিত আপনার ভিটায় গিয়া সংসার পাতিয়া বসিল। প্রথমদিনই সন্ধ্যায় সে ভুবনকে ডাকিয়া বলিল, শোন একটা কথা বলি।

সে আসিয়া বলিল, কী?

—বস, একটা জিনিস এনেছি, দেখ। তোকে কেমন সোন্দর করে দি, দেখ।

মতিলাল খানিকটা খড়ির মতো সাদা গুঁড়ো জলে গুলিতে বসিল। ভুবন আশ্চর্য হইয়া প্রশ্ন করিল, উ কী?

মতিলাল অহংকারভরে বলিল, যাত্রায় সব মুখে মাখে, দেখিস নাই? কালো কুচ্ছিতও এতে সোন্দর হয়—বলিয়া সে ভুবনকে রঙ মাখাইতে বসিল। তারপর একটা আয়না মুখের সম্মুখে ধরিয়া বলিল, দেখ।

ভুবন তাহার হাত হইতে আয়নাখানা টানিয়া লইয়া নিবিষ্ট চিত্তে নিজের প্রতিবিম্ব দেখিতে বসিল। তারপর সহসা আয়নাখানা রাখিয়া দিয়া বলিল, আয়, তোকে মাখিয়ে দি আমি।

গম্ভীরভাবে মতিলাল বলিল, উঁহু, তু পারবি না। ই সব ভাগ-মাপ শিখতে হয়। দে, আমি মাখি। —বলিয়া সে নিজেই রঙ মাখিতে বসিল।

ভুবন কিন্তু অভিমান করিল। সেটুকু আবিষ্কার করিয়া মতিলাল বলিল, তোকে শিখিয়ে দোব, তু একদিন মাখিয়ে দিস।

ভুবন বলিল, তু কোথায় শিখেছিস, শুনি?

মতিলাল হাসিয়া বলিল, যাত্রার দলে শিখেছি। তা ছাড়া আমি কত রকম সাজতে পারি বলে! দেখবি?

সে তাহার একটা ঝাঁপি খুলিয়া বাহির করিল বস্তার তৈয়ারি ভালুকের খোলস, পেত্নী সাজিবার ছেঁড়া কাঁথা, আরও কত কী!

তাহার পর ক্রমশ ভুবন আবিষ্কার করিল, মতিলালের ওই পেশা। খাটুনির নাম নাই, খায়-দায় ঘুমায়, যাত্রার দলের ভার বয়, তামাক সাজে, আর মাঝে মাঝে রং সাজিয়া বেড়ায়।

ভুবন কিন্তু দারুণ পরিশ্রমী মেয়ে, শরীরে শক্তিও তাহার বিপুল; সে ধান ভানিয়া, ঘুঁটে দিয়া, ঘাস বেচিয়া স্বচ্ছন্দ আহারের প্রাচুর্যে বিপুলকায় মতিলালকে আরও স্ফীত এবং কুৎসিত করিয়া তুলিল, সঙ্গে সঙ্গে নিজেও তাহাই হইয়া উঠিল। মতিলালকে সে অহরহ তিরস্কার করে রোজগারের জন্য। মতিলালের সেই এক উত্তর—খাটতে গেলে গতরে লজর দেয় সব, উ হবে না। যাত্রার দলে এবার মাইনে হবে। আর ছেলেপিলে হোক, তখন না হয়—। ছেলে না হলে কি ঘর—! বলিয়া সে পুলকে হি-হি করিয়া হাসে।

ভুবন বলিল, হবে তো ছেলেপিলে।

মতিলালের মনে পুলক বাড়িয়া গেল, দাঁড়া, আজ মাদুলি এনে দোব তোকে।

মাদুলি সে আনিয়াও দিল, একটা নয়, একটা একটা করিয়া পাঁচ-ছয়টা মাদুলি ভুবনের বুকে এখন ঝোলে।

