হায় এ খেদ মোর মনে
ভালবেসে মিটল না আশ—কুলাল না এ জীবনে।
জীবন এত ছোট কেনে? হায়—
জীবনে যা মিটল নাকো মিটবে কি তাই হায় মরণে?
এ ভুবনের কান্না যত হয় কি হাসি ও ভুবনে?
জীবন এত ছোট কেনে? হায়—
তারাশঙ্করের ‘কবি’র গান। তাঁর গভীর মনন ও জীবনদর্শনের পরিচয় এই গানে। বেদের ঋষিরা জীবনকে জীবনের জন্যই বলেছিলেন, তা কেবল মৃত্যুর প্রতীক্ষাধীন নয়—’জীবাতবে ন মৃত্যবে’। রবীন্দ্রনাথও ‘এই সূর্যকরে, এই পুষ্পিত কাননে’, ‘মানুষের মাঝে’ বেঁচে থাকতে চেয়েছিলেন। এই ধরিত্রী এবং তার মৃত্তিকার সন্তানের প্রতি ব্যাকুলিত ভালোবাসাই এই দর্শনের উৎস। তারাশঙ্করের জীবনচেতনা এবং সাহিত্যসৃষ্টিতে সেই ভালোবাসা সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। বীরভূমের লাল মাটির ঊষর বন্ধুর বুকে যে মায়া, যে করুণা ও ভালোবাসা লুকিয়ে আছে তাকেই সন্ধান করেছেন তিনি। গ্রাম জনপদের মানুষের অন্তহীন দারিদ্র্য, তুচ্ছ কলহ বিবাদ, তীব্র কুসংস্কার, সংঘাত-সংগ্রাম, আকাঙ্ক্ষা- অসহিষ্ণুতা, বাসনা-বেদনা এবং সর্বনাশের অতল গহ্বরে দাঁড়িয়েও জীবনের প্রতি অকপট অনুরাগ তারাশঙ্করকে বিস্মিত করেছে, তাঁর লেখনীকে বাঙ্ময় করেছে। রাঢ়ের নির্দয় প্রকৃতি, নিরাবরণ সূর্যের অকৃপণ অগ্নিবর্ষণ, অজয়-ময়ূরাক্ষীর বুক ভাসানো জল-কল্লোল, হাটে-মাঠে শ্যামল শস্যের সমারোহ, বন-উপবন, শাক্ত-বৈষ্ণব-বাউলের সুরগুঞ্জন, বীরভূমের মাটি ও মানুষের মনে যে অপার মহিমা বিস্তার করেছে তারাশঙ্কর তাকেই ধরতে চেষ্টা করেছেন তাঁর গল্পে উপন্যাসে। তাঁর সাহিত্যের কল্পনা জীবন পেয়েছে মাটি ও মানুষের ঘ্রাণে, তাদের সম্পর্কের সুগভীর দ্বান্দ্বিকতায়, তাদের সংগ্রামের স্বেদস্পর্শে ও স্বপ্নের নিবিড়তায়। ‘গণদেবতা’, ‘পঞ্চগ্রাম’, ‘ধাত্রীদেবতা’, ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’, ‘রসকলি’, ‘বেদেনী’, ‘ডাকহরকরা’, তথা অসংখ্য গল্প-উপন্যাসে গ্রামের সমাজ, ক্ষয়িষ্ণু জমিদারতন্ত্র ও সরল সাদাসিধে মানুষের হাসিকান্নার কাহিনি ও তাদের জীবনানুবর্তনের পৌনঃপুনিকতার শিল্পিত প্রকাশ ঘটেছে, বেদে, পটুয়া, লাঠিয়াল, চৌকিদার-দফাদার, ডাক-হরকরা, তাঁতি, কামার, মুচি রাঢ়ের ভাষায় তাদের উপেক্ষিত প্রাণের কথা বলেছে, আবার সামন্ত, আধা-সামন্ত, শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত, মাস্টার, গান্ধিবাদী এবং বিপ্লবীও তাদের বিশ্বাস ব্যথা, স্বপ্ন দেখা ও স্বপ্নভঙ্গের জন্য বিলাপ করেছে। এই অপূর্ব রসায়নে গড়া তারাশঙ্করের সাহিত্যের সংসার। সুকুমার সেন ‘বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস’ গ্রন্থে লিখেছেন ‘তারাশঙ্কর লইলেন তাঁহার দেশ দক্ষিণ-পূর্ব বীরভূমের সাধারণ লোকের জীবন—পুরানো গ্রামের জমিদার-ঘর হইতে নদীচরের মাল-বেদে পাড়া পর্যন্ত।’ শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তারাশঙ্করকে বললেন ‘… গ্রাম্যজীবনের চারণ কবি।’ তাঁর সুবিবেচিত বিশ্লেষণ ‘তারাশঙ্কর পল্লীজীবনের মূল প্রবাহ অনুসরণ করিয়াছেন—ইহার উৎসাহ-অবসাদ, গৌরব-গ্লানি, বাঁচিবার আকাঙ্ক্ষা ও মরণধর্মী জড়তা, নূতন ভাবের ও প্রয়োজনের সংঘাতে ও পুরাতন আদর্শের ভাঙ্গনে ইহার অসহায় কর্তব্যবিমূঢ়তা—এই সমস্তই … তাঁহার রচনায় অভিব্যক্তি লাভ করিয়াছে।……..সূর্যকরোজ্জ্বল ক্ষুদ্র তরঙ্গভঙ্গের ন্যায় পথ-চলার মধ্যেই হৃদয়াবেগের ক্ষণিক দীপ্ত দাহ বিকিরণ করিয়াছে।…তাঁহার রচনাকে উপন্যাস অপেক্ষা মহাকাব্যের সহিত নিকটতর সম্পর্কান্বিত করিয়াছে।’
তারাশঙ্করের জন্ম বীরভূম জেলার লাভপুর গ্রামে ১৩০৫ বঙ্গাব্দের ৮ শ্রাবণ, ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দের ২৪ জুলাই। বাবা হরিদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, মা প্রভাবতী দেবী। লাভপুর স্কুল থেকে ১৯১৫ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি প্রথমে সেন্ট জেভিয়ার্স এবং পরে আশুতোষ কলেজে পড়াশোনা করেন। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার কারণে পড়াশোনা আর এগোয়নি। তবে কিশোর বয়স থেকেই সমাজকল্যাণকর কাজে তিনি উৎসাহী হন। চোদ্দ বছর বয়সে ‘সমাজ সেবক সমিতি’র সদস্য হয়ে গ্রামজীবনের দুঃখ নিবারণের ব্রতধারণ করেন তারাশঙ্কর। বিবেকানন্দের সেবাধর্ম ও ক্ষুদিরামের দেশপ্রেম ছিল তাঁর শৈশব-কৈশোরের জীবনাদর্শ। পরিণত বয়সে গান্ধিবাদের অহিংস-অসহযোগিতায় তিনি দীক্ষিত হলেও, বিবেকানন্দ এবং ক্ষুদিরামের প্রেরণা তাঁকে সাহস জুগিয়েছে এবং গৌরবদান করেছে। তারাশঙ্করের জীবন ও সাহিত্যকর্মে তাঁর মা বাবা এবং পিসিমার প্রভাব ছিল অপরিসীম। ‘আমার কালের কথা’ গ্রন্থে মায়ের কথা লিখতে গিয়ে তারাশঙ্কর বলেছেন, ‘আমার জীবনে মা আমার সত্যসত্যই ধরিত্রী, তাঁর মনোভূমিতেই আমার জীবনের মূল নিহিত আছে, শুধু সেখান থেকে রসই গ্রহণ করেনি, তাঁকে আঁকড়েই দাঁড়িয়ে আছে। ওই ভূমিই আমাকে রস দিয়ে বাঁচিয়ে, প্রেরণা দিয়ে বলেছে,—’আকাশলোকে বেড়ে চল, সূর্য আরাধনায় যাত্রা কর।…..’ আর বাবার কথা, ‘তিনি মারা যান অল্প বয়সে। আমার বয়স তখন আট বৎসর। কিন্তু তার স্মৃতি আমার মনের উপর গভীর রেখাপাত করে গিয়েছে।’ তাঁর বাবার ব্যক্তিগত সংগ্রহে ছিল অনেক বই। তারাশঙ্কর নিঃশব্দে বিচরণ করেছেন তাদের পাতায় পাতায়, আহরণ করেছেন সাহিত্যের বোধ এবং জিজ্ঞাসা; পরবর্তীকালে এই সঞ্চয় সহায়ক হয়েছে তাঁর সাহিত্য সৃষ্টিতে। সংসারে ছিলেন তাঁর এক স্বামী পুত্রহারা পিসিমা যাঁর দৃপ্ত ব্যক্তিত্ব ও সংগ্রামশীলতা তারাশঙ্করকে সাহস জুগিয়েছে। এঁদের তিনজনের কথাই উল্লেখ করেছেন তারাশঙ্কর ‘আমার জীবনে যাঁদের প্রভাব রক্তে, মাংসে, মেদে, মজ্জায়, চিন্তনে, মননে ধাতুগত হয়ে আছে তাঁদের মধ্যে……বাবা, মা, পিসীমা।’ ‘ধাত্রীদেবতা’র পিসিমার মধ্যে তারাশঙ্কর আপন পিসিমাকেই প্রতিষ্ঠিত করেছেন। স্কুলের মাস্টারমশাইদের মধ্যে নীলরতনবাবু কিশোর তারাশঙ্করকে সর্বাধিক অনুপ্রাণিত করেন। তাঁর প্রতি কিশোর ছাত্রের সরল বিশ্বাস ও অনুরাগ পরিণত জীবনেও পরম শ্রদ্ধায় স্থিত ছিল। স্কুলের নীলরতনবাবু ‘ধাত্রীদেবতা’য় রামরতনবাবু হয়ে, দেখা দেন। ছাত্র তারাশঙ্কর সাহিত্যিক তারাশঙ্কর হয়ে তাঁর শ্রদ্ধেয় স্মৃতির তর্পণ করেন এই বলে ‘একমুখ দাড়িগোঁফ, বিশালকায় পুরুষ। সদানন্দ মানুষ, দেবতার মত চরিত্র—বহু শতের মধ্যে এমন মানুষ মেলে। নির্মল, নির্ভীক, বিচিত্র। তেমনি কোমল, মধুর।’
তারাশঙ্করের কর্মজীবন ও রাজনীতির জীবন প্রায় একাকার। সেন্ট জেভিয়ার্সে আই.এ. পড়ার সময় থেকে রাজনীতির প্রতি তিনি টান অনুভব করেন এবং পুলিশের সন্দেহ-দৃষ্টির শিকার হন। ১৯২১ সালে অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার জন্য তিনি অন্তরীণ হন। পরে ১৯৩০ সালে গান্ধিজির লবণ সত্যাগ্রহের দিনগুলিতে তাঁকে আবার জেলবন্দি করা হয়। গান্ধি-আরউইন চুক্তির সুবাদে একবছর পরে তিনি মুক্তি পান এবং স্থির করেন তাঁর সাধ্যমতো সাহিত্য-ব্রতে একনিষ্ঠ থেকে তিনি দেশসেবা করবেন। অর্থ উপার্জনের জন্য তারাশঙ্কর একসময় কয়লার ব্যবসা করেছিলেন, কানপুর এবং পাটনাতেও স্বল্পকালের জন্য চাকরি করেছেন, কলকাতায় স্থান থেকে স্থানান্তরে বাসা বদল করেছেন, কখনও ভবানীপুরের প্রিয়নাথ মল্লিক রোডে, কখনও বা বউবাজারের মেস বাড়ি, মীর্জাপুর স্ট্রীটের ‘শান্তিভবন’, আবার কিছুদিন বাগবাজারের আনন্দ চ্যাটার্জী লেন। একসময় মনোহরপুকুর রোডেও তিনি জীবন কাটিয়েছেন। সুতীব্র অভিমানে একবার তিনি নিজের দেশ লাভপুর ছেড়ে চলেও আসেন। ইতিমধ্যে ১৯১৪ সালে লাভপুরের যাদবলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাতনি উমাশশীর সঙ্গে তারাশঙ্করের বিবাহ হয়।