বেশ চলিতেছিল। কর্মপরায়ণা ভুবনের কর্মের মধ্যেই দিন কাটিয়া যাইত। সেদিন সহসা তাহার দৃষ্টিতে পড়িল, পুকুরের ধারে মতিলাল বসিয়া হি-হি করিয়া হাসিতেছে, আর যাত্রার দলের কয়েকটা ছেলে তাহাকে কাদা মাখাইতেছে। একজনের কথাও তাহার কানে আসিল, সে মতিলালকে বলিতেছিল, গাঙের পলি যদি মাখতে পারিস, তবে রঙ ফরসা হবে নিশ্চয়। এতেও হবে তবে ফিট গোরা হবে না।

সে কথার দিকে মতিলালের মন ছিল না। সে দূরের কতকগুলো ছোট ছেলের কথা শুনিয়া হাসিতেছিল।

তাহারা হাততালি দিয়া নাচিতেছিল আর সুর করিয়া গাহিতেছিল, আয় রে কালে মোষ, কাদা মাখবি বস।

ভুবনের অঙ্গ জ্বলিয়া গেল। সে মতিলালকেই ডাকিল, ও মুখপোড়া, বলি শোন।

মতিলাল হি-হি করিয়া হাসিতে হাসিতে উঠিয়া আসিল।

যাত্রার দলের একজন বলিল, মাধব তাঁতীর লীলেবতী।

ক্রোধে ভুবনের চোখে  জল দেখা দিল, মতিলাল কিন্তু হাসিয়া বলিল, বলুক কেনে; তোরও যেমন!

ইহার পর ক্রমশ ভুবন আবিষ্কার করিল, এ কথা এ গ্রামের সকলেই বলে, কর্মের ব্যস্ততার মধ্যে ভুবন এতদিন শুনে নাই, বা শুনিতে পায় নাই। ভুবন জেদ করিয়া বসিল, এখানে সে থাকিবে না। মতিলাল বলিল, মামার ভিটে তো মোটে এইটুকুন ছোট ঘর, ছেলেপিলে হলে কুলাবে কেনে?

ভুবন বলিল, ঘর করে লিবি, অত বড় হাঁদা মুনিষ।

প্রবল আপত্তি করিয়া মতিলাল বলিল, উঁহু, সি আমি পারব না। বাবা, ঘর তুলা কি সোজা কথা!

ভুবন তবু মানিল না, সে বলিল, ঘরের খরচ আমি দিব! আর বাবা আছে, দাদা আছে—

বাধ্য হইয়া বৎসর খানেক পূর্বে মতিলাল মাতুলালয়ে আসিয়া বাস আরম্ভ করিল। ভুবনের চেষ্টায় ও অর্থে ঘর হইয়াছে। মতিলাল এখানকার পাঁচালির দলে এখন তামাক সাজে। দত্ত-কাকার দরবারে নিয়মিত হাজিরা দেয়, দত্ত-কাকা তাহাকে কলিকাতার যাত্রার দলে চাকরি করিয়া দিবেন। ভুবন যেমন খাটিত, তেমনই খাটে। তাহার পরিশ্রমে এখানেও স্বচ্ছন্দ সংসার, কোনো অভাব নাই। বলিতে ভুলিয়াছি, এখন ঘরের কাজ, ভাত রাঁধা, জল তোলা, এগুলি মতিলালকে করিতে হয়! বাড়িতে পা দিলেই ভুবনের শরীরে অসুখ দেখা দেয়।

ওই চৈত্র সংক্রান্তির দিনই।

মতিলাল রান্নাবান্না শেষ করিয়া স্নান করিয়া আসিল। দুইখানা গামলায় হাঁড়ির ভাত ঢালিয়া ডাকিল, ভোবন, ওঠ।

ভুবন উঠিয়া বসিল। মতিলালের গামলার দিকে চাহিয়া বলিল, এই যে বললি, ক্ষিদে নাই আজ! চারটি ভিজিয়ে রাখলে কালকের মুড়ি আসান হত।

থাবা ভরিয়া গ্রাস তুলিতে তুলিতে মতিলাল বলিল, আবার লেগেছে ক্ষিদে।

ভুবন বলিল, তোর ওই কুকুরের ভাত আমার হেনসেল থেকে দোব না আজ। তোর ভাত থেকে তু দে। লইলে লৈবিদ্যি আন।

মতিলাল হি-হি করিয়া হাসিয়া বলিল, দেখবি, রেতে চেঁচাবে ক্ষিদেতে, ঘুম হবে না তোর।

ভুবন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চোখের দৃষ্টিতে যেন অগ্নিবর্ষণ করিয়া বলিল, নেতার মেরে দোব তাহলে আজ ওর।

মতিলাল সকাতর কণ্ঠে বলিল, আহা-হা ভোবন, কেষ্টের জীব! আর জানিস, তোর যখন ছেলে হবে, তখন দেখবি কত কাজ করে গোবরা!

ভুবন উষ্মাভরেই কহিল, কী, করবে কী শুনি?

—এই ছেলে শুয়ে থাকবে, গোবরা পাহারা দেবে, কাক তাড়াবে।

সত্য, গোবরগণেশের ওই গুণটি আছে, বাড়িতে কাক নামিতে দেয় না।

ভুবন শুধু বলিল, হুঁ।

মতিলালের দৃষ্টিতে পড়িল, পার্বতী ও মদন দুয়ারের পাশে দাঁড়াইয়া উঁকিঝুঁকি মারিতেছে! সে গাল ভরিয়া হাসিয়া বলিল, এই দেখ ভোবন, এই ছেলেটার কথা বলেছিলাম।

পার্বতী মদনকে বলিতেছিল, ওই দেখ।

ভুবন মুখ ফিরাইয়া তাহাদের দেখিয়া বলিল, এস খোকাবাবুরা, প্যায়রা আছে দোব, বস।

—ওরে বাবা রে, ধরবে ভাই!—বলিয়া মদন ছুটিয়া পলাইল।

পার্বতী তখনও দাঁড়াইয়া ছিল। মতিলাল বলিল, প্যায়রা খাবে এস খোকাবাবু। যাবার সময় আমি হাতি সেজে পিঠে করে দিয়ে আসব তোমাকে—বলিয়াই সে মাটিতে হাত পাড়িয়া চতুস্পদ সাজিয়া পার্বতীকে দেখাইল।

মদন পিছন হইতে ডাকিল, পালিয়ে আয় রে, ধরবে।—পার্বতী আর থাকিতে সাহস করিল না, পলাইল।

পরদিন কিন্তু সকালেই তাহারা আসিয়া হাজির। ঢেঁকিশালে ভুবন দুমদুম শব্দে ধান ভানিতেছিল। মতিলাল দাওয়ায় বসিয়া মুড়ি খাইতেছিল।

দুয়ারের গোড়ায় দাঁড়াইয়া পার্বতী বলিল, ভালুক, প্যায়রা দিবি?

মুখে একমুখ মুড়িসুদ্ধই মতিলাল দাঁত বাহির করিয়া বলিল, এস এস, খোকাবাবু এস।

মদন বলিল, ওখান থেকে ছুঁড়ে দে। তুই ভূত? সে রাক্কুসী কই, সেই দাঁত বার করে?—বলিয়াই সে দাঁত বাহির করিয়া দেখাইয়া দিল।

মতিলাল হা-হা করিয়া হাসিয়াই সারা হইল।

—কে রে, খালভরা ছেলে!—ভুবন ঢেঁকিশাল হইতে বাহির হইয়া আসিল।

পার্বতী ও মদন ছুটিয়া পলাইল। ভুবন আপন মনেই বকিতেছিল, ভদ্দনোকের ছেলে, ভদ্দনোক সব, বাক্যি দেখ দেখি! ভূত, রাক্কুসী! অঃ!

মতিলাল তখন সবলে পেয়ারা গাছটাকে নাড়া দিতেছিল। সে হি-হি করিয়া হাসিয়া বলিল, তুও যেমন ভোবন, বলুক কেনে!

ভুবন ঝঙ্কার দিয়া বলিল, না, বলবে কেনে, কীসের লেগে? ছেলের কথা দেখ দিকি নি!

গ্রামের ধারে দাঁড়াইয়া মদন তখন পার্বতীকে বলিতেছিল, না, যাসনি ভাই, শুনিস নি রাক্কুসীর গল্প? ওরা ঠিক ভূত আর রাক্কুসী—মানুষ সেজে আছে।

—খোকাবাবু, ও খোকাবাবু, প্যায়রা নিয়ে যাও।—আঁচলে করিয়া পেয়ারা লইয়া মতিলাল হাসিতে হাসিতে তাহদের ডাকিতেছিল।

মদন বলিল, ওইখানে ঢেলে দে। তুই সরে যা।

মতিলাল হাসিয়া পেয়ারাগুলি ঢালিয়া দিয়া সরিয়া গেল।

পেয়ারাগুলি তুলিয়া লইয়া পার্বতী বলিল, ভালুক হয়ে যা দেখি, সেই কালকের মতো।

মতিলাল হি হি করিয়া হাসিয়া বলিল, দাঁড়াও তোমরা, আসছি আমি।

কয়েক মিনিট পরেই ঘোঁৎ-ঘোঁৎ শব্দ শুনিয়া পেয়ারা খাইতে ব্যস্ত মদন ও পার্বতী দেখিল, ভালুক আসিতেছে। সঙ্গে সঙ্গে মদন প্রচণ্ড বেগে ছুটিল। পার্বতীও তাহার অনুসরণ করিল। ভালুক উঠিয়া দাঁড়াইয়া ডাকিল, অ খোকাবাবু!

ছেলে দুইটির সঙ্গে মতিলালের একটু আত্মীয়তা হইল, কিন্তু সে আত্মীয়তা নিবিড় হইল না। তাহারা পেয়ারার জন্য রোজ আসে, কিন্তু মতিলালকে ধরা দিল না।

মতিলাল হাসিমুখে ডাকে, তাহারা খানিকটা সরিয়া গিয়া বলে, না।

মতিলাল তাহাদিগকে প্রলুব্ধ করিতে চেষ্টা করে, কত সাজতে পারি আমি, তোমাদিগে দেখাব।

মদন বলে, ছাই; বস্তা গায়ে দিয়ে! ভালুকের রোঁয়া নেই, যাঃ!

পার্বতী বলে, ভূত সাজতে পার?

হাসিতে হাসিতে মতিলাল বলে, হুঁ। দুধ খাও তো? না খেলে আমি ভূত সেজে ধরব।

—কই, সাজ দেখি ভূত।

—সেই ধরমপুজোর সময়। আর দেরি নাই।

—বাঘ সাজতে পার?

—হুঁ।

—সব সাজতে পার তুমি?

—হুঁ।

ভীত অথচ মুগ্ধ-বিস্ময়ে ছেলে দুইটি মতিলালের দিকে চাহিয়া থাকে।

মতিলাল ডাকে, শোন শোন, একটা কথা বলি।—সঙ্গে সঙ্গে সে নিজেই আগাইয়া আসে। ছেলে দুইটি সভয়ে ছুটিয়া পলাইয়া যায়।

ভুবন বলে, তোর যেমন আদিখ্যেতা! উ কি তোর স্বভাব?

মতিলাল হি-হি করিয়া হাসিয়া বলে, ওরা ভয় করে; আমার ভারি ভালো লাগে ভোবন। আমি আবার বিল কী জানিস, দুধ খাও তো, না খেলে আমি ধরব! একদিন পেত্নী সাজব, দাঁড়া।

ভুবন বলিল, ভূত তো সেজেই আছিস, আর পেত্নী সাজতে হবে না বাপু, থাম।

মতিলালের হাসি আর থামিতে চায় না।

রাঢ় দেশ। বৈশাখ মাসে বুদ্ধ-পূর্ণিমায় ধর্মরাজের পূজা, নিম্নজাতির এক বিরাট উৎসব। মতিলালের গ্রামে—মহুগ্রামে ধর্মরাজের পূজার উৎসবে প্রচুর ধূমধাম হয়। মহুগ্রামের ধর্মদেবতা নাকি ভারি জাগ্রত। চার-পাঁচখানা গ্রামের নিম্নজাতির সকলেই এই ধর্মরাজের পূজা-অর্চনা করে। এবার উৎসবের আড়ম্বর খুব বেশি। পাশের বর্ধিষ্ণু গ্রামে স্বর্ণকাররা পাল্লা দিয়া নাকি উৎসব করিবে। এবার ঢাক আসিল ত্রিশটা। মহুগ্রামে বরাদ্দ হইয়াছে পঁয়ত্রিশটা। সংবাদটা কিন্তু গোপন রাখা হইয়াছে। ও গ্রামের ভক্তের সংখ্যা পঁয়তাল্লিশ, পঞ্চাশ পূর্ণ করিবার জন্য খুব চেষ্টা হইতেছে। মহুগ্রামের ভক্তের সংখ্যা ষাট ছাড়াইয়া গিয়াছে।

চুলওয়ালা দত্ত-খুড়োর সঙ্গে মতিলাল মহা উৎসাহে তদ্বির-তদারক করিতেছিল। দত্ত- খুড়ো বলিল, তুইও একজন ভক্ত হলি না কেন মতিলাল?

মতিলাল হি-হি করিয়া হাসিয়া বলিল, উপোস করতে লারব খুড়োমশায়। উ হবে না।

দত্ত-খুড়ো হাসিয়া বলিলেন, পেটটি না ভরলে মতিলালের আমার চলবে না, না কী বল মতিলাল?

মতিলাল হাসিয়া বলিল, ভোবন কী বললে জানো? বললে, প্যাটে ছুরি মার তু।

দত্ত বলিল, তা বেশ! তোকে কিন্তু ইদিকের কাজ ডাক-হাঁক সব করতে হবে। বোলানের দল সব আনতে হবে। আর, সঙ এবার কিন্তু খুব আচ্ছা বঁঢ়িয়া রকমের হওয়া চাই।

মতিলাল একমুখ হাসিয়া বলিল, পাঁচ জুতো খাব, উ গাঁকে হারাতে না পারি তো।

সার্ধ দুই সহস্র বৎসরেরও পূর্বে যে তিথিতে অর্ধ-জগতের ধর্মগুরু মহামানব বুদ্ধ সুজাতার পায়সান্ন গ্রহণ করিয়া নতুন করিয়া স্নানান্তে মরণ-পণে তপস্যায় বসিয়াছিলেন, সেই পূর্ণিমার ঠিক প্রথম লগ্নে উৎসবের প্রারম্ভ। সেই দিন হয়—মুক্তিস্নান।

দলে দলে ভক্তরা ‘মুক্তচান’ করিয়া উত্তরী পরিতেছিল। ঢাকের বাজনায় সচকিত পাখির দল কলরব করিয়া আকাশে উড়িয়া বেড়াইতেছিল, কোনো স্থানে বসিতে তাহাদের সাহসই ছিল না। হনুমানের দলও দ্রুতবেগে বিপুল শব্দ করিয়া গ্রাম ছাড়িয়া পলাইতেছিল।

মতিলাল আপনার সঙের পোশাকের থলি বাহির করিয়া বসিয়াছিল, দুই টুকরা সোলাকে সে ধারালো ছুরি দিয়া চাঁচিতেছিল।

ভুবন বলিল, আ মরণ তোর, দেশের লোক গেল মুক্তচান দেখতে, আর পেটুক রাক্ষসের কাজ দেখ!

সাদা সোলা দুই টুকরা দুই গালে দুই দিকে পুরিয়া মতিলাল হাত বাড়াইয়া ছুটিয়া আসিল, ধঁরব, খাঁব তোঁকে।

ভুবনও দুই পা সরিয়া গিয়া বলিল, এই দেখ, ভালো হবে না বলছি।

মতিলাল হি-হি করিয়া হাসিতে লাগিল।

ভুবন বলিল, দেখ দেখি, মানুষকে ভয় লাগিয়ে দেয়। খোল বাপু, তোর দাঁত খোল।

মতিলাল পরম পরিতুষ্ট হইয়া প্রশ্ন করিল, তোরও ভয় লাগল ভোবন?