তারাশঙ্করের ছোটো গল্প রচনার ইতিহাস বড় বিচিত্র। ‘আমার সাহিত্য জীবন’-এ নিজেই সে কাহিনি তিনি শুনিয়েছেন। এক নিঃসঙ্গ নির্জন রাতে ‘কালিকলম’ পত্রিকায় প্রেমেন্দ্র মিত্র’র ‘পোনাঘাট পেরিয়ে’ এবং শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়-এর ‘রেশমি বন্দর : জনি ও টনি’ পড়ে মুগ্ধতায় তাঁর মন ভরে যায়। বীরভূমের পটভূমিতেই গল্পদুটির বিস্তার, তাই তারাশঙ্কর তাদের মধ্যে চেনা জগতের গন্ধ পেয়ে যান এবং নিজের মনের মধ্যেই বুনে নেন নিজের গল্পের প্লট। যেন হঠাৎই আলোকস্নানে স্নিগ্ধ হয়ে ওঠে তাঁর কথা এবং কল্পনার ভুবন, সৃষ্টি হয় অসামান্য গল্প ‘রসকলি’। ‘রসকলি’র মায়াময়তা ছন্দময় মহাকাব্যের মতো তাঁর মানসলোকে চিরজাগ্রত থেকেছে, তিনি স্বীকার করেছেন ‘আমি কেমন করে আচম্বিতে পৃথিবীর মায়াপুরীতে এটা ওটা নাড়তে নাড়তে সোনার কাঠি কুড়িয়ে পেলাম, যার স্পর্শে অসাড় মানুষ ঘুম ভেঙে ফুটে ওঠে ফুলের মত।’ ‘রসকলি’ তাঁর প্রথম গল্প হলেও, প্রথম প্রকাশিত গল্প ‘স্রোতের কুটো’, ছাপা হয়েছিল ‘পূর্ণিমা’ পত্রিকায়। গল্পকার হিসাবে তারাশঙ্করের আত্মপ্রকাশের অবলম্বন ছিল ‘কল্লোল’ পত্রিকা, পরে ‘কালিকলম’। রবীন্দ্র-শরতের পর একঝাঁক তরুণ কথাশিল্পী আত্মপ্রকাশের বিহ্বলতায় ‘কল্লোল’ এবং ‘কালিকলম’কেই অবলম্বন করেছিলেন। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র, প্রবোধ সান্যাল ছিলেন এঁদের দলে। অচিরে তারাশঙ্করও যোগ দিলেন এঁদের সঙ্গে। ‘কল্লোল’ ও ‘কালিকলম’-এর লেখকগোষ্ঠীর মধ্যে ক্রোধ ও বিদ্রোহ ছিল বিশেষ বৈশিষ্ট্য। তাঁরা সমাজকে ছিন্ন করে, চূর্ণ করে বিচার করতে চেয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে আশ্রয় খুঁজেছিল একটা বদ্ধ যুগের নিদারুণ যন্ত্রণা। তাঁদের বক্তব্য ছিল স্পষ্ট, সাহস ছিল অবারিত, মন ছিল সংস্কারমুক্ত এবং কলম ছিল প্রায় তরবারির মতো। যুগের সংস্কারকে আঘাত করার স্পর্দ্ধায় তাঁরা ছিলেন প্রায় অনমনীয়। এঁদের সাথে যাত্রা শুরু করলেও তারাশঙ্কর শেষপর্যন্ত সমধর্মী থাকেননি। কেবল ‘বিরুদ্ধবাদ’-এর মধ্যে সাহিত্যের মুক্তি তাঁর কাম্য ছিল না। তিনি শেষ পর্যন্ত বিশ্বাস করে গেছেন সাহিত্যকে সমাজ ও জীবনের সত্য অভিজ্ঞতা ও অভিব্যক্তিকেই ভাষারূপ দিতে হবে, তবে অন্ধ আঘাতে নয়, নান্দনিকতার আবরণে রূঢ় বাস্তবের নির্মমতা উন্মোচন সম্ভব। এদিক দিয়ে বিচার করলে ‘কল্লোল’-এ তাঁর আত্মপ্রকাশ এবং ‘কালিকলম’-এ আশ্রয় মিললেও তিনি এই উভয় পত্রিকার উচ্চারিত আদর্শ ও লক্ষ্য থেকে দূরত্ব রক্ষা করে নিজস্ব রচনার স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্র্য নির্মাণ করতে পেরেছিলেন। তাঁর রচনার প্রেক্ষিত, দেখবার চোখ এবং বলবার রীতি সবই ছিল আলাদা, সেখানে তিনি নিঃসঙ্গ না হলেও সম্পূর্ণ একক। অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্ত ‘কল্লোল যুগ’-এ তারাশঙ্কর সম্পর্কে নিজেই একথা স্বীকার করেছেন ‘আসলে সে (তারাশঙ্কর) বিদ্রোহের নয়, সে স্বীকৃতির, সে স্থৈর্যের। উত্তাল ঊর্মিমালায় নয়, সমতল তটভূমির…তুঙ্গ গিরিশৃঙ্গের।’