ভুবন বলিল, হ্যাঁ, ভয় লাগতে আমার দায়! কিন্তু তু যে বললি, ধম্মরাজের মাদুলি এনে দিবি?

ট্যাঁক হইতে খুলিয়া মাদুলি বাহির করিয়া দিয়া মতিলাল বলিল, একটো পাঁঠা কিনে রাখতে হবে আবার। ছেলে হলে পাঁঠা লাগবে—দেবাংশী বলেছে।

পরদিন পূর্ণিমার অবসান-সময়ে ব্রতের উদযাপন। ঢাক-শিঙা কাঁসি-কাঁসর ঘণ্টা-শঙ্খ বাজাইয়া শোভাযাত্রা বাহির হইল। প্রথমেই একদল ঢাক ও বাদ্যভাণ্ড, তাহার পরেই শ্রেণীবদ্ধভাবে বারো-চৌদ্দ সারি ভক্তের দল ভাঁড়াল মাথায় করিয়া চলিয়াছে। ভাঁড়াল এক-একটি জলপূর্ণ মঙ্গল-কলস, কলসগুলির গলায় ফুলের মালা; ভক্তের দলেরও প্রত্যেকের গলায় মোটা মোটা কল্কে আউচ ও গুলঞ্চ ফুলের মালা। ভক্তদলের চারিপাশে সারি সারি ধূপদানি হইতে ধূপের ধোঁয়া উঠিতেছে। তাহারা ঢাকের বাজনার তালে তালে ভক্ত-নাচ নাচিয়া চলিয়াছে। আবার পিছনে একদল ঢাক। তাহার পিছনে দশখানা গ্রামের নিম্নশ্রেণীর নরনারী কাতারে কাতারে চলিয়াছে।

মহুগ্রামের ভাঁড়াল আসিয়া বর্ধিষ্ণু গ্রামখানায় প্রবেশ করিল। মহুগ্রাম এই গ্রামের বাবুদেরই জমিদারী, চিরকাল ভাঁড়াল এ গ্রামে আসে। রাস্তার দুই পাশের ঘরের দাওয়া ভদ্র নরনারীতে পরিপূর্ণ। ভাঁড়ালের দলের ভক্তদের সঙ্গে তালে তাল তাহাদেরই মতো নাচিতে নাচিতে চলিয়াছে কত ছেলে। তাহার মধ্যে অগ্রবর্তী পার্বতী ও মদন।

আপনাদের দাওয়া হইতে পার্বতীর মা ডাকিল, ওরে, ও হতভাগা, উঠে আয়। এই বোশেখ মাসের দুপুর-রোদ—উঠে আয়।

পার্বতী নাচিতে নাচিতেই মাকে এক ভেংচি কাটিয়া দিল।

সমস্ত দলের পিছনে একখানা ঢাকের বাদ্যধ্বনি অকস্মাৎ শোনা গেল। সঙ্গে সঙ্গে এক ভয়ার্ত কলরব। পিছনের দিক হইতে ভিড় ভাঙ্গিয়া চতুর্দিকে সব ছুটিয়া পলাইতেছিল। বামন গুলপী বুড়ি মাত্র হাত দুই লম্বা, সে পলাইতে না পারিয়া একটা বাড়ির দেওয়ালে মুখ গুঁজিয়া মুদিত চোখে কাঠের মতো লাগিয়া গেল।

ভয়েরই কথা। ঢাকের সম্মুখে তালে তালে নাচিতে নাচিতে আসিতেছিল—বিকট এক মূর্তি! মাথায় এক আঁটি খড়ে কালো রঙ মাখাইয়া পরচুলা পরিয়াছে, বিকটাকার মুখে দুই গালের পাশে গজদন্তের মতো দুই দাঁত, রাজ্যের ছেঁড়া কাঁথা পরনে, জানু পর্যন্ত ঝুলিয়া পড়িয়াছে দুই স্তন, সর্বোপরি ভয়াল তাহার দুই হাত—প্রত্যেকটি চার-পাঁচ হাত করিয়া লম্বা, এক হাতে এক ঝাঁটা।

কয়েক মিনিটের মধ্যেই ভক্তদল ও বাদ্যভাণ্ড ছাড়া রাস্তা পরিষ্কার হইয়া গেল। মদন যে কোথায় পলাইল, তাহার সন্ধান পার্বতী পাইল না। সে ছুটিয়া আসিয়া লুকাইল মায়ের পিছনে।

মাও ভয় পাইয়াছিল, তবু সে বলিল, যাবি, যাবি আর? ডাকব ঝাঁটা-বুড়িকে? শোন শোন, ও ঝাঁটাবুড়ি!

ঝাঁটাবুড়ি ঘুরিয়া দাঁড়াইল। পার্বতীকে ঠেলিয়া সম্মুখে আনিয়া মা বলিল, এই দেখ, রাস্তায় পেলেই ধরবি একে।

ঝাঁটাবুড়ি পরমানন্দে নানা অঙ্গভঙ্গি সহকারে বিচিত্র নৃত্য আরম্ভ করিয়া দিল সেইখানে।

হারুবাবুর মা খপ করিয়া পার্বতীর চোখ ও কপাল আবৃত করিয়া বলিয়া উঠিলেন, পালাও, তুমি পালাও।

নাচিতে নাচিতে ঝাঁটাবুড়ি চলিয়া গেল।

হারুবাবুর মা তখন বলিতেছিলেন,  জল—জল—পাখা—পাখা।

মতিলাল বাঁড়ুজ্জে-বাড়িতে বকশিশ পাইল দুই টাকা। বাবু ভারি খুশি হইয়াছিলেন। তিনি নিজে ভয়ে বু-বু করিয়া উঠিয়াছিলেন।

বাড়িতে সে তখন পোশাক ছাড়িতেছে, দত্ত-খুড়ো বাড়ি পর্যন্ত আসিয়া তারিফ করিয়া বলিলেন, খুব ভালো হয়েছে মতিলাল।

সবিনয়ে মতিলাল হি-হি করিয়া হাসিল শুধু।

দত্ত বলিল, বামন গুলপী বুড়ি থাকতে থাকতে ধপাস করে পড়ে গেল। মুখুজ্জেদের পার্বতীর চেতন করাতে তো ডাক্তার ডাকতে হয়েছিল। আর বাঁড়ুজ্জে-কত্তা তো—

চমকিয়া উঠিয়া মতিলাল প্রশ্ন করিল, পার্বতীর চেতন হয়েছে?

দত্ত বলিলেন, হ্যাঁ তবে একটু বেগ পেতে হয়েছিল। ওর মায়ের যেমন—

পোশাক-পরিচ্ছদ সব পড়িয়া রহিল, মতিলাল ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।

আবার তাড়াতাড়ি ফিরিয়া আসিয়া পেয়ারার গাছ ঝরাইয়া এক কোঁচড় পেয়ারা লইয়া সে বাহির হইয়া গেল। আবার কিছুক্ষণ পরে সে ফিরিয়া আসিয়া কতকগুলো কী লইয়া চলিয়া গেল।

পার্বতী শুইয়াছিল, তাহার মা শিয়রে বসিয়া বাতাস করিতেছিল। বাপ ফুলু মুখুজ্জে ক্রমাগত আপন মনে তিরস্কার করিতেছিল পত্নীকে, হুঁ, আক্কেল দেখ দেখি, হুঁঃ!

বাহির হইতে কে ডাকিল, বাবু!