তারাশঙ্করের বিপুল রচনাবলীর মধ্যে থেকে বেছে বেছে কিছু প্রতিনিধিস্থানীয় লেখা পড়া সাধারণ পাঠকের পক্ষে সবসময় সম্ভব হয়ে ওঠে না। তারাশঙ্করের নির্বাচিত এই গল্পগুচ্ছ তাই তাঁদের কাজে লাগবে। ‘জলসাঘর’ দুর্বিনীত স্পর্ধা ও অমিত ঐশ্বর্যের ক্ষয় ও নির্বাপণের যে ছবিটি তুলে ধরে তার মধ্যে সামন্ততন্ত্রের অবসানের স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এককালের আভিজাত্য, আত্মাভিমান, সম্পদ ও প্রাণের উচ্ছ্বাস নদীতটে অস্তাচলগামী ম্লান সূর্যের মতো কীভাবে ধীরে ধীরে লুপ্ত হয়ে যায় তারই মর্মস্পর্শী কাহিনি ‘জলসাঘর’। ‘অগ্রদানী’ সেকালের সমাজ বাস্তবতার এক করুণ গ্রন্থি উন্মোচন করে। পরনির্ভরশীল, পরান্নভোজী এই ক্লীব ব্রাহ্মণ সম্প্রদায় নিজেদের লালসা চরিতার্থ করার জন্য সামান্য আত্মমর্যাদাটুকু পর্যন্ত বিসর্জন দেন। অদৃষ্টের কী নির্মম কৌতুক, কেবল লোভের জন্যেই জমিদারের হাতে সঁপে দেওয়া নিজের অকাল প্রয়াত সন্তানের পিণ্ডভক্ষণ করতে হল এমন এক অগ্রদানী ব্রাহ্মণ পূর্ণ চক্রবর্তীকে। ‘কালাপাহাড়’ গল্পের শোক এবং উন্মাদনা আমরা ভুলতে পারি না, যদিও গল্পটির আর একটি বক্তব্য যা রংলালের মধ্যে দৃপ্ত হয়ে উঠেছিল তা এই শোকের তাণ্ডবের মধ্যে চাপা পড়ে গেছে প্রায় পুরোটাই। ‘দেবতার ব্যাধি’ গল্পে এক অধঃপতিত ডাক্তারের ক্ষতবিক্ষত হৃদয়ের মর্মান্তিক আত্মদহন দেখতে পাই। প্রবৃত্তির প্রবলতায় নিয়ন্ত্রণহারাকে এক মানুষের করুণ, অসহায় পরিবর্তিত বাকস্তব্ধ হয়ে যেতে হয়। আর এক পরিণতি দেখি ‘আখড়াই-এর দীঘি’তে—কালী বাগদির জীবনের অন্ধকার ও বিপর্যয়, তার দীর্ঘ হাজতবাস, পুত্রের অকালে শোচনীয় জীবনাবসান এবং দীঘির মৃত্যুকূপে তার জীবন নিঃশেষ হয়ে যাওয়া একটা আর্ত দহনের দাগ রেখে যায় আমাদের কাতর হৃদয়ে, আমরা বিমূঢ় বোধ করি। এই সংকলনে অন্তর্ভুক্ত দুটি অসামান্য গল্প :—’বেদেনী’ এবং ‘ডাইনী’। যে-কোনো বিবেচনায় বিশ্বের শ্রেষ্ঠ গল্পের তালিকায় এ দুটি অসাধারণ গল্প স্থান পেতে পারে। ‘ডাইনী’ গল্পটি রবীন্দ্রনাথের নিজের ভালো লেগেছিল, তারাশঙ্কর ‘আমার সাহিত্য জীবন’-এ তার উল্লেখ করেছেন। ‘বেদেনী’তে রাধিকার প্রেম, প্রবঞ্চনা, প্রাণতৃষ্ণা, ভালোবাসার মানুষের প্রতি তার আবেগ ও আসক্তি, কিষ্টো ও শম্ভুর প্রতি তার আচরণ, দুরন্ত যৌবনের প্রবল প্রবহমানতা, গল্পে এমনই গতিসঞ্চার করে যে রুদ্ধনিঃশ্বাসে তা পড়ে যেতে হয়। দেওয়া-নেওয়া, ভালো লাগা, না-লাগার দ্বান্দ্বিকতায় আকীর্ণ হৃদয় অবশেষে প্রতিহিংসার রক্তপাতে স্তিমিত হয়। ‘ডাইনী’, সমাজের বিচারহীন, বিবেচনাহীন নিষ্ঠুরতার কাছে এক নিরাশ্রয় বৃদ্ধার অসহায় আত্মসমর্পণের বেদনাবিধুর কাহিনি। তারাশঙ্কর চোখে দেখেছিলেন স্বর্ণ ডাইনীকে, অনুভব করেছিলেন তাঁর বেদনা। ‘…শেষ কালটায় আমি বুঝেছিলাম তার বেদনা। মর্মান্তিক বেদনা ছিল তার। নিজেরও তার বিশ্বাস ছিল সে ডাইন।’ সময় পাল্টালেও আজও ডাইনি হত্যার নিষ্ঠুরতা থেকে ভারতবর্ষের গ্রাম সমাজ মুক্ত নয়। তাই তারাশঙ্করের মর্মবিদারী বিবরণ আজও সত্য ও প্রাসঙ্গিক—’ছাতিফাটার মাঠে ঘনধূমাচ্ছন্নতার মত ধূলায় একটা ধূসর আস্তরণে মাটি হইতে আকাশের কোল পর্যন্ত আচ্ছন্ন হইয়া থাকে।….ডালটার নীচে ছাতিফাটার মাঠের খানিকটা ধূলা কালো কাদার মত ঢেলা বাঁধিয়া গিয়াছে। ডাকিনীর কালা রক্ত ঝরিয়া পড়িয়াছে। অতীত কালের মহানাগের বিষের সহিত ডাকিনীর রক্ত মিশিয়া ছাতিফাটার মাঠ আজ আরও ভয়ঙ্কর হইয়া উঠিয়াছে।’ সংকলন গ্রন্থের সবকটি গল্পের বিবরণ বা ব্যাখ্যা দেওয়া নিরর্থক। পাঠক নিজেই গল্পের চেহারা ও চরিত্র অনায়াসে বুঝে নেবেন। কারণ তারাশঙ্কর তাঁর অনাড়ম্বর ভাষা এবং আন্তরিক কথনশৈলীতে গল্পগুলির মধ্যে প্রাণসঞ্চার করেছেন, কোন আরোপিত জটিলতা বা বৌদ্ধিক ব্যাখ্যায় জীবনের সরল সত্যকে ব্যাহত বা অন্যপথগামী করেননি।
পরিচিতি, প্রতিপত্তি, পুরস্কার—একজন সাহিত্যিক যে স্বীকৃতি ও সম্মান আশা করেন, তার সবই তারাশঙ্কর তাঁর জীবদ্দশায় পেয়েছেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে শরৎ স্মৃতি পদক ও জগত্তারিণী পদকে সম্মানিত করে। তিনি রবীন্দ্র পুরস্কার, আকাদেমী পুরস্কার, শিশির কুমার পুরস্কার ও জ্ঞানপীঠ পুরস্কার লাভ করেছেন। তাঁর সারা জীবনের সাহিত্যসাধনার স্বীকৃতিতে তাঁকে ‘পদ্মশ্রী’ ও ‘পদ্মভূষণ’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। তিনি সাহিত্য আকাদেমীর ফেলো নির্বাচিত হন। দেশের নানা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সাম্মানিক ডি.লিট. উপাধি দান করে। ১৯৫২ সালে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল তাঁকে বিধান পরিষদের সদস্য মনোনয়ন করেন, ১৯৬০-এ রাষ্ট্রপতি তাঁকে রাজ্যসভার সদস্য করেন। ভারতের সংস্কৃতি দূত হিসাবে তিনি বিশ্বের নানা দেশও ভ্রমণ করেন। এইভাবে জীবনকালেই তিনি কিংবদন্তীতে পরিণত হন। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের বাংলা ভাষাভাষীদের কাছে তারাশঙ্কর অতি পরিচিত ও প্রিয় নাম। তাঁকে নতুন মোড়কে পাঠকদের কাছে হাজির করার এই শ্রদ্ধেয় প্রয়াস তাই অভিনন্দনযোগ্য।
সুদিন চট্টোপাধ্যায়