—কে?—ফুলু মুখুজ্জে বাহিরে আসিয়া আতকাইয়া ছুটিয়া ঘরে প্রবেশ করিয়া দরজা বন্ধ করিয়া দিল।

বাহির হইতে সাড়া আসিল, আজ্ঞে ভয় নাই, আমি মতিলাল। খোকাবাবুকে ডেকে দেন, ভালুক সেজে এসেছি আমি, ভালুক দেখলে তার ভয় ভেঙ্গে যাবে।

দরজা খুলিল এবং সঙ্গে সঙ্গে মতিলালের মাথায় পড়িল এক লাঠি। লাঠি মারিয়া মুখুজ্জে বলিল, বেরো শালা, বেরো।

এক লাঠিতে মতিলালের কিছু হইবার কথা নয়, হয়ও নাই; খানিকটা মাথার চামড়া কাটিয়া গিয়াছিল শুধু। পরদিন সে দত্ত-খুড়োর বাড়িতে বসিয়া প্রশ্ন করিতেছিল, না খেলে শরীর বাঁচবে, কাকামশায়? আর রঙ ফরসা হয় কী সাবানে, বলেন দেখি?

বেণী ডোম—চৌকিদার আসিয়া তাহাকে ডাকিল, তোকে ডাকছে মতিলাল, পেসিডেনবাবু।

—কেন?—মতিলাল অবাক হইয়া প্রশ্ন করিল।

বেণী বলিল, কাল তোকে লাঠি মারে নাই ফুলু মুখুজ্জে? তাই লালিশ-টালিশ করতে বলবে তোকে হয়তো।

মতিলাল হাসিয়া বলিল, উ আমার লাগে নাই বেনো জেঠা। লালিশ আবার করে নাকি—ওই লিয়ে?

—তা বলে আয় গিয়ে বাপু।

মতিলাল উঠিল। পথে ছেলের পাল সভয়-কৌতুকে দূরে দাঁড়াইয়া বলিতেছিল, ঝাঁটাবুড়ি, ও ঝাঁটাবুড়ি!

মতিলাল হি-হি করিয়া হাসিতেছিল।

পথে নারাণবাবুর বাড়ির ভিতর কে বলিতেছিল, দুধ খাও সুকু, ডাকব ঝাঁটাবুড়িকে?

মতিলাল বিনা দ্বিধায় বাড়ির মধ্যে ঢুকিয়া একমুখ দাঁত বাহির করিয়া হাসিয়া বলিল, দুধ খাও খোকাবাবু।

ছেলেটা ভয়ে বিবর্ণ হইয়া উঠিল। মা ছেলেকে লইয়া ঘরের মধ্যে ঢুকিয়া পড়িয়া বলিল, বেরিয়ে যাও তুমি, বেরিয়ে যাও।

মতিলাল বাহির হইয়া আসিতেই বেণী জিজ্ঞাসা করিল, কী, হল কী তোর মতিলাল, অ্যাঁ? মতিলাল—মতে!

মতিলাল বাড়ি ফিরিল প্রহারজর্জরিত দেহে।

ভুবনের চোখে আজ জল দেখা দিল, সে তাড়াতাড়ি তেলের বাটি লইয়া বসিয়া বলিল, কী হল, কে মেলে?

মতিলাল ফুঁপাইয়া কাঁদিয়া বলিল, ছোট ছেলে আমাকে দেখে প্যাঙাসপারা হয়ে গেল ভোবন!

ভুবন প্রশ্ন করিল, কে, মেলে কে তোকে?

—পেসিডেনবাবুর চাপরাসীঃ; গাঁ ঢুকতে বারণ হয়ে গেল, ছোট ছেলেতে ভয় পাবে আমাকে।—কণ্ঠস্বর তাহার রুদ্ধ হইয়া গেল।

ভুবন চকিত হইয়া বলিল, ও কী, মাদুলি ধরে টানছিস কেনে, ওই?

পট করিয়া মাদুলির সুতা ছিঁড়িয়া লইয়া মতিলাল বলিল, আমাদের ছেলে আমাদেরই মতো কুচ্ছিৎ হবে তো ভোবন! কাজ নাই।


© 2024 পুরনো বই